You are on page 1of 73

মেঘাবৃতা নগনন্দিনী সমীপে ...

গোড়ার কথা
এ লেখাটা সেই ছোটবেলার ভূ গোল পড়ার মতো।
সেই খুব ছোটবেলায় যখন পড়তাম, একটা নদী বেরিয়েছে ওই
তু ষারমৌলী হিমালয়ের হৃদয় চিরে, তারপরে রিনরিনে নুপুরের শব্দ তু লে
কত না উপল বিছানো শৈলশিরার পাশ দিয়ে নীচে নেমেছে নৃত্যরত
উচ্ছ্বল তরুণীর মতো আনন্দ ছড়াতে ছড়াতে। তারপরে হয়ত কোথাও
কোনো বড়োসড়ো বাধা পেয়ে দুদিকে হাত ছাড়াছাড়ি হয়ে নিজেদের
মতো করে বয়ে চলে গেছে।
কেমন যেন ধাঁধা লাগত চোখে, ঠিক যেন এক অচিন স্বপ্ন-পারাবার। ওই
তু ষারকিরীট, ওই শৈলশিরা, ওই আস্বচ্ছ বিভাজিকা, ওই ঘনসন্নিবদ্ধ
মহীরুহের সারি, ওই অচঞ্চল মেঘশ্রেণী, তার মাঝখান দিয়ে পাথরের খাঁজ
বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণার জলের শব্দ, নীচে ফেনিল তরঙ্গ নিচয়। মনে
মনে পড়া থামিয়ে ফিরে গিয়ে বারবার ভালো করে ওই নুপুরধ্বনি
ছড়ানো স্রোতার নৃত্যপথ দেখতে চাইতাম। সে স্রোতাও বড়ো কুহকিনী,
ভালো করে দেখতে না দেখতেই মুখ লুকিয়ে ফেলত এক লহমায়, এক
অজানা তরঙ্গ-রাজ্যে।
'মায়াঞ্জন' কি আর কেউ কাউকে জোর করে পরায়!!!
ও পরে নিতে হয় নিজেকেই। আমিও নিয়েছিলাম, সেই কোন এক অবুঝ
শৈশবেই, নিজেকে ভালো করে বুঝতেও না দিয়ে, ফিরে ফিরে ওই উপল
বিছানো উল্টো পথে স্রোতাদের দেখতে গিয়েই।
এ গল্পও ঠিক তেমনই।
আমরা শুরু করেছিলাম একসঙ্গেই। কলকাতা থেকেই। উঁহু, বলার ভু ল
হলো। শুরু করেছিলাম, আমার আগের রাজদর্শনের পরেই, সাম্রাজ্ঞীকে
দেখার সুপ্ত অভিলাষ অসাবধানে প্রকাশ করে ফেলেই। কিন্তু যাত্রীদ্বয়ের
মাঝের তৈরী হয়ে ওঠাটা একটু আলাদা রকমের হলো। ফলে, সেই যে
সেই ছায়াছবিটা ছিল, কলেজবেলায় দেখা, আকিরা কুরোসাওয়ার রসোমন,
আমাদের গল্পটার ধরণধারণ ওইপথেই বাঁক নিল।
এবার হিমালয়ে আমি ছু টেছি, প্রাণপণে, যখন যেমন পেরেছি। আক্ষরিক
অর্থেই ছু টেছি, কারণ গত একবছর এটাই আমি আমার ধ্যানজ্ঞান করে
রেখেছিলাম। নিজেকে এই সাধনা থেকে একচু লও সরতে দিইনি।
আমার সঙ্গী সৌমী নিজের মতো করে অভ্যস্ত হয়েছে। সারা রাস্তাটাই
ওর সুবিধেমতো ছন্দে চলেছে। ফলে আমার লেখায় যথেষ্টরও বেশি কষ
থাকবে। আর সৌমীর মন্দাক্রান্তা চালে থাকবে রস, একথা আমি হলফ
করে এখনই বলতে পারি। যাঁরা উপভোগ করতে চান, পাশাপাশি রেখে
দুটোই পড়বেন বরং।
ওই সেই রসোমনের মতো।
দুটো লেখায় দুরকমের অভিজ্ঞতা যেমন থাকবে, দুধরণের দর্শন যেমন
থাকবে, দুরকমের পরিপ্রেক্ষিতও থাকবে তেমনই।
বাকিটা আগেরবারের মতোই, ছবি আমার ভাঁড়ারে বিশেষ মজুদ নেই।
আমি হৃদয় দ্রব করা ছবি দিতে অক্ষম। ছবির দায়িত্ব সৌমীর।
মনে মনে সত্যিই আশা করব, কেউ খুব বেশি আশাহত হবেন না।
অলমিতি ...
ছবিটা আমাদের গাইড, যদিও তাকে রাখাল বলাই ভালো, বুধি তামাং এর
তোলা। নববর্ষের দিন ভোরে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পে।
পর্ব - ১
তখন, গেল বছরের জ্যৈষ্ঠ মাস। দিগন্তের আনাচেকানাচে একছটাক ঝড়
দূরে থাকুক, এককণা মেঘের আঁচড়ও খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই তাকিয়ে
তাকিয়ে চোখ ব্যথা করে ফেললেও।
সপ্তাহের মাঝামাঝি বেশ কিছু কাজ সেরে বাড়ি ফিরছি, রাস্তায় গাড়ির
অনন্ত সারণীতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে অনেকক্ষণ। গরমে গা-
হাত-পা চিড়বিড় করছে। বাড়ি ঢু কেই আকণ্ঠ ঠাণ্ডা জল খেলাম মাটির
কুঁ জো থেকে। তারপরে হাতে মুখে জল দিয়ে, ঠাণ্ডা হয়ে এক কাপ কফি
নিয়ে পশ্চিম দিকের জানালার ধারে বসলাম। এ জানালা আমার
সান্ধ্যকালীন অতিপ্রিয় নিভৃ ত বাতায়ন।
টিং করে শব্দ হলো ফোনে। তারপর আবার একটা, আবারও একটা।
হয়তো কারুর দরকার আছে। 'দেখবখন, একটু পরে,' এই ভেবেই আবার
কফিতে মন দিলাম।
আবার টিং টিং।
উঠে পড়তে হলো।
ফোন তু লে দেখি, আরোও অনেক মেসেজের সঙ্গে সৌমীর কয়েকটা
মেসেজ। একসঙ্গে অনেকগুলো, পরপর। ভাবলাম, 'দেখি, এ ছানার আবার
কি হলো।'
- 'বিদিশাদি, ভালো আছো তো!
- আমি সৌমী।
- আমি তোমার সঙ্গে পরেরবার যাবো কিন্তু।
- যাবোই।'
-'কোথায় যাবি ???'
-'অন্নপূর্ণা ... আমি যাবো কিন্তু।
-তু মি না বলতে পারবে না। আমি যাবোই।'
- ' আচ্ছা', লিখে তখনকার মতো ছেড়ে দিলাম।
তখন সবে মাস দেড়েক হলো এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ঘুরে এসেছি।
পায়ের ব্যথা সেরেই গেছে প্রায়। শেষকালে লিখে ফেলেছিলাম পরেরবার
রাজেন্দ্রাণীকে দেখতে যেতেই হবে। না দেখলে চলে ? রাজাকে দেখে
এলাম, তার পরিবারকে দেখব না বললে হয়! এসব পুণ্য কাজ শুরু করে
অর্ধসমাপ্ত রাখতে নেই।
ওকথা মনে করে রেখেছে সৌমী।
ঠিক আছে। মনে রাখুক না, হিমালয় তো আর যে সে জিনিস নয়, তার
নিজের আলাদা স্বতঃসিদ্ধ থাকে সবসময়ই, বা বলা ভালো সে নিজের
স্বতঃসিদ্ধ নিজেই তৈরী করে নেয়। দেখা যাক, কি হয় শেষমেষ।
সপ্তাহখানেক পরে মনে হলো, মেয়েটা এত করে যেতে চাইছে, জেদ করছে
যখন, আস্তে আস্তে করে তৈরী হওয়ার 'অ - আ - ক - খ' গুলো বলতে
শুরু করি বরং। যতটা লেগে থেকে থেকে অভ্যেস করানো যায়। কিছু
না হোক আট-হাজারি শৃঙ্গ বলে কথা, পা ফেললাম আর কয়েক ঘণ্টা
হাঁচড়-পাঁচড় করে পৌঁছে গেলাম, এমন তো হওয়ার যো নেই।
সৌমী তখন ব্যাঙ্কের কাজে পুণেতে। এই কাজের চাপ আমি জানি। ফোন
করলাম না। মেসেজে লিখলাম, প্রতিদিন কিন্তু কম করে দশহাজার পা
হাঁটতেই হবে। তার সঙ্গে কম করে পাঁচ-লিটার জলের বোতল নিয়ে
পাঁচতলা একতলা করা অন্তত দুবার, sit-up, squatting এগুলো তো
আছেই। যদিও হিমালয়ের রাস্তায় পা দিলেই এসব নিয়মের খলনলচে
বদলে যায় তবু এগুলো তো করতেই হবে।
- 'আর কি কি করতে হবে বলো !'
- 'দম বাড়ানোর জন্য যা যা পারবি সব। কিচ্ছু বাদ দিবি না।
প্রাণায়াম, পারলে ওটাও।'
- 'ওটা করি, সঙ্গে সাঁতার কাটব ??? '
- 'হ্যাঁ, সবচেয়ে ভালো exercise তো সাঁতার। পারলে এখনই শুরু কর
ওটা। আমিও শেষ কয়েকটা মাস যদি পারি দেখব।'
- 'আচ্ছা। আমি তাহলে আমার পায়ের জন্য ডাক্তার দেখাই। ওনার সঙ্গে
কথা বলেই সব শুরু করব।'
- 'হ্যাঁ, ওটাই আগে করবি। খুব জরুরী কাজ।'
কথা ফু রুল।
আমি আবার নিজের শরীরচর্চ া নিয়ে পড়লাম। মাঝে বৃষ্টির মাস এলো,
বৃষ্টির মাস গেল। খুব বেশি বৃষ্টির দিনগুলো ছিল বড্ডো ক্ষণস্থায়ী।
বৃষ্টির দম কমে আসতেই আবার হাঁটা শুরু হলো।
দশহাজার, বারোহাজার, তেরোহাজার, পনেরহাজার ...
এর সঙ্গে বাজার ইত্যাদির জন্য হাঁটা আছেই, ক্লাসের জন্য হাঁটা আছে,
কাছাকাছি যেসব বন্ধু দের বাড়ি, সেখানে প্রায় হেঁ টেই যেতে লাগলাম।
আমার বন্ধু দের খুব বিরক্ত করেছি এই পুরো সময়টা, মাঝেসাঝে কোনো
বন্ধু বাইরে থেকে এলে নেমন্তন্ন থাকত, যেতাম, কিন্তু খেতাম না। দেখা
করে দুকাপ কফি খেয়ে ফিরে আসতাম হেঁ টে। কেউ কিচ্ছু বলে নি
কোনোদিন। এসব চু পচাপ সহ্য করে গেছে। খিদে পেত, খেতে ইচ্ছেও
হতো দুর্নিবার। কিন্তু মাপা খাবারের বাইরে আমি পা বাড়াই নি। কারণ
ততদিনে বুঝতে পারছি যে আমার পরিশ্রম করার ক্ষমতা একটা নির্দ্দিষ্ট
saturation level এ পৌঁছে গেছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেটা হওয়াই অত্যন্ত
স্বাভাবিক। সেখানে লোভে পড়ে বেশি খাবার খেয়ে ফেললে সেটা ক্ষয়
করার জন্য আমি বেশি exercise তো করতে পারবই না, আর তাতে
যদি শরীর খারাপও হয়, সেটার জন্য রোজের অভ্যেস কয়েকদিন হলেও
পিছিয়ে দিতে হবে।
এর পরবর্তী সময়ে অনেকে, মানে সব বয়সের নারী পুরুষ নির্বিশেষে
প্রচু র মানুষ আমার কাছে বারবার জানতে চেয়েছেন, এইসব জায়গায়
যেতে হলে কতটা ওজন কমাতে হয়। সকাল থেকে কতবার কি কি
খেতে হয়। কিভাবে শরীরকে একটা নির্দ্দিষ্ট মাপে বেঁধে রাখতে হয়।
আমি এখনও বলছি, হলফ করে, যাঁরা এসব জায়গায় যেতে চান, বা
নিজের চেহারাকে একটা নির্দ্দিষ্ট পরিধিতে আটকে রাখতে চান, তাঁদের
ওজন কমাতে হবে না। সামনে কোনো ওজনের লক্ষ্যমাত্রাও রাখতে হবে
না। যা খেতে পছন্দ করেন তাই খাবেন, অতিরিক্ত তেল-মসলা বাদ
দিয়ে। শুধু মনে রাখতে হবে যে, যেমন করেই হোক আর যতদিনেই
হোক এসব রাস্তার প্রতিকূলতা জয় করার জন্য আপনাকে প্রতিদিন
আধঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে হবে, সমতলে। এই
জায়গায় এসে পৌঁছতে আমার ঠিক এক বছর লেগেছিল। তাও এবারে
যাওয়ার আগে দেখলাম আমার speed আধঘণ্টায় 4.78 কিলোমিটারে এসে
ঠেকল। এর চেয়ে বেশি speed বাড়াতে গিয়ে দেখলাম বেশ ক্লান্ত লাগছে।
ফলে এখানেই আমি শেষ করেছিলাম। ওটাই ছিল আমার cut-off mark.
আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম যে, এই অভ্যেসে একটা বছর সময়ে আমি
নিজেকে যে জায়গায় এনে দাঁড় করাতে পারব, তাতে আমার অতিরিক্ত
ওজন সংক্রান্ত সব অসুবিধেই ঠিক জায়গামতো এসে যাবে। শেষ চারমাস
আমি রোজ এই speed এই 4.78 কিলোমিটার হাঁটতাম।
এই কথাটাই আগেরবার একজন শেরপা বলে দিয়েছিলেন।
... এবং সেটাই সত্যি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত।
পোখরার রাস্তায় ...
পর্ব - ২
প্রত্যেকবার, এমনকি এই এক সপ্তাহ আগে ফিরে আসার পরও প্রচু র
মানুষজন আমার কাছে জানতে চেয়েছেন আমি কেন যাই এই পাহাড়ে।
বারবার, এত কষ্ট সহ্য করেও।
এই জিজ্ঞাসুদের মধ্যে আমার নিজের পরিবারের সদস্যরাও পড়েন।
সত্যিই, এ রাস্তায় চলার জন্য কষ্ট করতে হয়, এ তো আর leisure trip
বা প্রমোদভ্রমণ নয়, গাড়ি করে কোথাও গিয়ে নামলাম, সেখান থেকে
কিছু টা হেঁ টে একটা টিলায় চড়লাম, সেখান থেকে funicular এ চড়ে
একবারে গিয়ে নামলাম চোখধাঁধানো আদিগন্ত বরফের রাজ্যের ঠিক
মাঝখানটিতে। সেখানে ইচ্ছেমত সময় কাটিয়ে অক্ষত অবস্থায় আবার
ফিরে এলাম যেখানে ছিলাম সেখানে। মক্ষিকার স্থানে মক্ষিকা হয়ে।
ঠিক যেমন বিদেশী সিনেমায় দেখা যায়।
তা তো আর হওয়ার যো নেই, আমাদের প্রথমে সমতল থেকে আস্তে
আস্তে উঁচুর দিকের শহরে যেতে হবে। সেখানে একরাত কাটিয়ে আরও
দূরে একটু উঁচুতে অন্য একটা শহরে, তারপরে শুরু হবে হাতে লাঠি
নিয়ে চড়াই বা উৎরাই ভাঙা, নিরবচ্ছিন্ন, অবিরাম। দিনের শেষে একরাশ
ক্লান্তি নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলবে কোনো পাহাড়ী চটিতে, যেখানে
নামমাত্র আহার্য এবং স্বাচ্ছন্দ্যই চরম এবং পরম প্রাপ্তি বলে আগ্রহভরে
গ্রহণ করতে হবে।
প্রথমে পাহাড়ী জঙ্গলের রাস্তা, তারপরে উপল বিছানো বন্ধু র পথ, তারপরে
পাথরে পাথর ঠেকিয়ে কোনোমতে খাড়া করে দেওয়া সিড়ি ঁ , যার অনেকটা
অংশই ভেঙে গেছে ঘোড়া, ইয়াক, খচ্চরদের খুরের আঘাতে, তারপরে
সামনে আসবে সেই সব ছবিতে দেখা শৈলশিরার বিভাজিকার মধ্যে দিয়ে
বয়ে চলা কিশোরীর সিথি ঁ র মতো পাহাড়ী স্রোতা, যার দুদিকের পাড়ে
বিশাল বিশাল পাথর বিছানো। ওই নিস্তব্ধ বন্ধু র প্রান্তরে তার গর্জ ন
শুনলে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার লোভ সামলানো বড়োই
কঠিন। সে নদীর ধার দিয়ে চলতে থাকবে অপরিসর রাস্তা, সে রাস্তা
আবার উঠে গেছে এক পাহাড়ের গা বেয়ে অন্য এক পাহাড়ের মাথায়।
তারপরে আসবে এবড়ো খেবড়ো পাথর বেরিয়ে থাকা রাস্তা, আদতে
কোনো এক পাহাড়েরই অনাবৃত শরীর, তার ওপর দিয়েই চলতে হবে
এরপরে, আরোও অনেকটা পথ। আক্ষরিক অর্থেই গায়ে ছু রির মতো কেটে
কেটে বসা ঠাণ্ডা হাওয়ায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে।
এসব অঞ্চলের ওপর দিয়ে শরীরটাকে দু-তিন চারদিন ধরে টানার পরে
আস্তে আস্তে দুধারের পাহাড়ের গায়ের সেই ঝকঝকে মন ভালো করা
সবুজের পোঁচ যাবে মিলিয়ে। আসবে সেই হা-হা করা অঞ্চল, যেখানে
পাহাড়ের গায়ের সবুজের বর্ণচ্ছটা পাকাপাকিভাবে কোন এক অদৃশ্য
ভোজবাজিতে আত্মগোপন করে পরিণত হয়েছে বিবর্ণ ধূসর-সবুজ, ধূসর-
হলুদ মরা মরা রঙে।
এখানে এলেই পাহাড় এক লহমায় বুঝিয়ে দেবে যে, এ এক অচিনপুরের
রাস্তা, যে রাস্তায় পা দিলে সত্যি গা ছমছম করে দিনেদুপুরেই। পাথর
বেরিয়ে থাকা দুই পাহাড়ের মাঝখানের যে বিস্তীর্ণ ঊষর অঞ্চলে দাঁড়ালে
মনে হয় হাওয়াটাও কেমন যেন অচেনা। বুক ভরে শ্বাস নিলে এখানে
একটু ও আরাম লাগে না। এ রাস্তা এমন এক রাস্তা যেখানে চার
কিলোমিটার হেঁ টে পরবর্তী গ্রামে পৌঁছতে আড়াই ঘণ্টা লাগে।
তবুও আমরা যাই। এই অমানুষিক কষ্ট স্বীকার করে, হাঁপাতে হাঁপাতে।
সে কি শুধু এই পাহাড়ের অনির্বচনীয় রূপের টানে!
সবাই বলে পাহাড় টানে, পাহাড় ডাকে, পাহাড় আমাদের এক অতলস্পর্শী
নিঃশব্দ-বিশালত্বের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, যেখানে শুধু এক আস্বচ্ছ
আবরণ নিজেকে নিজের কাছে উন্মুক্ত করে দিতে থাকে প্রতিনিয়ত।
পাহাড়ের রূপ কুহকিনী, মায়ায় ভু লিয়ে নিয়ে চলে।
এর সব কথাগুলোই সত্যি।
কোনোটা মিথ্যে নয়।
আমরা মানুষ, আমরা সবাই সবসময় একই রকম জিনিস তো
ভালোবাসতে পারি না। কেউ পাহাড় ভালোবাসি তো কেউ সমুদ্র। এ
পার্থক্য তো থাকবেই।
কিন্তু এর কষ্টটাও তো বাস্তব। বড়ো কঠিন বাস্তব।
সারা বছর ধরে পরিশ্রম, নিজেকে কঠিন নিয়মে বেঁধে রাখা, সবরকমের
লোভনীয় পার্থিব ভোগ্যবস্তুর হাতছানি উপেক্ষা করা ...
শুধুমাত্র এত কষ্টের জন্য?
আমিও অনেক ভেবেছি এটা নিয়ে।
কেন যাই আমরা? এই কষ্ট স্বীকার করে বারবার?
পাহাড়ের রূপ, গাম্ভীর্য, তার চ্যালেঞ্জ এসব তো বাদই দিলাম। তার
বাইরেও কিছু কিছু জিনিস যে থাকেই।
প্রথম কারণ অবশ্যই, কষ্টের আশু স্বীকৃ তি। অত্যন্ত প্রতিকূলতার মধ্যে
দিয়ে অত্যন্ত কষ্ট করে যেখানে পৌঁছনো যায় বা আমরা পৌঁছই, সে
জায়গাটা সাধারণত আমজনতা ছুঁ য়ে দেখতে চান না। এই পরিশ্রমের
স্বীকৃ তি আমাদের motivate করে। এ কষ্ট চোখে দেখা যায়, এ কষ্টকে
হাত বাড়িয়ে ছোঁয়াও যায়। এ এক ধরণের যশোলাভের ইচ্ছেও বটে।
দ্বিতীয়ত, আমরা হয়ত একটু আলাদা ধরণের মানুষ যারা নিজেদের
ক্ষমতাকে সবসময় চ্যালেঞ্জ করতে ভালবাসি। সবসময় নিজেদের শারীরিক
বা মানসিক limit push করাটা আমাদের কাছে শ্রেয় এবং প্রেয়। নাহলে
একই রাস্তায় অগুনতিবার হাঁটার কোনো অন্য যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে
পাওয়া যায় না।
এভাবে যেতে যেতে একটা গন্তব্যে সফলভাবে পৌঁছলে সবসময়ই আমাদের
মনে হয়, এই রাস্তাটা হাঁটা হলো, কষ্ট করে হলেও তো হলো, এর পরের
রাস্তাটা একটু হেঁ টে দেখি। ভেতরে ভেতরে একটা আত্মবিশ্বাসও কাজ
করে চলে অবিরাম, এটা পেরেছি যখন, পরের কঠিন রাস্তাটাও পারব।
ওটা এর চেয়ে একটু বেশি কঠিন বই তো নয়। আরো একটু কষ্ট হবে,
এর বেশি আর হবে কি!
আমরা যারা বারবার এই কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে চাই, বা যারা নিজের
অজান্তেই হিমালয়ের কোলে শেষযাত্রায় যাই তাদের মনের মধ্যে সর্বদা এই
ভাবনাই কাজ করে চলে। সারা জীবন এই কষ্টের মধ্যে দিয়ে ঘুরে এসে
শেষে এই কষ্টকে একেবার ব্রাত্য করে দিতে মন চায় না আমাদের।
হয়ত সেইজন্যেই অন্তিম গন্তব্য হিসেবেও হিমালয় এতটাই অভীপ্সিত হয়ে
ওঠে।
এই ছবিটি আমাদের গাইড বুধি তামাং তু লে দিয়েছিল। পেছনদিকে
মাছাপুছারে বা মৃচ্ছপুচ্ছ বা Mt. Fishtail কে দেখা যাচ্ছে।
পর্ব - ৩
সকাল সন্ধ্যে একই নিয়মের মধ্যে দিন কাটতে লাগল। একটা নির্দি ষ্ট
নিয়মে বাঁধা থাকলে মনে হয় বাকি দিন গুলোও এই একইভাবে চলে
যাবে। কিন্তু সবসময় তো সেটা হয় না, মানে হওয়া সম্ভব নয়, কারণ
যাঁরা সবার অলক্ষ্যে বসে বসে আমাদের দিনান্তের duty roaster তৈরী
করেন তাঁদেরও একটু আমাদের নিয়ে রসিকতা করতে ইচ্ছে হয়।
জানুয়ারীর মাঝামাঝি সৌমী জানালো যে ওর পায়ের আপাত-
অসুবিধেগুলো বেশ ভালোর দিকে আসতে শুরু করেছে, খুব একটা
অসুবিধে নেই, ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে, আর ওর এক আত্মীয়,
যিনি মাঝেমাঝেই হিমালয়ের সান্নিধ্যে দিন কাটাতে ভালবাসেন, তাঁর
সঙ্গেও ওর এই যাত্রার ব্যাপারে বিস্তারিত কথা হয়েছে, তিনিও অভয়
দিয়ে বলেছেন যে ওর বর্ত মান অবস্থায় এই যাত্রাটা এমন কিছু কঠিন
চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে না।
আমি নিশ্চিন্ত হলাম, এই ভেবে যে, এবারের যাত্রায় আমাদের দুজনের
শ্রীচরণ-যুগলকে আর কিছু দিন একটু সাবধানে রাখতে পারলে হয়তো খুব
বেশি কষ্ট হবে না।
তখন আমার স্পীড একেবারে যেমনটি চেয়েছিলাম তার কাছাকাছি
পৌঁছেছে, পায়ের muscle toning মোটামুটি অভিপ্রেত জায়গায় এসেছে, দৌঁড়ে
পাঁচতলা উঠতে পারছি না হাঁফিয়েই প্রায়। ফলে এই স্থিতাবস্থা চলতে
থাকলে বাকি দিনগুলোর জন্য নিশ্চিন্ত।
ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় হঠাৎ করে আমার জ্বর হলো। শুধু
জ্বর, ইনফ্লুয়েনজা মত, আর কিছু হয়নি। জ্বর সেরেও গেল। এর পরে
হাঁটতে গিয়ে দেখলাম কোমরে অসম্ভব ব্যথা করছে, আর একটু নড়াচড়া
করলেই বিচ্ছিরি রকমের ক্লান্তও লাগছে।
দু-তিনদিন সবরকমের শরীরচর্চ া বন্ধ রাখলাম। তারপরে চেষ্টা শুরু
করতেই আবার সেই একই অবস্থা।
মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে বসলাম, কারণ এর আগেপিছে অন্য কোনো
ইঙ্গিত আছে কিনা আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে। ডাক্তার তো
আছেনই, সঙ্গে আমিও একটু ভাবি।
ভাবতে গিয়ে মনে হল, দুসপ্তাহ আগে একটু হজমের এবং পেটের গণ্ডগোল
হয়েছিল। একেবারে অব্যর্থ symptoms, আমিই বোকার মতো পাত্তা দিই
নি।
নিশ্চিত হয়ে ডাক্তারবাবুকে ফোন করে বললাম, 'আমার কোভিড হয়েছে
এই নিয়ে দ্বিতীয়বার, দিন দশেক আগে।'
- 'কি করে বুঝলে?'
