Professional Documents
Culture Documents
RAJNAGAR: A Study On Amiabhushan
RAJNAGAR: A Study On Amiabhushan
ভাবলে অবাক হতে হয়, যখন দেখি, যেসব সাহিত্যসত্য তিনি বহুপূর্বে বলে গেছেন, সেটার
প্রতিধ্বনি করছেন সাম্প্রতিক নোবেলবিজয়ী লেখকগণও। অধুনা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত
লেখক মারিও বার্গাস ইয়োসা যখন তাঁর নোবেল-ভাষণে বলেন, ‘আমার জন্য সাহিত্য হয়ে উঠল
দৈব-দুর্বিপাক ঠেকানোর পন্থা, প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের হাতিয়ার, অসহনীয়তা থেকে পলায়নের পথ
এবং আমার বেঁচে থাকার যৌক্তিকতা’, তখন সেইসব মর্মার্থ কি বেশ আগেভাগ আমরা জেনে
যাই না অমিয়ভূষণের সাহিত্যভাবনার বদৌলতে? মিলিয়ে নেওয়ার স্বার্থে এবার উদ্ধার করা যাক
অমিয়ভূষণের বহুমূল্য সাহিত্যচিন্তা, ‘জীবন আমাকে জাগিয়ে রেখেছে এবং জাগতে আমার ভালো
লাগছে না। এই জাগরণে আমার বৃদ্ধি নেই... আমি ঐ পার্টিকুলার ধরনের এস্কেপ চাচ্ছি। মায়ের
জঠরে যে এস্কেপ করেছিলাম জীবনকে ছোঁয়ার, জীবনকে আদিরূপে দেখবার, জীবনের সঙ্গে
ওতপ্রোতভাবে মিশে যাওয়ার চেষ্টা... দর্শন ইত্যাদি জ্ঞানবিজ্ঞান ইত্যাদি দিয়ে তো নিজেকে জানা
হল না। সে সব দিয়ে যা জেনেছি তা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। সাহিত্য সৃষ্টির মূলে হয়তো অস্বস্তি
থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা।’ এই এস্কেপ কিন্তু জীবন থেকে পলায়ন নয়; বরং এই নান্দনিক আনন্দ
এমনফলে হয় কী, অমিয়ভূষণ entertainment-এর ধার দিয়ে তো যানই না, তার বদলে
সাহিত্যকে তিনি দেখেছেন একটি সামাজিককর্ম হিসেবে, একটা কমিউনিকেশনের শক্তিশালী
মাধ্যম রূপে। কথাসাহিত্য সম্পর্কে অত্যন্ত স্বচ্ছ ধারণা থাকায় জীবনের স্বরূপকে তিনি ব্যাখ্যা
করেছেন সহৃদয়তার সঙ্গে, কোনো ইজম বা তত্ত্বের আলোকে নয়। ফিজিক্যাল ও পলিটিক্যাল
এনটিটির চেয়ে মানুষের সাইকোলজিক্যাল এনটিটিকে অধিক মূল্যায়িত করেছেন, ‘মানুষ কী? এ
জানতে বুঝতেই তো হয়রান।... মানুষকে কেউ এক্সপ্লেন করতে পারে না। সে একটা কাব্য।’
তাঁর মতে, ‘সাহিত্যের পথ বিচার ও বিশ্লেষণের নয়, গঠন ও বিশ্বাস উৎপাদনের। অস্বীকার করা
যায় না, একজন ঔপন্যাসিক, নাট্যকার অথবা কবি আবেগের ভাষাতেই কথা বলেন। ...এবং
এইজন্য বোধহয় উপন্যাস বলতে boy meets a girl কখনও ভাবতেই পারি না... উপন্যাস
আমাদের কৌতূহল নিবারণ করে না এবং আমাদের এ্যাডোলেসেন্ট যৌনপ্রবৃত্তির পরিতৃপ্তির
উপায়ও নয়। উপন্যাস প্রকৃতপক্ষে একটা থিম যা আমাদের চোখের নিচে ফুটে ওঠে... অর্থাৎ
