You are on page 1of 14

লেনিনীয় সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বঃ একটি পর্যালোচনা

সাম্রাজ্যবাদ এর ধারণাকে কমরেড লেনিন বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্নের সাপেক্ষে বিস্তৃ ত পরিধিতে আলোচনা করে
গিয়েছেন। ১৯১৫ সাল থেকে ১৯২৩ অবধি বিভিন্ন লেখার মধ্যেই লেনিন সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি
নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং তার সাপেক্ষে আন্তর্জাতিক কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের কর্মসূচী নির্ধারণ এর দিকে
এগিয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদকে একটি সুনির্দি ষ্ট মার্ক্সীয় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বর্গ (political economic
category) হিসেবে তত্ত্বায়িত ও প্রয়োগ করা কম্যুনিষ্ট আন্দোলনে লেনিনের অবদান গুলির মধ্যে একেবারেই
প্রথমদিকে থাকবে। অন্য আরোও বিবিধ বিষয়ের মতনই সাম্রাজ্যবাদ নিয়েও লেনিনের এই গভীরতর চর্চা
কোনো শৌখিন তত্ত্বতালাসের ধারায় গড়ে ওঠেনি। সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে লেনিনের ভাবনা ও অবদানকে ঠিক ভাবে
চর্চা গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক
প্রেক্ষাপটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় ততকালীন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন তথা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অভ্যন্তরে
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এর কর্ত ব্য প্রশ্নে তীব্র রাজনৈতিক মতাদর্শগত সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। লেনিনের
সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব সেই সংগ্রামের বিপ্লবী ফসল হিসেবেই উঠে আসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এর ব্যাপ্তি ও গভীরতা
দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ও তার অন্তর্ভু ক্ত পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টি গুলোর সামনে
এক নতু ন পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল। এতবদকাল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এর মূলধারার ভাবনা ছিল
আন্তর্জাতিক ভাবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের শ্রমিক শ্রেনীর সংগ্রামের মধ্যে ঐক্য গড়ে
তোলা। বিশ্বযুদ্ধের সামনে পড়ে সেই ভাবনা জোরালো ধাক্কা খায়। অন্য দেশের শ্রমিক আন্দোলনের সাথে ঐক্য
তো দূর অস্ত, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অন্তর্ভু ক্ত প্রায় সমস্ত সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টি গুলো এই সময়ে নিজের
নিজের দেশের শ্রমিক শ্রেনীর অধিকারের সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক লড়াইকে বাস্তবত ফাইলে পুরে
আলমারিতে তু লে রাখে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অন্তর্ভু ক্ত প্রায় সমস্ত সোশাল ডেমোক্রেটিক দলই নিজের
দেশের বুর্জোয়া সরকারের যুদ্ধবাজ নীতির সমর্থনে রাস্তায় নামেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক
চরিত্রকে তাত্ত্বিক ভাবে বুঝতে পারার অক্ষমতা তাঁদেরকে এই আগ্রাসী জাতীয়তাবাদী অবস্থানে নিয়ে যায়।
তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সর্বজনস্বীকৃ ত তাত্ত্বিক নেতা কার্ল কাউটস্কি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও
তৎকালীন পুঁজিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১৯১৪ সালে ‘অতি সাম্রাজ্যবাদ’ এর তত্ত্ব
এনে হাজির করেন। কাউটস্কির এই তত্ত্ব বকলমে সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টীদের জাতীয় যুদ্ধবাজ অবস্থানকে
মদত যোগায়। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে জোরালো হয়ে ওঠা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের এই সংশোষনবাদী
ধারার সাথে কমরেড লেনিন এর নেতৃ ত্বে বলশেভিক পার্টি তাত্ত্বিক সংগ্রাম চালিয়েছিলো। আজকে দাঁড়িয়ে
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে বোঝা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বিরুদ্ধে
এই তাত্ত্বিক সংগ্রাম এর রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই তাত্ত্বিক সংগ্রাম ছাড়া সোভিয়েত
রাশিয়াতে নভেম্বর বিপ্লবের সফল সম্পাদন এক কথায় অসম্ভব ছিল। অসম্ভব ছিল বিপ্লবী মার্ক্সবাদের ধারায়
আন্তর্জাতিক কম্যুনিষ্ট আন্দোলন এর পুনর্গঠন। এই তাত্ত্বিক সংগ্রাম ছাড়া তৃ তীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কম্যুনিষ্ট
আন্দোলনের ছড়িয়ে পড়া সম্ভবপর ছিল না। আর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বিরুদ্ধে বলশেভিক পার্টি র এই
তাত্ত্বিক সংগ্রাম এর প্রধান হাতিয়ারই ছিল লেনিনীয় সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব। সাম্রাজ্যবাদকে একটি সুনির্দি ষ্ট মার্ক্সীয়
রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বর্গ হিসেবে তত্ত্বায়িত ও প্রয়োগ করা ছাড়া এই তাত্ত্বিক তথা রাজনৈতিক সংগ্রাম
আদৌ সফল ভাবে করাই যেত না।

আজ প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ১০০ বছর পেরিয়ে আন্তর্জাতিক কম্যুনিষ্ট আন্দোলন এর অবস্থা বেশ
ছন্নছাড়া, অপুষ্টিতে ভু গছে পুঁজিবাদ-উত্তর দুনিয়া গড়ার জন্য বিশ্বজোড়া সংগঠিত লড়াই। আগ্রাসী
জাতীয়তাবাদ ও দক্ষিণপন্থার উত্থান নতু ন করে কড়া নাড়ছে বিশ্বজুড়ে। এরকম সময়ে এসে দাঁড়িয়ে সামনে
দিকে এগিয়ে চলতে গেলে বর্ত মান বিশ্বব্যবস্থার ভিতরে থাকা বৈপ্লবিক উপাদানকে সঠিক ভাবে চিনতে পারা
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত গত দুই দশকে নয়া উদারবাদী বিশ্বায়নের গতিপথ ও তার সংকট ব্যবস্থা বদলের
বৈপ্লবিক উপাদানকে নানা ভাবে নতু ন চেহারায় হাজির করছে প্রতিদিন। আন্তর্জাতিক ভূ রাজনৈতিক সম্পর্ক
গুলির দ্রুত বদল ঠান্ডা যুদ্ধ পরবর্তী এক মেরু বিশ্বের সমীকরণে খানিক হলেও বদল আনছে। গত দেড় দু
দশকে তৃ তীয় বিশ্বের দেশগুলির অভ্যন্তরে শ্রেনী বিন্যাস এর ধরণ ও শ্রেনী সংগ্রামের সমীকরণ নতু ন ধরণের
চেহারা নিচ্ছে। লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ এর তত্ত্ব এর গভীর অধ্যয়ন আর কাটাছেড়া করা ছাড়া এই সমস্ত
উপাদানকে সঠিক ভাবে বোঝা ও খোঁজার কাজে একচু লও এগোনো সম্ভব নয়। এখানেই আজকের সময়ে
লেনিনের সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা।

বর্ত মান সময়ে লেনিনের সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বকে ঠিকভাবে ফিরে দেখতে গেলে দুটি স্তরে চর্চা পর্যালোচনা করা
প্রয়োজন। এর মধ্যে প্রথমটি হল ঐতিহাসিকতার স্তর। তার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নির্দি ষ্ট প্রেক্ষিতে রুশবিপ্লব
তথা বিশ্ববিপ্লবের বিশেষতায় লেনিনের তত্ত্বের ভূ মিকা নিয়ে চর্চা করা দরকার। একই সাথে দরকার থাকবে রুশ
বিপ্লব পরবর্তী তিন দশকে পদানত তৃ তীয় বিশ্বের শ্রেনী সংগ্রামের গতিপথে এই তত্ত্ব এর ভূ মিকাকে ফিরে দেখা।
আর দ্বিতীয় স্তরের পর্যালোচনার অভিমুখ হল বর্ত মান সময়ের স্তর। তার জন্য সাধারণ ভাবে সাম্রাজ্যবাদের
যুগে তথা আজকের সময়ে এই তত্ত্বের সার্বজনীনতার প্রশ্নটি কিভাবে প্রাসংগিক থাকছে তা খোঁজা। আমাদের
লেখায় এই দুটি স্তরকে মাথায় রেখেই লেনিনীয় সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব এর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক গুলিকে ফিরে
দেখার চেষ্টা করা হবে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও মার্ক্সবাদী মহলে সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন ধারণা ঃ


