You are on page 1of 2

বাগবাজারের হালদার বাড়ীর দুর্গাপূজার উপাখ্যান

অষ্টাদশ শতকের কলকাতার ইতিহাসের পাতায় উঁকি দিলে যে কয়টি বাবু সম্প্রদায় ভু ক্ত পরিবার এর হদিশ পাওয়া
যায় তার মধ্যে বাগবাজার এর হালদার বাড়ি অন্যতম।
হালদার দের আদি বাসস্থান ছিল হুগলী জেলার নউয়া পাড়া নামক স্থানে।হালদার পরিবার এর প্রান পুরুষ হিসেবে
জনপ্রিয় কৃ ষ্ণ প্রসাদ হালদার অষ্টাদশ শতকের মাঝা মাঝি কোন এক সময়ে কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে এসে
পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেন।
হালদার পরিবার জনপ্রিয়তা অর্জ ন করে মূলত কৃ ষ্ণ প্রসাদ হালদার এর কনিষ্ঠ পুত্র শ্রী প্রানকৃ ষ্ণ হালদার এর
আমলে। শোনা যায় তাঁর সময়ে হালদার পরিবার বনেদিয়ানা ,খ্যাতি, বৈভব, জাঁক জমক ইত্যাদি তে কলকাতার
সমসাময়িক প্রথম সারির অভিজাত পরিবার গুলির একজন হয়ে উথেছিল। এমনকি সমাচার দর্পণ পত্রিকায় তাঁকে
‘বাবু দের মধ্যে বাবু’ বলেও অভিহিত করা হয়েছিল। যাইহোক এহেন হালদার পরিবার এর দুর্গাপূজার ইতিহাস যেমন
চমকপ্রদ তেমনই পুজা আচার ও তু লনায় বেশ স্বতন্ত্র । মনে করা হয় এবাড়ির পুজার ইতিহাস প্রায় ৪৫০ বছরের ও
বেশি প্রাচীন। এই সুদীর্ঘ সময় ব্যাপী একইরকম পুজা আচার অপরিবর্ত নীয় ভাবে অনুসৃত হয়ে আসছে।
শোনা যায় কোন এক সময় এবাড়ির কোন এক পুর্ব পুরুষ হাওয়া বদলের জন্য কিছুকাল সাহেবপুরে ছিলেন।
সাহেবপুর হল উড়িষ্যার বালেশ্বর এর কাছে একটি অখ্যাত স্থান। সেইসময় সেখানে অবস্থান কালে কোন একদিন
রাত্রিকালে সেই ব্যাক্তি স্বপ্ন নির্দে শ লাভ করেন স্বয়ং দেবী দুর্গার। স্বপ্ন নির্দে শ পান যে – দেবী নিকটবর্তী মুসলমান
সম্প্রদায় ভু ক্ত কোন এক ধীবরের পর্ণকু টির এর অন্তঃস্থলে ভূ গর্ভে র ১৪ ফু ট নিম্নে প্রথিতা অবস্থায় বহুকাল ব্যাপী
আটকা পরে আছেন। দেবী নির্দে শ দেন অতি শীঘ্র জেন তাঁকে সেই স্থান থেকে উদ্ধার করে কলকাতায় ফিরে গিয়ে
যথোপচারে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
নির্দে শ মাফিক সেই স্থানে খনন করে সত্যসত্যই একটি দেবীমূর্তি পাওয়া যায়। কষ্টিপাথরে নির্মিত তিনফু ট উচ্চতার
সেই মূর্তি সিংহ রূঢ়া ,দশভু জা এবং বামহস্তে দেবী স্বয়ং মহিষাসুরের কেশ আকর্ষণপূর্বক দমনোদ্যতা ভঙ্গিমায়
অধিষ্ঠাতা। মহাকাল দেবীর ঊর্দ্ধে বিরাজমান । উভয়পার্শ্বে সন্তানাদির পরিবর্তে জয়া ও বিজয়া দেবী কে সঙ্গদান
করেছেন। ঐতিহাসিকগণের অনুমান মূর্তি টি সম্ভবত পাল সেন যুগে নির্মিত । প্রতিষ্ঠা কাল থেকেই দেবী নিত্য
