You are on page 1of 144

বিশেষ ডিজিটাল সংস্করণ

৪ জুন ২০২১

শঙ্খ ঘ�োষ স্মরণে


1
৫৬বর্ষ l ষষ্ঠ সংখ্যা l জু ন ২০২১

শঙ্খ ঘ�োষ স্মরণে


শঙ্খ ঘ�োষ, শ্রদ্ধাস্পদেষু... জয়দেব বসু ৫
শঙ্খ ঘ�োষের গদ্য পবিত্র সরকার ৭
শঙ্খ ঘ�োষ : অবিরল স্মৃতিসত্তা... সমীর রক্ষিত ২০
সময়ের শব্দ যশ�োধরা রায়চ�ৌধুরী ২২
নিঃশব্দের সংয�োগ শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায় ৩৩
আমাকে ভুবন দাও আমি দেব সমস্ত অমিয় কিশ�োর সেনগুপ্ত ৪২
শঙ্খ ঘ�োষের দিকে সায়ন্তন সেন ৫২

গল্প
ঘরবন্দি মুখগুল�ো স�ৌরভ হ�োসেন ৭৩
কবিতা
অশ�োক অধিকারী ত�ৌফিক হ�োসেন নাসির ওয়াদেন দেবানন্দ ভট্টাচার্য ৮৪
ধারাবাহিক প্রবন্ধ
ভারতের জাতীয় আন্দোলন গান্ধিজী : একটি জীবন
ইরফান হাবিব অনুবাদ : অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী ৯১
ধারাবাহিক উপন্যাস
স�োনাই পাড়ের রূপকথা শতদল দেব ৯৮

বিদেশী বই
জন বার্জারের পত্রোপন্যাস তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায় ১০৫
সিনেমার ভাষা
“আমাদের” আর “ওদের” সংলাপ... অরুণাভ গাঙ্গুলি ১১৬

রম্য রচনা
পরিণয়মঙ্গল, শঙ্খ ঘ�োষ আর ডুপ্লিকেট শরৎচন্দ্র বৃত্তান্ত
সিদ্ধার্থ মুখ�োপাধ্যায় ১ ২২
প্রচ্ছদ ও সূচিপত্রের আল�োকচিত্র : সন্দীপ কুমার
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা : বিশ্বজিৎ আইচ
সম্পাদক : অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষে অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী কর্তৃক
৩১, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০১৬ থেকে প্রকাশিত ও গণশক্তি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেড,
৩৩, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট কলকাতা ৭০০০১৬ থেকে তৎকর্তৃক মুদ্রিত।
ফ�োন : ২২১৭ ৬৬৩৩-৪০, ফ্যাক্স : ২২২৬৩৭৮৮ Web : www.nandanpatrika.com
2
সম্পাদকীয়
বেনারসের মণিকর্ণিকা ঘাট শ্মশানে দাউ দাউ জ্বলছে
চিতা। এই ছবি প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছিল নন্দন পত্রিকার
মে মাসের ডিজিটাল সংখ্যায়। একজন পাঠিকা ফ�োন
করে বলেছিলেন, প্রচ্ছদে এই ভয়ানক ছবি কি না
দিলেই চলছিল না?
সঙ্গত প্রশ্ন। একটি সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকার
প্রচ্ছদে কি চিতার আগুনের ছবি মানায়?
মানায় না ত�ো। আমরাও কি কখন�ো ভেবেছিলাম
এরকম ছবি ছাপতে হবে?
নন্দন সংখ্যার জন্য যে পরিকল্পনা নিয়ে আমরা
এগ�োচ্ছিলাম, প্রথম দফার কর�োনা সংক্রমণের ধাক্কা
সামলে যখন আমরা মাত্র কয়েকটি সংখ্যা আবার ছাপা
শুরু করলাম, তখনই এল সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ।
এর পরিণাম যে এরকম ভয়াবহ হতে পারে তা
কল্পনার মধ্যে ছিল না। দিল্লি মুম্বাই বেঙ্গালুরু কলকাতা
বেনারস লখন�ৌ কানপুর পাটনা আমেদাবাদ সুরাট
সর্বত্র চিতার আগুন জ্বলছে ত�ো জ্বলছেই। আলিগড়
মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর�োনার আক্রমণে শিক্ষক ও
শিক্ষাকর্মী এত মারা গেছেন যে ক্যাম্পাসের ভিতরে
নির্ধারিত কবরখানায় তাঁদের সকলের মরদেহর জায়গা
হচ্ছে না। দিল্লির রাজপথে অ্যাম্বুলেন্স এর সাইরেন শব্দে

3
নাগরিকদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সর্বত্র অক্সিজেনের
ভয়াবহ সংকট। কলকাতার হাসপাতালে ভ্যাকসিন
নিয়ে হাতাহাতি। আপনি আমি যদি কর�োনা আক্রান্ত
নাও হই, তবু ঘর বন্দী অবস্থায় টেলিভিশন চ্যানেলে
অথবা স্মার্টফ�োনে এই ভয়াবহ দৃশ্যের ক�োলাজ
আমাদের বিষাদগ্রস্ত করে তুলছে।
এই পরিস্থিতিতে নন্দনের প্রচ্ছদে অন্য ক�োন�ো
বিষয়ের কথা আমরা ভাবতেই পারিনি। সেই ক্ষেত্রে
চরম উদাসীনতার পরিচয় দিতাম।
যেসব পরিবার কর�োনার আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছেন,
সদস্যদের হারিয়েছেন চিরদিনের মত তাঁদের যন্ত্রণার
ভাগীদার হতে চেয়েছি আমরা। যতটুকু পারি।
তবু, হ্যাঁ তবু এই বিষাদঘন পরিবেশের মধ্যেই
হার না মানা মানুষের প্রতিজ্ঞাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী, বিজ্ঞানী ও গবেষক, কর�োনা
ম�োকাবিলার সঙ্গে যুক্ত সরকারি-বেসরকারি অজস্র
কর্মীদের পরিশ্রম, সরকারি সাহায্যের আশায় না থেকে
স্বউদ্যোগে এইসব আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান�োর যে
ছবি দেখা যাচ্ছে তা এই সমাজের এক নতুন চেহারা।
অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ক্লাব,
অ্যাস�োসিয়েশন মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
দেশের নানা প্রান্ত, বিদেশ থেকেও নানাভাবে সাহায্য
এসে প�ৌঁছেছে। আমাদের রাজ্যে গর্ব করার মত
সক্রিয়তা দেখাচ্ছে রেড ভলান্টিয়ারস।
বিপদ এখন�ো কাটেনি। আগামী দিনে নতুন করে
সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা রয়েছে যথেষ্ট
পরিমাণে। তার বিরুদ্ধে লড়াই করার সর্বাত্মক প্রস্তুতি
দরকার।
আমাদের যেন আর চিতার ছবি প্রচ্ছদে না ছাপতে
হয়।

4
পু ন র্মু দ্র ণ

আল�োকচিত্র : সন্দীপ কুমার

শঙ্খ ঘ�োষ, শ্রদ্ধাস্পদেষু...


(৫ ফেব্রুয়ারি মনে রেখে)

জয়দেব বসু
এটাই শেষ লেখা, যা কিনা রাত্রিকে তুলে আনবে হাওয়ায়-হাওয়ায়,
তা থেকে পুংকেশরের রেণুতে, আর বয়স্ক আলবাট্রস শেষবার বিষণ্ণ
ডানা মেলে পার হতে চেষ্টা করবে নুনঢিবি ও নারকেলঅরণ্য, যেখান
থেকে দেখা যাবে মুরগির ডিমের মতন নিজের অক্ষের ভরে ঘুরছে
পৃথিবী, গিলগামেশের পর হয়ত�ো এবারই শেষ, আর ক�োন�োদিন
কেউ ত�োমাকে তেমন অনন্ত থেকে ছুঁড়ে ফেলবে না, কেউ ত�োমাকে
লুফে নেবে না মাটি স্পর্শের আগেই, র�োঁয়াওঠা মুখিয়ার মত�ো দিন
চলবে দায়বদ্ধ, গতানুগতিক।

আলবাট্রস, বুড়�ো পাখি, এবারেই চরম উড়াল...


এই শেষ হতাশাজনক শীত, চতুর্থ ঘণ্টার পর ভারি কুয়াশার পর্দা
নিঃশব্দে নেমে আস‍‌ছে খড়্‌গের মত�ো, পাদপ্রদীপের আল�ো মুছে
গিয়ে এইবার টেবিলে টেবিলে জ্বলে উঠবে ম�োম, অন্ধকারে ভেসে
5
উঠবে রুপালি মাছের ঝাঁক, পাক্‌সি ইস্কুলের উঠ�োনে সারারাত
ঝরতে থাকবে সুপারির পাকা ফল, আর এইবার বাখ্‌ঝুঁকে পড়বেন
অর্গানে, আবলুশ কাঠের ঠিক একবিন্দু আগে এসে থম্‌কে দাঁড়াবে
শাদা চুল, শহরের র�োমকূপে—শহরের কণ্ঠনালীতে আচম্‌কা শিউরে
উঠবে ‘প্যাশন’...

দা প্যাশন অভ্‌আওয়ার টিচার...


সসাগরা এই ধরিত্রীর ক�োন্‌-ক�োন্‌শহরে বা গ্রামে তুমি জেগে আছ�ো?
কান পাত�ো, ডানার মরিয়া স্পন্দে বাখ্‌ শুরু করছেন সংগীত,
কুষ্ঠর�োগীরা ফিরে পাচ্ছে ভাল�োবাসা, একটি অন্নের কণা পরিতৃপ্ত
কর‍‌ছে ভুবন, আর, এই শেষ বাণ যা কিনা শিক্ষকের জন্য তৈরি
করছে শয্যা, তৈরি করছে উপাধান, মাটির ভাণ্ডার থেকে ছিনিয়ে
আনছে জলধারা; এক সৈনিকের প্রতি অন্য সৈনিকের এভাবেই গার্ড
অভ্‌অনার...।

সকাল ১০.১৯ মিনিট


৩/২/৮৯

ভবিষ্যৎ (১৯৯২) কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্র

6
শঙ্খ ঘ�োষের গদ্য
পবিত্র সরকার

আল�োকচিত্র : সন্দীপ কুমার

১ মামুলি এক ভূমিকা
একজন মানুষ, যিনি মুখ্যত কবি, তিনি যখন গদ্য লেখেন তখন
নিশ্চয়ই তাঁর এমন কিছু বলার কথা থাকে যা তিনি কবিতায় বলার
সম্ভাবনা নাকচ করেন। অতি মামুলি ওই কথার পুনরাবৃত্তি করে বলি,
কবিতা মূলত এক ধরনের মাধ্যম, গদ্য আর-এক ধরনের। এ ত�ো
সবাই জানেন যে, কবিতায় ছন্দে, মিলে, স্তবকবন্ধে, কিংবা সে সব
বর্জন করেও রূপকে চিত্রকল্পে শব্দব্যঞ্জনায় মূলত আবেগের উৎস
থেকে পাঠকের আবেগ-আন্দোলনের লক্ষ্যে কবির রচনা ধাবিত
হয়। তার কিছুটা অংশ পরে চিন্তায় রূপান্তরিত হতেই পারে, কিন্তু
7
তার সম্মুখের দরজাটা হল আবেগ। কিন্তু গদ্য, যখন তা কবিতার
লক্ষ্যকে পরিহার করে তখন তা লেখকের চিন্তার কথা পাঠকের
চিন্তার পরিসরে প�ৌঁছে দেবার জন্য রচিত হয়। এ কথাও জানা যে,
কবিতা কখনও গদ্যের এই ল�োকপ্রসিদ্ধ কাজের দায়িত্ব তুলে নিতে
পারে। পাঠকের মনে পড়বে কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত-
এর চৈতন্য আর রামানন্দ রায়ের সাধ্য-সাধনতত্ত্ব বিচারের অংশটি,
কিংবা রবীন্দ্রনাথের স�োনার তরী-র ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায়
যাত্রাভিমুখী গৃহকর্তার সঙ্গে গৃহিণী কী কী জিনিস গুছিয়ে দিয়েছেন
তার তালিকা। সেখানে আবেগের ভূমিকা প্রধান নয়, গ�ৌণ, যদিও
তা একেবারে অনুপস্থিত নাও হতে পারে। আবার গদ্যও কখনও
কবিতার কাজ নিজের হাতে তুলে নেয়, তখন তা আবেগের দ�োলা
দিয়েই আমাদের কাছে আবেদন তৈরি করে। কাজেই, দিশি-বিদেশি
‘অথরিটি’র উদ্ধৃতি না দিয়ে, বহু পুর�োন�ো কথাই আবার সংক্ষেপে
পুনরাবৃত্তি করি—কবিতার আবেদন আবেগ ও কল্পনার কাছে, গদ্যের
আবেদন সাধারণভাবে জ্ঞান ও যুক্তির কাছে। অর্থাৎ সরল বাইনারি
বা দ্বিসম্ভবের সূত্রে কবিতা আর গদ্যকে আলাদা করা চলে না।
দুয়ের তফাতের মধ্যে ফাঁক নেই, বরং একটা পরম্পরা বা পর্যায়
আছে। তাতে শূন্য থেকে বহু সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করাও হয়ত�ো
সম্ভব।
শঙ্খ ঘ�োষ যখন গদ্য লেখেন তখন গদ্যের এ সব শর্ত ত�ো তাঁকে
মানতেই হয়। তবু পাঠকেরা জানেন যে, গদ্যের নানা ধরন আছে।
নিছক সংবাদের যে গদ্য, আইনি দলিলের যে গদ্য, বিজ্ঞানের
প্রবন্ধের যে গদ্য, তার ধরন আলাদা। এই যে চর্চার পরিসর অনুযায়ী
আলাদা আলাদা গদ্যের চরিত্র, তাকে ভাষাবিজ্ঞানে register বলা
হয়, ব্রিটিশ ভাষাতাত্ত্বিক হ্যালিডে এই পরিভাষাটি সৃষ্টি করেছেন।
সংজ্ঞা হল, language according to use. আমরা রেজিস্টারের
বাংলা করেছি ‘নিরুক্তি’। এও মামুলি কথা যে, মান্য চলিত
গদ্যও, এক জন লেখকের লেখা হলেও, একরকম হতে পারে
না। ব্যক্তিগত শৈলী বা স্টাইলের মুদ্রণ সব জায়গাতেই থাকবে,
তবু স্মৃতিচারণের গদ্যের নিরুক্তি এক হবে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে
ওকাম্পোর সম্পর্কের বিবরণ ও বিশ্লেষণের গদ্যের নিরুক্তি একটু
অন্যরকম হবে, কবিতা রচনার মুহূর্তগুলির স্মরণের গদ্য আর-একটু
অন্যরকম হবে, কবিতা সেখানে গদ্যকে আক্রমণ করবে এসে—এ
8
ত�ো বলাই যায়। এ সব মেনে নিয়েই আমরা শঙ্খ ঘ�োষের গদ্যের
কিছু সাধারণ লক্ষণ বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব। আমাদের মূল লক্ষ্য
হবে শঙ্খ ঘ�োষের গদ্যশৈলীর কতকগুলি চিহ্ন স্থির করা। সেগুলি
ক�োথায় অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যায়, ক�োন্ ক�োন্ সূত্র থেকে
আমরা বলতে পারি যে, এগুলি শঙ্খ ঘ�োষেরই লেখা, অন্য কারও
নয়। অবশ্যই শঙ্খ ঘ�োষের কবিতার মত�ো গদ্যও অনেক অনুজ
লেখকের গদ্যকে প্রভাবিত করেছে, ‘প্রভাবশালী’ লেখকের কাছে
সেটাই প্রত্যাশিত। হয়ত�ো শঙ্খ ঘ�োষও তাঁর পূর্ববর্তী বুদ্ধদেব বসু
বা এই ধরনের কারও ব্যক্তিগত গদ্যশৈলীর দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত
হয়ে থাকবেন। আমরা সবাই জানি যে, এর মূলে একটা সজ্ঞান
নির্বাচন বা choice থাকে। সেটা কবিতা বা গদ্য উভয় ক্ষেত্রেই।
খুব দুর্বল বা খেয়ালি লেখকেরা হয়ত�ো ‘আমি অমুকের মত�ো লিখব’
ভেবে শুরু করেন, ইংরেজ চ্যাটার্টন যেমন করেছিলেন। কিন্তু
বেশির ভাগ আত্মসচেতন লেখক একটা সময়ে অন্তত ‘আমি আমার
মত�োই লিখব’ সেই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তখন তাঁর মধ্যে একটা
ব্যাপক বাছাই চলে। কবিতার ক্ষেত্রে কবিরা যেমন, গদ্যলেখকেরাও
তাঁদের পছন্দের একটা বৃত্ত তৈরি করেন। এটা ত�ো ব�োঝাই যায়
যে, শঙ্খ ঘ�োষ কবিতায় তিরিশের বছরগুলির যাঁরা সব ‘দুর্বোধ্য’
অথচ নিঃসন্দেহে শক্তিশালী কবি, তাঁদের শৈলী বর্জন করেছিলেন,
তেমনই গদ্যেও বিষ্ণু দে বা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের গদ্যকে আদর্শ মনে
করেননি। কবিতা বা গদ্যে তাঁর সহজ লক্ষ্য ছিল ব্যাপক সাধারণ
পাঠকের সঙ্গে সংয�োগস্থাপন। এই সিদ্ধান্ত সকলে নেন না, নিশ্চয়ই
তার পিছনে ব্যক্তিগত ক�োনও কারণ থাকে। শঙ্খ ঘ�োষ নিয়েছিলেন।
সচেতন শৈলীর চেয়ে সংয�োগ, অস্মিতার চেয়ে তার অতিক্রমণ তাঁর
কাছে বড় হয়ে উঠেছিল। সেই দিক থেকে তাঁর গদ্যের সাফল্য
বা ব্যর্থতা (!) বিচার করতে হবে। যেহেতু পাঠকমুখী আগ্রহ এক
ধরনের আবেগ, তা তাঁর গদ্যে শৈলীর সৃষ্টি করেছে, আবার লেখার
উদ্দেশ্য অনুসারে তার মধ্যে নানা ভাঁজবিভঙ্গও। জানি না আমাদের
এই দ্রুত এবং অসম্পূর্ণ (সব লেখা এখন হাতের কাছে নেই, সংগ্রহ
করা কঠিন) পরিক্রমায় তার কতটা দেখান�ো সম্ভব হবে। এই লেখায়
তাঁর গদ্যের কিছু ভাষাতাত্ত্বিক লক্ষণ আমরা দেখাব, পরে হয়ত�ো তা
যে মায়া সৃষ্টি করে তার অন্যান্য কারণ অনুসন্ধান করব।
কিন্তু তারও আগে, শঙ্খ ঘ�োষের গদ্য লেখারও একটা ভূমিকা
9
করে নিতে হবে। সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে ঢুকেছেন, পড়াতে
ভাল�োই লাগছে। বেতন মাসে একশ�ো পঁচিশ টাকা। সেই সঙ্গে সাড়ে
সতের�ো য�োগ সাড়ে সতের�ো টাকা অনুষঙ্গ। কিছু অতিরিক্ত পাওয়া
যেত সান্ধ্য ক্লাসে পড়িয়ে শঙ্খ সেটা ছেড়ে দিয়েছেন। ইউজিসি
স্কেলের একটা শর্ত হচ্ছে বিদ্যাভিত্তিক গদ্য প্রবন্ধ লেখা, জানি না
তখনি ইউজিসি মার্কিন দেশের publish or perish দর্শনের প্রতি
প্রণতচিত্ত হয়েছিল কি না। সে জন্য হ�োক, বা নিছক জ্ঞানচর্চার
নিজস্ব তাগিদ থেকে হ�োক, সহকর্মীরা নানা গ্রন্থরচনা করছেন। শঙ্খ
নানা স্থানে নিজেকে অলস বলেন, (‘বড়�োকাকা বলতেন, অলস যদি
দেখতে চাও ত�ো তাকিয়ে দেখ�ো ওকে, পৃথিবীর সেরা’—এখন সব
অলীক), জানি না গদ্য লেখায় অনীহা তার চিহ্ন ছিল কি না। এক
সহকর্মী এসে চুপি চুপি পরামর্শ দিয়ে গেলেন যে, ইউজিসি স্কেলের
জন্য কিছু গদ্যপ্রবন্ধ লেখা দরকার। কিন্তু তাঁর গদ্য লিখতে ইচ্ছে
করে না। বেশ কিছুদিন কাটবার পর বিভাগীয় প্রধানের অসন্তোষের
খবর জানালেন সহকর্মী ক্ষেত্র গুপ্ত, শঙ্খ ঘ�োষের প্রতিক্রিয়া, আমরা
উদ্ধৃত করি—
‘সে কী, কেন?’ ‘উনি বলেছেন, এইভাবে ডেকে ত�ো নিলাম।
কিন্তু ক্লাসে পড়ান�ো ছাড়া কিছুই ত�ো করছেনা ও; ছ-মাস বলে বলে
একটা প্রবন্ধ পর্যন্ত লেখাতে পারলাম না।’ মর্মাহত, চুপ করে থাকি।
ক�োন�োরকম গদ্য যে কিছুতেই লিখতে ইচ্ছে করে না, কেমন করে সেটা
ব�োঝাই ওঁকে। ভাবি, একটি-দুটি লেখা অন্তত লিখতেই হবে, নইলে
অসম্মান করা হবে ওঁর আস্থাকে। ১৯৬৫ সালে সিটি কলেজ ছেড়ে
আসবার আগে একটি-দুটি গদ্যলেখা লিখতেই হল�ো তাই।’
(গদ্যসংগ্রহ ১, পৃ. ১৯৭)
সেই গদ্যের সংগ্রহ এখন তের�ো খণ্ডে বেরিয়েছে। তাঁর গদ্য
লেখার দ্বিধা কেটেছিল বলে আমরা খুশি। তবে কর�োনার কারণে
আমরা তার সবগুলি খণ্ড দেখে উঠতে পারিনি।
এবার আমরা তাঁর গদ্যের আল�োচনায় যাব, সেই মানুষটির,
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছে যাঁর শৈশবে হাতেখড়ি হয়েছিল।

২ গদ্যের লক্ষণগুলি
ক. প্রশ্ন ও তার ব্যবস্থাপনা
স্মৃতিচারণ কিছুটা আত্মজীবনীর অংশ, ভ্রমণকাহিনিও তাই। দুইই
কিছুটা অতীতে আশ্রিত, যে-অতীতের নেতিবাচক অভিজ্ঞতাও
 10
সময়ের প্রলেপে উপশান্ত হয় এবং কিছু পরিমাণে লেখকের মমতা
লাভ করে। মমতা এই দিক থেকে যে, সে ঘটনাগুলিকে লেখক
পুনরুদ্ধার করে পাঠকের কাছে প�ৌঁছে দেবার কথা ভাবেন, এবং
তাতেই আমরা জানতে পারি যে, সেই ফেলে-আসা অভিজ্ঞতাগুলি
এখনও তাঁর কাছে মূল্যবান।
গদ্যসংগ্রহ-এর একেবারে প্রথম বই বইয়ের ঘর-এর প্রথম লেখার
প্রথম বাক্য থেকেই আমরা শঙ্খ ঘ�োষের গদ্যের একটা প্রধান
লক্ষণের সঙ্গে পরিচিত হই—তা হল, পাঠকের সঙ্গে যতটা না-হ�োক,
তার চেয়ে বেশি করে নিজের সঙ্গে নিজের কথ�োপকথন। নিজেকে
তিনি প্রশ্ন করেন বারবার, যেমন ‘হাতপাবাঁধা হনুমান’-এর প্রথমেই
‘আবারও কি হারিয়ে ফেললাম বইখানা?’ এ প্রশ্নটা অবশ্যই তাঁর
নিজেকে। কিন্তু সব সময় নিজেকে প্রশ্ন করেন না তিনি। তাঁর মনে
সব সময় এক পাঠকের প্রিয় উপস্থিতি থাকে, তাঁর মনে হয় তাঁর
লেখা পড়তে পড়তে পাঠকের মনেও একাধিক প্রশ্নের উদ্রেক হতেই
পারে। তিনি নিজে সেই প্রশ্নটি উচ্চারণ করার দায়িত্বও নেন—যেমন
এই লেখার নানা স্থানে। একটা কৃত্তিবাসি রামায়ণ হারিয়ে গেছে বলে
লেখক প্রায় হাহাকার দিয়ে শুরু করেছেন লেখা, কিন্তু পাঠকের
মনে জাগতেই পারে এই প্রশ্ন যে, আর-একটা বই কিনে নিলেই
ত�ো হয়, এত হাহাকার করার কি আছে? সেই প্রশ্নটা তিনি নিজেই
তুললেন, তৃতীয় অনুচ্ছেদে একাধিকবার—‘কেন এত খ�োঁজা? কত
কত রামায়ণে ত�ো ভরে আছে ঝলমলান�ো দ�োকানগুলি। সেসব বই
থেকে অনেক কিছু কি বেশি ছিল সেই আমার রামায়ণে?’
এই বহু বহু প্রশ্ন, কখনও নিজেকে (পাঠককে সেটা জানতে
দিতে তাঁর আপত্তি নেই), কখনও পাঠকের মনের প্রশ্নের অনুমান
ও উচ্চারণ, এবং প্রবল আন্তরিকতায় তার উত্তরদান ও ব্যাখ্যান।
যেমন, ‘বই যখন শরীর পায়’ নামক রচনায়—বালক বয়সে ক�োনও
একটা পরীক্ষায় বসার তাগিদে, মূলত তাঁর বাবার প্রর�োচনায়,
‘পড়তে হল�ো রবীন্দ্রনাথের একগুচ্ছ বই।’ ওই অপরিণত বয়সে
‘বড়দের’ কবিতা পড়ছেন, পাঠকের মনে এই প্রশ্নের পূর্বানুমান
করে তিনি সে প্রশ্ন উচ্চারণ করলেন—‘কিন্তু কবিতা পড়া? ‘চৈতালি’
‘ক্ষণিকা’ ‘উৎসর্গ’ ‘পলাতকা’-র কবিতা পড়া? তার কি ক�োন�ো
অভিভব হবে বালকমনে? হওয়া সম্ভব?’
পরের অনুচ্ছেদেই উত্তর আসে একটু প্রতিপ্রশ্ন দিয়ে—‘কেনই
 11
বা নয়?’ ‘চৈতালি’র টুকর�ো টুকর�ো জীবনছবি, গ্রামীণতায় ভরা;
দুলকিলাগা ছন্দে ‘ক্ষণিকা’র ফুরফুরে মেজাজ, ‘পলাতকা’র
কারুণ্যময় মেয়েদের কথা! কেনই-বা এরা মুঠ�োয় নিতে পারবে না
ক�োন�ো অল্পবয়সীর হৃদয়?
এ যেন প্রায় মুখ�োমুখি কথ�োপকথনের গদ্য, যেখানে এক অদৃশ্য
পাঠক (নিশ্চয় পাঠিকাও) হাজির লেখকের সামনে। দ্বিতীয়জনের
কথা বলার সুয�োগ নেই, কিন্তু পাছে সে নিজেকে বঞ্চিত ব�োধ করে
এ জন্য সংবেদী লেখক নিজেই তার প্রশ্নগুলিকে ধরেন এবং তার
সুরাহা করেন। এই গদ্যে একেবারেই ক�োনও প্রভুত্ব নেই, তাতে
নিজের কথা শ�োনান�োর ব্যাকুলতা আছে, সেই সঙ্গে পাঠকের
অনুচ্চারিত প্রশ্ন যে তাঁর লেখাকে এগিয়েও দিচ্ছে তারও স্বীকৃতি
আছে। খুব কম লেখকই তাঁর লেখায় পাঠককে এভাবে উৎকীর্ণ
করেছেন। তাতে পাঠকও কি একটু খুশি হন, লেখকের লেখায় তাঁর
আমন্ত্রণ আছে দেখে? শঙ্খ ঘ�োষের মত�ো করেই আমরা নিক্ষেপ
করি প্রশ্নটা। কিন্তু এখানে আমরা ব্যাকরণের একটা লক্ষণের দিকে
দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তা হল প্রশ্নবাক্যের যথেচ্ছ ব্যবহার। তা একটা
উপায়, কিন্তু কীসের উপায় তার আল�োচনা আমরা আগে করেছি,
একটা দ্বন্দ্ব বা dialectics তৈরির। নিজের সঙ্গে, পাঠকের সঙ্গে।
ফলে পাঠককে মুশকিলে ফেলে এমন শব্দ বা অন্বয় তিনি ব্যবহারই
করেন না।

গ. ক্রিয়াপদের অগ্রাধিকার
তাঁর গদ্যের আর একটা ব্যাকরণগত লক্ষণ যা চ�োখের সামনে
লাফিয়ে লাফিয়ে চলে আসে তা হল তাঁর বাক্যে ক্রিয়াপদের
ব্যবহার। সকলেই আমরা জানি যে, বাংলায় ক্রিয়াপদ বাক্যের শেষে
আসে, সেটাই তার স্বাভাবিক জায়গা। কিন্তু শঙ্খ ঘ�োষের গদ্যে সে
নিয়ম ব্যতিক্রমের দ্বারা সম্মানিত। এখন সব অলীক থেকে একটা
অনুচ্ছেদের অংশ উদ্ধার করি—
‘কলেজের ছাত্রদের নিয়েই তৈরি হয়ে উঠত কলেজের বাইরেও
এক-একটা দল, তৈরি হত�ো হয়ত�ো ক�োন�ো স্টাডি সার্ক্‌ল, কখন�ো
বা নাম হতে পারত তার ‘প্রগতি পরিষদ’, সেখানে আল�োচনা হত�ো
সাহিত্য নিয়ে রাজনীতি নিয়ে মার্ক্সবাদের নানা তত্ত্ব নিয়ে, পিছন থেকে
উৎসাহ দিতেন মাস্টারমশাইরা। ইতিহাসের অধ্যাপক মামুদ সাহেব

 12
থাকতেন পার্কসার্কাস ট্রামডিপ�োর ঠিক পিছনে, একা মানুষ তিনি,
তাঁর ফ্ল্যাটেই হতে পারত বেশিরভাগ বৈঠক। প্রথম দিকটায় তিনি
থাকতেন শ্রোতা, আর তারপর তর্কের আসরে নেমে পড়তেন তিনি
নিজেই। সেখানে কখনও আহ্বান থাকত ননী ভ�ৌমিকের জন্য, কখন�ো
হীরেন্দ্রনাথ মুখ�োপাধ্যায়, কখন�ো বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায়ের? তিনি কি আসবেন আমাদের ডাকে? বরানগরের
বাড়িতে গিয়ে তাঁকে ব�োঝাবার ভার পড়ল একজনের ওপর। রাজি
হয়ত�ো হবেন না, কিন্তু মুখ�োমুখি কথা বলবার এই সুয�োগটা কি ছাড়া
উচিত ? সেই সুয�োগ আঁকড়ে ধরে চলল সেই একজন তাঁর ডেরায়,
বহুক্ষণের সাধনায় বশেও আনতে পারল তাঁকে, আর সেই অবিশ্বাস্য
সফলতার আনন্দে বরানগর থেকে কলেজ স্ট্রিট পর্যন্ত পায়ে হেঁটেই চলে
এল সে, যেন উড়তে উড়তে হালকা হাওয়ায় একটা পাখির মত�ো।’২
যে সব পাঠক এ সব বিষয় লক্ষ করেন তাঁরা জানেন যে, বাংলা
সাধুভাষায় কদাচিৎ ক্রিয়াপদের এই এগিয়ে আসা ঘটত। সাধারণ
বিবৃতিমূলক রচনায় এর দৃষ্টান্ত খুব বেশি না থাকাই সম্ভব। হাতের
কাছের একটি বই থেকে৩ একটি অনুচ্ছেদ তুলি—
‘এই নবজিজ্ঞাসা বা নবচেতনার প্রাথমিক পর্বে তিনটি অস্ফুট
পরিবর্তনের চিহ্ন আমাদের চ�োখে পড়ে। মানুষ নিজের ওপর
বিশ্বাস কিছুটা ফিরে পাওয়ায় পুর�োপুরি দেবনির্ভর বাঙালি জীবন
কিছুটা মানবমুখী হয়ে উঠল—সমকালীন বাংলা সাহিত্যেও তার ছাপ
পড়ল। সাহিত্যে দেবদেবীর মাহাত্ম্যপ্রচার অব্যাহত থাকলেও, তা
ঠিক দেবমুখিতা থাকল না। স্মরণীয়, বৃহত্তর অর্থে যাকে মানবিকতা
(humanism) বলা হয়, তার অর্থ যদি করি, বঞ্চিত নিপীড়িত মানবের
প্রতি মমতা, তাদের দুঃখ নিরসনের সচেতন প্রয়াস, তাহলে উনিশ
শতকের সূচনায় খুব কম জনই তাঁদের কথা ভেবেছেন, বা তাঁদের দু্ঃখ
দূর করে সম্মান দিতে প্রয়াসী হয়েছেন। যে কারণে উনিশ শতকের
এই নবজিজ্ঞাসা বাংলার বৃহত্তর জনজীবনকে স্পর্শ করতে পারেনি।
যা কিছু জিজ্ঞাসা, যা কিছু সংশয়, তা শহর অঞ্চলের (বিশেষ করে
কলকাতার) সামান্য সংখ্যক শিক্ষিতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল, পল্লি
অঞ্চলে তার প্রভাব যথেষ্ট পড়েনি।’
আমরা এমন বলি না যে, এই ক্রিয়ান্তিক বাক্যের মধ্যেও
ব্যক্তির ক�োনও মুদ্রণ আনা সম্ভব নয়, কিংবা বিবৃতিমূলক গদ্যেও
ক্রিয়াপদকে তার বাক্যশেষের অবস্থান থেকে সরান�ো হয় না। কিন্তু
শঙ্খ ঘ�োষ যখন তা করেন তা বাংলায় চলিতভাষা প্রয়�োগের যে
ব্যক্তিগত ব্যাকরণ সেই ১৯১৪-র সবুজপত্র থেকে তৈরি হয়েছে

 13
তার দীর্ঘ ঐতিহ্য মেনেই করেন। সেই সময়ে প্রমথ চ�ৌধুরী এবং
রবীন্দ্রনাথের চলিত গদ্য ক্রিয়াপদকে বাক্যের নানাস্থানে সরিয়ে
এনে সেই গদ্যে এক ধরনের ব্যক্তিকতা য�োগ করা শুরু করেন।
এতে, আমাদের মতে, বাক্যে যে সংবাদ দেওয়া হয় তাতে কিছুটা
মৃদু নাটকীয়তার সঞ্চার করা যায়। এই কারণে যে, বাক্যের মূল
সংবাদবাহক যে phrase-গুলি—কে করছে, কী করছে, কীভাবে
করছে সেগুলি পরে আসছে, যেন পাঠকের ক�ৌতূহলকে খানিকটা
ঘনীভূত হতে দিয়ে লেখক খবরটা একটু দেরিতে দিচ্ছেন। বাক্যে
ক্রিয়া শেষে থাকলে ওই হালকা চমকটা থাকে না।

গ. ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটিয়ে মধ্যে অন্য খবর গুঁজে দেওয়া


এও একটা অন্বয় বা বাক্যগঠনের কায়দা, এবং এর জন্য
আমরা ইংরেজি গদ্যের কাছে ঋণী। বাক্যের মধ্যে বাক্য গুঁজে
দিয়ে বাক্যের গঠন জটিল করে ত�োলা। এই ‘জটিলতা’ পরিণত
ভাষাব্যবহারকারীর কাছে ক�োনও সমস্যা নয়, কারণ সে নিজেও এই
ধরনের জটিলতা প্রতিমুহূর্তেই সৃষ্টি করছে তার কথায়। তবু গদ্যে
এই ধরন মূলত ইংরেজি গদ্যের থেকে এসেছে, যা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
অনেক আগেই লক্ষ করেছেন। যেখান থেকেই আসুক, ইংরেজি
ভাষাভিজ্ঞ বুদ্ধদেব বসু, পরে অর্থনীতিবিদ অশ�োক মিত্র প্রভৃতির
রচনায় তা বাংলার সাহিত্যিক গদ্যের এক স্থায়ী লক্ষণ হয়ে গেছে।
যেমন এই বাক্যগুলি—
‘বস্তুত, গত পঁচিশ বছর জুড়ে, বা হয়ত�ো আর একটু বেশিও হতে
পারে, আমরা আমাদের চারপাশে যে মিডিয়ার ফেঁপে-ওঠা চেহারা
দেখতে পাচ্ছি, রেডিও টেলিভিশন আর কাগজের পর কাগজের যে
প্রকাশ�োল্লাস, মনের ওপর তার একটা প্রভাব নিশ্চয়ই আছে।’৪
কিংবা—
এ-অভিয�োগকে উপেক্ষা করবার আগে গ�োটা পৃথিবীর দিকে খ�োলা
চ�োখে তাকাতে হয় একবার—যেখানে মানুষ একই সঙ্গে চাঁদে উড়ছে
আর অসহায় মাটিতে এমন ব�োমা ছুঁড়ে ফেলছে যার স্প্লিন্টার শরীরে
ঢুকে গেলে এক্সরে দিয়েও তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না আর, মানুষ তৈরি
করছে ভব্যসভ্য সমাজ, চালচলনে নিখুঁত, যেন আনুষ্ঠানিকতার ঈষৎ
স্থলন হলেই ধ্বসে যাবে সব—আর তার পাশেই সাপ্তাহিক ‘টাইম’-এ
খবর ছাপা হচ্ছে ‘এ হেল্‌থি রাইজ ইন রেপ’—এ কি প্রহসন না সর্বনাশ?’৫

 14
এই গদ্যের মধ্যে একটা দ�ৌড় আছে, নানা প্রসঙ্গ এক সূত্রে বেঁধে
এক সঙ্গে বলে ফেলার একটা ইচ্ছা আছে, উনিশ ও আদি বিশ
শতকীয় সাধু গদ্যের মন্থরতার সঙ্গে এর পার্থক্য সহজেই ধরা যায়।
না, জয়েসীয় চেতনা-প্রবাহের মত�ো অত বিশৃঙ্খল নয় এ গদ্য, তবু
ব�োঝা যায়, চেতনাপ্রবাহের মধ্যে গদ্য এক ধরনের বেপর�োয়া মুক্তি
না পেলে এই গতি আসত না পৃথিবীর গদ্যে, এ ব্যাপারে বাংলা
সাহিত্যে তাঁর আগেই একটি ঐতিহ্য হয়ত�ো তৈরি হয়েছিল।

২ শৈলীর বাইরে : নানামুখিতা, বহুপঠন


কবি এবং সাহিত্যের অধ্যাপক, কাজেই শঙ্খ ঘ�োষের রচনায়
সাহিত্য ও কবিতার প্রসঙ্গই বেশি থাকবে তাঁর স্মৃতিচারণের বাইরে, তা
অস্বাভাবিক নয়। রবীন্দ্রনাথ ত�ো বটেই—তাঁর গদ্যসংগ্রহ-এর তিনটি
খণ্ডের অনেকটা জুড়ে তিনি হাজির। কিন্তু এ সব গদ্যে একটা ব্যাপার
দেখি যে, দু-একটি ক্ষেত্রে ছাড়া শঙ্খ ঘ�োষ অধ্যাপকের একাডেমিক
অভ্যাস গ্রহণ করেন না। এক ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ- বইয়ে তাঁকে দেখি
উৎসনির্দেশ, পাদটীকা ইত্যাদি দিয়ে গ্রন্থটির একটি প্রগাঢ় বিদ্যায়তনিক
চেহারা দিতে। আরও দু-এক জায়গায় পাদটীকা য�োগ করেন তিনি।
কিন্তু অন্য লেখাগুলিতে তা করেন না, তা সত্ত্বেও তাঁর বহুমুখী
পঠনের বিষয়টা চূর্ণ চূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে থাকে। হঠাৎ চলে আসে ডি এইচ
লরেন্সের একটা কথা, স্পেন্ডার, মধুসদূ ন, এলিয়ট, ওয়ার্ডসওয়ার্থ,
কীয়ের্কেগার্ড, ঋগ্‌বেদের রাত্রিস্তোত্র, জাক মারিত্যাঁ, ক�োলরিজ,
শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, গিন্‌সবার্গ, ট�োমাস মান, আর্জেন্টিনার ভাবুক
এজেকিয়েল মার্টিনেথ, মালার্মে, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, বিমলচন্দর সিংহ,
আঁদ্রে জিদ, জঁ কক্‌ত�ো, গেস্টাল্ট‌ সাইক�োলজি, এডমন্ড উইলসন,
তেইয়া দ্য শারদ্যাঁ.ওয়ালেস স্টিভেন্‌স—কে নেই, কী নেই? কবিদের
কবিতা শুধু নয়, ঔপন্যাসিকদের উপন্যাস শুধু নয়, তাঁদের নানা
গদ্যরচনার নানা ছত্র তাঁর অভাবিত স্মৃতি তাঁর মুখে প�ৌঁছে দেয়।
শুধু তাঁর জার্নাল পড়লেই তাঁর পাঠ্যের আভাসে স্তম্ভিত হতে হয়।
এত নাম যে করেন তা কি কলেজে য�ৌবনে তাঁর শিক্ষক ক্ষুদিরাম
দাসের এই বকুনি থেকে যে, ক�োনও এক পরীক্ষার খাতায় শঙ্খের
‘ঋষি বলেছেন,’ বলে একটি উদ্ধৃতি দেওয়ায় যিনি লাল কালিতে
পাশে লিখে দিয়েছিলেন, ‘ক�োন্ ঋষি? চালাকি ক�োর�ো না।’ পরে
‘ঐতিহ্যের বিস্তার’ তাঁর পাঠ ও মন�োয�োগের পৃথিবীকে আরও ক�োন্
 15
ক�োন্ দিগন্তে প�ৌঁছে দেবে আমাদের তার হিসেবই থাকবে না। কিন্তু
তা থেকেই বুঝতে পারি, পাণ্ডিত্যের চেনা প্রকাশ্য ছকে নিজেকে না
স্থাপন করেও এই মানুষটির অধ্যয়ন অনেক পণ্ডিতের চেয়েও বেশি,
এবং বহুমুখী।
এতেই প্রকাশিত হয় তাঁর সর্বত�োমুখী এক গ্রহিষ্ণুতা। তাঁর একটা
রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল, নিজের নিরীশ্বরবাদের কথাও তিনি বার
বার বলেন, কিন্তু তবু তিনি শ�োনেন অরবিন্দের দর্শনের কথা।
তাঁর নানা লেখা পড়লে পাঠকের আর-একটা জিনিস মনে হয়।
অল্প কয়েকটি বাক্যে এক-একটি চরিত্র তৈরি করে দিতে পারেন তিনি,
মানুষের ভেতর-বাইরেটা দেখিয়ে দিতে পারেন। বন্ধুর, অধ্যাপকের,
টাঙ্গাওয়ালার, ভুটানের ড্রাইভারের। পরিপার্শ্ব বর্ণনাতেও তাঁর জুড়ি
নেই। অবশ্যই ছ�োটদের জন্য একটি-দুটি উপন্যাস লিখেছেন তিনি,
কিন্তু তার বাইরে বড়দের জন্য গল্প-উপন্যাসের উদ্যম কেন তাঁর হল
না, এই প্রশ্ন আমাদের মত�ো পাঠককে পীড়িত করে। তাঁর মানুষকে
দেখা, পৃথিবীকে দেখার মধ্যে যে গভীরতা ছিল তা গল্পে-উপন্যাসে
বিস্তারিত হলে কতই না সম্পদ সৃষ্টি হত। আমাদের মনে হয়, তিনি
বাংলা সাহিত্যকে এই দিক থেকে বঞ্চিত রাখলেন। পাওয়ার হিসেব
অবশ্য আমাদের কিছুটা প্রব�োধ দেয়।
তৃতীয় আর-একটা কথা। একটা ছ�োট উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করি—
‘১৯৫২ সালের দ�োসরা এপ্রিল। পার্ক সার্কাস ময়দানের মাঝখানে
দাঁড়িয়ে বিস্ময়বিমুগ্ধ একজন তরুণ দেখছে : ক�োনাকুনি পথ ভেঙে
দীর্ঘ পদক্ষেপে বিশাল প্যান্ডেলের দিকে ওই এগিয়ে চলেছেন মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায় ; তুর্কি কবি নাজিম হিকমতের কবিতার টাইপ-করা
ইংরেজি স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে সুভাষ মুখ�োপাধ্যায় ইন্টারভিউ দিচ্ছেন এক
অবাঙালি সাংবাদিকের কাছে, প্রেস-চিহ্নিত ঘেরাওয়ের মধ্যে বসে বিবরণী
লেখার জন্য তৈরি হয়ে আছেন মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, মঞ্চ থেকে
সভাপতিমণ্ডলীর নাম ঘ�োষিত হচ্ছে একের পর এক—ওস্তাদ আলাউদ্দিন
খান, উদয়শঙ্কর, যামিনী রায়, মামা ওয়রেরকার, সুমিত্রানন্দন পন্থ,
ভাল্লাথ�োল, মুল্ক্‌ র‌ াজ আনন্দ, কৃষণ চন্দর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়,
মন�োরঞ্জন ভট্টাচার্য, পৃথ্বীরাজ কাপুর...’
এর মধ্যে একটা বিষয় হল প্রত্যক্ষতা, যেন শুধু কবির নয়,
পাঠকেরও চ�োখের সামনে ঘটছে ঘটনাটা। শঙ্খ ঘ�োষের স্মৃতিকথার
এইটা একটা বড় লক্ষণ। যে জন্য তাঁর কথাসাহিত্য রচনার বিষয়ে
আমাদের অভাবব�োধ থেকেই যাবে। আর একটা বিষয় হল, সবাই
 16
বলে কবিরা সাল-তারিখের বিষয়ে অমন�োয�োগী, কবিরা নিজেরাও
নিজেদের সম্বন্ধে এই সংস্কার ছড়াতে এবং প�োষণ করতে ভাল�োবাসেন।
কিন্তু শঙ্খ ঘ�োষ ম�োটেই তা নন। তিনি আখ্যানের ধরনে স্মৃতিচারণা
করেন, তার রসটা ইতিহাসের নয়, গল্পের। কিন্তু চারপাশে ছড়িয়ে
রাখেন সনতারিখ। কবে বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলন শুরু হয়েছিল, কবে
কলকাতায় স�োমেন চন্দের হত্যার ধিক্কারসভা হল, কিংবা শুরু হল
কলকাতা পুস্তক মেলা—বস্তুতপক্ষে ১৯৫০-এর পরেকার কলকাতার
সাংস্কৃতিক জীবনের একটা ইতিহাসই যেন উঠে আসে তাঁর লেখায়।
কাজেই ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকেরা শঙ্খ ঘ�োষের স্মৃতিচারণাগুলিকে
কবির লেখা বলে তুচ্ছ করতে পারবেন না। আমি জানি না তিনি নিজে
ক�োনও ডায়েরি রাখতেন কি না, কিন্তু তাঁর আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি আমরা
নিজেরাও প্রত্যক্ষ করেছি নানা সূত্রে।
দ্বিতীয়ত, তাঁর রচনায় প্রশ্নবাক্যের বাহুল্য আছে বলে আমরা
দেখিয়েছি, তা সকলেরই চ�োখে পড়ে, কিন্তু তাঁর নিজের মধ্যেও
যে অনন্ত প্রশ্ন আছে, তা তাঁর জার্নাল-এর লেখাগুলি পড়লে
ব�োঝা যায়। কারও বক্তৃতা শুনছেন, কারও সাক্ষাৎকার পড়ছেন,
কারও সঙ্গে কথ�োপকথন চলছে, এ সব তাঁর ভাল�ো লাগছে তা
জানাতে তাঁর দ্বিধা নেই, কিন্তু সেই ভাল�ো লাগার মধ্যেও প্রশ্ন
থাকে, সংশ�োধন থাকে, যদিও সেটা যে সংশ�োধন তা বুঝতেই দেন
না তিনি। যেমন অমিয় চক্রবর্তী আর কবিপত্নী হৈমন্তী বললেন,
তাঁদের নবজাত শিশুকন্যা সেমন্তীকে (জন্মের দুদিন বাদে) দেখেই
রবীন্দ্রনাথের ‘শিশুতীর্থ’ লেখার কথা মনে হয়েছিল। শঙ্খ ঘ�োষ তার
পরেই য�োগ করেন—‘কিন্তু কেমন করে বুঝব আমরা সেকথা? লেখা
যে শুরু হল�ো এর দুমাস পর, জার্মানির এক প্যাশন প্লে৬ দেখে, সে
ত�ো অমিয়বাবুরই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা! ঠিক সেই মুহূর্তেই ত�ো দেশে
তিনি চিঠি লিখেছিলেন তাঁর সে-অভিজ্ঞতার বিবরণ জানিয়ে?’
এই হল শঙ্খ ঘ�োষের বিদ্যায়তনিক বা অ্যাকাডেমিক আল�োচনার
এক চেহারা। তিনি দৈনন্দিন নানা উপলক্ষ্যে তাঁর প্রশ্নাকুলতা তৈরি
রাখেন, সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকেন নিজে, ক�োনও জ্ঞানের প্রসঙ্গ এলেই
তার সত্যাসত্য নির্ধারণের বিষয়ে।

৩ গদ্য বলেন যখন


তাঁর আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা অবশ্যই মূলত লিখিত ভাষণ হত, যার
 17
সংগঠনে একটা পারিপাট্য থাকত, আর থাকত সুনির্বাচিত শব্দ, যা
শুধু তাঁর চিন্তাস্রোতকে বহন করত না, তাঁর আবেগকেও উন্মুখ করত,
দুইই আমাদের স্পর্শ করত। তাঁর উচ্চারণের মধ্যে ওই একটা সংযত
গাম্ভীর্য ছিল, কিন্তু কবিতার আবৃত্তির মত�োই তা ছিল আবেদনময়।
সেটা তাঁর বক্তৃতা যাঁরা শুনেছেন তাঁরা সকলেই জানেন। কিন্তু আমরা
দেখেছি, যখন তিনি অপ্রস্তুতভাবেও কিছু বলতে উঠেছেন তখনও
তাঁর কথা একটা চমৎকার সংগঠন পেয়েছে। তাঁর ক্লাসে পড়ান�োও
ছিল ওই রকম। জানি না, তাঁর ওই অপ্রস্তুত বক্তৃতা ক�োথাও ধরা
আছে কি না। থাকলে তাতে কথ্য গদ্যের আরও নানা মাত্রা বিচার
করা সম্ভব হত, তার উচ্চারণ, শব্দের নির্বাচন, তাতে জ�োর দেওয়া
না দেওয়া, এবং তাতে কীভাবে একটা সম্পূর্ণতা দিতেন তিনি।

৪ কিছু উচ্চারণ
‘নতুন শব্দের সৃষ্টি নয়, শব্দের নতুন সৃষ্টিই কবির অভিপ্রায়।’

‘আজকের দিনে কবিসমাজের যে আবহাওয়া তৈরি হয়েছে—শুধু


কবিতাসমাজ নয়, গ�োটা সমাজেরই—তাতে সংখ্যার হিসেব আর
প্রত্যক্ষতার হিসেবকেই ধরে-নেওয়া হয় প্রতিভার পরিমাপ, সেই হল�ো
কবিপরিচয়ে বেঁচে থাকবার হিসেব। প্রকৃতির চেয়ে পরিমাপ আজ বড়�ো।
অন্তরাল সহ্য করা কবিদের পক্ষে আজ অসম্ভব হয়ে উঠেছে তাই। কবি
আজ অনুষ্ঠাতা, প্রবহমান অনুষ্ঠাতা।’

‘পদ্যছন্দকে খুলতে খুলতে গদ্যকবিতার দিকে প�ৌঁছন রবীন্দ্রনাথ, আর


গদ্যকেই কবিতার সাজ পরিয়ে নিতে গদ্যছন্দকে ধরতে চান অবনীন্দ্রনাথ।’

‘সেমিনার ব্যাপারটার এই এক মুশকিল। ঔৎসুক্যের চেয়ে ক�ৌতূহল


সেখানে বেশি, জানবার ইচ্ছের চেয়ে যাচাই করবার ইচ্ছেটাই যেন বড়�ো।
এমন সেমিনার অল্পই দেখেছি, যেখানে বিজ্ঞ শ্রোতারা ক�োন�ো বিনয় নিয়ে
আসেন, নিজের গুরুগরিমা ভুলে কেবল বিষয়টির তদ্‌গত আকর্ষণেই
আসেন। সেমিনার হল পণ্ডিতদের টুপিতে আর�ো-একটি পালক গুঁজবার
খেলা, বায়�োডাটার ভল্যুম বাড়ান�ো। ‘যিনি বলছেন তাঁর চেয়ে আমিই-বা
কী কম জানি’ এই হচ্ছে এখনকার পণ্ডিতদের আত্মজিজ্ঞাসা।’

‘আর আজ, ঢুকছি যখন ভবনে, তখন এই ল�োকটি আমাকে বিমূঢ়


করে দিয়ে বলেছে : ‘ভিজলেন ত�ো? ঠান্ডা লাগেনি ত�ো? লাগে না বেশি
ঠান্ডা। আর তাছাড়া, আমি কাল বাড়ি ফিরে প্রার্থনাও করেছি আপনাদের

 18
জন্য, যেন ঠান্ডা না লাগে।’ দাতারাম বাল্মীকি এর নাম।
এই হল আরেকরকম মানুষ। মানুষ, যেমন হতে পারত। মানুষ, যেমন
হবার কথা ছিল। কিন্তু তার বদলে আমরা এমন হলাম কেন?’

