You are on page 1of 2

কতিপয় এমপি ও আলাদিনের চেরাগ

চিররঞ্জন সরকার
সুকু মার রায় ‘খুড়োর কল’ নামক কবিতায় এক আশ্চর্য কল বা যন্ত্রের কথা বলেছিলেন। যে যন্ত্র ঘাড়ের কাছে লাগালে ওই
খুড়োর ‘খাই খাই’ স্বভাব বেড়ে যায় এবং সে যা পায় তাই খেতে থাকে। আমাদের দেশের কিছু কিছু এমপির মধ্যে যেন ওই
‘খুড়োর কল’ চালু হয়েছে। এমপি হলেই তাদের ‘খাই খাই’ স্বভাব বেড়ে যায় এবং সে যা পায় তাই খেতে থাকে। এমপি
হওয়ার পর খাই খাই স্বভাবের কারণে অবিশ্বাস্য গতিতে বাড়তে থাকে তাদের সহায়-সম্পদ।
জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর কথাই ধরা যাক। যুবদল ও জাতীয় পার্টি র রাজনীতি থেকে ভোল পাল্টে
আওয়ামী লীগে এসে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আঙু ল ফু লে কলাগাছ হয়ে গেছেন তিনি। তাঁর সম্পদ বাড়ছে অস্বাভাবিক
গতিতে। ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর মাত্র ১০ বছরে সামশুল হক চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রীর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে
অন্তত এক হাজার ৫৪৬ শতাংশ।
উল্লেখ্য, গত কয়েক বছরে ক্যাসিনোকাণ্ডসহ বিভিন্ন উপায়ে জ্ঞাত আয়বহির্ভূ ত সম্পদ অর্জ নের দুর্নীতি দমন কমিশনের
অনুসন্ধানে হুইপ সামশুল হকের নাম উঠে আসে। দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জ নের অভিযোগ তদন্তের প্রয়োজনে জাতীয়
সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন ও সুনামগঞ্জ-১ আসনের
সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনসহ ছয়জনের বিদেশ যাত্রায় সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
কয়েকদিন আগে ক্ষমতাসীন দলের নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকু ল ইসলাম শিমুলের স্ত্রীর নামে কানাডায় বাড়ি
কেনার অভিযোগের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। সম্প্রতি হৃদরোগে মৃত্যুবরণকারী সরকারদলীয় এমপি আসলামুল হকের
সম্পদের যে বিবরণী পাওয়া যায়, এক কথায় তা বিস্ময়কর। তার কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা ৩ হাজার কোটি টাকারও
বেশি। এই টাকা তিনি বিভিন্ন কোম্পানির নামে ঋণ নিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-১৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
করেন আসলামুল হক। এজন্য নির্বাচন কমিশনে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হয়েছিল তাকে। এতে উল্লেখ করা ছিল,
রাজধানীর আমিনবাজার এলাকায় তার সাড়ে তিন বিঘা জমি রয়েছে। এর পাঁচ বছরের মাথায় ২০১৩ সালে একই আসনে
প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য হলফনামা জমা দেন আসলামুল হক। এতে তিনি দেখিয়েছেন, তার মালিকানাধীন জমির পরিমাণ ১৪১
একরের বেশি। এভাবে তার সহায়-সম্পত্তি বাড়তেই থাকে। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয় তাঁর সম্পদের বিস্তার।
আমাদের দেশে কিছু কিছু মানুষের কাছে রাজনীতিটা এখন টাকা বানানোর মেশিনে পরিণত হয়েছে। কোনো রকমে নমিনেশন
‘বাগিয়ে’ নিয়েই শুরু হয়ে যায় টাকা বানানোর অভিযান। এদেশে এমপি হওয়া মানে যেন কিছু মানুষের ‘আলাদিনের চেরাগ’
হাতে পাওয়া। এই চেরাগের জাদুতে অর্থ-বিত্ত-সহায়-সম্পদ কেবল বাড়তেই থাকে। নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যবসা, লাইসেন্স-
পারমিটবাজি, কমিশন বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, দখলসহ নানা কায়দায় তারা টাকার পাহাড় গড়ে তোলেন।
অবশ্য সাধারণ মানুষ তাদের টাকা বানানোর কায়দা-কৌশল অনেক ক্ষেত্রেই জানতে পারে না। আর জানবেই বা কি করে?
বাজারের যা পরিস্থিতি, চালের যা দাম, তাতে দুবেলা খাবার জোটাতেই হিমশিম, সেখানে চিন্তা করা তো বিলাসিতা! আর
সবাই যদি চিন্তা করতে বা ভাবতে শুরু করে তাহলে এই ধনের কাঙাল এমপিদের তো কপাল পুড়বে! এটাও একটা নীতি যে
সাধারণ মানুষকে সব সময় রুটি-রুজির সমস্যায় জর্জ রিত রেখে নিজের আখের গোছানোর চেষ্টা করা। তাদের প্রধান ভাবনা
কীভাবে চাকরিটা টিকিয়ে রাখা যায় আর মাল কামানো যায়! একবার এমপি-মন্ত্রী হতে পারলে খাওয়া-পরার অভাব থাকে না।
সঙ্গে দেদার বিলাসিতা। শুধু কি নিজের? একই সঙ্গে আগামী কয়েক প্রজন্মের বসে খাবার ব্যবস্থাও পাকা করা চাই।
তারা জনগণের জন্য কিছুই করেন না, তেমন নয়। তারা জনগণের কথাও ভাবেন, কী করে জনগণকে ভু লিয়ে শান্ত রাখা
যায়, কী করে অনন্তকাল নিজেদের স্বার্থোদ্ধার করা যায়। জনগণের জন্য কোন কাজটা করলে (মানে সেই খুড়োর কলের মুলো)
জনগণ খুশি থাকবে এবং লাভের অঙ্কও অনেক বেশি হবে, তেমন কাজ তারা কিছু করেন বটে।