সব খুলে বললাম। কি ওষুধ খেয়েছি সেটাও বললাম।
উনি সব শুনে বললেন, 'হ্যাঁ কোভিডই হয়েছিল, আর এটা এখন আকছার
হচ্ছে। এভাবেই হচ্ছে আর সেরে যাচ্ছে। ভয়ের কিছু নেই।'
- 'আমি জানি ভয়ের কিছু নেই, কিন্তু হাঁটতে পারছি না তো। এপ্রিলে
যাওয়া। মাঝে মোটে একমাস বাকি।'
- 'একটা ভিটামিন খাও। শুরু করার দিন পাঁচেক পরে আস্তে আস্তে হাঁটা
শুরু করবে। ধর তক্তা মার পেরেক করে কাজ কোরোনা কিন্তু। আস্তে
আস্তে করবে।'
- 'আচ্ছা।'
যেমন কথা তেমনি কাজ। ওষুধ শুরু হলো। একটু একটু করে হাঁটাও
শুরু হলো।
তারপরে মার্চ মাস পড়ল।
এই একটা মাসই সময়। যা যা বাকি আছে সব করে নিতে হবে।
আগের বারের মতো এলার্জি র ইঞ্জেকশনের কোর্স শেষ করলাম। পা ঠিক
আছে, ব্যথা নেই, ফলে steroids নিতে হবেনা। তারপরে ডাক্তারের কাছে
গেলাম, routine check-up এর জন্য।
আমার ডাক্তাররা বেশ my dear ভদ্রলোক, 'বললাম, অন্নপূর্ণায় যাচ্ছি। একটু
দেখে দাও দেখি।'
- 'Oh, fabulous, তু মি যাও। আমি তো পারব না, ছবি দেখি বরং,' বলে
সব চেক করা হলো। দেখা গেল BP টা একটু ওপরের ceiling ছুঁ য়ে
আছে।
- 'ওষুধ খাও বিদিশা, কাল থেকেই।'
- 'হাতে তো বেশিদিন তো সময় নেই, এ ওষুধ সেট হতেও তো সময়
নেবে। রাস্তায় যদি কোনো অসুবিধে হয়!'
- 'হবে না, আমি সেই বুঝেই দিচ্ছি। না খেলে যদি high-altitude এ
অসুবিধে হয় তখন করার কিছু থাকবেনা। শুরু করো কাল থেকেই।
প্রায় পঞ্চাশে পৌঁছে এটা তো একটু এদিক ওদিক হবেই।'
- 'তা হবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।'
ওষুধ শুরু হলো। কিছু এদিক ওদিক কিন্তু বুঝলামই না।
এদিকে যাওয়ার টিকিট ইত্যাদি করতে হবে, যে সংস্থার সঙ্গে আমাদের
যাওয়ার কথা তারা যে তারিখে শুরু করতে চাইছে, সেদিনের টিকিটের
দাম আকাশছোঁয়া, আর তার সঙ্গে দিল্লীর আট-দশ ঘণ্টার ট্রানজিট।
ভেতরে ভেতরে ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠলাম।
সৌমী ফোন করে বলল, 'এখন দুদিন online ticketing site দেখো না
দিদি। আমি দুদিন পরে টিকিট কাটব। তু মি চিন্তা কোরো না।'
চু প করে বসে রইলাম।
অন্য একটা এদিক-ওদিক করাও আছে। আমাদের সংস্থা প্রতি সোমবার
ট্রেক শুরু করে। আমরা তো আর তার মধ্যে পৌঁছচ্ছি না। ফলে কথা
বলে ঠিক করতে হলো যেদিনই পৌঁছবো কাঠমাণ্ডুতে তার একদিন পরে
যাত্রা শুরু হবে। সেদিন যে বারই পড়ুক না কেন। আর দেখা গেল
যাত্রী হিসেবে আমরা হারাধনের দুটি কন্যেই হাত-ধরাধরি করে চলব।
ওদের একটা বড়ো টিম অন্নপূর্ণায় যাবে মে মাসে। তখন আমাদের
যাওয়ার অসুবিধে আছে।
তিনদিন পরে যাওয়ার ফ্লাইটের টিকিট কাটা হলো।
আমার মামু দেখলাম বেশ দুশ্চিন্তায় আছে। সবসময় দিন হিসেব করে
ফেরার টিকিট দেখছে। বুঝলাম ব্যাপার বেগতিক।
সৌমী যাওয়ার টিকিট কেটে মেল-এ পাঠিয়ে দিতেই আপ্পু হিসেব করে
আধঘণ্টার মধ্যে ফেরার টিকিট কেটে ফেলল।
যাত্রার বাকি যা বন্দোবস্ত সব মোটামুটি করা হয়ে গেল ধীরেসুস্থে।
এবার শেষ ক’দিনের ঝালিয়ে নেওয়ার পালা আর ব্যাগ গোছানোর
পালা।
এক সপ্তাহ আগে সুজিতদাকে ফোন করলাম। মাঝে বেশ কয়েক মাস
কোনো কথা হয়নি। এইসব recent development সম্পর্কে উনি কিছু ই
জানেন না। আবার পাহাড়ে যাচ্ছি, খবরটা ওনাকে দেবো না তা হয় না।
ফোন লাগল না। নিশ্চয়ই কাজের জন্য ইংলণ্ড কিংবা স্পেন যাচ্ছেন।
Message করে রাখলাম, 'দাদা, অন্নপূর্ণা যাচ্ছি।'
পরেরদিন উত্তর পেলাম।
- 'দারুণ খবর। চলে যান। এই যাত্রাটা আপনি পুরোটা দারুণ উপভোগ
করতে পারবেন। কারণ, নিশ্চয়ই আমার মতো কোনো মূর্তি মান রসভঙ্গ
মাঝ-রাস্তায় আপনাকে পুষ্পক রথে চড়াবে না।'
- 'থামুন দেখি দাদা। শোলুখুম্বুর অভিজ্ঞতাটা আমার জীবনের অন্যতম
সুন্দর অভিজ্ঞতাগুলোর একটা। আমি খুব খুব আনন্দ পেয়েছিলাম।'
হাসলেন সুজিতদা। ওটা মেসেজের উত্তরেই বুঝতে পারলাম।
- 'সাবধানে আসুন। ছবি দেবেন কিন্তু।'
- 'হ্যাঁ, আমার ছবি তোলার জ্ঞান আপনাদের কয়েকজনের চেয়ে ভাল কেই
বা আর জানে। আপনি অসম্ভব সুন্দর জায়গার অসম্ভব কুৎসিত ছবি
পাবেন।'
- 'তাই দেবেন। তাই দেখব। সাবধানে আসুন, দুগগা দুগগা।'
কথা ফু রোলো।
কলকাতায় যাঁদের জানানো দরকার তাঁদের সবাইকে জানানো হল।
আমার সব বন্ধু রা জানত, পিনাকীদা, মামাদা, সুদীপ্তদা,পারমিতাদি, সুতপাদি,
টিনা, মোম আর পূর্ণাকে জানালাম। আমার আরেক বন্ধু ইন্দ্রাণীকেও
জানালাম। আর যাঁরা প্রথম থেকে জানতেন তাঁরা তো জানতেনই।
সব কাজ সেরে নিশ্চিন্ত মনে ব্যাগ গোছাতে বসলাম।
(ক্রমশ)
পর্ব - ৪
মার্চে র শেষাশেষি সৌমীও এসে পড়ল কলকাতায়।
তখন বেশ গরম। সকাল-বিকেলের রুটিন maintain করতে দুবেলাই ঘেমে
স্নান করে যাচ্ছি। একটু থিতু হয়ে সৌমীই ফোন করল।
- 'বিদিশাদি, আমি পুণে থেকে সব গোছগাছ করেই এখানে এসেছি। যাতে
যাওয়ার জন্য খুব বেশি কিছু নিতে না হয়।'
- 'এই একটা দারুণ কাজ করেছিস। বারবার গোছগাছ করতে ভীষণ
বিরক্ত লাগে।'
- 'শোনো না, তু মি সেই যে পাহাড়ের জিনিসপত্রের লিস্টটা দিয়েছিলে তার
কিছু কিছু জিনিস এখন কিনে নেবো।'
- 'বেশি কি আর কিনবি? Thermals আর রেনকোট। ওসব কাঠমাণ্ডুতেই
পাবি। আমি তো দু-একটা জিনিস ওখান থেকেই নেবো। পারলে thermal
টা কিনে নিস। এখানকার thermal এ বেশ ভালই কাজ চলে যায়।'
- 'আচ্ছা। আরো কয়েকটা জিনিস এখানে কিনব। কিনে নিই বলো!'
- 'বেশি কিছু নিস না।'
- 'Sleeping bag এনেছি সঙ্গে করে।
- 'ওটা বাড়িতে রেখে দিয়ে যাস। লাগবে না।'
- 'লাগবে না ???' স্বপ্নভঙ্গের সুর সৌমীর গলায়।
- 'না, লাগবে না। প্রত্যেকটা tree house এ কম্বল লেপ এসব দেয়।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ওর বেশি কিছু লাগে না। লাগলে তো thermal
আছে।'
- 'না গো দিদি, আমি নিয়ে যাই, আমি ওখানে বরং নিজের জিনিসই
ব্যবহার করব।'
কিছু বললাম না। চাইছে নিতে নিয়ে যাক। পরেরবার ঠিক কম কম
জিনিস নেবে।
একে বলে অভিজ্ঞতা।
আর আমি তো Camp 1 এ থাকবো না। মানে ওখানে যাওয়ারই
যোগ্যতা নেই, থাকা তো দূরঅস্ত। ওই glacier আর crevasse trek করবে
কে? ফলে আমার sleeping bag লাগবে না। যদি বা কোনো বেস ক্যাম্পে
থাকতেও হয়, হয় মাছাপুছারে বা অন্নপুর্ণার কোনো একটায়, সেখানে বেশি
প্রয়োজন হলে প্রচু র layers আছে শীত আটকানোর। সঙ্গে উলের মোজা
আছে, তিস্তার বোনা সোয়েটার আছে, আর কি চাই !
ছোট্ট লাগেজ হলো। মোটে সাত কেজি।
সৌমিকে জিজ্ঞেস করলাম, 'তোর ফিটনেস কি অবস্থায় আছে রে?'
- 'জানো তো দিদি, বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে এনেছিলাম। হঠাৎ কতকগুলো
কারণে এদিক ওদিক হয়ে একটু ওজনটা বেড়ে গেল।'
ঢোঁক গিললাম, ফোনের এপার থেকে।
ওদিক থেকে সৌমী বলে চলেছে, 'সেই যে একবার একটু বেড়ে গেল না,
সেটা আর কিছু তেই নামছে না গো।'
আর ফেরার রাস্তা নেই।
বললাম, 'ওজন নিয়ে আমার অতো মাথাব্যথা নেই। তু ই দম, স্পীড আর
ফিটনেসটা দ্যাখ। এগুলো দেখতেই হবে।'
- 'হ্যাঁ, দশহাজার পা হাঁটতে কিন্তু সেরকম কোনো অসুবিধে হচ্ছে না।'
বুঝলাম, এ ছানা কষ্ট পাবে রাস্তায়।
তবু বললাম, 'হাঁটা বন্ধ করবি না কিন্তু।'
- 'না, হাঁটছি, এই কদিন হাঁটবও।'
- 'ঠিক আছে রে।'
বাক্সপ্যাঁটরা গোছানো শেষ। ওষুধপত্রও নেওয়া হয়ে গেছে।
যাওয়ার একদিন আগে সৌমী এলো। ওকে সামনে থেকে দেখেই পাহাড়ে
ও যে কতটা কষ্ট পাবে তার খানিক ধারণা হলো। যা হোক, বয়স কম,
কষ্ট হলেও চলে যাবে ঠিক। বেশিক্ষণ কষ্ট স্থায়ী হবে না। এটাই যা
সুবিধে।
ওকে বললাম, 'আমি কিন্তু Diamox খাবো গোটা ট্রিপটায়। কাঠমাণ্ডু
থেকেই শুরু করব।'
সৌমী বলল, 'আমি খাবো না দিদি। আমাকে একজন ডাক্তার বলেছিলেন
যে ওটা kidney affect করে। পাহাড়ের উচ্চতা manually সইয়ে নিয়ে
উঠতে। আমি তাই করব।'
ঠিক আছে। যা ইচ্ছে করবে করিস। আমি খাবো ওই কটা দিন। সঙ্গে
extra Diamox নিয়েও যাবো।
সুন্দর একটা কেক আর একটা quick drying towel উপহার হিসেবে
এনেছিল সৌমী। ওই দিয়েই আমার আর আপ্পুর অগ্রীম জন্মদিন পালন
করা হলো। একটু হা-হা হি-হি হলো। তারপর ও বাড়ি ফিরল, তখন
বেশ রাত হয়েছে।
এপ্রিলের ন-তারিখ সকালে আমরা কাঠমাণ্ডুর উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলাম।
কাঠমাণ্ডুতে সেই আগের মতোই হালকা বসন্তের শিরশিরে হাওয়া। খুব
বেশি লোক আর প্রায় ঘাড়ের ওপর উঠে পড়া গাড়ি বাদ দিলে এ
শহরটাকে আমার বেশ আপন আপন লাগে। বেশ নিজের দেশের মতোই।
আজ তো আর নতু ন আসছি না কাঠমাণ্ডু!
নয় নয় করে বার দশেক আসা হয়ে গেল।
প্লেন থেকে নেমে ঘণ্টাখানেক ধরে ওদেশে ঢোকার সব formalities
মিটিয়ে, আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে ব্যাগপত্র ট্রলিতে তু লে গটগটিয়ে
হাঁটতে শুরু করলাম। বাইরে গাড়ি থাকার কথা আমাদের pick-up
করার জন্য, নাম লেখা placard সহ। ড্রাইভারকে আমি চিনি। দুজনে
মিলে তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেললাম, কোনো placard এর চিহ্নমাত্র নেই
কোথাও।
আশ্চর্য ... এমন তো হওয়ার কথা নয়।
আরো আশ্চর্য, সৌমীর দেশের Vodafone connection নেপালে স্বচ্ছন্দে
কাজ করতে লাগল অথচ আমার Airtel তায় corporate connection ঘাড়
ট্যারা করে ধন্না দিয়ে বসে রইল।
ফোন করা হলো যে সংস্থা ব্যবস্থা করেছিল তাদের কে, তারা খবর নিয়ে
খবর দিলো গাড়ি এয়ারপোর্টে র পথে জ্যামে আটকে আছে, আসছে।
দুজনে একটা semi-open enclosure এ দাঁড়িয়ে আছি, গরম, কিছু করার
নেই, দু-একজন নতু ন placard নিয়ে উদয় হলেই চোখ কুঁ চকে পড়ার চেষ্টা
করছি প্রাণপণে।
সৌমী বলল, 'তু মি যে রেটে হাঁটছ, এখান থেকেই মনে হচ্ছে সোজা বেস
ক্যাম্প পৌঁছে যাবে।'
- 'দাঁড়া রে, মাঝে অনেক কাজ আছে।'
আরো দু-একবার ফোনাফু নি হওয়ার পরে একটা সাদা গাড়ি এলো। দেখি
সেই ড্রাইভার, কিন্তু placard নেই।
খপ করে থামালাম। আমার ভয়ঙ্কর হিন্দীতে বললাম, 'কোথায় ছিলে বাবা
এতক্ষণ ?'
- 'এই তো ম্যাডাম। ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে।'
সৌমীও ধরল, 'প্ল্যাকার্ড কই?'
- 'ম্যাডামকে তো চিনি।'
- 'আরে সে যতই চেনো না কেন, বিদেশে এলাম, placard দেখব না
নিজেদের নামের! সে কি হয় নাকি! কি দুঃখ দিলে বলো তো!'
- 'আরে ম্যাডাম, আমি ঠিকই দেখে নিতাম।'
- 'না, না,’ সৌমী অনড়। এটা তো ঠিক হলো না। নামের placard থাকার
কথা, প্রথমেই কিনা সেটা নেই। খুব খারাপ হলো তো,’ ক্ষোভ ঝরে
পড়তে লাগল ওর কথায়।
- 'ঠিক ঠিক। আমি পৌঁছেই রিপোর্ট করব,' সান্ত্বনা দিয়ে বললাম।
সৌমী ঘুরতে ভালবাসে, কোথায় কি দ্রষ্টব্য আছে সেগুলোও খুঁটিয়ে দেখতে
ভালবাসে, ফলে placard এর দুঃখ আপাতত মুলতু বী রেখে ঘোরার
পরিকল্পনা নিয়ে পড়ল। ফেরার দিন দুপুরে ফ্লাইট আমাদের, তার আগে
পশুপতিনাথের মন্দির আর রাজবাড়ি দেখা হবে, এই ড্রাইভারই নিয়ে
যাবে, এর সঙ্গে সেসব পরিকল্পনা তৈরী হয়ে গেল।
আমি চু পচাপ জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রাস্তা দেখতে লাগলাম।
(ক্রমশ)
ছবি সৌজন্য : সৌমী চৌধুরী
পর্ব - ৫
হোটেলে ঢু কে একটু আড়মোড়া ভেঙেই তৈরী হতে হলো। এবার
জিনিসপত্র কিনতে যেতে হবে। যে ছেলেটির আমাদের পোখরার বাসের
টিকিটপত্র permit ইত্যাদি handover করে দেওয়ার কথা তাকে আসতে
বলে দিয়েছি, তার জন্য অপেক্ষা করে হবে। একটা সিম কার্ড নিতে হবে,
কাজ প্রচু র।
নীচে গিয়ে কফি আর একটা কিছু নিয়ে বসলাম।
আমার প্রভূ ত নেশা আছে, আর সৌমী নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিয়েছে যে ওর
কোনো নেশা নেই, আমি তাতে সবিশেষ নিশ্চিন্ত ছিলাম।
কিন্তু এই নেশাগুলো আমার বড়ো আপন, এদের ছাড়া আমার চলবে না।
কফি শেষ করতে না করতেই নীতেশ এসে পৌঁছল। আমাদের
Annapurna Conservation Area র permit, পরেরদিনের পোখরা যাওয়ার
টিকিট ইত্যাদি দিয়ে গেল আর আমরা কোথা থেকে down jacket কিনব
সেটা বলে দিয়ে গেল।
আমরা দুই কন্যে মিলে তো বেরুলাম থামেলের রাস্তায়।
এবারেই হলো মজা।
ছশো মিটার মতো গিয়ে সে দোকান, নাম কালাপাত্থর স্টোর্স। রাস্তা
থেকে সরু গলি, সেটা হঠাৎ ডানদিকের দেয়াল কেটে ততোধিক সরু
ঁ তে পরিণত হয়ে ঘুরে ঘুরে তিনতলায় গেছে।
সিড়ি
তিনতলায় একটা বড়ো টানা লম্বা ঘর, সেখানে দেওয়ালের গায়ে টানা
লোহার বইয়ের rack দাঁড় করানো আছে, তাতে ঠাসা বরফের দেশে
যাওয়ার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। কষ্ট করে কোন বেসক্যাম্প বা কোন
পাহাড়ে যাবেন বললেই সেই আবহাওয়ার সঙ্গে মানানসই জিনিস হাতে
এসে যাবে। Down jacket, মোজা, sleeping bag, জলের বোতল, পাহাড়ে
ওঠার hardwares সব পাওয়া যায়। খালি দড়ি বা climbing dry rope
ছাড়া।
Down jacket এর সারিতে দাঁড়িয়ে একটা খুব অল্পবয়সী ছেলে, ট্রেকিং
প্যান্ট ইত্যাদির জায়গায় একটি মেয়ে, আর এমনি jacket, windcheater
এর ধাপিতে আর একটি মেয়ে। বাইরের সিড়ি ঁ তে মোজা carabiner,
jumar এর জায়গায় মালিক আর তার সামনে আরেকটি অল্পবয়সী মেয়ে
calculator হাতে দাঁড়িয়ে। এদের সবাইকে ঘিরে গোটা থামেলের রাস্তার
অর্ধেক ভীড় মাছির মতো লেপ্টে আছে। এই এতোগুলো লোক যদি
একসঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়ে কেনাকাটা শেষ করে, তাহলে কতটা লম্বা
আর ভয়াবহ traffic jam হবে সেটা ভাবতে ভাবতেই দেখি যে, আমি
আর সৌমী ওই বড়ো হলঘরটায় ঢু কে পড়েছি।
এরপরে আমরা যা করলাম তাতে থামেল কেন, চৈত্র সেলের গড়িয়াহাট
ফেল করবে।
যেকোনো বড়ো মাছবাজারের সিমেন্টের উঁচু চাতালের মতো টানা ফু ট
কুড়ি লম্বা চাতালের এমাথা থেকে ওমাথা অবধি ডাঁই করা বিভিন্ন
হিমাঙ্কের নীচের তাপমাত্রা মোকাবিলা করার down jacket এলোমেলো
করে রাখা, একটার ওপর আরেকটা। আমাদের প্যাকনা অনেক, রঙ পছন্দ
হয় তো ঢঙ পছন্দ হয় না, সেটা পছন্দ হয় তো সাইজে মেলে না, সাইজে
মেলে তো সেই কবেকার সুপ্ত ইচ্ছে jacket এর ওপরে সুন্দর করে আঁকা
North Face এর লোগো, সেটা পাওয়া যায় না, একেবারে মেফিস্টোফিলিস
কেস।
আঁটি আঁটি খড়ের গাদা থেকে সূচ ঁ খুঁজে বের করার ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা
নিয়ে আমরা মাঠে নেমেছি, এটু কুতে বিভ্রান্ত হলে চলে!
এমন খোঁজা খুঁজলাম এবং ওই ছানাটাকে দিয়ে খোঁজালাম যে, সে
শেষমেষ হাল ছেড়ে দিয়ে হাসতে শুরু করল।
এমন প্রতিক্রিয়া আমাদের মতো গড়িয়াহাট বিজয়ীদের কাছে ভীষণই
অপমানকর, বলাই বাহুল্য, সৌমী বলতে লাগল, একেবারে সেই আটকে
যাওয়া রেকর্ডে র মতো, - 'তু মি হাসবে না কিন্তু, একদম হাসবে না বলে
দিচ্ছি।' ও যত বলে, এ ততো হাসে, তার হাসি আর থামতেই চায় না।
পুরো গাদা করা মাল প্রায় বেলচা দিয়ে উল্টোনোর মতো করে এদিক
থেকে ওদিক দেখে তিন চারবার করে গায়ে চড়িয়ে পরখ করে দুটো
jacket আর একটা trek pant তো কেনা হলো। কিনে নিয়ে বেরোনোর
সময় আমি যখন বললাম, যে, ফিরে এসে একটা windcheater নেবো
এখান থেকেই, দেখলাম তখন তাদের চোখ ভু রুর বেড়া ডিঙিয়ে কপালে
উঠে পড়েছে।
কলার তু লে বিজয়ীর মতো বেরিয়ে এলাম।
দুজনের মনেই তখন এক অনুভূতি, 'আমি কি ডরাই সখী ভিখারী রাঘবে
!'