থিম নামে এক জীবন্ত বিষয়ের ভাব।’ উপর্যুক্ত বিষয়াদি ঝালিয়ে নেওয়ার হেতু এই, অমিয়ভূষণের
সাহিত্য-মননের কাছাকাছি যাওয়া আর সেই আলোকচ্ছটায় রাজনগর উপন্যাসে কী ঘটে সেটা
বোঝার চেষ্টা করা। প্রকৃতপ্রস্তাবে রাজনগর উপন্যাসটি তাঁর প্রকল্পিত ট্রিলজির দ্বিতীয় খন্ড; প্রথম
খন্ডের নাম নয়নতারা; তৃতীয় অংশ যার পূর্বনির্ধারিত নাম ছিল ‘স্যর রাজচন্দ্র’ শেষমেশ আর
লিখিত হয়নি। ফলে রাজনগর উপন্যাসের আলোচনায় নয়নতারার অথবা বিস্তৃতির স্বার্থে অন্য
বইগুলোর প্রসঙ্গ যে ঘুরেফিরে আসবে, এতে আর আশ্চর্য কি! এক অনির্বচনীয় আনন্দ যা
ব্রহ্মস্বাদের সহোদরা।
ট্রিলজির এই দুই পার্টধৃত সময়কাল ১৮৫৫ থেকে ১৮৮৩, যার মধ্যে নয়নতারার কালখন্ড
১৮৫৫ থেকে ১৮৫৭ আর বাদবাকি কালখন্ড রাজনগরে সন্নিবিষ্ট। বস্ত্তত স্থিরীকৃত তৃতীয় খন্ড
লিখিত না হলেও রাজনগর উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদে ‘স্যর রাজচন্দ্র’র সারসংক্ষেপ যে ঢুকে
পড়েছে তা সহজে অনুমেয়; কেননা শেষ পরিচ্ছেদের কালসীমা বিস্তৃত হয়েছে দীর্ঘ দুদশক জুড়ে,
অথচ তার আগপর্যন্ত পুরো বইটির সময়কাল মাত্র কয়েক বছরের। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে,
উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় হিসেবে ইতিহাসের এই সময়খন্ডকে লেখক বেছে নিলেন কেন? কেন
আঁকলেন তৎকালীন ফিউডাল সমাজের চিত্র? কারণ নিশ্চয় আছে। আমরা জানি, ওই ঊনবিংশ
শতাব্দীতে একটার পর একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল, যার ভরকেন্দ্রে ছিল সিপাহি বিদ্রোহ
আর ১৮৫৭-এর সিপাহি বিদ্রোহের প্রভোকেশনগুলোর ছিল এনফিল্ড রাইফেলের টোটায় গরু ও
শুয়োরের চর্বির ব্যবহার, সতীদাহ দমন, বিধবা বিবাহ আইন, ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ও
শাসকশক্তি ইংরেজ কর্তৃক ভারতীয় ধর্মের কুৎসা রটনার মতো ব্যাপারসমূহ। সাধারণ বাঙালি এ-
জাতীয় আন্দোলনে সোৎসাহে যোগ দেয় সত্য কিংবা গদিচ্যুত কোনো কোনো সামন্ত অথবা
কোনো কোনো জমিদার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থনও জানায় বটে, তবে বাস্তবতা এটা,
জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করার মতো কোনো আদর্শ এখানে ছিল না, বড়জোর ছিল
ইংরেজবিরোধিতা।
সিপাহি বিদ্রোহ একটি খন্ডিত বিদ্রোহ ছিল, কেননা সর্বভারতীয়বোধ তখনো তৈরি হয়নি, হয়
পরের বছর; হেতু এই, ভারতবর্ষ বলতে যা বোঝায় সেটির জন্ম ১৮৫৮ সালে, বস্ত্তত ইংরেজরা
যেদিন থেকে লাল ম্যাপ এঁকেছিল, সেদিন থেকেই অবিভক্ত ভারতবর্ষের সূচনা। এর আগে তো
