You are on page 1of 104

​1

তু লিকা রায়

ইতি লাবণ্য
(ট্যাব/কিন্ডেল/কম্পিউটার সংস্করণ)

প্রকাশক এবং স্বত্বাধিকারীর লিখিত অনুমতি ছাড়া এই বইয়ের কোনও অংশের


কোনওরূপ পুনরুৎপাদন বা প্রতিলিপি করা যাবে না, কোনও যান্ত্রিক উপায়ের
মাধ্যমে প্রতিলিপি করা যাবে না বা কোনও ডিস্ক, টেপ, পারফোরেটেড মিডিয়া বা
কোনও তথ্য সংরক্ষণের যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পুনরুৎপাদন করা যাবে না। এই শর্ত
লঙ্ঘিত হলে উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।

published on 6th October

​2
published by Muktodhara
©muktodhara

​3
একটা মিসিং ডায়রি ! একটা কেস ! না চাইতেও বেরিয়ে পড়া
একটা অপ্রিয় সত্য! মনুষ্যজীবন বড়ই বিচিত্র, এই জীবনে শাশ্বত
বলে কিছুই নেই। আজ যে পরম আপন, কাল সেই-ই শত
আলোকবর্ষ দূরের বাসিন্দা। সাথে থেকেও একে অপরের থেকে দূরে
থাকা কিংবা দূরে থেকেও সাথে থাকতে চাওয়া, এর নামই কি
সমঝোতা? এই সমঝোতা করতে না চাইলেই কি তকমা জোটে
'কলংকিত' ! বাঁচতে চাওয়ার অধিকার তো সবার আছে ! কিন্তু বেঁচে
থাকার সম্বল যে মানুষগুলো, নিজের আপনজন, নিজের পরিবারই
যখন অপরিচিতি হয়ে যায় তখন বেঁচে থাকার আর কি কোনো কারণ
বেঁচে থাকে? কোনো মানুষকে সম্পূর্ণ চেনা কি সম্ভব? নাকি চেনা
অচেনার মাঝে আসলে অনেক অংশই ধূসর? কোনটা আসল রূপ
কোনটাই বা নকল? এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য দায়ী আসলে কে?
এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেবে 'ইতি লাবণ্য'।

-তু লিকা রায়

​4
উৎসর্গ

সূরজকে

​5
সূচিপত্র

প্রথম পর্ব 6
দ্বিতীয় পর্ব 16
তৃ তীয় পর্ব 29
চতু র্থ পর্ব 40
পঞ্চম পর্ব 48
ষষ্ঠ পর্ব 59
সপ্তম পর্ব 67
অন্তিম পর্ব 78

​6
প্রথম পর্ব

।।১।।

দুপুর হতে চলল প্রায়। ঘড়ির কাঁটা বেলা ১টা ছুঁইছুঁই। বাইরে আজ প্রচন্ড
রোদে রাস্তাঘাট একটু ফাঁকা ফাঁকাই, ফোনটা বাজল।

একটু ঠান্ডা জলে তেষ্টা মেটাচ্ছিল সুদীপ্তা, ল্যান্ড লাইনটা ধরতে ইশারা
করল রাতু লকে।

রাতু ল একটা ফাইলে মুখ গুঁজে ব্যস্ত ছিল, বুঝতে খানিকটা সময় লাগল
ওর, বেশ খানিকক্ষণ বাজার পর ফোনটা এসে ধরল ও।

-"হ্যালো, রায়পুর থানা।"

ওপাশ থেকে এমন কিছু কথা ভেসে আসছিল, যাতে ককরেছিলরে


রাতু লের মুখের অভিব্যক্তি বদলাচ্ছিল একটু একটু করে। ব্যাপারটা নতু ন
কিছু নয়। অভ্যস্ত হয়ে গেছে এখন সুদীপ্তা। ছয় মাসের ব্যবধানে জয়েন
ওরা দুজন, প্রায় ৪ বছর হতে চলল চাকরির, এখনও রাতু লের আকাশ থেকে
পড়ার মত ভাবভঙ্গি করাটা আর গেল না। আরে, পুলিশকে কি আর কেউ

​7
সুখবর দিতে ফোন করে? অঘটন ঘটলেই তো ফোনটা করে! তো যখন
অঘটনের কথা শুনব জানেই, তখন এমন ভাবভঙ্গির কি মানে? অনেকবার
রাতু লকে এটা বুঝিয়েছে সুদীপ্তা, যে একটু শান্ত রাখতে মাথাটা, মুখের
ভাবভঙ্গি যেন নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে, কিন্তু বুঝলে তো? কে শোনে কার
কথা? বলে তো লাভ নেই তাই এই মানুষকে। তাই খুব একটা পাত্তা দিল না
সুদীপ্তা।

ফোনটা মিনিট খানেকের মধ্যে রাখার পর নির্লিপ্তভাবেই খানিকটা


জিজ্ঞাসা করল, "কি হয়েছে? কি কেস?"

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল রাতু ল, "আরে হাইপ্রোফাইল কেস। মিসিং
সকাল থেকে বা কাল রাত থেকে, এখুনি যেতে হবে, নীলা ভবন।"

-"মানে? কে? নীলা ভবন মানে, দ্য লাবণ্য সান্যাল?"

-"ইয়েস।"

-"হোয়াট!"

***

রাস্তায় খুব একটা জ্যাম ছিল না, পৌঁছাতে তাই খুব একটা সময় লাগল না
ওদের, মোটামুটি আধ ঘন্টার মধ্যেই 'নীলা ভবন'-এর গেট পেরিয়ে
প্রাসাদোপম বাড়িতে ঢু কল ওরা।

এর মধ্যেই লোকজন খবর পেয়ে গেছে। বাড়ির সামনে অল্প বিস্তর জটলা
বাঁধতে শুরু করেছে। গাড়ি থামতেই দ্রুত পায়ে নেমে এল সুদীপ্তা। বাড়িটার
সামনে বাগান। পুরো বাড়িটাই ধবধবে সাদা, সামনেই সিঁড়ি পেরিয়ে সদর
দরজা, খোলাই রয়েছে। প্রায় ১২-১৫ টা ধাপ পেরিয়ে বাড়ির ভিতর ঢু কল
ওরা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাক লেগে গেল বাড়িতে ঢু কেই। একটা
বিশাল বড় পেন্টিং ঝোলানো রয়েছে সামনেই, মনোমুগ্ধ করা। গাঢ় নীল
রঙের শাড়িতে সিংহাসনে বসে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে লাবণ্য সান্যাল। কি

​8
বুদ্ধিদীপ্ত, প্রখর সেই দৃষ্টি! যেন অবলীলায় পড়ে নিতে পারে মানুষের মনের
ভিতর অবধি সমস্ত অলিগলি। রাতু লের গলার স্বরে ঘোর কাটল যেন
সুদীপ্তার।

-"দেখা হলো?"

-"হুম, কি অসাধারণ না? এইরকম একজন মানুষ... জাস্ট ভাবতে পারছি


না।"

-"হুম, সেটাই। যাক গে, চল।"

-"হুম।"

দুজনে এগোল বাড়ির ভিতরে।

***

বাড়িতে ঢু কতেই একটা উৎকণ্ঠা যে সবার মধ্যেই সেটা নজর এড়াল না।
স্বাভাবিক সেটাই। লাবণ্যর মেয়েকে দেখে ভারী মায়া হল সুদীপ্তার। কিন্তু ,
পরক্ষণেই দিদার কোন কথার উত্তরে এমনভাবে উত্তর দিল, ভু ল ভাঙল
সুদীপ্তার। দেখে যা মনে হচ্ছে, তা যে সত্যি না-ও হতে পারে, সেটা আগেই
বোঝা উচিত ছিল।

প্রথমে গিয়েই লাবণ্যর ঘরটায় আগে ঢু কল ওরা। বিশাল ঘর, পরিপাটি


করে সাজানো। খাটের একপাশে ছোট্ট টেবিলে জলের বোতল একটা,
একজোড়া হীরের কানের দুল-ও ঐ টেবিলটার উপরেই খোলা। বোতলটা
অর্ধেক ভর্তি । বিছানায় একটি মাথার বালিশ, একটি পাশ বালিশ। খাটের
দুপাশে দেওয়ালে দুটি ল্যাম্প, মাথার উপর একটি ল্যাম্প। খাটের সামনেই
বিশালকায় এক আয়না, ড্রেসিং টেবিল, উপরে কিছু সাজের সামগ্রী, একটা
পারফিউমের বোতল খোলা। একটা টিস্যু পেপার মোচড়ানো, কাজলের
হালকা দাগ তাতে। ড্রেসিংটেবিলের পাশেই আছে টিভিটা, ঘরের তু লনায়
টিভিটাই যা একটু ছোট। ঘরের সাথে লাগোয়া ব্যালকনি। সামনেই বাগান,

​9
গেট অবধি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, ইনফ্যাক্ট গেট
পেরিয়ে রাস্তাটাও। ব্যালকনিতে কোন গ্রিল নেই, ঝুঁকে এদিক ওদিক দেখল
সুদীপ্তা। কেউ চাইলে এই ব্যালকনি দিয়ে যেতেও পারে, আসতেও পারে।
ব্যালকনি আর ঘরের মাঝে একটি কাঁচের স্লাইডিং ডোর। ঘরে ঢু কে এল
ওরা। অ্যাটাচ্ড বাথরুমটাও খুলে ঢু কল একবার। নাকে একটা সুগন্ধি গন্ধ
এসে লাগল, এখন হাল্কা হয়ে গেছে। মিষ্টি কোন শাওয়ার জেল-এর গন্ধ
মনে হল।

