You are on page 1of 7

মশকী

রচনাঃ অহি ন রা য়

দুটো কাঁপতে থাকা হাতের তালু আর তাদের গোঁড়া থেকে বেড়ে ওঠা বৃষ্টির পর ভিজে থাকা ডালপালা গুলোর
মতো ঘাম-মাখা আঙু লগুলো একটা ফোন কে জাপটে ধরে আছে । লাল রঙের ফোন টার স্ক্রীন –এর উপরের
ডানদিক টার বেশকিছুটা চিঁ র খেয়েছে , আঘাতটার প্রাপ্তি হয়েছে সদ্যই । বুড়োআঙু লদুটো বেশ কয়েকবার ভু ল
করার পর অবশেষে ফোন টার লক টা খুলতে সক্ষম হল । ভীত আঙু লগুলো মন্থর গতিতে ফোনের
CONTACTS –এর সারির মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নিয়ে তাতে কল মেলালো ।

উল্টোদিকে ফোনটা বেজে উঠলো - ‘ জিন্দগি ক্যায়সি পেহেলি হায় ‘ , কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোনটা রিসিভ
করলো একজন ।

কল কারী ভয়ে কাঁপতে থাকা স্বরে বললঃ “ রাজু ! রাজু তু ই কোথায়ে ? আমাকে ! আমাকে বাঁচা ! এই বুড়িটা
! এই বুড়িটা ! “

উল্টোদিকের জন অবাক স্বরে উত্তর দিলোঃ “ কে রাজু ? সরি রং নাম্বার । “

কল কারী বেশ খানিকটা বিরক্ত হয়ে বার কয়েক ভু ল করার পর ডায়ালড্‌ নাম্বার টার পুরোটা বলে শোনানোয়
উত্তরকারী নম্র ভাবে তাকে বুঝিয়ে বললঃ “ না , আসলে আপনি যে নাম্বার টা বললেন সেটা আমার না । তাহলে
মনে হয় ক্রস কানেকশান হয়েছে । আমার নাম সজীব ।”

সজীব কল টার ওপারে একজন বৃদ্ধার করুণ কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো ।

বৃদ্ধা টি অত্যন্ত করুণ ভাবে বলছেঃ “ দে না বাবা যা চাইছি ! “

এরপর সজীব সেই কল কারী ব্যক্তির চিৎকার শোনার পরক্ষনেই কল টা ডিসকানেক্টেড হয়ে গেল ।

সজীব ফোনটা কান থেকে নামিয়ে পাওয়ার বাটান টা বার কয়েক প্রেস করে বুঝলো যে ফোনটার ব্যাটারি ডেড হয়ে
গেছে ।

ফোনটা প্যান্টের ডান পকেটে রেখে হাঁটা টা আগের মতোই জারি রাখলো সে । সঙ্গে মনে মনে ভাবতে লাগলো
সেই উদ্ভট কল কারীর ব্যাপারটা । তার অনুমানঃ বৃদ্ধা মা কিছু চেয়েছে এবং তাতেই ছেলের রাগ
আর চিৎকার । সামাজিক বিতৃ ষ্ণার একটা দ্রুত নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল তার গোফ ছুঁ য়ে ।

আজ অফিস থেকে কাজ শেষ করে বেরোতে একটু বেশি ই দেরি হয়ে গেছে তার , তাই আর রিটার্ন –এর ক্যাব
পায়নি সে । তার ওপরে আবার ফোনের ব্যাটারি ডেড হয়ে যাওয়াতে এখন আর ক্যাব বুক ও করা যাবে না ।
মনে ভাবলোঃ ধুর ! আজ প্রোজেক্ট –এর লাস্ট মিটিং টা যে করে হোক কাটিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো ,
তাহলে অন্তত এখন আর এক -ঘণ্টা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হতো না ।

