You are on page 1of 2

যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার দীক্ষা ও আরশির মুখে পড়শি দেখা

দীর্ঘ দুই দশকের যুদ্ধ শেষে, আফগানিস্তান হতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার চলাকালেই তালেবান সরকার
আফগানিস্তানের দখল নেয়। উদ্ভূ ত সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে সেসময় কাবুল বিমানবন্দরে যাত্রীদের দেশ ছাড়ার হিড়িক
চলছিল। বিরাজ করছিল ব্যাপক আতঙ্ক ও অরাজকতা। ২৬শে আগস্ট কাবুল বিমানবন্দরে আফগানিস্তানে ইসলামিক
স্টেট গ্রুপের স্থানীয় শাখা আইএস-কে এর সন্ত্রাসী হামলার কয়েকদিন পরই ভয়াবহ একটি ড্রোন হামলা চালায়
যুক্তরাষ্ট্র। একদিকে যদ্ধেু পরাজয়ের গ্লানি এবং অন্যদিকে আইএস-কে এর হামলার প্রতিশোধের প্রেক্ষাপটেই চালানো হয়
এই ড্রোন হামলাটি। পরবর্তীতে, জানা যায় আইএস-কে এর সদস্য সন্দেহে জামাইরি আহমাদি নামক যে ব্যক্তিকে লক্ষ্য
করে এই ড্রোন হামলাটি চালানো হয়, তিনি ছিলেন পেশায় একজন ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার এবং আফগানিস্তানে
ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক সংস্থা নিউট্রিশন অ্যান্ড এডু কেশন ইন্টারন্যাশনালের দীর্ঘদিনের কর্মকর্তা। ঐ হামলায় তার
পরিবারের দশজন বেসামরিক লোক নিহত হয়। পরবর্তীতে, যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি
ঘটনাটিকে 'ট্রাজিক মিসটেক' হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু, জীবন নিয়ে এ কেমন ভু ল। এই ভুলের পর আফগানিস্তানে
মার্কি ন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

'ফরেন পলিসি'তে চার্লি কার্পেন্টারের লেখা অনুযায়ী, টার্গেটেড কিলিং মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই বিষয়ে
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। তবে ৯/১১ এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রতিনিয়ত এই আইনগুলি লঙ্ঘন করে
আসছে। যাইহোক, এটিই একমাত্র নিষেধাজ্ঞা নয় যা মার্কি ন যুক্তরাষ্ট্র লঙ্ঘন করেছে। গত বছর জানয়ু ারিতে, ইরাকে
যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় সোলাইমানির হত্যাকাণ্ড ‘ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের’ প্রকৃ ষ্ট উদাহরণ। যক্ত
ু রাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে
সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছিলেন এই নেতা। যার কারণে হত্যা করা হয় সামরিক এই কৌশলবীদকে। ঐ
হামলায় আরও নিহত হন ইরাকি সিনিয়র মিলিশিয়া কমান্ডার আবু মাহদি আল-মুহান্দিস৷ পরবর্তীতে, ইরানের আরেক
পরমাণু বিজ্ঞানীকেও হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আইনানসু ারে, এরা সকলেই ছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত ব্যক্তি।
এসব 'টার্গেটেড কিলিং' ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে গৃহীত আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত ব্যক্তিদের
সাথে সম্পর্কি ত আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়মের পরিপন্থী। আন্তর্জাতিক আইন এবং নিয়ম ছাডা় ও, টার্গেটেড কিলিং হলো
'বিচারবহির্ভূ ত হত্যাকাণ্ড', এবং এটি যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া এবং 'ন্যায়বিচারের অধিকার' কে অতিক্রম করে। সম্প্রতি
দ্যা গার্ডি য়ান পত্রিকা হতে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, ৯/১১ এর পর দীর্ঘ ২০ বছরে মার্কি ন ড্রোন এবং বিমান হামলায় কমপক্ষে
২২ হাজার বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। এসব আইন লঙ্ঘনের পরও যুক্তরাষ্ট্র জেনারেল সোলেইমানির হত্যাকে
ন্যায়সঙ্গত বলে উল্লেখ করেছে এবং মার্কি নিদের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনে আরও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দেয়
পেন্টাগন।