বাড়ির ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে লাবণ্য সান্যালের নানা মুহূর্তে র ছবি।


একটি ছবি তো এসে দেখছিল ওরা, এছাড়াও সিঁড়ির দেওয়াল ঘেঁষে পরপর
অনেক ছবি। কোনটা পুরস্কার গ্রহণের, কোনটা নিজের ব্যবসা সংক্রান্ত কোন
সাফল্যের, কোনটা আবার পুরস্কার প্রদানের। নীচে কাঁচের একটা আলমারি,
সাজানো কিছু স্মারক। সংখ্যাটা খুব বেশীও না, আবার খুব কমও না। এই
প্রথম একটি ছবি চোখে পড়ল লাবণ্যের ঘরে, ওনার মেয়ের, ভারী সুন্দর
ছবিটা। মেয়েটা খুবই ছোট, কিন্তু মুখের মিল আছে। লাবণ্যের ঘরের
কাগজপত্র একটু এদিক ওদিক দেখছিল সুদীপ্তা। বাইরে রাতু ল ততক্ষণে
একটু কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছে। যাক, তাও ভাল। এবার একটু
ম্যাচিওরিটি দেখাচ্ছে কাজে। প্রতিবার তো নিজের জগতেই থাকে যেন।
টেনে টেনে কাজের জগতে নিয়ে আসতে হয়।

একটা ড্রয়ার খোলাই ছিল, আরেকটা লক্ড। ড্রয়ারটা খুলতে হবে ইশারায়
বলতে বলল ওদের সাথে আসা নতু ন হাভালদার রানাকে। যেটা খোলা
ছিল, সেটা এদিক ওদিক দেখতে দেখতে বুঝল এই ড্রয়ার লক্ড না রাখার
কারণ। মামুলি কিছু ডকু মেন্টস-এর জেরক্স রাখা রয়েছে। ঘড়িটা একবার
দেখল সুদীপ্তা, আরেকবার রানার দিকে ইশারা করল, তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই
চাবি নিয়ে এলেন একজন বয়স্কা মহিলা। রানা কানের কাছে এসে পরিচয়টা
দিয়ে দিল জিজ্ঞাসা করার আগেই, 'সাবিত্রী দেবী'।

***

সাবিত্রী দেবীর পরিচয়টা এখনও পর্যন্ত পরিষ্কার নয় সুদীপ্তার কাছে।

​10
তাই আর সময় নষ্ট না করে সরাসরি প্রশ্ন করল ও, "আপনার পরিচয়টা
যদি একটু দেন ..."

-"হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়। আমার নাম সাবিত্রী দাস। বাড়ি কৃ ষ্ণনগর। তবে
কলকাতায় আছি বহুবছর। এবাড়িতে কাজ করছি ৪৫ বছর প্রায়।"

কথাগুলো গড়গড় করে এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন উনি। যেন এই


কটাকথা কেউ বলতে বলে দিয়েছিল। বলার জন্যই হাঁকপাঁক করছিলেন,
বলে এবার শান্তি। উপর থেকে নীচে একবার ভাল করে জরিপ করে নিল
সুদীপ্তা। ভদ্রমহিলার পরনে সাদা তাঁতের শাড়ি, সরু পাড়, কাঁচা পাকা চুল,
হাত খোঁপা বাঁধা, উচ্চতা বেশ কমই বলা যায়, গায়ের রং বেশ চাপা, চোখে
চশমা, বয়স কম করে ৬৫-৭০ হবেই। তাহলে অনেক কম বয়স থেকেই এই
বাড়িতে আছেন, মনে মনে একটা হিসাব কষে নিল সুদীপ্তা।

ভদ্রমহিলার দৃষ্টি চঞ্চল, অবনত। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই দৃষ্টি,
যেন কতক্ষণে এই ঘর থেকে যেতে পারবেন, সে চাঞ্চল্য স্পষ্ট। উপরন্তু ,
এরকম একজন মানুষের মুখে উত্তরগুলো যেন বড় বেশি বসিয়ে দেওয়া,
কাঠকাঠ। শব্দগুলো আদৌ তার নিজের নয় বলেই মনে হল সুদীপ্তার।

আবার প্রশ্ন করল ও, "আপনার পরিবার? মানে কে কে আছেন বাড়িতে?


আর এই বাড়িতে আপনি ২৪ ঘন্টাই..."

"হ্যাঁ, সংসারে যাবতীয় কাজকর্ম তো আমাকেই দেখতে হয়, বাকি সবাই


তো ব্যবসার কাজেই... আমার বাড়িতে আছে বলতে দুই মেয়ে। দুই মেয়েই
সংসারী। তাই কোন পিছুটান নেই তেমন।"

এই কথাগুলো তাও যেন স্বাভাবিকভাবে বলল।

-"হুম, চাবিটা।"

হাত থেকে চাবিটা নিয়ে ড্রয়ারটা খুলল সুদীপ্তা।

​11
-"আচ্ছা, এই ড্রয়ারের চাবি কি আপনার কাছেই থাকে?"

-"না, মানে, হ্যাঁ, একটা চাবি মিষ্টির কাছে, আর একটা আমার কাছেই
থাকে।"

মাথা নাড়ল সুদীপ্তা, এই বাড়িতে সাবিত্রীদেবীর অবস্থাটা ঠিক কতটা


গুরুত্বপূর্ণ, বুঝতে আর সময় লাগল না ওর।

ড্রয়ারটা খুলতেই, বেশ কিছু ব্যবসায়িক দলিলপত্র হাতে এল সুদীপ্তার,


সাথে হাতে এল একটা ডায়রী।

।।২।।

নীলাভবন থেকে বেরোনোর তোড়জোড় করছে এবার ওরা। যা প্রাথমিক


জিজ্ঞাসাবাদ বা ঘরদোর সার্চ করা মোটামুটি শেষ। আবার আসতে তো হবে
কিন্তু , এখন আর তেমন কিছু কাজ নেই।

ক্ষিদেটাও বেশ জোরেই পেয়েছে। ফেরার পথে ঐ 'খানা-খাজানা' থেকে


কিছু একটা হেভি প্যাক করিয়ে নেবে ঠিক করল সুদীপ্তা। আজ আর বাড়ি
গিয়ে রান্না করবে না। কেসটায় মাথা লাগাতে হবে।

***

ওরা যখন বেরল নীলাভবন থেকে, তখন বিকেল হয়ে গেছে। গাড়িতে
চুপচাপ বসেই ছিল সুদীপ্তা। রাতু ল ড্রাইভ করতে করতে অনেক কিছুই
বলছিল, কিন্তু সুদীপ্তার ঐ দিকে পাত্তা দেওয়ার মতো ইচ্ছে নেই, তাই
স্বাভাবিক ভাবেই চুপচাপ নিজের ভাবনায় মগ্ন ছিল সুদীপ্তা।

রাতু ল বলল, "কি এত ভাবছিস বলতো?"

-"কি আবার ভাবব ? হাই প্রোফাইল কেস, মিডিয়া এতক্ষণে জেনে গেছে
নিশ্চয়। এবার তো আমাদের অবস্থা খারাপ হবে।"

​12
-"আমি প্রথমেই চেপে দিয়েছি। এত কিছু নেই টেনশন করার।"

-"বাবাহ! এত ম্যাচিওর কবে থেকে হয়ে গেলি?"

-"যেদিন থেকে বিয়ের ডেট ফিক্সড হল।"

রাতু লের মুখে হাসি। সুদীপ্তা একবার আড়চোখে রাতু লের মুখটা দেখে
হেসে আবার সামনে তাকাল। ওর বলার আগেই রাতু ল বলল, "বেশ কটা
ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখেছি আজ জানিস।"

-"যেমন?"

-"আচ্ছা, তোর লাবণ্য সান্যালের বাবা মাকে কেমন লাগল?"

-"মানে? এ আবার কি রকম কথা? মেয়ের এরকম একটা খবর, তো মা


বাবার অবস্থা আর কেমন হতে পারে? এমনিতে তো শিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিত
ভাল পরিবারেরই। এতে আর মনে হওয়ার কি আছে।"

-"দ্যাখ, আমি কথা বলে যা বুঝলাম, চিন্তিত তো নিশ্চয়, কিন্তু কোথাও যেন
একটু নিশ্চিন্তও।"

-"কি আজে বাজে বকছিস বলতো?"

-"আরে বড় লোকদের ব্যাপার, হয় এসব। বাবা মা দুজনেই বিজনেস


পার্ট নারও খাতায় কলমে, তো লাবণ্য সান্যালের যদি কিছু হয়ে যায়, তো
বাবা মাও তো ইন্সিওরেন্সের টাকা পাবে।"

-"প্লিজ চুপ কর রাতু ল, যা পারছিস বকে যাচ্ছিস। কেস সল্ভ করতে হবে,
বানাতে নয়। আর কি এমন দেখেছিস, যে তোর এরকম মনে হল?"