এবার সিম কার্ড কিনতে যাওয়া হলো, passport ইত্যাদি দিয়ে। হাতে বেশ
অনেকটা সময়, পাশে একটা দোকানে চা ও পাওয়া গেল, বেশ উত্তর
ভারতীয় ফ্লেভারের মসালা চা। লোভ সামলানো গেল না। সিম কিনে,
ছবি তু লে, তাকে activate করিয়ে, প্রচু র হাঁটাহাঁটি করে একটু warmed-up
হয়ে হোটেলে ঢোকা গেল।
পরেরদিন ভোর বেলায় ট্যাক্সি করে বাসস্ট্যাণ্ডে এসে বাসে বেশ জাঁকিয়ে
বসে পড়লাম দুজনে। আট-দশ ঘন্টার যাত্রাপথ। ট্যুরিস্ট বাস, দারুণ
আরামপ্রদ না হলেও নেহাৎ দুচ্ছাই করার মতো নয় বিশেষ। দেশী
বিদেশী অনেক যাত্রীই আছে। ইসরায়েল থেকে আসা এক Jewish
পরিবারের সঙ্গে আলাপ হলো, এক বছরের ছু টি নিয়ে world tour এ
বেরিয়েছেন ছেলেপুলে নিয়ে। ভদ্রলোক শিক্ষক, ভদ্রমহিলা নার্স। অনেক
গল্প হলো ওনাদের আচার উপাচার নিয়ে। গল্পের মাঝখানে দেখলাম
পাহাড়ী নদীর ধার ঘেঁষে চলেছি আমরা।
অনেক নদী পড়ে এ রাস্তায়, খুব স্বাভাবিক। পঞ্চান্ন কিলোমিটার বিস্তৃত
পর্বতমালা, অসম্ভব বড়ো একটা range যেটা ছড়িয়ে আছে নেপালের
উত্তরের বেশ অনেকটা অংশ জুড়ে, সেখান থেকে দু-একটা নদী নেমে এসে
তার করুণাধারায় সবাইকে সিক্ত করে তু লবে ঠিক এমনটা আশা করাই
বড়ো অন্যায়। কালী গণ্ডকি, শ্বেত গণ্ডকি, ত্রিশূলী, মার্সিয়াংদি সবাইকে চোখ
দিয়ে ছুঁ তে ছুঁ তে চললাম। এরা আবার নীচে নেমে জুড়ে জুড়ে গিয়ে
আমাদের গঙ্গাকে পরিপুষ্ট করে তু লেছে।
প্রথমে কথা ছিল এই রাস্তাটা ছোট প্লেনে যাওয়ার। যেমনভাবে আমরা
গিয়ে পৌঁছেছিলাম লুকলায়। কিন্তু উপর্যুপরি accident এর বহর দেখে
আমি রাজী হই নি। আর ট্রেকের আগে একটু শরীরের অন্য
আবহাওয়ায় নড়াচড়া হওয়া ভালো। সৌমীর যদিও ইচ্ছে ছিল ওপর
থেকে, মানে birds-eye view এর মতো করে দেখার, আমার মন তাতে
সায় দেয় নি।
ত্রিশূলী আর মার্সিয়াংদির সঙ্গমস্থলও পড়ে এ রাস্তায়। খুব সুন্দর
জায়গাটা। যাওয়ার সময় সৌমী ম্যাপ দেখতে দেখতে যাচ্ছিল। তা সত্ত্বেও
আমাদের বসে থেকে থেকে চোখ লেগে গেল। যখন চটকা ভাঙল, তখন
ওই সঙ্গম ছাড়িয়ে আরো সাত কিলোমিটার মতো রাস্তা চলে গেছি
আমরা। মনের দুঃখ মনেই রইল তখনকার মতো।
ঘণ্টা দশেক পরে, প্রচু র landslide zone পেরিয়ে, যেখানে পাথর সরিয়ে
রাস্তার কাজ হচ্ছে তখনও, বিকেল পাঁচটায় পোখরা পৌঁছলাম। দেখি
ফোনে একটি ছেলে, তার নাম বুধি তামাং, লিখেছে, 'আমি পোখরা
পৌঁছেছি। আপনাদের সঙ্গে দেখা করব।'
একে আমাদের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেয়নি কেউ, এর নামও বলে
রেখেনি আগে থেকে। বুঝলাম আমাদের এ-যাত্রার পাহাড়ী রাস্তার রাখাল
নিযুক্ত হয়েছে। এর হেফাজতেই নিজেদের সমর্পণ করতে হবে আগামী
কয়েকদিনের জন্য।
-'আচ্ছা,' বলে হোটেলের দিকে ছু টলাম। ততক্ষণে ধুলোয় পুরো স্নান করে
গেছি আমরা। আমাদের একটু পরিষ্কার হতেই হবে।
কাছেই হোটেল। হাতমুখ ধুয়ে, স্নান করে আমরা পোখরার অন্যতম
আকর্ষণ ফেওয়া লেক দেখতে বেরুলাম।
পাহাড়ী সূর্যাস্তের মেদুর আলোয় সে লেক অপরূপা, মোহময়ী। মায়ালোকের
ছায়াতরণী হয়ে যেতে তার এক মুহূর্ত ও দেরী হলো না। সৌমী তখন
প্রাণভরে নদীর ধারে পুজো এবং আরতির ছবি তু লছে।
আলো-আঁধারির একটা মায়া আছে, মায়া আছে জলেরও।
প্রায় জনশূন্য লেকের পাড়ে চু প করে বসে দূরের অস্পষ্ট শৈলশিরার
মাঝখানের স্তিমিত আলোয় আগামী কয়েকদিনের অদেখা স্বপ্ন-পারাবারের
মায়াজাল বুনতে লাগলাম মনে মনে।
(ক্রমশ)
পোখরার লেকের প্রচু র ছবি আমার time-line এ সবাই দেখেছেন, আরোও
দেখবেন সৌমীর time-line এ, ও সত্যিই অসাধারণ কিছু ছবি তু লেছে।
পর্ব - ৬
ততক্ষণে সৌমী বুঝে গেছে এই দিদির সঙ্গে চলতে গেলে সবসময়ই একে
আলাদা করে কোনো ফাঁকা জায়গা থেকে খুঁজে নিতে হবে। ভীড়ভাট্টায়
একে পাওয়া যাবে না।
বেশ অনেকক্ষণ ধরে আমাকে ফোন টোন করে, লোকে-লোকারণ্য জায়গা
থেকে location বলে বলে, ঠিক বের করে ফেলল। তারপরে সেই দমবন্ধ
ভীড়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে সেলফিও তু লে ফেলল।
মানতেই হলো, এ খুকির এলেম আছে।
এদিক ওদিক একটু পা চালিয়ে ঘুরে হোটেলে ফিরলাম। দেখি আমাদের
রাখাল অপেক্ষা করছে। সৌমী কথা বলতে বসল, আমি ওপর থেকে ঘুরে
এলাম।
ওকে আমাদের permit ইত্যাদি দিয়ে দিল সৌমী। পরেরদিন কখন
বেরুনো হবে, কিভাবে যাওয়া হবে সেই নিয়ে কথাবার্ত া হলো খানিক।
তারপরে ছেলেটি চলে গেল।
আগেরবার যেমন কলার তু লে interview নিয়েছিলাম, এভারেস্টে উঠেছে
কিনা জানতে চেয়ে, এবারে আর সে রাস্তায় পা বাড়াই নি। কোন
স্বপ্নভঙ্গ সে রাস্তার কোন কোণে অপেক্ষা করছে তা কেই বা বলতে
পারে!
সৌমীই সেসব খবর দিল। বলল, 'জানো, ও আসলে summitter, আমরা
দুটো মেয়ে যাচ্ছি বলে নীতেশের উপর্যুপরি অনুরোধে ও সঙ্গে যাচ্ছে। ও
শুধুমাত্র ট্রেকিং গাইড নয়।'
নড়েচড়ে বসলাম। যে রাস্তা যত বিপদসঙ্কুল সেখানে আগ্রহ তত বেশি।
সামনের বেশ কটা দিন হাতে আছে। বেশ অনেক কিছু জানা যাবে।
এদের সম্পর্কে যতই বলা যাক না কেন আমার মনে হয় কথা কম পড়ে
যায়। নিজের প্রায় সারা পাহাড়ী-পথে চলা জীবনে একমাত্র এদেরই
পুরোপুরি বিশ্বাস করে এসেছি। টাকা-পয়সা সহ। অত্যন্ত দায়িত্বশীল
মানুষ, আন্তরিকতা, আতিথেয়তার বোধ অসাধারণ, কোনোকিছু র সঙ্গে তু লনা
করা যায় না। যেকোনো প্রতিকূল অবস্থা এরা মোকাবিলা করে নেবে যে
কোনো রকম ভাবে। যদি করতে না পারে ওরা যাত্রীদের সঙ্গেই
শেষযাত্রায় যাবে, যেটা পাহাড়ে আকছার হয়ে থাকে।
এই লেখার মাঝপথে এসে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আমি জানাচ্ছি আমরা যেরকম
ভাবে আহত হয়েছিলাম, এবং যেভাবে নেমে এসেছি তার শতকরা দুশো
ভাগ কৃ তিত্ব এদেরই। আমাদের প্রায় বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে এরা দুজনে,
একজন বুধি তামাং অন্যজন পোর্ট ার সুরেন্দ্র।
পরেরদিন সকাল সকাল প্রাতরাশ হয়ে গেল। তারপরে গাড়ি এলো
আমাদের নিতে। কথা হয়েছিল, পোখরা থেকে কিমচে এই একান্ন
কিলোমিটার রাস্তা আমরা গাড়িতে যাবো। কারণ, এখানে গাড়ির রাস্তা
আছে। নাহলে এই রাস্তা পেরুতে আরো তিনদিন লেগে যাবে। কিমচে
থেকে আরেকটা গাড়ি নেওয়া হলো আরেকটু এগোনোর জন্য। যাদের
হাতে সময় থাকে, তারা এখানের শেষ দশ কিলোমিটার হেঁ টেই পাড়ি
দেন।
রোদ ঝলমলে দিন। রাস্তায় চলতে চলতে পাশের ক্ষেত খামার, দূরের
আঁকাবাঁকা পাহাড়ের পেছন থেকে উঁকি দিতে দেখা যাচ্ছে রাজেন্দ্রণীর
এক অংশ অন্নপূর্ণা সাউথ আর মাছাপুছারেকে। ছবি তু ললাম, কত দূরে
এখনও, এর কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছতে হবে আগামী কয়েকদিনে।
- 'দিদি, বুধি তামাং বলে উঠল। এখন থেকে মাছাপুছারেকে দেখে দেখেই
যেতে হবে।'
- 'আচ্ছা, মাছাপুছারেই টার্গেট তাহলে, এনাকে পেরিয়ে তবে মা-জননী। ওই
মাঝপথের আমা দাবলামের মতো?'
- 'কি বললে? আমলা-দামলা?' সৌমী জানতে চাইল।
- ‘আমলা-দামলা নয়, আমা দাবলাম, Everest Circuit এর সবচেয়ে সুন্দরী
শৃঙ্গ। যদিও নামটা Everest Circuit অন্য কোনো শৃঙ্গের সঙ্গে মেলেনা ...
হয়ত অতো সুন্দরী বলেই।’
- 'আপনি আর কোনো বেস ক্যাম্প করেছেন এর আগে?' গাইড জানতে
চাইল।
- 'হ্যাঁ, কাঞ্চনজঙ্ঘা, এভারেস্ট-লোৎসে, নন্দাদেবী ইস্ট, শিবলিঙ্গ।'
- 'কাঞ্চনজঙ্ঘা, ইণ্ডিয়ার সাইড দিয়ে করেছেন?'
- 'হ্যাঁ, সিকিম থেকে। সে অনেকদিন হলো।'
- 'তাহলে এটা এমন কিছু নয়।'
- 'না বাপু, এ সব হলো আটহাজারি পাহাড়, ও কি আর ছেড়ে কথা
বলবে? এদের এমন করে underestimate করা উচিত নয়। এনারা হলেন
সবাই রাজা।’
- 'আর যখন রাজত্ব এনাদেরই ...' মনে মনে না বলে থাকতে পারলাম
না।
খুব মিষ্টি করে হাসল বুধি।
আমাদের মাথায় তখনও মাছাপুছারে ঘুরছে। শৃঙ্গের মাথাটা ঠিক মাছের
ল্যাজের মতো, বড়ো anti-romantic কথা হলো এটা, বলা উচিৎ
মৎস্যকন্যার পুচ্ছের মতো।
- 'আচ্ছা, এতে এখনও অবধি কেউ ওঠে নি কেন?'
- 'একে তো আমরা ঈশ্বর বলে মনে করি।'
- 'কেন করো? আখ্যানটা কি? বিষ্ণুর মৎস্য অবতার ?'
- 'হ্যাঁ,' মাথা নেড়ে সায় দিল বুধি।
- 'তারপর, summit হয়নি কেন? কাঞ্চনজঙ্ঘাকেও তো আমরা ঈশ্বর ভাবি,
তাই তো ওই পাহাড়ের মাথায় পা দেওয়া বারণ ছিল একসময়।'
- 'আসলে যতজনই এতে উঠতে চেয়েছে তাদের মধ্যে একজনও বেঁচে
ফিরে আসেনি। ফলে পাকাপাকিভাবে এতে ওঠার সবরকমের প্রচেষ্টা বন্ধ
করে দেওয়া হয়েছে।'
পরে পড়লাম, গত শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষাশেষি মাছাপুছারে বা
মৃচ্ছপুচ্ছতে ওঠার চেষ্টা হয়েছিল। মূল সামিটের ১৫০ মিটার আগে
থেকেই British Climbing Team নেমে আসে, ঠিক যেমনটা এককালে করা
হতো কাঞ্চনজঙ্ঘার ক্ষেত্রে। তারপরে গত শতকেরই আশির দশকে
একবার ওঠার চেষ্টা করা হয়েছিল, সে চেষ্টা সফলও হয়েছিল। কিন্তু
ততদিনে এই পাহাড়ে পা রাখার অনুমতি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল
নেপাল সরকার। ফলে ওই summit বেআইনী বলে গণ্য হয়।
সৌমী একটা ব্যাপারে আমার মতো। খুব মাছ খেতে ভালবাসে। ও
মাছাপুছারেকে দেখতে দেখতে মাছের ল্যাজা খাওয়ার স্বপ্নও দেখে ফেলল।
আর এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই আমরা পায়ে চলার রাস্তার
গোড়ায় পৌঁছে গেলাম।
এ গাড়ি নামিয়ে দিল ঘান্দ্রুকের একটু আগে নয়াপুলে। এখান থেকে পায়ে
চলার পথ। সুরেন্দ্র আমাদের দুজনের rucksack দড়ি দিয়ে বেঁধে মাথার
সঙ্গে শক্ত করে আটকে নিল, আর বুধি সৌমীকে যাত্রার জন্য একটু
গোছগাছ করে দিতে লাগল। আমি ওর দিকে একটু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে
তাকাতেই বলল, 'এই একমাত্র রাস্তা, ডানহাতের রাস্তা ধরে হাঁটবেন দিদি।'
নিশ্চিন্ত হয়ে আমি পা চালালাম। পাহাড়ের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কষ্ট হয়
ঠিকই, কিন্তু মানুষ গুলিয়ে ঘোল খায় না কখনও। সুরপুরীর রাস্তা এক
এবং একমাত্রই হয়।
ঘান্দ্রুক একটা তু লনামূলকভাবে বড়োসড়ো গ্রাম, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায়
২০০০ মিটার মতো উঁচুতে। মোটামুটি হাজার ঘর গ্রামবাসী আছেন এই
কাছাকাছির পাহাড়গুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বড়োসড়ো বললাম এই
কারণে, এখান থেকে ঘন্টাদেড়েক হেঁ টে দুটো বড়ো পাহাড় আর জঙ্গল
পেরিয়ে চমরঙ ডাণ্ডা বলে যে গ্রামটায় পৌঁছতে হয় সেটা ঘান্দ্রুকেরই
আওতায় পড়ে। আর এই সব ছোট ছোট গ্রাম মিলিয়ে মিশিয়ে পড়ে
কাকসি জেলার আওতায়।
পা চালালাম মাটি, ধুলো আর পাথরের রাস্তায়। সৌমী ততক্ষণে এক ঝাঁক
ঈগল দেখতে পেয়েছে আকাশে, ও ক্যামেরা বের করে তৈরী হতে লাগল।
ভাল ভাল ছবি উঠু ক, আমি চলি।
যেতে যেতে দেখলাম এদিককার রাস্তা বেশ সুপরিকল্পিত ভাবে তৈরী
হচ্ছে, বড়ো একটা dumperdozer একটানা কাজ করে চলছে পাহাড়ের
গায়ের পাশেই। পাশে জড়ো করা আছে অজস্র লোহার খাঁচা। এগুলোর
মধ্যে বড়ো বড়ো পাথর ভরে খাদের দিকে মোটা লোহার তার দিয়ে
আটকে দেওয়া হবে, যাতে গাড়ি খাদে না পড়ে যায়, অনেকটা রেলিঙের
মতো করে। হাঁটতে হাঁটতে দেখি এক ভদ্রলোক চলেছেন সঙ্গে, হাতে
বিশাল এক বাণ্ডিল তার। সঙ্গে এক ছোকরা একটা বিশাল ব্যাগ নিয়ে
চলেছে।
হিমালয়ের রাস্তার মজা বেশ, চলতে চলতে যে কোনো মানুষের সঙ্গে দু-
চার মিনিট গল্প করে নেওয়া যায়।
- 'আপনি এখানে থাকেন?' জিজ্ঞেস করেই ফেললাম।
- 'আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি এই গ্রামেরই লোক, কিন্তু এখন থাকি পোখরায়। গ্রামে
যাচ্ছি একটা স্কু লে CCTV install করতে।'
-'এই রাস্তাই তো?'
-'হ্যাঁ, আর মিনিট কুড়ি, কাছেই। আপনি একা হাঁটছেন নাকি?'
-'না বোন আছে সঙ্গে, আসছে।'
-'ইণ্ডিয়া থেকে এসেছেন?'
- 'হ্যাঁ ...'
- 'ইণ্ডিয়ার কোথায় বাড়ি ?'
- 'কলকাতা ... '
- 'আচ্ছা, কলকাতায় তো আমরা মাঝেমধ্যেই যাই, যেতে হয়।' হাসলেন
ভদ্রলোক।
আমিও হাসলাম।
একটা বাঁক ঘুরছি তখন, দুজনের স্থানীয় লোক উল্টোদিক থেকে
আসছিলেন, ওনাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। ওনারা কথা বলতে লাগলেন।
আমি হাঁটতে লাগলাম।
মিনিট কুড়িই লাগল ঘান্দ্রুক পৌঁছতে। গ্রামের গেট দিয়ে ঢু কে সরু
পাথর বিছানো রাস্তা। একপাশে বাড়ি, তারপরে সিড়ি ঁ করে রাস্তা, সেখানে
আবার বাড়ি।
দ্বিতীয় বাড়ির চাতালে গিয়ে বসলাম, বেশ প্রশস্ত চাতাল, হাত পা ছড়িয়ে
বসা যায়। বন্ধু দের একটা ছবি পাঠালাম জায়গাটার। আগে গাইড
আসুক, সৌমী আসুক, তারপরে দেখা যাবে কোথায় থাকার ব্যবস্থা হয়েছে
সেই রাতের মতো।
অপেক্ষা করতে করতেই সেই ভদ্রলোক এসে পৌঁছলেন, CCTV র তার
হাতে করে। গ্রামের দোরগোড়ায় দেখা।
- 'আরে !!! আপনি পৌঁছে গেছেন? এখানে বসে আছেন কেন?'
- 'বাকিরা আসে নি তো। পোর্ট ার হয়ত এসেছে, কোথায় আছে জানিনা।
ওরা আসুক। '
- 'আপনার তো বেশ স্পীড !'
- 'কি যে বলেন ! এখনো তো কিছু ই শুরু হয়নি।'
- 'তা হোক, তবু ভালো স্পীড। খুব একটা কষ্ট হবেনা। All the best...'
হাত তু লে নমস্কার করলাম। প্রতি-নমস্কার করে উনিও চলে গেলেন
ওনার গন্তব্যের দিকে।
এর খানিক বাদে সৌমী এলো। আমরা আবার সিড়ি ঁ ভেঙে নিজেদের
হোমস্টের দিকে এগোতে লাগলাম।
(ক্রমশ)
পর্ব - ৭
ঘান্দ্রুক গ্রামটা মূলতঃ গুরুং সম্প্রদায়ের বাসস্থল। বেশিরভাগ মানুষই এই
সম্প্রদায়ভু ক্ত। এদের তৈরী করে দেওয়া একটা স্কু ল, একটা গুম্ফাও আছে
এর ছোট্ট পরিসরের মধ্যে। আর আছে একটা মিউজিয়াম। বেশ অদ্ভূ ত
শুনতে লাগলেও হিমালয়ের কোলে একটা প্রায় অশ্রুত গ্রামে একটা
সাংস্কৃতিক সংগ্রহশালা থাকতে দেখে আমরা বেশ একটু অবাকই
হয়েছিলাম সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। পাথর আর মাটি দিয়ে তৈরী করা
বাড়ি, তার ভেতরে ওদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, পেতলের মূলতঃ, সঙ্গে আরো
অনেক ধাতু র জিনিসও আছে। বাইরে ওই পরিবারের যাঁরা এসবের
দেখভাল করেন তাঁদের থাকার জায়গা। এই বাড়িটা দোতালা। নীচে
ওদের ঐতিহ্যবাহী জামাকাপড়ের সংগ্রহশালা। টিকিট কেটে ঢু কতে হয়।
সৌমী খুব আগ্রহী। আগেভাগে সেই মাটির ঘরে ঢু কে পড়ে দেখে নিল
সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
সেদিনটা বেশ ঝকঝকে ছিল। আমরা ঘান্দ্রুকে পৌঁছে একটা হোমস্টেতে
ঢু কে পড়লাম। তার চারতলায় আমাদের থাকার ঘর সঙ্গে attached
bath...
আমি বেশ ভালো করেই জানি যে, এই attached bath এর luxury টা
এখানেই শেষ। এর পর থেকে সব common washroom কপালে জুটবে।
কারণ, পাহাড়ের ওপরে প্রতিটি ঘরের সঙ্গে একটা করে bathroom বা
waterline installation এর কোনো অবস্থাই থাকে না।
তখনও অন্নপূর্ণার প্রায় পুরো range কে সামনে থেকে দেখা যাচ্ছে।
তখনও কুয়াশা আদর করে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে দেয়নি। বন্ধু দের
গ্রুপে জানতে চাইলাম কারা online এ আছে। Video call করতে হলে খুব
তাড়াতাড়ি করতে হবে। তিস্তা, বিদিশাদি আর আপ্পু দেখলাম online এ
আছেন। চট করে তিনটে ফোন করে ফেললাম। সৌমী খুব উত্তেজিত
হয়ে তো তিস্তাকে অভয় দিয়ে বলল, 'এখানে আমি যখন এত সহজে
আসতে পেরেছি, তোমার কাছে এটা কিছু ই মনে হবে না। তু মি এখনই
প্ল্যান করতে পারো। কালকের রাস্তাটা হেঁ টে তোমাকে বলব ওটা কেমন।'
দুজনে বেশ রাজীও হয়ে গেল দেখলাম।
যাকগে যাক বাবা। একজন ready reckoner পেয়েছে তিস্তা। যার পায়ের
অবস্থা ওর নিজের পায়ের মতো। সবচেয়ে ভালো করে ও-ই বোঝাতে
পারবে।
বিদিশাদির ফোন যখন শেষ হয়ে এসেছে তখন দেখলাম ঘন কুয়াশা
উঠে আসছে পাহাড়ের মাথায়।
আর কাউকে ফোন করে কিছু দেখানো যাবে বলে মনে হলো না।
যাওয়া এবং আসার সময় আমি চারটে দিন পরিষ্কার আকাশ পেয়েছিলাম
কিছু ক্ষণের জন্য। ওইটু কু সময় যাঁরা online থাকতেন তাঁদের ফোন
করতাম। একটু কথাও হতো, ভালও লাগত, আর হিমালয়কে একটু ছুঁ য়ে
দেখানোও হতো। অবশ্য connectivity ও এখানে একটা বড়ো ভূ মিকা
পালন করত। শেষের দিকে টাওয়ার পাওয়া যেত না একেবারেই।
হিমালয়ে সেটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
সৌমীর বেশ ভালো লেগেছিল ঘান্দ্রুক। সময়ও ছিল হাতে। ও আর
আমাদের রাখাল এদিক ওদিক ঘুরে বেরিয়ে সব দেখতে লাগল।
আমি গুটিগুটি ওই সংগ্রহশালা চত্বরে ঢু কলাম। এক মহিলা দেখভাল
করেন। বাইরের দিকে ওনার একটা স্টেশনারী দোকানও আছে। শ্যাম্পু,
সাবান, চিরুণী, লজেন্স এসব অনেক এটাসেটা পাওয়া যায়।
নাম জিজ্ঞেস করতে বললেন, 'আমার নাম লংকা।'
এই মাটি করেছে, এই মিষ্টি মহিলার নাম লংকা কেন?
জানতে চাইলাম গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে কিনা।
- 'না ছোট একটা ক্লিনিক আছে, টু কটাক কাজ চলে। হাসপাতাল আর সব
কিছু তো পোখরায়।'
- 'সে তো বহুদূর। Emergency হলে কি করবে?'
