You are on page 1of 4

কোয়ারেন্টাইন থেকে কোয়ারেন্টাইনেঃ রুশো, রবিনসন ক্রু সো আর ‘আমি’

ক্যাথরিন মালাবু
১৭৪৩ সালের মে মাসে কোন এক রহস্যজনক রোগে মৃত ক্রু দের বহনকারী একটি জাহাজ কর্ফু থেকে মেসিনাতে
পৌঁছাল।
জাহাজ এবং কার্গোটিকে পুড়িয়ে ফেলা হল, কিন্তু এর পরপরই হাসপাতাল আর শহরের বস্তিগুলোতে একটি
অদ্ভু ত নতু ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে শুরু করল। এবং গ্রীষ্মকালে মহামারী আকারে জন্ম নিলো এক ভয়াবহ
প্লেগ। যেটি চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়ে সিসিলির অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ার আগেই
গায়েব হয়ে গেল। এসময় রুশো প্যারিস হতে ভেনিসে যাচ্ছিলেন কিন্তু মহামারির কারনে জেনোয়াতেই আটকে যান।
কনফেশনস(১৭৮২) গ্রন্থে তিনি তার কোয়ারান্টাইন পর্বের বর্ণনা করেন এভাবে-
মেসিনাতে তখন প্লেগের সময়। ইংরেজ নৌবাহিনী সেখানে নোঙর গেড়েছিল ও আমাকে বহনরত ফেলুকাটি
পরিদর্শনের জন্য এসেছিল। আর এই পরিস্থিতির কারনে এক দীর্ঘ ও কঠিন সমুদ্রযাত্রা শেষে পৌঁছানোর পরে আমরা
একু শ দিনের কোয়ারেন্টাইনে সাব্যস্ত হয়েছিলাম।
যাত্রীদের জাহাজেই অথবা লাজারেতোতে থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছিলো। যদিও আমাদের বলা হয়েছিলো যে
জায়গাটি তখনও বাসযোগ্য হয়নি। সবাই ফেলুকাতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। অসহ্য গরম, জাহাজের সংকীর্ণতা,
ভেতরে চলাফেরার অসাধ্যতা আর জাহাজভর্তি ইঁদুরের কারণে আমাকে সকল ঝুঁকিসমেত লাজারেতোই বেছে
নিতে হল।
ফলস্বরূপ আমাকে প্রায় ফাঁকা একটি বড় দোতলা ভবনে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে আমি কোন জানালা, বিছানা,
টেবিল কিংবা চেয়ার তো খুঁজে পেলামই না, কোন পিঁড়ি কিংবা খড়ের আঁটিও পেলাম না। রাতে ঘুমানোর ছালা
আর আমার দুটো ট্রাঙ্ক এনে দিয়ে বিরাট দরজায় মস্ত তালা ঝু লিয়ে আমাকে ভেতরে আটকানো হল। আর দেয়া হল
চেম্বারে চেম্বারে কিংবা তলায় তলায় হাটার পূর্ণ স্বাধীনতা। যার সবখানেই খুঁজে পেলাম একই নিঃসঙ্গতা আর
রিক্ততা।
যদিও একারণে ফেলুকার বদলে লাজারেতো বাছাই করেছি দেখে আমাকে অনুতপ্ত হতে হয়নি। ঠিক আরেক
রবিনসন ক্রু সোর মতো আমি নিজেকে আসন্ন একু শ দিনের জন্য গুছিয়ে নিতে শুরু করলাম যেমনটা আমার সারা
জীবনই করা উচিত ছিলো।
প্রথমেই ফেলুকা থেকে আমার সাথে আসা ইঁদুরগুলোকে মারার বিনোদন পেলাম। সেগুলোকে সরিয়ে ফেলার
সাথে সাথে কাপর-চোপর বদলে ফেলে আমার বেছে নেয়া চেম্বারটা সাজাতে শুরু করলাম।
আমার ওয়েস্টকোট আর শার্ট গুলো দিয়ে একটা ভালো তোশক বানিয়ে ফেললাম। ন্যাপকিনগুলো একসাথে
সেলাই করে সেগুলো দিয়ে চাদর, চেম্বারে পরার রোব দিয়ে বিছানার চাদর আর জোব্বাটা দিয়ে একটা বালিশ
বানালাম। একটা ট্রাঙ্ক সমান করে শুইয়ে দিয়ে সিট আর অন্যটা দিয়ে টেবিল বানিয়ে নিলাম।
কিছু কাগজ আর একটা দোয়াত-কালি বের করে আমার সাথে থাকা এক ডজন বইগুলোকে একটি লাইব্রেরীর
মতো করে সাজালাম। এক কথায়, আমার সাথে থাকা জিনিসপত্রগুলোকে এতো ভালোভাবে সাজালাম যে রু
ভার্দে লেতের টেনিস কোর্টে যেমন সুসজ্জিত ছিলাম এই ফাঁকা লাজারেতোতেও পর্দা আর জানালা ছাড়া ঠিক প্রায়
তেমন অবস্থা পেলাম।
আমার খানা পরিবেশনও কোন অংশে কম আড়ম্বরপূর্ণ ছিলো না। অস্ত্র সজ্জিত দুজন সৈন্যের প্রহরায় আমার
প্রতি বেলার ভোজ পরিবেশিত হত। সিঁড়িটি ছিলো আমার ভোজন কক্ষ, অবতরনস্থলটি টেবিল আর ধাপগুলো
সিট। আমার খাবার পরিবেশনের সাথে সাথে একটি ছোট ঘন্টা বাজিয়ে জানানো হতো যে আমি খাবার টেবিলে
বসতে পারি।
ভোজ আয়োজনের মধ্যবর্তী সময়ে যখন আমি পড়া অথবা লেখা কিংবা এপার্ট মেন্ট সাজানোর কাজ না করতাম
তখন আমি প্রোটেস্ট্যান্টদের কবরস্থানে হাটতে যেতাম, যেটি আমার জন্যে উঠান হিসেবে কাজ করতো। এই
জায়গা থেকে আমি বন্দরের দিকে মুখ করা একটি লণ্ঠনে উঠতাম আর সেখান থেকে জাহাজগুলোর আসা যাওয়া
দেখতাম। এভাবেই আমার চৌদ্দ দিন কেটে গেলো।