ধরা যাক কোনো এক জায়গায় রাস্তা নেই, সেখানে রাস্তা বানানো হলো। ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার কাজের ভার পেল। জনগণ রাস্তা
পেয়েই খুশি। সে রাস্তা ভালো না খারাপ, কত খরচ-এসব অসাধারণ ব্যাপার তো আর সাধারণের জানার কথা নয়! জনগণ
খুশি, ঠিকাদার লাভের অঙ্ক বুঝে নিয়ে খুশি, আর মন্ত্রী বা এমপি এক ঢিলে দুই পাখি মেরে দ্বিগুণ খুশি। একটা পাখি জনগণ
কে খুশি রাখা, আরেকটা ঠিকাদারের কাছে লাভের অংশ বুঝে নেওয়া। এটা একটা অতি সামান্য উদাহরণ মাত্র।
রাজনীতির ব্যবসায় এই হলো সুবিধা, যতদিন গদিতে, লোকসানের কোনো ভয় নেই, বিনা ইনভেস্টে শুধু লাভ আর লাভ।
ভয় শুধু একটাই যদি কখনও এই সুখের ঘরে আগুন লাগে!
আমাদের দেশের সিস্টেমটাও বড় অদ্ভূ ত। আজ পর্যন্ত এমন উদাহরণ খুব কমই দেখা গেছে যে, দুর্নীতির কারণে জনগণ
কোনো নেতা বা নেত্রীকে ভোট দেয়নি! অদ্ভু ত এই দেশ! এদেশে মেধাবী হয়েও চাকরি পাওয়া যায় না, কিন্তু একজন ফৌজদারি
মামলায় অভিযুক্ত অপরাধী ব্যক্তিও অনেক ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি হয়ে অনেকের চাকরি দিতে পারেন।
একটা ভালো কাজ তা সে যে দলই করুক, সমস্ত রাজনৈতিক দল সেটা সমর্থন করে প্রশংসা করেছে, এমন দৃষ্টান্ত আমাদের
দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের কর্তাব্যক্তিরাই চান না যে তার দলের সবচেয়ে সৎ ব্যক্তিটি
নেতা হোক, নির্বাচিত হোক। যদিওবা হয়, তাহলে সবাই মিলে তাকে অযোগ্য-অথর্ব বানিয়ে দেন। সে কোনো কাজই করতে
পারে না, তাকে করতে দেওয়া হয় না। বর্ত মান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিতে সততা বা সৎ মানুষের কোনো ভাত নেই।
এদেশের মানুষকে নিয়ে প্রহসনের কোনো শেষ নেই। একটা বড় তামাশার নাম হলো বিজ্ঞাপন। রেডিও-টিভিসহ গণমাধ্যমে
বিজ্ঞাপন দেখিয়ে নিরন্তর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে উপহাস করা হয়। যদিও এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, তবু একটু বলা দরকার। যে
দেশে বেশিরভাগ মানুষের দুবেলা খাওয়া জোটে না, অনেক মানুষ ফু টপাতে রাত কাটায়, সেখানে দুধ, স্ট্রবেরি, আপেল, পিচ
ইত্যাদি দামি ফলের তৈরি তথাকথিত রং ফর্সা করার মুখে মাখার ক্রিম, সাবান বা শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন কিংবা দামি মোবাইল
সেট, টিভি ফ্রিজের বিজ্ঞাপন নিদারুণ উপহাস বা ব্যঙ্গ ছাড়া কি?
আসলে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের অনেকেই লুটপাট আর নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া আর কিছুই ভাবতে
পারেন বলে মনে হয় না। এই রাজনীতিবিদ নামক ব্যবসায়ীদের এই লুটপাটের টাকা কোথায় যায়? পাচার হয়ে বিভিন্ন দেশে
চলে যায়। এর একটা বড় অংশ যায় সুইস ব্যাংকে। ২০২০ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক)
বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্র্যাংক, স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৫ হাজার ২৯১ কোটি টাকা।
অবশ্য আগের বছরের চেয়ে এর পরিমাণ কিছুটা কমেছে। উল্লেখ্য, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি নাগরিকদের সঞ্চিত টাকা অন্তত
১২টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সমান।
নিউইয়র্ক ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর
গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। বর্ত মান বাজারদরে তা ৬৪ হাজার কোটি টাকা। জিএফআই-র তথ্যমতে,
কয়েকটি মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়। এর মধ্যে রয়েছে আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং),
রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি, ভিওআইপি ব্যবসা ইত্যাদি। এছাড়া কয়েক বছর ধরে সরাসরি
বিদেশে ডলার নিয়ে যাওয়ার তথ্যও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
আশঙ্কার বিষয় হলো, প্রতিবছর নানাভাবে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে। আইনগতভাবে দেশের বাইরে টাকা
নিয়ে যাওয়ার সুযোগ না থাকলেও গত দেড় দশকে অনেক বাংলাদেশি মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, সিঙ্গাপুর, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র,
অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে বাড়ি-ফ্ল্যাট ক্রয়ে এবং বিভিন্ন ব্যবসায় হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। নানা প্রক্রিয়ায়
দেশ থেকে প্রতি বছর শত শত, হাজার হাজার কোটি পাচার হয়ে যাচ্ছে, আর আমরা বসে বসে কেবল আঙ্গুল চু ষছি! যেন
এর বাইরে আমাদের কিছুই করার নেই!

You might also like