You are on page 1of 20

ফিরিয়ে দিতে এসে

সবাই থমথমে পরিবেশে বসে আছে। সঙ্কর চক্রবর্তী হইচই থামিয়েছেন। সাথে অন্যদের বাকশক্তি যেন খুইয়ে গেছে।
অথচ এতক্ষণ বাড়ি মাথায় তু লেছিল সবাই। এই মাঝরাতে বাড়ি মাথায় তোলার জন্য যথেষ্ট উপলক্ষ্য দরকার ।
সেই উপলক্ষের অবতারণা সঙ্কর চক্রবর্তী নিজে করেছেন। মিনিট পনের আগে স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙ্গে গেছে।

সঙ্কর চক্রবর্তী স্বপ্ন দেখেছেন কয়েকটা ছোট বাচ্চা খাটের নিচ থেকে এসে তার পায়ের আঙ্গুল টানছে। খাটের নিচ
থেকে এসে তার পায়ের আঙ্গুল । ভয়ে তিনি শরীর গুটিয়ে নিচ্ছেন। বাচ্চাগুলোও আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। আঙ্গুল
ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। কুঁ কড়ে নিজেকে সংকীর্ণ করে আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা করেছেন সংকর চক্রবর্তী।
কিন্তু শিশুগুলো ক্রমেই বীভৎস্য পশুতে পরিণত হতে থাকে, দানবীয় শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসে তার দিকে। একে
একে পায়ের সবকটা আঙ্গুল উপড়ে ফেলে যন্ত্রণার নরকে ডু বিয়ে দেয়া হচ্ছে সঙ্কর চক্রবর্তীকে। এমন অবস্থায় তার
স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে।

এমন স্বপ্ন দেখে প্রথমে হাউমাউ করে কেঁ দেই ফেলেছিলেন সঙ্কর চক্রবর্তী। আর এতেই মাঝরাতে বাড়ি মাথায় নেয়ার
উপলক্ষ্য পাওয়া গেছে। সবাইকে ভয়ার্ত ভঙ্গিতে স্বপ্নের বর্ণনা দেয়ার জন্য ডেকে আনতে হয়নি। বরং ঘটনা দেখার
জন্য সবাই একে একে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু ঘটনার শোনার পর অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এবং রীতিমত
বিরক্ত হয়েছে। তাদের ধারণা এটা খুবই সাধারণ দুঃস্বপ্ন । এই দলে সঙ্কর চক্রবর্তীর পুত্রবধু অদিতি আর গৃহকত্রী
চৌধুরানী আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চৌধুরানী সর্বপ্রথম মুখ খুললো – “ রাইত বাজে তিনটা । এইটা খোয়াব
দেখার কোন সময় হইলো? এই খোয়াবের কোন দাম নাই।“

সঙ্কর চক্রবর্তী রেগে গেলেন – “ দেবী চৌধুরানী এসেছেন স্বপ্নের দাম বোঝাতে । এই, তু ই কি বুঝিস স্বপ্নের দামের।
তোর কি মনে হয়, এই স্বপ্ন ভ্যালু লেস? “

“ হ বুঝি তো । মইধ্যা রাতের খোয়াবের দাম নাই। ভোর রাইতের খোয়াবের দাম বেশি। যখন-তখন ফইলা যায়। তয়
যে খোয়াব ফলবে তার আবার টাইম-টেবল লাগেনা। “

“তোকে দেবী চৌধুরানীর সাথে তু লনা করা ভু ল হয়েছে। তোর জ্ঞান তো তাকেও বিট দিবে। এই জ্ঞান নিয়া আমার
চোখের সামনে থাকবি না, এক্ষু নি দূর হ। “

চৌধুরানী ঘরের বাইরে এসে রাগ ঝাড়লো।


-“উচিত কতা কইলে দোস্ত ব্যাজার। বুইড়া বয়সে ভূ ত ধরছে, মাথা আউলা খোয়াবের ভূ ত। “

এদিকে ঘরে তখন পুত্রবধূ অদিতি সঙ্করকে সান্তনা দিচ্ছিলো – “ বাবা, আপনি শুধু শুধু দুঃচিন্তা করছেন। যার
কারণে সেই সব চিন্তা মাথায় গেথে বসে আছে আর আপনি দুঃস্বপ্ন দেখছেন। আপনার বয়স হচ্ছে আপনি আমোদ-
ফু র্তি তে থাকবেন। আপনার এত কিসের চিন্তা?”

বিরক্তি ঢেকে সান্ত্বনা দেয়া বেশ কঠিন কিন্তু অদিতি এই কাজটা অবলীলায় করলো। পুত্রবধুর কথায় সঙ্কর চক্রবর্তী
খানিক আশ্বস্ত হলেন। এত কিসের চিন্তা তার? চিন্তা করার জন্য তো ছেলেরা আছে। কিন্তু বয়সটাই এমন। কাজকর্ম
নেই। সিংহভাগ সময় তাই চিন্তা করেই কাটাতে হয়। জীবনের শেষে এসে সব হস্তান্তর করার জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন
। প্রস্তুতির জন্য চিন্তা করতে হয়। এই চিন্তাটাই বা কম কি?

জীবনতলার মোড়ের কাছেই ছোট দো-তলা বাড়ি “ঠাই” । জমিদারি ঘরানার নির্মাণশৈলী। বাড়ির গায়ের সাদা
চু নকাম ক্রমে ফ্যাকাশে হয়ে হলদেটে ভাব ধরেছে। এই বাড়ির বড় কর্তা সঙ্কর চক্রবর্তী। কতিপয় রাষ্ট্রপতির যেমন
নামমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান তেমনি সঙ্কর চক্রবর্তীও নামমাত্র বড়কর্তা। ক্ষমতার কাঠিটা বড়ছেলে রণবীরকে দিয়েছেন তাও
প্রায় এক দশক আগে। রণবীরের স্ত্রী অদিতি। হুগলীর মেয়ে। বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক হলো। মেয়েটা সন্তানের মা
হতে পারলো না। এই নিয়ে ডাক্তারের কাছেও যাওয়া-আসা হচ্ছে বেশ। ডাক্তার কোন রকম সমস্যা দেখছেন না।
না রণবীরের, না অদিতির। অথচ সৃষ্টিকর্তা মুখ তু লে তাকাচ্ছেন না। এই এতটু কু অপ্রাপ্তি ছাড়া তেমন কোন বিষয়ে
আক্ষেপ নেই অদিতির। মেয়েটা পাশের প্রাইমারী স্কু লে পড়াতো । মাঝে হঠাৎ কি মনে করে চাকু রীটা ছেড়ে দিল।
তার ধারণা একসাথে দুইদিকে মন দেয়া যায়না। ঘর-সংসারে মন দিলে হয়ত ভগবান মুখ তু লে চাইবেন, এমন
কু সংস্কার চাকু রি ছাড়ার পিছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।

সঙ্কর চক্রবর্তীর ছোট ছেলে আরস। সে গ্রাজুয়েশন করে চাকরির চেষ্টা করছে। অদিতি যখন প্রাইমারীর চাকরিটা
ছাড়লো তখন সব থেকে রাগ হয়েছিল আরস। সে এত চেষ্টা করছে চাকরির জন্য আর বৌদি কিনা দেখাশুনা
চাকরি ছেড়ে চলে আসছে। আরস আবার একেবারে পরনির্ভ রশীল নয়। নানান সময় তাকে নানান জীবিকা নিতে
দেখা যায়। এলাকায় টিউশনি করিয়ে মাস্টার হিসেবে বেশ নাম করেছে সে। তারপরেও আরসের গতিবিধি নিশ্চিত
করে বলা যায়না। কোন দিন দেখা যায় আরস ঔষুধের দোকানে বসা শুরু করেছে, কখনো যাবে নানান ইভেন্ট
ম্যানেজমেন্ট টিমের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুই-তিন মাস লাপাত্তা। বাড়ির কেউ আর এসব বিষয়ে মাথা ঘামায় না।
আরস কয়েকদিন বাড়ি না ফিরলেও কারো মাথা ব্যাথা হয়না। যদি আরস হঠাৎ ফোন করে বলে – “ আমি আগামী
দুই মাস বাড়ি ফিরবো না।“ তএব কেউ অবাক হবেনা। “ওহ আচ্ছা” বলে ফোন রেখে দিয়ে সবাইকে খবরটা
জানিয়ে দেবে। খবরের প্রতিক্রিয়া হিসেবে সবাই আবার “ওহ আচ্ছা” বলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখবে।