-"আমি যখন জিজ্ঞাসাবাদ করছিলাম, বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভদ্রলোক


বলছিলেন, 'ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন, পাপের শাস্তি তো এই
জীবনেই ভোগ করতে হবে।' এবার বল, বাবা হয়ে যদি এরকম বলে তো কি

​13
বুঝব?"

-"পাপ?"

-"হুম।"

-"আর ভালর জন্য মানে..."

-"ভাল মানে, বিজনেস যে লসে চলছিল সেটা তো জানিসই। কতটা লস


এসব তো রিপোর্ট গুলো দেখার পরই জানা যাবে, মুখার্জীদা আসছেই। তো
লসে চলা বিজনেস, হঠাৎ করে যদি ইন্সিওরেন্সের মোটা টাকা হাতে আসে,
তো ভাল তো বটেই।"

-"হুম, কিন্তু পাপ?"

-"সেটা ডিটেলসে দেখতে হবে। ডায়েরিটা তো নিয়ে এসেছিস, আজ


রাত্রের মধ্যে সেটা বের করে খুঁজে, আর একটা ব্যাপার..."

-"কি?"

-"মেয়ের সাথে, মানে লাবণ্য সান্যালের মেয়ের সাথে মায়ের সম্পর্ক টাও
না স্বাভাবিক নয়। মেয়েটা কিরকম অদ্ভু ত বিহেভ করছিল দেখলি?"

-"না, দেখিনি তেমন। আমি তো সার্চ করছিলাম। কাল আরেকবার এসব,


যদি না কোন খোঁজ পাওয়া যায়।"

-"হুম, ঠিক আছে। মেয়েটার মায়ের উপর যেন ভীষণ রাগ, এমন একটা
ভাব যেন আপদ বিদায় হয়েছে, বাঁচা গেছে।"

-"লাবণ্য সান্যালের হাজবেন্ড, শ্বশুরবাড়ি..."

-"ডিভোর্স হয়ে গেছে তো ক'বছর আগে। ওখানে কবে যাবি ভাবছিস?"

​14
-"দেরি করা যাবে না, কালই যেতে হবে।"

-"তোর কি মনে হচ্ছে? কি হতে পারে?"

-এখনও অবধি কিছুই ক্লিয়ার নয়। সবার সাথেই আরেকবার কথা বলা খুব
দরকার। সবার মোটিভই দেখতে হবে। তবে তার আগে ডায়েরিটা আজ শেষ
করতেই হবে। ওটা থেকে অনেক ইনফরমেশন বেরোবে বলেই মনে হচ্ছে।"

-"আচ্ছা, বাকী লোকের ঘরগুলো সার্চ হয়েছে? আমি তো শুধু লাবণ্যর


ঘরেই ছিলাম।"

-"হ্যাঁ, রিপোর্ট দিয়ে দেবে আর আধ ঘন্টার মধ্যে।"

-"আচ্ছা।"

-"আরেকটা জিনিস কানে এল।"

-"কি বলতো?"

-"আই থিঙ্ক ডায়েরি থেকেই সেটা জানা যাবে।"

-"কি?"

-"দীপ মজুমদার।"

-"নামটা তো আমিও শুনেছি, কিন্তু আমি তো প্রথমে ভাবতাম গুজব।


কিন্তু ..."

-"কোন গুজব নয় বলেই আমার মনে হয়।"

-"জানিস তখন আমি কলেজে, যখন পেপারে, খাসখবরে প্রথম ওদের


বিয়ের খবরটা বেরিয়েছিল, পুরো তিনপাতার ইন্টারভিউ গোগ্রাসে
গিলেছিলাম। আমার না প্রথম থেকেই লাবণ্য সান্যাল আর অর্জুন
রায়চৌধুরীর জুটিটা খুব ভাল লাগত। যাকে বলে পাওয়ার কাপল। এত

​15
বোল্ড একজন মানুষ, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব! আমি তো ইন্টারভিউ টিভিতে
এলেই হাঁ করে শুনতাম। কি সুন্দর কথা বলে! আর দুজনেই যেন একে
ওপরের পরিপূরক। এত সুন্দর মানাত দুজনকে, দুজনেই কি সুন্দর, শিক্ষিত,
সাকসেসফু ল, প্রভাবশালী, অথচ একে অপরের প্রতি কি অসাধারণ
আনুগত্য। কিন্তু , তারপর যখন এই দীপ মজুমদারের নামটা এল, আমার তো
বিশ্বাসই হয়নি। এ হতে পারে না। কিন্তু , এখন এত বছর পর; এখন সত্যি
অদ্ভু ত লাগছে..."

-"তু ই তো লাবণ্য সান্যালকে নিয়ে রীতিমত অবসেসড।"

-"নারে, লাবণ্য সান্যালকে পছন্দ করে না এরকম মানুষ হয়ত হাতে গোনা।
এরকম একজন মানুষকে লোক ভালবাসবে, অ্যাডমায়ার করবে, পাগল হবে,
এটাই তো স্বাভাবিক।"

-"আর যারা পছন্দ করে না, তারা যখন নিজের পরিবারেরই লোক, তখন
কি বলবি?"

-সেটাই তো খটকা। এটা কি করে সম্ভব?"

-"কারণ পৃথিবীর থেকে নিজের পরিবারই সবটা জানে, সব থেকে বেশি


চেনে।"

-"মানে? কি যাতা বলছিস?"

-"যেটা বুঝছিস, সেটাই বললাম। অবসেশন থেকে বের, নিরপেক্ষভাবে


মাথাটা লাগা।"

আর কিছু বলল না সুদীপ্তা। ডায়েরিটা আনমনে খোলা বন্ধ করতে


করতেই একটা পাতায় চোখ আটকাল। "দীপ" - নামটা লাল কালিতে
জ্বলজ্বল করছে। সাদা কালোর মাঝে জায়গাটা বড্ড ধূসর লাগছে এবার,
বোঝা জটিল, কিন্তু বুঝতে তো হবেই।

​16
​17
দ্বিতীয় পর্ব

।।১।।

রাতু ল সুদীপ্তার বিয়ে মাস ছয়েক পর। দুই বাড়ি থেকেই খুশী মনেই
মেনে নিয়েছে। দুজনে এখন একসাথেই থাকে, এটা অবশ্য বাড়িতে
জানে না। এতটাও খোলামনের মানসিকতা নেই বাড়িতে, তাই আর
জানায়নি। বাইরে থেকে মাকে ফোনটা করে ঘরে ঢু কল সুদীপ্তা।
রাতু লকে দেখতে না পেয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগল ও।

আপাতত এক বি.এইচ.কে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েই আছে দুজন, বিয়ের


পর দুই বি.এইচ.কে নিয়ে নেবে, দুই বাড়ির লোকজনও আসবে
তখন।

এদিক সেদিক দেখতে দেখতে রান্নাঘরে পৌঁছাল সুদীপ্তা, রাতু ল


রান্নাঘরে কি করছে?

​18
-"আমি তো খাবার কিনে নিলাম। তু ই আবার কি করছিস?"

-"কিছু না, চল, আসছি।"

রাতু ল রান্না করতে ভালবাসে, তাই এই ব্যাপারে বেশী কিছু বলে


না ওকে সুদীপ্তা।

গরম গরম কফি আর নুডলস নিয়ে যতক্ষণে ঘরে এল, ওয়েব


সিরিজটা ততক্ষনে অর্ধেক শেষের পথে।

বাইরে থেকে আনা খাবারগুলোও একটু গরম করে নিয়ে খেতে


বসল ওরা। সাধারণত এই সময়টায় ওরা কাজ সংক্রান্ত কোন
আলোচনা করে না। এটা একান্তই নিজস্ব সময়। কিন্তু আজ যেন মাথা
থেকে কিছুতেই বেরোচ্ছে না চরিত্রগুলো। অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে
বারবার সুদীপ্তা।

টিভিটা চলছেই, কিছুই মাথায় যাচ্ছে না ওর। তাড়াতাড়ি খেয়ে


উঠে পড়ল ও, কাল সবার প্রথমে যেতে হবে গল্ফগ্রীণ আর
গিরিশপার্ক । মানে লাবণ্য সান্যালের শ্বশুরবাড়ি আর দীপ মজুমদারের
বাড়ি। আজই যাওয়া হতো, কিন্তু দু'জনের কেউই এখানে ছিলেন না।
আউট অফ স্টেশন। ঐ জন্য আরও বেশী করে সন্দেহ হচ্ছে। দুজনেই
একসাথে কাল সকাল ও দুপুরেই এসে পৌঁছাবে এখানে। কি অদ্ভু ত
না!