রোজ সে ইয়ারফোনে গান শুনতে শুনতে ক্যাবে বাড়ি ফেরে , তাই এই রাস্তাটা যে এরকম সময়ে এতটা জনশূন্য
আর নিস্তব্ধ থাকে , তা সে আগে কক্ষনো খেয়ালই করে নি । সে যাই হোক , আজ তাকে এই ঝিঁঝিঁপোকার
সিম্ফনি শুনতে শুনতেই বাড়ি যেতে হবে ।
রাস্তার দুদিকে ঝোপের দীর্ঘ সারি আর তাকে স্যান্ডু ইচের মতো ঘিরে রয়েছে ঈষৎ ঘন জঙ্গল । হিংস্র জন্তু-
জানোয়ারের ভয়ের কারণ নেই যেহেতু এলাকাটা কলকারখানা দিয়ে ঘেরা । হ্যাঁ , তবে চু রি- ছিনতাই ভয় একটু
হলেও আছে কারণ এত রাতে কারখানাও বন্ধ । - এই সমস্ত আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতেই হেঁটে চললো সজীব

কিছুটা দূরে রাস্তার ধাঁরে একজোড়া আলো দেখতে পেলো সে , আরও বেশ কয়েক পা হাঁটার পর সেই আলো
জোড়া একটা বাসস্ট্যান্ড -এ রূপান্তরিত হল । লোকও কয়েকজন আছে মনে হল তার , যদি সুযোগ হয় তাহলে
কারোর ফোন থেকে ভাইকে কল করে তাকে নিতে আসার কথা বলবে এই ভাবলো সে ।

সামনে গিয়ে সে দেখে একটা মাতাল গোছের লোক মুখে জামা চাপা দিয়ে স্ট্যান্ড –এর সীটে বেজায় ঘুম দিচ্ছে ,
তাই তাকে আর ডাকা ঠিক বুঝলো না সজীব ।

আর তার পাশেই একটা বুড়ি মাথা নিচু করে মাটিতে বসে একটা মিষ্টি সুর গুনগুন করতে করতে একটা কু কু রকে
আদর করছে , আর কু কু রটাও বেশ আরামে টানটান হয়ে ঘুম দিচ্ছে আদর পেয়ে । বুড়ির পোশাক-আশাক দেখে
আর তার কাছে ফোন চাইলো না সজীব । বুড়ি বোধ হয় ভিক্ষা করে , ময়লা -জমা কাপড় আর মাথার প্রায়
গোটা শরীর টাকে ঢেকে ফেলার ক্ষমতা রাখা ঊশকো-খূশকো রোদে পুড়ে লালচে হওয়া চু ল দেখেই এই অনুমান
সজীবের । তাই সে আর দাঁড়ালো না , আগের মতোই এগিয়ে চললো ।

স্ট্যান্ড টা পেরিয়ে দু-পা যেতে না যেতেই সজীবের কানে ভেসে এলো বুড়ির জিজ্ঞাসাঃ “ বাবা , পরের গাড়ী
কখন আসবে ? “

প্রশ্নটা মনে হয় তারই উদ্দেশ্যে এই ভেবেই সজীব পেছনে ফিরলো । বুড়ি এখনও আগের মতোই মাথা নিচু করে
আদর বিতরণ করে চলেছে আর তার সঙ্গেই গুনগুন করে চলেছে সেই মিষ্টি সুর টা ।

সজীব প্রশ্নটাকে নিজের পকেটে পুরে ভদ্রতার খাতিরে বুড়ির কাছে এসে দাড়িয়ে বললোঃ “ জানি না তো
ঠাকু মা , আসলে আমি এই রাস্তাটায় সচরাচর আসি না “ ।

ক্যাবে যাতায়াত করে বলার পর যদি বুড়ির পরের প্রশ্নটা হয় যে - ‘ ক্যাব আবার কী ? ‘ - তাই এই রাস্তায় না
আসার উত্তর ।

বুড়ি কু কু রটাকে আদর করতে করতে সজীবকে জিজ্ঞাসা করলোঃ “ একটা কাজ করবি বাবা ? “

সজীবের কিছু বলার আগেই বুড়ি খুব করুণ স্বরে বললোঃ “ কিছু খাবার দিবি বাবা ? না রে , একা খাবো না
, একেও দেবো “ ।

একে বলতে যে বুড়ি কু কু র টাকে বোঝাচ্ছে সেটা বুঝতে পারলো সজীব । কু কু র তারও খুব পছন্দের একটা প্রাণী

কিন্তু সজীবের কাছে তো এই মুহূর্তে কোনো খাবার নেই , আর আশেপাশেও কোনো দোকান পাবে বলে তার মনে
হচ্ছে না । তাই সে বুড়ি কে উত্তর দিলোঃ “ কী দেবো ঠাকু মা ? আমার কাছে তো এখন কোনো খাবারই নেই ,
আর সামনেও কোনো দোকান দেখছি না “ ।

