Professional Documents
Culture Documents
Nandan June 2021 Final
Nandan June 2021 Final
৪ জুন ২০২১
বিদেশী বই
জন বার্জারের পত্রোপন্যাস তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায় ১০৫
সিনেমার ভাষা
“আমাদের” আর “ওদের” সংলাপ... অরুণাভ গাঙ্গুলি ১১৬
রম্য রচনা
পরিণয়মঙ্গল, শঙ্খ ঘ�োষ আর ডুপ্লিকেট শরৎচন্দ্র বৃত্তান্ত
সিদ্ধার্থ মুখ�োপাধ্যায় ১ ২২
প্রচ্ছদ ও সূচিপত্রের আল�োকচিত্র : সন্দীপ কুমার
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা : বিশ্বজিৎ আইচ
সম্পাদক : অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষে অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী কর্তৃক
৩১, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০১৬ থেকে প্রকাশিত ও গণশক্তি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেড,
৩৩, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট কলকাতা ৭০০০১৬ থেকে তৎকর্তৃক মুদ্রিত।
ফ�োন : ২২১৭ ৬৬৩৩-৪০, ফ্যাক্স : ২২২৬৩৭৮৮ Web : www.nandanpatrika.com
2
সম্পাদকীয়
বেনারসের মণিকর্ণিকা ঘাট শ্মশানে দাউ দাউ জ্বলছে
চিতা। এই ছবি প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছিল নন্দন পত্রিকার
মে মাসের ডিজিটাল সংখ্যায়। একজন পাঠিকা ফ�োন
করে বলেছিলেন, প্রচ্ছদে এই ভয়ানক ছবি কি না
দিলেই চলছিল না?
সঙ্গত প্রশ্ন। একটি সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকার
প্রচ্ছদে কি চিতার আগুনের ছবি মানায়?
মানায় না ত�ো। আমরাও কি কখন�ো ভেবেছিলাম
এরকম ছবি ছাপতে হবে?
নন্দন সংখ্যার জন্য যে পরিকল্পনা নিয়ে আমরা
এগ�োচ্ছিলাম, প্রথম দফার কর�োনা সংক্রমণের ধাক্কা
সামলে যখন আমরা মাত্র কয়েকটি সংখ্যা আবার ছাপা
শুরু করলাম, তখনই এল সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ।
এর পরিণাম যে এরকম ভয়াবহ হতে পারে তা
কল্পনার মধ্যে ছিল না। দিল্লি মুম্বাই বেঙ্গালুরু কলকাতা
বেনারস লখন�ৌ কানপুর পাটনা আমেদাবাদ সুরাট
সর্বত্র চিতার আগুন জ্বলছে ত�ো জ্বলছেই। আলিগড়
মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর�োনার আক্রমণে শিক্ষক ও
শিক্ষাকর্মী এত মারা গেছেন যে ক্যাম্পাসের ভিতরে
নির্ধারিত কবরখানায় তাঁদের সকলের মরদেহর জায়গা
হচ্ছে না। দিল্লির রাজপথে অ্যাম্বুলেন্স এর সাইরেন শব্দে
3
নাগরিকদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সর্বত্র অক্সিজেনের
ভয়াবহ সংকট। কলকাতার হাসপাতালে ভ্যাকসিন
নিয়ে হাতাহাতি। আপনি আমি যদি কর�োনা আক্রান্ত
নাও হই, তবু ঘর বন্দী অবস্থায় টেলিভিশন চ্যানেলে
অথবা স্মার্টফ�োনে এই ভয়াবহ দৃশ্যের ক�োলাজ
আমাদের বিষাদগ্রস্ত করে তুলছে।
এই পরিস্থিতিতে নন্দনের প্রচ্ছদে অন্য ক�োন�ো
বিষয়ের কথা আমরা ভাবতেই পারিনি। সেই ক্ষেত্রে
চরম উদাসীনতার পরিচয় দিতাম।
যেসব পরিবার কর�োনার আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছেন,
সদস্যদের হারিয়েছেন চিরদিনের মত তাঁদের যন্ত্রণার
ভাগীদার হতে চেয়েছি আমরা। যতটুকু পারি।
তবু, হ্যাঁ তবু এই বিষাদঘন পরিবেশের মধ্যেই
হার না মানা মানুষের প্রতিজ্ঞাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী, বিজ্ঞানী ও গবেষক, কর�োনা
ম�োকাবিলার সঙ্গে যুক্ত সরকারি-বেসরকারি অজস্র
কর্মীদের পরিশ্রম, সরকারি সাহায্যের আশায় না থেকে
স্বউদ্যোগে এইসব আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান�োর যে
ছবি দেখা যাচ্ছে তা এই সমাজের এক নতুন চেহারা।
অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ক্লাব,
অ্যাস�োসিয়েশন মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
দেশের নানা প্রান্ত, বিদেশ থেকেও নানাভাবে সাহায্য
এসে প�ৌঁছেছে। আমাদের রাজ্যে গর্ব করার মত
সক্রিয়তা দেখাচ্ছে রেড ভলান্টিয়ারস।
বিপদ এখন�ো কাটেনি। আগামী দিনে নতুন করে
সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা রয়েছে যথেষ্ট
পরিমাণে। তার বিরুদ্ধে লড়াই করার সর্বাত্মক প্রস্তুতি
দরকার।
আমাদের যেন আর চিতার ছবি প্রচ্ছদে না ছাপতে
হয়।
4
পু ন র্মু দ্র ণ
জয়দেব বসু
এটাই শেষ লেখা, যা কিনা রাত্রিকে তুলে আনবে হাওয়ায়-হাওয়ায়,
তা থেকে পুংকেশরের রেণুতে, আর বয়স্ক আলবাট্রস শেষবার বিষণ্ণ
ডানা মেলে পার হতে চেষ্টা করবে নুনঢিবি ও নারকেলঅরণ্য, যেখান
থেকে দেখা যাবে মুরগির ডিমের মতন নিজের অক্ষের ভরে ঘুরছে
পৃথিবী, গিলগামেশের পর হয়ত�ো এবারই শেষ, আর ক�োন�োদিন
কেউ ত�োমাকে তেমন অনন্ত থেকে ছুঁড়ে ফেলবে না, কেউ ত�োমাকে
লুফে নেবে না মাটি স্পর্শের আগেই, র�োঁয়াওঠা মুখিয়ার মত�ো দিন
চলবে দায়বদ্ধ, গতানুগতিক।
6
শঙ্খ ঘ�োষের গদ্য
পবিত্র সরকার
১ মামুলি এক ভূমিকা
একজন মানুষ, যিনি মুখ্যত কবি, তিনি যখন গদ্য লেখেন তখন
নিশ্চয়ই তাঁর এমন কিছু বলার কথা থাকে যা তিনি কবিতায় বলার
সম্ভাবনা নাকচ করেন। অতি মামুলি ওই কথার পুনরাবৃত্তি করে বলি,
কবিতা মূলত এক ধরনের মাধ্যম, গদ্য আর-এক ধরনের। এ ত�ো
সবাই জানেন যে, কবিতায় ছন্দে, মিলে, স্তবকবন্ধে, কিংবা সে সব
বর্জন করেও রূপকে চিত্রকল্পে শব্দব্যঞ্জনায় মূলত আবেগের উৎস
থেকে পাঠকের আবেগ-আন্দোলনের লক্ষ্যে কবির রচনা ধাবিত
হয়। তার কিছুটা অংশ পরে চিন্তায় রূপান্তরিত হতেই পারে, কিন্তু
7
তার সম্মুখের দরজাটা হল আবেগ। কিন্তু গদ্য, যখন তা কবিতার
লক্ষ্যকে পরিহার করে তখন তা লেখকের চিন্তার কথা পাঠকের
চিন্তার পরিসরে প�ৌঁছে দেবার জন্য রচিত হয়। এ কথাও জানা যে,
কবিতা কখনও গদ্যের এই ল�োকপ্রসিদ্ধ কাজের দায়িত্ব তুলে নিতে
পারে। পাঠকের মনে পড়বে কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত-
এর চৈতন্য আর রামানন্দ রায়ের সাধ্য-সাধনতত্ত্ব বিচারের অংশটি,
কিংবা রবীন্দ্রনাথের স�োনার তরী-র ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায়
যাত্রাভিমুখী গৃহকর্তার সঙ্গে গৃহিণী কী কী জিনিস গুছিয়ে দিয়েছেন
তার তালিকা। সেখানে আবেগের ভূমিকা প্রধান নয়, গ�ৌণ, যদিও
তা একেবারে অনুপস্থিত নাও হতে পারে। আবার গদ্যও কখনও
কবিতার কাজ নিজের হাতে তুলে নেয়, তখন তা আবেগের দ�োলা
দিয়েই আমাদের কাছে আবেদন তৈরি করে। কাজেই, দিশি-বিদেশি
‘অথরিটি’র উদ্ধৃতি না দিয়ে, বহু পুর�োন�ো কথাই আবার সংক্ষেপে
পুনরাবৃত্তি করি—কবিতার আবেদন আবেগ ও কল্পনার কাছে, গদ্যের
আবেদন সাধারণভাবে জ্ঞান ও যুক্তির কাছে। অর্থাৎ সরল বাইনারি
বা দ্বিসম্ভবের সূত্রে কবিতা আর গদ্যকে আলাদা করা চলে না।
দুয়ের তফাতের মধ্যে ফাঁক নেই, বরং একটা পরম্পরা বা পর্যায়
আছে। তাতে শূন্য থেকে বহু সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করাও হয়ত�ো
সম্ভব।
শঙ্খ ঘ�োষ যখন গদ্য লেখেন তখন গদ্যের এ সব শর্ত ত�ো তাঁকে
মানতেই হয়। তবু পাঠকেরা জানেন যে, গদ্যের নানা ধরন আছে।
নিছক সংবাদের যে গদ্য, আইনি দলিলের যে গদ্য, বিজ্ঞানের
প্রবন্ধের যে গদ্য, তার ধরন আলাদা। এই যে চর্চার পরিসর অনুযায়ী
আলাদা আলাদা গদ্যের চরিত্র, তাকে ভাষাবিজ্ঞানে register বলা
হয়, ব্রিটিশ ভাষাতাত্ত্বিক হ্যালিডে এই পরিভাষাটি সৃষ্টি করেছেন।
সংজ্ঞা হল, language according to use. আমরা রেজিস্টারের
বাংলা করেছি ‘নিরুক্তি’। এও মামুলি কথা যে, মান্য চলিত
গদ্যও, এক জন লেখকের লেখা হলেও, একরকম হতে পারে
না। ব্যক্তিগত শৈলী বা স্টাইলের মুদ্রণ সব জায়গাতেই থাকবে,
তবু স্মৃতিচারণের গদ্যের নিরুক্তি এক হবে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে
ওকাম্পোর সম্পর্কের বিবরণ ও বিশ্লেষণের গদ্যের নিরুক্তি একটু
অন্যরকম হবে, কবিতা রচনার মুহূর্তগুলির স্মরণের গদ্য আর-একটু
অন্যরকম হবে, কবিতা সেখানে গদ্যকে আক্রমণ করবে এসে—এ
8
ত�ো বলাই যায়। এ সব মেনে নিয়েই আমরা শঙ্খ ঘ�োষের গদ্যের
কিছু সাধারণ লক্ষণ বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব। আমাদের মূল লক্ষ্য
হবে শঙ্খ ঘ�োষের গদ্যশৈলীর কতকগুলি চিহ্ন স্থির করা। সেগুলি
ক�োথায় অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যায়, ক�োন্ ক�োন্ সূত্র থেকে
আমরা বলতে পারি যে, এগুলি শঙ্খ ঘ�োষেরই লেখা, অন্য কারও
নয়। অবশ্যই শঙ্খ ঘ�োষের কবিতার মত�ো গদ্যও অনেক অনুজ
লেখকের গদ্যকে প্রভাবিত করেছে, ‘প্রভাবশালী’ লেখকের কাছে
সেটাই প্রত্যাশিত। হয়ত�ো শঙ্খ ঘ�োষও তাঁর পূর্ববর্তী বুদ্ধদেব বসু
বা এই ধরনের কারও ব্যক্তিগত গদ্যশৈলীর দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত
হয়ে থাকবেন। আমরা সবাই জানি যে, এর মূলে একটা সজ্ঞান
নির্বাচন বা choice থাকে। সেটা কবিতা বা গদ্য উভয় ক্ষেত্রেই।
খুব দুর্বল বা খেয়ালি লেখকেরা হয়ত�ো ‘আমি অমুকের মত�ো লিখব’
ভেবে শুরু করেন, ইংরেজ চ্যাটার্টন যেমন করেছিলেন। কিন্তু
বেশির ভাগ আত্মসচেতন লেখক একটা সময়ে অন্তত ‘আমি আমার
মত�োই লিখব’ সেই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তখন তাঁর মধ্যে একটা
ব্যাপক বাছাই চলে। কবিতার ক্ষেত্রে কবিরা যেমন, গদ্যলেখকেরাও
তাঁদের পছন্দের একটা বৃত্ত তৈরি করেন। এটা ত�ো ব�োঝাই যায়
যে, শঙ্খ ঘ�োষ কবিতায় তিরিশের বছরগুলির যাঁরা সব ‘দুর্বোধ্য’
অথচ নিঃসন্দেহে শক্তিশালী কবি, তাঁদের শৈলী বর্জন করেছিলেন,
তেমনই গদ্যেও বিষ্ণু দে বা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের গদ্যকে আদর্শ মনে
করেননি। কবিতা বা গদ্যে তাঁর সহজ লক্ষ্য ছিল ব্যাপক সাধারণ
পাঠকের সঙ্গে সংয�োগস্থাপন। এই সিদ্ধান্ত সকলে নেন না, নিশ্চয়ই
তার পিছনে ব্যক্তিগত ক�োনও কারণ থাকে। শঙ্খ ঘ�োষ নিয়েছিলেন।
সচেতন শৈলীর চেয়ে সংয�োগ, অস্মিতার চেয়ে তার অতিক্রমণ তাঁর
কাছে বড় হয়ে উঠেছিল। সেই দিক থেকে তাঁর গদ্যের সাফল্য
বা ব্যর্থতা (!) বিচার করতে হবে। যেহেতু পাঠকমুখী আগ্রহ এক
ধরনের আবেগ, তা তাঁর গদ্যে শৈলীর সৃষ্টি করেছে, আবার লেখার
উদ্দেশ্য অনুসারে তার মধ্যে নানা ভাঁজবিভঙ্গও। জানি না আমাদের
এই দ্রুত এবং অসম্পূর্ণ (সব লেখা এখন হাতের কাছে নেই, সংগ্রহ
করা কঠিন) পরিক্রমায় তার কতটা দেখান�ো সম্ভব হবে। এই লেখায়
তাঁর গদ্যের কিছু ভাষাতাত্ত্বিক লক্ষণ আমরা দেখাব, পরে হয়ত�ো তা
যে মায়া সৃষ্টি করে তার অন্যান্য কারণ অনুসন্ধান করব।
কিন্তু তারও আগে, শঙ্খ ঘ�োষের গদ্য লেখারও একটা ভূমিকা
9
করে নিতে হবে। সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে ঢুকেছেন, পড়াতে
ভাল�োই লাগছে। বেতন মাসে একশ�ো পঁচিশ টাকা। সেই সঙ্গে সাড়ে
সতের�ো য�োগ সাড়ে সতের�ো টাকা অনুষঙ্গ। কিছু অতিরিক্ত পাওয়া
যেত সান্ধ্য ক্লাসে পড়িয়ে শঙ্খ সেটা ছেড়ে দিয়েছেন। ইউজিসি
স্কেলের একটা শর্ত হচ্ছে বিদ্যাভিত্তিক গদ্য প্রবন্ধ লেখা, জানি না
তখনি ইউজিসি মার্কিন দেশের publish or perish দর্শনের প্রতি
প্রণতচিত্ত হয়েছিল কি না। সে জন্য হ�োক, বা নিছক জ্ঞানচর্চার
নিজস্ব তাগিদ থেকে হ�োক, সহকর্মীরা নানা গ্রন্থরচনা করছেন। শঙ্খ
নানা স্থানে নিজেকে অলস বলেন, (‘বড়�োকাকা বলতেন, অলস যদি
দেখতে চাও ত�ো তাকিয়ে দেখ�ো ওকে, পৃথিবীর সেরা’—এখন সব
অলীক), জানি না গদ্য লেখায় অনীহা তার চিহ্ন ছিল কি না। এক
সহকর্মী এসে চুপি চুপি পরামর্শ দিয়ে গেলেন যে, ইউজিসি স্কেলের
জন্য কিছু গদ্যপ্রবন্ধ লেখা দরকার। কিন্তু তাঁর গদ্য লিখতে ইচ্ছে
করে না। বেশ কিছুদিন কাটবার পর বিভাগীয় প্রধানের অসন্তোষের
খবর জানালেন সহকর্মী ক্ষেত্র গুপ্ত, শঙ্খ ঘ�োষের প্রতিক্রিয়া, আমরা
উদ্ধৃত করি—
‘সে কী, কেন?’ ‘উনি বলেছেন, এইভাবে ডেকে ত�ো নিলাম।
কিন্তু ক্লাসে পড়ান�ো ছাড়া কিছুই ত�ো করছেনা ও; ছ-মাস বলে বলে
একটা প্রবন্ধ পর্যন্ত লেখাতে পারলাম না।’ মর্মাহত, চুপ করে থাকি।
ক�োন�োরকম গদ্য যে কিছুতেই লিখতে ইচ্ছে করে না, কেমন করে সেটা
ব�োঝাই ওঁকে। ভাবি, একটি-দুটি লেখা অন্তত লিখতেই হবে, নইলে
অসম্মান করা হবে ওঁর আস্থাকে। ১৯৬৫ সালে সিটি কলেজ ছেড়ে
আসবার আগে একটি-দুটি গদ্যলেখা লিখতেই হল�ো তাই।’
(গদ্যসংগ্রহ ১, পৃ. ১৯৭)
সেই গদ্যের সংগ্রহ এখন তের�ো খণ্ডে বেরিয়েছে। তাঁর গদ্য
লেখার দ্বিধা কেটেছিল বলে আমরা খুশি। তবে কর�োনার কারণে
আমরা তার সবগুলি খণ্ড দেখে উঠতে পারিনি।
এবার আমরা তাঁর গদ্যের আল�োচনায় যাব, সেই মানুষটির,
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছে যাঁর শৈশবে হাতেখড়ি হয়েছিল।
২ গদ্যের লক্ষণগুলি
ক. প্রশ্ন ও তার ব্যবস্থাপনা
স্মৃতিচারণ কিছুটা আত্মজীবনীর অংশ, ভ্রমণকাহিনিও তাই। দুইই
কিছুটা অতীতে আশ্রিত, যে-অতীতের নেতিবাচক অভিজ্ঞতাও
10
সময়ের প্রলেপে উপশান্ত হয় এবং কিছু পরিমাণে লেখকের মমতা
লাভ করে। মমতা এই দিক থেকে যে, সে ঘটনাগুলিকে লেখক
পুনরুদ্ধার করে পাঠকের কাছে প�ৌঁছে দেবার কথা ভাবেন, এবং
তাতেই আমরা জানতে পারি যে, সেই ফেলে-আসা অভিজ্ঞতাগুলি
এখনও তাঁর কাছে মূল্যবান।
গদ্যসংগ্রহ-এর একেবারে প্রথম বই বইয়ের ঘর-এর প্রথম লেখার
প্রথম বাক্য থেকেই আমরা শঙ্খ ঘ�োষের গদ্যের একটা প্রধান
লক্ষণের সঙ্গে পরিচিত হই—তা হল, পাঠকের সঙ্গে যতটা না-হ�োক,
তার চেয়ে বেশি করে নিজের সঙ্গে নিজের কথ�োপকথন। নিজেকে
তিনি প্রশ্ন করেন বারবার, যেমন ‘হাতপাবাঁধা হনুমান’-এর প্রথমেই
‘আবারও কি হারিয়ে ফেললাম বইখানা?’ এ প্রশ্নটা অবশ্যই তাঁর
নিজেকে। কিন্তু সব সময় নিজেকে প্রশ্ন করেন না তিনি। তাঁর মনে
সব সময় এক পাঠকের প্রিয় উপস্থিতি থাকে, তাঁর মনে হয় তাঁর
লেখা পড়তে পড়তে পাঠকের মনেও একাধিক প্রশ্নের উদ্রেক হতেই
পারে। তিনি নিজে সেই প্রশ্নটি উচ্চারণ করার দায়িত্বও নেন—যেমন
এই লেখার নানা স্থানে। একটা কৃত্তিবাসি রামায়ণ হারিয়ে গেছে বলে
লেখক প্রায় হাহাকার দিয়ে শুরু করেছেন লেখা, কিন্তু পাঠকের
মনে জাগতেই পারে এই প্রশ্ন যে, আর-একটা বই কিনে নিলেই
ত�ো হয়, এত হাহাকার করার কি আছে? সেই প্রশ্নটা তিনি নিজেই
তুললেন, তৃতীয় অনুচ্ছেদে একাধিকবার—‘কেন এত খ�োঁজা? কত
কত রামায়ণে ত�ো ভরে আছে ঝলমলান�ো দ�োকানগুলি। সেসব বই
থেকে অনেক কিছু কি বেশি ছিল সেই আমার রামায়ণে?’
এই বহু বহু প্রশ্ন, কখনও নিজেকে (পাঠককে সেটা জানতে
দিতে তাঁর আপত্তি নেই), কখনও পাঠকের মনের প্রশ্নের অনুমান
ও উচ্চারণ, এবং প্রবল আন্তরিকতায় তার উত্তরদান ও ব্যাখ্যান।
যেমন, ‘বই যখন শরীর পায়’ নামক রচনায়—বালক বয়সে ক�োনও
একটা পরীক্ষায় বসার তাগিদে, মূলত তাঁর বাবার প্রর�োচনায়,
‘পড়তে হল�ো রবীন্দ্রনাথের একগুচ্ছ বই।’ ওই অপরিণত বয়সে
‘বড়দের’ কবিতা পড়ছেন, পাঠকের মনে এই প্রশ্নের পূর্বানুমান
করে তিনি সে প্রশ্ন উচ্চারণ করলেন—‘কিন্তু কবিতা পড়া? ‘চৈতালি’
‘ক্ষণিকা’ ‘উৎসর্গ’ ‘পলাতকা’-র কবিতা পড়া? তার কি ক�োন�ো
অভিভব হবে বালকমনে? হওয়া সম্ভব?’
পরের অনুচ্ছেদেই উত্তর আসে একটু প্রতিপ্রশ্ন দিয়ে—‘কেনই
11
বা নয়?’ ‘চৈতালি’র টুকর�ো টুকর�ো জীবনছবি, গ্রামীণতায় ভরা;
দুলকিলাগা ছন্দে ‘ক্ষণিকা’র ফুরফুরে মেজাজ, ‘পলাতকা’র
কারুণ্যময় মেয়েদের কথা! কেনই-বা এরা মুঠ�োয় নিতে পারবে না
ক�োন�ো অল্পবয়সীর হৃদয়?
