You are on page 1of 8

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২৫ জানুয়ারি ১৮২৪ – ২৯ জুন ১৮৭৩) ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও
নাট্যকার এবং প্রহসন রচয়িতা।[২] তাকে বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণ্য করা হয়। আধুনিক বাংলা
সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি হিসেবেও তিনি পরিচিত।
ব্রিটিশ ভারতের যশোর জেলার এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বংশে জন্ম হলেও মধুসূদন যৌবনে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে মাইকেল মধুসূদন নাম
গ্রহণ করেন এবং পাশ্চাত্য সাহিত্যের দুর্নিবার আকর্ষণবশত ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। জীবনের
দ্বিতীয় পর্বে মধুসূদন আকৃ ষ্ট হন নিজের মাতৃ ভাষার প্রতি। এই সময়েই তিনি বাংলায় নাটক, প্রহসন ও কাব্যরচনা করতে শুরু
করেন।
মাইকেল মধুসূদন বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্ত ক। তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি অমিত্রাক্ষর
ছন্দে রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত মেঘনাদবধ কাব্য নামক মহাকাব্য। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি হলো দ্য
ক্যাপটিভ লেডি, শর্মিষ্ঠা, কৃ ষ্ণকু মারী (নাটক), পদ্মাবতী (নাটক), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, একেই কি বলে
সভ্যতা, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, চতু র্দ শপদী কবিতাবলী, হেকটর বধ [৩] ইত্যাদি। মাইকেলের
ব্যক্তিগত জীবন ছিল নাটকীয় এবং বেদনাঘন। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যু হয় এই মহাকবির।

জীবন[সম্পাদনা]
১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলা প্রেসিডেন্সির যশোর জেলার (অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যশোর জেলার কেশবপুর
উপজেলার) সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে মধুসূদন দত্তের জন্ম হয়। তিনি ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত ও
তার প্রথমা পত্নী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের এক খ্যাতনামা
উকিল। মধুসূদনের যখন তেরো বছর বয়স, সেই সময় থেকেই তাকে কলকাতায় বসবাস করতে হত। খিদিরপুর সার্কু লার
গার্ডে ন রিচ রোডে (বর্ত মানে কার্ল মার্ক স সরণী) অঞ্চলে তিনি এক বিরাট অট্টালিকা নির্মাণ করেছিলেন।

শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]
মধুসূদনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তার মা জাহ্নবী দেবীর কাছে। জাহ্নবী দেবীই তাকে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃ তির
সঙ্গে সুপরিচিত করে তোলেন। সাগরদাঁড়ির পাশের গ্রামের শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফু ল হকের কাছে তার
প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। বিদ্বান ইমামের কাছে তিনি বাংলা, ফারসি ও আরবি পড়েছেন। সাগরদাঁড়িতেই মধুসূদনের বাল্যকাল
অতিবাহিত হয়।
তেরো বছর বয়সে মধুসূদন কলকাতায় আসেন। স্থানীয় একটি স্কু লে কিছুদিন পড়ার পর তিনি তদনীন্তন হিন্দু
কলেজে (বর্ত মানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। মধুসূদন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাই অচিরেই কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন
ডি. এল. রিচার্ড সনের প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। রিচার্ড সন মধুসূদনের মনে কাব্যপ্রীতি সঞ্চারিত করেছিলেন। হিন্দু কলেজের
প্রাক্তন অধ্যাপক ডিরোজিওর স্বদেশানুরাগের স্মৃতিও তাকে বিশেষ উদ্বুদ্ধ করত। এছাড়া কলেজে তার সহপাঠী ছিলেন ভূ দেব
মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, প্যারীচরণ সরকার প্রমুখ ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আঠারো বছর
বয়সেই মহাকবি হওয়ার ও বিলাতে যাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার মনে বদ্ধমূল হয়ে যায়।
১৮৪৩ সালে রেভারেন্ড কৃ ষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট মধুসূদন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এরপর ওই বছরই ১৩
ফেব্রুয়ারি মিশন রো-তে অবস্থিত ওল্ড মিশন চার্চ  নামে এক অ্যাংলিক্যান চার্চে গিয়ে তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাকে দীক্ষিত
করেছিলেন পাদ্রী ডিলট্রি। তিনিই তার "মাইকেল" নামকরণ করেন। মধুসূদন পরিচিত হন "মাইকেল মধুসূদন দত্ত" নামে। তার
এই ধর্মান্তর সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। রাজনারায়ণ দত্ত তার বিধর্মী পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। খ্রিস্টধর্ম
গ্রহণের পর মধুসূদন শিবপুরের বিশপস কলেজে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এখানে তিনি গ্রিক, লাতিন, সংস্কৃ ত প্রভৃ তি
ভাষা শিক্ষা করেন। রাজনারায়ণ দত্ত তাকে পরিত্যাগ করলেও, বিশপস কলেজে পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করছিলেন। চার
বছর পর তিনি টাকা পাঠানো বন্ধ করেন। বিশপস কলেজে কয়েকজন মাদ্রাজি ছাত্রের সঙ্গে মধুসূদনের বন্ধু ত্ব হয়েছিল। বিশপস
কলেজে অধ্যয়ন শেষ করে যখন কলকাতায় চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন মধুসূদন। তখন তার সেই মাদ্রাজি বন্ধু দের সঙ্গে
ভাগ্যান্বেষণে মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই) চলে যান মধুসূদন। কথিত আছে, আত্মীয়স্বজনের অজ্ঞাতসারে নিজের পাঠ্যপুস্তক বিক্রি
করে সেই টাকায় মাদ্রাজ গিয়েছিলেন তিনি।

