Professional Documents
Culture Documents
জয়-বাংলা-পরিবারের-৭২-বছর
জয়-বাংলা-পরিবারের-৭২-বছর
১.
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত। ভারতে নেহেরু পরিবার,
পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবার, শ্রীলংকায় বন্দরনায়েক, মায়ানমারে অং সান-
উত্তরাধিকারসূত্রে দেশ শাসন করেছে। এই পরিবারতন্ত্রের বাইরে গিয়ে নতুন
রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টির দাবিতেও সোচ্চার বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বীরা।
বাংলাদেশে তেমনই বঙ্গবন্ধু পরিবার। এবং এই পরিবারের সীমা বঙ্গবন্ধু কিংবা
তার কন্যা শেখ হাসিনায় আটকে নেই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগানকে ক্বলবে
ধারণ করা প্রতিটি বাঙালী এই পরিবারের সদস্য। এই বাংলার, এই বদ্বীপের
সকল অর্জন, সকল ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগ। ভাষা আন্দোলন, আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে ৬দফা, ৬৯এর
গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, স্বৈরাচারবিরোধী
আন্দোলন- আওয়ামী লীগকে কোথাও থেকে সহজে মুছে ফেলা যাবে না।
২.
আওয়ামী লীগের আজকের অবস্থানে আসতে কম ঝঞ্ছা পোহাতে হয়নি। পাকিস্তান
হওয়ার পর তখন দুই পাশেই মুসলিম লীগের জয় জয়কার। পূর্ব পাকিস্তানে
মুসলিম লীগের হাল সব এলিটদের হাতে। নবাব ফ্যামিলির লোকজন, চোস্ত উর্দুতে
বাতচিৎ করা লোকজন। সেখানে আমজনতার ঠাই নাই। কলোনিয়াল শাসন থেকে
মুক্তি পেয়ে বাঙালী ঢুকে পড়লো আরেক উপনিবেশবাদে। রাজনীতিতে এই
জনতাকে সম্পৃক্ত করতে, রাজনীতিকে ধনীদের হাত থেকে মুক্তি দিতেই জন্ম
নিলো আওয়ামী লীগ। আওয়ামী মানে জনতা। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন কেএম দাস
লেনের রোজ গার্ডেনে জন্ম নিলো আওয়ামী মুসলিম লীগ। ৬ বছর পর
ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির চর্চায় মুসলিম শব্দটি ঝেড়ে ফেললো এই সংগঠন। ১৯৫৪
সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২২৩টি আসনের ১৪৩টি আসনই জিতেছিলো
আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিয়েছিলো মুসলিম লীগকে। তারা আর
কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দল হয়ে
দাড়ায় আওয়ামী লীগ। ১৯৫৭ সালে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক মতপার্থক্যে মাওলানা
ভাসানী আলাদা হয়ে ন্যাপ গড়লেন। আওয়ামী লীগ চলে এলো শেখ মুজিবুর
রহমানের ডায়নামিক নেতৃত্বে।
পাকিস্তানে সামরিক শাসন শুরুর পর জান্তার মাথা ব্যথার নাম হয়ে যায় আওয়ামী
লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হেন অজুহাত নেই যা ব্যবহার করে তাকে
জেলে ঢোকানো হয়নি। তার মতো এতো দীর্ঘ সময় জেল খাটেননি আর কোনো
নেতা। যাবজ্জীবনের আসামী জেল খাটে ১৪ বছর, বঙ্গবন্ধু খেটেছেন প্রায় ১৩
বছর। নির্দিষ্ট করে বললে ৪ হাজার ৬৭৫ দিন! এই অন্তর্বর্তী সময়েই তিনি
দিয়েছেন স্বাধীনতার রূপরেখা। ৬ দফার ধারাবাহিকতায় এলো ৭ মার্চ- এবারের
সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। নেতার
তর্জনী হেলনে বাঙালী বুঝে নিলো যুদ্ধ করে মাতৃভুমি ছিনিয়ে নেয়ার সময়
এসেছে। সেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তার দুই বছর