- ‘অল্প হলে গাড়ি পাওয়া যায়। আর বেশি হলে মরে যেতে হবে, এর
বেশি আর হবেটাই বা কি!’ নির্লিপ্ত মুখে উত্তর দিলেন মহিলা।
কি সহজ উত্তর, এদের অতি সহজ জীবনধারণের মতো। কি সহজভাবে
অন্তিমকেও এরা গ্রহণ করে নেয়। পাহাড় আর কঠিন জীবনধারণ
সম্ভবতঃ এটাই শেখায়। আর আমরা একটু কুতেই কতো হায় হায় করতে
থাকি।
হিমালয়ে সন্ধ্যে হলেই খেয়ে নিতে হয়। তারপরে রাত নটার মধ্যে গভীর
ঘুমে তলিয়ে যেতেও হয়। নাহলে পরের দিনের হাঁটা চৌপাট হয়ে যাবে।
ভোরে উঠে হাতমুখ ধুয়ে তৈরী হয়ে নিলাম। নীচে একটা ছাদ মতো
আছে। নেমে সেখানে এসে দেখি সামনে ঝলমল করছে অন্নপূর্ণা আর
মাছাপুছারে। দুজনেই ছবি তু ললাম।
প্রাতরাশ সেরে বেরুনো গেল।
প্রথমে পড়ল একটা পাহাড়ী জঙ্গল। এটায় আবার চড়াই নেই খালি
নীচের দিকে নামতে হবে। নেমে যেতে হবে এই অঞ্চলের মূল নদী
মোদীখোলার তীরে। সেখান থেকে আবার ওঠার রাস্তা। এই নীচের দিকে
নামতে হলেই আমার একটু হলেও বুক ধুকপুকনি শুরু হয়। কারণ, যতটা
নামতে হবে, প্রথমে সেই পর্যন্ত তো উঠতে হবেই, তারপরেও হয়ত আরো
ততটা, নাহয় তার অর্ধেকও উঠতে হতে পারে। মানে আমি যদি তিনশ
মিটার নামি তাহলে একটু পরেই আমাকে ওই তিনশ মিটার উঠতে হবে,
তারপরে হয়ত আরো তিনশ বা নিদেনপক্ষে আড়াইশ মিটার উঠতে হবে।
এই জঙ্গলটা বেশ দারুণ। পাহাড় আর পাথর, পাথরের ওপর শুকনো
পাতা, ফলে যিনি হাঁটছেন তিনি আদতে বুঝছেন না পরবর্তী পদক্ষেপে
পায়ের তলায় ঠিক কি রকম নুড়িপাথর পড়তে চলেছে। এর ওপর
সোনায় সোহাগা, পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ছোটছোট ঝোরা।
বেশ মজার ব্যাপার দেখলাম এখানে এসে। এই ঝোরাগুলো পাহাড় বেয়ে
নেমে এসে পাহাড়ী রাস্তাকে আড়াআড়িভাবে পেরিয়ে ডানদিকের বা
বাঁদিকের খাদে পড়ছে না। এগুলো পাহাড়ের ওপর থেকে পুরো রাস্তা
ধরেই নেমে আসছে নীচে, ফলে পুরো রাস্তাটা শ্যাওলা ঢাকা পিচ্ছিল হয়ে
আছে।
বুঝলাম অন্নপুর্ণার রাস্তা ভিজে। বিস্তৃত পর্বতমালা হওয়ার জন্য এই পথ
এতো রঙীন।
বস্তুতঃ, এ পথের শতকরা চল্লিশভাগ অংশই ভেজা।
বেশ অনেকের সঙ্গে নামছিলাম। কেউ কাউকে চিনি না, সব পথের বন্ধু ।
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ছিলেন। আমার চেয়ে বয়সে বড়ো। উনিই প্রথম
কথা বললেন, 'ম্যাডাম, আপনার এটা প্রথম ট্রেক?'
হাঁটতে হাঁটতেই হাসলাম।
- ' না ... হয়ত শেষ ট্রেক বলতে পারেন।'
- 'এর আগে কোথায় কোথায় গেছেন?'
- 'গতবছরই EBC করেছি,' বেশি কিছু ভেঙে বললাম না।
দাঁড়িয়ে পড়লেন ভদ্রলোক।
- 'গত বছর EBC, এই বছর অন্নপূর্ণা করে বলছেন আপনার শেষ ট্রেক?
কেন?' আর্ত নাদের মতো শোনালো ওনার প্রশ্নটা।
- 'এখনও তো অন্নপূর্ণা হয় নি। সবে তো শুরু।'
- 'EBC র পরে এটা তো ছেলেখেলা।'
- 'ওকথা বলবেন না। আটহাজারি শৃঙ্গ তো শেষমেষ। বয়সও হচ্ছে।'
- 'ম্যাডাম পারবেন ঠিক। আমি এই রাস্তায় এই নিয়ে সাতবার হাঁটছি।
আমার বয়স বাষট্টি। আপনার নিশ্চয়ই এতটা বয়স হয় নি।'
- 'না, Sir, তা হয়নি এখনও।
-'তাহলে থামবেন না। অন্ততঃ ধৌলাগিরি করে আসুন। ভালো লাগবে।'
- 'হ্যাঁ, ওই পুনহিল এর ওদিকটায় তো?'
- 'ম্যাডাম,' বলে হাঁটা বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন,
'আপনি কিন্তু খুব ভালো করে জানেন যে আমি ধৌলাগিরির Base
Camp এর কথা বলছি।'
- 'দেখি, যদি সম্ভব হয়, ভাববো।'
জঙ্গল পার হয়ে নদীর পাড়ে এলাম। এখানে ব্রীজ আছে, কিন্তু পাথরের
ওপর দিয়ে নদী পেরুলে সময় যথেষ্টরও বেশি কম লাগে। কোথায়
কোথায় পা দেবো তার একটা হিসেব নিকেশ ছকে নিয়ে চটপট নদী
পেরিয়ে গেলাম। এবার শুরু হবে ওপরে ওঠা। যতক্ষণ না পরের গ্রামে
এসে পৌঁছচ্ছি।
চড়াই শুরু হলো, জঙ্গলময় চড়াই, ওই ভিজে রাস্তা, কিন্তু পাথর সাজিয়ে
সাজিয়ে ধাপ করে দেওয়া আছে অধিকাংশ জায়গায়। ফলে কথায় কথায়
শ-দেড়েক সিড়ি ঁ , তারপরে একটু চড়াই রাস্তা আবার ওইরকম সিড়ি ঁ ।
গতবারে নারায়ণজীকে অন্নপূর্ণার কথা বলায় বলেছিলেন, 'ওখানে আর
যাওয়ার আছেটা কি, সব তো সিড়ি ঁ করে দিয়েছে। আপনি নামচে খুমজুং
ঁ র কথা ভাবছেন নাকি? তার চেয়ে মানাসলুর
পেরিয়ে এসে অন্নপূর্ণার সিড়ি
কথা ভাবুন বরং।'
বলে এমনভাবে তাকিয়েছিলেন যে আমি আর কথাটি খসানোর সাহস
করিনি।
তারপরে বলেছিলেন, 'Annapurna Circuit করতে ইচ্ছে হলে আমায় ফোন
করবেন। আমি নিয়ে যাবো।'
ইচ্ছে ছিল না যে তা নয়। কিন্তু একমাসের ধাক্কা। বাইশ দিনে প্রায়
আড়াইশো কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা পেরুতে হবে। আর আমি খুব
ভালো করে জানি যে, আমার এই ফিটনেসে সেটা সম্ভব হবে না। ওটা
নিছক difficult trek নয়, ওটা একেবারেই challenging trek ...
এই গোটা পাহাড়টা আমি প্রায় একাই হেঁ টেছি। এই হাঁটাটা হাঁটতে আমার
শুধু যে অসম্ভব ভাল লেগেছিল শুধু নয়, থেকে থেকে সেই প্রথম পাহাড়ী
জীবনে সিঙ্গালিলা পেরুনোর কথা মনে পড়ছিল।
চড়াই পেরুলাম, তারপরে একবার চড়াই একবার উতরাই, করতে করতে
পৌঁছনো গেল চমরঙ্গ ডাণ্ডায়।
চওড়া পাথরের সিড়ি ঁ পেরিয়ে সরু পাথরের রাস্তা তারপরে একটা কাঠের
বাড়ি, তার পাথরের চাতালে কাঠের চেয়ার টেবিল কয়েক পা এগিয়ে
গেলে চারদিক খোলা পাঁচিল তোলা viewpoint, পাঁচিলে বসার ব্যবস্থা
করা আছে।
সামনে ঝকঝক করছে অন্নপূর্ণা, ডানদিকে মাছাপুছারে। Online check
করা হলো। শুধু তিস্তাই আছে। ফোন করলাম। ও কি দেখেছিল ও ই
বলতে পারবে। তারপরে আপ্পু। ঘুমজড়ানো চোখে এমন করে, 'কি বলছিস
বল ...' বলল, যে আমি তখনই নিশ্চিত হলাম আপ্পু এই সুরপুরীর কোনো
সৌন্দর্যই দেখতে পাচ্ছে না।
আমি মাথায় বাঁধার রুমালটা খুলে একটা দড়িতে টাঙিয়ে দিলাম।
মোটামুটি ঠাণ্ডাতেও হাঁটার পরিশ্রমে ওটা ঘামে ভিজে সপসপ করছে।
রোদ আছে, কয়েক মিনিটে শুকিয়ে যাবে। পাশে একটা ছোট জলের কল।
ওখানকার লোকজনেরা বাসনকোসন ধোবার জন্য ব্যবহার করে। কল
খুলে ঠাণ্ডা জলে মাথাটা ধুয়ে নিয়ে চু ল আঁচড়ে রোদে বসলাম।
ততক্ষণে দেখি আমাদের গাইড বুধি এসে পড়েছে একা।
- 'সৌমী কই?'
- 'নীচে ছবি তু লছে, আসছে ...'
বুধির হাতে সময় ছিল। বসল পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে।
ওকে আমি ধরে পড়লাম।
- 'কোন আটহাজারের peak করেছ তু মি বাবু?'
- 'মানাসলু।'
আমি impressed ... মানাসলু কঠিন, খুবই কঠিন।
- 'আর ?'
- 'বাকি সব সাত আর ছ-হাজার। Everest Circuit এর অনেকগুলো,
Island Peak, Pumori, Thamserku, Lobuche East, আমার বাড়ি তো
ফেরুচের ওদিকে।'
- 'বলো কি খোকা? ওই ডিংবোচের ওদিকে? সোয়া চারহাজারের ওপারে?'
- 'হ্যাঁ , ওখানেই বাড়ি।'
আমি চু প। চোখ বুজে মনটাকে এক জায়গায় আনতে হলো।
- 'তোমার তো যাকে বলে পাহাড়ে চড়ার পায়ে খড়ি খুম্বতে ু । এভারেস্ট
হয়নি? লোৎসে?'
চু প করে রইল। হয়ত হয়েছে, কিন্তু certificate নেই, বা Camp - 4 অবধি
হয়েছে।
- 'আমা দাবলাম করেছ?'
- 'না ...'
- 'সে কি? খুব tricky এবং strategic climb তো ওটা। ওটা করলে না?
গত season ই তো Elitexped গেল।'
- 'আপনি খবর রাখেন?'
- 'হ্যাঁ, এদের সবকটা adventure এর খবর আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি।
পারলে পরের season এ যাও।'
যাও বলে দিলাম বটে। কিন্তু বললেই তো হয় না। Summit এর খরচ
আকাশছোঁয়া। সুযোগ পাওয়াও একটা বড়ো ভাগ্যের ব্যাপার এদের
কাছে।
এরা গ্রামের ছেলে, বড়োদের বা আমার মতো পাহাড়ে পা না দেওয়া প্রায়
মূর্খের কথাতেও মুখে মুখে তর্ক করে না। বুধি চু প করে রইল।
মাছাপুছারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমা দাবলামের কথা মনে
পড়ল।
আমা দাবলাম রূপসী ...
আমা দাবলাম অসম্ভব গরবিনীও বটে।
ডিংবোচের কাছে সামনে থেকে এই আসঙ্গলিপ্সু কিন্নরীর আলিঙ্গনোদ্যত
মূর্তি দেখে মনে হয়েছিল, এর আকুল আহ্বান উপেক্ষা করে যে অন্য পথে
হাঁটতে পারে তার হৃদয় সত্যি প্রস্তরবৎ কঠিন।
আমরা একে একপাশে সরিয়ে রেখে হাঁটি, কারণ মাথার পেছনে 'এভারেস্ট'
নামের কোনো এক মোহ কাজ করে চলে অবিরাম।
ফিরে এসে অনুভব করেছিলাম, এতটা অবহেলা না করলেও পারতাম।
এতটা নিষ্ঠুরতা ওই সুন্দরীর প্রাপ্য হতে পারে না কিছু তেই।
উঠে পড়লাম, মাথার রুমাল শুকিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে
পরের গ্রামে।
- 'বুধি, পরে একবার পারলে আমা দাবলাম যাবো। তোমার সঙ্গেই যাবো।'
- 'চলুন দিদি। আমার বাড়িতে দুদিন থেকেও আসবেন।' বুধি এককথায়
রাজী।
- 'হ্যাঁ, সঙ্গে আরেকবার যদি ...'
... কথা শেষ করি নি।
বুধি এভারেস্টের টান বুঝতে পেরে খুব মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ল।
(ক্রমশ)
পর্ব - ৮
ততক্ষণে সৌমী ছবি তোলা শেষ করে উঠে এসেছে যেখানে আমরা বসে
ছিলাম। আমি উঠে পড়লাম। যতটা রাস্তা তাড়াতাড়ি হেঁ টে পেরিয়ে
যাওয়া যাবে ততটাই সুবিধে। ও একটু বিশ্রাম নিক।
Viewpoint এর পাশের রাস্তা ধরে সোজা চলতে শুরু করলাম, সামনে
বেশ খানিকটা চড়াই, এটার জন্য মানসিকভাবে সবাই প্রস্তুতই থাকি। এই
রাস্তার প্রথমভাগে বেশ অনেকটা সিড়িঁ আছে, কিন্তু বাকিটু কু পাহাড়ী
চড়াই। একটু থেমে থেমে উঠতে হয়। কষ্ট যে একেবারে হয় না বলা
উচিত নয়, কিন্তু এটু কু তো হবেই।
রাস্তায় দুটি অল্পবয়সী ভারতীয় ছেলের সঙ্গে দেখা। অপসৃয়মান
কৈশোরের গন্ধ এখনও পুরোপুরি ওদের চোখ মুখ থেকে মুছে যায় নি।
পৃথিবী ওদের কাছে কত নতু ন, কত রঙীন। খুব ভালো লাগে এদের
দেখলে।
ওরা নিজে থেকে আলাপ করল।
- 'আন্টি, একা যাচ্ছেন ?'
- 'না বাবু, আমার বোন আছে সঙ্গে, আসছে।'
- 'আপনি বাঙালী ...?'
- 'হ্যাঁ, কি করে বুঝলে?'
- 'আমার মা বাঙালী।'
এটা জানার পরে আমি আর অন্য ভাষায় কথা বলিনি।
- 'থাকো কোথায় তোমরা ?'
- 'দেরাদুনের কাছে।'
- 'বলো কি? আমার মামাশ্বশুরের বাড়ি তো ওখানে ছিল। কত গেছি।'
- 'এখনও যান ? '
- 'না বাবা।'
- 'তোমাদের দলে আছো কজন?'
- 'আমরা ছজন যাচ্ছি। সবাই একই কলেজে পড়তাম।'
- 'বাহ। চলো। '
কথা বলতে বলতে সামনে সামনে হাঁটতে লাগল ওরা। খুব কাছে
কাছেই।
হঠাৎ শুনি ওদের দুজনের একজন বলছে, 'সমুদ্রে তো অনেক যাই। সমুদ্র
কেমন যেন অন্যরকম। আর এই পাহাড়কে দ্যাখ, এর মাঝখানে এলে
কেমন নিজেকে ছোট ছোট মনে হয়।'
এই বয়সেই এসব ভাবছে এরা। এখনও, এই যুগেও।
এক মুহূর্তে মনটা ভালো হয়ে গেল। ওই হাত বাড়িয়ে প্রায় ছুঁ তে পারা
আকাশটার মতোই ঝকঝকে।
আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ওরা।
এবার চড়াই শেষ, মানে তখনকার মতো। বেশ অনেকটা নীচে নামা
আছে। তারপরেই জানি আবার একটা প্রাণান্তকর চড়াই আসবে।
নীচে নামতে নামতে একটা ছোট্ট বাড়ি পড়ল রাস্তায়। পাশে দেখি একটা
বোর্ড লাগানো। সামনে গিয়ে দেখি ট্রাউট মাছের ফার্ম। একটা কুড়ি ফু ট
বাই পাঁচ ফু ট চৌবাচ্চায় ট্রাউট মাছের চাষ হচ্ছে।
সে বাড়ির চাতালে গিয়ে বসলাম। সঙ্গে সুরেন্দ্র ছিল।
- 'দিদি, চা লাগবে?'
- 'তু মি কি চা নেবে ?'
- 'না, লেবুর জলেই আমার হবে।'
- 'আমিও তাই নেবো। ওটায় খুব ঝরঝরে লাগে।'
মাঝারি এক গ্লাস লেমন স্কোয়াশ এলো। ঢকঢকিয়ে শেষও হয়ে গেল এক
লহমায়। মনে হল শরীরটা জুড়িয়ে গেল। চাতালে দুটো ভাল্লুকের মতো
লোমশ কুকুর ছিল। তাদের সঙ্গে খুব বন্ধু ত্ব করে ছবি তু লে উঠে
পড়লাম। আজ সিনুয়া পৌঁছতেই হবে।
আবার চড়াই, পুরো পাহাড়ী চড়াই রাস্তা। হঠাৎ টু কটু ক করে একটা খুব
লম্বা ছেলে চলতে লাগল আমার পাশে পাশে। এও অল্পবয়সী।
- 'আন্টি, ইণ্ডিয়া থেকে আসছেন?'
- 'হ্যাঁ বাবু।'
- ‘ইণ্ডিয়ার কোথায়?’
- ‘কলকাতা।’
- 'আমি বাংলাদেশ থেকে আসছি। ঢাকায় বাড়ি।'
- 'বাহ, কেমন লাগছে পাহাড়?'
- 'আগে তো আসতাম না, এই আসছি। বেশ অন্যরকম।'
- 'হ্যাঁ, পাহাড় একেবারেই অন্যরকম।'
- 'আপনার কি এটা প্রথম?'
- 'না বাবা, এটা দিয়ে শেষ করব ভেবে রেখেছিলাম।'
- 'আপনার একটা interview নেবো?'
- 'আমার আবার কিসের interview? যারা climb করতে যাচ্ছেন তাদের
interview নাও। ওটাই তোমার কাজে লাগবে।'
- 'না, অনেক সিনিয়ররা ABC যাচ্ছেন আন্টি, আমি যেসব সিনিয়রদের
রাস্তায় দেখছি তাঁদের interview করছি। একটু বলুন কিছু ।'
- 'আগে যা যা লিখেছি তাই-ই বললাম।'
দু-চারটেই কথা মোটে। শেষ হতে, 'আসি আন্টি,' বলে পা চালালো।
খানিক চলার পর দেখি আরেকটা ছোট্ট গ্রাম মতো। ছমরঙ, বেশ
ঁ । ঝপঝপ করে এগিয়ে যাচ্ছি
বাঁধানো রাস্তা, আরো সুন্দর বাঁধানো সিড়ি
তখন। হঠাৎ দেখি ডানহাতে একটা German Bakery, সেই নামচে বাজার
আর খুমজুঙের মতো। খুমজুঙে ভেতরে একটা cafeteria ছিল। এখানে
খালি takeaway counter, সেই apple pie, black forest, cinnamon roll,
সব আছে কিন্তু apple strudel নেই।
ছবি তু ললাম, সুজিতদাকে পাঠাতেই হবে। তখনও সকালের খাবার হজম
হয়নি। কিছু খেতে ইচ্ছে করল না।
এর পরে যে জিনিসটা সামনে এলো সেটা দেখে অন্তরাত্মা একটু ও কাঁপেনি
বললে খুব অন্যায় করা হবে। পুরো এক কিলোমিটার লম্বা সিড়ি ঁ , অর্ধেক
প্যারাবোলার মতো করে নেমে গেছে নীচে। খুব সুন্দর সিড়ি ঁ । তার মানে
ফেরার সময় উঠে আসতে হবে এই সিড়ি ঁ বেয়েই। পুরো সিড়িঁ টা নেমে
এলে নীচে দেখা যাবে একটা নির্মীয়মান গুম্ফা।
হাতে সময় ছিল। চারদিকটা খুঁটিয়ে দেখলাম। একটা দানপাত্র রাখা
আছে, তাতে যে যা খুশি অর্থসাহায্য করতে পারে এই গুম্ফা নির্মাণকল্পে।
ডানহাতে খাদের দিকে সিমেন্টের ব্লক বসানো, তার পাশে একটা লোহার
বোর্ড । তাতে এক ভদ্রলোকের ছবি আঠা দিয়ে আটকানো আছে।
ভদ্রলোককে দেখতে অনেকটা তিব্বতীয় ধর্মগুরুদের মতো।
নীচে ইংরেজীতে লেখা আছে, এই ভদ্রলোকের নাম Dennis Lee, ইনি হংকং
এর বাসিন্দা, ঘোড়েপানি ট্রেক এ গিয়েছিলেন। তারপর আর তাঁকে খুঁজে
পাওয়া যায়নি। ওনার সন্ধান দিতে পারলে পুরস্কারও ঘোষণা করা
আছে।
বেশ অবাক হলাম। ঘোড়েপানি যাওয়া এমন কিছু বড়ো ব্যাপার নয়।
মাত্র কয়েক কিলোমিটার চড়াই ভাঙতে হবে মূল viewpoint এর আগে
যেখান থেকে ধৌলাগিরিকে স্পষ্ট দেখা যায়। পুরোটার elevation তিন
হাজার মিটারও নয়। আমি তো ভেবেই রেখেছিলাম, যখন পা আর
নেহাৎ চলতে চাইবে না তখন ওইখানে যাবো। খুব উঁচু নয়, ফলে ওটাই
হাতের পাঁচ হিসেবে তোলা রইল।
ওখান থেকে হারিয়েও যাচ্ছে মানুষ। হয়ত কোনো শারীরিক প্রতিবন্ধকতা
হয়েছিল। উনি বুঝতে পারেন নি।
আর, এইসব ঘটনার জন্যেই গাইড ছাড়া পাহাড়ী রাস্তায় হাঁটতে দিতে
রাজী নয় নেপাল সরকার। একদিকে ঠিকই করছে।
এটা পেরিয়ে আরো একটু চড়াই। এখানেও সিড়ি ঁ আছে। উঠেই একটা
লম্বা দোকান, সামনে টানা ছাউনিওলা বসার জায়গা।
লোভ হলো।
ওই সিমেন্টের ধাপিতেই বসলাম, ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে তখন।
- 'কিছু লাগবে?' এক বয়স্ক ভদ্রলোক জানতে চাইলেন।
- 'তাত পানি।'
এক গ্লাস গরম জল এলো। তাতে একটা কফির পাউচ ঢেলে দু-চারটে
শুকনো ফল সহ পেটে চালান করে দিলাম। বেশ খানিকক্ষণ চলে যাবে।
এখানেও আরেকটা বোর্ড । ওই ভদ্রলোকের ছবি আটকানো।
সামনে দাঁড়িয়ে ঘোড়েপানির কথা ভাবছি।
- 'দিদি, adventure is dangerous...' বুধি পৌঁছে গেছে ততক্ষণে।
- 'সে তো বটেই,' adrenaline surge হয় খুব, motivation ও হয় বেশ।
কিন্তু dangerous তো বটেই। ওটা জেনেই তো আমরা এ পথে নামি।
- ‘আপনি এগোন। এরপরে ব্যাম্বুতে পৌঁছে দুপুরবেলার খাবার খেতে হবে।
আমি সৌমীকে নিয়ে আসছি। আর যেখানে, যাই খান না কেন, সঙ্গে
গার্লিক স্যুপ আর ginger lemon honey tea যেন থাকে।’
- ‘ঠিক আছে। তাই-ই খাবো।’
পিঠের ব্যাগটা ঠিকঠাক করে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। হিমালয়ের পথে
চলতে চলতে জায়গায় জায়গায় বেশিক্ষণ বসতে নেই, বসা যায় না, তাও
অনেকক্ষণ বিশ্রাম হলো।
এরপরে খুব বেশি খাড়া চড়াই ছিল না। একটু ওঠা-নামা ওঠা-নামা
চলতে চলতেই আস্তে আস্তে ঢু কে পড়লাম এক বিস্তৃত বাঁশের জঙ্গলে। ঘন
সবুজ বাঁশের জঙ্গল। কত রকমের সবুজ, শ্যাওলা সবুজ, হালকা সবুজ,
সঙ্গে মাঝে মাঝে দু একটা রডোডেনড্রনের গাঢ় লাল ফু ল একমাত্রিক
সবুজ জঙ্গলকে অন্যতর মাত্রা দিয়েছে। মাঝে মাঝে অচেনা কোনো গাছ,
যার পুরো কাণ্ডটাকে কোথাও ভেলভেটের মতো, কোথাও জামার লেসের
মতো করে জড়িয়ে রেখেছে উজ্জ্বল সবুজ বা হালকা নীলাভ সবুজ রঙের
পাহাড়ি মস, তার পাশ থেকে শীতঘুম ভেঙে দুহাত ছড়িয়ে আড়মোড়া
ভাঙছে একটা দুটো ছোট্ট তামা রঙের পাতা। প্রকৃ তির কারুকার্য দেখলে
মুগ্ধ হওয়া ছাড়া কোনো উপায়ই থাকে না।
এরপরে একটা ছোট চড়াই, এ চড়াই বেশ অনেকটা অঞ্চল ধরে ছড়ানো।
মনে হতে লাগল, উঠছি তো উঠছিই, রাস্তা আর যেন শেষ হয় না।
দুপুর দুপুর ব্যাম্বু পৌঁছলাম। তখন পা চলছে না প্রায়। সেই ভারতীয়
ছেলে দুটো দেখলাম প্রথম বাড়িটার চাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
- 'আন্টি এসে গেছেন আপনি?'