খাওয়া শেষে উঠে হাতটা ধুয়ে নিলো সুদীপ্তা। ডায়েরিটা নিয়ে


বসল নিলো খাটের পাশের জানলাটা ঘেঁষে। এই জায়গাটাই ওর
সবথেকে প্রিয়। জানলাটা দিয়ে খোলা আকাশটা দেখা যায় মন ভরে।
ডায়েরিটা বেশ মোটা, কালো রঙের। বেশ পুরোনোও। পাতাটা যত্ন
নিয়ে পাল্টাল সুদীপ্তা।

​19
একটা মানুষের এত গুণ কি করে থাকতে পারে? হাতের লেখা
যেন মুক্তোর মত ঝলমল করছে প্রতিটি পাতায়। পাতাগুলোয়
হলদেটে আভা, বেশ পুরোনো সেটা বোঝাই যাচ্ছে।

প্রথম পৃষ্ঠার তারিখটা দেখল সুদীপ্তা, তারিখটা আজ থেকে ১৫


বছর আগের। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে শেষ পৃষ্ঠায় গিয়ে থামল
সুদীপ্তা। কিন্তু , আশ্চর্য বিষয়, বেশ কিছু পৃষ্ঠা ফাঁকাই পড়ে আছে।
ডায়েরি লিখতে লিখতে মাঝ পথেই লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন
লাবণ্য। প্রথম থেকে চোখ বোলাতে লাগল সুদীপ্তা। চোখ বোলাতে
লাগল কারণ, ঘড়ির কাঁটা এখন রাত ১২টা ছুঁইছুঁই। এই সময়ে শুরু
করে কালকের মধ্যে শেষ করা অসম্ভব, এখন থেকেই চোখদুটো
জুড়ে আসছে ঘুমে। তাই, হালকাভাবে লিখিত শব্দগুলোকে আত্মস্থ
করতে লাগল সুদীপ্তা। মুক্তাক্ষরের উপর হাত বোলাতে বোলাতে
যখন চোখ বুজে ঘুমের দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে সুদীপ্তা,
তখন, সিগারেটের গন্ধ এসে লাগল নাকে। রাতু ল তার মানে আবার
শুরু করেছে?

।।২।।

ঘুম থেকে আজ বেশ তাড়াতাড়িই উঠে পড়েছে সুদীপ্তা। ভোর রাত


থেকেই ঘুমটা পাতলা হয়ে গেছিল। একটা অদ্ভু ত অস্বস্তি হচ্ছিল
শরীরে। সকাল থেকে উঠে এক কাপ কফি নিয়ে আর ডায়েরিটা নিয়ে
বসল সুদীপ্তা। এই বারান্দাটায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া
যায়। এখানে এখনও ধূসরতা অতটা থাবা বসাতে পারেনি। একটু
ভিতরের দিকে ফ্ল্যাটটা, তাই, পলিউশনটাও বেশ কম। এখনও কাক,
শালিখ, চড়াই পাখির দেখা মেলে এখানে। ডায়েরির প্রতিটা পাতায়
একটা পুরোনো, ফেলে আসা সাদা কালো স্মৃতি, হলদেটে হয়ে
যাওয়া পাতাগুলো যেন আরও বেশি করে টানে কাছে। প্রতিটি ছত্রে
ছত্রে কি অপূর্ব শব্দচয়ন! এক একটি বাক্য যেন এক নিমেষে টেনে

​20
নিয়ে চলে যাচ্ছে ১৫-টো বছর আগের পুরোনো শহরটায়। কেউ এত
সুন্দর লিখলে হারিয়ে না গিয়ে উপায় কি? কেউ এত গুণের
অধিকারী কি করে হতে পারে? আর এরকম একজন মানুষের সাথেই
এমনটা হতে হল...

কতক্ষণ ডু বে ছিল ডায়েরিতে কে জানে? রাতু লের ডাকে টনক


নড়ল।

-"রেডি হবি কখন? কটা বাজে দেখেছিস?"

কয়েক সেকেন্ড সময় নিল সুদীপ্তা বাস্তবে ফিরতে, ঘড়ির দিকে


তাকিয়ে ধক করে উঠল বুকটা।

-"এ বাবা, এত বেজে গেছে? আগে বলবি তো?" বলতে বলতে


ঘরে দৌড়ে রেডি হতে গেল ও, ডায়েরিটা সযত্নে সঙ্গে নিয়ে। রাতু ল
সুদীপ্তার এই অবসেশন সম্পর্কে অবগত। দেখে নিজের মনেই হাসল
শুধু। তারপর হাতের কাজগুলো সারতে লাগল।

***

গল্ফগ্রিনে পৌঁছাল যখন ওরা, তখন বেলা ১২টা প্রায়। কোনরকম


ভনিতা না করে কাজের কথায় আসবে, ঠিকই করে রেখেছিল ওরা।
সময় নষ্ট করার মত সময়ও নেই। কালই ইন্টারোগেট করতে পারলে
ভাল হত, কিন্তু বড়-বড় লোকদের ব্যাপার। পারমিশন পাওয়া গেলে
তো।

ওরা সদর দরজা দিয়ে ঢু কে নীচেই বৈঠকখানায় দাঁড়িয়ে এদিক


ওদিক দেখতে লাগল। এখন প্রতিটি জিনিসের উপরেই নিঁখুত
পর্যবেক্ষণও ভীষণ জরুরী। একটা জিনিস ভারী অদ্ভু ত লাগল
সুদীপ্তার, দুটো বাড়ির মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। কালকের আর

​21
আজকের এই দুটো জায়গার মধ্যে একটা জিনিসই এক, তা হল
বৈভব। এটা ছাড়া সম্পূর্ণ বিপরীত দুটো জগত যেন। একদিকে কাল
বাড়ির প্রতিটা কোণে যেমন পাশ্চাত্যের ছাপ স্পষ্ট, শোবার ঘর থেকে
বসার ঘর পেরিয়ে বাগান সর্বত্র। অন্যদিকে আজ বনেদিয়ানা,
ঐতিহ্যে যেন মোড়া গোটা প্রাসাদোপম বাড়ি।

-"বসুন।"

মহিলা কন্ঠে সচকিতে ফিরে তাকাল সুদীপ্তা। সাধারণভাবে পরা


চওড়া পাড়ের তাঁতের শাড়ি। হাত খোঁপা, মাথায় গোল লাল টিপটা
জ্বলজ্বল করছে যেন। বয়স ৭০ এর কাছাকাছি হবে। চোখে মুখে
বয়সের ছাপ থাকলেও এক অদ্ভু ত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে যেন। মনে
হয় যেন দু'চোখ ভরে দেখতেই থাকি, একদম মায়ের মত। সব মা
হয়তো একইরকম হয়। মিষ্টি হাসি নিয়ে সুদীপ্তকে দ্রুততার সাথে
পর্যবেক্ষণ করলেন মহিলা। সেটা সুদীপ্তার নজর এড়াল না।

সুদীপ্তা বসল, পাশের চেয়ারটা টেনে বসলেন উনি। এখন


আপাতত ঘরে কারো প্রবেশ নিষেধ।

-"বলুন, কি কি জানতে চান।" মহিলার বাচনভঙ্গিতে বোঝা গেল


শিক্ষিত, চালচলনেও সে ছাপ স্পষ্ট। চোখেমুখে ঔজ্জ্বল্য স্পষ্ট।

-"আপনার নাম?"

-"মিসেস হেমা রায়চৌধুরী।" সুদীপ্তার বুকে লাগানো নাম প্লেটটা


একবার দেখে নিয়ে বললেন উনি।

ফরম্যালিটির জন্য জিজ্ঞেস করল সুদীপ্তা, "আপনার লাবণ্য


সান্যালের সাথে সম্পর্ক ?"

​22
চেষ্টা করেও মুখের অভিব্যক্তি পুরোপুরি লুকাতে পারলেন না
মহিলা। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললেন, "আমার ছেলের প্রাক্তন
স্ত্রী।"

ভদ্রমহিলা বেশ অস্বস্তিতে বোঝাই গেল।

সুদীপ্তা আবার বলল, "আপনার সাথে লাবণ্য সান্যালের সম্পর্ক টা


ঠিক কেমন?"

আরেকটু অস্বস্তি বাড়ল যেন মহিলার। শাড়িটা আরেকটু গায়ে


জড়িয়ে নিয়ে দৃষ্টি বাইরের দিকে রেখে বললেন, "ডিভোর্সের পর
সম্পর্ক কেমন হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?"

সুদীপ্তা - "সেটা তো ডিভোর্সের কারণের উপর নির্ভ র করে।"

হেমা - "আপনারা খবরে, ম্যাগাজিনে পড়েননি, শোনেননি?


তাহলে এখন সময় নষ্ট করছেন কেন?"

সুদীপ্তা - "সেসব তো মিডিয়ার খবর। আসল সত্যিটা জানতে


চাই।"

হেমা - "যেটা জানেন, সেটাই সত্যি। আপনার কি আর কোন প্রশ্ন


আছে?"

সুদীপ্তা - "হ্যাঁ, লাবণ্য সান্যাল যে নিঁখোজ সে বিষয়ে আপনার কি


কাউকে সন্দেহ হয়?"