‘...দেখতে পাই প্রাণনার সমস্ত মহলেই—জীব বা উদ্ভিদ—একের


দিকে অন্যের বিসর্পিত অভিমুখিতা, অভিমুখী সেই টানটারই অন্য নাম
ভাল�োবাসা। যে মনে করে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে প্রকৃতি থেকে, সর্বস্ব
থেকে, এমনকী সেও যুক্ত হয়ে আছে, থাকতে চায়, তার মুহূর্তের সঙ্গে,
প্রবাহণের সঙ্গে। য�োগ ছাড়া কিছু নেই, আর সেই য�োগেরই অন্য নাম
ভাল�োবাসা।’

টীকা
১ শঙ্খ ঘ�োষের গদ্যসংগ্রহ ১, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, ২০০২, পৃ. ১৭,
৩১।
২ গদ্যসংগ্রহ ১, পৃ. ১৬৫-৬৬।
৩ স্বপন বসু, বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস, কলকাতা, পুস্তক বিপণি, পৃ. ৮।
৪ গদ্যসংগ্রহ ৩, ২৬৬ পৃ.
৫ ওই, ১৪৬ পৃ.
৬ জার্মানির ওবেরআম্মেরগাউ গির্জায় অনুষ্ঠিত প্যাশন প্লে, রবীন্দ্রনাথ
১৯৩০-এ তা দেখেছিলেন।

 19
শঙ্খ ঘ�োষ : অবিরল
স্মৃতিসত্তা...
সমীর রক্ষিত

আল�োকচিত্র : সন্দীপ কুমার

কৈ শ�োরে দিদির মুখে শ�োনা। ইভাদির (বিশ্বাস) বিয়ে


হচ্ছে ক�োলকাতার শঙ্খ ঘ�োষের সঙ্গে। তিনি কবি।
জলপাইগুড়ির সেই কিশ�োরের স্মৃতিতে রয়ে
যায় একথা। তারপর সেই কিশ�োর এল বি-ই কলেজে পড়তে।
শিবপুরে। অচেনা কলকাতা। তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের রেলিং-
 20
এ ঝুলত বইপত্র। হঠাৎ চ�োখে পড়ে ‘দিনগুলি রাতগুলি’। শঙ্খ
ঘ�োষের প্রথম কবিতার বই। ঝপ করে কিনে ফেলা।
সে-কিশ�োর তখন য�ৌবনে পা দেয়া আমি। এবং সাহিত্যের
দিকে ঝুঁকে পড়েছি। বিশেষত কবিতায়।
কফি হাউসের তরঙ্গ গর্জন শ�োনা যায়। বন্ধু বান্ধব সন্ধান।
কফির তীব্র গন্ধ আর সিগারেটের ধ�োঁয়ার র�োমাঞ্চ মিশে যায়।
শক্তি, সুনীল। অদূরে ‘পরিচয়ে’ সুভাষ মুখ�োপাধ্যায়। তখন
আমার সবচেয়ে পঠিত প্রিয় কবি।
শিবপুর বি-ই কলেজের পাঠ যখন শেষে, ডালহ�ৌসিতে এক
স্থাপত্য ফার্মে কর্মস্থল। দু’বছরেও মন বসল না। এরপর স্থাপত্য
বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।
উত্তর-দক্ষিণ লম্বা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এপার-ওপার আছে।
মাঝখানে পুবে পশ্চিমে এক দলা, তার ওপরে আবার একটা
দ�োলনা ব্রিজও আছে। এখনও।
এপারে দক্ষিণে গ্রন্থাগার—সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, ইঞ্জিনিয়ারিং
ফ্যাকালটি ও মূল প্রশাসনিক কেন্দ্র—অরবিন্দ ভবন।
আর উত্তরে আর্টস ফ্যাকাল্টি। সাহিত্য জগতের নক্ষত্রল�োক।
দ�োলনা ব্রিজের দিকে মুখ করে দ�োতলার একটি ঘরে আবার শঙ্খ
ঘ�োষকে পাওয়া গেল।
কিছুকাল কেটে যায়। তখন আমি আমাদের শিক্ষক সংগঠনের
সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত। শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সামাজিক
কর্মে উৎসাহীদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি হল। উদ্দেশ্য শিক্ষক
সংগঠনের একটি ম্যাগাজিন নাম ‘মুখপত্র’-প্রকাশিত হবে। সিদ্ধান্ত
গৃহীত হল সর্ববাদীসম্মতভাবে। সহসা আমাকে অবাক করে দিয়ে
শঙ্খ ঘ�োষের মত ব্যস্ত মানুষ বলে ওঠেন—আমি ‘মুখপত্র’র প্রুফ
দেখে দেব। এবং তিনি সুবীর রায়চ�ৌধুরী ও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের
দক্ষিণে টিবি হাসপাতাল পার হয়ে যেতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ এক প্রেসে। তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন তাঁর কর্তব্য।
শঙ্খ ঘ�োষ তাঁর দায়িত্ব শুধু অত্যন্ত সুচারুরূপে পালন করেননি
সেই সঙ্গে তাঁর স্বেচ্ছাব্রতের বিরল চরিত্রকে, সামাজিক দায়ব�োধকে
অতি উজ্জ্বল আল�োয় চিরচিহ্নিত করে গেছেন। এমন কবি সামাজিক
দায়ব�োধে অবিচল মানুষ আজ বিরল। কাজেই তাঁর প্রয়াণ নেই।
তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত জুড়ে চিরকাল জেগে থাকুন।
 21
সময়ের শব্দ
যশ�োধরা রায়চ�ৌধুরী

আল�োকচিত্র : সন্দীপ কুমার


নাইনটিন এইটি ফ�োর গ্রন্থে জর্জ অরওয়েলের একটা উক্তি
আমার কাছে বারে বারে ফিরে আসে। তিনি বলেছিলেন আমাদের
জীবিতকালেই ক�োন বিশাল পরিবর্তন দেখতে পাবার সম্ভাবনা কম।
আমাদের আসল জীবন আছে ভবিষ্যতের গর্ভে। সে ভবিষ্যৎ ঠিক
 22
কতদিন পরে, তাও আমরা জানিনা। দশ বছরও হতে পারে, হাজার
বছরও হতে পারে। তবু শুভচিন্তার আর যুক্তিব�োধের এলাকাটা অল্প
অল্প করে বাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে। ওটুকুই আমাদের কাজ।
লেখাটি পড়ে আমার অবধারিতভাবে শঙ্খ ঘ�োষের অননুকরণীয়
স্বরক্ষেপণে বলা, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের করা দূরদর্শনের জন্য
তথ্যচিত্রটির একটি উক্তি মনে পড়েছিল। যেখানে তিনি বলছেন
তাঁর সেই চাপা ও দৃঢ় স্বরে, ফ্যাসিজমকে আমরা নিন্দা করি।
কিন্তু নিন্দা করতে করতে কখন যেন নিজেদের অজান্তেই আমরা
নিজেদের ভেতরে ফ্যাসিজমকে লালন করি। জানতে পারিনা
আমরা নিজেরাও ফ্যাসিস্ট হয়ে গেছি।
সুচিন্তা, শুভচিন্তা, শান্ত স্বরে বলে চলা যুক্তির কথন আজকের
এই জগত থেকে যত মুছে যাচ্ছে, ব্ল্যাকব�োর্ড ভরে ভরে উঠছে
মারাত্মক কাটাকুটি দাগে, অরওয়েলের কথা বা শঙ্খ ঘ�োষের কথা
যেন ভেজা ডাস্টারের মত তত কয়েক বর্গ ইঞ্চি করে মুছে মুছে
ব্ল্যাকব�োর্ডটা পরিষ্কার করে করে দিচ্ছে। যাতে তাতে লেখা চলে
স্পষ্ট কিছু অক্ষর। শান্ত কিছু অক্ষর।
লেখক বা স্রষ্টার সঙ্গে তার পারিপার্শ্বিকের ক্ষমতাবলয়ের যুদ্ধটা
চিরদিনের। আজ তার ধার কিছু বেশি। তবু এই যুদ্ধ অনিবার, এরই
ইতিহাস মানব সমাজ। যতক্ষণ না চারিদিক থেকে চাপ আসে,
যতক্ষণ না লেখক অনুভব করেন কলম বা তুলি তুলে নেওয়াও
একরকমের অবস্থান নেওয়া, লড়াইয়ে শামিল হওয়া, ততক্ষণ তাঁর
সৃষ্টিতে সেই যাচিত আগুন থাকে না ব�োধ হয়, পাঠক যা থেকে
নিজের দীপ জ্বালিয়ে নিতে পারেন।
আমাদের এখনকার লেখাকথাগান সিনেমা, এখনকার শিল্প, সাহিত্য
ক�োথাও যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে মনে হয়, নিজের বাস্তবতা থেকে।
না, আলগা স্টেজ গরম করার প্রতিবাদের কথা বলছি না হয়ত।
চারদিক থেকে যাবতীয় অন্যায় অবিচারকে তিল তিল আহরণ করে,
নিজের ভেতরে তার প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়ে ওঠার জন্য অপেক্ষা
করে, ঝুঁকি নিয়ে কিছু একটা লিখে বা তৈরি করে ফেলার যে কাজ,
তা যে কত কঠিন আর অমিল আজকের দিনে।
ক�োন আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠছেন শিল্পী সাহিত্যিক, এমন
ক�োন ঘটনাকে গল্পকথা মনে হতে শুরু করেছে, আজকাল
জনমানসে তাই বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে রসিকতা, ইয়ার্কিও সেই দিকেই
 23
নির্দেশ করে। পাঠক আর বিশ্বাস করেনা যে লেখক ক�োন সততা
বা সিনসিয়ারিটি থেকে রচনা করছেন। আগুনও আহরণ করতে
পারেন না। এই সময়ের এটাই অভিশাপ। এতটাই অবিশ্বাসী সময়
আমাদের।
যেন নিখিলেশ চরিত্র, রবি ঠাকুরের ঘরে বাইরে-তে। যেন ছত্রে
ছত্রে মিলে যাওয়া, প্রায় ভবিষ্যৎবাণীর মত। কীভাবে প্লেগ বিচ্ছিন্ন
শহর হয়ে ওঠে ডিপ্রেসনে ডুবে যাওয়া বিরহ আক্রান্ত প্রেমিক
প্রেমিকার শহর, অবিশ্বাসের শহর, একে অপরকে সন্দেহ করার,
সহানুভূতিশূন্য হবার শহর, তা পড়ে ভাবি কামুর দ্য প্লেগ বইতে,
এ ত আমাদের সময়ের কথা।
সেভাবেই পাতা উল্টোই নয়ের দশকে পড়া ক�োন বইয়ের।
যে বইয়ের নাম লাইনেই ছিলাম বাবা। পাতায় পাতায় লেখা ছিল
ক্ষমতার, ডিক্টেটরশিপের, চাপিয়ে দেওয়া রাজনীতির আগুনের
মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসা এক মানুষের র�োজ নামচা। বইটি ১৯৯৩
তে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে হৈ চৈ ফেলা বললে শুধু ভুল হবে, তার
লাইন বাই লাইন প্রবাদপ্রতিম হয়ে গিয়েছিল। যেভাবে পরশুরামের
কাহিনির এক একটি বাক্যবন্ধ প্রবাদপ্রতিম, হয় হয় জানতি পার�ো
না বা ঠ�োঁটের সিঁদুর অক্ষয় হ�োক ধরনের, সেভাবে এই যে আমাদের
সময়ের চারণ কবি, যাকে ভগবান মেনে চলেছে প্রজন্মের পর
প্রজন্ম, প্রতিটি লেখাতেই এঁকে আমরা আলাদা করে সেলাম করেছি
আর অন্যমনেই মুখস্ত হয়ে গেছে এঁর স�োজাসাপটা লাইনগুলি, যেন
ভঙ্গিমার কাতরতাহীন ভাণহীন, এই সময়ের যা সবচেয়ে সম্পন্ন
মুখ�োশ সেই শিল্পের ভণিতা অতি অলংকরণ থেকে বহু দূরে এক
সত্যকথনের গরিমাময় আল�োতে চ�োবান�ো।
১৯৯৩ সালের বইটি তখন ক�োন রাজা , রাজড়া, ক�োন শাসকের
প্রতি লেখা, তা অনুক্ত থাক, উহ্য থাক। সেসময়ে যে ক্ষমতাবৃত্ত
বলেছে, ‘মত তা-ই যা আমার মত’ সে বৃত্ত সময়ের আন্দোলনে
নেমে গিয়েছে মাটিতে, উঠেছে অন্য ক�োন ক্ষমতাবৃত্তের নতুন
স�ৌধ। সেই ক্ষমতাও এই মুহূর্তে, ‘আজ ২০১৯ সালেও বলছে, মত
তা-ই যা আমার মত’।
‘অন্ধের কাছে কী বা রাত্রি কী বা দিন’ এই বাক্যবন্ধ কবি লেখবার
পর কত অগুন্তিবার উচ্চারণ করেছি আমরা। প্রথম যে বইতে
কবিতার লাইন হিসেবে ঠাঁই পেয়েছিল তা, সে ত এই বইই!
 24
বিস্ময়ের বই, আমার যখন ২৮ বছর তখনকার বই, চিরন্তন বই,
লাইনেই ছিলাম বাবা। এখন�ো প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ মাথায় গাঁথা।
কাড়াকাড়ি করে পড়া আমাদের, তাও মনে পড়ে।
লাইনেই ছিলাম বাবা, লহমার জন্য ছিটকে গিয়ে
খুঁজেই পাই না আর নিজেকে— কী মুশকিলে পড়েছি!
এটা ত�ো আমারই টিন? আমার না? এটাই আপনার?
সবই দেখি একাকার। আমি তবে ক�োথায় রয়েছি!
এ কী হচ্ছে? সরে যান-না! আরে আরে— আমরা কি আলাদা?
দেখছেন ত�ো সবকটা এই একসঙ্গে জাপটান�ো দড়ি বাঁধা।
থামুন না! তুমি কে হে? আমি? হেই। হ�োই হেই হাঁট।
প্রতিবাদ? না না বাপু—কিছুই করছি না প্রতিবাদ।
ক�োন�োমতে ফিরে যাব ফাঁকা টিন বাজিয়ে সহজে—
আগুনই ক�োথাও নেই— কী হবে-বা জ্বালানির খ�োঁজে।
(লাইন/ শঙ্খ ঘ�োষ)


মনে পড়ে ১৯৮৫ সাল। প্রেসিডেন্সি কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের
শেষাশেষি অথবা সেকেন্ড ইয়ারের শুরু সেটা। কলেজটাই নরম
ল�োহার পাতকে দুমড়ে মুচড়ে আকার আকৃতি দেয়। কলেজের তিন
প্লাস দুই ওই পাঁচটা বছর। আমার কাছে অম�োঘ, অনিবার্য। বি এ
ফার্স্ট ইয়ার থেকে এম এ পড়া অব্দি জীবনের বছরগুল�োর যে দৃপ্ততা,
তা আমার বাকি জীবনকে গড়ে দিল। দেয় ব�োধ হয় এভাবেই। আর
সেই সময়ের প্রতি মুহূর্ত কীভাবে যেন গানে কবিতায় বইয়ের পাতা
ও সিনেমায় এক জমজমাট হয়ে চলা, বেজে ওঠা অর্কেস্ট্রা ছিল।
সেই অর্কেস্ট্রায় প্রায় প্রতিদিন ছিলেন শঙ্খ ঘ�োষ ও তাঁর কবিতারা।
আমাদের কলেজ জীবনের সেই দিনগুল�োর ধরতাই ছিল
রাজনীতি। এক দিকে এসএফআই, অন্যদিকে অতিবাম রাজনীতির
ছেলেপিলেরা ক্যান্টিন কাঁপাত, প�োর্টিক�োয় জমায়েত হত। ক্লাসে
ক্লাসে ক্যামপেন করত। ত�ো, সেইসব ক্যাম্পের থেকেই আসত
ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা, ভ�োট পেয়ে যারা ইউনিয়ন রুম দখল
করত আর তারপর একের পর এক আয়�োজন করত নানান
প্রতিয�োগিতার।
আশ্চর্যের কথা, সেরকমই এক ইউনিয়ন আয়�োজিত আবৃত্তি
প্রতিয�োগিতায় প্রথম বিষয় হিসেবে পেয়েছিলাম, ‘বাবুমশাই’।
 25
সে ছিল একদিন আমাদের য�ৌবনে কলকাতা!
বেঁচে ছিলাম ব’লেই সবার কিনেছিলাম মাথা
আর তাছাড়া ভাই
আর তাছাড়া ভাই আমরা সবাই জেনেছিলাম হবে
নতুন সমাজ, চ�োখের সামনে বিপ্লবে বিপ্লবে
যাবে খ�োল-নলিচা
যাবে খ�োল-নলিচা পালটে, বিচার করবে নিচু জনে’
কিন্তু সেদিন খুব কাছে নয় জানেন সেটা মনে
মিত্র বাবুমশয়
প্রত্যেকের মুখে মুখে ফেরা সেই কবিতার সঙ্গে ক্যান্টিনের টেবিল
পিটুনির শব্দ। ছন্দের মায়াজালের সঙ্গে সঙ্গে, আজ্ঞে হ্যাঁ, সেই
ইতিহাসচেতনাই। কেননা তখন সময় লালে লাল। আমরা কম্যুনিস্ট
কাকে বলে জানছি। কম্যুনিস্ট আদর্শবাদের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের সংঘাত
নিয়ে এ কবিতা তার আগে অথবা পরে অনেকেই আবৃত্তি করেছে। কিন্তু
মুখে মুখে ফেরা সেই মজাদার ছড়ার ছন্দের সূত্র একবার যার মাথার
ভেতর বসে গেছে, তার জীবন হয়ত পুর�োটাই একরকম থাকেনি।
এই যে কলেজ ক্যান্টিনে বসে বসে জীবনের কিছু পাঠ নেওয়া,
এই যে প্রতিটি রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ, আর এই
যে কবিতার মধ্যে দিয়ে তা ঘটা — কেমন এক অব্যর্থ দীক্ষা এটা।
শঙ্খ ঘ�োষের ভাষাতেই বলতে ইচ্ছে করে :
‘আর কলকাতা, কলকাতা খুলে দিল সাম্প্রতিকের দরজা। একদিনে
নয়, দিনে দিনে। সেখানেও ছিল বহিরাগতের ভীরুতা, জানা ছিল না
ক�োনদিকে আছে পথ... প্রেসিডেন্সি কলেজের পিছনবেঞ্চ থেকে সামনের
দিকে টান দিয়েছিল যারা, তারা কবি ছিল না কেউ, ছিল কবিতার
প্রেমিক। তাদেরই হাতে উপহার পেয়ে পেয়ে একদিন আধুনিক কবিদের
পৃথিবীতে প�ৌঁছে গেছি কখন। ছমছমে এক অজানা গুহার সামনে সেই
আমাদের সমবেত মুগ্ধতা – আজও স্পষ্ট মনে পড়ে।’ (কবিতার মুহূর্ত)
আশ্চর্য, এই কথা কি আমার�ো নয়? অথবা, আমরা কি
নিজেদেরই বার বার করে তৈরি করে নিইনা আমাদের পিতৃসমদের
আদলে? হয়ত এভাবেই ঘটে দীক্ষা, চলে প্রজন্মের পর প্রজন্মে
চলাচল, মানসধারার।
হ্যাঁ, সেই বইটিকে আবিষ্কারও আমার ক্যান্টিনে বসেই। একদিন
এক বন্ধু ক্যান্টিনে নিয়ে এল পাতলা একটা বই। কবিতার মুহূর্ত।
এ বই নিয়ে কীভাবেই না কাড়াকাড়ি করেছি আমরা। এই বইতেই
 26
পেয়েছি, কবির নিজের লেখা নিজের কবিতার ইতিহাস — যে
প্রবন্ধটির নামই ‘কবিতার মুহূর্ত’।
‘যমুনাবতী’-র মত অতি জনপ্রিয় কবিতার লেখার পেছনের
ঘটনাকাহিনি, ক�োন সে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সংয�োগ করে চিন্তার বারুদে
আগুন, আর ঘটিয়ে ত�োলে কবিতার আতশবাজি...তা জানার সুয�োগ
পেয়েছি। জেনেছি ‘বাবরের প্রার্থনা’-র মত কবিতার প্রেক্ষাপট। আর�ো
কত, কত কবিতা। ‘আরুণি উদ্দালক’, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’,
‘লজ্জা’, ‘ভিখিরি ছেলের অভিমান’, ‘কলকাতা’। প্রতিটা কবিতা
নিজেকে উন্মোচিত করেছে আমার কাছে, এই কবিতার মুহূর্তের হাত
ধরে ধরেই। আর কী বিশাল এক ইতিহাসপট রচিত হয়েছে মাথার
ভেতরে। কতটাই না বড় হয়ে খুলে গেছে কবিতার আকাশ।
হ্যাঁ, ইতিহাসচেতনার প্রথম পাঠ ত�ো এভাবেই পেতে হয়।
সমাজসচেতন, এক তীব্র সময়-সংবেদী কবির প্রতিটি অক্ষরকে হতে
হয় সৎ ও দায়বদ্ধ, প্রতিটি অক্ষর থেকে ঝরে পড়ে তাঁর বিশ্বাসের
কথা – এই কথাটিও মনের ভেতর মুদ্রিত হয়েছে সেই সময় থেকেই
অম�োঘভাবে। আর ত�ো ক�োনমতেই তা থেকে মুক্তি এল না আমার
মত সামান্য কবিতালেখকেরও।
নিজেকে যখনই মনে হয়েছে বিচ্ছিন্ন, প্রেসিডেন্সির ক্যান্টিন থেকে
শুরু করে, জীবনের যে যে ক্ষেত্রে নিজের ‘অয�োগ্যতা’ নিজেই দেখে
মুখ লুকিয়ে সরে আসা হয়, তখন ত�ো সাথী হয় ‘কলকাতা’-র মত
অম�োঘ কবিতাই। ‘বাপজান হে/ কইলকাত্তায় গিয়া দেখি সক্কলেই
সব জানে/ আমিই কিছু জানিনা’...


এরপর আমরা বড় হয়ে গেলাম। আমরা আমাদের যার
যার জীবনে অংশগ্রহণ করলাম। আমি ত�ো আর ফিরে যাইনি
পঠনপাঠনের প্রাঙ্গনে, করিনি মেধা ও জ্ঞানের বিশ্ববিদ্যায়তনিক
চর্চা। অ্যাকাডেমিশিয়ার থেকে দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছি আমি। এসেছি
অন্য পেশায়। ১৯৯৩ সেই সময়। আমি ইতিমধ্যেই শিমলাতে
তখন। কলকাতায় এসে সংগ্রহ করলাম বিপুল হৈ চৈ পড়ে যাওয়া
বইটি। প্রায় মুখে মুখে একেবারে অনিবার্য হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই
‘তুমি ক�োন দলে’ কবিতাটি।
তার আগে ও পরে, সারা ভারতে যেমন ধর্ম জাতপাতের
 27
সুভাষ মুখ�োপাধ্যায়কে লেখা শঙ্খ ঘ�োষের লেখা একটি চিঠি

ভিত্তিতে ছুঁতমার্গ, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক রঙ বা পার্টির ছুঁতমার্গ


একই থেকে গেছে , (যাকে কেউ কেউ শ্লেষ করে বলেন, পলিটিকাল
অ্যাপারথাইড) আর অম�োঘ থেকে অম�োঘতর হয়ে উঠেছে এই
প্রশ্নটা, তুমি ক�োন দলে। শিক্ষাক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত জীবনে, শ্মশানে
রাজদ্বারে। সবকিছু রেঙে উঠেছে বাম দক্ষিণের রঙে, সমর্থক
বির�োধীর রঙে, আমরা ত�োমরার রঙে।
আত্মঘাতী ফাঁস থেকে বাসি শব খুলে এনে কানে কানে প্রশ্ন কর�ো
তুমি ক�োন্ দল/ রাতে ঘুম�োবার আগে ভাল�োবাসবার আগে প্রশ্ন কর�ো
ক�োন্ দল তুমি ক�োন্ দল
আজ�ো আমাদের এই ভারতে এই বাংলায় প্রতিমুহূর্তে রক্ত
ছিটকে উঠছে , অন্য দলের চিহ্নিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে, প্রতি মুহূর্তে
প্রতি লাইন, প্রতি অক্ষর কাগজে বসাবার প্রায় সাথে সাথেই চিহ্নিত
 28
হচ্ছে লেখক, ক�োন দলের সে।
১৯৯৩ মানে, আমার জীবনে প্রথম ছাপা হওয়া কবিতাদের
সময়, প্রথম কবি স্বীকৃতির সময়। নিজের প্রথমদিকের কবিতা
লিখতে লিখতে, অদৃশ্য এক হাত মাথার উপর অনুভব করিনি
সর্বদাই, তাঁরই? তাঁরই দেখান পথে কি যাইনি, শ্লেষের পথ ধরে,
নয়া-অর্থনীতির পরবর্তী নব্বই দশকের দিনকালে, সমসময়ের
অলিগলি চ�োরাপথগুলি ঘুরতে, সেগুলি নিয়ে লিখতে! এতটাই,
এমনকি, যে, দেশ পত্রিকার দপ্তরে লেখা জমা পড়ার পর, শ্রদ্ধেয়
সম্পাদক বলেছিলেন নাকি (অপর এক কবির মুখেই যা আমার
বিশ্রুত), এই মেয়েটি শঙ্খ ঘ�োষকে অনুসরণ করে দেখছি।
‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘আয় আর�ো বেঁধে বেঁধে থাকি’ বা
‘এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায়’-এর মত কথা সবই শঙ্খ ঘ�োষের
লিখিত কবিতার লাইন, কিন্তু আমাদের প্রজন্মের এক-একটি
স্লোগানের মত। ‘রাতে ঘুম�োবার আগে ভাল�োবাসবার আগে প্রশ্ন
কর�ো ক�োন্ দল তুমি ক�োন্ দল’, ‘শবের উপর শামিয়ানা’ — এক
একটি মেধাবী খড়্গ, না ব�োঝার, কুয়াশার আঁধার কেটে ফেলার।
মুখে মুখে উচ্চারিত হবার মত সহজ, গভীর, তীব্র, আল�ো।
এই সব কবিতা নানা বই থেকে। তবু কেবল এই একটি বই
আজ যখন হাতে নিয়েছি এই মুহূর্তে পড়ে ফেলছি শুরু থেকে
শেষ, কী নির্বিকল্প, কী সমসাময়িক তা। সে সময়ে ৭৭ থেকে ৯৩
এর ১৬ বছরের বাম শাসনের ‘শান্তিকল্যাণ’-এর পশ্চিমবঙ্গ ছিল।
এক মজে যাওয়া, পলিতকেশ বিশ্বাসের, অথবা বিশ্বাসহীন আদর্শ-
কপচান�োর সময়ের শবের উপর শাসকের শামিয়ানা ছিল হয়ত বা।
আজকে আছে অন্য এক ক্ষমতাতন্ত্র, অন্য সব ভয়। ফ্যাসিজমের
করাল ছায়া। প্রতি মুহূর্তে ভয়ে থাকার দিনকাল। অভিপ্রায় ধমক
চমক। সামান্য বিরুদ্ধতার আঁচ পেলেই শাস্তির খাঁড়া নেমে আসা।
আসলে ক্ষমতায় বসা মানুষগুল�ো পালটায় পার্টির রং পালটায় রাজা
আসে রাজা যায় কিন্তু দিন বদলায় না, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আগেই
জানিয়েছিলেন। শঙ্খ ঘ�োষ আমাদের জানালেন,
তিন রাউন্ড গুলি খেলে তেইশজন মরে যায় ল�োকে এত বজ্জাত হয়েছে!
স্কুলের যে ছেলেগুলি চ�ৌকাঠেই ধ্বসে গেল অবশ্যই তারা ছিল সমাজবির�োধী। ...
পুলিশ কখন�ো ক�োন অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ।
( ন্যায় অন্যায় জানিনে)

 29
রাষ্ট্র তার নিজস্ব অস্ত্রগুলি সর্বদা চ�োখা রাখে। তাই সিঙ্গুর
নন্দীগ্রাম মনে পড়ে, তারপর সম্প্রতি আবার�ো মৃত্যু মনে পড়ে
ইস্কুলবালকদের, পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুরে... মনে পড়ে কাশ্মীর,
মনে পড়ে ছত্তিসগড়।
‘আমি যখন চালাই গুলি /বুলেট ত�ো প্রায় ক্ষীরের পুলি/ লক্ষ্যে
ঠিকই থাকে মাথার খুলি’ অথবা ‘আমি যখন মারছি ত�োমায়/ বুঝতে
হবে সেসব সময়/মরছ কেবল নিজের নিজের ব�োমায়’ (গানের
মত�ো)
সেই একই কবিতা কী অব্যর্থভাবে এখানেও তাই প্রয�োজ্য, এই
সময়েও।
নিজের বুদ্ধিবৃত্তির ওপরে অসম্ভব আত্মপ্রত্যয় যে ‘পাবলিকের’
সেই পাবলিক এখন, উত্তর ডিজিটাল যুগে, হ�োয়াটসঅ্যাপ
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া করতে করতে আর�ো বেশি বুদ্ধিমান কিনা,
তাই মনে হয় এই কবিতা আজই লিখলেন কবি :
হঠাৎ কখন�ো যদি ব�োকা হয়ে যায় কেউ, সে ত�ো নিজে আর
বুঝতেও পারে না সেটা/ যদি বুঝতই তাহলে ত বুঝদারই
বলা যেত তাকে। তাই যদি, তবে
তুমিও যে ব�োকা নও কীভাবে তা বুঝলে বল�ো ত�ো? (ব�োকা)

দেশপ্রেমের থর�ো থর�ো এই সময়ে, ভাসমান এবং চলমান দেশভক্তির


এই হিড়িকে, এই লাইনদুটিও ত হয়ে ওঠে অনিবার্য তাই।
‘গ�োটা মগজ আমায় দিয়�ো
তবেই হবে দেশপ্রিয়
দেশও হবে অবিস্মরণীয়’ ( গানের মত�ো)

একই কবিতা সমকালীন আবার চিরকালীন তাই। কেননা,


“আমাদের এই সময়টাকে সবদিক দিয়ে সর্বার্থে জড়িয়ে আছেন
তিনি। তাঁরই কথায়, ‘শিকড় দিয়ে আঁকড়ে’ আছেন। বাংলা কবিতায়
প্রায় ষাট বছর ধরে তিনি তৈরি করে নিয়েছেন এমন এক পথ, যে-
পথে স্বল্প যাত্রী, যে-পথে সামান্য আল�ো জ্বলে। সমাল�োচনায় নিয়ে
এসেছেন সর্বজনব�োধ্য এক জ্ঞানচর্চার দিশা, সংক্রামকভাবে বারবার
সাড়া দিয়েছেন সংকট সময়ে।’’
–শঙ্খ ঘ�োষ বিষয়ে রেজাউল করিম সুমন
কবির ‘নিঃশব্দের তর্জনী’কে, অনেকে বলেন, ‘নিহিত
 30
পাতালছায়া’-র ভূমিকা। নিজের ভেতরে সমসময়কে বিস্তার দেওয়া।
এ বড় কঠিন দায়। অথচ কবি যেহেতু ক্রমাগতই এ কাজটি করে
চলেন, কবিতায় ও গদ্যে, তাই এ কথা মনে হতেই পারে। ‘কবি
ও তার পাঠক’ বলে এ গ্রন্থে একটি প্রবন্ধ আছে। যে লেখায় কবির
নিজস্ব বীক্ষণকে আমরা পাচ্ছি। সেখানেই কবি ‘সমসময়’ নামে
একটি অংশে লেখেন :
...কাকে বলি সমসময়। আমরা সকলে যে ঠিক একটাই সময়ে
বেঁচে আছি, আমাদের সকলের সময় যে একেবারে সমান, এ কথা তত
সত্যি নয়।... সময়ের যেন ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি তল তৈরি হয়ে আছে
আমাদের ভিন্ন জনের অভিজ্ঞতায়...
শিক্ষিত অশিক্ষিত, ধনী নির্ধন সকলেই কি আসলে আলাদা
আলাদা সময়ে বাঁচি না আমরা? আলাদা আলাদা বৃত্তে?
তারপরই তিনি বলেন, সমসময়কে তাই ধারণ করা যায়না, করা
যায় ঐতিহ্যকে। ঐতিহ্য মানে কিন্তু অতীতমাত্র না, সে স্থাণু নয়।
সে বার বার আবিষ্কৃত হয়।
সেখানে কবি নিজেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বলে দেন, শিল্পীর/
কবির কাজ হল — দেশনিহিত কালকে দেশ�োত্তর কালে প�ৌঁছে
দেওয়া। নদীকে সমুদ্রে মিলিয়ে দেওয়া। বারবার এইসব প্রশ্নে
ফিরে ফিরে এসেছেন তাঁর সারাজীবনের কথায়, লেখায়। আমি
শুধু আল�ো পেয়েছি, দিশা পেয়েছি, ঘ�োর তমসায় যেমন দিশা
দেখায় কম্পাস।
সমসময়কে দূরবীক্ষণ নিয়ে দেখার ক্ষমতাটি দিয়ে তিনি
আমাদের কম্পাস হয়ে থাকেন। যে সময়ের বাসিন্দা আমরা, যে
দেশের বাসিন্দা, সে দেশ ও কালে বেঁচে থাকতে থাকতেই সমসময়
পাতিত আকারে প�ৌঁছে যাচ্ছে তাঁর কবিতার ভেতর দিয়ে পরবর্তী
পাঠকের হাতে।


শঙ্খ ঘ�োষকে নিয়ে বলার মূল কথাটি কিন্তু আরেকটু আলাদা।
সেটা হল এইই, যে, তিনি কখন�ো অন্য কারুকে দ�োষ দেন না
তাঁর লেখায়। তাঁর শ্লেষ এতটা বিদ্ধকারী কারণ তাঁর দ�োষার�োপের
জন্য তুলে ধরা আঙুলগুলির কিছু যেমন অন্যদিক বাকিগুলি সব
নিজের দিকেই ফেরান�ো। কখন�ো ভুলতে দেননা, আমরা আপন
 31
দ�োষে কীভাবে নিজেদের জড়িয়ে নিচ্ছি এই ভয়াবহ সময়ের সাক্ষ্যে,
ভয়াবহ ধ্বংসের বা মৃত্যুর অনেকগুল�োই আমরাই সাধন করছি
ঘটাচ্ছি মানুষকে ঠেলে দিচ্ছি অনিবার্য মৃত্যুর মুখে। এই ভয়ানক
আত্মদগ্ধকারী বিবেকের সচেতনাই আমাদের উত্তরাধিকার এই বই
থেকে। ফ্যাসিজম সম্বন্ধে বলা হয় একজন ডিক্টেটর, যথা হিটলার
কীভাবে জন্মেছিলেন সেটা বড় প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন এই যে এতজন
সাধারণ জার্মান কীভাবে নাৎসিবাহিনীর উদগ্র সদস্য হয়েছিলেন,
এত জন কীভাবে বিশ্বাস করেছিলেন হিটলারের পথই একমাত্র পথ।
অন্ধ প্রশ্নহীন আনুগত্যে আমরা, আমি আপনি তিনি আমাদের মত
সাধারণরাই আসলে বিশাল বিশাল সব নেতানেত্রীদের তৈরি করি।
দ�োষ কার�ো নয় গ�ো মা, নেচে নেচে এসেছ হে শ্যামা
নৃমুন্ডমালিনী, খচ মুন্ডু কেটে নেবে বলে, সে ত�ো
আমারই আদরে, আমি খাল কেটে এনেছি ত�োমাকে —
কীভাবে কেটেছি তাও কিংবদন্তি হয়ে আছে আজ। (শ্যামা)
সেকারণেই, এই অস্বস্তিকর যাত্রায় আত্মদর্শনে ক�োন নিবৃত্তি
দেন না কবি। দেন না ক�োন নিষ্কৃতি আমার নিজস্ব অপরাধব�োধ
থেকে। আমাকে কখন�ো তিনি ছেড়ে দেন না। পাঠক কবির সঙ্গে
চলে নিরুপায়। কেননা সেও সমান হেঁটমুন্ড।
আর এই সবটাই লেখা হয় নির্জলা পথের ঘাটের সর্বজনের
ভাষায়। গভীর থেকে গভীরে চলন অথচ বাচনে সর্বজনগ্রাহ্যতা।
এইই আমাদের সময়ের স্বর শঙ্খ ঘ�োষ। যাঁর প্রবাদপ্রতিম অস্তিত্ব
আর�ো এক শতক ছুঁয়ে থাকবে আমাদের।

 32
নিঃশব্দের সংয�োগ
শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়

আল�োকচিত্র : সন্দীপ কুমার

বি শেষণে সবিশেষ আস্থা ছিল না শঙ্খ ঘ�োষের। নিজের


গদ্য লেখা নিয়ে যতই মজা করে লিখুন যে, সারাজীবনে
তিনি না কি ‘নিঃশব্দের তর্জনী’র মত�ো সাড়ে তিন পৃষ্ঠার
একটি গদ্য বা জার্নালধর্মী কিছু টুকর�ো লেখা ছাড়া আর ক�োন�ো গদ্য
‘স্বেচ্ছায় বা সানন্দে’ লিখতে পারেননি কখন�ো— পাঠক জানে তাঁর
গদ্যলেখা বস্তুত কবি শঙ্খ ঘ�োষের চালচিত্রটিকে অনুপুঙ্খে সাজায়।
জার্নালধর্মী বা আত্মজনকথামূলক লেখাগুল�ো সরিয়ে রাখলে বাকি
যে বিপুল গদ্যের সম্ভার, তার একটি অক্ষ যদি রবীন্দ্রনাথ হন, তবে
অন্যটি নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনা— কবিতার (বৃহত্তর অর্থে শিল্পেরও)
আঁতের কথা পরতে পরতে খুলে দেখান�ো। প্রসঙ্গত বলে রাখা
দরকার, রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে ক�োন�ো স্থাণু বিগ্রহ ছিলেন না, ছিলেন
 33
চেতনার নিরন্তর প্রহরী। মনকে মুক্ত রাখা, সজাগ ও বিচারশীল
রাখার বিশল্যকরণী। অনেকটা যেন ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’
কবিতাবইয়ের ‘ঝড়’ কবিতাটির শেষ পঙক্তির মত�ো— ‘আমারও
নিয়তি এই, ত�োমাকেই ঘিরি পাকে পাকে’। অন্যদিকে অপর অক্ষটি
দাঁড়িয়ে রয়েছে পাঠক, রুচি আর সমগ্রতার ধারণার ওপর। একথা
অবশ্য একেবারেই বলা যাবে না যে আমরা এই দুটি অক্ষের কথা
কল্পনা করলেও, এই দুই ধরনের লেখার মধ্যে নিরন্তর চলাচল আদ�ৌ
কখন�ো বন্ধ ছিল। এমনকী দুই অক্ষের মধ্যে নেই ক�োন�ো তাত্ত্বিক
পাঁচিলও।
কবিতালেখা আর সংয�োগের ভাষা নিয়ে শঙ্খ ঘ�োষ প্রায়
সারাজীবনই লিখে গেছেন বিভিন্ন গদ্যে। নিজের কবিতালেখা নিয়ে
১৯৬৬-তে ‘নিঃশব্দের তর্জনী’ গদ্যে তিনি লিখছেন কবিতা বিষয়ে
তাঁর সেসময়ের ভাবনা :
তাই মনে হয় লিখতে হবে নিঃশব্দে কবিতা, এবং নিঃশব্দ কবিতা।
শব্দই জানে কেমন করে সে নিঃশব্দ পায়, ঐশ সূত্র না ছিঁড়েও। তার জন্য
বিষম ঝাঁপ দেবার দরকার আছে দুঃসহ আড়ালে থেকে। দুঃসহ, কেননা
অন্তরাল সহ্য করাই মানুষের পক্ষে সবার চেয়ে কঠিন। কবিকে ত�ো আজ
সবটাই খেয়ে ফেলছে মানুষ, তাই মানুষের এই শেষ দায়টা মেনে নিয়েও
ঘুরছে সে, অন্তরাল ভেঙে দিয়ে এক শরীর দাঁড়াতে চাইছে অন্য শরীরের
সামীপ্যে। তা যদি না হয় তাহলে সহ্য যায় পেরিয়ে,— কিন্তু তবু সেই
দুঃসহ আড়ালে বসে সে তৈরি রাখবে একটা দৈনন্দিনের মুখ�োশ; তাকে
কেউ চিনবে না, আঙুল তুলে বলবে না ‘এ ল�োকটা কবি’, আর তার ভিতর
থেকে গ�োপনে জন্ম নেবে নিঃশব্দ কবিতা।
শব্দের অন্তর্গত এক ‘অবাচ্যতা’র অনুসন্ধানেই আগ্রহী
ছিলেন তিনি। কিন্তু এই ভাবনা জীবনবিমুখ ক�োন�ো গুহ্য সাধন
নয়। মানুষের ভিড় এড়িয়ে নিজের জন্য ছ�োঁয়াচ বাঁচান�ো ক�োন�ো
দূরত্বের কথা ভাবছিলেন না। বরং চৈতন্যের সংঘর্ষের ভিতর
থেকেই খুঁজে নিতে চাইছিলেন নিঃশব্দের তর্জনী, যার ভিত্তিভূমি
হবে যাপন। অস্তিত্বের শুদ্ধতার স্বীকৃতিই হয়ত�ো কবিকে পাইয়ে
দিতে পারে নিঃশব্দ বা পরমের স্পর্শ। আমাদের খেয়াল রাখা
দরকার, চ�ৌত্রিশ বছর বয়সে কবির এই ভাবনা নেহাতই
তাৎক্ষণিক ক�োন�ো চিন্তার কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ নয়। এর সাত-
আট বছর পর যখন প্রকাশিত হবে ‘মূর্খ বড়�ো, সামাজিক নয়’,

 34
তাতে নাম কবিতাটির মত�োই ঠাঁই পাবে ‘আয়ু’ কবিতাটিও।
নাম কবিতাটি ত�ো ‘নিঃশব্দের তর্জনী’র প্রায় সহ�োদরা বলা
যায়। কিন্তু ‘নিঃশব্দের তর্জনী’ লেখার প্রায় সমসময়ে, ১৯৬৭
থেকে ১৯৬৯-এর মধ্যে লেখা কবিতাগুলি যখন ১৯৭৮-এ
‘তুমি ত�ো তেমন গ�ৌরী নও’ নামে গ্রন্থবদ্ধ হয়, তখন তাতে
দেখি ‘নিঃশব্দ’ নামেই একটি কবিতায় শঙ্খ ঘ�োষ লিখছেন :
যেমন চালাক ছেলে হঠাৎ ঘুরিয়ে নেয় মুখ
সে-রকম নয়
ওরা চারপাশ থেকে ঘিরে ওর বুকে রঙ মারে।

প্রথমে ভেবেছে রঙ, ঘরে ফিরে দেখে


জামায় লেগেছে রক্তকণা
যত ম�োছে তত ওঠে জ্বলে

কেন ? এত রক্ত কেন ? কার সিঁড়ি বানাও পাঁজরে ?