অসহায় বুড়িটাকে সাহায্য করার খুব ঈচ্ছে ছিল সজীবের ।

বুড়ি আবার আগের মতোই করুণ স্বরে বললোঃ “ দে না বাবা কিছু থাকলে , খুব খিদে পেয়েছে রে “ ।

“ সত্যিই কিছু খাবার নেই ঠাকু মা আমার কাছে , আর থাকলে তোমায় দেবো না ই বা কেন !” -অসহায়ের মতো
উত্তরটা দিল সজীব ।
“ তোমার বাড়ি কোথায় ঠাকু মা ? “ - কু কু র টার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে সজীব ।

“ আমার আবার বাড়ি ! “ - হেঁসে উত্তর দেয় বুড়িটা ।

বুড়ি আর কিছু বললো না । সজীব খেয়াল করলো বুড়ির নিচু করা মাথাটা থেকে কাপড়ের এলোমেলো কয়েকটা
টু করো ঝু লছে , আর সেই টু করো গুলোর লাগোয়া চামড়া টা পোড়া । পোড়া মুখটা ঢাকার জন্যেই মুখে এরকম
কাপড় জড়ানো ।

বুড়িটার ওপর খুব মায়া হলো সজীবের ।

কু কু রটাকে আদর করার কাজে বুড়ির অংশীদার হওয়ার জন্য সে কিছুটা ঝুঁকে শুয়ে থাকা কু কু রটার মাথায় হাত
বোলাতেই সজীব আঁতকে উঠলো । হাত দিয়ে বেশ কয়েকবার ঝাঁকু নি দেওয়ার পর সে নিশ্চিত হলো যে শুয়ে থাকা
প্রাণীটার দেহে প্রাণ নেই ।

এতক্ষণে বুড়ি তার দিকে মুখ তু লে তাকিয়েছে । বুড়ির মুখ থেকে কাপড়ের বাঁধনটা আল্গা‌ হওয়াতে বুড়ির মুখটা দেখে
সজীব ভয়ে পিছনে ছিটকে গেল । মুখের পুড়ে যাওয়াটা ভয়ের বিষয় নয় , বুড়ির যে চোখের কোটর দুটোয় চোখ
বলে কিছুই নেই । কোটরের ভেতরটা মিশমিশে কালো , কোটর দুটো বেয়ে টকটকে লাল রক্ত চু য়ে চু য়ে পড়ছে ।
কোটর দুটোর ভেতরে কী যেন কিলবিল করছে ।

সজীব ভয়ে কাঁপতে থাকে , তার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না , এতোটা ভয় বোধ হয় জীবনে সে আগে
কক্ষনো পায় নি । ভয়ে সে সীটে শুয়ে থাকা মাতাল টাকে ডাকার চেষ্টা করে , কিন্তু কোনো শব্দ সে উচ্চারণ করতে
পারে না । সজীব নিজের কাঁপতে থাকা শরীরটা নিয়ে হামাগুরি দিয়ে সীটের সামনে পৌঁছে মাতাল টার গা-এ হাত
দিয়ে ঠেলা দিতেই শুয়ে থাকা নিথর দেহটা বালিশের মতো গড়িয়ে নিচে পড়ে যায় । লোকটার শরীরটা রক্তশূন্য ও
ফ্যাকাশে আর ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে আছে তার রক্তশূন্য হলদে কাঠের মতো চোখগুলো । নিজের মৃত্যুর ভয়ের
একটা প্রতিরুপ সজীব দেখতে পেল লোকটার চোখে মুখে ।

বুড়ি খিলখিলয়ে হেঁসে উঠলো , বড় নিষ্ঠু র ও ভয়ঙ্কর সেই হাঁসি । হাতদুটোকে উপরে তু লে মাথাটাকে দুদিকে
ঝাঁকিয়ে বুড়ি দম দেওয়া পুতু লের মতো হাততালি দিয়ে চললো ।

হাঁসতে হাঁসতে বুড়ি বললোঃ “ দে না বাবা একটু রক্ত , খুব খিদে পেয়েছে । তু ই যে বললি তোর কাছে
খাবার নেই , আছে তো ! ওই যে হাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে পরছে , সারা শরীরে ছুটে বেরাচ্ছে । মিথ্যে কথা
বললি তো ঠাকু মা টাকে ! “

