You are on page 1of 6

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলায় জন্ম নেওয়া একজন বাঙালি কবি এবং পরবর্তী কালে বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক যিনি
বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূ মিকা রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা
সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃ তি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখযোগ্য এবং তিনি ছিলেন বাঙালি
মনীষার এক তু ঙ্গীয় নিদর্শন। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ –

দুই বাংলাতেই তার কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তার কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে বিদ্রোহী কবি
নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তার কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক
অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ।

বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক,
সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক,

রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তার কবিতা ও
গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তার প্রবেশ, ধূমকেতু র মতো তার প্রকাশ। যেমন লেখাতে
বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে – কাজেই "বিদ্রোহী কবি", তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে
প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবনঃ ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মে (জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান


জেলার আসানসোল মহকু মার চু রুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। চু রুলিয়া গ্রামটি
আসানসোল মহকু মার জামুরিয়া ব্লকে অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয়
স্ত্রী জাহেদা খাতু নের ষষ্ঠ সন্তান তিনি।

তার বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাযারের খাদেম। নজরুলের তিন ভাইয়ের মধ্যে
কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন এবং দুই বোনের মধ্যে সবার বড় কাজী সাহেবজান ও কনিষ্ঠ উম্মে কু লসুম। কাজী
নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল "দুখু মিয়া"। নজরুল গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। মক্তবে
(মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কু ল)

কু রআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে তার পিতার মৃত্যু হয়, তখন
তার বয়স মাত্র নয় বছর। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয়

এবং মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকা অর্জ নের জন্য কাজে নামতে হয় তাকে।  6
এসময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে
হাজি পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াযযিন (আযান দাতা) হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইসব
কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ
পান যা পরবর্তীকালে তার সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। 7
তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়। মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল
বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃ ষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান
ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল) দলে যোগ দেন। 8

তার চাচা কাজী বজলে করিম চু রুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফার্সি ও উর্দূ
ভাষায় তার দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ধারণা করা হয়, বজলে করিমের
প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি)
9

এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই সাহিত্য চর্চা শুরু
হয়। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও
কবিতা লিখতেন। নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃ ত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন।
একইসাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ 10 

পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন। সেই অল্প বয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন। এর
মধ্যে রয়েছে চাষার সঙ, শকু নীবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি
কালিদাস, বিদ্যাভূ তু ম, রাজপুত্রের গান, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ এবং মেঘনাদ বধ। একদিকে মসজিদ, মাজার ও
মক্তব জীবন, অপর দিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক 11

জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে। নজরুল কালীদেবীকে নিয়ে প্রচু র শ্যামা সঙ্গীত ও রচনা করেন, নজরুল
তার শেষ ভাষনে উল্লেখ্য করেন - “কেউ বলেন আমার বানী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর
কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে
গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।”12

১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। লেটো দলে তার প্রতিভায় সকলেই যে মুগ্ধ
হয়েছিল তার প্রমাণ নজরুল লেটো ছেড়ে আসার পর তাকে নিয়ে অন্য শিষ্যদের রচিত গান: "আমরা এই অধীন,
হয়েছি ওস্তাদহীন / ভাবি তাই নিশিদিন, বিষাদ মনে / নামেতে নজরুল ইসলাম, কি দিব গুণের প্রমাণ", 13

এই নতু ন ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কু ল ছিল রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কু ল, এরপর ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ
ইংরেজি স্কু লে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। মাথরুন স্কু লের তৎকালীন প্রধান
শিক্ষক ছিলেন কু মুদরঞ্জন মল্লিক যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তার সান্নিধ্য নজরুলের
14

অনুপ্রেরণার একটি উৎস। কু মুদরঞ্জন স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে নজরুল সম্বন্ধে লিখেছেন,
“ ছোট সুন্দর ছনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাশ পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি
হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল। ”
যাহোক, আর্থিক সমস্যা তাকে বেশ দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। 15

ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে। এর পর
একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডে র খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ
নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময়
আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ'র সাথে তার পরিচয় হয়।16

দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয়
পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কু লে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে
দেন। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কু লে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে
পড়াশোনা শুরু 17

করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না
দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। এই স্কু লে অধ্যয়নকালে নজরুল এখানকার চারজন শিক্ষক
দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এরা হলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী চেতনাবিশিষ্ট নিবারণচন্দ্র
ঘটক, ফার্সি সাহিত্যের হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্য চর্চার নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।18

নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় এক মসজিদে
সম্মানিত মুয়াযযিন হিসেবেও কাজ করেছিলেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি
কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর
তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের
বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মতো কবিতা; ধূমকেতু র মতো
সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী, এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল
সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার
সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন।
ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতু ন ধারার
জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল, এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃ ষ্ট শ্যামা সংগীত ও হিন্দু
ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন
নজরুল সঙ্গীত বা "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়।