কর্মজীবন[সম্পাদনা]
মধুসূদন মাদ্রাজেও বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেন নি। স্থানীয় খ্রিষ্টান ও ইংরেজদের সহায়তায় তিনি একটি স্কু লে ইংরেজি
শিক্ষকের চাকরি পান। তবে বেতন যা পেতেন, তাতে তার ব্যয়সংকু লান হত না। এই সময় তাই তিনি ইংরেজি পত্রপত্রিকায়
লিখতে শুরু করেন। মাদ্রাজ ক্রনিকল পত্রিকায় ছদ্মনামে তার কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। হিন্দু ক্রনিকল নামে একটি
পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই অর্থাভাবে পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে হয়। পঁচিশ বছর বয়সে
নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যেই তিনি দ্য ক্যাপটিভ লেডি তার প্রথম কাব্যটির রচনা করেন। কবি ও দক্ষ ইংরেজি লেখক হিসেবে
তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
বিবাহ[সম্পাদনা]
মাদ্রাজে আসার কিছুকাল পরেই মধুসূদন রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতীকে বিবাহ করেন। উভয়ের
দাম্পত্যজীবন আট বছর স্থায়ী হয়েছিল। রেবেকার গর্ভে মধুসূদনের দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। মাদ্রাজ জীবনের শেষ পর্বে
রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার অল্পকাল পরে মধুসূদন এমিলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়া নামে এক ফরাসি তরুণীকে বিবাহ
করেন। আঁরিয়েতা মধুসূদনের সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন। এদিকে মাইকেল তার এক কপি দ্য ক্যাপটিভ লেডি বন্ধু গৌরদাস
বসাককে উপহার পাঠালে, গৌরদাস সেটিকে জে ই ডি বেথুনের কাছে উপহার হিসেবে পাঠান। উক্ত গ্রন্থ পাঠ করে অভিভূ ত
বেথুন মাইকেলকে চিঠি লিখে দেশে ফিরে আসতে এবং বাংলায় কাব্যরচনা করতে পরামর্শ দেন। ১৮৫৬ সালে মধুসূদন
কলকাতায় ফিরে আসেন। পত্নীকে সেই সময় তিনি সঙ্গে আনেন নি।

ফ্রান্সে[সম্পাদনা]
কবি ইংল্যান্ডে আইন বিষয়ে পড়ালেখা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানের আবহাওয়া এবং বর্ণবাদিতার কারণে বেশি দিন
ইংল্যান্ডে থাকেন নি। তারপর তিনি ১৮৬০ সালে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে চলে যান। কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা ছিল খুব
খারাপ। একমাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর জন্য তিনি তার আইন বিষয়ে পড়া শেষ করে ভারতে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কিন্তু তিনি কখনোই কলকাতায় তার এই লেখাপড়াকে কাজে লাগান নি, উপরন্তু দরিদ্রতার জন্য মৃত্যুবরণ করেন।

সাহিত্য জীবন[সম্পাদনা]
মধুসূদন দত্ত নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে পদার্পণ করেন। রামনারায়ণ তর্ক রত্ন বিরচিত 'রত্নাবলী' নাটকের
ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব বোধ করেন। এই অভাব পূরণের লক্ষ্য
নিয়েই তিনি নাটক লেখায় আগ্রহী হয়েছিলেন। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রচনা করেন ‘শর্মিষ্ঠা' নাটক। এটিই প্রকৃ ত অর্থে বাংলা
ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রচনা করেন দুটি প্রহসন, যথা: 'একেই কি বলে সভ্যতা' এবং 'বুড়ো
শালিকের ঘাড়ে রোঁ' এবং পূর্ণাঙ্গ 'পদ্মাবতী' নাটক। পদ্মাবতী নাটকেই তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। ১৮৬০
খ্রিষ্টাব্দে তিনি অমিত্রাক্ষরে লেখেন 'তিলোত্তমাসম্ভব' কাব্য। এরপর একে একে রচিত হয় 'মেঘনাদ বধ কাব্য' (১৮৬১) নামে
মহাকাব্য, 'ব্রজাঙ্গনা' কাব্য (১৮৬১), 'কৃ ষ্ণকু মারী' নাটক (১৮৬১), 'বীরাঙ্গনা' কাব্য (১৮৬২), চতু র্দ শপদী কবিতা (১৮৬৬)।

সাহিত্য জীবনের অনুপ্রেরণা[সম্পাদনা]


মধুসূদন দত্ত তাঁর সাহিত্য জীবনে বিশেষ করে ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের সাহিত্য কর্ম এবং তাঁর জীবন দ্বারা অত্যন্ত বেশি
অনুপ্রাণিত হয়ে ছিলেন। তাঁর মহান সৃষ্টি মেঘনাদ বধ মহাকাব্য প্রকাশ এবং এটি পরিচিত করে তোলা যদিও খুব সহজ ছিল
না, তারপরও তিনি নিজেকে মহাকাব্যটির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্রভাব প্রকাশ করেছিলেন। তারই অংশ হিসেবে
তিনি কাব্যে প্রথম হোমেরিক স্টাইলের লেখার প্রবর্ত ন করেন। তিনি এক সময় নিজেকে বলেছিলেন : "আমি এক সকালে
উঠে নিজেকে সফল হিসেবে পাই নি, এই কাব্যের সফলতা বহু বছরের কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।"