সজীব ভয়ে চিৎকার করতে করতে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে কারো উপস্থিতির আশায় । সে নিজের জায়গা
থেকে উঠতে পারছে না , সে যেন নিজের শরীরেরই মালিকানা হারিয়ে ফেলেছে । বুকে ভর দিয়ে নিজের শরীর
টাকে রাস্তায়ে ঘসতে ঘসতে সে বুড়ির থেকে দূরে যাওয়ার বিফল চেষ্টা করতে থাকে ।

বুড়ি এবার তার মাথার সামনের ঝু লে থাকা চু লগুলোকে সরায় । সজীব দেখে বুড়ির পায়ের নখগুলো আর চু লের
কয়েকশো ঝাঁক কু কু র টার সারা শরীরে গেঁথে রয়েছে এবং সেগুলো বয়ে উপরে উঠছে লালচে স্রোত ।

বুড়ির মাথার ঝাঁকড়া চু লগুলো এবার কেঁ চোর মতো বুকে হেঁটে এসে সজীবের সারাগায়ে ফু টতে থাকে , বুড়ির
চোখের কোটর দুটো থেকে বেরিয়ে আসে কালো নিরেট দুটো মশার ঝাঁক আর ঘিরে ফেলে সজীবের গোটা
শরীরটাকে । কয়েকশো বিষাক্ত ছুঁ চ ফু টতে থাকে তার গোটা শরীর টাতে আর তার সাথেই চলতে থাকে ভয়ার্ত
জন্ত্রনাকাতর চিৎকার ।

“ ভালো থাকিস রে বাবা , ভালো থাকিস , অসহায় বুড়িটার খিদে মেটাচ্ছিস , সে তোর ভালো করবেই “ - পোড়া
মুখটা রাতের কালো আকাশের দিকে তু লে হাঁসতে থাকে বুড়িটা ।
এবার বুড়ি কু কু র টাকে ছেড়ে সজীবের পায়ের কাছে এসে বসেছে , তার পায়ের ধারালো ও বিষাক্ত নখগুলোকে
গেঁথে দেয় বুকে এবং পেটে । নখ এবং চু লগুলো বেয়ে উপরে উঠতে থাকে সেই তরল যা কয়েক মুহূর্ত আগে
পর্যন্তও প্রবাহিত হচ্ছিলো সজীবের শিরা-ধমনীতে ।বুড়ি গুনগুন করে চলেছে আগের সেই মিষ্টি সুরটা আর তারই
মাঝে বারবার থেমে সেই বিকট হাঁসিটা হাসছে ।

কিছুক্ষন পর আবার আগের সেই নিস্তব্ধতা । একজন মাঝবয়সী লোক বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো । স্ট্যান্ডের সীটে
দুজন মুখ চাপা দিয়ে ঘুমাচ্ছে । একটা করুণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো স্ট্যান্ডের একটা কোনা থেকে একটা জিজ্ঞাসার
ফাঁদ সঙ্গে নিয়েঃ “ বাবা , পরের গাড়ি কখন আসবে ? “

বাহ ! গল্পটা বেশ ভালোই লাগলো রাজর্ষির , নামটাই বেশ অন্যরকম , দেখেই পড়ার ইচ্ছে হয়েছিল তার । গল্পটার
নাম - ‘ ভূ তু ড়ে নিয়ার ফু তু রে ‘ , এখানে ‘ ফিউচার ‘ শব্দটাকে যে ‘ ফু তু রে’ লেখা হয়েছে - এই ওয়ার্ড -প্লে টা বেশ
ইউনিক লাগে রাজর্ষির । তার উপরে , ওর ডাকনামও যে রাজু , এই ব্যাপার টাও তার কৌতূ হলের কারণ হয়ে
ওঠে গল্পটার প্রথমের কয়েকটা লাইন পড়ামাত্রই । গল্পটার কভার ফোটোটাও বেশ ইউনিক - স্ক্রিনে চিঁ র ধরা একটা
লালরঙের ফোন আর সেই চিঁ র বেয়ে লাল রক্ত পড়ছে ।

গল্পটা পড়ে রাজর্ষির ক্লাস সিক্সে পড়া একটা তথ্য মনে পড়ে গেল - শুধুমাত্র মশকী অর্থাৎ স্ত্রী মশারাই কামড়ায় ,
কারণ টা সে কিছুতেই মনে করতে পারলো না ।