-"নিঁখোজ কেন? ও তো স্বেচ্ছায় চলে যেতেও পারে। এমনিও ঐ


মুখ না দেখানোই উচিত ছিল অনেক আগেই।"

-"হ্যাঁ, সে তো বুঝলাম, কিন্তু এখন তো আমাদের সবটাই দেখতে

​23
হবে, ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়, যাই হোক না কেন। সন্দেহের তালিকায়
কিন্তু সকলেই আছে।"

-"বলতে কি চান সোজাসুজি বলুন।" ভদ্রমহিলার কন্ঠে উগ্রতা


স্পষ্ট, চেহারার সাথে সুরের যেন বিস্তর ফারাক।

-"বলছি যে লাবণ্য সান্যালের নিরুদ্দেশের পিছনে প্রত্যক্ষ বা


পরোক্ষভাবে কার বা কাদের হাত রয়েছে, সেটা বের করা ও তাকে
খুঁজে আনাই আমাদের প্রথম কাজ এখন। তাই আমরা কাউকেই
সন্দেহের বাইরে রাখতে পারব না। কিছু জানতে পারলে অবশ্যই
জানাবেন। এবার আপনি আসতে পারেন। আর অর্জুন বাবুকে
পাঠিয়ে দিন প্লিজ।"

অর্জুন রায়চৌধুরী না আসা অবধি বাইরের দিকে অন্যমনস্কভাবেই


তাকিয়ে ছিল সুদীপ্তা।

কি আশ্চর্য না? এখানে আসা অবধি কোথাও লাবণ্যর একটি ছবি,


একটি চিহ্নও দেখেনি ও। থাকার কথাও না হয়তো। কিন্তু এই
বাড়িতেই নিজের জীবনের অনেকটা কাটিয়ে গেছে সে। যখন
নিজের কাছের মানুষগুলোই বদলে যায়, তাদের সাথে সম্পর্কে র
সমীকরণগুলো বদলে যায়। তখন কত অচেনা হয়ে যায় সবকিছু।
মানুষের মন বোঝা সত্যি বড় জটিল।

জুতোর শব্দে চোখ দুটো একবারের জন্য বুজে ফেলল সুদীপ্তা,


জ্বালা করছিল চোখ দুটো। আর্দ্র চোখ মেলে ফিরে তাকাল এবার।

এর আগে চাক্ষু স দেখার সুযোগ হয়নি। যেটুকু দেখেছে ম্যাগাজিনে


বা টিভিতেই।

পরনে একটা নীল রঙের পাঞ্জাবী, চোখে চশমা, চুলটা খানিক

​24
এলোমেলো, হাতে দামী ঘড়ি, পায়ে স্লিপার। গায়ের রং উজ্জ্বল
শ্যামবর্ণ। চোখদুটো চশমার আড়ালে ঢাকা পড়লেও বেশ উজ্জ্বল।
বয়স মেরে কেটে ৪৫ এর মধ্যে। মুখে একগাল হাসি নিয়ে নমস্কার
জানাল অর্জুন রায়চৌধুরী। রগের দিকের চুলে রুপোলী আভা।

"বলুন আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?" চেয়ারে বসতেই


প্রশ্ন করল মিঃ রায়চৌধুরী।

-"আমার হাতে বেশী সময় নেই। তাই একটু তাড়াতাড়ি করছি আর


কি... আপনাকে চা সরবত কিছু দিয়েছে তো?"

সুদীপ্তা এখনও অবধি একটি শব্দও খরচ করেনি। এবার মুখ খুলল,
"না, না, সে সব কোন দরকার নেই।"

-"না, না, তা কি করে হয়? সন্ধ্যাদি, এঘরে... সরবত বলছি, ঠিক


আছে? যা গরম পড়েছে ... সরবত দিয়ে যাও তো এখুনি।"

সুদীপ্তা একটু হাসি টানার চেষ্টা করল মুখে। এক পায়ের উপর এক


পা তু লে বেশ আয়েশ করে বসল অর্জুন রায়চৌধুরী। দুটো হাত একত্র
করে আঙু লগুলো নিয়ে ফাটাতে লাগল, মুখ দেখেই বোঝা গেল
কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু ইতস্তত বোধ করছে যেন। তবে
এর স্থায়িত্ব দু'-তিন সেকেন্ড, তারপরেই বলল, "আসলে আমার মা-
র হাই ব্লাড প্রেশার। একটুতেই মাথা গরম, সকলের সাথে কিছু না
কিছু লেগে থাকে। আপনার সাথেও কথোপকথনটা খুব একটা মসৃণ
হয়নি, সেটা মায়ের মুখ দেখেই আমি বুঝে গেছি। আমি মায়ের হয়ে
ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।"

-"আরে না, না, আপনি এই নিয়ে এত ভাববেন না। এসব নিয়ে


আমি এত মাথা ঘামাই না।"

​25
-"থ্যাঙ্ক ইউ। বলুন।"

-লাবণ্য সান্যালের সাথে ডিভোর্সের পরও আপনাদের যাবতীয়


বিজনেস একসাথেই রয়েছে।"

এক লহমায় অর্জুন রায়চৌধুরীর মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেল,


সেটা পরিষ্কার দেখল সুদীপ্তা। কিন্তু মায়ের মতো মেজাজ হারালেন
না। একটা দেঁতো হাসি হেসে সুদীপ্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, "আমি
চিরকাল পার্সোনাল আর প্রফেশনাল লাইফ আলাদাই রাখা পছন্দ
করি। আর এটাই হওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়।"

অর্জুন রায়চৌধুরীর চোখের চাহনি দেখেই বুঝতে পারল সুদীপ্তা,


এ গভীর জলের মাছ।

-"আপনাদের বিজনেসের লিগ্যাল ডকু মেন্টসগুলো একবার


দেখতে চাই।"

-"ঠিক আছে, আমি আমার ম্যানেজারকে বলে দিচ্ছি, সুশোভন


নাম ওর, কাজের ছেলে। ও বুঝিয়ে দেবে আপনাদের।"

-"আপনাদের ইনসিওরেন্স আছে নিশ্চয়।"

-"হ্যাঁ আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক।"

-"তো, সেই ইনসিওরেন্স অনুযায়ী, দুই পার্ট নারের মধ্যে একজনের


কিছু হলে আরেকজন টাকাটা পাবে তাই তো?"

-"হ্যাঁ, তাই। কিন্তু আপনি কি বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি


না।"

​26
-"আপনাদের বিজনেস তো এখন খুব একটা ভাল চলছে না।"

-"হ্যাঁ, চলছে না। বিগত কয়েক বছর ধরেই বিজনেসে চলছে


স্ট্রাগল। আজ নতু ন তো নয়। কিন্তু আপনি যেটা মিন করছেন, সেটাই
যদি আমার করার হত আমি অনেক আগেই করে ফেলতাম। যেদিন
দীপের কথা জানতে পেরেছিলাম সেদিনই... যাক গে।"

বেশ উত্তেজিত স্বরে কথাগুলো বলতে বলতে চুপ করে গেলেন


অর্জুন রায়চৌধুরী।

তারপর আবার বললেন, "দেখুন, এটা সত্যি যে দীপের কথা


জানার পর থেকে আমি ওকে ঘৃণা করি। প্রথম যখন জানতে
পেরেছিলাম, মনে হয়েছিল খুন করে দি। হয় লাবণ্যকে নয়তো
নিজেকে। কিন্তু ভালবাসা বড় বিষম বস্তু । এখন ঘৃণা আর প্রেমের
সমীকরণটা সাম্যাবস্থায় চলে এসেছে। লাবণ্যর এই নিরুদ্দেশের
পিছনে আমার কোন হাত নেই। এটা আমি ক্লিয়ার করে দিতে চাই।
আপনারা আপনাদের ডিউটি করবেন, জানি। কিন্তু আমার মনে হয়
এসবে সময় নষ্ট না করে ঐ দীপের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিন। আমি
এব্যাপারে বেশ টেন্সড। যতই হোক, লাবণ্য আমার...।"

অর্জুন রায়চৌধুরীর চোখটা ছলছল করে উঠল। সুদীপ্তা বুঝতে


পারল না, এই চোখের জলটা আসল নাকি নকল।

।।৩।।

আর বেশী সময় নষ্ট করল না ওরা, বেরিয়ে পড়ল গিরিশপার্কে র


উদ্দেশ্যে। এই ধাঁধার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, এখনও যার সাথে
মুখোমুখি হওয়া বাকী।

​27
***

সাবেকী বাড়ি, তিনতলা। উত্তর কলকাতার আমেজ পুরোপুরি


মিশে আছে বাড়ির আনাচে কানাচে। বেশ একটা অন্যরকম মন ভাল
করা পরিবেশ। কিংবা, সুদীপ্তার এরকম বাড়ি বরাবর ভাল লাগে,
তাই হয়তো একটু বেশীই ভাল লাগছিল 'স্বপ্ননীড়'।

হ্যাঁ, এই নামটাই তো লেখা ছিল শ্বেত পাথরের উপর। গাড়ি


বারান্দাটার দিকে বেশ খানিক্ষণ তাকিয়ে বাড়িতে ঢু কেছিল সুদীপ্তা।
বসার ঘরে বসল। বাড়িতে ঢোকার মুখ থেকে শুরু করে বসার জায়গা
অবধি নানারকম ছোট ছোট গাছের সমাহার। ছোট বড় হরেক রকমের
রঙ বেরঙের টবের ভেতর হাসিখুশি গাছগুলো যেন একসাথে
অভ্যর্থনা জানাতে ব্যস্ত। বসার ঘরেও সবুজ রঙের প্রাচুর্য্য। চোখে
বেশ আরাম লাগছে সুদীপ্তার। একদিকের বুক শেলফে ভর্তি অজস্র
বই।

বেশী বসতে হল না। চলে এলেন দীপ মজুমদার। সুদীপ্তা একদৃষ্টে


তাকিয়েছিল খানিক্ষণ, কেন লাবণ্য এই দীপের সাথে সম্পর্কে
জড়িয়েছিল তা যেন খানিকটা আন্দাজ করতে পারল সুদীপ্তা। এমন
আকর্ষণীয় পুরুষের প্রতি আকৃ ষ্ট হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। যদিও
পুরোটাই বাহ্যিকভাবে বিচার করছে সুদীপ্তা, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে।
ভিতরে সত্যি কতটা তিক্ত, অপ্রিয়, তা সুদীপ্তাও হয়তো জানে না।

-"নমস্কার" হাসিমুখে নমস্কার জানাল দীপ মজুমদার।

গলার স্বর ততটাই আকর্ষণীয়, ভরাট স্বর। টকটকে ফর্সা গায়ের


রঙ, চোখে চশমা, গালে হালকা দাড়ি। বাদামী রঙা চুলের ভিতর
পাকা চুলও আছে বেশ কটা। খানিকটা যেন অগোছালো, পরনে
টিশার্ট ট্রাউজার্স। নিতান্ত সাধারণ সাজপোশাকেই যেন অসাধারণ

​28
করে তু লেছে ব্যক্তিত্বকে। বেতের চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসল ওরা।

***

-"সরি আপনাকে বসতে হল একটু। আসলে এটা আমার 'জামুন'-


এর খাওয়ার সময়। এই সময়টার জন্যই ও বসে থাকে। তাই
আরকি..."