শব্দ হয়ে যায় শব্দহীন
যেমন সমস্ত রঙ একাকার শাদায় গম্ভীর

ভিতরে আগুন নিয়ে তবু শূন্যে চেয়ে থাকে খরা


নিঃশব্দ ঝরান�ো নয়, নিঃশব্দ বুকের মধ্যে ধরা।
কবিতাটির রচনাসময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশের কথা
মাথায় রাখলে বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয় কিয়ের্কেগার্দের পরা-
নীরবতা বা মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্কের পরমতার ব�োধ কখন�োই
কাঙ্ক্ষিত নয় কবির। বরং বলা যায়, রিলকের মত�ো নিঃশব্দের প্রতি
পক্ষপাত ছিল তাঁর। শব্দের মধ্যিখানের ধূসর নীরবতার পরিসরটি তাঁর
কাছে উপস্থিত হত শব্দের প্রকৃত ব�োধ নিয়ে। ‘ছন্দোহীন সাম্প্রতিক’
(‘নিঃশব্দের তর্জনী’তে গ্রন্থিত) প্রবন্ধে যেমন লিখেছিলেন, ‘এক-
একটি কবিতা লেখা অনেক বিরূপতার মধ্য দিয়ে এক-একটি যুদ্ধের
সমাপন’। আমাদের ধারণা প্রেরণা শব্দে প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকলেও ক�োন�ো
দৈব প্রেরণার অনুসন্ধান তাঁর ছিল না, চিরকাল নিজের চারপাশ আর
যাপনের মধ্যে থেকেই তুলে এনেছেন কবিতা।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত জানিয়েছিলেন কাব্যের প্রধান গুণ স্বাচ্ছন্দ্য,
এটা বুঝতেই তাঁর না কি অর্ধেক য�ৌবন কেটে যায়। কিন্তু বাংলা
কবিতায় প্রেরণার অনুসন্ধান ব�োধহয় শঙ্খ ঘ�োষের কবিতা লেখা

 35
শুরুর অনেকদিন আগেই গত হয়েছিল। ‘শব্দ আর সত্য’ বইয়ের
‘ঈশ্বরের এক মুহূর্ত’(১৯৭৪) প্রবন্ধে এই প্রসঙ্গে তিনি এলিয়টের
‘সেক্রেড উড’ গ্রন্থের বহু চর্চিত ‘ট্র্যাডিশন অ্যান্ড ইন্ডিভিজুয়াল
ট্যালেন্ট’ প্রবন্ধের প্রসঙ্গ টেনে দেখিয়েছেন কীভাবে ওয়ার্ডসওয়ার্থীয়
কবিতার ধারণা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছিল গত শতাব্দীর তিরিশের
দশকের বাংলা কবিতার জগতে। সুধীন্দ্রনাথ থেকেই তিনি উদ্ধার
করেছেন, ‘প্রেরণাতে অল�ৌকিকের আভাস আছে বলে সাহিত্যসৃষ্টির
উক্ত উপকরণ আমি সাধ্যমতে মানতে চাইনি, তার বদলে আঁকড়ে
ধরেছিলুম অভিজ্ঞতাকে।’ প্রেরণাকে অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রতিস্থাপিত
করার এই প্রকল্পে একেবারেই সায় ছিল না শঙ্খ ঘ�োষের। বাইরের
সঙ্গে ভিতরের নিবিড় য�োগ রেখেও নিজেকে ক্রমাগত ভিতরমুখী
করার একধরনের ব�োধ ছিল। তাই ‘কল্পনা আমার প্রজা ; মগজের
আমি জমিদার’ গ�োত্রের উচ্চারণে তাঁর অস্বস্তি গ�োপন থাকেনি।
এমনকী সুভাষ মুখ�োপ্যাধ্যায়ের সঙ্গে সখ্যের দিনগুলির স্মৃতিচারণে
তিনি শুনিয়েছেন ‘ফুল ফুটুক’ বইয়ের শেষ কবিতা ‘এখন ভাবনা’র
সৃজনকথা। মফস্বলের এক শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সুভাষ
না কি বলেছিলেন কবিতার একটা ‘প্লট’ মাথায় এসেছে তাঁর। যার
পরিণতি এই কবিতাটি। দুটি কবিতার যুগ্মকে এখানে প্রথমটির
ভাবনা দ্বিতীয়টিতে পরিণতি লাভ করেছে এইভাবে :
ঠিক তেমনি দূরে,
কতদূরে ঠিক জানি না,
আজও দেখতে পাচ্ছি—
হিরণ্যগর্ভ দিন
হাতে লক্ষ্মীর ঝাঁপি নিয়ে আসছে।
গান গেয়ে
আমাকে বলছে দাঁড়াতে।

গুচ্ছ গুচ্ছ ধানের মধ্যে দাঁড়িয়ে


তার বলিষ্ঠ হাত দুট�ো আমি দেখতে পাচ্ছি—
আমি শেষ বারের মত�ো
মাটিতে পড়ে যাবার আগে
আমার ভাল�োবাসাগুল�োকে
নিরাপদে
তার হাতে
প�ৌঁছে দিতে চাই।
 36
এই কবিতায় আশাবাদের সুরটুকু কবিতা রচিত হবার আগেই
কেমন করে কবির জানা হয়ে গেল তা আশ্চর্য ঠেকে তাঁর, হয়ত�ো
খানিক কৃত্রিমও মনে হয়। হয়ত�ো কবিতায় ‘কতদূরে ঠিক জানি
না’, এই অনিশ্চিত বাচনও ততটা বিশ্বাস্য ঠেকে না। যদিও তিনি
জানেন সুভাষ বিশ্বাস করতেন গদ্য পঙক্তির মত�োই কবিতার
চরণও স্পষ্ট ও বুদ্ধিগ্রাহ্য করে সাজিয়ে ত�োলা যায়। বস্তুত, রবীন্দ্র-
পরবর্তী আধুনিক কবিতায় তিরিশের কবিদের মধ্যে জীবনানন্দেই
আশ্রয় পেয়েছেন শঙ্খ ঘ�োষ। কবিতার ক্ষেত্রে শুদ্ধ কল্পনা আর বুদ্ধি
এই দুটি বর্গের মধ্যে কঠ�োর বিভাজন না রেখে একটা চলাচলের
পরিসর তৈরি করতে চেয়েছেন জীবনানন্দ। অন্তঃপ্রেরণা তিনি
স্বীকার করেছেন। শব্দটির অঢেল অপপ্রয়�োগের কথা মাথায় রেখেও
এর শুদ্ধতায় ক�োথাও একটা আশ্বাস ছিল তাঁর। ‘কবিতার কথা’
প্রবন্ধটিতে জীবনানন্দ লিখছেন :
আমি বলতে চাই না যে, কবিতা সমাজ বা জাতি বা মানুষের সমস্যাখচিত—
অভিব্যক্ত স�ৌন্দর্য হবে না। তা হতে বাধা নেই। অনেক শ্রেষ্ঠ কাব্যই তা হয়েছে
কিন্তু সে সমস্ত চিন্তা, ধারণা, মতবাদ, মীমাংসা কবির মনে প্রাক্কল্পিত হয়ে
কবিতার কঙ্কালকে যদি দেহ দিতে যায় কিংবা সেই দেহকে দিতে চায় আভা
তাহলে কবিতা সৃষ্টি হয় না— পদ্য লিখিত হয় মাত্র— ঠিক বলতে গেলে পদ্যের
আকারে সিদ্ধান্ত, মতবাদ ও চিন্তার প্রক্রিয়া পাওয়া যায় শুধু।
জীবনানন্দের ধারণা ছিল, কবিতা-লেখা কাজটির গতিপ্রকৃতি
অন্য রকম। আগে থেকে স্থির করা ক�োন�ো ধারণা, চিন্তা বা মতবাদ
কবির মনকে আচ্ছন্ন করে থাকাটা তিনি ক্ষতিকর বলেই মানতেন।
অবশ্য যদি তেমনটা ঘটেও থাকে তাঁর বিশ্বাস ছিল সেক্ষেত্রে ‘কল্পনার
আল�ো ও আবেগ’ সেগুলিকে নিরস্ত করে দেয়। সিদ্ধান্ত, প্রশ্ন, মতবাদ
ক�োন�োটাই পরিত্যাজ্য বলে ভাবেননি তিনি, কিন্তু সেগুলিকে দেখতে
চেয়েছেন সুন্দরীর কটাক্ষের পিছনের শিরা উপশিরা বা রক্তকণিকার
মত�ো সপ্রাণ ও অবশ্যম্ভাবী উপাদান হিসেবে। যার উপস্থিতি জরুরি
কিন্তু প্রকট নয়। জীবনানন্দের কথায়, ‘জীবনের সমস্যা ঘ�োলা
জলের মূষিকাঞ্জলির ভিতর শালিকের মত�ো স্নান না করে বরং যেন
করে আসন্ন নদীর ভিতর বিকেলের শাদা র�ৌদ্রের মত�ো;— স�ৌন্দর্য
ও নিরাকরণের স্বাদ পায়।’ এইভাবেই হয়ত�ো বুদ্ধি আর কল্পনার
একটা সামঞ্জস্য বিধান করতে চেয়েছিলেন জীবনানন্দ। অভিজ্ঞতার
কথা তিনিও বলেন, স্বীকার করেন কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতারও
 37
একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা আছে। কিন্তু তা সুধীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতার
ধারণার সমীপবর্তী নয়। শঙ্খ ঘ�োষেরও গভীর আস্থা ছিল হৃদয়বৃত্তি
আর মেধার যুগলবন্দিতে। আসলে শিল্পের পরম্পরায় এক ধরনের
পরিপূরণের ধারণায় বিশ্বাস ছিল তাঁর। যেখানে খণ্ড-চূর্ণ শিল্পব�োধ
প্রশ্রয় পেত না। এ ঠিক ঝ�োড়�ো হাওয়া আর প�োড়�ো বাড়ির ভাঙা
দরজাকে মেলান�ো নয়, বরং চিন্তার এক ধরনের সমগ্রতা। রুচি ও
কালভাবনার এই সমগ্রতা ব�োধ নানা রুচির নানা কবিকে সমগ্রভাবে
আস্বাদনের অভ্যাসে দীক্ষিত করে। যেখানে মানুষ ও গ�োষ্ঠী,
 38
অন্ধকার ও স্পষ্টতা, অনুরাগ ও প্রত্যাখ্যানের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়
আমাদের জীবনের সত্য। এই সত্য আসলে খণ্ড হয়েই আমাদের
সামনে আসে, কিন্তু সেগুলির সমবায়ে তৈরি হয় চলমান চিত্রমালার
মত�ো মেধাবী যাপনের অনুকূল এক পরিবেশ।
বহমান চৈতন্যের স্বীকৃতি খুঁজতে শঙ্খ ঘ�োষ একটা মীমাংসার
কাছাকাছি প�ৌঁছেছিলেন ‘কবিতার মুহূর্ত’ বইটির সূচনা নিবন্ধ ‘পা
ত�োলা পা ফেলা’য়। বাইরের পৃথিবী আর ব্যক্তিগত অনুভবের জগৎ,
এ-দুয়ের স্পষ্ট বিভাজন না করে এক তৃতীয় সত্তার কথা বলেছিলেন
তিনি। ‘যমুনাবতী’ কবিতাটির পর�োক্ষ ইঙ্গিতে বলেছিলেন যন্ত্রণার,
মৃত্যুর ছবি যেমন কবিতা হতে পারে তেমনি তা হতে পারে কবির
আত্মজিজ্ঞাসা, অভিমান, বিষণ্ণতাকে ঘিরেও। এখানেই তাঁর কাছে
জরুরি হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। ২০০৭-এ প্রণবেশ সেন স্মারক
বক্তৃতায় যে-লিখিত ভাষণটি তিনি পাঠ করেছিলেন সংয�োগের ভাষা
নিয়ে, ‘অন্ধের স্পর্শের মত�ো’ নামে যে দ্যুতিময় গদ্য পরবর্তীতে
মুদ্রিতও হয়েছে, সেখানে মাত্রাব�োধ আর সত্যানুসন্ধানের প্রসঙ্গে
তাই এসেছে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসের চন্দ্রনাথবাবুর
কথা। সন্দীপের আপাত শক্তি আর নিখিলেশের নিহিত শক্তির
কথাও। নিখিলেশ চায় গড়তে, সে জানে আপাতভাবে একে মনে
হতে পারে প�ৌরুষের অভাব বা সঙ্কল্পেরও অভাব। কিন্তু নিহিত
শক্তির এ মৃদুতা এনে দেয় অন্তরের জ�োর। সংয�োগের সম্ভাবনা এতে
পরিবর্ধিত হয় বহুগুণ।
কবিতা এবং কবির অনুভূত সত্যের, অর্থাৎ শব্দ ও তার
মাধ্যমে সঞ্চারিত সত্যের অভিব্যক্তি ও পরিবর্তনশীলতাও তাঁর
ভাবনার অন্তর্গত হয়েছিল সত্তরের দশক থেকেই। ১৯৭৪-এ লেখা
‘শব্দ আর সত্য’ প্রবন্ধে হাংরি জেনারেশনের কবিদের প্রতিষ্ঠান
বির�োধিতার জরিপ করতে গিয়ে তিনি হাংরিদের দাবি আর সৃষ্টির
তুল্যমূল্য আল�োচনা প্রসঙ্গে দেখিয়েছিলেন, সত্যসন্ধানী লেখা সব
যুগেই হওয়ার কথা, সমাজের বা সাহিত্য গ�োষ্ঠীর বিরুদ্ধাচরণও কিছু
অভূতপূর্ব নয় সেখানে। কিন্তু শব্দের বিপুল বিস্তার আর চটকদার
বিজ্ঞাপনের বাইরে নিজের অন্তর বাহিরকে খুলতে পারাটাই কবিতা
বা কবির শ্রেষ্ঠ য�োগ্যতা। কবিতার সত্য ক�োন�ো জড় শালগ্রাম শিলা
নয়, বরং পরিবর্তনশীল, ক্রম-উন্মোচনশীল। এই সত্যের সামনে
কবির অস্তিত্ব মুখ�োমুখি হয় এক সংঘর্ষের যা থেকে আবারও, শঙ্খ
 39
ঘ�োষ মনে করেন, জন্মাতে পারে তৃতীয় ক�োন�ো সত্তা। ‘কবি আর
তাঁর উপাদান’ প্রবন্ধেও (‘শব্দ আর সত্য’) তাই তিনি কবিতার
প্রতিমাকে শুধু উপকরণ হিসেবে দেখতে চান না। তাঁর মতে, ‘এক
হিসেবে এটাও তাঁর যুদ্ধের চিহ্ন’। কবিতার প্রতিমা সেকারণেই
কবির কাছে উভয়ত সাধ্য ও সাধন দুই হয়ে ওঠে। কবিসত্তা আর
সামাজিক মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার দ্বন্দ্বে কবিতার প্রতিমায় তাই
ঠাঁই পায় সমকালীনতা, অভিজ্ঞতার রেশও।
১৯৮২ সালে শিলচরের একটি সভায় এক ম�ৌখিক ভাষণে শঙ্খ
ঘ�োষ (পরে যা ‘সংয�োগের কবিতা’ নামে মুদ্রিত হয় ‘কবিতালেখা
কবিতাপড়া’ বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে এবং ‘মুখের কথা সভায়’
বইটিতেও) কবি ফাল্গুনী রায়ের ‘আত্মহত্যা’র শিকড় খুঁজতে গিয়ে
লেখকের যন্ত্রণারও হদিশ দিয়েছেন। জীবনের যে-দিকটিতে আল�ো
ফেলতে চান একজন সৃজনশীল লেখক, সেটা নিজের সর্বস্ব বাজি
রেখে বলার মধ্যে, প্রতিকূল পরিবেশে সমস্তটা নিজের মধ্যে অনুভব
করার মধ্যে একটা তীব্র যন্ত্রণা আছে। সেই যন্ত্রণার প্রাবল্যে হয়ত�ো
চিৎকার করতে চায় মন, তবু চিৎকার কবিতা নয়। ‘১৯৪৬-৪৭’
কবিতায় জীবনানন্দ যেমন বলেছিলেন মানুষের ভাষা যদি তার
অনুভূতি দেশ থেকে আল�ো না পায়, পরিপ�োষণ না পায় তবে তা
সংয�োগ সাধনের রুপ�োলি সুত�ো হয়ে উঠতে পারে না। ভাষা তখন
হয়ে দাঁড়ায়, ‘নিছক ক্রিয়া ; বিশেষণ ; এল�োমেল�ো নিরাশ্রয় শব্দের
কঙ্কাল’। চারপাশের যাবতীয় অসুখ, সহজ ছন্দ থেকে দূরে চলে
যাওয়া জীবন, কুঁকড়ে যাওয়া অস্তিত্ব হয়ত�ো প্রতিবাদই কামনা
করে। কিন্তু তার কাব্যিক চেহারায়, যেখানে তা বিস্তারকামী, সংয�োগ
সেখানেও অবশ্যম্ভাবী থেকে যায়। বিচ্ছিন্নতার পালটা এই সংয�োগের
সঙ্গে শঙ্খ ঘ�োষ এখানে ভাল�োবাসার একটা শক্তির কথাও জুড়ে
নিয়েছেন প্রসঙ্গক্রমে। যদিও খুব বিস্তারে এ বিষয়ে বলেননি, তবু
ধরে নিতে অসুবিধে হয় না, যে কয়েকটি ম�ৌল মানবিক গুণের
প্রতি একজন কবির আস্থা থাকার কথা, তা থেকে কখন�ো চ্যুত
হননি তিনি। কিন্তু বিচ্ছিন্নতার সংকটকে একেবারে নাকচ করে
দেওয়ার মধ্যেও এক ধরনের যান্ত্রিকতা আছে বলে মনে করতেন।
বিচ্ছিন্নতার অস্তিত্ব ও সম্ভাবনার ঐতিহাসিক কারণকে অগ্রাহ্য
করার মত�ো অসংবেদনশীল ভাবনা ছিল না তাঁর। তাই অনুসন্ধান
করেছেন বিচ্ছিন্নতার ওপারে থাকা মনকে সেতুবন্ধে আনবার
 40
কথা। তাঁর ধারণা এক্ষেত্রে প্রধান বাধা আত্মকেন্দ্রিকতা। ভুললে
চলে না যে আত্মকেন্দ্রিকতা আর ব্যক্তিগতের আয়�োজন সমার্থক
নয়। ব্যক্তিগতের সঙ্গে সমাজের ক�োন�ো প্রত্যক্ষ বির�োধ নেই।
কিন্তু আত্মকেন্দ্রিকতার সঙ্গে আছে। শঙ্খ ঘ�োষের মনে হয়েছে বরং
ব্যক্তিগতের যত্ন নেওয়া সমাজের পক্ষে মঙ্গলজনক। কেননা তাতে
সামাজিকবৃত্তে অংশগ্রহণের একটা প্রস্তুতি-কাজ চলতে পারে।
নিজেকে গড়া আর নিজের অর্জনগুলিকে চিনে গেঁথে নেওয়ার
অবকাশ থাকতে পারে। এই প্রসঙ্গেও ফের তিনি শরণাপন্ন হতে
চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের। কেননা তাঁর ধারণা, রবীন্দ্রনাথের কাছে
সবচেয়ে বড়�ো প্রাপ্তি ‘প্রস্তুতির দীক্ষা’। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসটিকে যদি
চলতি ধারণায় শুধু চারটি চরিত্রের উন্মোচন অর্থে চতুরঙ্গ না ধরে
আমরা শচীশের জীবনের চারটি পর্ব হিসেবেও দেখি— ধ্রুববাদ বা
সাধারণ্যে নাস্তিক্য, সার্বিক ভক্তিবাদ, প্রেম ও নিজের কাজে ফিরে
মুক্তির বিপুল আকাশের স্বাদ পাওয়া— শচীশ কিন্তু সময়ের সঙ্গে
সঙ্গে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেনি, হয়ে উঠেছে আত্মশক্তিতে বলশালী।
রবীন্দ্রনাথের সৃজনে এই আত্মশক্তিরই উদ্বোধন ঘটেছে ফিরে ফিরে
বললেও অত্যুক্তি হবে না। শঙ্খ ঘ�োষ এই আত্মশক্তিকেই বলতে
চান কবির বর্ম। যা কবিকে বাঁচতে ও নিরন্তর সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করবে।
তিনি নিজেও জীবনের অভ্যস্ত চলার মাঝে, শুশ্রূষারহিত অস্তিত্বের
পীড়নে বিদ্ধ হতে হতেও কখন�ো হঠাৎই আবিষ্কার করছেন অদৃষ্টপূর্ব
ক�োন�ো অধিত্যকা, হয়ত�ো এক পশলা বৃষ্টির পর বিকেলবেলার
আল�োয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে চরাচর। শঙ্খ ঘ�োষের বিশ্বাস ছিল
দৈনন্দিনের সঙ্গে এই চকিত উদ্ভাসনের গ�োপন রসায়নই ধরে দিতে
পারে ক�োন�ো সত্য। আর সেই সত্যকে ধরতে তাঁর আয়ুধ ছিল শব্দের
মধ্যেকার নিঃশব্দ।

 41
আমাকে ভুবন দাও
আমি দেব সমস্ত অমিয়
কিশ�োর সেনগুপ্ত

আল�োকচিত্র : সন্দীপ কুমার

বা ংলা সাময়িক পত্রজগতের সম্মাননীয় মানুষ নির্মাল্য


আচার্য’র প্রয়াণের পর অর্থনীতিবিদ, প্রাবন্ধিক অশ�োক
মিত্র ১৪০২ শারদীয় অনুষ্টুপ-এ লিখলেন: ‘কিছু কিছু
সত্য মেনে নিতে হয়। মেনে না নিয়ে উপায় নেই বলেই মেনে নিতে
হয়। বয়স যত বাড়ে, বার্ধক্যজনিত এক নিঃস্বতাব�োধ দরজায় দাঁড়িয়ে
কড়া শুধু নাড়েই না, ভিতরে সেঁধ�োয়। সেই বাস্তবের পাশাপাশি,
ক্রমশ অন্য একটি সত্যের সঙ্গেও মুখ�োমুখি হতে হয়: সুহৃদ
পরিজনের বৃত্ত এখন থেকে সঙ্কীর্ণ, সঙ্কীর্ণতর হতে বাধ্য। ...আর
যে-কদিন বাঁচব�ো, আমাদের জীবনবৃত্তান্ত নির্মাল্য আচার্যবিহীন।’
ওই একই পত্রিকায় পরের প্রতিবেদনটি শঙ্খ ঘ�োষের। তাঁর কথায়:
‘বন্ধুদের কাছে তার আসাও ছিল যেমন নিঃশব্দে, যাওয়াও তেমনি।
আর বন্ধুদের সঙ্গে অভিমানময় সম্পর্কের এই ধরনটাই যেন তার
জীবনেরও সঙ্গে সম্পর্কের চরিত্র। তেমনই নিঃশব্দ তার আসা,
 42
নিঃশব্দে চলে যাওয়া। মধ্যে কিছু শব্দচিহ্ন ধরে রাখা শুধু। পঁয়ত্রিশ
বছরের সংস্কৃতি জগতের কিছু শব্দচিহ্ন। তারই নাম এক্ষণ। তারই
নাম নির্মাল্য আচার্য।’
ক�োন�ো ক�োন�ো সময় ক�োন�ো ক�োন�ো ঘটনা এমনই আকস্মিকতায়
আবৃত থাকে যখন একেবারে নিশ্চুপ নিশ্চল হয়ে থাকতে ইচ্ছে
করে। যেমন ছিল গত বাইশে এপ্রিল। কিন্তু আমাদের এই ধ্বস্ত
সময়ে, আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে চার্টার্ড এর�োপ্লেনের নামা ওঠা
আর ভ�োটযুদ্ধের ক্লান্তিকর মিথ্যে ভাষণের আবহাওয়ায় সেভাবে
নিজেকে একান্তে পাওয়ার সুয�োগ ছিল না। তারিখটা বাইশে এপ্রিল।
স�োশাল সাইট ফেসবুকে লেনিনের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি শুরু হয়ে গিয়ে‍‌ছে
সকাল থেকেই। থেমে নেই আমরাও; প�োস্ট করা হয়ে গিয়েছে শঙ্খ
ঘ�োষ অনূদিত ব্রেখটের কবিতা অজেয় লিপি—
প্রথম মহাযুদ্ধের দিনগুল�োয়
সান কার্লোতে ইতালীয় জেলের এক খুপরিতে
কিছু সৈন্য মাতাল আর চ�োর যেখানে বন্দী
সেখানে স�োশ্যালিস্ট এক সৈনিক কপিং পেন্সিলে
একদিন আঁচড় কাটল দেয়ালে:
‘দীর্ঘজীবী হ�োন লেনিন!’

ধূসর খুপ‍‌রিতে, আবছা কিন্তু বিশাল হরফে কথাগুলি লেখা


জেলারমশাই দেখলেন, দেখে এক বালতি চুনসুদ্ধ পাঠালেন এক মিস্তিরি
ছ�ো‍‌ট�ো একটা বুরুশে সে চুনকাম করে দিল ওই ভয়ঙ্কর লিপি
কিন্তু সে ত�ো কেবল অক্ষরগুলির ওপরেই বুলিয়েছিল চুন
তাই এখন খুপরির ওপরদিকে চুনেই জ্বলজ্বল করছে:
‘দীর্ঘজীবী হ�োন লেনিন!’
তারপর এল আরেকজন বড়�োসড়�ো এক বুরুশ নিয়ে
গ�োটা দেয়ালে বুলিয়ে দিল চুন
ফ‍‌লে বেশ খানিকক্ষণ দেখা গেল না কিছু, কিন্তু
সকালবেলা
চুন শুকিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ফুটে উঠল সেই লিপি, আবারঃ
‘দীর্ঘজীবী হ�োন লেনিন!’
এরইমধ্যে, সেই সকালেই হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে আসে খবর—
তিনি নেই, চলে গিয়েছেন না-ফেরার দেশে।
মানুষটি শঙ্খ ঘ�োষ। দু’হাজার সাত সালে ‘প্রণবেশ সেন স্মারক
বক্তৃতা’র শুরুতে তিনি জীবনানন্দকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন:
 43
‘ভাল�ো করা কথা ভাবা এখন কঠিন’। সে-ভাষণের একটা নামও
দিয়েছিলেন কবি—অন্ধের স্পর্শের মত�ো। স্বভাবসুলভ নরম ও
মৃদুস্বরে নিতান্তই গল্প বলার মত�ো করে ওঁর পারিবারিক জীবনের
দু’একটা অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন সেদিন। তার একটি হল এই
যে, শেষবয়সে শঙ্খ ঘ�োষের বাবা চ�োখে বিশেষ দেখতে পেতেন না।
ভাল�ো লাগা বলতে বই পড়া, কথা বলা। একসময় বই পড়া বন্ধ
হয়ে গেল; কথা বলাও এল�ো কমে। আশেপাশে কারও উপস্থিতি
টের পেলে নামটা জানতে চাইতেন তারপর বলতেন ‘কই, হাতটা
দেখি’, বলে বাড়িয়ে দিতেন হাত। হাত ধরে বেশ কিছুক্ষণ বসে
থাকতেন নিশ্চুপ হয়ে। কথা যে বিশেষ হত�ো এমনটা নয় তবে
হাতের ওই ‘জড়িয়ে থাকাটুকু’ ছিলই।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটি এইরকম। বাড়িতে চিকিৎসার প্রয়�োজনে
চিকিৎসক এসেছেন। র�োগী দেখে ব্যবস্থাপত্র লিখে তিনি বললেন:
‘এই ওষুধটা দিয়ে দুদিন আমরা দেখব। এতে যদি ফল না হয়
তাহলে আমাদের আরেকরকম করে ভাবতে হবে।’ প্রথমাবস্থায়
শঙ্খ ঘ�োষের মনে হয় চিকিৎসা ত�ো করবেন চিকিৎসক, সেখানে
‘আমরা’ শব্দটি আসে কীভাবে? ‘আমি’ হওয়াটাই কি বাঞ্ছনীয়
ছিল না। সেটাই ত�ো হত�ো সত্য। কিন্তু না, পরে ওঁর উপলব্ধি
এইরকম যে, ওই একটিমাত্র শব্দ ব্যবহারে বা শব্দবদলে, ‘আমি’
থেকে ‘আমরা’য় প�ৌঁছে দিয়ে চিকিৎসক তাঁর র�োগীটির সঙ্গে
র�োগীর আত্মীয়দেরও অনেকটা শুশ্রুষা করে নিলেন। সংয�োগের
ভাষা তাহলে এমনই হওয়া উচিত যাতে আশ্বস্ত হয় মন, দূরের
মানুষকেও মনে হয় আত্মজন। চিকিৎসক র�োগীর জন্য প্রয়�োজনীয়
বিধান নির্দেশটিকে ‘কেবল ওঁর জীবিকার দিক থেকে দেখছেন না,
দেখছেন ব্যক্তিগতভাবে।’
বস্তুত খুব সহজ করে কবি আমাদের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন
সংয�োগের মূল শর্তটিকে। আমরা যখন পরস্পরের সঙ্গে কথা বলি
আমরা চাই যে অন্যপ্রান্তের মানুষটি যেন আমার কথাটা বুঝতে পারেন;
যে ভাবনা বা দৃষ্টি‍‌ক�োণ থেকে কথাটা বলছি সেটি যেন উল্টোদিকের
মানুষটি আত্মস্থ করতে পারেন, তাঁর উপলব্ধির মধ্যে আনতে পারেন।
কিন্তু সবসময় ত�ো হয় না তেমনটা। শঙ্খবাবু বলছেন:
জ্ঞাতসারে তেমনটা চাইলেও, অজ্ঞাতেও কি সেইরকমই চাই
সবসময়ে? সে বুঝুক, জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে এটা অবশ্য চাই। কিন্তু কী বুঝুক?
আমার কথাটা? ভাবনাটা? না কি অনেকসময়ে এইটে—আমি যে ভাবতে

 44
পারি, সেই ক্ষমতাটা? কিংবা অনেকসময়ে তারও চেয়ে একটু এগিয়ে,
ভাবতে পারি বা না পারি, আমি যে আমি, সেই অবস্থানটা? কথা বলা
একটা সংয�োগ। কিন্তু ওইসব সময়ে, ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয় — কেবলমাত্র
অ-য�োগ নয় — সেটা সমূহ বি-য�োগেও গিয়ে প�ৌঁছতে পারে।
ওই একই ভাষণে তিনি তাঁর এক মাস্টারমশাই প্রেসিডেন্সি
কলেজের অধ্যাপক গ�োপীনাথ ভট্টাচার্য’র উল্লেখ করেছেন।
অধ্যাপক ভট্টাচার্য দর্শন পড়াতেন। তাঁর পাঠদানকালে ছাত্রছাত্রীরা
অধ�োমুখ, খাতায় নোট নিতে ব্যস্ত।
অধ্যাপক ভট্টাচার্য ওদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন: ‘তাহলে
আমি কথা বলব কার সঙ্গে? ব�োঝাব কাকে যদি ত�োমাদের চ�োখ
থাকে খাতায়? বুঝব কেমন করে যে কথাগুলি প�ৌঁছচ্ছে ক�োথাও?’
এই তাহলে সংয�োগের এক অলিখিত শর্ত যেখানে বক্তা এবং
শ্রোতা উভয়ের চ�োখই থাকবে খ�োলা, পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ।
শঙ্খবাবু সংয�োগ বা সংয�োগের ভাষা নিয়ে যে গভীর উচ্চারণ
করে গিয়েছেন আজ তা নিয়ে গভীরভাবে ভাববার সময় এসেছে।
বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে যাওয়া ‘আত্মসমাল�োচনা’ নয়, আজ দরকার
গভীর ‘আত্মসমীক্ষা’ (ইনট্রোস্পেকশন)। আমরা সকলেই জানি
দু’হাজার সাতের প্রায় গ�োড়া থেকেই পশ্চিমবঙ্গব্যাপী এক ভয়ঙ্কর
অরাজকতা জারি ছিল। আজ বলতে দ্বিধা নেই যে, রাজনৈতিক
বাধ্যবাধকতার জায়গা থেকে সে-অরাজকতার ব্যাখ্যা একরকম।
আবার ওই আত্মসমীক্ষার জায়গা থেকে দেখলে অনেকগুল�ো প্রশ্ন
এবং সমাধান একই সাথে ভিড় করে আসে মনে। অনেক অনেক
সমস্যা ছিল, অনেক সময়েই অকারণ অয�ৌক্তিক বির�োধ ছিল
তবুও প্রশ্ন জাগে: সংয�োগের ভাষা ব্যবহারে ক�োথাও কি ক�োন�ো
বিনয়ের অভাব ছিল? যে অভাব একটা সময়ে বিধ্বংসী ক�োন�ো
লব্জের জন্ম দেবে! শঙ্খবাবুর কাছ থেকে জানা গেল কমলকুমার
মজুমদার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বলছেন: ‘শ�োন�ো, এই যে আমরা
উপন্যাসটা লিখছি...’, সুনীল বাধা দেন: ‘আমরা বলছেন কেন
কমলদা, লিখছেন ত�ো আপনি!’ উত্তরে কমলকুমার জানিয়েছিলেন
ম�োটেই তিনি লিখছেন না। ঠাকুর তাঁকে দিয়ে লেখাচ্ছেন। ‘সেটা
আমি না হয়ে তুমিও হতে পারতে বা অন্য কেউ। আমরা সবাই
মিলেই লিখছি।’ শঙ্খর মতে এটা বিনয় নয় বিশ্বাস। বিশ্বাসটা এই
যে, আমার আমিটা খুব বড়�ো কথা নয় ওটা একটা উপলক্ষ মাত্র।
 45
চারপাশের মানুষগুল�োর মধ্যে একইসাথে একই অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত
হচ্ছে, প্রকাশটা হয়ত�ো হচ্ছে একজন বা দুজনের মাধ্যমে। যখন
ক�োন�ো একজনের থেকে ভাবনাটা প্রকাশিত হচ্ছে তিনি বলতেই
পারেন যে এটা ‘আমি’ বলছি—ভুল ত�ো নেই কিছু তাতে। আবার
সেই প্রকাশ মুহূর্তেই কেউ বলতে পারেন ‘আমরা’, তাতেও ভুল
হয় না বরং গ�োড়ায় বলা চিকিৎসকটির মত�ো নিজেদের পরিসরের
মানুষজনকে আপন করে নেওয়ার একটা শক্তি তৈরি হয়।
উল্লিখিত ভাষণটির আরেকটি অংশের পাঠ নিয়ে আমরা প্রসঙ্গান্তরে
যাব। ধূর্জটিপ্রসাদের একটি বইয়ের নাম আমরা ও তাঁহারা। দুটি পক্ষ
যে-বইয়ের আধার। একপক্ষে ‘তাঁহারা’। অন্যপক্ষে ‘আমরা’। অথচ
পাঠের মধ্যে সবসময়ই ‘আমি’ ‘আমরা’ নয়। ভূমিকায় ধূর্জটিপ্রসাদ
বলছেন: ‘আমরা ও তাহারা-তে একদিকের বক্তা আমি, অন্যদিকের
বক্তা তাঁহারা।’ তবে নামে কেন ‘আমরা’? ধূর্জটিপ্রসাদের জবাবদিহিঃ
‘নিজের মধ্যে তথাকথিত উচ্চশিক্ষিতের দ�োষগুল�ো লক্ষ্য করেছি
বলেই একবচন ব্যবহার করেছি।’
শঙ্খ ঘ�োষ তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য, বিপুল অভিজ্ঞতা,
অসামান্য সৃজনশীলতা দিয়ে সংয�োগের এই দিকটি আত্মস্থ
করতে পেরেছিলেন। আর সেটি করতে পেরেছিলেন বলেই
এই সেদিনের—‘দেখ খুলে ত�োর তিন নয়ন/রাস্তা জুড়ে খড়্গ
হাতে/দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন’—এই লেখার বহু আগে ওই
দু’হাজার সাত সালে বলতে পেরেছিলেন:
‘যেসব সময়ে এই সমস্তটাকে জড়িয়ে নিয়ে ভাবনা করবার কথা,
তখন ‘আমরা’ শব্দের এমন বিভাজিত প্রয়�োগ হয়ত�ো স্থায়ী ক�োন�ো সঙ্কট
তৈরি করে তুলতে পারে, আমাদের ব�োঝায় অনেক ভুল ঘটে যেতে
পারে। ধরা যাক, ক�োন�ো সরকার যখন ‘আমরা’ উচ্চারণে ক�োন�ো কথা
বলেন, তখন সে-আমরা থেকে বির�োধী ক�োন�ো রাজনৈতিক পক্ষ বর্জিত
থাকতে পারে বটে, কিন্তু তার অন্তর্গত করে নেবার কথা দেশের সমস্ত
সাধারণ মানুষকে। অর্থাৎ বক্তাকে বুঝতে হবে যে তাঁর সেই ‘আমরা’র
পরিসর যত ছ�োট�ো হয়ে আসবে, তাঁর দেশও হয়ে উঠবে ততটাই খণ্ডিত।
কথাটা এ নয় যে ‘ওদের’ ‘আমরা’ করে তুলতে হবে, বরং এই হবার
কথা ছিল যে ‘ওরা’ ‘আমরাই’। সেটা লক্ষ না করে, আমরা-ওরার যে
বিভাজনটা দূর করবারই দায়িত্ব ছিল আমাদের, একটা শব্দ ব্যবহারের
মধ্য দিয়ে সেটাকে হয়ত�ো-বা বাড়িয়েই চলেছি আমরা।’’
কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র নামের একটি নাট্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত
 46
আমরা অনেকে। ব্রাত্য বসুর নাট্যরূপে শঙ্খ ঘ�োষের ‘বাবরের প্রার্থনা’
মঞ্চস্থ করেছি আমরা। সে-প্রসঙ্গে পরে আসব। কল্যাণী নাট্যচর্চার
প্রথম প্রয�োজনাটি বেশ সমাদৃত হয়। একটা দুট�ো পুরস্কারও আসতে
শুরু করে; সেটি উনিশশ�ো আটানব্বই সাল। সংগঠনে আমরা
সিদ্ধান্ত নিই প্রয�োজনার কারণে কেউ যদি অর্থমূল্যে ক�োন�ো পুরস্কার
পান তবে তা সংগঠনকে দিয়ে দিতে হবে। কেননা নাট্য প্রয�োজনার
সাফল্য নির্ভর করে দলগত কাজের ওপর, ব্যক্তির উৎকর্ষ সেখানে
গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই, কিন্তু সমবেত উদ্যোগের ঊর্ধ্বে নয় কখনই।
আমাদের মধ্যে গ�োলমালটা হল এই যে, আমরা বিভ্রান্তি বা অজ্ঞতার
কারণে প্রায় সময়েই আমাদের সকলের করা কাজটাকে ‘আমার
কাজ’ বলে দেগে দিয়ে আত্মতৃপ্তিতে মগ্ন হয়ে পড়ি। ব্যক্তিগত স্তর
থেকে সামাজিক রাজনৈতিক স্তর পর্যন্ত এই ‘আমি’ তখন হয়ে ওঠে
‘এক ঘ�োষণা-শব্দ, চিৎকার-শব্দ’—তৈরি হতে থাকে একটা জ�োর
দিয়ে বলবার অসভ্য অভ্যেস, যে অভ্যেস আস্ফালনের মধ্যে দিয়ে
নিঃশব্দে এগিয়ে আসতে থাকে ফ্যাসিবাদ। ‘ফ্যাসিবাদ আমাদের
স্বভাবের একটা অনিয়ন্ত্রিত চিৎকার।’
থিয়েটার করার সূত্রেই শঙ্খ ঘ�োষের সঙ্গে আমাদের য�োগায�োগ
সম্ভব হয়েছিল। মানুষটি নিজে থেকেই দেখতে এসেছিলেন আমাদের
প্রয�োজনা নক্সীকাঁথার মাঠ। তারপরে অনুরুদ্ধ হয়ে দেখেছিলেন অমর
মিত্রর উপন্যাস নির্ভর আমাদের আরেকটি প্রয�োজনা অশ্বচরিত।
সিরিয়াস থিয়েটারে ওইটিতেই আমাদের দলের নিজস্ব নির্দেশক;
এবার আর আমন্ত্রিত নির্দেশক নন। অশ্বচরিত দেখে একটি এক
পৃষ্ঠার চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তাতে প্রথমেই উল্লেখ করেছিলেন
নক্সীকাঁথার মাঠ দেখে মুগ্ধতার কথা। সেইসাথে অশ্বচরিত নিয়ে বেশ
কয়েকটি পরামর্শ।
সত্যি বলতে ওঁর সঙ্গে আমাদের মুখ�োমুখি আলাপ ব্রাত্য বসুর
মাধ্যমে। বাবরের প্রার্থনা কবিতাটির নাট্যরূপ দেওয়ার পর সেটি
শ�োনান�োর জন্য আমরা দুজনে মিলে প�ৌঁছে যাই উল্টোডাঙার
ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসেরর এক সাধারণ ফ্ল্যাটে। বসার ঘরে দেওয়ালে,
তাকে, খাটে সর্বত্র বই আর পত্রপত্রিকা। তারপর নানা কারণে সময়ে
অসময়ে বহুবার কথা হয় টেলিফ�োনে। বাবরের প্রার্থনা’র মঞ্চ মহলা
দেখতে এসেছিলেন কল্যাণীতে। এরপর গ�ৌতম হালদারের একটা
কাজের সূত্রেও বেশ কয়েকবার ওঁর কাছে যেতে হয়েছিল।
 47
২০১৬-র ন�োটবন্দি ঘ�োষণা হওয়ার কয়েকদিন পর জ্ঞান
মঞ্চে অভিনয় ছিল নুরলদীনের সারাজীবন প্রয�োজনার। দেখতে
এসেছিলেন এবং শ�ো শেষে বাঙালির ত�ো বটেই আমাদের জাতির
বিবেক নিজে থেকে মঞ্চে উঠে এসে আলিঙ্গন করেছিলেন প্রণামটুকুও
করবার সুয�োগ না দিয়ে—সে এক আশ্চর্য শিহরণ। বড় ইচ্ছে ছিল
দয়াময়ীর কথা দেখবেন। স্বাস্থ্য এবং কর�োনা সংক্রমণের সতর্কতার
কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। বন্ধু ইমানুল হকের মাধ্যমে দয়াময়ীর
কথা’র ভিডিও পাঠিয়েছিলাম। মনে হয় দেখে উঠতে পারেননি।
একটা ভীষণই খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা।
সে যে কেবল অশ্রুতপূর্ব, অদৃষ্টপূর্ব অতিমারীর কারণে—তা নয়
অতিমারী নিশ্চিত করেই এক ভয়ঙ্কর সংকট ও অনিশ্চয়তার
মধ্যে ফেলেছে গ�োটা বিশ্বের মানুষকে। আমাদের বিপদ সেসবের
চেয়েও মারাত্মক। ভ্যাকসিন, সতর্কতা অবলম্বন ও অন্যান্য স্বাস্থ্য
সংক্রান্ত বিধিনিষেধগুল�ো পালন করে হয়ত�ো বা এই অতিমারীকে
রুখে দেওয়া যাবে কিন্তু যে ভয়াল সঙ্কট আমাদের মন�োজগতে,
আমাদের সামাজিকতায়, আমাদের সাংস্কৃতিক মননে নেমে এসেছে
এবং আসছে প্রতিনিয়ত—সেসব প্রতিহত করার পদক্ষেপে শঙ্খ ঘ�োষ
কেবল আমাদের শক্তি ছিলেন না, ছিলেন বিবেক, ছিলেন চেতনা।
ওঁকে সামনে রেখে, ওঁর লিখে যাওয়া কথাগুল�োকে বারংবার
উচ্চারণ করে যে যূথবদ্ধতা নির্মিত হত প্রতিনিয়ত, তা ওই ‘দশের
লাঠি একের ব�োঝা’ গ�োত্রীয় প্রবাদ।
তিনি চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। সবাইকেই যেতে হয় ক�োন�ো
না ক�োন�োদিন। আমরাও একটা একটা দিন পার করছি আর এগ�োচ্ছি
প্রৌ‌ঢ়ত্বের চ�ৌকাঠে। এমন সময়ে, এই আমাদের মত�ো প্রবীণেরা
ওঁরই শেখান�ো প্রার্থনাটুকু নিবেদন করতে পারি স�োচ্চারে—বিশেষত
আজকের অশ্লীল ও অপসংস্কৃতিময় বিপন্ন সময়ে—‘ধ্বংস করে দাও
আমাকে যদি চাও, আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’
আমাদের এক মাস্টারমশাই কয়েকদিন আগেই প্রায়শই আমাকে
বলতেন ইয়�োনেস্কোর ‘গণ্ডার’ নাটকটি মঞ্চস্থ করার জন্য। ওঁর এই
বলার নেপথ্যে একটা যন্ত্রণা ছিল, হয়ত�ো বা হতাশাও। গত কয়েক
বছর যাবৎ ভারতবর্ষের সামাজিক রাজনৈতিক জগতে যে সাম্প্রদায়িক
মেরুকরণের লাগাতার প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছে তা থেকে মুক্ত থাকেনি
আমাদের রাজ্যও। এবং কী আশ্চর্য—পাশের, কাছের বহু পরিচিত
 48
মানুষজন হাসতে হাসতে কত সহজে ম�ৌলবাদী ভাবনার সঙ্গী হয়ে
যাচ্ছেন তা দেখে যন্ত্রণা পাওয়াটাই স্বাভাবিক। বছর চারেক আগে
সাংগঠনিক এক সঙ্কটে পড়ে ‍‌থিয়েটারের অগ্রজ মানুষ রুদ্রপ্রসাদ
সেনগুপ্তকে ফ�োন করতে হয়েছিল। প্রয়�োজনীয় কথাবার্তার পর
রুদ্রবাবু টেলিফ�োনে একটা কবিতা শুনিয়েছিলেন—শঙ্খ‍‌ ঘ�োষের
হামাগুড়ি। বহু পঠিত বহুশ্রুত হলেও এই পরিসরে কবিতাটি উদ্ধৃত
করা প্রয়�োজন—
ঘুমটা ‍ভেঙে গেল হঠাৎ। বাইরে কি ঝড় হচ্ছে?
দাপাদাপি করছে জানলার পাল্লা দুট�ো
মাঝে মাঝে বিজলি ঝলকাচ্ছে।
ফের শুয়ে পড়তে গিয়ে সেই বিদ্যুতের ছটফটে আল�োয় মনে হল
ঘরের মধ্যে যেন হামা দিচ্ছে কেউ। কে এখানে? কে?
হামা ক�োন�ো শব্দই করে না।
উঠে আসি কাছে, আবারও জিজ্ঞেস করি, কে আপনি? কী চান?
সে তবু নিশ্চুপ থেকে এ ক�োণে ও ক�োণে ঘুরছে
মাথা তুলছে না কিছুতেই, চ�োখে চ�োখ নয়।
‘কিছু কি খুঁজছেন আপনি?’
শুনতে পাচ্ছি, ‘খুঁজছি ঠিকই, খুঁজতে ত�ো হবেই
পেলেই বেরিয়ে যাব, নিজে নিজে হেঁটে।’
‘কি খুঁজছেন?’
মিহি স্বরে বললেন তিনি ‘মেরুদণ্ডখানা।’
সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলকান�ো ফের। চমকে উঠে দেখি...
একা নয়, বহু বহু জন
একই খ�োঁজে হামা দিচ্ছে এ-ক�োণে ও-ক�োণে ঘর জুড়ে।
যে যন্ত্রণায় কাতর হয়েছি আমরা সাম্প্রতিকে, সত্যদ্রষ্টা কবিকে তা
দংশন করেছিল আরও বহু আগে।
ওঁর কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ—সেসব নিয়ে বিস্তারিত আল�োচনা
ধৃষ্টতারই নামান্তর হবে। কতটুকুই বা জানি আমরা! তবুও তারই
মধ্যে ওঁর অসংখ্য কবিতার উল্লেখ আমাদের প্রাণিত করে। এই
পরিসরে তেমন দু’একটির উল্লেখ বাহুল্য হচ্ছে বলে মনে হয় না।
পথনাটক চলছে কারখানার গেটে। কংগ্রেস আশ্রিত গুণ্ডাদের
আক্রমণে খুন হয়ে গেলেন তরুণ বামপন্থী নাট্যকার নির্দেশক
অভিনেতা সফদার হাসমি। সারা দেশ জুড়ে ঝড় উঠল, দেশ টপকে
সে-ঝড় আল�োড়ন ত�োলে আন্তর্জাতিক আঙিনাতেও। সফদারের
জীবনসঙ্গী ও সহকর্মী মলয়শ্রী হাসমি তাঁদের নাট্যদল ‘জন নাট্য
 49
মঞ্চ’ নিয়ে কলকাতায় এসেছেন নাটক মঞ্চস্থ করতে। আরও
অনেক মানুষের সঙ্গে সে-প্রয�োজনা দেখলেন শঙ্খ ঘ�োষ, লেখনি
কথা বলে উঠল তাঁর—
হাতের ওপর হাত রাখা খুব সহজ নয়
সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়
এ কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়
পায়ের ভিতর মাতাল, আমার পায়ের নিচে
মাতাল, এই মদের কাছে সবাই ঋণী
ঝলমলে ঘ�োর দুপুরবেলাও সঙ্গে থাকে
হাঁ-করা ওই গঙ্গাতীরের চণ্ডালিনী
সেই সনাতন ভরসাহীন অশ্রুহীনা
তুমিই আমার সব সময়ের সঙ্গিনী না?
তুমি আমায় সুখ দেবে তা সহজ নয়
তুমি আমায় দুঃখ দেবে সহজ নয়

 50
প্রবাদ হয়ে যাওয়া এই কবিতার ছত্রগুলি আজও উদ্দীপ্ত করে,
আজও প্রেরণা জ�োগায় অগণন তরুণ তরুণীকে।
হ�োমার’এর ইলিয়ড নির্ভর David Benioff এর লেখা এবং
Wolfgang Petersen নির্দেশিত Troy চলচ্চিত্রটি বেশ কয়েকবার
দেখেছি। কিংবদন্তিসম একঝাঁক অভিনেতা অভিনেত্রীর অভিনয়
সমৃদ্ধ সে-চলচ্চিত্রের বলিষ্ঠ সংলাপ আমাদের মননে ঝড় ত�ো
ত�োলেই যেন বা প�ৌঁছে দেয় ট্রয় যুদ্ধের দিনগুলিতে, চাক্ষুষ করায়
গ্রিক আর স্পার্টান বীরদের। সে-যুদ্ধে গ্রিক বীর অ্যাকিলিস, স্পার্টার
রাজপুত্র হেক্টরসহ আরও অনেকে নিহত হন। বন্ধু অ্যাকিলিসের
অন্তোষ্টিশেষে ইথাকার রাজা ওডিসিউস যে-কথাগুল�ো বলেন তা
এইরকম:
‘If they ever tell my story, let them say I walked
with giants. Men rise and fall like the winter wheat,
but those names will never die. Let them say I lived
in the time of Hector, tamer of horses. Let them say, I
lived in the time of Achilles.’
শঙ্খ ঘ�োষকে নিয়ে আমাদের জাঁক প্রায় একইরকম।

 51
শঙ্খ ঘ�োষের দিকে
সায়ন্তন সেন

আল�োকচিত্র : সন্দীপ কুমার


শিবাজী বন্দ্যোাপাধ্যায়কে নকল করে লেখাটির নাম রাখতে
পারতাম — ‘শঙ্খর’ কলকাতা যাত্রা। কিন্তু আমার পক্ষে সেইটে
বড়�ো স্পর্ধার কথা হবে। আমরা নয় দশকের দল, তীব্র য�ৌবনের
শঙ্খ ঘ�োষকে আবিষ্কার করেছি পূর্বজদের স্মৃতিকথা থেকে। আর
আমাদের মফস্বলে এই সেদিনও রাজধানীর প্রভাতী সংবাদ আছড়ে
পড়ত সন্ধ্যায়, অনেকটা দেরি করে। তারপরেও থাকে তাঁর কীর্তি,
তার ব্যাপ্তি ক্যালেন্ডারের এঁদ�ো হিসেব ছাপিয়ে যায়, তবু, অন্তত
আমার এ-আল�োচনা করবার কথা নয়। ভরসা কেবল, এই যে একটা
আলাপের উপক্রম করেছি, তার সুবাদে, হয়ত�ো শঙ্খ ঘ�োষের কিছু
কবিতা ও গদ্যাংশের কাছে আরও একবার ফেরা যাবে। হয়ত�ো তর্ক
ত�োলা যাবে, হয়ত�ো বুঝে নেওয়া যাবে কী আমাদের শেখার আছে
ওঁর কাছে। সেটুকুই উদ্দেশ্য, আর উদ্দেশ্য — সত্যি কথা বলা।
শঙ্খ ঘ�োষের দুটি উপন্যাস, কিছু প্রবন্ধ, অল্পকিছু ছড়া ও

 52
সাক্ষাৎকার আমি নিশ্চয়‌ই পড়েছি, তাঁর অনেক কবিতাও পড়েছি
বিচ্ছিন্ন ভাবে নানা সময়ে, কিন্তু পাঠক হিসেবে শঙ্খ ঘ�োষের সঙ্গে
আলাদা করে ক�োন�ো নিবিড় সখ্যের বাঁধন আমার অনেক দিন
পর্যন্ত গড়ে উঠতে পারেনি। যেমন গড়ে উঠেছিল গ�োঁফের রেখা
দেখা দেওয়ার ঠিক আগে আগেই, জয়দেব বসুর সঙ্গে। কেন সেই
দিন, পকেটে তাজা কবিতার পাণ্ডুলিপি আর উদাস মুঠ�োয় ভরা
প্রত্যাখ্যান নিয়ে শহরের রাস্তায় রাস্তায় অকারণ ঘুরে বেড়াবার সেই
দিনগুলিতেই বিশেষ করে জয়দেবকে এত মনে ধরেছিল আমার?
কে জানে! এখন ভাবি, অপমানিত এক কিশ�োরের করুণ আত্মদাহ
আর তীক্ষ্ণ অহমিকা আছে ওঁর অনেক কবিতায় ও গদ্যে, সেইটেই
তখন আকর্ষণ করেছিল মুখ্যত। প্রথিতযশা প্রৌঢ় হওয়ার চেয়ে,
সে-বয়সে আর কে না জানে, অপমানিত কিশ�োর হওয়াই ভাল�ো।
তাই ক�োন�ো ক�োন�ো বন্ধুর বাড়িতে, রাত বাড়লে, নিজেকে রবাহুত
জেনেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি জনগণতান্ত্রিক কবিতার ইশ্‌তেহার
থেকে অংশবিশেষ সরব পাঠ করেছি। তখন‌ শঙ্খ ঘ�োষ একবার
এসেছিলেন আমার অভিজ্ঞতায়। ব�োধহয় জয়দেবের মৃত্যুর অল্প
কিছু দিন পরেই শঙ্খ ঘ�োষের একটি গদ্য আমার হাতে আসে,
নাকি অন্য কার‌ও লেখায় ওঁর রচনার উদ্ধৃতি, তা আজ আর মনে
নেই, লেখাটি সম্প্রতি উদ্ধার করলাম।
যতটা লিখত জয়দেব, তার অনেকটাই ছাপা হত�ো না। যতটা
ছাপা হত�ো, তারও অনেকটা হত�ো না গ্রন্থিত। এসব না-এর মূলে ছিল
হয়ত�ো কিছুটা তার উদাসীনতা, কিছুটা জেদ, কিছু-বা অভিমানও।
অনেকদিন ধরে পাঠকদের সঙ্গে এইভাবে একটা দূরত্বই ঘটে আছে
ওর, অনুরাগী পাঠকেরা জানতেও পারেননি যে কতখানি তাঁরা
হারিয়েছেন।
‘অভিমান’, ‘উদাসীনতা’ আর ‘জেদ’ — যদিও আজ আমি
ক্রম পাল্টে নিতে চাই বিন্যাসের — তিনটি শব্দের পরপর উন্মোচন
আমাকে সেই মুহূর্তে একটা আশ্চর্য মুক্তি দিয়েছিল, মনে পড়ে। ঠিক
যে-কথাটি আমি নানা বাকবিন্যাসে ভাবতে চেষ্টা করেছি এতদিন,
বলতে চেষ্টা করেছি ক�োথাও ক�োথাও, সেই কথাটিই এত অব্যর্থ,
নিখুঁত, ছিপছিপে, সংবেদী ভাষায় আমার সামনে এসে হাজির হল
জয়দেবের সঙ্গে সেই বিয়�োগমুহূর্তে, আমি শঙ্খ ঘ�োষকে ভাল�োবেসে
ফেললাম।
 53

কিন্তু এ-ও পরেকার কথাই হল। আজ শুনলে অনেকে হয়ত�ো
ভারী আশ্চর্য হবেন যে শঙ্খ ঘ�োষের দিকে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল
আর‌ও অনেকদিন আগে, শ্রীমতী ল�োপামুদ্রা মিত্রের একটি জনপ্রিয়
গানের সূত্রে। অবশ্য আশ্চর্য না হতেও পারেন, কারণ কলকাতা
ও মফস্বলের গান-শ�োনা মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এক
কালে ল�োপামুদ্রার গতায়াত ও নিশ্চিত খাতির ছিল। সুনীল গাঙ্গুলি
আর জীবনানন্দ‌ও ছিলেন ল�োপামুদ্রার ঝুলিতে। পরে অশ�োক
মিত্রের লেখায় পড়েছি: জীবনানন্দের কবিতার মাঝে অমন ঝাঁ-ঝাঁ
তালবাদ্য খেলান�োটা খুব‌ই নাকি নাজায়েজ হয়েছে। কিন্তু কী আর
করা, ল�োপামুদ্রার সেই ‘যমুনাবতী’-গানের সূত্রেই প্রথম, ভয়াল,
আর কিছু-বা-রহস্যাবৃত এক দীপ্তি নিয়ে শঙ্খ ঘ�োষ আমার সামনে
এসে দাঁড়ালেন অকস্মাৎ। আমি নিতান্ত বালক, অদীক্ষিত, বর্মহীন।
সে-গানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ত�ো জানিই না, বাণীও অনেক
সময়েই খুবই খট�োমট�ো লাগে, নিশ্চিত ক�োন�ো মানে ব�োঝা যায়
না অনেক চরণের, ছ�োট এক মেয়ে যুদ্ধে গিয়ে মারা যায় — ম�োদ্দা
ভাবটুকুই কেবল বুঝতে পারি। অথচ কী ক্লান্তিহীন আকর্ষণ গানটির
প্রতি, সমস্ত অস্বস্তির হ�োঁচট টপকে গিয়ে, অথবা সমস্ত অস্বস্তির
কারণেই বিশেষ করে, অনেক দিন পর্যন্ত গানটি আমার সঙ্গে রয়ে
যায়। ততদিন, যতদিন না আমি খ�োঁজখবর করে নিজেই আবিষ্কার
করি যমুনাবতী কবিতাটি, শীর্ণ এক কবিতাব‌ই ঘেঁটে। এতক্ষণে
আগুন ফলে নিভন্ত চুল্লিতে, শঙ্খ ঘ�োষের দিকে গুটিগুটি পায়ে সেই
এগ�োন�ো শুরু হয় আমার। নিতান্ত বালক বয়সে — আমাদের ‘গূঢ়
মফস্বলে’ যখন পাতাঝরার শব্দ শ�োনা যেত — এক কিশ�োরীর যুদ্ধে
যাওয়া আর বারুদ বুকে নিয়ে ফেরার বিয়�োগান্তগাথা, সেই তখন‌ই,
গাঁথা হয়ে যায় আমার স্মৃতিতে।
অথচ তারপরেও পাঠক হিসেবে তেমন একটা নিয়মিত
য�োগায�োগ ওঁর সঙ্গে আমার গড়ে উঠল না। যদিও, কলকাতায়
লেখাপড়া করতে যাওয়ার আগেই আমি শঙ্খ ঘ�োষের বেশ কিছু
কবিতা মন দিয়ে পড়েছি। তবু এখন মনে হয়, সে-সব কবিতা
আমার চারপাশে পড়া হত বলেই যেন পড়েছি। ইংরেজিতে একে
বলা যেতে পারে, শঙ্খ ঘ�োষ খানিকটা ঐতিহাসিকভাবেই আমার
রক্তে ‘ট্রান্সমিটেড’ হয়েছেন ছেলেবেলা থেকে। মনে পড়ছে,
 54
আমাদের এক মাস্টারমশাই একবার এম এ ক্লাসে মার্কস পড়াতে
গিয়ে ফাজিল দৃষ্টি হেনে বলেছিলেন, ‘মার্কসের লেখা এক লাইন‌ও
না পড়ে মার্কসের সমাল�োচনা অথবা প্রশংসা করবার অধিকার
আমাদের‌ই আছে, কারণ মার্কস বাঙালির রক্তে হিস্টরিক্যালি
ট্রান্সমিটেড হয়েছেন’। কথাটা রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারেও ব�োধহয়
চালিয়ে দেওয়া যায়। তবে কবি শঙ্খ ঘ�োষের ক্ষেত্রে কথাটা এখনই
(!) খাটে কিনা, আর খাটে যদি, তাহলে সেটা সমর্থনয�োগ্য কিনা
তা আপনারা ভেবে দেখবেন। রক্তের জন্য ক�োন�ো বাড়তি স্বাধীনতা
আমি নিচ্ছি না। জাবাল সত্যকাম বা আরুণি উদ্দালক যে আমি
পড়েছি তার কারণ সে সময় আমাদের শহরের একদল মানুষ ওই
সব কবিতার কথা শতমুখে বলতেন, ২০০২ সালের পর থেকে
বারবার, নানা সময়ে, রাজনৈতিক স্লোগানে ব্যবহার‌ও করতেন।
তার‌ই উত্তরাধিকার হয়ত�ো: নির্ভয়ার মৃত্যুর পর ভাঙাচ�োরা এক
নাট্যমহলাকক্ষে অনেক উত্তেজিত রাজনৈতিক বিসংবাদের মাঝখানে
আমি আঁকড়ে ধরি ক্লান্ত ও ব্যাথাতুর দুটি চরণ, ‘এত যদি ব্যূহচক্র
তীর তীরন্দাজ তবে কেন/ শরীর দিয়েছ শুধু বর্মখানি ভুলে গেছ
দিতে!’ অথবা তার‌ আগে — ‘এই শহরের‌ই রাস্তায় একটি কাল�ো
মেয়ে যখন উঠে দাঁড়িয়ে তীরের ফলার মত�ো ছিটকে আসত
দর্শকের কাছাকাছি আর বলে উঠত ‘খেতে ত�ো হবেই বাবা!’,
ব�োধহয় সফদর হাশমির ক�োন�ো নাটকে — আমি তখনও গিলতাম
তাঁকে। এ-বাবদে আমার ক�োন�ো কৃতিত্ব নেই কেবল এটুকু জানান
দেওয়া ছাড়া যে, সেদিনের সেই সংক্ষুব্ধ, রাজনীতি-সচেতন
মফস্বল আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। ক�োথাওই পারিনি মনে
হয়। ক�োন�ো ক�োন�ো গণহত্যার প্রতিবাদ এখন আর খুব প্রকাশ্যে
করা যায় না। করলে, হায়, এমনকী শঙ্খ ঘ�োষেরও মৃত্যু কামনা
করা হয়!


