You are on page 1of 3

স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীনতা তু মি

বদরুদ্দীন উমর

স্বাধীনতা দিবস বাংলাদেশে যেভাবে পালিত হয় তার মধ্যে বাংলাদেশের ট্র্যাজেডির একটা পরিচয় আছে। কারণ
স্বাধীনতা দিবস পালনের উৎসব যখন চলতে থাকে তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার কোনো খবর থাকে না।
সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা পদদলিত হতে থাকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা উদযাপনকে তাই এক ধরনের ভধৎপব বলেও
মনে হয়

'জাতীয় সংসদের আয়নায় বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর চেহারা দেখুন' শিরোনামে বিগত ১৪ মার্চ ২০১১ তারিখ
সমকালে আমি এক প্রবন্ধ লিখেছিলাম। বাংলাদেশে যখন স্বাধীনতা দিবস হৈ-হল্লার সঙ্গে পালিত হচ্ছে তখন এই
চেহারার আর একটা দিক নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আবার হলো সংসদের স্পিকারের কিছু বক্তব্যের
পরিপ্রেক্ষিতে। ২০ মার্চ জাতীয় সংসদের স্পিকার অধিবেশন চলাকালে বলেন যে, বিতর্কে র সময় সরকার ও
বিরোধী পক্ষ উভয়েই পরস্পরের বিরুদ্ধে যেভাবে অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করেন তাতে তাদের লজ্জাবোধ করা উচিত।
যে সংসদ সদস্যরা এই ধরনের ভাষা প্রয়োগ করেন, তাদের জন্য বিতর্কে র সময় বরাদ্দ করার ব্যাপারে তিনি
সরকারি ও বিরোধী দল উভয় পক্ষের চিফ হুইপেরই সমালোচনা করেন। তিনি আরও বলেন যে, সাংসদরা
এভাবে অসংসদীয় এবং অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করলে প্রত্যেক বারই তাকে সেসব শব্দ রেকর্ড থেকে বাদ দেওয়ার
নির্দে শ দিতে হয়। কিন্তু ঘন ঘন এটা ঘটতে থাকা এক অশ্লীল ব্যাপার। তিনি বলেন, অবস্থা দেখে মনে হয় যে,
তার একমাত্র কর্ত ব্য হলো, এই ধরনের অসংসদীয় শব্দ রেকর্ড না করার নির্দে শ দিতে থাকা। (উধরষু ঝঃধৎ
২১.৩.২০১১)
অশ্লীল ও অভদ্র শব্দ ব্যবহার বন্ধ করার জন্য স্পিকার বারংবার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও বুধবার ১৬ মার্চ উভয়
পক্ষের বেশ কয়েকজন সাংসদ রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনা প্রসঙ্গে পরস্পরের বিরুদ্ধে অশ্লীল ও অভদ্র
শব্দ ব্যবহার করেন। ২০ তারিখে এর ওপর বক্তব্য দিতে গিয়ে স্পিকার বলেন, শুধু পরস্পরের বিরুদ্ধে অশ্লীল
শব্দ ব্যবহারই নয়, তার সঙ্গেও অতি অভদ্র আচরণ করা হয়েছে। আশরাফি পাপিয়া নামে বিরোধী বিএনপি দলীয়
এক সাংসদের আচরণ সম্পর্কে স্পিকার বলেন, সময় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তার মাইক বন্ধ করায় তিনি তাকে
উদ্দেশ করে বলেন, 'মাইক দে'! স্পিকারের এই বক্তব্যের জবাবে বিরোধী দলের চিফ হুইপ এক পয়েন্ট অব অর্ড ারে
দাঁড়িয়ে বলেন, 'আমাদের দলীয় সদস্য পাপিয়া যদি এ কথা বলে থাকেন এবং তা যদি রেকর্ডে থাকে, তাহলে আমি