ফেসবুকের এই পেজটাকে ফলো করে রাজর্ষি , প্রায়শই এই পেজে এরকম বেশ ভালো ভালো গল্প আপলোড করা
হয় । কিন্তু এই গল্পটা একটু আলাদা , কারণ এই গল্পটাতে লেখকের নামের জায়গাটা ফাঁকা রাখা হয়েছে । যে
অ্যাকাউন্টটা থেকে গল্পটা আপলোড করা হয়েছে সেটাও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ওপেন হচ্ছে না ।‌

জানালার বাইরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজের অহেতু ক কৌতূ হল টাকে কমিয়ে নিল রাজর্ষি ।

আজ প্রায় সাত – আট বছর পর রাজর্ষি তাদের গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে , সঙ্গে তার কলেজের বন্ধু প্রবাল ও আসছে
গ্রামের পরিবেশে কয়েকটা দিন কাটাবে বলে । প্রবালের বাড়ি থেকে গ্রাম টা তু লনামুলকভাবে কাছে হওয়াতে সে
একাই পৌঁছে যেতে পারবে বলে জানিয়েছে রাজর্ষিকে , এতক্ষনে বোধ হয় সে পৌঁছেও গেছে ।

প্রবাল আপাতত এখন কোথায় জানার জন্য তাকে কল করে রাজর্ষি , কানে আসে প্রবালের কলার টিউন - ‘
উসকো ছুপা কর ম্যা সবসে কভি লে চলু কহিঁ দূর , আখোকে পেয়ালো সে পিতা রহু উসকে চ্যাহেরে কা নুর ‘ ,
লাইফ ইন এ মেট্রো ।

রাজর্ষির খেয়াল ফেরে যে সে আপাতত ট্রেনে , মেট্রো তে নয় । প্রবাল ফোনটা রিসিভ করলে রাজর্ষি ইয়ার্কি করে
বললোঃ “ কিরে , তাহলে আর আসছিস না তো ? সে একদিকে সুবিধাই হল , টাকা – করিও আমি সঙ্গে তেমন
কিছু আনি নি “।

“ সত্যিই আসতাম না রে , কিন্তু তু ই পরে আবার রাগ করবি তাই বাধ্য হয়েই আসতে হচ্ছে “ - হেঁসে উত্তর দেয়
প্রবাল ।

“ বাই দা ওয়েহ্‌, কোথায় এখন ? “ - হেঁসে আবার প্রশ্ন করে রাজর্ষি ।

“ এই পাঁচ – সাত মিনিট হল নামলাম তোদের পূর্বনগর ষ্টেশনে , মানুষ থাকে তো এখানে ? কোথাও তো লোক
দেখছি না , ষ্টেশনটা তো পুরো ফাঁকা “ - উত্তর দেয় প্রবাল ।

রাজর্ষি মজা করে বললোঃ “ তু ই ষ্টেশনে আর দাঁড়াশ না , আসার আগে বাবা বলেছে আজকাল নাকি চু রি –
ছিনতাই খুব হচ্ছে , সামনে কোনো চা –এর গুমটি পেয়ে যাবি , ওখানে গিয়ে দাঁড়া “ ।
প্রবালের হাঁসি শুনে রাজর্ষি আবার বললোঃ “ তু ই কিছু টু কটাক টিফিন কর , আমি দশ – পনেরো মিনিটের মধ্যে
পৌঁছে যাবো “ ।

এই বলে রাজর্ষি ফোনটা রাখল । প্রথমে ফোনের গল্পটায় আর তারপর বন্ধু র সাথে গল্পে সে এতটাই হারিয়ে
গিয়েছিল যে সে খেয়ালই করেনি যে ট্রেনের এই নীল – সবুজ বগিটায় এখন তাকে নিয়ে মাত্র দুইজন ই রয়ে গেছে ।
কয়েকটি সীট পরেই তার দিকে মুখ করে বসে আছে একটি মেয়ে । মেয়েটির বয়স রাজর্ষির চেয়ে বছর কয়েক কম
হবে , পোশাক দেখে অনুমান করা যায় যে শহুরে , আর হ্যাঁ , অত্যন্ত সুন্দরী ।