এ যেন প্রায় মুখ�োমুখি কথ�োপকথনের গদ্য, যেখানে এক অদৃশ্য
পাঠক (নিশ্চয় পাঠিকাও) হাজির লেখকের সামনে। দ্বিতীয়জনের
কথা বলার সুয�োগ নেই, কিন্তু পাছে সে নিজেকে বঞ্চিত ব�োধ করে
এ জন্য সংবেদী লেখক নিজেই তার প্রশ্নগুলিকে ধরেন এবং তার
সুরাহা করেন। এই গদ্যে একেবারেই ক�োনও প্রভুত্ব নেই, তাতে
নিজের কথা শ�োনান�োর ব্যাকুলতা আছে, সেই সঙ্গে পাঠকের
অনুচ্চারিত প্রশ্ন যে তাঁর লেখাকে এগিয়েও দিচ্ছে তারও স্বীকৃতি
আছে। খুব কম লেখকই তাঁর লেখায় পাঠককে এভাবে উৎকীর্ণ
করেছেন। তাতে পাঠকও কি একটু খুশি হন, লেখকের লেখায় তাঁর
আমন্ত্রণ আছে দেখে? শঙ্খ ঘ�োষের মত�ো করেই আমরা নিক্ষেপ
করি প্রশ্নটা। কিন্তু এখানে আমরা ব্যাকরণের একটা লক্ষণের দিকে
দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তা হল প্রশ্নবাক্যের যথেচ্ছ ব্যবহার। তা একটা
উপায়, কিন্তু কীসের উপায় তার আল�োচনা আমরা আগে করেছি,
একটা দ্বন্দ্ব বা dialectics তৈরির। নিজের সঙ্গে, পাঠকের সঙ্গে।
ফলে পাঠককে মুশকিলে ফেলে এমন শব্দ বা অন্বয় তিনি ব্যবহারই
করেন না।
গ. ক্রিয়াপদের অগ্রাধিকার
তাঁর গদ্যের আর একটা ব্যাকরণগত লক্ষণ যা চ�োখের সামনে
লাফিয়ে লাফিয়ে চলে আসে তা হল তাঁর বাক্যে ক্রিয়াপদের
ব্যবহার। সকলেই আমরা জানি যে, বাংলায় ক্রিয়াপদ বাক্যের শেষে
আসে, সেটাই তার স্বাভাবিক জায়গা। কিন্তু শঙ্খ ঘ�োষের গদ্যে সে
নিয়ম ব্যতিক্রমের দ্বারা সম্মানিত। এখন সব অলীক থেকে একটা
অনুচ্ছেদের অংশ উদ্ধার করি—
‘কলেজের ছাত্রদের নিয়েই তৈরি হয়ে উঠত কলেজের বাইরেও
এক-একটা দল, তৈরি হত�ো হয়ত�ো ক�োন�ো স্টাডি সার্ক্ল, কখন�ো
বা নাম হতে পারত তার ‘প্রগতি পরিষদ’, সেখানে আল�োচনা হত�ো
সাহিত্য নিয়ে রাজনীতি নিয়ে মার্ক্সবাদের নানা তত্ত্ব নিয়ে, পিছন থেকে
উৎসাহ দিতেন মাস্টারমশাইরা। ইতিহাসের অধ্যাপক মামুদ সাহেব
12
থাকতেন পার্কসার্কাস ট্রামডিপ�োর ঠিক পিছনে, একা মানুষ তিনি,
তাঁর ফ্ল্যাটেই হতে পারত বেশিরভাগ বৈঠক। প্রথম দিকটায় তিনি
থাকতেন শ্রোতা, আর তারপর তর্কের আসরে নেমে পড়তেন তিনি
নিজেই। সেখানে কখনও আহ্বান থাকত ননী ভ�ৌমিকের জন্য, কখন�ো
হীরেন্দ্রনাথ মুখ�োপাধ্যায়, কখন�ো বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায়ের? তিনি কি আসবেন আমাদের ডাকে? বরানগরের
বাড়িতে গিয়ে তাঁকে ব�োঝাবার ভার পড়ল একজনের ওপর। রাজি
হয়ত�ো হবেন না, কিন্তু মুখ�োমুখি কথা বলবার এই সুয�োগটা কি ছাড়া
উচিত ? সেই সুয�োগ আঁকড়ে ধরে চলল সেই একজন তাঁর ডেরায়,
বহুক্ষণের সাধনায় বশেও আনতে পারল তাঁকে, আর সেই অবিশ্বাস্য
সফলতার আনন্দে বরানগর থেকে কলেজ স্ট্রিট পর্যন্ত পায়ে হেঁটেই চলে
এল সে, যেন উড়তে উড়তে হালকা হাওয়ায় একটা পাখির মত�ো।’২
যে সব পাঠক এ সব বিষয় লক্ষ করেন তাঁরা জানেন যে, বাংলা
সাধুভাষায় কদাচিৎ ক্রিয়াপদের এই এগিয়ে আসা ঘটত। সাধারণ
বিবৃতিমূলক রচনায় এর দৃষ্টান্ত খুব বেশি না থাকাই সম্ভব। হাতের
কাছের একটি বই থেকে৩ একটি অনুচ্ছেদ তুলি—
‘এই নবজিজ্ঞাসা বা নবচেতনার প্রাথমিক পর্বে তিনটি অস্ফুট
পরিবর্তনের চিহ্ন আমাদের চ�োখে পড়ে। মানুষ নিজের ওপর
বিশ্বাস কিছুটা ফিরে পাওয়ায় পুর�োপুরি দেবনির্ভর বাঙালি জীবন
কিছুটা মানবমুখী হয়ে উঠল—সমকালীন বাংলা সাহিত্যেও তার ছাপ
পড়ল। সাহিত্যে দেবদেবীর মাহাত্ম্যপ্রচার অব্যাহত থাকলেও, তা
ঠিক দেবমুখিতা থাকল না। স্মরণীয়, বৃহত্তর অর্থে যাকে মানবিকতা
(humanism) বলা হয়, তার অর্থ যদি করি, বঞ্চিত নিপীড়িত মানবের
প্রতি মমতা, তাদের দুঃখ নিরসনের সচেতন প্রয়াস, তাহলে উনিশ
শতকের সূচনায় খুব কম জনই তাঁদের কথা ভেবেছেন, বা তাঁদের দু্ঃখ
দূর করে সম্মান দিতে প্রয়াসী হয়েছেন। যে কারণে উনিশ শতকের
এই নবজিজ্ঞাসা বাংলার বৃহত্তর জনজীবনকে স্পর্শ করতে পারেনি।
যা কিছু জিজ্ঞাসা, যা কিছু সংশয়, তা শহর অঞ্চলের (বিশেষ করে
কলকাতার) সামান্য সংখ্যক শিক্ষিতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল, পল্লি
অঞ্চলে তার প্রভাব যথেষ্ট পড়েনি।’
আমরা এমন বলি না যে, এই ক্রিয়ান্তিক বাক্যের মধ্যেও
ব্যক্তির ক�োনও মুদ্রণ আনা সম্ভব নয়, কিংবা বিবৃতিমূলক গদ্যেও
ক্রিয়াপদকে তার বাক্যশেষের অবস্থান থেকে সরান�ো হয় না। কিন্তু
শঙ্খ ঘ�োষ যখন তা করেন তা বাংলায় চলিতভাষা প্রয়�োগের যে
ব্যক্তিগত ব্যাকরণ সেই ১৯১৪-র সবুজপত্র থেকে তৈরি হয়েছে
13
তার দীর্ঘ ঐতিহ্য মেনেই করেন। সেই সময়ে প্রমথ চ�ৌধুরী এবং
রবীন্দ্রনাথের চলিত গদ্য ক্রিয়াপদকে বাক্যের নানাস্থানে সরিয়ে
এনে সেই গদ্যে এক ধরনের ব্যক্তিকতা য�োগ করা শুরু করেন।
এতে, আমাদের মতে, বাক্যে যে সংবাদ দেওয়া হয় তাতে কিছুটা
মৃদু নাটকীয়তার সঞ্চার করা যায়। এই কারণে যে, বাক্যের মূল
সংবাদবাহক যে phrase-গুলি—কে করছে, কী করছে, কীভাবে
করছে সেগুলি পরে আসছে, যেন পাঠকের ক�ৌতূহলকে খানিকটা
ঘনীভূত হতে দিয়ে লেখক খবরটা একটু দেরিতে দিচ্ছেন। বাক্যে
ক্রিয়া শেষে থাকলে ওই হালকা চমকটা থাকে না।
14
এই গদ্যের মধ্যে একটা দ�ৌড় আছে, নানা প্রসঙ্গ এক সূত্রে বেঁধে
এক সঙ্গে বলে ফেলার একটা ইচ্ছা আছে, উনিশ ও আদি বিশ
শতকীয় সাধু গদ্যের মন্থরতার সঙ্গে এর পার্থক্য সহজেই ধরা যায়।
না, জয়েসীয় চেতনা-প্রবাহের মত�ো অত বিশৃঙ্খল নয় এ গদ্য, তবু
ব�োঝা যায়, চেতনাপ্রবাহের মধ্যে গদ্য এক ধরনের বেপর�োয়া মুক্তি
না পেলে এই গতি আসত না পৃথিবীর গদ্যে, এ ব্যাপারে বাংলা
সাহিত্যে তাঁর আগেই একটি ঐতিহ্য হয়ত�ো তৈরি হয়েছিল।
৪ কিছু উচ্চারণ
‘নতুন শব্দের সৃষ্টি নয়, শব্দের নতুন সৃষ্টিই কবির অভিপ্রায়।’
18
জন্য, যেন ঠান্ডা না লাগে।’ দাতারাম বাল্মীকি এর নাম।
এই হল আরেকরকম মানুষ। মানুষ, যেমন হতে পারত। মানুষ, যেমন
হবার কথা ছিল। কিন্তু তার বদলে আমরা এমন হলাম কেন?’
টীকা
১ শঙ্খ ঘ�োষের গদ্যসংগ্রহ ১, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, ২০০২, পৃ. ১৭,
৩১।
২ গদ্যসংগ্রহ ১, পৃ. ১৬৫-৬৬।
৩ স্বপন বসু, বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস, কলকাতা, পুস্তক বিপণি, পৃ. ৮।
৪ গদ্যসংগ্রহ ৩, ২৬৬ পৃ.
৫ ওই, ১৪৬ পৃ.
৬ জার্মানির ওবেরআম্মেরগাউ গির্জায় অনুষ্ঠিত প্যাশন প্লে, রবীন্দ্রনাথ
১৯৩০-এ তা দেখেছিলেন।
19
শঙ্খ ঘ�োষ : অবিরল
স্মৃতিসত্তা...
সমীর রক্ষিত
১
নাইনটিন এইটি ফ�োর গ্রন্থে জর্জ অরওয়েলের একটা উক্তি
আমার কাছে বারে বারে ফিরে আসে। তিনি বলেছিলেন আমাদের
জীবিতকালেই ক�োন বিশাল পরিবর্তন দেখতে পাবার সম্ভাবনা কম।
আমাদের আসল জীবন আছে ভবিষ্যতের গর্ভে। সে ভবিষ্যৎ ঠিক
22
কতদিন পরে, তাও আমরা জানিনা। দশ বছরও হতে পারে, হাজার
বছরও হতে পারে। তবু শুভচিন্তার আর যুক্তিব�োধের এলাকাটা অল্প
অল্প করে বাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে। ওটুকুই আমাদের কাজ।
লেখাটি পড়ে আমার অবধারিতভাবে শঙ্খ ঘ�োষের অননুকরণীয়
স্বরক্ষেপণে বলা, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের করা দূরদর্শনের জন্য
তথ্যচিত্রটির একটি উক্তি মনে পড়েছিল। যেখানে তিনি বলছেন
তাঁর সেই চাপা ও দৃঢ় স্বরে, ফ্যাসিজমকে আমরা নিন্দা করি।
কিন্তু নিন্দা করতে করতে কখন যেন নিজেদের অজান্তেই আমরা
নিজেদের ভেতরে ফ্যাসিজমকে লালন করি। জানতে পারিনা
আমরা নিজেরাও ফ্যাসিস্ট হয়ে গেছি।
সুচিন্তা, শুভচিন্তা, শান্ত স্বরে বলে চলা যুক্তির কথন আজকের
এই জগত থেকে যত মুছে যাচ্ছে, ব্ল্যাকব�োর্ড ভরে ভরে উঠছে
মারাত্মক কাটাকুটি দাগে, অরওয়েলের কথা বা শঙ্খ ঘ�োষের কথা
যেন ভেজা ডাস্টারের মত তত কয়েক বর্গ ইঞ্চি করে মুছে মুছে
ব্ল্যাকব�োর্ডটা পরিষ্কার করে করে দিচ্ছে। যাতে তাতে লেখা চলে
স্পষ্ট কিছু অক্ষর। শান্ত কিছু অক্ষর।
লেখক বা স্রষ্টার সঙ্গে তার পারিপার্শ্বিকের ক্ষমতাবলয়ের যুদ্ধটা
চিরদিনের। আজ তার ধার কিছু বেশি। তবু এই যুদ্ধ অনিবার, এরই
ইতিহাস মানব সমাজ। যতক্ষণ না চারিদিক থেকে চাপ আসে,
যতক্ষণ না লেখক অনুভব করেন কলম বা তুলি তুলে নেওয়াও
একরকমের অবস্থান নেওয়া, লড়াইয়ে শামিল হওয়া, ততক্ষণ তাঁর
সৃষ্টিতে সেই যাচিত আগুন থাকে না ব�োধ হয়, পাঠক যা থেকে
নিজের দীপ জ্বালিয়ে নিতে পারেন।
আমাদের এখনকার লেখাকথাগান সিনেমা, এখনকার শিল্প, সাহিত্য
ক�োথাও যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে মনে হয়, নিজের বাস্তবতা থেকে।
না, আলগা স্টেজ গরম করার প্রতিবাদের কথা বলছি না হয়ত।
চারদিক থেকে যাবতীয় অন্যায় অবিচারকে তিল তিল আহরণ করে,
নিজের ভেতরে তার প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়ে ওঠার জন্য অপেক্ষা
করে, ঝুঁকি নিয়ে কিছু একটা লিখে বা তৈরি করে ফেলার যে কাজ,
তা যে কত কঠিন আর অমিল আজকের দিনে।
ক�োন আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠছেন শিল্পী সাহিত্যিক, এমন
ক�োন ঘটনাকে গল্পকথা মনে হতে শুরু করেছে, আজকাল
জনমানসে তাই বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে রসিকতা, ইয়ার্কিও সেই দিকেই
23
নির্দেশ করে। পাঠক আর বিশ্বাস করেনা যে লেখক ক�োন সততা
বা সিনসিয়ারিটি থেকে রচনা করছেন। আগুনও আহরণ করতে
পারেন না। এই সময়ের এটাই অভিশাপ। এতটাই অবিশ্বাসী সময়
আমাদের।
যেন নিখিলেশ চরিত্র, রবি ঠাকুরের ঘরে বাইরে-তে। যেন ছত্রে
ছত্রে মিলে যাওয়া, প্রায় ভবিষ্যৎবাণীর মত। কীভাবে প্লেগ বিচ্ছিন্ন
শহর হয়ে ওঠে ডিপ্রেসনে ডুবে যাওয়া বিরহ আক্রান্ত প্রেমিক
প্রেমিকার শহর, অবিশ্বাসের শহর, একে অপরকে সন্দেহ করার,
সহানুভূতিশূন্য হবার শহর, তা পড়ে ভাবি কামুর দ্য প্লেগ বইতে,
এ ত আমাদের সময়ের কথা।
সেভাবেই পাতা উল্টোই নয়ের দশকে পড়া ক�োন বইয়ের।
যে বইয়ের নাম লাইনেই ছিলাম বাবা। পাতায় পাতায় লেখা ছিল
ক্ষমতার, ডিক্টেটরশিপের, চাপিয়ে দেওয়া রাজনীতির আগুনের
মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসা এক মানুষের র�োজ নামচা। বইটি ১৯৯৩
তে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে হৈ চৈ ফেলা বললে শুধু ভুল হবে, তার
লাইন বাই লাইন প্রবাদপ্রতিম হয়ে গিয়েছিল। যেভাবে পরশুরামের
কাহিনির এক একটি বাক্যবন্ধ প্রবাদপ্রতিম, হয় হয় জানতি পার�ো
না বা ঠ�োঁটের সিঁদুর অক্ষয় হ�োক ধরনের, সেভাবে এই যে আমাদের
সময়ের চারণ কবি, যাকে ভগবান মেনে চলেছে প্রজন্মের পর
প্রজন্ম, প্রতিটি লেখাতেই এঁকে আমরা আলাদা করে সেলাম করেছি
আর অন্যমনেই মুখস্ত হয়ে গেছে এঁর স�োজাসাপটা লাইনগুলি, যেন
ভঙ্গিমার কাতরতাহীন ভাণহীন, এই সময়ের যা সবচেয়ে সম্পন্ন
মুখ�োশ সেই শিল্পের ভণিতা অতি অলংকরণ থেকে বহু দূরে এক
সত্যকথনের গরিমাময় আল�োতে চ�োবান�ো।
১৯৯৩ সালের বইটি তখন ক�োন রাজা , রাজড়া, ক�োন শাসকের
প্রতি লেখা, তা অনুক্ত থাক, উহ্য থাক। সেসময়ে যে ক্ষমতাবৃত্ত
বলেছে, ‘মত তা-ই যা আমার মত’ সে বৃত্ত সময়ের আন্দোলনে
নেমে গিয়েছে মাটিতে, উঠেছে অন্য ক�োন ক্ষমতাবৃত্তের নতুন
স�ৌধ। সেই ক্ষমতাও এই মুহূর্তে, ‘আজ ২০১৯ সালেও বলছে, মত
তা-ই যা আমার মত’।
‘অন্ধের কাছে কী বা রাত্রি কী বা দিন’ এই বাক্যবন্ধ কবি লেখবার
পর কত অগুন্তিবার উচ্চারণ করেছি আমরা। প্রথম যে বইতে
কবিতার লাইন হিসেবে ঠাঁই পেয়েছিল তা, সে ত এই বইই!
24
বিস্ময়ের বই, আমার যখন ২৮ বছর তখনকার বই, চিরন্তন বই,
লাইনেই ছিলাম বাবা। এখন�ো প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ মাথায় গাঁথা।
কাড়াকাড়ি করে পড়া আমাদের, তাও মনে পড়ে।
লাইনেই ছিলাম বাবা, লহমার জন্য ছিটকে গিয়ে
খুঁজেই পাই না আর নিজেকে— কী মুশকিলে পড়েছি!
এটা ত�ো আমারই টিন? আমার না? এটাই আপনার?
সবই দেখি একাকার। আমি তবে ক�োথায় রয়েছি!
এ কী হচ্ছে? সরে যান-না! আরে আরে— আমরা কি আলাদা?
দেখছেন ত�ো সবকটা এই একসঙ্গে জাপটান�ো দড়ি বাঁধা।
থামুন না! তুমি কে হে? আমি? হেই। হ�োই হেই হাঁট।
প্রতিবাদ? না না বাপু—কিছুই করছি না প্রতিবাদ।
ক�োন�োমতে ফিরে যাব ফাঁকা টিন বাজিয়ে সহজে—
আগুনই ক�োথাও নেই— কী হবে-বা জ্বালানির খ�োঁজে।
(লাইন/ শঙ্খ ঘ�োষ)
২
মনে পড়ে ১৯৮৫ সাল। প্রেসিডেন্সি কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের
শেষাশেষি অথবা সেকেন্ড ইয়ারের শুরু সেটা। কলেজটাই নরম
ল�োহার পাতকে দুমড়ে মুচড়ে আকার আকৃতি দেয়। কলেজের তিন
প্লাস দুই ওই পাঁচটা বছর। আমার কাছে অম�োঘ, অনিবার্য। বি এ
ফার্স্ট ইয়ার থেকে এম এ পড়া অব্দি জীবনের বছরগুল�োর যে দৃপ্ততা,
তা আমার বাকি জীবনকে গড়ে দিল। দেয় ব�োধ হয় এভাবেই। আর
সেই সময়ের প্রতি মুহূর্ত কীভাবে যেন গানে কবিতায় বইয়ের পাতা
ও সিনেমায় এক জমজমাট হয়ে চলা, বেজে ওঠা অর্কেস্ট্রা ছিল।
সেই অর্কেস্ট্রায় প্রায় প্রতিদিন ছিলেন শঙ্খ ঘ�োষ ও তাঁর কবিতারা।
আমাদের কলেজ জীবনের সেই দিনগুল�োর ধরতাই ছিল
রাজনীতি। এক দিকে এসএফআই, অন্যদিকে অতিবাম রাজনীতির
ছেলেপিলেরা ক্যান্টিন কাঁপাত, প�োর্টিক�োয় জমায়েত হত। ক্লাসে
ক্লাসে ক্যামপেন করত। ত�ো, সেইসব ক্যাম্পের থেকেই আসত
ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা, ভ�োট পেয়ে যারা ইউনিয়ন রুম দখল
করত আর তারপর একের পর এক আয়�োজন করত নানান
প্রতিয�োগিতার।
আশ্চর্যের কথা, সেরকমই এক ইউনিয়ন আয়�োজিত আবৃত্তি
প্রতিয�োগিতায় প্রথম বিষয় হিসেবে পেয়েছিলাম, ‘বাবুমশাই’।
25
সে ছিল একদিন আমাদের য�ৌবনে কলকাতা!
বেঁচে ছিলাম ব’লেই সবার কিনেছিলাম মাথা
আর তাছাড়া ভাই
আর তাছাড়া ভাই আমরা সবাই জেনেছিলাম হবে
নতুন সমাজ, চ�োখের সামনে বিপ্লবে বিপ্লবে
যাবে খ�োল-নলিচা
যাবে খ�োল-নলিচা পালটে, বিচার করবে নিচু জনে’
কিন্তু সেদিন খুব কাছে নয় জানেন সেটা মনে
মিত্র বাবুমশয়
প্রত্যেকের মুখে মুখে ফেরা সেই কবিতার সঙ্গে ক্যান্টিনের টেবিল
পিটুনির শব্দ। ছন্দের মায়াজালের সঙ্গে সঙ্গে, আজ্ঞে হ্যাঁ, সেই
ইতিহাসচেতনাই। কেননা তখন সময় লালে লাল। আমরা কম্যুনিস্ট
কাকে বলে জানছি। কম্যুনিস্ট আদর্শবাদের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের সংঘাত
নিয়ে এ কবিতা তার আগে অথবা পরে অনেকেই আবৃত্তি করেছে। কিন্তু
মুখে মুখে ফেরা সেই মজাদার ছড়ার ছন্দের সূত্র একবার যার মাথার
ভেতর বসে গেছে, তার জীবন হয়ত পুর�োটাই একরকম থাকেনি।
এই যে কলেজ ক্যান্টিনে বসে বসে জীবনের কিছু পাঠ নেওয়া,
এই যে প্রতিটি রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ, আর এই
যে কবিতার মধ্যে দিয়ে তা ঘটা — কেমন এক অব্যর্থ দীক্ষা এটা।
শঙ্খ ঘ�োষের ভাষাতেই বলতে ইচ্ছে করে :
‘আর কলকাতা, কলকাতা খুলে দিল সাম্প্রতিকের দরজা। একদিনে
নয়, দিনে দিনে। সেখানেও ছিল বহিরাগতের ভীরুতা, জানা ছিল না
ক�োনদিকে আছে পথ... প্রেসিডেন্সি কলেজের পিছনবেঞ্চ থেকে সামনের
দিকে টান দিয়েছিল যারা, তারা কবি ছিল না কেউ, ছিল কবিতার
প্রেমিক। তাদেরই হাতে উপহার পেয়ে পেয়ে একদিন আধুনিক কবিদের
পৃথিবীতে প�ৌঁছে গেছি কখন। ছমছমে এক অজানা গুহার সামনে সেই
আমাদের সমবেত মুগ্ধতা – আজও স্পষ্ট মনে পড়ে।’ (কবিতার মুহূর্ত)
আশ্চর্য, এই কথা কি আমার�ো নয়? অথবা, আমরা কি
নিজেদেরই বার বার করে তৈরি করে নিইনা আমাদের পিতৃসমদের
আদলে? হয়ত এভাবেই ঘটে দীক্ষা, চলে প্রজন্মের পর প্রজন্মে
চলাচল, মানসধারার।
হ্যাঁ, সেই বইটিকে আবিষ্কারও আমার ক্যান্টিনে বসেই। একদিন
এক বন্ধু ক্যান্টিনে নিয়ে এল পাতলা একটা বই। কবিতার মুহূর্ত।
এ বই নিয়ে কীভাবেই না কাড়াকাড়ি করেছি আমরা। এই বইতেই
26
পেয়েছি, কবির নিজের লেখা নিজের কবিতার ইতিহাস — যে
প্রবন্ধটির নামই ‘কবিতার মুহূর্ত’।
‘যমুনাবতী’-র মত অতি জনপ্রিয় কবিতার লেখার পেছনের
ঘটনাকাহিনি, ক�োন সে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সংয�োগ করে চিন্তার বারুদে
আগুন, আর ঘটিয়ে ত�োলে কবিতার আতশবাজি...তা জানার সুয�োগ
পেয়েছি। জেনেছি ‘বাবরের প্রার্থনা’-র মত কবিতার প্রেক্ষাপট। আর�ো
কত, কত কবিতা। ‘আরুণি উদ্দালক’, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’,
‘লজ্জা’, ‘ভিখিরি ছেলের অভিমান’, ‘কলকাতা’। প্রতিটা কবিতা
নিজেকে উন্মোচিত করেছে আমার কাছে, এই কবিতার মুহূর্তের হাত
ধরে ধরেই। আর কী বিশাল এক ইতিহাসপট রচিত হয়েছে মাথার
ভেতরে। কতটাই না বড় হয়ে খুলে গেছে কবিতার আকাশ।
হ্যাঁ, ইতিহাসচেতনার প্রথম পাঠ ত�ো এভাবেই পেতে হয়।
সমাজসচেতন, এক তীব্র সময়-সংবেদী কবির প্রতিটি অক্ষরকে হতে
হয় সৎ ও দায়বদ্ধ, প্রতিটি অক্ষর থেকে ঝরে পড়ে তাঁর বিশ্বাসের
কথা – এই কথাটিও মনের ভেতর মুদ্রিত হয়েছে সেই সময় থেকেই
অম�োঘভাবে। আর ত�ো ক�োনমতেই তা থেকে মুক্তি এল না আমার
মত সামান্য কবিতালেখকেরও।
নিজেকে যখনই মনে হয়েছে বিচ্ছিন্ন, প্রেসিডেন্সির ক্যান্টিন থেকে
শুরু করে, জীবনের যে যে ক্ষেত্রে নিজের ‘অয�োগ্যতা’ নিজেই দেখে
মুখ লুকিয়ে সরে আসা হয়, তখন ত�ো সাথী হয় ‘কলকাতা’-র মত
অম�োঘ কবিতাই। ‘বাপজান হে/ কইলকাত্তায় গিয়া দেখি সক্কলেই
সব জানে/ আমিই কিছু জানিনা’...
