Professional Documents
Culture Documents
2
2
স্বাধীনতার পূর্বাভাস
১৯৭০ সালের জুন মাস। সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (র.) তদীয় ভক্তবৃন্দের সামনে
যে স্বগতোক্তি করেছিলেন তাও ছিল বেশ তাৎপর্যবহ। তিনি বলেছিলেন, “পাকিস্তান এক দেশ
নয়। পশ্চিমাদের সাথে আমাদের খাদ্যে মিল নাই। তারা রুটি খায়, আমরা বাঙ্গলীরা খাই ভাত।
নারী পুরুষ নির্বিশেষে তাদের পরিধেয় সেলোয়ার কামিজ, আমাদের লুঙ্গি কোর্তা, ধুতি শাড়ি।
মুখের ভাষায়ও তাদের সাথে আমাদের মিলে না। তাদের পাঁচ ভাষাঃ পাঞ্জাবী, সিন্ধী, পশতু ,
বেলুচী ও উর্দু । আমাদের একটি মাত্র ভাষা-বাংলা। তাদের ভাষা আমরা বুঝিনা, আমাদের
ভাষাও তারা বুঝে না। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের জলবায়ুও আলাদা। পশ্চিম পাকিস্তানে শীতে
অধিক শীত, গরমে অত্যধিক গরম, এখানকার জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ। দুই অঞ্চলের ভূ মি গঠন
এবং সংস্কৃ তি ও কৃ ষ্টির ধারাও ভিন্ন। সুতরাং এ দেশ এক থাকতে পারে না”। শুধু তাই নয়, ৭০
সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (র.)-এর ইঙ্গিতপূর্ণ
মন্তব্যও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এ সময় গাউছিয়া আহমদিয়া মজিলের সামনে আমগাছে
লাগানো আওয়ামী লীগের একটা পোষ্টারের ভাষা ছিল এরকম, “সোনার বাংলা শ্মশান কেন?”
নির্বাচন প্রশ্নে আশেক ভক্তরা জানতে চাইলেন তাঁরা কোথায় ভোট দেবেন। তখন ঐ পোষ্টারের
প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বললেন “এসব তো মিথ্যা নয়”। তাঁর এই মন্তব্য প্রকারান্তরে ভোটের
মাধ্যমে পাকিস্তানী শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ রায় দেওয়ারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
একাত্তর সালে হানাদার বাহিনীর আক্রমণের ফলে বাঙ্গালী জাতি যখন একটা মহা ক্রান্তি কালের
মধ্যে অবস্থান করছিল, বাঙ্গালী জাতির অস্তিত্ব পৃথিবীতে থাকবে কি থাকবে না এ ধরণের
ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়েছিল; সেই ঐতিহাসিক যুগ-সন্ধিক্ষণে সৈয়দ দেলাওর
হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (র.)-এর ভূ মিকা ছিল প্রতীকীভাবে সুস্পষ্ট এবং ঐতিহাসিকভাবে
অত্যন্ত দায়িত্বশীল। একাত্তর সালের ৫ই এপ্রিল দরবার শরীফে চৈত্র মাসে হযরত বাবাভাণ্ডারীর
(১৮৬৫-১৯৩৭) নির্ধারিত বার্ষিক হয়তো ওরশ শরীফ সমাগত প্রায়। ইতোমধ্যে পাক হানাদার
বাহিনী হাটহাজারীতে এসে অবস্থান নিয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপদজনক ও
স্পর্শকাতর। এহেন নাজুক অবস্থায় ওরশ শরীফের সপ্তাহখানকে পূর্বে (২৮ মার্চ ১৯৭১) ভক্ত
সৈয়দ নুরুল বখতেয়ার শাহ হুজুরের কাছে এসে হাদিয়া-মিছিলের অনুমতি চেয়ে বললেন,
“ওরশের হাদিয়া নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে মিছিল নিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে দিক্
বিদিগ্ মুখরিত করে ওরশ শরীফে আসার অনুমতি প্রার্থনা করছি” । নুরুল বখতেয়ার শাহের
এহেন প্রস্তাব শুনে দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (র.) সম্মতিসূচক হাত তু লে অনুমতি প্রদান
করেন। যথারীতি হুজুরের অনুমতি পেয়ে আশেক ভক্তরা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিক্-
বিদিগ্ মুখরিত করে হাদিয়া-মিছিল নিয়ে নিরাপদেই দরবার শরীফ এসে পৌঁছান। পথে বিভিন্ন
জায়গায় পুলিশের মুখোমুখি হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দেখেও কেউ কোন প্রকার
বিড়ম্বনা সৃষ্টি করেননি। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে এহেন হাদিয়া-মিছিলের অনুমতি
প্রদান ছিল চলমান মুক্তিযুদ্ধের নিশ্চিত বিজয়েরই আধ্যাত্মিক পূর্বাভাস।