আরসের জন্য কেউ না ভাবলেও দুইজন আছেন যারা আরসের প্রতিটা মুহূর্তে র জন্য উদ্বিগ্ন থাকেন।
প্রথমজন হচ্ছেন আরসের মা সুপ্রিয়া চক্রবর্তী, আর দ্বিতীয়জন কথা খানিক বাদে বলছি।

সুপ্রিয়া চক্রবর্তীর কথায় আসা যাক। গোলগাল চেহারার দোহারা গড়নের মহিলা। বয়স পঞ্চাশ ছুইছুই।
বয়সকালে রুপবতীদের কাতারে ছিলেন। সেই যে ৭১ সালে সঙ্কর চক্রবর্তী বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় আসলেন।
এরপর তার আর ফেরা হলো না। ওপারের টান কাটিয়ে উঠতে এপারে যে টানের প্রয়োজন ছিল তা সুপ্রিয়া বেশ
জোগান দিয়েছিলেন। এই মমতাময়ী শোকের আবহে প্রলেপ দিতে জানেন। আর তাই হয়ত সঙ্কর এই সমস্ত তার
সহ্য ক্ষমতার বাগে আনতে পেরেছেন। সুপ্রিয়া না থাকলে সঙ্কর হয়ত আজ অবধি টিকে থাকত না।

সঙ্কর আর সুপ্রিয়ার একটা মেয়ে আছে মেয়ের নাম প্রতিমা সন্তানদের মধ্যে প্রতিমা মেজো। বিয়ে হয়েছে
বিধান নগরে। মেয়ে দেখতে সংকরের মায়ের মত হয়েছে। একথা সঙ্কর ছাড়া কেউ জানেনা। কারণ সঙ্করের মা কে
এখানকার কেউ দেখেনি। এখনো মায়ের মুখ দেখতে ইচ্ছা হলে সঙ্কর মেয়েকে ডেকে পাঠান।

স্বপ্ন দেখেই মেয়েকে ফোন করে দিয়েছেন সঙ্কর চক্রবর্তী বিধান নগর থেকে জীবনতলা প্রায় পঞ্চাশ
কিলোমিটার পথ। ফোন পাওয়া মাত্র প্রতিমা রওনা দিয়েছে। সাথে আছে তার বর সৌরভ আর একমাত্র মেয়ে
রনতী। প্রথমে অবশ্য সৌরভ বলেছিল এই মাঝরাতে বের হওয়ার কোন মানে হয়? কিন্তু পরে প্রতিমার জোর দাবির
কাছে তা ধোপে টেকেনি। একদিক দিয়ে অবশ্য ভালোই হয়েছে। এই ভোর রাতে পৌঁছালে নিজের ভাবমূর্তি তু লে
ধরে যদি অতিরিক্ত খাতির করা যায় তবে সঙ্কর চক্রবর্তীর সম্পত্তি ভাগাভাগির অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় নিজের
অবস্থান পোক্ত করা যাবে।

প্রতিমা বললো- “গাড়ি আস্তে চালাও। রনতীর ঠান্ডা লাগবে।“

সৌরভ জবাব দিলো – “ রাস্তা ফাকা, জোরে কি আর আস্তে কি?”

- ঠান্ডা লাগলে রনতী এখনি উঠে যাবে। তখন এপাশ ওপাশ সব এলোমেলো হয়ে যাবে।
- এলোমেলো হলে তো বেশ হবে। অন্তত রাত দুপুরে তোমার বাপের বাড়ি যাওয়ার শখটা ঘুচবে।
- আমি কি শখ করে বাপের বাড়ি যাচ্ছি ?
- শখ না তু মি যাচ্ছো আহ্লাদে। তোমার পিতাশ্রী কি স্বপ্ন দেখেছেন তার জন্য রাতের ঘুম নির্বাসন দিয়ে এখন
আমাকে গাড়ি নিয়ে ছুটতে হচ্ছে।
- তোমার খুব কষ্ট হয়ে গেছে বুঝি? তু মি থেকে গেলেই পারতে।
- সেটাই উচিত ছিল। বড্ড দায় হয়ে গেল।

প্রতিমা গাড়ির কাঁচ তু লেদিল। প্রায় সাথে সাথে রনতীর ঘুম ভেঙ্গে গেল।

সে চোখ খুলেই বললো – “ মাম্মা আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

প্রতিমা জবাব দিলো – “ তোমার নানু বাসায় যাচ্ছি মাম্মা।“

“নানু বাড়ি এত অন্ধকার কেন?”

এবার রনতীর কথার জবাব দিলো সৌরভ- “ তোমার নানু বাড়ি খুবই আধুনিক আলো ব্যবহার করে তো তাই
আমরা দেখতে পাচ্ছিনা।“

প্রতিমা বেশ রেগে গিয়ে বললো – “ সৌরভ, তু মি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো। ছোট বাচ্চাটাকে কি শেখাচ্ছো?”

রনতী বেশ আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে – “ মাম্মা বাড়াবাড়ি কি?”

- দেখছো কি শিখতেছে? বাচ্চাটার সামনে এগুলো কি না বললেই নয়?


- পাপ্পা-মাম্মা, তোমরা ঝগড়া কর কেন? তোমরা খুব ঝগড়ু টে, মানা করলেও শোন না। তার থেকে গাড়ির
কাচটা আবার খুলেও দাও তো আমি আবার ঘুমের ভান করে থাকি। তোমাদের সাথে কথা বলতে
ভালো লাগেনা।

কথাটা বলেই রনতী ঘুমের ভান করলো। প্রতিমা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে গভীর
ঘুমে বিভোর।

প্রতিমাদের পৌঁছাতে প্রায় ঘন্টা দেড়েক সময় লাগলো। ভোর রাতে ‘ঠাঁই’ এর সবাই আবার জেগে
উঠলো।

প্রতিমা, সৌরভ আর রনতী সোজা চলে গেল সংকর চক্রবর্তীর ঘরে। ডিম লাইট জ্বালিয়ে সঙ্কর চক্রবর্তী বসে
ছিলেন। মেয়ে আর জামাইকে দেখে আধশোয়া ভঙ্গিতে চলে গেলেন। এই ভঙ্গিতে যাওয়ার অবশ্য কারণ আছে।
রনতী সঙ্কর চক্রবর্তীর পাশে শুয়ে বুকে মাথা দিল। সঙ্কর চক্রবর্তী একটা হাত তু লে দিলেন রনতীর মাথায়। রনতী
চোখ বন্ধ করলো। এখনো তাকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছে। এরপর সঙ্কর চক্রবর্তী প্রতিমার দিকে তাকালেন।

কথা শুরু করলো সৌরভ। সে বলল – “ বাবা, শরীর কেমন এখন?”

সঙ্কর চক্রবর্তী বললেন – “ শরীর ত বেশ ভালোই। কিন্তু মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। আজেবাজে স্বপ্ন দেখছি
আজকাল।“

- মন বিক্ষিপ্ত থাকলে তো সমস্যা। শরীরের গোঁড়া হচ্ছে মনে। মনে সমস্যা শুরু তো গোটা শরীরে সমস্যা
শুরু।

সৌরভের মুখের কথা কেড়ে নিলো প্রতিমা।ভয় মিশ্রিত স্বরে সে জিজ্ঞাস করলো – “ কি স্বপ্ন দেখেছো বাবা? খুলে
বলো তো। আমার কিন্তু ভয় করতেছে।“

সঙ্কর চক্রবর্তী নতু ন উৎসাহ সঞ্চয় করে বললেন – “ ভয়ের কিছু নাই। অতি সাধারণ স্বপ্ন দেখছি। কয়েকটা
বাচ্চা ঘুমের মধ্যে আমার পায়ের আঙ্গুল টানতেছে। গভীর রাতে স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে গেছলাম। হঠাৎ আজেবাজে
স্বপ্ন দেখলে যা হয় আর কি?