যখন মহামারীর কারণে পুরো মানবজাতিকে ‘ঘরে থাকু ন’ বলা হল, আমার সাথে সাথেই কনফেশনস থেকে এই
অংশটির কথা মনে পড়ে গেল। যখন তার দুর্ভ াগ্যের সঙ্গীরা সবাই একসাথে জাহাজে থাকার সিদ্ধান্ত নিল,
রুশো তখন লাজারেতোতে বন্দি থাকাকেই বেছে নিল। লাজারেতো হলো সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্তদের
চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল। ফেলুকা বা ভূ মধ্যসাগরীয় জাহাজ-ও কোয়ারেন্টাইনের জন্য ব্যবহার করা
হত। অবশ্যই জেনুয়াতে ভ্রমণকারীদেরই শুধু এই দুটো সুযোগ দেয়া হয়েছিল আর রুশোর মনে হয়েছিল জাহাজ
ছেড়ে নিজে নিজে ভবনটিতে থাকাই তার জন্যে শ্রেয়।
এই ঘটনাটিকে অনেকে শুধুমাত্র বাছাই করার ধারনার ভিত্তিতে পড়তে পারেনঃ আবদ্ধ থাকার সময় কোনটা করা
সর্বোত্তম? অন্য মানুষের সাথে কোয়ারেন্টাইনে থাকা? নাকি একা একা কোয়ারেন্টাইনে থাকা? আমাকে স্বীকার
করতে হবে যে আমি নিজেও এরকম একটি বিকল্প ভেবে বেশ কিছু সময় কাটিয়েছি। আমার কাছে যদি এই দুটো
অপশনের মধ্যে থেকে বেছে নিতে বলা হতো, তাহলে আমি কী করতাম? (প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি যে আমি
বর্ত মানে একা একা ক্যালিফোর্নিয়ার আরভিনে প্রায় পুরোপুরি জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছি)
তবে এই রচনাংশে হয়তো আরও অন্তর্নিহিত কিছু আছে – সেটি হচ্ছে কোয়ারেন্টাইন তখনই শুধুমাত্র সহনীয় যখন
আপনি তা থেকে কোয়ারেন্টাইনে থাকেন – যদি আপনি কোয়ারেন্টাইনের ভেতরেই কোয়ারেন্টাইনে থাকেন এবং
বলতে গেলে একই সাথে এই ‘থাকা’ থেকেও।

