You are on page 1of 3

মুক্তিযুদ্ধে

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের গৌরবোজ্জ্বল ভূ মিকা ইতিহাসের


অকথিত এক নতু ন অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকে এই দরবার শরীফ হয়ে উঠেছিল
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি ও সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক মেজর
জিয়া সহ সামরিক বেসামরিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকেই
মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহায়তা নিয়েছিলেন বিভিন্নভাবে। বলাবাহুল্য, এ
সময় দরবার শরীফের গদীতে সমাসীন ছিলেন স্বয়ং দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (র.)। শুধু
তাই নয়; তদীয় চতু র্থ পুত্র ডাঃ সৈয়দ দিদারুল হক সহ দরবার শরীফের আওলাদে পাকের আরো
কয়েকজন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে ঝাঁপিয়েও পড়েছিলেন।
সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (র.)-কে কেন্দ্র করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ
সময়ের এই গৌরবজনক ভূ মিকাই শুধু নয়; ইতঃপূর্বেকার ব্যক্তি দেলাওর হোসাইন
মাইজভাণ্ডারী (র.)-এর সমাজ ও রাজনীতি সচেতনতা, গভীর অন্তর্দৃ ষ্টি, চিন্তার স্বচ্ছতা,
বক্তব্যের সুস্পষ্টতা, সর্বোপরি প্রয়োজনীয় সময়ে প্রতিবাদী ভূ মিকার ঘটনাবলী আমাদের
রীতিমত বিস্মিত করে তোলে।
সমাজ ও রাজনীতি সচেতন সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী তরুণ বয়সের সময়ে,
বিশের দশকে প্রত্যক্ষভাবে খেলাফত আন্দোলনের সাথে নিজেকে সংশ্লিষ্ট করেছিলেন।
রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ, সর্বোপরি সমাজ জীবন সম্পর্কে তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণের
ভিত্তিভূ মি হিসেবে এই খেলাফত আন্দোলনের অভিজ্ঞতা রীতিমত মাইল ফলক হিসেবে
বিবেচিত। অবিভক্ত ভারতবর্ষে পাকিস্তান সৃষ্টি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় ।
১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে “উত্তর চট্টগ্রাম প্লাবন নিবারণ সমিতি'র উদ্যোগে ফটিকছড়ির নানুপুর
আবু সোবহান স্কু ল মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বন্যা সমস্যার সমাধানের উপর এক মহতি
সম্মেলন। স্বয়ং দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (র.)-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রী
জনাব হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (র.)-
এর উদ্যোগেই গঠিত হয়েছিল এই “উত্তর চট্টগ্রাম প্লাবন নিবারণ সমিতি” । তিনি ছিলেন।
সভাপতি, সম্পাদক ছিলেন স্কাউট মাষ্টার নুরুল কু দ্দুছ। তিনদিন ব্যাপী সম্মেলনের প্রথম দুই
দিন যথারীতি তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তৃ তীয় দিনের আলোচ্য বিষয় ছিল
সমসাময়িক রাজনীতির বহুল আলোচিত ঘটনা “ পাকিস্তানের প্রস্তাব"। এই দিনের সভায় তিনি
উপস্থিত হননি। কোন কারণ ছাড়া রহস্যজনকভাবে তাঁর অনুপস্থিতি দরবার সংশ্লিষ্ট- জনদের
রীতিমত ভাবিয়ে তু লে। তাই সমিতির কোষাধ্যক্ষ শিল্পপতি মীর্যা আবু সহ অনেক গণ্যমান্য
ব্যক্তি মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে আসেন হুজুরের কাছ থেকে বিষয়টির রহস্য উদ্ঘাটনের
জন্যে। তাঁদের আগমনের বিষয় অবহিত হয়ে হুজুর (সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী) যে
কথা বলছেন, তার সার সংক্ষেপ দাঁড়ায় এমনঃ পাকিস্তান নামের মধ্যে আছে পাঞ্জাবের
আদ্যাক্ষর (P), আফগানিস্থানের (A) কাশ্মিরে (K), সিন্ধু বা ইনডাসের (I), বেলুচিস্থানের
(STAN), কিন্তু আমি মৌলিকভাবে জানতে চাই এতে বাংলার (B) শব্দটি কোথায়?
সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (র.)-এর এই তাৎপর্যমন্ডিত ছোট্ট অথচ গভীর
মর্মভেদী প্রশ্নটি উপস্থিত সকলকে রীতিমতো হতচকিত করে দেয়। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রশ্নে
প্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি আরো জানান যে, “ফজলুল হক সাহেবকে বাদ দিয়ে সবাই
যখন জিন্নাহর পেছনে দৌঁড়াচ্ছে তখন পাকিস্তান হবে। তবে মোহটা কেটে গেলে ষড়যন্ত্রের জাল
ছিড়ে বাঙ্গালীরা একদিন বেরিয়ে আসবেই। ফাঁকিই যার ভিত্তি সে দেশ পঁচিশ বছরের অধিক
টিকবে না- টিকতে পারে না।”
বলাবাহুল্য, উল্লিখিত গভীর অন্তর্দৃ ষ্টিতে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য দুটি যে কোন ঝানু
রাজনীতিবিদকেও হার মানায়। এ ক্ষেত্রে মনে করা কঠিন হয়ে পড়ে যে তিনি কোন রাজনীতি চর্চা
করেন না। তিনি হলেন বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তর সুফিতাত্ত্বিক আধ্যাত্মিক প্লাটফরম
মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের সাজ্জাদানশীন এবং তাঁর মৌলিক পরিচয় তিনি একজন
আধ্যাত্মিক পীর।
মৌলিকভাবে বাংলা এবং বাঙ্গালীদের স্বীকৃ তি না দিয়ে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, সে
রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কেরা শুরু থেকে বাংলা ও বাঙ্গালীদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাঙালীদের উপর পাকিস্তানীদের শোষণ, নিপীড়ন, সর্বশেষে
একাত্তরের গণহত্যা এ কথা সমূহের ঐতিহাসিকভাবে প্রতিবাদ হিসেবে তিনি পাকিস্তান বিষয়ক
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করা থেকে বিরত ছিলেন একজন দার্শনিকের প্রতিবাদী
সচেতনতায়।