আমরা শুরুতে বলেছিলাম সাম্রাজ্যবাদকে একটি সুনির্দি ষ্ট মার্ক্সীয় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বর্গ হিসেবে
তত্ত্বায়িত ও প্রয়োগ করা কম্যুনিষ্ট আন্দোলনে লেনিনের অন্যতম অবদান। তবে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ নিয়ে বা বলা
ভালো বিশ্ব অর্থনীতির সাপেক্ষে উন্নত পুঁজিবাদী বিশ্বের অর্থনীতি, তার সংকট ও গতিপ্রকৃ তির নিয়ে গভীরে
চর্চা করার জন্য সেইসময়কার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা বহু ব্যক্তিই নিজেকে
নিয়োজিত করেছিলেন। লেনিন ছাড়াও রুডলফ হিলফার্ডিং, কার্ল কাউটস্কি, রোজা লুক্সেমবুর্গ, নিকোলাই
বুখারিন ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মার্ক্সের সময়ের পর বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে এত গভীর বিতর্ক সম্ভবত
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে বিরল। সেই বিতর্কে র প্রেক্ষিত থেকে দাঁড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব নিয়ে
আলোচনা করলে আমরা লেনিনের সুনির্দি ষ্ট অবদান এর দিকটিকে ধরতে পারব।

পুঁজির সঞ্চয়নের ধারণা মার্ক্সীয় অর্থনীতির একটি মৌলিক ধারণা। বর্ধিত পুনরুতপাদনের প্রক্রিয়াতে উদ্বৃত্ত
মূল্যের পুঁজিতে রূপান্তরিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে পুঁজির সঞ্চয়ন অবিরত ভাবে ঘটতে থাকে। পুঁজির সঞ্চয়নের
সাধারণ নিয়ম মেনেই পুঁজির ঘনীভবন ( concentration) ও কেন্দ্রীভবন (centralization) এর প্রবণতাও
জোরালো হয় - সে আলোচনা মার্ক্স ক্যাপিটালের প্রথম খন্ডেই করেছিলেন। একই সাথে তিনি অর্থ(money)
ঋণ ব্যবস্থা(credit) ও ব্যাঙ্ক পুঁজি(bank capital) নিয়েও তৃ তীয় খন্ডে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা
করেছিলেন। একই সাথে তৃ তীয় খন্ডে মার্ক্স দেখান ঘনিভবন ও কেন্দ্রীভবনের হাত ধরে পুঁজি যেভাবে উচ্চ
আঙ্গিক গঠন প্রাপ্ত হচ্ছে তাতে মুনাফার হারের নিম্নমুখী প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। মার্ক্সের পরবর্তী সময়ে এই
ঘনীভবন ও কেন্দ্রীভবনের প্রবণতার হাত ধরে শিল্প পুঁজি এবং ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার চরিত্রের যে গভীর বদল আসছে
তা নিয়ে তৎকালীন সময়ে হিলফার্ডিং, কাউটস্কি সহ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ গভীরে চর্চা করেন। ব্যাঙ্ক পুঁজি
ও শিল্প পুঁজির আন্তঃ সংযোগ কিভাবে লগ্নি পুঁজির জন্ম দিচ্ছে তার প্রাথমিক মার্ক্সীয় ধারনাও হিলফার্ডীং
নির্মাণ করেন।
১ দ্রষ্টব্য Finance Capital By Rudlofh Hilferding,1910,Finance Capital and Crisises by Karl Kautsky 1911
লগ্নি পুঁজি মুনাফার হার
এর সমতার প্রবনতাকে আটকে দিয়ে কিভাবে দাম নির্ধারণকে প্রভাবিত করে তা নিয়েও হিলফার্ডীং গভীরে
চর্চা করেন। উচ্চ আঙ্গিক গঠনযুক্ত পুঁজির মুনাফার সংকটকে কাটিয়ে তোলার জন্য লগ্নি পুঁজির কার্যপ্রণালী
ও নীতি কিভাবে অনুন্নত দেশে পুজির রফতানি ঘটাচ্ছে তার ব্যাপারেও হিলফার্ডীং ও কাউটস্কি প্রাথমিক
ধারণা তৈরি করেন। তারা বলেন পুরানো যুগের উপনিবেশবাদে যেভাবে পণ্যর রফতানি হত তার পরিবর্তে
অনুন্নত দেশে লগ্নি পুঁজির রফতানি মার্ক্স পরবর্তী সময়ে পুঁজিবাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্কে র মুখ্য চরিত্র হয়ে
উঠছে। হিলফার্ডিং এর কাজের সূত্র ধরে কাউটস্কি উন্নত পুঁজিবাদী দেশে লগ্নি পুঁজির জন্ম, অনুন্নত কৃ ষিপ্রধাণ
দেশে পুঁজির রফতানি, বিশ্বঅর্থনীতি নিয়ন্ত্রনের জন্য শুরু হওয়া বিশ্বযুদ্ধ – সহ বিবিধ ঘটনাবলীকে পুঁজিবাদের
সাম্রাজ্যবাদী বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিতও করেন। কিন্তু কাউটস্কি এই সমস্ত বৈশিষ্ট সহ সাম্রাজ্যবাদকে পুঁজিবাদের
একটি বিশেষ সাময়িক দশা ( a temporary phase) হিসেবে তত্ত্বায়িত করেন। কাউটস্কির ভাষায়
“Imperialism is a product of highly developed industrial capitalism. It consists in the striving
of every industrial capitalist nation to bring under its control or to annex all large areas
of agrarian [Kautsky’s italics] territory, irrespective of what nations inhabit it.” একই সাথে
কাউটস্কি বলেন সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ আসলে বিশেষ পর্যায়কালে উন্নত রাষ্ট্র গুলির নীতি (policy)
হিসেবে হাজির হয়েছে। এই পর্যায় অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক সংঘায়নের মধ্যে দিয়ে শান্তিপুর্ণ অতি
সাম্রাজ্যবাদ এর নতু ন দশায় পুঁজিবাদ প্রবেশ করবে। যেখানে পুঁজির ঘনীভনন ও কেন্দ্রীভবনের প্রবণতার
অন্তিম প্রকাশ হিসেবে সমগ্র বিশ্বজুড়ে এমন কার্টে ল / সঙ্ঘ তৈরি হবে যা বিভিন্ন দেশের পুঁজি ও রাষ্ট্র এর
প্রতিদ্বন্দীতাকে আত্মসাৎ করে ফেলবে। কাউটস্কির ব্যাখ্যায় সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধ হল শান্তিপুর্ণ ও ঘণীভূ ত
পুঁজিবাদের উত্তরণের পথে একটি উতক্রান্তিকালীন পর্যায়। বিশ্বযুদ্ধেরর সময়ে পুঁজিবাদের মধ্যে যে রাজনৈতিক
ও অর্থনৈতিক গভীর সংকট সৃষ্টি হয়েছিল তাকে কাউটস্কি উপেক্ষা করেন। তার জন্য সেই সংকটএর মধ্যে
নিহিত থাকা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের উতক্রান্তিকালীন তাতপর্য্য খুঁজে পেতেও কাউটস্কি ব্যর্থ হন।
২) Imperialism and