“বাচ্চাগুলা খালি আঙ্গুল টানলো আর কিছু করলো না।“ - দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে সৌরভ জিজ্ঞেস করলো ।

- না, তেমন কিছু করেনা, তবে আঙ্গুল টানতে না দিলে একটু বাড়াবাড়ি করে।
- কি রকম বাড়াবাড়ি? রাগারাগি করে নাকি? বাচাগুলো কথা বলে নাকি?
- না রাগারাগি করেনা। কথাও বলেনা। স্বপ্ন হচ্ছে শব্দহীন জগত, কথা বললেও শুনতে পাওয়ার কথা না।

“ কি বাড়াবাড়ি করে সেটা বল তো বাবা? “ প্রতিমার উৎকন্ঠা বেড়েই চলেছে।

বেশ সহজ ভঙ্গিতে সঙ্কর চক্রবর্তী জবাব দেয় – “ বাড়াবাড়ি তেমন কিছু না, আঙ্গুল টানতে না পারলে বিভিন্ন
ভেক ধরে ভয় দেখায়। নানান জন্তু জানোয়ারের ভেক ধরে আসে ।“

“বল কি বাবা! আমার কিন্তু ভালো লাগছে না । তু মি সাইক্রায়টিস্ট দেখাও।“

রনতী হঠাৎ চোখ খুলে প্রশ্ন করলো – “ নানাভাই, বাচ্চাগুলা কি আমার মত দেখতে?”

সঙ্কর চক্রবর্তী উত্তর দিল – “ না নানাভাই, কেউ কি আর তোমার মত হতে পারে?”


রনতী তৃ প্তি নিয়ে আবার চোখ বন্ধ করলো। চোখ বন্ধ করে অন্যের কথা শোনা রনতীর কাছে একটা খেলা। এই
খেলা অবশ্য আমরাও খেলে থাকি। কখনো খুব খেয়াল করে আবার কখনো বেখেয়ালে অন্যের কথা শুনে বেড়াই।
আবার প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তা ছড়িয়ে বেড়াই। রনতী ছোট সে এখনো ছড়িয়ে বেড়ানো শিখতে পারে নি।

গরম পরোটা ভাজা হচ্ছে। পরোটা ভাজছে চৌধুরানী প্রতিমারা আসাতে সকাল সকাল উঠতে হয়েছে
তাকে। আবার বাড়তি মানুষের জন্য বাড়তি কাজও জুটেছে। সব মিলিয়ে চৌধুরানীর মেজাজ পাকিয়ে আছে।
চৌধুরানী আবার কারো ধার ধারেনা। মেজাজ চরমে উঠলে সমানে সবাইকে মেজাজ দেখিয়ে দেয়। তার ব্যবহারে
মাঝে মাঝে বোঝাই যায় না এ বাড়ির আসল কর্তা কে।

খাবার টেবিলকে এই মুহূর্তে একটা ছোটখাটো বৈঠকখানা বানিয়ে ফেলা হয়েছে। সঙ্কর চক্রবর্তী ছাড়া বাড়ির সবাই
এখানে উপস্থিত। সময়ে সময়ে পরোটা আর ভাজি সংকু লান হচ্ছে না বলে চৌধুরানীকে আসা-যাওয়ার মধ্যে
থাকতে হচ্ছে। বাকি সদস্যরা গোল টেবিল বৈঠকে প্রাণ সঞ্চার করছেন।এই গোল টেবিলের একমাত্র নিরুৎসাহিত
দর্শক হচ্ছে ‘আরস’ । কারণ গোল টেবিল বৈঠকের আলোচ্য বিষয় তার অপছন্দের। সে অপেক্ষা করছে। হুট
করে উঠে যাওয়া যায়না তাই অপেক্ষা করছে।

চৌধুরানী একটা একটা করে পরোটা আনছে। এতে অবশ্য সে নিজে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত। এই বিরক্তি বারবার
যাওয়া-আসার কারণে না। টেবিলে কি বিষয়ে কথা হচ্ছে সেটা শুনতে না পাওয়ার ক্ষোভ থেকে বিরক্তি জন্ম নিচ্ছে।
সেই বিরক্তি ক্রমেই তার মেজাজের উপর প্রভাব রেখে চলেছে।

রণবীর আর সৌরভ স্বস্ত্রীক পাশাপাশি বসেছে। রনতী তার বড় মামি অদিতির কাছে বসেছে। রনতীর নামটাও
অবশ্য অদিতির দেয়া। রনতীকে সবচেয়ে বেশি স্নেহ বুঝি অদিতিই করে। অদিতি যে মাতৃ স্নেহ পুষে রেখেছে তার
সবটা সে এখন রনতীকে ঢেলে দিচ্ছে। সম্ভবত রনতীও এটা বুঝতে পারে। তাই সেও বড় মামিকে ছাড়া কিচ্ছু
বোঝে না।

সৌরভ রণবীরকে উদ্দেশ্য করে বললো – “ এই পুরানো মডেলের বাড়ি রেখে লাভ নেই , বুঝলেন দাদা। আমার
এক পরিচিত ডেভলপার আছে কথা বলে রেখেছি। যদিও বাড়িটা বেশ ভিতরে তবুও জোর-জোর করে রাজি
করিয়েছি। এখন কাগজ পাতি হলেই কাজে হাত দেয়া যায়।“

রণবীর ‘কিন্তু’ বলে থেমে গেল। এই কিন্তুর একটা অর্থ আছে। রণবীর, প্রতিমা, আরস এতবড় হয়েছে কখনো এই
বাড়ির দলিল-দস্তাবেজ নিজ চোখে দেখেনি। কন দলিল আদৌ আছে কিনা এনিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে সবার মনে।
জীবনতলার মানুষজনের ধারণা সঙ্কর চক্রবর্তী দখল করে আছে ‘ঠাঁই’ নামের এই বাড়িটা।
আরস উঠে গেল। আলোচনা বিষয়বস্তু শেষ অবধি সম্পত্তি ভাগাভাগিতে গিয়ে গড়াবে এটা তার জানা। এই
বিশয়ে কন আগ্রহ নেই তার মাঝে।

আরস উঠে যাওয়াতে কেউ ভ্রূক্ষেপ করলো না।

সবাই এক অনিশ্চয়তা নিয়ে বসে রইলো। সেই অনিশ্চয়তার আগুনে ঘি ঢেলে দিচ্ছে সঙ্কর চক্রবর্তীর আচরণ।
সাধারণত এই বয়সে মানুষ যা করে সঙ্কর চক্রবর্তী তার কিছুই করছেন না। এই বয়সে সঙ্কর চক্রবর্তী মাঝে মাঝেই
দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে বসে পড়বেন। হাতের কাছে সন্তানদের পেলে ডেকে আবেগ নিয়ে বলবেন – “ এই যে
দলিলটা দেখছিস এটা ব্রিটিশ আমলের। আমাদের মিনাখানের জমিটার। ওটার বাম দিকটায় নতু ন সব বিল্ডিং
উঠছে। জায়গাটা বেদখল হয়ে যাচ্ছে । খোঁজ নিতে হবে। কিন্তু সঙ্কর চক্রবর্তী কখনোই এ বিষয়ে আগ্রহ দেখান না।
কথা উঠলে এড়িয়ে যান। কি যেন গোপন করতে চান। কি একটা তথ্য আছে যেন। যেটা তিনি নিশ্ছিদ্র কন ভল্টে
গোপন করে রেখেছেন।কারো সাধ্য নেই সেই ভল্টের সন্ধান পাওয়া।

জয়ন্ত সরাসরি সঙ্কর চক্রবর্তীর সামনে পড়েছে। বাড়ির বাইরে ‘টু -লেট’ লেখা ঝু লানো থাকায় জয়ন্তের
সুবিধাই হলো। অন্তত কথা শুরু করার একটা বিষয়বস্তু পাওয়া গেছে। এবার এই বাড়িতে থাকার একটা ব্যবস্থা
করলেই হয়।

সঙ্কর চক্রবর্তী এই বয়সেও সামনের গাছগুলোয় নিজে পানি দেয়। এটা তার প্রতিদিনের রুটিন।
মাঝেমাঝে কিছু গাছ অতিরিক্ত পানির বোঝা সইতে না পেরে ইহলোক ত্যাগ করে। তবুও সঙ্কর চক্রবর্তী তার
দৈনিক রুটিনের কাজটু কু করছিলেন। বাহিরে এক ছেলেকে দেখলেন। মাঝ বয়সি হবে। রণবীরের সমবয়সি হবে
হয়ত। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শান্তু মত চোখ বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে বোঝা যাচ্ছে। গেটের উপর দিয়ে উকি দিচ্ছে
সে। এই ছেলেটার নামই জয়ন্ত।

সঙ্কর চক্রবর্তী এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলেন – “কি চাই?”