ত্রিশাল এ আগমনঃ ১৯১৪ সালে নজরুল প্রতিভায় বিমুগ্ধ দারোগা রফিজউল্লাহর মাধ্যমে প্রথম ময়মনসিংহ
আসেন।

আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখায় পাওয়া যায়, ১৯১৪ সালে কাজী রফিজউল্লাহ দারোগা নজরুলকে ভর্তি
করানোর জন্য তাঁর পাশের বাড়ির ছেলে কাজী ইসমাইলের সাথে ময়মনসিংহের সিটি স্কু লে পাঠান । নজরু লে র না-
কি স্কু লটি পছন্দ হয়েছিল কিন্তু জায়গীর না পাওয়ায় ওই স্কু লে পড়ার সৌভাগ্য হয়নি নজরুলের । একই সালের জ ু ন
মাসে কাজী নজরুল ইসলাম ও ছোট ভাই কাজী আবুল হোসেনকে দরিরামপুর ইংরেজি হাইস্কু লে (বর্ত মানে
নজরুল একাডেমি) ভর্তি করান দারোগা সাহেব।19

কাজীর শিমলা গ্রাম থেকে ত্রিশালের দরিরামপুরের দূরত্ব ছিল পাঁচ কিলোমিটার। এই পাঁ চ কি লোমি টার পথ হেঁটে
যেতে হতো নজরুলকে স্কু লে ক্লাস করার জন্য। বর্ষাকালে রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ত। ফলে স্কু লে
যাতায়াতে খুব কষ্ট হতো নজরুলের। এই অসুবিধা লাঘব করার জন্য দারোগা সাহেব ত্রিশালের নামাপাড়ায় তাঁর
আত্মীয় কাজী হামিদুল্লাহর 20

বাড়িতে জায়গীর রাখেন নজরুলকে। কিন্তু হামিদুল্লাহ ছি লে ন ধার্মি ক , পরহেজগার ও গম্ভীর প্রকৃ তির লোক।
নজরুল নামাজ পড়তেন না, এজন্য তিনি নজরুলকে ঘৃণা করতেন এবং শাসনে রাখতেন।21

কাজী নজরুল ইসলাম এর স্মৃতিরক্ষায় ত্রিশালে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠান এবং যে সকল প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে তার
বিবরণঃ বিভিন্ন লেখকের লেখা থেকে পাওয়া যায়, কাজীর শিমলায় নজরুল তিন মাস অবস্থান করেছেন। সে খানে
অনেক স্বাধীনতা ছিল নজরুলের। কিন্তু জায়গীর বাড়িতে এতো স্বাধীনতা ছিল না। তাই নজরুল বাঁশি বাজানো,
গান গাওয়া, রাস্তাঘাট,22

বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো, একটি বটগাছে চড়ে বাঁশি বাজানো ইত্যাদি করতেন। নজরু ল তখন তেমন প ড়া শো না
করতেন না। তাই নজরুলকে আশ্রয়হীন হতে হয়। পরে তিনি বিচু তিয়া বেপারীর বাড়িতে জায়গীর থাকেন। বেপারী
বাড়ির পূর্ব দিকে একটি ছোট পুকু র ছিল। সেই ঘরেই নজরুল থাকতেন। অবশ্য পুকু রটিতে নজরুল গোসল
করতেন না।23

পাশের বাড়ির আরেকটা পরিষ্কার পানির পুকু রে তিনি গোসল করেছেন। কবির স্মৃ তি বি জ ড়ি ত এ বাড়ি তেই তাঁ র
স্মৃতি রক্ষার্থে সংস্কৃ তি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে তিনতলা বিশিষ্ট ‘নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র’। প্রথম তলায়
অডিটোরিয়াম, দ্বিতীয় তলায় অফিস রুম এবং তৃ তীয় তলায় লাইব্রেরি রয়েছে। এ ছা ড়াও কবি যে ঘরে ঘ ু মাতেন ;
সেই ঘরটি পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে। পাশেই একটি প ু কু র খনন করা হয়েছে।24

নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত দরিরামপুর হাই স্কু লের নাম এখন নজরুল একাডেমি। কবি জীবি ত থা কা অব স্থ ায় এ বং
জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃ তি পাওয়ার আগেই ১৯৬৫ সাল থেকে এ বিদ্যালয় মাঠে জাঁকজমকপূর্ণ নজরুল
জন্মজয়ন্তী পালন শুরু হয়। ১৯৯০ সালে এ স্কু ল মাঠে রাষ্ট্রীয়ভাবে জন্মজয়ন্তী পালন শুরু হয়। ২০১৮ সালে
মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিকে সরকারিকরণ করা হয়।25
এছাড়াও সংস্কৃ তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রফিজউল্লাহ দারোগা বাড়ির আঙিনায় নির্মাণ করা হয়েছে নজরুল
পাঠাগার ও স্মৃতি ভবন। সংরক্ষ ণ করা হয়েছে নজরু ল যে খাটে ঘ ু মাতেন ; সেই খাটটিও।

