You are on page 1of 6

উত্তু রের বাতাস

গৌতম রায়

সকাল বেলা দরজা খুলতেই এক পশলা বাতাস আদর করে দিয়ে যায়। আগের রাতের শেভ করা গালে নতু ন ব্রণের মতো
অযাচিত শিহরণ জাগায়। এক হাতে বড় ব্যাগ, কাঁধে ল্যাপটপের পুলিন্দা, চোখে চশমা, কিংবা আলোঝলমলে দ্যুতি- একগুচ্ছ
আনন্দ- সব মিলিয়ে খুব সকালেই বাসা থেকে বের হন আমাদের এই দিনপঞ্জির মূল চরিত্র।

ছুটির দিনের মতোই সকাল। অন্যান্য সপ্তাহ হলে হয়তো বিছানার উষ্ণ সান্নিধ্য কিংবা ঘুমের সাথে রতিক্রিয়া ছেড়ে উঠতে মন
চাইতো না। কিন্তু সারা দেশের কাছে বিহ্বল হয়ে থাকা ঢাকা শহর ক্রমেই প্রান্তিক হতে থাকা মানুষের কাছে শেকড়ের কাছে ফিরে
যাওয়াটা রতিক্রিয়ার চাইতেও মোহময়, স্খলনজনিতআনন্দময়। ফলে চা কিংবা নাস্তা না করেই অফিসবরাদ্দকৃ ত গাড়িটি ছুটে
চলে উত্তু রের দিকে, উত্তরের দিকে।

গৌতম নামের এক বালকের দিনযাপনের কাহিনীগুলো প্রায়ই একঘেঁয়ে। কখনও কখনও সেগুলো প্রবল আত্মবিশ্বাস ও
উদ্দীপনায় ভরা, কখনও নিশ্চু প কোনো আউটসাইডারের এক বিবমিষাজনিত আত্মঅহংকার কিংবা অভিমানে ভরা জীবনে
বলক দিয়ে আসা ফেনাময়। অফিস থেকে তাই যখন ঢাকার বাইরে কাজ করার কথা উঠে,তখন সেখানে প্রাণপ্রাচু র্যের
দুর্বাঘাসগুলো লকলকিয়ে উঠে।

গাড়ির ভেতর এফএম রেডিও চলছে, পত্রিকা পড়ার মতো বিলাসিতাটা ত্যাগ করার চেষ্টা থাকলেও একসময় প্রাত্যকর্মের
মতোই তাগিদ অনুভব করে গৌতম। জীবনের দায় বুঝে ফেলার মতো শিক্ষাটা মানুষ পেয়ে গেলে তখন থেকেই পরাধীনতার
শুরু। জীবনের সাথে রাষ্ট্র যুক্ত হলে এ দায় শিকল হয়ে ঝু লে পড়ে। তাই রাস্তার অ্যাক্সিডেন্টের খবরগুলো কিছুটা হলেও
চিন্তাযুক্ত করে গৌতমকে- একবার ভাবে, আজকে এরকম একটা অ্যাক্সিডেন্ট হলে কি খুব খারাপ হবে?

ঠিক এসময় উত্তরবঙ্গ থেকেই একটা ফোন। একেবারেই অপরিচিত কিন্তু বহুল আন্তরিক ও প্রাচু র্যময় কণ্ঠ- আপনি এখন
কোথায়? গৌতম অনুভব করে-

রক্তে তার বান হেনেছে

ডাকছে ওই উত্তরের বাতাস, মানুষ নয়তো-

পুরো উত্তর ভর করেছে

ওই মানবীর কণ্ঠে হয়তো।

২.

জীবনকে পাশ কাটিয়ে চলার মতো অনেক উপাদানই আছে, হয়তো। আপনি চাইলেই জীবনের বহু প্রাচু র্য কিংবা বহু
পঙ্কিলতাকে অনায়াসেই পাশ কাটিয়ে যেতে পারবেন। কালিয়াকৈরের বাইপাস রাস্তাটু কু পার হওয়ার সময় গৌতম হিসেব
করতে বসে- এই জীবনে সে কতোজনের বাইপাস হয়েছে? হঠাৎ একসময় ধন্দে পড়ে যায়- সে নিজেই কি মানুষকে বাইপাস
করছে না? কালিয়াকৈরের গ্যাঞ্জামগুলো স্তিমিত হয়েছে, গৌতম হঠাৎই বুঝতে পারে- গ্যাঞ্জামের কারণে বাইপাস করলে
জীবনের প্রাচু র্য বা পঙ্কিলতা হয়তো স্পর্শই করে না; কিন্তু সদর রাস্তা প্রাণহীন হয়ে পড়ে।

৩.