জয়ন্ত উত্তর করলো প্রশ্ন দিয়ে – “বাসা ভাড়া হবে নাকি?”

- তা হবে, তা বিবাহ করেছো?


- জ্বি না, ব্যাচেলর। একটা কাজে জীবনতলায় আসা।
- দুইতলায় তিনটে ঘর আছে। আপনি একা মানুষ এত ঘর দিয়ে কি করবেন?
- আলাদা কোন ঘর নেই? সাথে একটা বাথরুম থাকলেই শুধু হয়।
- বাড়ি ভাড়া দেব বাড়ির প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য। এ বাড়ির সবাই জীবিত থেকেও মৃত । সবাই আছে
নিজেকে নিয়ে। এই জন্য পরিবারকে ভাড়া দিতে হবে।ব্যাচেলর ভাড়া দিলে বাড়ি আরো শুনশান হয়ে যাবে

- আপনার সমস্যা না থাকলে আমি তিনটা ঘরই ভাড়া নিতাম।ভাড়া আপনি যা চান।
- ভাড়া তো আসল বিষয় না।বাড়ি ভর্তি মানুষ থাকবে। কয়েকটা ছোট বাচ্চা-কাচ্চা ছোটাছুটি করবে। এর
কাছে ভাড়া কোন ব্যাপার না।
- ছাদের ঘরটা ভাড়া দেয়া যায় না?
- ওখানে তো বাথরুম নাই। এইএক সমস্যা ছাড়া ফাস্ট ক্লাস ঘর। নিচে বাগানের বাথরুম ব্যবহার করতে হবে।
- আমার কোন সমস্যা হবেনা। ( আনন্দে বেশ উৎফু ল্ল শোনালো জয়ন্তের কণ্ঠ। )
- তোমাকে আমার বেশ ভালো লেগেছে বলে ঘরটা দিচ্ছি। কেন ভালো লেগেছে বল তো?
- কেন?
- তোমার সাথে কথা বলে বহুদিন পর আরাম পেয়েছি। কথার মধ্যে কলকাতার টান নাই।
- জ্বি, আমি বাংলাদেশ থেকে আসছি।
- বলো কি? তু মি বাংলাদেশের? আমার পূর্বপুরুষরা অধিকাংশ কিন্তু বাংলাদেশে ছি। ৭১’এ আমি কলকাতা
চলে আসলাম। তারপর থেকে এখানে। সেইসব গল্প আর একদিন করা যাবে। আপাতত তু মি সেটেল হও।
উই হ্যাভ লট মোর টু টক অ্যাবাউট। বাংলাদেশি মানুষ পাওয়া গেছে বহুদিন বাদে।
- আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
- ধন্যবাদ দিতে হবেনা। তোমাকে আমার বেশ ভালো না দারুণ ভালো লেগেছে। এর আবার একটা প্রমাণও
আছে। কি প্রমাণ বলো তো?
- কি প্রমাণ?
- তোমার সাথে কথা শুরু করেছিলাম আপনি দিয়ে ভালো লাগার সাথে সাথে সম্বোধন পরিবর্ত ন হয়ে
তু মিতে চলে এসেছে… হা হা হা ……… এই ভালো লাগার পুরষ্কার হিসেবে এই বাড়িতে তোমার ‘ফু ল ফ্রি
স্কলারশিপ’ মানে থাকা-খাওয়া সব ফ্রি। শুধু বাগানের বাথরুম টা ব্যবহার করতে হবে হা হা হা …… ।
জয়ন্তও ও হাসলো, এমন সাবলীল হাসির সামনে না হেসে থাকা যায় না। সঙ্কর চক্রবর্তী চৌধুরানী কে ডেকে
ছাদের ঘরে জয়ন্ত কে নিয়ে যেতে বললো। হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত একজনকে বাড়িতে স্থান দেয়াটা চৌধুরানী পছন্দ
করলো না। মুখ বেজার করে সে জয়ন্ত কে ঘর পর্যন্ত রেখে এলো।

জয়ন্ত কে রেখে চৌধুরানী সোজা চলে গেল রণবীরের কাছে। রণবীর অফিসের জন্য বের হবে এমন সময়
চৌধুরানী উপস্থিত।

- বড় বাবু খানিক কথা ছিল।


- কি কথা বলে ফেল।
- বড় কর্তার মাথা পুরা খারাপ হয়া গেছে। ডাক্তার দেখান লাগবো ।
- এইসব বলতে এসেছিস?
- শখে তো বলতে আসি নাই। ঘটনা না গুরুতর বড়বাবু।
- কি হয়েছে? খুলে বল।
- বড় কর্তা এক হোমরা ব্যাটারে বাড়িত তু লছে। ছাদের ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা হইছে। বিপদের মইধ্যে আর
এক বিপদ।

চৌধুরানীর কথায় রণবীর তেমন গুরুত্ব দিল না। রণবীর মানুষটাই এমন। বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে ধৈর্যের যে
গুণটা থাকা দরকার তা রণবীরের আছে। হঠাৎ কোন বিষয়ে বিচলিত হয়ে পড়া রণবীরের স্বভাবসিদ্ধ কাজ নয়।
চৌধুরানী এমন নানা রকম অভিযোগ নিয়ে মাঝেমাঝেই আসে রণবীরের কাছে। এই যেমন কিছুদিন আগে
একবার এসেছিল। সেবার অভিযোগ ছিল প্রতিমার স্বামী সৌরভের বিরুদ্ধে।

- বড়বাবু, বইনের বিয়া দিয়া কি লাভ হইলো কন দেখি?

রণবীর বললো- “ কেন রে কি হলো আবার ?”

- দেখেন না কোন জামাই সব সময় ঘুরঘুর করে। এই সব কি ভালো দেখায়?


- মাঝেমাঝে যাওয়া আসা থাকা তো ভালো।
- যাওয়া-আসা থাকা ভালো তয় এত যাওয়া-আসা থাকা ভালো না। মানুষে নানান কথা কয়।
- মানুষ কি বলে?
- মানুষে কয় জামাইয়ের অন্য দিকে মনমতি
- অন্য দিকে মন-মতি মানে?
- বড় বাবু আপনি দেহি হাছাই সাদা মনের মানুষ। কিচ্ছু বোঝেন না। জামাইয়ের মন-মতি এই বাড়ির সহায়-
সম্পত্তির উপর। বেবাকে বোঝে খালি আপনি বোঝেন না।

চৌধুরানীর এই অভিযোগ একেবারে মিথ্যা নয়। চক্রবর্তী পরিবারের সম্পত্তির দিকে সৌরভের চোখ টানা আছে
সেটা মোটামুটি সবার জানা। কিন্তু এত অল্পতে হইচই করার মত ছেলে রণবীর নয়। চৌধুরানীর অভিযোগ হেসে
উড়িয়ে দিলেও ঠিক পদক্ষেপটাই সে নিবে সময় মত।

রণবীরের কাছে সুবিধা করতে না পেরে চৌধুরানী একে একে অদিতি, প্রতিমা, সৌরভ, আরস সবার কাছে
খবরটা বেশ দায়িত্ব নিয়ে পৌঁছে দিল। অদিতি আর প্রতিমা রান্না ঘরে ছিল। তাদের দুজনকে একসাথে জানানো
হয়েছে। তেমন কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। সৌরভও যত সামান্য প্রতিক্রিয়া দেখালেও সে সবচেয়ে চিন্তিত।
তার ইচ্ছা ছিল নিজেই গিয়ে জয়ন্তের সাথে দেখা করে আসে। কিন্তু বাড়ির জামাই বলে আগ বাড়িয়ে নাক গলানোর
মত কাজ করা যাচ্ছেনা।

আরসের কাছে গিয়ে চৌধুরানী বেশ ভালো সাড়া পেয়েছে। আরসকে চৌধুরানী বলেছে – “ ছোট বাবু
বিপদের মইধ্যে আর এক বিপদ হইছে।“

আরস চোখ বড় বড় করে বলেছে – “ কি হয়েছে বল তো ?”

