You are on page 1of 61

বর্ষ ১ । সংখ্যা 5 । অক্টোবর ২০২৩

অক্টোবর ২০২৩ 1
এ সংখ্যার সম্পাদক
আহমাদ রফিক

প্রকাশকাল
অক্টোবর ২০২৩

প্রথম বর্ষ
পঞ্চম সংখ্যা

প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা
আবদুল্লাহ আল মাহমুদ

সার্বিক য�োগায�োগ

অক্টোবর ২০২৩ 2
সম্পাদকীয়
এমন ত�ো হয়, বারান্দায় পড়ে থাকে গেরুয়া
র�োদ। কিছুক্ষণ জানালায় থুতনি রেখে, বাতাস তুলে
যায় বুকে হাহাকার। নিরবতা বসে থাকে পাখিদের
মত�ো গাছের ডালে ডালে। উড়ে যাওয়া পাখির খাচায়
থেকে যায় শুধু উড়ে যাওয়ার স্মৃতি। মাঠের পর মাঠ
পড়ে থাকে করুণ শূন্যতা নিয়ে। খেলার বয়সগুল�ো
ভুলে যায় আল�োড়নের ক�ৌশল। হাত ও কণ্ঠ জমে
যায় অন্তর্জালজুড়ে। দৃশ্যের পর দৃশ্য বদলাতে থাকে।
তখন কী করে মানুষ? কী ছুঁতে চেয়ে জীবনের দিকে
অলক্ষেই বাড়িয়ে দেয় মনের হাত? চতুর্ভুজের এ
সংখ্যার বুকে ব�োধহয় এমন অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর
লেখা আছে।

হ্যাঁ, আরেকটা বিষয়ে ব�োধহয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ


না করলেই নয়, প্রতিটি লেখার চিন্তা, মতামত ও
বানানরীতি লেখকের নিজস্ব। মাআসসালাম।

আহমাদ রফিক

অক্টোবর ২০২৩ 3
সূচিপত্র
যবানে বাংলা । 06
আবদুল্লাহ আল মাহমুদ
ঘ�োর অথবা অনন্ত তৃষা । 13
জুবায়ের রশীদ
হলুদ খামে মন । 20
নুরুযযামান নাহিদ
ক�োন�ো এক কিশ�োরের অসমাপ্ত জীবনী । 27
আহমাদ সাব্বির

অজস্র প্রশ্নের দিকে তাকিয়ে। 31


আলমগীর মুরতাজা
গ্রাম-শহর-অভিবাসন । 33
ইফতেখার জামিল

অক্টোবর ২০২৩ 4
ভালবাসার সাম্পান । 40
আহমাদ রফিক
শাহ ওয়ালিউল্লাহর জন্মভিটায় । 42
হাসান আজীজ
ম�োহ ম�োহ সুর । 49
ওমর আলী আশরাফ
গাজালি । 52
সাবের চ�ৌধুরী

অক্টোবর ২০২৩ 5
যবানে বাংলা
আ ব দু ল্লা হ আ ল মা হ মু দ

ভা ষা পরিবারের আদি কুলজি-ঠিকুজি উল্লেখপূর্বক একটা তালিকা কিছুদিন আগে


ইন্টারনেট-জগতে কিঞ্চিত আল�োড়ন তুলেছিল। ছবিটা শির�োনামের সঙ্গেই জুড়ে
দিচ্ছি, এখানে খেয়াল করলে দেখবেন, বাংলা, হিন্দি, অসমিয়া সহ বেশকিছু অতি ব্যবহৃত
ভাষার উৎস হিসেবে যে সংস্কৃতের নাম আমরা পাঠ্যবইতে পড়ে এসেছি, তাকে বিলকুল
অস্বীকার করা হয়েছে। ভারতীয়দের গর্বের সংস্কৃতের ধ্বজা এইভাবে অস্বীকৃত হতে দেখে
খানিকটা ক�ৌতুকব�োধ করলাম। বহুদিন আগে পড়া সেই আপ্তবাক্য, বাংলা সংস্কৃতের
দুহিতা, মনে পড়ায় একচিমটি রগড়ও অনুভব করলাম বৈকি।

অক্টোবর ২০২৩ 6
জননী ও দুহিতার মধ্যে যে সাদৃশ্য তা নিতান্ত সংস্কৃতের দুহিতা। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র ভাষ্যে
সাধারণ মানুষের চ�োখেই ধরা পড়ে, অথচ - ‘সংস্কৃত যুগ বলিয়া আমরা একটি পৃথক যুগ
সংস্কৃত ও বাংলার যে দূরত্ব, তাতে দুজনের কল্পনা করতে পারি না। প্রাকৃতের পূর্বে প্রাচীন
নিকট আত্মীয় হওয়া দূরে থাকুক, দূরের প্রাকৃতের যুগ, যাহার সাহিত্যিক রূপ আমরা
আত্মীয়তা নিয়েই সন্দেহ দেখা দেয়। বাংলা পালি ভাষায় দেখি। প্রাচীন প্রাকৃতের পূর্বে প্রাচীন
ভাষার আদি অস্তিত্বের যে ইতিহাস, তাতে দেখা ভারতীয় আর্য ভাষার যুগ। এই কালের ব্রাহ্মণ্য
যায় খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে ব�ৌদ্ধ ধর্মগুরু মীননাখের সমাজের সমাজের বহির্ভূত জনসাধারণের কথ্য
কাব্যই ছিল প্রথম বাংলা লেখার সার্থক প্রয়াস। ভাষাকে আদিম প্রাকৃত বলা হইয়াছে। সুতরাং
পরবর্তীতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার দেখা যাইতেছে সংস্কৃতের সহিত বাঙ্গালার
হতে পঞ্চাশটি কাব্যের সমন্বয়ে রচিত একটি ক�োনও সাক্ষাৎ সম্পর্ক নাই।’ (বাঙ্গালা ভাষার
সংকলনের সন্ধান পান, যা আজকে আমরা ইতিবৃত্ত, ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ)
চর্যাপদ নামে চিনি। ভাষাপন্ডিত ড. মুহাম্মদ বস্তুত বাংলার সঙ্গে সংস্কৃতের এই দহরম
শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষার যতগুল�ো কালপর্ব
বস্তুত গত পঞ্চাশ বছরে ‘এপারে’র বাংলার আরবি-ফারসিজাত নাপাকি
নিয়ে ওপার বাংলার যে হাহাকার, এর পেছনে আছে বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ না
করাতে পারার আফস�োস, ভারতে ক্রমশঃ অগুরত্বপূর্ণ হয়ে পড়ার বেদনা,
এবং আরও অনেক অব্যক্ত যন্ত্রণা। তারা বাংলার যে ব্যবহার নিয়ে আপত্তি
ত�োলেন, তার গ�োড়াতেই আছে বিস্তর গলদ।

নির্দেশ করেছেন, তার ক�োনটিতেই সংস্কৃত


মহরম সম্পর্কের শুরুটা খুব বেশিদিন আগের
সাধারণ্যে প্রচলিত ক�োন ভাষা ছিল না। বস্তুত
নয়। এর আগে সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার খুব
সংস্কৃত ক�োন কালেই সাধারণ মানুষের মুখের
গভীর সম্পর্ক ছিল না। বাংলামুলুকে ইলিয়াস
ভাষা হিসেবে ব্যবহার হওয়ার নজির নাই,
শাহীর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মূলত
এটা সবসময়ই ছিল রাজরাজরা, ধর্মীয় পণ্ডিত জনগণের মুখের ভাষা থেকে বাংলার রাষ্ট্রীয়
ও গুরুস্থানীয় মানুষের ভাষা। ফলে কাছাকাছি পৃষ্ঠপ�োষকতার যাত্রা শুরু, শতাব্দীর হিসেবে
সময়ে ব্যবহার হওয়া হিসেবে সংস্কৃতের সঙ্গে
ঈসায়ি চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি, স্তরের
বাংলার সম্পর্ক আছে সত্যি, কিছু সংস্কৃত শব্দ
বিচারে মধ্যযুগ। এইসময় বাংলায় একদিকে শাহ
সে নিজের মাঝে হজম করে নিয়েছে, এও ঝুট
মুহাম্মদ সগীর ইউসুফ জ�োলেখা কাব্য রচনা
নয়, কিন্তু তাতে এটা প্রমাণ হয় না যে, বাংলা
অক্টোবর ২০২৩ 7
করেন, অপরদিকে সহস্রাধিক কবি রাধাকৃষ্ণের খেয়ে ফেলল, নিয়ে নিল�ো। কয়েকজন ত�ো
প্রেমলীলাকে কাব্যাকারে রচনা করেন, যাদের আবার অতিউৎসাহী হয়ে বাংলাদেশি বাংলা
শতাধিক ছিলেন আবার মুসলমান কবি। (তাদের ভাষায় আরবি) আর ক�োলকেতে
বিষয়টাকে আমরা মুঘল দরবারে হিন্দু কবিদের বাংলার তুলনামূলক শব্দ দেখিয়ে বলছেন ক�োন
নাতে রাসুল পাঠ করার সাথে তুলনা করতে শব্দ এস্তেমাল করা জায়েজ, আর ক�োনটা
পারি। রাষ্ট্রীয় সমাদর ও উৎসাহ পেয়ে কবিবর্গ ব্যবহার করলে পরে ধূলায় মিশে যাওয়া রবীন্দ্র-
র�ৌরব নরকের ভয় উপেক্ষা করে বাংলার চর্চা বঙ্কিমের রুহের তকলিফ হয়। সেই তালিকামতে
শুরু করলেও, চতুর্দশ শতাব্দী থেকে উনবিংশ খরচ না করে ব্যয় করা উচিত, হিসেব না করে
শতাব্দীতে ইংরেজকর্তৃক ইংরেজিকে রাষ্ট্রীয় শুধু গুনে রাখলেই সই, অবশ্য কাজটা যে
ভাষা হিসেবে ব্যবহার শুরু করার আগ পর্যন্ত খারাপ হল�ো তাও বলার উপায় নাই, বলতে
ফারসি ছিল এই দেশের রাজভাষা। তাই প্রায় হবে ত্রুটিপূর্ণ। এই পর্যন্ত ক�োন মতে মানা
আড়াই হাজার শব্দ ভাণ্ডারের পাশাপাশি গেলেও যখন সরবরাহের ‘সনাতনী বাংলা’
বাংলায় ফারসি বাক্যরীতির সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য শুনলাম ‘দুগ্ধফেননিভ শুকর’, তখন আমি ও
করা যায়। এস্থলে প্রাতঃস্মরণীয় সৈয়দ মুজতবা আমার ফেসবুক বন্ধুরা যে অট্টহাসি দিয়েছিলাম,
আলী খানিকটা সন্দেহের সঙ্গে একটা বাক্যের তা ভিক্টোরিয়া মেম�োরিয়ালে বসে বাংলাভাষা
তুলনা করে দেখিয়েছেন, উদ্ধারে নিরত গর্গ চ্যাটার্জিরাও শুনতে
পেয়েছিলেন।
ফারসি - চুন - পাদশা - মরা - দীদন্দ - গুফতন্দ
- তু - কুজা - মীরাওয়ী? বস্তুত গত পঞ্চাশ বছরে ‘এপারে’র বাংলার
বাংলা - যখন - বাদশা - আমাকে - দেখলেন - আরবি-ফারসিজাত নাপাকি নিয়ে ওপার বাংলার
যে হাহাকার, এর পেছনে আছে বাংলাকে
বললেন - তুই - ক�োথায় - যাচ্ছিস?
নিয়ন্ত্রণ না করাতে পারার আফস�োস, ভারতে
এখানে প্রতিটি শব্দের বৈয়াকরণিক অবস্থান ক্রমশঃ অগুরত্বপূর্ণ হয়ে পড়ার বেদনা, এবং
ফারসি ও বাংলাতে হুবহু এক। তবে একটি আরও অনেক অব্যক্ত যন্ত্রণা। তারা বাংলার যে
বাক্যের তুলনায় সিদ্ধান্তে আসা দুষ্কর হলেও ব্যবহার নিয়ে আপত্তি ত�োলেন, তার গ�োড়াতেই
ফারসির সঙ্গে বাংলার যে রুহানি সিলসিলা তা আছে বিস্তর গলদ।
এনকার করার উপায় নাই।
আঠার�োশ�ো সত্তরের দশকে কালিপ্রসন্ন
অধুনা ফেসবুকের কল্যাণে প্রায়শই দেখতে সিংহের লেখা হুত�োম প্যাঁচার নকশা আর তার
পাই ওপাড় বাংলা থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে সমসাময়িক বঙ্কিমের রচনা পাশাপাশি উল্লেখ
আসে, বাংলাদেশের বাংলা আর বাংলা থাকছে করলে দেখা যাবে, দুজনে কাছাকাছি সময়ে
না, জ�োব্বা-বুরকা পরা আরবি ফারসি তাদের লিখলেও হুত�োমের ভাষায় সাধারণ মুখের কথার
অক্টোবর ২০২৩ 8
ছাপ, লিখছেন ‘পাকি হয়ে উড়তে গিয়ে ছাত কহিলেন যেন মত আছিলেন বঙ্গে
থেকে পরে মরা’। অপরদিকে বঙ্কিম লিখছেন বঙ্গদেশি বাক্য অনুকরণ করিয়া
‘বীরেন্দ্রসিংহ গাত্রোত্থানপূর্বক দণ্ডবৎ হইলেন; বাঙ্গালের কদর্থেন হাসিয়া হাসিয়া’
অভিরাম স্বামী বীরেন্দ্রের হস্তদত্ত কুশাসন�োপরি প্রাচীন থেকে আধুনিক, সকল যুগের পশ্চিমবঙ্গীয়
উপবিষ্ট হইলেন, অনুমতিক্রমে বীরেন্দ্র সাহিত্যিকদের কাছেই পূববাংলার ভাষা ছিল
পুনরুপবেশন করিলেন’। মুশকিল হচ্ছে, বঙ্কিম, অবজ্ঞার শিকার। এ প্রসঙ্গে আমরা নারায়ণ
ঈশ্বরচন্দ্রের এহেন ভাষা যে ক�োনকালেই কারুর গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা টেনিদার গল্পগুল�ো মনে
মুখের ভাষা ছিল না, তা বলার অপেক্ষা রাখে করতে পারি, যেখানে হাবুল সেন নামে একটি
না। খ�োদ রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চ�ৌধুরিরাও ভাষার বাঙালি অভিবাসী চরিত্র ছিল, গল্পে যার ভূমিকা
এইরকম মুখ থেকে লেখায় না এসে লেখা থেকে কেবল পূববাংলার ভাষায় কথা বলে বাড়তি
মুখে ওঠান�োর চেষ্টাকে উল্টাযাত্রা বলছেন। তাই রসের সঞ্চার করা। ইদানীংকালের পশ্চিমবঙ্গীয়
দেখা গেল ছয়শ�ো বছর মুঘল-তুর্কি শাসনের নাটক সিনেমাতেও এপার বাংলার ভূমিকা
পরও বাংলায় আরবি-ফার্সি শব্দের সংখ্যা ম�োটে
অনেকটা অপরিবর্তিতই রয়েছে। যদিও যাদের
আড়াই হাজার, ওদিকে বঙ্কিমের লেখার প্রায়
হাতে পশ্চিমবাংলার শিল্পসাহিত্যের উন্নতি,
নব্বইভাগ শব্দ বাংলায় অব্যবহৃত সংস্কৃত। তাদের অনেকেরই আদিপুরুষ ছিলেন এপার
তাদের এই অস্বাভাবিক যাত্রা ও একটা বাংলার, যারা নিজেদের মধ্যে স্থানীয় ভাষায় কথা
আর্টিফিশিয়াল স্ট্যান্ডার্ড ভাষা তৈরির মিশনের বললেও, যখন লিখতেন, তখন তাদের কলমে
নিচে চাপা পড়ে গেছে বাংলার আদি রূপ। এ ভাষা নিছক হাস্যপরিহাসের উপাদান হিসেবে
নদিয়ার ভাষা থেকে উৎসে, ব্যবহারে আলাদা উঠে আসত�ো। বাংলার একটি ডায়ালেক্ট হিসেবে
বাংলার বিভিন্ন ডায়ালেক্ট তাদের অবজ্ঞার সিলটি, চাটগাঁইয়া, অমপুরিয়া এগুল�ো স্বাধীন
শিকার হয়েছে। অবশ্য এই ধারাবাহিকতা যে বাংলাদেশে আলাদা স্বাধীন ভাষা হিসেবে হয়ত�ো
উনিশ শতকের ফ�োর্ট উইলিয়াম কলেজের চর্চিত হয়নি, কিন্তু ব্যবহারে, গ্রহণয�োগ্যতায়
অধ্যাপকদের থেকে শুরু হয়েছে তা নয়। এগুল�ো এই দেশের মানুষের কাছে কবুলিয়ত
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানাচ্ছেন, মধ্যযুগে হাসিল করেছে। অপরদিকে প্রমথ চ�ৌধুরি তথা
ভাববাদী সাহিত্যের জ�োয়ার আনার পথিকৃত পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্যিকদের নজরে বাংলা ভাষা
চৈতন্যদেবের মধ্যেও নিজ ভাষার গ�ৌরব ও আহত হয়েছে সিলেটে, নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে।
অন্য আঞ্চলিক রূপগুল�োর প্রতি অবজ্ঞা ছিল। বাংলার পাশাপাশি অন্যান্য যে ভাষাগুল�ো
তিনি বঙ্গদেশি বাঙ্গালদের কথাকে কদর্থ করে আছে, যেমন উড়িয়া, অহমিয়া, এগুল�োর
হাসিঠাট্টা করতেন। উচ্চারণে, শব্দভান্ডারে বাংলার সঙ্গে অসম্ভব
‘সবার সহিত প্রভু হাস্য কথা রঙ্গে মিল। তবে এই সাদৃশ্য সত্বেও সত্য হচ্ছে
অক্টোবর ২০২৩ 9
এগুল�ো আলাদা ভাষা, যার নিজস্ব বর্ণমালা, নাই। যদিও স্বাধীনতা উত্তর কয়েকটি দশক
গতিপ্রকৃতি, ইতিহাস আছে। যদিও ইতিহাসের পর্যন্ত এই দেশের ভাষা, সাহিত্য, গণমাধ্যমে
একটা কালপর্বে এই ভাষাগুল�োকে বাংলা দাড়িকমা সমেত ক�োলকেতে আদবকেতা মেনে
হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। ১৯২৬ চলা হত�ো। ক�োলকাতার নির্ধারিত উচ্চারণকে
সালের একটা পুস্তক সেদিন ইন্টারনেটে খুঁজে ‘শুদ্ধ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটা খায়েশ
পেয়েছি, যার শির�োনাম হচ্ছে, ‘উড়িয়া স্বতন্ত্র এখনও আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকর্তাদের
ভাষা নহে’। নিতান্ত হাস্যকর পুস্তক সন্দেহ মধ্যে বিদ্যমান আছে। তবে নতুন শতকের
নাই, তবে সেখানে পশ্চিম বঙ্গীয় শিক্ষিত শ্রেণির সিকিভাগ পেরিয়ে যাওয়ার পরে এখন বলা
চ�োখে বাংলার উপভাষা ও কাছাকাছি ভাষাগুল�ো যায়, ক�োলকাতার আশ্রয়ের বাইরে বাংলাদেশি
কী মর্যাদা রাখত তার একটা নজির পাওয়া বাংলা একটা স্বাধীন চরিত্র অর্জন করার পথে
যায়। ফলে এই সিদ্ধান্তে আসাটা খুব বেশি ভুল আছে।
হবে না যে, পশ্চিম বাংলা তার রাজনৈতিক
শিল্প সাহিত্যে এই অঞ্চলের মানুষের মুখের

বাংলার পাশাপাশি অন্যান্য যে ভাষাগুল�ো আছে, যেমন উড়িয়া, অহমিয়া,


এগুল�োর উচ্চারণে, শব্দভান্ডারে বাংলার সঙ্গে অসম্ভব মিল। তবে এই
সাদৃশ্য সত্বেও সত্য হচ্ছে এগুল�ো আলাদা ভাষা, যার নিজস্ব বর্ণমালা,
গতিপ্রকৃতি, ইতিহাস আছে।
আনুকূল্য ও নদিয়ার কাছাকাছি অবস্থানের
ভাষাকে আদরণীয় করে ত�োলার পুর�োভাগে
বায়�োলজিক্যাল সুবিধাবলে অপরাপর বাংলা
ছিলেন মরহুম হুমায়ুন আহমেদ। তার
ভাষাভাষীদের অবদমন করে রাখতে চেয়েছে,
অপরিমিত সৃজনশীলতাকে তিনি এই দেশের
এবং সেই মন�োভাব এখনও বহাল আছে।
মানুষের ভাষায়, স্থানীয় ভাবে-ভঙ্গীতে প্রকাশ
২. করেছিলেন। বিশুদ্ধতাবাদীদের আপত্তি সামলে
পুববাংলা ও পশ্চিমবাংলার ভাষায় রবিন্দ্রনাথের তিনি মিডিয়া ও সাহিত্যে এই বাংলার একটা
‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে’ যে খুব কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছিলেন। গত
একটা কার্যকরী হয় নাই, সে কথা বলার শতকের শেষ দশক থেকে নিয়ে এই শতকের
জন্যই আমার এতক্ষণের মুসাবিদা। স্বাধীন দেশ শুরুর দশকটিতে তার এই প্রচেষ্টা চলমান ছিল।
হিসেবে বাংলার গতি এদেশে যেভাবে বিস্তৃত এর ফলে আজকের বাংলাদেশে এসে আমরা
হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে তার বিস্তার সেভাবে হয় নাম পরিচয় মুছে দিয়ে কেবল লেখার মাধ্যমেও
অক্টোবর ২০২৩ 10
চিহ্নিত করতে পারি ক�োনটা আমাদের এখানের ভাল দিক থাকে, তেমনি এর প্রতিক্রিয়ায়
ভাষা, ক�োনটা ওপারের। গড়ে উঠেছে বাংলাবাজার ভিত্তিক বাংলাচর্চার
ক�োলকাতা থেকে আলাদা একটি বাংলাভাষা আয়�োজন। তবে তা এখনও নবীন পর্যায়
দাঁড় করান�োর ব্যাপারে নিকট অতীতে হুমায়ুন অতিক্রম করছে বিধায় সে অর্থে ম�ৌলিক লেখার
আহমেদের নাম আমরা স্মরণ করলেও তিনিই পরিমাণ কম, অনুবাদের ভাগটাই বেশি।
একমাত্র ব্যক্তিত্ব নন। বরং দেশবিভাগের পরবর্তী এর বাইরে সৃজনশীল সাহিত্যে বাংলাদেশি
সময়ে বেশ কিছু সাহিত্যিক ক�োলকাতা থেকে বাংলার নিজ চরিত্র বিনির্মানে ভূমিকা রাখছেন
আলাদা একটি বাংলা দাঁড় করান�োর ক�োশেশ এই প্রজন্মের লেখক ও কবিগণ। যাদের বেড়ে
করেছেন। এক্ষেত্রে ফররুখ আহমদ ও আবুল ওঠার সময়টি থেকেই স্বতন্ত্র বাংলা নির্মানের
মনসুর আহমদকে আমরা স্মরণ করতে পারি। কর্মপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, ফলে এরা যখন
এঁদের মধ্যে ফররুখের ভাষা ছিল র�োমান্টিক ও লিখতে শুরু করেছেন, ততদিনে তাদের ভাষা,
ক�োলকাতার মতই কৃত্রিম, উল্টোদিকে আবুল অভিরুচি, চিন্তা সবকিছুতে এই বাংলার প্রভাব
মনসুর আহমদ নির্দ্বিধায় ঢাকার চলতি বাংলা পড়তে শুরু করেছে। তাই হাসান র�োবায়েত
ব্যবহার করেছেন। যখন লেখেন -
ইদানীংকালে এই প্রক্রিয়ার গতিপথ একটু ভিন্ন ত�োমাকে দরদ করি প্রথম র�োজার মত করে
দিকে ম�োড় নিয়েছে বলে অনুমান করা যায়। গত যেভাবে দরদ করে স্বামীরা বাঁধে বউয়ের চুল
কয়েকবছরে ঢাকার বাজারে একটি নতুন পাঠক দ�োয়া কুনুতের মত�ো আজ দেখি ভুলে গেছি সব
শ্রেণীর উত্থান ঘটেছে, যারা ম�োটাদাগে দ্বিতীয় আমার তওবা তুমি এখন কি করবে কবুল?
প্রজন্মের শিক্ষিত, সেইসঙ্গে ধর্মচর্চা করেন। তখন আমাদের মনে হয় না প্রথম র�োজার
সমাজের অন্য শ্রেণীগুল�োর তুলনায় এই মত উপমা কী করে ব্যবহার হতে পারে বাংলা
অংশটি তুলনামূলক বেশি পাঠাভ্যাস রাখেন। কবিতায়, যেখানে সৈয়দ হকেরা, শামসুর
আর তাদের রুচি মাফিক চাহিদার য�োগান দিতে রাহমানেরা সাধারণ বাঙালি মুসলমানের
গড়ে উঠেছে একটি স্বতন্ত্র বইয়ের বাজার, যার দৈনন্দিন জীবনের ক�োন অনুষঙ্গ সাহিত্যে যুক্ত
ভাষা ম�োটাদাগে বাংলাদেশি, রুচিতে আধুনিক, করতে অস্বস্তিতে ভুগতেন।
ধর্মে মুসলমান। যদিও এই ক্ষেত্রটি আগেও
বিদ্যমান ছিল, তবে তা প্রধানত ইসলামি দেশবিভাগ পূর্ববর্তী সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের
ফাউন্ডেশন কেন্দ্রিক। গত পনের�ো বিশ বছরে রাজধানী হিসেবে কলকাতার যে সমাদর ছিল,
বাংলাদেশের অন্য সকল প্রতিষ্ঠানের মত ক�োলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি, রাজনৈতিক
এটিও চেতনাইজেশনের পাল্লায় পড়ে তার ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্যিকদের কল্যাণে বাংলায়
গ্রহণয�োগ্যতা হারিয়েছে। প্রতিটা মন্দের যেমন ক�োলকাতার যে সমাদর ছিল, দেশবিভাগের