যাক সে কথা, আমি বলছিলাম যে এত কিছুর পরেও আমি শঙ্খ
ঘ�োষের তন্বিষ্ঠ পাঠক হয়ে উঠতে পারলাম না। শঙ্খসমুদ্রের দিকে
আর‌ও একটু এগ�োলাম বরং শহর ছাড়ার পরে, যখন গ্র্যাজুয়েশনের
প্রথম বছরে আমাদের পাঠ্যসূচিতে আবির্ভূত হল কৃশ, সবুজ সেই
বই — সুপুরিবনের সারি। আর ‘পাঠ্যপুস্তক’টি সাবাড় করবার
 55
আগেই, ওঁর সঙ্গে দেখা হল আমার।
কলেজে উঠলেই যেমনটা করতে হয় বলে জানতাম, অনতিনির্দিষ্ট
এক বন্ধুদল প্রথম সপ্তাহেই সেই মত�ো একটা কাগজের সম্পাদকীয়
দপ্তরে হল্লা করলাম, ডি লা গ্র্যান্ডি নামে নিজেদের একটা কাগজ
থাকতে হবে আমাদের, তাতে লিখবেন শঙ্খ ঘ�োষ — এরকম সিদ্ধান্ত
গৃহীত হয়ে গেল। লেখার আবদার নিয়ে অতঃপর তিনজন আমরা
হাজির হলাম বহুশ্রুত সেই র�োববারের আড্ডায়। স্যার খুব কম কথা
বলেন, আপ্যায়নে অসম্ভব যত্নশীল, আমরা কুণ্ঠিত অথচ গদগদ-
ভাবে চেয়ারে উপবিষ্ট, আর ভারতীয় ‘অন্যধারার ছবি’র সীমা ও
স্ববির�োধ নিয়ে একটা ভারী সিরিয়াস তর্কাতর্কি চলছে। অনেকদূর
পর্যন্ত আমি বুঝতে চেষ্টা করছি, হঠাৎ একজন উত্তেজিত হয়ে
বললেন, ‘সে আপনি যদি এখন বিদেশী ছবির সঙ্গে তুলনা করেন,
তাহলে ত�ো হবে না, ভারতের মধ্যে ছবি হিসেবে ওটা ভাল�োই’
— এবারে, এতক্ষণে, আমিও কিছু বলব কিনা ভাবছি। সংক�োচে
বাক্যটা সাজিয়ে উঠতে পারছি না মনের মতন। অথচ বলতে চাইছি
অনেক কথা, বলতে চাইছি — ভারতবর্ষে ছবি বানিয়েছেন ঋত্বিক
ঘটক, মনি কাউল, তারপরেও ‘ভারতীয় ছবির মধ্যে ভাল�ো’ —
এরকম একটা হীনমন্য অহং-এই কি চিরটাকাল ডুবে থাকা উচিত
আমাদের? ভাবনার সুত�ো ছিঁড়ল, আমায় চমকে দিয়ে স্যার, প্রায়
ইচ্ছে করেই যেন, শুনতেই-দিতে-চান-না এত দূর মৃদুস্বরে বলে
উঠলেন, ‘এটা তুমি কী বললে!’, আর বলতে বলতেই, একটু যেন
সবিনয় ক�ৌতুক মিশিয়ে হাসলেন ঠ�োঁটচাপা, ছেলেছ�োকরা হলে
সে-হাসিকে সহজেই বলা যেত — ‘মিচকে’। অমূল্য সেই হাসি যে
আমার মনে থেকে গেছে আজও অবিকল, তার একটা কারণ আছে।
ওঁর স্মিতহাসির যে ফ�োট�োগ্রাফগুলি আমি এই মুহূর্তে মনে করতে
পারছি, আপনারা লক্ষ্য করে দেখবেন, তার অনেকগুলিতেই হাসির
ভিতর এই ‘সবিনয় ক�ৌতুক’ (নাকি অবিনয়ের অছিলা তা আসলে?)
মেশান�ো আছে। এই ক�ৌতুকের কথা শঙ্খ ঘ�োষের স্মৃতিচারণায়
অনেক আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধু বলেছেন বারেবারে। তবু আজ
আরেকবার কথাটায় বাড়তি নজরটান দিতে চাইছি। কারণ, যে-
ক�ৌতুকপ্রবণতা শঙ্খ ঘ�োষের চরিত্রের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য, তা
ঠিক হাওয়ায় ভাসান�ো ক�োন�ো অকারণ, অহেতুক ক�ৌতুক‌নয়, সে-
ক�ৌতুকের লক্ষ্যমুখে — আমার ত�ো মনে হয় — অতিনির্ধারিত এক
 56
‘তুমি’ বা ‘ত�োমরা’ আছে সবসময়। অবশ্য‌ ‘ক�ৌতুক’ শব্দটা আমি
একটু কম ভেবেই বেছে নিলাম, আর‌ও সরস একটা শব্দ ল�োকায়ত
ভাষাপরিসর থেকে ধার করে, আরও নিখুঁত করে, একে ব�োধহয়
‘রঙ্গ’-ও বলা যেত।
কেমন সে রঙ্গ?
তাঁর সাহচর্যে থেকে একরকম করে সেই রঙ্গপ্রিয়তার বিদ্যুৎছটা
দেখেছে অনেকে। আমাদের ছাত্রকালের কবিবন্ধু পৃথ্বী বসুর
স্মৃতিচারণায় এরকম একটা ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে — একবার
এক ক�ৌতূহলী যুবা নাকি ওঁকে জিগ্যেস করেছিলেন ক�োন�ো অবসরে,
‘স্যার, আপনি অল্প বয়সে লিখে যে আনন্দ পেতেন, এখন‌ও কি আর
তেমন পান?’, উত্তরে স্যারের প্রতিজিজ্ঞাসা, ‘আমি যে অল্প বয়সে
লিখে আনন্দ পেতাম, ত�োমায় কে বলল?’ মুখ্যত এটাই আজ আমার
বলবার কথা — কেউকেটা হলে বলতাম ‘প্রতিপাদ্য’ — বিশ্বাসের,
যাপনের আর সকল সত্যের মত�োই ওঁর এই চারিত্র্য উঠে এসেছিল
কবিতায়, ক�ৌতুক বা রঙ্গ কেবল নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে আর‌ও একটু
মাত্রা চড়িয়ে মকারি, উদ্ধত তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা এবং চলতি কথায়
যাকে বলে ‘পিন মারা’ — এই সমস্ত কিছু আছে শঙ্খ ঘ�োষের গুচ্ছ
গুচ্ছ কবিতায় পুর�োদস্তুর। মনে হতে পারে, আমি বাসি কথা বলছি,
পুনরাবৃত্তি করছি আল�োচিত সন্দর্ভের। বিশেষজ্ঞ ন‌ই, তাই কথাটা
প্রস্তাব আকারে না রেখে, আমার ব্যক্তিগত পাঠ-অভিজ্ঞতা হিসেবেই
রাখি: শঙ্খ ঘ�োষের কবিতার ন্যূনতম ব্যবচ্ছেদ‌ও মন�োয�োগী ক�োন�ো
স্কলার যদি করেন কখন‌ও, তাহলে সমষ্টির বিরুদ্ধে ব্যক্তির যুদ্ধে
এই রগড়, এই প্রচ্ছন্ন ‘মকারি’-র উৎস শঙ্খ ঘ�োষের কবিআত্মার
ক�োন্ গহনে, সমাজপ্রবাহের ক�োন্ ক�োন্ সংবাদের ভিতর, আর
সমাজে কেমন তার রাজনৈতিক অভিঘাত — এ-দুটি প্রশ্ন‌ তাঁকে
খতিয়ে দেখতে হবে বলেই মনে হয়। কেননা এ ব্যাপারে খুব
বিচক্ষণ ক�োন�ো আল�োচনা আজও হয়নি। একে যদি নিখাদ, নিরেট
প্রতিষ্ঠানবির�োধিতা বলে পাশ কাটিয়ে যেতে চান, তাহলে আমার
সঙ্গে আপনার পাঠ-অভিজ্ঞতা এইখান থেকে আর মিলবে না। ওঁর
মহত্তম কবিতাগুলির ব্যাখ্যানের আমার কিছু সিরিয়াস অতৃপ্তি রয়ে
যাবে। অজস্র সেই কবিতাদের মধ্যে থেকে খুব অল্প কিছু চয়ন করে
আজ পড়তেও হবে এখানে আমায়। নানা সময়ে শঙ্খ ঘ�োষের যে-
কবিতাগুলি আমার সঙ্গে থেকেছে, তাদেরই ভিতর থেকে কয়েকটি
তাই বেছে এনেছি।

 57

শঙ্খ ঘ�োষ সম্পর্কে অনেককেই বলতে শুনেছি, ভারী বিনয়ের
সঙ্গে সবসময়েই নাকি পূর্বপক্ষের সামনে বিকল্প প্রস্তাবটি উনি পেশ
করে থাকেন। কিন্তু এইটেই যদি তাঁর কথা বলবার একটিমাত্র,
অথবা সবচাইতে সুচিন্তিত ভঙ্গি হয়, তাহলে এ-কবিতার ব্যাখ্যা কী?

সহজ
আমিই সবার চেয়ে কম বুঝি, তাই
আচম্বিতে আমার বাঁ-পাশে এসে হেসে
পিঠ ছুঁয়ে চলে যাও;
‘অত কি সহজ?’ বল তুমি।

তার পর আমার কী বাকি থাকে? অপরাধ


আমার দু-পাশে কেন কাশফুল হয়ে ভরে ওঠে?
শরীরে শারদবেলা নত হয়ে নেমে আসে যেন-বা আমিই শস্যভূমি —
অত যে সহজ নয় মাঝে-মাঝে তাও ভুলে যাই।
‘এসে’, ‘হেসে’, ‘ছুয়ঁ ে’, ‘চলে’ — এতগুলি অসমাপিকা যে নৃত্যময়
চপলতা ইম্পোজ (প্রক্ষেপ?) করে, ‘অত কি সহজ?’ — এই প্রশ্নের
শরীরে, তাকে কি বিনয়ের লক্ষণ বলা চলে কিছুতেই? বেশি-
ব�োঝা ‘তুমি’টির এই প্রায়-বাতাসে-ভেসে ভারহীন, দায়হীন চলে
যাওয়াটিকে — আমাদের জমানায় অনেকে যেমন বলে — কবিও
কি আপাদমস্তক ‘জাজ’ করছেন না? ‘তুমি’ চলে গেলে বাকি থাকে
‘অপরাধ’, কিন্তু সে অপরাধ‌ও কাশফুল হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ বেদনার
স্পর্শে। ‘সবার’-এর বিপ্রতীপে দাঁড়ান�ো ভারী, তীব্র, বিপজ্জনক
‘আমিই শস্যভূমি’ উচ্চারণ হয়ে ওঠে কবির ব্যক্তিসত্তার সচেতন
অহমিকার প্রত্যয়ী ঘ�োষণা। আমি জানি, অনেকে এখানে বলতে
চাইবেন, এ ত�ো সহজ কবিতাটির কথকের মন�োভাব, একে কবির
মন�োভাব বলে চালান�ো কি ঠিক হচ্ছে ত�োমার? আমি তখন বলব:
কথকের ওই মন�োভাবের মধ্যেই আমি তবে শঙ্খ ঘ�োষের কবিআত্মাটি
খুঁজতে চাইছি। জানাতে চাইছি, এ-অহমিকা আসলে কথকের নয়
ম�োটেই, বরং, কবির বলেই এ কথকের। কথাটা বলবার জন্য অন্য
অনেক কবিতাই আমি বেছে নিতে পারতাম, কিন্তু এই সহজ কবিতায়
প্রসঙ্গটা অনেক সূক্ষ্ম স্তরে পড়া যায়। তার কারণ, এই অহমিকার,
এই মেঠ�ো-পরিহাসের উল্টো দিকে ক�োন�ো ব্যারাক বা সেনাছাউনি
 58
নেই, আছে — যে-কথা বলছিলাম — অতিনির্ধারিত এক ‘তুমি’,
আর তুমির চেয়ে একটু-যেন বেশি দূরত্বে থাকা সবাই: ‘আমিই সবার
চেয়ে কম বুঝি’। ‘তুমি’, কথক ও সবাই — হায়ারার্কির এক ত্রিক�োণ-
সম্পর্কে থেকে পরস্পরকে কার্যত নিরীক্ষণ করে, জাজ করে, আর
শেষমেষ জিতে যান খ�োদ শঙ্খ ঘ�োষ। আজ্ঞে হ্যাঁ, কথক নয়। কবি
শঙ্খ ঘ�োষ। কথকের খ�োলস ছিঁড়ে ‘আমিই শস্যভূমি’ প্রস্তাবটি
অথরের‌জয় ঘ�োষণা করে, শস্যভূমি ত�ো কবি ছাড়া আর কেউ হতেই
পারে না। আর কে আছে তেমন কর্ষণের বেদনায়, তেমন প্রসবের
ভারে আকুল! আর কে আছে যার পুঞ্জীভূত ‘অপরাধ’ — কবিতা!
আর, একটু দুষ্টুমি করে, অ-শঙ্খসুলভ বাকপ্রতিমায় যাকে ‘পিন্
মারা’ বলতে চাইছি — তার‌ও দৃষ্টান্ত সুপ্রচুর, কিন্তু এবারেও এমন
একটা কবিতাই আমি আপনাদের করতলে রাখতে চাই, যে-কবিতার
পিন্ ম�োটেই পুলিশ বা রাষ্ট্রের গায়ে সরাসরি বেঁধে না। যে-কবিতায়
শঙ্খ ঘ�োষ শুনতে পান, পথের মাঝে এক যুবাকে ভিখারি নাকি
ডেকে বলে গিয়েছে, প্রথম থেকেই শ�োনাই —
সত্য
আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল যুবা
সদ্যপ্রেমে ঝাপসা, বিক্ষত।
পথের ভিড়ে মুখ লুকিয়ে কাল এক
ভিখারি তাকে বলে গিয়েছে ডেকে:
‘দিনের বেলা একলা ঘুরি পথে
রাতদুপুরে সঙ্ঘে যাই ফিরে
সঙ্ঘে আমি একলা থাকি বটে
একার পথে সঙ্ঘ টের পাই।
ত�োর কি আছে এমন যাওয়া-আসা?
কর্মী, ত�োর জ্ঞানের বহু বাকি —
আমাকে তুই যা দিতে চাস ভুল
ফিরিয়ে নিই আমার ভাঙা থালা।
তাছাড়া এই অবিমৃশ্য ঝড়ে
স্পষ্ট স্বরে বলতে চাই ত�োকে
সত্য থেকে সঙ্ঘ হতে পারে
সঙ্ঘ তবু পাবে না সত্যকে।’
কবিতার দ্বিতীয় চরণে যে-ছিল-‘আমার’ ‘সদ্যপ্রেমে ঝাপসা,
বিক্ষত’ যুবা, একটু পরেই, মুখহীন এক ভিখারির তরজমায়,
 59
সঙ্ঘের আবিলস্পর্শে সে হয়ে পড়ল ‘কর্মী’। আশা করি বুঝতেই
পারছেন, ‘কর্মী’ শব্দটা এখানে — প্রায় নাটবল্টুর সমতুল — অ(প)
ব্যবহারে-মস্তিষ্ক-খ�োয়ান�ো সঙ্ঘের ইউনিটমাত্রের পরিচিতিচিহ্ন
হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ‘তুই’ সম্বোধনে, ভাঙা থালা ফিরিয়ে নেওয়ার
ক�োরিওগ্রাফে ঝলসাচ্ছে স�ৌজন্যহীন তাচ্ছিল্য। আর কবিতার শেষে
যে ‘পাঞ্চলাইন’ — তাতে ক�োন�ো সপ্রশ্ন বিনয়ের বালাই ত�ো নেই-ই,
উপরন্তু মানবমুক্তির লক্ষ্যে যাঁরা খুব মন দিয়ে সঙ্ঘ ইত্যাদি করেন,
তাঁদের পক্ষে প্রপ�োজিশনটা, ভাষায় ও ভঙ্গিতে, ম�োটেই স্বস্তিদায়ক
নয়। আমি নিজে যেহেতু ব্যবহারিক অর্থে সঙ্ঘপন্থী, সুতরাং আমার
পক্ষেও, বুঝতেই পারছেন, প্রপ�োজিশনটা ম�োটেই স্বস্তিদায়ক নয়।
অতএব শুরুতে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা মেনে, সত্যের‌ই খাতিরে
আলগ�োছে একটা তর্ক এখানে আমি উসকে রাখতে চাই।
‘সবার’ উল্টোদিকে নির্জন এই ‘আমি’টি, অথবা অবিমৃশ্য ঝড়ের
ভিতর ক�োন�ো একটি ‘স্পষ্ট স্বর’ এমন আঁতিপাতি হয়ে খ�োঁজেন কেন
শঙ্খ ঘ�োষ, তাঁর অজস্র কবিতায়? সম্ভবত খ�োঁজেন, কারণ সেই স্বরের‌ই
অনুসরণে, সেই আমিটির হাত ধরেই, সত্যে প�ৌঁছতে হবে তাঁকে।
সত্যকে খুজতে
ঁ হবে সমস্ত এপারেটাসের, ক্ষমতাতন্ত্রের, প্রতিষ্ঠানের,
অথবা সমষ্টির ল্যাপাপ�োছা চীৎকৃত অস্তিত্বের মুখ�োমুখি দাঁড়ান�ো একা,
নির্জন, নিঃসঙ্গ, ক�োটি ক�োটি পরস্পরবির�োধী যন্ত্রণার ভিতর অস্তিত্বের
অর্থ হাঁকড়াতে থাকা মানুষটির নির্মম ও অতন্দ্র ‘আত্ম’জিজ্ঞাসার মধ্যে।
শব্দ ও সত্য ব‌ইতে, কর্মে ও কথায় নিভৃত পরিচিকীর্ষার মধ্যে দিয়ে
মানুষের ‘ব্যক্তিগত উত্তরণ’-এর কথা যে বলেছেন শঙ্খ ঘ�োষ, তাও
আমরা সকলেই পড়েছি। তবু, আরেকবার সেই রচনার অংশবিশেষ
হয়ত�ো মনে করে নেবার প্রয়�োজন পড়বে এখন। কলকাতা পত্রিকায়
প্রকাশিত জ্যোতির্ময় দত্তের একটি লেখার প্রতিক্রিয়ায় কলম ধরেছিলেন
কবি, জ্যোতির্ময়ের নীরবতাব্রত ভঙ্গ করতে চেয়ে লিখেছিলেন —
লেখক ত�ো অভিমান করতেই পারেন যখন তিনি দেখেন যে তাঁর
কথার ক�োন�ো তাৎক্ষণিক মূ্ল্য নেই একেবারেই। স্পেনের গৃহযুদ্ধে যখন
দেশবিদেশের লেখকদলের মন জানতে চাওয়া হয়েছিল, দেড়শ�োজন
উত্তরদাতার মধ্যে তখন দুজন ছিলেন নিরপেক্ষ আর একজন মাত্র
ফ্রাঙ্কোপক্ষে, কিন্তু ফল কী হল তার? তিন বছরের মধ্যেই ফ্রাঙ্কোর জয়,
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আবির্ভাব! ... কিন্তু সেইজন্যে কি ভাষার‌ই উপর
অভিমান করা সাজে? সেইজন্যে কি নির্ভাষ প্রকৃতির কাছে শর্তহীন
আত্মসমর্পণ ঠিক?
 60
‘বৃহৎ সামাজিক বাজার’ যখন ভাষাকে ‘নিঃশীল, নিঃসাড়’ করে
দেয়, আলাপকে করে ত�োলে ‘নির্জনন’, তখন একা-একা চিন্তক কী
করতে পারেন? আর‌ও একটু পড়ব।
রাষ্ট্রনীতির কলর�োল মিথ্যে বলে শুধু। দলীয়তার পেষণে ঝরে যায়
ব্যক্তি। প্রম�োশন বা বিজ্ঞাপনের নষ্টামিতে মানুষের মন চিরদিনের মত�ো
সরে যায় প্রেম থেকে, স�ৌন্দর্য থেকে। কিন্তু এর‌ই মধ্যে আপনি চান
সুন্দরকে গড়ে তুলতে, এর‌ই মধ্যে আপনি চান ভাল�োবাসার সেতু মন
থেকে মনে। তাই আপনাকে কেবলই দাঁড়াতে হবে এই দলীয়তা এই
কলর�োল এই প্রম�োশন-ল�োলুপতা বা বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে, কাজে এবং
কথায়। কাজে, সে হল�ো আপনার ব্যক্তিগত উত্তরণ। কথায়, সে হল�ো
আপনার বন্ধুজনের পরিচর্যা, আপনার পরিবেশের প্রতিষেধক। বন্ধুরা
এখন‌ই আপনার হাতে হাত রাখবে না হয়ত�ো, বাংলাদেশ বা ভিয়েতনাম
নিয়ে আপনার কথাও শুনবে না হয়ত�ো কেউ, কিন্তু যে-কথা আপনার
বলার তা তবু আপনাকে বলে যেতে হবে এইজন্য যে, কেউ জানে না
গ�োপনে কেমন ভাবে সঞ্চিত হতে থাকে কথার শক্তি, কেউ জানে না
ক�োন্‌ তরুণ বা তরুণীর ব�োধ আপনি শুদ্ধ করে দেন মুহূর্তের জন্য,
আর এইভাবে তৈরি হয়ে ওঠে হয়ত�ো-বা এক ভবিষ্যতের ব্যক্তি। হয়ত�ো
একজন, একজন মাত্র।
কবিতার মত�োই, শঙ্খ ঘ�োষের প্রাবন্ধিক প্রস্তাবপত্রেও এই মাত্র
একজনের খ�োঁজ বিধৃত হয়ে থাকতে দেখব — জিজ্ঞাসার দীপ্তশিখা,
উচ্চারণের সংযমী পটুত্ব, অনেকের মাঝে মাত্র যে-একজনকে, মাত্র
যে-একজনই, সুধীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘প্রাতিস্বিকতা’ দেবে। নিজের
তাত্ত্বিক আর ব্যবহারিক মাপের মধ্যে রফা করতে গিয়ে ক্লান্ত, দীর্ণ
যে প্রতিদিন প্রশ্ন করবে নিজেকে: ‘আমি কি নিত্য আমার‌ও সমান?’
এখন ঝামেলা হল (মানে আমার কাছে ঝামেলা আর কি), সত্যে
প�ৌঁছন�োর প্রক্রিয়া যদি এতখানি ব্যক্তিগত ও অন্তর্মুখ হয়, তাহলে
সঙ্ঘের ব্যাকরণের সঙ্গে ত�ো তার একটা আবশ্যিক বির�োধ রয়েই
যাচ্ছে। যে-ক�োন�ো য�ৌথতাই, যে-ক�োন�ো সামূহিকতাই কি তবে
অনিবার্যভাবে সত্য‍ভ্রষ্ট হবে? জিজ্ঞাসু, সংশয়ী, সত্যভাষী ক�োন�ো
স্বরের জন্ম ও লালন কি কার্যত অসম্ভব মানুষের সমবায়ের ভিতর?
নাকি, অন্য কিছু বলতে চান শঙ্খ ঘ�োষ আসলে? তর্কটা আমিই প্রথম
তুলছি তা নয়। হয়ত�ো অনেকেই এ-তর্ক আগে তুলেছেন, আমার
জানা ও না-জানা। কিন্তু তারপরেও তর্কটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি।
প্রমাণ, কবির প্রয়াণের পর প্রাবন্ধিক, শিক্ষক মালিনী ভট্টাচার্য এই

 61
বির�োধ-বাস্তবতা সম্পর্কে সতর্ক থেকে আলত�ো হুঁশিয়ারি দিয়েছেন,
ছ�োট্ট এক নিবন্ধে। জাবাল সত্যকাম কবিতাটির কথা বলতে-বলতে,
শঙ্খ ঘ�োষের নির্জনতাপ্রীতির ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে মালিনী লিখছেন,
কবিত্বের র�োমান্টিক ধারণায় কখন�ো কখন�ো যে নির্জনতাকে সত্যদৃষ্টির
জন্য আবশ্যিক বলে মনে করা হয়, এখানে কি তিনি তার‌ই আত্মীকরণ
করেছেন? সমস্ত দলবদ্ধতার বাইরে, সংঘাত ও হট্টগ�োলের বাইরে এক
আত্মমগ্ন স্বেচ্ছা-‘বনবাসে’র কথাই বলছেন?
কিন্তু এর বেশি এগ�োন না এই পথে আর, বরং প্রশ্নটিকে উদাসীন
সংশয়ে ঝুলিয়ে রেখে প্রাবন্ধিক জানান, ‘এমন অর্থ কেউ করতেই
পারেন’। আর নিজে কিন্তু, র�োমান্টিকতার প্রত্যয় থেকে ফিরে
আসেন স্বভূমে,
শুধু কবি নয়, গ্রামশির ভাষায় প্রত্যেক মানুষই যদি চেতনাজীবী হয়,
সেই চেতনার অনুসন্ধান ত�ো প্রত্যেকের ভিতরের লড়াই, নিজের সঙ্গে
লড়াই‌ও বটে। সেত�ো শুধু সামূহিকতার স্রোতে ভেসে গিয়ে হয় না।
মজার ব্যাপার, ‘স্রোতে ভেসে গিয়ে’ কথাটিতেও সেই এক‌ই প্রাজ্ঞ
বিরক্তির ছাপ যেন, শঙ্খ ঘ�োষের একা মানুষটির। যদিও বিরক্তি
সত্ত্বেও সঙ্ঘ সম্পর্কে তার ক�োন�ো আন্তরিক অশ্রদ্ধা ফুটে উঠছে না।
কিন্তু এই নিরীহ চেতাবনিতে ত�ো আর শঙ্খ ঘ�োষ কুকথার আগল
টানেন না, ব্যক্তিসত্তার সচেতন অহমিকা তাঁর কবিতায় বিস্তৃত হয়
আরও বহুদূর —
পাগল
‘এত কিসের গর্জে আকাশ
চিন্তা ভাবনা শরীরপাত?
বেঁচে থাকলেই বাঁচা সহজ,
মরলে মৃত্যু সুনির্ঘাত!’ —
ব’লে, একটু চ�োখ মটকে,
তাকান মত্ত মহাশয় —
‘ঈষৎ মাত্র গিলে নিলে
যা স‌ওয়াবেন তাহাই সয়।
‘হাওড়া ব্রিজের চূড়�োয় উঠুন
নীচে তাকান, ঊর্ধ্বে চান —
দুট�োই মাত্র সম্প্রদায়
নির্বোধ আর বুদ্ধিমান।’

 62
‘মত্ত’ মহাশয়ের এই চ�োখ-মটকান�ো, নিঃশংসয় সমাজবিশ্লেষণে
আমি আর আমার ক�োন�ো ক�োন�ো বন্ধু একদিন সায় দিয়ে উঠতে
পারিনি। ব�োধহয় কবিও সায় দিতে পারেননি আগাগ�োড়া। কিন্তু
আজ, এই মুহূর্তে আরেকবার ভেবে দেখছি: ‘পাগল’ কেন কবিতাটির
নাম? মিশেল ফুক�ো যেমনটা দেখিয়েছেন আমাদের, অতিনিয়ন্ত্রিত,
কেন্দ্রায়িত, গ্রহণ-লাগা যক্ষপুরীর ভিতর কখন�ো-কখন�ো শুধু
পাগলেরা সত্যি কথা বলে, তাই কি? নাকি মত্ত মহাশয়েরও
দেখায় আছে নির্দিষ্ট এক ‘অবস্থানগত’ সীমাবদ্ধতা, ‘চুড়�ো’ থেকে
মানুষের দিকে চাইবার নিবার্য অভিশাপ? এ-কবিতা কি মধ্যবিত্তের
আত্মকরুণারও? প্রশ্ন ত�োলা রইল। ক�োন�ো নিশ্চিত, অভ্রান্ত উত্তর
এই মুহূর্তে জানা নেই। এখন শুধু ভাবছি: এই পণ্যমগ্নতার সময়ে
‘স্রোতে গা ভাসাবার’ প্রবণতা সম্পর্কে আমাদের সকলের আলাদা
আলাদা করে সচেতন হ‌ওয়ার দরকার আছে কিনা, দরকার আছে
কিনা চতুরতা খুলে রেখে, সঙ্ঘের বর্ম ও শিরস্ত্রাণ খুলে রেখে কখন�ো
কখন�ো আকাঁড়া নিজের মুখ�োমুখি দাঁড়াবার। কেননা জিজ্ঞাসার
আল�ো ত�ো জ্বলে ওঠে একটি মাত্র চেতনায়, অনেকের চেতনায় তা
এক সঙ্গে জ্বলে উঠতে পারে, কিন্তু তবুও, তখনও, তা আলাদা করে
প্রত্যেকের। ব্যক্তিত্বের পরিশীলন ছাড়া সে আল�ো জ্বলবে কেমন করে
তবে? ভেবে দেখছি, যে-ক�োন�ো সঙ্ঘের‌ই ভিড় যখন নানা কায়দা
ও ক�ৌশলে ব্যক্তির বশ্যতা আদায় করতে চায়, প্রশ্ন করতে বারণ
করে, কথায়-কথায় সম্মতিসূচক ঘাড় বাঁকাতে শেখায় শুধু, রাষ্ট্রের
এপারেটাসের মত�ো একই-একই ‘টুল’ যখন ক্ষমতা কায়েম রাখতে
ব্যবহার করেন ঘ�োরতর বিপ্লবীরা, তখন শঙ্খ ঘ�োষের কবিতার নির্জন
মানুষটি আমাদেরও চেতনায় কি প্রতিস্পর্ধা ছড়াতে থাকে না? যে-
স্পর্ধার উৎসে প্রতিভার দীপ্তশিখায় জ্বলছে অক্ষম প্রতির�োধে ফুঁসতে
থাকা, উচ্ছ্রিতগ্রীবা ইন্ডিভিজ্যুয়ালের বিশুদ্ধ ক্ষোভ। দেখা যাচ্ছে,
ক�ৌতুক থেকে আমি আপাতত ক্ষোভে এসে প�ৌঁছেছি। কিন্তু এখানেই
থামতে রাজি নই, কেননা অন্য অন্য কবিতায় সে-ই সকলকে জানিয়ে
দিতে চেয়েছে — ‘আমার দুঃখের কাছে ত�োমাদের নত হতে হবে!’ নত
ত�ো হয়েইছি আমরা, নত হয়ে জানতে চাইছি, বকচ্ছপ আধুনিকতার
পীড়নে ক্লিষ্ট জন্ম-ইস্তক-পঙ্গু (‘পঙ্গু’ শব্দটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
দিয়েছেন) যে ‘ব্যক্তি’ আমাদের নায়ক, আমাদের সময়ের নায়ক,
‘জনতার মুখরিত সখ্য’ থেকে, জনতার মুখরিত সখ্যে থেকে কিছু কি
 63
আল�োকচিত্র : সন্দীপ কুমার

শেখার নেই তারও? দুঃসময়েই বা শিল্পীরা কেন শরণ নেবেন তবে,


সঙ্ঘের? এ ত�ো ভারী অন্যায়!

কিন্তু এসব অর্বাচীন তর্ক থাক। আমি ‘দুঃখের’ কথাটা আরও


একটু বলি।

এই মাঝারি মাপের, ও মানের আল�োচনায় প্রাসঙ্গিক অনেক
কবিতার কথাই উল্লেখও করবার সুয�োগ পাব না ভেবে খেদ হচ্ছে।
তবে এখন যে-কবিতাটির কথা বলব, সেইটে ওই পাগল-এর

 64
পাশাপাশি রেখে পড়লে সম্ভবত শঙ্খ ঘ�োষের কবিমানসের আর‌ও
পূর্ণ ক�োন�ো পরিচয়ে আমরা উপনীত হতে পারব। অবশ্য, এই
কবিতাটিই বাছার‌ আর‌ও একটা কারণ আছে। ক�ৌশিক রায়চ�ৌধুরী
ওঁর জলস্রোত কথা কয় আলেখ্য রচনায় এটি ব্যবহার করেছিলেন।
সে-রচনার একটা মঞ্চ-উপস্থাপনা দেখার স�ৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
আগে ওতেই শ�োনা, পরে পড়েছি। তাচ্ছিল্য, মকারি, ক্রোধ, বিযুক্তি,
নির্বাসন ও দলাপাকান�ো তপতপে ডিনায়াল (এর ক�োন�ো নিখুঁত
তরজমা পাইনি, তবে কাছাকাছি হয়ত�ো ‘প্রত্যাখ্যান’) এই কবিতায়
একেবারে মাখামাখি হয়ে আছে। কবিতার নাম কলকাতা, সঙ্ঘ
নয়, প্রতিষ্ঠান নয়, রাষ্ট্র নয়, আস্ত শহরটাকে, শহরের মানুষদের
ফালাফালা করে দেখছে একটা ক্রুদ্ধ, তির্যক, অপমানিত, আপরুটেড
গেজ, এবং উল্লেখ থাক: পূর্ববঙ্গীয় ডায়ালেক্টে আগাগ�োড়া লেখা শঙ্খ
ঘ�োষের আর ক�োন�ো কবিতা আমি পড়িনি।

কলকাতা

বাপজান হে
ক‌ইলকাত্তায় গিয়া দেখি সক্কলেই সব জানে
আমিই কিছু জানি না
আমারে কেউ পুছত না
ক‌ইলকাত্তার পথে ঘাটে অন্য সবাই দুষ্ট বটে
নিজে ত�ো কেউ দুষ্ট না
ক‌ইলকাত্তার লাশে
যার দিকে চাই তার‌ই মুখে আদ্যি কালের মজা পুকুর
শ্যাওলাপচা ভাসে
অ স�োনাব�ৌ আমিনা
আমারে তুই বাইন্দা রাখিস, জীবন ভ‌ইরা আমি ত�ো আর
ক‌ইলকাত্তায় যামু না।
‘জীবন ভ‌ইরা’ কথাটিতে আবহমান এক অভিবাসন, নাকি
নির্বাসন, কান্নার মত�ো ঘন হয়ে ওঠে আমার কণ্ঠে। আমার মত�োই
আর‌ও কেউ-কেউ নিশ্চয়‌ই নিজের রক্তের বিশ্লেষণ করে জেনেছে:
সেই নির্বাসন থেকে কলকাতাকে জীবনের স্পন্দনহীন, লাশের মত�ো
ঠান্ডা‌ই লাগে দেখেশুনে। শহর ছাড়ার পর, কলকাতায় লেখাপড়া
করতে এসে, এইসব রচনার মধ্যে দিয়ে শঙ্খ ঘ�োষের সঙ্গে একটা
 65
সহিতত্ব ঘটে যেতে থাকে আমার। তখনও জানি না, কবিতার মুহূর্ত
বইতে উল্লিখিত কবিতাটির জন্মবৃত্তান্ত নথিবদ্ধ করে রেখেছেন শঙ্খ
ঘ�োষ। টুকে রেখেছেন, এক বাস ড্রাইভারকে ভর্ৎসনায়, নির্দেশে,
পরামর্শে কীভাবে নীল করে দিয়েছিল একদিন কলকাতা শহরের
সমবেত যাত্রীদল —
এমনকী স্টিয়ারিংটা কীভাবে ঘ�োরাতে হবে তারও নির্দেশ দেয়
কেউ। হঠাৎ তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, তারাই ঠিক জানে,
সবটাই জানে, ক�োন্ পথে কীভাবে এলে কিছুমাত্র সময় নষ্ট না করেই
প�ৌঁছন�ো যেত গন্তব্যে, সেটা নির্ভুল ভাবে কেবল তাদেরই কাছে স্পষ্ট,
কেবল ড্রাইভারটিই জানে না কিছু। ‘এদিকটায় ঢ�োকালেন কেন? এখন
বের�োবেন কী করে?’ ‘পাশের ডানদিকের রাস্তাটা ধরলেই ত�ো ঠিক
হত!’ ‘কলকাতার পথঘাট কি চেনেন কিছু? খুব ত�ো গাড়ি চালাচ্ছেন’
‘ক�োথা থেকে যে জ�োটায় এদের!’ অবিরাম এইসব বাক্যবর্ষণ কানে নিয়ে
ড্রাইভার কী ভাবছে? আমি জানি না সে কী ভাবছে।
আমরাও জানি না, কী সে ভেবেছিল উচ্চারিত নাগরিক গঞ্জনার
ভিতর। কিন্তু দেখছি নজর করে, কবির প্রকাশ্য ব্যথাতুর প্রশ্নমালা
ছুঁয়ে থাকে অভিবাসনেরই নানা স্তর-তরঙ্গ,
প্রায়ই কি তাকে সইতে হয় এ-রকম, আমাদের এই কলকাতার
রাস্তায়? ক�োথায় দেশ তার? কলকাতায়, নাকি বাইরের ক�োন�ো গ্রামে?...
মনে পড়ে আমাদের পুব-বাংলার ছ�োট্ট শহরের কথা, মনে হতে থাকে
বড়�ো এই শহরের মধ্যে আজও আমি চিনতে পারিনি কিছু। অন্য সকলেই
কি সবকিছু জানে? ফিরে আসে আবার সেই ড্রাইভারের মুখ, সেই চ�োখ,
আর সেই সঙ্গে ঝাঁপ দিয়ে আসে অদ্ভুত কটা লাইন, যেন আমি বলছি
কাকে: ‘বাপজান হে/ কইলকাত্তায় গিয়া দেখি সক্কলেই সব জানে/ আমিই
কিছু জানি না।’ বাপজান কেন হঠাৎ? অল্প একটু হাসি এসে প�ৌঁছয়
ঠ�োঁটের ক�োণে।
যদিও এ-আবিষ্কার কবিতাটি পড়বার আরও কিছুদিন পরেকার।
কিন্তু ইতিমধ্যে, আপাত-নীরবতার আবডাল ছিঁড়ে ব্যথিত, ক্রুদ্ধ,
তির্যক, অভিমানী, এবং আবারও বলতে চাই: আপরুটেড শঙ্খ ঘ�োষ
আমার অনেকখানি কাছাকাছি চলে আসেন। আমি প্রথমবার দীর্ঘ
সময় পড়ে থাকি ওঁর কবিতা চ�োখে নিয়ে, পড়ে থাকি রাতের পরে
রাত, বন্ধুদের জানাই আমার ‘সাম্প্রতিক’ শঙ্খপ্রেমের কথা। সে-
শঙ্খপ্রেম, হয়ত�ো অহংকার হবে বলা, আমার‌ই চারপাশের আর‌ও
অনেকের মত�ো নয়। ক�োন�ো অতিকথা হয়ে শঙ্খ ঘ�োষের উপস্থিতি
 66
যে আমায় আচ্ছন্ন করেনি ওঁকে পড়বার আগে, তাতে ওঁর কবিতার
সম্মুখীন হতে সুবিধেই হয়েছে আমার। কথাটা আলাদা করে বলতে
চাইছি, কারণ ‘বাংলার বিবেক’, অথবা ‘বাংলার জাগ্রত বিবেক’ —
এসব আশ্চর্য উপাধিতেই বিভিন্ন শিবিরের ক�োন�ো ক�োন�ো খবরের
কাগজ এখন ভূষিত করতে চাইছেন তাঁকে। করতে চাইছেন কাছে
ও দূরের আর‌ও অনেক মানুষ। সহজ কথা নয়, একেবারে ‘জাগ্রত
বিবেক’, অর্থাৎ কিনা, আস্ত একটা জনসমষ্টির সমস্ত প্রকাশের ভুল-
ঠিক, পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায় বিচার করে নেওয়া যাবে শঙ্খ ঘ�োষের‌ই
খাপে-মাপে। কিন্তু এরকম ক�োন�ো প্রশ্নোর্ধ্ব, নিষ্কম্প, নিখুঁত, স্বরাট,
স্থিত, পূর্ণ অস্তিত্ব হয়ে শঙ্খ ঘ�োষ যদি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান,
দাঁড়াতে থাকেন বারেবারে, তাহলে তাঁর অনেক কবিতার নিহিত
অস্থিরতার, অ্যাজিটেশনের সঙ্গে আর ততখানি সহজ করে মিলতে
পারি না আমরা। সম্ভ্রমের, ভীরুতার একটা কণ্টকিত দূরত্ব ক্রমাগত
দূরে ঠেলে দিতে থাকে পাঠককে। কবিতাকে মনে হয় মন্ত্রের মতন।
তর্ক না-করে, আলাপে না-গিয়ে, কেবল ‘নীতিবাক্য’টুকু নিষ্কাশন
করে নিতে ইচ্ছে হয় তার শরীর ছেনে। কবির বদলে সদাবৃদ্ধ,
স্থিতপ্রজ্ঞ, ধ্যানস্থ, অবিচল এক ন্যায়দণ্ড শেষে পড়ে থাকে হাতে,
আর তার অন্তরালে ক্রমাগত আশিরনখ হারিয়ে যেতে থাকেন সেই
শঙ্খ, সেই কলহপর মাতাল যুবা — যার সঙ্গে মতান্তরের সকল পথ
রূদ্ধ হয়ে যায়নি। সেই শঙ্খ ঘ�োষ আমাদের চ�োখের সামনে বনে
যান প্রতিষ্ঠান, এতদূর প্রতিষ্ঠান যে তেমন-তেমন ‘অনগ্রসর’দের
চ�োখ রাঙিয়ে বলতে পারে বাচাল ছন্দজীবীর দল: ‘শঙ্খ ঘ�োষের
নাম শ�োনেনি, এমন কেউ/ ত�োমায় যদি প্রোপ�োজ করে কী করবে?’
উদ্ধৃতিটা ঠিক হল কিনা জানি না, ভুল হলেও কিছু যায় আসে না।
শঙ্খ ঘ�োষের দিকে আমার যাত্রা, এই সব নষ্টামি, অশালীন অক্ষরস্তূপ
ভেদ করে পথ কেটে নিতে পারবার ব্যক্তিগত সংগ্রামের খতিয়ান‌ও
বটে, শুনতে যত‌ই খারাপ লাগুক — এও, খাঁটি সত্যি কথা।


কিন্তু এত কথার ভিড়ে সেই সুপুরিবনের সারি-র কথাটা আর
বলা হল না। সুপুরিবনের সারি যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন: এ
আসলে শঙ্খ ঘ�োষের‌ই দেশ-ঘর ছেড়ে আসার গল্প, তাঁর‌ই বাল্যুস্মৃতির
খতিয়ান। আর সেই গল্পের ন্যারেশনের পরতে পরতে লতিয়ে থাকে
 67
চলে-আসা কবির, থেকে-যাওয়া পরিজনদের জন্য হাহাকার,
অপরাধব�োধ, শুধু পরিজন নয়, দৃষ্টিপথ থেকে অপস্রিয়মান মাটি,
জল, গাছ, মন্দির, পথ, ভাঙা ন�ৌকা — স্থান, যে স্থান আসলে গড়ে
ওঠে সাহচর্যে, সম্পর্কে, সেই স্থানের জন্যে এক বালকের আকুতি
— কেন চলে যেতে হয়, তার ক�োন�ো সন্তোষজনক উত্তর জানার
আগেই যে চলে যাওয়া কাকে বলে টের পায় সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে। পূর্ব
পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে আসে নীলুদের গ�োটা পরিবার প্রায়,
নীলুর দাদু আসেন না। নীলু চলে আসে চিরদিনের মত�ো, দাদুকে
ছেড়ে, হারুন, তার মুসলমান বাল্যবন্ধুটি, তাকে গাঁয়েই ফেলে রেখে
কলকাতায় চলে আসে সে। এতক্ষণ ধরে বলে চলেছি হাহাকার,
অপরাধব�োধ, আকুতি, অথচ কে-না-জানে, শব্দ ত�ো সাশ্রুকুমির,
সে কেবল পিছলে যায়, তাই সুপুরিবনের সারি-র অবিস্মরণীয় সেই
শেষ দুটি পরিচ্ছেদের ভাবটুকু কিছুতেই আমি ধরতে পারছি না,
ফলে আবার‌ও শঙ্খ-শরণ নিতেই হচ্ছে আমায় —
এইবার বাঁ দিকে বাঁক নিতে হবে, খাল ছেড়ে এবার নদীতে পড়বে
ন�ৌক�ো। বাঁক নেবার মুখে, হাটখ�োলার ক�োণে, উলটে-রাখা প্রকাণ্ড এক
মাটির জালার ওপর বসে বসে সবুজ একটা রুমাল ওড়াচ্ছে, কে? কে
ওটা? চমকে উঠে নীলু দেখে, হারুন! ওই ত�ো ওইখানে এসে বসে আছে
হারুন। চিৎকার করে বলে ওঠে হারুন: ‘এই-যে আমি, নীলাই। এই-যে
রে! আসিস কিন্তু আবার, সামনের বার। আসবি ত�ো? কী রে, আসবি
ত�ো? আসিস আবার। আসবি?’
জালার থেকে নেমে নদীর পাড়ি ধরে হাঁটতে থাকে হারুন। আর
মাঝে মাঝে বলে: ‘কী রে, কথা কইস না ক্যান্, আসবি ত�ো?’
উত্তর দেয় না নীলু। যাত্রা করবার সময়ে জলের ছায়ায় নিজের
মুখ দেখেও বলেনি ত�ো সে কিছু। উত্তর দেয় না, কিন্তু চলন্ত ন�ৌক�োর
ছই থেকে নিমেষহারা তাকিয়ে থাকে হারুনের চ�োখে চ�োখে। আস্তে
আস্তে অস্পষ্ট হয়ে আসে সেই চ�োখ, অস্পষ্ট হয়ে যায় হারুন, অস্পষ্ট
হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে পিছনে-পড়ে-থাকা তাদের গ�োটা গ্রামখানা।
বড�়োমামা বলে: ‘ওই দেখ্ শুরু হল�ো বড�়ো সুপুরিবনটা। জানিস ত�ো,
ওই পর্যন্তই হল�ো আমাদের গ্রামের সীমা। ব্যস্, তারপর, শেষ —’
শেষ? হ্যাঁ, শেষ। প্রণাম ত�োমায়, শেষ। প্রণাম ত�োমায়, এই
দ্বাদশীর বিকেল। প্রণাম, ওই খালের মুখে নদীর জলের ঢেউ। প্রণাম
ত�োমায় তুলসীতলা, মঠ। প্রণাম ফুলমামি। প্রণাম, তবে প্রণাম ত�োমায়
সুপুরিবনের সারি।
মনে মনে বলতে চায় নীলু: হারুন, আসব আবার। কিন্তু বলতে পারে
না কিছু। আবার একবার ডান দিকে বাঁক নিয়ে ন�ৌক�ো শুধু চলতে থাকে
মচর মচর, ঢিমে তালে, একটানা পশ্চিমের দিকে।

 68
এই উপন্যাস আমি পড়েছিলাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা
বিভাগের ফাঁকা ক্লাসঘরে বসে। তারপর ক্লাস শুরু হল আমাদের।
‘থাকা’, ‘থেকে যাওয়া’ কাকে বলে, ব�োঝাতে গিয়ে একদিন
বললেন মাস্টারমশায়, ‘বিশ্বায়ন�োত্তর পৃথিবীতে এক অর্থে আমরা
সকলেই রিফিউজি’। আর ঐ বাক্য মরমে পশিবার পর, স্বভূমি
থেকে উৎপাটিত, সংকুচিত, অপরাধী, বিষণ্ণ এক বালকের শেষ
প্রণতি মাটিকে, আর কেবল শঙ্খ ঘ�োষের স্মৃতিকথা হয়ে র‌ইল না
আমার কাছে, ঐ ক্লাসঘরে, ঐ মুহূর্ত থেকে তা ফেন�োমেন�োলজিতে
অঙ্গীকৃত হয়ে গেল।

আমি আবিষ্কার করলাম কবিতায় দেখা উদ্ধত, ক্রুদ্ধ, ব্যথিত,


অশান্ত ও অভিমানী সেই যুবকের‌ই ছেলেবেলা। দেখলাম পাঁজরের
নিচে তার মানচিত্র ছেঁড়া, তাই বিরামহীন রক্তক্ষরণের অনুভূতিমালা
সাজান�ো অজস্র কবিতায়। ‘আমরা সবাই রিফিউজি’ — ক্লাসঘরে
শ�োনা এই কথাটিই আজ‌ও গুঞ্জরিত হয় বারেবারে, আমার নাছ�োড়
অ্যান্টেনায়। কলকাতা সম্পর্কে বারবার তাঁর মন্তব্য, কখন�ো ভিখারি,
কখন�ো-বা বেশ্যার ভ�োকাবুলারি থেকে রাজধানীর সভ্যতার দিকে
ছুঁড়ে দেওয়া অন্তর্ঘাত — ‘খেতে ত�ো হবেই বাবা!’, অথবা জাবাল
সত্যকাম কবিতার সেই নির্জন রাখালের কথা, ‘ওরা হাসাহাসি
করে, মুখে থুতু দেয়, ঢিল ছুঁড়ে মারে’ — হিংসার এই কান্নাচাপা
শীতল বিবরণের মধ্যের আমাকে আশিরনখ দ�োলাতে থাকে একটাই
শব্দ, একটাই সত্য: উদ্বাস্তু। আর এই ঘটমান অভিবাসনকে (হেঁয়ালি
করে কবি লেখেন ‘প্রতিদিনের পুনর্বাসন’) ক�োন�ো মেদুর কল্পনার
আলেখ্যে বাঁধেন না কবি, বরং জুড়ে দেন ক্রমপ্রসারণশীল কল�োনির
রাজনৈতিক প্রতির�োধের সঙ্গে, ভাবে ও আঙ্গিকে। বিপ্লবভাবাপন্ন
‘মিত্র বাবুমশাই’কে ঠাট্টা করবার জন্য, মক্ করবার জন্য তাঁর
কল্পনায় বেজে ওঠে ‘সাহেব’ শব্দটি দ্বিত্বের ঝংকারে। শুধু তাই নয়,
সেই যে যমুনাবতী কবিতার কথায় আমরা আলাপ শুরু করেছিলাম,
সে-কবিতার ‘হায় ত�োকে ভাত দিই কী করে যে ভাত দিই হায়/
হায় ত�োকে ভাত দেব কী দিয়ে যে ভাত দেব হায়’ — হাহুতাশে
আমি খুঁজে পাই গ্রাম্য ক�োন�ো প্রৌঢ়ার পুনরাবৃত্ত, নিষ্ফল কান্নার সুর
ফিরে পড়তে গিয়ে। দেখি, কবিতার মুহূর্ত-য় সাধারণ ভাবে ভাতের
দাবিতে ‘কখন�ো-কখন�ো শহরে এসে দাঁড়ায়’ যে-আপাত-অদৃশ্য
 69
মানুষেরা, তাঁদের কথা বলেন শঙ্খ ঘ�োষ। শুধু কি ভাতের দাবিতে
‘শহরে এসে দাঁড়ায়’ মানুষ? সে মিছিল তবু ত�ো দেখা যায় চ�োখে!
কিন্তু সেটুকুই ত�ো আর সব নয়।
যাদবপুরে যারা পড়তে আসে, তাদের মধ্যে কিছু কিছু থাকে গ্রাম
থেকে সদ্য উঠে আসা যুবক, এই প্রথম তারা ক�োন�ো জাঁকজমকের
শহরকেন্দ্রে এসে প�ৌঁছল। একটা ভীরু কাঁপুনি তাদের সমস্ত চ�োখেমুখে
লেগে থাকে তখন, নিজেকে সন্তর্পণ দূরত্বে প্রচ্ছন্ন রাখবার আয়�োজনে
বিব্রত থাকে তারা। তারপর কেউ কেউ মানিয়ে নেয়, পরিণত স্বাভাবিক
হয়ে ওঠে। কেউ-বা পারে না তা, বরং নতুন এই আধ�োজানা সংস্কৃতির
সংঘর্ষে একেবারে উদভ্রান্ত হয়ে পড়ে, উন্মাদ হবার ঘটনাও ঘটে যায়
কখন�ো-কখন�ো।
এদের মুখের দিকে তাকালেই মনে পড়ে নিজের অল্প বয়সের কথা।
মনে পড়ে সে-আমলের প্রেসিডেন্সি কলেজে পরম অভিজাত পরিবেশের
মধ্যে কতদূর অসহায় পরিত্যক্ত লেগেছিল নিজেকে, পদ্মাপারের ছ�োট
রেলকল�োনি থেকে প�ৌঁছন�ো এই এক অর্বাচীন আমি। আবরণে আচরণে
উচ্চারণে যে দূরত্বের বিচ্ছেদ তৈরি হয়েছিল সেদিন, ভিতরে ভিতরে
সেই ভীরুতা আজও কাটিয়ে উঠতে পেরেছি বলে মনে হয় না। এদের
মুখচ্ছবিতে তাই নিজেরই আদল দেখতে পাই।
শান্তিনিকেতনে এমনই এক কিশ�োরের আত্মহননের খবরে
একদিন দুলে ওঠে কবির পৃথিবী, কত দশকের ওপার থেকে পুবের
সেই রেলকল�োনি জ্যান্ত হয়ে ওঠে আবার আত্মঘাত কবিতায়।
আত্মঘাত

এখানে আমাকে তুমি কীসের দীক্ষায় রেখে গেছ?