“বড় কর্তা এক ব্যাটারে থাকতে দিছে। ছাদের ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা।“

“ বলিস কি? তাহলে তো দারুণ বিপদ।“ – আরস মহা আশ্চর্যবোধক মার্কা মুখ করে বললো।

আরসের এমন মুখভঙ্গি যে কৃ ত্রিম তা চৌধুরানী বুঝতে পারলো না। ছোট কর্তা তার কথা খুব গুরুত্ব সহকারে
শুনছে মনে করে চৌধুরানীর উৎসাহ ক্রমবর্ধমান রেখেই বললো – “ বিপদের আর কি বাকি আছে ছোট কর্তা?,
চোর-ছ্যাঁচড়ের মত চেহারা। একবার যদি চোক্ষে দেখতেন।“

নিজ চোখে দেখার জন্য আরস সর্বপ্রথম ছাদে গেল। তার হাতে একটা মুখোশ। মুখোশ দিয়ে সে কি করবে
বোঝা যাচ্ছেনা।

জয়ন্ত ঘর গোছাচ্ছিল । এই ঘরে প্রচু র আলো-বাতাস খেললেও তার সাথে পাল্লা দিয়ে ইদুর তেলাপোকাও
খেলছে। হঠাৎ মুখোশ পরা এক ছেলে দরজায় দাঁড়ালো । বেশ বিদঘুটে মুখোশ। মুখোশ পরা মানুষটি আন্তরিকতার
ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো – “ আপনার নামটা জানতে পারি?”
হঠাৎ মুখোশ দেখে জয়ন্ত হকচকিয়ে গেছে। মুখ থেকে কথা সরছে না। স্বাভাবিক হওয়ার আগেই আরস মুখোশ
খুলে ফেললো। হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো – “ আমি আরস। এই বাড়ির ছোট ছেলে। আপনার নাম?”

জয়ন্ত হাত প্যান্টে মুছে হাত বাড়িয়ে বললো – “ আমি জয়ন্ত ।“

- মুখোশ দেখে ভয় পেয়েছিলেন নাকি ?


- ঠিক ভয় না। অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম।
- আমাদের সবার মুখেই কিন্তু অদৃশ্য মুখোশ ঝু লছে। সে মুখোশ আমরা দেখতে পাইনা। তাই আমাদের
সমস্যাও হয়না। মাঝে মাঝে মানুষের এই অদৃশ্য মুখোশ আমাদের সামনে আসে । তখন আমরা অপ্রস্তুত
হয়ে পড়ি।

আরসের কথা শুনে জয়ন্তের হাততালি দিতে ইচ্ছা করছে। সে এই মাত্র দারুণ কিছু কথা বলেছে। আমাদের সবার
সামনেই মুখোশ ঝু লছে। জয়ন্ত ভাবছে তার নিজের মুখোশটার কথা। এই মুখোশ টা সামনে আসতে কতদিন
লাগবে? জয়ন্ত চাইলে আজকেই আনা যায়। সে চাইলে সারাজীবন ধরে রাখতে পারে। কিন্তু জয়ন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই
এসেছে। এবার মুখোশ টা খুলে ফেলবে। এই মুখোশে দিন দিন দম আটকে আসছে তার। আবার এত শক্ত একটা
মুখোশ হুট করেও খোলা যায়না। তাকে সময় নিতে হবে। এই সময়টু কু নিতে হবে এই বাড়ির মানুষগুলোর কারণে।
জয়ন্ত মুখোশের ভিতর বাহির দুই রুপই জানে। তার মানিয়ে নিতে হয়তো সময় লাগবে না। কিন্তু এই বাড়ির সবাই
কি হঠাৎ করে মেনে নিতে পারবে?

বাড়িতে নতু ন একজন এসেছে। একথা মোটামুটি সবার কানে পৌঁছে গেছে। চৌধুরানী পারলে সারা পাড়া
জানিয়ে দিত। নেহাত সে সুযোগ নেই বলে চক্রবর্তী পরিবারের এই নতু ন সদস্য সংযোজন সম্পর্কে সবাই অন্ধকারে
রইলো। চক্রবর্তী পরিবারের সদস্যরা যে অন্ধকারে নেই সে কথা বলা যাচ্ছে না। শুধু মাত্র আরস সেই নতু ন সদস্যের
সাথে দেখা করেছে এবং তার নাম জানে। স্বয়ং সঙ্কর চক্রবর্তী তার নাম জানেনা । নাম না জানা একজনের জন্য
সঙ্কর চক্রবর্তী বাড়ি “ ফু ল ফ্রি স্কলারশিপ “ ঘোষণা করেছে। এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এসেছে কিছুক্ষণ আগে।
ঘোষণা দেয়ার সময় সঙ্কর চক্রবর্তী লক্ষ্য করেছেন ছেলেটার নাম শোনা হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তিনি এড়িয়ে
গেছেন। এটি বয়স বৃদ্ধির লক্ষণ।

ঘোষণায় বলা হয়েছে – “ আমাদের মৃতপ্রায় এই বাড়িতে নারায়ণ উপস্থিত হয়েছেন। নারায়ন মানে
অতিথি। অতিথি মানেই নারায়ণ। ছাদের ঘরে তার থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। তিনি গুরু দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশ
একে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন। দায়িত্ব সম্পন্ন করে তিনি চলে যাবেন। এই ভিনদেশী অতিথির সার্বিক সুযোগ-সুবিধার
প্রতি লক্ষ্য রাখা আমাদের একান্ত কর্ত ব্য। “

ঘোষণাটি দেয়া হয়েছে বাড়ির নারী সদস্যদের সামনে। পুরুষ সদস্যের মধ্যে সৌরভ উপস্থিত ছিল। ঘোষণাটি কারোই
ভাল লাগেনি। কেউ বিরক্তি প্রকাশ না করলেও সুপ্রিয়া করেছেন। সঙ্কর চক্রবর্তী সেই বিরক্তিকে পাত্তা দেন নি।
ঘোষণা দেয়ার সময় তার চোখ জ্বলজ্বল করছিলো। তার কতদিনের শখ বাংলাদেশে যাবেন। ওপারে বাপ-দাদারা
নেই।বাপ-দাদার ভিটেগুলো দেখবেন। সেই যে ৭১’এ চলে আসলেন আর যাওয়া হলো না। এবার যদি এই ছেলের
হাত ধরে যাওয়া যায়। শেষ বয়সে এসে বাপ-দাদার বাস্তুভিটা দেখতে চাওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু বাস্তু ভিটার চেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ যে সম্পদ, যে আবেগ সঙ্কর চক্রবর্তী ফেলে এসেছেন তা ফেলে এতটা দিন কিভাবে থাকলেন তিনি? এই
প্রশ্ন নিজেকে করে উত্তর পান না সঙ্কর চক্রবরতি।এবার যদি একটা উত্তর পাওয়া যায়!

সকাল সকাল দিশাদের বাসার সামনে ছোট ছেলেমেয়েদের ভিড়। এদের প্রতিদিন সকালেই দেখা যায়। দিশা সকালে
এক ঘন্টা করে তাদের পড়ায়। নিজ স্বার্থ, সময় ব্যয় করে এমনটা এখনকার সময়ে দেখা যায়না। এজন্যই
আশপাশের মানুষজন দিশার প্রশংসায় মুখর। কিন্তু নিজ ঘরেই সামান্য উৎসাহ পায়না দিশা। উল্টা কাকা-কাকীদের
কাছে কথা শুনতে হয় রোজ। তবুও দিশা কাজটা করবেই। কারণ তার ভালো লাগে।

ছোট থেকে কাকা-কাকীর সংসারে বড় হয়েছে দিশা। বাবা-মার চেহারা ঠিকঠাক মনেও নেই তার। বাবা-মা
থাকলে জীবন কেমন হতো, সে নিয়ে খুব একটা ভাবে না দিশা। বরং বাবা-মা না থাকতে জীবনটা কেমন সেটা
মেনে নিয়েই বেঁচে আছে সে। কাকা-কাকীর বঞ্চনা সেই শৈশব থেকে দিশাকে একটা শিক্ষা দিয়েছে। সব কথা গায়ে
মাখলে চলে না। আর এই একটা শিক্ষাই দিশাকে নতু ন জীবন দিয়েছে। ফু রফু রে মেজাজের আবহ লেগেই থাকে
দিশার চোখে মুখে। খুব ভারি অপমান খিলখিল করে উড়িয়ে দেয়ার অসামান্য ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে এই মেয়ে।