কি অসম্ভব মার্জিত কথাবার্তা। সুদীপ্তার যেন একের পর এক


অবাক হওয়ার পালা। কথার মাঝেই 'জামুন' লেজ নাড়াতে নাড়াতে
চলে এল। একটা ছোট্ট সাদা আর বাদামী রঙা বিগল। সুদীপ্তার
নিজেরও কু কু র খুব প্রিয়।

জামুনের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন দীপ, "এই


একজনই আমার সম্বল, বাকি তো সবাই-ই ..." হেসে কথাটা
অসম্পূর্ণই রাখলেন দীপ।

-"কাজের কথায় আসা যাক।" হেসে সুদীপ্তা নিজের নোটবুক আর


পেনটা হাতে নিতে নিতে বলল।

-"হ্যাঁ, একদম, প্লিজ।"

কোন রাখঢাক না করেই শুরু করল সুদীপ্তা, "লাবণ্য সান্যালের


মিসিং-এর ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি। তো এই পুরো কেসটায়
বারবার আপনাদের সম্পর্ক টার সমীকরণউঠে আসছে নানা দিক
থেকে, সেই সম্পর্কে আগে বলুন। প্লিজ কিছু লুকোবেন না। এই
কারণে আমাদের কাজ করতেও দেরী হচ্ছে আর বিপদ লাবণ্য
সান্যালের বাড়ছে। প্লিজ।"

- "আপনি কি শুনেছেন আমি জানি না। আমায় যদি জিজ্ঞাসা

​29
করেন, সেটা হল একটা অসম্ভব ভাল বন্ধু । ভীষণ কাছের বন্ধু । ভীষণ
প্রিয় একজন মানুষ লাবণ্য। এর থেকে বেশি আর কি বলব বলুন?"

-"শুধু এই বন্ধু ত্বের কারণে লাবণ্য সান্যাল আর অর্জুন


রায়চৌধুরীর ডিভোর্স হতে পারে না, তাই না?" - সুদীপ্তা।

মাথা নত করে নিল দীপ। তারপর বললেন, "এই অনুশোচনা


আমার আমৃত্যু থাকবে, আমি মরলেও শান্তি পাব না, আমি জানি,
কিন্তু এতে লাবণ্যর কোন দোষ ছিল না। আমিই অসময়ে ভু ল
জায়গায় এসে পড়েছিলাম। যার জন্য আমি কোনদিনও নিজেকে
ক্ষমা করতে পারব না। আর এটাই সত্যি। বাকি যে যাই বলুক।"

সুদীপ্তা নিজেও প্রত্যাশা করেনি, এরকম কিছু শুনতে হবে। ঘরের


পরিবেশ গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হচ্ছে। সুদীপ্তা বলল, "আপনার
সাথে লাবণ্যর শেষ কবে কথা হয়েছে?

সুদীপ্তা এক্সপেক্ট করছিল, ডেট মনে করবার বা বানিয়ে বলবার


চেষ্টা করবে। কিন্তু , বেশ দৃঢ়তার সাথে বলে উঠলেন দীপ, "১১ ই মে,
২০২০, যেদিন ওদের ডিভোর্স হয়েছিল সেদিনই শেষ। আপনি
চাইলে ভেরিফাই করে নেবেন।"

এতটা কনফিডেন্স খুব একটা সুবিধার লাগল না সুদীপ্তার।

-"লাবণ্য সান্যালের এই মিসিং-এর জন্য আপনার কাউকে সন্দেহ


হয়?"

-'নাহ, আই অ্যাম অ্যাবসোলিউটলি ক্লু লেস। আমি শোনার পর


থেকে নিজেও অবাক। ইনফ্যাক্ট আমি ওদের বাড়িতে ফোনও
করেছিলাম, কিন্তু আমার ফোন কেটে দেয়। তাই এখনও অবধি আর

​30
যাওয়ার..."

চুপ করে যায় দীপ। প্রশ্নোত্তর পর্ব চলতে থাকে, দাঁ বাবুকে
হ্যান্ডওভার করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে আসে সুদীপ্তা,
রানা আর রাতু লকে বাকি দিকগুলো সার্চ করতে নির্দেশ দিয়ে উপর
দিকে আসতে থাকে ও। পুরো বাড়িটা একবার খুঁজে দেখা ভীষণ
দরকার। মনের ভিতর একটা খটকা লাগছে যেন।

***

দীপ পেশায় একটি নামী কোম্পানীর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। কিন্তু ,


বাড়িতে বৈভবের প্রাচুর্য্যের থেকে বইয়ের প্রাচুর্য্যই বেশী, সেটা খুব
ভাল লাগল সুদীপ্তার। বাড়িটা বেশ বড়ই, দোতলা। একতলায় বসার
ঘর, রান্না ঘর, ডাইনিং স্পেস, বাথরুম, এইসব। একটা স্টোররুমও
আছে। রান্নার যাবতীয় ভাঁড়ারে ঠাসা। উপরে উঠতে উঠতে ধূপের
গন্ধ এল নাকে। পুজো হয়েছে তার মানে কিছুক্ষণের মধ্যেই। চোখ
ঘোরাল সুদীপ্তা এদিক ওদিক। দুটোই বিশাল মাপের বেডরুম,
অ্যাটাচ্ড বাথরুম, সঙ্গে করিডর, এইধারে ছোট্ট সিঁড়ি দিয়ে উপরে
ঠাকু র ঘর। আর একধারে ছাদ।

হঠাৎ যেন মনে হল কেউ ঝট করে সরে গেল ছাদের দরজার কাছ
থেকে। সবকিছু বেশ পরিপাটি করে সাজানো, প্রথম ঘরটায় ঢু কে
এদিক ওদিক চোখ ঘোরাল সুদীপ্তা। এবাড়িতে দীপ মজুমদার যখন
একাই, তাহলে নিশ্চয় কাজের লোকই সব করে ঘরের কাজ। মানে
কাজের লোকের সাথেও কথা বলাটা দরকার। ঘরের ভিতর এদিক
ওদিক চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে একটা জিনিসের দিকে চোখ গেল,
কোথায় যেন দেখেছে চাবির রিঙটা, বেশ অন্যরকম, একটা নীল
কৃ ষ্টালের মতো। এরকমটাই দুই বাড়ির মধ্যেই কোন এক বাড়িতে
দেখেছে ও। চোখ বন্ধ করে ভাবতে ভাবতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল

​31
সুদীপ্তা। আর তখনই হল শব্দটা। একটা কিছু মাটিতে পড়তে পড়তেই
কেউ খুব তাড়াতাড়ি তু লে নিল যেন জিনিসটা, ধাতব কোন
জিনিসের আওয়াজ। স্বাভাবিকভাবেই উৎসুক হল সুদীপ্তার
চোখদুটো। সঙ্গে সঙ্গে পিছন ঘুরে ঘর থেকে বেরতেই হতভম্ব হল
সুদীপ্তা। এখানে? এভাবে? ও তো এক্সপেক্টই করেনি!!!