এই দেশ ভিন্ন-ভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। শুধু কি তাই, বিদ্রোহ সফল হলে কে হবেন সংযুক্তির কর্তা
এটাও ছিল বিশাল প্রশ্ন। কারণ সম্ভাব্য সংযুক্তির কর্তা হিসেবে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহকে ভাবা হচ্ছিল।
কিন্তু তাঁকে কি নির্দ্বিধায় মেনে নিত শিখ, মারাঠা কিংবা বাংলা-অযোধ্যার নবাবরা? ইত্যাকার
জটিল রাজনৈতিক ভাষ্যের দায়ভার লেখক নিজেই অন্যত্র মিটিয়ে গেছেন বলে উপন্যাসদ্বয়ের
রসাস্বাদনে পাঠক বাড়তি সুবিধাভোগ করেন। আন্দাজ করি, এর বাইরেও বৃহৎ কারণ আছে।
বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের রচনাকাল বাংলা কথাসাহিত্যের কেবল উন্মেষপর্ব নয়, অত্যন্ত
গুরুত্ববহ অধ্যায়ও বটে। তিনজন শিল্পীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আবার একাই একশ : বিকাশোন্মুখ
বাংলা ভাষাকেই শুধু পূর্ণতা দান করেননি, তাঁর হাত ধরে বাংলাসাহিত্য একলাফে সাবালকত্ব
অর্জন করে। কিন্তু তার পরেও কথা থেকে যায়। তাঁদের রচনায় কলোনিয়াল সমাজকাঠামো
সেইভাবে চিত্রিত না হলে হয় কী, উত্তরসাধক হিসেবে অমিয়ভূষণকে এগিয়ে আসতে হয়।
নয়নতারা, রাজনগর ও গড় শ্রীখন্ডসহ একাধিক উপন্যাসে তিনি ফিউডাল চালচিত্রকে প্রতিবিম্বিত
করেছেন; মধু সাঁধুখায় এসেছে আরো পেছনের সমাজ, ১৫৮৬ সালের জীবনচিত্র।
এতে বোঝা যায়, ঔপনিবেশিক সমাজপ্রেক্ষিতকে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন বেশ ভালোভাবে।
তাই গড় শ্রীখন্ড পাঠের পর অমিয়ভূষণের বাবা যখন ছেলের সম্পর্কে স্ত্রীর কাছে বিস্ময় প্রকাশ
করে বলেন, ‘না-দেখে, না-শুনে সে কী করে-বা বাবার ঠাকুরদাদাকে তাঁর পোশাক, চালচলন,
কথা বলা, মনের ভঙ্গি, নীল ভূঁইয়ার দেওয়ালে এঁকে ফেলেছে’, তখন সেই বিস্ময়বোধ
আমাদেরকেও সমান ছুঁয়ে যায়। আন্দাজ হয়, তাঁর বাবার ঠাকুরদা মথুরাপ্রসাদমশায়ের ক্রয়কৃত
সিপিয়া রঙের দুর্গাকার নীলকুঠির সামন্ততান্ত্রিক আবহ এক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করে থাকবে।
নয়নতারা ও রাজনগর উপন্যাসে ইতিহাসের ডিটেল্স এতো ব্যাপকভাবে এসে যাচ্ছিল, একশ
বছরের ইতিহাসের ধারাকে তিনি যেন ঠিক বাগে রাখতে পারছিলেন না, পরিণতিতে তৃতীয় পার্ট
লেখার পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়। বোধকরি লজিকটি ষোলো আনা সত্য নয়, অর্ধসত্য বড়জোর;
তৃতীয় খন্ড প্রকাশের ব্যাপারে প্রকাশকদের অনীহাও এখানে কম দায়ী নয়। ইতিহাসাশ্রিত হওয়া