the War by Karl Kautsky 1914


। একই সাথে কাউটস্কি পুঁজি রফতানির বিষয়টিকেও সামগ্রিকতায় ধরতে পারেননি। তার
কাছে পুঁজি রফতানির মুল বিষয় ছিল অনুন্নত দেশের কৃ ষি অর্থনীতির মধ্যে পুঁজির রফতানি। সাম্রাজ্যবাদের
যুগে পুঁজি রফতানি মোটেই শুধুমাত্র উন্নত দেশ থেকে অনুন্নত দেশ এর মধ্যে হয় না। বরং পুঁজির রফতানি
একটি সর্ব্বব্যাপী ঘটনা হয়ে উঠেছে যা উন্নত বিশ্বে দেশগুলির নিজেদের মধ্যেও ঘটে চলেছে । সাম্রাজ্যবাদের
যুগে পুঁজির সঞ্চয়ন এর প্রক্রিয়া গুনগত ভাবে এই নতু ন এক ধরণের শৃংখলের জন্ম দেয় যা কাউটস্কির নজর
এড়িয়ে যায়। সব মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদ কাউটস্কির কাছে কোন বিশেষ নতু ন যুগ হিসেবে উপস্থিত হয়নি। ফলে
নতু ন যুগে নতু ন রাজনীতির প্রশ্নটিও কাউটস্কির কাছে অধরা থেকে যায়। রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে
কাউটস্কি ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ অবধি সোশাল ডেমোক্রাট পার্টি র মধ্যে থেকে গিয়ে কোন জোরালো যুদ্ধ
বিরোধিতার অবস্থান নেননি। ১৯১৭ সালে ক্রমশ যখন যুদ্ধের ভয়াবহতা ও গতিপথ দীর্ঘায়িত হচ্ছিল তখন
তিনি সোশাল ডেমোক্রাট পার্টী ছেড়ে সমমনস্কদের সাথে নতু ন দল তৈরি করেন।

অন্যদিকে সেই একইসময় জার্মান পার্টি র জাতীয় যুদ্ধবাজ অবস্থানের উলটোদিকে দাঁড়িয়ে বিপ্লবী মার্ক্সবাদের
ধারাবাহিকতায় জোরালো ভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন রোজা লুক্সেমবুর্গ। কিন্তু তৎকালীন বিশ্ব অর্থনীতিকে
ব্যাখা করতে গিয়ে তিনি পুঁজি সঞ্চয়নের জন্য আবশ্যিক বর্ধিত পুনরুতপাদনের সমস্যা (extended
reproduction) ও তার মধ্যে থাকা মূল্য উসুল ( Value realization) জনিত সংকটের প্রবণতার উপর
মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেন। উপরুক্ত তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে দাঁড়িয়ে ১৯১৩ সালে রোজা “পুঁজির
সঞ্চয়ন’ (Accumulation Of Capital) বইটি লেখেন। সেই বইতে রোজা দেখান অপুঁজিবাদী অনুন্নত দেশের
পণ্যের বাজার দখলের এর মাধ্যমে বর্ধিত পুনরুৎপাদনের সংকট মেটানোর জন্য উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির
মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে। এবং এই প্রতিযোগিতার পরিণতিতে উন্নত শক্তিগুলির মধ্যে যুদ্ধকে সেই
সময়পর্বের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে রোজা চিহ্নিত করেন। সেই ধারাবাহিকতায়
সাম্রাজ্যবাদ এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি বলেন “Imperialism is the political expression of the
accumulation of capital in

its competitive struggle for what remains still open of the non-capitalist environment.”
Accumulation of Capital by Rosa Luxemburg pg 426
পুঁজিবাদের সংকট নিয়ে রোজার পর্যবেক্ষণ ছিল যে অনুন্নত কৃ ষিপ্রধান
দেশের বাজার বলপূর্বক অধিগ্রহণের মারফত মূল্য উসুল এর সংকটকে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ দীর্ঘকাল
সামাল দিতে পারবে না। এবং এর ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নিজের সংকটের পরিণতিতে ভেংগে পড়বে যা
বৈপ্লবিক সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের দরজা খুলে দেবে। রোজার ধারণার মধ্যে বৈপ্লবিক উপাদান থাকলেও
সাম্রাজ্যবাদ ও বিশ্বযুদ্ধের যথার্থ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক স্বরূপ রোজার লেখায় উঠে আসেনি। এমনকি লগ্নি
পুঁজির ধারণা, পুঁজি রফতানির রাজনৈতিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব – সাম্রাজ্যবাদের এই সমস্ত মৌলিক প্রশ্নগুলিও
রোজা গুরুত্ব সহকারে বুঝেই উঠতে পারেননি, এমনকি উপরুক্ত লেখায় তার কোন উল্লেখও করেননি। বাস্তবত
মার্ক্সের পরবর্তী সময়কার বিশ্ব রাজনৈতিক অর্থনীতির গুনগত বদলকে রোজা অনুধাবন করতে পারেননি। সেই
কারণে বাস্তব রাজনীতির ক্ষেত্রে বিপ্লবী অবস্থান নিলেও সাম্রাজ্যবাদ এর বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে বিশ্ববিপ্লবের
সম্ভাবনার বিভিন্ন উপাদান যেমন অবদমিত জাতিসত্ত্বার লড়াই এর তাতপর্য্য সংক্রান্ত ধারণা রোজার ভাবনায়
একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। এ বিষয়ে পরে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব।

সাম্রাজ্যবাদী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাপেক্ষে জার্মান পার্টি সহ দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অধিকাংশ পার্টি যে জাতীয়
যুদ্ধবাজ অবস্থান নিয়েছিল লেনিনের নেতৃ ত্বে রাশিয়ার বলশেভিক পার্টি তার সরাসরি সমালোচনা করে এবং
দেশে শ্রমিক শ্রেনীর নেতৃ ত্বে বিপ্লবী গৃহযুদ্ধের ডাক দেয়। ১৯১৫ সালে রুশ পার্টি র অন্যতম তাত্ত্বিক নিকোলাই
বুখারিন ‘সাম্রাজ্যবাদ ও বিশ্বঅর্থনীতি’ নামক একটি বই লেখেন। এই বইটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাম্রাজ্যবাদী স্বরূপ
হাজির করার সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরে একধরণের
প্রাথমিক ব্যাখ্যা হাজির করে। লগ্নি পুঁজির চরিত্র,পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অধীনে একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির বিকাশ
নিয়ে এই বইতে বুখারিন বিস্তারিত আলোচনা করেন, যা থেকে সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে বহু অন্তর্দৃ ষ্টি উঠে আসে। কিন্তু
সামগ্রিকতায় সাম্রাজ্যবাদকে একটি নতু ন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পর্যায় হিসেবে দেখা বা সাম্রাজ্যবাদকে একটি
সুনির্দি ষ্ট মার্ক্সীয় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বর্গ হিসেবে নির্মাণ করার কাজ বুখারিনের লেখাটি করতে পারেনি।

‘সাম্রাজ্যবাদঃ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ – লেনিনের তত্ত্বতে একচেটিয়ার ধারণা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর সময়পর্বে ১৯১৪ থেকে ১৯১৫ সালে প্রায় ৯ মাস সময় ধরে লেনিন অত্যন্ত গভীর
ভাবে হেগেল এর লেখা অধ্যয়ন করেন। তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক তাত্ত্বিকদের মধ্যে এই উদাহরণ একভাবে
বিরল ছিল। হেগেলিয় দ্বন্দতত্ত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট মুন্সিয়ানা ছাড়া মার্ক্সসীয় রাজনৈতিক অর্থনীতিকে গভীরে
অনুধাবন করা যায় না এবং ৫০ বছর বাদে এসে মার্ক্সবাদিরা কেউ সেই কারণে মার্ক্সকে বোঝেন না
৪) lenin collected

works vol38 page180


– এই ছিল ১৯১৫ সালে হেগেল পড়ার পর লেনিনের উপলব্ধি। দুটি পরস্পর বিপরীত মুখী
প্রবণতা সম্পন্ন প্রক্রিয়া একই স্তর থেকে কিভাবে নতু ন স্তর এর জন্ম দেয় তাকে বোঝার ব্যাপারে হেগেলীয়
দ্বন্দতত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। being থেকে becoming এর প্রক্রিয়ায় nothing এর তাতপর্য্য হেগেলে
বারবার উঠে আসে। হেগেলিয় দ্বন্দতত্ত্বের এই শিক্ষাকে লেনিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কাজে লাগালেন
তৎকালীন সময়ে পুঁজিবাদের একচেটিয়া ও প্রতিযোগিতার প্রবণতার আন্তঃসম্পর্ক কে বোঝার জন্য।