তবে কি পত্রিকার বাস্তব চিত্রগুলো ফু টে উঠছে রাস্তায় রাস্তায়। গৌতম জানালা দিয়েই দুমড়েমুচড়ে যাওয়া বাস কিংবা
ট্রাকগুলোর বডির চিৎকার যেন শুনতে পায়। এই সময় আবার এফএম রেডিও জানায়- ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে এক সড়ক
দুর্ঘটনায় দশ জনের মৃত্যু। জীবন যেনো মেতেছে মৃত্যুর উৎসবে! এই উৎসবের মাঝেই চলে আহারক্রিয়ার মতো যাবতীয়
সম্ভোগের ইভেন্টগুলো। পাকু ল্লার এক চা দোকানদার বহুদিন ধরেই বিক্রি করতেন গরুর দুধের চা। বিশ্ব মন্দা তাঁকে আক্রান্ত
করেছে কিনা জিজ্ঞেস করলে হয়তো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবেন, কিন্তু এটা বুঝেন- মানুষ এখন ছয় টাকা দিয়ে দুধ-চা
খেতে চাইবে না। ফলে লেবুযুক্ত লাল চা মনে করিয়ে দেয় কোনো এক লাল পতাকার কথা যেখানে সমস্যা নামক শব্দটি
বিসর্জি ত হলেও সমাধানের অনস্তিত্ব ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছিলো দিনে দিনে। সব লাল একদিন মিশে গিয়েছিলো সূর্যাস্তের
লালিমায়।

৪.

আমি, এই দিনপঞ্জির লেখক এবার উপর থেকে তাকাই গৌতমের দিকে। গাড়ির এসির বাতাসে চু ল উড়ছে না ঠিক, মুখের
ওপর শীতল বাতাস শরীরের অনাবৃত অংশের রোমগুলোকে সটান করে তু লছে। মুখের ওপর কিছু খেলা করছে কিনা দেখার
জন্য তাকাতেই সামনে গাড়ির আয়না চোখে পড়ে। পেছন থেকে আসা আরও অনেক বড় গাড়ি উত্তর দিয়ে যায়- শুধু একটি
মুখ দেখার জন্যই আয়না নয়; দেখ, সহস্র পদার্থ- হয়তো প্রতিপদার্থও- তোমাকে দেখছে তোমারই মুখ দিয়ে তোমারই আয়নায়।

৫.

মাত্র চারশটা টাকা দিয়ে গৌতমের গাড়ি যমুনা নদীকে পদানত করেছে। নিচ দিয়ে কোটি কোটি কিউসেক পানি সময়ের প্রবাহে
গড়িয়ে চললেও উপরে পাষাণের হৃদয়বৃত্তির মতো জেগে থাকা সেতু গৌতমের গাড়িটিকে সঙ্গী করেছে। নিচের পানি দুফোটা
অশ্রু ফেলে- আমার উপর গিয়ে গেলে, আমাকে ছুঁ য়ে গেলে না?

গৌতম স্মিতমুখে হাসে- এ হলো আমার সূক্ষ্ম প্রতিশোধ।

যমুনা বুঝে না। তিরতির করে কয়েকটন পানি এগিয়ে দেন বঙ্গোপাসাগরের থলেতে। প্রতি মুহূর্তে নিজের বক্ষের ধন উগরে দিয়ে
দায়শোধ করছে যমুনা। বুকের পাষাণ নামে, নতু ন পাষাণের বসতি গড়ে। গৌতমের প্রতিশোধ শুনে বুক ভেদ করে জেড়ে ওঠা
চরের কাশফু লগুলো আন্দোলিত হয়। পরগাছাদের প্রতিশোধ ভয়ঙ্কর!

৬.

অসংখ্য বাঁক পেরিয়ে গৌতমের গাড়ি এগিয়ে যেতে থাকে। প্রতিটা বাঁকের কোণায় গৌতমের মনে পড়ে আরও কিছু বাঁকের
কথা, যেগুলোর কিছুটা সে দেখেছিলো, অনেকগুলোই দেখে নি। ওই বাঁকগুলো পেরুতে পারলে কি জীবনটা থিতু হতো?