ভাষাগত দক্ষতা[সম্পাদনা]
মাইকেল মধুসূদন দত্ত একাধারে ছিলেন বহু ভাষাবিদ। শিশু কালে গ্রামের টোল থেকে তার ফারসি ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে ভাষা
শিক্ষার শুরু হয়। তিনি ইংরেজি ছাড়াও ল্যাটিন, গ্রিক, ফারসি, হিব্রু, তেলেগু, তামিল ইত্যাদি ভাষায় অনায়াসে কথা বলতে
পারতেন। তিনি এমনকি ফারসি ও ইতালীয় ভাষায় কবিতাও লিখতে পারতেন। মাতৃ ভাষা ছাড়া তিনি আরো বারোটি ভাষা
জানতেন।

নাটক[সম্পাদনা]
বাংলা নাটকে মাইকেল মধুসূদনের আবির্ভাব আকস্মিক। ১৮৫২ সালে তারাচরণ শিকদার, জে. সি. গুপ্ত ও রামনারায়ণ
তর্ক রত্নের হাত ধরে বাংলায় শৌখিন রঙ্গমঞ্চে নাট্য মঞ্চায়ন শুরু হয়। এই সময় লেখা নাটকগুলির গুণগত মান খুব ভালো
ছিল না। ১৮৫৮ সালে পাইকপাড়ার জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ও প্রতাপচন্দ্র সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতার বেলগাছিয়া
নাট্যমঞ্চে রামনারায়ণ তর্ক রত্নের রত্নাবলী নাটকটি অভিনীত হয়। শিল্পগুণবিবর্জি ত এই সাধারণ নাটকটির জন্য জমিদারদের
বিপুল অর্থব্যয় ও উসাহৎসা হ দেখে মধুসূদনের শিক্ষিত মন ব্যথিত হয়ে ওঠে। এরপর তিনি নিজেই নাট্যরচনায় ব্রতী হন।
রামনারায়ণ তর্ক রত্নের সংস্কৃ ত নাট্যশৈলীর প্রথা ভেঙে তিনি পাশ্চাত্য শৈলীর অনুসরণে প্রথম আধুনিক বাংলা নাটক রচনা
করেন।
মাইকেল মধুসূদনের নাট্যচর্চার কাল ও রচিত নাটকের সংখ্যা দুইই সীমিত। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬১ - এই তিন বছর তিনি
নাট্যচর্চা করেন। এই সময়ে তার রচিত নাটকগুলি হল : শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯), একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০), বুড়ো শালিকের
ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০), পদ্মাবতী (১৮৬০), কৃ ষ্ণকু মারী (১৮৬১)। এছাড়া মৃত্যুর পূর্বে মায়াকানন (১৮৭৪) নামে একটি অসমাপ্ত
নাটক।
শর্মিষ্ঠা[সম্পাদনা]
শর্মিষ্ঠা একটি পৌরাণিক নাটক। রচনাকাল ১৮৫৯। এটিই আধুনিক পাশ্চাত্য শৈলীতে রচিত প্রথম বাংলা নাটক। নাটকের
আখ্যানবস্তু মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত রাজা যযাতি, শর্মিষ্ঠা ও দেবযানীর ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনী থেকে গৃহীত। অবশ্য
পাশ্চাত্য নাট্যশৈলীতে লিখলেও, মাইকেল এই নাটকে সংস্কৃ ত শৈলীকে সম্পূর্ণ বর্জ ন করেন নি। এই নাটকের কাব্য ও
অলংকার-বহুল দীর্ঘ সংলাপ, ঘটনার বর্ণনাত্মক রীতি, প্রবেশক, নটী, বিদুষক প্রভৃ তির ব্যবহার সংস্কৃ ত শৈলীর অনুরূপ।
আবার ইংরেজি সাহিত্যের রোম্যান্টিক ধারার প্রভাবও এই নাটকে স্পষ্ট। প্রথম রচনা হিসেবে ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও, সেই
যুগের ইংরেজি-শিক্ষিত পাঠকসমাজে এই নাটকটি খুবই সমাদৃত হয়। বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে সাফল্যের সঙ্গে নাটকটি
অভিনীতও হয়।

একেই কি বলে সভ্যতা  ও বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ[সম্পাদনা]