প্রতিযোগিতা ও একচেটিয়ার একধরণের সহাবস্থান পুঁজিবাদের প্রথম যুগেও ছিল। বিভিন্ন লেখায় তার চরিত্র
নিয়ে মার্ক্স উল্লেখও করেছেন।
৫) see Poverty of philosophy,
কিন্তু পুঁজির সঞ্চয়নের সাথে সাথে ঘনীভবন ও
কেন্দ্রীভবনের বিকাশ এই সহাবস্থানের চরিত্রকে গুনগত ভাবে বদলে দিয়েছে। হেগেলিয় দ্বন্দতত্ত্বের মনোযোগী
ছাত্র লেনিন এই গুনগত বদলের ফলে নতু ন এর জন্মকে গভীরে অনুধাবণ করেন। প্রতিযোগিতার উপর
একচেটিয়ার স্থায়ী আধিপত্য তৈরি হচ্ছে যার ফলে পুঁজিবাদ একটি নতু ন স্তরে উপনীত হয়েছে। এই ছিল
সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে লেনিনের ভাবনার প্রধান নির্যাস। একচেটিয়া ও প্রতিযোগিতার এই নতু ন আন্তঃসম্পর্ক
অর্থনীতি ও রাজনীতিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্তরে কিভাবে বদলাচ্ছে তার গভীর পর্যবেক্ষণ ও
পর্যালোচনা করাই ছিল সাম্রাজ্যবাদকে দেখার লেনিনীয় পদ্ধতি। লেনিন তার সাম্রাজ্যবাদ সংক্রান্ত লেখায়
‘একচেটিয়া’ অবধারণা ( concept) টির গুণগত বৈশিষ্ট্য( Qualifying Characteristics) নির্মাণ করার মধ্যে
দিয়ে তাকে অনেক বিস্তৃ ত পরিসরে সংজ্ঞায়িত করেন। এই তাত্ত্বিক পদ্ধতিই তার সাম্রাজ্যবাদ এর তত্ত্বকে
কাউটস্কি হিলফার্ডীং তো বটেই এমনকি বুখারিন এর থেকেও আলাদা করে তোলে। সাম্রাজ্যবাদকে একটি
সাময়িক দশা বা নীতি হিসেবে কেন দ্যাখা উচিত তার সমর্থনে Imperialism and The War লেখায় কাউটস্কি
মার্ক্স কে উদ্ধৃ ত করে বলেন “We can say of imperialism what Marx said of capitalism: Monopoly
creates competition and competition creates monopoly.The violent competition of great
concerns led to the formation of trusts and the destruction of small concerns. Just so there
may develop in the present war a combination of the stronger nations which will put an end
to the competitive building of armaments.” এই উক্তি থেকে সহজেই দেখা যায় কাউটস্কি ভেবেছিলেন
প্রতিযোগিতা ও একচেটিয়ার সরল দ্বন্দের নিয়ম মেনে পুঁজি কিছুদিনের মধ্যেই সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়ার
আগ্রাসী নীতি থেকে অতি সাম্রাজ্যবাদের শান্তিপূর্ণ নীতিতে প্রবেশ করবে। একচেটিয়া ও প্রতিযোগিতার
সম্পর্ক কে হেগেলীয় দন্দ্ব তত্ত্বর আলোকে দেখতে কাউটস্কি ব্যর্থ হন। একচেটিয়া ও প্রতিযোগিতার সম্পর্কে র
ক্ষেত্রে মার্ক্সের সময়ের পরে পুঁজিবাদে যে নতু ন গুণ সংযোজন হয়েছে সেটা কাউটস্কি ধরতেই পারেননি।
বাস্তবত কাউটস্কি অন্তর্বস্তুতে মার্ক্সের সময়েই আটকে পড়েন। ফলত তিনি নতু ন তাত্ত্বিক বিচারের উপর দাঁড়িয়ে
বিশ্ব অর্থনীতি এবং সাম্রাজ্যবাদকে দেখতেই পারেননি। এখানেই লেনিনের একচেটিয়া সংক্রান্ত ধারণার
অনন্যতা। ১৯১৬ সালে রচিত সাম্রাজ্যবাদ ঃ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় বইয়ের প্রথম অধ্যয়েই লেনিন পন্য
উৎপাদনের শিল্প ক্ষেত্রে একচেটিয়া ও প্রতিযোগিতার নতু ন সম্পর্কে র সাপেক্ষে ‘একচেটিয়া” এর ধারনাকে
বিস্তারিত ভাবে উদাহরণ সহযোগে লেখেন। সেখানে তিনি দেখানে কিভাবে পণ্য উতপাদন এর ক্ষেত্রে ঘনিভবণ
ও কেন্দ্রীভবনের ফলে কিভাবে কার্টে ল এবং ট্রাস্ট তৈরি হওয়ার মধ্যে দিয়ে একচেটিয়া প্রাধান্যকারী জায়গায়
চলে আসছে। ঘনীভবন ও পুঞ্জিভবনের মধ্যে দিয়ে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা একচেটিয়া বিবর্ত নের এগোচ্ছে এবং তা শিল্প
পুঁজির সাথে আন্তঃসম্পর্কে র সাপেক্ষে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে নতু ন ভূ মিকায় হাজির হচ্ছে। এই বিষয়টি তু লে
ধরাই ছিল লেনিনের দ্বিতীয় অধ্যয়ের বিষয়বস্তু। তৃ তীয় পরিচ্ছদে এসে লগ্নি পুঁজির সংজ্ঞা নির্ধারিত করার সময়
লেনিন একচেটিয়ায় ধারণার উপর দাঁড়িয়ে হিলফার্ডীং এর প্রদত্ত সংজ্ঞার সীমাবদ্ধাতাকে চিহ্নিত
করেন। “Finance capital is capital controlled by banks and employed by industrialists.”
হিলফার্ডীং প্রদত্ত লগ্নি পুঁজির এই সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করে লেনিন বলেন “ This definition is
incomplete insofar as it is silent on one extremely important fact—on the increase of
concentration of production and of capital to such an extent that concentration is leading, and
৬) Lenin Collected Works,vol 22, pg 226, progreesive publishers Moscow 1964
has led, to monopoly.” ।  এবং এই অধ্যয়ে তিনি
বিস্তারিত ভাবে লগ্নি পুঁজি ও লগ্নি পুঁজির হাত ধরে তৈরি হওয়া financial oligarchy কিভাবে বিশ্ব
অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে তা সবিস্তারে ব্যাখা করেন। লগ্নি পুঁজির অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকা একচেটিয়া
প্রবণতাটির নির্দি ষ্ট স্বরূপ উন্মোচিত হয় এই অধ্যয়ে। এই একই ধারাবাহিকতায় লগ্নি পুঁজির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
হিসেবে পুঁজির রফতানিকেও ব্যাখা করেন লেনিন। এই প্রসঙ্গে লেনিনের মতামত ছিল কাউটস্কিদের থেকে
অনেক বেশি বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তবসন্মত। কাউটস্কি হিলফার্ডীংরা লগ্নি পুঁজির রফতানির বৈশিষ্ট্যকে শুধুমাত্র
অনুন্নত কৃ ষি প্রধানদেশে পুঁজির রফতানি ঘটনা হিসেবে দেখেছিলেন এবং তার উপর দাঁড়িয়ে উপনিবেশের
দখলদারির ঘটনাকেই সাম্রাজ্যবাদের প্রধান চারিত্রিক নীতি হিসেবে ঠাউড়েছিলেন। অন্যদিকে লেনিন পুঁজি
রফতানিকে শুধুমাত্র উন্নত - অনুন্নত দেশের মধ্যেকার সম্পর্ক হিসেবে দেখেননি। উন্নত দেশের নিজেদের মধ্যেও
বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে যে পুঁজি রফতানি হচ্ছে সেটাও তিনি চিহ্নিত করেন। এবং তার ফলে একচেটিয়া পুঁজিবাদী
সংঘগুলির মধ্য দিয়ে যে সমগ্র বিশ্ব বাজারের বন্টন - বিভাজন ঘটছে সেটাও সাম্রাজ্যবাদের যুগে লগ্নি পুঁজির
একটি সাধারণ প্রবণতা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ১৯১০ সালের তথ্য দিয়ে তিনি দেখান যে কিভাবে জার্মান পুঁজি
উন্নত ইউরোপ বা আমেরিকা বাজারে প্রভাব বিস্তার করেছে। সাম্রাজ্যবাদকে শুধুমাত্র উন্নত বনাম অনুন্নত
কৃ ষিপ্রধান দেশের সম্পর্ক না দেখে সামগ্রিক বিশ্বব্যবস্থা হিসেবে চরিত্রায়িত করতে পারা লেনিনের তত্ত্বকে
অনেক সার্বজনীন করে তোলে। শুধুমাত্র অনুন্নত কৃ ষিপ্রধান উপনিবেশ বা আধা উপনিবেশ গুলোতে নয়; বরং
গোটা বিশ্ব ব্যবস্থাতেই একচেটিয়ার মাধ্যমে লগ্নি পুঁজি কিভাবে নির্ভ রতার সম্পর্ক তৈরি করছে তা বোঝাতে
গিয়ে লেনিন পর্তু গাল ব্রিটেনের সম্পর্কে ও টেনে আনেন। লেনিন দেখান কিভাবে একদা ঔপনিবেশিক প্রভু ও
রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন দেশ হয়েও পর্তু গাল বাস্তবত ব্রিটিশ লগ্নি পুঁজির নিয়ন্ত্রণে নির্ভ রশীল দেশ হয়ে রয়েছে।
লেনিন বলেন  “Relations of this kind have always existed between big and little states, but in
the epoch of capitalist imperialism they become a general system, they form part of the sum
total of “divide the world” relations and become links in the chain of operations of world
৭) Lenin Collected Works,vol 22, pg 264, progreesive publishers Moscow 1964
finance capital.” । একচেটিয়া ও প্রতিযোগিতার
আন্তঃসম্পর্ক শিল্প ক্ষেত্র - ব্যাঙ্ক ক্ষেত্র এর নতু ন ধরণের সংযুক্তিকরণের মধ্যে দিয়ে লগ্নি পুঁজি এর জন্ম
দিয়েছে। সেই লগ্নি পুঁজি বিশ্ববাজার এবং জাতি রাষ্ট্র গুলির মধ্যে নতু ন স্তরের নিয়ন্ত্রন ও প্রতিযোগিতার শৃঙ্খল
এর জন্ম দিয়েছে। এই পুরো প্রক্রিয়াতে পুঁজিবাদ এর রাজনৈতিক অর্থনীতিকে একটি নতু ন যুগে একটি নতু ন
পর্যায়ে উন্নীত করেছে। সেই নতু ন পর্যায়টিই লেনিনের কাছে সাম্রাজ্যবাদ। ফলত লেনিনীয় ধারণায় সাম্রাজ্যবাদ
পুঁজিবাদের কোন বিশেষ নীতি বা সাময়িক দশা নয়, বরং একটি নির্দি ষ্ট পর্যায়, যাকে উচ্চ বিমূর্তায়ণের স্তরে
লেনিন বলেছেন “If it were necessary to give the briefest possible definition of imperialism we
should have to say that imperialism is the monopoly stage of capitalism.......We have seen
that in its economic essence imperialism is monopoly capitalism. This in itself determines its
place in history, for monopoly that grows out of the soil of free competition, and precisely out
of free competition, is the transition from the capitalist system to a higher socio-economic
৮) Lenin Collected Works,vol 22, pg 298, progreesive publishers Moscow 1964
order.” ।