অক্টোবর ২০২৩ 11
পর থেকে সেই গুরুত্বের গ্রাফ ক্রমশঃই থাকলেও ধীরে ধীরে স্বাধীন রূপ প্রকাশিত
নিম্নমুখি। নিখিল ভারতের অসংখ্য ভাষার মধ্যে হচ্ছে। বিবিধ ভাষার সাহিত্য, শাস্ত্রীয় পুস্তকাদি
বাংলার গ�ৌরব এটুকুই, এ ভাষার একজন বাংলায় প্রতিনিয়ত সংয�োজিত হচ্ছে। আর এই
সাহিত্যিক সাহিত্যে ন�োবেল পেয়েছিলেন। এ সবই হচ্ছে এপারের বাংলায়। তাই একথা বলাই
বাদে ভারতে বাংলা একটা প্রাদেশিক ভাষা বৈ যায়, বর্তমানে বাংলার কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গ নয়,
অন্য কিছু নয়। তদুপরি পশ্চিম বাংলা, আসাম, ঢাকা।
উড়িষ্যায় বাংলাকে সর্বদা হিন্দি, ইংরেজি, উর্দুর
সঙ্গে ম�োকাবিলা করতে হচ্ছে। অপরদিকে
বাংলাদেশের পরিস্থিতি এইরকম নয়, এখানের abdullah624683@gmail.com
বাংলা একটা দীর্ঘ সময় ক�োলকাতার অনুগত

অক্টোবর ২০২৩ 12
ঘ�োর অথবা অনন্ত তৃষা
জু বা য়ে র র শী দ

আ মাদের অনুভূতিগুল�ো হেমন্তের কুয়াশার মত�ো—এই আছে এই নেই। খুব


বেশি সময় জমাট বেঁধে থাকে না। নদীর ঢেউ আর মাথার ওপর ভাসতে থাকা
আশ্বিনের সাদা মেঘের মত�ো নিরন্তর আসা-যাওয়া করতে থাকে নিত্যনতুন অনুভূতি।
ট্রেনের জানালায় থুতনি রেখে বাইরের ধাবমান প্রকৃতি এক পলক দেখে হারিয়ে ফেলার
মত�োই প্রতিদিনের অনুভূতিগুল�ো আমরা হারিয়ে ফেলছি। কাল যে সুন্দর ম�োহিত করেছে
আজ তা শুধুই স্মৃতি হয়ে আছে। যে বিভা, যে আল�োক পরম আনন্দে ভাসিয়েছে, জীবন
থেকে সেটি এখন অতীত। উপলক্ষটা স্মরণ করতে পারি হয়ত, কিন্তু যে অনুভূতি ও
উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল তার সবটা বুদবুদের মত�ো মিইয়ে যায়। প্রেয়সীর প্রথম সাক্ষাতে
একজন পুরুষের দেহমনে যে প্রগাঢ় অনুভূতির সঞ্চার হয় দিন কয়েক পর তা আর মনে
অক্টোবর ২০২৩ 13
থাকে না। ক�োন�ো এক বিকেলে বাদাম ভাঙার লেখালেখির এই ঘ�োর ভেতরে যে অনন্ত তৃষার
ফাঁকে সে দিনটি যখন স্মরণ করার চেষ্টা করে জন্ম দিয়েছে সহসা এর থেকে বের হতে পারছি
তখন আবছা আবছা দৃশ্যমান স্মৃতিগুল�োই মনে না। লিখতে পারাই যেন পরম সুখের। বিভিন্ন
পড়ে কেবল। মনে পড়ে না হৃদয়ের সেই র�োমাঞ্চ, সময়ে লেখা এমনই কয়েকটি টুকর�ো অনুভূতি
সেই একান্ত অনুভূতি। রাতে ঘুমিয়ে পড়ার সাথে অবমুক্ত করছি পাঠকের সামনে।
সাথে অনুভূতিগুল�োও অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ৩. ৫. ২৩
নতুন সকালে আবার নতুন অনুভূতির জন্ম হয়।
ব্যতিক্রম হচ্ছে ডায়েরি। একজন ভাষাচতুর আল মাহমুদ-এর আত্মজীবনীর শুরুর অংশ
ব্যক্তি চাইলে শব্দ বাক্য দিয়ে হৃদয়ের অদৃশ্য ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ আমার বেশ প্রিয় একটি

আমাদের ধারায় কর্ম ও জীবনযাপনের যে একটা স্রোত দীর্ঘদিন চলে আসছে


এটা পাড়ি দেওয়া বড্ড কঠিন। এই স্রোতে অনেকে অনেকভাবে হারিয়ে যাচ্ছে।
আমার ধারণা, এটা খুবই গড়পড়তা একটা সিস্টেম। লেখালেখি ও গবেষণার
জন্য যৎসামান্য যে একান্ত অবসর ও স্বস্তিটুকুন কর্ম ও জীবনযাপনে দরকার
তা এখানে নেই। সেইসাথে মানুষের চিন্তাধারার বৈচিত্র্য অনুযায়ী এখানে কর্মের
অবকাশ নেই। নেই মানে সিস্টেমে নেই। কেউ চাইলে তার মত�ো করে খুঁজে নিতে
হয় পথ।

অনুভূতিগুল�ো জিইয়ে রাখতে পারে। পরে বই। বেশ কয়েকবার পড়েছি। ভাল�ো গদ্য
একদিন ডায়েরির হলুদ পাতায় চ�োখ দুটি মেলে পড়তে ইচ্ছে করলে বইটি হাতে নিই। এমন
ধরলে বিস্মৃত সেই অনুভূতিগুল�ো হঠাৎ তাড়া আরও কিছু বই আছে, ইচ্ছে হলে পড়ি।
খেয়ে ঝাঁকবাঁধা কবুতরের মত�ো উড়তে থাকে বিশেষ করে দুপুরে খাবারের পর যখন একটা
চ�োখে-মুখের সামনে। আলসেমি ভাব আসে তখন। বইটি পড়তে
পড়তে আমার মনে ধরে, আচ্ছা এমন করে—
আগের মত�ো এখন আর ডায়েরি লেখা হয় ঠিক এই বইটির মত�ো করে গদ্য লেখার জন্য কী
না। মাঝেমধ্যে ক�োন�ো তীব্র অনুভূতি, হঠাৎ দরকার আসলে। জীবনযাপনে অন্তর্গত ব�োধে
ক�োন�ো ভাবনা হৃদয়ে প্রবল হয়ে উঠলে লিখতে ও চৈতন্যে ষ�োল�োআনা লেখক না হলে কাঁড়ি
বসি। এসব লেখা কেউ কখনও পড়বে না
কাঁড়ি বই পড়ে এমনতর গদ্য কি লেখা যায় না?
জানি। তারপরও লিখে রাখি। প্রথম যেদিন
আল মাহমুদ এটা পেরেছিলেন। আল মাহমুদ এ
মনের আনন্দে এক পৃষ্ঠা লিখে উঠেছি সেদিন
বইয়ে গদ্যের যে প্যাটার্ন ব্যবহার করেছেন, ঠিক
অক্টোবর ২০২৩ 14
ক�োন পরিচয়ে বাঁধব জানি না। একটা পরিচয় ১৪. ৭. ২৩
ত�ো অবশ্যই আছে। কিন্তু সে পরিচয়ের অন্য খাঁচায় বন্দী পাখি দেখলে আমার ভীষণ মায়া
বইগুল�োর সাথে এর যে ফারাক আমি সে কথাই হয়। একটি পাখির কথা চিন্তা করলে আমাদের
বলছি। ইদানীং দেখি গদ্যকে বিভিন্ন প�োশাক কর�োটিতে ভেসে ওঠে চিরচেনা কিছু দৃশ্য।
পরান�ো হচ্ছে, বিভিন্ন ব্রান্ডও তৈরি করছেন চারপাশে ছড়ান�ো গাছপালা। সবুজ পাতা।
লেখকরা গদ্যের। ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’র সাথে ঘন নিবিড় ছায়া। এসবের ভেতর পাখি তার
এসবের ক�োন�োটাকেই মেলাতে পারি না। গদ্যে স্বজনসমেত ওড়াউড়ি করছে। কিচিরমিচির স্বরে
কাব্যসুলভ ভাবালুতা নেই, জ�োর করে বসিয়ে কথা বলছে। এই তাদের ভাষা। এই বাসায় তারা
দেওয়া শব্দ নেই, পাঠককে মুগ্ধ করার বাসনায় কথা বলে, আনন্দে হাসে, বেদনায় কাঁদে এবং
অহেতুক উপমা উৎপ্রেক্ষার প্রয়াস নেই। তবে রচনা করে তাদের নিজস্ব শিল্প। পৃথিবীতে বহু
আছে অনেককিছু—পড়তে পড়তে টের পাওয়া প্রজাতির প্রাণী আছে। এসবের মধ্যে অল্প যে
যায়। দুটি গ্রামের মাঝ দিয়ে হাইওয়ে র�োডের কয়েকটি আমাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে, পাখি
সমান প্রস্থের যে সরল নদী বয়ে গেছে সহস্র তার অন্যতম। পাখিদের জীবনযাত্রা কী দারুণ,
বৃক্ষের পাতা ছুঁয়ে, ন�ৌকায় করে সে নদী পাড়ি তা ঘন বৃক্ষ শ�োভিত পাখি ভরা ক�োন�ো বাগানে
দেওয়ার যে আনন্দ, আল মাহমুদ-এর যেভাবে নির্জন দুপুরে একমনে বসে থাকলে টের পাওয়া
বেড়ে উঠির গদ্যটা ঠিক এমন। এই মুগ্ধতা যায়। সঙ্গে নেওয়া যাবে না কাউকে। হাতে
রাতের সমুদ্র দর্শনেও পাওয়া যায় না। যেমন ম�োবাইল থাকবে না। একটু পরপর ফেসুবকের
পাওয়া যায় না বিভূতিভূষণ বা অন্য কারও গদ্য নিউজফিড চ�োখ ব�োলান�ো যাবে না। আর
পড়েও। আল মাহমুদ-এর সমস্ত রচনার মধ্যে ক�োন�োভাবেই ছবি ত�োলার জন্য তড়পান�ো যাবে
‘যেভাবে বেড়ে উঠি’র গদ্যকে আমি সেরা বলি। না। ডালে ডালে পাখিদের ওড়াউড়ি, বিচিত্র
তারপর পানক�ৌড়ির রক্ত। ভঙ্গিতে ডাকাডাকি এবং পাখিদের জীবনযাত্রা
আল মাহমুদের লেখার প্রতি আমার আগ্রহের অবল�োকন করাই হবে উদ্দেশ্য। আমার বহুদিন
একটা কারণ হল�ো, ১৯৫৪ সালে টিনের বাক্সে কেটেছে পাখিদের এমন জীবনযাপন দেখে।
করে আল মাহমুদ নতুন যে শব্দগুল�ো বাংলা ফলে পাখি হবে মুক্ত স্বাধীন এই দর্শন আমার
সাহিত্যের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বহন করে হৃদয়ে পুঁতে গেছে। তাই ক�োথাও খাঁচাবন্দী পাখি
ঢাকা নিয়ে এসেছেন আশৈশব-কৈশ�োর আমি এ দেখা আমার জন্য যন্ত্রণার।
শব্দগুল�োর ভেতর বেড়ে উঠেছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ঘটনা হল�ো, আজ আমার এক বন্ধুর বাড়িতে
ও নরসিংদী দুটি জেলার আঞ্চলিক সংস্কৃতি গিয়েছিলাম। বন্ধুটি শখ করে বাসার ছাদে নিয়ে
অভিন্ন। পড়ে তাই আলাদা একটা মজা পাই। গেল তার প�োষা পাখি দেখান�োর জন্য। সিঁড়ি

অক্টোবর ২০২৩ 15
ভেঙে যখন ওপড়ে উঠছি সে তখন বেশ উচ্ছ্বাস পাখিগুল�ো আগে মুক্ত করে দাও।
নিয়ে পাখিগুল�োর আগাম বিবরণ শ�োনাতে ২৭. ৮. ২৩
লাগল আমাকে। তার ধারণা ছিল, পাখিগুলো
দেখে আমি যারপরনাই মুগ্ধ হব। আমার ভেতরে আজ ছিল আমাদের পরিবারের এইকসঙ্গে
কবিতার কয়েক জ�োড়া পঙক্তি খলবলিয়ে উঠবে। আনন্দের ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। বাড়িতে অনেক
কিন্তু হল�ো তার উল্টো। আনন্দের বদলে আমি নতুন মেহমান এসেছে। স�ৌজন্য ও হালপুরসির
বরং তীব্র বেদনার মুখ�োমুখি হলাম। দেখি এই জন্য এগিয়ে গেলাম। আমার কৈশ�োরের একজন
কামরাঙা র�োদের বিকেলে সবগুল�ো পাখি খাঁচার শিক্ষকও ছিলেন অতিথিদের ভিড়ে। তিনিই
ভেতর একটা শক্ত কাঠের ওপর ঝিম মেরে বসে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন,
আছে। পাখিদের স্বভাবজাত ওড়াউড়ি নেই। ‘হুজুরের এই ছেলে বড় লেখক।’ আমি কিছুটা
কিচিরমিচির নেই। বরং বেদনার মত�ো একরাশ অস্বস্তি ব�োধ করলাম। লেখক পরিচয়ের যে
বিষণ্নতা ছড়িয়ে আছে চ�োখে-মুখে। খাঁচার আভিজাত্য-মহিমা, যে মর্যাদা-কর্ম-কীর্তি, এর
এক ক�োণে কয়েকটি পাত্রে খাবার ও বাসি পানি ক�োন�োটিই আমি ধারণ করতে পারিনি এখনও।
রাখা। আমাদের দেখে পাখিগুল�ো ভয় পেল না। কয়েকদিন বয়ান করে আন্তর্জাতিক বক্তা হওয়া

এইসব কিছু দিনরাত্রি জীবন থেকে চেয়ে নিয়েছি।


নড়ল না একটুও। পাখিদের মত�ো আমার মনও যায় হয়ত�ো, লেখক বিষয়টি তেমন না। যুগের
হঠাৎ বিষণ্ন হয়ে উঠল। এমন সময় দেখি— পর যুগ সাধনা ও অধ্যবসায়ে তবেই লেখক হয়ে
দূরের কার্নিশে বসে আছে কয়েকটি কাক। আমি উঠতে হয়। তাই কেউ ঘটা করে লেখক বললে
তাকিয়ে আছি—এরই মধ্যে একটা কাক উড়ে আমার অস্বস্তি লাগে। একথা সত্য, জীবনে
আসল আর বসে থাকা একটি কাক উড়ে গেল আমি লেখকই হতে চেয়েছি। হাজার হাজার
আমগাছের ডালে। কিন্তু খাঁচাবন্দী পাখিগুল�ো কাল�ো হরফের একজন লেখক। ছাত্রকালে
চিরদিনের জন্য বসে থাকল পুরন�ো এক খণ্ড তুখ�োড় বক্তৃতা করতে পারতাম। বন্ধুরা বলত,
কাঠের ওপর। বক্তা হবি তুই। কিন্তু প�োস্টারে নাম সাঁটান�োর
স্বপ্ন দেখিনি ক�োন�োদিন। স্বপ্ন দেখতাম, বিখ্যাত
আমি বাসায় চলে আসি। রাতে ফেসবুক স্ক্রল ক�োন�ো শিল্পী প্রচ্ছদে আমার নাম লিখে ছড়িয়ে
করছি। আমার সে বন্ধুর একটি স্ট্যাটাস চ�োখে দেবে জনারণ্যে।
পড়ল। কারাবন্দী আলেমদের মুক্তির আর্তি
জানিয়ে আবেগঘন লেখা। আমি ছ�োট্ট করে এই স্বপ্নের জন্য যে কষ্ট, ত্যাগ ও স্যাক্রিফাইস
তাকে বললাম—ত�োমার খাঁচাবন্দী বিষণ্ন আমি করছি তা লেখকমাত্রেই করতে হয়।

অক্টোবর ২০২৩ 16
লেখকদের কাছে এসবের আলাদা ক�োন�ো এখানে কর্মের অবকাশ নেই। নেই মানে
মাহাত্ম্য নেই। বিভিন্ন সময় বলতে শ�োনা যায়, সিস্টেমে নেই। কেউ চাইলে তার মত�ো করে
অমুকে ভাল�ো লিখতে পারত এখন হারিয়ে খুঁজে নিতে হয় পথ। একজন সাধারণ শিক্ষিতের
গেছে। এভাবেও বলতে শুনি, লিখতে ত�ো সামনে অনেকগুল�ো অপশন ঝ�োলান�ো থাকে।
এসেছিল অনেকে, কজনইবা টিকে আছে। সেখান থেকে নিজের পছন্দটা সে বেছে নিতে
সত্যিই ব্যাপারটা। আমারও জানাশ�োনা অনেক পারে চাইলে। কারও পেশা ও নেশা যদি এক হয়
প্রতিভা হারিয়ে গেছে। সূচনা দেখে যাদের তার সফলতার যাত্রা হয় সুলভ ও পুষ্পকাকীর্ণ।
ভেবেছিলাম ভাল�ো নাম করবে একদিন, এই শূন্যতার জায়গায় আমরা পড়ে আছি।
আজ তারা নেই ক�োন�ো খবরে। এইযে হারিয়ে হাজার�ো প্রতিভার ডানা ঝড় আসার আগেই
যাওয়া, প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটিয়ে ঝাঁকবাঁধা ভেঙে যায়। ফলে য�োগ্য ব্যক্তি বিকশিত হচ্ছে
মানুষের ভিড়ে মিশে যাওয়া, এসবের কারণ কী না। যথারূপে পালন হচ্ছে না আমাদের দায়িত্ব।
আসলে? বিশেষ করে, ছাত্রকালে যারা নিবিড় ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে আমাদের যে দায়
সাহিত্যচর্চায় নিজেকে প্রস্তুত করেছে। দিনরাত সেটা ঠিকঠাক আঞ্জাম দেওয়া হচ্ছে না। মাচার
একাকার করে ফেলেছে এসবে। স্বপ্ন দেখেছে আড়ালে লাউ আর দিঘির প্রান্তে অযত্নে বেড়ে
লেখালেখিতে মেলে ধরবে নিজেকে। কিন্তু ওঠা কলমি শাক দিয়ে কি আর জাতির বৃহত্তর
পরবর্তীতে আর দেখা মেলেনি তাদের। আমার কর্ম সম্পাদন করা যায়।
ব্যাপারটা ত�ো এমন, দশজন ছিলাম, এখন মাঝেমধ্যে আমারও ভয় হয়। জীবন কখনও
লিখছি এক কি দুইজন। অথচ স্বপ্ন ও সম্ভাবনা আমাকে এমন বাস্তবতায় নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়
ছিল সকলেরই। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশ�োনার পর কি-না, যেখানে এক দুপুর বই নিয়ে বসে থাকার
লেখালেখিতে নিজেদের তারা মেলে ধরতে এবং কয়েক পাতা লেখার দুদণ্ড অবসর পাওয়া
পারেনি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে যাবে না। আমার সেসব বন্ধু, একদা যাদের
পেয়েছি। এবং তা খুবই সাদামাটা। আমাদের সাথে শব্দ ও শিল্পের তুমুল তৃষ্ণা নিয়ে বেড়ে
ধারায় কর্ম ও জীবনযাপনের যে একটা স্রোত উঠেছি, সাহিত্য আড্ডা দিয়েছি, পাঠচক্র করেছি,
দীর্ঘদিন চলে আসছে এটা পাড়ি দেওয়া বড্ড নাশতার টাকা বাঁচিয়ে পত্রিকা করেছি, তাদের
কঠিন। এই স্রোতে অনেকে অনেকভাবে হারিয়ে মত�ো আমিও নিজেকে মিলিয়ে ফেলি কি-না
যাচ্ছে। আমার ধারণা, এটা খুবই গড়পড়তা নানা সব আয়োজনে। আমি কিছুতেই তাদের
একটা সিস্টেম। লেখালেখি ও গবেষণার জন্য ছ�োট করছি না। তাদের কাজকে ত�ো অবশ্যই
যৎসামান্য যে একান্ত অবসর ও স্বস্তিটুকুন না। কিন্তু সেই স্বপ্নের কী হল�ো যা আমরা ঘুম
কর্ম ও জীবনযাপনে দরকার তা এখানে নেই। থেকে জেগে বাস্তবে রূপান্তর করেছিলাম।
সেইসাথে মানুষের চিন্তাধারার বৈচিত্র্য অনুযায়ী