শর্মিষ্ঠার পরে ১৮৬০ সালে মাইকেল রচনা করেন একেই কি বলে সভ্যতা ও বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নামে দুটি প্রহসন। এই
প্রহসন দুটি তার দুটি শ্রেষ্ঠ নাট্যরচনা। প্রথম নাটকটির বিষয় ছিল ইংরেজি শিক্ষিত নব্য বাবু সম্প্রদায়ের উচ্ছৃ ঙ্খলতা ও
দ্বিতীয়টির বিষয় ছিল সনাতনপন্থী সমাজপতিদের নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন। এই নাটকে মাইকেলের পর্যবেক্ষণ শক্তি,
সমাজবাস্তবতাবোধ ও কাহিনী, চরিত্র ও সংলাপ রচনায় কু শলতা বিশেষ প্রশংসা লাভ করে। কিন্তু নাটকের বিষয়বস্তু নব্য ও
সনাতনপন্থী উভয় সমাজকেই বিক্ষু ব্ধ করে তু লেছিল। তাই বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে নাটকটি অভিনীত হওয়ার কথা থাকলেও,
শেষপর্যন্ত তা হয় নি। এতে মাইকেল খুবই হতাশ হয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে প্রহসন রচনা থেকে নিজেকে গুটিয়ে
নিয়েছিলেন।

পদ্মাবতী[সম্পাদনা]
১৮৬০ সালেই মধুসূদন রচনা করেন পদ্মাবতী নাটকটি। এটিও পৌরাণিক নাটক। তবে এই নাটকের ভিত্তি পুরোপুরি ভারতীয়
পুরাণ নয়। গ্রিক পুরাণের ‘অ্যাপেল অফ ডিসকর্ড ’ গল্পটি ভারতীয় পুরাণের মোড়কে পরিবেশন করেছেন মধুসূদন। গ্রিক
পুরাণের জুনো, প্যালাস ও ভেনাস এই নাটকে হয়েছেন শচী, মুরজা ও রতি। হেলেন ও প্যারিস হয়েছেন পদ্মাবতী ও ইন্দ্রনীল।
তিন দেবীর মধ্যে রতিকে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নির্বাচিত করলে অন্য দুই দেবী ইন্দ্রনীলের প্রতি রুষ্টা হন এবং ইন্দ্রনীলের জীবনে বিপর্যয়
নামিয়ে আনেন। শেষে রতি ও ভগবতীর চেষ্টায় ইন্দ্রনীল উদ্ধার পান এবং বিচ্ছিন্না স্ত্রী পদ্মাবতীর সঙ্গে তার মিলন ঘটে। মূল
গ্রিক উপাখ্যানটি বিয়োগান্তক হলেও, মাইকেল এই নাটকটিকে ইংরেজি ট্র্যাজি-কমেডির ধাঁচে করেছেন মিলনান্তক। এই নাটকে
সংস্কৃ ত নাট্যরীতির প্রভাব অল্পই। প্লট-নির্মাণ, নাটকীয় দ্বন্দ্ব উপস্থাপনা ও চরিত্র চিত্রণে মাইকেল এখানে আগের থেকে পরিণত
হয়েছেন।

মায়াকানন[সম্পাদনা]
কৃ ষ্ণকু মারী নাটক রচনার পর মাইকেল কাব্যরচনায় পুরোদমে মনোনিবেশ করেন। শেষ জীবনে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে বেঙ্গল
থিয়েটারের কর্ণধার শরচ্চন্দ্র ঘোষের অনুরোধে তিনি মায়াকানন নাটকটি রচনায় হাত দেন। নাটকটি তিনি শেষ করতে পারেন নি।
করেছিলেন ভু বনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। এই নাটকটির শিল্পমূল্য বিশেষ নেই। মাইকেলের সৃষ্টিপ্রতিভার কোনো সাক্ষর এতে পাওয়া
যায় না।

মেঘনাদবধ কাব্য[সম্পাদনা]
মূল নিবন্ধসমূহ:  মেঘনাদবধ কাব্য  ও  মহাকাব্য
মধুসূদন দত্তের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হচ্ছে -- অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণ উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত মেঘনাদবধ
কাব্য নামক মহাকাব্যটি। চরিত্র-চিত্র হিসেবে রয়েছেন : রাবণ, ইন্দ্রজিৎ , সীতা, সরমা, প্রমীলা প্রমুখ। তিনি তার
কাব্যকে অষ্টাধিক সর্গে বিভক্ত করেছেন এবং সংস্কৃ ত অলঙ্কারশাস্ত্র অনুযায়ী এতে নগর, বন, উপবন, শৈল, সমুদ্র, প্রভাত,
সন্ধ্যা, যুদ্ধ, মন্ত্রণা প্রভৃ তির সমাবেশও করেছেন। কিন্তু সর্গান্তে তিনি নতু ন ছন্দ ব্যবহার করেন নি, সর্গশেষে পরবর্তী সর্গকথা
আভাসিত করেন নি। যদিও তিনি বলেছিলেন,

গাইব মা বীররসে ভাসি মহাগীত


“ ”
তবুও কাব্যে করুণ রসেরই জয় হয়েছে। মেঘনাদবধ কাব্য রামায়ণ-আহৃত কাহিনীর পুণরাবৃত্তি নয়—এটি নবজাগ্রত বাঙালির
দৃষ্টি নিয়তি-লাঞ্ছিত নবমানবতাবোধের সকরুণ মহাকাব্যের রূপে অপূর্ব গীতি-কাব্য। মেঘনাদবধ কাব্য এ দিক দিয়ে বাংলা কাব্য
সাহিত্যে একক সৃষ্টি।[৪]
মধুসূদন অতি আশ্চর্য্যজনকভাবে নির্মাণ-কু শলতা গুণে মহাকাব্যোচিত কাব্য-বিগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। এ কাব্যের তাপর্য
ৎপর্য
রাবণ-চরিত্রের প্রতীকতায়। তার সৃষ্ট রাবণ চরিত্রে পরম দাম্ভিকতা প্রকট হয়ে উঠে নি। রামায়ণকে তিনি তার মানবতার
আলোকে বিধৌত করে যে মহাকাব্য রচনা করেছেন, তা আসলে রোমান্টিক মহাকাব্য। এ কারণে আকারে 'মেঘনাদবধ কাব্য'
মহাকাব্যোচিত হলেও, এর প্রাণ-নন্দিনী সম্পূর্ণ রোমান্টিক এবং মধুসূদন এ কাব্যে জীবনের যে জয়গান করেছেন, তা বীররসের
নয়, কারুণ্যের। কবি তাই, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,