বগুড়া পার হওয়ার সময় ঝাঁকু নি না পেয়ে বিস্মিতই হয় গৌতম। এই মাত্র বছরখানেক আগেও এদিক দিয়ে ঘুরে গেছে সে।
তখন কতো চড়াই-উৎরাই ছিলো এই রাস্তার! বন্ধু র পথ পাড়ি দিতে গিয়ে কতো মানুষ মারা গেছে! মাত্র একটা বছরেই কি
চড়াই-উৎরাইয়ের জীবন মসৃণ হতে পারে! একটা পিচঢালা কালো মিশমিশে পথ সঙ্গীসাথীমানুষদের জীবনটাকে পিচ্ছিল করে
তু লতে পারে?

অসংখ্য প্রশ্ন। উত্তর অনির্দি ষ্ট। গাইবান্ধার পথ পেরুতে পেরুতে অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলে, অধিকাংশ প্রশ্ন নিজেই নিজের
কাছে আড়াল তু লে রাখে।

৭.

ছটফটে সন্ধ্যেটায় আবার বগুড়া শহরে ফিরে আসে গৌতম। সাতমাথার মোড়ে বগুড়ার বিখ্যাত দই খেতে খেতে ভাবে- ব্র্যান্ড
জিনিসটা কতোই না শক্তিশালী! একবার শুধু শোয়া থেকে উঠতে পারলেই হলো, কয়েক প্রজন্মের মানুষকে চিবড়ে খেতে
পারবে! এই দই কি ঢাকাতে নেই?

আছে হয়তো। কিন্তু সকালবেলা যে বগুড়া ডাক দিয়েছিলো গৌতমকে তাঁর যে কোনো খোঁজ নেই! হারিয়ে গেলো? নাকি যত্ন
করে ভু লেই গেলো?
পকেটফোনটা বের করে সুমিষ্ঠ কণ্ঠের 'আপনি ভু ল নম্বরে ডায়াল করেছেন' কিংবা 'আপনার ডায়ালকৃ ত নম্বরটি এই মুহূর্তে
ব্যস্ত আছে' শুনবে বলে কানে লাগায়। কিন্তু পরিবর্তে দীর্ঘায়িত টু ট শব্দগুলো বুঝিয়ে দেয়- পৃথিবী আসলেই অধরা।

একটু রাতে বগুড়া আবার ডাকে গৌতমকে। উপলব্ধিজাত কথাগুলোয় গৌতম বুঝে- অপর পৃথিবী আসলে এই পৃথিবীর
মতোই মায়াময়, কিন্তু কষ্টসঞ্জাতরসে তার বসবাস।

রাত বাড়ে, গভীর হয়। আবারও এসি রুমে এসি ছেড়ে ল্যাপটপে গৌতম দিনপঞ্জি লিখতে বসে।

বিধাতা অলক্ষ্যে হাসেন- যে ঢাকাকে ছেড়ে গৌতম বেরিয়েছে তৃ প্তির উদ্দেশ্যে, সেই ঢাকা আসলে বাস করে গৌতমের মাথায়।

বিধাতা হাসেন কি?

আজ রাতে বগুড়াতে গৌতমের ঘুম হবে না। শরীর জানান দিচ্ছে, কারো এক বিহ্বলতা তাকে জাগিয়ে রেখে নিজে ঘুমুচ্ছে
পুরো সত্ত্বার ভেতর।

৮.

শেভ করা গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি ওঠে; আগের রাতে মাটিতে বীজ ফেলে রাখার মতো - ভোরবেলা চারাগাছগুলো উঁকিঝুঁকি
দিতে শুরু করলে পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কৌতু হলে যেমন দেখে- গাড়ির আয়না দিয়ে গৌতম তেমনই নিজের গাল
দেখছে। এই শেভ করা নিয়ে বিধাতার প্রতি গৌতমের প্রবল রাগ ছিলো- কী দরকার ছিলো পুরুষদের শুধু শুধু হয়রানি করার!
একদিন-দুদিন পরপর এই ঝামেলা কে করবে! কী আরামেই না আছে মেয়েরা! কিন্তু যেদিন ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ সম্পর্কে জানলো
একটু ভালোভাবে, বিধাতার ওপর সমস্ত রাগ শুধু তু লেই নিলো না, পাল্টারাগে ভস্মীভূ ত করে দিলো। আহারে! তার
আপনজনকে যে যদি প্রতিমাসে প্রবলতার মুখোমুখি হতে হয়! শেভ করা তো তু চ্ছ!