৩
এরপর আমরা বড় হয়ে গেলাম। আমরা আমাদের যার
যার জীবনে অংশগ্রহণ করলাম। আমি ত�ো আর ফিরে যাইনি
পঠনপাঠনের প্রাঙ্গনে, করিনি মেধা ও জ্ঞানের বিশ্ববিদ্যায়তনিক
চর্চা। অ্যাকাডেমিশিয়ার থেকে দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছি আমি। এসেছি
অন্য পেশায়। ১৯৯৩ সেই সময়। আমি ইতিমধ্যেই শিমলাতে
তখন। কলকাতায় এসে সংগ্রহ করলাম বিপুল হৈ চৈ পড়ে যাওয়া
বইটি। প্রায় মুখে মুখে একেবারে অনিবার্য হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই
‘তুমি ক�োন দলে’ কবিতাটি।
তার আগে ও পরে, সারা ভারতে যেমন ধর্ম জাতপাতের
27
সুভাষ মুখ�োপাধ্যায়কে লেখা শঙ্খ ঘ�োষের লেখা একটি চিঠি
29
রাষ্ট্র তার নিজস্ব অস্ত্রগুলি সর্বদা চ�োখা রাখে। তাই সিঙ্গুর
নন্দীগ্রাম মনে পড়ে, তারপর সম্প্রতি আবার�ো মৃত্যু মনে পড়ে
ইস্কুলবালকদের, পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুরে... মনে পড়ে কাশ্মীর,
মনে পড়ে ছত্তিসগড়।
‘আমি যখন চালাই গুলি /বুলেট ত�ো প্রায় ক্ষীরের পুলি/ লক্ষ্যে
ঠিকই থাকে মাথার খুলি’ অথবা ‘আমি যখন মারছি ত�োমায়/ বুঝতে
হবে সেসব সময়/মরছ কেবল নিজের নিজের ব�োমায়’ (গানের
মত�ো)
সেই একই কবিতা কী অব্যর্থভাবে এখানেও তাই প্রয�োজ্য, এই
সময়েও।
নিজের বুদ্ধিবৃত্তির ওপরে অসম্ভব আত্মপ্রত্যয় যে ‘পাবলিকের’
সেই পাবলিক এখন, উত্তর ডিজিটাল যুগে, হ�োয়াটসঅ্যাপ
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া করতে করতে আর�ো বেশি বুদ্ধিমান কিনা,
তাই মনে হয় এই কবিতা আজই লিখলেন কবি :
হঠাৎ কখন�ো যদি ব�োকা হয়ে যায় কেউ, সে ত�ো নিজে আর
বুঝতেও পারে না সেটা/ যদি বুঝতই তাহলে ত বুঝদারই
বলা যেত তাকে। তাই যদি, তবে
তুমিও যে ব�োকা নও কীভাবে তা বুঝলে বল�ো ত�ো? (ব�োকা)
৪
শঙ্খ ঘ�োষকে নিয়ে বলার মূল কথাটি কিন্তু আরেকটু আলাদা।
সেটা হল এইই, যে, তিনি কখন�ো অন্য কারুকে দ�োষ দেন না
তাঁর লেখায়। তাঁর শ্লেষ এতটা বিদ্ধকারী কারণ তাঁর দ�োষার�োপের
জন্য তুলে ধরা আঙুলগুলির কিছু যেমন অন্যদিক বাকিগুলি সব
নিজের দিকেই ফেরান�ো। কখন�ো ভুলতে দেননা, আমরা আপন
31
দ�োষে কীভাবে নিজেদের জড়িয়ে নিচ্ছি এই ভয়াবহ সময়ের সাক্ষ্যে,
ভয়াবহ ধ্বংসের বা মৃত্যুর অনেকগুল�োই আমরাই সাধন করছি
ঘটাচ্ছি মানুষকে ঠেলে দিচ্ছি অনিবার্য মৃত্যুর মুখে। এই ভয়ানক
আত্মদগ্ধকারী বিবেকের সচেতনাই আমাদের উত্তরাধিকার এই বই
থেকে। ফ্যাসিজম সম্বন্ধে বলা হয় একজন ডিক্টেটর, যথা হিটলার
কীভাবে জন্মেছিলেন সেটা বড় প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন এই যে এতজন
সাধারণ জার্মান কীভাবে নাৎসিবাহিনীর উদগ্র সদস্য হয়েছিলেন,
এত জন কীভাবে বিশ্বাস করেছিলেন হিটলারের পথই একমাত্র পথ।
অন্ধ প্রশ্নহীন আনুগত্যে আমরা, আমি আপনি তিনি আমাদের মত
সাধারণরাই আসলে বিশাল বিশাল সব নেতানেত্রীদের তৈরি করি।
দ�োষ কার�ো নয় গ�ো মা, নেচে নেচে এসেছ হে শ্যামা
নৃমুন্ডমালিনী, খচ মুন্ডু কেটে নেবে বলে, সে ত�ো
আমারই আদরে, আমি খাল কেটে এনেছি ত�োমাকে —
কীভাবে কেটেছি তাও কিংবদন্তি হয়ে আছে আজ। (শ্যামা)
সেকারণেই, এই অস্বস্তিকর যাত্রায় আত্মদর্শনে ক�োন নিবৃত্তি
দেন না কবি। দেন না ক�োন নিষ্কৃতি আমার নিজস্ব অপরাধব�োধ
থেকে। আমাকে কখন�ো তিনি ছেড়ে দেন না। পাঠক কবির সঙ্গে
চলে নিরুপায়। কেননা সেও সমান হেঁটমুন্ড।
আর এই সবটাই লেখা হয় নির্জলা পথের ঘাটের সর্বজনের
ভাষায়। গভীর থেকে গভীরে চলন অথচ বাচনে সর্বজনগ্রাহ্যতা।
এইই আমাদের সময়ের স্বর শঙ্খ ঘ�োষ। যাঁর প্রবাদপ্রতিম অস্তিত্ব
আর�ো এক শতক ছুঁয়ে থাকবে আমাদের।
32
নিঃশব্দের সংয�োগ
শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়
34
তাতে নাম কবিতাটির মত�োই ঠাঁই পাবে ‘আয়ু’ কবিতাটিও।
নাম কবিতাটি ত�ো ‘নিঃশব্দের তর্জনী’র প্রায় সহ�োদরা বলা
যায়। কিন্তু ‘নিঃশব্দের তর্জনী’ লেখার প্রায় সমসময়ে, ১৯৬৭
থেকে ১৯৬৯-এর মধ্যে লেখা কবিতাগুলি যখন ১৯৭৮-এ
‘তুমি ত�ো তেমন গ�ৌরী নও’ নামে গ্রন্থবদ্ধ হয়, তখন তাতে
দেখি ‘নিঃশব্দ’ নামেই একটি কবিতায় শঙ্খ ঘ�োষ লিখছেন :
যেমন চালাক ছেলে হঠাৎ ঘুরিয়ে নেয় মুখ
সে-রকম নয়
ওরা চারপাশ থেকে ঘিরে ওর বুকে রঙ মারে।
35
শুরুর অনেকদিন আগেই গত হয়েছিল। ‘শব্দ আর সত্য’ বইয়ের
‘ঈশ্বরের এক মুহূর্ত’(১৯৭৪) প্রবন্ধে এই প্রসঙ্গে তিনি এলিয়টের
‘সেক্রেড উড’ গ্রন্থের বহু চর্চিত ‘ট্র্যাডিশন অ্যান্ড ইন্ডিভিজুয়াল
ট্যালেন্ট’ প্রবন্ধের প্রসঙ্গ টেনে দেখিয়েছেন কীভাবে ওয়ার্ডসওয়ার্থীয়
কবিতার ধারণা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছিল গত শতাব্দীর তিরিশের
দশকের বাংলা কবিতার জগতে। সুধীন্দ্রনাথ থেকেই তিনি উদ্ধার
করেছেন, ‘প্রেরণাতে অল�ৌকিকের আভাস আছে বলে সাহিত্যসৃষ্টির
উক্ত উপকরণ আমি সাধ্যমতে মানতে চাইনি, তার বদলে আঁকড়ে
ধরেছিলুম অভিজ্ঞতাকে।’ প্রেরণাকে অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রতিস্থাপিত
করার এই প্রকল্পে একেবারেই সায় ছিল না শঙ্খ ঘ�োষের। বাইরের
সঙ্গে ভিতরের নিবিড় য�োগ রেখেও নিজেকে ক্রমাগত ভিতরমুখী
করার একধরনের ব�োধ ছিল। তাই ‘কল্পনা আমার প্রজা ; মগজের
আমি জমিদার’ গ�োত্রের উচ্চারণে তাঁর অস্বস্তি গ�োপন থাকেনি।
এমনকী সুভাষ মুখ�োপ্যাধ্যায়ের সঙ্গে সখ্যের দিনগুলির স্মৃতিচারণে
তিনি শুনিয়েছেন ‘ফুল ফুটুক’ বইয়ের শেষ কবিতা ‘এখন ভাবনা’র
সৃজনকথা। মফস্বলের এক শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সুভাষ
না কি বলেছিলেন কবিতার একটা ‘প্লট’ মাথায় এসেছে তাঁর। যার
পরিণতি এই কবিতাটি। দুটি কবিতার যুগ্মকে এখানে প্রথমটির
ভাবনা দ্বিতীয়টিতে পরিণতি লাভ করেছে এইভাবে :
ঠিক তেমনি দূরে,
কতদূরে ঠিক জানি না,
আজও দেখতে পাচ্ছি—
হিরণ্যগর্ভ দিন
হাতে লক্ষ্মীর ঝাঁপি নিয়ে আসছে।
গান গেয়ে
আমাকে বলছে দাঁড়াতে।
41
আমাকে ভুবন দাও
আমি দেব সমস্ত অমিয়
কিশ�োর সেনগুপ্ত
44
পারি, সেই ক্ষমতাটা? কিংবা অনেকসময়ে তারও চেয়ে একটু এগিয়ে,
ভাবতে পারি বা না পারি, আমি যে আমি, সেই অবস্থানটা? কথা বলা
একটা সংয�োগ। কিন্তু ওইসব সময়ে, ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয় — কেবলমাত্র
অ-য�োগ নয় — সেটা সমূহ বি-য�োগেও গিয়ে প�ৌঁছতে পারে।
ওই একই ভাষণে তিনি তাঁর এক মাস্টারমশাই প্রেসিডেন্সি
কলেজের অধ্যাপক গ�োপীনাথ ভট্টাচার্য’র উল্লেখ করেছেন।
অধ্যাপক ভট্টাচার্য দর্শন পড়াতেন। তাঁর পাঠদানকালে ছাত্রছাত্রীরা
অধ�োমুখ, খাতায় নোট নিতে ব্যস্ত।
অধ্যাপক ভট্টাচার্য ওদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন: ‘তাহলে
আমি কথা বলব কার সঙ্গে? ব�োঝাব কাকে যদি ত�োমাদের চ�োখ
থাকে খাতায়? বুঝব কেমন করে যে কথাগুলি প�ৌঁছচ্ছে ক�োথাও?’
এই তাহলে সংয�োগের এক অলিখিত শর্ত যেখানে বক্তা এবং
শ্রোতা উভয়ের চ�োখই থাকবে খ�োলা, পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ।
শঙ্খবাবু সংয�োগ বা সংয�োগের ভাষা নিয়ে যে গভীর উচ্চারণ
করে গিয়েছেন আজ তা নিয়ে গভীরভাবে ভাববার সময় এসেছে।
বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে যাওয়া ‘আত্মসমাল�োচনা’ নয়, আজ দরকার
গভীর ‘আত্মসমীক্ষা’ (ইনট্রোস্পেকশন)। আমরা সকলেই জানি
দু’হাজার সাতের প্রায় গ�োড়া থেকেই পশ্চিমবঙ্গব্যাপী এক ভয়ঙ্কর
অরাজকতা জারি ছিল। আজ বলতে দ্বিধা নেই যে, রাজনৈতিক
বাধ্যবাধকতার জায়গা থেকে সে-অরাজকতার ব্যাখ্যা একরকম।
আবার ওই আত্মসমীক্ষার জায়গা থেকে দেখলে অনেকগুল�ো প্রশ্ন
এবং সমাধান একই সাথে ভিড় করে আসে মনে। অনেক অনেক
সমস্যা ছিল, অনেক সময়েই অকারণ অয�ৌক্তিক বির�োধ ছিল
তবুও প্রশ্ন জাগে: সংয�োগের ভাষা ব্যবহারে ক�োথাও কি ক�োন�ো
বিনয়ের অভাব ছিল? যে অভাব একটা সময়ে বিধ্বংসী ক�োন�ো
লব্জের জন্ম দেবে! শঙ্খবাবুর কাছ থেকে জানা গেল কমলকুমার
মজুমদার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বলছেন: ‘শ�োন�ো, এই যে আমরা
উপন্যাসটা লিখছি...’, সুনীল বাধা দেন: ‘আমরা বলছেন কেন
কমলদা, লিখছেন ত�ো আপনি!’ উত্তরে কমলকুমার জানিয়েছিলেন
ম�োটেই তিনি লিখছেন না। ঠাকুর তাঁকে দিয়ে লেখাচ্ছেন। ‘সেটা
আমি না হয়ে তুমিও হতে পারতে বা অন্য কেউ। আমরা সবাই
মিলেই লিখছি।’ শঙ্খর মতে এটা বিনয় নয় বিশ্বাস। বিশ্বাসটা এই
যে, আমার আমিটা খুব বড়�ো কথা নয় ওটা একটা উপলক্ষ মাত্র।
45
চারপাশের মানুষগুল�োর মধ্যে একইসাথে একই অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত
হচ্ছে, প্রকাশটা হয়ত�ো হচ্ছে একজন বা দুজনের মাধ্যমে। যখন
ক�োন�ো একজনের থেকে ভাবনাটা প্রকাশিত হচ্ছে তিনি বলতেই
পারেন যে এটা ‘আমি’ বলছি—ভুল ত�ো নেই কিছু তাতে। আবার
সেই প্রকাশ মুহূর্তেই কেউ বলতে পারেন ‘আমরা’, তাতেও ভুল
হয় না বরং গ�োড়ায় বলা চিকিৎসকটির মত�ো নিজেদের পরিসরের
মানুষজনকে আপন করে নেওয়ার একটা শক্তি তৈরি হয়।
উল্লিখিত ভাষণটির আরেকটি অংশের পাঠ নিয়ে আমরা প্রসঙ্গান্তরে
যাব। ধূর্জটিপ্রসাদের একটি বইয়ের নাম আমরা ও তাঁহারা। দুটি পক্ষ
যে-বইয়ের আধার। একপক্ষে ‘তাঁহারা’। অন্যপক্ষে ‘আমরা’। অথচ
পাঠের মধ্যে সবসময়ই ‘আমি’ ‘আমরা’ নয়। ভূমিকায় ধূর্জটিপ্রসাদ
বলছেন: ‘আমরা ও তাহারা-তে একদিকের বক্তা আমি, অন্যদিকের
বক্তা তাঁহারা।’ তবে নামে কেন ‘আমরা’? ধূর্জটিপ্রসাদের জবাবদিহিঃ
‘নিজের মধ্যে তথাকথিত উচ্চশিক্ষিতের দ�োষগুল�ো লক্ষ্য করেছি
বলেই একবচন ব্যবহার করেছি।’
শঙ্খ ঘ�োষ তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য, বিপুল অভিজ্ঞতা,
অসামান্য সৃজনশীলতা দিয়ে সংয�োগের এই দিকটি আত্মস্থ
করতে পেরেছিলেন। আর সেটি করতে পেরেছিলেন বলেই
এই সেদিনের—‘দেখ খুলে ত�োর তিন নয়ন/রাস্তা জুড়ে খড়্গ
হাতে/দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন’—এই লেখার বহু আগে ওই
দু’হাজার সাত সালে বলতে পেরেছিলেন:
‘যেসব সময়ে এই সমস্তটাকে জড়িয়ে নিয়ে ভাবনা করবার কথা,
তখন ‘আমরা’ শব্দের এমন বিভাজিত প্রয়�োগ হয়ত�ো স্থায়ী ক�োন�ো সঙ্কট
তৈরি করে তুলতে পারে, আমাদের ব�োঝায় অনেক ভুল ঘটে যেতে
পারে। ধরা যাক, ক�োন�ো সরকার যখন ‘আমরা’ উচ্চারণে ক�োন�ো কথা
বলেন, তখন সে-আমরা থেকে বির�োধী ক�োন�ো রাজনৈতিক পক্ষ বর্জিত
থাকতে পারে বটে, কিন্তু তার অন্তর্গত করে নেবার কথা দেশের সমস্ত
সাধারণ মানুষকে। অর্থাৎ বক্তাকে বুঝতে হবে যে তাঁর সেই ‘আমরা’র
পরিসর যত ছ�োট�ো হয়ে আসবে, তাঁর দেশও হয়ে উঠবে ততটাই খণ্ডিত।
কথাটা এ নয় যে ‘ওদের’ ‘আমরা’ করে তুলতে হবে, বরং এই হবার
কথা ছিল যে ‘ওরা’ ‘আমরাই’। সেটা লক্ষ না করে, আমরা-ওরার যে
বিভাজনটা দূর করবারই দায়িত্ব ছিল আমাদের, একটা শব্দ ব্যবহারের
মধ্য দিয়ে সেটাকে হয়ত�ো-বা বাড়িয়েই চলেছি আমরা।’’
কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র নামের একটি নাট্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত
46
আমরা অনেকে। ব্রাত্য বসুর নাট্যরূপে শঙ্খ ঘ�োষের ‘বাবরের প্রার্থনা’
মঞ্চস্থ করেছি আমরা। সে-প্রসঙ্গে পরে আসব। কল্যাণী নাট্যচর্চার
প্রথম প্রয�োজনাটি বেশ সমাদৃত হয়। একটা দুট�ো পুরস্কারও আসতে
শুরু করে; সেটি উনিশশ�ো আটানব্বই সাল। সংগঠনে আমরা
সিদ্ধান্ত নিই প্রয�োজনার কারণে কেউ যদি অর্থমূল্যে ক�োন�ো পুরস্কার
পান তবে তা সংগঠনকে দিয়ে দিতে হবে। কেননা নাট্য প্রয�োজনার
সাফল্য নির্ভর করে দলগত কাজের ওপর, ব্যক্তির উৎকর্ষ সেখানে
গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই, কিন্তু সমবেত উদ্যোগের ঊর্ধ্বে নয় কখনই।
আমাদের মধ্যে গ�োলমালটা হল এই যে, আমরা বিভ্রান্তি বা অজ্ঞতার
কারণে প্রায় সময়েই আমাদের সকলের করা কাজটাকে ‘আমার
কাজ’ বলে দেগে দিয়ে আত্মতৃপ্তিতে মগ্ন হয়ে পড়ি। ব্যক্তিগত স্তর
থেকে সামাজিক রাজনৈতিক স্তর পর্যন্ত এই ‘আমি’ তখন হয়ে ওঠে
‘এক ঘ�োষণা-শব্দ, চিৎকার-শব্দ’—তৈরি হতে থাকে একটা জ�োর
দিয়ে বলবার অসভ্য অভ্যেস, যে অভ্যেস আস্ফালনের মধ্যে দিয়ে
নিঃশব্দে এগিয়ে আসতে থাকে ফ্যাসিবাদ। ‘ফ্যাসিবাদ আমাদের
স্বভাবের একটা অনিয়ন্ত্রিত চিৎকার।’
থিয়েটার করার সূত্রেই শঙ্খ ঘ�োষের সঙ্গে আমাদের য�োগায�োগ
সম্ভব হয়েছিল। মানুষটি নিজে থেকেই দেখতে এসেছিলেন আমাদের
প্রয�োজনা নক্সীকাঁথার মাঠ। তারপরে অনুরুদ্ধ হয়ে দেখেছিলেন অমর
মিত্রর উপন্যাস নির্ভর আমাদের আরেকটি প্রয�োজনা অশ্বচরিত।
সিরিয়াস থিয়েটারে ওইটিতেই আমাদের দলের নিজস্ব নির্দেশক;
এবার আর আমন্ত্রিত নির্দেশক নন। অশ্বচরিত দেখে একটি এক
পৃষ্ঠার চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তাতে প্রথমেই উল্লেখ করেছিলেন
নক্সীকাঁথার মাঠ দেখে মুগ্ধতার কথা। সেইসাথে অশ্বচরিত নিয়ে বেশ
কয়েকটি পরামর্শ।
সত্যি বলতে ওঁর সঙ্গে আমাদের মুখ�োমুখি আলাপ ব্রাত্য বসুর
মাধ্যমে। বাবরের প্রার্থনা কবিতাটির নাট্যরূপ দেওয়ার পর সেটি
শ�োনান�োর জন্য আমরা দুজনে মিলে প�ৌঁছে যাই উল্টোডাঙার
ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসেরর এক সাধারণ ফ্ল্যাটে। বসার ঘরে দেওয়ালে,
তাকে, খাটে সর্বত্র বই আর পত্রপত্রিকা। তারপর নানা কারণে সময়ে
অসময়ে বহুবার কথা হয় টেলিফ�োনে। বাবরের প্রার্থনা’র মঞ্চ মহলা
দেখতে এসেছিলেন কল্যাণীতে। এরপর গ�ৌতম হালদারের একটা
কাজের সূত্রেও বেশ কয়েকবার ওঁর কাছে যেতে হয়েছিল।
47
২০১৬-র ন�োটবন্দি ঘ�োষণা হওয়ার কয়েকদিন পর জ্ঞান
মঞ্চে অভিনয় ছিল নুরলদীনের সারাজীবন প্রয�োজনার। দেখতে
এসেছিলেন এবং শ�ো শেষে বাঙালির ত�ো বটেই আমাদের জাতির
বিবেক নিজে থেকে মঞ্চে উঠে এসে আলিঙ্গন করেছিলেন প্রণামটুকুও
করবার সুয�োগ না দিয়ে—সে এক আশ্চর্য শিহরণ। বড় ইচ্ছে ছিল
দয়াময়ীর কথা দেখবেন। স্বাস্থ্য এবং কর�োনা সংক্রমণের সতর্কতার
কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। বন্ধু ইমানুল হকের মাধ্যমে দয়াময়ীর
কথা’র ভিডিও পাঠিয়েছিলাম। মনে হয় দেখে উঠতে পারেননি।
একটা ভীষণই খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা।
সে যে কেবল অশ্রুতপূর্ব, অদৃষ্টপূর্ব অতিমারীর কারণে—তা নয়
অতিমারী নিশ্চিত করেই এক ভয়ঙ্কর সংকট ও অনিশ্চয়তার
মধ্যে ফেলেছে গ�োটা বিশ্বের মানুষকে। আমাদের বিপদ সেসবের
চেয়েও মারাত্মক। ভ্যাকসিন, সতর্কতা অবলম্বন ও অন্যান্য স্বাস্থ্য
সংক্রান্ত বিধিনিষেধগুল�ো পালন করে হয়ত�ো বা এই অতিমারীকে
রুখে দেওয়া যাবে কিন্তু যে ভয়াল সঙ্কট আমাদের মন�োজগতে,
আমাদের সামাজিকতায়, আমাদের সাংস্কৃতিক মননে নেমে এসেছে
এবং আসছে প্রতিনিয়ত—সেসব প্রতিহত করার পদক্ষেপে শঙ্খ ঘ�োষ
কেবল আমাদের শক্তি ছিলেন না, ছিলেন বিবেক, ছিলেন চেতনা।
ওঁকে সামনে রেখে, ওঁর লিখে যাওয়া কথাগুল�োকে বারংবার
উচ্চারণ করে যে যূথবদ্ধতা নির্মিত হত প্রতিনিয়ত, তা ওই ‘দশের
লাঠি একের ব�োঝা’ গ�োত্রীয় প্রবাদ।
তিনি চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। সবাইকেই যেতে হয় ক�োন�ো
না ক�োন�োদিন। আমরাও একটা একটা দিন পার করছি আর এগ�োচ্ছি
প্রৌঢ়ত্বের চ�ৌকাঠে। এমন সময়ে, এই আমাদের মত�ো প্রবীণেরা
ওঁরই শেখান�ো প্রার্থনাটুকু নিবেদন করতে পারি স�োচ্চারে—বিশেষত
আজকের অশ্লীল ও অপসংস্কৃতিময় বিপন্ন সময়ে—‘ধ্বংস করে দাও
আমাকে যদি চাও, আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’
আমাদের এক মাস্টারমশাই কয়েকদিন আগেই প্রায়শই আমাকে
বলতেন ইয়�োনেস্কোর ‘গণ্ডার’ নাটকটি মঞ্চস্থ করার জন্য। ওঁর এই
বলার নেপথ্যে একটা যন্ত্রণা ছিল, হয়ত�ো বা হতাশাও। গত কয়েক
বছর যাবৎ ভারতবর্ষের সামাজিক রাজনৈতিক জগতে যে সাম্প্রদায়িক
মেরুকরণের লাগাতার প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছে তা থেকে মুক্ত থাকেনি
আমাদের রাজ্যও। এবং কী আশ্চর্য—পাশের, কাছের বহু পরিচিত
48
মানুষজন হাসতে হাসতে কত সহজে ম�ৌলবাদী ভাবনার সঙ্গী হয়ে
যাচ্ছেন তা দেখে যন্ত্রণা পাওয়াটাই স্বাভাবিক। বছর চারেক আগে
সাংগঠনিক এক সঙ্কটে পড়ে থিয়েটারের অগ্রজ মানুষ রুদ্রপ্রসাদ
সেনগুপ্তকে ফ�োন করতে হয়েছিল। প্রয়�োজনীয় কথাবার্তার পর
রুদ্রবাবু টেলিফ�োনে একটা কবিতা শুনিয়েছিলেন—শঙ্খ ঘ�োষের
হামাগুড়ি। বহু পঠিত বহুশ্রুত হলেও এই পরিসরে কবিতাটি উদ্ধৃত
করা প্রয়�োজন—
ঘুমটা ভেঙে গেল হঠাৎ। বাইরে কি ঝড় হচ্ছে?