মেয়েটি একদৃষ্টে জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়েছে । রাজর্ষি মেয়েটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে বুঝতে পেরে
মেয়েটি রাজর্ষির দিকে বিরক্তি ভরা দৃষ্টিতে যেই তাকিয়েছে , রাজর্ষি ওমনিই অপ্রস্তুত হয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি
ঘুরিয়ে নেয় ।

প্রায় চলেই এসেছে , আর মিনিট দশেক । এদিকটা এখনও উন্নয়নের ফাঁদে পরে নি , তাই বাতাসে এখনও শান্তি
মিশে আছে । বাইরেটা পুরো নীলচে – কালো অন্ধকারে ডু বে আছে আর তারই মধ্যে মাঝে মাঝে অতিক্রান্ত হওয়া
শহুরে আলোগুলোকে জোনাকির মতো মনে হচ্ছে । আকাশের একা ফর্সা চাঁদটা মনে হচ্ছে রাজর্ষিকে নিজের সঙ্গী
মনে করেছে , তারই সাথে সাথে দ্রুতপায়ে হেঁটে চলেছে আকাশপথে । সন্ধ্যের আঁধারে বুকে ভর দিয়ে দ্রুতবেগে
সাপের মতো চলেছে ট্রেনটা ।

একটা পোড়ো মন্দির রাজর্ষির চোখে পড়লো । হ্যাঁ , এই মন্দির টাতেই ছোটোবেলা বার কয়েক এসেছে সে । ঠিক
যেন একইরকম রয়ে গেছে মন্দির টা , কারোর মেরামতের খেয়ালের ছায়া পর্যন্ত পড়েনি । এই মন্দিরের পর আর
মাত্র মিনিট দুই – তিন , তারপরেই রাজর্ষির গন্তব্যের ষ্টেশন – পূর্বনগর ।

রাজর্ষি সীট থেকে উঠে বাঙ্ক থেকে ব্যাগটা নামিয়ে পিঠে নিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় । রাজর্ষিকে দেখে
মেয়েটিও সীট ছেড়ে উঠে পড়ে । অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই বাঙ্কে হাত না পেয়ে অবশেষে মেয়েটি রাজর্ষিকে
বলেঃ “ এক্সকিউজ্‌ মি , শুনছেন ! আসলে আমি ব্যাগটা নামাতে পারছি না , একটু নামিয়ে দেবেন প্লিজ্‌ “ ।

রাজর্ষি মেয়েটিকে বৃথা চেষ্টা করতে দেখেছিল , সে এমনিতেও নিজে থেকেই হেল্প করার কথাটা বলতে যাচ্ছিলো ,
কিন্তু মেয়েটি নিজে থেকে বলতে সে খুশিই হল ।

নিজের ব্যাগটা একটি সীটের ওপর রেখে রাজর্ষি যেই বাঙ্ক থেকে মেয়েটার ব্যাগটা নামাবে বলে হাতদুটোকে সোজা
করেছে ওমনি রাজর্ষির কোমরে হ্যাঁচকা টান লাগে , আর মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে চিন্তার সূরে জিজ্ঞাসা করেঃ “ দাদু
তোমার লাগলো ? “

রাজর্ষি পিছন দিকে ফিরে অবাক ভাবে মেয়েটার দিকে তাকায় । মেয়েটা আবারও রাজর্ষিকে সেই একই কথা
জিজ্ঞাসা করেঃ “ দাদু তোমার লাগলো ? ছাড়ো আমি নিজেই আবার চেষ্টা করে দেখি “ ।

রাজর্ষির মনে হয় তার কোমরে টান ধরেছে দেখে মেয়েটি হয়তো তার সাথে মজা করছে , তাই সে আবার বাঙ্ক
থেকে ব্যাগটা নামানোর জন্য হাতদুটো ঊচূ করতে গিয়ে দেখে সে তার নিজের ডানহাতে ধরে আছে একটি যষ্টি ।
রাজর্ষি আচমকা নিজের হাতে এই যষ্টিটা দেখে ঘাবড়ে যায় এবং সেটাকে হাত থেকে ফেলে দেয় ।

রাজর্ষি দেখে তার হাত দুটোর চামড়া বয়স্কদের মতো কুঁ চকে যাচ্ছে , তার দুহাতের কালচে লোমগুলো ক্রমশ
নিজেদের রঙ হারিয়ে সাদার দিকে এগোচ্ছে । ট্রেনের জানালার কাঁচের প্রতিফলনে সে দেখে তার মুখের চামড়াও
এতক্ষনে বয়স্কদের মতো কুঁ চকে গেছে এবং তার শরীরটাও ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে ।