এক একটি বাজার যায়, এক এক ধরনের মানুষের আচরণ বদলাতে থাকে। বদলাতে থাকে চারপাশের চরিত্র। এমনকি গাড়ির
ড্রাইভারেরও। এই দেখুন, গৌতম কিন্তু একবারও তার সহযাত্রীর নামটি আপনাদের বলে নি! কেন? তাকে কি ভু লে ছিলো?
নাকি মানমর্যাদার প্রশ্ন নিয়ে ভ্রমণসঙ্গীকে আলাদা করার অবচেতন প্রচেষ্টা তার বুকেও জমে আছে?

সহযাত্রী এবং চালক হুমায়ূন কবীর। উদ্দাম যুবক, চা-পিয়াসী, গৌতমের মতোই। ফলে যেখানে সেখানে চায়ের আড্ডা জমে
যায় দুজনে। বগুড়া বাসস্ট্যান্ডে গরুর দুধের চা পাওয়া যায়, সেখানে সকালবেলার চা খাওয়ার পর একটানে রংপুরে। আজকের
রাতটা এখানেই! কিন্তু তার আগে যেতে হবে কু ড়িগ্রাম।

৯.

এই জীবনে গৌতম কয়টা জীবনকে সঙ্গী করেছে জানি না, কয়টা জীবনে সঙ্গী হয়েছে- তাও জানি না। কিন্তু জীবনের
প্রবহমানতার ভেতরে চলতে চলতে সে অসংখ্যবার টের পেয়েছে- বাইরের পরিচিত রূপ থেকে কোনো এক প্রভাবকের ক্রিয়ায়
বের হতে নতু নতর অন্য কোনো সত্ত্বা। হালকা বৃষ্টির পর কালো পিচ ঢালা পথে যে সাদা ফেনাভ ঢেউ উঠে, বাতাসের এবং
রাস্তার গলে যাওয়া বিটু মিনে অ্যাসিড গলে গলে সাদা হতে থাকে। শিশুতোষ চোখে চালকের ব্যাখ্যা শুনে- 'এইরহম বিরিস্টি
বালা না। গাড়ি চালাইতে বহুত পরবলেম। খালি পিসলা খায়।' সামনে আস্তে ধীরে চলতে থাকা ট্রাক সাইড দিতে চায় না,
কথার ফাঁকেই ঝড়ো হাওয়া বইতে থাকে- শিলাবৃষ্টি হবে কি?

১০.

মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে। কোন মা? না, জন্মদাত্রী নয়; তিস্তা ব্রিজ পার হওয়ার সময় খুব করুণ চোখে দেখে নদীর বুকে পানির
হাহাকার। আসার সময় যমুনার যে প্রবল জলভার দেখে এসেছিলো গৌতম, এখানে তো তার শিশুটিও নেই। এই তিস্তাই কি
একদিন যমুনাকে পানি দেয় নি? তিস্তার স্তন্যামৃত পান করেই কি যুমনা আজকের যুবক হয়ে উঠে নি? তিস্তা তবুও অভিশাপ
দেয় না, খালি দেখে, কী অবহেলায় মানুষ তার ওপর আরেকটা সেতু তৈরি করছে। হাহাকার করে ওঠে- বুকের ওপর এতো খুঁটি
গেড়ে বসলে পাশ ফিরে শোয়া যাবে কি?

আস্তে আস্তে কু ড়িগ্রাম পার হয়ে গৌতমের গাড়ি চলে যায় নাগেশ্বরীতে। কী সুন্দর নাম! নাগেশ্বরী! নাগ+ঈশ্বরী? মানে মা মনসার
কোনো পুত্রজ হয়তো এখানে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলো। আরও সুন্দর সুন্দর নাম আছে কু ড়িগ্রামের উপজেলাগুলোর।
রৌমারী, ফু লবাড়ি, ভু রুঙ্গামারী...। ভু রুঙ্গামারী থেকে ঘুরে আসা যায় না?