দাপাদাপি করছে জানলার পাল্লা দুট�ো
মাঝে মাঝে বিজলি ঝলকাচ্ছে।
ফের শুয়ে পড়তে গিয়ে সেই বিদ্যুতের ছটফটে আল�োয় মনে হল
ঘরের মধ্যে যেন হামা দিচ্ছে কেউ। কে এখানে? কে?
হামা ক�োন�ো শব্দই করে না।
উঠে আসি কাছে, আবারও জিজ্ঞেস করি, কে আপনি? কী চান?
সে তবু নিশ্চুপ থেকে এ ক�োণে ও ক�োণে ঘুরছে
মাথা তুলছে না কিছুতেই, চ�োখে চ�োখ নয়।
‘কিছু কি খুঁজছেন আপনি?’
শুনতে পাচ্ছি, ‘খুঁজছি ঠিকই, খুঁজতে ত�ো হবেই
পেলেই বেরিয়ে যাব, নিজে নিজে হেঁটে।’
‘কি খুঁজছেন?’
মিহি স্বরে বললেন তিনি ‘মেরুদণ্ডখানা।’
সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলকান�ো ফের। চমকে উঠে দেখি...
একা নয়, বহু বহু জন
একই খ�োঁজে হামা দিচ্ছে এ-ক�োণে ও-ক�োণে ঘর জুড়ে।
যে যন্ত্রণায় কাতর হয়েছি আমরা সাম্প্রতিকে, সত্যদ্রষ্টা কবিকে তা
দংশন করেছিল আরও বহু আগে।
ওঁর কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ—সেসব নিয়ে বিস্তারিত আল�োচনা
ধৃষ্টতারই নামান্তর হবে। কতটুকুই বা জানি আমরা! তবুও তারই
মধ্যে ওঁর অসংখ্য কবিতার উল্লেখ আমাদের প্রাণিত করে। এই
পরিসরে তেমন দু’একটির উল্লেখ বাহুল্য হচ্ছে বলে মনে হয় না।
পথনাটক চলছে কারখানার গেটে। কংগ্রেস আশ্রিত গুণ্ডাদের
আক্রমণে খুন হয়ে গেলেন তরুণ বামপন্থী নাট্যকার নির্দেশক
অভিনেতা সফদার হাসমি। সারা দেশ জুড়ে ঝড় উঠল, দেশ টপকে
সে-ঝড় আল�োড়ন ত�োলে আন্তর্জাতিক আঙিনাতেও। সফদারের
জীবনসঙ্গী ও সহকর্মী মলয়শ্রী হাসমি তাঁদের নাট্যদল ‘জন নাট্য
49
মঞ্চ’ নিয়ে কলকাতায় এসেছেন নাটক মঞ্চস্থ করতে। আরও
অনেক মানুষের সঙ্গে সে-প্রয�োজনা দেখলেন শঙ্খ ঘ�োষ, লেখনি
কথা বলে উঠল তাঁর—
হাতের ওপর হাত রাখা খুব সহজ নয়
সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়
এ কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়
পায়ের ভিতর মাতাল, আমার পায়ের নিচে
মাতাল, এই মদের কাছে সবাই ঋণী
ঝলমলে ঘ�োর দুপুরবেলাও সঙ্গে থাকে
হাঁ-করা ওই গঙ্গাতীরের চণ্ডালিনী
সেই সনাতন ভরসাহীন অশ্রুহীনা
তুমিই আমার সব সময়ের সঙ্গিনী না?
তুমি আমায় সুখ দেবে তা সহজ নয়
তুমি আমায় দুঃখ দেবে সহজ নয়
50
প্রবাদ হয়ে যাওয়া এই কবিতার ছত্রগুলি আজও উদ্দীপ্ত করে,
আজও প্রেরণা জ�োগায় অগণন তরুণ তরুণীকে।
হ�োমার’এর ইলিয়ড নির্ভর David Benioff এর লেখা এবং
Wolfgang Petersen নির্দেশিত Troy চলচ্চিত্রটি বেশ কয়েকবার
দেখেছি। কিংবদন্তিসম একঝাঁক অভিনেতা অভিনেত্রীর অভিনয়
সমৃদ্ধ সে-চলচ্চিত্রের বলিষ্ঠ সংলাপ আমাদের মননে ঝড় ত�ো
ত�োলেই যেন বা প�ৌঁছে দেয় ট্রয় যুদ্ধের দিনগুলিতে, চাক্ষুষ করায়
গ্রিক আর স্পার্টান বীরদের। সে-যুদ্ধে গ্রিক বীর অ্যাকিলিস, স্পার্টার
রাজপুত্র হেক্টরসহ আরও অনেকে নিহত হন। বন্ধু অ্যাকিলিসের
অন্তোষ্টিশেষে ইথাকার রাজা ওডিসিউস যে-কথাগুল�ো বলেন তা
এইরকম:
‘If they ever tell my story, let them say I walked
with giants. Men rise and fall like the winter wheat,
but those names will never die. Let them say I lived
in the time of Hector, tamer of horses. Let them say, I
lived in the time of Achilles.’
শঙ্খ ঘ�োষকে নিয়ে আমাদের জাঁক প্রায় একইরকম।
51
শঙ্খ ঘ�োষের দিকে
সায়ন্তন সেন
১
শিবাজী বন্দ্যোাপাধ্যায়কে নকল করে লেখাটির নাম রাখতে
পারতাম — ‘শঙ্খর’ কলকাতা যাত্রা। কিন্তু আমার পক্ষে সেইটে
বড়�ো স্পর্ধার কথা হবে। আমরা নয় দশকের দল, তীব্র য�ৌবনের
শঙ্খ ঘ�োষকে আবিষ্কার করেছি পূর্বজদের স্মৃতিকথা থেকে। আর
আমাদের মফস্বলে এই সেদিনও রাজধানীর প্রভাতী সংবাদ আছড়ে
পড়ত সন্ধ্যায়, অনেকটা দেরি করে। তারপরেও থাকে তাঁর কীর্তি,
তার ব্যাপ্তি ক্যালেন্ডারের এঁদ�ো হিসেব ছাপিয়ে যায়, তবু, অন্তত
আমার এ-আল�োচনা করবার কথা নয়। ভরসা কেবল, এই যে একটা
আলাপের উপক্রম করেছি, তার সুবাদে, হয়ত�ো শঙ্খ ঘ�োষের কিছু
কবিতা ও গদ্যাংশের কাছে আরও একবার ফেরা যাবে। হয়ত�ো তর্ক
ত�োলা যাবে, হয়ত�ো বুঝে নেওয়া যাবে কী আমাদের শেখার আছে
ওঁর কাছে। সেটুকুই উদ্দেশ্য, আর উদ্দেশ্য — সত্যি কথা বলা।
শঙ্খ ঘ�োষের দুটি উপন্যাস, কিছু প্রবন্ধ, অল্পকিছু ছড়া ও
52
সাক্ষাৎকার আমি নিশ্চয়ই পড়েছি, তাঁর অনেক কবিতাও পড়েছি
বিচ্ছিন্ন ভাবে নানা সময়ে, কিন্তু পাঠক হিসেবে শঙ্খ ঘ�োষের সঙ্গে
আলাদা করে ক�োন�ো নিবিড় সখ্যের বাঁধন আমার অনেক দিন
পর্যন্ত গড়ে উঠতে পারেনি। যেমন গড়ে উঠেছিল গ�োঁফের রেখা
দেখা দেওয়ার ঠিক আগে আগেই, জয়দেব বসুর সঙ্গে। কেন সেই
দিন, পকেটে তাজা কবিতার পাণ্ডুলিপি আর উদাস মুঠ�োয় ভরা
প্রত্যাখ্যান নিয়ে শহরের রাস্তায় রাস্তায় অকারণ ঘুরে বেড়াবার সেই
দিনগুলিতেই বিশেষ করে জয়দেবকে এত মনে ধরেছিল আমার?
কে জানে! এখন ভাবি, অপমানিত এক কিশ�োরের করুণ আত্মদাহ
আর তীক্ষ্ণ অহমিকা আছে ওঁর অনেক কবিতায় ও গদ্যে, সেইটেই
তখন আকর্ষণ করেছিল মুখ্যত। প্রথিতযশা প্রৌঢ় হওয়ার চেয়ে,
সে-বয়সে আর কে না জানে, অপমানিত কিশ�োর হওয়াই ভাল�ো।
তাই ক�োন�ো ক�োন�ো বন্ধুর বাড়িতে, রাত বাড়লে, নিজেকে রবাহুত
জেনেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি জনগণতান্ত্রিক কবিতার ইশ্তেহার
থেকে অংশবিশেষ সরব পাঠ করেছি। তখন শঙ্খ ঘ�োষ একবার
এসেছিলেন আমার অভিজ্ঞতায়। ব�োধহয় জয়দেবের মৃত্যুর অল্প
কিছু দিন পরেই শঙ্খ ঘ�োষের একটি গদ্য আমার হাতে আসে,
নাকি অন্য কারও লেখায় ওঁর রচনার উদ্ধৃতি, তা আজ আর মনে
নেই, লেখাটি সম্প্রতি উদ্ধার করলাম।
যতটা লিখত জয়দেব, তার অনেকটাই ছাপা হত�ো না। যতটা
ছাপা হত�ো, তারও অনেকটা হত�ো না গ্রন্থিত। এসব না-এর মূলে ছিল
হয়ত�ো কিছুটা তার উদাসীনতা, কিছুটা জেদ, কিছু-বা অভিমানও।
অনেকদিন ধরে পাঠকদের সঙ্গে এইভাবে একটা দূরত্বই ঘটে আছে
ওর, অনুরাগী পাঠকেরা জানতেও পারেননি যে কতখানি তাঁরা
হারিয়েছেন।
‘অভিমান’, ‘উদাসীনতা’ আর ‘জেদ’ — যদিও আজ আমি
ক্রম পাল্টে নিতে চাই বিন্যাসের — তিনটি শব্দের পরপর উন্মোচন
আমাকে সেই মুহূর্তে একটা আশ্চর্য মুক্তি দিয়েছিল, মনে পড়ে। ঠিক
যে-কথাটি আমি নানা বাকবিন্যাসে ভাবতে চেষ্টা করেছি এতদিন,
বলতে চেষ্টা করেছি ক�োথাও ক�োথাও, সেই কথাটিই এত অব্যর্থ,
নিখুঁত, ছিপছিপে, সংবেদী ভাষায় আমার সামনে এসে হাজির হল
জয়দেবের সঙ্গে সেই বিয়�োগমুহূর্তে, আমি শঙ্খ ঘ�োষকে ভাল�োবেসে
ফেললাম।
53
২
কিন্তু এ-ও পরেকার কথাই হল। আজ শুনলে অনেকে হয়ত�ো
ভারী আশ্চর্য হবেন যে শঙ্খ ঘ�োষের দিকে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল
আরও অনেকদিন আগে, শ্রীমতী ল�োপামুদ্রা মিত্রের একটি জনপ্রিয়
গানের সূত্রে। অবশ্য আশ্চর্য না হতেও পারেন, কারণ কলকাতা
ও মফস্বলের গান-শ�োনা মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এক
কালে ল�োপামুদ্রার গতায়াত ও নিশ্চিত খাতির ছিল। সুনীল গাঙ্গুলি
আর জীবনানন্দও ছিলেন ল�োপামুদ্রার ঝুলিতে। পরে অশ�োক
মিত্রের লেখায় পড়েছি: জীবনানন্দের কবিতার মাঝে অমন ঝাঁ-ঝাঁ
তালবাদ্য খেলান�োটা খুবই নাকি নাজায়েজ হয়েছে। কিন্তু কী আর
করা, ল�োপামুদ্রার সেই ‘যমুনাবতী’-গানের সূত্রেই প্রথম, ভয়াল,
আর কিছু-বা-রহস্যাবৃত এক দীপ্তি নিয়ে শঙ্খ ঘ�োষ আমার সামনে
এসে দাঁড়ালেন অকস্মাৎ। আমি নিতান্ত বালক, অদীক্ষিত, বর্মহীন।
সে-গানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ত�ো জানিই না, বাণীও অনেক
সময়েই খুবই খট�োমট�ো লাগে, নিশ্চিত ক�োন�ো মানে ব�োঝা যায়
না অনেক চরণের, ছ�োট এক মেয়ে যুদ্ধে গিয়ে মারা যায় — ম�োদ্দা
ভাবটুকুই কেবল বুঝতে পারি। অথচ কী ক্লান্তিহীন আকর্ষণ গানটির
প্রতি, সমস্ত অস্বস্তির হ�োঁচট টপকে গিয়ে, অথবা সমস্ত অস্বস্তির
কারণেই বিশেষ করে, অনেক দিন পর্যন্ত গানটি আমার সঙ্গে রয়ে
যায়। ততদিন, যতদিন না আমি খ�োঁজখবর করে নিজেই আবিষ্কার
করি যমুনাবতী কবিতাটি, শীর্ণ এক কবিতাবই ঘেঁটে। এতক্ষণে
আগুন ফলে নিভন্ত চুল্লিতে, শঙ্খ ঘ�োষের দিকে গুটিগুটি পায়ে সেই
এগ�োন�ো শুরু হয় আমার। নিতান্ত বালক বয়সে — আমাদের ‘গূঢ়
মফস্বলে’ যখন পাতাঝরার শব্দ শ�োনা যেত — এক কিশ�োরীর যুদ্ধে
যাওয়া আর বারুদ বুকে নিয়ে ফেরার বিয়�োগান্তগাথা, সেই তখনই,
গাঁথা হয়ে যায় আমার স্মৃতিতে।
অথচ তারপরেও পাঠক হিসেবে তেমন একটা নিয়মিত
য�োগায�োগ ওঁর সঙ্গে আমার গড়ে উঠল না। যদিও, কলকাতায়
লেখাপড়া করতে যাওয়ার আগেই আমি শঙ্খ ঘ�োষের বেশ কিছু
কবিতা মন দিয়ে পড়েছি। তবু এখন মনে হয়, সে-সব কবিতা
আমার চারপাশে পড়া হত বলেই যেন পড়েছি। ইংরেজিতে একে
বলা যেতে পারে, শঙ্খ ঘ�োষ খানিকটা ঐতিহাসিকভাবেই আমার
রক্তে ‘ট্রান্সমিটেড’ হয়েছেন ছেলেবেলা থেকে। মনে পড়ছে,
54
আমাদের এক মাস্টারমশাই একবার এম এ ক্লাসে মার্কস পড়াতে
গিয়ে ফাজিল দৃষ্টি হেনে বলেছিলেন, ‘মার্কসের লেখা এক লাইনও
না পড়ে মার্কসের সমাল�োচনা অথবা প্রশংসা করবার অধিকার
আমাদেরই আছে, কারণ মার্কস বাঙালির রক্তে হিস্টরিক্যালি
ট্রান্সমিটেড হয়েছেন’। কথাটা রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারেও ব�োধহয়
চালিয়ে দেওয়া যায়। তবে কবি শঙ্খ ঘ�োষের ক্ষেত্রে কথাটা এখনই
(!) খাটে কিনা, আর খাটে যদি, তাহলে সেটা সমর্থনয�োগ্য কিনা
তা আপনারা ভেবে দেখবেন। রক্তের জন্য ক�োন�ো বাড়তি স্বাধীনতা
আমি নিচ্ছি না। জাবাল সত্যকাম বা আরুণি উদ্দালক যে আমি
পড়েছি তার কারণ সে সময় আমাদের শহরের একদল মানুষ ওই
সব কবিতার কথা শতমুখে বলতেন, ২০০২ সালের পর থেকে
বারবার, নানা সময়ে, রাজনৈতিক স্লোগানে ব্যবহারও করতেন।
তারই উত্তরাধিকার হয়ত�ো: নির্ভয়ার মৃত্যুর পর ভাঙাচ�োরা এক
নাট্যমহলাকক্ষে অনেক উত্তেজিত রাজনৈতিক বিসংবাদের মাঝখানে
আমি আঁকড়ে ধরি ক্লান্ত ও ব্যাথাতুর দুটি চরণ, ‘এত যদি ব্যূহচক্র
তীর তীরন্দাজ তবে কেন/ শরীর দিয়েছ শুধু বর্মখানি ভুলে গেছ
দিতে!’ অথবা তার আগে — ‘এই শহরেরই রাস্তায় একটি কাল�ো
মেয়ে যখন উঠে দাঁড়িয়ে তীরের ফলার মত�ো ছিটকে আসত
দর্শকের কাছাকাছি আর বলে উঠত ‘খেতে ত�ো হবেই বাবা!’,
ব�োধহয় সফদর হাশমির ক�োন�ো নাটকে — আমি তখনও গিলতাম
তাঁকে। এ-বাবদে আমার ক�োন�ো কৃতিত্ব নেই কেবল এটুকু জানান
দেওয়া ছাড়া যে, সেদিনের সেই সংক্ষুব্ধ, রাজনীতি-সচেতন
মফস্বল আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। ক�োথাওই পারিনি মনে
হয়। ক�োন�ো ক�োন�ো গণহত্যার প্রতিবাদ এখন আর খুব প্রকাশ্যে
করা যায় না। করলে, হায়, এমনকী শঙ্খ ঘ�োষেরও মৃত্যু কামনা
করা হয়!
৩
যাক সে কথা, আমি বলছিলাম যে এত কিছুর পরেও আমি শঙ্খ
ঘ�োষের তন্বিষ্ঠ পাঠক হয়ে উঠতে পারলাম না। শঙ্খসমুদ্রের দিকে
আরও একটু এগ�োলাম বরং শহর ছাড়ার পরে, যখন গ্র্যাজুয়েশনের
প্রথম বছরে আমাদের পাঠ্যসূচিতে আবির্ভূত হল কৃশ, সবুজ সেই
বই — সুপুরিবনের সারি। আর ‘পাঠ্যপুস্তক’টি সাবাড় করবার
55
আগেই, ওঁর সঙ্গে দেখা হল আমার।
কলেজে উঠলেই যেমনটা করতে হয় বলে জানতাম, অনতিনির্দিষ্ট
এক বন্ধুদল প্রথম সপ্তাহেই সেই মত�ো একটা কাগজের সম্পাদকীয়
দপ্তরে হল্লা করলাম, ডি লা গ্র্যান্ডি নামে নিজেদের একটা কাগজ
থাকতে হবে আমাদের, তাতে লিখবেন শঙ্খ ঘ�োষ — এরকম সিদ্ধান্ত
গৃহীত হয়ে গেল। লেখার আবদার নিয়ে অতঃপর তিনজন আমরা
হাজির হলাম বহুশ্রুত সেই র�োববারের আড্ডায়। স্যার খুব কম কথা
বলেন, আপ্যায়নে অসম্ভব যত্নশীল, আমরা কুণ্ঠিত অথচ গদগদ-
ভাবে চেয়ারে উপবিষ্ট, আর ভারতীয় ‘অন্যধারার ছবি’র সীমা ও
স্ববির�োধ নিয়ে একটা ভারী সিরিয়াস তর্কাতর্কি চলছে। অনেকদূর
পর্যন্ত আমি বুঝতে চেষ্টা করছি, হঠাৎ একজন উত্তেজিত হয়ে
বললেন, ‘সে আপনি যদি এখন বিদেশী ছবির সঙ্গে তুলনা করেন,
তাহলে ত�ো হবে না, ভারতের মধ্যে ছবি হিসেবে ওটা ভাল�োই’
— এবারে, এতক্ষণে, আমিও কিছু বলব কিনা ভাবছি। সংক�োচে
বাক্যটা সাজিয়ে উঠতে পারছি না মনের মতন। অথচ বলতে চাইছি
অনেক কথা, বলতে চাইছি — ভারতবর্ষে ছবি বানিয়েছেন ঋত্বিক
ঘটক, মনি কাউল, তারপরেও ‘ভারতীয় ছবির মধ্যে ভাল�ো’ —
এরকম একটা হীনমন্য অহং-এই কি চিরটাকাল ডুবে থাকা উচিত
আমাদের? ভাবনার সুত�ো ছিঁড়ল, আমায় চমকে দিয়ে স্যার, প্রায়
ইচ্ছে করেই যেন, শুনতেই-দিতে-চান-না এত দূর মৃদুস্বরে বলে
উঠলেন, ‘এটা তুমি কী বললে!’, আর বলতে বলতেই, একটু যেন
সবিনয় ক�ৌতুক মিশিয়ে হাসলেন ঠ�োঁটচাপা, ছেলেছ�োকরা হলে
সে-হাসিকে সহজেই বলা যেত — ‘মিচকে’। অমূল্য সেই হাসি যে
আমার মনে থেকে গেছে আজও অবিকল, তার একটা কারণ আছে।
ওঁর স্মিতহাসির যে ফ�োট�োগ্রাফগুলি আমি এই মুহূর্তে মনে করতে
পারছি, আপনারা লক্ষ্য করে দেখবেন, তার অনেকগুলিতেই হাসির
ভিতর এই ‘সবিনয় ক�ৌতুক’ (নাকি অবিনয়ের অছিলা তা আসলে?)
মেশান�ো আছে। এই ক�ৌতুকের কথা শঙ্খ ঘ�োষের স্মৃতিচারণায়
অনেক আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধু বলেছেন বারেবারে। তবু আজ
আরেকবার কথাটায় বাড়তি নজরটান দিতে চাইছি। কারণ, যে-
ক�ৌতুকপ্রবণতা শঙ্খ ঘ�োষের চরিত্রের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য, তা
ঠিক হাওয়ায় ভাসান�ো ক�োন�ো অকারণ, অহেতুক ক�ৌতুকনয়, সে-
ক�ৌতুকের লক্ষ্যমুখে — আমার ত�ো মনে হয় — অতিনির্ধারিত এক
56
‘তুমি’ বা ‘ত�োমরা’ আছে সবসময়। অবশ্য ‘ক�ৌতুক’ শব্দটা আমি
একটু কম ভেবেই বেছে নিলাম, আরও সরস একটা শব্দ ল�োকায়ত
ভাষাপরিসর থেকে ধার করে, আরও নিখুঁত করে, একে ব�োধহয়
‘রঙ্গ’-ও বলা যেত।
কেমন সে রঙ্গ?