অক্টোবর ২০২৩ 17
৬. ৯. ২৩
ইদানীং পুরান ঢাকার নাজিরাবাজার খেতে যাই নিয়মিত। মজাদার
খাবারের প্রতি আমার একটা পক্ষপাত আছে। নাজিরাবাজারের কয়েকটি
খাবার আমার অতি প্রিয়। তেহারির জন্য হাজি। ছ�োট্ট একটা খাবার ঘর।
ছোট বলতে তাদের খাবারের যে সুনাম সুখ্যাতি সে তুলনায় অনেক
ছ�োট। আকারে সাধারণ রেস্তোরাঁর মত�োও না। প্রায়শই গিয়ে দাঁড়িয়ে
থাকতে হয়। আবার খেতে বসে কয়েক লুকমা মুখে পুরতেই পেছনে
এসে ল�োক দাঁড়িয়ে থাকে। আমার ধারণা, বাংলাদেশের সবচেয়ে ভাল�ো
তেহারি এখানে হয়। ক�োন�ো উপলক্ষে কেউ আমাকে খাওয়াতে চাইলে
এখানে যাই। পুষিয়ে খাওয়া যায় তখন। হা হা। দামের তুলনায় পরিমাণে
কম। এজন্য পেটপুরে খেতে হলে ডাবল নিতে হয়। ভ�োজনরসিক হলে
তিনটা। আমরা কাজিনরা আজ একত্র হয়েছিলাম। রাতে হাজির তেহারি
খেতে গেলাম। বদরুজ্জামান ভাই খাইয়েছেন। আমাদের মধ্যে ভাল�ো
একজন সাধারণ খেতে পারে সাব্বির—আমার ছ�োট ভাই। আমি যখন দুই প্লেট খেয়ে
শিক্ষিতের সামনে হাত ধুতে যাব ও দেখি তৃতীয় প্লেট শুরু করছে।
অনেকগুল�ো অপশন
কাচ্চির জন্য ব�োখারী। প্রথম যখন এই রেস্টুরেন্টে খেতে বসি নাম দেখে
ঝ�োলান�ো থাকে। অবাক হয়েছি। আনকমন নাম। এখানের কাচ্চিটা আমার মনে ধরেছে।
সেখান থেকে নিজের বাসমতি চাল, দুই পিস মাটন আর সাথে মজাদার আচার। স্বাদের
পছন্দটা সে বেছে পাশাপাশি সবচেয়ে ভাল�ো দিক হল�ো, পেটপুরে খেলেও ক�োন�োপ্রকার
নিতে পারে চাইলে। পার্শপ্রতিক্রিয়া নেই। যতবারই এখানে খেয়েছি, পেটের ক�োন�োরকম
কারও পেশা ও নেশা পীড়ায় ভুগিনি। অথচ অন্য ক�োথাও কাচ্চি খেলে একটা না একটা
যদি এক হয় তার সমস্যা হবেই।
সফলতার যাত্রা হয় কাবাবের জন্য বিসমিল্লাহ কাবাব। নাজিরাবাজার নিয়মিত গেলেও
সুলভ ও পুষ্পকাকীর্ণ। বিসমিল্লাহ কাবাবে বসা হয়নি। আলু বাজার হয়ে নাজিরাবাজার ঢুকতেই
এই শূন্যতার জায়গায় চ�োখে পড়ে বিসমিল্লাহ কাবাব। ভেতরে ও বাইরে মানুষের হৈহল্লা।
আমরা পড়ে আছি। একদিন ফেসবুকে বাংলাদেশের বিখ্যাত কিছু খাবারের নাম দেখি।
হাজার�ো প্রতিভার সাহিত্যের মত�োই আমি কিছুটা ভ�োজনরসিক। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবগুল�ো
ডানা ঝড় আসার খাবারের নাম পড়ি। ত�ো পড়তে পড়তে নাজিরাবাজারের বিসমিল্লাহ
আগেই ভেঙে যায়। কাবাবের খ�োঁজ পেলাম। ঢাবিতে পড়ে আমার এক কাজিন। পুরান ঢাকা

অক্টোবর ২০২৩ 18
খেতে গেলে ও-ই আমার নিত্যসঙ্গী। ব্যাপারটা কলর�োল চারদিকে। রাতের যে স্বভাব-প্রকৃতি
বললাম তারে। পরদিনই গেলাম নাজিরাবাজার। কখন�োই দেখা যায় না এখানে। এখানে জীবন
বিসমিল্লাহ কাবাবে ঢুকে দেখি ল�োকে গিজগিজ সতত ক�োলাহলমুখর। রুদ্রের কবিতা আছে না,
করছে ভেতরে। আপাতত বসার জায়গা নেই। বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে। এখানে সেটা হয়ে
একটু অপেক্ষা করি। ভাল�ো কিছুর জন্য অপেক্ষা যায়, বাতাসে কাচ্চির গন্ধ ভাসে।
করাটাও মধুর। খেতে বসে অনুমান ঠিক হল�ো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরুষ হলগুল�োর গেইট
ভিন্ন একটা স্বাদ সে থেকে প্রিয় খাবারের রাতভরই খ�োলা থাকে। শহিদুল্লাহর হলের
তালিকায় যুক্ত হল�ো বিসমিল্লাহ কাবাব। পুকুর পাড়ে অনেক রাত পর্যন্ত ছেলেরা দেখি
তেহারি, কাচ্চি অথবা কাবাব যা-ই খাই না আড্ডা দেয়। ওয়াসিম চিনিয়েছে জায়গাটা। ও
কেন, শেষে বিউটি লাচ্ছি না খেলে অপূর্ণতা এখানে মাস্টার্স করছে। নাজিরাবাজারে খেয়ে
থেকে যায়। নাজিরাবাজার যারা খেতে যায় এখানে এসে কিছুক্ষণ বসে থাকি। যেদিন তাড়া
অধিকাংশেরই এমন একটা ধারণা হয়ে গেছে। থাকে না অথবা ক্লান্তি থাকে শরীরে সেদিন
ভিড় দেখে আমার তাই মনে হয়। বিউটি লাচ্ছি অনেকটা সময় গড়িয়ে যায়। এখানে বসে গল্প
পুরান ঢাকার বিখ্যাত খাবারের একটি। চ�োখের করতে বড্ড লাগে। চারপাশে পুরন�ো ভবন।
সামনেই বানিয়ে পরিবেশন করে। পানি, তাদের সামনে ছড়ান�ো বাগান। মাঝঘানে বিশাল পুকুর।
নিজেদের তৈরি স্পেশাল দই, বরফকুচি এই পুকুরের পানিতে খেলা করে বহুরঙা নিয়ন
সামান্য কটি জিনিস লাচ্ছির উপাদান। কিন্তু ওরা আল�ো। এরই মাঝে একটা আবছা অন্ধকার
যেন কীভাবে বানায়। ফলে চ�োখের সামনে তৈরি জমে থাকে চারপাশে। যেদিন আকাশে বড়
সাধারণ খাবারই মুখে দিলে অসাধারণ হয়ে চাঁদ থাকে, বাতাস বয়, সেদিন উঠতে ইচ্ছে
যায়। আমি ত�ো মাঝেমধ্যে বলেই ফেলি, ওরা করে না। পুকুর ধারে বসে জীবনের গল্প খুব
কী এমন দেয় যে, মানুষ গভীর রাত পর্যন্ত এই জমে। সাধারণ কথাগুল�ো দেখি কেমন গভীর
লাচ্ছির জন্য দাঁড়িয়ে থাকে! কিন্তু চুমুকেই এক হয়ে ওঠে। ভাবনার জট খ�োলে দ্রুত। বিভিন্ন
গ্লাস শেষ করার পর মনে হয়, না এটা না খেয়ে দার্শনিক জিজ্ঞাসা লাফিয়ে ওঠে মনে। জ্ঞানী ও
চলে গেলে কিছুতেই ঠিক হত�ো না। প্রজ্ঞাদীপ্ত ক�োন�ো বন্ধুর সাথে রাত দুপুরে নদীর
ধারে, শান বাঁধান�ো পুকুর ঘাটে অথবা সৈকতের
রাত যত গভীর হয় ল�োকসমাগম তত বাড়তে
পালত�োলা বেঞ্চে বসে গল্প করে দেখবেন কী
থাকে নাজিরাবাজারে। রাত দেড়টা-দুইটায়
দারুণ মুগ্ধতা জমে ওঠে চারপাশে। এইসব কিছু
এখানে এলে মনে হয়, পল্টন মতিঝিলে মাত্র
দিনরাত্রি জীবন থেকে চেয়ে নিয়েছি।
বুঝি অফিস ছুটি হয়েছে। এরও অধিক হৈহল্লা

অক্টোবর ২০২৩ 19
হলুদ খামে মন
নু রু য যা মা ন না হি দ

গ তরাতে মেয়ের দ্বিতীয় চিঠিটা পেয়েছি। তার মা ছবি তুলে পাঠিয়েছেন। অতি
গ�োপনে। ওকে না জানিয়ে। সবার অগ�োচরে একান্তে সংগ�োপনে বাবাকে উদ্দেশ্য
করে লেখা তার এক পৃষ্ঠার দীর্ঘ পত্র অন্য কেউ দেখে ফেলেছে এবং ফট�ো তুলে বাবার
মুঠ�োফ�োনে পাঠিয়ে দিয়েছে জানতে পারলে নিশ্চিত আড়ি দিত�ো সে। গাল ফুলিয়ে, মন
ভার করে, সবার সাথে কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়ে একাকি বসে থাকত�ো নিশ্চুপ। কিংবা
চ�োখের জল আড়াল করতে বালিশে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদত�ো। কাঁদতে কাঁদতে
ঘুমিয়ে পড়ত�ো। আষাঢ়ের বৃষ্টি-জলে ধ�োয়া সাদা পদ্মের মত�ো নিষ্পাপ মুখের নিচে বাঁ
হাতের আঙুলগুল�ো ভাঁজ করে নরম ক�োমল উন্মুক্তপ্রায় মুঠি ঠেকিয়ে ব্যথা-বেদনার
স্পর্শহীন নির্ভার দীপ্তিময় আদুরে অবয়ব নিয়ে ঘুমুতে যেত�ো এক জান্নাতি শিশু। আমার
মেয়ে। সদ্য লিখতে শিখেছে সে। সবার অলক্ষ্যে দু-দুট�ো চিঠি সে লিখে ফেলেছে বাবার
আকস্মিক দূরে চলে যাওয়ায় ব্যথিত হয়ে। কাছের মানুষগুল�ো সম্পর্কে তার ঢের
অভিয�োগ। মনমুকুরে প্রতিবিম্বিত বাবাকে বলবার মত�ো অনেক কথা।
জীবনের প্রথম চিঠিটা আমিও লিখেছিলাম বাবাকে উদ্দেশ্য করে। তখন বেশ বড় হয়ে

অক্টোবর ২০২৩ 20
গেছি। নাজেরা পড়ি। ভেতরে তুমুল আবেগ, নি; সরকারি বিধিনিষেধের জেরে। কেমন যেন
উত্তেজনা ও কৈশ�োরিক অস্থিরতা। সরকারি ইতস্তত লাগছিল। কেন লাগছিল? ক�োন�ো
চাকরির সুবাদে বাবা দূরে দূরে থাকতেন। ব্যাখ্যা নেই। সাধারণত কৈশ�োরের আবেগ,
কখন�ো পার্বত্য অঞ্চলে, কখন�ো সমভূমির অনুভব, চিন্তা ও আচরণের পেছনে ক�োন�ো যুক্তি
জেলাগুল�োতে (সরকারি ভাষায় প্লেইন থাকে না। রেললাইনের সুউচ্চ পিলারের ওপর
ডিস্ট্রিক্ট)। মাসের পর মাস বাবার সাথে দেখা থেকে কিশ�োরদল নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কেন
হত�ো না আমাদের। কৈশ�োরে বাবার নৈকট্য পড়ছে? ওদের কি ভয় নেই? কিংবা তুরাগের
ছিল তাই সুদূর পরাহত। আমার কৈশ�োরজুড়ে দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা কাল�ো পানিতে ডুবসাঁতারে
বাবা ছিলেন একটি পরাবাস্তব জলছবির মত�ো; মাত�োয়ারা কিশ�োরের দল। বেলা গড়াচ্ছে,
যাকে নানারূপে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখে দেখে ওঠার নাম নেই? কেন করছে এমন? কেন তেল
চ�োখে ধাঁ ধাঁ লেগে যায়। বুঝে ওঠা যায় না, চিটচিটে কাল�ো পানির উৎকট দুর্গন্ধও তাদের
ব্যাখ্যা করা যায় না। সকল বিশ্লেষণের বাদেও থামাতে পারছে না? ক�োন�ো ব্যাখ্যা নেই। কিংবা
অবিশ্লেষিত রয়ে যায় অনেক কিছু। বিপরীতে, যা আছে তা বড়দের কাছে গ্রহণয�োগ্য না। তাই
বেদনা ও একাকিত্বের সবটুকু নীল বুকে চেপে বাবাকে দেখে কেন কুঁকড়ে গিয়েছিলাম সেদিন,
মা ছিলেন ব�োশেখের র�োদে শীতল ছায়াদার এই মাঝবয়েসে বসে মনে করতে পারছি না।
ফলবান বটবৃক্ষের মত�ো। শান্ত, নীরব ও ধীরে ধীরে বাবার কাছে গেলাম। সালাম দিলাম।
ভরসাস্থল। সাধ, আহ্লাদ, আবদার সবকিছু ছিল মুসাফাহা করলাম। সম্ভবত জীবনে প্রথমবার
তার জন্য সংরক্ষিত। অনাহূত জৈবনিক জ�োয়াল বাবার সাথে সেদিন মুসাফাহা করেছিলাম;
বইতে বইতে অবসাদে ক্লান্ত হয়ে গেলে এখনও অভ্যাসবশত হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। বাবা
ছুটে যাই মায়ের কাছে; ব্যথা-বেদনার ঝাঁপি মিষ্টি করে মুচকি হেসেছিলেন। বাবা সবসময়
খুলে বসতে। পরম আত্মবিশ্বাসের সাথে সান্ত্বনা মুচকি হাসেন। হাসির সাথে মিশে থাকে একরাশ
দিয়ে মা বলেন, চিন্তা করিস না। ত�োর মা আছে লাজনম্র অভিব্যক্তি। নবি করিম সাল্লাল্লাহু
না! হ্যাঁ, মা আছেন। আমার পুর�ো জীবনজুড়ে আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে যেমনটা আবু
আছেন। কখন�ো যেন এই বটবৃক্ষের ছায়া সাঈদ খুদরি (রা.) বলেছেন :
আমাকে এতিম বানিয়ে না যায়, রব্বে কারিমের
দরবারে এ-ই কামনা। “পর্দার অন্তরালের কুমারীদের চেয়েও নবীজি
সাল্লাল্লাহু লাইহি ওয়া সাল্লাম অধিক লজ্জাশীল
নাজেরার এক সহপাঠী জানিয়ে গেল, কেউ ছিলেন। যখন তিনি অপছন্দনীয় কিছু দেখতেন,
একজন দেখা করতে এসেছে আমার সাথে। আমরা তার চেহারা দেখেই তা বুঝতে পারতাম।”
বেরিয়ে দেখি আব্বা। ফুল হাতা শার্ট আর জিন্স (সহিহ ব�োখারি : ৬১০২)
পরনে। পায়ে কেডস। তখন�ো দাড়ি রাখেন

অক্টোবর ২০২৩ 21
মাদরাসায় ভর্তির পর এই প্রথমবার তিনি আমাকে নিয়ে বাজারে
গেলেন। বলিভদ্র বাজারে নিয়ে গেলেন মিষ্টি খাওয়াতে। আয়েশ
করে মিষ্টির দ�োকানে বসে প্রায় এক কেজি একাই সাবাড় করে
ফেললাম। বাবা অপলক চ�োখে হাভাতে পুত্রের গলধঃকরণ দেখে
হিফজখানার গেলেন। খাওয়া শেষে আমাকে মাদরাসায় প�ৌঁছে দিয়ে বাবা ফের
সম্মানিত চলে গেলেন অচেনা দূর ক�োন�ো শহরে। সেই যে গেলেন আর কখন�ো
উস্তায জিজ্ঞেস ছেলের মাদরাসায় তিনি আসেন নি। কিংবা আসতে পারেন নি। দৈব
আমাদের একত্রিত হতে দেয় নি।
করেছিলেন,
বাবা চলে যাওয়ার পর সহপাঠী একজন জানতে চেয়েছিল, উনি
ত�োমার বাবার কি ত�োমার বড় ভাই? আমি লজ্জায় কুণ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলাম। এক
মুখে দাড়ি নাই? অব্যক্ত বেদনা হৃদয় অলিন্দে সহসা জেঁকে বসল। দুঃখকর এই
সে রাতে সবাই অনুভব থেকে দীর্ঘ কয়েক বছর আমি বের�োতে পারি নি। এরপর
থেকে যতবার বাবাকে দেখতাম একটা অশ্রাব্য স্বর কর্ণকুহরে ফুঁ
ঘুমিয়ে পড়ার পর দেওয়ার মত�ো করে বলে উঠত, ত�োমার বড় ভাই নাকি?
একা একা নিরবে
সাহস জমিয়ে একদিন পুরাতন রপ্তানি গেটে চলে গেলাম। সেখানে
লিখতে বসলাম তখন প�োস্ট অফিস ছিল। চিঠি পাঠাবার হলদে খাম কিনে আনলাম
আব্বার কাছে ‍চিঠি। দু’টাকা দিয়ে। অতি গোপনে সকলের অগ�োচরে ‘হাতের লেখা’
কী কী লিখেছিলাম, খাতায় লিখে ফেললাম বাবাকে ঘিরে থাকা সবটুকু আবেগ, আহ্লাদ,
অভিয�োগ ও আকাঙ্ক্ষার কথা। আনাড়ি হাতে লেখা সেই চিঠিখানা
আজ আর মনে হলদে খামে ভরে জিভের জলে ডাক টিকিটের আঠা ভিজিয়ে মুখ
নেই। এতটুকু মনে আটকে দিলাম। ঠিকানা লিখে পাঠিয়ে দিলাম বাবার উদ্দেশে।
আছে, উত্তরে অতঃপর উত্তরের অপেক্ষায় প্রহর গড়াতে থাকল�ো নদীর তরঙ্গের
মত�ো। অতি ধীরে। কুলকুল করে। এ নদীর ক�োন�ো তাড়া নেই যেন।
আব্বা লিখেছিলেন, আমার অপেক্ষার প্রহর কাটে না। বাবার উত্তরও আসে না। এভাবে
ত�োমার সহপাঠীদের কত দিন, কত মাস অপেক্ষায় ছিলাম আজ আর মনে নেই; স্মৃতিতে
জানিয়ে দিয়�ো, দাগ কেটে আছে কেবল অপেক্ষার ব্যথাটুকু। স্মৃতিরা সব মুছে যায়,
আমার আব্বু এবার থেকে যায় ব্যথার দাগ।

অবশ্যই দাড়ি আজ অব্দি সেই চিঠির উত্তর আসেনি। আসবেও না কখন�ো।


প্রাপকের কাছে সেই চিঠি প�ৌঁছেনি বলেই আসবে না। একজন
রাখবেন।
অক্টোবর ২০২৩ 22
অস্থিরমতি কিশ�োরের বেদনাকীর্ণ আবেগমথিত উপমা, উৎপ্রেক্ষায় সজ্জিত চিঠিগুল�ো পাঠককে
পত্রটি অজানা ক�োন�ো প�োস্ট অফিসের চিঠি- ম�োহিত করে ফেলত। কেউ বিশ্বাস করতে চাইত�ো
বাক্সের ক�োণায় পড়ে থেকে নীরবে-নিভৃতে না, বার�ো-তের�োর এই কিশ�োরের হাতে রচিত
নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিংবা পাইকারি দরে হয়েছে এমন কাব্যিক গদ্য। নিজের জন্য লেখার
বিক্রি হয়ে গেছে কাগজবিক্রেতা মহাজনের উপলক্ষ তৈরি হয়েছিল বেশ কয়েক বছর পরে।
ন�োংরা আড়তে। কেউ হয়ত ঝালমুড়ি খাওয়া হিফজখানার সম্মানিত উস্তায (রাহিমাহুল্লাহ)
শেষে পায়ে দলে চলে গেছে সেই ছ�োট্ট চিরকুট। জিজ্ঞেস করেছিলেন, ত�োমার বাবার মুখে দাড়ি
এভাবে কত আবেগ, বেদনা, ভালবাসা কিংবা নাই? পুরন�ো ক্ষতে নতুন খ�োঁচা খেয়ে রক্তক্ষরণ
সুসংবাদ-দুঃসংবাদ প�োস্ট অফিসের অনীহায়, হতে লাগল�ো খুব। সে রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার
ডাকহরকরার অলসতায় চিরতরে ঘুমিয়ে গেছে, পর একা একা নিরবে লিখতে বসলাম আব্বার
নষ্ট হয়ে গেছে, পদদলিত হয়েছে তার ক�োন�ো কাছে ‍চিঠি। কী কী লিখেছিলাম, আজ আর
ইয়ত্তা নেই। প্রাপক জানতেই পারেনি তার জন্য মনে নেই। এতটুকু মনে আছে, উত্তরে আব্বা
একটা মানুষ কতটা উৎকণ্ঠিত, পীড়িত, আপ্লুত লিখেছিলেন, ত�োমার সহপাঠীদের জানিয়ে
ও অপেক্ষারত ছিল। কতটা ভালবাসা নিয়ে দিয়�ো, আমার আব্বু এবার অবশ্যই দাড়ি
কেউ একজন অপেক্ষা করছিল তার একটুকর�ো রাখবেন।
প্রীতিময় বাক্যের। আমাদের হৃদয়টাও ত�ো প�োস্ট সাত বছর বয়েসি আমার ছ�োট্ট মেয়েটি কচি
বক্সের মত�ো। কত শত আবেগ সেখানে জমতে হাতে লেখা প্রথম চিঠিতে ক�োনরকম ভুমিকা
থাকে প্রতিনিয়ত। সহস্র আকাঙ্ক্ষা, উদ্যোগ, ছাড়া মূল বক্তব্যে চলে গেছে। কেবল মূল বক্তব্যে
স্বপ্ন স্তুপ হতে থাকে হৃদমাঝারে। একদিন হুট না; প্রথম লাইনেই সে বলে ফেলেছে বক্তব্যের
করেই শুয়ে পড়তে হয় মাটির তলে সাড়ে তিন গভীরে ডুবে থাকা তার গাঢ় অনুভবের কথা।
হাত ঘরে। প্রিয়জনের ছুঁড়ে দেওয়া মাটির নিচে সে লিখেছে,
চাপা পড়ে যায় অব্যক্ত প্রেম, বেদনা, বিরহ,
আকাঙ্ক্ষা, লক্ষ্য, উদ্যোগ, স্বপ্ন, কল্পনা ও বাবা, তুমি চিরকালেও যদি শহিদ হয়ে যাও তবু
হাসি-কান্না। প্রিয় মানুষটি জানতে পারে না; ত�োমার দেখা আমি পাব�ো না।
মৃত ল�োকটার অনেক কিছু বলবার ছিল তাকে। খানিকটা দুর্বোধ্য গঠনরীতিতে সাজান�ো তার
ক�োনদিন জানতেও পারবে না, ল�োকটা তাকে এই বাক্যটি অনুভবের দীর্ঘ পথযাত্রার পর
অনেক ভালবাসত। ক্ষোভ ও নিরাশার সংশ্লেষে প্রগাঢ় বেদনা
এরপর অনেক চিঠি লিখেছি আমি; অপরের থেকে বুক ভেঙে উঠে আসা চাপা আর্তনাদ।
হয়ে। চিঠি লেখার হাত পাকা হয়ে গিয়েছিল প্রথম বাক্যে অনুয�োগ, ক্ষোভ ও নিরাশার
হিফজখানার সেই দুরন্ত কৈশ�োরে। নানারকম এমন অকপট উচ্চারণ থাকে না সাধারণত।

অক্টোবর ২০২৩ 23
বিবৃতির ধারাবাহিকতায় ক্ষোভের প্রকাশ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দেয় ব্যথার দহন। বাবাও
সীমান্ত অতিক্রম করলে এমন বাক্য উঠে আসে তাকে ভালবাসেন প্রচণ্ড। তার অভাবব�োধ
হৃদয়ের অতল জলধি থেকে। চ�োখের অশ্রু আর বাবাকেও পীড়িত করে মর্মে মর্মে।
কলমের কালি হয়ে ঝরতে থাকে জড়াজড়ি করে। আমি অবাক হয়ে যাই তার দ্বিতীয় লাইন পড়ে।
ব�োঝাই যায়, বাক্যটি লেখার আগে ক্ষোভ, জীবনে কখন�ো স্বজনত�োষক ছিলাম না আমি।
বেদনা, নিরাশা ও অভাবব�োধের যাতনা তাকে বরং স্বজন-সুহৃদের প্রতি রূঢ়তার দণ্ড কাঁধে
প�োড়াচ্ছিল খুব। বড়দের মত�ো সফল কপটতায় নিয়ে ফিরছি আজন্ম। ফলে, একমাত্র মেয়ের
কানুনের অনুবর্তী সেজে ধীরেসুস্থে একটা একটা লেখা বলেই মুগ্ধ হয়ে পড়ছি ভেবে নিজেকে
করে গ�োলাপের পাপড়ি ছেঁড়ার মত�ো নিয়ন্ত্রিত প্রবঞ্চিত করতে অন্তর সায় দেয় না। ম�োটেই
আবেগ প্রকাশ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। মুগ্ধ হয়ে পড়ছি না আমি; পড়ে মুগ্ধ ও চমৎকৃত
ক্ষোভ ও নিরাশা যখন মাত্রা অতিক্রম করেছে হয়ে যাচ্ছি। এইটুকুন মেয়ে, সবে সাতটি বর্ষ
এবং হৃদয়ের ব্যথাটুকু বলবার মত সঙ্গী যখন পা ছুঁয়েছে তার, ক্ষোভের আতিশয্যে কী সুন্দর
তার নেই সে ছুটে গেছে খাতা-কলমের কাছে। ব্যঙ্গ করে সে! বদনাম করাকে কটাক্ষ করে সে