তবে এই বইটি খুঁটিয়ে না দেখলে লেনিন এর ‘একচেটিয়া’ নিয়ে ভাবনাকে সর্বগ্রাসী যান্ত্রিক মনে হতে পারে ।
এবং এই বইটির পদ্ধতিকে (methodology) ভু ল ভাবে পাঠ করে একচেটিয়াকে যান্ত্রিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে
দেখার প্রবণতা লেনিনের জীবদ্দশাতেই কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের মধ্যে এসেছিল। সেই প্রবনতা পরবর্তীতে
স্তালিনের নেতৃ ত্বাধীন তৃ তীয় আন্তর্জাতিকের ভিতর বারেবারে ফিরে এসেছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী
সময়েও তৃ তীয় বিশ্বের কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের মতাদর্শগত ভাবনায় জোরালো ভাবে উপস্থিত থেকে
আন্দোলনের প্রভূ ত ক্ষতি সাধণ করেছে। তবে আমরা এই লেখায় সেই ইতিহাস নিয়ে আলোচনায় ঢু কব না।
আমরা বরং একচেটিয়ার যান্ত্রিক ধারণার বিরুদ্ধে লেনিনের নিজের বক্তব্যতে ফিরে আসি। “সাম্রাজ্যবাদঃ
পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়” বইটি লেখার ৩ বছর বাদে সোভিয়েত বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ১৯১৯ সালের মার্চ
মাসে বলশেভিক পার্টি র অষ্টম কংগ্রেসে পার্টি প্রোগ্রামের প্রস্তাবনা (preamble) লেখা নিয়ে বুখারিন এর সাথে
লেনিনের তীব্র বিতর্ক হয়। সেই বিতর্কে র পিছনে ছিল একচেটিয়া ও সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে বুখারিনের যান্ত্রিক
মনোভাব। বুখারিন বলশেভিক পার্টি র কর্মসূচী লেখার সময় সেই কর্মসুচীর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ
পতনের একটি পরিপূর্ণ রূপরেখা দিতে বলেন। কর্মসূচীর মধ্যে এই রূপরেখা দেওয়ার ব্যাপারে লেনিন তার
আপত্তি জানিয়েছিলেন। পরে কংগ্রেসের ভাষণে লেনিন বলেন “When Comrade Bukharin stated that an
attempt might be made to present an integral picture of the collapse of capitalism and
imperialism, we objected to it in the commission, and I must object to it here. Just try it, and
you will see that you will not succeed. Comrade Bukharin made one such attempt in the
commission, and himself gave it up. I am absolutely convinced that if anybody could do this,
it is Comrade Bukharin, who has studied this question very extensively and thoroughly. I
৯) Reports On The
assert that such an attempt cannot be successful, because the task is a wrong one.”
Party Programme, March 19, Lenin Selected Works Volume 3,Pg 180.
এই বিতর্ক কে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে একই লেখায় লেনিন
একচেটিয়া ও প্রতিযোগিতার সম্পর্ক কে হেগেলিয় দ্বান্দিকতার ঐতিহ্যে তু লে ধরেন। লেনিন বলেন
“Comrade Bukharin’s concreteness is a bookish description of finance capitalism. In reality
we have heterogeneous phenomena to deal with. In every agricultural gubernia there is free
competition side by side with monopoly industry. Nowhere in the world has monopoly
capitalism existed in a whole series of branches without free competition, nor will it
exist. To write of such a system is to write of a system which is false and removed from
reality. If Marx said of manufacture that it was a superstructure on mass small
production, imperialism and finance capitalism are a superstructure on the old
capitalism. If its top is destroyed, the old capitalism is exposed. To maintain that there is
such a thing as integral imperialism without the old capitalism is merely making the wish
further to the thought. This is a natural mistake, one very easily committed. And if we had an
integral imperialism before us, which had entirely altered capitalism, our task would have
been a hundred thousand times easier. It would have resulted in a system in which everything
would be subordinated to finance capital alone. It would then only have remained to remove
the top and to transfer what remained to the proletariat. That would have been extremely
agreeable, but it is not so in reality. In reality the development is such that we have to act in
an entirely different way. Imperialism is a superstructure on capitalism. When it collapses,
we find ourselves dealing with the destruction of the top and the exposure of the foundation.
That is why our programme, if it is to be a correct one, must state what actually exists. There
is the old capitalism, which in a number of branches has grown to imperialism. Its tendencies
are exclusively imperialist. Fundamental questions can be examined only from the point
of view of imperialism. There is not a single major question of home or foreign policy
১০) Reports
which could be settled in any way except from the point of view of this tendency.
On The Party Programme, March 19, Lenin Selected Works Volume 3,Pg 182., Foreign Language Publishing House Moscow, 1961