পাটি আর চাটাই বিছিয়ে দিশা বাচ্চাগুলোর বসার ব্যবস্থা করেছে। এদেরকে শিক্ষা দেয়া হয় অভিনব পদ্ধতিতে।
আজকে শিক্ষার মুল বিষয় নিয়মানুবর্তি তা । সময় মত নিয়ম মেনে কোন কাজ করাই হচ্ছে নিয়মানুবর্তি তার মূল
বিষয় এটা সবাইকে গতদিন বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। নিয়মানুবর্তি তার অংশ হিসেবে আজকে সবাইকে সময় মত
আসতে হবে। তাই সবাই বেশ আগে ভাগে চলে এসেছে। এরা সবাই এই এলাকাতেই থাকে। দৈন্য-দশার কারণে
স্কু ল যেতে পারেনা। কিন্তু খুব আগ্রহ নিয়ে শিখতএ আসে এখানে।
দিশা পড়ানো শুরু করবে। সে তার ব্ল্যাকবোর্ডে বড় করে ‘ নিয়মানুবর্তি তা’ লিখল। সবাই রীতিমত হইচই করে
যাচ্ছে। দিশা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো- “ আজকের মূল বিষয় কি বলো তো ।“ একজন হাত তু ললো ।এর
নাম ‘পাকা পেপে’। পাকা পাকা কথার জন্য এর বিশেষ স্থান আছে। পাকা পাকা কথা বলেও তার আবার অনেক
গুন। সব মিলিয়ে নাম হয়েছে ‘পাকা পেপে’। দিশা ইশারা করলে পাকা পেপে কথা বলা শুরু করলো – “ আপা
লেখাটা হালকা ট্যারা হইচ্ছে। আজকের বিষয় হইতেছে নিয়ম মানা নিয়া। নিয়মের মধ্যে ট্যারা ভ্যাকা থাকলে তো
সমস্যা।“

দিশা হাসলো। পাকা পেপের পাকা কথা ।শিক্ষার্থীদের মধ্যে আর একজন হচ্ছে ‘দেগোল মাথা’। এই নাম
নিয়ে কম কৌতু ক হয়নি। কিন্তু কি কারণে এই নামকরণ সে কথা স্পষ্ট নয়। ‘দেগোল মাথা’ বলতে আসলে কি
রকম মাথা বোঝানো হয় সেটা জানা গেলে হয়ত মিলিয়ে দেখা যেত। সে যাই হোক, এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘পাকা
পেপে’ আর ‘দেগোল মাথা’ মোটামুটি নেতৃ স্থানীয়। একজন পক্ষে কথা বললে অন্যজন বিপক্ষে কথা বলবেই। এই
মুহূর্তে ‘পাকা পেপে’ যে কথা বলেছে তার প্রতিউত্তর না করা পর্যন্ত ‘দেগোল মাথা’র শান্তি নেই। তাই সে হাত
তু লে দাঁড়িয়ে নিজের কথা তু লে ধরলো – “ আপা, আমার মনে হচ্ছে লেখা ঠিকই আছে। যে বলেছে ট্যারা লেখা
তার চোখেই হালকা ট্যারা রোগ আছে।“

এরা পরস্পর বিরোধী কথা বললেও সারাদিন এদের আলাদা করা মুশকিল। দিশার এই শিক্ষা কার্যক্রম
অবৈতনিক হলেও বাচাগুলো দিশাকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে। এই সাহায্য চাইতে গিয়ে দিশা মাঝে মাঝে এদের
‘পাকাপেপে’ জাতীয় নাম উচ্চারণ করলে কৌতু কের চু ড়ান্ত হয়। দিশা পারত পক্ষে এসব নামে ডাকে না। তবু মুখ
ফসকে বেরিয়ে গেলে বিপদ ঘটে। সবার হাসি থামানোর জন্য তখন সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়।

দিশার বাচ্চাগুলোর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। এই সাহায্যের সবটা জুড়েই আছে একটা মানুষের খোঁজ-
খবর নেয়া। দিশা হচ্ছে সেই দ্বিতীয়জন যে আরসের জন্য সর্বক্ষণ চিন্তা যুক্ত থাকে। আরস মাঝে মাঝে লাপাত্তা হয়,
দিশার চিন্তার বলীরেখা গভীর হয়। শুধু শুধু একটা মানুষের জন্য চিন্তা করা মানেই সেই মানুষটার সাথে জড়িয়ে
যাওয়া। সেই মানুষটার প্রতিটা মুহূর্তে র সাথে জড়িয়ে যাওয়া। কোন কারণ নেই, তবুও আমরা জড়িয়ে থাকতে
ভালোবাসি। যেমন দিশা আরস কে জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে থাকতে তার ভালো লাগে।

এই ভালো লাগা বেশ পুরানো। দিশা তখন মাধ্যমিকে। সবে অষ্টম শ্রেণী পাস করেছে। নবম শ্রেণীতে
শুরুতেই ক্লাসের সবাই টিউশন ঠিক করে ফেললো। জানুয়ারি মাস যায় যায় অবস্থা। দিশা কাকীকে বলে যাচ্ছে
একটা গণিত টিউশন অন্তত দরকার। কাকী কানে তু লছে না। দিশা প্রতিদিন হাসিমুখে কাকীর ধমক খাচ্ছে। নানান
কাজ করে কাকীর মন পাওয়ার চেষ্টা করছে। একবার তিনদিনে একটা কাথা সেলাই করে দিল। তারপর অনুনয়
করে বললো – “ কাকী, কাকাকে বলছো আমার কথাটা? একটাবার বলে দাও না। তোমার দোহাই লাগে।“

বিনিময়ে কাকী কথাটা কাকার কান পর্যন্ত দিয়েছিল। তবে সুপারিশের স্বরে নয়। বরং শুনে মনে হতে পারে কোন
অভিযোগ করছেন।

সেই রাতে দিশা অপমান উড়িয়ে দিতে পারে নি। অপমান, অভিমান হয়ে ধরা দিয়েছিল। বাবা -মার উপর
অভিমান। এ পার্থিব জগতে এ ধরনের অভিমান কাউকে বলা যায় না। এ অভিমানের একমাত্র ভাষা 'অশ্রু'।
দিশা সেই ভাষার আশ্রয়ে সারারাত কাটিয়ে দিল।

সকালে হাসি হাসি মুখ করে দিশা তার বন্ধু দের জানিয়ে দিল তার টিউশনি পড়া হচ্ছে না, কাকা রাজি হয় নি। সে
এমন ভাবে কথাটা বলল, যেন সে আনন্দের কোন কথা বলছে। এই যে তার চোখে জল, এটাও যেন আনন্দের!
পরদিন দিশার বন্ধু তাকে অবাক করা তথ্যা জানালো যে দাদার কাছে সবাই পড়ছে সেই দাদা দিশাকে তার সাথে
দেখা করতে বলেছেন। দিশার ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল। এতটা অসহায় তার নিজেকে কখনোই মনে হয় নি।
তাহলে কি দিশাদের বাড়ির টানাপোড়নের কথা তার বন্ধু দাদাকে বলে দিল? দিশার মাথাটা যেন নুইয়ে গেল।
নিজেকে এতোটা নগন্য মনে হতে লাগল যেন সে পৃথিবীর সবচেয়ে অবান্ঞ্চিত কেউ।

রাতে দিশা অনেক ভাবল। তাতে আনন্দ-লজ্জা মিশ্রিত এক অনুভু তি হলো। যাওয়াটা কি ঠিক হবে? আর কত
ছোট হতে হবে সবার কাছে! তবে এই লজ্জা ও হীনতার মাঝেও কোথাও যেন একটু আনন্দ মিশ্রিত আছে! এই
আনন্দ টু কু কোথা থেকে আসছে! সেই আনন্দের উৎসের সন্ধান করতেই হয়।

শেষমেশ আনন্দের কাছে যাবতীয় লজ্জা আর হীনমন্যতা হার মানলো। দিশা সিদ্ধান্ত নিল যে সে যাবে। কে কি
আর বলবে তাতে! অপমান তো আর করবে না! আর করলেও বা কি! অপমান ঝেড়ে ফেলার জন্য হাসি আছে
দিশার। ভু বন ভোলানো হাসি।

তারপরদিন আরসের সঙ্গে দেখা হলো দিশার। আরস সবে স্নাতক শুরু করেছে। আরস দিশাকে জিগ্যেস করলো
-" তোমার নাম কি দিশা?"