এই অবাস্তব দৃশ্যটি দেখে সে কয়েক পা জানালা থেকে পিছিয়ে যায় । রাজর্ষির মনের ভিতরে ভীতি এবং যুক্তির
এক তু মুল দড়ি টানাটানি চলছে । তারপর যুক্তির পাল্লা একটু ভারী হতেই জানালার দিকে এগিয়ে কাঁচের
প্রতিফলনে আবার নিজের আসল চেহারা দেখতে পেয়ে সে স্বস্তি ফিরে পায় ।
ঠিক এই মুহূর্তে সে শুনতে পায় এক বৃদ্ধার খিলখিল হাঁসি । পেছনে ফিরে রাজর্ষি দেখে চোখের কাছটা কাপড়ের
টু করো বাঁধা গল্পের সেই বুড়ি তার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে আর বলছেঃ “ দে বাবা , আমায় একটু
রক্ত দে , খুব খিদে পেয়েছে রে , দে বাবা “ ।

রাজর্ষি দেখে তার চারিদিকে ট্রেনের বগিটার প্রত্যেকটা সীটে , গোটা মেঝে টা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে
অজস্র রক্তশূন্য ও ফ্যাকাশে মৃতদেহ , পচা গন্ধে ভরে গেছে গোটা বগিটা । রাজর্ষি ভয়ে পিছুপা হতে গিয়ে পড়ে
যায় সেই মৃতদেহের স্তূ পে ।

বুড়ির চু লগুলো সেই ছরিয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা মৃতদেহ গুলোর ফাঁক – ফোঁকর থেকে কেঁ চোর মতো বেরিয়ে এসে
রাজর্ষির হাত – পা পেচিয়ে ফেলে । রাজর্ষি প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজের হাত –পা ছাড়ানোর , কিন্তু তাতে কোনো
লাভ হয় না ।

বুড়ির চোখের ওপরের কাপড় আলগা হয়ে খুলে পড়ে যায় , পুড়ে যাওয়া মুখের চোখের কোটরগুলো থেকে চু য়ে
চুয়ে পড়ছে রক্ত আর কোটরদুটোর ভেতরে কিলবিল করছে অগুন্তি মশার ঝাঁক । সেই মশার ঝাঁক কোটরদুটো
থেকে বেরিয়ে ঘিরে ফেলে রাজর্ষির গোটা শরীরটাকে । অসহ্য যন্ত্রণায় রাজর্ষি গোঙাতে থাকে , তার সারা শরীরটা
থেকে ফিনকি দিয়ে বেরোতে রক্ত , মশার ডানা ঝাপটানোর শব্দে তার জ্ঞান হারানোর পরিস্থিতি ।

“ কে বলে এখন আর ভালো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না ! এরা সবাই আমার খিদে মিটিয়েছে নিঃস্বার্থভাবে , তোরা
বড্ড ভালো রে বাবা “ - বিকট একটা হাঁসি হেঁসে চেঁ চিয়ে কথাগুলো বলে বুড়িটা । তার মাথার চু লগুলো একইসাথে
অনেকগুলো শরীর থেকে রক্ত শুষে নিচ্ছে । চুলগুলোর ওপর ভর দিয়ে বুড়ির ময়লামাখা দেহটা মাটি ছেড়ে শূন্যে
ভেসে ওঠে , ধীরে ধীরে এগোতে তা থাকে রাজর্ষির দিকে ।

কোনোরকমে রাজর্ষি নিজের ডানহাতটা বুড়ির চু লের ফাঁস থেকে মুক্ত করে সেই ডানহাতের তালু দিয়ে কপালে বসে
থাকা মশাগুলোর ওপর চাপড় দিতে সঙ্গে সঙ্গেই তার ঘুমটা ভেঙে যায় ।