এ ক�োন্ জগৎ আজ গড়ে দিতে চাও চারদিকে?
এ ত�ো আমাদের ক�োন�ো য�োগ্য ভূমি নয়, এর গায়ে
স�োনার ঝলক দেখে আমাদের চ�োখ যাবে পুড়ে।
বুঝি না কখন�ো ঠিক এরা ক�োন্ নিজের ভাষায়
কথা কয়, গান গায়, কী ভাষায় হেসে ওঠে এরা
পিষে ধরে আমাদের গ্রামীণ নিশ্বাস, সজলতা,
কী ভাষায় আমাদের একান্ত বাঁচাও হল�ো পাপ।
আমার ভাইয়ের মুখ মনে পড়ে। গ্রামের অশথ
মনে পড়ে। তাকে আর এন�ো না কখন�ো এইখানে।
এইখানে এলে তার হৃদয় পাণ্ডুর হয়ে যাবে
এইখানে এলে তার বিশ্বাস বধির হয়ে যাবে
বুকের ভিতরে শুধু ক্ষত দেবে রাত্রির খ�োয়াই।

 70
আমার পৃথিবী নয় এইসব ছাতিম শিরীষ
সব ফেলে যাব বলে প্রস্তুত হয়েছি, শুধু জেন�ো
আমার বিশ্বাস আজও কিছু বেঁচে আছে, তাই হব
পঁচিশে বৈশাখ কিংবা বাইশে শ্রাবণে আত্মঘাতী।

কল্লোলিনী তিল�োত্তমার ‘আনুপূর্ব — অতিবৈতনিক’রা কি পড়েন


এসব? নিশ্চয়ই পড়েন। কিন্তু ব�োঝেন আদ�ৌ, ‘ভাষা’ ও ‘উচ্চারণ’
কেন এলিয়েনেশন (দরদী তার্কিক সলিমুল্লাহ খান দেখিয়েছেন
এর সঠিক তরজমা হতে পারে ‘বি দেশী করণ’)-এর দুটি অন্যতম
জড়ুলচিহ্ন হয়ে ওঠে দেশভিখারি শঙ্খর প্রতিবাদ-প্রকল্পে? ব�োঝেন
কি, প্রতিষ্ঠান অফিস-কাছারি-বিশ্ববিদ্যালয়ের থাম্বাগুল�ো নয় শুধু,
প্রতিষ্ঠান থাকে ব্যাখ্যার ভাষায়, মন্তব্যের ক্ষমতায় সেঁধিয়ে? যদি
থাকে, তবে এই ভাষার সঙ্গেও নিশ্চিত সংঘর্ষ হয়েছে শঙ্খ ঘ�োষের
কাব্যভাষার। আরও য�োগ্য ক�োন�ো আল�োচক করবেন সে সংঘর্ষের
বিশ্লেষণ।


এখন পর্যন্ত এই আমার শঙ্খ-পাঠ। সুতরাং, শেষ কবিতা। উদ্যত
কুঠারের বিরুদ্ধে আঁকড়ে থাকা শিকড়ের প্রত্য য় এইভাবে কখন�ো-
কখন�ো স্থানের শূন্যতাকে মনে হয় ভরিয়ে দিতে পারে, আজ যখন
খাতায়-কলমে আর কিছুদিন পরেই আমরা‌ও উদ্বাস্তু হয়ে যাব কিনা
সে-কথা ভাববার সময় এসেছে স্বচ্ছ ভারতবর্ষে, তখন পড়তেই হবে
এ-কবিতা আরেকবার —
ত্রিতাল

ত�োমার ক�োন�ো ধর্ম নেই, শুধু


শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া
ত�োমার ক�োন�ো ধর্ম নেই, শুধু
বুকে কুঠার স‌ইতে পারা ছাড়া
পাতালমুখ হঠাৎ খুলে গেলে
দুধারে হাত ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া
ত�োমার ক�োন�ো ধর্ম নেই, এই
শূন্য তাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া।

শ্মশান থেকে শ্মশানে দেয় ছুঁড়ে

 71
ত�োমার‌ই ওই টুকর�ো-করা-শরীর
দুঃসময়ে তখন তুমি জান�ো
হলকা নয়, জীবন ব�োনে জরি।
ত�োমার ক�োন�ো ধর্ম নেই তখন
প্রহরজ�োড়া ত্রিতাল শুধু গাঁথা —
মদ খেয়ে ত�ো মাতাল হত সবাই
কবিই শুধু নিজের জ�োরে মাতাল!

 72
ঘরবন্দি মুখগুল�ো
স�ৌরভ হ�োসেন

‘‘এ র চেয়ে জেলে থাকা ঠের ভাল�ো ছিল।


দেশে ইংরেজ থাকলেওও হত। একটা
সাদা সাহেব মেরে জেলে যেতাম। তাও
ত�ো ল�োকে বলত সুরাবুদ্দি ল�োকটা স্বদেশি
ছিল। দেশের লেগে বিপ্লব করতে গিয়ে জেল খেটেছিল।’’
‘‘অ্যাঁঃ হনু বীর ঘরে বসে মারে তীর ! তুমি যে কত্ত পালহুয়ান
তা আমার হাড়ে হাড়ে জানা আছে। একটা মশা টিপে মারতে পারে
না সে আবার সাহেব মারবে!’’ ঠেস মেরে ওঠেন জৈনব। ফর্সা
মুখটা ভেংচে দাঁত খিটমিট করেন। ভেঙে পড়া ক�োমরে আঁচলটা
গুঁজে বিড়বিড় করেন, ‘‘জেলের ঘানি টানা যে কী জিনিস তা ত�ো
ব�োঝেনি। সে ঠাপ বুঝলে বুঝত, বিপ্লব করা কা‍‌কে বলে। সারা
জীবন মুখে কত বিপ্লবের কথা শুনলাম। সেসব ক�োথায় ক�োন নদীর
জলে ভেসে চলে গেল!’’ জৈনবের এই এক দ�োষ, মানুষটার কিছু
একটা ত্রুটি পেলেই হল, আর রেহাই নেই। একেবারে হাড়-মাংস
ছিঁড়ে খাবেন। ইদানিং আরও খিটখিটে হয়ে উঠছেন। কথায় কথায়
তক্ক করেন। সুরাবুদ্দিও ছেড়ে দেওয়ার ল�োক নন। বলেন, ‘অত
 73
বিরক্ত হয়ে উঠছ ত�ো ত�োমরা মা বেটা মিলে আমাকে ঘরের ভেতর
বেঁধে রেখেছ কেন? ছেড়ে দিলেই পার�ো। জানে সবুর পেতা।’ আর
যান ক�োথায়। পারলে লেকটাকে গিলে খান জৈনব। গলা ঝেঁঝিয়ে
ওঠেন, ‘কেন, ত�োমার কি কবরে যাওয়ার খুউব সখ হয়েছে? বাইরে
গেলে যে আর জ্যান্ত বাড়ি ঢুকবে না, তা ভাল�োই জান�ো। সে তাল
জ্ঞান ত�োমার ঠিকই আছে। তুমি অত বেতাল হওনি এখনও। নিজে
ত�ো মরবেই এখন গুষ্টিসুদ্ধ নিয়ে মরবার ফন্দি আঁটছ?’
শরীর আর নিতে পারছে না। চারপাশের দেওয়াল যেন হাঁ করে
গিলে খেতে আসছে। আমি ত�ো আর ইট পাথরের দেওয়াল নয়?
আমি রক্ত-মাংসের মানুষ। এভাবে ঘরের মধ্যে আর কতদিন বন্দি
থাকা যায়? এভাবে আর কটাদিন চললে শ্বাস এমনিই বন্ধ হয়ে
আসবে। ভাইরাসকে আর গলায় ঢুকে ফুসফুস হার্টটাকে খেতে হবে
না। সে খক করার আগেই ডকে উঠে যাব। জানালার ধারে মুখ
রেখে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বললেন সুরাবুদ্দি। আজ একানব্বই
দিন হতে চলল। বাইরের জগতটা একবারের জন্যেও দেখেননি।
মন তার উসখুস করছে। পারলে জানালার রড ভেঙে উড়ে যান।
গঙ্গার ধারের ঠেকটাই সব চেয়ে বেশি তার ভেতরটাকে কাটছে।
এই ঠেকটাই যে তার বুকের অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকে। হদ্দিন
বিকেলে সেখানে আড্ডা ঠুকতে যাওয়া চাইই চাই। একদিন না
গেলেই ভেতরটা কেমন হা হা করে। সে ঠেকটাই আজ তিনমাস
পা পড়েনি! ভাবলেই শিশুরমেত�ো ডুকরে উঠছেন সুরাবুদ্দি।
‘একদিন আমাকে না হয় তুইই নিয়ে চল।’ ছেলে নুরুলকে অনুর�োধ
করেছিলেন সুরাবুদ্দি। নিয়ে যাওয়া ত�ো দূরের কথা উল্টে ধমকে ছিল
নুরুল। চ�োখ গরম করে বলেছিল, ‘ত�োমার ক�োনও কিছুর প্রয়�োজন
হলে আমাকে বল�ো না, আমিই এনে দিচ্ছি। ত�োমার যাওয়ার কী
দরকার?’ সুরাবুদ্দি ছেলের মুখের ওপর বলেছিলেন, ‘মানুষের
মুখগুল�ো এনে দে। পারবি?’ ‘ত�োমার সব সময় ফুটেনি ফুটেনি
কথা।’ বলে বাপের কাছ থেকে চলে এসেছিল নুরুল। নুরুল জানে,
গঙ্গার ঠেকের ওই বুড়�োগুল�োর জন্যে তার বুড়�ো বাপটার মন পড়ে
থাকে। বাপটাকে এত বলেও ব�োঝান�ো যায় না যে ওই ঠেকে এখন
আর কেউ যান না। সবাই ত�োমার মত�ো ঘরে বন্দি। তাও ত�ো নুরুল
বাপের ম�োবাইলে অল কল ফ্রি রিচার্জ করে দিয়েছে। বলেছে, যত
পার�ো ম�োবাই‍‌লে কথা বল�ো, গল্প কর�ো, আড্ডা মার�ো। কিন্তু নাহ,
 74
বললেই বলে, সামনে থেকে কথা না বললে কি মনের সাধ মিটে?
নুরুল বাপের মুখের ওপর বলে দিয়েছিল, ‘গল্পের ঠেক না পরের
গিল্লা করার ঠেক? পরের গিল্লা না করতে পারলে বুঝি ত�োমার ঘুম
আসে না?’ নুরুল গঙ্গার ধারের ওই দিকটা দিয়ে যাওয়ার সময় বেশ
কয়েকবার ঠেকটার আড্ডায় কান দিয়েছিল। যা শুনেছিল নুরুলের
তখনই মনে হয়েছিল বুড়�ো বাপটাকে হিড়হিড় করে টেনে হিঁচড়ে
বাড়িতে ঢ�োকায়। বুড়�োগুল�ো পরনিন্দা পরচর্চায় একেবারে মশগুল।
হালের রাজনীতিকে ছ্যা ছ্যা করে তুচ্ছাই করেন। হালফিলের
নেতামন্ত্রীদের গালমন্দ করেন। ব্যাঙ্গ তামাশা করেন। তারপর হ�ো
হ�ো করে ফ�োকলা হাসি হাসেন। এখানেই নুরুলের ভয়। বাপটা যা
করছেন তাতে হালফিলের শাসকদলের ক�োন নেতা না কলার ধরে
বলে ‘ত�োর বাপ খুব বাড় বেড়েছে গদ্দনটা কেটে গঙ্গায় ভাসিয়ে
দেব?’ শুধু কি রাজনীতি? রাস্তা দিয়ে হালফিলের টপ মিনিস্কাট পরে
যেসব উচ্ছ্বল মেয়েরা যায় তাদের শরীর নিয়েও বুড়�োগুল�ো মশকরা
করেন। নুরুল ভাবে, বুড়�োগুল�ো বয়সে বুড়�ো হলেও মনে চাঙ্গা
আছেন। নুরুল একবার কঠিন সিদ্ধান্তটা প্রায় নিয়েই ফেলেছিল,
বাপটাকে ওই ধেড়ে খ�োকাদের আড্ডায় আর যেতে দেবে না। কিন্তু
আটকে রাখতে পারেনি। মা জৈনব বলেছিলেন, ‘যা করছে করতে
দে। কটাদিন আর বাঁচবে। এট্‌টুআট্‌টু হাসি ঠাট্টা করছে ত�ো করুক
না। এই তিনপেয়ে বয়সে ওসবই ত�ো মনের খ�োরাক। জ�োর করে
আটকে রাখলে তখন মাথার অসুখটা উস্কাতে পারে!’ তিনি আরও
বলেছিলেন, ‘ভাত রুটিই কি শুধু মানুষের খ�োরাক? হাসি-ঠাট্টা
ম�োজ-মস্তিও জীবন চালাতে লাগে রে। শরীরের খ�োরাকেই ত�ো আর
জীবন চলে না, তার জন্যে মনের খ�োরাকও লাগে।’ ‘কেন, মসজিদে
যাবে? নামাজ পড়বে। আল্লাহর দ�োআ কালমা পড়বে। শেষ জীবনে
ত�ো এট্‌টুআট্‌টু ধর্মকর্ম করবে?’ বলেছিল নুরুল, জৈনব তা শুনে
চ�োখ কপালে তুলে বলেছিলেন, ‘বাবা তাহলেই হয়েছে! ত�োর বাপ
নামাজ পড়বে! র�োজা রাখবে! তাহলে দুনিয়া কাল থেকে উল্টো
দিকে ঘুরবে!’ মায়ের কথায় রেখেছিল নুরুল। বুড়�ো বাপটাকে আর
ঘরে আটকে রাখেনি। কিন্তু যখন থেকে শুনল ভাইরাসটা বয়স্ক
মানুষদের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রিক্স তখন থেকে আর ক�োনও ঝুঁকি
নেয়নি নুরুল। তার ওপরে আবার বুড়�ো বাপটার শরীরে হাজার
অসুখের কামড়। এই সুগার কমল ত�ো প্রেশার বাড়ল। প্রেশারও
 75
যা বা ওষুধে কন্ট্রোল করা গেল ত�ো পায়ে বাতের ব্যামু উস্কাল�ো।
এ হাজার খিটকেলের ব্যাপারে। অসুখ যেন বুড়�ো হাড় পেলে পাত
পেড়ে বসে। ক�োনভাবেই শরীর ছেড়ে যেতে চায় না।
‘‘এসব দে‍‌শের সরকারের ফন্দি। গরিবমানুষকে ফ্যারে ফেলা।
যেনতেন প্রকারে পুজঁ িপতিদের সুবিধা কর এ দ্যাওয়া। মানুষকে
ঘরে বন্দি করে রেখে কদ্দিন দেশ চালাবে? তার আগে ত�ো মানুষকে
খাবার দিতে হবে? দেশের যা হাল তাতে করে ত�ো গরিব মানুষগুল�ো
এমনিতেই না খেয়ে মরে যাবে। এক্ষুনিই ত�ো দেখছি, কেউ রেশন
পাচ্ছে কেউ পাচ্ছে না।’’ গায়ে সাদা রঙের স্যান্ডো গেঞ্জিটা গলাতে
গলাতে বললেন সুরাবুদ্দি। কাঁধ আর পাঁজরের হাড়গুল�ো হেঁশেল
ঘরের বাঁশের বাতার মতন চিড়চিড় করছে। হাড়গুল�ো মাংস খেয়ে হাঁ
করে আছে। বয়স এভাবেই শরীরের মাংস ঝরান�োর কুড়ুল হয়ে ওঠে।
অথচ সুরাবুদ্দির এই প�ৌনে ছ-ফুট কাল�ো শরীরে একসময় বলদের
মত�ো বল ছিল। অন্ধকার দিয়ে হেঁটে যেতেন ত�ো ল�োকে ভাবতেন ক�োন
মহিষ আসছেন বুঝি! সাতাত্তরের ঝঞ্ঝাটের সময় বর্গাচাষি সুরাবুদ্দি
এই তাগড়া শরীর নিয়েই যখন কংগ্রেসিদের সামনে রুখে দাঁডাতেন,
তখন কংগ্রেসিরা বাপ বাপ করে পালাত। বলত, শাল�ো সুরাবুদ্দি এক
মানুষে তিন মানুষকে খাবে! গ�োসুল করে কেবলই বাথরুম থেকে
বের�োলেন। এবার আয়নার সামনে চিরুনি হাতে দাঁড়াবেন। সামনের
দিকের টাক পড়া মাথার উসক�োখুসক�ো পাকা চুলগুল�োকে চেপ্টে
আঁচড়াবেন। কানের পাশের কিছু লম্বা চুল টেনে টাকটার ওপরে ঢেকে
দেবেন। সুরাবুদ্দির এসব দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আগে ত�ো জৈনবকে
ডেকে বলতেন, ‘দ্যাখ�ো ত�ো টাকটা ঠিকঠাক ঢাকা পরল কি না।’
জৈনব তখন ফুট কেটে বলতেন, ‘টাক ত�ো খুব সামলাতে পাইচ্ছ
টাকাগুলেন ত�ো সামলাতে পারলে না।’ সুরাবুদ্দি জানেন, জৈনব
ক�োন কিছুর একটা ছুত�ো পেলেই ওই প্রধানির টাকাগুল�োর খ�োটা
দেন। সুরাবুদ্দি দু-দুবারের পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন। শাসকদলের
প্রধান। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। কিন্তু সৎ রাজনীতিক সুরাবুদ্দি ক�োন দিনও
দলের লাইনের বাইরে যাননি। নিজের জন্যে এক কানাকড়িও পকেটে
ঢ�োকাননি। বললে বলতেন, গরিবের টাকা মেরে খেলে পেটে বদহজম
হবে। নুরুল খবরের কাগজটায় চ�োখ পুতে ঁ ছিল। বাপের কথাটা কানে
বাজতেই গলা চড়িয়ে বলল, ‘‘ত�োমার মাথা থেকে দেখছি এখনও ওই
বামদলের ভুতটা যায়নি!’’
 76
‘‘ত�োরা ত�ো আজকাল সবকিছুতেই বাম ভুত দেখিস। দেখিস,
বাম ছাড়া এ দেশের গতি নেই। একদিন আবার বামেরাই ক্ষমতায়
আসবে।’’ একটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন সুরাবুদ্দি। নুরুল বলল,
‘‘তদ্দিন তুমি ত�ো মরে ভুত হবাই আমরাও মরে ভুষি হয়ে যাব।’’
নুরুল ঠ�োঁট কাটা। মুখে যা আসে তাই বলে দেয়। বাম-মা মানে
না। আসলে নুরুল মন থেকে ওই লাল পার্টিটাকে ঘৃণা করে।
একদম চ�োখের ক�োণায় সহ্য করতে পারে না। পুর�ো বাপের উল্টো।
অন্য পার্টিকেও যে দুধ কলা দিয়ে ভাল�োবাসে তা নয়। আসলে
নুরুল হালফিলের রাজনীতিকেই ঘৃণা করে। তার হক কথা, দেশের
উন্নয়নের জন্যে নয় আজকাল সবাই নিজের পকেটের উন্নয়নের
জন্যে রাজনীতি করে। তাতে দেশ থাকল না মরল তাদের খেয়াল
নেই। তাতে দেশের লঙ্গি উঠে দেশ ন্যাংট�ো হয়ে যাক ক�োনও ক্ষতি
নেই। দেশ ফ�োকলা খ�োকলা হয়ে যাক ক�োনও দুঃখ নেই।
সুরাবুদ্দি লেখাপড়া জানা ল�োক নন। ক�োনরকমে কলম ভেঙে
নাম সহিটা করতে পারেন। তবে গেরামের ম�োড়ল ছিলেন। তার
কপালে স্কুল কলেজের লেখাপড়া না জুটলেও তার মাথায় মগজে
নাকি লেখাপড়া জানা ল�োকের বুদ্ধি আছে। বুদ্ধির মারপ্যাঁচ আছে।
ল�োকে তাইই বলে। সে নিয়ে আবার তার গর্বের শেষ নেই। বেটা
নুরুলকে বুক উঁচিয়ে বলেন, ‘ত�োর মতন যদি আমিও ইস্কুল কলেজে
পড়তাম আমিও ফাস্ট ডিভিশন নিয়ে আইএ বিএ পাশ করতাম।
তারপর সিভিলের পরীক্ষা দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হতাম।’ ‘বামুন হয়ে
আকাশের চাঁদ ছ�োঁয়ার আস্পদ্দা’ বাপকে ঠেস মারত নুরুল। নুরুল
হাইস্কুলের ভুগ�োলের শিক্ষক। সে এমনিতেই সবকিছুকে গ�োল
দেখলেও বাপটাকে সবসময় তিন ক�োণা চার ক�োণাই দেখে। বিড়বিড়
করে বলে, বুড়�োর গিঁটে গিঁটে চালাকি বুদ্ধি। এসব ওই লাল পার্টির
অবদান। নুরুল উঠতে বসতে লাল পার্টিকে গালি গালাজ করে।
যেখানে সেখানে গিল্লা করে। আর সেসব শুনে বাপ সুরাবুদ্দিও
বেটাকে ফুট কাটেন, ‘লাল পার্টিটা ছিল বলে ন্যায্য পথে চাকরিটা
পেয়েছিলি। এক কানাকড়িও খচ্চা করতে হয়নি। এখন হলে,
ভিটেমাটি বেচেটেচেও একটা ক্যারানিগিরি জুটত না।’ বাপের এই
খ�োঁচা মারা কথাটা নুরুলকে একরকম বাধ্য হয়েই হজম করতে হয়।
বাপের এই কথাটায় কিন্তু ক�োন মিথ্যে নেই। আজকাল সরকারি
চাকরির যা হাল, ভাবলে তার গা শিহরণ দিয়ে ওঠে।
 77
ছাদে আর কথ পায়চারি করা যায়! হেঁটে হেঁটে শেষে ছাদটাই
না ধসে পড়ে! জৈনব তাকে ‘ঘরের ভেতরে কুঁচে মুরগির মত�ো না
বসে থেকে ছাদে গিয়ে হাঁট�ো গা না ক্যানে’ বললেই সুরাবুদ্দি ছাদে
হাঁটার খ�োঁটাটা দেন। সুরাবুদ্দি আরও বলেন, ‘শুনছি, ভাইরাসটা
নাকি বাতাসে ন-ঘণ্টা অব্দি বেঁচে থাকছে! ছাদে ত�ো হাঁটতে বলছ,
ভাইরাসটা যদি হাওয়াতে ভেসে এসে নাকে মুখে ঢুকে পড়ে!’
তার নিদান অবশ্য ছেলে নুরুলই বাতলে দিয়েছে, ‘মুখে মাস্ক পরে
হাঁটাহাঁটি কর�ো।’ তিন মাস ধরে এই ছাদটাই সুরাবুদ্দির পৃথিবী।
ইহকাল পরকালের জমিন-আসমান। সুরাবুদ্দি ছাদের উপরের
আসমানে উড়ে বেড়ান�ো আল্লাহর জ্বিন ফেরেশতাকে নিয়েও ঠাট্টা
মশকরা করেন। বলেন, ভাইরাসটা যদি বাতাসে ভেসে থাকে তাহলে
ত�ো জ্বিন আর ফেরেশতাদেরও করোনা হয়ে যাবে! জৈনব তখন
মুখে আল্লাহর নামি নিয়ে ‘তওবা’ ‘তওবা’ করতে করতে বলেন,
‘তুমি ত�ো একেবারে কাফের গ! জাহান্নাম ছাড়া ত�োমার ক�োনও
গতি নেই।’ জৈনব মানুষটাকে আল্লাহর পথে ফেরান�োর অনেক
চেষ্টা কসরত করেছেন। কিন্তু ঘাড় কাত করা ল�োক সুরাবুদ্দির ঘাড়
কাতই থেকেছে। তিনি উল্টে জৈনবকে শুনিয়েছেন, ‘এত ত�ো ধম্ম
ধম্ম কর�ো, ত�ো একটা দুআ মুন্তর ফুঁক�ো দেখি যাতে করে কর�োনা
ভাইরাসটা দুনিয়া থেকে বিদেয় হয়ে যাক?’ ‘সব সময় কুফরি
কথাবাতরা!’ বলে মুখে আল্লাহর নাম নেন জৈনব। তারপর আঁচল
দিয়ে চ�োখ মুছতে মুছতে দুখ কাঁদেন, ‘ত�োমার এই মুনাফেকগিরির
জন্যে আমাকেও জাহান্নামে যেতে হবে। হাশরের ময়দানে আল্লাহকে
আমি কী কৈফিয়ত দেব?’ তারপর বিড়বিড় করতে করতে জৈনব
বলেন, ‘সবাই বলে স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর জান্নাত। আমার এমন
প�োড়া কপাল স্বামীর পা ত�ো দূরের কথা বুকে কপালেও জান্নাত
নেই! স্বামীর হাত ধরে স�োজা দ�োযখে যেতে হবে!’
গ্রামে থাকলে তাও মাঠে-ঘাটে যেতে পারতাম। মাচান টাচানে
বসতে পারতার। পাঁচটা দশটা ল�োকের সাথে কথা বলতে পারতাম।
এ শহরে কি মরতে যে থাকলাম! নুরুকে অত করে বললাম,
আমাকে না হয় এ কটা দিন গ্রামের বাড়িতে রেখে আয়। নুন ভাত
যা পাব তাই খাব আর থাকব। এদিকে ওদিক একআধবার ঘুরতে
ত�ো পারব? বুক ভরে শ্বাস ত�ো নিতে পারব? মাঠ-ঘাট ডহর-নহর
গাছপাতা বন-বাদাড় দেখে তাও ত�ো জানকে বলতে পারতাম,
 78
সুরাবুদ্দি এখনও জানে মরেনি। দেহ মন নিয়ে বেঁচে আছে। ছুঁড়াটা
বাপের কথা কানই করল না। বলে কি না আমার এখন যা বয়স
বাড়ির বাইরে এক ধাপও বের�োন�ো যাবে না। ভাইরাসটা বুড়�ো
মানুষদের কাছে একেবারে সাক্ষাৎ আজরাইল! গলাই ঢুকলেই খপ
করে জানটাকে নখের আঁচড় দিয়ে তুলে নেবে! উল্টে আমাকে এক
পেট স্বাস্থবিধির কথা শুনল�ো, উঠতে বসতে হাতে স্যানিটাইজার
দিতে হবে। সে স্যানিটাইজার দেওয়ার আবার কত নিয়ম শেখাল�ো।
আঙ্গুলের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে ঘষতে হবে। উলটে পালটে ঘোষতে
হবে। কনুই পর্যন্ত ধুতে হবে। নখের ভেতর যেন ফেনা ঢ�োকে।
বাইরে গেলেই মুখে মাস্ক পরতে হবে। সে মাস্ক আবার একবার
পরেই সার্ফ দিয়ে কাচতে হবে। মাস্ক পরারও আবার ফ্যাকড়া
কত! সেসব জানার চেয়ে আজকালকার স্কুলের পরীক্ষায় পাশ করা
আরও সহজ। প্রত্যেক দিন সকাল বেলা নিয়ম করে ছাদে উঠে
র�োদে ঘণ্টাখানেক হাঁটতে হবে। তাতে করে নাকি শরীরে ভিটামিন
ডি জমবে। ভিটামিন ডি নাকি শরীরের ক্ষমতা বাড়িয়ে শরীরকে
কর�োনা ভাইরাস থেকে রক্ষা করবে। ওষুধের একদম অনিয়ম করা
যাবে না। সারাদিন ভাল�োমুন্দ বেশি করে খেতে হবে। ফলমূল মাছ-
মাংস অঢেল খেতে হবে। অঢেল ফলমূল মাছ-মাংস! অত করে
খেলে একটা চাকরির টাকা ত�ো দূরের কথা জমিদারের জমিদারিও
ফুরিয়ে যাবে। বেটার ফলমূল মাছ-মাংস খাওয়ার কথাটা শুনে ঠেস
মেরে বলেছিলেন সুরাবুদ্দি। এ কথাও বলেছিলেন, ‘আমার না হয়
বেটার চাকরির টাকা, কিনছি খাচ্ছি, কিন্তু যাদের টাকা পয়সা নেই
তাদের কী হবে? গরিব মানুষের ত�ো ফ্যান ভাতই জ�োটে না, সেখানে
ফলমূল মাছ-মাংস!’ বাপের এ কথাটা শুনে নুরুল আবারও সেই
লাল পার্টির খ�োঁটা দিয়েছিল, ‘ত�োমার মাথা থেকে দেখছি এখনও
সাম্যবাদ আর সমাজতন্ত্রের ভুতটা যা‌য়নি!’ তারপর চ�োখ পাকিয়ে
বলেছিল, ‘পুষে পুষে থও। কবরে গিয়ে সমাজতন্ত্র আন�ো। ত�োমরা
যা হাড়বজ্জাত ল�োক, কিয়ামতের মাঠে গিয়েও বলবে, আমরা
সমাজতন্ত্র চাই। মার্কসবাদ অমর রহে। যত্ত সব!’ মুখ ভেংচেছিল
নুরুল। তারপর ভুগ�োলের মাস্টারমশাইয়ের মত�ো বলেছিল, ‘দুনিয়ার
ম্যাপটা খুলে একবার দেখ�ো গা, ত�োমাদের জানের জান চীন দেশ
এই মারণ ভাইরাস সৃষ্টি করেছে।’ ছেলের কথাটা সুরাবুদ্দির আঁতে
লেগেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘ওসব আমেরিকার বানান্যে গপ্প।
 79
আমেরিকা নিজে সৃষ্টি করে চীনের ঘাড়ে দ�োষ দিচ্ছে।’ নুরুল এবার
ফিক করে হেসেছিল। ঠ�োঁটে দুষ্টু হাসি মাখিয়ে বলেছিল, ‘আমি ত�ো
ভুলেই গেছিলাম, ত�োমাদের ত�ো এটাও একটা অসুখ। দুনিয়ার সব
খারাপেই আমেরিকা ভুত দেখা।’
সুরাবুদ্দি চীন আমেরিকার অত ভুগ�োল ইতিহাস জানেন না।
মুখ্যু মানুষ বাপের কালে ক�োনদিন বইয়ের পাতা খুলেও দেখেননি।
দেশগুল�ো গ�োল না লম্বা। সরু না ম�োটা। ওসব জানেন না। কিন্তু
এত বছর পার্টি করার ফলে এটা জানতেন, ‘হিন্দি চিনি ভাই ভাই’
আর ‘আমেরিকার পুঁজিবাদ নিপাত যাক’। কতদিন মিছিলে মিটিঙে
গলা ফাটিয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই। আর এখন কর�োনা ভাইরাসের
ছ�োবলে জানতে পারছেন, ভাইরাসটা কার ল্যাবে সৃষ্টি তা নিয়ে চীন
আর আমেরিকার মধ্যে প্রায় যুদ্ধ লাগার উপক্রম। দুনিয়া ত�োলপাড়।
‘অ্যা আল্লাহ দিয়েছেন আল্লাহ ঠিকই ফিরিয়ে নেবেন’ জৈনব বললে
সুরাবুদ্দি গলা ভারি করে বলেছেন, ‘না গ�ো না, অ্যা আমেরিকার
সৃষ্টি করে চিনে ছেড়ে দিয়েছে। চীনকে ঠাপে ফেলার জন্যে। শেষে
নিজেই ঠাপে পড়ে গেছে।’ শেষ কথাটা বলার সময় সুরাবুদ্দি কেমন
মিচকি হাসি হাসলেন। যেন সেই আদ্যিকালের কমরেড পুঁজিবাদী
আমেরিকাকে ব্যঙ্গ করে বলতে চাইলেন, এবার ঠেলা বুঝ।
সুরাবুদ্দি আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা জিনিস ঠাহর করতে
পারছেন, হাওয়ার কেমন বদল এসেছে। আগের বছরগুল�োতে এ
সময় ভ্যাদভেদে গরম থাকত। গরমের ঠাপে হাওয়াও ঘামত।
একআধবার কালবৈশাখী আকাশ কাল�ো করে নেমে এলেও বর্ষা
আসতে আসতে সেই শ্রাবণ লেগে যেত। এ বছর জৈষ্টিতেই কেমন
বর্ষা বর্ষা ভাব। হাওয়াতেও অত বালি তাতান�ো ভাপ নেই। আষাঢ়
পরলেই ঝেপে নামবে বৃষ্টি। শুনছি, গঙ্গার জলও নাকি কাঁচের মতন
ঝকমক করছে! নদীতে দূষণ কম। কবে থেকে কলকারখানা বন্ধ।
গাড়িঘ�োড়া চলছে না। বিমান উঠানামাও বন্ধ। শুধু কি আমাদের
দেশে, গ�োটা দুনিয়ায় বন্ধ। ফলে হাওয়া বাতাস সেসব কাল�ো ধ�োঁয়া
আর দূষণ থেকে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। দুনিয়া নাকি একশ বছর আগের
বয়সে ফিরে গেছে। পৃথিবী সত্যিই জানে, নিজেকে কেমন করে
রক্ষা করতে হয়। জৈনবের কথাগুল�োই ঠিক, দুনিয়ার মানুষ যতই
হিজ্জাবুর ন�োংরা আবর্জনা গু গবর কালি ধুলি দিয়ে দুনিয়াটাকে শ্বাস
বন্ধ করে মেরে ফেলার চক্রান্ত আটুক না কেন আল্লাহ ঠিকই জানেন
 80
তার সৃষ্টি করা দুনিয়াকে কী করে বাঁচাতে হয়। এমন এক জিনিস
দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছেন ল�োকে না পারছে দেখতে না পারছে
শুনতে। ঘরের দজ্জা জানালা বন্ধ করে লুকিয়ে থাকছে। আকাশের
গায়ে উড়ে বেড়ান�ো ছেড়া ছেড়া মেঘ সুরাবুদ্দির চার দেওয়ালে ঠাসা
মনটাকে উড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। সত্যিই খ�োলা আকাশ দেখার
মধ্যেও কত সুখ থাকে। মেঘেদের আঁকিবুঁকি, অপরাহ্নের আকাশে
সূর্যের রঙ ছড়ান�োর প্রতিয�োগিতা, তারপর ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামলে
কাকভেজা ভিজে জৈনবের কাছে বকুনি খাওয়া। আহাঃ কত মজা!
কত সুখ! সুরাবুদ্দি এখন বৃষ্টি হলেই জুবেদকে নিয়ে সটান ছাদে
উঠে যান। ছাদের জমান�ো জলে কাগজের ন�ৌক�ো করে ভাসিয়ে
দেন। তারপর নাতি জুবেদের মধ্যে দেখতে পান নিজের শৈশবকে।
এই ছাদের উপর খ�োলা আকাশ আর নুরুলের বেটা জুবেদ আছে
বলে তাও সুরাবুদ্দি চার দেওয়ালের ভেতরে কিছুটা বাইরের জগত
খুঁজে পান। নদী-নালা মাঠ-ঘাট গ্রাম-শহর আর মানুষ মুনিশের স্বাদ
পান। কিন্তু সেসবও ত�ো একঘেয়েমি হয়ে উঠছে? একই জিনিস আর
কত! সুরাবুদ্দি একআধবার জ�োর করে বের�োতে চাইলে, নুরুল ভয়
দেখিয়েছে, কর�োনায় মরলে কিন্তু লাশ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কুকুর শেয়ালের মতন ক�োন গ�োপন জায়গায় ফেলে দেবে। জৈনব
ত�ো গায়ে কাঁটা দেওয়া কথা বলেছেন, মুসলমানের বেটা হয়ে শেষে
হিন্দুদের মতন আগুনে পুড়ে ছাই হবে! জানাজা কবরের মাটি সেসব
ত�ো পাবেই না। উল্টে শ্মশানের চুল্লিতে পুড়িয়ে দেবে! এমন প�োড়া
কপাল হবে আমার শেষে মরা স্বামীর মুখটাও দেখতে পাব না! যা
এট্‌টূআট্‌টু জান্নাতে যাওয়ার সুয�োগ থাকত তাও জাহান্নামে চলে
যাবে! আর গেটের বাইরে পা বাড়াননি সুরাবুদ্দি। চার দেওয়ালকেই
আল্লাহর দুনিয়া ভেবে শুয়েছেন বসেছেন হেঁটেছেন। খেয়েছেন
হেগেছেন। যা কথা বলার বলেছেন। যা না বলার তাও বলেছেন।
ফলে বউ ছেলের সাথে হামেশাই খিটিমিটি লেগেছে। আর কত চুপ
করে থাকা যায়? চুপ করে থাকতে থাকতে যে একসময় ব�োবা হয়ে
যাব। ভেবেছেন সুরাবুদ্দি।
আজ দুপুরের ভাতঘুমটা ভাঙতে কিছুটা দেরিই হল নুরুলের।
বউ ছেলে নিয়ে লম্বা ঘুম দিয়েছিল। এমনিতেই তার দুপুরে
ঘুম�োন�োর অভ্যেস নেই। সময় আর ক�োথায় যে ঘুম�োবে। স্কুল থেকে
ফিরতে ফিরতে সেই বিকেল গড়িয়ে যায়। সূর্যটা তখন ভাগীরথীর
 81
ক�োলে লাল টিপ হয়ে ঝুলে থাকে। আর এখন অঢেল সময়।
স্কুল বন্ধ। ঘুমটা একটু বেশি লম্বা হলেই যেন ভাল�ো হয়। যতক্ষণ
ঘুমিয়ে থাকা যায় ততক্ষণই শান্তি। জেগে থাকলেই দুনিয়ার হাজার
খিটকেল। প্রতি মুহূর্তের কর�োনা আপডেট। আজ কতজন আক্রান্ত
হল, কতজন মরল। আমাদের জেলায় কর�োনা এল কি না। এলেও
কীভাবে এল। ওষুধ আবিষ্কারের খবর কি। ভ্যাকসিন কি আবিষ্কার
হচ্ছে? ভিন খাটতে যাওয়া শ্রমিকরা কতদূর হেঁটে এল। কতজন না
খেতে পেয়ে মরল। এসব হাবিজাবি চিন্তা মাথাটাকে খেয়ে ফেলে।
জৈনবও এই সময়টা একটু জিরিয়ে নেন। সারাদিনের কাজের ধকল
শরীলটা বিছানা ছুঁলেই ঘুম ঘ্যাঁচ করে ধরে নেয়। ব্যাপারটা প্রথম
লক্ষ্য করল নুরুলই। আব্বা ক�োথায়! ঘরে ত�ো নেই। তবে কি ছাদে?
ছাদে উঠল নুরুল। নাহ, সেখানেও নেই। বাথরুম টয়লেট বারান্দা
আন্টাকান্টা সব তন্য তন্য করে খ�োঁজা হল কিন্তু সুরাবুদ্দি ক�োত্থাও
নেই। তবে কি আব্বা কাউকে না বলে গেরামের বাড়িতে চম্পট
দিয়েছেন? ভাবল নুরুল। নুরুলের বউ ম�ৌসুমি ‘থাম�ো, একবার
ফ�োন করে দেখি’ বলে যেই সুরাবুদ্দির ম�োবাইলে ফ�োন লাগাল
অমনি রিংট�োনটা শোবার ঘর থেকে কানে এল। জৈনব বলল,
‘‘ফ�োন লিয়ে যায়নি। ঘরেই থুয়ে গেছে।’’ নুরুলের মাথায় কিছু
একটা ঠক করতেই সে বলল, ‘‘থাম�ো, আমি এক্ষুনি আসছি।’’
বলেই সে মুখে মাস্ক লাগিয়ে মোটর বাইকটা স্টার্ট দিল। ‘‘ক�োথায়
যাচ্ছ?’’ ম�ৌসুমি জানতে চায়ল নুরুল বলল, ‘‘এসে বলছি।’’
যা আন্দাজ করেছিলাম। তাই। আমার ভাবনাটাই ঠিক। গঙ্গার
ধারে গ�োরাবাজার ঘাটের কাছের ঠেকটায় বাপ সুরাবুদ্দিকে বসে
থাকতে দেখে মনে মনে বলল নুরুল। কিন্তু একটা জিনিস দেখে
অবাক হল নুরুল। আশপাশে ত�ো কাউকে দেখতে পাচ্ছি ন্যা। তাহলে
আব্বা কার সাথে কথা বলছেন! তবে কি এবার আব্বার মাথাটা
গেল! আরও কিছুটা নিকটে গেল নুরুল। হ্যাঁ, ঠিক। আব্বা বিড়বিড়
করে কথা বলছেন। মুখে মাস্ক পরা আছে বলে সে কথা অত ছড়াচ্ছে
না। নুরুল শুনতে পেল, সুরাবুদ্দি বিড়বিড় করে বলছেন, ‘‘গরিবের
পেটে ভাত নাই। ওষুধ আবিষ্কারের বালাই নাই। বিজ্ঞানে ভরসা
নাই। আর থালা-বাসন শঙ্খ বাজিয়ে আল�ো-বাতি নিভিয়ে ভাইরাস
তাড়াবে! ল�োকটা প্রধানমন্ত্রী না গ�োদানমন্ত্রী? দেশ এমন উলুক্ষুনে
প্রধানমন্ত্রী আগে কক্ষুনও পায়নি।’’ কিন্তু ও কথা শুনছে কে? ধন্দটা
 82
মনে জাগতেই নুরুল আরও কিছুটা কাছে এগিয়ে গেল। দেখল, বাপ
সুরাবুদ্দি যেখানে বসে আছেন তার চেয়ে মিটার পাঁচেক দূরত্বে নদীর
নীচের দিকের সিঁড়িতে বসে আছেন আসমত চাচা। মুখে লাল রঙের
মাস্ক। এক মাথা উস্কোখুস্কো পাকা চুল গঙ্গার ফিরফিরে হাওয়াতে
নড়ছে। নুরুলদের গ্রামের পাশের গ্রামের মানুষ। নুরুলদের
বহরমপুরে উঠে আসার বছর খানেক আগেই আসমত চাচা এ
শহরে চলে এসেছেন। একসময় পার্টির হ�োলটাইমার ছিলেন। এখন
প্রতিদিন বিকেলে এই গঙ্গার ঠেকে সুরাবুদ্দির আড্ডার সাথি। নুরুল
দেখল, কান খাড়া করে বাপ সুরাবুদ্দির কথাগুল�ো শুনছেন আসমত
চাচা। নুরুল একবার ভাবল বাপটাকে এক বকুনি দিয়ে ম�োটরবাইকে
তুলি। কিন্তু পরক্ষণেই তার মা জৈনব বিবির কথাটা মনে পড়ে গেল।
জৈনব বলেছিলেন, ‘যা করছে করতে দে। কটাদিন আর বাঁচবে।
এট্‌টুআট্‌টু হাসি-ঠাট্টা করছে ত�ো করুক না। এই তিনপেয়ে বয়সে
ওসবই ত�ো মনের খ�োরাক।’ নিজের উপস্থিতির ক�োন জানান দিল
না নুরুল। ভুউউ করে ম�োটরবাইকটা স্টার্ট দিল। দেখল, পড়ন্ত
সূর্যের লাল গ�োলাপি আল�ো দিগন্ত ঠিকরে ভাগীরথীতে পড়ছে।
আর সে আল�ো পেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠছে আবহমানকালের
ভাগীরথী। সে খিলখিল হাসি বাপ সুরাবুদ্দির ঠ�োঁটেও এসে লাগছে।
নুরুল খেয়াল করল সে হাসি বাপ সুরাবুদ্দি থেকে তার ঠ�োঁটেও এসে
লাগল। সেও একবার ঠ�োঁট চিপে হাসল।

 83
w or ye

অশ�োক অধিকারীর দুটি কবিতা


চিতা
আগুনের ভেতর যাওয়া এত সহজ
শুধু, নাকের নল দুটি খুলে নিলে
বিবস্ত্র রাষ্ট্রের অক্সিজেন প্ল্যান্ট থেকে
ধ�োঁয়ার কুণ্ডলী প�োড়া শরীরের গন্ধ হয়ে যায়।
আমাদের মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়,
এটুকু লিখিয়ে নিতে পারলেই
বেজে ওঠে মরমী দ�োহার!
তারপর যে যার লক্ষ্যে যেতে যেতে
বাৎসরিক পর্বে কিছু ফুল বরাদ্দ করা।

চিতা কী নিভতে জানে, কে নেভাবে


এই সর্বগ্রাসী ক্ষুধা! বিরল নিঃশ্বাস টুকু-
ক�ৌট�োয় রেখে চলেছে পিতৃ তর্পণ
ক�োন�োদিন খুঁজে পাওয়া যাবে কী
এইখানে ছুঁড়ে ছিলে ফুল; এই মাটি
আমার ঈশ্বর, সাদা প�োশাকের
কথাবার্তায় সম্পর্কের কীইবা এসে যায়।

84
84
মুখ
মুখ গুল�ো অন্ধকারে একরকম,
আল�োয় এলে মনে হয়- এত সুন্দর!
হাত গুল�ো আল�োয় একরকম,
অন্ধকারে নিশপিশ করে যেন শিকারী

আমাদের অনেক মুখ ছিল; যেন


সুবর্ণ ক্যানভাসঃ যাই আঁক�ো
হয়ে যেত পাশের বাড়ির লতাগুল্ম স্নেহ
একটানে হয়ে যেত নদী আকাশ পথ্য
আমাদের অনেক হাত ছিল; কত�ো
নিবিড় ; কাঁধ ছুলে বলে দেওয়া যেত
এই হাত রক্ত স্পর্শ করে নি ক�োন�োদিন

সব মুখ- হাত পাল্টে পাল্টে শিকারীর


বর্ম-অলঙ্কার! পৃথিবীতে আর কবে
সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের পরে
মিলে যাবে মানব-রতন।

85
85
ত�ৌফিক হ�োসেনের দুটি কবিতা
আজ মৃত্যু আসবে নাকি?
আজ মৃত্যু আসবে নাকি?
এখন জ্ঞানত দরজা খুলে দিলাম,
এস�ো ত�ো মৃত্যু আমার ইচ্ছায়!