খুব যায়! গাড়ি আস্তে আস্তে এগুতো থাকে। ওই তো ও পাশেই সীমান্ত। একটু ছুঁ য়ে যাওয়া যাবে কি? চায়ের দোকানদার সাবধান
করে দেয় গুড়ের চা বানাতে বানাতে। একটু পরে কার সাথে যেনো প্রবল ঝগড়া লাগে। মুখের বাণী উড়িয়ে নিয়ে যায় সব
অখণ্ডতা। বাংলাতে গালি দিয়ে শহুরে ভদ্রলোকরা শান্তি পান না; এ ভাষায় নাকি গালির অভাব। গৌতম কান খাড়া করে শুনে
দুর্বোধ্য, সাবলীল এবং আহ্লাদিত সব গালিগুলো। মুখস্থও করে রাখে কয়েকটা, কিন্তু ফিরতি পথে আসতে আসতে এক এক
করে সব ভু লে যায়। যেখানকার সম্পদ, নিজেকে সেখানেই রেখে দেয় প্রকৃ তি।

১১.

গৌতম পুরো পথটাই ঘুমোতে ঘুমোতে আসে। কী এক শ্রান্তিময় ঘুম! গৌতম প্রতিবারই ভাবে, ঢাকার বাইরে গিয়ে বুকভরে
বাতাস নিবে, পুরো শরীরের সব দূষিত বাতাস ফু সফু স থেকে একটানে বের করে দেবে, কিন্তু কোনোবারই তা মনে থাকে না। মনে
পড়ে ফেরার সময় আমিনবাজারের ইটের ভাটাগুলো দেখে। তখন মনে হয়, তাই তো এবারও বুক ভরা বাতাস নেওয়ার কথা
তো মনে পড়লো না?

প্রকৃ তি নামক বিধাতা হাসে। প্রকৃ তিতে গেলে কি মানুষের কৃ ত্রিমভাবে মনে করে বুক ভারা বাতাস নিতে হয়, বোকা ছেলে?
ঢাকার দূষিত বাতাস পেলে তবেই না মনে পড়বে বিশুদ্ধ বাতাসের কথা। দূষিত ছাড়া বিশুদ্ধের কোনো অস্তিত্ব নেই রে!

১২.

রাত দশটায় গৌতম ব্র্যাকের টার্ক থেকে বের হয় হাইওয়েতে। হাঁটতে হাঁটতে রাতের হাঁটে পৌছে। চা খেতে খেতে শুনে
দোকানদারে রাতের চিন্তাগুলো। না, বউয়ের কথা কেউ বলে না, কেউ বলে না একটা শান্তির ঘুমের কথা কিংবা সম্ভোগজীবনের
উপাখ্যানগুলো কেউ একটু নাড়াচাড়া করেও দেখে না, সবারই চিন্তা আগামীকাল নিয়ে।

এই পৃথিবীর বড় উৎকণ্ঠা এবং চিন্তাভাবনা আগামীকালকে ঘিরেই। কারো আগামীকাল আগামীকালেই, কারোরটা বা আরো
দুদিন পর, কিংবা বছরকয়েক পর।

বগুড়া থেকে রংপুর হয়ে কু ড়িগ্রামের ভু রুঙ্গামারী, সেখান থেকে পুনরায় রংপুর- এই দীর্ঘ যাত্রায় গৌতম কোনো মানুষ দেখে নি।
জনতা দেখেছে। রাতে শুয়ে শুয়ে অবাক হয়ে ভাবে সে- মানুষ দেখা বড়, না জনতা দেখা? ‘মানুষ জাগবে ফের, জাগবে মানুষ’
কথাটা কি সত্য? মানুষ কি আলাদাভাবে জাগতে পারে? জনতা জাগলে কি মানুষ জাগে না?

আজ রাতে জনতা গৌতম মানুষ গৌতমকে দহন করবে।

১৩.

মানুষ এক অবাক প্রাণী- চলতে গেলে থামতে চায়, থেমে থাকলে চলার প্রেমে মজে। সারাদিন গাড়ি ছুটছে তো ছুটছেই,
ছুটছেই, ছুটছেই... থামার ইচ্ছে বাড়ছেই, বাড়ছেই...

রংপুর পার হয়ে গাড়ি ছুটছে নীলফামারীর দিকে। উদ্দেশ্য ডোমার। দুটো সুন্দর জায়গা- ডোমার, ডিমলা। কেমন যেনো ডিম-
ডিম-ডোম-ডোম গন্ধ! সেই সাতসকালে ‘অংপুরত ছাড়ি’ আসার পর গাড়ি শুধু চলছেই, ডোমার যাবে, ডিমলা যাবে, ডিমলা
যাবে, ডোমার যাবে, ডোমলা যাবে, ডিমার যাবে, ডোমলা, ডিমার... গৌতমের কি তন্দ্রা এসে গিয়েছিলো? ডোমলা-ডিমার
জিনিসগুলো কী?