তার পক্ষ থেকে আপনার কাছে ক্ষমা চাই।' জাতীয় সংসদের বিদ্যমান সাংস্কৃতিক নিম্ন চরিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের এ ক্ষমাপ্রার্থনা প্রশংসনীয় কাজ! কিন্তু এ ক্ষেত্রে যা লক্ষণীয় তা হলো, যার অশ্লীল শব্দ
ব্যবহার এবং অভদ্র আচরণের জন্য তাদের চিফ হুইপ ক্ষমা চাইলেন, তিনি নিজে এ ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন না!!
কিন্তু সংসদীয় রীতি অনুযায়ী এ ক্ষমাপ্রার্থনা সর্বাগ্রে তারই করা দরকার ছিল। কাজেই অপরাধী নিজে দোষ
স্বীকার না করে তার পক্ষে অন্য কেউ দোষ স্বীকার ও ক্ষমাপ্রার্থনা করলে যে অবস্থা দাঁড়ায় এ ক্ষেত্রেও তাই
হয়েছে। যেখানে এই ধরনের অসভ্য ও অভদ্র আচরণের জন্য চিফ হুইপ কর্তৃ ক আলোচ্য সাংসদকে ভর্ৎ সনা করা
দরকার ছিল, সেখানে তিনি সে কাজ না করে নিজে তার পক্ষে ক্ষমাপ্রার্থনা করে নিজের দলের এ অসভ্য সাংসদকে
এক ধরনের রেয়াত দিলেন। এভাবে দোষীকে রেয়াত দেওয়া যে সমস্যা সমাধানের কোনো পথ নয় তা বলাই
বাহুল্য। কাজেই যাদের সাংস্কৃ তিক মান নিম্ন, যারা অশ্লীল ও অসভ্য, তারা নারী হোক অথবা পুরুষ, ভবিষ্যতেও
তারা জাতীয় সংসদে একই আচরণ করবে। আচরণ যেখানে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পর্কি ত সেখানে এটাই
স্বাভাবিক।
যে কোনো দেশের শাসক শ্রেণীর চরিত্রের, বিশেষত তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্রের প্রতিফলন যে তাদের
পার্লামেন্ট বা জাতীয় সংসদে ঘটবে এটাই সাধারণ ও স্বাভাবিক। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না। ১৯৭২
সাল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে যে শাসক শ্রেণী গঠিত হতে শুরু করে তার বর্ত মান পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তার
চরিত্রই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রতিফলিত হচ্ছে।
তবে এখানে বলা দরকার যে, শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, তাদের আমলাতন্ত্র, তাদের সিভিল
সোসাইটি, তাদের ব্যবসায়ী মহল, তাদের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী সবকিছু র অবস্থা এখন এমন যাতে
মনে হয় একটা জাতি যেন তার মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, পা ওপরে তু লে। পাকিস্তানিদের হাত থেকে পরিত্রাণ
পেয়ে স্বাধীন দেশে বাঙালির যে স্বাধীনতার চর্চ া হওয়ার কথা ছিল, তার পরিবর্তে এখন উচ্ছৃঙ্খলতারই রাজত্ব।
এই উচ্ছৃঙ্খলতার আওতায় আছে সব কিছু । চু রি, ঘুষখোরি, প্রতারণা, ভূ মিদস্যুতা, লুণ্ঠন থেকে নিয়ে দেশের ও
জনগণের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে পকেট ভরার ব্যাপার সবকিছু ই এ উচ্ছৃঙ্খলতার অংশ। জাতীয় সংসদে যা
নিয়মিতভাবেই ঘটে তার সঙ্গে এসব উচ্ছৃঙ্খলতার ওতপ্রোত সম্পর্ক । এ উচ্ছৃঙ্খলতা যদি সমগ্র শাসক শ্রেণীকে গ্রাস
না করত তাহলে জাতীয় সংসদের চিত্র হতো অন্য প্রকার। তার আয়নায় দেখা যেত শাসক শ্রেণীর অন্য এক রূপ।
এখানে বলা দরকার যে, এভাবে শাসক শ্রেণী যে সংস্কৃতি এবং অভ্যাস গড়ে তোলে তার প্রভাব পড়ে সমগ্র