সমুদ্রতীরের শ্মশানে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কাব্যের উপসংহার করিয়াছেন।


“ ”
বীরাঙ্গনা পত্রকাব্য(১৮৬২)[সম্পাদনা]
(সংস্কার- মঙ্গল মন্ডল গড়বেতা)
বাংলা সাহিত্যে পত্রাকার কাব্যরচনা প্রথম দেখা যায় বীরাঙ্গনা কাব্যে। ১৮৬২ সালে এই গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হয়। দুষ্মন্তের
প্রতি শকু ন্তলা, সোমের প্রতি তারা, দ্বারকনাথের প্রতি রুক্মিণী, দশরথের প্রতি কৈকয়ী, লক্ষ্মণের প্রতি সূপর্ণখা, অর্জু নের প্রতি
দ্রৌপদী, দুর্যোধনের প্রতি ভানুমতী, জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা, শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী, পুরুবার প্রতি উর্বশী, নীলধ্বজের প্রতি জনা
— এই ১১টি পত্ররূপী কবিতা নিয়ে কাব্যগ্রন্থটি রচিত। মধুসূদন তার কাব্যে এই নারীদের পুরাণ-পরিচিতির মূলে আঘাত
করেছেন। তিনি মানবিক অনুভূ তির আলোকে নারী-হৃদয়ের কথকতায় ব্যক্ত করিয়েছেন।[৫]

দাম্পত্য জীবন[সম্পাদনা]
মাদ্রাজে গিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভের চেয়েও কবি যে বিশেষ কাজটি করেছিলেন তা হচ্ছে এক শ্বেতাঙ্গিনীকে বিয়ে করা। মাদ্রাজে
অবস্থানকালীন সময়ে তিনি রেবেকা ম্যাকটাভিশ নামক এক ইংরেজ যুবতীকে বিয়ে করেন। অরফান আস্যাইলাম স্কু লে
পড়াতে শুরু করার পরই পরিচয় হয় তার ভাবী স্ত্রী রেবেকার সাথে। বিয়ের এই প্রক্রিয়াটি অবশ্য খুব সহজ ছিল না। তার বন্ধু
গৌরি দাশকে লিখেছিলেন""রেবেকাকে পেতে খুব ঝামেলা হয়েছিল, বুঝতেই তো পারছো তার(রেবেকা) সমস্ত শুভাকাঙ্ক্ষী
এই বিয়ের বিরুদ্ধে ছিল"" তাদের বিয়ে সম্পাদন হয় ৩১ জুলাই ১৮৪৮ সালে। বিদেশে গিয়ে রোগ ভোগ করা, চাকরি জোটানো
তারপর এই বিদেশিনীকে বিয়ে করা এই সবই হয়েছিল মাদ্রাজ পৌঁছানোর ছ' মাসের ভিতরে। কিন্তু তাদের এই দাম্পত্য জীবন
বেশি দিন স্থায়ী ছিল না। তিনি ভেবেছিলেন বিয়ের পর তার প্রাণের রেবেকাকে সাথে নিয়ে সুখী হবেন। কিন্তু সুখ জিনিসটা
বিধাতা হয়ত তার কপালে লিখেন নি। সংসারের নানা ঝঞ্ঝাট, গোলমাল দেখা দিল। মাইকেলের একগুয়েমির কারণে স্ত্রীর
মতের সাথে অমিল হতে লাগল। এর ফলে তিনি কয়েক বছরের মধ্যেই রেবেকার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। রেবেকার গর্ভে
মধুসূদনের দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়।
মাদ্রাজ জীবনের শেষ পর্বে রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার অল্পকাল পরে মধুসূদন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজের কোনো
এক শিক্ষকের কন্যা হেনিরিয়েটা সোফিয়া নামে এক ফরাসি তরুণীকে বিবাহ করেন। হেনিরিয়েটাও সর্বগুণ সম্পন্ন রুচিমার্জি ত
মেয়ে ছিলেন। হেনিরিয়েটা মধুসূদনের সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন। তাদের নেপোলিয়ান নামক এক ছেলে এবং শর্মিষ্ঠা নাম
এক মেয়ে। তার বংশধরদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় লিয়েন্ডার পেজ।

মৃত্যু[সম্পাদনা]
মধুসূদনের শেষ জীবন চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আইন ব্যবসায়ে তিনি তেমন সাফল্য লাভ করতে
পারেন নি। তাছাড়া অমিতব্যয়ী স্বভাবের জন্য তিনি ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েন। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল
হাসপাতালে কপর্দ কহীন (অর্থাভাবে) অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তাকে কলকাতার সাক‌ু লার রোডে সমাধি দেওয়া
হয়। মহাকবি জীবনের অন্তিম পর্যায়ে জন্মভূ মির প্রতি তার সুগভীর ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন অবিস্মরণীয়
পংক্তিমালায়। তার সমাধিস্থলে নিচের কবিতাটি লেখা রয়েছে :

'দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব


“ বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্তকু লোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ-তীরে
জন্মভূ মি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী' ”
FROM ANOTHER SITE
মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনী
মাইকেল মধুসূদন দত্ত, (১৮২৪-১৮৭৩) মহাকবি, নাট্যকার, বাংলাভাষার সনেট প্রবর্ত ক, অমিত্রাক্ষর ছন্দের
প্রবর্ত ক। ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে, এক জমিদার বংশে
তাঁর জন্ম। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল। মা জাহ্নবী দেবীর তত্ত্বাবধানে
মধুসূদনের শিক্ষারম্ভ হয়। প্রথমে তিনি সাগরদাঁড়ির পাঠশালায় পড়াশোনা করেন। পরে সাত বছর বয়সে তিনি
কলকাতা যান এবং খিদিরপুর স্কু লে দুবছর পড়ার পর ১৮৩৩ সালে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বাংলা,
সংস্কৃ ত ও ফারসি ভাষা শেখেন।

হিন্দু কলেজে অধ্যয়নকালেই মধুসূদনের প্রতিভার বিকাশ ঘটে। ১৮৩৪ সালে তিনি কলেজের পুরস্কার বিতরণী
অনুষ্ঠানে ইংরেজি ‘নাট্য-বিষয়ক প্রস্তাব’ আবৃত্তি করে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এখানে তাঁর সহপাঠী
ছিলেন ভূ দেব মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক প্রমুখ, যাঁরা পরবর্তী জীবনে স্বস্ব
ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে মধুসূদন উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কলেজের
পরীক্ষায় তিনি বরাবর বৃত্তি পেতেন। এ সময় নারীশিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন।

হিন্দু কলেজে অধ্যয়নের সময়েই মধুসূদন কাব্যচর্চা শুরু করেন। তখন তাঁর কবিতা জ্ঞানান্বেষণ, Bengal
Spectator, Literary Gleamer, Calcutta Library Gazette, Literary Blossom, Comet প্রভৃ তি
পত্রিকায় প্রকাশিত হতো।

এ সময় থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন বিলেত যাওয়ার। তাঁর ধারণা ছিল বিলেতে যেতে পারলেই বড় কবি হওয়া যাবে।
তাই পিতা তাঁর বিবাহ ঠিক করলে তিনি ১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি  গ্রহণ করেন এবং তখন থেকে তাঁর নামের
পূর্বে ‘মাইকেল’ শব্দটি যুক্ত হয়। কিন্তু হিন্দু কলেজে খ্রিস্টানদের অধ্যয়ন নিষিদ্ধ থাকায় মধুসূদনকে কলেজ ত্যাগ
করতে হয়। তাই ১৮৪৪ সালে তিনি বিশপ্স কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৪৭ পর্যন্ত এখানে অধ্যয়ন করেন। এখানে
তিনি ইংরেজি ছাড়াও গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃ ত ভাষা শেখার সুযোগ পান।
এ সময় ধর্মান্তরের কারণে মধুসূদন তাঁর আত্মীয়স্বজনদের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাঁর পিতাও এক সময়
অর্থ পাঠানো বন্ধ করে দেন। অগত্যা মধুসূদন ভাগ্যান্বেষণে ১৮৪৮ সালে মাদ্রাজ গমন করেন। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন
শিক্ষকতা করেন। প্রথমে মাদ্রাজ মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলাম স্কু লে (১৮৪৮-১৮৫২) এবং পরে মাদ্রাজ
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভু ক্ত হাইস্কু লে শিক্ষকতা (১৮৫২-১৮৫৬) করেন।

মাদ্রাজের সঙ্গে মধুসূদনের জীবনের অনেক ঘটনা জড়িত। এখানেই তিনি সাংবাদিক ও কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ
করেন। তিনি Eurasion (পরে Eastern Guardian), Madras Circulator and General Chronicle ও
Hindu Chronicle পত্রিকা সম্পাদনা করেন এবং Madras Spectator-এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন
করেন (১৮৪৮-১৮৫৬)। মাদ্রাজে অবস্থানকালেই Timothy Penpoem ছদ্মনামে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ The
Captive Ladie (১৮৪৮) এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ Visions of the Past প্রকাশিত হয়। রেবেকা ও হেনরিয়েটার সঙ্গে
তাঁর যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় বিবাহ এখানেই সংঘটিত হয়। মাদ্রাজে বসেই তিনি হিব্রু, ফরাসি, জার্মান, ইটালিয়ান,
তামিল ও তেলেগু ভাষা শিক্ষা করেন।