লেনিনের উপরের দীর্ঘ উদ্ধৃ তি থেকে একচেটিয়ার যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বদলে সাম্রাজ্যবাদের পর্যায়ে একচেটিয়া ও
প্রতিযোগিতার দ্বান্দিক যোগসূত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লেনিন বহু জায়গাতেই সাম্রাজ্যবাদ এর পরজীবি তথা
ক্ষয়িষ্ণু চরিত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু এই পরজীবিতা বা ক্ষয়িষ্ণু প্রবণতাকে লেনিন কখনোই যান্ত্রিক
ভাবে দেখেননি। বরং লেনিনের ধারণায় ক্ষয়িষ্ণু তার দুটি প্রেক্ষিত প্রধান ভাবে উঠে আসে। প্রথমটি হল শিল্প
পুঁজি বা উৎপাদনের আধিপত্যের বদলে উন্নত দেশগুলি মধ্যে রেন্টিয়ার বা সুদখোর প্রবণতার আধিপত্য বৃদ্ধি
পাওয়া। দ্বিতীয়টি হল শ্রমিক শ্রেনীর আন্দোলনের মধ্যে আপোষকামীতার বৃদ্ধি । সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিবাদ
অবশ্যই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন শিল্প ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত স্থিতাবস্থার সন্মুখীন হবে কিন্তু নানা নতু ন উদ্ভাবন বা বিভিন্ন
নতু ন শিল্প ক্ষেত্রের বিকাশের সম্ভাবনাটি লেনিনের ধারণায় কখনোই অনুপস্থিত ছিল না। বরং সেই সম্ভবনার
উপস্থিতি কিভাবে পুঁজিবাদকে রাজনৈতিকভাবে জোরালো করে তোলে তা তার কাছে সুস্পষ্ট ছিল। সেই
প্রজন্মের বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ বিপ্লবী মার্ক্সবাদী যেমন রোজা বা বুখারিন মার্ক্সীয় অর্থনীতির উপর দাঁড়িয়ে পুঁজিবাদ
বা সাম্রাজ্যবাদ পতনের প্রণালী (schemata) আঁকার মধ্যে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে তত্ত্বায়িত করতে
গিয়েছিলেন। লেনিন তার সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব দিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের এ হেন যান্ত্রিক তত্ত্বায়নের উদ্যোগ
কখনোই নেননি বরং তার সক্রিয় বিরোধিতা করেছেন। এখানে সমসাময়িক বাকি বিপ্লবী মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকদের
থেকে লেনিনের সাম্রাজ্যবাদের ধারণার বিশেষত্ব ও দূরদর্শিতা। লেনিন এর তত্ত্ব অনুসারে সাম্রাজ্যবাদ হল
পুঁজিবাদের একটি বিশেষ পর্যায়, যেখানে বিশ্ব পুঁজিবাদ একটী নতু ন স্তরের অন্তর্জাল বা শৃংখল ( network or
chian) হিসেবে নিজেকে সংগঠিত করেছে। অন্যান্য সমসাময়িক বিপ্লবী মার্ক্সবাদীদের মতন সংকটগ্রস্ত
পুঁজিবাদের পতনের কোন যান্ত্রিক ইউটোপীয় প্রণালী তৈরি করার বদলে, এই নতু ন পর্যায়ের বাস্তব ব্যবচ্ছেছ করে
লেনিন চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদী শৃংখলের দুর্বলতম গ্রন্থিকে, চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন
সাম্রাজ্যবাদের যুগের মধ্যে থাকা বৈপ্লবিক উপাদানগুলি ও সম্ভবনাকে। একই সাথে নতু ন ভাবে নির্দি ষ্ট করতে
চেয়েছেন এই যুগের প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতাকেও যা শ্রমিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করছে। সাম্রাজ্যবাদের
তত্ত্বের আলোকে মূর্ত অবস্থার মুর্ত বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে লেনিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্বে বেশ কয়েকটী নতু ন
রাজনৈতিক ধারণা হাজির করেন। এই ধারণাগুলি একদিকে সোভিয়েত এ বলশেভিক বিপ্লবের ভিত্তিভূ মি
স্থাপন করেছিল। অন্যদিকে কম্যুনিষ্ট আন্দোলনকে উন্নত পশ্চিম ইউরোপের পরিধি ছাড়িয়ে বিশ্বজোড়া একটি
আন্তর্জাতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করেছিল। পরের অনুচ্ছেদে আমরা সেই ধারনা গুলি নিয়ে আলোচনা
করব।

সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বের অনুসিদ্ধান্ত ঃ কয়েকটি বৈপ্লবিক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ

১৯১৫ থেকে ১৯১৮ সাল অবধি লেনিনের লেখায় বেশ কিছু নতু ন রাজনৈতিক ধারণা সুস্পট হয়ে ওঠে যা
বলশেভিক বিপ্লব এর সফল সম্পাদন ও তৃ তীয় আন্তর্জাতিকের নির্মানের তাত্ত্বিক ভিত্তিভূ মি হয়ে ওঠে।
অভিজাত শ্রমিক এর ধারণা (labour Aristocracy), জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, পশ্চাদপদ দেশের
ক্ষমতাদখলের জন্য সর্বহারা আধাসর্বহারার বিপ্লবী শ্রেনী ঐক্য – প্রভৃ তি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ধারণাগুলি
লেনিনের সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বের অনুষঙ্গ হিসেবেই গড়ে ওঠে।