আগে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীকে পূর্ব পাকিস্তানের নাম
বাংলাদেশ বলে ঘোষণা দিলেন বঙ্গবন্ধু। ওই নামেই এখন ওড়ে আমাদের লাল
সবুজ পতাকা।
স্বাধীনতার পর সময়টা ছিলো বড্ড কঠিন! যুদ্ধবিধ্বস্ত, তলাবিহীন ঝুড়ির দেশকে
বিনির্মাণের দায়িত্বে ছিলো আওয়ামী লীগ। এর মধ্যেই এলো আঘাত। ৭৫ এর ১৫
আগস্ট হত্যা করা হলো জাতির জনককে। তারপর আবার একাত্তরের মতো
চললো নির্মূল অভিযান। শুরু হলো আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র।
বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চক্রান্ত। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে টিকে গেলো আওয়ামী লীগ।
৮১তে ফিরলেন শেখ হাসিনা। ঘুরে দাড়ালো আওয়ামী লীগ। লাঠি গুলি
টিয়ারগ্যাস, আর্জেস গ্রেনেডেও ঠেকানো গেলো না তার উত্থান। গত ১৩ বছর ধরে
শাসনক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এই একযুগ সমৃদ্ধির যুগ। উন্নয়নের সোপান বেয়ে
তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তলাবিহীন ঝুড়ির সেই দেশটা এখন মধ্যম
আয়ের দেশ! পাকিস্তান ভারতের চেয়েও এগিয়ে গড় প্রবৃদ্ধিতে।
৩.
এই লম্বা যাত্রাপথে এমন নয় কোনো ভুল ছিলো না। খন্দকার মোশতাকের মতো
ডানপন্থীদের দলে রাখার মূল্য জীবন দিয়ে চুকিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। শেখ হাসিনার
দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ অন্যায় সমঝোতার। যে স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে
লড়তে গিয়ে জীবন দিলেন নুর হোসেন, সেই স্বৈরাচারের দলকে জোটসঙ্গী করার
সমঝোতা। ২০১৩ সালের পর হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সমঝোতা। এর মূল্য
কম দিতে হয়নি। গত ৮ বছরে মৌলবাদের ভয়াবহ উত্থানের অন্যতম কারণ ছিলো
এই সমঝোতা। পড়ার বই পাল্টে গেছে, দলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে সাম্প্রদায়িক
ঘরানার লোকজন! আশার কথা সেই ফাঁদ কেটে বেরোতে পেরেছে দল। যদিও
অন্যান্য দলগুলো নিয়ে মহাজোট করে সরকার চালায় আওয়ামী লীগ, কিন্তু তারা
কেউ অপরিহার্য্য নয়। আওয়ামী লীগ নিজের জোরেই চলার মতো অবস্থানে
বহুদিন। রাস্তা থেকে মোল্লাদের দূরে রাখতে যে সমঝোতা সেটাও ভেঙ্গে কঠোর
অবস্থানে এখন সরকার।
হ্যা দলে দূর্নীতিবাজ আছে। অসৎ লোক আছে। সাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ
আছে। অপরাধী আছে। কিন্তু তারা গুটি কয়েক। সামষ্টিক আওয়ামী লীগের
গাণিতিক হিসেবে তারা অতীব সংখ্যালঘু। দিনরাত প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়ে
টিকে থাকা লাঠির জোরে নয়। এই টিকে থাকা পরিবারের সদস্যদের
ভালোবাসায়। আওয়ামী পরিবারের লোকজন অত্যাচার সয়ে বড় হয়েছে। ত্যাগের
রাজনৈতিক দিক্ষায় দিক্ষিত তারা। সরকারে আসার পর প্রচুর নতুন মুখ দেখা যায়।
এদের গায়ে গতরে চর্বিও অনেক। তেল মেরে মেরে বিস্ময়কর উত্থান অনেকের।
ত্যাগীদের হতাশ করে এরা অনেক কিছুই বাগিয়ে নিচ্ছে। কেউ কেউ ধরা পড়ছে,
জেলে যাচ্ছে। আমরা জানি দলের বিপদে এরা থাকবে না। কিন্তু এদের অপরাধের
দায় আমাদেরই নিতে হবে। তারপরও আমরা আশাহত নই। আওয়ামী লীগের
ঘরের মধ্যে রাজনীতি এতো বেশী যে তারা এ কারণেই মাঠের রাজনীতিতে
অপরাজেয়।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু