Professional Documents
Culture Documents
বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ
বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ
ইকবাল হাবিব
বঙ্গবন্ধু র সমাধির পাশ দিয়ে যে সড়কটি ছিল, সেটি আমরা বন্ধ করে দিই। অবশ্য বিকল্প হিসেবে
টু ঙ্গীপাড়া উপজেলার আগত সব মানুষের জন্য একটি ডাইভারশন সড়ক নির্মাণ করে দিই।
প্রথমে আমরা একটি পাবলিক কোটইয়ার্ড নির্মাণ করি- যেখানে জনসমাগম হবে, স্থাপত্যের
ভাষায় যাকে পাবলিক গাদারিং স্পেস বলা হয়। সেখানে প্রক্ষালনকেন্দ্র, ক্যান্টিন, সুভিনিয়র
বিক্রয়কেন্দ্র, লাইব্রেরি ও মসজিদ মিলিয়ে একটি লোকসমাগমস্থল বানানোর পরিকল্পনা করি।
বিলের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া আইলের মতো পথকে গোপালগঞ্জের স্থানীয় ভাষায় ‘হালট’
বলে। এখানেও সে রকম একটি হালট ছিল। সেই হালট দিয়ে হয়তো বঙ্গবন্ধু ও একসময়
হেঁটেছেন। তার মৃত্যুর পর মানুষ সেটি দিয়েই সমাধি পর্যন্ত যেত। সেটিকে আমরা পাবলিক
প্লাজা পর্যন্ত যাওয়ার জন্য এমন একটি পথ বানানোর পরিকল্পনা করি, যে পথ দিয়ে হাঁটলে মানুষ
জানবে– এই সোঁদামাটি থেকে বেরিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু কিভাবে বিশ্বসভায় মহান নেতায় পরিণত
হন। এ ধরনের একটি অভিজ্ঞতার যাত্রাপথ আমরা তৈরি করি।
আমরা পথটির নাম দিয়েছি ‘বিথীকা’। বিথীকাটি দুটো “তালাব” বা পুকু রের পাশ দিয়ে যায়।
বড় তালাব এবং ছোট তালাব। সেখানকার ঘাস এবং গাছ আমরা সংরক্ষণ করি। একটি
দেয়াল তু লে পাশের বাড়িগুলোর সঙ্গে একটি আড়াল তৈরি করি। এই বিথীকা ধরেই ‘হালট’
থেকে হঠাৎ করেই দর্শনার্থীরা একটি স্পিরিচু য়াল কোটইয়ার্ডে প্রবেশ করবেন। এই কোটইয়ার্ডে র
ঠিক মাঝখানে বঙ্গবন্ধু ও তার বাবার কবর বিদ্য মান । জায়গাটিকে আমরা একটি
বৃত্তাকার পারাফোরেটেড বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে দিই, যাতে আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে।
সেখানে কোন কৃ ত্তিম আলো-বাতাসের দরকার নেই। এর ভেতরে দাঁড়িয়ে যখন আপনি
মোনাজাত করবেন, মৃতের স্মরণ করবেন, কবিতাপাঠ করবেন, দোয়া করবেন বা পবিত্র গ্রন্থ
থেকে কিছু উচ্চারণ করবেন, তখন আপনি বাইরের দুনিয়া থেকে আলাদা হয়ে যাবেন। এ রকম
একটি জায়গা তৈরি করে, তার চারপাশে থেকে উত্থিত একটি স্থাপত্য হিসেবে তৈরি করা হয়।
প্রকৃ তিনির্ভ রতাই এ স্থাপত্যের সবচেয়ে বড় ঐশ্বর্য হিসেবে বিবেচিত। সে সময় অনেক সম্মানিত
ব্যক্তি আমাদের সাজেশন দিয়েছিলেন। আমি তাদের নাম উল্লেখ করছি না। তারা বলেছিলেন,
এই স্থাপত্য ইরানের শাহ কিংবা তু রষ্কের কামাল আতাতু র্কে র মাজারের মতো হবে না কেন?