তাঁর সাহচর্যে থেকে একরকম করে সেই রঙ্গপ্রিয়তার বিদ্যুৎছটা
দেখেছে অনেকে। আমাদের ছাত্রকালের কবিবন্ধু পৃথ্বী বসুর
স্মৃতিচারণায় এরকম একটা ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে — একবার
এক ক�ৌতূহলী যুবা নাকি ওঁকে জিগ্যেস করেছিলেন ক�োন�ো অবসরে,
‘স্যার, আপনি অল্প বয়সে লিখে যে আনন্দ পেতেন, এখনও কি আর
তেমন পান?’, উত্তরে স্যারের প্রতিজিজ্ঞাসা, ‘আমি যে অল্প বয়সে
লিখে আনন্দ পেতাম, ত�োমায় কে বলল?’ মুখ্যত এটাই আজ আমার
বলবার কথা — কেউকেটা হলে বলতাম ‘প্রতিপাদ্য’ — বিশ্বাসের,
যাপনের আর সকল সত্যের মত�োই ওঁর এই চারিত্র্য উঠে এসেছিল
কবিতায়, ক�ৌতুক বা রঙ্গ কেবল নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটু
মাত্রা চড়িয়ে মকারি, উদ্ধত তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা এবং চলতি কথায়
যাকে বলে ‘পিন মারা’ — এই সমস্ত কিছু আছে শঙ্খ ঘ�োষের গুচ্ছ
গুচ্ছ কবিতায় পুর�োদস্তুর। মনে হতে পারে, আমি বাসি কথা বলছি,
পুনরাবৃত্তি করছি আল�োচিত সন্দর্ভের। বিশেষজ্ঞ নই, তাই কথাটা
প্রস্তাব আকারে না রেখে, আমার ব্যক্তিগত পাঠ-অভিজ্ঞতা হিসেবেই
রাখি: শঙ্খ ঘ�োষের কবিতার ন্যূনতম ব্যবচ্ছেদও মন�োয�োগী ক�োন�ো
স্কলার যদি করেন কখনও, তাহলে সমষ্টির বিরুদ্ধে ব্যক্তির যুদ্ধে
এই রগড়, এই প্রচ্ছন্ন ‘মকারি’-র উৎস শঙ্খ ঘ�োষের কবিআত্মার
ক�োন্ গহনে, সমাজপ্রবাহের ক�োন্ ক�োন্ সংবাদের ভিতর, আর
সমাজে কেমন তার রাজনৈতিক অভিঘাত — এ-দুটি প্রশ্ন তাঁকে
খতিয়ে দেখতে হবে বলেই মনে হয়। কেননা এ ব্যাপারে খুব
বিচক্ষণ ক�োন�ো আল�োচনা আজও হয়নি। একে যদি নিখাদ, নিরেট
প্রতিষ্ঠানবির�োধিতা বলে পাশ কাটিয়ে যেতে চান, তাহলে আমার
সঙ্গে আপনার পাঠ-অভিজ্ঞতা এইখান থেকে আর মিলবে না। ওঁর
মহত্তম কবিতাগুলির ব্যাখ্যানের আমার কিছু সিরিয়াস অতৃপ্তি রয়ে
যাবে। অজস্র সেই কবিতাদের মধ্যে থেকে খুব অল্প কিছু চয়ন করে
আজ পড়তেও হবে এখানে আমায়। নানা সময়ে শঙ্খ ঘ�োষের যে-
কবিতাগুলি আমার সঙ্গে থেকেছে, তাদেরই ভিতর থেকে কয়েকটি
তাই বেছে এনেছি।
57
৪
শঙ্খ ঘ�োষ সম্পর্কে অনেককেই বলতে শুনেছি, ভারী বিনয়ের
সঙ্গে সবসময়েই নাকি পূর্বপক্ষের সামনে বিকল্প প্রস্তাবটি উনি পেশ
করে থাকেন। কিন্তু এইটেই যদি তাঁর কথা বলবার একটিমাত্র,
অথবা সবচাইতে সুচিন্তিত ভঙ্গি হয়, তাহলে এ-কবিতার ব্যাখ্যা কী?
সহজ
আমিই সবার চেয়ে কম বুঝি, তাই
আচম্বিতে আমার বাঁ-পাশে এসে হেসে
পিঠ ছুঁয়ে চলে যাও;
‘অত কি সহজ?’ বল তুমি।
61
বির�োধ-বাস্তবতা সম্পর্কে সতর্ক থেকে আলত�ো হুঁশিয়ারি দিয়েছেন,
ছ�োট্ট এক নিবন্ধে। জাবাল সত্যকাম কবিতাটির কথা বলতে-বলতে,
শঙ্খ ঘ�োষের নির্জনতাপ্রীতির ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে মালিনী লিখছেন,
কবিত্বের র�োমান্টিক ধারণায় কখন�ো কখন�ো যে নির্জনতাকে সত্যদৃষ্টির
জন্য আবশ্যিক বলে মনে করা হয়, এখানে কি তিনি তারই আত্মীকরণ
করেছেন? সমস্ত দলবদ্ধতার বাইরে, সংঘাত ও হট্টগ�োলের বাইরে এক
আত্মমগ্ন স্বেচ্ছা-‘বনবাসে’র কথাই বলছেন?
কিন্তু এর বেশি এগ�োন না এই পথে আর, বরং প্রশ্নটিকে উদাসীন
সংশয়ে ঝুলিয়ে রেখে প্রাবন্ধিক জানান, ‘এমন অর্থ কেউ করতেই
পারেন’। আর নিজে কিন্তু, র�োমান্টিকতার প্রত্যয় থেকে ফিরে
আসেন স্বভূমে,
শুধু কবি নয়, গ্রামশির ভাষায় প্রত্যেক মানুষই যদি চেতনাজীবী হয়,
সেই চেতনার অনুসন্ধান ত�ো প্রত্যেকের ভিতরের লড়াই, নিজের সঙ্গে
লড়াইও বটে। সেত�ো শুধু সামূহিকতার স্রোতে ভেসে গিয়ে হয় না।
মজার ব্যাপার, ‘স্রোতে ভেসে গিয়ে’ কথাটিতেও সেই একই প্রাজ্ঞ
বিরক্তির ছাপ যেন, শঙ্খ ঘ�োষের একা মানুষটির। যদিও বিরক্তি
সত্ত্বেও সঙ্ঘ সম্পর্কে তার ক�োন�ো আন্তরিক অশ্রদ্ধা ফুটে উঠছে না।
কিন্তু এই নিরীহ চেতাবনিতে ত�ো আর শঙ্খ ঘ�োষ কুকথার আগল
টানেন না, ব্যক্তিসত্তার সচেতন অহমিকা তাঁর কবিতায় বিস্তৃত হয়
আরও বহুদূর —
পাগল
‘এত কিসের গর্জে আকাশ
চিন্তা ভাবনা শরীরপাত?
বেঁচে থাকলেই বাঁচা সহজ,
মরলে মৃত্যু সুনির্ঘাত!’ —
ব’লে, একটু চ�োখ মটকে,
তাকান মত্ত মহাশয় —
‘ঈষৎ মাত্র গিলে নিলে
যা সওয়াবেন তাহাই সয়।
‘হাওড়া ব্রিজের চূড়�োয় উঠুন
নীচে তাকান, ঊর্ধ্বে চান —
দুট�োই মাত্র সম্প্রদায়
নির্বোধ আর বুদ্ধিমান।’
62
‘মত্ত’ মহাশয়ের এই চ�োখ-মটকান�ো, নিঃশংসয় সমাজবিশ্লেষণে
আমি আর আমার ক�োন�ো ক�োন�ো বন্ধু একদিন সায় দিয়ে উঠতে
পারিনি। ব�োধহয় কবিও সায় দিতে পারেননি আগাগ�োড়া। কিন্তু
আজ, এই মুহূর্তে আরেকবার ভেবে দেখছি: ‘পাগল’ কেন কবিতাটির
নাম? মিশেল ফুক�ো যেমনটা দেখিয়েছেন আমাদের, অতিনিয়ন্ত্রিত,
কেন্দ্রায়িত, গ্রহণ-লাগা যক্ষপুরীর ভিতর কখন�ো-কখন�ো শুধু
পাগলেরা সত্যি কথা বলে, তাই কি? নাকি মত্ত মহাশয়েরও
দেখায় আছে নির্দিষ্ট এক ‘অবস্থানগত’ সীমাবদ্ধতা, ‘চুড়�ো’ থেকে
মানুষের দিকে চাইবার নিবার্য অভিশাপ? এ-কবিতা কি মধ্যবিত্তের
আত্মকরুণারও? প্রশ্ন ত�োলা রইল। ক�োন�ো নিশ্চিত, অভ্রান্ত উত্তর
এই মুহূর্তে জানা নেই। এখন শুধু ভাবছি: এই পণ্যমগ্নতার সময়ে
‘স্রোতে গা ভাসাবার’ প্রবণতা সম্পর্কে আমাদের সকলের আলাদা
আলাদা করে সচেতন হওয়ার দরকার আছে কিনা, দরকার আছে
কিনা চতুরতা খুলে রেখে, সঙ্ঘের বর্ম ও শিরস্ত্রাণ খুলে রেখে কখন�ো
কখন�ো আকাঁড়া নিজের মুখ�োমুখি দাঁড়াবার। কেননা জিজ্ঞাসার
আল�ো ত�ো জ্বলে ওঠে একটি মাত্র চেতনায়, অনেকের চেতনায় তা
এক সঙ্গে জ্বলে উঠতে পারে, কিন্তু তবুও, তখনও, তা আলাদা করে
প্রত্যেকের। ব্যক্তিত্বের পরিশীলন ছাড়া সে আল�ো জ্বলবে কেমন করে
তবে? ভেবে দেখছি, যে-ক�োন�ো সঙ্ঘেরই ভিড় যখন নানা কায়দা
ও ক�ৌশলে ব্যক্তির বশ্যতা আদায় করতে চায়, প্রশ্ন করতে বারণ
করে, কথায়-কথায় সম্মতিসূচক ঘাড় বাঁকাতে শেখায় শুধু, রাষ্ট্রের
এপারেটাসের মত�ো একই-একই ‘টুল’ যখন ক্ষমতা কায়েম রাখতে
ব্যবহার করেন ঘ�োরতর বিপ্লবীরা, তখন শঙ্খ ঘ�োষের কবিতার নির্জন
মানুষটি আমাদেরও চেতনায় কি প্রতিস্পর্ধা ছড়াতে থাকে না? যে-
স্পর্ধার উৎসে প্রতিভার দীপ্তশিখায় জ্বলছে অক্ষম প্রতির�োধে ফুঁসতে
থাকা, উচ্ছ্রিতগ্রীবা ইন্ডিভিজ্যুয়ালের বিশুদ্ধ ক্ষোভ। দেখা যাচ্ছে,
ক�ৌতুক থেকে আমি আপাতত ক্ষোভে এসে প�ৌঁছেছি। কিন্তু এখানেই
থামতে রাজি নই, কেননা অন্য অন্য কবিতায় সে-ই সকলকে জানিয়ে
দিতে চেয়েছে — ‘আমার দুঃখের কাছে ত�োমাদের নত হতে হবে!’ নত
ত�ো হয়েইছি আমরা, নত হয়ে জানতে চাইছি, বকচ্ছপ আধুনিকতার
পীড়নে ক্লিষ্ট জন্ম-ইস্তক-পঙ্গু (‘পঙ্গু’ শব্দটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
দিয়েছেন) যে ‘ব্যক্তি’ আমাদের নায়ক, আমাদের সময়ের নায়ক,
‘জনতার মুখরিত সখ্য’ থেকে, জনতার মুখরিত সখ্যে থেকে কিছু কি
63
আল�োকচিত্র : সন্দীপ কুমার
64
পাশাপাশি রেখে পড়লে সম্ভবত শঙ্খ ঘ�োষের কবিমানসের আরও
পূর্ণ ক�োন�ো পরিচয়ে আমরা উপনীত হতে পারব। অবশ্য, এই
কবিতাটিই বাছার আরও একটা কারণ আছে। ক�ৌশিক রায়চ�ৌধুরী
ওঁর জলস্রোত কথা কয় আলেখ্য রচনায় এটি ব্যবহার করেছিলেন।
সে-রচনার একটা মঞ্চ-উপস্থাপনা দেখার স�ৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
আগে ওতেই শ�োনা, পরে পড়েছি। তাচ্ছিল্য, মকারি, ক্রোধ, বিযুক্তি,
নির্বাসন ও দলাপাকান�ো তপতপে ডিনায়াল (এর ক�োন�ো নিখুঁত
তরজমা পাইনি, তবে কাছাকাছি হয়ত�ো ‘প্রত্যাখ্যান’) এই কবিতায়
একেবারে মাখামাখি হয়ে আছে। কবিতার নাম কলকাতা, সঙ্ঘ
নয়, প্রতিষ্ঠান নয়, রাষ্ট্র নয়, আস্ত শহরটাকে, শহরের মানুষদের
ফালাফালা করে দেখছে একটা ক্রুদ্ধ, তির্যক, অপমানিত, আপরুটেড
গেজ, এবং উল্লেখ থাক: পূর্ববঙ্গীয় ডায়ালেক্টে আগাগ�োড়া লেখা শঙ্খ
ঘ�োষের আর ক�োন�ো কবিতা আমি পড়িনি।
কলকাতা
বাপজান হে
কইলকাত্তায় গিয়া দেখি সক্কলেই সব জানে
আমিই কিছু জানি না
আমারে কেউ পুছত না
কইলকাত্তার পথে ঘাটে অন্য সবাই দুষ্ট বটে
নিজে ত�ো কেউ দুষ্ট না
কইলকাত্তার লাশে
যার দিকে চাই তারই মুখে আদ্যি কালের মজা পুকুর
শ্যাওলাপচা ভাসে
অ স�োনাব�ৌ আমিনা
আমারে তুই বাইন্দা রাখিস, জীবন ভইরা আমি ত�ো আর
কইলকাত্তায় যামু না।
‘জীবন ভইরা’ কথাটিতে আবহমান এক অভিবাসন, নাকি
নির্বাসন, কান্নার মত�ো ঘন হয়ে ওঠে আমার কণ্ঠে। আমার মত�োই
আরও কেউ-কেউ নিশ্চয়ই নিজের রক্তের বিশ্লেষণ করে জেনেছে:
সেই নির্বাসন থেকে কলকাতাকে জীবনের স্পন্দনহীন, লাশের মত�ো
ঠান্ডাই লাগে দেখেশুনে। শহর ছাড়ার পর, কলকাতায় লেখাপড়া
করতে এসে, এইসব রচনার মধ্যে দিয়ে শঙ্খ ঘ�োষের সঙ্গে একটা
65
সহিতত্ব ঘটে যেতে থাকে আমার। তখনও জানি না, কবিতার মুহূর্ত
বইতে উল্লিখিত কবিতাটির জন্মবৃত্তান্ত নথিবদ্ধ করে রেখেছেন শঙ্খ
ঘ�োষ। টুকে রেখেছেন, এক বাস ড্রাইভারকে ভর্ৎসনায়, নির্দেশে,
পরামর্শে কীভাবে নীল করে দিয়েছিল একদিন কলকাতা শহরের
সমবেত যাত্রীদল —
এমনকী স্টিয়ারিংটা কীভাবে ঘ�োরাতে হবে তারও নির্দেশ দেয়
কেউ। হঠাৎ তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, তারাই ঠিক জানে,
সবটাই জানে, ক�োন্ পথে কীভাবে এলে কিছুমাত্র সময় নষ্ট না করেই
প�ৌঁছন�ো যেত গন্তব্যে, সেটা নির্ভুল ভাবে কেবল তাদেরই কাছে স্পষ্ট,
কেবল ড্রাইভারটিই জানে না কিছু। ‘এদিকটায় ঢ�োকালেন কেন? এখন
বের�োবেন কী করে?’ ‘পাশের ডানদিকের রাস্তাটা ধরলেই ত�ো ঠিক
হত!’ ‘কলকাতার পথঘাট কি চেনেন কিছু? খুব ত�ো গাড়ি চালাচ্ছেন’
‘ক�োথা থেকে যে জ�োটায় এদের!’ অবিরাম এইসব বাক্যবর্ষণ কানে নিয়ে
ড্রাইভার কী ভাবছে? আমি জানি না সে কী ভাবছে।
আমরাও জানি না, কী সে ভেবেছিল উচ্চারিত নাগরিক গঞ্জনার
ভিতর। কিন্তু দেখছি নজর করে, কবির প্রকাশ্য ব্যথাতুর প্রশ্নমালা
ছুঁয়ে থাকে অভিবাসনেরই নানা স্তর-তরঙ্গ,
প্রায়ই কি তাকে সইতে হয় এ-রকম, আমাদের এই কলকাতার
রাস্তায়? ক�োথায় দেশ তার? কলকাতায়, নাকি বাইরের ক�োন�ো গ্রামে?...
মনে পড়ে আমাদের পুব-বাংলার ছ�োট্ট শহরের কথা, মনে হতে থাকে
বড়�ো এই শহরের মধ্যে আজও আমি চিনতে পারিনি কিছু। অন্য সকলেই
কি সবকিছু জানে? ফিরে আসে আবার সেই ড্রাইভারের মুখ, সেই চ�োখ,
আর সেই সঙ্গে ঝাঁপ দিয়ে আসে অদ্ভুত কটা লাইন, যেন আমি বলছি
কাকে: ‘বাপজান হে/ কইলকাত্তায় গিয়া দেখি সক্কলেই সব জানে/ আমিই
কিছু জানি না।’ বাপজান কেন হঠাৎ? অল্প একটু হাসি এসে প�ৌঁছয়
ঠ�োঁটের ক�োণে।
যদিও এ-আবিষ্কার কবিতাটি পড়বার আরও কিছুদিন পরেকার।
কিন্তু ইতিমধ্যে, আপাত-নীরবতার আবডাল ছিঁড়ে ব্যথিত, ক্রুদ্ধ,
তির্যক, অভিমানী, এবং আবারও বলতে চাই: আপরুটেড শঙ্খ ঘ�োষ
আমার অনেকখানি কাছাকাছি চলে আসেন। আমি প্রথমবার দীর্ঘ
সময় পড়ে থাকি ওঁর কবিতা চ�োখে নিয়ে, পড়ে থাকি রাতের পরে
রাত, বন্ধুদের জানাই আমার ‘সাম্প্রতিক’ শঙ্খপ্রেমের কথা। সে-
শঙ্খপ্রেম, হয়ত�ো অহংকার হবে বলা, আমারই চারপাশের আরও
অনেকের মত�ো নয়। ক�োন�ো অতিকথা হয়ে শঙ্খ ঘ�োষের উপস্থিতি
66
যে আমায় আচ্ছন্ন করেনি ওঁকে পড়বার আগে, তাতে ওঁর কবিতার
সম্মুখীন হতে সুবিধেই হয়েছে আমার। কথাটা আলাদা করে বলতে
চাইছি, কারণ ‘বাংলার বিবেক’, অথবা ‘বাংলার জাগ্রত বিবেক’ —
এসব আশ্চর্য উপাধিতেই বিভিন্ন শিবিরের ক�োন�ো ক�োন�ো খবরের
কাগজ এখন ভূষিত করতে চাইছেন তাঁকে। করতে চাইছেন কাছে
ও দূরের আরও অনেক মানুষ। সহজ কথা নয়, একেবারে ‘জাগ্রত
বিবেক’, অর্থাৎ কিনা, আস্ত একটা জনসমষ্টির সমস্ত প্রকাশের ভুল-
ঠিক, পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায় বিচার করে নেওয়া যাবে শঙ্খ ঘ�োষেরই
খাপে-মাপে। কিন্তু এরকম ক�োন�ো প্রশ্নোর্ধ্ব, নিষ্কম্প, নিখুঁত, স্বরাট,
স্থিত, পূর্ণ অস্তিত্ব হয়ে শঙ্খ ঘ�োষ যদি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান,
দাঁড়াতে থাকেন বারেবারে, তাহলে তাঁর অনেক কবিতার নিহিত
অস্থিরতার, অ্যাজিটেশনের সঙ্গে আর ততখানি সহজ করে মিলতে
পারি না আমরা। সম্ভ্রমের, ভীরুতার একটা কণ্টকিত দূরত্ব ক্রমাগত
দূরে ঠেলে দিতে থাকে পাঠককে। কবিতাকে মনে হয় মন্ত্রের মতন।
তর্ক না-করে, আলাপে না-গিয়ে, কেবল ‘নীতিবাক্য’টুকু নিষ্কাশন
করে নিতে ইচ্ছে হয় তার শরীর ছেনে। কবির বদলে সদাবৃদ্ধ,
স্থিতপ্রজ্ঞ, ধ্যানস্থ, অবিচল এক ন্যায়দণ্ড শেষে পড়ে থাকে হাতে,
আর তার অন্তরালে ক্রমাগত আশিরনখ হারিয়ে যেতে থাকেন সেই
শঙ্খ, সেই কলহপর মাতাল যুবা — যার সঙ্গে মতান্তরের সকল পথ
রূদ্ধ হয়ে যায়নি। সেই শঙ্খ ঘ�োষ আমাদের চ�োখের সামনে বনে
যান প্রতিষ্ঠান, এতদূর প্রতিষ্ঠান যে তেমন-তেমন ‘অনগ্রসর’দের
চ�োখ রাঙিয়ে বলতে পারে বাচাল ছন্দজীবীর দল: ‘শঙ্খ ঘ�োষের
নাম শ�োনেনি, এমন কেউ/ ত�োমায় যদি প্রোপ�োজ করে কী করবে?’
উদ্ধৃতিটা ঠিক হল কিনা জানি না, ভুল হলেও কিছু যায় আসে না।
শঙ্খ ঘ�োষের দিকে আমার যাত্রা, এই সব নষ্টামি, অশালীন অক্ষরস্তূপ
ভেদ করে পথ কেটে নিতে পারবার ব্যক্তিগত সংগ্রামের খতিয়ানও
বটে, শুনতে যতই খারাপ লাগুক — এও, খাঁটি সত্যি কথা।
৬
কিন্তু এত কথার ভিড়ে সেই সুপুরিবনের সারি-র কথাটা আর
বলা হল না। সুপুরিবনের সারি যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন: এ
আসলে শঙ্খ ঘ�োষেরই দেশ-ঘর ছেড়ে আসার গল্প, তাঁরই বাল্যুস্মৃতির
খতিয়ান। আর সেই গল্পের ন্যারেশনের পরতে পরতে লতিয়ে থাকে
67
চলে-আসা কবির, থেকে-যাওয়া পরিজনদের জন্য হাহাকার,
অপরাধব�োধ, শুধু পরিজন নয়, দৃষ্টিপথ থেকে অপস্রিয়মান মাটি,
জল, গাছ, মন্দির, পথ, ভাঙা ন�ৌকা — স্থান, যে স্থান আসলে গড়ে
ওঠে সাহচর্যে, সম্পর্কে, সেই স্থানের জন্যে এক বালকের আকুতি
— কেন চলে যেতে হয়, তার ক�োন�ো সন্তোষজনক উত্তর জানার
আগেই যে চলে যাওয়া কাকে বলে টের পায় সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে। পূর্ব
পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে আসে নীলুদের গ�োটা পরিবার প্রায়,
নীলুর দাদু আসেন না। নীলু চলে আসে চিরদিনের মত�ো, দাদুকে
ছেড়ে, হারুন, তার মুসলমান বাল্যবন্ধুটি, তাকে গাঁয়েই ফেলে রেখে
কলকাতায় চলে আসে সে। এতক্ষণ ধরে বলে চলেছি হাহাকার,
অপরাধব�োধ, আকুতি, অথচ কে-না-জানে, শব্দ ত�ো সাশ্রুকুমির,
সে কেবল পিছলে যায়, তাই সুপুরিবনের সারি-র অবিস্মরণীয় সেই
শেষ দুটি পরিচ্ছেদের ভাবটুকু কিছুতেই আমি ধরতে পারছি না,
ফলে আবারও শঙ্খ-শরণ নিতেই হচ্ছে আমায় —
এইবার বাঁ দিকে বাঁক নিতে হবে, খাল ছেড়ে এবার নদীতে পড়বে
ন�ৌক�ো। বাঁক নেবার মুখে, হাটখ�োলার ক�োণে, উলটে-রাখা প্রকাণ্ড এক
মাটির জালার ওপর বসে বসে সবুজ একটা রুমাল ওড়াচ্ছে, কে? কে
ওটা? চমকে উঠে নীলু দেখে, হারুন! ওই ত�ো ওইখানে এসে বসে আছে
হারুন। চিৎকার করে বলে ওঠে হারুন: ‘এই-যে আমি, নীলাই। এই-যে
রে! আসিস কিন্তু আবার, সামনের বার। আসবি ত�ো? কী রে, আসবি
ত�ো? আসিস আবার। আসবি?’
জালার থেকে নেমে নদীর পাড়ি ধরে হাঁটতে থাকে হারুন। আর
মাঝে মাঝে বলে: ‘কী রে, কথা কইস না ক্যান্, আসবি ত�ো?’