শ্রমিক আভিজাত্যের ধারণা

উনিবিংশ শতকের শেষ দিক থেকেই উন্নত দেশের শ্রমিক আন্দোলনের এর মধ্যে একধরণের আপোষকামী
সুবিধাবাদী প্রবণতা বেশ জোরালো হয়ে উঠেছিল। এই প্রবণতা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে সংশোধনবাদী
প্রবণতা হিসেবে নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটায়। উনিবিংশ শতকের একদম শেষভাগে বার্ণস্টাইন, মিলের‍্যান্ড
প্রমুখরা সর্বপ্রথম এই ধারার প্রতিনিধি হিসেবে মার্ক্সবাদ এর বিপ্লবী ঐতিহ্যকে সংশোধন এর কাজে নামেন। তবে
শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে এই প্রবণতা মার্ক্স এঙ্গেলস এর জীব্দদশাতেই চিহ্নিত হয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের
বিভিন্ন দেশে বিশেষত ইংল্যাণ্ডের শ্রমিক শ্রেনীর একটি অপেক্ষাকৃ ত এগিয়ে থাকা অংশ বুর্জোয়া ব্যবস্থা ও
রাজনীতির সাথে গভীর সংযোগে লিপ্ত হচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সমাজব্যবস্থা বদলের
তু লনায় বুর্জোয়া ব্যবস্থার মধ্যেই তু লনামূলক ভাবে নিজেদের সুখ সাচ্ছন্দ্য তথা আর্থসামাজিক অবস্থার
উন্নতির চেষ্টাতে তারা নিজেদের নিয়োজিত করছেন। উনিবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই এই পর্যবেক্ষন
এঙ্গেলস বারবার নানান জায়গায় করেছিলেন।
১১) Lenin Collected Works,vol 22, pg 283, progreesive publishers Moscow 1964
। কিন্তু
বিংশ শতাব্দী শুরুর পর এই প্রবণতা ইংল্যাণ্ড ছাড়িয়ে ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম সমস্ত দেশের শ্রমিক
আন্দোলনের মধ্যেই জোরালো হয়ে ওঠে। এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে এসে কাউটস্কি, তু রাতি, হাইডম্যান,
প্লেখানভদের হাত ধরে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক এর মধ্যে এই সংশোধনবাদী প্রবনতা
আধিপত্যকারী জায়গা নিয়ে ফেলে। সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে বিপ্লবী দিশায়
পরিচালনা করতে গেলে এই সুবিধাবাদের বা সংশোধনবাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যাখা অত্যন্ত্য গুরুত্বপুর্ণ
ছিল। সেই কারণে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনীতির সাথে শ্রমিক আন্দোলন তথা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের
সুবিধাবাদী সংশোধনবাদী প্রবনতার আন্তঃসম্পর্ক খোঁজা লেনিনের অন্যতম কাজ ওঠে। সাম্রাজ্যবাদের
অর্থনীতির বিশ্লেষণ করে লেনিন দেখান লগ্নি পুঁজি নিজের দেশের সীমানার বাইরে প্রযুক্ত হয়ে অপেক্ষাকৃ ত
উচ্চহারে অতিরিক্ত মুনাফা পাচ্ছে। ফলে সেই অতিরিক্ত মুনাফার লভ্যাংশ দিয়ে নিজের দেশের শ্রমিক শ্রেনীর
একটি উচ্চবর্গীয় অংশকে উন্নত পুঁজিবাদী দেশের বুর্জোয়া ব্যবস্থা বিভিন্ন পদ্ধতিতে ‘ঘুষ’ দিয়ে বিপ্লবী রাজনীতি
থেকে সরিয়ে আপোষের পথে নিয়ে আসতে সক্ষম হচ্ছে। Preface to Imperialism: The highest Stage of Capitalism, LCW Ibd pg 194

এটাই লেনিনের শ্রমিক আভিজাত্যের ধারণা হিসেবে পরিচিত। মার্ক্সের যুগে ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেনীর মধ্যে এই
আপোষের প্রবণতা উপস্থিত থাকলেও সেটা উক্ত যুগে উন্নত দেশগুলির ভিতর একটি সাধারণ জোরালো
প্রবণতা হিসেবে হাজির হয়ে শ্রেনী গঠন ও শ্রেনী সংগ্রামের( class formation and class struggle) পথকে
প্রভাবিত করতে শুরু করেনি। ফলে উন্নত দেশগুলির শ্রমিক শ্রেনীর গঠনের মধ্যে এই ধরণের বিভাজন এর
রাজনৈতিক গুরুত্ব মার্ক্সের লেখায় পাওয়া যায় না। তবে সাম্রাজ্যবাদের যুগে লগ্নি পুঁজির অতিরিক্ত মুনাফার
উপর ভিত্তি করে শ্রমিক আভিজাত্যের তত্ত্ব কোনো নিছক তাত্ত্বিক বিতর্ক ছিল না। বাস্তব রাজনীতির
সাংগঠনিক কার্যপ্রনালীর ক্ষেত্রেও এই তত্ত্বের সুনির্দি ষ্ট প্রভাব ছিল। সাম্রাজ্যবাদের যুগে উন্নত দেশের শ্রমিক
শ্রেনীর একটি অংশের মধ্যে আপোষের প্রবণতা বেশ জোরালো হয়ে ওঠে। ফলে শ্রমিক শ্রেনীর বিভিন্ন
অংশকে আপোষবাদের উল্টোদিকে পৃথক ভাবে বিপ্লবী ভাবনায় সংগঠিত করার কাজ সমাজতান্ত্রিক
আন্দোলনের সামনে নতু ন ভাবে হাজির হয়। ফলত ১৯০১ -০৩ সালে লেনিন তার পার্টী ভাবনার যে প্রাথমিক
রূপরেখা হাজির করেছিলেন শ্রমিক আভিজাত্যের তত্ত্ব সেই পার্টি র ধারণাকে আরও সুনির্দি ষ্ট ও পরিপূরক
করে তোলে। সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য সাংগঠনিক ভাবে সংঘবদ্ধ যে আন্দোলনের ধারা শ্রেনী
সংগ্রামে প্রয়োজনীয় সেটা রাশিয়াতে তৈরি হতে পারলেও, জার্মানি সহ বিভিন্ন দেশে তা অনুপস্থিত ছিল।
রোজা সহ বিভিন্ন বিপ্লবীরা আপোষবাদ- সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী মার্ক্সবাদের ঐতিহ্যে উদ্যোগ নিলেও তা
তাত্ত্বিক সাংগঠনিক রূপ পায়নি। শ্রমিক আভিজাত্যের অবধারণার মধ্যে দিয়ে লেনিনের সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব ও
পার্টি র তত্ত্ব এক মনিকাঞ্চন যোগসূত্র খুঁজে পায়। এই মনিকাঞ্চন যোগ ছাড়া রুশ বিপ্লব অসম্ভব ছিল। এমনকি
আজকের বিশ্বেও সাম্রাজ্যবাদ যে ধরণের কার্যপ্রনালীতে লিপ্ত তার উপর দাঁড়িয়ে শ্রমিক আভিজাত্যের তত্ত্বের
প্রাসংগিকতা হারিয়ে যায়নি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের কার্যপ্রনালী আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে প্রথম বিশ্ব বা তৃ তীয়
বিশ্বে ঠিক কিভাবে শ্রম আভিজাত্যের আপোষকারী প্রবণতার জন্ম দিচ্ছে তা আরোও বিষদ ও গভীর চর্চার
দাবি করে। কিন্তু আমাদের লেখায় সেই প্রসংগে গভীরে ঢোকার সুযোগ নেই।

জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের লেনিনীয় ধারণা ও তৃ তীয় দুনিয়ার মুক্তি সংগ্রাম