বিলীয়মান স্মৃতিছবিগুল�ো আঙুলের মাথায় রেখে নিমীলিতপ্রায় দুচ�োখে


খুঁজতে থাকে বিস্মৃত অতীত। নিজেকে খুঁজতে গিয়ে আমি অব�োধ এক
কিশ�োরকে পাই। বাবাকে চিঠি পাঠাতে হলুদ খাম কিনে আনে সে। সরকারি
ম�োহরাঙ্কিত হলদে খামে একান্ত গ�োপনে লেখা বেদনার আখ্যান পুরে দিয়ে
ফিরতি হলদে খামের আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষমান থাকে যে কিশোর।
প্রথম বাক্যেই বলে দিয়েছে হৃদয়ের হাল। লেখে, ‘চারিদিকে সুনাম ছড়িয়ে দেবে আমার’।
‘বাবা, তুমি যদি শহিদ হয়েও যাও, আর হয়ত গেরাস্থালীয় না হলে পুর�ো বাক্যটাই তুলে
দেখা পাব�ো না আমি ত�োমার।’ তার লেখা প্রথম দেওয়া যেত। বাবার কষ্টকে অনুভব করে সে
বাক্যটিই বাবাকে আক্রান্ত করে। এক গভীর লেখে, ইশ, কী সময়কাল! ভাবি, এই বয়েসে
মর্মবেদনায় পুড়তে থাকেন তিনি। যেন শত ক্রোশ আমি কি লিখতে পারতাম? কিংবা লেখার চিন্তা
দূর থেকে অশ্রুত এক গান্ধার বিক্ষুদ্ধ বাতাসে কি মাথায় এসেছিল আমার?
চড়ে আচমকা এসে জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে। দ্বিতীয় চিঠিটা তার সম্পূর্ণ বাবাময়। বাবা নেই
প্রতিধ্বনিত হয় হৃদয়ের শিরা-উপশিরায় ব্যথার বলে তার মন ভাল�ো নেই। বাবা ছাড়া মানুষ কী
সারগাম হয়ে। অননুভূতপূর্ব বিষ-বাঁশরির সুর করে থাকে? কেমন থাকে? সে বুঝতে পারে
অক্টোবর ২০২৩ 24
না। এতটুকু সে ব�োঝে বাবা থাকলে ভাল হত�ো। বাবা তাকে অনেক বই
কিনে দিয়েছে। আরও অনেক বই কিনে দিত�ো। বাবার কীসে ভাল লাগে
এটা কেউ জানে না। আহারে, বাবার দুঃখ কেউ ব�োঝে না!
এইসব লেখা পড়ি আর নিজেকে খ�োঁজার চেষ্টা করি। মানুষের স্বভাব,
সবকিছুতেই সে নিজেকে খ�োঁজার পায়তারা করে। খুব আগ্রহ নিয়ে বন্ধু
তাকে সদ্য ঘটা অভিজ্ঞতা বলতে বসেছে, শুরু না হতেই বন্ধুর গল্পে
নিজেকে সেঁধিয়ে দিয়েছে সে। শ�োনাতে এসে এবার গালে হাত দিয়ে
খানিকটা বিরক্তি নিয়ে সেইসব আপাত-অরুচিকর কথাগুল�ো শুনে যেতে
হচ্ছে বন্ধুর। পড়তে বসেও সে হাতড়ে বেড়ায় অপসৃত গ�োল্লাছুটবেলা।
বিলীয়মান স্মৃতিছবিগুল�ো আঙুলের মাথায় রেখে নিমীলিতপ্রায় দুচ�োখে
খুঁজতে থাকে বিস্মৃত অতীত। নিজেকে খুঁজতে গিয়ে আমি অব�োধ
বাবা নেই বলে তার এক কিশ�োরকে পাই। বাবাকে চিঠি পাঠাতে হলুদ খাম কিনে আনে
মন ভাল�ো নেই। সে। সরকারি ম�োহরাঙ্কিত হলদে খামে একান্ত গ�োপনে লেখা বেদনার
বাবা ছাড়া মানুষ কী আখ্যান পুরে দিয়ে ফিরতি হলদে খামের আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষমান থাকে
করে থাকে? কেমন যে কিশোর। বিপরীতে, আমার ছ�োট্ট রাজকন্যা সবার অগ�োচরে ক্ষোভ
ও ব্যথার বাতাবরণ ‘হাতের লেখা’র খাতায় তুলে রাখে একান্তে। সবার
থাকে? সে বুঝতে দৃষ্টির আড়ালে গচ্ছিত রাখতে চায় লুকিয়ে। কেউ দেখে ফেললে ক্ষুব্ধ
পারে না। এতটুকু হয়। রেগে যায়। তার সাথে ঝগড়া করে। কান্নাকাটি করে। তপ্ত উষ্মায়
সে ব�োঝে বাবা হুমকি-ধমকি দেয়। সে চায় না কেউ এটা দেখুক। চায় না অপরের নজরে
থাকলে ভাল হত�ো। পড়ুক। সে জানে না, এখনও প�োস্ট অফিসে হলুদ খাম কিনতে পাওয়া
বাবা তাকে অনেক যায়। এখনও ডাক-টিকিট বিক্রি হয় সেখানে। এখনও হলুদ খামের গায়ে
থাকে সরকারি ম�োহর। থাকে জিভের জলে ভিজিয়ে লাগিয়ে দেওয়ার
বই কিনে দিয়েছে। মত�ো শুকন�ো আঠা। অতি প্রয়�োজনে এখনও কেউ কেউ হলদে খামে
আরও অনেক বই চিঠি পাঠায়। আরেকটু বড় হলে সেও পাঠাতে পারবে হলুদ খামে চিঠি।
কিনে দিত�ো। বাবার যদি বাবাকে তার মনে থাকে।
কীসে ভাল লাগে চিঠির জবাব দিইনি আমি। দিইনি কারণ, সে উত্তর পাওয়ার জন্য লেখেনি।
এটা কেউ জানে না। লিখেছে মনের কথা কাগজে গচ্ছিত রাখতে। কিংবা যে কথা কাউকে
আহারে, বাবার দুঃখ বলতে পারছে না কাগজ-কলমের কাছে সেই কথা বলে ফেলতে। খুব
কেউ ব�োঝে না! ভাল বন্ধু পেয়ে গেছে সে। নিষ্ঠাবান বিশ্বস্ত বন্ধু। কামনা করি, এই বন্ধুত্ব
টিকে থাকুক আমরণ। বাবার মত�ো কখন�ো যদি নিশুতি রাতে একাকি ঘরে
অক্টোবর ২০২৩ 25
নৈশব্দের শূন্যতা তাকে জ্বালাতন করে কাগজ- যাপনের নৈমিত্তিক গ্লানিতে পিষ্ট হতভাগার দল।
কলম যেন তাকে সঙ্গ দেয় তখন। পৃথিবীর যার জীবনে এই দুই ভরসাস্থল আছে, আত্মার
কাউকে যেসব কথা বলা যায় না, দু’টি জায়গায় উপশমের জন্য তার বদ্যির দরকার নেই।
সেসব বলে বেদনামুক্ত আর নির্ভার হওয়া যায়। আমার আটপ�ৌরে মন খেয়ালের বশে তবু
একজন সেই সত্তা যিনি সবকিছু শ�োনেন এবং আকাঙ্ক্ষা করে, একদিন হলদে খামে চড়ে তার
জানেন। যার কাছে হৃদয়ের ব্যথামালা বলতে দীর্ঘ হার্দিক মিথস্ক্রিয়া উড়ে আসবে আমার ছ�োট্ট
বলতে অশ্রুস্নান করে ওঠার পর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কামরায়। ত্রস্ত হাতে লেখা ভুমিকাহীন সেই
স�ৌভাগ্যবান মনে হয় নিজেকে। মনে হয় আর বাতাবরণের শুরুতে থাকবে, ‘বাবা, তুমি কাছে
কিচ্ছু দরকার নেই আমার; একান্ত অভিসারে নেই; আমার মন ভাল�ো নেই।’
আত্মার নির্বেদ বলবার মত বিশ্বস্ত তিনি ছাড়া
আর কে হতে পারে! তিনি সাত্তার। তিনি রউফ। নুরুযযামান নাহিদ
অসীম প্রেমময় পরম দয়ালু। ২৬-০৯-২০২৩ ইং
দ্বিতীয়, কাগজ-কলম। প্রাগৈতিহাসিক কাল জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম রূপগঞ্জ,
থেকে যাকে আশ্রয় করে বেঁচে আছে জীবন- নারায়াণগঞ্জ।

অক্টোবর ২০২৩ 26

ক�োন�ো এক কিশ�োরের অসমাপ্ত জীবনী


আ হ মা দ সা ব্বি র

এ ক গৃহত্যাগী কিশ�োর ঢাকা শহরে এসে বিপাকে পড়ে যায়৷ তার অবয়ব বিবর্ণ,
ফ্যাকাশে৷ দিনভর নির্ঘুম যাত্রাশেষে ট্রেনস্টেশনে প�ৌঁছে সে তার বর্তমান
গন্তব্য স্থির করে উঠতে পারে না৷ তার যাবার কথা সাঁয়ত্রিশ শায়েস্তা খান এভিন্যু৷
কিন্তু সে ঠিকানা মনে করতে পারে না৷ স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়াতেই তার চ�োখ
র�োদে পুড়ে জ্বলে ওঠে৷ ক’দিনের জমে যাওয়া ঘুম তাতে উবে যায় বটে, তবে যে
দুলুনি তাকে তাড়া করে ফিরছে সেই ট্রেনে চড়বার মুহূর্তটি থেকে তা কমে না কিছু;
বরং যেমন এক ঘ�োরলাগা মাদকতা এসে জাপ্টে ধরে চারপাশ থেকে৷ র�োদ কি নেশা
সৃষ্টি করে?

অক্টোবর ২০২৩ 27
স্টেশনের বাইরে পা ফেলে কিশ�োর৷ পাখির ফেলে ঠিকানা বিস্মৃত হয়, যে বিস্ফারিত চ�োখে
চ�োখে সব দেখতে থাকে৷ ভাবে—এটাই তবে খালি পায়ে হেঁটে যাওয়া তারই মতন একদল
রাজধানী; বাংলাদেশের ব্যস্ততম শহর! কালচে কিশ�োরের দেখা পেয়ে যায়, যে আলুথালু চুলের
মুখ�ো রিক্সাওয়ালাদের হাঁকডাক, হলদে রঙা মায়াবতী এক মা’কে দেখে ওঠে জ্যামে ড�োবা
ট্যক্সিড্রাইভারের প্রস্তাব, সবুজ সিএনজি রাস্তার পাশে ক�োমল শিশুর ঠ�োঁটে স্তন তুলে
চালকের সহজ প্রল�োভন সব ছুটে আসতে থাকে দিতে, যে এই রঙিন শহরের কাল�ো ছ�োপ ছ�োপ
কিশ�োরের উদ্দেশে৷ নিজেকে কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ রঙের মাঝে দলবদ্ধ প্রত্যেককে ভীষণ একলা
মনে হতে থাকে কিশ�োরের৷ তবে সে কারও একা দেখতে পায় তার মনে পড়ে যায়, সে
আহ্বানে সাড়া দিতে পারে না৷ ঠিকানাহীনতা নিজেও ভীষণ একলা। নিয়ন বাতির হলুদাভ
কিম্বা আশ্রয়হীনতা তাকে গুরুত্বপূর্ণ হতে হতেও ফ্যাকাশে আল�োর নিচে দাঁড়িয়ে কিশ�োরের মন
শেষ পর্যন্ত হতে দেয় না৷ সে পাংশু মুখে চেয়ে ড�োড�ো পাখির মত�ো হু হু করে ওঠে। কিশ�োরের
থাকে কেবল শূন্যে। আর রিক্সাওয়ালা, ট্যাক্সির তখন মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে
ড্রাইভার, সিএনজির চালক সবার সামনেই যায় প্রিয় বাইসাইকেলটার কথা। যে সাইকেলটা

পাখির চ�োখে সব দেখতে থাকে৷ ভাবে—এটাই তবে রাজধানী; বাংলাদেশের


ব্যস্ততম শহর! কালচে মুখ�ো রিক্সাওয়ালাদের হাঁকডাক, হলদে রঙা
ট্যক্সিড্রাইভারের প্রস্তাব, সবুজ সিএনজি চালকের সহজ প্রল�োভন সব ছুটে
আসতে থাকে কিশ�োরের উদ্দেশে৷ নিজেকে কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে থাকে
কিশ�োরের৷ তবে সে কারও আহ্বানে সাড়া দিতে পারে না৷

উদ�োম হয়ে পড়ে কিশ�োরের পরিচয়হীনতা৷ জলের দামে বেঁচে কিশ�োর ঢাকাগামী ট্রেনের
তাকে ছেড়ে তারা ছুটে যায় অন্যত্র৷ ক�োন�ো নাম টিকেট কিনেছে। ট্রেনের দুলুনির মত�োই
গ�োত্র পরিচয়ওয়ালার উদ্দেশে৷ আর কিশ�োর কিশ�োরের চারপাশ দুলে ওঠে।
স্টেশনের বাইরের উন্মুক্ত খ�োলা চত্বরে দাঁড়িয়েই দণ্ডায়মান ঝিমুনির ভেতর কিশ�োরের স্মৃতিপটে
থাকে; মনের মধ্যে এনে হাজির করতে আপ্রাণ হাজির হয় তার পিতা। মমতাময়ী মা। নতুন
চেষ্টা করে একটা ঠিকানা; একটা আশ্রয়৷ কিন্তু জীবনের পথে পা বাড়াবে বলে কিশ�োর ছেড়ে
কিশ�োরের কাছে তখনও অজানা—এ শহরে এসেছে যাদের সংশ্রব-সান্নিধ্য।
অজস্র মানুশ ভুগছে আশ্রয়শূন্যতায়৷
ঢাকা শহরের তুমুল ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও
সেদিনের সেই কিশ�োর, যে স্টেশনের বাইরে পা কিশ�োর নিজেকে নীরবতার ভেতর আবিষ্কার

অক্টোবর ২০২৩ 28
করে। ভেতরের শূন্যতা বাইরে এসে তার চারপাশ জড়িয়ে ধরে।
কিশ�োরের তখন ভীষণ শীত শীত অনুভূত হতে থাকে। বুকের বাঁ পাশে
শীত কাতরতা নিয়ে কিশ�োর ধীরে পা বাড়ায় তার পরিকল্পিত গন্তব্য
সাঁত্রিশ শায়েস্তা খান এভিন্যুয়’র দিকে।
ঢাকার সড়কে হেঁটে যেতে যেতে কিশ�োরের মনে পড়ে বহুদূর খুলনার
গগণ বাবু সড়কের কথা। যে সড়কে অবস্থিত নামী এক স্কুলের পাশ
দিয়ে সে প্রত্যহ অতিক্রম করত�ো। সেখানে তার সাথে দেখা হয়ে যেত�ো
উদ্বিগ্ন একদল অভিভাবকের সাথে। কিশ�োরের ভেতরটা ম�োচড় দিয়ে
উঠত�ো। কখনও কখনও অজান্তেই ভিজে উঠত�ো চ�োখের ক�োণ। আর
তখন কিশ�োরের মনে পড়ে যেত�ো, জীবনের ক�োন�ো বিদ্যানিকেতনেই,
যত ধরণের বিদ্যাপীঠেই সে পড়েছে, ক�োন�ো উপলক্ষেই ক�োন�ো
অভিভাবকের উপস্থিতি সে তার পাশে পায়নি।
খুব ছ�োট�োবেলায় কিশ�োর যখন স�োলায়মান নগর এবতেদায়ী
মাদরাসাতে ভর্তি হয়, বন্ধুদের দেখে, তারা কাঁধে বাহারি ব্যাগ ঝুলিয়ে,
হাতে সুদৃশ্য ওয়াটার পট নাচিয়ে নাচিয়ে মাদরাসায় এসে ঢ�োকে।
কিশ�োর বারান্দার ও প্রান্তে দাঁড়িয়ে দূর থেকে অভিভাবকদের হাত
ধরে বন্ধুদের প্রাণ�োচ্ছল প্রবেশ এবং অতঃপর ছুটি শেষে প্রত্যাবর্তনের
দৃশ্য দেখে। আক্ষেপে গলে যায়। হয়ত�োবা বেদনায় মুষড়ে পড়ে। নিজের
পাশে পিতা কিংবা মাকে কল্পনা করে। কিন্তু কারুরই বাস্তবিক উপস্থিতি
সে পাংশু মুখে চেয়ে কিশ�োর টের পায় না।
থাকে কেবল শূন্যে। এরপর পাইকগাছার ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়, দারুল উলুম কিংবা
আর রিক্সাওয়ালা, খাদেমুল ইসলাম মাদরাসার ঘ�োলাটে প্রাঙ্গন কি সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের
জনবহুল প্রান্তর ক�োথাও একান্ত আপন কার�ো স্পর্শ সে অনুভব করে
ট্যাক্সির ড্রাইভার,
না। বিদ্যানিকেতনের র�োদতপ্ত মাঠের ভেতর একা দাঁড়িয়ে থাকে
সিএনজির চালক কিশ�োর। হাঁটে, দ�ৌঁড়ায়, ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে। ক�োথাও চেনা বৃক্ষের
সবার সামনেই ছায়া সে দেখে না।
উদ�োম হয়ে অথচ সব কটা সাবজেক্টে লেটার মার্ক পাওয়া আমাদের এই কিশ�োর
পড়ে কিশ�োরের হেড স্যারের রুমে, মাদরাসার মুহতামিম সাহেবের সামনে বুক ফুলিয়ে
পরিচয়হীনতা৷ দাঁড়িয়ে থাকে। অভিভাবকের দস্তখতটা করবার মত�োন ক�োন�ো
অক্টোবর ২০২৩ 29
অস্তিত্বের আন্দোলন কিশ�োর দেখে ওঠে না। নিয়ে প্রান্তরজুড়ে হাঁটতে থাকে। কার যেন
গৃহত্যাগী ঐ কিশ�োর, ক্লান্ত কিশ�োর, ঘর অপেক্ষায় থাকে কিশ�োর। কিশ�োর জানে না।
পালান�ো কিশ�োর বহুদূর হেঁটে এসে, ঘ�োলাটে যেমন আমাদের এই কিশ�োর তখনও জানে না
অন্ধকার পেরিয়ে অবশেষে, সাঁয়ত্রিশ শায়েস্তা জীবনের গতিপথ আমূল বদলে দেবার মত�ো
খান এভিন্যু’র সামনে এসে দাঁড়ায়। ল�োহার এক ভ�োর রয়েছে তার অপেক্ষায়।
গেট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে প্রবেশ দিনাজপুর
করতেই কিশ�োরের সামনে আল�োয় ভরা এক
প্রান্তর উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। হঠাৎ আল�োর ২২.০৯.২০২৩
ঝলকানি কিশ�োরকে চমকিত করে দেয়। খানিক ahmedsabbir7422@gmail.com
ভীতও। এবারে সে ভয় ও চমক মেশান�ো অবয়ব

অক্টোবর ২০২৩ 30
অজস্র প্রশ্নের দিকে তাকিয়ে
আ ল ম গী র মু র তা জা
তরতরে গদ্যের মত�ো স্বগতিতে জীবন এগিয়ে যাচ্ছে। কতদূর কখন এগ�োল, টের পাওয়া
যাচ্ছে না, টের পেতে না পেতেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। এমন অদ্ভুত ঘ�োরেই কেটে যাচ্ছে একটা
জীবন, অবলীলায়।
জীবনের এই চলন্ত ট্রেনের স্টেশন বুঝি মৃত্যু; যে স্টেশনজুড়ে থাকে কেবল মৃত্যুপথযাত্রীটির
অসহায় বিচরণ, অন্য ক�োন�ো মানুষের চিহ্নটি মাত্র নেই। কিন্তু, জীবনের এই যে মৃত্যু, তা
কি শুধু একবারই ঘটে? শৈশবের মেঠ�োপথে অকারণ হাঁটতে হাঁটতে কিংবা কার্তিকের
শুকন�ো বিলে শুকিয়ে চিমসে যাওয়া একটা কচুরিপানা এবং পাশেই অন্য একটা কচুরির
শুকন�ো ডাঁটার ভেতর থেকে ডগমগিয়ে বেরিয়ে আসা নতুন ক�োন�ো ডগা দেখে আপনার
কি মনে হতে পারে না—জীবনের মৃত্যু বুঝি নিয়তই ঘটছে, জীবন প্রতিপদেই আলিঙ্গন
করছে মৃত্যুকে? মৃত্যুর ভেতর থেকে ফের জেগে উঠছে জীবন? ভেঙে শুকিয়ে যাওয়া
ক�োন�ো উদ্ভিদের ভেতর থেকেও মৃদু উঁকি দিচ্ছে নবাঙ্কুর? সাময়িক মৃত্যুর পর পুনরায়
বুঝে নিচ্ছে দিনরাত্রি র�োদ-বৃষ্টি-ঝড়ে প্রকৃতির মাঝে বুক টান করে দাঁড়িয়ে থাকবার
অক্টোবর ২০২৩ 31
পূর্ব কর্মযজ্ঞ? ফিরে পাচ্ছে জীবন, পূরণ করছে ভাল�ো-মন্দের স্বাধীনতা? পুনরুজ্জীবিত প্রকৃতি
কিছুকাল প্রকৃতিতে অনুপস্থিতির শূন্যতা? যেরকম শূন্যতা পূরণে ব্রতী হয়ে উঠছে, আমরা
কি পারব তা?
কিন্তু, চৈতন্যের নিস্তব্ধ জানালায় উঁকি দিয়ে
দেখুন—এরচেয়েও নিবিড়ভাবে প্রতিনিয়ত কিংবা জীবনকে যদি ভাবি একটি পর্বত এবং
মৃত্যু ঘটে চলেছে আমাদের। দু-তিন মিনিট আমরা সেই পর্বতের আর�োহী, সেই পর্বতের
আগে যে আপনিটি ছিলেন, দু-তিন মিনিট পর চূড়া কি তবে মৃত্যু? আমরা ত�ো চূড়ায় প�ৌঁছতে
সে আপনিটি আর থাকছেন না, নতুন এক অব্যাহত রাখছি আর�োহণ ৷ প�ৌঁছে যাওয়ার পর
আপনি হয়ে জেগে উঠছেন, সময়ের থাবায় নেমে আসবার ক�োন�ো পথ কি থাকবে আর?
যেন খ�োলস বদলাচ্ছেন প্রতি মুহূর্তে, প্রতিবার। একমাত্র পরিণতি ত�ো গহীন মৃত্যু-গহ্বর৷
একটুক্ষণ আগের আপনাকে আর কিছুতেই ছুঁতে নিজেকে তাই বলি—জীবনের হিসেব-খাতায়
পারছেন না আপনি। শৈশবে যে আপনি ভ�োরের কেবল সৎকর্মই যেন উৎকীর্ণ হয় ত�োমার৷ বাঁকে
নবীন আল�োয় কায়দা হাতে টুকটুক করে হেঁটে বাঁকে রেখে যাওয়া কৃতকর্মের খেসারত দিতে
যেতেন মক্তবে, যে আপনি দুদ্দাড় ছুটে যেতেন দিতেই যেন পুড়তে না হয় অনন্তকাল। তখন যে
খেলার মাঠে, অকারণ দীর্ঘক্ষণ ছুটে বেড়াতেন থাকবে না আর সংশ�োধনের অধিকার!
সারা মেঠ�োপথ, কল্পনায় দেখুন—কবেই তার
মৃত্যু ঘটে গেছে। ত্রিভুবন খুঁজলেও আর ফিরে বেলা ব’য়ে যায়!
পাবেন না তাকে। গ�োধূলির মেঘ-সীমানায়
ধূম্র ম�ৌন সাঁঝে
প্রকৃতির ক�োন�ো ক�োন�ো উদ্ভিদ মৃত্যুর পর ফিরে
নিত্য নব দিবসের মৃত্যুঘণ্টা বাজে।
পাচ্ছে নবজীবন এবং কর্মের স্বাধীনতা। কিন্তু,
- জীবনানন্দ দাশ
আমি-আপনি প্রতিনিয়ত একটু একটু করে মরে
যেতে যেতে যখন বেজে যাবে চূড়ান্ত মৃত্যুঘণ্টা, ২৪.৯.২৩
তখন কি আর ফিরে পাব কর্মের অধিকার?