রাজর্ষির ডানহাতের তালুতে লেগে আছে একফোঁটা রক্ত আর কপালের চামড়াতে চেপ্টে আছে একটা মশা । ঘামে
ভিজে গেছে রাজর্ষির গোটা জামাটা , ভয়ে তার গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে । দুঃস্বপ্নের ঘোরটা কাটতে কয়েক
মুহূর্ত সময় লাগে তার । বাঙ্ক থেকে ব্যাগটা নামিয়ে তা থেকে জলের বোতলটা বের করে কয়েক ঢোক জল খায়
সে । বুড়িটা রাজর্ষির রক্ত না শুষে না নিলেও দুঃস্বপ্নটা তার সমস্ত শক্তি যেন নিমেষে গিলে নিয়েছে , বোতলের
ঢাকনাটা খোলাও এখন রাজর্ষির কাছে একটা ক্লান্তিকর কাজ বলে মনে হচ্ছে ।

বাইরে সাইরেন বাজছে , ট্রেনটি দাড়িয়ে আছে সিগনালের জন্য । পাশেই সিগনালের জন্য দাড়িয়ে আছে আরেকটি
ট্রেন যার ভেন্ডারের কামরা টা এসে থেমেছে এই কামরার পাশেই , এই স্বপ্নের সেই পচা গন্ধ টার উৎস । এই
সাইরেনের আওয়াজটাকেই রাজর্ষি স্বপ্নে মশার ডানা ঝাপটানোর অসহ্যকর শব্দ বলে মনে করেছিলো ।

সে কী পুরোটাই স্বপ্ন দেখলো ? গল্পটা পড়া , প্রবালের সাথে ফোনে কথা বলা , পুরোটাই স্বপ্ন ? - ভাবতে থাকে
রাজর্ষি । ফোনটা চেক করে সে দেখে সতেরো মিনিট আগে প্রবালের সাথে কথা হয়েছে তার । তাহলে কথা বলার
পর কোনো এক সময়ে হয়তো তার চোখটা লেগে গিয়েছিল ।

ট্রেনটাও মোটেই ফাঁকা নেই , বগিটায় কম করে হলেও কু ড়ি জন মতো তো হবেই । ট্রেন একটা তীক্ষ্ণ শব্দে
সাইরেন বাজিয়ে আবার চলতে শুরু করলো অপর ট্রেনটিকে পেছনে ফেলে এবং মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই রাজর্ষি
অবশেষে দেখতে পেল সেই পোড়োমন্দিরটাকে। রাজর্ষি বার কয়েক নিজের চোখদুটো কচলে নিল বাস্তবতার প্রমাণ
হিসেবে ।

পিঠে ব্যাগ নিয়ে রাজর্ষি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো , তার সঙ্গে এসে দাঁড়ালো আরও তিনজন পারস্পরিক
অপরিচিতরা । অবশেষে ট্রেন প্রবেশ করলো পূর্বনগর ষ্টেশনে ।
ট্রেনটা নিজের বেগ কমাতেই রাজর্ষি তার বাঁ-পাটা বগিটার থেকে একটু বের করে । তার পায়ের নীচে দ্রুতবেগে সরে
সরে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মের এবড়ো খেবড়ো পাথরগুলো ।

প্ল্যাটফর্মে নামামাত্রই ছোটোবেলার অনেকগুলো ধুলোপড়া স্মৃতি এক এক করে তাদের ওপর জমা ধুলো ঝাড়তে
লাগলো । রাজর্ষি হাসিমুখে ষ্টেশনের গেটের দিকে হাঁটা শুরু করলো । ষ্টেশনটা প্রায় লোকজনহীন , যে ট্রেন যায়
শুধু সেটারই প্যাসেঞ্জার দের দেখা যায় , তার কিছুক্ষন পর আবার কোথাও কেউ নেই ।

কিছুদূর গিয়ে রাজর্ষি দেখতে পেলো কিছু লোকের জমায়েত হয়েছে সামনে কিছুটা দূরে । আরও কিছুটা হেঁটে তার
সামনে গিয়ে রেল কতৃ পক্ষের লণ্ঠনের আলোতে নীচের দৃশ্যটি দেখে রাজর্ষি আঁতকে উঠলো । লোকজনের ভিড়ের
মাঝখানে পড়ে আছে প্রবালের মৃতদেহ , তার শরীরটা ফ্যাকাশে । অসংখ্য ছিদ্রে ভরে আছে তার মুখ-হাত , যেন
কেউ কয়েকশো ছুঁ চ ফু টিয়ে শুষে নিয়েছে তার শরীরের রক্তের প্রায় সবটা আর তার পাশেই পড়ে আছে স্ক্রিনের
ডানদিকে চিঁ র খাওয়া গল্পের হুবহু সেই লাল ফোনটা ।

You might also like