আজ আমার কি আছে বাকি?


দেহ-মন কসাই করেছে নিলাম,
এত�ো হে মৃত্যু অবশিষ্ট ইচ্ছায়!

আজ মৃত্যু আসবে নাকি?

তবু মানুষ
এত�ো মানুষ দেখেছি
তবু মানুষকেই দেখতে ভাল�োলাগে
এই নির্যাস সত্য হয়ে মাথায় ঝরে পড়ে
যে পথ এখন�ো বাকি আছে
তার সম্মুখে যেন হেঁটে যায় দুটি পা
আমার দুই হাতে যেন
দুটি ফুল আরক্ত ধরা দেয় ফুলের ছন্দে
দুই হাত পেতে বসে আছি
ঘাম -গন্ধ মাখব�ো বলে
সেই বিস্বাদ এখন�ো ভুলিনি
অতঃপর তাকে আবার পেতে চাই
তারপর আবার
চেটেপুটে সব নিজের করে বুঝে নেব কথা দিলাম।

কত�ো মানুষ দেখেছি


তবু মানুষ দেখতে বড়�ো মুখিয়ে আছি।

86
86
নাসির ওয়াদেনের দুটি কবিতা
অতীত জানালা
একটু আকাশ রঙ মেখে নিই শরীরে
রাগী বাতাসের গায়ে লালর�োদ হাসে
পড়শির উঠ�োন জুড়ে গার্হস্থ্য কান্না
ত�োমার বিনিময় চ�োখ প�োড়ে আগুনে,ত্রাসে

কে যেন চুরি করে নিয়ে যায় অগ্নিমালা


কীসের ল�োভ, মায়া, ছন্নছাড়া মেঘ-বাতাস
ফুলের পাপড়ি উড়ে ক�োকিলের গানে গানে
আমার জানালা জুড়ে অতীত, খ�োলা আকাশ

খেলা হয়, বিচিত্র বর্ণের খেলা, খ�োলা মাঠ


নদীর জল, কুহকিনী ছায়া, শ্বেত পাথর, বাঁকে
গড়িয়ে গড়িয়ে যায় দুপুরের ঘ্রাণ, সন্ধ্যাবাতি
আমি খুঁজি অল�ৌকিক সুখ জানালার ফাঁকে

87
87
নদীর কাছে পাহাড়ের কাছে
সুখ কথাটির ভেতর কী এক অদ্ভূত শক্তি
জেগে আছে পাহাড়ের বুকে, গাছের পাতায়
ঝরে যায় প্রতিটি নিমেষ হাল সনের খাতা
ছিঁড়ে যায় অতীতের স্মৃতি নদীর কাছে, জলে
মুক্তো খুঁজতে গিয়ে হারিয়েছি ত�োমাকে, অ-সুখ
বাসা বেঁধে থাকে পিঁপড়ের স্বাদে, গরম বিছানা
অবেলা শীতরঙ মেখে হাঁক দেয় ‘ দিতে হবে ‘
কেউ কেউ বলে আরও কিছু, শত প্রতিশ্রুতি
বেলা চলে গেছে গেলে পাহাড়ের কাছে যাই
ঘুম নেই চ�োখে নদী জলে শুধু আল�োকথা
নিভৃত য�ৌবন জুড়ে আসে জ�োয়ারের পর ভাটা
বিমুখ পৃথিবী রুগ্ন শরীর কেবলই পিছনে হাঁটা
বৃষ্টির রাতে শব্দের অনুরণন শুনে শুতে যাই
হলুদ স্বপ্নেরা ঘা মেরে জাগিয়ে ত�োলে অভিমান
পাহাড়ের বুকে ধ্বনি ওঠে, নদী বুকে ঢেউ মেখে
আমি পাড়ি দিই জ�োৎস্নাসাগরে তুমি একা
নরম নদীর জলে শুয়ে শুয়ে কাটে যে প্রহর
তুমি কী এসেছ কাছে নদীটির তীরে পাহাড়ের ঢেউ

88
88
দেবানন্দ ভট্টাচার্যের দুটি কবিতা
জিজ্ঞাসার আভাস ছিল
হ্যাঁ ত�োমাকে বুঝতে ভুল করেছি। আর
তার চেয়েও বড় কথা হল,
ত�োমাকে সবটা ব�োঝাতেও পারিনি।
খুব কাছাকাছি থেকে, সুখদুঃখের
লেনদেন অথচ পার্থক্যেই রয়ে গেলাম।
আমার জমান�ো মুদ্রা তুমি সযত্নে
গুছিয়ে রেখেছিলে। সকল প্রয়�োজনীয়
কাগজপত্র ইশতেহার—সাজান�ো
থাকত�ো। ওঠানামা সিঁড়ির ধাপে ধাপে
ক�োন�ো সংশয় ছিল না। শুধু আয়নায়
জিজ্ঞাসার কিছু আভাস ছিল।
তুমিও ত�ো আমাকে ঠিক ঠিক পড়তে
পারলে না। একটাই রাস্তা। কিছুদূর হেঁটে
সাপের জিভের মত�ো দু-ভাগ হয়ে গেল।
হাতের কাজ মিটিয়ে এস আল�োচনায়
বসি। কথা হ�োক। জরুরি কথা।
প্রথমে নিপুণ ব�োঝাপড়া। তারপর একত্রে

যতদূর স্বাভাবিক হেঁটে যাওয়া যায়


— যেতে হবে। যাব।

89
89
জন্মভূমি খুশি হবেন
চারচ�ৌক�ো ঘরে আটকে আছি।
নজরবন্দী নয়। সারাদিন কী যে করি!
আঁকি লিখি পড়ি। ঘুম আর পায়চারি।
গান সেতার বাঁশি ও সর�োদ..... সময়
কাটান�ো এক জটিল সমস্যাই বটে।
খবর? বলবেন না প্লিজ! সারাদিন
একই বয়ানে গলা ফাটাচ্ছে।
মগজে পেরেক ঠুকছে।
গিন্নি বলেন, সারাদিন ত�ো ঘ�োরের
মধ্যে থাক, ছাইপাঁশ ভেবে কী হবে
শুনি। বরং ছাদবাগানে হাঁটাহাঁটি
কর—কাজে দেবে।
বেশিক্ষণ ত�ো বাগানেই থাকি।
ফুল পাতা ছায়ার সঙ্গে কথা হয়। ওরা
যেন আগের মত�ো মন�োয�োগী নয়।
তীব্র অসন্তোষ ও অবিশ্বাস লক্ষ্য
করেছি। গিন্নিকে কথাটা বলিনি।
তা হলেও কবিতা সাজাই। আবার
আবারও। শ্রোতা নেই। পাঠকও নেই।
প্রায়শই ভিক্ষা জ�োটেনা।
লেখা কাগজ ঝরাপাতার মত�ো
উড়ে যায়। এই উড়ান র�োজ আমি
দেখে থাকি। মনের কথা একটাই—
পায়ের নিচে জমি শক্ত করে
জন্মভূমি খুশি হবেন। শুধু এই টুকুই।

অলঙ্করণ : সুব্রত দাস

90
90
ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ইরফান
হাবিবের কয়েকটি অতীব মূল্যবান ঐতিহাসিক প্রবন্ধের অনুবাদ
ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে। তুলিকা প্রকাশনা সংস্থার দি
ন্যাশনাল মুভমেন্ট শীর্ষক গ্রন্থে এগুলি সংকলিত। সাম্প্রদায়িক
শক্তি যখন দেশের ইতিহাসকে বিকৃত করছে, তখন এই
প্রবন্ধগুলির গুরুত্ব অপরিসীম।

গান্ধিজী : একটি জীবন



ইরফান হাবিব
অনুবাদ : অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী

এ ই সময়ে গান্ধী যে কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন, তার


সামাজিক বার্তা সীমাবদ্ধ ছিল একথা বলা ম�োটেই ঠিক
হবে না। সামাজিক সমতার প্রশ্নে তাঁর যে সাফল্য তা
নিঃসন্দেহে একেবারে প্রাথমিক স্তরের হলেও এর গুরুত্ব এইখানে
যে এটি জাতীয় আন্দোলনের একটি প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হল,
যে কাজটি অতীতের ক�োন�ো নেতা করেননি। গান্ধীর “গঠনমূলক
কর্মসূচি”তে খদ্দর পরিহিত পুরুষ ও মহিলারা গ্রামে যেতেন, চরকায়
সুত�ো বানাতেন, শিক্ষাদানের কাজ করতেন এবং অস্পৃশ্যতার
বিরুদ্ধে লড়াই করতেন। যতই সীমাবদ্ধ হ�োক সেই প্রথম সমাজের
 91
খান আবদুর গফফর খানের সঙ্গে গান্ধী।

সব থেকে গরিব অংশের মানুষের প্রতি নজর দেওয়া হল, আগের


মত দানের গ্রহীতা হিসেবে নয়, তাদের সকলের সঙ্গে সমান হিসাবে
মর্যাদা দেওয়া হল। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে খান আবদুল গফফর খান
স্বাধীনভাবে একই ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন পাঠানদের
মধ্যে (খুদাই-খিদমতগার) এবং পরে গান্ধীকে তাঁর শিক্ষক ও নেতা
হিসেবে স্বীকার করে নেন। এইভাবে গান্ধী তাঁর শ্রম ও দক্ষতা
দিয়ে জাতীয় আন্দোলনের গণভিত্তি তৈরি করেছিলেন, যার শক্তি
সম্ভবত প্রথম দেখতে পাওয়া গেল ১৯২৮ সালে বরদ�ৌলি সত্যাগ্রহ
আন্দোলনে, যা ছিল কর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কৃষকদের এক সফল
সংগ্রাম।
ইতিমধ্যে সাইমন কমিশনের বয়কট এর মাধ্যমে (১৯২৭)
কংগ্রেসের অভ্যন্তরে প্রগতিশীলতার হাওয়া বইছিল এবং মতিলাল
নেহেরু রিপ�োর্টে (১৯২৮) নরমপন্থী মন�োভাবের জন্য হতাশা
তৈরি হয়েছিল। গান্ধী তাঁর স্বভাবসুলভ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়
নরমপন্থী ক�ৌশলকেই সমর্থন করলেন, কিন্তু একই সঙ্গে সম্পূর্ণ
অপ্রত্যাশিতভাবে ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে লাহ�োরে অনুষ্ঠিতব্য
কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য সভাপতি হিসেবে জহরলাল নেহেরুর
 92
নাম প্রস্তাব করে প্রগতিশীলদের সঙ্গে একটি সাঁক�ো তৈরির
গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। লাহ�োর অধিবেশনে কংগ্রেস
“পূর্ণ স্বরাজ”র দাবি ঘ�োষণা করল এবং তা অর্জনের জন্য আইন
অমান্য আন্দোলন শুরু করল�ো। যার নেতৃত্বে ছিলেন গান্ধী।
গান্ধীর শুরু করলেন এগার�ো দফা নরমপন্থী দাবি-দাওয়া নিয়ে,
যার মধ্যে ছিল ভূমি রাজস্ব হ্রাস, সামরিক খাতে খরচ কমান�ো,
লবণ করের অবসান ঘটান�ো, টাকার অবমূল্যায়ন, সংরক্ষণমূলক
মাশুল ব্যবস্থা, মদ খাওয়া নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি, যার উদ্দেশ্য ছিল,
সাধারণ কৃষক থেকে ব্যবসায়ী মানুষ সকলকে আকর্ষিত করা, আবার
জমিদাররা যাতে আহত না হয় সেদিকেও তাঁর খেয়াল ছিল। গান্ধী
আইন অমান্য আন্দোলনের প্রথম টার্গেট করলেন লবণের একচেটিয়া
ব্যবসাকে, এক মাস ধরে ডান্ডি পদযাত্রা চলল, ১৯৩০ সালের ৫ ই
এপ্রিল তা ডান্ডি প�ৌঁছাল�ো এবং গান্ধী লবণ সত্যাগ্রহ শুরু করলেন।
ঘটনায় যখন কংগ্রেসের নেতা ও কর্মীদের গ্রেফতার করা শুরু হল�ো
তখন দেশের নানা প্রান্তে গণঅভ্যুত্থান তৈরি হল�ো। পেশাওয়ারে প্রায়
১০ দিন ধরে (২৪ এপ্রিল থেকে ৫ মে) সরকার সম্পূর্ণ কর্তৃত্বহীন
হয়ে পড়েছিল। ৫ মে গান্ধী নিজে গ্রেপ্তার হলেন। এরপর গণহারে
আইন অমান্য সংঘটিত হল�ো। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার ৯০,০০০
আন্দোলনকারী কে জেলখানায় ভরল (যাদের মধ্যে বড় অংশ ছিলেন
মহিলা), সেই সঙ্গে কর না দেবার অপরাধে কৃষকদের সম্পত্তি কেড়ে
নেওয়া হল�ো। ১৯৩১ সালের ৪ মার্চ গান্ধী আরউইন চুক্তির মধ্য
দিয়ে আইন অমান্য আন্দোলনে”ছেদ”টানা হল�ো। দেশের মানুষ
দেখলেন ভারতের ভাইসরয় জাতীয় আন্দোলনের এক নেতার সঙ্গে
চুক্তি করছেন, এঘটনা তাঁদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি করল�ো, কিন্তু
চুক্তিতে দেখা গেল আটক বন্দীদের মুক্তি, কংগ্রেস সংগঠনের ওপর
থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ছাড়া আর বড় ক�োন�ো রকমের দাবি
আদায় সম্ভবপর হয়নি। যে সব সম্পত্তি সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল
তার অধিকাংশই ফেরত পাওয়া গেল না, সেই সঙ্গে জাতীয় নায়ক
ভগৎ সিং এর ফাঁসিও ঠেকান�ো গেল না।
এটা স্পষ্ট যে আইন অমান্য আন্দোলন তার গতি স্তিমিত হয়ে
যাবার আগেই গান্ধী একটা চুক্তিতে প�ৌঁছাতে আগ্রহী ছিলেন। সম্ভবত
১৯৩১ সালের ২৯ মার্চ করাচিতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে
গান্ধীকে তাঁর পক্ষে লজ্জাজনক চুক্তিতে আপ�োষ রফা করতে হয়।
 93
দ্বিতীয় গ�োলটেবিল বৈঠক। লন্ডন, ১৯৩১
ওই অধিবেশনে ম�ৌলিক অধিকার সংক্রান্ত মূল প্রস্তাবের খসড়াটি
তৈরি করেন জওহরলাল নেহেরু, সেটিকে সংশ�োধন করেন গান্ধী।
এই প্রস্তাবে গান্ধীর প্রধান ভাবনাগুলির কিছু প্রতিফলন ছিল, কিন্তু
মূলগতভাবে সেখানে একটি আধুনিক কল্যাণকর রাষ্ট্রের কথাই ভাবা
হয়েছিল, ক�োন স্ব নিযুক্তিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের কথা নয়; ভাবা
হয়েছিল শিল্পোন্নত সমাজের কথা,প্রাক শিল্প যুগের গ্রামীণ সমাজের
কথা নয়; আইন করেই নারী ও পুরুষের মধ্যে সমান অধিকার
প্রতিষ্ঠা, অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধকরণের কথা বলা হয়েছিল; গান্ধী চেয়ে
ছিলেন আইন করে নয়, মানুষকে বুঝিয়ে রাজি করাতে। প্রস্তাবে
ছিল শ্রমিকদের সুরক্ষা দেওয়া, জমির খাজনা কমান�ো, জমিতে
ভ�োগ দখলে র মেয়াদ সংস্কার করা (সুতরাং, সম্ভবত জমিদারী
উচ্ছেদ করা, যদিও তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি), শিল্পপতিরা এবং
ভূস্বামীরা যে গরিব মানুষের” রক্ষাকর্তা “এমন ধারণা প্রস্তাবের
ক�োথাও স্থান পায়নি। ১৯০৯ সালে গান্ধী যে “হিন্দ স্বরাজ” এর কথা
বলেছিলেন, এই প্রস্তাব ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সম্ভবত গান্ধী
উপলব্ধি করেছিলেন তিনি নিজেই ভারতীয় সমাজের মধ্যে নতুন
শক্তির আত্মপ্রকাশে সাহায্য করেছিলেন, যারা তাদের প্রাপ্য মর্যাদা
পেতে সরব হয়েছিল, তারা সনাতনী ব্যবস্থার কিঞ্চিৎ রূপান্তরে সন্তুষ্ট
ছিল না, বরং তারা বুর্জোয়া গণতন্ত্র এমনকি সমাজতন্ত্রের থেকে
উদ্ভূত আর�ো আপ�োষহীন দাবির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল।
 94
শহীদ ভগৎ সিং
গান্ধী আরউইন চুক্তির পর ১৯৩১ সালে দ্বিতীয় গ�োলটেবিল
বৈঠকে য�োগ দিতে যাওয়াটা গান্ধীর নিজের পক্ষে খুবই চাপের
ছিল। এখানে তিনি এবং কংগ্রেস মুসলিম ও শিখদের জন্য
আলাদা নির্বাচকমণ্ডলী তৈরি করার প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজি
ছিলেন, কিন্তু ওই বৈঠকে আমন্ত্রিত কিছু ছ�োট ছ�োট সাম্প্রদায়িক
সংগঠন কংগ্রেসের সঙ্গে মানিয়ে চলতে রাজি ছিল না, বরং ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যবাদের কাছ থেকে নিজস্ব কিছু সুবিধা আদায় করে নিতেই
তৎপর ছিল; এই বৈঠক ক�োন সিদ্ধান্তে প�ৌঁছান�োর আগেই ভেস্তে
যায়। এই অচলাবস্থার পর অবধারিতভাবে আইন অমান্য আন্দোলন
শুরু হয় এবং সরকার ১৯৩২ সালের ৪ জানুয়ারি গান্ধীকে গ্রেপ্তার
করে, কংগ্রেস সংগঠন নিষিদ্ধ ঘ�োষণা করা হয়, তাদের তহবিল ও
সম্পত্তি আটক করা হয় এবং এপ্রিল মাসে সরকারি ভাবে ৩২৪৫৮
জন বন্দিকে দ�োষী সাব্যস্ত করা হয়। এইভাবে প্রধান প্রতিপক্ষ
কে ঝেড়ে ফেলে, ব্রিটিশ সরকার কমিউনাল এওয়ার্ড (৪আগস্ট)
ঘ�োষণা করে, যেখানে পশ্চাত্পদ জাতের মানুষজনদের জন্য পৃথক
নির্বাচন মণ্ডলীর ঘ�োষণা করা হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে গান্ধীজী
 95
যুগপৎ অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে এবং পশ্চাত্পদ অংশের জন্য পৃথক
নির্বাচকমণ্ডলীর বিরুদ্ধে অনশন শুরু করলেন (২০ সেপ্টেম্বর)।
এর পরিণতিতে পশ্চাত্পদ জাত ও বর্ণহিন্দু নেতাদের মধ্যে পুনা চুক্তি
সম্পাদিত হল (২৪ সেপ্টেম্বর), ব্রিটিশ মন্ত্রিসভাকে বাধ্য করল সেই
ম�োতাবেক কমিউনাল এওয়ার্ড কে সংশ�োধিত করতে এবং তারপর
গান্ধী ২৬ সেপ্টেম্বর জেলখানায় অনশন ভঙ্গ করলেন। এরপর গান্ধী
তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বর্ণহিন্দুদের মনে করিয়ে দিতে থাকলেন
যে তাঁরা অস্পৃশ্যদের কাছে (এখন থেকে গান্ধী তাঁদের” হরিজন”
বলে সম্বোধন করতে শুরু করলেন) সমতার প্রশ্নে কি প্রতিশ্রুতি
দিয়েছিলেন। তিনি আইন অমান্য আন্দোলনের সঙ্গে (বারে বারে
কারাবরণ সহ) অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে জ�োরদার প্রচার শুরু করলেন
এবং ১৯৩৩ সালের মে মাসে আর একটি দীর্ঘ অনশনে বসলেন।
সেই সময় বেশ কিছু কংগ্রেস নেতা মনে করতেন এই প্রচার আইন
অমান্য আন্দোলনের মূল লক্ষ্যকে বিচ্যুত করে দিচ্ছে; কিন্তু এই
বক্তব্যের পাশাপাশি সম্ভবত একথাও সত্য যে ভারতীয় সমাজের
এই বড় রকম বিভেদের বিরুদ্ধে এই নিবিড় প্রচার জাতীয় আন্দোলন
কে তার সামাজিক ভিত্তি প্রসারিত করতে সাহায্য করেছিল। তবে
আইন অমান্য আন্দোলনকে আর টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না;
ইতিমধ্যেই ১৯৩৩ সালের মে মাসে গান্ধী তা স্থগিত করে ছিলেন,
পরে ১৯৩৪ সালের এপ্রিল মাসের তা চূড়ান্তভাবে প্রত্যাহৃত হয়।
গান্ধী নিজে কংগ্রেস থেকে “অবসর “ঘ�োষণা করলেন; তবে এটি ছিল
নিছকই আনুষ্ঠানিক অবসর এবং তিনিই কংগ্রেসের সব রকম বড় বড়
সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে শেষ কথা ছিলেন।
গান্ধী তাঁর সদর দপ্তর আমেদাবাদ থেকে সরিয়ে ওয়ার্ধায়
নিয়ে গেলেন, এবং প্রবল উৎসাহে গ্রামীণ কর্মসূচিতে যুক্ত হয়ে
পড়লেন যার ম�ৌলিক বৈশিষ্ট্য গুলি তিনি ১৯২০ এর দশকে
তৈরি করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া স্পিনার্স
অ্যাস�োসিয়েশন তৈরি করেছিলেন যেখানে ৫৩০০ গ্রামে ২,২০০০০
মহিলা সুতা প্রস্তুতকারক, ২০০০০ তন্তুবায় ও ২০০০০ কর্মীর
কর্মসংস্থান হয়েছিল। ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকার জায়গা নিল হরিজন
পত্রিকা এবং সেটাই ভিলেজ ইন্ডাস্ট্রিজ এস�োসিয়েশনের মুখপত্রে
পরিণত হল, যেখানে গ্রামীণ উন্নয়নের সঙ্গে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে
জ�োরদার লড়াই করার বার্তা পরিবেশিত হত। এ বিষয়ে ক�োন�ো
 96
হরিজন পত্রিকার একটি পৃষ্ঠা
সন্দেহ নেই যে এইসব গান্ধীবাদী “এনজিও”জি ডি বি বিড়লার
মত বৃহৎ পুঁজিপতির আর্থিক সাহায্য পেয়েছিল কিন্তু গান্ধী যেভাবে
সহজ-সরল জীবনাদর্শের আদর্শকে তুলে ধরেছিলেন তাতে ওইসব
কর্মীদের সঙ্গে গ্রামীণ মানুষ একাত্ম ব�োধ করতে শুরু করেন এবং
সেই সব মানুষদের মধ্যে কংগ্রেসের প্রভাবকে প্রসারিত করতে
সাহায্য করে, যারা এত�োকাল কংগ্রেসের নামও শ�োনেনি, ক�োনদিন
চ�োখেও দেখেনি।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)

 97
ধা রা বা হি ক উ প ন্যা স

স�োনাই পাড়ের রূপকথা


শতদল দেব


একই হাইস্কুলে সকাল-দুপুর—মেয়ে ও ছেলেদের। ছুটি হবার
আগে থেকেই যাতায়াতের পথে দাঁড়িয়ে থাকে বন্ধুদের সঙ্গে।
একদিন বেড়ার ক্লাসঘরের ফাঁক গলে ঢুকে ব�োর্ডে চক দিয়ে লিখে
এসেছে পছন্দের নাম, যদি সকালে এসেই চ�োখে পড়ে। দান�োটার
চ�োখ কখন�োসখন�ো আবার লুকিয়ে-চুরিয়ে স্নানের ঘাটে, ক�োন�ো
এক আদুল গা-এর দিকে চুম্বক হয়ে আটকে থাকে, ছটফট করে।
পাড়ার এক দাদা পরামর্শ দেয়, ‘এসবের একমাত্র নিরাময় প্রাণাময়-
য�োগ।’ চাঁচের বেড়ার নিরামিষ রান্নাঘরে চার্ট ঝুলিয়ে মাটির মেঝেতে

 98
মাদুর পেতে নির্জনে শ্বাস-প্রশ্বাসের চর্চা। কিন্তু কল্পনায় সেই দৃশ্য
চ�োখে পড়লেই যেন এক ভয়ানক অম�োঘ নেশা! কতরকম প্রতিজ্ঞা
একদিন কের�োসিন কুপি জ্বেলে হাত ছুঁয়ে শপথ, কিছুতেই না—কিন্তু
ফের টেনে ছেড়ে দেওয়া ইল্যাস্‌টিকের মত�ো সেই একই। ওদের
পাড়া ছাড়িয়ে প্রান্তে থাকা এক সাধুমাত�ো ল�োকের সঙ্গে দেখা করে।
ওনার পরামর্শে র�োজদিন কচি বেলপাতা চিব�োয়, প্রাচীন মুনিঋষিরা
নাকি এভাবেই...। একদিন শ্যামের চ�োখে পড়ে যায় ও চেঁ‍‌চিয়ে
বাড়ি মাত ‘সবাই দেখবে এস�ো রাধুর কাণ্ড!’ ওর চিৎকারে ছুটে
আসে আরতিও—‘কে শিখিয়েছে ত�োকে এসব? ঘর-সংসার ছেড়ে
সন্ন্যাস-টন্ন্যাসের ইচ্ছে নাকি?’
শেষে ক্লাসের বন্ধুরাই সহায় হয়। গ�োপনে হলুদ সেল�োফেন
পেপার ম�োড়া বইয়ের রঙিন ছবি! ওদের কাছ থেকেই শিখে নেওয়া
সব। তবে ওই সাময়িক সুখের পরে পরেই কেমন এক অবসাদ,
খানিক সময় পেরলেই ফের অশান্ত। তখন সকাল-বিকাল খেলার
মাঠে অতিরিক্ত ঘাম-ঝরান�ো—সাঁতরে তিনবার পুকরের এপার-
ওপার।
বর্ষা নামতেই এবার শুরু হয়ে গিয়েছিল রাধুদের সামনের ‘দু’নম্বর’
পুকুর বাঁধাইয়ের কাজ। ভার পেয়েছেন এপাড়ার ঠিকাদার সহদেব
পাল। ‘দখনে’ থেকে আসা মজুরের দল। স্কুল যাতায়াতের পথে
রাধুরা দেখে যেন এক মহাযজ্ঞ। পুকুরপাড় জুড়ে শালবল্লা, পিচের
কাটা ড্রাম, দড়িদড়ার স্তুপ। ভাঙা হরিমন্দিরের পাশ থেকে রাস্তার
ধারে ধারে ছ�োট�ো ছ�োট�ো হ�োগলা পাতার ছাউনি, মাথায় প্লাস্টিক
ছেঁড়া তাবু। লুঙ্গি, খালি গা, পেশি খ�োদাই কতগুল�ো যেন পাথরের
মূর্তি। বাঁশের তৈরি ভারায় ঝুলতে থাকা কপিকল, চার-পাঁচশ�ো
কেজি ওজনের ল�োহার বাটখারা, ওদের ভাষায় ‘মুনকি’। ‘হেইয়া
মারি ব�োল�োরে ভাই, হেইয়া মারি রে! ত�োল�োরে মুনকি ত�োল�োরে
নাই, হেইয়া মারি রে!’ পুকুরপাড় জুড়ে মানুষের ভিড়। রাধুর দিদি
গীতা, পাড়ার মেয়েরা এমনকি প্রীতিও এসে দাঁড়ায়। দড়ির টান
দিতে দিতে ওরা আর�ো দ্বিগুণ উৎসাহে গলা মেলায়, ‘পান-অ
খাইলে মুখ-অ লাল, হেইয়া মারি রে!’ ‘এপাড়ার মেয়েবউরাও সে
গান শুনে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ে। প্রতিবারই দরদর ঘামে স্নান
করে উঠেছে ওরা। কাল�ো করে আসা আকাশ, মুহুর্মুহু মেঘের গর্জন,
তবু গাট্টা গ�োট্টা জলিলভাই, ম�োস্তাক বা সিরাজুলদের ‍বিরাম নেই।
 99
শুন্য থেকে নেমে আসা ল�োহার পিণ্ডটার বাড়িতে পাড়া কাঁপান�ো
ঠকাস ঠকাস শব্দে শালখুঁটিগুল�ো একটু একটু করে মাটির ভিতর।
দলটার মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সি ওই সিরাজুল ছেলেটা। রাধুর
ছ�োড়দা শ্যামদের মত�োই। র�োগা, কাল�ো ছিপছিপে, মায়ামাখান�ো
দুট�ো বড় বড় চ�োখ। তাগড়া জ�োয়ান ল�োকগুল�োর সঙ্গে সমানে
পাল্লা দেয়। রাধুরা অবাক হয়, ওই শরীরের ভিতর ক�োথায় লুকিয়ে
ওর এত শক্তি?
একদিন বিকালে আলাপও জমে গেল�ো হাসি-খুশি ছেলেটার
সঙ্গে। দুট�ো নদী পেরিয়ে তবে ওদের গ্রাম। বর্ষার প্রক�োপ কিছুটা
কমে এলে রাতেরবেলা পড়া শেষে রাধুরা গিয়ে দাঁড়ায় ঝুপড়িগুল�োর
সামনে। কাঠের উনুনে ফুটছে ভাত, কেটে রাখা আলু, কুমড়�ো
ইত্যাদি একটা বড় গামলায়। বসয়ে সবচেয়ে কনিষ্ঠ সিরাজুলই
প্রধান বক্তা। সেদিন হচ্ছিল�ো চালকবিহীন এক রিকশা ভ্যানের
কাহিনি। কাজ করতে করতে নির্বিকার শুনে যায় বাকিরা। ‘তা
বুইলে, সে ভ্যানগাড়ি ছুটছে ত�ো ছুটছেই—সিটের ওপর কেই নেই,
এদিকে প্যাডেল আপনা আপনি ঘুরতিছে!’ রাধুরা অন্যদিকে মুখ
ফিরিয়ে ঠ�োঁঠ টিঁপে হাসলে সিরাজুল উত্তেজিত, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না?
তাইলে চল�ো আমার সাথে। আমার আব্বাও দেখিছে ভাদ্রমাসের
অমাবস্যায় গাজীপাড়া থেকে শিরিষতলা— এই আধামাইল যেয়ে
গাড়ি নিজেই স্থির!’
পাশ থেকে ওদেরই কেউ একজন বলে, ‘ওই ভ্যানরিকশা ছিল
কাহারপাড়ার মান্যচরণের। মহাজনের থে কর্জ নে কিনেছিল। ওটা
কেনবার পরে পরেই একবার মারল�ো ধাক্কা; ঠিকঠাক কইরে চালাতে
না চালাতে বউটারে ধরল�ো কী এক র�োগে। ধার আর শুধতে পারে
না, উলটে এদিন-ওদিক থেকে সুদে একেবারে গলা অবধি। শেষে
একদিন দড়ি নিয়ে ওই শিরিষ গাছটারই ডালে!’
শুনতে শুনতে মুখের হাসি কখন মিলিয়ে গেছে খেয়ালও করে
না রাধুরা।
সময় পেলে এসে গল্প করে যায় রাধুদের বারান্দাতেও। গীতাও
য�োগ দেয় সেই আসরে। ঠাম্মা চেঁচায়, ‘ক�োথাকার ক�োন বেজাইত্যা-
মেজাইত্যা? ঘরে ঠাকুরের আসন!’ ওরাও ছাড়ে না, আর ত�োমার
জন্যে যে গিমা, হেলেঞ্চা নিয়ে আসে তখন?
রাধু বিকেলের দি‍কে একদিন সাইকেলে যাচ্ছে, পিছন থেকে
 100
ক্যারিয়ারে হ্যাচকা টান, ‘দাও ত�ো একটুখানি?’ চলন্ত সাইকেলে
লাফ দিয়ে উঠে নানা কসরত। কখন�ো হাত ছেড়ে সিটের ওপর,
কখন�ো আবার হঠাৎ করে কষে সামনে ঝুঁকে চাকা ধরে স্থির—‘তুই
সাইকেল খেলা জানিস?’ বিস্ময় রাধুর চ�োখেমুখে।
সন্ধ্যায় ঝুপড়ির ভিতর কের�োসিন কুপির আল�োয় সিরাজুল
মেলে ধরে পুর�োন�ো একটা অ্যালবাম। জায়গায় জায়গায় ছত্রাকে
খেয়ে যাওয়া অস্পষ্ট কয়েকখানা ছবি : ক�োথাও গলায় টাকার মালা
সাইকেলে দাঁড়িয়ে হাতজ�োড় করে নমস্কার, ক�োথাও দর্শকের সঙ্গে
করমর্দন।

‘ভানু ওস্তাদের কাছে শেখা সব।’ অ্যালবাম হাতে বাইরে বেরিয়ে


আসে সিরাজুল। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছিল�ো দু-চারটে
তারা। ‘ত�োমরা দাদাদেরকে একবার বল�ো না? ওস্তাদকেও নয় নিয়ে
আসব�ো; এখনও আশপাশে কাজ আছে কয়েক মাস।’
লক্ষ ক�োটি আল�োকবর্ষ থেকে চুঁইয়ে আসা মহাজাগতিক নীল
আল�োয় ধুয়ে যাচ্ছিল ওর মুখ...।

রাধু সেদিন স্কুলে বসেই খবর পেয়ে যায়, বসনকা আর নেই।


টিফিন বেলায় ছুটতে ছুটতে ও যখন গিয়ে ওঠে, কান্নাকাটির রেশ
থেমে গিয়ে সব চুপচাপ। সারা উঠ�োন জুড়ে গ�োবরজলের ছিটে। উঁচু
 101
দাওয়ার এক ক�োণে খাটান�ো অর্ধেক তৈরি হওয়া জালখানা।
‘আর খানিক আগে এলে না বাবা?’ বসনকার ভাইয়ের বউ এসে
দাঁড়ান। শাড়ির খুঁটে চ�োখ মুছতে মুছতে নানান কথা— ‘কেমন গুম
মেরে গেছিলেন কদিন। আজকাল ত�ো তালগাছও আর কাটতেন
না!’
চুপচাপ শুনে যায় রাধু। এরপর নেমে আসে রাস্তায়। তখনও
ছড়িয়েছিটিয়ে কিছু খুচর�ো পয়সা, চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া খই।
তালবাগানটার সামনে এসে দাঁড়ায়; নিপুণ শিল্পের নিদর্শন হয়ে
বাবুইয়ের বাসাগুল�ো হাওয়ায় একটু একটু দুলছে। তেক�োনা ভেসাল-
জালটি গু‍‌ট�োন�ো জলের ওপর। ‘বুইলে ওইই যদ্দুর দেখা যায় সব
ছিল আমাদের... তারপর ত�োমরা বাঙালরা এলে...।’ কানে ভাসছে
বসনকার কথাগুল�ো।
খালের সামনে রাধু খানিক সময় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। চ�োখ
চলে যায় পুবে, দূর ধানমাঠ ছাড়িয়ে, খাল যেখানে হাঁটুভাঙা ‘দ’
হয়ে, ক্রমশ চওড়া হতে হতে বিশাল বিল-এ গিয়ে মিশে গেছে....।
বিকেল বিকেল সেদিন প্রীতির সঙ্গে ‘লকগেটের’ ওপর দাঁড়িয়েছিল
অশ�োক। এক ফ�োঁটা নির্জনতার জন্য মাথাকুটে মরে ওরা। কখনও
মালির বাগানের ভিতরে কাপড়ের ছাপাখানার রঙিন জলের পুকুরঘাট,
কখনও বা অন্য ক�োন�োদিকে। দুজনের মেলামেশা নিয়ে পাড়া এখন
সরগরম। পয়সাওয়ালা বাপের সুন্দরী মেয়ে— স্বয়ংবর সভায় প্রার্থীর
কি অভাব? একটু একান্ত নিরালা জায়গা, সাইকেলে প্যাডেল করে
যায়। তবু কিছু দৃষ্টি নজর করে ফেলবেই। আভাসে ইঙ্গিতে ঠেস,
টিপ্পনি— সখাসখীর কী খবর? যতদিন যাচ্ছে, প্রীতি বুঝতে পারছে
গল্পের দেওয়া-নেওয়া থেকে যে সম্পর্কের শুরু, তা আজ নিশ্চিত
অন্য ক�োন�ো খাতে, যার ওপর আর হাত নেই ওর।
খালের ওপর গেটগুল�ো সেচ দপ্তর থেকে ক�োন�োকালে লাগান�ো
হয়েছিল, স্রোত নিয়ন্ত্রণের কারণে। যুগের সঙ্গেই এখনকার প্রয়�োজন
তার ফুরিয়েছে, কিন্তু গাড়ির স্টিয়ারিং-এর মত�ো প্রকাণ্ড দুট�ো কাল�ো
হুইল আজও রয়ে গেছে সিমেন্টের চাতালখানার ওপর। আর আছে
খালের ওপারে দপ্তরের জন্যে তৈরি লাল রঙের ছ�ো‍ট�ো কোয়ার্টারটি।
এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা। জল-বিছুটি, ঘাস, লতায় ভরা সাপখ�োপের
আস্তানা, রাত নামলে এই জায়গাই অপরিচিত ও আতঙ্কের।
একধাপ উঁচুতে বাঁধান�ো সিঁড়ি-চাতালটায় দাঁড়ালে অনেক দূর পর্যন্ত
 102
দৃষ্টি ছড়িয়ে যায়। খালের ওপরই রয়েছে বহু পুরান�ো একটা ব্রিজ। কত
প্রাচীন, তা নিয়েও নানান কিংবদন্তি। কেউ বলে যুদ্ধের সময় সাহেবদের
হাতে; কার�ো কথায়, তার অনেক আগেই নাকি নবাব সিরাজ ঘ�োড়ার
পিঠে এই পথ দিয়ে....। সেতুটার একধারে রয়েছে, একটা বট, কবেই
মূলকাণ্ড হারিয়ে থামের মত�ো ম�োটাস�োটা নেমে আসা ঝুঁড়িগুল�োর ওপর
আজ—বুঝি বা সেই প্রাচীনকালেরই সাক্ষী হয়ে।
সারাদিনের কাজের শেষে ক্লান্ত সূর্য নেমে যাচ্ছে বিশাল সিঁদুরের
টিপ হয়ে পশ্চিম আকাশের দিগন্তরেখায়। তারই কিছু লাল ঠিকরে
এসে খালের জলে, কিছুটা প্রীতির সাদা স্কার্ট জামায়, মুখের ওপর।
বাবার দেওয়া নতুন কমলা লেডিজ সাইকেলে প্যারেড ব্রতচারির
মাঠ থেকে স�োজা এখানে। এখন যেন পিটির সেই ‘সাবধান’ ভঙ্গিতে
অশ�োকের চ�োখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে। চাহনিতে বুঝি বেদনা
মিশে রয়েছে। — ‘কী রে কী শুনলাম, সত্যিই সত্যিই এ পাড়াকে
বিদিয় জানাচ্ছিল?
—‘কী করার আছে নয়ত�ো? এখানকার অবস্থা ত�ো দেখছিস?
তাছাড়া বাড়ির বড়ছেলে যে?
—‘চলেই যাবি?’ কেঁপে ওঠে প্রীতির গলা। অশোক বুঝি বুকের
ভেরত শিকড় ওপড়ান�োর শব্দ টের পায়।,
মেজ�োজ্যাঠার তরফ থেকে এসে গেছে খবর, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব
যেন গ�োছগাছ করে রওনা হয়ে যায়; প্রাইভেট হলেও যথেষ্ট নামী
ক�োম্পানিতে শিক্ষানবিশীর সুয�োগ— ওয়েল্ডিং, ফিটিং ইত্যাদি। তবে
মাস ছয়েকের মধ্যে পার্মানেন্ট। আপাতত দু’হাজার কিল�োমিটার
দূরে, কন্‌স্ট্রাকশান সাইটে তাঁবুর ভিতরে।
করুণ গলায় প্রীতি যেন ভাসতে থাকা শেষ খড়কুট�ো আঁকড়ে
ধরবার চেষ্টায়— ‘বলছিলাম আর কয়েকটা দিন এসব জায়গায় খুঁজে
দেখলে হত না?’
খানিক সময় শব্দহীন কেটে যায়। প্রীতি ভাবে ওর নিজেরও
কি বয়েস বসে আছে? বাড়িকে ঠেকিয়ে রাখা আর কতদিন?
আত্মীয়স্বজন, অভিভাবকদের পিছে পড়ে থাকা, পীড়াপীড়ি সব
সময়। কেউ না কেউ ক�োন�ো না ক�োন�ো খবর আনছেই। মা’কে ঠেস
দিয়ে, ‘এখনও যদি দেখাশ�োনা না করেন... বয়েস একবার পেরিয়ে
গেলে, চেহারার এ ঠাঁট আর কদ্দিন?’ এরই মধ্যে বাবার ব্যবসায়ী
বন্ধুর একমাত্র ছেলে, মামাবাড়ির তরফে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, সুয�োগ্য
 103
পাত্রের—খ�োঁজ খবর...। যদি বন্ধুটি ততদিনে নিজের পায়ের ওপর,
সাহস করে নয় বাড়িতে কথাটা একবার...। বরাবরই বুঝি মনের
দিক থেকে দুর্বল ও, মরিয়া হয়ে কিছু ভাবতে গেলেই সিঁটিয়ে আসে।
চলাফেরার ব্যাপারে সব সময়ই ত�ো ও স্বাধীন, প্যারেড ব্রতচারীর
ক্যাম্প করতে কত জায়গায়? ‘বড় হচ্ছে মেয়ে, এভাবে বাড়ির কেউ
ছাড়া....।’ মা একটু গাঁইগুঁই করলেও, বাবা পাশে দাঁড়িয়েছে, ‘কী
হয়েছে? একা ত�ো আর নয়, কত সবাই একসঙ্গে।’ আবার ওকে
দেওয়া এই স্বাধীনতাই বুঝি আরেকদিকে আবেগ উদ্দামতার পথে এক
লক্ষণের গণ্ডী। অন্তরতম ইচ্ছের বাস্তব রূপ কল্পনাতেও দেখবার মনের
জ�োর?... সত্যি বলিত পঞ্চশিলা কল�োনিতে ওদের পাকাপাকিভাবে
থিতু হয়ে যাওয়াও আকষ্মিক। শহরে যাদের বড় ব্যবসা, তারা কিনা
শেষ পর্যন্ত এ উদ্বাস্তু এলাকায়? মামাবাড়ির তরফে কিছু গান-বাজনা
সংস্কৃতির চর্চাও। ও পাড়ার সংকীর্ণ, কুচুটে কল�োনি কালচারে ওরা
যেন কিছুটা বেখাপ্পা। মা ত�ো মাঝে মধ্যেই, ‘চল�ো আমাদের ওই পুরান�ো
জমিতেই গিয়ে ঘর ওঠাই?’ শহরের দক্ষিণে মায়ের বাপেরবাড়ির কাছে
কেনা ছ’কাঠা ছাড়াও আরও নানান জায়গাতেই রয়েছে ওদের। প্রীতি
খানিক ভবিতব্যর হাতেই ছেড়ে দিয়েছে নিজেকে—পালের হাওয়া
শেষ অবধি ক�োন্‌দিকে ওর ন�ৌকাকে....?
নীচে খালের কালচে জলের স্রোতে ভাঁটার টান। বড় গাঙের সঙ্গে
সরাসরি য�োগ আছে এই খালের। জনহীন এই নিরালায় দাঁড়িয়ে ওর
খুব ইচ্ছে হয় অশ�োকের হাতখানা একটু ধরে, কিন্তু দিনের আল�োয়
চারপাশের এমন ‍খ�োলামেলায়? মনের ঝ�োঁকটা সরিয়ে দিতেই হয়।
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘মাঝে মাঝেই ছুটিতে আসবি ত�ো?’
কেমন এক অজানা আশঙ্কা, উদ্বেগ অশ�োকের বুক জুড়ে, চিনচিন
অস্পষ্ট বেদনা। কে জানে কতদূরে, ক�োথায় ক�োন্‌নির্জন ধু ধু প্রান্তর,
ইট, পাথর, যন্ত্রপাতি বুকে করে ওর জন্যে অপেক্ষায়?
একঝাঁক ভিনদেশি পাখি ছিঁড়ে যাওয়া মালার মত�ো উড়ে যাচ্ছে
উত্তর থেকে দক্ষিণে। ওরা আসা শুরু করে দিয়েছে এরই মধ্যে?
দক্ষিণ-পশ্চিম ক�োণের লাল আকাশে ক্রমশ কাল�ো হতে থাকা
বিন্দুগুল�োর দিকে চেয়ে একখানা দীর্ঘশ্বাস! ও অস্ফুটে বলে, বাড়ি
চল প্রীতি, সন্ধে হয়ে এল�ো....।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)
অলঙ্করণ : সুব্রত দাস

 104
বিদেশী বই

জন বার্জারের
পত্রোপন্যাস
তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায়

(এক)
চিঠিতে লেখা উপন্যাস ক�োনও বিস্ময়কর কথাপ্রকরণ নয়। প্রায়
সব ভাষাতেই এমন উপন্যাস আছে যা কতকগুলি চিঠির সমষ্টি;
এক চরিত্র লিখছে, অপর চরিত্র পড়ছে। চরিত্র এবং ঘটনার ঘাত-
প্রতিঘাত সম্পর্কে আমরা ততটাই ওয়াকিবহাল যতটা চিঠিতে
বলা আছে এবং যতটুকু চিঠি থেকে অনুমান করা যাচ্ছে। এ এমন
উপন্যাস যাতে সংলাপ নেই, স্বগত�োক্তি আছে। চিঠির মধ্যে যদি
 105
সংলাপ উদ্ধৃত থাকে, তাহলেও সংলাপের ভাগ কম, স্বগত�োক্তির
ভাগ বেশি। যদি পত্রলেখক একাধিক হয়, তবে অনেকের
স্বগত�োক্তি; যদি একটি চরিত্রের লেখা ‍‌চিঠিই আমাদের সম্বল হয়,
তবে উপন্যাসটি একজনেরই আত্মকথন।
ইংরেজি সাহিত্যে এই ধরনের উপন্যাসের উপস্থিতি অন্তত অষ্টাদশ
শতাব্দী থেকে। তখনকার উদাহরণ হল রিচার্ডসন-রচিত প্যামেলা
(১৭৪০)। তখনকার উপন্যাস গল্পপ্রধান ছিল বলে চিঠিগুলি মাঝে
মাঝে পাঠকের আস্থা হারাত। যখন ঘটনাগুল�ো ঘটে যাচ্ছে, তখন
প্যামেলা নাম্নী পত্রলেখিকা কাগজে কলম ছ�োঁয়ান�োর সময় পাচ্ছে
কীভাবে? এ সব প্রশ্ন দেখা দিত। পরে উপন্যাস হয়ে দাঁড়াল
মন�োময়, আত্মগত। তখন পত্রোপন্যাস বা অন্য ধরনের উপন্যাসে
আত্মকথনকে বিশ্বাসয�োগ্য করার ততটা অসুবিধা রইল না।
উপন্যাসের ঐতিহ্যের এই বিকাশকে পুর�োপুরি কাজে
লাগিয়েছিলেন জন বার্জার (১৯২৬—২০১৭) তাঁর শেষ দিকের
একটি উপন্যাসে। ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় ফ্রম এ টু এক্‌স্‌
(From A to X)। আইডা-র লেখা চিঠি, জেভিয়ার-এর কাছে।
দুজনের নামের অদ্যক্ষর যথাক্রমে A এবং X, তার থেকেই
উপন্যাসের নাম। জেভিয়ার জেলখানায় ছিল, রাজনৈতিক বন্দি।
তার প্রণয়িনী আইডা তাকে যেসব চিঠি লিখত, সেগুলি জেভিয়ার
সযত্নে তিনটি ফিতে-বাঁধা গুচ্ছে জমিয়ে রেখেছিল কারাকক্ষে।
চিঠিগুলি যে প্রকাশ করছে, তার কাছে কীভাবে এল? সেকথা বার্জার
সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় পাঠককে জানাচ্ছেন বইয়ের সূচনায়। এই ভূমিকা
উত্তমপুরুষে লেখা এবং বার্জারের উক্তি। তাই মনে হবে কাল্পনিক।
পত্রলেখিকা এবং প্রাপক ক�োনও সত্যিকার দেশের অত্যাচারী
শাসকের হাতে উৎপীড়িত বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী; উপন্যাসটাকে
মনে হবে সত্য ঘটনা। সব লেখকই ত�ো তাই চান; উপন্যাসকে
পাঠক সত্য বলে ভাবুক। উপন্যাস-পাঠের মজা ত�ো ওইখানেই।
ভূমিকায় বার্জার লিখছেন, নতুন একটি কড়া-পাহারার জেলখানা
তৈরি হল বলে শহরের মাঝখানের পুর�োন�ো জেলটা পরিত্যক্ত হল।
এই পুর�োন�ো জেলখানার ৭৩ নম্বর সেলের বন্দি সিগারেটের খালি
প্যাকেট দিয়ে সেল্‌ফ্‌ বানিয়েছিল দেয়ালের গায়ে। এই সেলফের
খ�োপে চিঠির তিনটি প্যাকেট পাওয়া যায়। ৭৩ নম্বর সেলের
এই শেষ বাসিন্দার বিরুদ্ধে অভিয�োগ ছিল, সে এক সন্ত্রাসবাদী
 106
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। তাকে দু-দুট�ো যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের
সাজা দেওয়া হয়।
সেই হল জেভিয়ার। তিনটি প্যাকেটের সব কটি চিঠি তাকে
উদ্দেশ্য করে লেখা। চিঠিগুল�ো ফিতে-বাঁধা হলেও কালানুক্রমে
সাজান�ো নয়। আইডা (এই যদি তার সত্যি নাম হয়) ক�োনও চিঠিতেই
বছরের উল্লেখ করেনি, শুধু দিন আর মাসের সংখ্যা দেওয়া ছিল।
কালানুক্রম আন্দাজ করার চেষ্টা না করে জেভিয়ারের সাজান�োর
ধরনটাই রেখে দেওয়া উচিত বিবেচনা করেছেন বার্জার। বহু বছর
ধরে চিঠিগুলি লেখা, তা ব�োঝা যায়। মাঝে মাঝে চিঠির ও-পিঠের
পাতায় জেভিয়ার কিছু ন�োট লিখেছিল। সেগুলিও ছাপান�ো হয়েছে
বক্রাক্ষরে (ইটালিক্‌স্‌)।
স্বভাবতই আইডা তার রাজনৈতিক কাজের কথা চিঠিতে গ�োপন
করে গেছে, পরিচিত ব্যক্তিদের নামও পালটে দিয়েছে নিশ্চয়।
আইডা আর জেভিয়ারের বিয়ে হয়নি। সুতরাং দেখা করার অনুমতিও
কর্তৃপক্ষের কাছে চাইতে পারেনি আইডা। কিছু চিঠি লিখেও আইডা
পাঠায়নি, বিপজ্জনক ভেবে। পাঠান�ো চিঠি আর না-পাঠন�ো চিঠি,
সবই বার্জারের হাতে আসে। কীভাবে আসে, তা তিনি গ�োপন
রেখেছেন, প্রকাশ করলে অন্যদের বিপদ ঘটবে, এই বিবেচনায়।
না-পাঠান�ো চিঠিগুল�ো তিনি নিজের পছন্দমত�ো এক জায়গায় গুঁজে
দিয়েছেন ছাপান�োর জন্য।
পরিশেষে লিখছেন, আইডা আর জেভিয়ার আজ যেখানেই
থাকুক, জীবিত বা মৃত, ঈশ্বর যেন তাদের ছায়া দুটিকে আগলে
রাখেন।