-"আপনি এখানে?" বিস্মিত চোখে সামনের ব্যক্তিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ল


সুদীপ্তা।

​32
তৃ তীয় পর্ব

।।১।।

-"কি হল? উত্তর দিচ্ছেন না কেন?" সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে সাবিত্রী দেবীর


দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল সুদীপ্তা। ওর প্রথম থেকেই এই মানুষটাকে
নিয়ে সন্দেহ জেগেছিল। কিন্তু এটা একেবারে এক্সপেক্ট করেনি। খুব
বেশি চেঁচাতেও পারছে না। যতই হোক, যথেষ্ট বয়স্ক একজন মানুষ,
চাইলেও সম্ভব নয় জোর গলায় কথা বলা।

সাবিত্রী দেবীর অবনত দৃষ্টিতে যেন টলটল করছে জল। এটাও


আশাতীত সুদীপ্তার কাছে।

নিজেকে সামলে নিলেন প্রবীণা। শাড়ির আঁচলে মুখটা মুছে বেশ


দৃঢ় কন্ঠেই উত্তর দিলেন, "আমার ভাইঝি এখানে কাজ করে। ও আজ
তাড়াতাড়ি চলে গেছে, তাই আমায় আসতে হয়েছে। একটু সামলে
দিয়ে চলে যাব, ও সন্ধ্যের মধ্যে এসে যাবে।"

-"আপনি তো কাল বললেন না আপনার ভাইঝিও আছে, সে

​33
আবার এবাড়িতে কাজও করে। আবার আপনিও এই বাড়িতে
কাজের সূত্রে আসেন।"

-"আসলে আপনি তো শুধু পরিবারের কথাই জানতে


চেয়েছিলেন, তাই আর বলা হয়নি।"

-"আর একটা জিনিসও লোকানোর চেষ্টা করবেন না। যা জানেন


তাড়াতাড়ি বলে দিন। তাতে আপনারও ভাল আর আপনার
ম্যাডামেরও... আপনারা সহযোগিতা না করলে কিভাবে কাজ
এগোবে? যার খাচ্ছেনযার পরছেন তার বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র করতে
লজ্জা করছে না?" উচ্চস্বরে কথাগুলো বলে দিল এবার সুদীপ্তা,
আর মাথার ঠিক থাকছে না। জোরে একটা শ্বাস নিয়ে আবার বলল,
"আপনারা প্রত্যেকে নিজেদের মতো করে একটা গল্প বলে যাচ্ছেন।
কি ভাবলেন? পার পেয়ে যাবেন? সব কটার হাতে হাতকড়া পড়বে
এবার। কাল থেকে সহ্য করছি।" কথাগুলো রাগত স্বরে বলে চুপ
করল সুদীপ্তা। কিন্তু যা ঘটল তা এক্সপেক্ট করেনি ও একেবারেই।

চোখে জলের সাথে যখন অনেকটা অপমান আর অনেকদিনের


জমে থাকা যন্ত্রণা বেরিয়ে আসে, তখন হয়তো দৃষ্টিতে এমন হয়।

-"আমি ষড়যন্ত্র করব? আমি? আপনি জানেন লাবু যেদিন


জন্মেছিল সেদিন কে সারারাত জেগেছিল হাসপাতালে ওকে? প্রথম
কোলে করে কে মামাবাড়িতে পৌঁছাতে গেছিল? কে খাওয়াত
লাবুকে ঘন্টার পর ঘন্টার গল্প শুনিয়ে? জ্বরের ঘোরে মেয়েটা যখন
পড়ে থাকত কে বসে জলপট্টি দিত মাথার কাছে বসে? কে স্কু লে
যাওয়ার সময় ব্যাগ নিয়ে সাথে ছুটত? কে ওর জন্য খুঁজে খুঁজে
লুকিয়ে নিয়ে আসত ওর প্রিয় চটপটি? ষড়যন্ত্র করছে... ষড়যন্ত্র..."
কেঁ দে ফেললেন সাবিত্রী দেবী। অনেকদিনের চাপা কান্নাটা যেন

​34
বেরিয়ে এল।

-"লাবুকে খুঁজে পাওয়া এত সহজ নয়, ওকে খুঁজে পেতে গেলে


আগে ওকে জানুন, চিনুন। আর নয়তো... নয়তো ওকে একটু শান্তি
দিন এবার। অনেক সহ্য করেছে মেয়েটা... এবার একটু দয়া করে
শান্তি দিন।" কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলে নীচে চলে গেলেন
প্রৌঢ়া।

চেঁচামেচিতে কখন মিঃ মজুমদারও উঠে এসেছেন উপরে, খেয়াল


করেনি সুদীপ্তা। নিজেকে আজ কেমন অপরাধী লাগছে ওর। আর
একটি শব্দও উচ্চারণ করতে ইচ্ছে করছে না। আর এক মুহূর্ত ও
দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না এখানে, দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে
সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল সুদীপ্তা। পিছন ফিরে তাকাল না
একবারও, তাকালে হয়তো দেখতে পেত, কারো চোখে জল তো
কারো পড়ছে দীর্ঘশ্বাস। সবাই অপেক্ষায়... একজনেরই।

***

বাড়ি ফিরে এসেছে আধঘন্টা আগে, কেন কে জানে ওবাড়ি থেকে


বেরিয়ে আর ইচ্ছে করছিল না

কোথাও যেতে। বাকিরা তো আছেই, মাথাটা ভীষণ ঝিমঝিম


করছে। কোথাও যেন বুঝতে একটা ভু ল হচ্ছে। মানুষটাকে খুঁজে বের
করতে হলে মানুষটার মাথার মধ্যে কি চলছে সেটা জানতে হবে?
এটাই তো বললেন সাবিত্রীদেবী। মানে নিজের ইচ্ছাতেই কি সব
ছেড়ে চলে গেছেন লাবণ্য সান্যাল? নাকি এর অন্য কোন মানে
আছে? আচ্ছা, মানুষটা বেঁচে আছে তো? ধ্যুত! কি সব ভাবছে
ও? একটা করে দিন চলে যাচ্ছে, এক একটা মিনিট চলে যাচ্ছে,
কিন্তু এখনও অবধি কোথাও কোন কিছুই নেই। সময়টা বড্ড নষ্ট হয়ে

​35
যাচ্ছে, যত দেরী হচ্ছে তত যেন তাকে খুঁজে পাওয়ার রাস্তাটা ধূসর
হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যায়, তাকে খুঁজে পাওয়া কি
এতই সোজা? ফোনটা বেজে উঠল সুদীপ্তার, অচেনা নম্বর।
"হ্যালো" বলতেই ওপাশ থেকে কাঁদো কাঁদো গলাটা ভেসে এল।

।।২।।

সব কথা ফোনে হয় না। তাই, সামনে সামনি কথা বলাই সমীচীন


মনে হয়েছিল সুদীপ্তার। পেখমকে তাই আধঘন্টার মধ্যে নিজের
বাড়িতেই ডেকে নিয়েছিল ও। বাইরে তো মিডিয়ার লোক ওত পেতে
বসে আছে। শান্তিতে বসা বা কথা বলার মত পরিস্থিতিই রাখেনি
এরা। ওর বাড়ির ঠিকানাটা ফোনেই বুঝিয়ে দিয়েছিল পেখমকে।
আসার পর ও যতটা সম্ভব চেষ্টা করছে ওকে কমফর্টে বল ফিল
করাতে। একটা সাদা রঙের টপ আর একটা নীল ডেনিম পরনে,
এলোমেলো খোলা চুল ঘাড় অবধি, মুখটা মিষ্টি, মায়ের সাথে মুখের
মিল আছে। রোগা রোগা চেহারার এই মেয়েটাকেই কালকে কেমন
উদ্ধত, অহংকারী লেগেছিল। কিন্তু আজ এই মেয়েটারই মায়া ভরা
চোখদুটো দেখে কই তেমন তো মনে হচ্ছে না। কোনটা সত্যি
তাহলে? আজকের মেয়েটা যে সামনে দাঁড়িয়ে নাকি কালকের সেই
উদ্ধত, নাক উঁচু মেয়েটা?

-"সরি, ম্যাম, আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম।"

-"সরি বলার কিছু নেই পেখম। তু মি এসেছ আমার কাছে, এটাই


অনেক বড় ব্যাপার।"

-"আমি বাড়িতে সত্যি বলে আসিনি, তাই আমার হাতে বেশি সময়
নেই।"

-"হ্যাঁ, হ্যাঁ, একদম। তোমার যতটা যা বলার তু মি বলতে শুরু কর।

​36
আমিও আর দেরী করতে চাই না।"

পেখম বেশ নির্ভ য়েই বলতে লাগল -

"মায়ের সাথে আমার সম্পর্ক টা আর পাঁচজন মা-মেয়ের মতন নয়।


কেন জানি না। ছোট থেকেই আমি মাকে সেভাবে পাইনি কাছে,
দূরত্বটা হয়তো তখন থেকেই শুরু হয়েছিল। এরকমও অনেকদিন
হয়েছে, মা সকালে বেরনোর সময় আমায় কোন প্রমিস করে গেছেন,
আর আমি সেটা বিশ্বাস করে মায়ের অপেক্ষা করে গেছি, কিন্তু মা
সেই প্রমিস রাখেনি, ভু লেই গেছে। ধীরে ধীরে আমিও মায়ের জন্য
অপেক্ষা করা, মায়ের কথা বিশ্বাস করা বন্ধ করে দি।"