গাড়ির প্রবল ঝাঁকু নিতে তন্দ্রা ছুটে যায়। সিটবেল্ট বাঁধে নি, ড্যাশবোর্ডে মাথা ঠু কতে গিয়ে অল্পের জন্য নিজেকে সামলাতে
পারে- সামনের গাড়ি হঠাৎ করেই থেমে গেছে, থেমেছে আর আগেরটিও। কী যেনো ঝামেলা! দেখবে কি নেমে? কী দরকার? কী
দরকার ঝামেলায় জড়ানোর? কী দরকার?

ঢাকার শাহবাগে সেদিন দুটো মানুষ পড়েছিলো- নিথর হয়ে, সবাই দেখছে, মন্তব্য করছে, চলে যাচ্ছে। গৌতম দাঁড়িয়েছিলো
অনেকক্ষণ সেখানে। না, কিছুই করে নি। শুধু দাঁড়িয়ে ছিলো, দেখেছিলো মানুষের যাওয়া-আসার খেলা, একটা সময় সে
নিজেও চলে গিয়েছিলো গান গাইতে গাইতে-

শুধু যাওয়া-আসা শুধু স্রোতে ভাসা, শুধু আলো-আঁধারে কাঁদাহাসা...

আজও কি গৌতম অযাচিত ঝামেলাগুলো উপভোগ করবে এই পৃথিবীর আটদশটা সাধারণ মানুষের মতোই? কী হচ্ছে
সামনে? দেখবে কি? ঠিক তক্ষু ণি মাথার ভেতর ঘুণপোকা মনে করিয়ে দিতে থাকে- এগারটায় অমুক অ্যাপয়েন্টমেন্ট, দুটোয়
অমুক মিটিং, চারটায় অমুক ভিজিট... অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে গৌতমের বোধি শির তু লে জানান দেয়- এনজিও আর কর্পোরেট
সংস্কৃ তি মানুষকে জঞ্জাল ভাবতে শিখিয়েছে, ফার্মের মোরগের সাথে গৌতমের কোনো পার্থক্য নেই, দুটোই আত্মকেন্দ্রিক,
নির্জীব, পলায়নবাদী।

১৪.

সব ধরনের অস্পৃশ্যতাকে জয়যুক্ত করে গৌতমের গাড়ি আবারও এগিয়ে চলেছে... এবার সঙ্গী হয়েছেন কোনো এক কবি, জয়
গোস্বামী কি? নাকি শঙ্খ ঘোষ?

এমনি করে থাকতে গেলে শেষ নেই শঙ্কার, মারের জবাব মার

বুকের ভেতর অন্ধকারে ছলকে ওঠে হাড়, মারের জবাব মার

...বাপের চোখে ঘুম ছিলো না ঘুম ছিলো না মার, মারের জবাব মার

কিন্তু তারও ভেতরে দাও শব্দের ঝংকার, মারের জবাব মার

কথা কেবল মার যায় না কথার বড় ধার, মারের জবাব মার...

গৌতম ভাবে, আফসোস হয়, ধুসর গোধুলির পবল ধিক্কার দেয়- কোন জীবন যে ফেলে এসেছে!... ভবের বাজারে আকু ল করি
প্রাণ...

১৫.

ডোমার বাসস্ট্যান্ডে ঢু কতেই বাম পাশে একটি রেস্টু রেন্ট আছে- কাউকে ভালো রেস্টু রেন্টের কথা জিজ্ঞেস করলে এটাই
দেখিয়ে দিবে- অবাক ব্যাপার দুপুরে খেয়েছে, আর এখনি, এই মাঝ রাতেই গৌতম রেস্টু রেন্টের নাম ভু লে গেলো? এতো
চমৎকার স্বাদের রেস্টু রেন্টের নামটা ভু লে গেলো? মানুষ তখনি অন্য মানুষ কিংবা বস্তুর নাম ভু লে, যখন সেটিকে সে গুরুত্ব
দিতে চায় না- প্রমাণিত সত্যের থিওরিতে বিশ্বাসী গৌতম ভাবতে বসে- প্রান্তিক মানুষজন কখনোই শহরবাসীর নজর কাড়ে নি,
ব্যবসার উপলক্ষ ছাড়া; খাবারের কথা তাই মনে আছে- মনে আছে ওপাশে টেবিলে বসা ভরাট যৌবনের মেয়েটির কথা- কেবল
মনে নেই যে মানুষটি সযত্নে ‘ঢাকাত্থন আইসে’ মানুষকে খাবার দিলো, যার নামেই রেস্টু রেন্টের নাম, সেই মানুষটির নাম।