অক্টোবর ২০২৩ 32
গ্রাম-শহর-অভিবাসন
ই ফ তে খা র জা মি ল

বি দেশে আসলে আপনি অনেক কিছুই মিস করবেন। মিস করবেন বৃষ্টি, মিস করবেন
আড়িয়ালবিল—জলের আদিম আহবান। মিস করবেন মেঘলা দুপুর, মিস করবেন
মাচায় শুয়ে থাকার স্মৃতিগুল�ো। আপনার মনে হবে উপন্যাসের প্রিয় লাইনগুল�ো—
‘Some infinities are bigger than other infinities. … There are days,
many of them, when I resent the size of my unbounded set. I want
more numbers than I’m likely to get, and God, I want more numbers.
অক্টোবর ২০২৩ 33
But, I cannot tell you how thankful I মাঝে মাঝে আমার মনে পড়ে সেই ছ�োটবেলার
am for in our little infinity. I wouldn’t কথা, সেখানে, মানে গ্রামেই ত�ো কেটেছে
trade it for the world. You gave me শৈশবের প্রথম কয়েকটা বছর।
a forever within the numbered days, যেদিন স্থায়ীভাবে ঢাকা চলে আসি—সময়টা
and I’m grateful.’ হয়ত�ো দুপুরের কাছাকাছি, আমি বাহিরবাড়িতে
এখন, এখানে বিদেশবাড়িতে শহরেই থাকতে খেলায় মেতে আছি। গরুর পিঠে কয়েকটা ডাঁশ
হয়—থাকতে হয় এক চিরন্তন প্যারাডক্সের মাছি উড়ছে, আমি ছুটছি ওদের পেছনে পেছনে,
ভেতরে : ভাবি, কবে যাব�ো দেশে, ক্যালেন্ডারে ইতিমধ্যে কে একজন আমাকে ধরে নিয়ে গেল
গুণতে থাকি দিন, কবে যাব�ো পুরান ঢাকার ভেতরবাড়িতে। সবাই প্রস্তুত, আমরা স্থায়ীভাবে
অলিতে-গলিতে! ভাবি, গ্রামের কথাও; ঢাকা চলে যাচ্ছি । যদিও এখন�ো সবখানেই
ফুলবাড়িয়া, ময়মনসিংহ। প্রবাসীরা দেশে গ্রামের ঠিকানাটাই আমার স্থায়ী নিবাস, শহরের

আমার হিসাব গুলিয়ে যেতে থাকে, ফিরে যাই আদিম বিভ্রমে—গ্রাম,


শহর, প্রবাস—আমি মনে মনে বলি, দেয়ালের ওপারটাই সবচেয়ে
সুন্দর।

ফিরতে চায়, শহরের মানুষ গ্রামের মুগ্ধতা অবস্থানটা অস্থায়ী, তবে আমরা সবাই জানি,
কাটাতে পারে না, গ্রামের ল�োকেরা শহরে কবে এই তথ্যটি সত্য নয়, আমরা আর কখন�ো গ্রামে
যাবে সেই অপেক্ষায় থাকে, লাখ লাখ টাকা ফিরে যেতে পারব�ো না। আম্মা আমাকে ক�োলে
খরচ করে আসতে চায় বিদেশে—জীবন আটকে তুলে নিয়ে বললেন—দিনগুল�োর কথা মনে
থাকে অদ্ভুত এক চক্রে। পড়ে আবছা আবছা—‘আব্বু, আমরা ঢাকা
আমরা প্রত্যেকেই মনে করি, দেয়ালের ওপারটাই যাব�ো, ঢাকা গিয়ে ডাশ মাছি ধরে দেব ত�োমাকে।
বুঝি সবচে’ সুন্দর। আমাদের মধ্যে তৈরি হয় আমার কান্না তবু থামছিল�ো না, ‘আমারে গরুর
আকাঙ্ক্ষা; অবশ্য হয়ত�ো এই অপেক্ষাতেই বশা দে, আমারে গরুর বশা দে….’।
জীবনের স�ৌন্দর্য লুকায়িত, অপেক্ষা কেটে পরে আমি কীভাবে শান্ত হয়েছিলাম, সেটা আর
গেলে কেন বেঁচে থাকবে মানুষ? অর্থহীনতার এখন মনে করতে পারি না। চ�োখ বন্ধ করে
চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছুই হয় না। ভাবতে চেষ্টা করি, কল্পনায় বসি সেই শিশুটির

অক্টোবর ২০২৩ 34
পাশে, তার মাথায় হাত বুলাতে পারি না, মনে হয় মাথাটা ক�োথাও যেন
মিলিয়ে গেছে। ওকে আর ছুঁতেও পারি না, শুধু দূর থেকে করতে পারি
আকাঙ্ক্ষা, হয়ত�ো অপেক্ষাও। এই বড়বেলায় আমি জানি, ঢাকা শহরে
ডাশ মাছি পাওয়া যাবে না। মা আমাকে সত্য বলেননি। সত্য বললে কি
আমি বুঝতাম, আমাকে কি সত্য বলা যেত�ো?
মা কি আমাকে ব�োঝাতে পারতেন, শহরে না গেলে আমাদের পড়াশ�োনা
হবে না, চেনাজন থাকবে না, ফুটবে না চ�োখ, আমরা আটকে থাকব�ো
এক অদৃশ্য দেয়ালের মধ্যে? চরেবন্দ, উত্তরের নালা, কবিরের বাড়ি,
বেহিবিল—সেই রূপকথার জগত, এসবেই আবদ্ধ থাকবে আমার পূর্ব-
পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ। জগত চিনতে আমাকে ছাড়তে হবে শৈশব, ছাড়তে
হবে পবিত্র ভ�োরবেলা, কুয়াশা জমা কচুপাতা, অজান্তে ডেকে ওঠা বউ
কথা কও পাখির নীরব আহ্বান? ঢাকায় আমি ক�োথায় পাব�ো বাংলার
আদিবাসি শিয়ালমতি গাছের আঁশটে ঘ্রাণ?
2.
অভিবাসন মানুষের জীবন থেকে অনেককিছুই কেড়ে নেয়। কেড়ে নেয়
পরিচয়-পরিচিতি-কল্পনা : গ্রাম থেকে শহরে চলে আসাকে অনেকেই
হয়ত�ো ছ�োট করে দেখবেন, তবে এই অভিবাসনটাও সাধারণ কিছু নয়।
গ্রামে আমার বন্ধুর অভাব ছিল না, চাচাত�ো ভাইরা ত�ো ছিলই, পাড়াত�ো
ছেলেদের সংখ্যাও ছিল অনেক। ঢাকায় এলাকার ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব
পাতাতে পারিনি। স্কুল ছেড়ে মাদরাসায় ভর্তি হলাম, স্কুলের পরিচিতরাও
হারিয়ে গেল�ো।আলামিন-তামান্নারা এখন ক�োথায় আছে কে জানে।
অবশ্য আমি কখন�ো একাকীত্বে ভুগিনি; বাসার পাশেই মাদরাসা, মাদরাসার
সহপাঠীরা শূন্যতাটা পূরণ করেছিল�ো। তবে ওরাও ত�ো এলাকার স্থায়ী
কেউ নয়। ফলে মনে হয়, ঢাকার সাথে সম্পর্কটা কখন�োই গভীর হল�ো
না। ঢাকাইয়াদের সাথে মেশার সুয�োগ ছিল সীমিত, পাশাপাশি ওদের
সংস্কৃতিতে ঢুকতে হলে ওদের মত�ো হতে হবে, মনস্তাত্ত্বিকভাবে সেটা
কখন�ো মেনে নিতে পারিনি। ওরা আমাদেরকে কিছুটা খাট�ো চ�োখে
দেখত�ো, মুখে না বললেও ভাবনাটা ধরতে কষ্ট হত�ো না। কেন হব�ো
ওদের মত�ো, আমার অহংব�োধ টনটন করে উঠত।
অক্টোবর ২০২৩ 35
পুরান ঢাকায় প্রধানত দু’টি সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে শেষদিকে বৃহত্তর প্রমিত সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ
জনপ্রিয়; স�োব্বাসি, কুট্টি। স�োব্বাসিরাই মূলত বাড়তে থাকে—প্রধানত রাজনৈতিক কারণেই
ঢাকার আদিবাসী, তারা প্রধানত ফার্সি-আরবি বলা যায়, স�োব্বাসি-কুট্টিদের থেকে নিজের
মিশ্রিত ভাষায় কথা বলেন, তাদের ভাষাকে জীবনকে অনেক বড় মনে হতে থাকে।
বলা হয় ঢাকাইয়া উর্দু বা স�োব্বাসি উর্দু। বৃহত্তর জীবনচক্রের অনুসন্ধানে আমি কখন�োই
বনেদী-ধার্মিক পরিবারগুল�োতে এই সংস্কৃতির পুরান ঢাকার অধিবাসী হতে পারলাম না। এখন,
জনপ্রিয়তা বেশী। কুট্টিরা ঢাকায় এসেছে ব্রিটিশ পুরান ঢাকায় আমাদের নিজস্ব মালিকানাধীন
আমলে, প্রধানত বণিক ও শ্রমিক হিসেবে। বাসা আছে, তবে এখানে আমাদের ক�োন
তারা স�োব্বাসিদের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ‘পরিচয়’ নেই, সম্পর্ক আছে অনেকের সাথেই,
প্রভাবিত হলেও ঢাকাইয়া উর্দুতে অভ্যস্ত নন। ‘বংশীয় নিজস্বতা-আত্মীয়তা’ পাব�ো ক�োথায়?
অবশ্য কুট্টি ভাষাকে বলা যায় আঞ্চলিক বাংলা-
স�োব্বাসি উর্দুর মিলিত রূপ। কুট্টিদের মধ্যে ৩.
অর্থসম্পদের অহংকার অনেক বেশী, তাদের আপনার মনে হতে পারে, আত্মীয়তা-নিজস্বতার
মধ্যে আধুনিকতাও সংক্রমিত হয়েছে দ্রুত। প্রয়�োজন ক�োথায়? এই আছি বেঁচে আছি এই
স�োব্বাসিরা অনেক বেশী আত্মমুখী—তাদের ঢের—টিকে থাকতে সামাজিক সম্পর্কই যথেষ্ট,
পরিবারে সহজে ঢ�োকা যাবে না। কুট্টিদের কৃত্তিম নিজস্ব আত্মীয়তা-সংস্কৃতির দরকারটাই কী?
আভিজাত্য হজম করাও খানিকটা কঠিন।
ময়মনসিংহের ভাষা শুনলেই আমার মনটা
অবশ্য আমার কথাও হয়ত�ো পুর�োপুরি ঠিক কেমন করে ওঠে। আমার নানাবাড়ি কুমিল্লা
নয়। আমাদের শিক্ষকদের কেউ কেউ স�োব্বাসি সদরে, সেখানকার ভাষাও আমাকে অনেক
সংস্কৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। বেশী টানে। অবশ্য কিছুটা লজ্জার সাথেই বলি,
আমার বাবাও স�োব্বাসি ভাষা বলতে পারেন। আমি অনর্গলভাবে দাদা বা নানাবাড়ির উচ্চারণ-
আমি এসব সংস্কৃতি-সম্পর্কের প্রতি যথেষ্ট শব্দ ব্যবহার করতে পারি না। সেই আড়াই বছর
মনয�োগী ছিলাম না কখন�োই। আমি তারাবি বয়সে চলে আসলাম ঢাকায়, সম্পর্কের সুত�োটা
পড়াতাম এক স�োব্বাসি এলাকায়। নামাজ শেষে হালকা হয়ে গেল। আমার ভাতিজা-সন্তানরা
মুসল্লিরা ঢাকাইয়া উর্দুতে কথা বলত, আমার ক�োন ভাষা শিখবে—প্রমিত বাংলা থাকবে
সাথে আন্তরিকতাই দেখাত। তবে রমজান পাঠ্যক্রমে, স�োব্বাসি-কুট্টি ভাষায় অভ্যস্ত হতে
শেষ হলে আমি আর সেই এলাকায় যেতাম পারবে বলে মনে হয় না। ওরা একইসাথে
না। আভিজাত্য-অহংকারের কথা যতই বলি, ভুগবে পরিচয়হীনতায়, হীনমন্যতায়। দেখুন,
আমি নিজের দ�োষ অস্বীকার করি কীভাবে? ভাষা মানে নিছক শব্দ-বাক্যের সমষ্টি নয়,
আমি আটকে ছিলাম মাদরাসার জগতেই, ভাষা মানে স্থানীয় ইতিহাস, বংশীয় সিলসিলা,

অক্টোবর ২০২৩ 36
আত্মীয়তা—আপনি কি প্রমিত বাংলায় বাসার খাবার টেবিলে কথা
বলতে পারবেন, তাহলে আমাদের সন্তানরা ঠিক ক�োন একসেন্টে
নিজেদেরকে কল্পনা করবে?
গ্রামে প্রতি ঈদে নির্দিষ্ট ধরণের পিঠা বানান�ো হয়। মাশকালাই রান্না
করা হয় কয়েকভাবে, চ্যাপা শুঁটকির পদগুল�োও বংশপরিক্রমায়
শিখতে হয়—লবণ-মরিচ পরিমাণমত না হলে ভারী বিপদ। এগুল�ো
নিছক মা-ব�োনদের কাছ থেকে শেখা যায় না। ঈদকেন্দ্রিক পিঠাগুল�ো
বানান�ো হয় পাড়ার সব বাড়িতে, মেয়েরা শেখে চাচাত�ো ব�োনদের
কাছ থেকে, পাড়ার কাকি-ফুফুদের কাছ থেকেও। শহরে মা ছাড়া কেউ
মা কি আমাকে নেই, মাও ঠিক নিজ গ্রামের নয়, তিনিও হয়ত�ো সবকিছু সমানভাবে
ব�োঝাতে পারতেন, বানাতে জানেন না, জানলেও আগ্রহব�োধ করেন না। এভাবে হারিয়ে
শহরে না গেলে যায় নিজস্বতা—যে আওলাকিশি পিঠা চলে এসেছে শত শত বছর
থেকে, আপনার সন্তানরা সেটা খাবে না কখন�ো—এগুল�ো ভাবলে
আমাদের পড়াশ�োনা
আমার মনটা কেমন করে ওঠে।
হবে না, চেনাজন
খাবারকেও হালকাভাবে দেখার সুয�োগ নেই। খাবার সভ্যতা-সংস্কৃতির
থাকবে না, ফুটবে
গুরুত্বপূর্ণ অংশ—ম�োঘল সম্রাট বাবর হিন্দুস্থানীদের তাচ্ছিল্য
না চ�োখ, আমরা করেছিলেন, ত�োমরা দেখি খাবারটাও ঠিকমত খেতে জান�ো না, যুদ্ধে
আটকে থাকব�ো এক পারবে কীভাবে? ঢাকায় আপনাকে মহল্লার হ�োটেলের খাবার খেতে
অদৃশ্য দেয়ালের হবে, হয়ত�ো মাঝেমাঝে রেস্টুরেন্টে ফাস্টফুডস খেয়ে আসলেন।
মধ্যে? চরেবন্দ, এগুল�ো সবই অস্বাস্থ্যকর, অনেক খরুচে আইটেম। সবচে’ বড় কথা,
এভাবে আপনি আপনার খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে পারেন না।
উত্তরের নালা,
আপনি ছেড়ে যেতে পারেন না আপনার অতীতকে, আপনার দাদি-
কবিরের বাড়ি, কাকিরা যেসব খাবার বানাত যত্ন করে, এখানে কত গল্প-কাহিনী
বেহিবিল—সেই আছে—আপনি সেসব গল্প-কাহিনী ভুলতে পারেন না। মরিচের পিঠা
রূপকথার জগত, বসান�ো হত নবান্নের পরে। ঘরে ধান ওঠলে ঢেঁকিতে চাল কুটে বসান�ো
এসবেই আবদ্ধ হত পিঠা। তাপ চলত ওপর-নীচ উভয় দিক থেকেই, মুড়ে দেওয়া হত
কলাপাতা দিয়ে। কি অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণ বের হত—আমরা গ�োল হয়ে
থাকবে আমার
বসে থাকতাম চারদিকে। থেকে যাওয়া পিঠা পরদিন কুটা হত ছ�োট
পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর- ছ�োট করে, ডিম দিয়ে ভাজা হত—অদ্ভুত ছিল সেসব দিনগুল�ো।
দক্ষিণ।
অক্টোবর ২০২৩ 37
ভাষা-খাবারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বংশীয় ইতিহাস, পুরান ঢাকার অলিগলি, বিকেলে বুড়িগঙ্গা ধরে
য�ৌথপরিবারের বন্ধন। আমার দাদা পড়েছেন চলে যাব আটিবাজার।
দেওবন্দে, পরদাদাও তাই। ব্রিটিশ প্রশাসনের অবুঝ জামিলকে কে ব�োঝাবে, ফিরে যাওয়াটা
সাথে তাদের লেগে থাকত�ো ঠুকাঠুকি, তারা ম�োটেই সহজ নয়!
কর দিতে অস্বীকার করতেন, ‘ফত�োয়া’ দিয়ে
জনতাকেও নিজেদের সাথে নিতেন। অবশ্য ৪.
বেশীরভাগই কুলিয়ে উঠতে পারতেন না। আমরা, এখানে মালায়েশিয়ায়, প্রতিশুক্রবার
জমিদাররা পাঠাত লেঠেল, তারা পালিয়ে যেতে ভারী খাবার খাই। হয়ত�ো আফগানি কাবুলি
বাধ্য হতেন। পরদাদার পরদাদা ছিলেন এক প�োলাও, অথবা ইয়েমেনি ল্যাম্ব-মেন্দি রাইস,
রহস্যপুরুষ, এলাকায় তিনিই প্রথম মসজিদ কখন�ো আফ্রিকান চিকেন ফ্রাই। আমরা বলতে
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিন-চারজন, সবাই প্রবাসী বাংলাদেশি। মাঝে
ল�োকমুখে চালু আছে আমাদের এই পূর্বপুরুষ মাঝে দেশের গল্প করি, স্মৃতিতে হেসে উঠি,
ল�োকদের ‘কামলা’ হিসেবে নিয়ে নামাজ- আগের যুগের ক্রিকেটারদের মধ্যে প্রতিতুলনা
র�োজা শেখাতেন। সেখান থেকেই আজকে করি। অবশ্য কেবল আমি ছাড়া তারা কেউই
আমরা ‘হুজুর ফ্যামিলি’—মাঝে মাঝে চ�োখ বন্ধ দেশে ফিরতে চায় না, একজন বিয়ে করেছে
করে ভাবতে চেষ্টা করি পরদাদার দ�োয়া-বরকত মালয়েশিয়ান, বাকিরাও খুঁজছে আন্তর্জাতিক
ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদেরকেও। ঢাকায় এসে আমরা পাত্রী। তারা নিরাপত্তার কথা বলে, একাডেমিক-
হারিয়েছি কবরগুল�ো। বাবা নিয়মিত গ্রামে যান, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যুক্তি দেখায়—আমি তাদের
সংস্কার করেন কবরস্থান। যদিও সম্পর্কের যুক্তির প্রতিউত্তর দিতে পারি না। এখানে, প্রায়
গভীরতা কমছে দ্রুতই, আমাদের পারিবারিক প্রতিরাতে হাঁটতে বের হই। বিকেলে বসে থাকি
কাঁচারি ঘরটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাড়িতে মানুষ পাহাড়ি ঝিরির পাশে। ঢাকায় ক�োথায় পাব�ো
নেই, মেহমানদের ঘর টিকে থাকবে কতদিন? এমন প্রকৃতি-নিবাস?
যেদিন প্রথম মালয়েশিয়ায় আসি—পরিবারের শ�োভন কায়সার ভাই খ�োঁচা দিতে চেষ্টা করেন,
সবাই বিমানবন্দরে এসেছিলেন, বাবা-মা- তার মতে অতিরিক্ত গ্রাম-দেশপ্রীতি হিন্দুয়ানি
ভাই-ব�োন-ভাগিনা-ভাতিজারাও। ব�োনজামাই সংস্কৃতির প্রভাব, মক্কার কুরাইশিরাও আটকে
পরদিন ফেসবুকে লিখলেন, এক তরুণ স্বেচ্ছায় ছিল এমন নিজস্বগণ্ডিতে। ইসলাম এসে তাদের
দেশ ছেড়ে যাচ্ছে, অথচ দেশকে তার দেবার মুক্ত করল�ো, তাদের নিয়ে গেল দেশে দেশে—
ছিল অনেক কিছুই। আমি তার কথার গভীরতাটা কাজেই ইসলাম মানেই আন্তর্জাতিকতাবাদ।
বুঝিনি অনেকদিন। মনে হয়েছিল, পড়াশ�োনা আমি বলি, আবু বকর মদিনায় থেকেও মক্কার
শেষ হ�োক, ফিরে যাব সেই আগের জায়গায়— কথা ভাবতেন, দেশের ভাল�োবাসায় আচ্ছন্ন
অক্টোবর ২০২৩ 38
থাকত�ো তাদের মন, দূরদেশে সাহাবিরা মনে প্রিমিয়াম কফি খেতে খেতে ভাবি, হয়ত�ো ফিরতে
করতে চেষ্টা করতেন মদিনার খেজুর বাগানের পারি গ্রামে, দেওখলা-কালিবাজাইল, তবে
কথা। যদি মনে থাকে ভাল�োবাসা, তবে এই ক�োথায় পাব�ো এমন স্বর্গীয় খাবারে স্বাদ। আমার
আবেগ অস্বীকার করি কীভাবে? হিসাব গুলিয়ে যেতে থাকে, ফিরে যাই আদিম
চলতে থাকে যুক্তি-প্রতিযুক্তি। আমরা বসি বিভ্রমে—গ্রাম, শহর, প্রবাস—আমি মনে মনে
কফিশপে—বিল দেন জাকির ভাই, ইঞ্জিনিয়ার— বলি, দেয়ালের ওপারটাই সবচেয়ে সুন্দর।
দেড়শ�ো কিল�ো দূরে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