- "জ্বী"।

-"তু মি চাইলে আজ থেকেই এখানে পড়তে পারো তকে একটা শর্ত আছে।"
শর্তে র কথা শুনে দিশার উৎসাহের সবটু কু দমে গেল। কোন শর্ত রক্ষা করার মতন ক্ষমতা যে তার নেই! দিশার
মুখে কোন কথা সরছে না দেখে আরস বললো-"তু মিভয় পাচ্ছো নাকি? "

এই কথা বলে আরস হাসতে লাগল। দিশা দেখলো এই লোকটাও তার মতন হাসতে পারে। হাসি থামিয়ে আরস
আবার বলল, "ভয়ের কিছু নেই! কোন কঠিন শর্ত দেব না। শুধু একটা চেইন রিএকশান জারি রাখতে হবে। "

দিশা মৃদু স্বরে বলল-" কি চেইন রিঅ্যাকশন ?"

-"তোমাকে কয়েকটা বাচ্চা পড়াতে হবে। তু মি আমার কাছে বিনা টাকায় পড়বে আর বাচ্চাগুলোকে পড়াবে। ক্লাস
ওয়ান-টু র বাচ্চাদের পড়াতে পারবে না? "

-"পারবো। "

-"তোমার এখনই পড়াতে হবে না আরও বড় হও। সময় সুযোগ অনুযায়ী পড়াবে। কিন্তু পড়াতেই হবে। "

দিশার মনটা হালকা হতে শুরু করলো। শুধু বিনাটাকায় পড়াবে একথাটা সবার সামনে না বললে কি হতো না?
এই সামন্য অভিমানটু কু চোখ বন্ধ করে ভু লে গেল দিশা। তার সামনের এই মানুষটাতে দেবতার মতন মনে হতে
লাগল দিশার। দেবতাদের কাছে পার্থিব অনুভূ তি মূল্যহীন।

দিশা অবৈতনীক শিক্ষার চেইন রিএকশন ধরে রেখেছে। আর ধরে রেখেছে আরসের প্রতি ভাল লাগা। ভাল লগা
দীর্ঘদিন পুষে রাখলে ভালবাসার রুপ নেয়। দিশান ক্ষেত্রে তাই হলো। ততদিনে মাধ্যমিক পেরিয়ে গেছে। আরসের
সাথে আর দেখা হয় না। সারাটাদিন ছটফট করে কাটে দিশার। উচ্চ মাধ্যমিকের বইয়ের পাতায় পাতায় আদিশা
আদিশা লিখে।

ভরিয়ে ফেলল দিশা। একদিন কাকী তাকে জিগ্যাসা করলো -"বইয়ে এসব কি লিখেছিস? "

-"কিছু না কাকী।"

-"আদিশা মানে কি? "

-"কিছু না কাকী।"

তার কাকী সন্দেহের দৃস্টিতে তাকায় তার দিকে। দিশার ভেতরটা কেমন করে উঠে। দিশা আর 'আদিশা' লেখে না।
এখন লেখে 'আদি'। আরস-দিশান সংক্ষিপ্ত রুপ। দিশা এভাবেই তার ভালবাসা আড়াল করে রেখেছিল।
এমনকি আরসের কাছেও প্রকাশ করার সাহস করে নি। কাছের মানুষ গুলোই সারজীবন দিশার কাছ থেকে দুরে
চলে গিয়েছে। অবহেলার সংজ্ঞা শিখিয়েছে। আরস এমনিতেই ছন্নছাড়া মানুষের মতন জীবনযাপন করে।
দিশারর মনে হয়েছিল আরসের কাছেও অবহেলা পাবে সে। কিন্তু বিপরীত ঘটনাই ঘটেছে। দিশা অবাক হয়ে লক্ষ্য
করেছে, তার সাথে আরসের অদ্ভু দ মিল গুলো। কেউ তাদের নিয়ে ভাবে না আর তারাও অন্যের বিষয় নিয়ে
আগ্রহ দেখায় না

আরস নিজের মতন ঘুরে বেড়ায়। অনেকটা বাউন্ডু লে মানুষের মতন। অথচ ছেলেটার পরিবার আছে। বাবা-মা,
ভাই-বোন সবাই আছে। কেউ তার খোঁজ রাখছে না। দিশা এই মানুষটার খোঁজ রাখা শুরু করলো। কখন
কোথায় আছে, ঠিকমতন খাচ্ছে কি না এই সব। আরসও ঠিক থাকে না। একটা মেয়ের পক্ষে একটা ছেলের
খোঁজ রাখা সম্ভব না। এই জন্যই দিশা "পাকা পেঁপে" আর "দেগোল মাথা" দের সাহায্য নিতে থাকে। সাহায্য
করতে করতে বাচ্চাগুলো একটা বড় সাহায্য করে বসলো। যদিও এ সাহায্যটা সম্পুর্ন অযাচিত ছিল, তবুও এ
সাহায্যটার বড় দরকার ছিল দিশার।

তখন আরস এক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট টিমের সাথে নানা জায়গা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ এখানে তো কাল ওখানে।
এই টিম আবার বিয়ের কাজ করে বেশী। খাওয়া দাওয়ার সমস্যা হবার কথা না। তবুও দিশা না খেয়ে ঘুমাতে যায়-
কি জানি সে খেয়েছে কি না!

অদ্ভু দ এক উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটাতে কাটাতে দিশা এখন ক্লান্ত। আরসের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। একদিন
দুইদিন না। পুরো একটা মাস, একটা মানুষের ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই দিশা আরসের বাড়ি পর্যন্ত গেল।
বাড়িতে গিয়েও তার কোন হদিস পাওয়া গেল না। উল্টো সংকর চক্রবর্তীর বাঁকা চোখের সম্মুখীন হতে হলো।
আরসের মা সুপ্রিয়া দিশার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। একমাত্র ছেলের জন্য মায়ের বুক হুহু করে। দিশার সামনে প্রায়
কেঁ দে ফেলেছিলেন সুপ্রিয়া। দিশারও ইচ্ছে করছিল তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। তারা যে একই মানুষের জন্যে
কষ্টে আছেন।

এরজন্য অবশ্য কাউকে অভিযোগ করারও কিছু নেই। যে মানুষটার জননয এতোকিছু তারই তো ভ্রুক্ষেপ নেই!.
দিশা সিদ্ধান্ত নিল, এবার সে ফিরলে সোজা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। তারপর শাষণের সুরে বলবে-" আপনি
এভাবে উধাও হবেন না তো! আমার ভাল লাগে না। আপনি এতোদিন কি ঠিকমতন খাওয়া দাওয়া করেছেন?
জানেন আপনার জন্য কতরাত আমি না খেয়ে ঘুমিয়েছি! "
এজন্য ক্ষু দে গোয়ান্দাদের মতন দায়িত্ব দেয়া হলো "পাকা-পেপে" আর "দেগোল মাথা"-কে। খুব সোজা দায়িত্ব-
আরসের ছায়াও দেখলে দৌড়ে দিশাকে জানাতে হবে। তার মাস দেড়েক পর, ছায়াশুদ্ধ আরসকে দেখা গেল
জীবনতলায়। যখন থেকে আরস বেড়িয়েছে, সেই তখন থেকে দুইটা বাচ্চা তার পিছু নিয়েছে। ছোট বাচ্চা বলে
পাত্তা দিতে চায় নি। কিন্তু পরে দেখা গেল, এরা সত্যিই পিছু ছাড়ছে না। আরসের সঙ্গে ছায়ার মতন সব জায়গায়
যাচ্ছে। আরস চু ল কাটাতে গেল, সেখানেও দেখা গেল বাচ্চা দুইটা পেপার পড়ার ভান করে বের হয়ে আসল।
আবার আরস চা খেতে গেল, এরাও দেখি চা খেতে গেল! পিরিচে ঢেলে একটা চা দুজনে ভাগ করে খেল।
আরস তাদের কাছে ডাকল। তার ধারণা ছিল, কাছে ডাকলে বাচ্চা দুটো ঘাবড়ে যাবে। কিন্তু এরা ঘাবড়ালো না।
কধা বলার ভঙ্গিও বেশ সহজ। কোন জড়তা বা ভয় নেই তাদের মধ্যে। জিগ্যেস করলো -"তোমরা আমার পিছন
পিছন ঘুরছো কেন?"