উত্তর দেয় না নীলু। যাত্রা করবার সময়ে জলের ছায়ায় নিজের
মুখ দেখেও বলেনি ত�ো সে কিছু। উত্তর দেয় না, কিন্তু চলন্ত ন�ৌক�োর
ছই থেকে নিমেষহারা তাকিয়ে থাকে হারুনের চ�োখে চ�োখে। আস্তে
আস্তে অস্পষ্ট হয়ে আসে সেই চ�োখ, অস্পষ্ট হয়ে যায় হারুন, অস্পষ্ট
হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে পিছনে-পড়ে-থাকা তাদের গ�োটা গ্রামখানা।
বড�়োমামা বলে: ‘ওই দেখ্ শুরু হল�ো বড�়ো সুপুরিবনটা। জানিস ত�ো,
ওই পর্যন্তই হল�ো আমাদের গ্রামের সীমা। ব্যস্, তারপর, শেষ —’
শেষ? হ্যাঁ, শেষ। প্রণাম ত�োমায়, শেষ। প্রণাম ত�োমায়, এই
দ্বাদশীর বিকেল। প্রণাম, ওই খালের মুখে নদীর জলের ঢেউ। প্রণাম
ত�োমায় তুলসীতলা, মঠ। প্রণাম ফুলমামি। প্রণাম, তবে প্রণাম ত�োমায়
সুপুরিবনের সারি।
মনে মনে বলতে চায় নীলু: হারুন, আসব আবার। কিন্তু বলতে পারে
না কিছু। আবার একবার ডান দিকে বাঁক নিয়ে ন�ৌক�ো শুধু চলতে থাকে
মচর মচর, ঢিমে তালে, একটানা পশ্চিমের দিকে।
68
এই উপন্যাস আমি পড়েছিলাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা
বিভাগের ফাঁকা ক্লাসঘরে বসে। তারপর ক্লাস শুরু হল আমাদের।
‘থাকা’, ‘থেকে যাওয়া’ কাকে বলে, ব�োঝাতে গিয়ে একদিন
বললেন মাস্টারমশায়, ‘বিশ্বায়ন�োত্তর পৃথিবীতে এক অর্থে আমরা
সকলেই রিফিউজি’। আর ঐ বাক্য মরমে পশিবার পর, স্বভূমি
থেকে উৎপাটিত, সংকুচিত, অপরাধী, বিষণ্ণ এক বালকের শেষ
প্রণতি মাটিকে, আর কেবল শঙ্খ ঘ�োষের স্মৃতিকথা হয়ে রইল না
আমার কাছে, ঐ ক্লাসঘরে, ঐ মুহূর্ত থেকে তা ফেন�োমেন�োলজিতে
অঙ্গীকৃত হয়ে গেল।
70
আমার পৃথিবী নয় এইসব ছাতিম শিরীষ
সব ফেলে যাব বলে প্রস্তুত হয়েছি, শুধু জেন�ো
আমার বিশ্বাস আজও কিছু বেঁচে আছে, তাই হব
পঁচিশে বৈশাখ কিংবা বাইশে শ্রাবণে আত্মঘাতী।
৭
এখন পর্যন্ত এই আমার শঙ্খ-পাঠ। সুতরাং, শেষ কবিতা। উদ্যত
কুঠারের বিরুদ্ধে আঁকড়ে থাকা শিকড়ের প্রত্য য় এইভাবে কখন�ো-
কখন�ো স্থানের শূন্যতাকে মনে হয় ভরিয়ে দিতে পারে, আজ যখন
খাতায়-কলমে আর কিছুদিন পরেই আমরাও উদ্বাস্তু হয়ে যাব কিনা
সে-কথা ভাববার সময় এসেছে স্বচ্ছ ভারতবর্ষে, তখন পড়তেই হবে
এ-কবিতা আরেকবার —
ত্রিতাল
71
ত�োমারই ওই টুকর�ো-করা-শরীর
দুঃসময়ে তখন তুমি জান�ো
হলকা নয়, জীবন ব�োনে জরি।
ত�োমার ক�োন�ো ধর্ম নেই তখন
প্রহরজ�োড়া ত্রিতাল শুধু গাঁথা —
মদ খেয়ে ত�ো মাতাল হত সবাই
কবিই শুধু নিজের জ�োরে মাতাল!
72
ঘরবন্দি মুখগুল�ো
স�ৌরভ হ�োসেন
83
w or ye
84
84
মুখ
মুখ গুল�ো অন্ধকারে একরকম,
আল�োয় এলে মনে হয়- এত সুন্দর!
হাত গুল�ো আল�োয় একরকম,
অন্ধকারে নিশপিশ করে যেন শিকারী
85
85
ত�ৌফিক হ�োসেনের দুটি কবিতা
আজ মৃত্যু আসবে নাকি?
আজ মৃত্যু আসবে নাকি?
এখন জ্ঞানত দরজা খুলে দিলাম,
এস�ো ত�ো মৃত্যু আমার ইচ্ছায়!
তবু মানুষ
এত�ো মানুষ দেখেছি
তবু মানুষকেই দেখতে ভাল�োলাগে
এই নির্যাস সত্য হয়ে মাথায় ঝরে পড়ে
যে পথ এখন�ো বাকি আছে
তার সম্মুখে যেন হেঁটে যায় দুটি পা
আমার দুই হাতে যেন
দুটি ফুল আরক্ত ধরা দেয় ফুলের ছন্দে
দুই হাত পেতে বসে আছি
ঘাম -গন্ধ মাখব�ো বলে
সেই বিস্বাদ এখন�ো ভুলিনি
অতঃপর তাকে আবার পেতে চাই
তারপর আবার
চেটেপুটে সব নিজের করে বুঝে নেব কথা দিলাম।
86
86
নাসির ওয়াদেনের দুটি কবিতা
অতীত জানালা
একটু আকাশ রঙ মেখে নিই শরীরে
রাগী বাতাসের গায়ে লালর�োদ হাসে
পড়শির উঠ�োন জুড়ে গার্হস্থ্য কান্না
ত�োমার বিনিময় চ�োখ প�োড়ে আগুনে,ত্রাসে
87
87
নদীর কাছে পাহাড়ের কাছে
সুখ কথাটির ভেতর কী এক অদ্ভূত শক্তি
জেগে আছে পাহাড়ের বুকে, গাছের পাতায়
ঝরে যায় প্রতিটি নিমেষ হাল সনের খাতা
ছিঁড়ে যায় অতীতের স্মৃতি নদীর কাছে, জলে
মুক্তো খুঁজতে গিয়ে হারিয়েছি ত�োমাকে, অ-সুখ
বাসা বেঁধে থাকে পিঁপড়ের স্বাদে, গরম বিছানা
অবেলা শীতরঙ মেখে হাঁক দেয় ‘ দিতে হবে ‘
কেউ কেউ বলে আরও কিছু, শত প্রতিশ্রুতি
বেলা চলে গেছে গেলে পাহাড়ের কাছে যাই
ঘুম নেই চ�োখে নদী জলে শুধু আল�োকথা
নিভৃত য�ৌবন জুড়ে আসে জ�োয়ারের পর ভাটা
বিমুখ পৃথিবী রুগ্ন শরীর কেবলই পিছনে হাঁটা
বৃষ্টির রাতে শব্দের অনুরণন শুনে শুতে যাই
হলুদ স্বপ্নেরা ঘা মেরে জাগিয়ে ত�োলে অভিমান
পাহাড়ের বুকে ধ্বনি ওঠে, নদী বুকে ঢেউ মেখে
আমি পাড়ি দিই জ�োৎস্নাসাগরে তুমি একা
নরম নদীর জলে শুয়ে শুয়ে কাটে যে প্রহর
তুমি কী এসেছ কাছে নদীটির তীরে পাহাড়ের ঢেউ
88
88
দেবানন্দ ভট্টাচার্যের দুটি কবিতা
জিজ্ঞাসার আভাস ছিল
হ্যাঁ ত�োমাকে বুঝতে ভুল করেছি। আর
তার চেয়েও বড় কথা হল,
ত�োমাকে সবটা ব�োঝাতেও পারিনি।
খুব কাছাকাছি থেকে, সুখদুঃখের
লেনদেন অথচ পার্থক্যেই রয়ে গেলাম।
আমার জমান�ো মুদ্রা তুমি সযত্নে
গুছিয়ে রেখেছিলে। সকল প্রয়�োজনীয়
কাগজপত্র ইশতেহার—সাজান�ো
থাকত�ো। ওঠানামা সিঁড়ির ধাপে ধাপে
ক�োন�ো সংশয় ছিল না। শুধু আয়নায়
জিজ্ঞাসার কিছু আভাস ছিল।
তুমিও ত�ো আমাকে ঠিক ঠিক পড়তে
পারলে না। একটাই রাস্তা। কিছুদূর হেঁটে
সাপের জিভের মত�ো দু-ভাগ হয়ে গেল।
হাতের কাজ মিটিয়ে এস আল�োচনায়
বসি। কথা হ�োক। জরুরি কথা।
প্রথমে নিপুণ ব�োঝাপড়া। তারপর একত্রে
89
89
জন্মভূমি খুশি হবেন
চারচ�ৌক�ো ঘরে আটকে আছি।
নজরবন্দী নয়। সারাদিন কী যে করি!
আঁকি লিখি পড়ি। ঘুম আর পায়চারি।
গান সেতার বাঁশি ও সর�োদ..... সময়
কাটান�ো এক জটিল সমস্যাই বটে।
খবর? বলবেন না প্লিজ! সারাদিন
একই বয়ানে গলা ফাটাচ্ছে।
মগজে পেরেক ঠুকছে।
গিন্নি বলেন, সারাদিন ত�ো ঘ�োরের
মধ্যে থাক, ছাইপাঁশ ভেবে কী হবে
শুনি। বরং ছাদবাগানে হাঁটাহাঁটি
কর—কাজে দেবে।
বেশিক্ষণ ত�ো বাগানেই থাকি।
ফুল পাতা ছায়ার সঙ্গে কথা হয়। ওরা
যেন আগের মত�ো মন�োয�োগী নয়।
তীব্র অসন্তোষ ও অবিশ্বাস লক্ষ্য
করেছি। গিন্নিকে কথাটা বলিনি।
তা হলেও কবিতা সাজাই। আবার
আবারও। শ্রোতা নেই। পাঠকও নেই।
প্রায়শই ভিক্ষা জ�োটেনা।
লেখা কাগজ ঝরাপাতার মত�ো
উড়ে যায়। এই উড়ান র�োজ আমি
দেখে থাকি। মনের কথা একটাই—
পায়ের নিচে জমি শক্ত করে
জন্মভূমি খুশি হবেন। শুধু এই টুকুই।
90
90
ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ইরফান
হাবিবের কয়েকটি অতীব মূল্যবান ঐতিহাসিক প্রবন্ধের অনুবাদ
ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে। তুলিকা প্রকাশনা সংস্থার দি
ন্যাশনাল মুভমেন্ট শীর্ষক গ্রন্থে এগুলি সংকলিত। সাম্প্রদায়িক
শক্তি যখন দেশের ইতিহাসকে বিকৃত করছে, তখন এই
প্রবন্ধগুলির গুরুত্ব অপরিসীম।
97
ধা রা বা হি ক উ প ন্যা স
৫
একই হাইস্কুলে সকাল-দুপুর—মেয়ে ও ছেলেদের। ছুটি হবার
আগে থেকেই যাতায়াতের পথে দাঁড়িয়ে থাকে বন্ধুদের সঙ্গে।
একদিন বেড়ার ক্লাসঘরের ফাঁক গলে ঢুকে ব�োর্ডে চক দিয়ে লিখে
এসেছে পছন্দের নাম, যদি সকালে এসেই চ�োখে পড়ে। দান�োটার
চ�োখ কখন�োসখন�ো আবার লুকিয়ে-চুরিয়ে স্নানের ঘাটে, ক�োন�ো
এক আদুল গা-এর দিকে চুম্বক হয়ে আটকে থাকে, ছটফট করে।
পাড়ার এক দাদা পরামর্শ দেয়, ‘এসবের একমাত্র নিরাময় প্রাণাময়-
য�োগ।’ চাঁচের বেড়ার নিরামিষ রান্নাঘরে চার্ট ঝুলিয়ে মাটির মেঝেতে
98
মাদুর পেতে নির্জনে শ্বাস-প্রশ্বাসের চর্চা। কিন্তু কল্পনায় সেই দৃশ্য
চ�োখে পড়লেই যেন এক ভয়ানক অম�োঘ নেশা! কতরকম প্রতিজ্ঞা
একদিন কের�োসিন কুপি জ্বেলে হাত ছুঁয়ে শপথ, কিছুতেই না—কিন্তু
ফের টেনে ছেড়ে দেওয়া ইল্যাস্টিকের মত�ো সেই একই। ওদের
পাড়া ছাড়িয়ে প্রান্তে থাকা এক সাধুমাত�ো ল�োকের সঙ্গে দেখা করে।
ওনার পরামর্শে র�োজদিন কচি বেলপাতা চিব�োয়, প্রাচীন মুনিঋষিরা
নাকি এভাবেই...। একদিন শ্যামের চ�োখে পড়ে যায় ও চেঁচিয়ে
বাড়ি মাত ‘সবাই দেখবে এস�ো রাধুর কাণ্ড!’ ওর চিৎকারে ছুটে
আসে আরতিও—‘কে শিখিয়েছে ত�োকে এসব? ঘর-সংসার ছেড়ে
সন্ন্যাস-টন্ন্যাসের ইচ্ছে নাকি?’
শেষে ক্লাসের বন্ধুরাই সহায় হয়। গ�োপনে হলুদ সেল�োফেন
পেপার ম�োড়া বইয়ের রঙিন ছবি! ওদের কাছ থেকেই শিখে নেওয়া
সব। তবে ওই সাময়িক সুখের পরে পরেই কেমন এক অবসাদ,
খানিক সময় পেরলেই ফের অশান্ত। তখন সকাল-বিকাল খেলার
মাঠে অতিরিক্ত ঘাম-ঝরান�ো—সাঁতরে তিনবার পুকরের এপার-
ওপার।
বর্ষা নামতেই এবার শুরু হয়ে গিয়েছিল রাধুদের সামনের ‘দু’নম্বর’
পুকুর বাঁধাইয়ের কাজ। ভার পেয়েছেন এপাড়ার ঠিকাদার সহদেব
পাল। ‘দখনে’ থেকে আসা মজুরের দল। স্কুল যাতায়াতের পথে
রাধুরা দেখে যেন এক মহাযজ্ঞ। পুকুরপাড় জুড়ে শালবল্লা, পিচের
কাটা ড্রাম, দড়িদড়ার স্তুপ। ভাঙা হরিমন্দিরের পাশ থেকে রাস্তার
ধারে ধারে ছ�োট�ো ছ�োট�ো হ�োগলা পাতার ছাউনি, মাথায় প্লাস্টিক
ছেঁড়া তাবু। লুঙ্গি, খালি গা, পেশি খ�োদাই কতগুল�ো যেন পাথরের
মূর্তি। বাঁশের তৈরি ভারায় ঝুলতে থাকা কপিকল, চার-পাঁচশ�ো
কেজি ওজনের ল�োহার বাটখারা, ওদের ভাষায় ‘মুনকি’। ‘হেইয়া
মারি ব�োল�োরে ভাই, হেইয়া মারি রে! ত�োল�োরে মুনকি ত�োল�োরে
নাই, হেইয়া মারি রে!’ পুকুরপাড় জুড়ে মানুষের ভিড়। রাধুর দিদি
গীতা, পাড়ার মেয়েরা এমনকি প্রীতিও এসে দাঁড়ায়। দড়ির টান
দিতে দিতে ওরা আর�ো দ্বিগুণ উৎসাহে গলা মেলায়, ‘পান-অ
খাইলে মুখ-অ লাল, হেইয়া মারি রে!’ ‘এপাড়ার মেয়েবউরাও সে
গান শুনে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ে। প্রতিবারই দরদর ঘামে স্নান
করে উঠেছে ওরা। কাল�ো করে আসা আকাশ, মুহুর্মুহু মেঘের গর্জন,
তবু গাট্টা গ�োট্টা জলিলভাই, ম�োস্তাক বা সিরাজুলদের বিরাম নেই।
99
শুন্য থেকে নেমে আসা ল�োহার পিণ্ডটার বাড়িতে পাড়া কাঁপান�ো
ঠকাস ঠকাস শব্দে শালখুঁটিগুল�ো একটু একটু করে মাটির ভিতর।
দলটার মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সি ওই সিরাজুল ছেলেটা। রাধুর
ছ�োড়দা শ্যামদের মত�োই। র�োগা, কাল�ো ছিপছিপে, মায়ামাখান�ো
দুট�ো বড় বড় চ�োখ। তাগড়া জ�োয়ান ল�োকগুল�োর সঙ্গে সমানে
পাল্লা দেয়। রাধুরা অবাক হয়, ওই শরীরের ভিতর ক�োথায় লুকিয়ে
ওর এত শক্তি?
একদিন বিকালে আলাপও জমে গেল�ো হাসি-খুশি ছেলেটার
সঙ্গে। দুট�ো নদী পেরিয়ে তবে ওদের গ্রাম। বর্ষার প্রক�োপ কিছুটা
কমে এলে রাতেরবেলা পড়া শেষে রাধুরা গিয়ে দাঁড়ায় ঝুপড়িগুল�োর
সামনে। কাঠের উনুনে ফুটছে ভাত, কেটে রাখা আলু, কুমড়�ো
ইত্যাদি একটা বড় গামলায়। বসয়ে সবচেয়ে কনিষ্ঠ সিরাজুলই
প্রধান বক্তা। সেদিন হচ্ছিল�ো চালকবিহীন এক রিকশা ভ্যানের
কাহিনি। কাজ করতে করতে নির্বিকার শুনে যায় বাকিরা। ‘তা
বুইলে, সে ভ্যানগাড়ি ছুটছে ত�ো ছুটছেই—সিটের ওপর কেই নেই,
এদিকে প্যাডেল আপনা আপনি ঘুরতিছে!’ রাধুরা অন্যদিকে মুখ
ফিরিয়ে ঠ�োঁঠ টিঁপে হাসলে সিরাজুল উত্তেজিত, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না?
তাইলে চল�ো আমার সাথে। আমার আব্বাও দেখিছে ভাদ্রমাসের
অমাবস্যায় গাজীপাড়া থেকে শিরিষতলা— এই আধামাইল যেয়ে
গাড়ি নিজেই স্থির!’
পাশ থেকে ওদেরই কেউ একজন বলে, ‘ওই ভ্যানরিকশা ছিল
কাহারপাড়ার মান্যচরণের। মহাজনের থে কর্জ নে কিনেছিল। ওটা
কেনবার পরে পরেই একবার মারল�ো ধাক্কা; ঠিকঠাক কইরে চালাতে
না চালাতে বউটারে ধরল�ো কী এক র�োগে। ধার আর শুধতে পারে
না, উলটে এদিন-ওদিক থেকে সুদে একেবারে গলা অবধি। শেষে
একদিন দড়ি নিয়ে ওই শিরিষ গাছটারই ডালে!’
শুনতে শুনতে মুখের হাসি কখন মিলিয়ে গেছে খেয়ালও করে
না রাধুরা।
সময় পেলে এসে গল্প করে যায় রাধুদের বারান্দাতেও। গীতাও
য�োগ দেয় সেই আসরে। ঠাম্মা চেঁচায়, ‘ক�োথাকার ক�োন বেজাইত্যা-
মেজাইত্যা? ঘরে ঠাকুরের আসন!’ ওরাও ছাড়ে না, আর ত�োমার
জন্যে যে গিমা, হেলেঞ্চা নিয়ে আসে তখন?
রাধু বিকেলের দিকে একদিন সাইকেলে যাচ্ছে, পিছন থেকে
100
ক্যারিয়ারে হ্যাচকা টান, ‘দাও ত�ো একটুখানি?’ চলন্ত সাইকেলে
লাফ দিয়ে উঠে নানা কসরত। কখন�ো হাত ছেড়ে সিটের ওপর,
কখন�ো আবার হঠাৎ করে কষে সামনে ঝুঁকে চাকা ধরে স্থির—‘তুই
সাইকেল খেলা জানিস?’ বিস্ময় রাধুর চ�োখেমুখে।
সন্ধ্যায় ঝুপড়ির ভিতর কের�োসিন কুপির আল�োয় সিরাজুল
মেলে ধরে পুর�োন�ো একটা অ্যালবাম। জায়গায় জায়গায় ছত্রাকে
খেয়ে যাওয়া অস্পষ্ট কয়েকখানা ছবি : ক�োথাও গলায় টাকার মালা
সাইকেলে দাঁড়িয়ে হাতজ�োড় করে নমস্কার, ক�োথাও দর্শকের সঙ্গে
করমর্দন।
104
বিদেশী বই
জন বার্জারের
পত্রোপন্যাস
তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায়
(এক)
চিঠিতে লেখা উপন্যাস ক�োনও বিস্ময়কর কথাপ্রকরণ নয়। প্রায়
সব ভাষাতেই এমন উপন্যাস আছে যা কতকগুলি চিঠির সমষ্টি;
এক চরিত্র লিখছে, অপর চরিত্র পড়ছে। চরিত্র এবং ঘটনার ঘাত-
প্রতিঘাত সম্পর্কে আমরা ততটাই ওয়াকিবহাল যতটা চিঠিতে
বলা আছে এবং যতটুকু চিঠি থেকে অনুমান করা যাচ্ছে। এ এমন
উপন্যাস যাতে সংলাপ নেই, স্বগত�োক্তি আছে। চিঠির মধ্যে যদি
105
সংলাপ উদ্ধৃত থাকে, তাহলেও সংলাপের ভাগ কম, স্বগত�োক্তির
ভাগ বেশি। যদি পত্রলেখক একাধিক হয়, তবে অনেকের
স্বগত�োক্তি; যদি একটি চরিত্রের লেখা চিঠিই আমাদের সম্বল হয়,
তবে উপন্যাসটি একজনেরই আত্মকথন।
ইংরেজি সাহিত্যে এই ধরনের উপন্যাসের উপস্থিতি অন্তত অষ্টাদশ
শতাব্দী থেকে। তখনকার উদাহরণ হল রিচার্ডসন-রচিত প্যামেলা
(১৭৪০)। তখনকার উপন্যাস গল্পপ্রধান ছিল বলে চিঠিগুলি মাঝে
মাঝে পাঠকের আস্থা হারাত। যখন ঘটনাগুল�ো ঘটে যাচ্ছে, তখন
প্যামেলা নাম্নী পত্রলেখিকা কাগজে কলম ছ�োঁয়ান�োর সময় পাচ্ছে
কীভাবে? এ সব প্রশ্ন দেখা দিত। পরে উপন্যাস হয়ে দাঁড়াল
মন�োময়, আত্মগত। তখন পত্রোপন্যাস বা অন্য ধরনের উপন্যাসে
আত্মকথনকে বিশ্বাসয�োগ্য করার ততটা অসুবিধা রইল না।
উপন্যাসের ঐতিহ্যের এই বিকাশকে পুর�োপুরি কাজে
লাগিয়েছিলেন জন বার্জার (১৯২৬—২০১৭) তাঁর শেষ দিকের
একটি উপন্যাসে। ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় ফ্রম এ টু এক্স্
(From A to X)। আইডা-র লেখা চিঠি, জেভিয়ার-এর কাছে।
দুজনের নামের অদ্যক্ষর যথাক্রমে A এবং X, তার থেকেই
উপন্যাসের নাম। জেভিয়ার জেলখানায় ছিল, রাজনৈতিক বন্দি।
তার প্রণয়িনী আইডা তাকে যেসব চিঠি লিখত, সেগুলি জেভিয়ার
সযত্নে তিনটি ফিতে-বাঁধা গুচ্ছে জমিয়ে রেখেছিল কারাকক্ষে।
চিঠিগুলি যে প্রকাশ করছে, তার কাছে কীভাবে এল? সেকথা বার্জার
সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় পাঠককে জানাচ্ছেন বইয়ের সূচনায়। এই ভূমিকা
উত্তমপুরুষে লেখা এবং বার্জারের উক্তি। তাই মনে হবে কাল্পনিক।
পত্রলেখিকা এবং প্রাপক ক�োনও সত্যিকার দেশের অত্যাচারী
শাসকের হাতে উৎপীড়িত বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী; উপন্যাসটাকে
মনে হবে সত্য ঘটনা। সব লেখকই ত�ো তাই চান; উপন্যাসকে
পাঠক সত্য বলে ভাবুক। উপন্যাস-পাঠের মজা ত�ো ওইখানেই।
ভূমিকায় বার্জার লিখছেন, নতুন একটি কড়া-পাহারার জেলখানা
তৈরি হল বলে শহরের মাঝখানের পুর�োন�ো জেলটা পরিত্যক্ত হল।
এই পুর�োন�ো জেলখানার ৭৩ নম্বর সেলের বন্দি সিগারেটের খালি
প্যাকেট দিয়ে সেল্ফ্ বানিয়েছিল দেয়ালের গায়ে। এই সেলফের
খ�োপে চিঠির তিনটি প্যাকেট পাওয়া যায়। ৭৩ নম্বর সেলের
এই শেষ বাসিন্দার বিরুদ্ধে অভিয�োগ ছিল, সে এক সন্ত্রাসবাদী
106
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। তাকে দু-দুট�ো যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের
সাজা দেওয়া হয়।
সেই হল জেভিয়ার। তিনটি প্যাকেটের সব কটি চিঠি তাকে
উদ্দেশ্য করে লেখা। চিঠিগুল�ো ফিতে-বাঁধা হলেও কালানুক্রমে
সাজান�ো নয়। আইডা (এই যদি তার সত্যি নাম হয়) ক�োনও চিঠিতেই
বছরের উল্লেখ করেনি, শুধু দিন আর মাসের সংখ্যা দেওয়া ছিল।
কালানুক্রম আন্দাজ করার চেষ্টা না করে জেভিয়ারের সাজান�োর
ধরনটাই রেখে দেওয়া উচিত বিবেচনা করেছেন বার্জার। বহু বছর
ধরে চিঠিগুলি লেখা, তা ব�োঝা যায়। মাঝে মাঝে চিঠির ও-পিঠের
পাতায় জেভিয়ার কিছু ন�োট লিখেছিল। সেগুলিও ছাপান�ো হয়েছে
বক্রাক্ষরে (ইটালিক্স্)।
স্বভাবতই আইডা তার রাজনৈতিক কাজের কথা চিঠিতে গ�োপন
করে গেছে, পরিচিত ব্যক্তিদের নামও পালটে দিয়েছে নিশ্চয়।
আইডা আর জেভিয়ারের বিয়ে হয়নি। সুতরাং দেখা করার অনুমতিও
কর্তৃপক্ষের কাছে চাইতে পারেনি আইডা। কিছু চিঠি লিখেও আইডা
পাঠায়নি, বিপজ্জনক ভেবে। পাঠান�ো চিঠি আর না-পাঠন�ো চিঠি,
সবই বার্জারের হাতে আসে। কীভাবে আসে, তা তিনি গ�োপন
রেখেছেন, প্রকাশ করলে অন্যদের বিপদ ঘটবে, এই বিবেচনায়।
না-পাঠান�ো চিঠিগুল�ো তিনি নিজের পছন্দমত�ো এক জায়গায় গুঁজে
দিয়েছেন ছাপান�োর জন্য।
পরিশেষে লিখছেন, আইডা আর জেভিয়ার আজ যেখানেই
থাকুক, জীবিত বা মৃত, ঈশ্বর যেন তাদের ছায়া দুটিকে আগলে
রাখেন।
(দুই)
প্রথম প্যাকেট থেকে একটা চিঠি :
ওষুধের দ�োকানে যাচ্ছি, দেখি একটা ল�োক পথের কিনারায় বসে
আছে গ�োল ম�োড়ের কাছে, যেখানে মালবেরি গাছটা আছে পাহাড়ের
তলায়। দেখে চিনতে পারলাম না। তার পাশে পড়ে আছে একটা
ভাঙাচ�োরা সাইকেল, সামনের চাকাটা ত�োবড়ান�ো। ত�োমার বয়সি
হবে, তবে একেবারেই ত�োমার মত�ো নয়।
অন্য ক�োনও ল�োকই ত�োমার মত�ো নয়। সব কিছুই একই সুত�োয়
তৈরি, আর প্রত্যেক ল�োক ভিন্নভাবে গড়ে ত�োলা।
107
ব�োঝা গেল না সে সাইকেল থেকে পড়ে গেছে না কি সাইকেলটা
চুরি গিয়েছিল, তবে সে খুঁজে পেয়েছে। যেভাবে ছুঁয়ে আছে তা
থেকে ব�োঝা যায় অবশ্য যে সাইকেলটা ওরই। ওর প্যান্টের একটা
পা ছেঁড়া, তা থেকে মনে হয় ও পড়ে গিয়ে থাকতে পারে। ওর বাকি
জামাকাপড়ও ন�োংরা, চটি জ�োড়াও ছেঁড়া, গ�োড়ালি-ভাঙা। পড়ে
গিয়েছিল হয়ত�ো, কিংবা ও যখন ঘুম�োচ্ছিল তখন সাইকেল চুরি
গিয়েছিল, চোরটাই পড়ে গিয়েছিল।
অনেকক্ষণ ধরে একা থাকলে, যেমন আমি আছি, এই সব ব�োকা
ব�োকা বিষয় নিয়ে ভাবনা-চিন্তা চলে। তুমি আমার সঙ্গে থাকলে
সাইকেলটার কথা মাথাতেই আসত না। ওকে জিজ্ঞাসা করিনি কী
ঘটেছিল, কারণ দেখতেই পাচ্ছিলাম ও প্রাণপণে ভাবছে এর পর
কী করবে। মুখটা দু-হাতের তালুতে বসান�ো, কনুই দুট�োর ভর দুই
হাঁটুতে, আর বাঁ চটি থেকে ওর বুড়�ো আঙুল বেরিয়ে আশ্রয় খুঁজছে
ডান চটির ছেঁড়া গ�োড়ালিতে নাক ঢুকিয়ে। সিদ্ধান্ত নেবার মুহূর্ত।
এইসব মুহূর্তে ত�োমাদের পুরুষ মানুষদের এক বিশেষ মুখভঙ্গি দেখা
যায়। যেন ত�োমরা প্রাণপণে চাইছ অদৃশ্য হয়ে যেতে। আকাশে মিশে
যেতে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আত্মবলি। মেয়েরা অন্যরকম। তারা বেশিরভাগ
সিদ্ধান্ত নেয় পাছার ওপর জাঁকিয়ে বসে।
আমি নিয়েছি একটা সিদ্ধান্ত। বিয়ে করি না? তুমি আমার কাছে
প্রস্তাব দাও! আমি হ্যাঁ বলি! তারপর ওদের জিজ্ঞাসা করি। ওদের
অনুমতি যদি পাওয়া যায় তবে বিয়ের সময়ে দেখা হবে এবং তারপর
চিরকাল সপ্তাহে একবার করে ভিজিটিং রুমে সাক্ষাৎ!