- 'হ্যাঁ বাবু।’ বলতে বলতেই বসে পড়লাম।
- 'একটা চকোলেট খাবেন?' ছেলেটা আমার দিকে একপলক তাকিয়েই
বলল।
আমার ব্যাগে চকোলেট আছে। কিন্তু তখন সারা শরীর ভেঙে আসছে।
বুঝতে পারছি এক্ষু ণি কিছু একটা energizer লাগবে। মাথা নেড়ে হ্যাঁ
বললাম।
- 'এই যে আন্টি, আসুন,' বলে একটা আস্ত sneakers আমার হাতে তু লে
দিলো।
অত্যন্ত দুঃসময়ে ছেলেটা আমার হাতে যে খাবার তু লে দিল, সে খাবার
আমি মাথায় ঠেকিয়ে গ্রহণ করলাম। এদের কৃ তজ্ঞতা জানানোর ভাষা
নেই। ওরা অত্যন্ত কুণ্ঠিত হলো দেখলাম। কিন্তু আমি তো প্রাণ ফিরে
পেলাম।
পুরো sneakers টা খেয়ে মনে হলো চারদিকটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
সামনে একটা জলের কল। মুখে পাইপ লাগানো। কল খুলে পুরো মাথা
ভিজিয়ে রোদে বসলাম।
- 'কি খাবেন দিদি?’ সুরেন্দ্র রান্নাঘরের অবস্থা তদারক করে এসে জানতে
চাইল।'
- 'নুডল স্যুপ।'
- 'গার্লিক স্যুপ তো?'
- 'হ্যাঁ, যা তোমরা খেতে বলবে।'
এক বাটি ধোঁয়া ওঠা রসুন কুচি দেওয়া নুডল স্যুপ এলো। খেতে খেতেই
শরীর গরম হয়ে গেল।
-'দিদি, তাড়াতাড়ি সিনুয়া পৌঁছতে হবে কিন্তু। আজ ওখানেই থাকা।'
- 'হ্যাঁ খেয়ে বেশিক্ষণ বসব না।'
এখানকার লোকেরা বেশ ডাল ভাত খেয়ে পাহাড়ী রাস্তায় মাইলের পর
মাইল হাঁটতে পারে। আমায় মেরে ফেললেও ওটা হবে না। ভাত পেটে
পড়লে আমি আবার বিছানা ছাড়া কিছু দেখতে পাই না। তাই ভাতটা
যতদূর সম্ভব এড়িয়েই চলি।
দুজনে মিলে খেতে বসলাম। সুরেন্দ্র যথারীতি খেলো ডাল-ভাত। আমি
নুডল স্যুপেই আটকে রইলাম।
(ক্রমশ)
পর্ব - ৯
খেয়ে খানিক এদিক ওদিক করে আবার সিড়ি ঁ পেরিয়ে খাড়া চড়াইয়ের
সামনে গিয়ে পড়া গেল। বেশ খানিকটা চড়াই ভাঙার পরে মোটামুটি
মিনিট কুড়ির ঢেউতোলা রাস্তা, মানে একটু উঁচু আবার একটু নীচু , এই
আর কি।
থেমে থেমে চলছি, ডানহাতের কোণে হিঁউচু লী আর মাছাপুছারেকে পরিষ্কার
দেখা যাচ্ছে। হিঁউচু লীর চূ ড়া থেকে একটু নীচে, আমার আন্দাজ বলে
দেড়শ মিটার নীচে বেশ স্পষ্ট একটা মেঘের রিং, ঠিক সৌরমণ্ডলের
অন্যতম গ্রহ শনির চারদিকে যেমন রিং দেখা যায়, তেমনই, শুধু এটা
ঝকঝকে সাদা রঙের। বেশ অন্যরকম লাগল। একেবারে নিটোল মেঘের
রিং আগে কখনও পাহাড়ের মাথার কাছে এভাবে দেখেছি বলে মনে পড়ে
না।
ছবি তু লে লাভ নেই, যা দেখছি সেটা ছবিতে আনতে পারব না। আমার
ফোনের ক্যামেরাও অতো কিছু শক্তিশালী নয়। ভালো করে দেখে আবার
চলতে শুরু করলাম। পরের কুড়ি মিনিটে আরো বেশ অনেকটা রাস্তা
চলার পরে দেখি রিংটা বেশ ভরাট হচ্ছে।
কিরকম হলো এটা? চোখের ভু ল নাকি?
তা সে চোখের ভু ল হোক আর যাই হোক, হাজার চেষ্টা করলেও ওর
বেশি আর কিছু ই দেখতে পাবো না। আরো একটা পাহাড় পেরুনো গেল।
রিংটা বেশ ভালরকম ভরাট হয়েছে। আলোটা একটু মরেও এসেছে।
- 'সুরেন্দ্র, আর কতটা ?'
এদের সঙ্গে আমার প্রথম থেকেই একটা বোঝাপড়া থাকে। কতটা চড়াই
আর কতটা উঁচুনীচু রাস্তা আগে থেকে বলে দাও বাপু, আমি সেইমতো
আমার এনার্জি খরচ করব। মানে যদি অনেকটা চড়াই থাকে আমি
প্রথমেই চেষ্টা করব যতটা পারি একচোটে পেরিয়ে গিয়ে বিশ্রাম করার।
উচু নীচু রাস্তা তো আদতেই পাহাড়ী ভ্রমণবিলাসীদের আকাঙ্ক্ষিত রাস্তা।
কষ্টের ভাগটা তো আগে শেষ করি।
আমাদের এসব body language এরা বোঝে। আলাদা করে বুঝিয়ে দিতে
হয় না।
- 'আর চল্লিশ মিনিট দিদি।'
- 'তোমার চল্লিশ মিনিট? তাহলে আমার তো একঘণ্টা দশ মিনিট লাগবে।'
- 'না, যে speed এ যাচ্ছেন তাতে একঘণ্টার একটু কমই লাগবে হয়ত।
শেষে একটা চড়াই আছে।'
- 'চলো চলো।'
আরো দুটো পাহাড় পেরুনো গেল। পঁয়ত্রিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে তখন।
বসলাম একটু । একটু জল একটা চকোলেট, দুবার বুক ভরে শ্বাস নেওয়া
তারপরে আবার উঠে পড়া। আরো কুড়ি মিনিট চলার পরে কয়েকটা
নীল রঙের বাড়ির টিনের চাল চোখে পড়ল। হিমালয়ের গ্রামগুলোর
বাড়ির চাল সব সাধারণতঃ নীল রঙেরই হয়। মানে গ্রামের কাছাকাছি
এসে পড়েছি।
তবে এই চক্ষু গোচর হওয়া মানেই কিন্তু পায়ের সামনে আসা নয়। ওই
আশার ছলনে ভোলার দিন আমরা পেরিয়ে এসেছি অনেক আগেই। ও
অধ্যায়ে পৌঁছতে আরো হয়ত কুড়ি মিনিট লাগবে। কারণ, মাঝের সেই
চড়াইয়ের মুখ দেখে উঠতে পারিনি তখনও।
চড়াই এলো চড়াই পেরুনোও হলো। একটু বেশিই সময় লাগল দেখলাম,
পুরোপুরি এক ঘণ্টাই। এবার সিনুয়াতে ঢোকার মুখের শেষ চড়াইয়ের
কোণে দাঁড়িয়ে আছি। পাশের খাদে বাঁশ আর অন্যান্য গাছের জঙ্গল, ঘন
এবং প্রায় গগনস্পর্শী।
বেশ ভালো করে দেখা যাচ্ছে অন্নপূর্ণা সাউথ হিঁউচু লী আর
মাছাপুছারেকে। হিঁউচু লীর চূ ড়ার পুরোটাই তখন ওই ঘন সাদা মেঘের
আড়ালে। বাকি অংশটা বেশ দেখা যাচ্ছে। এদিকটায় তখনও আলো
আছে ভালোই।
একমিনিট ভালো করে দেখে হাঁটা শুরু করেছি, বেশ গুম গুম করে
মেঘের গর্জ ন শুরু হলো। শুধু কয়েকবারই মাত্র। তারপরেই একটা
হিমশীতল হাওয়ার ঝলক একেবারে পাঁজর কাঁপিয়ে দিল।
না থেমেই হাঁটছি তখন। যতক্ষণ আলো পাওয়া যাবে ততক্ষণ পা চালিয়ে
চলতে হবে। সুরেন্দ্র মাঝে মাঝে মুখে শব্দ করতে লাগল।
জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, 'এরকম শব্দ করছ কেন?'
- 'ভালু আসে দিদি, বৃষ্টি হলে। শব্দ করতে করতেই যেতে হবে।'
'Bear' সিনেমাটা মনে পড়ল। প্রায় এইরকম পাহাড়ী অঞ্চল British
Columbia রই গল্প ওটা।
সিনুয়া পৌঁছলাম যখন, তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যে। আলোর তেজ
কমে এসেছে। এদিকে বৃষ্টির ছিটেফোঁটা নেই, কিন্তু অন্য কোনোখানে সে
যে এসেছে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় রইল না।
ছোটবেলার ভূ গোল বইয়ের সেই বৃষ্টির diagram টা মনে পড়ল। সেই
মেঘ জমে ওঠা, সেই পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খাওয়া, সেই পাহাড়ের গা বেয়ে
আরো ওপরে ওঠা, তারপরে ঘনীভূ ত হয়ে বৃষ্টি হওয়া। শুধু আমরা
যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হবে, আর যে
রাজনন্দিনীকে দেখতে যাচ্ছি তার মাথায় শনশনিয়ে বরফের বৃষ্টি হবে।
ও তো হতেই হবে, এতো বড়ো পাহাড়, আমাদের মতো একই অবস্থা হলে
মান থাকে কখনও?
মুড়ি মিছরির একদর !
তা কি হওয়া সাজে এহেন রাজঅন্তঃপুরে?
মনে পড়ল, গত বছর কাঞ্চনজঙ্ঘার summit এর ওপরে একটা লেকচার
এবং presentation শুনতে গিয়েছিলাম। যিনি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তিনি
বলেছিলেন প্রথম যাঁরা এই শৃঙ্গ জয় করেন (১৯৫৫ সালে), Joe Brown
এবং George Band, তাঁরা camp 4 থেকে summit push এর বেশ
কয়েকঘণ্টা পরে সামিটের কাছাকাছি পৌঁছে এক ভয়ঙ্কর ব্লিজার্ডে র সামনে
পড়েন। সে ব্লিজার্ড এমনই ভয়াবহ ছিল যে, তাঁরা একটা সময়
ভেবেছিলেন শৃঙ্গ জয়ের সম্ভাবনা না হাতছাড়া হয়ে যায়। এনাদের
অভিযানের ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে (১৯০৫ সালে) এই শৃঙ্গজয়ের যে
প্রথম অভিযান হয়েছিল সেই অভিযাত্রীরা তো এই ঝড়ের সামনে পড়ে
নেমে আসতে বাধ্য হন। Veteran climber দের মতে কাঞ্চনজঙ্ঘার এই
ব্লিজার্ড নাকি এই পাহাড়ের ultimate challenge.
সিনুয়ায় গিয়ে পৌঁছলাম। সিড়ি ঁ দিয়ে উঠে একটা বড়ো পাথরের চাতাল।
তার পাশে সিমেন্টের বসার জায়গা। এই বাড়ির লোকেরা এই অঞ্চলের
মধু সংগ্রাহক, এদের বলে honey hunters, কোন মধু খাওয়ার উপযোগী,
কোন মধু মানুষের খাওয়ার উপযোগী নয় তাও এঁরা জানেন। কয়েকশো
মিটার খাদ থেকে গজিয়ে ওঠা ওই বিশাল গাছ থেকে দড়িতে ঝু লে ঝু লে
এরা মধু আহরণ করেন।
চারপাশে ইতিউতি একটু ঘুরে বেড়ালাম। পায়ের ব্যথা ইত্যাদি শুরু
হয়নি তখনও। হাঁটার পরিশ্রমটা বোঝা যাচ্ছে ভালোই। আপাততঃ আমরা
পুরো যাত্রাপথের প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে এসেছি বললেই ঠিকঠাক ধারণা
করা যায়।
এ বাড়ির চারদিকে বিশাল বিশাল সিমেন্টের টব। সেই টবে বিশাল
বিশাল ঝিলমিলিয়ে ওঠা সাক্যুলেণ্ট। অধিকাংশের নতু ন পাতার ভেতর
থেকে বেরিয়ে আসা হাসি হাসি মুখের ফু ল সদ্য বসন্তের খবর ছড়িয়ে
দিচ্ছে পাহাড়ী আকাশে। কিছু অর্কি ডও ঝু লছে দেখলাম সামনের গাছে।
আর তাতে ফু ল নয় তো খালি রঙের ফু লঝু রি। কিন্তু ওই গাছটার
কাছাকাছি দাঁড়ানোর জায়গা না থাকায় ছবি তু লতে পারা যায়নি।
আশটা-পাশটা দেখে বেশ বড়ো এককাপ চা গলায় ঢেলে আমরা নিজেদের
ঘরে গেলাম।
পুরোনো দিনের লোহার ঘোরানো সিড়ি ঁ দিয়ে উঠে টানা বারান্দার শেষে
আমাদের ঘর। দুজনেই বসে তখন দম নিচ্ছি। আস্তে আস্তে ছন্দে ফেরা
গেল। সন্ধ্যেবেলা খাওয়ার ডাক পড়ল। আমি বলেই দিয়েছিলাম ডাল-
ভাত খাবো। ডাল-ভাত এলো। খাবারের অবস্থা দেখে বুঝলাম হিমালয়ের
বেশ অন্দরমহলে চলে এসেছি। এখন আর দারুণ ভালো কিছু পাওয়া
যাবে না। খেতে ভালোও লাগবে না বিশেষ।
কিন্তু খেতেই হবে, নাহলে হাঁটা যাবেনা, মানে পাহাড়ে চড়ার এনার্জি কম
পড়ে যাবে। কোনোরকমে মুখ বুজে সব খেয়ে নিলাম। যখন ওষুধ
খাচ্ছি, তখন বুধি জানতে চাইল কি কি ওষুধ খাচ্ছি আমি প্রতিদিন।
বললাম, - 'সকালে একটা হালকা প্রেশারের ওষুধ আর diamox, রাতে
একটা anti-allergic আর calcium supplements, ওটা আমায় খেতেই হবে
প্রতিদিন।'
বুধি মাথা নেড়ে বলল, 'কোনো অসুবিধে নেই দিদি। ঠিক আছে।'
পরে বুঝেছিলাম, উচ্চতাজনিত সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কি ত কোনো ওষুধ আছে
কিনা, বা আমার শরীরের ঠিক অবস্থা কি এটা ও ওই ওষুধগুলো থেকে
বুঝে নিল। যাতে পরে কোনোরকম শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সামলা
করতে পারে।
পরের দিন আমাদের বেশ অনেকটাই পথ পাড়ি দেওয়ার কথা। থাকার
ব্যবস্থা হয়েছে হিমালয় বলে একটা গ্রামে। মাঝে দুবার থামার দুটো
জায়গা পাবো। তাতেই মোটামুটি খাওয়া দাওয়া সেরে নিতে হবে।
বেরিয়ে পড়লাম, বলা ভালো দুগ্গা বলে ঝু লে পড়লাম।
আমরা রাতে যেখানে ছিলাম সেটা লোয়ার সিনুয়া এখান থেকে কুড়ি
মিনিটের চড়াই পেরিয়ে আপার সিনুয়া। এই গ্রামে খুবই কম কয়েকঘর
লোকের বসবাস। এটা পেরোনোর পরে দেখলাম আস্তে আস্তে জঙ্গলের
ওড়না জড়ানো পাহাড়ের চরিত্র আলাদা হয়ে যেতে লাগল। খুব একটু
একটু করে, খুব সন্তর্পণে। যেন কোনো অদৃশ্য শিল্পী আদিগন্ত এক
মনোমোহিনী ক্যানভাসে রঙের পরত চড়াতে চড়াতে শেষ করার একটু
আগে ছেড়ে দিচ্ছেন, এই ছেড়ে দেওয়াটা অসম্ভব subtle, এমনিতে চোখে
পড়ে না, কিন্তু এক মুহূর্ত থমকে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে নজরে আসে ঠিক।
আর সে ছেড়ে দেওয়াটাও বড়ো সুন্দর। ওপরের সব রঙ এসে আলতো
করে নীচের রঙহীনতায় মিশে যাচ্ছে, ঠিক সমুদ্রের ঢেউ যেমন করে
পাড়ে এসে ভাঙে, আর ফেনা ফেলে রেখে সরে যায়, ঠিক তেমনই।
বেশ অনেকটা চড়াই ভাঙার পরে একটা ছোট চটিতে এলাম। এখানে
দুটোই মাত্র বাড়ি দেখেছি। একটায় আমরা বসেছিলাম অন্যটা এর একটু
পাশে ছিল। খুব খিদে পেয়েছে তখন, আর বেশ ঘুমও পাচ্ছে দেখলাম।
এটা বেশ ভালো চড়াই, সৌমীর উঠতে সময় লাগবে। যথারীতি থুপ্পা বা
নুডল স্যুপের অর্ড ার দিলাম।
প্রচু র ট্রেকারের ভীড় সেখানে। ওরা সামলাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে।
বুঝলাম খাবার দিতে দেরী হবে। টেবিলে মাথা রেখে একটু ঘুমিয়েও
নিলাম। খাবার এলো যখন, দেখি সৌমীও এসে পৌঁছেছে। খাওয়া শেষ
করে একটু বসে আবার চলা শুরু হলো। আড়াইটে নাগাদ পৌঁছলাম
লোয়ার দোবানে। এখান থেকে কুড়ি মিনিট সিড়ি ঁ ভেঙে পৌঁছতে হলো
আপার দোবানে।
হিসেবমতো এইসব গ্রামের নীচের বসতিগুলোই প্রথমে তৈরী হয়েছে। পরে
ওপরে কয়েকঘর লোক নতু ন করে বাড়ি করে বসবাস করা শুরু করায়
upper আর lower এই দুটো ভাগে এই পাহাড়ী চটিকে ভাগ করে দেওয়া
হয়েছে।
আমরা মোটামুটি সবাই সাড়ে তিনটের মধ্যে পৌঁছে গেছি। এর পরের
থামার জায়গাই হিমালয়। আর ঘন্টাদুয়েকের রাস্তা। এমন কিছু নয়।
গরমকাল, সূর্য ডু বতে দেরী আছে। ছটা সাড়ে ছটায় পৌঁছলেও কোনো
অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। রাস্তায় অন্ধকার মনে হলে head lamp
জ্বালিয়ে পৌঁছে যাবো ঠিক। এমন সময় শুরু হলো বৃষ্টি। দফায় দফায়
বৃষ্টি। একেবারে আকাশ অন্ধকার করে পাহাড়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে
পাহাড়কে আদরে ভাসিয়ে দেওয়া বৃষ্টি। আমরা যতজন ট্রেকার ওখানে
এসে দাঁড়িয়েছিলাম, তারা সবাই একসঙ্গে আটকে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে
আমাদের সংস্থাকে জানিয়ে দিলাম অবস্থার কথা। এখানকার লোকেরা এই
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরুতে পারে, কিন্তু আমাদের পক্ষে সেটা খুব একটা
বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে না। পাহাড়ের বৃষ্টি, সেদিনটাই চলবে
বড়োজোর। পরেরদিন সকাল থেকে আকাশ আবার ঝকঝকে নীল হয়ে
যাবে।
ঠিক হলো, সে রাতটা ওখানেই থাকা হবে।
এতে আমাদের যেমন একদিকে সুুবিধে হল, অন্যদিকে বেশ অসুবিধেও
হলো।
(ক্রমশ)
পর্ব - ১০
দোভানের পাহাড়ী চটির ঘরগুলো নেহাৎই ছোট ছোট। একটা টানা লম্বা
ঘর, তাতে একটা লম্বা টেবিল, আর তার দুদিকে লম্বা লম্বা করে দুটো
করে স্কু লের বেঞ্চের মতো বেঞ্চ বসানো। ঘরের বাইরে ছাউনি ঢাকা
টানা বারান্দা।
দরজার দিকের দেওয়ালে একটা টানা চৌকি, তাতে তোষক কম্বল সাজিয়ে
বিছানা করা। কোণের দেওয়ালে একটা প্লাইয়ের তাক, তাতে wi-fi,
charging port ইত্যাদি রাখা রয়েছে।
এর পাশে ছোট ছোট প্লাইয়ের পার্টি শন করা ঘর, একটা করে প্লাই কাটা
জানালা, তাতে string দিয়ে পর্দ া লাগানো। একটা চোয়ার আর দুটো খাট,
বাড়তি বলতে একটু পা ফেলার জায়গা। ওইটু কু জায়গায় আমরা দুজন
একসঙ্গে পা ফেলতে পারব না। একজনকে বসে থাকতে হবে অন্য
একজন যদি নড়াচড়া করে।
সব ঘরগুলো পার হয়ে একটা washroom, তার পাশে একটা স্নানের
জায়গাও আছে।
বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে। একটু শুয়ে বিশ্রাম নিলাম। তারপরে বিরক্ত
হয়ে উঠে পড়ে পাশের খাবার ঘরে গেলাম।
খাবার ঘরের দরজা বন্ধ রাখতে হয়। নাহলেই হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া
ঢু কে পড়বে। আমরা বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে টু কটাক গল্প করতে
লাগলাম। সৌমী ইতিমধ্যেই পায়ে একটু আঘাত পেয়েছে, সেসব, তারপরে
এটা ওটা সেটা গল্প করতে করতে পেছনে একটা অন্যরকম শব্দ শুনে
দেখি একটা অল্পবয়সী মেয়ে YouTube চালিয়ে নেপালী সিনেমার গান
শুনছে। সে মোবাইলে বিভোর, সামনে কারা বসে আছে বা বসে নেই, কি
করছে সে সব তথ্য তার কেশাগ্রও স্পর্শ করছে না।
আমাদের আধ বেলা নষ্ট হয়েছে। তাতেই আমরা ঘোরতর চিন্তান্বিত।
কতটা মেকাপ দেওয়া যাবে আর কিভাবে দেওয়া যাবে তার হিসেব-
নিকেশ চলতে লাগল। ঠিক হলো, পরেরদিন খুব ভোরভোর বেরিয়ে যাবো
আমরা। হিমালয়ে পৌঁছে ব্রেকফাস্ট খাওয়া যাবে।
কোনো চিন্তা নেই। আমি সবেতেই রাজী। তখন আমাদের ফোনে
নেটওয়ার্ক ছিল না, ফলে ওদের wi-fi থেকেই আপ্পুকে ফোন করলাম।
দেখলাম, আপ্পুর একমাত্র প্রশ্ন 'তোদের ABC পৌঁছনো কবে?'
- 'কালকেই হয়ে যেত প্রায়, কিন্তু বৃষ্টির জন্য আটকে গেছি তো।'
কোনো সাড়াশব্দ নেই। বুঝলাম পছন্দ হয়নি। ফিরতে দেরী হলে আমাকে
বাজার থেকে বরফ কিনে নিয়ে গিয়ে রীতিমত snow wash করে দেবে।
- 'বললাম যত তাড়াতাড়ি পারি যাওয়ার চেষ্টা করব। বুঝতে পারছ তো
পাহাড়ী রাস্তা।'
বুঝতে তো সবাই পারছে। শুনলাম আপ্পু বলছে, 'দ্যাখ কতটা পারিস।
সাবধানে যাস।'
ফোন রেখে খেতে গেলাম। আমাদের সামনে তখন একটি বিদেশী ছেলে
আর এক মহিলা বসে। আলাপ করলাম। ছেলেটি তার মাকে নিয়ে
অন্নপূর্ণায় যাচ্ছে। সে অসম্ভব ভদ্র, খুব মিষ্টি করে কথা বলল আমাদের
সঙ্গে। ছেলেটির মাকে দেখে মনে হলো হয়ত তিনি কথা বলা একেবারেই
পছন্দ করেন না। কারণ, পুরো সময়টাই উনি চু প করে বসে রইলেন।
সত্যি বলতে কি গোটা ট্রিপে এদের দেখে আমি একমাত্র আশ্চর্য হয়েছি।
আজকের দিনে প্রায় দুর্গম পাহাড়ে একটি বিদেশী বা বলা ভাল শ্বেতকায়
যুবক তার মাকে নিয়ে চলেছে দেখে আমার খুব অদ্ভূ ত লেগেছে। এসব
মূল্যবোধ যেখানে আমাদের দেশেই চলে যেতে বসেছে, সেখানে ওদের দেশে
তো থাকারই কথা নয়। তা সত্ত্বেও এ তার মাকে নিয়ে যাচ্ছে।
ওরা সেইরাতে আমাদের পাশের ঘরেই ছিল। আমি বেশ অনেক রাত
পর্যন্ত ছেলেটিকে শুনলাম ফোনে অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছে
আর জরুরি নির্দে শ দিয়ে যাচ্ছে।
সেদিন রাতে কিছু তেই ভালো করে খেতে পারিনি। মনে হলো খাবার
গিলতে কষ্ট হচ্ছে। গোটা ট্রিপে ওই প্রথম এবং ওই শেষ আমি খাবার
থালায় রেখে উঠে পড়লাম। যেটা কখনও করি না। সৌমী বলল, 'দিদি,
খেয়ে নাও গো, না খেলে যিনি খাবার দিচ্ছেন তাঁর ভালো হয় না।'
বললাম, 'আমি কোনোদিন খাবার নষ্ট করি না রে, আজ খেলে মনে হচ্ছে
সব উঠে আসবে। আজ আর পারব না।'
ভোরের আলো ফু টতে না ফু টতেই বেরিয়ে পড়তে হলো। মোটামুটি জোরে
পা চালিয়ে চড়াই পেরিয়ে হিমালয়ে যখন পৌঁছলাম তখন বাজে সাড়ে
সাতটা।
পৌঁছে দেখি সেই ভারতীয় ছেলেদুটি বাইরে ঘোরাফেরা করছে।
- 'আন্টি, আপনাকে দেখে তো আমি ফিদা হয়ে গেছি।'
- 'কেন বাবু? আমাকে দেখে কেন? আমার তো বয়স হয়েছে!'