অক্টোবর ২০২৩ 39
১ ভালবাসার সাম্পান
আ হ মা দ র ফি ক

আ মার কৈশর আল�োড়িত করা ঘনিষ্ঠ ভাই বন্ধুদের


কেউ বাবা হচ্ছে, কেউ পতি—এই জাতীয় খবর
যখনই শুনছি, তখনই মনে হচ্ছে, যেন এই মন্থর দিনে কেউ
একজন টং করে স্মৃতির এস্রাজে ট�োকা দিল, আর সমস্ত
স্মৃতি তার সুরে,লহড়িতে শান্ত পুকুরের মত দুলে উঠল।
সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে, যখন তারা ও আমি এসবের
কিছুই ছিলাম না; নিতান্ত কিশ�োর,কিংবা সদ্য কৈশর ছাড়িয়ে
উর্ধ্বমুখী গুল্মের মত বেড়ে উঠতে চাওয়া লিকলিকে ১৬-
১৭-১৮ বয়সী। বাংলা সাহিত্য পড়ি। একে-ওকে বেল না
দেওয়ার মত উন্নাসিক সমাল�োচনা করি। আর বৃদ্ধ-বয়স্কদের
অথর্বতা খুঁজে ফিরি। সাহিত্য বন্ধুত্ব ভাতৃত্ব তখন আমাদের
এক নতুন পৃথিবীতে ঢুকিয়ে দেয়। আমাদের সামনে থেকে
সমস্ত দূরত্ব ঘুচে গিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতে একাকার হয়ে যাই।
আমাদের একেকজন—কেউ বাংলা সাহিত্যেই থিতু হবে বলে
স্থির করে, কেউ মাদরাসা ও সাহিত্য—এই দ�োটানায় ভ�োগে,
কেউ কবি হওয়ার স্বপ্নে বিরামহীন কবিতা লেখে, ছড়া কাটে।
কেউ একজন একটি ভাল�ো গদ্য বা কবিতা ফেসবুকে প�োস্ট
করা মাত্রই অন্যরা একই সাথে আনন্দ গর্ব ও ঈর্ষার সাথে
পড়ে। মনে মনে তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সংকল্প তীব্র হয়ে
ওঠে। ও আসলে তেমন ছাড়িয়ে যেতে চাওয়াও নয়, বলা
যায় নিজেকেই উন্নত করার লাল বাসনা। বয়স চৈতন্য ও
ভালবাসার সাম্পান ছাড়াও আমাদের তখন মিলনমেলা হল�ো
ফেসবুককেন্দ্রিক একটা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ। নাম কিশ�োর কলাপ।
আমি মাদরাসায় চলে যাই, মন পড়ে থাকে এর কাছে। হয়ত�ো
ওদেরও। নিজেদের বয়সের অনাধিক্যতা জেনেও কে বড় এ

অক্টোবর ২০২৩ 40
নিয়ে শত বিতর্ক হত�ো এখানে। যায়েদকে মনে পড়তাম এক কড়া নিয়ন্ত্রনযন্ত্র মাদরাসায়। ফলে
করতাম আমরা সবার চেয়ে ছ�োট ও। কিন্তু ও তা এদিক থেকে আবার আমিই ছিলাম সবচেয়ে
কখন�োই মেনে নিত না। মানজুরের ভেতরে ছিল ক�োনঠাসা হয়ে। ক�োথাও আড্ডা দেওয়ার কথা
ওরই মানানসই সুদৃশ্য খাড়া নাকের মত সবকিছু উঠলে, আমি বৃহস্পতিবার বা শুক্রবারের হিসাব
ছাপিয়ে ওঠার তুমুল উদগ্রীবতা। এ বিতর্কে তা কষেও পরেক্ষণেই দমে যেতাম মনে মনে। চ�োখে
খুবই চ�োখে পড়ত আমাদের। ওয়ালী—একটা ভাসত এক বিষণনতম বৃহস্পতিবারের ছবি,
সাদাকাল�ো ছবির ভেতরে কবির অনন্তের দিকে কিংবা শুক্রবার—মাদরাসার বন্ধ গেইটে ঝুলে
তাকিয়ে থাকা প্রফাইল পিকচার ও বাস্তবতার থাকা ল�োহার বড় তালা, নিরুপায় হয়ে পড়ালেখা
যুগপৎ। আর ছিল সমীর। সমীরের সাথে এখন�ো করছে সবাই যার যার মত�ো করে, দু চারজন
সরাসরি দেখা হয়নি আমার। কিন্তু, এ কথাটিকে ছুটি চাইতে গিয়েও কাল�োমুখ করে ফিরে আসে
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় বৈ কি। আর হাসান— হুজুরের কামরা থেকে, সেই মুখের উপরে যেন
সে গল্প ভালবাসত। গল্প লিখত। রক্ষণশীল সুস্পষ্ট হরফে লেখা—ছুটি নেই, কিংবা হাজার
পরিবারের ঘেরাট�োপে পড়ে গিয়েছিল সে। এই রকমের জেরার পরও পরাস্ত হওয়া, উপযুক্ত
সংঘের ভিতরে তখন পর্যন্ত এই পারিবারিক কারণ দর্শাতে না পারার অক্ষমতা। এই সব
ঘেরাট�োপের বাইরে ম�োটামুটি স্বাধীন ছিলাম ছবি ও বাস্তবতার কথা মনে করে ক�োথাও যে
সম্ভবত আমি আর যায়েদই। ক�োথাও বেরুতে যাব�ো তা আর ভেবে উঠতে পারতাম না। তাই
চাইলে পারিবারিকভাবে আমাদের কার�ো আড্ডা বা দেখা হওয়ার জন্য আমার একমাত্র
অনুমতির ত�োয়াক্কা করতে হত�ো না। মানে, ও পথ ভরসা ছিল পরীক্ষার ছুটিগুলি, যতদিন না আমি
রুদ্ধ ছিল না। তবে আমার উপর ছিল মাদরাসার লালমাটিয়ায় জালালাইন জামাতে উঠে একটি
কড়া নিয়ম-কানুনের খড়গ। ওস্তাদদের নিয়ন্ত্রণ। মুক্ত আকাশ পেয়েছিলাম।

অক্টোবর ২০২৩ 41
ছবি : প্রতীকি

শাহ ওয়ালিউল্লাহর জন্মভিটায়


হা সা ন আ জী জ

এ করাশ দ্বিধা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল�ো। রওনা হওয়ার
ঘন্টাখানেক আগেও জানতাম না ঠিক ক�োথায় যাচ্ছি। দারুল উলুমে লেগেছে ছুটির
হাওয়া। ইন্ডিয়ান ছাত্ররা দলে দলে বাড়ির পথ ধরছে। দরস পুর�োপুরি বন্ধ না হলেও চলছে
ঢিমেতালে। বাংলাদেশী পরিচিতি কয়েকজনও বাড়ি যাওয়ার ত�োড়জ�োড় করছে। তাদের
দেখে আমিও প্রভাবিত হয়েছিলাম, কিন্তু দেশ থেকে আব্বার কড়া নির্দেশ এল�ো, বাড়ির
কথা আপাতত ভুলে যেতে হবে। বার্ষিক পরীক্ষার আগে ওসব মাথায়ও আনা যাবে না। তাই
দুধের স্বাদ অন্য কিছু দিয়ে মেটাতে সফরে বেরিয়ে পড়লাম।
সফর-তালিকায় সম্ভাব্য নাম ছিল দুটি—কান্ধালা ও ম�োজাফফরনগর। আমিন ফ�োনে নানান
জায়গায় খ�োঁজ খবর নিয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে শেষে সিদ্ধান্ত প�ৌঁছল, কান্ধালা

অক্টোবর ২০২৩ 42
নয়, আপাতত ম�োজাফফরনগরেই যাওয়া যাক। দেখতে দেখতে ছ�োট্ট দর�োজাটা ঘিরে জনা
সেখান থেকে সুয�োগ হলে কান্ধালায় যাব, না দশেক ল�োক অবলীলায় দাঁড়িয়ে গেল।
হয় ফিরে আসব দেওবন্দে। মাদরাসা থেকে যখন বের হই আকাশে তখন
পালনপুরী সাহেবের দরস শেষ করে নাকেমুখে দুপুরের গনগনে সূর্য। অথচ ট্যাম্পুতে ওঠার
কয়টা গুঁজেই বেরিয়ে পড়লাম। এবং অবাক কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশ অন্ধকার হয়ে বৃষ্টি
হয়ে লক্ষ করলাম, সফরের প্রতি ভেতর থেকে পড়তে শুরু করে। আমার মনের ভূমি তাতে
ন্যূনতম ক�োন�ো সাড়া পাচ্ছি না। বুকের মধ্যে আরও স্যাতস্যাতে হয়ে ওঠে। নিজেকে ব্যস্ত
রীতিমত�ো ঝড় শুরু হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছে রাখার জন্য ফেসবুক লগ-ইন করি। একটা
ফিরে যাই। আমিনের কাছে মিনমিনে গলায় নতুন বাচ্চাম�ো এসেছে ফেসবুকে—জেনে নিন
দুই-একবার ফেরার আকুতিও জানালাম। কে আপনার মেলায় হারিয়ে যাওয়া বন্ধু! কে
পাত্তা পেলাম না। তাছাড়া ম�োজাফফরগনের আপনাকে মিস করে! আপনার অনুপস্থিতিতে
প্রতি আকর্ষণ যে আমারও নেই তাই বা বলি কে আপনাকে বার বার খ�োঁজে! আগের জন্মে
কী করে? কালিম সিদ্দিকি সাহেবের নাম দেশে কে আপনাকে খুন করেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি।
থাকতে কত�োবার শুনেছি! ভর্তি পরীক্ষার আমি অসীম ধৈর্য সহকারে প্রত্যেকটা অপশন
ছুটিতে একবার যাওয়ার প্রোগ্রাম করেও পরীক্ষা করলাম। যেন এই মানুষগুল�োকে চেনা
শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। তিনি নিজে একবার আমার অতীব জরুরি। দেখা গেল, ফেসবুকে
দেওবন্দে এসেছিলেন, সেদিনও তার সাক্ষাত যাদের সঙ্গে য�োগায�োগ সবচেয়ে বেশি হয়,
মিস করেছি। আজ যখন সুয�োগ এসেছে তার কথাবার্তা, মেসেজিং. লাইক-কমেন্ট চলে এমন
খানকায় হাজিরা দেওয়ার, সেটা কেন হাতছাড়া কয়েকজনের নামই ঘুরেফিরে আসছে। আগের
করব? কিন্তু মন ত�ো ক�োন�োভাবেই মানছে না। জন্মে আমার খুনি হিসেবে যার নাম এল�ো সেটি
বিরতিহীনভাবে কেবল গেয়েই চলেছে—ফিরে আমারই আরেক আইডি।
যাই, চল ফিরে যাই! ট্যাম্পু থেকে নেমে কিছুটা পায়েহাঁটা পথ।
যাত্রা শুরু হল�ো ট্যাম্পু-য�োগে। ট্যাম্পুচালক বড় ম�োজাফফরনগর ভারতের দাঙ্গাপ্রধান
দরাজ দিল। কাউকে ফেলে যেতে পারেন না। অঞ্চলগুল�োর অন্যতম। ফলে ভয়ের একটা সূক্ষ্ম
সকল যাত্রীকে গন্তব্যে প�ৌঁছান�োর এক পবিত্র অনুভূতি স্বভাবতই অনুভব করে উঠলাম। মনে
দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। হচ্ছিল এই বুঝি পাশ থেকে কেউ হামলে পড়ছে
যারাই হাত তুলছে সকলকে ঠেলে ঢ�োকান�ো আমার উপর। বুকের ঝড় তখনও থামেনি। বিরতি
হচ্ছে ভেতরে। যখন আর পা ফেলারও জায়গা দিয়ে দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে
রইল না তখন দরজায় দাঁড় করাতে লাগলেন। যাচ্ছে। গন্তব্য যত�ো নিকটে আসছে অস্থিরতা

অক্টোবর ২০২৩ 43
তত�ো বাড়ছে। কারণ কাছাকাছি থাকলে ফিরে যাবার একটা ন্যূনতম
সম্ভাবনা থাকে। এতদূর চলে আসার পর সেই সুয�োগটিও আর নেই।
সাময়িক যাত্রাবিরতি দিয়ে রাস্তার পাশ থেকে পেয়ারা কিনে খেলাম।
এরপর আবার যাত্রা শুরু। ফুলাত খানকার সামনে যখন রিক্সা থেকে
নামলাম ততক্ষণে আসরের আজান হয়ে গেছে।
নামাজের পর তালিমের মজলিস বসল। একটি উরদু বই থেকে আকাবিরে
দেওবন্দের সময়ানুবর্তিতা ও ক�োরবানির বিভিন্ন ঘটনা পড়ে শ�োনান�ো
হল�ো। বইটার নাম এখন আর মনে পড়ছে না। তালিম শেষে তাফরীহে
ট্যাম্পু থেকে বের হলাম। খানকাহর পাশেই ‘জামিআ ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ’র
নেমে কিছুটা শিক্ষাভবন। মাঝখানে ছ�োট্ট মাঠ রেখে চারপাশ ঘিরে ভবন তৈরি করা
পায়েহাঁটা পথ। হয়েছে। মাগরিব পর্যন্ত বসে রইলাম মাঠে। কালিম সিদ্দিকি সাহেব হজে
ম�োজাফফরনগর চলে গেছেন। এ যাত্রায়ও তার সঙ্গে সাক্ষাত হচ্ছে না। এত দীর্ঘ পথ
ভারতের দাঙ্গাপ্রধান এখন ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়। রাতটা কাটাতে হবে এখানেই।
অঞ্চলগুল�োর মাগরিবের পর গেলাম পাশের একটি পাবলিক লাইব্রেরিতে। এই
অন্যতম। ফলে লাইব্রেরির কথা আমি ‘তবু অনন্ত জাগে’তে বলেছি। চমৎকার সব
বইপত্রে ঠাসা, পড়ার পরিবেশও দারুণ। সময়টা সুন্দর কাটল। ক্ষণিকের
ভয়ের একটা সূক্ষ্ম জন্য ভেতরের ঝড়ের কথা ভুলে গেলাম। ইশার পর এক ভাই নিয়ে
অনুভূতি স্বভাবতই গেলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. এর জায়ে প্যায়দায়েশ বা জন্মভিটা
অনুভব করে দেখাতে। ফুলাত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. এর নানার বাড়ি। খানকা থেকে
উঠলাম। মনে হচ্ছিল কয়েক মিনিটের দূরত্ব। এখানেই একটি ছ�োট্ট ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন
এই বুঝি পাশ থেকে ভারতের জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিকতার ইতিহাস পাল্টে দেওয়া এই মনীষী।
ঘরের ভেতর অনুজ্জ্বল আল�ো জ্বলছিল। এই ঘর, এই অনুজ্জ্বল আল�ো,
কেউ হামলে পড়ছে এসবের সঙ্গে শাহ সাহেবের জন্মকালীন পরিস্থিতির বিশেষ ক�োন�ো
আমার উপর। য�োগসূত্র কি আছে?
বুকের ঝড় তখনও শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. জন্মগ্রহণ করেছেন আওরঙ্গজেব আলমগির
থামেনি। বিরতি রহ. এর ইন্তেকালের চার বছর আগে। আকবরের সময়ে ভারতজুড়ে
দিয়ে দিয়ে ক্ষণে যে অনৈসলামিক কর্মকান্ডের সূচনা হয়েছিল মুজাদ্দিদে আলফে সানি
ক্ষণে তার অস্তিত্ব রহ. এর সংস্কার আন্দোলনের ফলে জাহাঙ্গির-শাহজাহানের সময়ে
জানান দিয়ে যাচ্ছে। তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আর তা ষ�োলকলায় পূর্ণ হয়

অক্টোবর ২০২৩ 44
আওরঙ্গজেব রহ.-এর হাতে। ইসলামী বিধি- সময়ে। দিল্লির আশপাশের অঞ্চলগুল�োতে ঘাঁটি
বিধান যে আকবরি শাসনে হাস্যরসের পাত্রেগেড়ে এরা শহরের উপর লুটতরাজ শুরু করে।
পরিণত হয়েছিল, আওরঙ্গজেব রহ.-এর দুর্বিষহ করে তুলে দিল্লির জনজীবন। এদিকে
উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপ�োষকতায় সেখানে তৈরি হয়
সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুল�োতে ইংরেজদের
ইসলামি আইনের স্বীকৃত গ্রন্থ আল-ফাতাওয়াল
মতিগতিও ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছিল। ব্যবসার
হিন্দিয়া বা ফত�োয়ায়ে আলমগিরি। তিনি রাষ্ট্রের
নামে ঘাটি গেড়ে বসা এই বিদেশিদের কাছে
শৃঙ্খলায়ও ব্যাপক পরিবর্তন আনেন, রাষ্ট্রকে
ব্যবসার পরিবর্তে রাষ্ট্রক্ষমতাই হয়ে ওঠে মুখ্য।
দাঁড় করান একটি মজবুত ভিতের উপর । দিল্লির দুর্বল শাসনব্যবস্থা দেশিয় ও আন্তর্জাতিক
জীবনের শেষ কয়েকটি বছর তাকে ব্যয় করতে এসব অপশক্তিগুল�োকে শক্তি য�োগায়। ভারতে
হয়েছে শিখ ও মারাঠাদের বিরুদ্ধে মরণপণ মুসলমানদের গ�ৌরব�োজ্জ্বল শাসন উজ্জ্বলতা
হারিয়ে যাত্রা করে নিকষ অন্ধকারের দিকে।
আমার পুরন�ো চিন্তাটি আবারও ফিরে আসে। শাহ সাহেবের জন্মভিটার
পাশেই এই যে এত�োসব আয়�োজন, এই সবই কি তার সংস্কারকর্মের রুপক
নমুনা? এর প্রত্যেকটি কি তার একেকটি অবদানের প্রতিনিধিত্ব করছে?

রাষ্ট্র যখন এমন চরম পরিস্থিতির মুখ�োমুখি,


যুদ্ধে। ম�োঘল শাসনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত হুমকি
হয়ে ওঠা এই দুই শক্তিকে তিনি এক প্রকার দিল্লির শাসকরা তখন ডুবে আছে ভ�োগ আর
ক�োনঠাসা করে দিয়েছিলেন। তাদের ঐক্যবদ্ধ বিন�োদনের অন্ধকার কুপে। মদ, নারী, কাব্য,
শক্তি চূর্ণ করে নানা দল-উপদলে বিভক্ত করে নৃত্য আর আম�োদ-প্রম�োদেই কাটছিল তাদের
দিয়েছেন। যদি তার পরবর্তী বংশধরেরা পিতার প্রতিটি মুহূর্ত। দিল্লি শহরের অবস্থা ছিল আল�ো-
দূরদর্শীতা, হিম্মত ও ঈমানের ছিটেফ�োঁটাও ছায়াময়। সেখানে খানকা ছিল, মদের বারও
লাভ করত তাহলে এরা ভারতের মাটি থেকে ছিল। মাদরাসা ছিল, আবার জুয়ার আসরও
ছিল। মানুষ ভক্তিভরে খানকা ও মাজারে হাজিরা
চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত�ো। কিন্তু ইয়া লাল-
আসাফ! দিত�ো, আবার সমউদ্যমে অংশগ্রহণ করত�ো
আওরঙ্গজেব পরবর্তী শাসকদের অয�োগ্যতা নটী-নর্তকীদের নাচের আসরে। হিন্দুয়ানি
ও ভীরুতার সুয�োগে শিখ-মারাঠা নতুন করে রীতিনীতি ব্যাপকভাবে মুসলমানদের গ্রাস করে
নিয়েছিল। তেমনি ভেসে গিয়েছিল নৈতিকতা
মাথাচারা দিয়ে ওঠে। সঙ্গে য�োগ হয় জাঠরা।
আর সভ্যতার সকল বাধ।
যাদের উত্থান হয়েছিল আওরঙ্গজেব রহ. এর শেষ

অক্টোবর ২০২৩ 45
ধর্মীয় জ্ঞানের অঙ্গনেও বিরাজ করছিল সীমাহীন রাষ্ট্র ও অর্থনীতি—ক�োথায় তিনি হাত দেননি?
স্থবিরতা। ক�োরআনকে অন্য ভাষায় অনুবাদ ক�োন ক্ষতটিতে তিনি উপেক্ষা করে গেছেন?
করা ক�োরআনের অল�ৌকিকতার জন্য ক্ষতিকর যদি বলি, তারই কল্যানে আজ আমরা ভারতের
মনে করা হত�ো। হাদীসের চর্চাকে মনে করা হত�ো মাটিতে বসে ইসলামের বিশুদ্ধ রূপটি চর্চা করতে
দ�োষণীয় কাজ। এমনকি তাসাউফ ও আত্মশুদ্ধির পারছি, তাহলে কি খুব বাড়িয়ে বলা হবে?
মত�ো নিরেট সংস্কারমূলক আন্দোলনটি পর্যন্ত শাহ সাহেবের জন্মভিটা দেখে এসে রাতের
হিন্দুয়ানি রীতিনীতি ও বেদ-উপনিষদের খাবার খেলাম। এরপর গেলাম মাদরাসা
দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েছিল। পরিদর্শনে। দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার
মুজাদ্দেদে আলফে সানি রহ. এর সংস্কার সিলেবাসে পরিচালিত এই মাদরাসাটিতে মূলত
আন্দোলন আকবর কর্তৃক আর�োপিত হিন্দুয়ানি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা দেওয়া হয়।
রীতিনীতি এবং বেদআত ও রুসুমাতের বিরুদ্ধে এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য ছাত্ররা নদওয়ায় চলে
তীব্র আঘাত হয়ে এলেও জ্ঞানের জগতে যায়। আমরা ছাত্রাবাসের বিভিন্ন কামরা ঘুরে
সুদীর্ঘকাল ধরে জমে থাকা স্থবিরতা পুর�োপুরি দেখলাম। প্রত্যেকটিতেই ছাত্রদের মন�োয�োগী
দূর করতে সক্ষম হয়নি। জ্ঞানচর্চার দৃশ্য। অনুভব করি, আমার ভেতর
এমনই এক নাজুক সময়ে ঠিক সূর্যোদয়ের সময় ঝড়ের পরিবর্তে বিরাজ করছে প্রশান্তির সিগ্ধ
ভারতের জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিকতার আকাশে ক�োমল পরিবেশ। পড়াশ�োনাটা নিজের জন্য,
নতুন সূর্যের আগমণী সংবাদ হয়ে শাহ সাহেব উস্তাদের জন্য নয়—এই বাস্তবতাটা অনুভব
জন্মগ্রহণ করলেন। এরপরের ইতিহাস ত�ো করতে করতেই আমরা শিক্ষাজীবন পার করে
পৃথিবীর সামনেই। জ্ঞান, আত্মশুদ্ধি, সমাজ, দিই। যত�োদিনে অনুভূতিটা ভেতরে পাকাপ�োক্ত