গৌতমের পক্ষ থেকে এই দিনপঞ্জির লেখক সেই মানুষটির কাছে দুঃখপূর্ণ হৃদয়ে সমস্ত উপেক্ষার জন্য নতজানু হয়েছে।
মানুষকে ভু লে যাওয়া পাপ নয়, মানুষকে উপেক্ষার আরেক নাম পাপ।

১৬.

দিনাজপুরের কাহারোলে কান্তজীউ’র মন্দিরে গিয়েছে গৌতম, বেশ ক’বার। আজকে কি যাবে একবার? না, থাক। এসব জিনিস
একবার দেখাই ভালো। প্রথম দেখাটি ভালো কাটে নি। মন্দিরটি দেখতে দেখতে কেমন যেনো অদ্ভু ত অস্বস্তিতে ভু গছিলো প্রায়
পুরোটা সময়। গৌতমের মতো মিডলক্লাশভদ্রলোকেরা যে সুশোভন ভবনগুলোতে কাজ করে, সেগুলো কি অসংখ্য গরীব
মানুষের রক্ত-শ্রম-ফসল-অর্থ আর বঞ্চনার স্তুপ নয়? কান্তজীউ’র মন্দিরটিও কি তেমনি নয়? হয়তো কোনো গরীব প্রজার জমি
কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো এই মন্দির বানানোর নামে। হয়তো হাজার হাজার মানুষের বিনামূল্যের শ্রম পড়েছিলো এর প্রতিটি
কোণায়- মার্ক সভাই উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বের প্রয়োগও হয়তো এখানে পাখনা মেলেছিলো- হয়তো হাজার হাজার প্রজার ফসলের
ভাগ বসেছিলো কান্তজীউ’র বাজেটে, কিংবা রক্তনাঙ্গা শিশুর ধুলিমাখা শৈশবের পরিসমাপ্তিকে রঙিন হয়েছিলো এর
পলেস্তরাগুলো। একটি মন্দিরের জন্য কতো মানুষকে না খাইয়ে থাকতে হয়েছিলো, এই ইতিহাস জানাবে আজকের কোন
ইতিহাস? ইতিহাস বঞ্চিতকে বঞ্চিত করে, সবসময়, ইতিহাসের ইতিহাস তাই বলে... আর এই বঞ্চনা ইতিহাসই হয়তো
আমাদের গর্বিত-প্রবল ঐতিহ্য!

‌১৭.

দিনাজপুর শহরে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যা নেমে যায়। বাঁশেরহাটের রাস্তার দুদিকে ঘন গাছপালার ফাঁকে কোনো কু টিরের আলো
আসে না, গাড়ির হেডলাইট সমস্ত কালোপথকে আরো অন্ধকার শাণিয়ে ছুটতে থাকে গন্তব্যের পানে, মানুষই একমাত্র প্রাণী যে
কিনা অন্যের বাসখানায় থাকতে পারে নিজের গন্তব্যের মতো! গৌতম তার ব্যতিক্রম নয়, সারাদিন ছুটাছুটির পর বালিশ তাকে
ডাকে- বালিশের নরোম উষ্ণ সঙ্গ কোনো রমণীর কথা মনে করায় না- রমণী কোনো এক দূর বিদর্ভ নগরের, সেখানে যাওয়া যাবে
আরেকদিন...

১৮.

এই এক বিরল সমস্যা- ঘুম... গৌতমের বিবেক দিনপঞ্জি লেখে, গৌতম পড়ে, তার চোখে ঘুম নেই। বিবেক তাকে ঘুমাতে দেয়
না, নাকি তার কারণে বিবেক ঘুমাতে পারে না, সেই হিসাব চু কাতে চায়। গাধাটা বুঝে না- পৃথিবীর সব হিসেব চু কাতে নই, তাতে
গণ্ডগোলের মাত্রা বাড়ে, হিসেবে যে যতো বেশি কাচা, তার হিসেব ততো তাড়াতাড়ি মেলে।

সমাপ্ত

You might also like