এরমধ্যে মধুসূদনের পিতামাতা উভয়ের মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী হেনরিয়েটাকে নিয়ে
১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা আসেন। সেখানে তিনি প্রথমে পুলিশ কোর্টে র কেরানি এবং পরে
দোভাষীর কাজ করেন। এ সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেও তিনি প্রচু র অর্থোপার্জ ন করেন। তাঁর বন্ধু বান্ধবরা এ
সময় তাঁকে বাংলায় সাহিত্যচর্চা করতে অনুরোধ জানান এবং তিনি নিজেও ভেতর থেকে এরূপ একটি তাগিদ
অনুভব করেন। রামনারায়ণ তর্ক রত্নের রত্নাবলী (১৮৫৮) নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা
নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব অনুভব করেন এবং তাঁর মধ্যে তখন বাংলায় নাটক রচনার সংকল্প জাগে।
এই সূত্রে তিনি কলকাতার পাইকপাড়ার রাজাদের বেলগাছিয়া থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। এমন একটি
পরিস্থিতিতে নাট্যকার হিসেবেই মধুসূদনের বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে পদার্পণ ঘটে। তিনি মহাভারতের দেবযানী-যযাতি
কাহিনী অবলম্বনে ১৮৫৮ সালে পাশ্চাত্য রীতিতে রচনা করেন শর্মিষ্ঠা নাটক। এটিই প্রকৃ ত অর্থে বাংলা ভাষায়
রচিত প্রথম মৌলিক নাটক এবং একই অর্থে মধুসূদনও বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাট্যকার।

পরের বছর মধুসূদন রচনা করেন দুটি প্রহসন: একেই কি বলে সভ্যতা ও বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ। প্রথমটিতে তিনি
ইংরেজি শিক্ষিত ইয়ং বেঙ্গলদের মাদকাসক্তি, উচ্ছৃ ঙ্খলতা ও অনাচারকে কটাক্ষ করেন এবং দ্বিতীয়টিতে রক্ষণশীল
হিন্দু সমাজের আচারসর্বস্ব ও নীতিভ্রষ্ট সমাজপতিদের গোপন লাম্পট্য তু লে ধরেন। এ ক্ষেত্রেও মধুসূদন
পথিকৃ তের ভূ মিকা পালন করেন। তাঁর প্রহসন দুটি কাহিনী, সংলাপ ও চরিত্রসৃষ্টির দিক থেকে আজও অতু লনীয়।

মধুসূদনের কৃ তিত্ব এখানেই যে, তিনি যাকিছু রচনা করেছেন তাতেই নতু নত্ব এনেছেন। তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য
সাহিত্যের আদর্শ বাংলা সাহিত্যে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেন। তখনকার বাংলা সাহিত্যে রচনার শৈলীগত এবং
বিষয়ভাবনাগত যে আড়ষ্টতা ছিল, মধুসূদন তা অসাধারণ প্রতিভা ও দক্ষতাগুণে দূরীভূ ত করেন। ১৮৬০ সালে
তিনি গ্রিক পুরাণ থেকে কাহিনী নিয়ে রচনা করেন পদ্মাবতী নাটক। এ নাটকেই তিনি পরীক্ষামূলকভাবে ইংরেজি
কাব্যের অনুকরণে অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার বরেন। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার এটাই প্রথম এবং এর
ফলে তিনি বাংলা কাব্যকে ছন্দের বন্ধন থেকে মুক্তি দেন। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহারে এই সফলতা
তাঁকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করে এবং এই ছন্দে একই বছর তিনি রচনা করেন তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য। পরের বছর
১৮৬১ সালে রামায়ণের কাহিনী নিয়ে একই ছন্দে তিনি রচনা করেন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি । এটি বাংলা ভাষায় রচিত
প্রথম মৌলিক মহাকাব্য। আর কোন রচনা না থাকলেও মধুসূদন এই একটি কাব্য লিখেই অমর হয়ে থাকতে
পারতেন। এই কাব্যের মাধ্যমেই তিনি মহাকবির মর্যাদা লাভ করেন এবং তাঁর নব আবিষ্কৃ ত অমিত্রাক্ষর ছন্দও
বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। রামায়ণে বর্ণিত অধর্মাচারী, অত্যাচারী ও পাপী রাবণকে একজন দেশপ্রেমিক,
বীর যোদ্ধা ও বিশাল শক্তির আধাররূপে চিত্রিত করে মধুসূদন উনিশ শতকের বাঙালির নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ কবির
মর্যাদা লাভ করেন। এক্ষেত্রে তিনি ভারতবাসীর চিরাচরিত বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনে প্রকৃ ত সত্য সন্ধান ও
দেশপ্রেমের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, বাংলা সাহিত্যে তা তু লনাহীন।