প্রতি রাত্রে আমি ত�োমাকে গড়ে তুলি—একটা হাড়ের সঙ্গে আর
একটা সুক�োমল হাড় জুড়ে জুড়ে।
ত�োমার আইডা
(চার)
তৃতীয় প্যাকেট থেকে আর একটি :
এন কে-র লেখা বইটা পেয়েছিলে কি? আমি ছাতের ওপর বসে
আছি, সূর্য অস্ত যাচ্ছে, আমি এইমাত্র ম�োবাইলে কথা বললাম
110
আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে যাদের ওপর মর্টারের গ�োলাবর্ষণ হচ্ছে
ক্রোক�োডিল�োপ�োলিস-এ। তারা তামাশার গল্প শ�োনাল। তামাশা!
আমি ত�োমাকে ভয় দেখিয়েছিলাম দেবদূতদের গল্প শ�োনাব
বলে। এক সময়ে দেবদূতদের ডানা ছিল। কারও বার�োটা, কারও
চারটে, বেশির ভাগেরই দুট�ো। সর্বত্র ছিল দেবদূতেরা। এক হাজার
পাঁচশ�ো পঞ্চাশ দেবদূত-বাহিনী চিৎকার করে গাইত ঈশ্বরের ভজন।
তাছাড়াও শ্রমিক দেবদূতরা ছিল। সপ্তাহের প্রতিটি বার, দিনের
প্রতিটি ঘণ্টা, কম্পাসের প্রতিটি বিন্দু, প্রতিটি কাজ আর প্রতিটি
পরবের জন্য, প্রতিটি পাহাড় আর প্রতিটি পথের জন্য নির্দিষ্ট এক
একটি দেবদূত ছিল। প্রতিদিন সকালে প্রত্যেক দেবদূতের পুনর্জন্ম
হত।
মাঝে মাঝে ভাবি এই ঘন ভিড়ের মধ্যে ঘেরাও থাকতে কেমন
লাগত। ঠিক যেন উদ্বাস্তু শিবিরে থাকা!
তবে দেবদূতরা বেশির ভাগ সময়েই অদৃশ্য হয়ে থাকত। অদৃশ্য
কিন্তু অস্তিত্ব আছে—তাদের নির্দেশাবলি নিয়ে, মতামত নিয়ে,
অফুরান কণ্ঠস্বর আর ওয়েভব্যান্ড নিয়ে।
সংস্কৃত আঙ্গিরস শব্দের অর্থ পরমাত্মা। পারসিয়ান ভাষায়
আঙ্গার�োস মানে পত্রবাহক। গ্রিক ভাষায় আনজেলেস মানে দূত।
গত সপ্তাহে ভেড্-এর সঙ্গে দেখা। দূষিত জল খেয়ে
গ্যাস্ট্রোএনটেরাইটিস আর ডায়েরিয়া হয়েছে। ওকে নিফুর�োক্সাডাইজ
(দিনে ৮০০ মিলিগ্রাম) দিলাম আর কিছু ক�োপেরামাইড (দিনে ১২
মিলিগ্রাম)। ওষুধগুল�ো পকেটে পুরে সে আমাকে একটা গল্প বলল।
গুস্তাভ�ো মুচি বুড়�ো হয়েছিল, মরে গেল। ঘুমের মধ্যেই মারা গেল
এক জ�োড়া চটি সেলাই করতে করতে। এক দেবদূত তার সঙ্গে চলল
স্বর্গপথে। ক�োনও এক সময়ে দেবদূত কথা বলল। চাইলে নীচে
তাকিয়ে দেখতে পার�ো, ত�োমার জীবনের পদচিহ্নগুল�ো দেখতে
পাবে। বুড়�ো তাকিয়ে দেখল—সত্যিই দেখতে পেল নিজের পায়ের
ছাপের সুদীর্ঘ সারি। কিন্তু কী একটা দেখে তার খটকা লাগল। এ কী
করে হয়, সে জিজ্ঞাসা করল, যে দু-তিন বার অনেকটা জায়গা জুড়ে
আমার পায়ের ছাপ নেই, যেন জীবন শেষ হয়ে গিয়েছিল, আমি মরে
গিয়েছিলাম? তা কীভাবে সম্ভব? দেবদূত হেসে উত্তর দিল, সেই
ক-বার আমি ত�োমাকে ক�োলে তুলে নিয়েছিলাম।
দেবদূতেরা কথা বলে গান গেয়ে, আর সব গানই স্বপ্ন দেখে যে
111
এক দেবদূত তাকে গাইবে।
হয়ত�ো সংগীত আর ওই ডানাওয়ালা দেবদূতরা যমজ, একটা
জন্মেছিল অন্যটার আগে। প্রথমে সঙ্গীত। আর আমরা যদি সেই
একাকিত্বের কথা বুঝতে চাই, যখন প্রথম দেবদূত জন্মায়নি আর
সঙ্গীত ছিল একা, তবে শ�োন�ো বিলি হলিডের গান!
দুর্বলতাও ছিল তাদের, এই দেবদূতদের। পঞ্চদশ শতাব্দীতে
হিসেব করে দেখা গিয়েছিল পতিত দেবদূতদের সংখ্যা ১৩ ক�োটি!
অনেকেরই পতন হয়েছিল কারণ, আসায়েল-এর মত�ো, তারা
নারীসঙ্গম করেছিল!
ঘটনাক্রম সম্পর্কে আমি এইখানে খুব নিশ্চিত নই। উলট�োটাও
হয়ে থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে, পতনটা আগে, পরে নয়। ক�োনও
দেবদূতকে নেবার ল�োভ আমার কখন�োই হত না—কিন্তু পতিত
দেবদূতকে নেবার কথা আমি কল্পনা করতে পারি!
দ�োকানঘরে ইডেলমিস ওর চেয়ারটার জায়গা পালটে এমন
জায়গায় রেখেছে যাতে ও খ�োলা দরজা দিয়ে আইসক্রিম—কারখানাটা
দেখতে পায়। প�োড়�ো জমির ওপর দিয়ে কে হেঁটে আসছে দেখতে
ওর ভাল�ো লাগে। এখন ও রয়েছে সর্দি-কাশির ওষুধের দ্বীপে। এই
নিয়ে ও একটা ঠাট্টা করল। ও বই পড়ে, ভাবে, ঘুমে ঢ�োলে, ক�োনও
ক�োনও দিন সারা দিনে মাত্র একবার কি দুবার উঠে খদ্দেরকে
পরামর্শ বা ওষুধ দেয়। তবুও ও কিন্তু সেই একটা-দুট�ো কাজ বেছে
নেয়, কারণ, ক�োনও একটা স্তরে, ও প্রত্যেকটি লেনদেনের ওপর
নজর রাখে। কখনও কখনও আমার মনে হয়, ও শেষবারের মত�ো
আমাকে শিখিয়ে নিচ্ছে।
রাত হয়ে গেছে, বিদ্যুৎ চালু নেই। শুনতে পাচ্ছি, একটা ড্রোন
আকাশ থেকে নজরদারি করছে আমাদের ওপর, আর আমি
ম�োমবাতি নিয়ে শুতে যাবার আগে দু-হাতের মধ্যে আমার হাত
দুট�ো রাখলাম।
ত�োমার আইডা
(পাঁচ)
শুধু চিঠির মাধ্যমে চরিত্রের উন্মোচন নয়, শুধু আত্মকথনের মধ্যে
অতীত স্মৃতি, কল্পিত ভবিষ্যৎ আর অনুভূত বর্তমানকে একত্রিত
করা নয়, একটি রাজনৈতিক উপন্যাসও লিখছেন জন বার্জার,
একথা পরিষ্কার। শুধু প্রকরণ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা তাঁর উদ্দেশ্য
নয়, তাঁর বিষয়বস্তু একটি সাম্রাজ্যবাদবির�োধী, স্বৈরতন্ত্রবির�োধী,
শ্রমিক এবং কৃষকের অধিকার-রক্ষার রাজনীতিকে সচেতনভাবে
প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।
জেভিয়ারের মতামত আইডার পাঠান�োর চিঠির উলট�ো পিঠের
সাদা অংশে সরাসরি প্রকাশিত। যেহেতু সে এই মন্তব্য কাউকে
পাঠাচ্ছে না, তাই তাকে সেনসরের ভয়ে রেখে-ঢেকে বলতে হচ্ছে
না। সেখানে আছে ভূমিহীনদের মধ্যে জমি বিতরণে বলিভিয়ার
ম�োরালেস সরকারের ভূমিকার (২০০৬) স্পষ্ট প্রশংসা, দরিদ্রের
অনন্ত অভাবের কথা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মারণাস্ত্র-সর্জ্জার কথা।
আইডার পাঠান�ো চিঠিগুলিকে সেনসরের বেড়া ডিঙিয়ে জেলখানায়
ঢুকতে হয় বলে সেখানে মতামত অনেক তির্যকভাবে, সুক�ৌশলে
প্রকাশ করতে হয়। সে একটা ওষুধের দ�োকানে কাজ করে, যার
মালিক হল বুড়ি ইডেলমিস। ড্রোন সহয�োগে শাসকরা নজরদারি
চালায় আইডা-র ওপর; তার থেকে ব�োঝা যায় সে রাজনৈতিক
কাজকর্মে বিরতি দেয়নি জেভিয়ার কারান্তরালে যাওয়ার পরেও।
সম্ভবত দেবদূতদের কাহিনির মধ্যে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে শাসকদের ব্যঙ্গ
করা আছে। যে চিঠিগুল�োয় খ�োলাখুলি সরকার বা সৈন্যবাহিনীর
বিরুদ্ধে প্রতির�োধের কথা আছে, সে চিঠিগুলি জেভিয়ারকে পাঠান�ো
সম্ভব নয় বলেই আইডা পাঠায়নি। সে রকম একটি চিঠিতে উল্লেখ
113
আছে, আইডা এবং তার মত�ো আরও অনেক বৃদ্ধা শ্রমিক/কর্মচারী
একটি বন্ধ কারখানার সামনে পিকেট করে সামরিক ট্যাঙ্ক-বাহিনীকে
ঢুকতে বাধা দিচ্ছে, যাতে তারা কারখনায় ঢুকে বিদ্রোহীদের গ্রেপ্তার
করতে না পারে। সাতজন আশ্রয় নিয়েছে ভাঙা কাখানার শেডে,
যাদের আইডা বলছে ‘‘আমাদের ল�োক’’। ওপরে চক্কর দিচ্ছে
গ�োলবাহী হেলিকপ্টার, মাটিতে ট্যাঙ্ক। অতএব মহিলারা অবস্থান
করছেন ছাত জুড়ে, কারখানা ঘিরে। মুখে মুখে খবর ছড়িয়েছে,
আরও আরও মহিলা এসে প্রতির�োধকে দৃঢ়তর করছেন। তাঁদের
ওপরে গোলাগুলি না চালিয়ে সাতজন বিদ্রোহীকে শেষ করতে
পারবে না কেউ। শেষ পর্যন্ত প্রতির�োধ জয়যুক্ত হল, হেলিকপ্টার
আর ট্যাঙ্ক ফিরে গেল। এক ঘণ্টা পরে সুয�োগ বুঝে সেই সাতজনও
কারখানা ছেড়ে অন্য নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেল। নিরস্ত্র প্রতির�োধের
জয় বিনা রক্তপাতে ঘটেনি অবশ্য। দশ মিনিট পরে মুখে মুখে খবর
এল, আরও যে মহিলারা পিকেটে য�োগ দিতে আসছিল, পথে তাদের
ওপর গুলি চলেছে। গুলিতে মারা গেছে সংগীতশিক্ষিকা ম্যান্ডা।
কিন্তু ক�োন দেশে ঘটছে এ সব? এই সেনা-সন্ত্রাস, এই প্রতির�োধ,
এই কারাবাসে য�ৌবন থেকে বার্ধক্যে উত্তরণ? চরিত্রগুলির নাম থেকে
ব�োঝা যাবে না, কারণ নামগুলি বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির সূচক।
জেভিয়ার নামটি ক্যাথলিক, আইডা নামটি আরবি। এমন ক�োনও
দেশ যেখানে ক্যাথলিকরা সংখ্যালঘু, মুসলমান সংখ্যাগুরু? অথবা
উভয়েই সংখ্যালঘু কিংবা নিপীড়িত? চট করে প্যালেস্টাইনের কথা
মনে পড়বে, কিন্তু বার্জারের বর্ণিত দেশ দক্ষিণ আমেরিকা বা মধ্য
ইউর�োপে হওয়া অসম্ভব নয়; আবার তুর্কি, সিরিয়া, ইয়েমেন,
ইরাক হতে পারে, মিয়ানমারই বা নয় কেন? আমরা কি হলফ করে
বলতে পারব, আসামের কনসেনট্রেশন শিবিরগুলিতে, বা কাশ্মীর ও
লাডাখের গ্রামাঞ্চলে নরনারীর দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমরা
খুব ওয়াকিবহাল? এই ২০২১ সালে?
চিঠিগুলির সম্বোধন থেকেও নির্দিষ্ট অনুমান সম্ভব নয়। অনেক
চিঠিতে ক�োনও সম্বোধনই নেই। মি গুয়াপ�ো (ওগ�ো সুন্দর), মি
গ�োল�োন্দ্রিন�ো (আমার স�োয়াল�ো পাখি), স�োপল�োতে (ওয়েল্ডার,
কারণ জেভিয়ার কর্মজীবনে ওয়েল্ডার ছিল) সম্বোধনগুলি
স্প্যানিস ভাষার। ক�োথাও বা আইডা জেভিয়ারকে বলেছে ভূমিস্থিত
সিংহ অর্থাৎ বহুরূপী, কারণ ইংরেজি চ্যাম�োলিয়ন কথাটার ম�ৌল
114
গ্রিক অর্থ আক্ষরিকভাবে তাই, সে সিংহ মাটিতে হামাগুড়ি দেয়।
আবার অন্যত্র আইডা সম্বোধন করেছে হাবিবি (প্রিয়তম) কিংবা ইয়া
নুর (আমার আল�ো) বলে। দুটি শব্দই আরবি। উল্লেখ্য, ১৯৯০-এর
দশকের একটি জনপ্রিয় আরবি গানের প্রথম কলি ছিল ‘‘হাবিবি ইয়া
নুর-এ-আইন,’’ সেখান থেকেই শব্দ দুটি এসেছে। আরবি ভাষায় কথা
বলে অন্তত কুড়িটি দেশ, স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে মধ্য ও দক্ষিণ
আমেরিকার প্রায় সব দেশ, তা ছাড় পেল ও মেক্সিক�ো। তা হলে
ক�োথায় বাস করে বার্জারের চরিত্ররা? পৃথিবীর সবখানেই কি আছে
তারা? আইডা পছন্দ করে মার্কিন জ্যাজ্সঙ্গীতশিল্পী বিলি হ্যালিডের
(১৯১৫—১৯৫৯) গান, মুগ্ধ হয় বর্তমান তুর্কির প্রধান মহিলা-কবি
কুর্দিশভাষিণী বেজান মাটুর (জন্ম ১৯৬৮)-এর কবিতা পড়ে।
পরিকল্পনা করেই কি আইডার রুচিকে আন্তর্জাতিক করে তুলেছেন
জন বার্জার? বিপ্লবীদের ক�োনও দেশ নেই, এই কি তাঁর বক্তব্য? তাঁর
কাল্পনিক চরিত্রগুলিকে বিশ্ববিপ্লবের প্রতীক হিসেবে দেখি, এই কি
তাঁর অভিপ্রায়?
উপন্যাসে, শিল্প-সমাল�োচনায় এবং অন্যত্র নিজের রাজনৈতিক
ঝ�োঁক কখনও গ�োপন রাখেননি বার্জার। সাম্রাজ্যবাদের ও একচেটিয়া
পুঁজির প্রশ্রয়দাতা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গ�োড়া থেকেই লিখছিলেন
বলে তাঁকে প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করতে প্রতিক্রিয়াশীলরা দেরি
করেনি, যদিও তিনি কখনও কমিউনিস্ট পার্টি বা অন্য ক�োনও
রাজনৈতিক দলের নথিভুক্ত সদস্য ছিলেন না। তাঁর প্রথম উপন্যাস
আ পেইন্টার অব আওয়ার টাইম (১৯৫৮) যেহেতু তথাকথিত
‘মুক্ত’ দুনিয়াতে শিল্পীর আত্মপ্রকাশের সমস্যাগুলি তুলে ধরেছিল,
তাই কুখ্যাত কমিউনিস্টবির�োধী প্রতিষ্ঠান কংগ্রেস ফর কালচারাল
ফ্রিডম বইটির বিরুদ্ধে এমন চাপ দিতে থাকে যে প্রকাশক বাধ্য হন
বইয়ের সব কপি দ�োকান থেকে সরিয়ে নিতে। ব্রিটিশ সমাজ সম্পর্কে
বীতশ্রদ্ধ বার্জার ১৯৬২ সালে দেশত্যাগ করেন। আর ফেরেননি।
বুর্জোয়া সমাজের সমাল�োচনা দ ফুট অব ক্লাইড (১৯৬২) এবং
জি (১৯৭২) উপন্যাসেও উপস্থিত। পিগ আর্থ (১৯৭৯) প্রমুখ
উপন্যাসত্রয়ে বিধৃত কৃষকজীবন। এই সৃষ্টিবহুল পথ ধরে এসেছে
শেষ জীবনের কাজ ফ্রম এ টু এক্স্। তাঁর পক্ষপাত খেটে-খাওয়া
মানুষের দিকে, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রাখেননি বার্জার।
আর খেটে-খাওয়া মানুষের বন্ধন যে আন্তর্জাতিক, সে চেতনা
চরিত্রদের নাম এবং চিঠির সম্বোধনেও প্রতীয়মান।
115
সি নে মা র ভা ষা
৬
“আমাদের”
আর “ওদের”
সংলাপ...
অরুণাভ গাঙ্গুলি
116
নাকি দুজনকেই দেখতে পাব�ো। ক�োথায় কথা বলছে সেই পরিবেশ
বা তার অবস্থানও দেখাব�ো, এগুল�ো ঠিক করে নিতে হবে। সংলাপ
লেখার সময় তার তথ্য, আবেগ, নাটকীয়তা সেগুল�োও মনে করে
তার সংলাপ লিখতে হবে। টেলিফ�োনে কথা হলে কি দুজনকেই
দেখতে পাব�ো না একজনকে দেখব আর দুজনের কথা শুনতে
পাব�ো, সেটাও লিখে রাখতে হবে। এরকম অনেক খুঁটিনাটি বিষয়
চিত্রনাট্য লেখার সময় ঠিক করে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে
যিনি কথা বলছেন তাঁর সংলাপের মধ্যে দিয়ে যেন তাঁর নিজের
কথা বলার ধরন বা স্টাইলকে বজায় রাখা। তাঁর মনের অবস্থা তাঁর
আবেগ যেন ধরা পরে তাঁর সংলাপে। সংলাপ লেখার সময় দেখতে
117
হবে তিনি কি কিছু গ�োপন করতে চাইছেন, তাহলে তা একরকম
হবে। আবার তিনি কি কিছু ব�োঝাতে বা প্রভাবিত করতে চাইছেন?