লাজারেতোটি আসলে এই দ্বিগুণ কোয়ারেন্টাইনের প্রতীক যেটি একই সাথে যূথবদ্ধ অন্তরণ থেকে রুশোর নিজেকে
অন্তরীণ রাখার প্রয়োজনীয়তাকেও বুঝায়। অর্থাৎ এই অন্তরীত অবস্থার মধ্যেই আরেকটি একান্ত দ্বীপ তৈরি করা।
কিছু লোকের সাথে একটি জাহাজে আটকে থাকা নিশ্চয়ই এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার অনুভূ তির জন্ম দেয়, কিন্তু এই
বিচ্ছিন্নতা নির্জ নতা নয় এবং বাস্তবে নির্জ নতাই আবদ্ধ দশাকে সহনীয় করে তোলে।
এমনকি যিনি ইতিমধ্যে একা একাই থাকছেন এটি তার ক্ষেত্রেও সত্য। আমি লক্ষ্য করেছি যে নিজের ভেতর
অবগাহনের অক্ষমতা আসলে আমার জনবিচ্ছিন্নতাকে আরো দুর্বিষহ করে তু লছিল।
তাই সেই একান্ত বিন্দুটি খোঁজা যেখানে আমি স্বয়ং নিজে(দুইটি শব্দে) বিরাজ করতে পারি।
আমি এখানে নির্ভে জালত্বের কথা বলছি না। বলছি কেবলই আত্মার এক চূ ড়ান্ত নগ্নতার কথা যা নিজের ঘরে বসত
বানাতে দেয়, বলছি মনস্তাত্ত্বিক সেই স্থানটিকে চিহ্নিত করে ঘরটিকে বাসযোগ্য করে তোলার কথা যাতে কিছু একটা
করা সম্ভবপর হয়, আমার ক্ষেত্রে যেটি হল লেখা।