মার্কি ন সমাজ প্রতিনিয়ত বর্ণবাদী বৈষম্য, বিচারবহির্ভূ ত হত্যাকাণ্ড এবং পুলিশের সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। উপরন্তু,
বিচারবহির্ভূ ত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও রয়েছে দায়মুক্তির সংস্কৃ তি। 'গণতন্ত্র ও মানবাধিকার চ্যাম্পিয়ন' নামে পরিচিত
যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশেই মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। আমেরিকায় পলি
ু শের মধ্যে বর্ণবাদ ও পলিু শের সহিংস আচরণ দীর্ঘদিনের
একটি সমস্যা। মূলত, কৃ ষ্ণাঙ্গদের সম্পর্কে পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গদের ধারণা এখনও দাসত্ব ও উপনিবেশবাদের সময়েই
আটকে আছে৷ এরমধ্যে ২০২০ সালের মে মাসে, মহামারীকালীন যুক্তরাষ্ট্রে মিনিয়াপোলিস শহরে একজন শ্বেতাঙ্গ
পুলিশের নির্যাতনে কৃ ষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনায় সারাবিশ্বে তীব্র প্রতিবাদের সৃষ্টি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় "ব্ল্যাক
লাইভস ম্যাটার" (বিএলএম) নামে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলনের সূচনা হয়। ফ্লয়েডের মতো আরেক কৃষ্ণাঙ্গ
আমেরিকান, ব্রেওনা টেইলরও একই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। যখন তাকে আটকের অভিযানে পলি ু শ আটবার গুলি
করে। তারপর থেকে, ফ্লয়েড এবং টেইলর জাতিগত সহিংসতা এবং বিচারবহির্ভূ ত হত্যার মুখ হয়ে উঠেছে।
দুর্ভাগ্যবশত, সব ভু ক্তভোগী মিডিয়ার সমান মনোযোগ পায়নি। ম্যাপিং দ্য পুলিশ ভায়োলেন্সের (এমপিভি)
পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০ সালে পুলিশ কর্তৃ ক মোট নিহতদের মধ্যে কৃ ষ্ণাঙ্গ ছিল ২৮%, অথচ আমেরিকার মোট
জনসংখ্যার মাত্র ১৩% হল কৃ ষ্ণাঙ্গ। তদুপরি, পুলিশ ভায়োলেন্স রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী, পুলিশের হাতে ১১২০ জন
নিহত হয়েছে কিন্তু ৯৯ শতাংশ ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনা হয়নি । আমেরিকার আইনে, পুলিশ
অফিসারদের ফৌজদারি এবং দেওয়ানি মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ আইনি সুরক্ষা রয়েছে। এর ফলে এসব
হত্যাকাণ্ড বিচারের আওতামুক্ত থাকে।

২০১০ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃ ক গুম হওয়া বিষয়ক বৈশ্বিক সমস্যা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক একটি চু ক্তি
স্বাক্ষরিত হয়েছিল যা 'এনফোর্সড ডিসাপ্যারেন্স প্যাক্ট' নামে পরিচিত। আশ্চর্যজনকভাবে, এক দশক পরে ২০২০ সালে,
মাত্র ১৩টি ইইউ সদস্যরাষ্ট্র 'আইসিপিপিইডি' কনভেনশনটি অনুমোদন করেছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে, মার্কি ন যুক্তরাষ্ট্র
সর্বদা গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নিশ্চিতকরণে বেশ সোচ্চার থাকে। কিন্তু বিষয়টি যখন এটি তার মিত্রদের বেলায় ঘটে,
তখন যুক্তরাষ্ট্র শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল- এর ভূ মিকা পালন করে। ইসরায়েল, সৌদি আরব এবং মিশর সহ মার্কি ন
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূ ত হত্যা,
নির্যাতন, আইনি অধিকার অস্বীকার করা এবং আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত ব্যক্তিদের হত্যা। 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'
ঘোষণার পর থেকে মার্কি ন যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত 'সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা এবং জাতীয় নিরাপত্তা সমুন্নত রাখার যুক্তি'র
অধীনে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে জোরপূর্বক নিখোঁজের শিকার হয়েছে বহু মানুষ। 'আবু গারিব' এবং 'গুয়ানতানামো বে'-
এর মতো কারাগারগুলো ভিকটিমদের আটকে রাখার জন্য ব্যবহার করা হতো। এআই রিপোর্ট অনযু ায়ী, ২০১৩ থেকে
২০২০ সালের মধ্যে অন্তত ৩৯ জন বন্দী ছিল।

এসব অপরাধ সংগঠিত হওয়ার জন্য মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি সরকারের ভূ মিকাকে দায়ী করছে। অ্যামনেস্টি
ইন্টারন্যাশনালের মতে, বিদ্যমান 'ক্যাসল ডকট্রিন' এবং 'স্ট্যান্ড ইয়ান গ্রাউন্ড' আইন এর ফলে পরিস্থিতির আরও
অবনতি ঘটছে। সম্ভবত, সরকার নিষ্ক্রিয় ভূ মিকা পালন করছে। তাছাডা় , গ্লোবাল টাইমস রিপোর্ট অনুসারে, শুধুমাত্র
২০২০ সালে মার্কি ন যুক্তরাষ্ট্রে ২ মিলিয়ন বন্দুক বিক্রি হয়েছিল। উল্লেখ্য, মহামারীর মধ্যে মার্কি ন প্রশাসন বন্দুকের
দোকানকে অপরিহার্য দোকান হিসাবে তালিকাভু ক্ত করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিয়ত নিজ দেশে মানবাধিকার অবস্থা উপেক্ষা করে, যখন অন্য দেশের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে তখন
ব্যাপারটা অনেকটা আরশির মুখে পড়শি দেখার মতন। নিজ স্বার্থ হাসিলের কৌশল হিসেবে টার্গেটেড দেশগুলোর
মানবাধিকার বিষয় নিয়ে কথা বলে মূলত এসব দেশকে চাপের মধ্যে রাখাই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। মানবাধিকারের
'প্রকৃ ত' চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য; মার্কি ন যুক্তরাষ্ট্রকে তার বৈদেশিক নীতির লঙ্ঘন, দ্বৈততা এবং 'অনৈতিক' দিকগুলি
পরিহার করতে হবে, যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় এর ভূ মিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

(তন্ময় চৌধুরী, ২০২১)

Tonmoy Chowdhury is an independent researcher. He is interested in Refugee and Migration,


Human Security Issues, South Asian Politics and Economic Diplomacy. The views expressed are
personal. He can be contacted at ctonmoy555@gmail.com

You might also like