জামিয়া ইমাম ওয়ালিউল্লাহ ইসলামিয়া,


ফুলাত, ম�োজাফফরনগর।

অক্টোবর ২০২৩ 46
হয়ে বসে তত�োদিনে হারিয়ে যায় জীবনের স�োনালী দিনগুল�ো। অথচ
এখানে উস্তাদের ক�োন�ো রকমের নেগরানি ছাড়াই ছাত্ররা কী গভীর
অভিনিবেশ সহকারে জ্ঞানচর্চায় মগ্ন আছে। এমন হৃদয়জ�োড়ান�ো দৃশ্য
দেখে মন প্রশান্ত না হয়ে উপায় আছে?
মাদরাসার সঙ্গে লাগ�োয়া মুসলিম পার্সোনাল ল ব�োর্ড পরিচালিত
শরঈ আদালত বা দারুল কাযা। আমাদের আদালতকক্ষ ভেতর থেকে
ঘুরিয়ে দেখান�ো হয়। আমার পুরন�ো চিন্তাটি আবারও ফিরে আসে। শাহ
সাহেবের জন্মভিটার পাশেই এই যে এত�োসব আয়�োজন, এই সবই
কি তার সংস্কারকর্মের রুপক নমুনা? এর প্রত্যেকটি কি তার একেকটি
অবদানের প্রতিনিধিত্ব করছে?
তিনি দ্বীনী শিক্ষায় সংস্কার এনেছেন। ক�োরআনকে তৎকালীন সবচেয়ে
চালু ভাষা ফারসিতে অনুবাদ করে সঙ্গে যুক্ত করেছেন গুরুত্বপূর্ণ টীকা।
পাঠ্যতালিকায় যেখানে হাদিসের সর্বোচ্চ কিতাব ছিল মেশকাত, সেখানে
তিনি সিহাহ সিত্তা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সঙ্গে যুক্ত করেছেন ফিকহি
আল�োচনার ধারা। তাসাউফের নামে চলে আসা হিন্দুধর্ম প্রভাবিত
কুসংস্কারকে ধুয়ে-মুছে ইসলামের বিশুদ্ধ ইহসানের চেতনা তৈরির যে
কাজ মুজাদ্দিদ রহ. শুরু করেছিলেন তাতে পূর্ণতা এনে বিশুদ্ধ আত্মশুদ্ধি
চর্চার এক অনুপম নজির তৈরি করেছেন, পাশাপাশি চেষ্টা করেছেন
জনসাধারণকে ইসলামী আইনের প্রতি ফিরিয়ে আনতে।
আজ তার জন্মভিটা সংলগ্ন কমপ্লেক্সটিতে এর সবকিছুরই ত�ো সমন্বয়
ঘটছে। এখানে আছেন দরদি ও অনুভূতিপ্রবণ দায়ী মাওলানা কালিম
সিদ্দিকি। যার হাত ধরে হাজার�ো বিধর্মী ইসলামে দিক্ষীত হয়েছে। আছে
দ্বিনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জ্ঞানচর্চার জন্য সুন্দর মন�োরম পরিবেশ এবং
ইসলামি আইন বাস্তবায়নের জন্য শরঈ আদালত।
ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমে ভাঙল যিকিরের আওয়াজে।
পুর�ো খানকা যেন একসঙ্গে জেগে উঠেছে। শুরু হয়ে গেছে ‍যিকিরের
সুমধুর সঙ্গীত। খানকার প্রতিটি ইট-বালু থেকে ভেসে আসছে স্রষ্টার
প্রতি নিবেদনের পবিত্র সুর। চিরঅলস আমি আজ বিছানাত্যাগ করতে
ক�োন�োরকম অলসতার লেশমাত্র খুঁজে পেলাম না। ওজু করে কয় রাকাত
অক্টোবর ২০২৩ 47
নামাজ পড়েই তাদের সঙ্গে জুড়ে গেলাম। রাতে শুধু শাহ সাহেবের সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে
জ্ঞানচর্চা আর শরঈ আইন বাস্তবায়নের সংয�োগ পেয়েছিলাম। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হল�ো বিশুদ্ধ
তাসাউফ চর্চার ধারাও।
বাদ ফজর দেওবন্দের উদ্দেশ্যে ফিরতি পথ ধরলাম। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে
ওয়লিউল্লাহি ইলমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার হযরতুল উস্তাদ মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরির
গুরুত্বপূর্ণ দরস।

অক্টোবর ২০২৩ 48
ম�োহ ম�োহ সুর
ও ম র আ লী আ শ রা ফ

এ কটি সংগীত আমার ভাল�ো লেগেছে। দশবার বিশবার পঞ্চাশবার শ�োনা হয়ে গেছে।
রাতে শুনি, দিনে শুনি। দশজন শিল্পী গানটি কভার করেছেন। সবার কণ্ঠে অন্তত
একবার করে শ�োনা হয়ে গেছে। কথায় আছে, লেবু বেশি কচলালে তিতা হয়ে যায়। এটা
বিভিন্ন ঘটন-অঘটন বিষয়ে যেমন সত্য, গানটি শুনতে শুনতে এখন মনে হচ্ছে, শিল্প-
সাহিত্য-স�ৌন্দর্যের বেলায়ও কথাটা খাটে। এখন আর গানটা শুনতে ইচ্ছে করে না। ক�োথাও
চলছে কানে এলে একটু বিরক্তিই লাগে বরং।
মানুষের মন খারাপ হলে, নিজেকে একান্তে মনে পড়লে মানুষ সুরের কাছে যায়, সবুজের
সান্নিধ্যে বসে, নিরিবিলিতে নিজেকে সময় দেয়। যে সুর মনকে শান্ত করে, যার সংগীত
হৃদয়কে আর্দ্র করে, মানুষ সে কণ্ঠে সুরের মূর্ছনায় একটু প্রশান্তি পেতে চায়। কিন্তু এমন
কার সুর আছে, এমন ক�োন সংগীত আছে, নিরবধি একটি মনকে যে নিরিবিলি আনন্দ
অক্টোবর ২০২৩ 49
দিয়ে চলতে সক্ষম? বিশবার পঞ্চাশবার শ�োনার রিদম বজায় থাকে। খাড়া জবরের এক আলিফ
পরেও বিরক্তি আসে না? আমার এই জীবনে টান, মদ্দে মুনফাসিলের তিন আলিফ টান,
সে রকম ক�োন�ো সুর-সংগীতের সন্ধান এখন�ো মদ্দে মুত্তাসিলের চার আলিফ টান—কী সুন্দর
পাইনি। বরং দেখেছি, সবচেয়ে প্রিয় গানটাও সুরের তাল লয় গতিবেগ বজায় রেখে ছন্দে
শুনতে শুনতে একসময় মানুষ নতুন গান নতুন ছন্দে দুলতে দুলতে এগুতে থাকে তিলাওয়াত।
সুরের সম্মোহন খ�োঁজে। মনটাকে মুহূর্তে বিমূঢ় করে ফেলে। ইচ্ছে করে
কিন্তু ক�োন�ো সংগীত কিংবা নিছক বিন�োদনের এই সুরে এই ছন্দে নিজেকে ভেঙেচুরে বিলীন
উৎস না হয়েও পবিত্র কুরআন যুগ যুগ ধরে করে দিই।
সারা পৃথিবীর অজস্র মানুষকে, বিভিন্ন ভাষার এত সুর, এত প্রশান্তি আর ক�োথায় আছে?
জাতিকে, সব সংস্কৃতির গ�োত্রকে নিরবধি গানের ক�োন�ো কিতাব না হয়েও কুরআনের এই
মানুষের মন খারাপ হলে, নিজেকে একান্তে মনে পড়লে মানুষ সুরের কাছে
যায়, সবুজের সান্নিধ্যে বসে, নিরিবিলিতে নিজেকে সময় দেয়। যে সুর
মনকে শান্ত করে, যার সংগীত হৃদয়কে আর্দ্র করে, মানুষ সে কণ্ঠে সুরের
মূর্ছনায় একটু প্রশান্তি পেতে চায়। কিন্তু এমন কার সুর আছে, এমন ক�োন
সংগীত আছে, নিরবধি একটি মনকে যে নিরিবিলি আনন্দ দিয়ে চলতে
সক্ষম?
প্রশান্তি জুড়িয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার মানুষ তাদের চিরন্তন সুরলহরি কী সুন্দর যুগ যুগ ধরে মানুষের
ভাষায় কী বলে, আমরা বুঝি না; কিন্তু তাদের মনের এলাজ হয়ে কাজ করছে। প্রতিদিন
কণ্ঠে কুরআনের সুর-সম্মোহন আমাদের ইমামের কণ্ঠে আমরা বারবার সুরা ফাতিহা শুনি,
হৃদয়গুল�োকে উতলা করে চলে। ইউর�োপের ক�োন�ো বিরক্তি ধরে না। একাকী নামাজে মুখে
মানুষের সংস্কৃতি আমাদের সঙ্গে মেলে না; কিন্তু আপনাতেই উঠে আসে সুরা ইখলাস, ক�োন�ো
তাদের কণ্ঠে কুরআনের তিলাওয়াত আমাদের ক্লান্তি লাগে না।
অন্তরে বিঁধে যায়।
যত শুনি, মনে একই রকম অনুভূতি থেকে
কুরআন ক�োন�ো কবিতার গ্রন্থ নয়, সংগীতের যায় না; ধীরে ধীরে গভীর গম্ভীর হয়, বসে যায়
লিরিকও নয়; অথচ প্রতিটি অক্ষর, হরকত, মনের অন্দরে। ইমাম যখন তিলাওয়াত করেন
শব্দ, বাক্য, আয়াত কী সুন্দর সুষমায় ছন্দে ‘আল-হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’, আমার
ছন্দে সুরে সুরে কলকল বয়ে চলে। সুরের চিন্তায় ভেসে ওঠে জগৎসমূহের রবের করুণা
অক্টোবর ২০২৩ 50
দয়া আর ভাল�োবাসার চিত্র। তাঁর অনুগ্রহেই ক�োটি, দশ ক�োটি, পঞ্চাশ ক�োটিবার একই
ত�ো আমি তাঁর কদমে লুটিয়ে পড়বার তাওফিক আয়াত পুনরাবৃত্তি হতে থাকলেও ক্লান্তি আসে
পেয়েছি। প্রতি ওয়াক্ত নামাজে, প্রতিটি আয়াতে না। উল্টো ব�োধে, চিন্তায়, অনুভবে গভীরতা
আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে, মনে ভাল�োবাসা আসে, ভাল�োবাসার জায়গাটা আর্দ্র হতে থাকে।
জাগতে থাকে, আল্লাহকে আমি আরও কাছ কুরআনের এই চিরন্তন মুজিযা পাওয়ার পর
থেকে অনুভব করার সুয�োগ পাই—একদম শাহ দুনিয়ার সামান্য গান বা সংগীত মুমিনকে এমন
রগেরও কাছ থেকে। মনে হয়, আজরাইল রুহ কী সুখ দিতে পারে? ছ�োট আনন্দের জন্য কি
নিতে এলেও তখন আমি তার দিকে তাকাবার মানুষ কখন�ো বড় প্রাপ্তিকে কিছুক্ষণের জন্য
ফুরসত পাব না। হলেও ভুলে থাকে, থাকতে পারে?
এই ত�ো কুরআনের চিরন্তন মুজিযা। এর
সুর-সম্মোহন আমাদের প্রশান্তি দেয়, এর ওমর আলী আশরাফ
তিলাওয়াত আমাদের এলাজ হয়ে কাজ করে,
এতে মন�োয�োগ আমাদের হৃদয়গুল�োকে জাগ্রত omaraliashraf508@gmail.com
করে, মনটা ভরে দেয় ভাল�োবাসায়। এক

অক্টোবর ২০২৩ 51
গাজালি
সা ঈ দ র মা দা ন আ ল বূ তী (রাহ.)
সা বে র চ�ৌ ধু রী অনূদিত

ই মাম গাজালির পুর�ো নাম ছিল মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আত-তূসী।
নামের এই শেষ অংশটি থেকেই বুঝা যাচ্ছে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তূস নগরীতে,
৪৫০ হিজরীতে। পিতা মুহাম্মদ ছিলেন নেহাত দরিদ্র মানুষ। পশম বুনে পরিবারের জীবিকা
নির্বাহ করতেন। তূস শহরেই তার একটা দ�োকান ছিল। নিজের তৈরী পশমের জিনিসপত্র
সেখানে নিয়ে বিক্রি করতেন। দরিদ্র হলেও পিতা মুহাম্মদ ছিলেন খুবই আত্মমর্যাদাশীল
একজন মানুষ। নিজে যেটুকু যা উপার্জন করতেন, তা দিয়েই সংসার চালাতেন—কার�ো
থেকে কখন�ো দান দাক্ষিণ্য গ্রহণ করতেন না। আলেম উলামা ও ফকীহদের মজলিসে
তাঁর ছিল নিয়মিত যাতায়াত। ফিকহের প্রতি ছিল প্রচণ্ড ভাল�োবাসা ও সীমাহীন আগ্রহ।

অক্টোবর ২০২৩ 52
ফলে, তাদের মজলিসগুল�োতে গিয়ে সবসময় পাড়ি জমালেন আল্লাহর সান্যিধ্যে। মৃত্যুর
পড়ে থাকতেন। শ্রদ্ধায় বিনত হয়ে ফকীহগণের আগে আগে এ দুজনকে তুলে দিয়ে গেলেন
খেদমত করতেন এবং প্রায়ই এটা-সেটা বিভিন্ন নিজের এক বন্ধুর হাতে। সে বন্ধুটি ছিলেন খুব
কিছু উপহার দিতেন। তার সামর্থ ছিল সামান্যই। পরহেজগার ও আল্লাহওয়ালা মানুষ। অশ্রুসজল
কিন্তু হৃদয় যখন ভাল�োবাসায় উপচে ওঠে, সাধ্য হয়ে বললেন—ভাই, আমার কপালে ইলম ছিল
তখন বাধ সেধে দাঁড়াতে পারে না। ফলে, যা ছিল না, এ নিয়ে সারাটা জীবন আমি দুঃখ করেছি;
সেখান থেকেই ভাল�োবাসার মানুষদের জন্য কিন্তু আল্লাহর কাছে আশাবাদী, আমি যা পাইনি
নিয়ে যেতেন ভক্তি ও আগ্রহের সাথে। নিজে আমার এ ছেলে দুট�ো তা পাবে। এ পথে চলতে
সেভাবে ইলম শিখতে পারেননি; কিন্তু ইলমের গিয়ে তারা যখন যে সমস্যার মুখেই পড়ুক, তুমি
প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে এই মজলিসগুল�ো ত�োমার সাধ্যের সবটুকু দিয়ে তাদেরকে এগিয়ে
তাকে আন্দোলিত করত ভীষণভাবে। হৃদয়ের যেতে সাহায্য করবে। সব কিছু সহজ করে দেবে।
সকল দুয়ার খুলে আর মস্তিষ্ককে সজাগ ও এর জন্য যদি আমার রেখে যাওয়া সমস্ত সম্পদ
সতেজ করে সেখানে বসে থাকতেন সুদীর্ঘ খরচ করে ফেলতে হয়, তবে তাই ক�োর�ো।
সময়। একসময় নিজেকে হারিয়ে ফেলতেন, তারপর সে বন্ধু নিজের সাধ্য অনুযায়ী এতিম
বিগলিত আত্মায় ঝড় উঠত, তখন হাউমাউ করে দুই বালককে পড়ালেখা করাতে লাগলেন।
কাঁদতেন। আল্লাহর কাছে দ�োয়া করতেন— কিন্তু অল্প দিনের ভিতর পিতার রেখে যাওয়া
এমন একটা সন্তান যেন তিনি পান, যে আলেম সব সম্পদ শেষ হয়ে গেল। সে বন্ধুটিও ছিলেন
হবে, ফকীহ হবে এবং দীনের তরে নিজেকে নেহায়েত দরিদ্র মানুষ। ক�োনমতে খেয়েপড়ে
বিলিয়ে দেবে সর্বান্তকরণে। নিজের জীবনটা নিয়ে চলছিলেন। ফলে বাধ্য
এক সময় আল্লাহ তার দ�োয়া কবুল করলেন। হয়ে একদিন তাদের ডেকে বললেন: শোন,
এই তপ্ত অশ্রুর ফ�োঁটা থেকে জন্ম নিল দু দুট�ো ত�োমাদের অর্থকড়ি যা ছিল, সব ত�ো খরচ হয়ে
সন্তান। একজনের নাম রাখলেন মুহাম্মদ। গিয়েছে। আমি নিজেও গরীব মানুষ, দেখতেই
অপরজন আহমদ। দিন রাত পিতা মুহাম্মদের পাচ্ছো। ফলে ত�োমাদের ভরণপ�োষণ করার
আশা ও স্বপ্ন আবর্তিত হতে লাগল এ দুই মত�ো টাকাপয়সা আমার নেই। কী করা যায় ভাবা
সন্তানকে কেন্দ্র করে। বহুদিন পর স্বপ্ন বুঝি দরকার। আমার বিশেষ পরামর্শ হল�ো, ত�োমরা
ডানা মেলল। হৃদয়ের গভীর থেকে সবসময় ইলম তলবের জন্য ক�োন একটা মাদরাসায়
দ�োয়া করতেন আল্লাহ যেন তাদেরকে আলেম ভর্তি হয়ে যাও। এমন ক�োন মাদরাসায়, যেখানে
ও ফকীহ হিসেবে কবুল করেন। তারাই ত�োমাদের থাকা খাওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ
করবে। পিতার বন্ধুর এমন পরামর্শ শুনে,
কিন্তু পিতা মুহাম্মদের সময় ফুরিয়ে এসেছিল।
তারা তাই করলেন। (সুবকিকৃত তাবাকাতুশ
সন্তান দুজনকে ছ�োট অবস্থায় রেখেই তিনি
অক্টোবর ২০২৩ 53
শাফিইয়্যাহ খণ্ড.৬, পৃষ্ঠা ১৯৩,১৯৪)
একসময় দুই ভাই জীবনের ভিন্ন দুটি পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন।
মুহাম্মদ এগিয়ে গেলেন পাণ্ডিত্যের জগতে। সবটুকু ধ্যানজ্ঞান ও
মন�োয�োগ দিয়ে আহরণ করতে লাগলেন শরীয়তের জ্ঞান ও দর্শন।
সীমাহীন কষ্ট ও সবরের সাথে এবং হীরার মত�ো তীক্ষ্ম ধারাল�ো মেধা
দিয়ে আত্মায় সঞ্চিত করতে লাগলেন জ্ঞানের অমৃত সুধা। অল্পদিনের
মধ্যে সহপাঠী ও সমবয়সী সবাইকে ছাড়িয়ে তিনি মাথা তুলে দাঁড়ালেন
জ্ঞানের সুউচ্চ আকাশে। বিস্ময় ও মুগ্ধতা নিয়ে সবাই তাকাল�ো তার
দিকে।
আর ছ�োট ভাই আহমদ গেলেন আত্মশুদ্ধির পথে। ইবাদাত ও সাধনায়
নিজেকে বিলিয়ে দিলেন। এই জগতে ছড়িয়ে পড়ল�ো তার পরিশুদ্ধ
আত্মার সুঘ্রাণ। সেই সাথে দাওয়াতের কাজে আত্মনিয়�োগ করলেন
তার ভেতরে একনিষ্ঠভাবে। তাঁর কথা ছিল খুবই সুমিষ্ট ও সুমধুর। উচ্চারণ ছিল
যে গভীর নিখুঁত, স্পষ্ট ও বিশুদ্ধ। উপস্থাপনা ছিল বড়ই চিত্তাকর্ষক। কথা বলতে
আত্মোপলব্ধির জন্ম শুরু করলে পুর�ো মজলিস যেন সম্মোহিত হয়ে পড়ত�ো। (ইবনুল
নিয়েছিল এবং সে ইমাদকৃত শাযারাতুয যাহাব। খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৬০)
থেকে যে মর্মপীড়ায় মুহাম্মদ আবু হামেদ আল গাজালি শিক্ষাজীবনের শুরুতে তূসের
অস্থির হয়েছিলেন, কাছেই ছ�োট একটি শহর জুরজানে গিয়েছিলেন। সেখানে আবু নসর
ইসমাঈলী নামে একজন উস্তাদ আছেন। তাঁর কাছে গিয়ে বিভিন্ন
হৃদয়ের এই যন্ত্রণা
বিষয়ে পাঠ গ্রহণ করতে শুরু করেন। সে সময়ে পড়াশ�োনার ক্ষেত্রে
থেকে তিনি মুক্তি তার নিয়ম ছিল উস্তাদ থেকে যা শুনতেন, খাতায় লিখে রাখতেন।
পেতে চাচ্ছিলেন
একদিন নিজ এলাকা তূসে ফিরে আসার সময় ইমাম গাজালি পড়ে
ব্যাকুল হয়ে। এই গেলেন একদল ডাকাতের হাতে। এরপর যা হওয়ার তাই হল�ো—
ব্যকুলতাই একসময় ডাকাতদল তল্লাশি চালিয়ে লুটে নিলো তার সব কিছু । এমনকি
তাকে নামিয়ে ন�োটখাতাগুল�ো পর্যন্ত। একেবারে সর্বস্বান্ত করে ডাকাতদল যখন
আনল�ো পথে, দীন চলে যাচ্ছিল�ো, তখন বিশেষ একটি ঘটনা ঘটল�ো, যা গাজালির
শিক্ষাদর্শনকেই পাল্টে দিল আমূলভাবে। সে মুহূর্তটির বিবরণ দিতে
এক মুসাফিরের
গিয়ে তিনি বলেন—এরপর আমি তাদের পিছু পিছু চলতে লাগলাম।
বেশে। যেভাবেই হ�োক খাতাগুল�ো ত�ো ফেরত আনতে হবে। পিছে পিছে
অক্টোবর ২০২৩ 54
যাচ্ছি দেখে ডাকাত সর্দার ধমক দিয়ে বলল�ো— এরপর তিনি নিশাপুর চলে আসেন। এখানে
ব্যাটা, ভাগ। না হয় মেরে ফেলব�ো।’ আমি মরিয়া ছিলেন আরেক জগদ্বিখ্যাত উস্তাদ—ইমামুল
হয়ে বললাম—‘আল্লাহর দ�োহাই লাগে। আমার হারামাইন আবদুল মালিক জুআইনি। আবু
খাতাগুল�ো শুধু ফেরত দিয়ে দাও। এগুল�ো হামেদ গাজালি তার গভীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন
ত�োমার ক�োন�ো কাজে লাগবে না।’ সর্দার কিছুটাএবং নিমগ্ন হন ইলম অন্বেষণের কঠিন সাধনায়।
বিস্মিত হয়ে বলল�ো, কীসের খাতা? এক পর্যায়ে ফিকহ, তর্কশাস্ত্র, শরীয়তের
মূলনীতি ও ফিকহের মূলনীতিতে গভীর
বললাম, এগুল�োতে আমি আমার পড়াশ�োনার
পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সেই সাথে গ্রহণ করেন
বিষয় লিখে রেখেছি। এ বিষয়গুল�ো শেখার
হিকমতশাস্ত্র, যু্ক্তিবিদ্যা ও দর্শনের পাঠ। এসব
জন্যই মূলত সফর করেছিলাম।
বিষয়ে শুধু ম�ৌলিক ধারণাই অর্জন করেননি;
সর্দার তখন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল�ো— চিনে এসেছেন ছ�োটবড় সমস্ত অলিগলি।
শেখার জন্য গিয়েছিলে? তুমি ক�োন মুখে এ দাবি
এ সময়ে ‍ তিনি ‘ইমামুল হারামাইনের ছাত্র’
করছ�ো? জ্ঞান কি কখন�ো ছিনিয়ে নেওয়া যায়?
হিসেবে বিখ্যাত হয়ে উঠেন। কথিত আছে,
তুমি বলছ�ো তুমি জ্ঞান অর্জন করে এসেছ�ো,
ইমামুল হারামাইন স্বয়ং তাকে নিয়ে গর্ব করতেন
অথচ এখন আমরা ত�োমার জ্ঞান ত�োমার
এবং বলতেন, আবু হামেদ জ্ঞানের গহীন এক
থেকে খুলে নিয়ে যাচ্ছি, আর তুমি স্রেফ মুর্খ
সমুদ্র। তবে কেউ কেউ এটাও বলেছেন: ইমামুল
হয়ে দাঁড়িয়ে আছ�ো! এ ত�ো বড় হাস্যকর কথা!’
হারামাইন প্রকাশ্যে তার প্রশংসা করলেও
এরপর সে তার এক শিষ্যকে বলল�ো—ঠিক
ভিতরে ভিতরে তার দক্ষতা ও য�োগ্যতা নিয়ে
আছে, ছ�োকরাকে খাতাগুল�ো ফিরিয়ে দাও।
বিব্রত ব�োধ করতেন।
ইমাম গাজালি বলেন, এ কথাগুল�ো ত�ো ডাকাত
এবং এই সময়টিই ছিল তার জ্ঞানগত শ�ৌর্যের
বলেনি; মূলত আল্লাহ তাআলা তাকে দিয়ে
স্ফুরণের কাল। বর্ণনা নির্ভর ও মস্তিষ্কজাত নানা
বলিয়েছেন, যেন আমার সামনে সত্যিকারের
বিষয়ে দু হাত খুলে লিখতে থাকেন একের পর
পথটা খুলে যায়। ফলে তূস প�ৌঁছে আর দেরি
এক অসাধারণ সব রচনা। পুর�ো পৃথিবী অবাক
করিনি। এসেই খাতাগুল�ো আত্মস্থ করতে
বিস্ময়ে তার দিকে চ�োখ তুলে তাকায়। পিপাসার্ত
বসলাম। শেষ করতে তিন বছর লেগেছিল। কিন্তু
হয়ে লুফে নেয় তার রচনাসম্ভার। ইমাম সুবকির
শেষ করার পর এমন আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল,
ভাষ্যমতে এসবের পেছনে কাজ করেছে মূলত
এখন ডাকাতের পাল্লায় পড়লেও তারা আমার
গাজালির অসাধারণ তীক্ষ্ম মেধা, চিন্তার
সব নিয়ে যেতে পারবে; কিন্তু ইলম নিতে পারবে
স্বচ্ছতা ও পরিশুদ্ধতা, গভীর অনুভব, অবাক
না। (তাবাকাতুশ শাফিইয়্যাহ, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা,
করা মুখস্থশক্তি, ভাবনার গভীরতা, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম
১৯৫)
মর্মের বিস্ময়কর উদঘাটন, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ত ও
অক্টোবর ২০২৩ 55
অপ্রতির�োধ্য শক্তির সাথে বিতর্ক করতে পারার কিছু দিনের ভিতরেই তিনি সেসব উচ্চমার্গিয়
ক্ষমতা এবং অকাট্য দলীল হাজির করে নিজের বিতর্কে সবাইকে পরাজিত করে চড়ে বসলেন
বক্তব্য প্রমাণ করার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে চুপ নেতৃত্বের একক আসনে।
করিয়ে দেওয়ার আল্লাহ প্রদত্ত বিস্ময়কর
সকলেই শ্রদ্ধাভরে ও অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকৃতি দিল�ো
সক্ষমতা। (প্রাগুক্ত : খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ১৯৬)
তার অসাধারণ বিতর্ক শক্তি, জ্ঞানের গভীরতা
যখন ইমামুল হারামাইনের ইন্তেকাল হল�ো ও দালিলিক সক্ষমতার। ইমাম গাজালির
গাজালি তখন নিশাপুর থেকে মুআসকার প্রতিভায় নিজামুল মুলক যারপরনাই মুগ্ধ
অঞ্চলের দিকে রওয়ানা হলেন। মুআসকার হল�ো হলেন। তাকে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করলেন
নিশাপুরে কাছেই বিশেষ একটি এলাকার নাম। বাগদাদে অবস্থিত মাদরাসায়ে নেজামিয়ায়। সে

তিনি নিশাপুরের নেজামিয়া মাদরাসায় যাওয়ার পর আমি অনেক বার তার


সাক্ষাতে গিয়েছি। আগে তিনি উচ্চারণে, ভাবনার গভীরতায়, জ্ঞানে,
এবং আশ্চর্য সুন্দর বিশুদ্ধ বাক্য নির্মানের শক্তিতে আত্মপ্রতারিত হয়ে
নিজের সমকালীন ল�োকদের সাথে যে গর্ব দেখাতেন, তাদেরকে যে
তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সাথে বিচার করতেন, আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তালাশ করলাম
সেসবের ক�োন কিছু এখনও পাওয়া যায় কি না; কিন্তু দেখলাম এ এক অন্য
গাজালি। আগের চেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত এক মানুষ। ক�োমল, নরম, বিনয়ী
এবং পুরন�ো সমস্ত বিচ্যূতি থেকে মুক্ত একজন নির্মল মানুষ।

সেখানে ছিলেন ওজির নিজামুলমূলক। তার সময় নেজামিয়া মাদরাসাটি ছিল পৃথিবী বিখ্যাত
দরবারে পণ্ডিতদের আসর বসত�ো নিয়মিত। এবং আরবসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের একমাত্র
দেশের বাছাই করা পণ্ডিতগণ উচ্চতর আলাপ বিশ্ববিদ্যালয়।
আল�োচনায় মজলিস গুলজার করে রাখতেন
ইমাম গাজ্জালী সেখানে একটা সময় পর্যন্ত
সবসময়। ইমাম গাজালি তাদের সাথে গিয়ে
শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জ্ঞানী
য�োগ দিলেন। অত্যন্ত আগ্রহ ও প্রতাপ নিয়ে
ও দক্ষ শিক্ষাগুরু হিসেবে তার মর্যাদার আসন
সবার সাথে অংশ নিলেন পাণ্ডিত্যপূর্ণ সেসব
অনেক উঁচু হয়ে উঠল�ো। জ্ঞানগত উৎকর্ষে তিনি
আল�োচনায়। এমন মজলিসে পণ্ডিতে পণ্ডিতে
পরিণত হলেন অসাধারণ এক প্রবাদ পুরুষে।
বিতর্ক হওয়া ছিল সাধারণ নিয়ম। দেখা গেল
বিভিন্ন শহর নগর ও অঞ্চল হতে মানুষ দলে
অক্টোবর ২০২৩ 56
দলে তার কাছে আসতে লাগল�ো। একই সাথে তার অমূল্য বইপত্র
বিপুলভাবে ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর দিক দিগন্তে। খেয়াল করলে দেখা
যায়, সে সময়টিতে ইমাম গাজ্জালী আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন গ্রন্থ
রচনা, বিতর্ক, শিক্ষকতা এবং প্রচলিত দার্শনিক মতবাদ গুল�োর
তালাশসহ জ্ঞানগত বিচিত্র কর্মকাণ্ডের ভিতর। এসব কাজে তাকে
অনুপ্রাণিত করেছিল খ্যাতির ম�োহ, প্রসিদ্ধি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং
প্রতিপক্ষকে চুপ করিয়ে দেওয়ার গ�োপন ল�োভ। এ বিষয়টি তিনি
তার আত্মজীবনী আল মুনকিদ মিনাদ দালাল গ্রন্থে নিজেই স্বীকার
করেছেন। শুধু তাই নয়, তার মানসিক অবস্থাটি তখন আর�ো অদ্ভুত
ছিল, যা পরবর্তী গাজালির সাথে ক�োনভাবেই মিলান�ো যায় না।
নিজের জ্ঞান নিয়ে তার গর্ব ছিল সীমাহীন এবং তা যে তিনি যত্ন করে
লুকিয়ে রাখতেন এমন নয়, সেই সাথে প্রতিপক্ষ বা বিদ্যান অন্য যে
কাউকে দেখতেন খুবেই তুচ্ছ নজরে।
তবে এটা সত্য যে, তিনি তার সমস্ত গর্ব ও অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ আমি ইমাম
সত্ত্বেও দাঁড়িয়েছিলেন সত্যের পক্ষেই। তাঁর এই জ্ঞানগত কর্মকাণ্ড
গাজালিকে দেখলাম
জাতিকে উপকৃত করছিল বিপুলভাবে। জনমনে ছড়িয়ে পড়া নানাবিধ
দ্বিধা ও সংশয়কে সমূলে উৎপাঠিত করছিলেন অপ্রতির�োধ্য দলিল এলাকায় ঘুরাফেরা
প্রমাণ দিয়ে। ইসলামী আকিদাকে নষ্ট করার জন্য বিভিন্ন দিক থেকে করছেন। হাতে
ধেয়ে আসা বিভ্রান্ত দার্শনিক আক্রমণকে তিনি প্রতিহত করছিলেন একটি লাঠি, পরনে
বীর বিক্রমে। এক কথায় যদি বলতে হয় আল্লাহ তাআলা তার জবান, সুফিদের মত�ো তালি
বর্ণনা ও জ্ঞান থেকে এমন এক য�োদ্ধাকে প্রস্তুত করেছিলেন যে
দেওয়া জীর্ণ জামা,
অপ্রতির�োধ একাডেমিক দলিল প্রমাণ দিয়ে দিনের পক্ষে লড়াই
করছিল। গলায় চামড়ার
ছ�োট একটি পানির
তারপর আচানক তার ব�োধ�োদয় হল�ো। তিনি আত্মহমিকা ও খ্যাতির
ম�োহ নামক যে গ�োলক ধাঁধায় আটকে পড়েছিলেন, সে ব্যাপারে পাত্র। অথচ এই
সচেতন হয়ে উঠলেন। এই আত্মউপলব্ধির পরই তার হৃদয়ে জাগল�ো মানুষটাকেই আমি
সীমাহীন এক বিষাদ ও শূন্যতা। যে জ্ঞানগত কর্মের শক্তিতে তিনি বাগদাদে দেখেছি কী
সম্মানের সর্বোচ্চ চড়ায় উঠে এসেছেন এবং নির্বিশেষে সবার হৃদয় শানশ�ৌকত নিয়ে
জয় করেছেন অপরিসীম মুগ্ধতায়, সম্মানের সে জীবনটি চালিয়ে নিতে
দরস দিচ্ছেন।
ভিতরে তৈরি হল�ো প্রবল এক অসমর্থন। বলা যায় তিনি তার এই
অক্টোবর ২০২৩ 57
জীবনটিকে ঘৃণা করতে শুরু করলেন। মানসিক তিনি, সাথে সাথে সেখান থেকে চলে যেতেন
অস্থিরতা বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে এমন অন্য ক�োথাও। ক�োন ক�োন সময় এমনকি সেই
হল�ো—তিনি মান সম্মান খ্যাতি ও প্রতিপত্তি শহরটি থেকেই কিছুদিনের জন্য গায়েব হয়ে
সকল কিছু ফেলে বেরিয়ে পড়লেন সুদূরের পথে। যেতেন। তারপর ল�োকেদের মাঝে তার বিষয়ে
বহুদিনের সাধনায় ও অভাবনীয় কর্মচঞ্চল্যে আলাপ আল�োচনা যখন স্তিমিত হয়ে আসত�ো,
জ্ঞানগত নেতৃত্বের যে সুউচ্চ আসনটি নির্মাণ তখন আবার ফিরে আসতেন অন্য ক�োন
করেছিলেন, একে নিমিষে পরিত্যাগ করে ধারণ ফকিরের বেশে। এই সময়টাতে তিনি নিজেকে
করলেন সাধারণ এক ফকিরের বেশ, প্রবেশ বদলে ফেলার এক কঠিন সাধনায় নিমগ্ন হয়ে
করলেন তাদের সাদামাটা জীবনের ভিতর। রইলেন। এত�োদিনকার পরিচিত পৃথিবী থেকে
তার ভেতরে যে গভীর আত্মোপলব্ধির জন্ম বিচ্ছিন্ন হয়ে নিভৃতভাবে আত্মনিয়�োগ করলেন
নিয়েছিল এবং সে থেকে যে মর্মপীড়ায় অস্থির আত্মশুদ্ধির অভিযানে। কীভাবে গাফেল
হয়েছিলেন, হৃদয়ের এই যন্ত্রণা থেকে তিনি মুক্তি অন্তরকে সজাগ করে সত্যিকারের মানুষ
পেতে চাচ্ছিলেন ব্যাকুল হয়ে। এই ব্যকুলতাই হয়ে উঠা যায় সেই সাধনায় কাটল দিন আর
একসময় তাকে নামিয়ে আনল�ো পথে, দীন এক রাতগুল�ো। আত্মসচেতনতার এই কালটিতেই
মুসাফিরের বেশে। দেখা গেল মাদ্রাসা নেজামিয়া তিনি রচনা করেন তার জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ ইহয়াউ
ও সংশ্লিষ্ট সকল কিছু থেকে বিমুখ হয়ে একদিন উলূমিদ্দিন।
তিনি বাইতুল্লার পথে কাফেলাবদ্ধ হলেন। ইবনুল ইমাদ তার শাযারাতুয যাহাব গ্রন্থে
সময়টা ছিল ৪৮৮ হিজরী সন। হজ সমাপ্ত প্রসিদ্ধ মালেকি আলেম আবু বকর ইবনুল
করে তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস জিয়ারতে গেলেন। আরাবির সূত্রে লেখেন, তিনি বলেন, আমি
সেখান থেকে ফিরে এসে বসবাস করতে শুরু ইমাম গাজালিকে দেখলাম এলাকায় ঘুরাফেরা
করলেন দামেস্কের একটি জায়গায়, জামে করছেন। হাতে একটি লাঠি, পরনে সুফিদের
মসজিদের মিনারার নিচে। ক�োন ক�োন সময় মত�ো তালি দেওয়া জীর্ণ জামা, গলায় চামড়ার
মিনারার উপরেও থেকেছেন। আপন মাতৃভূমি ছ�োট একটি পানির পাত্র। অথচ এই মানুষটাকেই
ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনের এই সময়টি ছিল ম�োট আমি বাগদাদে দেখেছি কী শানশ�ৌকত নিয়ে
৯ বছর। দীর্ঘ এই সময়ের বেশিরভাগটুকু তিনি দরস দিচ্ছেন। বড় বড় জ্ঞানী গুণী চারশ�ো
দামেস্কেই ছিলেন, সাধারণ এক ফকিরের পাগড়ি সমবেত হত�ো তার মজলিসগুল�োতে।
বেশে, নিতান্ত অপরিচিত মানুষের মত। এই চাতক পাখির মত�ো আগ্রহ ভরে জ্ঞান আহরণ
সময়ে যদি কখন�ো টের পেতেন আশপাশের করত�ো তার থেকে। আমি তার কাছে গিয়ে
ল�োকজন তার ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠছে বা সালাম দিলাম। বললা, হে ইমাম, বাগদাদে
তার জ্ঞানের আভাস পেয়ে ভীড় জমাতে শুরু পাঠদান করা কি এর চেয়ে ভাল�ো ছিল না? এ
করছে, এবং ধীরে আবার�ো প্রশিদ্ধ হয়ে উঠছেন
অক্টোবর ২০২৩ 58
কথা শ�োনামাত্র তিনি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে আসে তাদের সাথে। সে সময় আল্লাহ চাইলেন
তাকালেন। তারপর বললেন, ইচ্ছার আকাশে তার গ্রন্থগুল�ো আর�ো বেশি প্রশিদ্ধি পাক,
যখন জাগল�ো স�ৌভাগ্যের পূর্ণিমা চাঁদ, আসল ছড়িয়ে পড়ুক আগের চেয়েও বেশি এলাকাজুড়ে
গন্তব্যের অস্তাচলে ঝুঁকে এল�ো প্রত্যাবর্তেনের পৃথিবীর দিকদিগন্তে। বিশেষ করে ইয়াহয়াউ
সূর্যটা, তখন: উলূমিদ্দিন ও আল আরবাঈন ফি উসূলিদ্দিন
রাতের প্রিয়জন ও সুখের মূহুর্তকে দূরে ফেলে, গ্রন্থ দুট�ো।
আকুল হয়ে ফিরে এলাম প্রথম আঙ্গিনায়।
সকল ভাল�োবাসা, প্রেম আর আগ্রহ বলল�ো ডেকে—
সে সময় উজিরের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন
থাম�ো, এই ত�ো, এখানেই ঘর, প্রেমিকদের ঠিকানা এই; ফখরুল মালিক জামালুশশুহাদা। তিনি
ধীরে চল�ো, নেমে পড়ো এখানেই, এই ত�ো আবাস। ইতিমধ্যেই ইমাম গাজালির মর্যাদা ও মহত্বের
বন্ধু, তাদের জন্য মিহি সুতায় কাপড় বুনেছি অনেক; কথা শুনতে পেয়েছেন। ফলে, খ�োরাসান
কিন্তু আমার কাপড়টি বুনবে কে? কেউ নেই।
তারপর এই ভেবে আমার চরকাটি ভেঙে গেল শেষে!
থেকে ছুটে এলেন সাক্ষাত করে তাঁর বরকতময়
সাহচর্য লাভ করার জন্য এবং তার ইলম থেকে

কিন্তু এবারের ফিরে আসাটা ছিল অন্যরকম। তর্কযুদ্ধে সমকালীন বিদ্যানদের


হারিয়ে ফেলার বাসনা, বির�োধীদের সাথে বিতণ্ডার ল�োভ এবং সম্মান ও
খ্যাতির যে ম�োহমালা নিজের গলা থেকে খুলে এসেছেন, তা পড়ে রইল�ো
আপন জায়গাতেই। ইমাম গাজালি সেদিকে ফিরেও তাকালেন না।

এর কিছু দিন পর তিনি দেশে ফিরে এলেন। উপকৃত হওয়ার জন্য। এরপর যখন সাক্ষাত
কিন্তু আগের মত�ো সেই ব্যস্ততা নেই। সবসময় হল�ো, তাকে দেখলেন, তার কথা শুনলেন,
জিকির ও ইবাদ বন্দেগিতে মগ্ন থেকে ধ্যানী এক তখন ‍ইমামের প্রতি তার ভাল�োবাসা আর শ্রদ্ধা
মানুষের মত�ো জীবন কাটাতে লাগলেন। নিজের আর�ো অনেকগুন বেড়ে গেল। তার নসীহত
সবটুকু মন�োয�োগ ও সামর্থ ব্যয় করে ভবিষ্যত ও আল�োচনা দ্বারা অসম্ভব প্রভাবিত হলেন।
গন্তব্য পরকালের জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলেন মনে মনে ভাবলেন যেভাবেই হ�োক গুনী এই
রাতদিন। আগের মত�ো আত্মমগ্ন হয়ে থাকা মানুষটিকে নিয়ে যেতে হবে। সেমতে প্রথমে
শশব্যস্ত মানুষটি নয়; তার বাড়ির দূয়ার এখন নিজের আকাঙক্ষার কথা ব্যক্ত করলেন, তারপর
হাট করে খ�োলা থাকে। প্রশস্ত ও প্রশান্তির এক পর্যায়ে জ�োর করে ধরলেন—যেতেই হবে।
সাথে সাক্ষাত করেন দর্শনার্থীদের সাথে, এমন মহান একজন মানুষের জ্ঞান ও হিকমত
ছাত্রদের সাথে, যারা নসীহ ও পরামর্শের জন্য এক জায়গায় এভাবে বন্দি হয়ে থাকবে, তার

অক্টোবর ২০২৩ 59
থেকে মানুষ উপকৃত হওয়ার সুয�োগ পাবে না, পুরন�ো সমস্ত বিচ্যূতি থেকে মুক্ত একজন নির্মল
তা হতে পারে না। খুব জ�োর দিয়ে আবেদন মানুষ।
জানালেন, তিনি যেন মাদরাসা মাইমুনিয়া মনে মনে ভাবলাম, এসব হয়ত�ো তার
নিজামিয়াতে শিক্ষকতার দায়িত্বটি কবুল করেন। ল�োক দেখান�ো আচরণ। ল�ৌকিকতার একটা
এমন তাগিদের সাথে যখন প্রস্তাব এল�ো, তাও বিভ্রান্তিকর পর্দা ক�ৌশলে টেনে দিয়েছেন নিজের
সরাসরির শাসকের পক্ষ হতে, ইমাম গাজালি উপর, নিজেকে সুন্দর দেখান�োর জন্য, আর�ো
একে উপেক্ষা করার সুয�োগ পেলেন না। ফলে, বেশি প্রশংসা পাবার আশায়। কিন্তু একসময়
আবার ফিরে গেলেন পুরন�ো শিক্ষকতায়, আগের পরিস্কার হল�ো, আমার এসব অনুমান নিতান্তই
দিনগুল�োর মত�ো শিক্ষার্থীদের জ্ঞানপিপাসা ভুল। এ ল�োক আসলেই আগের পাগলামি
মিটান�োর মহান কর্মে। কিন্তু এবারের ফিরে থেকে পুর�োপুরি জেগে উঠেছে।
আসাটা ছিল অন্যরকম। তর্কযুদ্ধে সমকালীন তিনি আর�ো বলেন, আমরা জিজ্ঞেস করলাম,
বিদ্যানদের হারিয়ে ফেলার বাসনা, বির�োধীদের কীসের নেশা তাকে বাড়ি থেকে বের নিয়ে
সাথে বিতণ্ডার ল�োভ এবং সম্মান ও খ্যাতির যে
গিয়েছিল, এখন আবার কেনই বা নিশাপুরে
ম�োহমালা নিজের গলা থেকে খুলে এসেছেন, মাদরাসায়ে নেজামিয়ায় পড়াতে এলেন। জবাবে
তা পড়ে রইল�ো আপন জায়গাতেই। ইমাম তিনি বললেন, দাওয়াতের কাজ থেকে বিরত
গাজালি সেদিকে ফিরেও তাকালেন না। থাকা এবং জ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীদেরকে উপকার
ইমাম গাজালির সমসাময়িক মানুষ আবদুল থেকে বঞ্চিত রাখা আমি নিজের জন্য বৈধ মনে
গাফির ইবনে ইসমাইল আল ফারিসির সূত্রে করিনি। সত্যকে প্রকাশ করা, সত্য উচ্চারণ
ইবনে আসাকির বর্ণনা করেন: তিনি নিশাপুরের করা এবং সত্যের পথে মানুষকে ডাকা আমার
নেজামিয়া মাদরাসায় যাওয়ার পর আমি একান্ত কর্তব্য।
অনেক বার তার সাক্ষাতে গিয়েছি। আগে এরপর তিনি আবার�ো বাড়ি ফিরে এলেন।
তিনি উচ্চারণে, ভাবনার গভীরতায়, জ্ঞানে, এসে ঘরের পাশেই শিক্ষার্থীদের জন্য খুললেন
এবং আশ্চর্য সুন্দর বিশুদ্ধ বাক্য নির্মানের একটি মাদরাসাসা, সাথে একটি খানকাহও।
শক্তিতে আত্মপ্রতারিত হয়ে নিজের সমকালীন আত্মশুদ্ধিতে আগ্রহী সালেকীনগণ এখানে
ল�োকদের সাথে যে গর্ব দেখাতেন, তাদেরকে এসে তাসাওউফ ও তাজকিয়ার পাঠ গ্রহণ
যে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সাথে বিচার করতেন, আমি করেন। এ দিনগুল�োতে তিনি তার পুর�ো
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তালাশ করলাম সেসবের ক�োন সময়টা কয়েকটি কাজে ভাগ করে নিয়েছিলেন:
কিছু এখনও পাওয়া যায় কি না; কিন্তু দেখলাম কুরআন তেলওয়াত, সালেকীনদের সাথে বসা,
এ এক অন্য গাজালি। আগের চেয়ে সম্পূর্ণ শিক্ষার্থীদের ক্লাস করান�ো। পাশাপাশি হাদীস
বিপরীত এক মানুষ। ক�োমল, নরম, বিনয়ী এবং
অক্টোবর ২০২৩ 60
অধ্যয়ন করা, মুহাদ্দিসীনদের মজলিসে বসা আহমদ বলেছেন: স�োমবার দিন সকালে ভাই
এবং সহীহ বুখারী ও মুসলিম পাঠ করা। ইমাম আবু হামেদ অজু করে নামাজ পড়লেন, তারপর
যাহাবি, ইবনে আসাকির ও অন্যান্য মনীষীগণ বললেন, আমার কাফনটা নিয়ে এস�ো। আনার
বলেছেন: যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে অল্প পর তিনি কাপড়টিতে চুমু খেলেন, তারপর
কিছুদিনের ভিতরে এই শাস্ত্রেও তিনি সবাইকে দুচ�োখের উপর রেখে বললেন: আল্লাহর কাছে
পেছনে ফেলে অনেকদূর এগিয়ে যেতেন। কিন্তু ফিরে যেতে আমি প্রস্তুত, সানন্দে, আনুগত্যের
মৃত্যু তাকে সে সময়টি দিল না। তার মৃত্যুর সাথে। এরপর পা দুট�ো ছড়িয়ে দিয়ে কিবলামুখ�ো
দিনটি ছিল স�োমবার, জুমাদাল উখরার ১৪ হলেন এবং দিনের আল�ো ভাল�োমত�ো ফুটে
তারিখ, ৫০৫ হিজরী। উঠবার আগেই ইন্তেকাল করলেন।
সিবত ইবনুল জাওযী রহ. তার দাদার সূত্রে বর্ণনা আল্লাহ তাঁর আত্মাকে পবিত্র রাখুন।
করেন: ইমাম গাজালি রহ. এর আপন ভাই উৎস: শাখসিয়্যাত ইস্তাওকাফাতনি। পৃ. ৮২-৮৮

অক্টোবর ২০২৩ 61

You might also like