নাকি তাঁর কথার মধ্যে ক�োন দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব আছে? সব কিছুর মধ্যে
দেখতে হবে যে তিনি সে কথা বলার সময় কি করছেন, অর্থাৎ তাঁর
অ্যাকশনগুল�ো কি কি থাকবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সব কথা বা
সংলাপ যেন স্পষ্ট উচ্চারণ হয় ও স্পষ্ট শ�োনা যায়।
সংলাপ আছে সেরকম সব দৃশ্যগুলিতে শট বিভাজন আগে থেকে
পরিকল্পনা করে নিতে হবে। যেমন পুর�ো সংলাপ একটা মাস্টার
শটে নিয়ে, পরে তা আবার ক্লোজ শটে নিয়ে নিতে হলে তা আগে
থেকে পরিকল্পনা দরকার। সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, সংলাপ
মাস্টার শটে বলেছিল, তা আবার ক্লোজ শটে বলতে হবে। যাতে
এডিট করার সময় ক�োন অসুবিধা না হয়। যাঁর উদ্দেশে কথা বলছেন
তারও কিছু ক্লোজ শটে প্রতিক্রিয়া নিয়ে রাখতে হবে। ক�োন দীর্ঘ
সংলাপ থাকলে সে ক্ষেত্রে কি কি মুভমেন্ট বা ঘটনা থাকবে লিখে
রাখতে হবে। কখন ক্লোজ শট নেব আর কখন লং বা মিড শট হবে
সেটা নির্ভর করবে কখন কার কথা এবং ক�োন কথাকে গুরুত্ব দিতে
হবে তার উপর। আবার এমনও হতে পারে যিনি শুনছেন তাঁর
গুরুত্ব বেশি, তখন তাঁর ক্লোজ শট লাগবে। সংলাপ দিয়ে তথ্য
পরিবেশনের একটা ঝ�োঁক লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু মনে রাখতে হবে
কতটা দৃশ্য বা ঘটনা দিয়ে তা করা যায়।
সে কারণেই ক্যামেরার ব্যবহারকে আরও কার্যকরী করে তুলতে
হবে। কারণ এই ক্যামেরার ব্যবহারই পারে দৃশ্যকে আরও সার্থক
করে তুলতে। কখন ক্যামেরা ট্র্যাক করে চলাচল করবে এবং
তার ফলে যে দৃশ্য মুহূর্ত তৈরি হবে যা সেই ভাবনাকে সার্থক রূপ
দেবে। আমরা হিচকক-এর সিনেমায় যে ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার
দেখেছি, যখন তাঁর কাহিনীকে আরও সার্থক করে তুলেছে। যেমন
“ভার্টিগ�ো’’ সিনেমায় একটা সমস্যার সন্মুখীন হয়েছিলেন। যখন
ক�োন মানুষ উপরে উঠে তখন তাঁর মাথা ঘ�োরে – এটাই ভার্টিগ�ো,
এটা একটা অসুখ। এখন এই অনুভূতি তিনি দর্শকের মধ্যে কি
করে নিয়ে যাবেন। সেটা দেখাতে একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন।
ক্যামেরা ট্র্যাক করার সময় সামনের দিকে এগিয়ে যায়, তাতে ফ্রেমটা
বদলে যায়। ক্যামেরা মূল বস্তুর দিকে এগিয়ে যায় চারপাশটা ক্রমশ
কমে যায়। হিচকক কি করলেন, ক্যামেরা যতটা ট্র্যাক ফরওয়ার্ড
118
করলেন ততটাই জুম আউট করতে লাগলেন। তাতে ফ্রেমটা একই
থেকে গেল। আপাতভাবে মনে হবে ক�োন কিছু ঘটছে না কিন্তু দর্শক
একটা গতি অনুভব করবে। মনে হবে একটা ব্যাকগ্রাউন্ড সরে সরে
যাচ্ছে – এতেই সেই ভার্টিগ�ো পরিস্থিতিটা দর্শক অনুভব করল�ো।
স্পিলবার্গও এইভাবে তাঁর জস সিনেমায় ব্যবহার করলেন। অর্থাৎ
ক্যামেরার ব্যবহারের উপর অনেক অনুভূতি রচনা করা যায়। দরকার
পরিচালকের সেই সৃষ্টিশীল মন। যেমন গ�োদার তাঁর সিনেমায় তিনটি
পদ্ধতি ব্যবহার করতেন, ১ ইচ্ছাকৃত বাধাদান ২ দ্বন্দ্ব অর্থাৎ যেটা
একটা দৃশ্যে দেখাচ্ছে বা সাউন্ড ট্র্যাকে ব�োঝান�ো হচ্ছে পরমুহূর্তেই
ঠিক তার বিপরীত কিছু দেখান�ো বা শ�োনান�ো হচ্ছে রিফ্র্যাকশান।
ক�োন বস্তুর মধ্যে দিয়ে আল�ো গেলে তা যেমন বেঁকে যায় খানিকটা
সেরকম একটা বিষয়। এর মধ্যে দিয়ে তিনি বাস্তব ও সিনেমার
ফারাকটা তুলে ধরতেন।
সিনেমার আধিপত্যকারী ভাষার প্রতিবাদে গড়ে উঠল
নিওরিয়ালিজম। এ যুগে প্রচলিত অনেক সিনেমার নিয়ম ও ব্যাকরণ
বদলে দিল। যেমন স্টুডিও থেকে ক্যামেরা বাইরে গেল। দ্বিতীয়ত,
119
যে অভিনয় করান হল এমন সকলকে দিয়ে যাঁরা সাধারণ রাস্তার
মানুষ। যেমন ডিসিকার “বাইসাইকেল থিফ” সিনেমার মূল চরিত্র –
বাবা, তিনি কিন্তু অভিনেতা ছিলেন না। এভাবেই এক বাস্তবতাকে
সিনেমায় রূপ দিলেন। এই ধারায় আন্দ্রে বাজা বা ফেলিনির ও
আন্তনিওনির প্রথম দিকের বেশ কিছু সিনেমায় খুবই প্রভাব পড়ল।
৪০ থেকে ৫০-এর দশক পর্যন্ত এই নিওরিয়ালিজমের ধারার পর
৬০-এর দশকে এল নুভেলভাগ বা নবতরঙ্গ। কাহিনী ও কাহিনীর
বাইরে গিয়ে সিনেমা এক এক নতুন ভাষার জন্ম দিল। সিনেমাকে
সাহিত্যের হাত থেকে মুক্ত করে সিনেমার ভাষাকে আরও বিকশিত
করার প্রয়াস চলতে লাগল�ো।
বিভিন্ন সময় জুড়ে সিনেমার যাঁরা নতুন নতুন ভাষা দিয়েছেন,
সেই সকল স্রষ্টা যাঁরা আসলে তাঁর যুগের তাঁর সময়ের ভাষাকে
অনুভব করেছিলেন। নিজের সময়কে এড়িয়ে গিয়ে শিল্পের জন্য
শিল্প নির্মাণে নিজেদের আটকে রাখেননি। সময়কে প্রশ্নহীনভাবে
দেখেননি। তাই তাঁদের সিনেমার ভাষায় আঙ্গিকে নতুন নতুন ধারার
জন্ম নিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এসেছিল নিওরিয়ালিজম।
হলিউডের আধিপত্যের সাহিত্যধর্মী ধারা, বৈভব এবং স্টুডিও-
নির্ভর সিনেমার জগৎ। বিভিন্ন দেশের মত�ো ফরাসি দেশেও তার
প্রভাবে বিপর্যস্ত। তারই প্রতিক্রিয়ায় ক্যামেরা বাইরে এল�ো, প্রকৃতির
আল�োয় তৈরি হল নুভেলবাগ সিনেমা। সমাজ বিচ্ছিন্ন সিনেমা হয়
না। হয় সে নানা আঙ্গিকে অনেক কিছু আড়াল করে, আর নয় সে
নানা আঙ্গিকে অনেক কিছুকে উন্মুক্ত করে।
“প্রতি যুগেই যে সব ধারণা আধিপত্য করেছে তারা চিরকালই
তখনকার শাসকশ্রেণীরই ধারণা” কমিউনিস্ট ইশ্তেহারে একথা
বলা হয়েছে। আর সেভাবেই ধারণা বা ভাষার ব্যাবহার ও তার
প্রকাশ হয়ে আসছে সেই সেই সমাজের ধারণা। সিনেমা বা শিল্প
সংস্কৃতি তার বাইরে নয়। তাই সেই সময়ের শাসকের ধারণার উপর
আশ্রয় করে যেমন মূল ধারার সিনেমা বা শিল্প সৃষ্টি হয়ে এসেছে,
তেমনই কখন�ো কখন�ো ক�োন স্রষ্টার সৃষ্টিতে এসেছে ভিন্ন ধারার ভিন্ন
ধারণার প্রতিফলন। লাতিন আমেরিকার সিনেমায় যেমন ভিন্ন ধারার
প্রতিফলন দেখতে পাই। সাম্রাজ্যবাদের কবলে ডুবে থাকা দেশের
অভিমান ও প্রতিবাদ ফুটে ওঠে কিছু পরিচালকের মাধ্যমে। যেমন
মিগুয়েল লিত্তিন, ফারনেন্দো স�োলানাস ও অক্টেভিও গেতিন�োর
120
মত�ো পরিচালকের মাধ্যমে। মিগুয়েল লিত্তিন এক সভায় সিনেমা
নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলছেন “জনসাধারণের মুক্তিসংগ্রামই হবে
আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাণের কেন্দ্রীয় বিষয়। চলচ্চিত্রকারদের এই
সদিচ্ছার সঙ্গে জনগণের বিপ্লবী চেতনা যুক্ত হয়ে জন্ম নেবে নতুন
চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব।’’ এই সকল ধারনাই হল সেই সমাজের যে
ধারণার আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক নতুন ধারণা। স্বাভাবিকভাবেই সেই
ধারণা থেকে গড়ে উঠা সিনেমার ভাষা ও আঙ্গিকে প্রচলিত ধারার
বিপরীতে এক নতুন প্রয়াস। যেমন ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায় আমরা
পাই এক ভিন্ন ধারার নির্মাণ শৈলী। যেখানে তার ক্যামেরার ব্যবহার
থেকে অভিনয় ধারায়ও আসে এক নতুন ভাষা। এই সিস্টেমের ভাষা
আর সিস্টেমের বিরুদ্ধে কথা বলার ভাষা আলাদা হবেই। প্রতিষ্ঠিত
সমাজের প্রগতিশীল শাখার অন্তর্ভুক্ত সিনেমার ভাবখানা এরকম,
যেন সমাজের যাবতীয় সংঘাত আপনা-আপনি মিটমাট হয়ে যাবে,
ক�োন এক শান্তিপূর্ণ উপায়ে। ফলত সেই সকল সিনেমার ভাষাও
তেমনই সাযুজ্য রেখে গড়ে উঠে। কিন্তু শ্রেণি-স্বার্থের দ্বন্দ্ব, শিল্প-
সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র সাড়া না দিয়ে পারে না। কাজেই যে কথাটা
উঠে আসছে “ওদের’’ আর “আমাদের” সংস্কৃতি। “ওদের’’
আর “আমাদের” সিনেমা। কিন্তু আধিপত্যকে পাকাপ�োক্ত করতে
গিয়ে শ�োষকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, তুমি যদি সফল হতে চায় ত�ো
তাহলে নিজেকে আমার আদলে গড়ে ত�োল�ো। তুমি যদি সিনেমা
নির্মাণ করতে চাও ত�ো আমার আদলে আমার ভাষায় সিনেমা কর,
তাহলেই ত�োমার সাফল্য আসবে। তখন একথা ও অভিয�োগ উঠে
আসবে সিনেমার আবার “ওদের’’ আর “আমাদের” হয় নাকি
সিনেমা সিনেমাই। অর্থাৎ গণতন্ত্রের বাগাড়ম্বর কথা বললেও,
আসলে আমার আদলে একই ছকে সকলকে কথা বলতে হবে।
আবার কেবল মাত্র দুট�ো আলাদা ভাষা ব্যবহারের কারণে সংস্কৃতি
আলাদা রূপ ধারণ করে না। সংস্কৃতি ও দর্শনের ভিন্ন ভিন্ন ধ্যান-
ধারণা ও চিন্তা–ভাবনার মধ্যে দিয়ে তার রূপান্তর হয়। তাই
সিনেমার ভাষা সিনেমার আঙ্গিক সিনেমার নির্মাণ শৈলী এই সব
কিছু নির্ভর করবে পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গির উপর। আর এই সকল
নানান প্রশ্ন আর সংঘাতের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠতে পারে নতুন
ভাষা নতুন সিনেমা।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)
121
রম্য রচনা
130
তালিম দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই গায়কদের দলে এক জনের
নাম— ‘শ্রী নরেন্দ্রনাথ দত্ত’। ভবিষ্যতের স্বামী বিবেকানন্দের
প্রিয় গানের মধ্যে ছিল ‘দুই হৃদয়ের যদি’— যা তাঁর সম্পাদনায়
‘সঙ্গীতকল্পতরু’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।
রবি ঠাকুর কলম ধরার পর রবীন্দ্রসৃষ্টি দিয়ে বিয়ের পদ্য সঙ্কলনের
প্রচ্ছদ সাজান�ো শুরু হল। প্রথম পাতায় রবীন্দ্র-কবিতাংশ, ভিতরের
পাতায় নিজেদের লেখা বিয়ের কবিতা। সেই উদাহরণও পাওয়া
যায়। যেমন শ�োভাবাজার রাজবাড়ির অমল কৃষ্ণ দেবের বিয়ের পদ্য
সঙ্কলনের প্রচ্ছদে কবিগুরুর রচনা:
“নূতন পথের যাত্রী দুটি
ছুটছে যাহার সন্ধানে
য�োগ করে দাও, এক করে দাও,
হলদে সুত�োর বন্ধনে।”
আরও যে বিয়ের উৎসবগুলিতে কবিগুরু তাঁর লেখা উপহার
হিসাবে দিয়েছিলেন, তার মধ্যে আছে বিহারীলাল গুপ্তের কন্যা
স্নেহলতার বিয়ে, দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা নলিনীর বিয়ে,
বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে, লীলাদেবীর বিয়ে, দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের
কন্যা ইন্দিরার বিয়ে, কবি অমিয় চক্রবর্তী (প্রসঙ্গত, বিয়ের
কবিতাটির নাম দিয়েছিলেন ‘পরিণয়মঙ্গল’। শব্দটি এখানেই প্রথম
ব্যবহৃত হয়), লালগ�োলার রাজা য�োগীন্দ্রনারায়ণ রায়ের বিয়ে,
ক�োচবিহারের রাজকন্যা ইলাদেবীর বিয়ে ইত্যাদি।
*
কবির আশীর্বাণী সকলেই চাইত। কাউকে বিমুখ করতেন না
তিনি। এ দিকে ফরমায়েশি লেখা লিখতেও মন চাইত না। সে কথা
জানিয়েছিলেন চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের মেয়ের বিয়ের জন্য কবিতা
পাঠান�োর সময়। এই ধরনের সৃষ্টি সব নিশ্চয়ই ছাপা হয়নি। কে
জানে, হয়ত�ো কিছু বিয়ের পদ্য এখনও লুকিয়ে আছে ক�োনও
পারিবারিক অ্যালবামের গহনে!
এই বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র আর বিয়ের পদ্য ছাপান�ো কাগজের কিন্তু
আইনি মান্যতা আছে। বিয়ের দলিল হিসেবে এদের authenticity
বা প্রামাণ্যতা ম্যারেজ রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট বা কাবিন কিংবা
নিকাহনামার চাইতে কিছুমাত্র কম নয়।
131
রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় আর শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা বিয়ের পদ্য।
শিবরাম আদত পদ্যের শেষে কয়েক লাইন য�োগ করে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশ
করেন ১৯২৪ সালে।
132
তারকবাবুর নাতির নামে,
‘আজকে ত�োমার বইবে তুফান বুকে
মুখেতে আর বলব�ো আমি কত
দুই জনেতে থাক পরম সুখে
একটি বোঁটায় দুটি ফুলের মত�ো।’
*
কবি অক্ষয় কুমার বড়াল, সুরেশচন্দ্র সমাজপতির বিয়েতে
লিখলেন— “ত�োমরা কে হে/ লভিছ অমর সুখ এই মর দেহে/
নয়নে নয়নে হয়/ কিবা প্রাণ বিনিময়/ কি মধুর লীলা-ছল সাধের
সন্দেহে।’’
রবীন্দ্রনাথ, ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথের কন্যা জয়শ্রীর বিবাহে
লেখেন আরেকটি ‘পরিণয় মঙ্গল’ কাব্য:
“ত�োমাদের বিয়ে হল ফাগুনের চ�ৌঠা,/ অক্ষয় হয়ে থাক
সিঁদুরের ক�ৌটা/ সাত চড়ে তবু যেন কথা মুখে না ফ�োটে/ নাসিকার
ডগা ছেড়ে ঘ�োমটাও না ওঠে,/ শাশুড়ী না বলে যেন কি বেহায়া
ব�ৌটা।’’
*
কবি সুনির্মল বসু কবি রমেশ দাসের বিবাহে: “...হঠাৎ পেলাম
চিঠির খাম/ উপরে তার আমার নাম/ খুলেই দেখি- হুর্ রে – বাহবা/
হ�োহ�ো হুর্ রে- বাহবা।/ বন্ধু কবি রমেশ দাস,/ পরছে গলায় বিয়ের
ফাঁস,/এই ব�োশেখেই— আল্লা হ�ো ত�োবা।’’
*
কল্যাণী দত্তর “থ�োড় বড়ি খাড়া” থেকে পেলাম:
“ধীরুভাই ডাক্তার
মরে গেছে মুখ তার
ঘাটে ঘাটে জলে জলে খুঁজিয়া
হও এবে শান্ত
খাও দুটি পান্ত
সুধামুখী বউ লও বুঝিয়া।”
লেখিকা জানাচ্ছেন, উল্লিখিত বর ছিলেন জাহাজের ডাক্তার।
সেই জাহাজ রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর, হংকং, সাংহাই ঘুরে বেড়াত। তা,
তিনি যখন অনেক বয়েসে বিয়ে করলেন, তাঁর ব�ৌদির নামে এই
133
নতুন রকম পদ্য ছাপান�ো হয়।
বুঝুন কান্ড !
বিয়ের পদ্যের প্রকৃত স্বরূপটি ধরা পড়ে, যদি তা লেখেন ঠাকুমা,
দিদিমা, ব�ৌদিদিরা। কাব্যরসকে ছাপিয়ে যায় আবেগ। যেমন, কনের
ঠাকুমা লিখছেন— “জীবন সাগরে ঝড় ওঠে যদি/ নাবিক পেয়�োনা
ভয়/ ঠাকুমার কথা স্মরণীয় তথা/ সংশয় কর জয়।’’ কনের মা
লিখছেন— “মা, তুই ম�োর হৃদয়ের ধন/ চিরদিন তাই ত�োরে করেছি
যতন।/ শিবপূজা করেছিলে/ মন�োমত শিব পেলে/ সেবিও, পূজিও
তারে অমূল্য রতন।’’
“শুনছি নাকি ও ঠাকুরপ�ো আজকে ত�োমার বি.এ./ ব�ৌ আনতে
যাচ্ছ তুমি ফ্রেন্ড ষ্টাফ নিয়ে...’’— এ পদ্যের সম্বোধন আর লঘু
রসিকতার সুরটাই বলে দেয়, লেখিকা জনৈকা ব�ৌদিদি। আবার
বরের বন্ধু লেখেন, “দেখে শুনে সামলে চলিস/ কিসের এত তাড়া?/
ও বুঝেছি মনের ভিতর/ কে দিয়েছে সাড়া।’’
পিতার দ্বিতীয় বিয়ে উপলক্ষে পুত্র লেখে: ‘‘আজি বৈশাখে দ�োলে
শাখে শাখে/ দ�োলনচাঁপার ফুল/ তারি সাথে সাথে ফ�োটে আজি বাবা/
ত�োমার বিয়ের ফুল।/ এ শুভ লগনে মায়েরে হারায়ে লাগিতেছে সব
ফাঁকা/ ক�োথা তুমি বাবা ক�োথা নতুন-মা রাখিব দুঃখ ঢাকা।’’
***
কিছুটা ম�োটা দাগের মজা ছিল নাপিতবচনে। বিয়েবাড়িতে
‘নরসুন্দর’ ছিল অপরিহার্য। মালাবদলের আগে কিংবা পরে ওরা
ছড়া কাটত, যা এখন প্রায় অবলুপ্ত।
একটা শুনুন:-
“উমা বসেন মহাদেবের ক�োলে
আর ভমর বসে ফুলে
এখন দুই গতরের মিল হল
সবাই হরি হরি হরি বল�ো।’’
এই গতর কথাটা আসলে ছিল গ�োত্র। শব্দটা সামান্য পাল্টে
খেলিয়ে উচ্চারণ করাটায় থাকত�ো এক নিষ্পাপ দুষ্টুমি।
বিয়ের কবিতা অনেক হল, এবার একটি দারুণ তত্ত্বের কবিতা
শুনুন।
134
“এক ঝুড়ি ফুল, গ�োলাপ বকুল
রজনীগন্ধা ডালি,
শয্যা উপরে সজ্জিত করে
রেখে যাবে বনমালী।
পাঠিয়েছি তাই পুষ্প-মিঠাই,
নতুন বস্ত্র সাথে।
উপহারমালা দিয়ে ভরা ডালা
বধূবরণের রাতে।
নতুন জামাই পরবেন, তাই
প্যান্ট-শার্ট খানকয়
জুত�ো, প্রসাধন, ক�োমর-বাঁধন,
খুব বেশি কিছু নয়।
কন্যার শাড়ি আছে রকমারি
বড়জ�োর পাঁচখানা।
সাথে আছে ভরা হরেক পসরা,
সাজার দ্রব্য নানা।
প্রণামীর তরে দুটি ডালা ভরে
আছে কিছু উপহার,
শ্রদ্ধা এবং ভাল�োবাসা ম�োড়া
বড় ছ�োট সবাকার।
আর আছে কিছু ন�োনতা মিষ্টি
চক�োলেট, মুখরুচি,
শুধু এইটুক, সঙ্গে থাকুক
এই তত্ত্বের সূচী।
কিছু ফল আর সবজি, আহার
সামান্য, অল্পই।
এটুকু গ্রহণে, সকলের মনে
যেন আপনার হই।’’
**
উপহারে পাওয়া বইয়ের প্রথম পাতায় ও লেখা হত স্বরচিত
কবিতা। সাহিত্যমান যথেষ্টই ভাল।
আমার পিশিমার বিয়ের উপহার পাওয়া ক�োন বইয়ের মার্জিনে
দেখেছিলাম-
135
সিনেমা, থিয়েটার ও প্রহসনের ধাঁচের পদ্য
136
অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার বইয়ের দুর্দান্ত কাটতি। এই সময় বাজারে এল
তার আরেকখানি উপন্যাস, ‘চাঁদমুখ’। সেটারও বিক্রি ভাল, কিন্তু
পাঠ প্রতিক্রিয়া ম�োটেও ভাল নয়। একেবারেই খাজা উপন্যাস
নামিয়েছেন লেখক। সেই আগের ঝাঁজ ক�োথায়?
শরৎবাবুর প্রকাশক বাজারচলতি বই নেড়েচেড়ে দেখলেন আরে!
এ অন্য শরৎচন্দ্র! ইনিও চট্টোপাধ্যায়। গল্পলহরী মাসিক পত্রিকার
সম্পাদক। পত্রিকা ভাল চলেনা কিন্তু নামটা পুঁজি করে নেমে
পড়েছেন উপন্যাস রচনায়!
প্রকাশক হরিদাস চ্যাটার্জি হন্তদন্ত হয়ে লেখককে জানালেন সব
কথা। এর বিহিত না করলে ত�ো ব্যবসা লাটে উঠবে তার! শরৎচন্দ্র
ম�োটেও পাত্তা দিলেন না। তাঁর ধারণা পাঠক ঠিক ধরে নেবে আসল
আর নকল। আর ব্যবসা? সে চিন্তার দায় প্রকাশকের।
আম পাঠকের দ�ৌড় শরৎবাবু আন্দাজ না করলেও প্রকাশক
ভালই জানেন। লেখার গুণে নয় মাল আর্ধেক নামের গুনে কাটে।
তদ্দিনে ‘হীরক দুল’ ও ‘শুভ লগ্ন’ নামে দুখানা আর�ো উপন্যাস
বাজারে বেরিয়ে গেল সেই শরৎচন্দ্রের। ল�োকে বলতে লাগল
শরৎবাবুর লেখা গেঁজে গেছে। আর পড়া যায়না!
এবার টনক নড়ল। উপায় কি? তাঁর নামে ত�ো আর নাম
ভাঁড়ান�োর মামলা করা যায় না। সেও যে শরৎচন্দ্র!
বাতায়ন পত্রিকার সম্পাদক অবিনাশ ঘ�োষাল অনেক পরামর্শ
দিলেন লেখককে, ক�োন�োটাই জমলনা। উলটে তিনি অবিনাশকে
বলেন যে এই নতুন ল�োককে গিয়ে ব�োঝাতে যে চরিত্রহীন বইটি
প্রকাশের পরে অনেকে শরৎচন্দ্রকে সাহিত্যে অশ্লীলতার দায়ে যা
তা বলছে। ছেলে ছ�োকরারা ঠ্যাঙান�োর জন্য লেখককে খুঁজছে, সেই
ভয়ে যদি...
অবিনাশ বুঝলেন লেখক একেবারেই সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না,
মরিয়া হয়ে বললেন স্বয়ং শরৎচন্দ্র গিয়ে নিজে যদি রিক�োয়েস্ট
করেন নাম পাল্টাতে তবে কাজ হবে। কিন্তু লেখক অনড়। তার
মতে এসব তাকে জব্দ করার জন্যেই করছে নতুন শরৎ। কারণ
তিনি গল্পলহরীতে লেখা দেননি!
কাগজে বিবৃতি দিলেও বিপদ, বিনা খরচায় নকলের পাবলিসিটি
হবে, ওর বইয়ের বিক্রি যাবে বেড়ে। অবিনাশের প্রস্তাব ওই শরৎকে
নামের আগে ‘চাঁদমুখ’ শব্দটি বসাতে অনুর�োধ করা, কারণ ওটিই
137
বিয়ের পদ্যের ব্যাপারে বাঙ্গালিরা যেন ‘‘উঁচা নিচা ছ�োট বড় সমান’’! এক দুঁদে
মুখ্যসচিব কন্যার বিবাহ প্রীতি উপহার।
গ�োধূলি লগ্নের বিয়ের মন্ত্র ইত্যাদি এতক্ষণে প্রায় শেষের দিকে।
বাসর ঘরের অনুষ্ঠানও একেবারে ক্লাইম্যাক্স ছুঁয়েছে ।
এরপর, কাল থেকে বুঝি শুরু হবে সংসারের ..
“ নয় নয়, নয় এ মধুর খেলা।’’
144