নজরুল ত্রিশালের নামাপাড়ায় শুকনি বিলের কাছে যে বটগাছে চড়ে বাঁশি বাজাতেন; সেই বটগাছের পাশেই শুকনি
বিলের মাঝে প্রতিষ্ঠা 26

করা হয়েছে কবির নামে বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। নজরু লে র সাহি ত্যকর্মের
ওপরে গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল ইনস্টিটিউট। জাতীয় কবির বিভিন্ন গান, কবিতা,
উপন্যাস, নাটক সর্বোপরি তার জীবনী এবং জীবনকর্মের ওপর গবেষণা চলমান রাখার জন্য বিভিন্ন শাখায়
পিএইচডি এবং এমফিল প্রোগ্রাম কোর্স চালু রয়েছে।27

এ ছাড়াও নজরুল চেতনা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে প্রতিটি বিভাগে বাধ্যতামূলক নজরুল স্টাডিজ নামে একটি কোর্স
পড়ানো হয়। ক্ যাম্পাসজ ু ড়ে ই যেন নজরু লে র ছোঁ য়া, নজরুলের স্মৃতি। ‘চির উন্ন ত মম শির’ নামক স্মৃ তি সৌধ আর
‘চক্রবাক’ নামক ক্যাফেটেরিয়াই নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি আবাসিক হলের নামও নজরুলের সৃষ্টিকর্মের নামে।
‘প্রভাতি’, ‘ঝিঙেফু ল’, ‘বিদ্রোহী’ ও ‘প্রলয়শিখা’ বাসের নাম আর দুটি মঞ্চের নাম ‘চু রুলিয়া’, ‘গাহি সাম্যের
গান’র পাশাপাশি একমাত্র মেডিকেল সেন্টারের নামও নজরুলের বইয়ের নামে ‘ ব্যথার দান’ । শি ক্ষ ার্থ ীদের জ ন্য
প্রচলিত বৃত্তিগুলোর নামকরণ করা হয়েছে কবিপরিবারের সদস্যদের নামানুসারে, ‘প্রমিলা বৃত্তি’, ‘বুলবুল বৃত্তি’,
‘কাজী অনিরুদ্ধ বৃত্তি’। কে ন্ দ্রীয়গ্রন্থা গারে রয়েছে নজরু লে র বইয়ের আ লাদা ক র্ন ার।

কবি নজরুলের ওপর গবেষণাসহ 28

তার চেতনা, কর্মকে আরও বিস্তৃ ত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চু ক্তি করে চলেছেন। এর মধ্যে উল্লে খযো গ্য- ২০১৮ সালের জুলাই মাসে
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে দুই বঙ্গে কবি নজরুলের নামাঙ্কিত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়
সমঝোতা চু ক্তি; যার মাধ্যমে নজরুল বিষয়ক গবেষণা বিনিময়, গবেষক বিনিময়, যৌথ গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ, যৌথ
নজরুল গবেষণা জার্নাল প্রকাশ, যৌথ নজরুল আর্কাইভস প্রতিষ্ঠিত, যৌথ স্টু ডিও ইত্যাদি আরও অনেক বিষয়ের
ওপর কাজ হচ্ছে। ২০১৯ সালের ডি সে ম্বরে জা তীয় কবি কা জী নজরু ল ইস লাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টি টি উট অব
নজরুল স্টাডিজ এবং ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের ফেরদৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক চু ক্তি,
যার মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্ম ও মূল্যবোধ ছড়িয়ে
দেওয়া হচ্ছে।29

Start
ত্রিশাল থেকে প্রস্থানঃ নজরুল ত্রিশাল থেকে চলে যাওয়ার নির্দি ষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কে উ কে উ
মনে করেন, নজরুল সপ্তম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে প্রথম কি দ্বিতীয় হয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ফারসি বিষয়ে
আটানব্বই পেয়েছিলেন নজরুল। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ফেল করেছিলেন ফারসি বিষয়ে। তাই প্রধান শিক্ষক গ্রেস
মার্ক দিয়ে পাস করে দিতে বললে নজরুলও গ্রেস মার্ক দাবি করেন। মার্ক না পেয়ে নজরুল বলেন, ‘যে স্কু লে ন্যায়
বিচার নেই, সেই স্কু লে নজরুল পড়বে না।’ এ ঘট নার দু’দিন পরে নজরু ল ও আব ু ল হোসেন ময়মন সি ংহে যান।
সন্ধ্যা নাগাদ আবুল হোসেন ফিরে এলে নজরুল আর আসেননি।

