You are on page 1of 3

বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূ লনীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি৷ এই নীতি রক্ষা ও

বাস্তবায়নে সংবিধানে কিছু রক্ষা কবচও আছে৷ ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নৃ গোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণের
কথা আছে সংবিধান ও আইনে৷ কিন্তু বাস্তব অবস্থা কী?

পশ্চিমা দেশগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে সম্পূ র্ণ পৃ থক ভাবা হয় কিন্তু বাংলাদেশের
পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষতা হলো সব ধর্মের সমান অধিকার।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা বা রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে সম্পূ র্ণ পৃ থক করে দেওয়া
বোঝায় না, বরং রাষ্ট্রের প্রদত্ত সু বিধায় সব ধর্মের সমান অধিকার ও অংশগ্রহণকে বোঝায়। সংবিধানের ২(ক)
অনু চ্ছেদে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম বলার পাশাপাশি হিন্দু , বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টানসহ অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও সমান
স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, যাতে বোঝা যায় রাষ্ট্র ইসলামসহ সব ধর্ম পালনে সমান মর্যাদা ও সমান
অধিকার নিশ্চিত করেছে। তবে, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতি সংবিধানের
এক ধরনের সৌজন্য বা আলঙ্কারিক স্বীকৃতি বলা যেতে পারে।
ইসলাম রাষ্ট্র ধর্ম হওয়ার পরেও
ইসলাম সব ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। ধর্ম পালনে কেউ বাধাগ্রস্ত হবে না। তাই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের
ধর্মগ্রন্থ, উপাসনালয় ও ধর্মীয় আচার-অনু ষ্ঠান নিয়ে কোনোরূপ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা কোনো মু সলমানের জন্য
সমর্থনযোগ্য নয়। সাম্প্রদায়িকতার নামে যারা বিশৃ ঙ্খলা করে তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে হজরত
মু হাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যারা মানু ষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য যু দ্ধ করে
এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয় (আবু দাউদ)।’
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলাম এতই সোচ্চার, রাসূ ল (সা.) নিজেদের জানমালের পাশাপাশি সংখ্যালঘু
অমু সলিম সম্প্রদায়ের জানমাল রক্ষায় সচেষ্ট থাকার জন্যও মু সলমানদের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। শুধু তাই
নয়, অন্য ধর্মাবলম্বী ও তাদের উপাসনালয়ের ওপর আঘাত-সহিংসতাও ইসলামে চিরতরে হারাম ও
নাজায়েজ ঘোষণা করা হয়েছে
ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের সংবিধানের অন্যতম মূ লনীতি যা সংবিধানের ৮(১) অনু চ্ছেদে সন্নিবেশিত হয়েছে।
এটির ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে ও সংবিধান বা আইনের ব্যাখ্যা দেয় এবং এটি রাষ্ট্র ও
জনগণের সব কাজের মূ ল ভিত্তি। সংবিধানের ৯ নম্বর অনু চ্ছেদে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়েছে,
যার ভিত্তি ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, যা ছিল আমাদের স্বাধীনতা যু দ্ধের মূ ল চেতনা। ৯নং অনু চ্ছেদের
মাধ্যমে একটি শোষণমু ক্ত ন্যায়ানু গ সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছে।
উপরন্তু ১২নং অনু চ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, ধর্মের
ভিত্তিতে বৈষম্য বা নিপীড়ন ও ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদার সু যোগ বিলোপ করার কথা বলা হয়েছে।
তবে সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং ১২ অনু চ্ছেদ ধর্ম নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে৷ সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা
হয়েছে, ‘‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মু ক্তি
সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল – জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র,
গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূ লনীতি হইবে৷'' তাই সংবিধানের প্রস্তাবনা
অনু যায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূ লনীতির চতুর্থ নীতিটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা৷
সংবিধানের ৪১ নম্বর অনু চ্ছেদে সব নাগরিকের স্বাধীনভাবে যেকোনও ধর্ম প্রচার ও পালনের অধিকার
নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের কতিপয় অনু চ্ছেদে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার এবং সমান
মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। ২৭-২৮ নম্বর অনু চ্ছেদে বলা হয়েছে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং
আইনের সমান সু রক্ষার অধিকার ভোগ করবে। রাষ্ট্রধর্মের ভিত্তিতে কোনও নাগরিকের সঙ্গে বৈষম্যমূ লক
আচরণ করবে না। সু তরাং যেকোনও হিন্দু বা বৌদ্ধ বাংলাদেশি নাগরিকের বৈষম্যহীনভাবে ধর্ম পালন ও
প্রচারের অধিকার আছে।
আর কাজ বা চাকরির ক্ষেত্রেও অসাম্প্রদায়িক নীতির কথা বলেছে বাংলাদেশের সংবিধান৷ সংবিধানের ২৯
(২) অনু চ্ছেদে বলা হয়েছে, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পু রুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক
প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন
করা যাইবে না৷ সু তরাং এটা পরিস্কার যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতি, রাষ্ট্রপরিচলানার নীতি, সংবিধান এবং
আইন ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদয়িকতাকে ঊর্ধে তুলে ধরেছে৷
একইসঙ্গে বাংলাদেশের ‘উপজাতি', ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ -গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি বিকাশ ও সংরক্ষণের
কথা বলা হয়েছে সংবিধানে৷ সংবিধানের ২৩(ক) অনু চ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র
জাতিসত্তা, নৃ -গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূ র্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও
বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷
সব ধর্মের মানু ষের সমান মর্যাদা ও অধিকার সংবিধানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে বিধায় এ দেশে হিন্দু -
মু সলমান সবাই রাষ্ট্রের চোখে সমান। সংবিধানের এই স্বীকৃতি দেশের বিদ্যমান আইন ও রাষ্ট্রের
নীতিমালাতেও প্রতিফলিত হয়। ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৯৬০-এ হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, ধর্মীয় উপাসনালয়ে
ভাঙচুর ও ধর্মীয় অনু ভূতিতে আঘাত হানে বা ধর্মীয় সমাবেশে শান্তি বিঘ্ন করে এমন কর্মকাণ্ডকে
পরিষ্কারভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
বাংলাদেশে একটি মানবাধিকার কমিশন রয়েছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘন বা যেকোনও নাগরিকের
মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারে সরকারকে জানতে পারবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারকে তাদের
অভিমত জানাতে পারে। এছাড়া, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হচ্ছে সব ধর্মীয় সম্প্রদায় ও মানু ষের অধিকার
রক্ষায় ও কল্যাণে বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইসলাম, হিন্দু , বৌদ্ধ ও
খ্রিষ্টানদের জন্য পৃ থক ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট রয়েছে।
ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু দের অধিকার রক্ষার্থে ধর্মনিরপেক্ষতার বিকল্প নেই। সংবিধান ও
বিদ্যমান আইনে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হলেও তার পরিপূ র্ণ বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হয় নানা কারণে। যেমন—
সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার ধর্মনিরপেক্ষতার পথে অন্তরায়।
সাম্প্রদায়িক আচরণ ও মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ধর্মীয় সংখ্যালঘু দের নাগরিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন
করে। আমাদের সংবিধানে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলের কথা বলা হয়েছে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা কী তার কোনও
ব্যাখ্যা কোথাও নেই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার বন্ধ কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে
জামায়াত-বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এখনও প্রশ্নবিদ্ধ থাকা ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ
ও রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু দের ওপর নির্যাতন বন্ধে ও তাদের শতভাগ অধিকার
নিশ্চিতে সর্বস্তরে ধর্মনিরপেক্ষতার বাস্তবায়ন অপরিহার্য। কিন্তু এই ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চ া বাস্তবে কেন আমরা
পূ র্ণাঙ্গভাবে দেখতে পাচ্ছি না, কেন অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পরিবেশের বিকাশ
ঘটছে না, তা পর্যালোচনা করা বিশেষ জরুরি। কারণ, একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব
মানু ষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে পারে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প রুখে দিতে পারে এবং সর্বস্তরে
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অর্জ নে সফল হতে পারে।

এসব সম্প্রদায়ের মানু ষের মধ্যকার ঐক্য, সংহতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার নামই হলো সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতি। মানবসমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ব অপরিসীম। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
মানু ষের মধ্যে ধৈর্য, সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ ঘটায়। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশ ও
জাতি উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত না করে কোনো জাতি উন্নতি করতে
পারে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনু পস্থিতিতে দেশের শান্তিশৃ ঙ্খলা বিনষ্ট হয়, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব
হুমকির সম্মু খীন হয়। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সংঘাতের সূ ত্রপাত ঘটায়, গৃ হযু দ্ধেও রূপ নেয়। অনেক ক্ষেত্রে
ইহকাল-পরকালের সব নেকির কাজও ধ্বংস হয়ে যায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কারণে।

You might also like