(দুই)
প্রথম প্যাকেট থেকে একটা চিঠি :
ওষুধের দ�োকানে যাচ্ছি, দেখি একটা ল�োক পথের কিনারায় বসে
আছে গ�োল ম�োড়ের কাছে, যেখানে মালবেরি গাছটা আছে পাহাড়ের
তলায়। দেখে চিনতে পারলাম না। তার পাশে প‍ড়ে আছে একটা
ভাঙাচ�োরা সাইকেল, সামনের চাকাটা ত�োবড়ান�ো। ত�োমার বয়সি
হবে, তবে একেবারেই ত�োমার মত�ো নয়।
অন্য ক�োনও ল�োকই ত�োমার মত�ো নয়। সব কিছুই একই সুত�োয়
তৈরি, আর প্রত্যেক ল�োক ভিন্নভাবে গড়ে ত�োলা।
 107
ব�োঝা গেল না সে সাইকেল থেকে পড়ে গেছে না কি সাইকেলটা
চুরি গিয়েছিল, তবে সে খুঁজে পেয়েছে। যেভাবে ছুঁয়ে আছে তা
থেকে ব�োঝা যায় অবশ্য যে সাইকেলটা ওরই। ওর প্যান্টের একটা
পা ছেঁড়া, তা থেকে মনে হয় ও পড়ে গিয়ে থাকতে পারে। ওর বাকি
জামাকাপড়ও ন�োংরা, চটি জ�োড়াও ছেঁড়া, গ�োড়ালি-ভাঙা। পড়ে
গিয়েছিল হয়ত�ো, কিংবা ও যখন ঘুম�োচ্ছিল তখন সাইকেল চুরি
গিয়েছিল, চোরটাই পড়ে গিয়েছিল।
অনেকক্ষণ ধরে একা থাকলে, যেমন আমি আছি, এই সব ব�োকা
ব�োকা বিষয় নিয়ে ভাবনা-চিন্তা চলে। তুমি আমার সঙ্গে থাকলে
সাইকেলটার কথা মাথাতেই আসত না। ওকে জিজ্ঞাসা করিনি কী
ঘটেছিল, কারণ দেখতেই পাচ্ছিলাম ও প্রাণপণে ভাবছে এর পর
কী করবে। মুখটা দু-হাতের তালুতে বসান�ো, কনুই দুট�োর ভর দুই
হাঁটুতে, আর বাঁ চটি থেকে ওর বুড়�ো আঙুল বেরিয়ে আশ্রয় খুঁজছে
ডান চটির ছেঁড়া গ�োড়ালিতে নাক ঢুকিয়ে। সিদ্ধান্ত নেবার মুহূর্ত।
এইসব মুহূর্তে ত�োমাদের পুরুষ মানুষদের এক বিশেষ মুখভঙ্গি দেখা
যায়। যেন ত�োমরা প্রাণপণে চাইছ অদৃশ্য হয়ে যেতে। আকাশে মিশে
যেতে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আত্মবলি। মেয়েরা অন্যরকম। তারা বেশিরভাগ
সিদ্ধান্ত নেয় পাছার ওপর জাঁকিয়ে বসে।
আমি নিয়েছি একটা সিদ্ধান্ত। বিয়ে করি না? তুমি আমার কাছে
প্রস্তাব দাও! আমি হ্যাঁ বলি! তারপর ওদের জিজ্ঞাসা করি। ওদের
অনুমতি যদি পাওয়া যায় তবে বিয়ের সময়ে দেখা হবে এবং তারপর
চিরকাল সপ্তাহে একবার করে ভিজিটিং রুমে সাক্ষাৎ!
প্রতি রাত্রে আমি ত�োমাকে গড়ে তুলি—একটা হাড়ের সঙ্গে আর
একটা সুক�োমল হাড় জুড়ে জুড়ে।
ত�োমার আইডা

চিঠির অন্য পিঠে জেভিয়ারের ন�োট :


বলিভিয়া। এক ক�োটি কুড়ি লক্ষ একর জমি বিতরণ করা হয়েছে
ভূমিহীন খেতমজুরদের মধ্যে। পরিকল্পনা যদি সফল হয়, তা হলে
আরও ১৪ ক�োটি ২০ লক্ষ হেক্টর জমি বিতরণ হবে ২৫ লক্ষ মানুষের
মধ্যে। গ�োটা জনসংখ্যার সিকি ভাগ। ইভ�ো ম�োরালেস, আজ রাত্রে
তুমি আমাদের এখানেই রয়েছে। এস�ো, বস�ো আমার কারাকক্ষে,
আড়াই মিটরে চওড়া, তিন মিটার লম্বা।
 108
(তিন)
দ্বিতীয় প্যাকেট থেকে একটা চিঠি :
ইয়া নুর,
তুমি সাবান পাঠাতে বলেছিলে—লিখেছিলে, এইভাবেই সাঁতারের
সবচেয়ে কাছাকাছি প�ৌঁছ�োন�ো সম্ভব। আজ সকালে পেলাম সেটা,
ত�োমার চিঠিটা। কাজেই আমি বার�োটা সাবান পাঠাচ্ছি, এই আশায়
যে তুমি অন্তত চারটে পাবে।
তামারা বলে এক বিধবা আছে, যে মাঝে মাঝে ওষুধের দ�োকানে
আসে। বয়স সত্তরের ঘরে। আজ সকালে এসেছিল ডান হাতের
তর্জনীতে কেটে যাওয়ার ক্ষত নিয়ে। খুব অল্পই কেটেছে, কিন্তু বিষিয়ে
উঠেছে খানিকটা—দু-তিনদিন আগে কেটেছে আলু কুটতে গিয়ে।
আমাকে দেখাল আঙুলটা। আর কাউকে দেখায়নি। এর মধ্যে
ওরা দুজনে—তামারা এবং তার ক্ষত—পরস্পরের স্নায়ুকে উৎপীড়িত
করছে। আমি খানিকটা মলম আর ছ�োট এক প্যাকেট অ্যাডহেসিভ
ড্রেসিং নিয়ে এলাম।
কীভাবে ড্রেসিং লাগাতে হবে তামারাকে ব�োঝালাম। সে বাঁ হাতে
আমার অনুকরণ করতে করতে হেসে উঠল।
আর একবার বল, সে অনুর�োধ করল।
আবার দেখিয়ে দিলাম এবং সে আমার অনুকরণ করল, খুব মন
দিয়ে, যেমনভাবে বাচ্চা মেয়েরা পুতুলকে সাজায়। তার ডান হাতটা
হয়ে গেছে তার পুতুল। এবার সে তার ছ�োট্ট ঘরে ফিরে যেতে পারবে
একটা পুতুল নিয়ে, ক্ষতচিহ্ন নিয়ে নয়।
ধন্যবাদ, পয়সা দিয়ে সে বলে, তুমি হলে দেবদূত।
আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, দেবদূতরা সব হাওয়া হয়ে গেছে।
আজকে পাকা খবর এসেছে যে আমাদের বিয়ের দরখাস্ত নামঞ্জুর
হয়েছে। বিধি আইবিইসি ২৭, ধারা এফ।
অনুপস্থিতিকে শূন্যতা মনে করার থেকে বড় ভুল আর নেই।
দুয়ের মধ্যে তফাত হল কালভেদের। (সে ব্যাপারে তাদের কিছুই
করার নেই)। শূন্যতা হল আগেকার, অনুপস্থিতি আসে পরে।
কখনও কখনও দুট�ো গুলিয়ে যায় আর তার জন্যই আমাদের কষ্ট
কিছুটা বেড়ে যায়।
ত�োমার
আইডা
 109
জন বার্জার

এই চিঠির উলট�ো পিঠে জেভিয়ারের মন্তব্য :


সব প্রতিশ্রুতিই ভেঙে গেছে। গরিবরা অভাব মেনে নিয়েছে
হতাশায় নয়, নিষ্ক্রিয়তার নয়। মেনে নিয়েছে অভাবের পিছনে উঁকি
দিয়ে দেখে, সেখানে নামহীন কিছু আবিষ্কার করে। সেটা ক�োনও
প্রতিশ্রুতি নয়, কারণ (প্রায়) সব প্রতিশ্রুতিই বিফলে গেছে; সেটা
একটা ব্র্যাকেট, একটা বন্ধনী, সময়ের নির্মম শ্রোতের মাঝখানে।
এই বন্ধনীগুল�ো য�োগফলই ব�োধহয় অনন্তকাল।

(চার)
তৃতীয় প্যাকেট থেকে আর একটি :
এন কে-র লেখা বইটা পেয়েছিলে কি? আমি ছাতের ওপর বসে
আছি, সূর্য অস্ত যাচ্ছে, আমি এইমাত্র ম�োবাইলে কথা বললাম
 110
আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে যাদের ওপর মর্টারের গ�োলাবর্ষণ হচ্ছে
ক্রোক�োডিল�োপ�োলিস-এ। তারা তামাশার গল্প শ�োনাল। তামাশা!
আমি ত�োমাকে ভয় দেখিয়েছিলাম দেবদূতদের গল্প শ�োনাব
বলে। এক সময়ে দেবদূতদের ডানা ছিল। কারও বার�োটা, কারও
চারটে, বেশির ভাগেরই দুট�ো। সর্বত্র ছিল দেবদূতেরা। এক হাজার
পাঁচশ�ো পঞ্চাশ দেবদূত-বাহিনী চিৎকার করে গাইত ঈশ্বরের ভজন।
তাছাড়াও শ্রমিক দেবদূতরা ছিল। সপ্তাহের প্রতিটি বার, দিনের
প্রতিটি ঘণ্টা, কম্পাসের প্রতিটি বিন্দু, প্রতিটি কাজ আর প্রতিটি
পরবের জন্য, প্রতিটি পাহাড় আর প্রতিটি পথের জন্য নির্দিষ্ট এক
একটি দেবদূত ছিল। প্রতিদিন সকালে প্রত্যেক দেবদূতের পুনর্জন্ম
হত।
মাঝে মাঝে ভাবি এই ঘন ভিড়ের মধ্যে ঘেরাও থাকতে কেমন
লাগত। ঠিক যেন উদ্বাস্তু শিবিরে থাকা!
তবে দেবদূতরা বেশির ভাগ সময়েই অদৃশ্য হয়ে থাকত। অদৃশ্য
কিন্তু অস্তিত্ব আছে—তাদের নির্দেশাবলি নিয়ে, মতামত নিয়ে,
অফুরান কণ্ঠস্বর আর ওয়েভব্যান্ড নিয়ে।
সংস্কৃত আঙ্গিরস শব্দের অর্থ পরমাত্মা। পারসিয়ান ভাষায়
আঙ্গার�োস মানে পত্রবাহক। গ্রিক ভাষায় আনজেলেস মানে দূত।
গত সপ্তাহে ভেড্‌-এর সঙ্গে দেখা। দূষিত জল খেয়ে
গ্যাস্ট্রোএনটেরাইটিস আর ডায়েরিয়া হয়েছে। ওকে নিফুর�োক্‌সাডাইজ
(দিনে ৮০০ মিলিগ্রাম) দিলাম আর কিছু ক�োপেরামাইড (দিনে ১২
মিলিগ্রাম)। ওষুধগুল�ো পকেটে পুরে সে আমাকে একটা গল্প বলল।
গুস্তাভ�ো মুচি বুড়�ো হয়েছিল, মরে গেল। ঘুমের মধ্যেই মারা গেল
এক জ�োড়া চটি সেলাই করতে করতে। এক দেবদূত তার সঙ্গে চলল
স্বর্গপথে। ক�োনও এক সময়ে দেবদূত কথা বলল। চাইলে নীচে
তাকিয়ে দেখতে পার�ো, ত�োমার জীবনের পদচিহ্নগুল�ো দেখতে
পাবে। বুড়�ো তাকিয়ে দেখল—সত্যিই দেখতে পেল নিজের পায়ের
ছাপের সুদীর্ঘ সারি। কিন্তু কী একটা দেখে তার খটকা লাগল। এ কী
করে হয়, সে জিজ্ঞাসা করল, যে দু-তিন বার অনেকটা জায়গা জুড়ে
আমার পায়ের ছাপ নেই, যেন জীবন শেষ হয়ে গিয়েছিল, আমি মরে
গিয়েছিলাম? তা কীভাবে সম্ভব? দেবদূত হেসে উত্তর দিল, সেই
ক-বার আমি ত�োমাকে ক�োলে তুলে নিয়েছিলাম।
দেবদূতেরা কথা বলে গান গেয়ে, আর সব গানই স্বপ্ন দেখে যে
 111
এক দেবদূত তাকে গাইবে।
হয়ত�ো সংগীত আর ওই ডানাওয়ালা দেবদূতরা যমজ, একটা
জন্মেছিল অন্যটার আগে। প্রথমে সঙ্গীত। আর আমরা যদি সেই
একাকিত্বের কথা বুঝতে চাই, যখন প্রথম দেবদূত জন্মায়নি আর
সঙ্গীত ছিল একা, তবে শ�োন�ো বিলি হলিডের গান!
দুর্বলতাও ছিল তাদের, এই দেবদূতদের। পঞ্চদশ শতাব্দীতে
হিসেব করে দেখা গিয়েছিল পতিত দেবদূতদের সংখ্যা ১৩ ক�োটি!
অনেকেরই পতন হয়েছিল কারণ, আসায়েল-এর মত�ো, তারা
নারীসঙ্গম করেছিল!
ঘটনাক্রম সম্পর্কে আমি এইখানে খুব নিশ্চিত নই। উলট�োটা‍‌ও
হয়ে থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে, পতনটা আগে, পরে নয়। ক�োনও
দেবদূতকে নেবার ল�োভ আমার কখন�োই হত না—কিন্তু পতিত
দেবদূতকে নেবার কথা আমি কল্পনা করতে পারি!
দ�োকানঘরে ইডেলমিস ওর চেয়ারটার জায়গা পালটে এমন
জায়গায় রেখেছে যাতে ও খ�োলা দরজা দিয়ে আইসক্রিম—কারখানাটা
দেখতে পায়। প�োড়�ো জমির ওপর দিয়ে কে হেঁটে আসছে দেখতে
ওর ভাল�ো লাগে। এখন ও রয়েছে সর্দি-কাশির ওষুধের দ্বীপে। এই
নিয়ে ও একটা ঠাট্টা করল। ও বই পড়ে, ভাবে, ঘুমে ঢ�োলে, ক�োনও
ক�োনও দিন সারা দিনে মাত্র একবার কি দুবার উঠে খদ্দেরকে
পরামর্শ বা ওষুধ দেয়। তবুও ও কিন্তু সেই একটা-দুট�ো কাজ বেছে
নেয়, কারণ, ক�োনও একটা স্তরে, ও প্রত্যেকটি লেনদেনের ওপর
নজর রাখে। কখনও কখনও আমার মনে হয়, ও শেষবারের মত�ো
আমাকে শিখিয়ে নিচ্ছে।
রাত হয়ে গেছে, বিদ্যুৎ চালু নেই। শুনতে পাচ্ছি, একটা ড্রোন
আকাশ থেকে নজরদারি করছে আমাদের ওপর, আর আমি
ম�োমবাতি নিয়ে শুতে যাবার আগে দু-হাতের মধ্যে আমার হাত
দুট�ো রাখলাম।
ত�োমার আইডা

এই চিঠির উল‍ট�ো পিঠে জেভিয়ারের মন্তব্য :


ভীতিশিল্প। গত সপ্তাহে প্যারিসে শুরু হয়েছে সালঁ দু বুর্,জ্‌
অস্ত্রভাণ্ডারের আন্তর্জাতিক বাজারের প্রদর্শনী। সফল প্রদর্শনীর
একটি উদাহরণ ছিল ক�োগিত�ো ১০০২ নামক এক সাদা ছাউনিতে।
 112
এসডিএস কর্তৃক প্রস্তুত। ওই ছাউনিতে একজন ভ্রমণকারীকে
বসান�ো হবে এবং প্রশ্ন করা হবে। তাঁকে হাত রাখতে হবে একটি
সমতলের উপর, যেটি একটি প্রাণপ্রতিক্রিয়া-নির্ধারক। প্রশ্নের প্রতি
শারীরিক প্রতিক্রিয়া ক�োগিত�ো ১০০২-তে প্রতিফলিত হবে এবং
তার থেকে ব�োঝা যাবে ল�োকটি সন্দেহভাজন কিনা। আমেরিকার
বিমানবন্দরে ব্যবহৃত। রপ্তানির জন্য প্রস্তুত। যদি আমরা এখানে
একটি ক�োগিত�ো ১০০২ আনতে পারতাম তাহলে পশুপালকদের
নিয়ে খেলা করা যেত। ওরা অবাক হয়ে যেত!

(পাঁচ)
শুধু চিঠির মাধ্যমে চরিত্রের উন্মোচন নয়, শুধু আত্মকথনের মধ্যে
অতীত স্মৃতি, কল্পিত ভবিষ্যৎ আর অনুভূত বর্তমানকে একত্রিত
করা নয়, একটি রাজনৈতিক উপন্যাসও লিখছেন জন বার্জার,
একথা পরিষ্কার। শুধু প্রকরণ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা তাঁর উদ্দেশ্য
নয়, তাঁর বিষয়বস্তু একটি সাম্রাজ্যবাদবির�োধী, স্বৈরতন্ত্রবির�োধী,
শ্রমিক এবং কৃষকের অধিকার-রক্ষার রাজনীতিকে সচেতনভাবে
প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।
জেভিয়ারের মতামত আইডার পাঠান�োর চিঠির উলট�ো পিঠের
সাদা অংশে সরাসরি প্রকাশিত। যেহেতু সে এই মন্তব্য কাউকে
পাঠাচ্ছে না, তাই তাকে সেনসরের ভয়ে রেখে-ঢেকে বলতে হচ্ছে
না। সেখানে আছে ভূমিহীনদের মধ্যে জমি বিতরণে বলিভিয়ার
ম�োরালেস সরকারের ভূমিকার (২০০৬) স্পষ্ট প্রশংসা, দরিদ্রের
অনন্ত অভাবের কথা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মারণাস্ত্র-সর্জ্জার কথা।
আইডার পাঠান�ো চিঠিগুলিকে সেনসরের বেড়া ডিঙিয়ে জেলখানায়
ঢুকতে হয় বলে সেখানে মতামত অনেক তির্যকভাবে, সুক�ৌশলে
প্রকাশ করতে হয়। সে একটা ওষুধের দ�োকানে কাজ করে, যার
মালিক হল বুড়ি ইডেলমিস। ড্রোন সহয�োগে শাসকরা নজরদারি
চালায় আইডা-র ওপর; তার থেকে ব�োঝা যায় সে রাজনৈতিক
কাজকর্মে বিরতি দেয়নি জেভিয়ার কারান্তরালে যাওয়ার পরেও।
সম্ভবত দেবদূতদের কাহিনির মধ্যে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে শাসকদের ব্যঙ্গ
করা আছে। যে চিঠিগুল�োয় খ�োলাখুলি সরকার বা সৈন্যবাহিনীর
বিরুদ্ধে প্রতির�োধের কথা আছে, সে চিঠিগুলি জেভিয়ারকে পাঠান�ো
সম্ভব নয় বলেই আইডা পাঠায়নি। সে রকম একটি চিঠিতে উল্লেখ
 113
আছে, আইডা এবং তার মত�ো আরও অনেক বৃদ্ধা শ্রমিক/কর্মচারী
একটি বন্ধ কারখানার সামনে পিকেট করে সামরিক ট্যাঙ্ক-বাহিনীকে
ঢুকতে বাধা দিচ্ছে, যাতে তারা কারখনায় ঢুকে বিদ্রোহীদের গ্রেপ্তার
করতে না পারে। সাতজন আশ্রয় নিয়েছে ভাঙা কাখানার শেডে,
যাদের আইডা বলছে ‘‘আমাদের ল�োক’’। ওপ‍রে চক্কর দিচ্ছে
গ�োলবাহী হেলিকপ্টার, মাটিতে ট্যাঙ্ক। অতএব মহিলারা অবস্থান
করছেন ছাত জুড়ে, কারখানা ঘিরে। মুখে মুখে খবর ছড়িয়েছে,
আরও আরও মহিলা এসে প্রতির�োধকে দৃঢ়তর করছেন। তাঁদের
ওপরে গোলাগুলি না চালিয়ে সাতজন বিদ্রোহীকে শেষ করতে
পারবে না কেউ। শেষ পর্যন্ত প্রতির�োধ জয়যুক্ত হল, হেলিকপ্টার
আর ট্যাঙ্ক ফিরে গেল। এক ঘণ্টা পরে সুয�োগ বুঝে সেই সাতজনও
কারখানা ছেড়ে অন্য নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেল। নিরস্ত্র প্রতির�োধের
জয় বিনা রক্তপাতে ঘটেনি অবশ্য। দশ মিনিট পরে মুখে মুখে খবর
এল, আরও যে মহিলারা পিকেটে য�োগ দিতে আসছিল, পথে তাদের
ওপর গুলি চলেছে। গুলিতে মারা গেছে সংগীতশিক্ষিকা ম্যান্‌ডা।
কিন্তু ক�োন দেশে ঘটছে এ সব? এই সেনা-সন্ত্রাস, এই প্রতির�োধ,
এই কারাবাসে য�ৌবন থেকে বার্ধক্যে উত্তরণ? চরিত্রগুলির নাম থেকে
ব�োঝা যাবে না, কারণ নামগুলি বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির সূচক।
জেভিয়ার নামটি ক্যাথলিক, আইডা নামটি আরবি। এমন ক�োনও
দেশ যেখানে ক্যাথলিকরা সংখ্যালঘু, মুসলমান সংখ্যাগুরু? অথবা
উভয়েই সংখ্যালঘু কিংবা নিপীড়িত? চট করে প্যালেস্টাইনের কথা
মনে পড়বে, কিন্তু বার্জারের বর্ণিত দেশ দক্ষিণ আমেরিকা বা মধ্য
ইউর�োপে হওয়া অসম্ভব নয়; আবার তুর্কি, সিরিয়া, ইয়েমেন,
ইরাক হতে পারে, মিয়ানমারই বা নয় কেন? আমরা কি হলফ করে
বলতে পারব, আসামের কনসেনট্রেশন শিবিরগুলিতে, বা কাশ্মীর ও
লাডাখের গ্রামাঞ্চলে নরনারীর দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমরা
খুব ওয়াকিবহাল? এই ২০২১ সালে?
চিঠিগুলির সম্বোধন থেকেও নির্দিষ্ট অনুমান সম্ভব নয়। অনেক
চিঠিতে ক�োনও সম্বোধনই নেই। মি গুয়াপ�ো (ওগ�ো সুন্দর), মি
গ�োল�োন্দ্রিন�ো (আমার স�োয়াল�ো পাখি), স�োপল�োতে (ওয়েল্‌ডার,
কারণ জেভিয়ার কর্মজীবনে ওয়েল্‌ডার ছিল) সম্বোধনগুলি
স্প্যানিস ভাষার। ক�োথাও বা আইডা জেভিয়ারকে বলেছে ভূমিস্থিত
সিংহ অর্থাৎ বহুরূপী, কারণ ইংরেজি চ্যাম�োলিয়ন কথাটার ম�ৌল
 114
গ্রিক অর্থ আক্ষরিকভাবে তাই, সে সিংহ মাটিতে হামাগুড়ি দেয়।
আবার অন্যত্র আইডা সম্বোধন করেছে হাবিবি (প্রিয়তম) কিংবা ইয়া
নুর (আমার আল�ো) বলে। দুটি শব্দই আরবি। উল্লেখ্য, ১৯৯০-এর
দশকের একটি জনপ্রিয় আরবি গানের প্রথম কলি ছিল ‘‘হাবিবি ইয়া
নুর-এ-আইন,’’ সেখান থেকেই শব্দ দুটি এসেছে। আরবি ভাষায় কথা
বলে অন্তত কুড়িটি দেশ, স্প্যানিশ ভাষায় কথা ব‍লে মধ্য ও দক্ষিণ
আমেরিকার প্রায় সব দেশ, তা ছাড় পেল ও মেক্‌সিক�ো। তা হলে
ক�োথায় বাস করে বার্জারের চরিত্ররা? পৃথিবীর সবখানেই কি আছে
তারা? আইডা পছন্দ করে মার্কিন জ্যাজ্‌সঙ্গীতশিল্পী বিলি হ্যালিডের
(১৯১৫—১৯৫৯) গান, মুগ্ধ হয় বর্তমান তুর্কির প্রধান মহিলা-কবি
কুর্দিশভাষিণী বেজান মাটুর (জন্ম ১৯৬৮)-এর কবিতা পড়ে।
পরিকল্পনা করেই কি আইডার রুচিকে আন্তর্জাতিক করে তুলেছেন
জন বার্জার? বিপ্লবীদের ক�োনও দেশ নেই, এই কি তাঁর বক্তব্য? তাঁর
কাল্পনিক চরিত্রগুলিকে বিশ্ববিপ্লবের প্রতীক হিসেবে দেখি, এই কি
তাঁর অভিপ্রায়?
উপন্যাসে, শিল্প-সমাল�োচনায় এবং অন্যত্র নিজের রাজনৈতিক
ঝ�োঁক কখনও গ�োপন রাখেননি বার্জার। সাম্রাজ্যবাদের ও একচেটিয়া
পুঁজির প্রশ্রয়দাতা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গ�োড়া থেকেই লিখছিলেন
বলে তাঁকে প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করতে প্রতিক্রিয়াশীলরা দেরি
করেনি, যদিও তিনি কখনও কমিউনিস্ট পার্টি বা অন্য ক�োনও
রাজনৈতিক দলের নথিভুক্ত সদস্য ছিলেন না। তাঁর প্রথম উপন্যাস
‌আ পেইন্টার অব আওয়ার টাইম (১৯৫৮) যেহেতু তথাকথিত
‘মুক্ত’ দুনিয়াতে শিল্পীর আত্মপ্রকাশের সমস্যাগুলি তুলে ধরেছিল,
তাই কুখ্যাত কমিউনিস্টবির�োধী প্রতিষ্ঠান কংগ্রেস ফর কালচারাল
ফ্রিডম বইটির বিরুদ্ধে এমন চাপ দিতে থাকে যে প্রকাশক বাধ্য হন
বইয়ের সব কপি দ�োকান থেকে সরিয়ে নিতে। ব্রিটিশ সমাজ সম্পর্কে
বীতশ্রদ্ধ বার্জার ১৯৬২ সালে দেশত্যাগ করেন। আর ফেরেননি।
বুর্জোয়া সমাজের সমাল�োচনা দ ফুট অব ক্লাইড (১৯৬২) এবং
জি (১৯৭২) উপন্যাসেও উপস্থিত। পিগ আর্থ (১৯৭৯) প্রমুখ
উপন্যাসত্রয়ে বিধৃত কৃষকজীবন। এই সৃষ্টিবহুল পথ ধরে এসেছে
শেষ জীবনের কাজ ফ্রম এ টু এক্‌স্‌। তাঁর পক্ষপাত খেটে-খাওয়া
মানুষের দিকে, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রাখেননি বার্জার।
আর খেটে-খাওয়া মানুষের বন্ধন যে আন্তর্জাতিক, সে চেতনা
চরিত্রদের নাম এবং চিঠির সম্বোধনেও প্রতীয়মান।

 115
সি নে মা র ভা ষা

“আমাদের”
আর “ওদের”
সংলাপ...
অরুণাভ গাঙ্গুলি

চি ত্রনাট্যের আরও একটি দিক হল সংলাপ। দৃশ্যের মাধ্যমে


কাহিনী বা কথা বলার সময় সংলাপের দরকার হয়। আর
এই সংলাপের পরিমিতি প্রয়�োগ ও দরকার। সংলাপ যেমন
একটা মাধ্যম, আবার সংলাপ সেই চরিত্রের এর একটা পরিচয়।
ক�োন চরিত্র কি ভাবে, কি ভাষায় কথা বলবে সেটা অনেক কিছুর
উপর নির্ভর করবে, যেমন কাহিনী বা ঘটনার সময়কাল, চরিত্রের
সামাজিক অবস্থান, ক�োন চরিত্র কি রকম সামাজিক অবস্থার থেকে
আসছে তার সংলাপও সেরকম হতে হবে। তাই সংলাপের ভাষা
খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ তার সংলাপই তার পরিচয়। অনেক
সময় সংলাপ সরাসরি চরিত্রের মুখে না হয়ে সেটা অফস্ক্রিনও হতে
পারে। যেমন সে বসে আছে বা ঘুরে বেড়াছে, আর তার মনের
কথাগুল�ো অফস্ক্রিন শুনতে পাচ্ছি। কখনও তার পুরান�ো ক�োন
স্মৃতি হতে পারে বা বর্তমান সময়ের ক�োন আত্মকথনও হতে পারে।
সেটা কথা হতে পারে, কবিতা বা গানও হতে পারে। আবার লং শট
বা ক্লোজ শট এর ক্ষেত্রে তার শব্দ আসতে বা জ�োরে শুনতে পারি,
সেটা পরিচালকের উপর নির্ভর করবে।
শট বিভাজনের সময় ঠিক করতে হবে সংলাপের সময় আমরা কি
দেখব। অর্থাৎ যার সংলাপ তার মুখ না যাকে বলছে তার অভিব্যক্তি,

 116
নাকি দুজনকেই দেখতে পাব�ো। ক�োথায় কথা বলছে সেই পরিবেশ
বা তার অবস্থানও দেখাব�ো, এগুল�ো ঠিক করে নিতে হবে। সংলাপ
লেখার সময় তার তথ্য, আবেগ, নাটকীয়তা সেগুল�োও মনে করে
তার সংলাপ লিখতে হবে। টেলিফ�োনে কথা হলে কি দুজনকেই
দেখতে পাব�ো না একজনকে দেখব আর দুজনের কথা শুনতে
পাব�ো, সেটাও লিখে রাখতে হবে। এরকম অনেক খুঁটিনাটি বিষয়
চিত্রনাট্য লেখার সময় ঠিক করে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে
যিনি কথা বলছেন তাঁর সংলাপের মধ্যে দিয়ে যেন তাঁর নিজের
কথা বলার ধরন বা স্টাইলকে বজায় রাখা। তাঁর মনের অবস্থা তাঁর
আবেগ যেন ধরা পরে তাঁর সংলাপে। সংলাপ লেখার সময় দেখতে

 117
হবে তিনি কি কিছু গ�োপন করতে চাইছেন, তাহলে তা একরকম
হবে। আবার তিনি কি কিছু ব�োঝাতে বা প্রভাবিত করতে চাইছেন?
নাকি তাঁর কথার মধ্যে ক�োন দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব আছে? সব কিছুর মধ্যে
দেখতে হবে যে তিনি সে কথা বলার সময় কি করছেন, অর্থাৎ তাঁর
অ্যাকশনগুল�ো কি কি থাকবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সব কথা বা
সংলাপ যেন স্পষ্ট উচ্চারণ হয় ও স্পষ্ট শ�োনা যায়।
সংলাপ আছে সেরকম সব দৃশ্যগুলিতে শট বিভাজন আগে থেকে
পরিকল্পনা করে নিতে হবে। যেমন পুর�ো সংলাপ একটা মাস্টার
শটে নিয়ে, পরে তা আবার ক্লোজ শটে নিয়ে নিতে হলে তা আগে
থেকে পরিকল্পনা দরকার। সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, সংলাপ
মাস্টার শটে বলেছিল, তা আবার ক্লোজ শটে বলতে হবে। যাতে
এডিট করার সময় ক�োন অসুবিধা না হয়। যাঁর উদ্দেশে কথা বলছেন
তারও কিছু ক্লোজ শটে প্রতিক্রিয়া নিয়ে রাখতে হবে। ক�োন দীর্ঘ
সংলাপ থাকলে সে ক্ষেত্রে কি কি মুভমেন্ট বা ঘটনা থাকবে লিখে
রাখতে হবে। কখন ক্লোজ শট নেব আর কখন লং বা মিড শট হবে
সেটা নির্ভর করবে কখন কার কথা এবং ক�োন কথাকে গুরুত্ব দিতে
হবে তার উপর। আবার এমনও হতে পারে যিনি শুনছেন তাঁর
গুরুত্ব বেশি, তখন তাঁর ক্লোজ শট লাগবে। সংলাপ দিয়ে তথ্য
পরিবেশনের একটা ঝ�োঁক লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু মনে রাখতে হবে
কতটা দৃশ্য বা ঘটনা দিয়ে তা করা যায়।
সে কারণেই ক্যামেরার ব্যবহারকে আরও কার্যকরী করে তুলতে
হবে। কারণ এই ক্যামেরার ব্যবহারই পারে দৃশ্যকে আরও সার্থক
করে তুলতে। কখন ক্যামেরা ট্র্যাক করে চলাচল করবে এবং
তার ফলে যে দৃশ্য মুহূর্ত তৈরি হবে যা সেই ভাবনাকে সার্থক রূপ
দেবে। আমরা হিচকক-এর সিনেমায় যে ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার
দেখেছি, যখন তাঁর কাহিনীকে আরও সার্থক করে তুলেছে। যেমন
“ভার্টিগ�ো’’ সিনেমায় একটা সমস্যার সন্মুখীন হয়েছিলেন। যখন
ক�োন মানুষ উপরে উঠে তখন তাঁর মাথা ঘ�োরে – এটাই ভার্টিগ�ো,
এটা একটা অসুখ। এখন এই অনুভূতি তিনি দর্শকের মধ্যে কি
করে নিয়ে যাবেন। সেটা দেখাতে একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন।
ক্যামেরা ট্র্যাক করার সময় সামনের দিকে এগিয়ে যায়, তাতে ফ্রেমটা
বদলে যায়। ক্যামেরা মূল বস্তুর দিকে এগিয়ে যায় চারপাশটা ক্রমশ
কমে যায়। হিচকক কি করলেন, ক্যামেরা যতটা ট্র্যাক ফরওয়ার্ড
 118
করলেন ততটাই জুম আউট করতে লাগলেন। তাতে ফ্রেমটা একই
থেকে গেল। আপাতভাবে মনে হবে ক�োন কিছু ঘটছে না কিন্তু দর্শক
একটা গতি অনুভব করবে। মনে হবে একটা ব্যাকগ্রাউন্ড সরে সরে
যাচ্ছে – এতেই সেই ভার্টিগ�ো পরিস্থিতিটা দর্শক অনুভব করল�ো।
স্পিলবার্গও এইভাবে তাঁর জস সিনেমায় ব্যবহার করলেন। অর্থাৎ
ক্যামেরার ব্যবহারের উপর অনেক অনুভূতি রচনা করা যায়। দরকার
পরিচালকের সেই সৃষ্টিশীল মন। যেমন গ�োদার তাঁর সিনেমায় তিনটি
পদ্ধতি ব্যবহার করতেন, ১ ইচ্ছাকৃত বাধাদান ২ দ্বন্দ্ব অর্থাৎ যেটা
একটা দৃশ্যে দেখাচ্ছে বা সাউন্ড ট্র্যাকে ব�োঝান�ো হচ্ছে পরমুহূর্তেই
ঠিক তার বিপরীত কিছু দেখান�ো বা শ�োনান�ো হচ্ছে রিফ্র্যাকশান।
ক�োন বস্তুর মধ্যে দিয়ে আল�ো গেলে তা যেমন বেঁকে যায় খানিকটা
সেরকম একটা বিষয়। এর মধ্যে দিয়ে তিনি বাস্তব ও সিনেমার
ফারাকটা তুলে ধরতেন।
সিনেমার আধিপত্যকারী ভাষার প্রতিবাদে গড়ে উঠল
নিওরিয়ালিজম। এ যুগে প্রচলিত অনেক সিনেমার নিয়ম ও ব্যাকরণ
বদলে দিল। যেমন স্টুডিও থেকে ক্যামেরা বাইরে গেল। দ্বিতীয়ত,
 119
যে অভিনয় করান হল এমন সকলকে দিয়ে যাঁরা সাধারণ রাস্তার
মানুষ। যেমন ডিসিকার “বাইসাইকেল থিফ” সিনেমার মূল চরিত্র –
বাবা, তিনি কিন্তু অভিনেতা ছিলেন না। এভাবেই এক বাস্তবতাকে
সিনেমায় রূপ দিলেন। এই ধারায় আন্দ্রে বাজা বা ফেলিনির ও
আন্তনিওনির প্রথম দিকের বেশ কিছু সিনেমায় খুবই প্রভাব পড়ল।
৪০ থেকে ৫০-এর দশক পর্যন্ত এই নিওরিয়ালিজমের ধারার পর
৬০-এর দশকে এল নুভেলভাগ বা নবতরঙ্গ। কাহিনী ও কাহিনীর
বাইরে গিয়ে সিনেমা এক এক নতুন ভাষার জন্ম দিল। সিনেমাকে
সাহিত্যের হাত থেকে মুক্ত করে সিনেমার ভাষাকে আরও বিকশিত
করার প্রয়াস চলতে লাগল�ো।
বিভিন্ন সময় জুড়ে সিনেমার যাঁরা নতুন নতুন ভাষা দিয়েছেন,
সেই সকল স্রষ্টা যাঁরা আসলে তাঁর যুগের তাঁর সময়ের ভাষাকে
অনুভব করেছিলেন। নিজের সময়কে এড়িয়ে গিয়ে শিল্পের জন্য
শিল্প নির্মাণে নিজেদের আটকে রাখেননি। সময়কে প্রশ্নহীনভাবে
দেখেননি। তাই তাঁদের সিনেমার ভাষায় আঙ্গিকে নতুন নতুন ধারার
জন্ম নিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এসেছিল নিওরিয়ালিজম।
হলিউডের আধিপত্যের সাহিত্যধর্মী ধারা, বৈভব এবং স্টুডিও-
নির্ভর সিনেমার জগৎ। বিভিন্ন দেশের মত�ো ফরাসি দেশেও তার
প্রভাবে বিপর্যস্ত। তারই প্রতিক্রিয়ায় ক্যামেরা বাইরে এল�ো, প্রকৃতির
আল�োয় তৈরি হল নুভেলবাগ সিনেমা। সমাজ বিচ্ছিন্ন সিনেমা হয়
না। হয় সে নানা আঙ্গিকে অনেক কিছু আড়াল করে, আর নয় সে
নানা আঙ্গিকে অনেক কিছুকে উন্মুক্ত করে।
“প্রতি যুগেই যে সব ধারণা আধিপত্য করেছে তারা চিরকালই
তখনকার শাসকশ্রেণীরই ধারণা” কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহারে একথা
বলা হয়েছে। আর সেভাবেই ধারণা বা ভাষার ব্যাবহার ও তার
প্রকাশ হয়ে আসছে সেই সেই সমাজের ধারণা। সিনেমা বা শিল্প
সংস্কৃতি তার বাইরে নয়। তাই সেই সময়ের শাসকের ধারণার উপর
আশ্রয় করে যেমন মূল ধারার সিনেমা বা শিল্প সৃষ্টি হয়ে এসেছে,
তেমনই কখন�ো কখন�ো ক�োন স্রষ্টার সৃষ্টিতে এসেছে ভিন্ন ধারার ভিন্ন
ধারণার প্রতিফলন। লাতিন আমেরিকার সিনেমায় যেমন ভিন্ন ধারার
প্রতিফলন দেখতে পাই। সাম্রাজ্যবাদের কবলে ডুবে থাকা দেশের
অভিমান ও প্রতিবাদ ফুটে ওঠে কিছু পরিচালকের মাধ্যমে। যেমন
মিগুয়েল লিত্তিন, ফারনেন্দো স�োলানাস ও অক্টেভিও গেতিন�োর
 120
মত�ো পরিচালকের মাধ্যমে। মিগুয়েল লিত্তিন এক সভায় সিনেমা
নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলছেন “জনসাধারণের মুক্তিসংগ্রামই হবে
আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাণের কেন্দ্রীয় বিষয়। চলচ্চিত্রকারদের এই
সদিচ্ছার সঙ্গে জনগণের বিপ্লবী চেতনা যুক্ত হয়ে জন্ম নেবে নতুন
চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব।’’ এই সকল ধারনাই হল সেই সমাজের যে
ধারণার আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক নতুন ধারণা। স্বাভাবিকভাবেই সেই
ধারণা থেকে গড়ে উঠা সিনেমার ভাষা ও আঙ্গিকে প্রচলিত ধারার
বিপরীতে এক নতুন প্রয়াস। যেমন ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায় আমরা
পাই এক ভিন্ন ধারার নির্মাণ শৈলী। যেখানে তার ক্যামেরার ব্যবহার
থেকে অভিনয় ধারায়ও আসে এক নতুন ভাষা। এই সিস্টেমের ভাষা
আর সিস্টেমের বিরুদ্ধে কথা বলার ভাষা আলাদা হবেই। প্রতিষ্ঠিত
সমাজের প্রগতিশীল শাখার অন্তর্ভুক্ত সিনেমার ভাবখানা এরকম,
যেন সমাজের যাবতীয় সংঘাত আপনা-আপনি মিটমাট হয়ে যাবে,
ক�োন এক শান্তিপূর্ণ উপায়ে। ফলত সেই সকল সিনেমার ভাষাও
তেমনই সাযুজ্য রেখে গড়ে উঠে। কিন্তু শ্রেণি-স্বার্থের দ্বন্দ্ব, শিল্প-
সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র সাড়া না দিয়ে পারে না। কাজেই যে কথাটা
উঠে আসছে “ওদের’’ আর “আমাদের” সংস্কৃতি। “ওদের’’
আর “আমাদের” সিনেমা। কিন্তু আধিপত্যকে পাকাপ�োক্ত করতে
গিয়ে শ�োষকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, তুমি যদি সফল হতে চায় ত�ো
তাহলে নিজেকে আমার আদলে গড়ে ত�োল�ো। তুমি যদি সিনেমা
নির্মাণ করতে চাও ত�ো আমার আদলে আমার ভাষায় সিনেমা কর,
তাহলেই ত�োমার সাফল্য আসবে। তখন একথা ও অভিয�োগ উঠে
আসবে সিনেমার আবার “ওদের’’ আর “আমাদের” হয় নাকি
সিনেমা সিনেমাই। অর্থাৎ গণতন্ত্রের বাগাড়ম্বর কথা বললেও,
আসলে আমার আদলে একই ছকে সকলকে কথা বলতে হবে।
আবার কেবল মাত্র দুট�ো আলাদা ভাষা ব্যবহারের কারণে সংস্কৃতি
আলাদা রূপ ধারণ করে না। সংস্কৃতি ও দর্শনের ভিন্ন ভিন্ন ধ্যান-
ধারণা ও চিন্তা–ভাবনার মধ্যে দিয়ে তার রূপান্তর হয়। তাই
সিনেমার ভাষা সিনেমার আঙ্গিক সিনেমার নির্মাণ শৈলী এই সব
কিছু নির্ভর করবে পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গির উপর। আর এই সকল
নানান প্রশ্ন আর সংঘাতের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠতে পারে নতুন
ভাষা নতুন সিনেমা।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)
 121
রম্য রচনা

পরিণয়মঙ্গল, শঙ্খ ঘ�োষ


আর ডুপ্লিকেট
শরৎচন্দ্র বৃত্তান্ত
সিদ্ধার্থ মুখ�োপাধ্যায়

য তীন্দ্রম�োহন গুপ্তের মতে, ১৩০৪ বঙ্গাব্দে কলকাতায় রাজা


সুব�োধ মল্লিকের বিয়ের সময় প্রথম পদ্য ছাপান�ো হয়েছিল।
বিশ শতকে বিয়ের পদ্য খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল�ো।
বিয়ের আমন্ত্রণপত্রে লেখা হত�ো পদ্য। যেমন, ‘বন্ধু ত�োমায় জানাই
খবর হয়ত�ো তুমি হাসবে। ৮ই ফাগুন আমার বিয়ে নিশ্চয় তুমি
আসবে।’
বাঙালির বিয়ে মানে সাহিত্য আর সংস্কৃতির ভুরি ভুরি
আয়�োজন। গান, কবিতা, ছড়া আর হরেক রকম গদ্য ছন্দ দিয়ে
সাজান�ো থাকত�ো বিয়ের আসর। এছাড়াও থাকত�ো নানারকমের
সাংস্কৃতিক আয়�োজনও।
বিয়ের চিঠি, আশীর্বাদ পত্র, তত্ব, উপহারের বইয়ের প্রথম
পাতাতে ত�ো বটেই, কবিতা-ছড়া-পদ্য থাকত ছাঁদনাতলার
 122
আলপনার সঙ্গে, নাপিতের মন্ত্রে, বাসর ঘরের আসরে এমনকি
পালকি বেহারার গানে।
কে না লিখেছেন বিয়ের পদ্য? রবীন্দ্রনাথ, কুমুদরঞ্জন মল্লিক,
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (‘বিচিত্রা’ পত্রিকার সম্পাদক), হেমেন্দ্র
কুমার রায়, শিবরাম চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী...মায়
স্বপন কুমার। এবং শঙ্খ ঘ�োষ!
ক্রমাগত হারিয়ে যেতে বসেছে এসব বৈবাহিক সাহিত্য ও
সাংস্কৃতিক আয়�োজন। বিস্মৃতির অতলে মিলিয়ে যাবার আগে
একবার ফিরে দেখা।

সেই কিশ�োর বেলা!
অনুষ্ঠান বাড়ি ভরাভর্তি ল�োকজন। বারান্দার একক�োণে
একদঙ্গল কিশ�োরী দারুণ ‘সিরিয়াসলি’ খেলছে “এলাটিং বেলাটিং
সই ল�ো...”।
রাজা ক�োন বালিকার খবর নিয়েছে জানার আগেই নজর গেল
সেই একা হয়ে পড়া বালকটির দিকে। অপুর মত�ো হাঁ করে হয়ত
কিশ�োরীখেলা দেখছে।
ব্যস, দলের সবচেয়ে পাকা বালিকাটি এগিয়ে আসত�ো র‌�াগিংয়ের
অভিপ্রায়ে। অপেক্ষাকৃত কাঁচা বালকটিকে প্রশ্ন করত ঃ “এই ছেলে,
‘বাটা’ বানানটা কী বল ত�ো?’’
পুজ�োয় চাই নতুন জুত�োর পাতা জ�োড়া বিজ্ঞাপনের আর মুখ�োশ,
রঙিন কাগজের চশমার ‘গিফটের’ সুবাদে বাটা খুবই পরিচিত নাম।
ছেলেটি বলেই দিত —
“বি এ টি এ।’’
মেয়েটি এবং অন্যরা তখন সমস্বরে বলত, ‘‘এম্মা, কী অসভ্য...
বিয়েটিয়ে বলছে !’’
কুসুম কুসুম প্রশ্নশরে কচি খ�োকার গন্ডদেশ কুসম কুসম
লজ্জারুণ!
কেচ্ছার ত্রিবেণী সঙ্গম হত�ো ঠিক তখনই। কলেজ পড়ুয়া
মেজমামা সেখান দিয়ে যাবার সময় হাওয়ায় ছুঁড়ে দিতেন -
“তুই আবার ‘লাভ ইন ট�োকিও’র প�োজ দিলি কেন রে ?’’
বিয়ে শব্দটার মধ্যেই কেমন একটা টুংটাং...ঝিমঝিম ‘অব�োধা
ব�োধ’ ছিল। লজ্জা-আনন্দ-ভয় ইত্যাদির বিবিধ মশলার আখনির
 123
জল মেশান�ো যেন।
বিয়েটিয়ের মধ্যে একটা আল�োছায়া আছে, সেটা বালক বয়েসেই
ব�োধগম্য হত।
কিশ�োরী দিদিদের পারস্পরিক ফিসফাসে শুনতাম, ‘‘জানিস,
বকুল দিদিকে দেখতে এয়েছিল ?’’
এই সব বকুলদি, বিন্তিদি, টুকুনদিরা বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠলে
ওদের ধিঙ্গিপনা বন্ধ হয়ে যেত। বাড়িতে লাজুকলতা হয়ে বসে
থাকতে হত।
ছেলেরা র�োজগারপাতি করলেই ‘পাত্র’ হয়ে ওঠে। ওদের অবশ্য
লজ্জাভাব দেখাতে হয় না, তবে আমার কাকা-মামাদের বিয়ের কথা
উঠলেই বলতে শুনেছি, ‘‘আমি বিয়ে করব না।’’ অন্ততপক্ষে,
‘‘এখন বিয়ে-ফিয়ে করব না।’’
যাই হ�োক, একসময় বিয়েফিয়ে হয়ে যেত এবং বেশ ক’দিন
আগে থেকেই ব�োঝা যেত, বাড়িতে বিয়ের ফুল ফুটতে চলেছে।
এক্কেবারে যাকে বলে ‘ঠাস ঠাস দ্রুম দ্রুম শুনে লাগে খটকা,
ফুল ফ�োটে?...’র মামলা!
হ্যাঁ, বিয়ের ফুল নিঃশব্দে ফুটত না। চ্যাঁচামেচি, ঠাট্টা-মশকরা,
ঝগড়াঝাটি, নাপিতের ছড়া, সানাইয়ের প�োঁ, শাঁখের ভ�োঁ, হাঁকাহাঁকি,
ডাকাডাকি এরকম নানা শব্দ সমন্বয়ে বিবাহকার্য সমাধা হত আমাদের
ছেলেবেলায় — যখন ক্যাটারিং প্রথা চালু হয়নি, চালু হয়নি বিভিন্ন
প্যাকেজ। ভাগ্যিস।
সম্প্রতি কাগজে দেখলাম, কনের পিঁড়ি ধরার ল�োকও প্যাকেজে
পাওয়া যাচ্ছে। হয়ত বাসর জাগার ল�োকও এল বলে!
ফুল ফুটলে ভ্রমর আসে। বিয়ের ফুলে ঘটক।
ক্ষিতিশ ঘটক...নরেন ঘটক।
বাড়ির ছেলেরা অর্থ-র�োজগেরে আর মেয়েরা ‘স�োমত্থ’ হলেই
গ�োলচশমার বুড�়োরা হাজির হত। নাকে নস্যি, হাতে খাতা। অমুক
বাড়ির তমুক বাড়ির বংশ পরিচয়, কুলুজি ব্যাখ্যা করত। তারপর
পাত্রীর গুণপনা।
পাত্রীর গুণাবলির মধ্যে রাঁধাবাড়া, সেলাইফ�োঁড়াই ত�ো বড়াই করে
বলা হতই, ‘হারম�োনিয়াম বাজিয়ে গানও গাইতে পারে’— এটা হল
এক্সট্রা ক্যারিকুলার অ্যাকটিভিটি। আর যদি গিটার বাজান�ো জানে
(“নূপুর বেজে যায় রিনিরিনি’’ বা “ম�োমের পুতুল মমির দেশের
 124
মেয়ে’’), অফিসার গ্রেড ছাড়া পাত্র ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হত�ো না!
মামার বাড়িতে আমার এক মামাত�ো দিদি প্রাণপণে তিনটি গান
প্র্যাকটিস করত— ‘ত�োমারি গেহে পালিছ স্নেহে’, ‘ক�োন কূলে আজ
ভিড়ল তরী’ আর ‘মায়ের পায়ের জবা হয়ে’। রবীন্দ্র-নজরুল-
শ্যামাসঙ্গীত। সকালবেলা গান প্র্যাকটিস হয়ে গেলে মামিমা ওর
মুখে দুধের সর আর মধু মাখিয়ে দিত। দিদি এরপর রান্নাঘরে গিয়ে
ঝিরিঝিরি ডুম�োডুম�ো, ফালি ফালি তরকারি ক�োটা প্র্যাকটিস করত।
আমার জন্ম দেশভাগের পরে। কিন্তু জ্ঞান হবার পরই বুঝতে
পেরেছিলাম আমার গুরুজনরা ওদের শরীর-সত্তায় ফেলে আসা
গ্রাম বহন করে চলেছেন শামুকের মত�ো। পাত্র পরিচয়ে বলা
হত ‘বজ্রয�োগিনীর অমুক মুখুজ্জ্যার বড় হিস্যার তমুকের মাইজ্যা
প�োলা’। এই মাইজ্যা প�োলা হয়ত�ো থাকে যাদবপুর কিংবা বিডন
স্ট্রিটে।
বিয়ের চিঠিতেও লেখা হত— কিশ�োরগঞ্জের অমুকের পুত্রের
সহিত বার�োদির তমুকের কন্যা... ইত্যাদি। এই সব কিশ�োরগঞ্জ
-বার�োদির গ্রামগুল�োর সঙ্গে ক�োনও সম্পর্কই নেই... শুধুই স্মৃতির
সম্পর্ক। আর স্মৃতির সম্পর্কেই বেঁচে ছিল কিছু শব্দাবলি।
আহা, একেই বুঝি ওয়েলশ ভাষায় বলে ‘হিরাইফ’( Hiraeth)!
বিয়ের দিন এগিয়ে এলে বাড়িতে যে আত্মীয়স্বজনরা আসতেন,
ওঁদের বলা হত নায়রী। ‘নাও’ হল ন�ৌকা। খালবিল নদীর দেশে ওঁরা
ন�ৌকাতেই ত�ো আসত। তাই নায়রী। এঁরা ‘ম�োলা’ বাঁধতেন— মানে
ম�োয়া। গুড় জ্বাল দিয়ে মুড়ির ম�োয়া তৈরি করে টিনের ক�ৌট�োয় ভরা
হত। অতিথি-অভ্যাগতের জন্য এটাই ছিল জলখাবার।
বাবার এক মামিমা ছিলেন। ব্যাঙামামার স্ত্রী অরুণা। উনি আর
ছ�োট ঠাকুমা এই নায়রী সমাবেশে গান গাইতেন।
“আমরা উসুমকুসুম মাইয়া ল�ো
বাপে আমাগ�ো দিল বিয়া
বুড়া জামাই দেইখা গ�ো
কথা কয়না বার্তা কয়না
বইয়া বইয়া থাকে ল�ো।’’
নীচে ছিল কলের জল। টালার। ওই অন্ধকার-অন্ধকার
কলঘরটাই যেন তাদের স্মৃতির মেঘনা-শীতলক্ষ্যা। যমুনার গানে
ওঁরা নিজেদের মত�ো গাইতেন—
 125
“ললিতা-বিশকা-চম্পা মালতিকা
বিন্দে বিন�োদিনী আয় ল�ো
আয় ল�ো কমলা চল সবে মিলে
মেঘনার কূলে চল ল�ো
বেলা যে পইর‍্যা আইল�ো, জল আনিতে যাই ।’’