পুজিতা। তাই এবাড়িতে দশমীর পর দেবী মূর্তি র বিসর্জ ন হয়না। কেবলমাত্র পুজার উদ্দেশ্যে নিবেদিত ঘটপাত্রটির
জল পরিবর্ত ন করা হয় গঙ্গার ঘাটে এবং সেই সঙ্গে দেবীমূর্তি র অভিমুখ দক্ষিন দিক থেকে পশ্চিম দিকে পরিবর্ত ন
করে দেওয়া হয়।
দেবীর বোধন হয় ষষ্ঠীর সন্ধ্যায়। এবাড়ির রীতি অনুযায়ী বাড়ীর মহিলাসভ্য বৃন্দ দেবী বরনের পূর্বে আমিষাহার করেন
এবং রীতি অনুযায়ী পান সুপারি মুখে নিয়ে দেবী কে বরন করে নেন।
সপ্তমীতে কাকভোরে নবপত্রিকার স্নানযাত্রা সূচনা হয়। বর্ত মানে হালদার পরিবার দুটি পৃথক শাখায় বিভক্ত হয়ে
যাওয়ায় উভয় পরিবারের পক্ষ থেকে পৃথক নবপত্রিকা একসাথে স্নানযাত্রায় রওয়ানা হয়। লালবর্ণের দুটি অসাধারন
কারুকার্যময় ছাতার আচ্ছাদন সহযোগে নবপত্রিকাদ্বয় মায়ের ঘাটে স্নান যাত্রার নিমিত্ত উপনীত হয়। স্নান সমাপনে
পুনরায় নবপত্রিকা গৃহে প্রত্যাবর্ত ন করে ও প্রতিমার পার্শ্বে অবস্থান করে।
অষ্টমীর সকাল শুরু হয় পুষ্পাঞ্জলি ও অন্যান্য পুজা আচারের মধ্য দিয়ে। অষ্টমীতে হালদার বাড়ীর মূল আকর্ষণ
অবশ্যই এবাড়ির সন্ধি পুজার নিয়ম রীতি। পুজার উপকরন হিসেবে ব্যবহৃত মোট ১০৮ টি মাটির প্রদীপ প্রতি বছর
ভিন্ন ভিন্ন নকশায় সজ্জিত করা হয়। কোন বছর শঙ্খের আদলে আবার কোন বছর প্রস্ফু টিত পদ্মের আদলে। দেবীর
নির্দি ষ্ট ইঙ্গিত অনুসরন করে প্রতি বছর প্রদীপ বিন্যাসের আদল ঠিক করা হয়।
এবাড়ীতে কু মারী পুজা হয় নবমীর সকালে। সাধারন পুজা পদ্ধতির রীতি থেকে একটু পৃথক এবাড়ীর কু মারী পুজার
সময় সারণি। প্রতিবছর অনুর্দ্ধা ষোড়শ বর্ষীয়া একটি কন্যা নির্বাচন করা হয় ও নবমীর সকালে হমোম ও আরতির
পর কু মারী পুজার সূচনা হয়। স্নান এর পর নবপরিধেয় সজ্জিতা , সালঙ্কারা , চরনে অলক্ত রঞ্জিতা কু মারী কে দেবী
জ্ঞানে পুজা করা হয়। নির্বাচিত কন্যাকে পুজা সম্পন্ন হওয়া অবধি উপসি থাকতে হয়। দেবী মূর্তি র নিকট থেকে
সংগৃহীত একটি পুষ্প , কু মারী নিজ হস্তে ধারন করে থাকে।
দশমীর সন্ধ্যায় এবাড়ীতে কিন্তু মোটেও বিষাদের সুর বাজে না। কারন বাড়ীর প্রতিমা কখনও বিসর্জ ন দেওয়া হয় না।
কেবল মূর্তি র অবস্থান পরিবর্ত ন করা হয়। বাড়ীর মহিলারা যথারীতি মেতে ওঠেন সিঁদুর খেলায় এবং সিঁদুর খেলা
শেষে প্রত্যেক সদস্য ‘শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়’ এই বাক্যটি লিখে মিষ্টিমুখ করে থাকেন।
এভাবেই শেষ হয় চারদিনের আনন্দমুখরিত উৎসব ।

You might also like