নজরুল তার বাকি জীবনে পূর্ববঙ্গে (বাংলাদেশে) বহুবার এলেও কখনো আসেননি ময়মনসিংহের ত্রিশাল। এমনকি
গফরগাঁওয়ে ১৯২৬ সালের ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ময়মনসিংহ জেলা কৃ ষক-শ্রমিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত
হয়েও আসতে পারেননি। তবে শু ধ ু ত্রিশালই নয়, নজরুল সুস্থাবস্থায় এরপর জন্মস্থান চু রুলিয়ায়ও যাননি।

১৯১৭ সালে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে যুদ্ধে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে ফেরতও আসেন। তবে
এরপর তিনি একবারের জন্যও চু রুলিয়া যাননি। চু রুলিয়ার সেই বাড়িতে দেয়ালে টাঙানো ছবি বলছে, নজরুল
আরও দুবার চু রুলিয়া এসেছিলেন; কিন্তু সে দু’বার তিনি ছিলেন রোগ-পরবর্তী জীবনের। পরি বারের সদ স্যরা তাঁ কে
নিয়ে গিয়েছিলেন চু রুলিয়ায়, কিন্তু তিনি জানতেন না যে তিনি চু রুলিয়ায় গিয়েছিলেন।

১৯২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বারবার পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছুটে আসেন।
বরিশাল, কু মিল্লা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, রংপুর, কু ষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, চু য়াডাঙ্গা প্রভৃ তি
অবিভক্ত বাংলার পশ্চাৎপদ জনপদসমূহের মানুষের কাছে এসেছেন, সভা ও অনুষ্ঠান করেছেন। ওইসব জ মায়েতে
তিনি জাগরণের কথা বলেছেন, স্বাধীনতার বাণী শুনিয়েছেন, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মন্ত্র দিয়েছেন।
অর্থাৎ কাজী নজরুল ইসলাম অবিভক্ত বাংলার বৃহৎ অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে জাগিয়ে তু লেছেন বক্তৃ তায় ,
গানে, আবৃত্তিতে এবং তাঁর বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে। ‘ স ুন্দরের ধ্ যান, তার স্তবের গানই আমার উপাসনা,
আমার ধর্ম যে কলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈবা। আমি তাকে ছাড়ি য়ে উঠতে
পেরেছি বলেই কবি।’ এভাবেই নিজের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে তার সাহিত্যকর্মে ধারণ করেছিলেন।

পুনঃরাই বাংলাদেশে আগমন ও প্রয়াণঃ ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে নজরুলকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারি
আদেশের প্রতিলিপি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে
একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি
নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে
বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের
নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারি আদেশ জারী করা হয়। মধ্যবয়সে তিনি পিক্স ডিজিজে আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু
তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এরপর যথেষ্ট
চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে কবির সবচেয়ে ছোট ছেলে এবং
বিখ্যাত গিটারবাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে।
জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ
করেন। নজরুল তার একটি গানে লিখেছেন, "মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে
মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই":- কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয়
মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তার সমাধি রচিত হয়। তবে প্রমিলা দেবীর শেষ
ইচ্ছা ছিল তাঁর স্বামীকে যেন তাঁর কবরের পাশে (চু রুলিয়ায় নজরুলের পৈতৃ ক বাড়িতে) সমাধিস্থ করা হয়। কিন্তু
প্রমিলার শেষ ইচ্ছাটি আর পূরণ হয়ে উঠে নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে অন্তিম শয়নে কবি নজরুল ইসলাম


তার জানাজার নামাজে ১০ হাজারেরও অধিক মানুষ অংশ নেয়। জানাজা নামায আদায়ের পরে রাষ্ট্রপতি আবু
সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়াল এডমিরাল এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল
এ জি মাহমুদ, মেজর জেনারেল দস্তগীর জাতীয় পতাকামণ্ডিত নজরুলের মরদেহ বহন করে সোহরাওয়ার্দী ময়দান
থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে নিয়ে যান। বাংলাদেশে তার মৃত্যু উপলক্ষে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত
হয় এবং ভারতের আইনসভায় কবির সম্মানে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

তিনি আজীবন অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন,
দেখিয়েছিলেন। ধর্মীয় গোঁ ড ়া মি , মানবিকতা, মূল্যবোধ, ভালোবাসাকে যিনি বেঁধেছেন একই সুতোয়, সেই কবি কাজী
নজরুলের সাহিত্য অনুপ্রাণিত করবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। তাদের হাত ধরেই কবির স্বপ্নের সো নার ব াং লা রূপ
ধারণ করবে বাস্তবে। বিদ্রোহী কবি সমাজে যে অনির্বাণ প্রদীপ জ্বালিয়েছেন, তার আলোকচ্ছটায় দূরীভু ত হবে সব
অন্ধকার।

You might also like