তারপর এক সন্ধ্যেয় সত্যি সত্যি অনেক আত্মীয় স্বজন, এয়�োতি,
পড়শি, ‘ননাস-ভাস্ ঠাকুর’ হ্যাকাঢ্যাকা নিয়ে ‘বিয়ে’ এসে পড়ত
হুড়মুড় করে।
তখন ভ�োজবাড়িতে ‘খাইয়ে’ ল�োকের সংখ্যা ছিল খুব। কুড়ি
পিস মাছ কিংবা চল্লিশটা রসগ�োল্লা উদরস্থ করার ল�োক অপ্রতুল
ছিল না। এ জন্য বিশেষজ্ঞরা ওড়িশার দেশীয় পাচকদের সঙ্গে গূঢ়
পরামর্শ করতেন। পাচক ঠাকুর অভয় দিতেন— ‘‘কিছি ভাবনা করন্তু
নাহি, মুহ মারি দেবি।’’ মানে, এমন কিছু ব্যবস্থা করা যাতে ‘মুখ
মেরে দেওয়া যায়’। হতে পারে সেটা প�োলাওতে ডালডা ঘি-এর
আধিক্য, কিংবা সন্দেশ পরিবেশনের আগে খুব বেশি মিষ্টি দেওয়া
দরবেশ পরিবেশন।
বিয়েবাড়ির হাঁকডাকটাই ত�ো আসল মজা।
“ কী রে ভ�োঁদা, কই গেলি রে?
কাজের সময় কাছে থাকিস না! সানাইয়ের কাপ্তেন কে একটু
জ�োরে ফুঁ লাগাতে বলে দে!’’
“ঠিক উলু দেবার সময় মেজ বউমাই বা গেল ক�োথায়?’’
“ওরে ক�োথায় গেলি... এই পাতে খানকতক লুচি দিয়ে যা!’’
“বারিকবাবুকে দইয়ের মাথা দে ত�ো — ম�োল্লারচকের দই! না
শুনব�ো, না !’’
ও দিকে কে একজন বাইরের ল�োক এসে সাঁটিয়ে যাচ্ছে। বলছে
আমি বরযাত্রী। বরপক্ষের ল�োক বলছে কই এ ত�ো আমাদের কেউ
নয়...। ক�োন এক মেস�োমশাই এই অনিমন্ত্রিতকে পাকড়াও করে
বাহবা নিচ্ছেন। বলছেন, ‘‘দেখেই বুঝেছিলাম খাবুলিওয়ালা।’’
যাঁরা বিয়েবাড়িতে ঢুকে গিয়ে খেয়ে যায়, ওদের খাবুলিওয়ালা
নাম দিতেন কেউ কেউ।
জানলায় দু’চারটে রজনীগন্ধার স্টিক এবং হেড লাইটের কাছে
কয়েকটা ফুলের ত�োড়া লাগান�ো থাকত�ো বরের গাড়িতে।
 126
কনেবাড়িতে ঢুকতেই বরযাত্রীদের গ�োলাপ জল স্প্রে করে
‘অন্তরঘট তক’ ( পড়ুন গেঞ্জি অবধি) সুবাসিত করা হত�ো। হাতে
গ�োলাপ ফুলও ধরিয়ে দেওয়া হত অনেক সময়।
ছ�োটবেলায় দেখতাম বিয়ের পদ্য। গ�োলাপি গ�োলাপি কাগজে
ছাপা ‘বড় নাতির শুভ বিবাহে ঠাকুমার উচ্ছ্বাস— ‘‘পরানের ধন বিলু
স�োনা করতে যাবে বি‌য়ে/টুকটুকে বউ আনবে বিলু ট�োপর মাথায়
দিয়ে...’’ কিংবা প্রাণাধিকা ছ�োট শ্যালিকার বিবাহে বড় জামাইবাবুর
খেদ— ‘‘ছ�োট শ্যালিকা মালবিকা আমার আকর্ষণ/তাঁকেই আমি
সঁপেছিনু আমার প্রাণ-মন/কত যত্ন করে আমার বাছত পাকা চুল/
তার লাগি সম্বন্ধ করে করেছিলাম ভুল...।”
তবে হ্যাঁ, এই ধরনের ইয়ার্কিময় পদ্য যেমন বাছাই ল�োকের
হাতে যেত, তেমনই বাছাই ল�োকের হাতেই সমর্পিত হত সিগারেট
বিলি করার ভার।

বিয়ের পদ্যগুলি ছিল ‘প্রীতি উপহার’। পদ্য ছাপিয়ে সমস্ত
নিমন্ত্রিতের কাছে হাতে হাতে বিলি করার প্রচলন ছিল। সব জায়গায়
যে ‘প্রীতি উপহার’ লেখা হত, তা নয়। ক�োনও পদ্যে বর-কনের নাম
লিখে নীচে লেখা হত ‘প্রীতির ডালা’ বা ‘প্রীতি নিবেদন’। ‘আশিস’,
‘স্নেহাশিস’, ‘শ্রদ্ধার্ঘ্য’, ‘মেয়েদের দুটি কথা’, ‘খ�োশ র�োজ’, এ সবও
লেখা থাকত। তার তলায় থাকত দীর্ঘ কবিতা। ছ�োটদের নামে ছাপা
হলে ‘ভাল�োবাসা’, বড়দের নামে হলে লেখা থাকত ‘আশীর্বাদ’।
বর-কনের প্রশংসা ও শুভ কামনাই ছিল সে সব পদ্যের মূল বিষয়।
বিয়ের পদ্য ছাপান�ো উপহারপত্র সে কালে অনুষ্ঠানবাড়ির
সাংস্কৃতিক অবস্থানেরও সূচক ছিল। কাব্যপ্রতিভাধারী আত্মীয় বা
বন্ধু নিজেরাই লিখতেন অভিনব সব কবিতা। অন্যরা স্মরণ নিতেন
ছাপাখানার। সে কালে সব ছাপাখানাতেই বিয়ের পদ্য ছাপা হত।
এমনকী শুধু বিয়ের পদ্য ছাপিয়েই ব্যবসা চলত অনেক ছ�োটখাট�ো
ছাপাখানার। মালা হাতে পরি, ফুল-লতাপাতার নকশা করা কাগজ
তৈরি থাকত, ফরমায়েশ মাফিক নাম বদলে দিলেই হল। এর ফলে
প্রায়ই যা হত— শ্রাবণ মাসে ক�োকিল ডেকে উঠত পদ্যে, ঘ�োর
অমাবস্যার বিবাহলগ্নও ভেসে যেত ফুটফুটে জ্যোৎস্নায়। সকলের
ত�ো আর কবি-বন্ধু বা সাহিত্য-ঘেঁষা আত্মীয় থাকত না। অথচ
বিয়ের মরশুমে পদ্য চাই-ই চাই। তাই সাধারণের জন্য এই বাজারি
 127
ব্যবস্থাই সই। জাতি, ধর্ম, সামাজিক অবস্থান-নির্বিশেষে বিয়ের পদ্য
ছাপাতেন সবাই।

বর বড় না কনে, বিয়ের আসরের সেই প্রতিয�োগিতারও অঙ্গ ছিল
বিয়ের পদ্য। বরের বাড়ি থেকে ক’টা পদ্য ছাপা হল? কনের বাড়ি
থেকেই বা কেমন পদ্য দিল? মজার গল্প শুনিয়েছেন যতীন্দ্রম�োহন
দত্ত। তাঁর ব�োনের বিয়ে উপলক্ষে কনেবাড়ি থেকে চারটে পদ্য
ছাপিয়ে বিলি করা হয়েছিল। বিয়ে ঠিক হয়েছিল বর্ধমানে চান্ডু-র
জমিদারবাড়িতে, পাত্র সেই আমলের মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার। তাদের
ঘরে হাতি ছিল, ষ�োল�ো বেহারার পালকিও। অথচ বরের বাড়ি থেকে
বিয়েতে একটিও পদ্য ছাপা হয়নি। সেই নিয়ে বাসরঘরে খুব পিছনে
লাগা হল জামাইয়ের। কেউ বলল ‘রেঢ়�ো’, কেউ আবার ছড়া কাটল:
‘ক�োঁচা লম্বা, কাছায় টান— তবে জানবে বর্ধমান!’
বিয়ের পদ্যে ঠাঁই হত প্যারডিরও। ‘ছ�োট মামার বিয়েতে’
‘নীল নবঘনে’র ছায়া ‘বিয়ের মন্তর’ নামে একটি পদ্যের সঙ্কলনই
প্রকাশ করে ফেলেছিলেন সত্যচরণ মিত্র। ১৩২০ সালের বৈশাখে,
ছেলের বিয়ে উপলক্ষে প্রকাশিত সেই সংকলনে পদ্যের সংখ্যা ম�োট
তিরিশটি। একটি পদ্যে লেখা:
“আজকাল
পদ্যহীন বিয়ে— ভাবলে গা কেঁপে ওঠে
আরে ছি ছি লাজে মরে যাই,
বর কনে থাক বা না থাক,—
পুরুত আসুক আর নাই আসুক
(অন্ততঃ) একটা পদ্য চাইই চাই।
লাল নীল কাগজেতে যা’তা লেখা
ল�োকের হাতে দিলেই তাই
তার বদলে একটা ‘‘থ্যাংকস’’
পেলে এক্কেবারে বর্ত্তে যাই।”
বরের ক�োষ্ঠী ও বংশপরিচয় নিয়েও লেখা হত পদ্য। সেগুলি
মূলত ছাপা হত বন্ধুদের নামে। শ�োভাবাজার রাজবাড়ি থেকে পাওয়া
‘কাকুলীর (কাকার) বিয়েতে’ পদ্য লিখেছে ছ�োট একটি মেয়ে: ‘ও
কাকুলী সত্যি বুঝি ত�োমার নাকি বিয়ে/ তুমি নাকি বউ আনবে ট�োপর
মাথায় দিয়ে...’ নববধূর কাছে পদ্য-শেষে তার আবদার: ‘যত পাবে
 128
সাজার জিনিষ ভাগ যেন তার পাই।’ আবার ভরা বর্ষায় ‘ছ�োট মামার
বিয়েতে’ পদ্য লেখা হচ্ছে রবিঠাকুরের ‘আষাঢ়’ কবিতার ছাঁদে:
‘শ্রাবণের মাঝে মামার বাড়ীতে তিল ঠাঁই আর নাহিরে।/ ওরে ত�োরা
আজ যাস্‌নে আজিকে যাস্‌নে বাড়ীর বাহিরে।’ হাসি-মশকরাও
ছিল— অবশ্যই সে কালের মূল্যব�োধের নিরিখে। দাদামশায়ের চতুর্থ
পক্ষের বিয়ে উপলক্ষে পাওয়া যাচ্ছে নাতিদের ছাপান�ো, চারিদিকে
কাল�ো বর্ডার দেওয়া পদ্য, বিষয়— নবপরিণীতার সম্ভাব্য একাদশীর
ব্যবস্থা!
গ্রামেও জনপ্রিয় ছিল এই প্রথা। হাতে হাতে বিলি হত বিয়ের
পদ্য। সেই সব পদ্যের কাগজ নিয়ে ছ�োটদের উৎসাহ ছিল
অপরিসীম। এই বিষয় নিয়ে একটু খ�োঁজখবর করতে গিয়ে দেখা
যাচ্ছে, কলকাতার বাঙালি মুসলমান পরিবারেও এই রেওয়াজ
ছিল। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘বণিক–বার্তা’ পত্রিকার একটা পুরন�ো
সংস্করণে ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে বিয়ের পদ্য থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া
হয়েছে। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় বসতি স্থাপন করা
আবুল হাসানের স্মৃতি উদ্ধৃত করে তাঁর পুত্র ইফতিখার হাসনাত
জানিয়েছেন, হাসান সাহেবের বিয়ে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে,
১৯৪২ সালে। সেই বিয়ের কবিতাটি লিখে দিয়েছিলেন কবি
সিকান্দার আবু জাফর। হাসান সাহেব ছিলেন ব্যায়ামবীর এবং প্রথম
মুসলমান ‘মিস্টার বেঙ্গল’। রাবীন্দ্রিক শৈলীতে রচিত বিয়ের পদ্যে
সেই বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।
“মধু বসন্ত জাগিল কি শেষে
মরমের তরুশাখে!
‘পেশীর দানব’ চঞ্চল হ�োল
‘রাঙা কুসুমের’ ডাকে?
অশান্ত আশা অন্তরে রাখি
পথে পথে যারে ফিরেছিলে ডাকি,
পেয়েছ�ো কি আজ সন্ধান তার
বসন্ত ঝংকারে?
মনে রেখ ভাই এ ‘ফুল’ ত�োমার
ডাম্বেল, রিং নয়,
কুস্তিতে জেতা চলিবেনা হেথা
শুধু মানা পরাজয়।...”
 129
মুসলিম সম্প্রদায়ের বিবাহ পদ্য

যুদ্ধের বাজার বলে বিয়ে থেমে থাকেনি। থেমে থাকেনি বিয়ের


পদ্য ছাপাও। কবিতায় ছায়া পড়েছে যুদ্ধের, বাঙালি তার মধ্যেও
অননুকরণীয় রসব�োধে মশকরা করে গিয়েছে। নেমন্তন্ন খাওয়ার
সময় যদি সাইরেন বেজে ওঠে? শুভদৃষ্টির মুহূর্তে যদি ব্ল্যাক আউট
হয়ে যায়? এই সব সম্ভাবনাও উঠে এসেছে পদ্যে।
*
পদ্য নিয়ে আল�োচনায় ঠাকুরবাড়ির প্রসঙ্গ না ছুঁয়ে গেলে হয়
না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ের আশীর্বাদ বা উপহার হিসাবে প্রচুর
লিখেছেন। তবে বিয়ে উপলক্ষে ক�োনও কবিতা নয়, প্রথম
লিখেছিলেন দু’টি গান। ১৮৮১ সালে। গানদু’টির প্রথম লাইন—
‘দুই হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি’ আর ‘মহাগুরু দুটি ছাত্র এসেছে
ত�োমার’। দ্বিতীয় গানটি পরে পরিবর্তন করে করেছিলেন ‘শুভদিনে
এসেছে দ�োঁহে’। গান দু’টি রাজনারায়ণ বসুর মেয়ে লীলাবতীর সঙ্গে
কৃষ্ণকুমার মিত্রের বিয়ে উপলক্ষে লেখা।
এই গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও একটা ইতিহাস।
লীলাবতীর বিয়েতে গানদু’টি গাইতে হবে বলে গায়কদের নিজেই

 130
তালিম দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই গায়কদের দলে এক জনের
নাম— ‘শ্রী নরেন্দ্রনাথ দত্ত’। ভবিষ্যতের স্বামী বিবেকানন্দের
প্রিয় গানের মধ্যে ছিল ‘দুই হৃদয়ের যদি’— যা তাঁর সম্পাদনায়
‘সঙ্গীতকল্পতরু’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।
রবি ঠাকুর কলম ধরার পর রবীন্দ্রসৃষ্টি দিয়ে বিয়ের পদ্য সঙ্কলনের
প্রচ্ছদ সাজান�ো শুরু হল। প্রথম পাতায় রবীন্দ্র-কবিতাংশ, ভিতরের
পাতায় নিজেদের লেখা বিয়ের কবিতা। সেই উদাহরণও পাওয়া
যায়। যেমন শ�োভাবাজার রাজবাড়ির অমল কৃষ্ণ দেবের বিয়ের পদ্য
সঙ্কলনের প্রচ্ছদে কবিগুরুর রচনা:
“নূতন পথের যাত্রী দুটি
ছুটছে যাহার সন্ধানে
য�োগ করে দাও, এক করে দাও,
হলদে সুত�োর বন্ধনে।”
আরও যে বিয়ের উৎসবগুলিতে কবিগুরু তাঁর লেখা উপহার
হিসাবে দিয়েছিলেন, তার মধ্যে আছে বিহারীলাল গুপ্তের কন্যা
স্নেহলতার বিয়ে, দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা নলিনীর বিয়ে,
বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে, লীলাদেবীর বিয়ে, দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের
কন্যা ইন্দিরার বিয়ে, কবি অমিয় চক্রবর্তী (প্রসঙ্গত, বিয়ের
কবিতাটির নাম দিয়েছিলেন ‘পরিণয়মঙ্গল’। শব্দটি এখানেই প্রথম
ব্যবহৃত হয়), লালগ�োলার রাজা য�োগীন্দ্রনারায়ণ রায়ের বিয়ে,
ক�োচবিহারের রাজকন্যা ইলাদেবীর বিয়ে ইত্যাদি।
*
কবির আশীর্বাণী সকলেই চাইত। কাউকে বিমুখ করতেন না
তিনি। এ দিকে ফরমায়েশি লেখা লিখতেও মন চাইত না। সে কথা
জানিয়েছিলেন চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের মেয়ের বিয়ের জন্য কবিতা
পাঠান�োর সময়। এই ধরনের সৃষ্টি সব নিশ্চয়ই ছাপা হয়নি। কে
জানে, হয়ত�ো কিছু বিয়ের পদ্য এখনও লুকিয়ে আছে ক�োনও
পারিবারিক অ্যালবামের গহনে!

এই বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র আর বিয়ের পদ্য ছাপান�ো কাগজের কিন্তু
আইনি মান্যতা আছে। বিয়ের দলিল হিসেবে এদের authenticity
বা প্রামাণ্যতা ম্যারেজ রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট বা কাবিন কিংবা
নিকাহনামার চাইতে কিছুমাত্র কম নয়।
 131
রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় আর শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা বিয়ের পদ্য।
শিবরাম আদত পদ্যের শেষে কয়েক লাইন য�োগ করে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশ
করেন ১৯২৪ সালে।

মনে পড়ল, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ব্যোমকেশ সিরিজের


গল্প - রক্তের দাগ। বিয়ের পদ্য ছাপান�ো কাগজের তারিখের সাহায্যে
একটি খুনের কিনারা করা হয়েছিল সে গল্পে।

“...আমাদের বিবাহের সময় কন্যাপক্ষ যে রুমাল-পদ্য
ছাপাইয়াছিল তাহাতে নলিনী দিদি তাঁহার আশীর্বাদে রজনীকে
‘চিনিপাতা দই’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন...।’’ বিমল কর
‘বালিকা বধূ’ ‘চিনি’র সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়েছেন এভাবেই।
*
প্রথম শ্রেণির বিয়ের পদ্যকার ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক।
কাট�োয়ার ডাকসাইটে ডেপুটি ছিলেন কবি তারকচন্দ্র রায়।
তারকবাবুর শালার বিয়েতে পদ্য লিখে দিয়েছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন
মল্লিক। আচার্য হরেকৃষ্ণ মুখ�োপাধ্যায়ের সংগৃহীত সেই পদ্যটি
লেখা হয়েছিল ১৩২২ সালের ১৮ মাঘ। পদ্যটি লেখা হয়েছিল

 132
তারকবাবুর নাতির নামে,
‘আজকে ত�োমার বইবে তুফান বুকে
মুখেতে আর বলব�ো আমি কত
দুই জনেতে থাক পরম সুখে
একটি বোঁটায় দুটি ফুলের মত�ো।’
*
কবি অক্ষয় কুমার বড়াল, সুরেশচন্দ্র সমাজপতির বিয়েতে
লিখলেন— “ত�োমরা কে হে/ লভিছ অমর সুখ এই মর দেহে/
নয়নে নয়নে হয়/ কিবা প্রাণ বিনিময়/ কি মধুর লীলা-ছল সাধের
সন্দেহে।’’

রবীন্দ্রনাথ, ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথের কন্যা জয়শ্রীর বিবাহে
লেখেন আরেকটি ‘পরিণয় মঙ্গল’ কাব্য:
“ত�োমাদের বিয়ে হল ফাগুনের চ�ৌঠা,/ অক্ষয় হয়ে থাক
সিঁদুরের ক�ৌটা/ সাত চড়ে তবু যেন কথা মুখে না ফ�োটে/ নাসিকার
ডগা ছেড়ে ঘ�োমটাও না ওঠে,/ শাশুড়ী না বলে যেন কি বেহায়া
ব�ৌটা।’’
*
কবি সুনির্মল বসু কবি রমেশ দাসের বিবাহে: “...হঠাৎ পেলাম
চিঠির খাম/ উপরে তার আমার নাম/ খুলেই দেখি- হুর্ রে – বাহবা/
হ�োহ�ো হুর্ রে- বাহবা।/ বন্ধু কবি রমেশ দাস,/ পরছে গলায় বিয়ের
ফাঁস,/এই ব�োশেখেই— আল্লা হ�ো ত�োবা।’’
*
কল্যাণী দত্তর “থ�োড় বড়ি খাড়া” থেকে পেলাম:
“ধীরুভাই ডাক্তার
মরে গেছে মুখ তার
ঘাটে ঘাটে জলে জলে খুঁজিয়া
হও এবে শান্ত
খাও দুটি পান্ত
সুধামুখী বউ লও বুঝিয়া।”
লেখিকা জানাচ্ছেন, উল্লিখিত বর ছিলেন জাহাজের ডাক্তার।
সেই জাহাজ রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর, হংকং, সাংহাই ঘুরে বেড়াত। তা,
তিনি যখন অনেক বয়েসে বিয়ে করলেন, তাঁর ব�ৌদির নামে এই
 133
নতুন রকম পদ্য ছাপান�ো হয়।
বুঝুন কান্ড !

বিয়ের পদ্যের প্রকৃত স্বরূপটি ধরা পড়ে, যদি তা লেখেন ঠাকুমা,
দিদিমা, ব�ৌদিদিরা। কাব্যরসকে ছাপিয়ে যায় আবেগ। যেমন, কনের
ঠাকুমা লিখছেন— “জীবন সাগরে ঝড় ওঠে যদি/ নাবিক পেয়�োনা
ভয়/ ঠাকুমার কথা স্মরণীয় তথা/ সংশয় কর জয়।’’ কনের মা
লিখছেন— “মা, তুই ম�োর হৃদয়ের ধন/ চিরদিন তাই ত�োরে করেছি
যতন।/ শিবপূজা করেছিলে/ মন�োমত শিব পেলে/ সেবিও, পূজিও
তারে অমূল্য রতন।’’
“শুনছি নাকি ও ঠাকুরপ�ো আজকে ত�োমার বি.এ./ ব�ৌ আনতে
যাচ্ছ তুমি ফ্রেন্ড ষ্টাফ নিয়ে...’’— এ পদ্যের সম্বোধন আর লঘু
রসিকতার সুরটাই বলে দেয়, লেখিকা জনৈকা ব�ৌদিদি। আবার
বরের বন্ধু লেখেন, “দেখে শুনে সামলে চলিস/ কিসের এত তাড়া?/
ও বুঝেছি মনের ভিতর/ কে দিয়েছে সাড়া।’’
পিতার দ্বিতীয় বিয়ে উপলক্ষে পুত্র লেখে: ‘‘আজি বৈশাখে দ�োলে
শাখে শাখে/ দ�োলনচাঁপার ফুল/ তারি সাথে সাথে ফ�োটে আজি বাবা/
ত�োমার বিয়ের ফুল।/ এ শুভ লগনে মায়েরে হারায়ে লাগিতেছে সব
ফাঁকা/ ক�োথা তুমি বাবা ক�োথা নতুন-মা রাখিব দুঃখ ঢাকা।’’
***
কিছুটা ম�োটা দাগের মজা ছিল নাপিতবচনে। বিয়েবাড়িতে
‘নরসুন্দর’ ছিল অপরিহার্য। মালাবদলের আগে কিংবা পরে ওরা
ছড়া কাটত, যা এখন প্রায় অবলুপ্ত।
একটা শুনুন:-
“উমা বসেন মহাদেবের ক�োলে
আর ভমর বসে ফুলে
এখন দুই গতরের মিল হল
সবাই হরি হরি হরি বল�ো।’’
এই গতর কথাটা আসলে ছিল গ�োত্র। শব্দটা সামান্য পাল্টে
খেলিয়ে উচ্চারণ করাটায় থাকত�ো এক নিষ্পাপ দুষ্টুমি।

বিয়ের কবিতা অনেক হল, এবার একটি দারুণ তত্ত্বের কবিতা
শুনুন।
 134
“এক ঝুড়ি ফুল, গ�োলাপ বকুল
রজনীগন্ধা ডালি,
শয্যা উপরে সজ্জিত করে
রেখে যাবে বনমালী।
পাঠিয়েছি তাই পুষ্প-মিঠাই,
নতুন বস্ত্র সাথে।
উপহারমালা দিয়ে ভরা ডালা
বধূবরণের রাতে।
নতুন জামাই পরবেন, তাই
প্যান্ট-শার্ট খানকয়
জুত�ো, প্রসাধন, ক�োমর-বাঁধন,
খুব বেশি কিছু নয়।
কন্যার শাড়ি আছে রকমারি
বড়জ�োর পাঁচখানা।
সাথে আছে ভরা হরেক পসরা,
সাজার দ্রব্য নানা।
প্রণামীর তরে দুটি ডালা ভরে
আছে কিছু উপহার,
শ্রদ্ধা এবং ভাল�োবাসা ম�োড়া
বড় ছ�োট সবাকার।
আর আছে কিছু ন�োনতা মিষ্টি
চক�োলেট, মুখরুচি,
শুধু এইটুক, সঙ্গে থাকুক
এই তত্ত্বের সূচী।
কিছু ফল আর সবজি, আহার
সামান্য, অল্পই।
এটুকু গ্রহণে, সকলের মনে
যেন আপনার হই।’’
**
উপহারে পাওয়া বইয়ের প্রথম পাতায় ও লেখা হত স্বরচিত
কবিতা। সাহিত্যমান যথেষ্টই ভাল।
আমার পিশিমার বিয়ের উপহার পাওয়া ক�োন বইয়ের মার্জিনে
দেখেছিলাম-
 135
সিনেমা, থিয়েটার ও প্রহসনের ধাঁচের পদ্য

“বহুদিন ছিনু প্রতীক্ষায়,


ত�োমারে দেখিতে পূর্ণতায়’’।
*
বিয়েতে “সঞ্চয়িতা’ উপহার দিতে গিয়ে সামনের সাদা পাতায়
পাত্রীর ব�ৌদির লেখা-” ‘‘স্মৃতি-সলিলে’’(পাত্র-পাত্রীর নাম!)
“যার তরে প্রতীক্ষিয়া ছিলে এতদিন,
গ্রহণ করিও তারে এই শুভ প্রাতে,
কালি রাতে, মিলনের হার হ�োল�ো গাঁথা,
তারি তরে নিবেদিত এই পংক্তি, এই ছিন্ন পাতা।”

তখন বিয়েতে দেদার বই উপহার দেওয়া হত। প্রভাবতী দেবী
সরস্বতী, স�ৌরীন্দ্রম�োহন মুখ�োপাধ্যায়ের (গায়িকা সুচিত্রা মিত্রের
বাবা) বইয়ের কাটতি ছিল বেশি। তবে সবচেয়ে এগিয়ে থাকতেন
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। চারটি ‘দেবদাস’ কিংবা ছয়টি ‘বিরাজ ব�ৌ’
একটি বিয়েতে পাওয়া ক�োন ব্যাপারই ছিল না।
‘চরিত্রহীন’ প্রকাশিত হওয়ার পর শরৎচন্দ্র জনপ্রিয়তায় হলেন

 136
অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার বইয়ের দুর্দান্ত কাটতি। এই সময় বাজারে এল
তার আরেকখানি উপন্যাস, ‘চাঁদমুখ’। সেটারও বিক্রি ভাল, কিন্তু
পাঠ প্রতিক্রিয়া ম�োটেও ভাল নয়। একেবারেই খাজা উপন্যাস
নামিয়েছেন লেখক। সেই আগের ঝাঁজ ক�োথায়?
শরৎবাবুর প্রকাশক বাজারচলতি বই নেড়েচেড়ে দেখলেন আরে!
এ অন্য শরৎচন্দ্র! ইনিও চট্টোপাধ্যায়। গল্পলহরী মাসিক পত্রিকার
সম্পাদক। পত্রিকা ভাল চলেনা কিন্তু নামটা পুঁজি করে নেমে
পড়েছেন উপন্যাস রচনায়!
প্রকাশক হরিদাস চ্যাটার্জি হন্তদন্ত হয়ে লেখককে জানালেন সব
কথা। এর বিহিত না করলে ত�ো ব্যবসা লাটে উঠবে তার! শরৎচন্দ্র
ম�োটেও পাত্তা দিলেন না। তাঁর ধারণা পাঠক ঠিক ধরে নেবে আসল
আর নকল। আর ব্যবসা? সে চিন্তার দায় প্রকাশকের।
আম পাঠকের দ�ৌড় শরৎবাবু আন্দাজ না করলেও প্রকাশক
ভালই জানেন। লেখার গুণে নয় মাল আর্ধেক নামের গুনে কাটে।
তদ্দিনে ‘হীরক দুল’ ও ‘শুভ লগ্ন’ নামে দুখানা আর�ো উপন্যাস
বাজারে বেরিয়ে গেল সেই শরৎচন্দ্রের। ল�োকে বলতে লাগল
শরৎবাবুর লেখা গেঁজে গেছে। আর পড়া যায়না!
এবার টনক নড়ল। উপায় কি? তাঁর নামে ত�ো আর নাম
ভাঁড়ান�োর মামলা করা যায় না। সেও যে শরৎচন্দ্র!
বাতায়ন পত্রিকার সম্পাদক অবিনাশ ঘ�োষাল অনেক পরামর্শ
দিলেন লেখককে, ক�োন�োটাই জমলনা। উলটে তিনি অবিনাশকে
বলেন যে এই নতুন ল�োককে গিয়ে ব�োঝাতে যে চরিত্রহীন বইটি
প্রকাশের পরে অনেকে শরৎচন্দ্রকে সাহিত্যে অশ্লীলতার দায়ে যা
তা বলছে। ছেলে ছ�োকরারা ঠ্যাঙান�োর জন্য লেখককে খুঁজছে, সেই
ভয়ে যদি...
অবিনাশ বুঝলেন লেখক একেবারেই সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না,
মরিয়া হয়ে বললেন স্বয়ং শরৎচন্দ্র গিয়ে নিজে যদি রিক�োয়েস্ট
করেন নাম পাল্টাতে তবে কাজ হবে। কিন্তু লেখক অনড়। তার
মতে এসব তাকে জব্দ করার জন্যেই করছে নতুন শরৎ। কারণ
তিনি গল্পলহরীতে লেখা দেননি!
কাগজে বিবৃতি দিলেও বিপদ, বিনা খরচায় নকলের পাবলিসিটি
হবে, ওর বইয়ের বিক্রি যাবে বেড়ে। অবিনাশের প্রস্তাব ওই শরৎকে
নামের আগে ‘চাঁদমুখ’ শব্দটি বসাতে অনুর�োধ করা, কারণ ওটিই
 137
বিয়ের পদ্যের ব্যাপারে বাঙ্গালিরা যেন ‘‘উঁচা নিচা ছ�োট বড় সমান’’! এক দুঁদে
মুখ্যসচিব কন্যার বিবাহ প্রীতি উপহার।

তার একমাত্র বিখ্যাত উপন্যাস। শরৎবাবুর পালটা যুক্তি সে যদি


উলটে আমায় নামের আগে ‘চরিত্রহীন’ বসাতে বলে!?
শেষাবধি অবিনাশ নিজেই যান নতুন শরৎচন্দ্রের কাছে। নাম
পাল্টাতে বা মাঝের ‘চন্দ্র’ টুকু বর্জন করতে ক�োনভাবেই রাজি হননি
গল্পলহরীর সম্পাদক। তবে অবিনাশ তাঁকে রাজী করিয়েছেন বইতে
ছবি ছাপতে যাতে পাঠক বুঝতে পারে কে ক�োন শরৎচন্দ্র। সে তিনি
ছাপতে রাজি, তবে শর্ত হল আসল শরৎচন্দ্রকেও ছাপতে হবে
নিজের ছবি, বইতে না হলেও, বিজ্ঞাপনে।
যেহেতু দুজনেই দাড়ি রাখেন সেই গ�োলমাল নিরসনে শরৎচন্দ্রকে
তার সাধের ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি কাটার পরামর্শ দিলেন শুভাকাঙ্ক্ষী
অবিনাশ।
জীবনচর্যায় ফরাসী ব�োহেমিয়ানিজমের অনুসারী শরৎচন্দ্র
এমিল জ�োলার অনুকরণে ফেঞ্চ-কাট দাড়ি রেখেছিলেন। সেই
সখের দাড়িকে বিদায় দিতে হবে ভেবেই মুষড়ে যান অপরাজেয়
কথাসাহিত্যিক।
 138
এর কদিন পরে গল্পলহরীর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নতুন
উপন্যাস ‘কণকাঞ্জলি’ প্রকাশিত হয়। যাতে ছবিসহ নাম বের�োয়
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জুনিয়র)
সেই হপ্তাতেই বাতায়ন পত্রিকায় শরৎচন্দ্রের ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি
বর্জিত ছবি ছাপা হল, তলায় লেখা ছিল চরিত্রহীন উপন্যাসের
লেখক শ্ৰীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
চাঁদমুখ উপন্যাসের লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম আজ
হারিয়ে গেছে। হয়ত বা ক�োন�ো পুর�োন�ো লাইব্রেরিতে এক কপি
চাঁদমুখ, কণকাঞ্জলি পড়ে আছে। হয়ত আজ�ো ভুলক্রমে শরৎচন্দ্র
ভেবে পড়তে নেন পাঠক পাঠিকারা।
এই ডুপ্লিকেট শরৎচন্দ্রের কথা শুনিয়েছেন সাগরময় ঘ�োষ মশাই
তাঁর ‘ সম্পাদকের বৈঠক ‘ লেখায়।
আর আসল শরৎচন্দ্র? এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী!

তাহার নামটি “অর্চনা’’।
সেন্ট্রাল এভিনিউয়ে জ�োড়াসাঁক�ো ঠাকুরবাড়ির যে ত�োরণটা আছে
ওটা দিয়ে ঢুকে মদন চ্যাটার্জী লেন। কয়েক পা এগ�োলেই দেখা
যাবে ডান দিকে একটা প�োস্ট অফিস। নাম অর্চনা উপ ডাকঘর।
সাধারণত প�োস্ট অফিসের নাম হয় রাস্তা বা এলাকার নামে। এটি
তার উজ্জ্বলতম ব্যতিক্রম।
উত্তর কলকাতার বাসিন্দা কৃষ্ণদাস চন্দ্র পেশায় ব্যবসায়ী নেশায়
সাহিত্যিক। ১৯০৪ সালে তিনি বার করে ফেললেন একটি মাসিক
সাহিত্য পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং তার নাম দিলেন ‘অর্চ্চনা’।
গল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে লাগল। অর্চ্চনা রীতিমত
জনপ্রিয় হল বাংলায়। সেত�ো আর অনলাইনের দিন নয়। পত্রিকা
দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার একমাত্র উপায় ডাকবিভাগ। চারিদিক
থেকে পত্রিকা পাঠান�োর এমন তাগিদ, মালিক কৃষ্ণদাস একটা
সাব প�োস্ট অফিসের জন্য আবেদন জানালেন সাহেবদের দৈনিক
স্টেটসম্যানে। তারপর চিঠি লিখলেন বড়লাট লর্ড কার্জনকে।
অনুমতি এল। ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হল নতুন ডাকঘর। যার নাম
স্রেফ একটি সাহিত্য পত্রিকার নামে।
পরের প্রজন্মে ‘অর্চ্চনা’ বানান পাল্টে গিয়ে ‘অর্চনা’ হয়েছে।
একটি সাহিত্যপত্রিকা বিতরণের কাজে একটা ডাকঘরের প্রতিষ্ঠা
 139
ইতিহাসে বিরল ঘটনা বললে অত্যুক্তি হয় না।
সে দিনের সেই পত্রিকা আজ, ইতিহাস। শুরু থেকেই
তারিণীচরণের বাড়িতেই ছিল পত্রিকার কার্যালয়। বাড়ির এক
দিকে বসত ‘অর্চ্চনা পরিষদ’-এর আড্ডা। বিভিন্ন সময়ে সেখানে
এসেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, গিরিশ ঘ�োষ,
কুমুদরঞ্জন মল্লিক, অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী,
মৈত্রেয়ী দেবী, বাণী রায়, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী , প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র,
বিপিনচন্দ্র পাল-সহ বহু ব্যক্তিত্ব।
সাবেক অর্চনা পত্রিকার একটি লেখা কিছু অংশ উদ্ধৃতি দেবার
ল�োভ সামলাতে পারলাম না।
‘এক নামকরা শিল্পীর বিয়ে উপলক্ষে কয়েক জন বিখ্যাত
লেখক-লেখিকার গদ্য ও পদ্য।
ওই শিল্পী হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্র কার্টুনিস্ট রেবতীভূষণ
ঘোষ— ‘দেশ’, ‘আনন্দবাজার’, ‘সচিত্র ভারত’ এবং সেই সময়ের
নানা পত্রপত্রিকায় যাঁর ব্যঙ্গচিত্র জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তাঁর
বিয়ের সময় ‘সাতপাকের পাঁচালী’ নামে একটি পুস্তিকা তিনি প্রকাশ
করেছিলেন। ওই পাঁচালির ‘পদকর্তা’রা হলেন রাজশেখর বসু,
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, সাগরময় ঘোষ, নরেন্দ্র দেব, আশাপূর্ণা দেবী,
প্রেমেন্দ্র মিত্র, মনোজ বসু, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়,
শিবরাম চক্রবর্তী প্রমুখ।
রাজশেখর বসু এবং সাগরময় ঘোষ অবশ্য পদ্য না লিখে গদ্যেই
তাঁদের মনের ভাব প্রকাশ করেছিলেন।
সাগরময় ঘোষ শিল্পীকে দু’টি সরস পরামর্শ দিয়েছিলেন—
‘‘কার্টুন এঁকে সবাইকে তো ব্যঙ্গ করেছেন। ভুলেও যেন গৃহিণীর
কার্টুন আঁকতে যাবেন না। গৃহ বিবাদ অনিবার্য। সৈয়দ মুজতবা
আলীর ‘মার্জার নিধন কাব্য’র কার্টুন আপনিই এঁকেছিলেন দেশ
পত্রিকায়। সে কবিতায় হিতোপদেশটি মনে আছে তো? ‘সাদির
পয়লা রাতে মারিবে বিড়াল?’’’
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ও শিল্পীকে দিয়েছেন সরস উপদেশ— ‘‘ছড়ার
হুল আর ট্যারা চোখের দৃষ্টিটা ঘরের ভিতর টেনে নিয়ে যেয়ো না।’’
প্রেমেন্দ্র লিখেছেন— ‘‘এতদিন তো বাটিতে রং গুললে নানা
রকম/ চালিয়ে গেলে তুলি।/ এখন থেকে মনের-ই রং এমন হবে
জবর/ আঁকতে না যাও ভুলি।/ যাই কেন না আঁকো তবু/ এইটুকু
 140
ঠিক জানি/ আলতো তুলির টানেও পাবো/ গভীর বুকের বাণী।’’
আশাপূর্ণা দেবীর চমৎকার কবিতা— ‘‘একটি চাকায় চলছিলো
রথ/ ক্লান্ত তালে মন্থরে।/ জুড়লো এসে আর এক চাকা/ বেদের বাঁধন
মন্তরে।/ সবেগে রথ চলবে এবার/ উৎসাহে আর উল্লাসে।/ জয়ধ্বনি
দিচ্ছি মোরা,/ আছি যারা আশপাশে।/ তার সাথে থাক আশীর্বাণী/
পথ যেন হয় অবন্ধুর।/ যুক্ত জীবন-যন্ত্রে বাজুক/ সুষমাময় স্নিগ্ধ
সুর।’’
শিবরাম চক্রবর্তী আশীর্বাদ করেছেন নববধূকে— ‘‘সিঁথির সিঁদুর
অক্ষয় হোক/ সুখের হোক ও ঘর।/ দীর্ঘজীবন মধুময় হোক/ ছেলে-
পুলে সুন্দর।’’
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পদ্যটিও সুখপাঠ্য— ‘‘তুলি কালি
রঙ দিয়ে/ হাসি আর খুশিতে/ ছোট বড়ো সকলেরে/ পারো তুমি
তুষিতে।/সুধাঝরা এই রাত/ মধুভারে টলমল/ জীবনেরে করো ছবি/
রঙে রসে ঝলমল।’’
বিয়ের রুমাল পদ্যের কথা বলব আর ‘অর্চনা’ আসবে না - তা
হয় নাকি?

কবি শঙ্খ ঘ�োষের বিয়ের গল্প শুনবেন ? তার লেখা বিয়ের পদ্য?
অনেকেরই ধারণা, শঙ্খবাবু রীতিমত�ো এক গুরুগম্ভীর মানুষ
ছিলেন। ঠাট্টা ইয়ার্কি করতেন না। কিন্তু আদতে তার উল্টো।
ছিলেন আদ্যন্ত রসিক। অথচ সেই রসিকতা কখনও শালীনতার
সীমা ছাড়াত না। কথা কম বলতেন, কিন্তু সেটুকুই অব্যর্থ।অনেক
সময় খানিক দুষ্টুমিও মিশে থাকত তাঁর রসিকতায়।
তাঁর অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছাত্রপ্রতিম সন্দীপন চক্রবর্তীর লেখায়
পাই বিবাহ বিষয়ক রসসিক্ত নানা মন্তব্য।
শঙ্খ ঘ�োষের বিয়ের গল্প তিনিই শুনিয়েছেন।
প্রতিমা দেবী ছিলেন তাঁর কলেজের সহপাঠিনী। বন্ধুতা থেকে
পরিণয়। স�ৌন্দর্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি — সবেতেই প্রতিমা তখন
অদ্বিতীয়া, অসাধারণ। শঙ্খ তখন হাড় জিরজিরে, কুচকুচে কাল�ো
এক যুবক। বিয়ের দিন তাকে দেখে নাকি প্রবল হতাশ হয়েছিলেন
শ্বশুর বাড়ির ল�োকজন। এমন ছেলেকে কি না পছন্দ করল তাদের
স�োনার প্রতিমা? বিয়ে ত�ো হল। পরদিন, বর-কনে রওনা হবার
আগে শ্বাশুড়ি-মা আর থাকতে পারলেন না। শঙ্খকে বললেন—
 141
একশ�ো বছরেরও আগের বিয়ের পদ্য

‘চিন্তা কর�ো না বাবা। প্রতিমার সঙ্গে থাকতে থাকতে, দেখ�ো, তুমিও


ফর্সা হয়ে যাবে।’
শঙ্খ তাঁর ধীর কিন্তু অম�োঘ স্বরে বলেছিলেন — “ কিন্তু আমার
সঙ্গে থাকতে থাকতে প্রতিমার যদি উল্টোটা ঘটে ?”।
বুঝুন!
শিলাইদহে ক�োন এক গণৎকার রবীন্দ্রনাথের হাত দেখে
বলেছিলেন, কবিগুরুর স্ত্রীর নাকি বৈধব্যয�োগ আছে। রবিঠাকুর
সারাজীবন সেই কথা মনে রেখেছিলেন।
মৃত্যুর বছর পাঁচ আগে শঙ্খবাবু একদিন হাসতে হাসতে সন্দীপন
কে বলেছিলেন — “ আমার হাত দেখে অনেকেই বলেছেন যে আমার
নাকি দুট�ো বিয়ে। অনেকদিন আশায় আশায় ছিলাম, বুঝলে। তবে,
এখন যে পুর�োপুরি আশা ছেড়ে দিয়েছি, তাও বলব না।’’
পাশে বসে সবচেয়ে বেশি হেসেছিলেন সন্দীপনের প্রতিমা
জ্যেঠিমা।
বিয়ে নিয়ে আরও একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল ২০১০ সাল
নাগাদ, এক শীতের সকালে।
 142
উনার বাড়িতে রবিবারের আড্ডায়, কবি জয়দেব বসু সেদিন
কেন জানি শঙ্খবাবুকে আপ্রাণ ব�োঝাবার চেষ্টা করছিলেন — প্রত্যেক
পুরুষের বিয়ে করা উচিত... সময়ে বিয়ে না করলে কি পরিণাম
হয়... ইত্যাদি।
কিছুক্ষণ শ�োনার পরে কবি বললেন -‘‘এক সন্দীপন ছাড়া
সকলেই ত�ো এখানে বিবাহিত। সন্দীপনের কি এইসব শ�োনার খুব
তাড়া আছে? তার চেয়ে বরং বিয়ের অপকারিতা বিষয়ে বিশদে
বলত�ো। সেইটিতে আমাদের অনেকের আগ্রহ হবে।’’
আড্ডার উচ্চকিত হাসির মধ্যে জয়দেব বসুর মুখটি দেখার মত
হয়েছিল।
 সন্দীপনের বিয়ের ব�ৌভাতের অনুষ্ঠান। ডিসেম্বর, ২০০৯
সাল। “স্যার” এসেছেন জ্যেঠিমাকে নিয়ে। সন্দীপনের পরনে
স�োনালী শেরওয়ানি আর রঙিন উড়ুনি। ইতিমধ্যে নতুন অতিথিরা
আসছেন। সন্দীপন স�ৌরীন ভট্টাচার্য মশাইয়ের সঙ্গে দু-কথা
বলছেন। শঙখ ঘ�োষ নতুন বরের কানের কাছে নিজের মুখটি
নিয়ে এসে ধীর কন্ঠে বললেন — “ঠিক এইরকম, এইরকম একটা
পাঞ্জাবি পেলাম না বলে সারাজীবন টিপু সুলতানের ভূমিকায়
অভিনয় করতে পারলাম না।”
এরপরেও বলবেন, শঙ্খ বাবু গ�োমড়াথেরিয়াম!
*
তাঁর নিজের বিয়েতে পদ্য লেখা কাগজ বিলি করা হয়েছিল
কি না জানিনা, তবে শঙখবাবু বিয়ের পদ্য লিখেছেন — অন্তত
একটি ত�ো লিখেছিলেনই। সঙ্গে ছিলেন আরেকজন সুবিখ্যাত কবি
- অল�োকরঞ্জন দাশগুপ্ত।
যতদূর জানা যাচ্ছে, সহকর্মী অধ্যাপক ও কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত
মশাইয়ের মেয়ের বিয়ের ‘বৈবাহিকি ‘ পত্রের কবিতা দুটি ছিল
এমনটাই।
পাত্রীর শঙ্খজ্যেঠু লিখেছিলেন —
বাবার চিঠি
*
“কথা ত�ো দিব্যি মিঠেমিঠে বল�ো
কথা নয় যেন লেখনই
অথচ কবেই ভুলে গিয়েছ যে কথা দিয়ে কথা রাখ�োনি,
 143
এরকম আমি দেখেছি ত�ো ঢের
এটুকু আমার জীবনে।
কথারা আড়ালে চাপা পড়ে থাকে
মখ্ মলে বাঁধা রিবনে।
খুলে কি কখন�ো মনে পড়ে যায়
হারান�ো আমার চিঠিটা?
ভাব�ো কি ‘যে মন হারিয়ে ফেলেছি
কি ভাবে আবার চিনি তা?’
যদি তাই চাও আকাশে বাজাও
মেঘের মৃদং নাকাড়া-
মনে রেখ�ো প্রাণ ফিরে দিতে পারে
আমাদেরই মত�ো বাবারা!”
*
কবি অল�োকরঞ্জন দাশগুপ্ত (পাত্রীর অল�োক জ্যেঠু)
লিখেছিলেন—
“আজ আমাদের আদরের দুহিতার
মিলনকুঞ্জে এসেছে সদলবলে
শ্বেতপারাবত, খেয়ে দেয়ে চলে যাবে
শান্তি ছড়াতে অখিল ভূমন্ডলে।”


গ�োধূলি লগ্নের বিয়ের মন্ত্র ইত্যাদি এতক্ষণে প্রায় শেষের দিকে।
বাসর ঘরের অনুষ্ঠানও একেবারে ক্লাইম্যাক্স ছুঁয়েছে ।
এরপর, কাল থেকে বুঝি শুরু হবে সংসারের ..
“ নয় নয়, নয় এ মধুর খেলা।’’

 144

You might also like