মধুসূদনের কাব্যে এক ধরনের নারীবিদ্রোহের সুর লক্ষ করা যায়। তাঁর কাব্যের নায়িকাদের মধ্য দিয়ে যেন যুগ যুগ ধরে
বঞ্চিত, অবহেলিত, আত্ম সুখ-দুঃখ প্রকাশে অনভ্যস্ত ও ভীত ভারতীয় নারীরা হঠাৎ আত্মসচেতন হয়ে জেগে
ওঠে। তারা পুরুষের নিকট নিজেদের ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ এবং কামনা-বাসনা প্রকাশে হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। তাঁর
বীরাঙ্গনা (১৮৬২) পত্রকাব্যের নায়িকাদের দিকে তাকালে এ কথার সত্যতা উপলব্ধি করা যাবে। এখানে জনা,
কৈকেয়ী, তারা প্রমুখ পৌরাণিক নারী তাদের স্বামী বা প্রেমিকদের নিকট নিজেদের কামনা-বাসনা ও চাওয়া-পাওয়ার
কথা নির্ভীকচিত্তে প্রকাশ করে। নারীচরিত্রে এরূপ দৃঢ়তার প্রকাশ বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের আগে আর কারও
রচনায় প্রত্যক্ষ করা যায় না। মধুসূদনের এ সময়কার অপর দুটি রচনা হলো কৃ ষ্ণকু মারী (১৮৬১) ও ব্রজাঙ্গনা
(১৮৬১)। প্রথমটি রাজপুত উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত একটি বিয়োগান্তক নাটক এবং দ্বিতীয়টি রাধাকৃ ষ্ণ বিষয়ক
গীতিকাব্য। এ পর্বে মধুসূদন দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ  নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং কিছুদিন হিন্দু
প্যাট্রিয়ট (১৮৬২) পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৮৬২ সালের ৯জুন মধুসূদন ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে বিলেত যান
এবং গ্রেজ-ইন-এ যোগদান করেন। সেখান থেকে ১৮৬৩ সালে তিনি প্যারিস হয়ে ভার্সাই নগরীতে যান এবং
সেখানে প্রায় দুবছর অবস্থান করেন। ভার্সাইতে অবস্থানকালে তাঁর জীবনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এখানে বসেই
তিনি ইতালীয় কবি পেত্রার্কে র অনুকরণে বাংলায় সনেট লিখতে শুরু করেন। বাংলা ভাষায় এটিও এক বিস্ময়কর
নতু ন সৃষ্টি। এর আগে বাংলা ভাষায় সনেটের প্রচলন ছিল না। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো ভার্সাই নগরীতে থেকেই তিনি
যেন মাতৃ ভূ মি ও মাতৃ ভাষাকে নতু নভাবে এবং একান্ত আপনভাবে দেখতে ও বুঝতে পারেন, যার চমৎকার প্রকাশ
ঘটেছে তাঁর ‘বঙ্গভাষা’, ‘কপোতাক্ষ নদ’ ইত্যাদি সনেটে। তাঁর এই সনেটগুলি ১৮৬৬ সালে চতু র্দ্দ শপদী কবিতাবলী
নামে প্রকাশিত হয়।

ভার্সাই নগরীতে দুবছর থাকার পর মধুসূদন ১৮৬৫ সালে পুনরায় ইংল্যান্ড যান এবং ১৮৬৬ সালে গ্রেজ-ইন থেকে
ব্যারিস্টারি পাস করেন। ১৮৬৭ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে ফিরে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দেন।
কিন্তু ওকালতিতে সুবিধে করতে না পেরে ১৮৭০ সালের জুন মাসে মাসিক এক হাজার টাকা বেতনে হাইকোর্টে র
অনুবাদ বিভাগে যোগদান করেন। দুবছর পর এ চাকরি ছেড়ে তিনি পুনরায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। এবারে তিনি
সফল হন, কিন্তু অমিতব্যয়িতার কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অমিতব্যয়িতার ব্যাপারটি ছিল তাঁর স্বভাবগত। একই
কারণে তিনি বিদেশে অবস্থানকালেও একবার বিপদগ্রস্ত হয়েছিলেন এবং বিদ্যাসাগরের আনুকূ ল্যে সেবার উদ্ধার
পান। ১৮৭২ সালে মধুসূদন কিছুদিন পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংহ দেও-এর ম্যানেজার  ছিলেন।
জীবনের এই টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েও মধুসূদন কাব্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। হোমারের ইলিয়াড অবলম্বনে ১৮৭১
সালে তিনি রচনা করেন হেক্টরবধ। তাঁর শেষ রচনা মায়াকানন (১৮৭৩) নাটক। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত তাঁর ১২টি
গ্রন্থ এবং ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ রয়েছে।

মধুসূদন ছিলেন বাংলা সাহিত্যের যুগপ্রবর্ত ক কবি। তিনি তাঁর কাব্যের বিষয় সংগ্রহ করেছিলেন প্রধানত সংস্কৃ ত
কাব্য থেকে, কিন্তু পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ অনুযায়ী সমকালীন ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির জীবনদর্শন ও রুচির
উপযোগী করে তিনি তা কাব্যে রূপায়িত করেন এবং তার মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যে এক নবযুগের সূচনা হয়।
উনিশ শতকের বাঙালি নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃ ৎ মধুসূদন তাঁর অনন্যসাধারণ প্রতিভার দ্বারা বাংলা ভাষার
অন্তর্নিহিত শক্তি আবিষ্কার করে এই ভাষা ও সাহিত্যের যে উৎকর্ষ সাধন করেন, এরফলেই তিনি বাংলা সাহিত্যের
ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি ‘মধুকবি’ নামে পরিচিত।

বাংলার এই মহান কবির শেষজীবন অত্যন্ত দুঃখ-দারিদ্রে্যর মধ্যে কেটেছে। ঋণের দায়, অর্থাভাব, অসুস্থতা,
চিকিৎসাহীনতা ইত্যাদি কারণে তাঁর জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। শেষজীবনে তিনি উত্তরপাড়ার জমিদারদের
লাইব্রেরি ঘরে বসবাস করতেন। স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃত্যুর তিনদিন পরে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন বাংলার এই মহা কবি
কপর্দ কহীন অবস্থায় জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। 

You might also like