- 'না আন্টি, আমাদের আর চারটে বন্ধু কে দেখুন, তারা আপনার অর্ধেক
বয়সী তারা এখনও এসে পৌঁছতে পারল না। আর আপনি চলে এলেন।'
- 'আমি হয়ত আগে বেরিয়েছি বাবু।'
- 'না আন্টি, এসব কোনো excuse হলো না। প্রথমে আপনার সঙ্গে যখন
দেখা হয়েছিল, তখনও ওরা আপনাকে পেরোতে পারে নি আজও পারল
না। ওদের ছাব্বিশ বছর বয়স আন্টি, আর কবে পারবে?'
হাসলাম।
- 'এটা তোমাদের প্রথম ট্রেক?'
- 'আমাদের দ্বিতীয় ট্রেক। আগে একটা চারদিনের ট্রেক করেছিলাম।'
তাহলে সামনের ট্রেকে নিশ্চয়ই আমাকে পেরিয়ে যাবে। আমিও তাই
চাই। আমি যেখানে শেষ করব সেখান থেকেই তো তোমাদের শুরু
করতে হবে।
ছেলেটা সামনে এসে প্রণাম করল।
বললাম, 'এসো তো বাবু, তোমার সঙ্গে একটা ছবি তু লি। সেদিন তোমার
দেওয়া চকোলেটটা না থাকলে আমি মাথা ঘুরে পড়ে যেতাম।'
- 'কি যে বলেন আন্টি। খালি তো একটা চকোলেট।'
- 'এখানে দাঁড়াও বাবু, ছবিটা তু লি।'
ছবি তোলা হলো।
আমরা সামনের ঘরে গেলাম breakfast করতে।
ডিম, পাঁউরুটি, স্যুপ খাওয়া হলো। বেরিয়ে দেখলাম, ওদের দলের বাকি
চারজন চলে এসেছে। একটু বসে আমরা পা চালালাম দেওরালির
উদ্দেশ্যে।
চড়াই ভেঙে একটু এগিয়ে হাতে পড়ল একটা মাশরুমের মতো দেখতে
পাহাড়, ওরা বলে গুহা। মাশরুমের যে stem টা দেখা যায়, ঠিক সেরকম
একটা গলার মতো আছে ওপরের বিশাল পাথরের ছাতার নীচে। সেখানে
একটা বিশ্রামের জায়গাও করে রাখা আছে। আমরা অনেকে মিলে
বসলাম সেখানে। ওদিকে অন্নপূর্ণা আর মাছাপুছারে ঝকঝক করছে নীল
আকাশের গায়ে। কালকেই হয়ত পৌঁছব এদের সামনে। সবার মনেই
তখন একটাই প্রার্থনা, কাল যেন আকাশের মুখ ভার না হয়। কেউ মুখ
ফু টে কিছু বলছে না, কিন্তু হিমালয়ে সবার মনের ইচ্ছে বোঝা যায়
চোখের দৃষ্টি দেখলেই।
এখান থেকে আধঘন্টাটাক পরে খানিক দূর যেতে রাস্তার উল্টোদিকে
খাদের ওধারে দেখি একটা পাহাড়, পাহাড় তো চারদিকেই, সন্তত,
নিরবচ্ছিন্ন। তবে এ পাহাড় বড়ো অন্যরকমের, আশেপাশের এদের সব
আত্মীয় অনাত্মীয়দের থেকে আলাদা। পুরো খাড়া হয়ে একেবারে সমকোণে
উঠে গেছে মাটি থেকে। এর পাথর আদ্যন্ত কৃ ষ্ণবর্ণের, আর তার গা
থেকে ঝু লছে চামরের মতো খড়ের রঙের ঘাস। বুঝলাম এবারে আস্তে
আস্তে হাওয়ায় অক্সিজেন কমতে শুরু করবে। এবার কঠিনতর রাস্তার
জন্য তৈরী হতে হবে।
এসব পাহাড় সামনে দেখা গেলেও হাতের কাছে তো নয়, খুব মন দিয়ে
দেখার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ দেখি বুধি বলছে ওই দেখুন blue sheep,
ওই দেখুন ওই বাঁদিকের ঝোলানো পাথরটা থেকে ওপরের পাথরটায়
উঠছে। খুব চেষ্টা করে দেখতে হলো। দেখি, একজোড়া, Himalayan Ibex,
সত্যি সত্যি জোড়া কিনা জানি না, তবে দুটি ibex ওই খাড়া পাহাড়ের
এই পাথর থেকে ওই পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে খাবার জোগাড় করে
বেড়াচ্ছে।
বুধির হাতে সৌমীর ক্যামেরা ছিল। ও ছবিও তু লল বেশ কয়েকটা। দু
চার মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার চলতে শুরু করলাম, দুপুরের
মধ্যেই দেওরালি থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে।
বেলাবেলি পৌঁছনো গেল দেওরালিতে। আগের রাতে খাওয়ার টেবিলে
আমাদের সামনেই বসেছিল বুধি আর সুরেন্দ্র। দেওরালিতে বুধি আগে
থেকেই বলল, 'দিদি ফ্রায়েড রাইস খান। ওটাই আপনি খেতে পারবেন।
আর হাঁটাও আছে অনেকটা।'
চু পচাপ খেয়ে নিলাম। ফ্রায়েড রাইসে সব্জি আছে, ডিম আছে, canned
tuna আছে। খারাপ লাগল না। বুঝলাম ভাত হলে গলা দিয়ে নামত না।
এটা যেমনই হোক খাওয়া গেল। এখন খেতে হবেই। দেওরালি ছেড়ে
একটু এগোতেই শুরু হলো অচিনপুরীতে প্রবেশপথের শেষ চড়াই।
খানিকটা এগোনোর পরে একটু নামা আবার একটু নামা, এই করে
পৌঁছনো গেল ঘাসের রাজত্বে। একেবারে শক্ত খড়খড়ে খড়ের মতো
খড়ের রঙের বিশাল বিশাল ঘাস, আর তার পাশের পাহাড়ের গাছগুলো
কেমন ধুলোমাখা বিবর্ণ, পাতাগুলোয় যেন কতদিনের মরচে ধরে আছে।
ঠিক এইখান থেকেই শুরু হলো সেই অচিনপুরের প্রবেশদ্বার, যেখানে শুধু
চার কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে আড়াই ঘন্টা লাগে। এমন কিছু
চড়াই নেই এখানে, খুব বেশি পাহাড় ভাঙতেও হয়না, তবুও, এতো
প্র্যাকটিসের পরেও কিছু তেই, তা সে যত চেষ্টাই করুন না কেন, এখানে
পা চালিয়ে চলা যায় না।
পৌঁছতে হবে সন্ধ্যের আগে। যতটা পারি তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু
করলাম।
- 'দিদি, এই বাঁহাতি রাস্তা ধরে যাবো। Shortcut হবে।'
- 'আচ্ছা, চলো ... '
খানিকটা এগিয়ে দেখি, এক বিশাল তিনকোণা ice -field, দেখে মনে হচ্ছে
ঠিক যেন একটা চাদরকে ভাঁজ করে তিনকোণা করে একটা ঢালু জমির
ওপরে, ওপর থেকে নীচে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওপর থেকে ice-field টা
পাহাড়কে জড়িয়ে নেমে এসে পায়ে চলার রাস্তাকে ঢেকে নীচের খাদে
নেমে গেছে। দেখে মনে হতেই পারে এটা গ্লেসিয়ার, কিন্তু এটা আদতে
ice-field ই।
Ice -field এ সৌমী পা দিল আগে।
ও দু পা এগোনোর পরেই ছবি তু লতে চাইল, খুব স্বাভাবিক, ইচ্ছে হবেই।
আমি ওকে ছবি তোলার জায়গা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে গেলাম।
পায়ের তলায় শক্ত বরফ। সেই ছোটবেলায় কাঠি আইসক্রীম যেমন
কড়মড় কড়মড় করত, এই বরফও জুতোর নীচে ওইরকম শব্দ করতে
শুরু করল।
বেশ খানিকটা এগোনোর পরে ও কতটা এসেছে দেখতে গিয়ে দেখি, ice-
field এর শুরুর দিকেই পড়ে গেছে আর হাঁটু দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।
এই অঞ্চলে হাঁটার দুটো নিয়ম আছে, প্রথমত, তাড়াতাড়ি হাঁটতে হয়।
দ্বিতীয়ত, জোরে কথা বলতে নেই। কারণ যেহেতু এখানে হাওয়ায়
অক্সিজেনের পরিমাণ যথেষ্টরও বেশি কম, ফলে এখানের পাহাড়ে তেমন
কোনো বড়ো গাছ থাকে না পাথরকে আটকে রাখার জন্য, ফলে যখন
তখন এখানে ধ্বস নামে। আর জোরে কথা বললে, সেই শব্দের কম্পনেও
পাথর গড়িয়ে পড়তে পারে।
পাহাড়ে হাঁটু ব্যবহার করা বারণ। এটা rock climbing এর ক্লাসে
আমাদের মাথায় ডাণ্ডা মেরে শেখানো হতো। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম,
ও হাঁটু দিয়ে ওটার চেষ্টা করছে আর হাঁটু আরো বেশি করে ওই অল্প
বরফেই ঢু কে যাচ্ছে।
স্থান, কাল ভু লে চেঁ চিয়ে বললাম, - 'হাঁটু দিয়ে নয়, এমনি ওঠ।'
সুরেন্দ্র এগিয়ে গিয়েছিল, চার পা পিছিয়ে এসে আমার হাত ধরে টান
দিয়ে বলল, 'দিদি, আপনি এখানে কোনো কথা বলবেন না। আপনি চলুন।
ওকে গাইড সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। ঠিক নিয়ে আসবে, চলুন।'
বাধ্য হয়ে এগোলাম। একটু এগিয়েই এই ice-field শেষ। একটু পরে
দাঁড়ালাম। সৌমী পার হয়ে এসেছে। বুধি এসে বলল, 'সৌমী রেগে গেছে
শর্ট কাট নিয়েছি বলে।'
কিছু বললাম না। শর্ট কাট না নিয়ে ঘুরপথে এলে কপালে যে কি জুটতে
পারে তা ফেরার সময় মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলাম।
(ক্রমশ)
পর্ব - ১১
মাছাপুছারে বেসক্যাম্প অবধি পৌঁছতে যতটা রাস্তা পার হতে হয় তার
তিনভাগের একভাগও পেরোনো হয়নি তখন।
আবার রাস্তা, খানিকটা খাড়াই, কোথাও একটু ঢেউ-খেলানো, কোথাও আবার
হয়ত প্রচু র বড়ো বড়ো বোল্ডার বিছানো। মাটিটা একেবারেই গ্লেসিয়ারের
মাটি। এ মাটির একটা বিশেষত্ব আছে। খুব মিহি দানার মাটি, নরম,
আর প্রায় সব পাহাড়ের কাছাকাছি জায়গাতেই একই রকমের ঘন রঙের,
হলদে আর খয়েরির মিশেল হলে দেখতে যেমন লাগে ঠিক তেমনি, নজর
করে দেখলে হঠাৎ মনে হবে ভিজে মাটি।
সেদিন আকাশ ঝকঝকে, থেকে থেকেই আকাশে চক্কর দিচ্ছে air taxi,
হেলিকপটার এর উড়ে নীচের দিকে নেমে যাওয়ার ধরণ দেখেই মালুম
হচ্ছে আমরা কতটা উঠে এসেছি ওপরে। মাঝে মাঝে আমাদের পেরিয়ে
এগিয়ে যাচ্ছে অন্নপূর্ণার অভিযাত্রীদলের পোর্ট াররা। তাদের পিঠে একই
রঙের অভিযান সংস্থার দুটো বিশাল বিশাল duffle ব্যাগ মুখোমুখি করে
বাঁধা। আর প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গে বিশাল বড়ো একটা করে
অ্যালুমিনিয়ামের কেটলি।
- 'Rescue হচ্ছে দেখছি এবারে বেশ।'
- 'হ্যাঁ, দিদি, এবারে weather ভালো নয়। ওপরে ব্লিজার্ড চলছে খুব।
অসুস্থও হচ্ছে।'
শুনতে শুনতেই হাঁটতে লাগলাম। সুরেন্দ্র মাঝে মাঝে গান চালাতো।
ফোনে ডাউনলোড করা। হিন্দী, তামিল, নেপালী সব আছে। পুরোনো
থেকে নতু ন পর্যন্ত বেশ অনেক কিছু । বেশ লাগত। গানটা চলতে থাকলে
বেশ একটা rhythm এ চলা যেত। চলার আসল কষ্টটা থেকে একটু
হলেও মনটা সরে যেত।
একটা ice-field এর পরে আরেকটা, তারও পরে আর একটা, এই করে
করে গোটা চারেক ice-field পেরোনো গেল।
পরেরগুলো আকারে বেশ ছোটই।
শেষ ice-field টা পেরিয়ে একটু বসলাম। আরো অনেক রাস্তা বাকি, সেটা
যে বাকি বুঝতে পারছি কারণ চোখ ছোট করে বা বড়ো করে কোন
রকমেই কোনো নীল রঙের চালওলা ঘর চোখে পড়ছে না।
একটু জল আর চকোলেট খেয়ে নিঃশ্বাস ফেলছি, বুধি এলো।
- 'সৌমী কই?'
- 'কাছেই আছে, ছবি তু লছে।'
একটু চু প করে থেকে বলল, 'দিদি, আপনি আগে কোনো পাস ট্রেক
করেছেন?'
- 'না, তো, মিলাম আর পিণ্ডারি করেছি। ওগুলো তো গ্লেসিয়ার, steady
glacier... '
- 'তাহলে আপনি Island Peak summit করতে পারবেন ঠিক। কোনো
অসুবিধে হবে না।'
- 'কোন peak?'
- 'Island Peak...'
- 'ওই Everest Circuit এর সেইইইই peak টা, যেটার চূ ড়াটা দেখলে মনে
হয় চামচ দিয়ে ice-cream এর মাথাটা কেটে খেয়ে নেওয়া হয়েছে?'
এই প্রথম বুধি থমকালো।
ওর প্রায় বরফের দেশে জন্ম। ইচ্ছে হোক বা না হোক প্রায় সারাবছরই
চারদিকে এমনই আইস দেখতে হয়, যে আইসক্রীম এর স্বপ্ন হয়ত ওর না
দেখলেও চলে। ওদের অঞ্চলের প্রধান পরিধেয় হলো down jacket, নারী-
পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সকালে উঠে একটা polo neck ফু ল হাতা
thermal এর ওপর একটা down jacket চাপিয়ে নেয়। আর ফ্যাশান
বলতে চু ল straight করা আর চু লে রঙ করা। এরকম জায়গার মানুষ
হয়ে বুধি হয়ত দূরতম দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না একটা পাহাড় দেখে
কারুর অর্ধেক খেয়ে নেওয়া আইসক্রীম স্কু প এর কথা মনে হতে পারে।
আমরা গরমের দেশের লোক। আমাদের এসব একটু বেশিই লাগে, তাই
মনের ইচ্ছেতে, উপমায় আমরা নিরন্তর ice-cream খুঁজি।
বুঝলাম মাথায় ঢোকে নি।
তখন আর অন্য কিছু করে বোঝানোর চেষ্টা করার সময় নেই।
আমাদের পৌঁছতে হবে সন্ধ্যের আগে। ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বললাম,
'আচ্ছা বলো তো বাবু, ওই পাহাড়টা crampons পরে চড়া যাবে, ওই
microspikes? ওই গ্লেসিয়ার ট্রেকের মতো?'
অজানা অচেনা জায়গায় হঠাৎ করে রাস্তায় চেনা মানুষকে দেখলে যেমন
আনন্দ হয়, বুধির চোখমুখ তেমনই চেনা জিনিসের নাম শুনে ঝলমলিয়ে
উঠল। মাথা নেড়ে বলল, 'না দিদি, professional ice-crampons আর
climbing shoe লাগবে। খালি microspikes এ হবে না। Fixed rope ও
থাকবে।'
- 'তাহলে ছাড়ো বাপু, এজন্মে হলো না। Next life এ ভেবে দেখব। প্রথম
থেকেই দেখব, চিন্তা কোরো না, চারদিকে যা competition, একটু ও সময়
নষ্ট করব না। আমি আবার পাহাড়ে traffic jam পছন্দ করি না।'
আমি আর সুরেন্দ্র হাঁটতে শুরু করলাম। সৌমী ততক্ষণে ছবি তোলা
শেষ করে ওইখানে পৌঁছে গেছে।
আস্তে আস্তে আকাশের আলো কমতে শুরু করল। এতক্ষণ আমরা যেখান
দিয়ে চলছিলাম তার পাশেই বড়ো বড়ো বোল্ডারের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে
নীচে নেমে গেছে মোদীখোলা নদী। নদীর ওপাশে অগুনতি পাহাড়, আগে
তাদের মাথার ওপরে অল্প পাউডার ছড়িয়ে দেওয়ার মতো বরফ ছিলো।
এবারে আস্তে আস্তে দেখলাম এদিককার পুরো পাহাড়গুলোই বরফে ঢাকা।
ঠিক মনে হলো রাজেন্দ্রাণীর পার্শ্বচরীরা দিনান্তের অর্ঘ্য নিয়ে সারিবদ্ধভাবে
দাঁড়িয়ে আছে।
দিনের আলো স্তিমিত হয়ে আসছে, পারি না পারি এখন জোরে হাঁটতেই
হবে।
- 'আর কতদূর?'
- 'ওই যে দূরের পাহাড়টা দেখছেন, ওটার আরও একটা পাহাড় পরে।
একটু বাঁদিকে এখান থেকে দেখা যাবো না।'
কিছু বললাম না, দূরের পাহাড়টাই তো দেখছি তিনটে পাহাড় পরে চতু র্থ
পাহাড়। কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। কথা বলা মানেই
ফালতু এনার্জি নষ্ট।
ওখান থেকে পুরো একঘন্টা লাগল ওই চতু র্থ পাহাড়কে চাক্ষু ষ করতে।
দূর থেকে মনে হচ্ছে একটা মেঘের পর্দ া ঢাকা ছোট পাহাড় তার ওপরে
একটা লোহার pole আটকানো।
ব্যস, আর কোথাও কিছু নেই।
দু মিনিট দাঁড়ালাম।
এরও আধঘণ্টাটাক পরে, হয়ত আধঘণ্টার বেশিই লেগেছিল, ঠিক মনে
নেই, ওই পাহাড়কে পেরিয়ে একটা উঁচু জায়গায় উঠে এলাম। পাশে দুটো
খুঁটিতে একটা বোর্ড লাগানো, লেখা 'মাছাপুছারে বেস ক্যাম্প'।
এখান থেকে মাছাপুছারে অনেক দূর। আলোও কম। এটা পেরিয়ে আসবে
আমাদের থাকার জায়গা।
বোর্ড পেরিয়ে নীচে নামলাম। খানিক এগিয়ে নীচ থেকে উঠে গেছে
পাথরের সিড়ি ঁ । ওপরে তিনটে মাত্র বড়ো থাকার জায়গা। সামনে থেকে
দেখলে মনে হয় একটা বড়ো পুকুর থেকে তিনটে দীর্ঘ রাস্তার মতো
সিড়িঁ গেঁথে তিনটে বাড়িতে যাওয়ার পথ করে দেওয়া হয়েছে। উঠতে
বাঁহাতে কোরিয়ার পর্বতারোহীরা একটা emergency clinic বানিয়ে
দিয়েছে। যাদের rescue করা হয় তাদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য। দেখে
বেশ ভালো লাগলো।
খুব ক্লান্ত লাগছে তখন। সামনের ট্রি হাউসটায় যাওয়া হলো। উঠেই
পাশে ডাইনিং হল। আমি হুড়মুড়িয়ে ঢু কে পড়লাম। চা লাগবে এক্ষু ণি,
মিষ্টি জাতীয় কিছু , আমার পা ভেঙে আসছে।
ডাইনিং হলের চারপাশ কাঁচে মোড়া। একটা ছেলে এসে পর্দ া সরিয়ে দিল,
চারপাশ সাদা, মরা আলোয় সেটা নীলাভ সাদা লাগছে। তারপর জানতে
চাইল, 'ব্যবস্থা ভালই বলুন ম্যাডাম।'
বলে কি রে বাবা। এখানে এই যে এতটা infrastructure করতে পেরেছে
তার পেছনে যে কি ঘাম-রক্ত আছে তা কি আমরা বুঝি না!
বললাম, 'যা আছে তা আমাদের প্রত্যাশার বাইরে বাবু। আমরা এতোটা
সুবিধে পাবো ভাবিইনি।'
- 'কি খাবেন ম্যাডাম?'
- 'Ginger lemon honey tea ... হানি বেশি লাগবে, ওটা যেন double
থাকে।'
- 'আর কিছু নেবেন না?'
- 'না ওটাই লাগবে এখন।'
চা এলো। বসে বসে অনেকক্ষণ ধরে তারিয়ে তারিয়ে চা খেলাম।
তখনও সৌমী আর বুধি এসে পৌঁছয় নি।
খালি কাপটা সরিয়ে রেখেছি, এমনসময় সুরেন্দ্র এসে ঢু কল।
- 'দিদি চলুন।'
- 'কোথায় যাবো আবার?'
- 'এখানে জায়গা খালি নেই। পাশেরটায় দেখতে হবে।'
পাশেরটায় যাওয়া মানে আবার অতোগুলো সিড়ি ঁ ঁ র নীচের
নেমে সিড়ি
প্রথম ধাপ থেকে অন্য বাড়ির সিড়ি ঁ তে পা দেওয়া।
তখন সত্যিই শরীর দিচ্ছে না।
- 'চলো।'
টাকা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। সব সিড়ি ঁ ভেঙে একেবারে নীচে নেমে
দাঁড়ালাম। সুরেন্দ্রকে বললাম, ‘তু মি বাবু গিয়ে দ্যাখো এখানে থাকার
জায়গা হবে কিনা, নাহলে ফালতু ফালতু এই সিড়ি ঁ আমি চড়ব না।’
সুরেন্দ্র চলে গেল।
পাঁচ মিনিট পরে বেরিয়ে ডাকতে এলো।
- 'আসুন দিদি, জায়গা আছে।'
বাঁধন ছেঁ ড়া আনন্দ হলো। আগেরবারে ঠিক যেমন নামচে বাজারে পৌঁছে
হয়েছিল। যদিও নামচে বাজার পৌঁছনো এর চেয়ে অনেক কঠিন। তবু
এতো আনন্দ অনেক দিন পরে পেলাম। বুঝলাম, বিশ্রাম করতে পারার
আনন্দ অন্য অনেক আনন্দকেই ছাপিয়ে যায়। আসল কথা হলো প্রতিকূল
পরিবেশে থাকলে সামান্য প্রাপ্তিই অসামান্য হয়ে ওঠে।
প্রায় গোটা পঞ্চাশেক সিড়িঁ ভেঙে উঠলাম। উঠে বেশ খানিকটা গিয়ে
বাঁদিকে ঘর। ঘরে চারটে বেড। একটা দরজার সোজাসুজি, একটা
দরজার ডানদিকে। প্রথম বেডটার পাশে একটু জায়গা ছেড়ে দুটো বেড
একসঙ্গে জোড়া দেওয়া। সৌমীকে জোড়া বিছানা ছেড়ে দিলাম। ও
আরাম করে ঘুমোক, আমার ছোট বিছানাতেই চলবে। দরজার পাশের
বেডটায় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখলাম।
মাথার কাছে একটা জানালা, rubber lining দেওয়া, একেবারে নিশ্ছিদ্রভাবে
বন্ধ করা। জানালার বাইরে একহাত মতো দূরে পাহাড়ের দেওয়াল উঠে
গেছে। আর জানালার কাঁচের গা ঘেঁষে মাঝামাঝি অবধি এক ফু ট
চওড়া বরফের স্ল্যাব। দেখে মনে হচ্ছে কাঁচ চুঁ ইয়ে ঠাণ্ডা ঢু কছে ঘরে।
একটু ঘুমিয়েও পড়েছি। তখন সৌমী এলো। ওকে দেখে তখন আমারই
কষ্ট হচ্ছে। শুধু কষ্টই হচ্ছে না, বেশ একটু অপরাধবোধও হচ্ছে। কেন
মিছিমিছি এভারেস্ট এর কথা লিখে স্বপ্ন দেখাতে গেলাম। বাকিটা ও
করে ফেলবে ঠিকই, তারপরে আবার এতটা রাস্তা নামতেও তো হবে।
বেস ক্যাম্প করে ফেললেই তো আর পাহাড়ে চড়ার যতিচিহ্ন পড়ে যায়
না।
সৌমী বিছানায় খানিক বসল, তারপরে শুয়ে পড়ল।
একটু পরেই বুধি এলো।
- 'দিদি, তাড়াতাড়ি খেয়ে নেবেন। কাল মাঝরাতে বেরুবো। এই ধরুন
তিনটে নাগাদ। রেডি হয়ে নেবেন।'
- 'ঠিক আছে, কি কি নেবো?'
- 'ভেস্ট আছে তো আপনাদের?'
- 'হ্যাঁ ...'
- 'তাহলে প্রথমে ভেস্ট পরবেন, টপ বা শার্ট পরতে হবে না। তার ওপরে
thermals, তার ওপরে fleece, তারপরে down jacket, সঙ্গে মোজা, টু পি
আর গ্লাভস। মাথায় হেডল্যাম্পটা পরে নেবেন।
আর ঠিক রাত একটায় diamox খেয়ে নেবেন। দেরী করবেন না কিন্তু।
ব্যাগে বেশি কিছু নেবেন না। অল্প একটু টাকা রাখবেন, knee-cap,
emergency ওষুধ, sunglasses আর জল।'
- 'আচ্ছা। চকোলেট নেবো না তো?'