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দাঁড়িয়ে অবদমিত জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটিকে লেনিন সাম্রাজ্যবাদের তাত্ত্বিক
কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন। জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এর প্রশ্নটি নিয়ে তৎকালীন
সময়ে রোজা এবং কাউটস্কির সাথে তার তীব্র বিতর্ক হয়েছিল। সাধারণ ভাবে সেই সময়কার সমাজতান্ত্রিক
আন্দোলনে সমস্ত তাত্ত্বিকরাই জাতিসত্ত্বার অবদমনের বিরোধী ছিলেন । কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাপেক্ষে
জাতিসত্ত্বার অবদমনের প্রশ্নটিকে কিভাবে মীমাংসা করা হবে তাই নিয়েই মূল বিতর্ক ছিল। রোজা সহ
অধিকাংশ মার্ক্সবাদীদের এই প্রসংগে দুটি যুক্তি ছিল। প্রথমত অবদমিত জাতিসত্ত্বার পক্ষে বিচ্ছিন্ন হয়ে
আলাদা রাষ্ট্র গড়া সাম্রাজ্যবাদের যুগে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ভাবে সম্ভবপর নয়। দ্বিতীয়ত এই দাবি
অন্তর্বস্তুতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দাবি যা নিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রশ্ন সমাধান হওয়া সম্ভবপর নয়। এই
বিতর্কে লেনিন বিভিন্ন লেখা লিখলেও ১৯১৬ সালে রচিত “The Socialist Revolution And Rights of
Nation to self determination” নামক লেখাটি সমগ্রতায় প্রশ্নটিকে উপস্থাপনা করার চেষ্টা করে।
সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রেক্ষিত টেনে লেনিন উপরে বর্ণিত দুটি যুক্তিকেই খন্ডন করেন। লেনিন
দেখান যে অন্তর্বস্তুতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দাবি হলেও সাম্রাজ্যবাদের যুগে অবদমিত জাতিসত্ত্বার লড়াই এর
মধ্যে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক উপাদান রয়েছে যা সরাসরি তথাকথিত উন্নত দেশের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাথে
সংহতিপূর্ণ। এবং সাম্রাজ্যবাদের যুগে বহু জনজাতির দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচী অবদমিত
জাতিসত্ত্বার প্রশ্নটিকে এড়িয়ে কিছুতেই এগোতে পারবে না। রাশিয়ার পরিস্থিতি বিচার করলে লেনিনের যুক্তির
ভিত্তিভূ মিটি আরও স্পষ্ট হয়। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বহু জাতিসত্ত্বার দেশ রাশিয়াতে জার ব্যবস্থার মতন
একটি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেনী ও অবদমিত জাতিসত্ত্বা উভয়কে নিজের মুক্তির জন্য লড়তে হচ্ছে।
অবদমিত জাতির বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার দেওয়ার ফলে জর্জি য়ান বা উজবেক কিংবা কাজাক জনজাতির
জার সাম্রাজ্য বিরোধী লড়াই বাস্তবত রুশিয়ান শ্রমিক শ্রেনীর রাষ্ট্র বিরোধী লড়াই এর অংশ হয়ে ওঠে। বাস্তবত
সেইজন্যই লেনিনের কাছে বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার ছাড়া জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্লোগানটি ফাকা
বুলির মতন ছিল। এখানেই রোজা বা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অন্যান্য তাত্ত্বিকদের সাথে তার পার্থক্য তৈরি
হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদের ধারণার উপর দাঁড়িয়ে অবদমিত জাতিসত্ত্বার অধিকারের এই ভাবনা ছাড়া বাস্তবত
রুশ বিপ্লব সফল হতে পারত না। জন্ম হতে পারত না বহু জাতিসত্ত্বার সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত সংঘের।

মার্ক্সের সময় থেকেই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে আন্তর্জাতিকতার ধারণাটি সর্বহারার মুক্তির সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে
জড়িত। প্যারি কম্যুন সেই আন্তর্জাতিকতাবাদ এর ঐতিহ্যকে আরও জোরালো করে তোলে। অন্যদিকে
জাতীয়তাবাদের ধারণা অন্তর্বস্তুতে একটি বুর্জোয়া মতাদর্শ হিসেবেই মার্ক্সের সময়কালীন সমাজতান্ত্রিক
আন্দোলন এ স্বীকৃ ত হয়ে এসেছে। ফলত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে ঔপনিবেশবাদ দ্বারা অবদমিত দেশ
গুলির জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের আন্তঃসম্পর্ক কি হবে তা কিন্তু প্রথম আন্তর্জাতিক বা দ্বিতীয় আন্তঃর্জাতিকের
সময়কালে একেবারেই চর্চার বিষয় হয়ে ওঠেনি। সেই সময়কার মার্ক্সবাদ তথা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ছিল
প্রধানত উন্নত পুঁজিবাদী বিশ্বের মুক্তির দর্শন, বাস্তবত সেই মানচিত্রে তৃ তীয় দুনিয়ার কোনো ঠাই ছিল না।
লেনিনের হাত ধরেই কম্যুনিষ্ট আন্দোলনে অবদমিত দেশ - জাতিসত্ত্বার জাতীয়তাবাদ ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের
আন্তঃসম্পর্ক তৈরি করার ভিত্তিভূ মি নির্মিত হয়। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মানচিত্রে তথাকতিত তৃ তীয়
দুনিয়ার সংগ্রামের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব ও বিচ্ছিন্ন হবার অধিকারের মাধ্যমে অবদমিত
জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণ – লেনিনের এই দুই ধারণাই কম্যুনিষ্ট আন্দোলনে সর্বপ্রথম অবদমিত দেশ বা
অবদমিত জাতির জাতীয়তাবাদের সাথে সর্বহারার আন্তঃর্জাতিকতাবাদের আন্তঃসম্পর্ক রচনা করে। মার্ক্সের
সময়ে যেকোন জাতীয়তাবাদকেই সম্পুর্ণ ভাবে বুর্জোয়া ভাবাদর্শ হিসেবে দ্যাখা হত। সাম্রাজ্যবাদের যুগের ধারণা
এনে লেনিন বর্ত মান বিশ্বব্যবস্থায় জাতীয়তাবাদ এর মধ্যে থাকা দু ধরণের প্রবণতাকে স্পষ্ট করে হাজির করেন।
একটি হল আধিপত্যকারী দেশের প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদ অন্যটি হল অবদমিত দেশের প্রগতিশীল
জাতীয়তাবাদ। লেনিনের এই তাত্ত্বিক ফ্রেমকে কাজে লাগিয়ে সোভিয়েত বিপ্লবের ঠিক পরেই তৃ তীয়
আন্তর্জাতিক তৃ তীয় বিশ্ব তথা উপনিবেশ- আধা উপনিবেশের শ্রেনী সংগ্রামের প্রশ্নে নানা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
নেওয়া শুরু করে। তার ফলে কম্যুনিষ্ট আন্দোলন তৃ তীয় দুনিয়ার দেশগুলিতে গতি লাভ করে। পরবর্তী কালে
কমরেড মাও সে তুং এই প্রশ্নে লেনিনের ভাবনাকে আরও নানা দিক থেকে সময় ও স্থান এর সাপেক্ষে
উপযোগী ও উন্নত করে তু লে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারণা নির্মান করেন। মাও এর অবদানের মধ্যে দিয়ে
লেনিনের সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব ৬০-৭০ দশক অবধি বিশ্ব কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের অন্যতম পথ নির্দে শিকা হয়ে
দাঁড়ায়। চীন দেশে নয়া গনতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হয়। তৃ তীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রেনী সংগ্রাম সুতীব্র আঁকার
নিয়ে কম্যুনিষ্ট পার্টি র নেতৃ ত্বে ক্ষমতা দখলের সংগ্রামের পরিণত হয়। উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে
লেনিনের সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব তথা তার অনুসিদ্ধান্ত গুলির ছাড়া রুশ বিপ্লব যেমন অসম্ভব ছিল তেমনই তৃ তীয়
বিশ্বের দেশে আন্তঃর্জাতিক কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের এই বিকাশও এককথায় অসম্ভব ছিল।

এই লেখার ভূ মিকায় আমরা বলেছিলাম আমরা বলেছিলাম যে লেনিনের সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব কে পর্যালোচনা
করতে গেলে দুটি পৃথক দিক ধরে পর্যালোচনা করা দরকার। এর মধ্যে প্রথম দিকটি হল ঐতিহাসিকতায়
লেনিনের সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বর পাঠ করা। অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নির্দি ষ্ট প্রেক্ষিতে রুশবিপ্লব তথা বিশ্ববিপ্লবের
বিশেষতায় লেনিনের তত্ত্বের ভূ মিকা নিয়ে চর্চা করা। এবং এর সাথে একই যোগসূত্রে থাকবে রুশ বিপ্লব পরবর্তী
তিন দশকে পদানত তৃ তীয় বিশ্বের শ্রেনী সংগ্রামের গতিপথে এই তত্ত্ব এর ভূ মিকাকে ফিরে দেখা। অনীকের এই
সংখ্যার লেখায় আমরা এই প্রথম দিকটি নিয়েই আলোচনা সীমিত করলাম। অনীকের পরবর্তী সংখ্যায়
আমরা দ্বিতীয় দিকটি নিয়ে আলোচনা করব। দ্বিতীয় দিকের পর্যালোচনার বিষয়বস্তু হল সাধারণ ভাবে
সাম্রাজ্যবাদের যুগে তথা বর্ত মান সময়ে এই তত্ত্বের সার্বজনীনতার প্রশ্নটি কিভাবে প্রাসংগিক থাকছে তা
খোঁজা।

You might also like