দেগোল মাথা জবাব দিল-"আপায় কাজ দিছে, আপনার ছায়া দেখা মাত্র তারে জানাতে হবে। "

-"এই আপাটা কে? "

এবারে পাকা পেপে মুখ খুলল-"আপনের জন্য একজন সারাটাদিন মনোঃকষ্টে থাকে। আর আপনে তারে চিনলেন
না। এমনই হয়। এই জগতের নিয়ম। আরস ধাক্কার মত খেল। এই বাচ্চাগুলো তো দার্শনিকের মত কথা বলে।

আরস আবার প্রশ্ন করলো – “ কে আমার জন্যে মনোঃকষ্টে থাকে?”

- “পরিচয় বলা যাবেনা। গোপনীয়তা আছে। বলা যাবে তবে শর্ত আছে।“ – দুজনে একসাথে জবাব দিল।
- কি শর্ত ?
- সুন্দর ভাষায় একটা চিঠি লেখেন। যাতে আমাদের আপার মন ভালো হয়। তার ভীষণ দুঃখ।
- আচ্ছা, আমি চিঠি লিখে দিব। তোমার আপার নাম বলো।
- নাম দিশা। আপনে তারে চেনেন।

আরসের মনে পড়েছে। এই মেয়েকে মাধ্যমিকে পড়িয়েছে সে।

আরস বললো – “তোমাদের আপা কি আমার সাথে দেখা করবে?”

- চিঠিতে লেইখা দেন। করতে পারে।

চায়ের দোকানে বসেই আরস চিঠি লিখলো।


“দিবা,

তোমার সাথে অনেকদিন বাদে যোগাযোগ হচ্ছে ভেবে ভালো লাগছে। তু মি আমার কারণে সারাক্ষণ
মনোঃকষ্টে থাকো। মনোঃকষ্ট নিয়ে ভালো থাকা যায় না। সুতরাং এই কথা শোনার পর কেমন আছো জাতীয় প্রশ্ন
করা অমূলক।

তোমার ছোট্ট দুই স্পাই এর সাথে দেখা। তারা বেশ দায়িত্ব নিয়ে আমার পিছে দিনের অর্ধভাগ ব্যয় করেছে।
যদিও আমি দ্রুত বুঝতে পেরে গেছি। ভবিষ্যতে তাদের আরো সাবধান হতে বলবে। আমাকে নিয়ে তোমার
উৎকণ্ঠার কারণ বুঝতে পারি নি। শুধু শুধু আমাকে নিয়ে চিন্তার কোন কারণ দেখিনা।

তোমার দুই স্পাইয়ের অনুরোধে এই চিঠি লিখছি। তাদের ধারণা এতে তোমার মনোঃকষ্ট দূর হবে, তু মি
ভালো থাকবে। ভালো থাকো এই আমার চাওয়া। এই চাওয়া সার্বক্ষণিক করার জন্য তোমার সাথে দেখা করা
প্রয়োজন। তু মি কি আমার সাথে দেখা করবে? “

প্রশ্নবোধক দিয়ে শেষ করা একটা চিঠি দুই স্পাই দিশার হাতে তু লে দিল। দিশা অবাক হয়ে চিঠি হাতে নি। চিঠি পড়ে
সে আরো অবাক হলো। অবিকল একই হাতে লেখা। মানুষটা দেখা করতে চায়।কি অদ্ভু দ ভাবে দিশা লজ্জায় ডু বে
গেল। একবার মনে হলো পাকামির শাস্তি দেয়া উচিত শয়তান দুইটাকে। কিন্তু মনে আনন্দ ধরে রেখে কাউকে শাস্তি
দেয়া যায় না। আর আনন্দের উপলক্ষ্যটাও তো দিয়েছে ঐ দুজনই। তাদের বরং পুরস্কৃ ত করা যায়।

স্বপ্নের ঘোরে নিজেকে হালকা মনে হয়। দিশারও একই অনুভূ তি হচ্ছে। ঘোর কাটতেই দিশা আরসের সাথে
দেখা করলো। দিশার চোখ ছলছল করে উঠল। কাউকে কিছু বলতে হলো না। তবুও যেন সব কথা বলা হয়ে
গেল। কোন ভাষায় বলা হল তা বোঝা গেলনা। শুধু আরস আর দিশা সে ভাষা জানে।

জয়ন্ত চক্রবর্তী পরিবারের সাথে বেশ ভালোই গেথে গেছে। সবাই তার খোঁজ খবর রাখছে নিয়মিত। খাবার সময়
হলে চৌধুরানী ডাকতে আসে। সবাই একসাথে খেতে বসে । খাবার টেবিলে নানান বিষয়ে কথা হয়। আহ, কি সুন্দর
দৃশ্য। শুধু বাড়ির ছোট ছেলে আরস একসাথে খেতে আসেনা। এইসুন্দর দৃশ্য থেকে সে বঞ্চিত হয়।
আমাদের সামনে অদ্ভু দ সুন্দর কিছু দৃশ্য দীর্ঘকাল ধরে রাখলে তার উপযোগ আস্তে আস্তে কমতে থাকে।
আরসের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। অথচ জয়ন্তের কাছে এটাই স্বর্গের একটা খন্ডচিত্র।

সকালে জয়ন্ত খালি গায়ে ছাদে ঘোরাফেরা করে। এটা আবার চৌধুরানীর ভালো লাগে না। তার মনে হয়
জয়ন্ত বাড়িওয়ালা বাড়িওয়ালা ভাব ধরে থাকে। এ বিষয়ে সে ইতোমধ্যে রণবীর, অদিতি ও আরসকে অভিযোগ
করেছে। এখন এসেছে খোদ সঙ্কর চক্রবর্তীকে বিষয় টা জানাতে।

- বড় কর্তা খানিক কথা ছিল।

সঙ্কর চক্রবর্তী বাগানে পানি দিচ্ছিলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন – “ খুব জরুরি কিছু ?”

- হ, বড় কর্তা। অতিব জরুরী।


- বল, আমি শুনছি।
- ছাদে যে ব্যাটায় থাকে ওরে খানিক সন্দেহ হয়।
- সন্দেহের কারণ কি?
- তেমন কিছু না, ব্যাটায় সারাদিন ঘরের মইধ্যে কি যে করে। খাইতে ডাকতে যাই। গেট খুলে না। ভিতর
থাইকা জবাব দেয়। আমি ভেন্টিলেটর দিয়া দেখছি ব্যাটায় কি সব কাগজ পাতি নিয়া সারাদিন বসি থাকে।
- ভেন্টিলেটর দিয়ে দেখা কি ধরনের ভদ্রতা?
- ভদ্রতার কথা চিন্তা করি নাই বড় কর্তা। মনে বিগাড় উঠছিলো তাই দেখছি। সন্দেহ হইলো তাই
জানাইলাম।
- একজন মানুষ অফিসের কাজে এসেছে।কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করছে।এখানে সন্দেহের কি দেখলি। থাপ্পড়
খাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

চৌধুরানী কাতর কন্ঠে বলল – “ চ্যাতেন ক্যান? আমার মনে ডাকছে তাই বলছি। মনে কইলো ব্যাটায় অন্য কোন
কামে আসছে।“

সঙ্কর চক্রবর্তীকে আর কোন বাক্য ব্যয় করতে হলো না। তার অগ্নিদৃষ্টিতেই কাজ হলো। চৌধুরানী চলে
গেল। সঙ্কর চক্রবর্তী ছাদের দিকে তাকালেন।জয়ন্তকে দেখা যাচ্ছে।

- বাবা কেমন আছো?


সঙ্কর চক্রবর্তী ছাদে এসেছেন জয়ন্ত লক্ষ্য করে নি। সে পিছন ফিরে জবাব দিল – “জ্বি ভালো আছি। আপনি
কেমন আছেন।“

- আমি আছি এক রকম। তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?


- না,না কোন অসুবিধা হচ্ছে না। মাঝখান থেকে আপনাদের কষ্ট দিচ্ছি।
- কষ্টের কিছু নেই। তু মি আছো আমার ভালো লাগছে। জীবনে ভালো লাগাটাই হচ্ছে আসল বিষয়। ভালো
না লাগা রোগ একবার ধরলেই সমস্যা। তু মি বিয়ে কর নি কেন?
- বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি।

You might also like