- 'লাগবে না, এতেই হয়ে যাবে। সব বাড়তি জিনিস রেখে যাবেন। এখন
বিশ্রাম নিন, ঠিক সাতটায় ডাকতে আসব। এখন ডাইনিং হলে গিয়েও
বসতে পারেন ইচ্ছে করলে।'
সৌমী দেখেছি বেশ লোকজনের মধ্যে থাকতে ভালবাসে। কিন্তু তখন
আমাদের একটু বিশ্রাম নিতেই হবে বুঝতে পারলাম। অন্তত যদি
মাঝরাতের লেপের ওম ছেড়ে পাহাড়ে চড়তে হয়।
(ক্রমশ)
পর্ব - ১২
সাতটার সময় বুধি আসার আগেই আমরা দুজনে দুজনকে প্রায় খুচি ঁ য়ে
উঠিয়ে ছাড়লাম। বুঝতে পারছি ঘুমোতে হবে তাড়াতাড়ি। নাহলে
মাঝরাতের অভিসার একটা বড়োসড়ো প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়বে।
ডাইনিং হলে গেলাম। সৌমীর সত্যি কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি, ও প্রায়
নিজেকে টেনে নিয়ে চলছে। আমারও যে হচ্ছে না তা নয়, পা অসম্ভব
ভারি লাগছে। পা ফেলতে গেলে দেখেশুনে পা ফেলতে হচ্ছে। যে
জায়গায় সিড়ি ঁ ছাড়া গত্যন্তর নেই সেখানে এই পা ফেলা মানে যে কি
যন্ত্রণা তা ভু ক্তভোগী মাত্রই জানেন।
আমরা সম্ভবতঃ দুজনেই ফ্রায়েড রাইস খেয়েছিলাম। ওটাই তখন একমাত্র
পেটভরা খাবার যা আমরা খেতে পারছি। পাহাড়ের খুব ওপর দিকে
বেশ মজা আছে। চারহাজার মিটারের পরে যেহেতু খাওয়ার ইচ্ছে অসম্ভব
কমে যায়, ফলে খাবারের পরিমাণও এখানে কম থাকে। আর সব জিনিস
নীচ থেকে হয় খচ্চরের পিঠে নয় মানুষ বয়ে নিয়ে যায় বলে দামও
সাংঘাতিক চড়া। আমরা নিজেদের বাড়িতে যেরকম প্লেটে বড়ো বড়ো
বাটি ঢাকা দিই, সেইরকম এক প্লেট ফ্রায়েড রাইস এলো।
খাওয়া শেষ হলো। যতগুলো precautionary medicine খাওয়া সম্ভব সব
খেয়ে নিলাম। শুধু রাত একটার জন্য diamox তোলা রইল।
বুধি আমাদের good night বলতে ঘরে ঢু কল। ও ততদিনে আমাদের
পছন্দ অপছন্দ সব বুঝে গেছে। প্রথম থেকে আমাদের বলে দেওয়া ছিল
সাড়ে তিন হাজারের পর থেকে যেন আমরা গরম জল খাই, নাহলে
নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। খুব গরম জল সহ্য না হলে একটু
গরম জল মিশিয়ে বা উষ্ণ জল। আমরা দুজন আবার দুরকমের। আমি
খুব গরম জল গরম চা খেতে পারি, সৌমীর আবার খুব গরম পানীয়তে
সমস্যা হয়।
বুধি এদিক ওদিক দেখে বলল, 'দিদি, অতো রাতে কাউকে তো পাবো না।
আপনার একটু গরম জল লাগবে তো?'
- 'হ্যাঁ, দুজনেরই তো উঠে জল লাগবে। তখন temperature কত থাকবে?'
- 'মাইনাস 3/4 থাকবে। দাঁড়ান দেখি।' বলেই হনহন করে কিচেনে চলে
গেল। কয়েক মিনিট পরে একটা ফ্লাস্ক নিয়ে হাজির গরম জল সহ।
- 'দিদি, এটা রইল, গরম থাকবে সকাল অবধি। আপনি খাবেন, সৌমী যেন
মিশিয়ে খায়। ওষুধটা খাবেন রাত একটা নাগাদ।
Good night ...'
- 'Good night ...'
আমরা যা যা জামাকাপড় লাগবে বের করে গুছিয়ে রেখে লেপের মধ্যে
ঢু কে পড়লাম। অন্য অন্য দিন সৌমী শুয়ে গান শুনতো, বা কিছু
দেখত। ওর রাত করে ঘুমোনো অভ্যেস। নটায় ঘুম আসতে চাইত না
বুঝতাম। সেদিন এতটাই ক্লান্ত যে অন্য কিছু র দিকে মন গেল না।
কিন্তু ওর ঘুম সেদিন ভালো হয়নি বুঝলাম। রাতে দেখি খুটখাট শব্দ।
- 'কি রে? উঠেছিস? কটা বাজে?'
- 'একটা।'
- 'ওষুধটা খেয়ে নি।'
- 'আমাকেও দিও তো একটা ট্যাবলেট।'
দুজনে দুটো diamox খেয়ে নিলাম। আর দেড়-ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়া যাবে।
শেষমেষ সৌমীর নড়াচড়ায় যখন ঘুম ভাঙল, তখন তিনটে বাজতে মোটে
তিন মিনিট বাকি। একেবারে ঘাড়মোড় গুঁজে কাজ শুরু হলো। গরম
জল, একটু এদিক ওদিক, তারপরেই সবরকমের বর্ম একটার পর একটা
গায়ে চড়ানো, পুরো ঘর জুড়ে তখন খালি zipper টানার শব্দ।
হঠাৎ শুনলাম সৌমী বলছে, 'আমার একটু ও ঘুম হয়নি জানো তো!'
ঝপ করে ঘর একেবারে নিস্তব্ধ।
- 'সে কি রে? কেন?'
- 'ওই যে diamox, ওর after effects ... '
- 'তাতে ঘুম হবে না কেন?'
- 'Diamox এর ওটাই কাজ heartbeat বাড়িয়ে দেওয়া। আমার heartbeat
বেড়ে গেল, কানে দপদপ করতে লাগল। আর ঘুম হলো না।'
যে কারণেই হোক আর যাই হোক, ঘুম না হওয়াটা তো একদম ঠিক
কথা নয়। এ তো বিস্তর ভোগাবে।
- 'তু ই যেতে পারবি তো?'
- 'হ্যাঁ পারব না মানে? এতদূর এলাম আর এটু কু ... ?'
- 'Good... চল, টু পি আর গ্লাভস পরে নে।'
সেজেগুজে ঠিক মনে হলো হাল্লা চলেছে যুদ্ধে।
দরজায় টোকা পড়ল।
- 'রেডি হয়েছেন আপনারা?'
- 'হ্যাঁ চলো।'
বুধি আমাদের জামার হাতা টাইট করে দিল, টু পি প্রায় গলা অবধি
নামিয়ে দিল, headlamp ঠিক করে দিল। দেখলাম ওর সঙ্গে একটাই
ছোটো ব্যাগ। একটা high altitude medical kit ...
- 'চলুন। ওই চাতাল বরাবর রাস্তা, চাতাল পেরিয়ে বিশাল বিশাল
পাথরের পাশ দিয়ে যেতে হবে।' নিজের লাঠি দিয়ে দেখালো। 'চলুন যাই।'
নিকষ কালো অন্ধকারে মুড়ে আছে চারদিক। Headlamp এর আলোয়
পায়ের কাছটা যতটা আলোকিত হচ্ছে ততটাই দেখে দেখে পা ফেলা শুরু
হলো।
এ রাস্তা আঁকাবাঁকা, মিনিট দশেক চলা তারপরে দুমিনিট হয়ত দম
নেওয়া। পায়ের তলায় মাটি আছে বুঝতে পারছি। একেবারে অন্যরকম
অনুভব হয়। বেশ খানিকটা এগোলাম। সৌমী খানিকটা পেছনে তখন।
আরো অনেকে আসছে আলো জ্বেলে।
- 'বুধি, সৌমী কই?'
- 'ওই আসছে দেখুন দেখতে পাবেন।' নীচের দিকে দেখালো।
- 'ওই প্রথমে যে আসছে?'
- 'না, চার নম্বরে যে আসছে।'
বুঝলাম ওর অভ্যস্ত পাহাড়ী চোখ আলোর nature দেখে বুঝতে পারছে।
অধিকাংশ সামিট তো এইভাবেই হয়, মাঝরাত থেকে ভোরে।
- 'ব্যাগে কি আছে বুধি?'
- 'ওষুধ আর injections, যদি কখনোও লাগে। আমরা এসব ব্যবহার
করতে চাই না। কারণ কোনোরকম ভু ল হলে আমার জেল হয়ে যাবে
দিদি। কিন্তু যদি কারুর খুব শরীর খারাপ হয় তাহলে ... '
- 'হুঁ ... '
বোল্ডারের জঙ্গল পেরিয়ে খানিকটা সোজা রাস্তা। সেটা পেরিয়ে ice-
field, ততক্ষণে বাঁদিক খালি হয়ে গেছে। দেখলাম বাঁদিকে শুরু হয়েছে
বরফের দেশ, একটানা, মাইলের পর মাইল জুড়ে। হালকা নীলাভ আলো
ঠিকরে বেরুচ্ছে ওই বরফ থেকে। চারদিকটা কেমন যেন আধো আলো
আধো আঁধারিতে স্বপ্নের দেশের মতো নীল হয়ে আছে।
তার ওপাশে স্বমহিমায় রাজেন্দ্রাণী অন্নপূর্ণা। পুরো দিগন্ত ঘিরে, সব সন্তান-
সন্ততি, পার্শ্বচরীদের নিয়ে।
অন্নপূর্ণার একটু ডানপাশে মাছাপুছারে, স্থির, গম্ভীর, আত্মবিস্মৃত।
মাছাপুছারের সঙ্গী বাকি অন্যান্য শৃঙ্গ পুরো দিগন্ত বেষ্টন করে আছে।
ওই নীল আলো কেমন একটা মায়াজাল বিছিয়ে দিয়েছে তাদের
তু ষারকিরীটের ওপর। গিরিবিভাজিকার যে রাস্তা দিয়ে আমরা উঠে
এলাম সেটাই সম্ভবতঃ একমাত্র পাকদণ্ডী যেখান দিয়ে এই স্বর্গোদ্যানে পা
রাখা যায়।
আমরা স্তব্ধবাক, আমরা পরিপূর্ণ। সত্যিই এখানে কিছু বলার থাকে না।
সৌমীর জন্য নীচের দিকে তাকালাম। আবার বুধি ওকে খুঁজে দেখিয়ে
দিল।
আবার চলা, বেশ বড়ো বড়ো ice-field তারপরে বোল্ডার, এখানে নদী
নেই, নদী অনেক নীচে। এখানে খালি ice-field ই আছে।
হাঁটছি, সেদিন আমাদের নববর্ষ। সৌমীর খুব ইচ্ছে ছিল প্রথম থেকেই
যাতে নববর্ষে আমরা এখানে আসি, সে ইচ্ছে বাস্তব হতে চলেছে। মনটা
বেশ ভালো হয়ে গেল। আবার একটু দাঁড়ানো, আবার চলা।
সকাল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে তখন। হঠাৎ দেখলাম ডানদিকে
অন্নপূর্ণার মাথায় হালকা লাল আবীর কেউ যেন মুঠো করে ছড়িয়ে
দিল। এ ছবি সৌমীর time-line এ আছে। আমি এতো মগ্ন হয়ে
দেখছিলাম যে ছবি তোলার কথা মনে হয়নি। আলোর আবীরের রঙটা
ঝকঝকে লাল নয়, বরং একটু সাদা ধোঁয়া মেশানো লাল। দেখেই
বুঝলাম, আজ আকাশ আর ঝলমলিয়ে হাসবে না, আর রাজেন্দ্রাণী এবং
তাঁর পার্শ্বচরীরা আস্বচ্ছ ওড়নায় মুখ ঢেকেই থাকবেন।
ঠিক আছে, কোনো চিন্তা নেই। রাজ্য ওনার, রাজত্ব ওনার, অন্দরমহল
ওনার, সঙ্গী-সাথী সব ওনার, সেখানে আমি কোথাকার কে, এসেই বায়নাক্কা
জুড়ে দেবো আলো-ঝলমলে মুখ দেখতে চাই বলে, আর সে আর্জি
বিনাবাক্যব্যয়ে সাম্রাজ্ঞীর দরবারে পাস হয়ে যাবে তা তো হতে পারে
না। প্রকৃ তি যেভাবেই বরণডালা সাজাক না কেন সেভাবেই গ্রহণ করতে
হবে।
অল্প আবীর খেলা, নিতান্তই অল্পক্ষণ স্থায়ী হলো, তবু ভালো লাগল, খুব
ভালো লাগল, ওই একটু খানি মুখ তু লে চাওয়া, ওড়নার ফাঁক দিয়ে একটু
কটাক্ষ, তাতেই মনে হল জীবন ধন্য।
ছোটবেলায় দিদার গাওয়া একটা বিখ্যাত শ্যামাসঙ্গীতের শেষ তিনটে
লাইন মনে পড়ল, ওই মুহূর্তে ই,
'আছি তোর অপিক্ষে
দে মা মুক্তি ভিক্ষে
কটাক্ষে করে পার।'
কোন কথা কোথায় কিভাবে মূর্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় তা কেই বা
বলতে পারে। কয়েক মিনিট মাত্র। আবার রাজেন্দ্রাণীর মুখ ঢেকে গেল
মরা আলোয়।
একটা সত্যি কথা স্বীকার করি।
জানেন তো, পাহাড়ে গিয়ে যখন খুব চড়াই ঠেলতে হয়, যখন মনে হয়
হাওয়া কমে গিয়ে বুকের মধ্যে হাপরের মতো শব্দ হচ্ছে, তখন মনে মনে
মাথা কুটতে কুটতে ভাবি কেন এলাম? সত্যিই, এত কষ্ট করে, এত মাথার
ঘাম পায়ে ফেলে, এত টাকা খরচ করে কেন এলাম? সত্যি সত্যি, মনে
হয়। আমি একবর্ণ বাড়িয়ে বলছি না। বারবার নিজেকে বলি পরেরবার
আসতে ইচ্ছে হলে এই চড়াইয়ের কষ্টটাই মনে রাখব খালি।
আর তারপর, যখনই এই অদৃশ্য হোরীখেলা দেখতে পাই, কিংবা একটু মুখ
তু লে চাওয়া, নাহলে পরিপূর্ণ রাজবেশে দর্শন, আমি এক লহমায় সব ভু লে
যাই, এই কষ্ট, এই ব্যথা, এই পরিশ্রম, এই সারা বছর নিজেকে সংযত করা,
সব ভু লে যাই। বাড়ি ফেরার পরে ওই রাজকীয় দর্শন বা ওই এক
লহমার কটাক্ষের কথাই শুধু মনে গেঁথে থাকে, অনেক অনেক চেষ্টা
করলেও ওঠার সময় ঠিক কিরকম কষ্ট হয়েছিল সেটা মনে পড়ে না,
সত্যিই পড়ে না। সব কষ্ট, ব্যথা, ধোঁয়ার মতো তালগোল পাকিয়ে
দিকচক্রবালে মিলিয়ে যায়।
আমরা আবার ভীষণ মনোযোগ সহকারে নতু ন পাহাড় খুঁজতে বসি।
এই একটু সিদ ঁ রে
ু আভা ঝপ করে মিলিয়ে যেতে দেখার পরে বুঝলাম
আমাদের ভাগ্যে সেদিন অন্ততঃ ঝকঝকে নীলাকাশ আর সোনার মুকুট
পরা সুন্দরীকে দেখার অবকাশ হবে না।
আগে হলে খুব মন খারাপ হতো। আমি রোদ্দুর ভালবাসি। বৃষ্টি, মেঘলা
আকাশ, এসব আমার পছন্দ কম। কিন্তু এখন আর মন খারাপ হয়না।
বরং মনে হয় এটারও তো একটা অন্যরকম সৌন্দর্য আছে, অন্যরকম
অনুভব আছে, অন্যরকম কল্পনা আছে।
রঙ থেকে রঙহীনতা সবকিছু নিয়েই তো প্রকৃ তি।
আরো আধঘণ্টা লাগল। খানিকটা চড়াই আবার ঢেউতোলা রাস্তা। শেষে
কয়েক পা ওপরে উঠে দেখি সামনে ওই ভিজে মাটির মতো বেশ চওড়া
জায়গা। দেখি বুধি বলছে,
- 'এই যে নিন দিদি, আপনার বেস ক্যাম্প এসে গেছে।'
সামনে বেশ কয়েক গজ খালি জমি। তার পরে দুটো খুঁটি দিয়ে বেস
ক্যাম্পের বোর্ড টাঙানো। তাতে ওদের ধর্মীয় পতাকা, আর অন্যান্য
অনেক দেশের পতাকা আটকানো আছে। এর ডান এবং বাঁপাশে টানা
ice-fields, বাঁদিকে দেখি অনেকগুলো অল্পবয়সী ছেলে জটলা করছে।
দুজন লাফিয়ে লাফিয়ে ডিগবাজিও খাচ্ছে। তিনজন একটু দূরে গিয়ে
বরফের বল ছুঁ ড়ছে। এদের সম্ভবতঃ এটাই প্রথম বেসক্যাম্প। আগে
ছোটো কোনো ট্রেক করেছে। খুব আনন্দ, কি করবে বুঝে উঠতে পারছে
না। এদের মা-বাবারাও এদের নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিয়েছেন। খুব সম্ভবতঃ
এরা পরেরবারই এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে যাবে।
সবার ছবি তোলা হয়ে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করলাম। তারপরে দেশের
পতাকাটা বের করে একটা ছবি তু লে দিতে বললাম বুধিকে। পাশে বেশ
কতগুলে বিদেশী ছেলেও ছিল।
বুধি বলল, 'দিদি, শুভ নববর্ষ।'
ধন্যবাদ দিলাম। আগের দিন ওদের নববর্ষ ছিল।
বিদেশী ছেলেদুটি বলল, 'বেশ দারুণ করে বছর শুরু হলো তো!'
মাথা নেড়ে হাসলাম।
বুধি বলল, 'চলুন দিদি, ওই দিকটা দেখে breakfast করবেন চলুন। ওদিকে
নামবেন না কিন্তু।'
- 'আচ্ছা।'
একটা টিলার এপর থেকে অন্নপূর্ণাকে দেখা যায় পুরো সামনে থেকে।
তখন ওপরে ভীষণ ভীড়, প্রায় ধাক্কাধাক্কি চলছে। উঠে দেখে এলাম। ছবি
তো সৌমী তু লবে। আমার চিন্তা নেই।
টিলা থেকে নেমে এসে একটা ট্রি হাউসে ঢু কলাম। এখানে দুটো মাত্র
থাকার জায়গা, পাশাপাশি। বুধি আমাকে যত্ন করে নিয়ে গিয়ে বসালো।
- 'দিদি muesli খাবেন?'
- 'দুধ খেতে পারব না বাবু।'
- 'আচ্ছা।'
খানিক পরে ধোঁয়া ওঠা garlic soup, পাঁউরুটি আর ডিমের অমলেট
গুছিয়ে সাজিয়ে দিয়ে গেল।'
- 'আপনি আস্তে আস্তে খান দিদি।'
- 'সৌমী কতদূর?'
- 'আসছে। আমি ওকে দেখতেই যাচ্ছি।'
(ক্রমশ
পর্ব - ১৩
তখন আমি সবে একটা পাঁউরুটি আর হাফ বোল স্যুপ সবে পেটে
চালান করে বাইরের হিমাঙ্কের সঙ্গে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি,
এমনসময়, হুড়মুড় করে বুধি ঢু কে এলো।
- ‘দিদি, ফ্ল্যাগটা কোথায়?’
- ‘ওই ব্যাগেই আছে।’
সে ফ্ল্যাগ খুঁজে নিয়ে দুড়দুড়িয়ে চলেও গেল।
বুঝলাম সৌমী এসে পৌঁছেছে। আমি তখন সবেমাত্র একটু উষ্ণ হয়েছি,
গরম গরম চাপাটি হওয়া বাকি আছে। গোটা টেবিল ভর্তি লোকজন,
দেশী কম বিদেশী বেশি। সবাই গল্প করছে। আমিও খেতে খেতে গল্পে
ঢু কে পড়লাম।
আমার বাঁপাশে Welsh এর দুজন এসে বসল। এদের সঙ্গে কাঠমাণ্ডু
অবধি একসঙ্গে ফিরেছি আমরা। ডানদিকে তিনটি অল্পবয়সী মেয়ে
এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ব্যঞ্জন সম্পর্কে কথা বলছিল। কথায় কথায়
বুঝলাম তন্দুরী চিকেনের খুব ভক্ত।
পথে এসো বাবা, সাধে কি আর ভারতীয় রেস্তোরাঁগুলো বিদেশে দু-পয়সা
করে খাচ্ছে। এসব মসলা তৈরী সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান তো ষোল
আনার ওপর আঠেরো আনা। বেশ একটু সময় কাটল।
প্রায় সবাই দেখি দুধ আর muesli, বা coco এসব খাচ্ছে।
হেলেন জানতে চাইল আমি muesli খাচ্ছি না কেন? একবাটি দুধ দিয়ে
খেয়ে নিলেই তো গল্প শেষ।
হেসে বললাম, 'I love milk, but ... '
চট করে বুঝে গেল, 'Oh, milk doesn't love you then ...'
- 'Yes, ...'
ওদিকে একটি বিদেশী ছেলে তখন বলছে, 'I don't have the slightest idea
what day is today. Not only today, right after the following day we
started the trek, I lost track of days ... completely ...'
বলা বাহুল্য, আমাদের সবারই তাই অবস্থা, পাহাড়ে এলে সময়ের concept
পাল্টে যায়। আমরা industrial time থেকে সরে গিয়ে agrarian time এ
ঢু কে পড়ি। আর দিনের শেষে এতই ক্লান্ত থাকি যে, দিনের হিসেব
মেলানোর অবকাশ থাকে না।
শুধু আমাদের নববর্ষ বলে আমরা এইবার বারের হিসেবটা রেখেছি।
বেশ আড্ডা হলো। পুরো পাহাড়ী আড্ডা, যেটা খাবার দিয়ে শুরু হয়ে,
দেশ বিদেশের আবহাওয়ার মধ্যে প্রচু র ঘুরপাক খেয়ে, শেষমেষ পরেরবার
কোন পাহাড়ে যাওয়া হবে তার প্রস্তুতিপর্বে গিয়ে শেষ হয়।
নেহাৎ যখন বুঝলাম জালিতে ফু লে রুটির মতো গরমটা হয়েছি পাহাড়ী
garlic soup এর কল্যাণে, তারপরে কান দিয়ে গরম হাওয়া ফু স করে
বেরিয়ে পড়ার উপক্রম হচ্ছে হচ্ছে, তখন উঠে পড়লাম। ঘরজোড়া
জানালার কাছে গিয়ে দেখি সৌমী নীচে পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বেড়াক একটু ।
সেদিন আপ্পুর জন্মদিন, তারপরে নববর্ষ। আপ্পুকে জন্মদিনের wish করতেই
হবে। Wi-fi এর connection নিলাম। আধ ঘণ্টার জন্য।
আপ্পুসহ সব বন্ধু দের, সব গ্রুপে শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা পাঠানো হলো।
নীচে নামলাম। পতাকা নিয়ে দুজনের দু চারটে ফটো তোলা হলো।
বুধিই আমাদের দুজনের ছবি তু লে দিল। আবার পেছনের সেই টিলার
দিকে গেলাম। সৌমী গেল ওপরে, আমি আর উঠলাম না, একবার তো
উঠেইছি ভীড় ঠেলে। এবারে ও গিয়ে ছবি তু লুক।
ফিরে এসে সৌমীর খেতে বসল, ও একটু বিশ্রাম নেবে। টাকা পয়সা
মেটানো হলো। তখন বাইরে বেশ আলো। বুধিকে বললাম, 'আমি যাই
তাহলে? মাছাপুছারেতে গিয়েই বসি?'
- 'হ্যাঁ নামুন দিদি। আজ ব্যাম্বুতে থাকতে হবে।'
রাজেশ্বরীকে সপার্ষদ একবার মন ভরে দেখে নিয়ে পা চালালাম।
ফেরার একটাই রাস্তা। এ রাস্তায় অসুবিধেও কিছু নেই তেমন। প্রায়
হনহন করে চলতে লাগলাম।
খানিক পরে এক গুজরাটি পরিবারের সঙ্গে দেখা। থাকেন কেনিয়াতে।
ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা বিশাল পরিবার নিয়ে এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে আঠেরো
বছরের ছেলে আর তেরো বছরের একটি মেয়েও আছে। দেখলাম এই
মা-বাবা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ছেলে মেয়েদের পাহাড়ের নেশা ধরিয়ে
দিচ্ছেন। বেশ অন্যরকম লাগল।
আমরা সবাই summit শেষ করে ফিরছি, সবাই পরিশ্রান্ত কিন্তু সক্ষম
অবস্থায় ফিরছি, আমরা পরিতৃ প্ত, সবায়ের চোখমুখেই খুশির ঝলক, যে খুশি
একটু একটু করে চুঁ ইয়ে চুঁ ইয়ে আশেপাশে হেঁ টে চলা অন্য অভিযাত্রীদের
মধ্যেও সঞ্চারিত হয়ে যায়।
ছেলেমেয়েগুলো দেখলাম বেশ আনন্দ পাচ্ছে। এটাই হয়ত পরবর্তী
অভিযানে ওদের উৎসাহিত করবে।
ভদ্রলোক আগে কোন কোন পাহাড়ে গেছি জানতে চাইলেন। খানিকক্ষণ
কথা হওয়ার পর বললেন, ' Have you travelled across Indian
Himalayas?'