সমাজে। বাংলাদেশেও তাই হচ্ছে। সমগ্র ব্যবস্থার ওপর এই প্রভাব তার সংকটকে গভীরতর করছে।
স্বাধীনতা দিবস বাংলাদেশে যেভাবে পালিত হয় তার মধ্যে বাংলাদেশের ট্র্যাজেডির একটা পরিচয় আছে। কারণ
স্বাধীনতা দিবস পালনের উৎসব যখন চলতে থাকে তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার কোনো খবর থাকে না।
সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা পদদলিত হতে থাকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা উদযাপনকে তাই এক ধরনের ভধৎপব বলেও
মনে হয়। মার্কি ন যুক্তরাষ্ট্রের একজন অপেক্ষাকৃ ত নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারী যখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বলেন
যে, তাদের কথামতো কাজ না করলে দু'দেশের সম্পর্কে র অবনতি ঘটবে। যখন তাদের কথা না শুনলে
বাংলাদেশে তাদের তথাকথিত ঋণ সাহায্য বন্ধ বা হ্রাস করার হুমকি তারা দেয় তখন বাংলাদেশে হৈ-হল্লার মধ্যে
স্বাধীনতা দিবস পালনকে এ দেশের জনগণের জীবনে এক বড় ট্র্যাজেডি ছাড়া আর কিইবা বলা যায়।
শাসক শ্রেণীর নানা রঙের দুষ্কৃতির বিষয় নিয়ে লিখে হয়রান হয়েছি। তাই এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধের
সময় স্বপ্নে দেখা স্বাধীনতার ওপর শামসুর রাহমানের 'স্বাধীনতা তু মি' নামে এক কবিতার কথা। শামসুর রাহমান
বেঁচে থাকলে স্বাধীনতার চলি্লশ বছর পর স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গের ওপর তাকে লিখতে বলতাম 'স্বাধীনতা তু মি'
নামে আর একটা কবিতা তার কাব্যিক ভাষায় সাজিয়ে-গুছিয়ে, যাতে থাকত_
স্বাধীনতা তু মি রুচির নিধনকারী, স্বাধীনতা তু মি অপার অশ্লীলতা, স্বাধীনতা তু মি খিস্তিখেউড় জাতীয় সংসদের,
স্বাধীনতা তু মি অসভ্যতার নাম, স্বাধীনতা তু মি ব্যবসায়ীদের নোংরা হাতের মোয়া, স্বাধীনতা তু মি চাল ডাল
তেল আলু পেঁয়াজের দাম, স্বাধীনতা তু মি সামাজিক এক ব্যবসা, তু মি 'শক্তি দধির' ঠোঙা, তু মি এনজিওদের
ক্ষু দ্রঋণের বোঝা। স্বাধীনতা তু মি চোরের ঘরের মাসি, তু মি ভূ মিদস্যুর পিসি, স্বাধীনতা তু মি পুলিশের লাঠি
র‌্যাবের ক্রসফায়ার, স্বাধীনতা তু মি শিক্ষার নামে ব্যবসা, তু মি গরিবের স্বাস্থ্যসেবার হাল। স্বাধীনতা তু মি
টেন্ডারবাজি ছাত্রদের, স্বাধীনতা তু মি ধর্মের নামে বিধর্মীদের মিছিল, স্বাধীনতা তু মি ফতোয়াবাজি, নারীর ওপর
হামলা, স্বাধীনতা তু মি মিথ্যাচারের নাম। স্বাধীনতা তু মি গরিবের শ্রম হজম করার ফাঁদ, স্বাধীনতা তু মি কৃ ষকের
জমি কৃ ষকের ভিটে হরণ করার নাম, স্বাধীনতা তু মি ভোটের আগে প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা, তু মি ভোটের সময়
কারচু পি, স্বাধীনতা তু মি ব্যবসায়ীদের নোংরা হাতের মোয়া। স্বাধীনতা তু মি ইতিহাসের যত মিথ্যা, স্বাধীনতা
তু মি পরাধীনতার বন্দি, স্বাধীনতা তু মি সাম্রাজ্যবাদের পায়ের তলার মাটি, স্বাধীনতা তু মি হতাশার এক নাম।
২৭-৩-২০১১
উপসম্পাদকীয়
উপসম্পাদকীয়-এর আর্ক াইভ
29-3-2011

You might also like