সত্ত্বেও গ্রন্থদ্বয় ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, কারণ চরিত্রগুলো সব কাল্পনিক। আবার ঐতিহাসিকও
বটে, কারণ দুই পার্টে নীলাক্ত সমাজকে প্রতিফলিত করা হয়েছে। উপন্যাসযুগলে কেবল
রাজরাজড়াদের কাহিনি নয়, বরঞ্চ যাবতীয় বৈশিষ্ট্যসমেত উনিশ শতকই উঠে এসেছে; এমনকি
সেকালে একটা আমূল পরিবর্তনের ঢেউ যেভাবে সর্বত্র আছড়ে পড়ছিল, সেটির উত্তাপও পাঠকের
গায়ে এসে লাগে।
এই অর্থে উপন্যাসদুটি ইতিহাসের শূন্যস্থান পূরণ করে; তার মানে ইতিহাস যেখানে গিয়ে নির্বাক
হয়ে যায়, কথাসাহিত্য সেখান থেকেই কথা জোগায়। আর তা করতে সংগত কারণেই
অমিয়ভূষণকে ইতিহাসের মহাসড়ক ছেড়ে হৃদয়বৃত্তিক পথে অগ্রসর হতে হয়েছে। সুতরাং হয় কী,
যাদের ঘিরে উপন্যাস আবর্তিত - সেই রাজবাড়ির রানীমা, রাজকুমার রাজু, দেওয়ান হরদয়াল,
সদর-নায়েব, নায়েবগিন্নি, নায়েবের ভাগ্নে গোবর্ধন কিংবা রাজবাড়ির শক্ত প্রতিপক্ষ ইংরেজ
নীলকর ডানকান হোয়াইট, চাইকি দেওয়ান হরদয়ালের স্কুলের শিক্ষক চন্দ্রকান্ত অ্যান্ড্রুজ বাগচী
ও তার ফিরিঙ্গি স্ত্রী ক্যাথারিন কেট এবং আরেক অন্যতম প্রধানচরিত্র ফরাসি খ্রিষ্টান পিয়েত্রো ও
তার ম্যানেজার-কাম-ডানহাত বুজরুক আলীসহ প্রজাকুলের একাংশ প্রাণাবেগে উত্তাপিত ও
সজীব। কাহিনির প্রারম্ভিক ফ্লাশব্যাকে আমরা দেখতে পাই - ফরাসি পিয়েত্রোর বাবা জাঁ পিয়েত্রো
১৭৯৪ সালে নৌকাযোগে ভ্রমণের সময় নদীতীরবর্তী বনের মধ্যে এক ব্রাহ্মণকন্যাকে সতীদাহের
আগুন থেকে রক্ষা করলে হয় কী, ওই বেঁচে-যাওয়া ব্রাহ্মণকন্যার সঙ্গে গান্ধর্বমতে জাঁ পিয়েত্রোর
বিয়ে পড়িয়ে কনের ভাই সমাজত্যাগ করে কাশীবাসী হন। ঘটনা সুতো ছাড়তে থাকে এই জায়গা
থেকে, যদিও নয়নতারার আনুষ্ঠানিক সূচনাকাল ১৮৫৫।
গান্ধর্বমতের এই নাটকীয় বিয়েটি অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় না, জাঁ পিয়েত্রোর ব্রাহ্মণ স্ত্রী বর্তমান
পিয়েত্রোকে জন্ম দেওয়ার পরপর মারা যায়। এদিকে আরেক নাটক এমনতর যে, ব্রাহ্মণকন্যার
সেই কাশীবাসী ভাইয়ের মেয়েই হচ্ছেন আলোচ্য উপন্যাসের জমিদার রানীমা অর্থাৎ রানীমার
পিসতুতো ভাই বর্তমান পিয়েত্রো; বয়সের হিসেবে রানীমার যখন ১৪, বর্তমান পিয়েত্রোর বয়স
তখন ৪০। ওই সময় দুজনার বিয়ের কথাবার্তা উঠলেও রক্তের সম্পর্কের কারণে বিয়েটা
শেষমেশ ভেঙে যায়। বিয়েটা ভেঙে যায় বটে, কিন্তু তাদের মধ্যে যে প্রণয়পূর্ণ বন্ধন গড়ে উঠেছিল
শেষদিন অবধি তা দুজনার হৃদিপদ্মে সংগোপনে সযত্নে ক্রিয়াশীল থাকে। এই ইস্থেটিক ডিলাইট
ও লাভই শেষতক সবকিছু ছাপিয়ে উপন্যাসের মূল থিম বা রূপের আধার হয়ে ওঠে।