- 'Yes ... '
- 'Is there any difference between these two?'
- ' Yes, Indian Himalayas is more greener, and much less harsher.'
- 'Understood ... '
এ রাস্তায় খুব একটা দেখে দেখে হাঁটতে হয় না। প্রচু র পাহাড়ের গল্প
চলতে লাগল। Ice field এ পা পিছলানোও গেল। এতে ব্যথা হয় না,
ভাগ্যিস।
একঘন্টার আশেপাশেই প্রায় গোটা রাস্তাটা পেরিয়ে আসাও গেল।
প্রায় মাছাপুছারের বেস ক্যাম্পে এসে পড়েছি, আর দুশো মিটার মতো
বাকি আছে, দেখি একদল অভিযাত্রী ওপরে উঠছে। একঝলক দেখেই
বুঝলাম এরা তাইওয়ানের লোক, কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন
adventure gear এবং accessories তাইওয়ানই তৈরী করে। বরফের
উপযোগী পোষাকে pastel shade এর ব্যবহার এদের চেয়ে ভালো কেউ
জানে না। আরো একটা জিনিস তৈরীতে এরা এখনও পৃথিবীর প্রথম
কয়েকটা দেশের মধ্যে থাকে, সেটা হলো সাইকেল।
এই পথে অচেনা সবাইকেই শুভেচ্ছা জানানোর নিয়ম, বেশ একটা feel
good factor কাজ করে। শুভেচ্ছা জানাতে জানাতে দেখি বুধি চলে
এসেছে।
- 'তু মি একা? সৌমী কই?'
- 'আসছে।'
নীচে নামলাম। যেখানে আগের রাত্রে ছিলাম সেখানেই। ঘরে ঢু কে
ব্যাগপত্র রেখে চাতালে এসে বসলাম। সৌমী এলেই দেওরালির দিকে
রওনা দেবো।
কয়েক মিনিট বসেই যে রাস্তা দিয়ে নেমে এলাম সেই রাস্তাকে আরো
একবার ভালো করে দেখতে গেলাম দিনের আলোয় কাছ থেকে।
যে চাতালটায় চেয়ার নিয়ে বসেছিলাম, সেটাই শেষে ওই রাস্তায় গিয়ে
মিশেছে, মানে চাতাল শেষ আর রাস্তা শুরু। চাতালের পরেই বিভিন্ন
মাপের বিশাল বিশাল পাথর আর তার মাঝখান দিয়ে রাস্তা। দেখলাম,
ওই রাস্তাটা আসলেই একটা পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলেছে। আর সেটা
ওই পাহাড়কে বেড় দিয়ে নয়, zigzag করে মাঝখান দিয়ে সোজা উঠে
গেছে ওপরে একটা steady gradient নিয়ে, হয়ত 70 degree gradient হবে।
এ পাহাড়টা এতই আকাশছোঁয়া যে এই চাতালে বসে এর চূ ড়া পেরিয়ে
অন্যদিকে দৃষ্টি যায় না। মানে সামনের view টা পুরো block করে
দাঁড়িয়ে আছে এ পাহাড়।
বুধির night trek এর সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশই
রইল না।
গতকাল আমরা এসেছি। এ রাস্তা দেখিনি, ভাগ্যিস দেখিনি, দেখলে পায়ের
ব্যথার সঙ্গে মনের ব্যথাও যে বেশ খানিকটা বাড়ত সে ব্যাপারে আমি
শতকরা দুশো ভাগ নিশ্চিত। রাতে বেরিয়েছি। তখন headlamp এর
কল্যাণে নিজের পায়ের সামনেটা ছাড়া কিছু ই আলোকিত নয়। যেখানে
পৌঁছে চারদিকে একটু আলোর ছিটে লেগেছে, ততক্ষণে এই রাস্তার
ভয়াবহতা পেরিয়ে এসেছি আমরা। বুঝতেই পারিনি ঠিক কি ধরণের
চড়াই অতিক্রম করতে হয়েছে আমাদের। বুঝতে পারলে অবশ্যই
শারীরিক কষ্টের সঙ্গে মানসিক কষ্টটাও যোগ হতো।
বুধির দিকে তাকালাম। সে তখন নির্বিকার চিত্তে মেঘ চুঁ ইয়ে আসা
রোদে গা সেঁকছে। ওটা তখন প্রায় সবার কাছেই luxury.
ঘণ্টাখানেকের কাছাকাছি প্রায় কুমীরের মতো বসে ছিলাম। কতজন নেমে
আসছে, অথচ সৌমীর দেখা নেই। যদিও রাস্তাটা নীচ থেকে দেখতে
ভয়াবহ, কিন্তু নেমে আসতে খুব একটা কষ্ট হয়ই না প্রায়। এতো সময়
তো লাগার কথা নয়।
- 'বুধি, সৌমী আসছে না কেন?'
- 'আসবে দিদি।'
আবার পাঁচ মিনিট পরে থাকতে না পেরে ডাকলাম।
- 'বুধি কোথায় গেল মেয়েটা?'
একই উত্তর।
আবার কিছু ক্ষণ কাটল।
- 'বুধি, দ্যাখ বাবু, মেয়েটা কোথায় গেল, কিছু হলো কিনা, কোথাও তো
দেখতে পাচ্ছি না।'
তখন ঘড়িতে বাজে সওয়া দশটা।
- 'আসবে, আসবে দিদি, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?'
কেমন যেন আমার মনে হতে লাগল, সব কিছু ঠিক নেই। কোথাও কিছু
একটা অসুবিধে আছে।
তখন পরিশ্রমে পা টনটন করছে। অক্সিজেন কম হলে অবসন্নও লাগে।
তাও উঠে চাতালে এদিক ওদিক করতে লাগলাম, আর মনে মনে সাহস
সঞ্চয় করতে লাগলাম এই ভেবে যে, যদি আরেকবার উঠতে হয় তাহলে
কালকে রাতের প্রতিটি পদক্ষেপ মনে করেই উঠতে হবে।
- 'বুধি, মেয়েটা তো আসছেই না! সাড়ে দশটা বাজতে চলল প্রায়।'
- 'দিদি, আমি নজর রাখছি। প্রচু র লোকে ফিরছে। আমার বন্ধু রাও
ফিরছে। কেউ খবর দেয়নি ওপরে কেউ অসুস্থ হয়েছে বলে। আপনি
বসুন শান্ত হয়ে।'
বসলাম। মিনিট পাঁচেক পরে বলল, 'ওই আসছে দেখুন।' বলে পাহাড়টার
একেবারে ওপরে আঙু ল তু লে দেখালো।
অতো ওপরে কি আছে দেখার মতো ক্ষমতা থেকে ঈশ্বর আমায়
চিরজীবনই বঞ্চিত করে রেখেছেন। আমি নির্বিবাদে বিশ্বাস করলাম,
বিশ্বাস করতে পেরে খুব ভালো লাগল। এরও আধঘণ্টা পরে আমি
সৌমীকে পরিষ্কার দেখতে পেলাম, এক পা এক পা করে নেমে আসছে, খুব
সাবধানে, খুব আস্তে।
এগারটা নাগাদ ওই চাতালে এসে পৌঁছলো। ওর হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে
বুঝতে পারছি।
বললাম, 'আয় বোস এখানে।'
- 'আমাকে এক্ষু ণি এক ঘণ্টা ঘুমোতে হবে দিদি। নাহলে আমি এক পাও
চলতে পারব না।' বলে নিজেকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে ঘরে ঢু কে গেল।
আমার ডেকে পা ছড়িয়ে বসে আরামের চটকা ভেঙে গেল। উঠে যত
তাড়াতাড়ি পারলাম ঘরে ঢু কে দেখি, সৌমী ওই পোষাকেই বিছানায় শুয়ে
পড়েছে, পা দুটো নীচে ঝু লছে অসাড়ের মতো, ও পুরো আচ্ছন্ন।
ততক্ষণে বুধিও দৌড়ে এসেছে।
- 'কি হল দিদি?'
দরজা খুলে ওকে দেখতে বললাম। ওকে দেখতে দিতেই হবে। কারণ,
একমাত্র ওই এই অসুবিধের সঙ্গে মোকাবিলা করতে জানে।
একঝলক দেখেই বলল, 'দিদি এটা altitude sickness...'
- 'ওর ঘুম হয়নি রাতে বলছিল।'
- 'ওটাও altitude sickness...'
ভীষণ দুশ্চিন্তা হলো। আমরা সত্তর কিলোমিটার রাস্তা হেঁ টে এসেছি। আর
কিছু না হোক ষাট বাষট্টি কিলোমিটার তো নামতেও হবে। নেহাৎ যদি
চলতে না পারে তাহলে এখান থেকে নামাতেও তো অসুবিধে হবে।
ঘোড়া পাওয়া যায় দোভান থেকে। এখানে অসুবিধে হলে air taxi ই
ভরসা।
বুধি বলল, 'দিদি, একঘণ্টা অপেক্ষা করে যাই, দেখি কোথায় গিয়ে
দাঁড়াচ্ছে।'
'অবশ্য, অবশ্য,' বলে ডাইনিং হলে গিয়ে বসলাম।
(ক্রমশ)
পর্ব - ১৪
এখানেও ডাইনিং হল সরগরম। এককাপ চা নিয়ে কোণে গিয়ে বসলাম,
দেওয়াল ঘেঁষে বেশ চওড়া কাঠের বক্স-বেঞ্চ, ভেতরে জিনিসপত্র রাখা
আছে, ওপরে সুন্দর করে কম্বল বিছানো বসার জায়গা। আমি তো
আবার কুঁ ড়ে বাঙালী, আর আমার ফেভারিট পাসটাইম হলো আলী
সাহেবের ভাষায় 'আসনপিঁড়ি হয়ে বসে হাঁটু দোলানো'। জুতোটু তো খুলে
বাবু হয়ে বসার যে একটা দুর্দ মনীয় ইচ্ছে হচ্ছিল সেটা অস্বীকার করার
কোনোই অবকাশ নেই। কিন্তু ওই যে রক্তের কুঁ ড়েমি, এক ঘণ্টা পরে
আবার নীচু হয়ে বসে কষ্ট করে ওটা পরতে হবে ভেবেই নিরস্ত
থাকলাম।
বেশ গুছিয়ে বসলাম, দেড়হাতি চওড়া বেঞ্চ, আমার জুতোসুদ্ধু পা অল্প
একটু বাইরে বেরিয়ে রইল। একটু পরেই একটি চীনা পরিবার এলো। মা
আর দুই ছেলে। এরা ডাল ভাত নিলো, ব্যাগ থেকে একটা শুকনো
ঝু রঝু রে আচারের প্যাকেট বেরুলো, সেটা বেশ করে ভাতে মেখে খেয়ে
নিলো। আচারটা যে বেশ মুখরোচক, সেটা খাওয়ার সময় ওদের মুখচোখ
দেখেই বোঝা গেল। খাওয়ার পরে মা আর এক ছেলে বাইরে চলে গেল,
অন্য ছেলেটি আমাদের বক্স-বেঞ্চে টানটান হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
সামনে একটি শেরপা ছেলে আর তার পোর্ট ার সঙ্গীটি এসে বসল। এ
ছেলেটি ছোটখাট, বেশ ঝরঝরে ইংরেজী বলে। বসেই বলল, 'আপনি ইণ্ডিয়া
থেকে এসেছেন না?'
- 'হ্যাঁ, কলকাতায় বাড়ি। তু মি কি বাবু খালি এই রুটেই ঘোরো বেশি?'
- 'না দিদি, ধৌলাগিরি, মানাসলুও যাই। তবে বেশি করি সার্কি ট।'
- 'এবারে তোমার client কে?'
- 'একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে নিয়ে এসেছি। উনি স্কটল্যাণ্ড থেকে
এসেছেন। তবে ওনার কোনো গাইডই দরকার ছিলো না। উনি সবই
চেনেন দেখলাম। পাহাড় সম্পর্কে বেশ ভালো জ্ঞান আছে। আমি না
থাকলেও কিছু যেত আসত না। কিন্তু এখন নিয়ম করে দিয়েছে।'
- 'ভালো করেছে, জানো তো, এই যে আমার বোনটা এসেছে আমার সঙ্গে,
একটু আধটু অসুবিধে তো হচ্ছেই, তোমরা না থাকলে দেখবে কে? আর
তোমাদেরও তো চলতে হবে। ভালো হয়েছে।'
- 'সেটা ঠিকই। একজন সঙ্গীও তো পাওয়া যায়।'
- 'হ্যাঁ, আসার সময় দেখলাম, ঘোড়েপানি থেকে একজন ট্রেকার নিখোঁজ।
একা গিয়েছিলেন। হয়ত চলতে চলতে কোনো অসুবিধে হয়েছিল। কাকেই
বা আর বলবেন।'
- 'হ্যাঁ, এইসব ঘটনার পরেই এই নিয়মগুলো করে দিয়েছে।'
স্কটল্যাণ্ডের ভদ্রলোক এলেন। বেশ লম্বা, প্রায় সত্তরের কাছাকাছি বয়স।
চেহারা দেখলেই বোঝা যায় পাহাড়ের হাওয়া ওনার অস্থিমজ্জায় মিশে
আছে।
আলাপ করলেন। স্কটল্যাণ্ড নিয়ে কথা উঠল। কথায় কথায় বললেন,
'জানেন তো আমার ইংল্যাণ্ড একদম ভালো লাগে না। সবাই সবসময়ই
ভীষণ ব্যস্ত।'
- 'আমারও লাগে না। একে তো weather পছন্দ নয়, আর মনে হয়
সবসময় আন্তরিকতা কম।'
ভদ্রলোক হেসে ফেললেন, 'ঠিক ঠিক, একদম খাঁটি কথা।'
- 'জানেন, আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে এখানে এসেছিলাম। তখন
এই বাড়িগুলো ছিলো না,' একটু চু প করে থেকে বললেন ভদ্রলোক।
- 'তাই? এই নিয়ে দুবার হলো অন্নপূর্ণা?'
- 'হ্যাঁ, ওই যে নীচে পাথরগুলো জড়ো করে রাখা আছে, ওখানে একটা
ছোটো কুঁ ড়ে মত ছিল, ওখানেই ছিলাম একরাত।'
নীচে তাকিয়ে দেখলাম। কিছু পাথর জড়ো করে রাখা আছে।
এটা ওটা গল্পগাছা চলল। বুঝলাম উনি যখন এসেছিলেন আগে তখন
এখান থেকে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প অবধি পুরো রাস্তাটাই মোটা বরফের
চাদরে মোড়া ছিল। গোটা রাস্তাটাই ছিল এক বিস্তৃত ice-field, বরফ
পেরিয়ে যেতে হতো পাস ট্রেক করার মতো করে। এখন ধরণী উষ্ণ
থেকে উষ্ণতর হয়েছেন। সব বরফ গলে মাটি আর পাথর বেরিয়ে
পড়েছে।
এ রাস্তা আজ শ্রীহীন হয়ে গেছে ...
আধঘণ্টা পেরিয়ে যেতে বুধি এসে বলল, 'দিদি, আপনি দুপুরের খাবারটা
খেয়ে নিন। রেডি হয়ে থাকুন, যাতে সৌমী উঠলে তাড়াতাড়ি বেরুতে
পারেন।'
সেই ফ্রায়েড রাইস খাবো বললাম। টু না আর ডিম দিয়ে তৈরী। প্রসঙ্গত,
আমরা পাহাড়ে যত ওপরে উঠি, ডিম আর canned tuna ছাড়া মাংস
প্রায় খাই-ই না বলতে গেলে। পাহাড়ী অঞ্চলে বেশি প্রোটিন আমাদের
মতো সমতলের মানুষদের হজম করতে একটু হলেও অসুবিধে হয়।
পঞ্চাশ মিনিটের মাথায় সৌমী উঠে এলো ডাইনিং হলে। একটু ঝরঝরে
দেখাচ্ছে ওকে।
- 'তু ই খাবি তো?'
- 'হ্যাঁ...'
- 'তাহলে খেয়ে তৈরী হয়ে নে।'
- 'তোমার জিনিসপত্র?'
- 'আমি সব গুছিয়ে নিয়েছি।'
খাওয়া শেষ করে, ওই ভদ্রলোককে বিদায় জানিয়ে বাইরে এলাম। একটু
নিশ্চিন্ত লাগছে। সৌমী বেশ কিছু টা সামলেছে। আজকে যতটা রাস্তা
টানতে পারা যায় ততই আমাদের সুবিধে হবে। নীচে নামা যে বড়ো
দরকার তা আমিও খুব বুঝতে পারছি।
বুধি বলল, 'দিদি আপনারা এগোন। আমি সৌমীকে নিয়ে যাচ্ছি।'
সৌমী খেতে বসল। আমি আর সুরেন্দ্র বেরিয়ে পড়লাম।
খানিকটা নামার পরেই পথে পড়ল মাছাপুছারে বেস ক্যাম্প, আলো
ভালোই আছে, আগের দিনের না তোলা ছবি তখন তোলা হলো। এটা
পেরিয়ে পড়লাম দেওরালির রাস্তায়।
এ রাস্তার বাঁদিকে সারি দেওয়া তু ষারশৃঙ্গ আর ডানদিকে ন্যাড়া পাহাড়।
হঠাৎ সুরেন্দ্র বলল, 'দিদি সরে আসুন।'
বেশ খানিকটা সরলাম। বাঁদিকে তাকিয়ে দেখি ওপরের পাহাড়ের গা
থেকে একটা বরফের লম্বা প্লেট চড়াৎ করে খুলে গেল, সেটা নেমে
আসতে আসতে নীচের বরফের দেওয়ালে ঠোক্কর খেয়ে একটা বরফের
চাদরকে সঙ্গে নিয়ে নামতে লাগল।
যেখান থেকে এটা হলো, সেটা খুবই উঁচু, ফলে নামতে নামতে গোটা
চাঙড়টাই ঝু রঝু রে হয়ে নীচের খাদে পড়ে গেল। চোখের সামনে প্রায়
মাথার পাশে একটা ছোটখাট, যাকে বলে micro-mini avalanche দেখা
গেল।
- 'চলুন দিদি,' কয়েক সেকেণ্ড পরে সুরেন্দ্র বলল।
হাঁটতে শুরু করলাম।
মিনিট চল্লিশ পরে একটু দাঁড়িয়েছি, ওদিক থেকে অনেকে আসছে এদিকে।
সুরেন্দ্রর সঙ্গে কথাবার্ত া হল ওদের।
- 'দিদি, আমরা আসার দিনের ওই শর্ট কাটটা নিতে পারব না। ঘুরে যেতে
হবে।'
- 'কেন?'
- 'একটা ice-field ধ্বসে গেছে। সেই বড়ো ice-field টা। ও রাস্তায়
যাওয়া যাবে না।'
আহ ... এখনই ধ্বসতে হলো? বেমক্কা রাগ হলো। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বলি,
যে, গিয়ে তো দেখি কি হয়েছে।
পাহাড় নেহাৎ আমার জমিদারি নয়, সুরেন্দ্রর দেখানো অন্য রাস্তা
ধরলাম, আর পা দেওয়ামাত্র বুঝলাম শর্ট কাটটা ঠিক কতটা আরামের
ছিল।
এদিকটায় বিশাল বিশাল বোল্ডার, বিশাল মানে কিছু বোল্ডার আমার
সমান উঁচু, তার পাশে একটু কম বিশাল বোল্ডার ঘেঁষাঘেঁষি করে বিছিয়ে
আছে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। খালি পাথরের ওপর দিয়েই যেতে হবে,
যেখানে মাটি দেখা যাচ্ছে সেখানে ওই পাথর ডিঙিয়ে মাটিতে পা ফেলতে
হবে।
একবার নদী পেরোনো হলো, ওইরকম বোল্ডারের ওপর দিয়েই, তারপরে
একটা পাথর ডিঙোতে গিয়ে আমি দুহাতে দুই লাঠি সুদ্ধু হুড়মুড় করে
সামনের পাথরে পড়লাম। প্রথম ধাক্কাটা সামলে উঠেও পড়লাম। সুরেন্দ্র
ছু টে এলো।
- 'দিদি, খুব লেগেছে?'
লেগেছে তো বটেই, ও আর বলে কি হবে।
- 'কি করে পড়লাম সুরেন্দ্র?'
একটা বড়ো বোল্ডারের নীচ থেকে একটা তিনকোণা পাথর বের করে
আনল, একেবারে ত্রিভু জাকৃ তি পাথর।
- 'এই পাথরটা নীচে ছিল বলে পড়েছেন। ওপরের বড়ো পাথরের ব্যালেন্স
গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল।'
দু-মিনিট দাঁড়াতে হলো। বাঁপায়ে লেগেছে। একটু সহনীয় হতে আবার
হাঁটা শুরু হল। হঠাৎ খেয়াল করলাম, যখন আমি নীচে নামার জন্য
ডান পা ব্যবহার করছি, তারপরে বাঁ পা ফেলার সময় ডান হাঁটু যখন
ভাঁজ করছি তখন পরের পদক্ষেপের জন্য ফেলতে যাওয়া ডান পায়ের
সাড় হারিয়ে যাচ্ছে।
আবার পড়লাম। এবার ডান পা ঢু কে গেল দুটো বোল্ডারের মাঝখানে।
এমনই বেকায়দায় ঢু কল যে, সুরেন্দ্রকে এদিক ওদিক করে পা পাথরের
খাঁজ থেকে বের করে দিতে হলো। ওই বিশাল পাথর সরানোর শক্তি
ওদেরও নেই। এর পরেরবার পড়লাম পায়ের পাতা ঠু কে, দুটো পাথরের
মাঝে। আঙু লে ভীষণ লাগল, দুপায়েই।
এই শেষ ব্যথা ক্রমশ বাড়তে লাগল। বুঝলাম, চোটটা ভোগাবে।
এরপরেও তিনবার নদী ওপার ওপার করতে হলো। তারপর আধঘণ্টা
হেঁ টে দেওরালি পৌঁছলাম। জল আর চকোলেট খেয়ে একটু বসে আবার
হাঁটা শুরু। এবারে হিমালয় এলো। যেখানে আগেরবার সকালে breakfast
খেয়েছিলাম সেখানে টু কটাক কুশল বিনিময় হলো। এবারের গন্তব্য
দোভান।
তখন বাজে বিকেল তিনটে। আরও ঘণ্টা দেড়েক লাগবে দোভান
পৌঁছতে।
এ রাস্তায় আরেকবার পড়লাম। এবার হাঁটুতে লাগল। দোভান পৌঁছতে
তখনও মিনিট কুড়ি বাকি। সামনে এক নেপালী দম্পতি যাচ্ছিল, ওদের
একটু first aid চাইলাম। Savlon জাতীয় কিছু । ওদের কাছে Savlon নেই,
কিন্তু Moov আছে। ঠিক আছে, ওতেই চলবে আপাততঃ, সন্ধ্যের আগে
দোভানে তো পৌঁছতেই হবে।
ঘড়ি দেখলাম, বিকেল পৌনে পাঁচটা।
Moov ভালো করে হাঁটুর চারদিকে লাগালাম। একটা মোটা gel pack
দেওয়া knee cap বের করে পরলাম। তারপরে আবার হাঁটতে শুরু
করলাম।
তখন দুটো লাঠির একটা লাঠি দিয়ে দিয়েছি সুরেন্দ্রকে।
কথা নেই বার্ত া নেই পরপর এতবার পড়ে যাওয়ার নিজের ওপর
নিজেরই বিরক্ত লাগতে শুরু করল।
- 'সুরেন্দ্র, আমি এতবার পড়লাম কেন? আমার মাথা কাজ করছে না
এমন তো নয়?'
- 'দিদি, আপনার শরীর ছেড়ে দিচ্ছে। আপনি রাত সাড়ে তিনটে থেকে
হাঁটছেন। যতই rest নিন, এখন বিকেল সাড়ে চারটে বাজে। দশ ঘণ্টার
ওপর হাঁটা হয়ে গেছে। অনেকটা রাস্তা তো low oxygen area য় ছিল।
এখন আপনার শরীর আর দিচ্ছে না।'
ঠিক, কথাটার যুক্তি আছে।
- 'দিদি, আজকে আমরা দোভানে থাকব। যত কাছেই হোক আপনাকে
নিয়ে ব্যাম্বুতে যাবো না। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আর চলা উচিত হবে না।
আপনার আজ পুরো বিশ্রাম দরকার।'
এর আর মিনিট দশেক পরে দোভান পৌঁছলাম। যাওয়ার সময় যেখানে
বৃষ্টির জন্য আটকে গিয়ে থেকেছিলাম, সেই দিদির বাড়িতেই গিয়ে
উঠলাম।
এবারে সৌমী আর বুধির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ
নেই। সন্ধ্যে হলো, রাত হলো, পাহাড়ী জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শনশন করে
বরফ-ঠাণ্ডা হাওয়া দিতে লাগল, ওদের দেখা নেই। ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে
না কাউকে। নিশ্চয়ই দেওরালি বা হিমালয়ে কোথাও থেকে গেছে।
শেষমেষ সারাদিনের পর জুতো খুলে চটি পরে আমি হাঁটুর পরিচর্যা
করতে বসলাম।
(ক্রমশ)

You might also like