আমি খেয়াল করেছি যে লেখা তখনই সম্ভব হয়েছে যখন আমি এরকম বন্দিত্বের ভেতরে বন্দিত্বে পৌঁছেছি, স্থানের
অভ্যন্তরে আরেকটি স্থান যেখানে আর কারো প্রবেশ নেই এবং যেটি একই সাথে অন্যদের সাথে আমার
যোগাযোগের একটি পূর্বশর্ত ও বটে। যখন আমি লেখার ভেতরে ডু বে যেতে পারতাম, তখন যেনো স্কাইপের
কথাবার্তাও অন্যরকম হয়ে উঠতো। সেগুলো প্রচ্ছন্ন একলাপের বদলে সংলাপ হয়ে উঠতো। লেখা সম্ভব হতো
যখন নির্জ নতা আমাকে জনবিচ্ছিন্নতা থেকে সুরক্ষিত রাখতো। অন্যদের কাছ থেকে কেউ বিচ্ছিন্ন হবার পরেও
তার সত্তার সাথে লেগে থাকা সকল রাখ-ঢাক, কাপর-চোপড়, পর্দা, মুখোশ আর অর্থহীন বাতচিত খুলে ফেলতে
হবে। সামাজিক দূরত্ব দূরত্বে থেকে যাওয়া সমাজের অবশিষ্টাংশ খুলে ফেলতে কখনোই যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলো না।
স্থানিক আশ্রয়কে এক চরম রবিনসন ক্রু শো অভিজ্ঞতা হতে হয়, এমন এক অভিজ্ঞতা যা মানুষকে শুন্য থেকে
ঘর বানাতে শেখায়। নতু নভাবে শুরু করতে কিংবা স্মরণ রাখতে শেখায়।
আমি ভাবি যে ফু কো তার জীবন সায়াহ্নে এসে এই একই কারণে আত্মসত্তার ন্যায়শাস্ত্র - আত্মসত্তার যত্ন,
আত্মসত্তার প্রযুক্তি, আত্মসত্তার প্রশাসনের ভাবনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন কি-না। এইডস ভেতরে
ভেতরে যেই সামাজিক বিচ্ছিন্নতার হুমকি তাকে জানান দিয়ে যাচ্ছিলো তার অভ্যন্তরেই কি নিজের জন্য একটি
জায়গা তৈরি করার তাগিদ ছিল এটি? সম্ভবত ফু কো তার নিজের দ্বীপটি খুঁজছিলেন, তার পরম(পর-ওম) জমি
যেখানে মৃত্যুর আগে তিনি খুঁজে পেতেন তার বলার ও লেখার সাহস।
যারা উনার শেষ সেমিনারগুলোতে রাজনীতি থেকে চূ ড়ান্ত নাস্তিমূলক অহংবাদী অপগমন দেখেছিলেন তাদের কাছে
বিষয়টি পুরোপুরি অলক্ষ্যে থেকে গেছে।
আমরা জানি যে কার্ল মার্ক্স রুশোর মতো আঠারশো শতকের রবিনসনেডসদের নিয়ে ঠাট্টা করেছিলেন। মার্ক্স
বলেছিলেন যে প্রকৃ তির কোন এক অবস্থায় বিচ্ছিন্ন মানুষদের অবশেষে সাক্ষাৎ ঘটে এবং তারা সেখানে একটি
গোষ্ঠী তৈরি করে এভাবে কোন উপায়েই সমাজের উৎপত্তি হতে পারে না। নির্জ নতা সমাজের উৎস হতে
পারে না।

এটা হয়তো সত্যি কিন্তু আমি মনে করি যে রাজনীতির অর্থ বুঝতে গেলে কিভাবে একজনের ভেতরে সমাজকে
খুঁজতে হয় এটা জানা প্রয়োজন। যারা কোভিড-১৯ মহামারীর ফলে উদ্ভু ত সংকটকে বৈশ্বিক রাজনীতি, পুঁজিবাদ,
জরুরি অবস্থা, পরিবেশগত সংকট, চায়না-যুক্তরাষ্ট্র- রাশিয়ার কৌশলগত সম্পর্ক ইত্যাদির আলোকে বিশ্লেষণ
করতে পারছেন তাদেরকে আমি সমাদর করি। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে এই মুহূর্তে আমি উল্টো ‘পৃথগাত্মা’ হওয়ার
চেষ্টা করছি। এটি আবার কোন অহংবাদ থেকে নয় কারণ আমি বরং মনে করি কখনো কখনো প্রত্যাহার, স্থগন,
সামাজিকতাকে বন্ধনীকৃ ত করা ভিন্নতায় পৌঁছানোর একমাত্র মাধ্যম, দুনিয়ার সকল বিছিন্ন মানুষের সাথে একাত্ম
হওয়ার একটি উপায়। এ কারণেই আমি একাকীত্বের মাঝে যথাসম্ভব আরও একাকী হওয়ার প্রচেষ্টায় আছি। এ
কারণেই আমিও লাজারেতোটি বেছে নিতাম।
২৩ মার্চ , ২০২০

ক্যাথরিন মালাবু কিংস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ইউরোপীয় দর্শন গবেষণা কেন্দ্রের দর্শন বিভাগের এবং আরভিনের
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউরোপীয় ভাষা ও সাহিত্য এবং তু লনামূলক সাহিত্য বিষয়ের একজন অধ্যাপক।
তিনি Ontology of the Accident: An Essay on Destructive Plasticity (2012), Before Tomorrow:
Epigenesis and Rationality (2016) এবং সম্প্রতি প্রকাশিত Morphing Intelligence: From IQ
Measurement to Artificial Brains (2019) গ্রন্থসমূহের রচয়িতা।

[১] Jean Jacques Rousseau, The Confessions, trans. pub., 2 vols. (London, 1903), 1:273-74.

You might also like