স্বাধীনতার পূর্বাভাস
১৯৭০ সালের জুন মাস। সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (র.) তদীয় ভক্তবৃন্দের সামনে
যে স্বগতোক্তি করেছিলেন তাও ছিল বেশ তাৎপর্যবহ। তিনি বলেছিলেন, “পাকিস্তান এক দেশ
নয়। পশ্চিমাদের সাথে আমাদের খাদ্যে মিল নাই। তারা রুটি খায়, আমরা বাঙ্গলীরা খাই ভাত।
নারী পুরুষ নির্বিশেষে তাদের পরিধেয় সেলোয়ার কামিজ, আমাদের লুঙ্গি কোর্তা, ধুতি শাড়ি।
মুখের ভাষায়ও তাদের সাথে আমাদের মিলে না। তাদের পাঁচ ভাষাঃ পাঞ্জাবী, সিন্ধী, পশতু ,
বেলুচী ও উর্দু । আমাদের একটি মাত্র ভাষা-বাংলা। তাদের ভাষা আমরা বুঝিনা, আমাদের
ভাষাও তারা বুঝে না। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের জলবায়ুও আলাদা। পশ্চিম পাকিস্তানে শীতে
অধিক শীত, গরমে অত্যধিক গরম, এখানকার জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ। দুই অঞ্চলের ভূ মি গঠন
এবং সংস্কৃ তি ও কৃ ষ্টির ধারাও ভিন্ন। সুতরাং এ দেশ এক থাকতে পারে না”। শুধু তাই নয়, ৭০
সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (র.)-এর ইঙ্গিতপূর্ণ
মন্তব্যও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এ সময় গাউছিয়া আহমদিয়া মজিলের সামনে আমগাছে
লাগানো আওয়ামী লীগের একটা পোষ্টারের ভাষা ছিল এরকম, “সোনার বাংলা শ্মশান কেন?”
নির্বাচন প্রশ্নে আশেক ভক্তরা জানতে চাইলেন তাঁরা কোথায় ভোট দেবেন। তখন ঐ পোষ্টারের
প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বললেন “এসব তো মিথ্যা নয়”। তাঁর এই মন্তব্য প্রকারান্তরে ভোটের
মাধ্যমে পাকিস্তানী শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ রায় দেওয়ারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
একাত্তর সালে হানাদার বাহিনীর আক্রমণের ফলে বাঙ্গালী জাতি যখন একটা মহা ক্রান্তি কালের
মধ্যে অবস্থান করছিল, বাঙ্গালী জাতির অস্তিত্ব পৃথিবীতে থাকবে কি থাকবে না এ ধরণের
ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়েছিল; সেই ঐতিহাসিক যুগ-সন্ধিক্ষণে সৈয়দ দেলাওর
হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (র.)-এর ভূ মিকা ছিল প্রতীকীভাবে সুস্পষ্ট এবং ঐতিহাসিকভাবে
অত্যন্ত দায়িত্বশীল। একাত্তর সালের ৫ই এপ্রিল দরবার শরীফে চৈত্র মাসে হযরত বাবাভাণ্ডারীর
(১৮৬৫-১৯৩৭) নির্ধারিত বার্ষিক হয়তো ওরশ শরীফ সমাগত প্রায়। ইতোমধ্যে পাক হানাদার
বাহিনী হাটহাজারীতে এসে অবস্থান নিয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপদজনক ও
স্পর্শকাতর। এহেন নাজুক অবস্থায় ওরশ শরীফের সপ্তাহখানকে পূর্বে (২৮ মার্চ ১৯৭১) ভক্ত
সৈয়দ নুরুল বখতেয়ার শাহ হুজুরের কাছে এসে হাদিয়া-মিছিলের অনুমতি চেয়ে বললেন,
“ওরশের হাদিয়া নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে মিছিল নিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে দিক্
বিদিগ্‌ মুখরিত করে ওরশ শরীফে আসার অনুমতি প্রার্থনা করছি” । নুরুল বখতেয়ার শাহের
এহেন প্রস্তাব শুনে দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (র.) সম্মতিসূচক হাত তু লে অনুমতি প্রদান
করেন। যথারীতি হুজুরের অনুমতি পেয়ে আশেক ভক্তরা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিক্-
বিদিগ্‌ মুখরিত করে হাদিয়া-মিছিল নিয়ে নিরাপদেই দরবার শরীফ এসে পৌঁছান। পথে বিভিন্ন
জায়গায় পুলিশের মুখোমুখি হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দেখেও কেউ কোন প্রকার
বিড়ম্বনা সৃষ্টি করেননি। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে এহেন হাদিয়া-মিছিলের অনুমতি
প্রদান ছিল চলমান মুক্তিযুদ্ধের নিশ্চিত বিজয়েরই আধ্যাত্মিক পূর্বাভাস।

You might also like