বঙ্গবন্ধু কন্যা একটি ছোট্ট স্কেচ এঁকে দিয়েছিলেন। সেটি এখনো টু ঙ্গিপাড়ায় টাঙ্গানো আছে । সব
প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু সেভাবে তৈরি হওয়া নেতা
নন। তিনি মাটি থেকে, সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে বেড়ে ওঠা নেতা। তার মাজার হবে সেই
প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠার অনুপ্রেরণা ভরপুর। সেখানকার প্রাকৃ তিক পরিবেশে গাছ,
তালব, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ইত্যাদি যাতে অক্ষু ণ্ন থাকে সেসব এই স্থাপত্য নির্মাণের সময়
বিবেচনায় রাখা হয়েছে। এই কারণেই হয়তো কেউ সেখানে গেলে বঙ্গবন্ধু কোথা থেকে কিভাবে
এসেছেন, কোথা থেকে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছেন দর্শনাথীরা যাতে ঘুরে ঘুরে দেখতে পারেন,
তেমন একটি বৃত্তাকার পথ রচনা করা হয়েছে। বিশেষ বিশেষ দিনে কবরের পাশে একটি বেষ্টনীর
এই কাঠের স্ট্রিমগুলো সরে যায় এবং ফু ল রাখার জন্য বেদিটা সামনে চলে আসে। মাঝেমধ্যে
যখন আনুষ্ঠানিক আয়ো জন থাকে , তখন আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে ফু ল দিতে পারবেন। কাঠের
স্ট্রিমগুলো সরে গেলেই কবর দেখা যায়। বাকি সারা বছর বন্ধ থাকে। এর চারপাশে আরেকটি
সার্কু লার স্পেস বা ইন্টারনাল কোটইয়ার্ড বঙ্গবন্ধু র বাড়ির আর সমাধির মধ্যে রয়েছে। এ
বাড়িতেই বঙ্গবন্ধু থাকতেন, যা পরে ছোট্ট একটি মিউজিয়াম হয়। তখন ফার্নিচার যা ছিল তার
সংরক্ষণ করে ওপরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা থাকতেন। সে বাড়িটিকে আমরা অক্ষু ণ্ন
রেখেছি। ভেতরের এই উঠোনে বসে মানুষ যাতে কোরআন পাঠ করতে পারেন বা আলো চনা
করতে পারেন সে রকম একটা ব্যবস্থাও সেখানে আছে। ঢাকা থেকে যে কফিনে বঙ্গবন্ধু কে
সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাও সংরক্ষিত আছে। পাবলিক ও স্পিরিচু য়াল দুই
কোটইইয়ার্ডে র মধ্যে থেকে এটি একেবারে মাটি সবাই যেন সব বুঝতে পারেন। জাতির পিতা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর সামরিক ঘাতকরা হয়তো ভেবেছিল,
মানুষের কাছ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে ফেলি। কিন্তু অবচেতন মনে ঘাতকরা তাকে সেখানেই
নিয়ে গেলেন। যে মাটিতে এই মহামানবের জন্ম, তিনি সেখানেই শায়িত আছেন। এর চেয়ে
ভালো যে আর হয় না সেটা এই স্থাপত্য করতে গিয়ে আমরা ভীষণভাবে উপলব্ধি করেছি।
আরেকটি ছোট তথ্য না দি লে ই নয় । সমাধি সমাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু র পরিবার
অন্যদের কাছ থেকে কোনো জমি অধিগ্রহণ করেননি। সেখানে গেলে মনে হয়, সমাধি আরেকটু
বড় করা যেত। কিন্তু আমরা তা পারিনি। জমি যা রয়েছে, সবই দান করেছেন বঙ্গবন্ধু র পরিবারের
সদস্যরাই। এসব স্মৃতি আমাকে কাঁদায়। আমরা জাতির পিতার সমাধিসৌ ধ করতে
গিয়েও কারও দান নিয়ে নিয়ে নিতে পারলাম না।
এহসান খান
এহসান খান স্থপতি ও নগর পরিকল্পক। তিনি ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে স্থাপত্যে গ্রাজুয়েশন করেন। তিনি ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেড-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
এখন এহসান খান আর্কি টেক্টস নামে নিজের স্থাপত্য চর্চায় নিয়োজিত তিনি। জাতীয় ও
আন্ত র্জা তিক অঙ্গ নে পুরস্কারপ্রা প্ত এহসান খান বিশ্বাস করেন নগর ও গ্রামীণ সমাজের নানা
স্তরে স্থাপত্যের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
ইকবাল হাবিব
একজন সক্রিয় স্থপতি ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মী। তিনি ‘ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেড’-এর
একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা। সমাজ ও পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধ স্থাপত্য চর্চায় নিয়োজিত তিনি।
১৯৯৩ সালে তিনি স্থাপত্যের গ্রাজুয়েশন করেন। বাংলাদেশের স্থপতি ইনস্টিটিউটের একজন
সক্রিয় সদস্য তিনি। ঢাকার নানা নাগরিক সংকট নিয়ে সোচ্চার কণ্ঠ তিনি। আন্ত র্জা তিক
খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি মোশে শাফবি ও জাহা হাদীদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
ইশতিয়াক জহির
একজন সক্রিয় স্থপতি ও নগর পরিকল্পক। তিনি ‘ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেড’-এর একজন
সহ-প্রতিষ্ঠাতা। গত ২৬ বছর ধরে স্থাপত্য চর্চায় নিয়োজিত ইশতিয়াক জহির বাংলাদেশের
স্থপতি ইনস্টিটিউটের একজন সক্রিয় এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কি টেকচার
একজন সম্মান সূচক সদস্য। বাংলাদেশে স্থাপত্যে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভের পর তিনি যুক্তরাজ্যে
কম্পিউটার এবং ডিজাইনে পোষ্ট গ্রাজুয়েশন করেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোতে
তার বহু নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।