এটুকু বলে মাথা নীচু করে চুপ করে যায় পেখম। ছলছলে চোখদুটো
আড়াল করার চেষ্টা করে কয়েক সেকেন্ড। তারপর আবার বলে, "মা
বাবাকে ছোট থেকেই দেখে এসেছি কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। আমি
ওদের জন্য কতটা ইম্পরট্যান্ট সেটা আমি সত্যিই কোনদিন ফিল
করিনি। তারপর মা বাবার ডিভোর্স। আমি বুঝতেই পারছিলাম না
প্রথমে কার কাছে যাব আমি? কে আমায় রাখতে চায় এটা আমার
মাথায় আসেনি বিশ্বাস করুন। আমার মনে হচ্ছিল দুজনেই যদি
রাখতে না চায়, তখন আমি কোথায় যাব? কার কাছে থাকব? কিন্তু
তখন যখন মা আমার কাস্টডি নিয়ে কথা শুরু করে, আমি সত্যি খুব
অবাক হয়ে গেছিলাম সেদিন। বুঝতে পারছিলাম না, কি হচ্ছে?
আমাকে কাছে রাখার জন্য মা লড়ছে এটাই প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না।
তারপর থেকে মায়ের সাথে আমার সম্পর্ক টা বড় অদ্ভু ত জায়গায়
গিয়ে দাঁড়ায়। একবার মনে হতো, আর কেউ না থাক, মা আমার
জন্য আছে, থাকবে। নয়তো আমায় কাছে রাখার জন্য লড়ল কেন?
আরেকবার মনে হত, মা এত স্বার্থপর কেন? ঐ লোকটার জন্যই তো
মা বাবার ডিভোর্স, সমস্ত নিউজে, ম্যাগাজিনে, সোশ্যাল মিডিয়ায়
এই নিয়েই আলোচনা। মাথাটা দপদপ করত আমার এইসব নিয়ে

​37
শুনতে শুনতে। খুব রাগ হতো, ঘেন্না হতো। ইচ্ছে করত এই সবকিছু
থেকে পালিয়ে যেতে।"

বলতে বলতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পেখম। বাইরে জানলার দিকে


তাকাল। তারপর বলল, "যাই হোক। আমি আমার লাইফ, আমার
ডেসটিনি, মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু তাই বলে আমি কখনও এটা
চাইনি..."

গলাটা যেন বুজে এল কিশোরী মেয়েটার। কিশোরী হলেও


পেখমের কথাগুলো আজ ভাবিয়ে তু লছে সুদীপ্তার অবচেতন
মনকে।

-"আমি কখনও চাইনি মা-ই হারিয়ে যাক! হারিয়ে যেতে তো আমি


চেয়েছিলাম। আমি জানি না কি হয়েছে, কি চলছে। কিন্তু মা বেশ
কিছুদিন ধরেই ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেছিল। অন্ধকার ঘরে বসে থাকত
ঘন্টার পর ঘন্টা। জিজ্ঞাসা করলেই বলত, 'ভাবছি'। দ্যাট ওয়াজ নট
নর্ম্যাল। কিন্তু , মায়ের সাথে শেয়ার করার মত বা মাকে জিজ্ঞাসা
করার মতন সম্পর্ক কোনদিনই তৈরী হয়নি, তাই আমি... কিন্তু এখন
মনে হচ্ছে নিশ্চয় কিছু হয়েছে, আর তার জন্যই... প্লিজ ম্যাডাম,
আমার যা মনে হচ্ছিল বলা উচিত আপনাকে বললাম, আপনিও যা
জিজ্ঞাসা করার করুন। আমি পুরো কোঅপেরাট করব। কিন্তু মাকে
খুঁজে বের করুন। ঐ লোকটাকে আমি বিশ্বাস করি না। ও সব পারে।"

-"কে?"

-"কে আবার? অর্জুন রায়চৌধুরী... আমার বাবা।"

এটা এক্সপেক্ট করেনি সুদীপ্তা। হচ্ছেটা কি? কাকে বিশ্বাস করবে?


কে সত্যি বলছে আদৌ?

​38
-"তু মি এরকম বলছ, তার পিছনে নিশ্চয় যুক্তি সঙ্গত কারণ আছে
কোন, তো সেটা না বললে তো..."

-"হ্যাঁ, আমি সব বলব, কিন্তু আমার হাতে আজ সময় কম,


বেশীক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকলে আমার বাড়ি থেকে বেরনো নিয়েও
সমস্যা শুরু করবে ওরা।"

-"ওরা মানে?"

পেখমের উত্তর দেওয়ার আগেই ওর ফোনে একটা নোটিফিকেশন


ঢু কল সম্ভবত। ও উঠে পড়ল সেটা দেখেই।

-"আজ আসছি, আমি আপনাকে ফোন করে যত দ্রুত সম্ভব


যোগাযোগ করছি আবার।"

সুদীপ্তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে গেল পেখম।

বেশ অদ্ভু ত লাগল ওর। পেখমের কথাগুলো কতটা সত্যি? নাকি


কেউ ওকে এগুলো বলতে পাঠিয়েছিল? সব গুলিয়ে যাচ্ছে। সবটা
ধোঁয়াশা। উঠে পড়ল সুদীপ্তা, নিজের ঘরে ঢু কে দরজাটা লাগিয়ে
দিল। ডায়েরিটা শেষ করা ভীষণ জরুরি।

।।৩।।

ট্রেনের নম্বর আর প্ল্যাটফর্মের নম্বরটা মিলিয়ে নিয়ে বসল স্টেশনে


লাবণ্য। এত ভারী লাগেজ বয়ে আনতে গিয়ে হাঁফিয়ে গেছে তো
বটেই। কিন্তু , শারীরিক ধকলের থেকে বেশী মানসিক ধকল। মনটা যে
এতটা খারাপ হবে স্বপ্নেও ভাবেনি ও। গুজরাটে যখন পোস্টিং হয়ে
এসেছিল, এতদূর, বাড়ি সংসার সব ছেড়ে, তখনও কেঁ দেছিল,
আজও কাঁদছে। কারণটাও এক, শুধু যাদের জন্য কেঁ দেছিলো সেই

​39
মানুষগুলো আলাদা।

আজ যদি ঐ মেহতাদের সাথে মিটিংটা না থাকত, সবকটা বন্ধু


এখানে লাবণ্যর সাথে স্টেশনেই থাকত, সেটা লাবণ্য খুব ভাল করে
জানে, বন্ধু জিনিসটা এমন। যাদের সাথে সবসময় আছি, হাসছি,
গল্প করছি, ঘুরতে যাচ্ছি, কাজ করছি, তারা যে সবসময় ভাল বন্ধু
হয় তা কিন্তু নয়। 'বন্ধু ' শব্দটাও যেমন দামী, যার তার জন্য ব্যবহার
করা যায় না, তেমনি সত্যিকারের বন্ধু পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার,
তা লাবণ্য জানে। আর সেই সৌভাগ্যটা ওর হয়েছে। মনে মনেই
একটা স্বস্তির হাসি হাসল লাবণ্য।

এখনও এনাউন্স হল না ট্রেনের, বলছে নাকি লেট আছে ঘন্টা


খানেক। মানে এখন এখানেই খানিকক্ষণ বসতে হবে। বাইরে
আকাশটা আজ মেঘলা, এই মেঘলা দিন খুব পছন্দ লাবণ্যর। আজ
অর্জুনেরই আসার কথা ছিল। কিন্তু একটা জরুরী কাজে আর আসা
হল না ওর। অসুবিধাটা বুঝলেও মনে মনে যে খারাপও লেগেছে
সেটা অস্বীকার করতে পারে না লাবণ্য।

এই চাকরিটা ছেড়ে ব্যবসা শুরু করার ডিসিশনটা ওদের দুজনেরই,


আর চাকরিটা ছেড়ে লাবণ্যর কোন অনুতাপ নেই। ওর মন থেকে
একটাই ধ্বনি আসছে, যা হবে এবার ভালই হবে।

***

বই পড়ার অভ্যাস লাবণ্যর ছোট থেকে। সব সময় বই মুখে গুঁজে


বসে থাকার জন্য বকাও খেত দিদা-ঠাম্মির কাছে। ভাই বোনদের
পড়তে বসানোর জন্য বকা দিতে হত, ওকে বই রেখে ওঠানোর জন্য
রীতিমত কসরত করতে হাত ওনাদের। তা এই সুঅভ্যাসটা ওর
সবদিনই থাকবে, তাই ওর প্রিয় লেখকের বইটা এখনও ওর সাথেই

​40
আছে। বইটা খুলে পা দুটো মুড়ে স্টেশনেই বইয়ের পাতায় মশগুল
হয়ে গেল লাবণ্য।

একবার বই পড়তে শুরু করলে সময় কতটা গড়িয়ে গেছে, খেয়াল


থাকে না লাবণ্যর কোনদিনই। পরিচিত কন্ঠস্বরে টনক নড়ল ওর। বই
থেকে মুখটা সরাতেই মুখে নিজের অজান্তেই হাসি ফু টে উঠল ওর।

-"কিরে, তু ই এখানে?"

-"হ্যাঁ, শুনলাম প্রদীপদার কাছে, ট্রেন প্রায় আড়াই ঘন্টা লেট।


তখনই মনে মনে কষে নিলাম, লাবণ্য ম্যাডাম তাহলে স্টেশনেই
নিশ্চয় বইয়ে মুখ গুঁজে বসে। ব্যস, মিটিং শেষ করে চলে এলাম,
আর যা ভাবলাম তাই।"

-"হুম, তাহলে লাবণ্য রায়চৌধুরীকে তার নিজের থেকেও বেশী


দীপ মজুমদার চেনে বলছিস"

-"এটা আবার জিজ্ঞাসা করবার মতন কিছু? সত্যি কথাই তো।"

-"হুম," মুখের হাসিটা রেখেই সম্মতি জানাল লাবণ্য। এই চাকরি


ছাড়ার ডিসিশনটা নেওয়া এতটাও সহজ ছিল না লাবণ্যর জন্য। এত
বড় একটা ডিসিশন! এতটা রিস্ক। স্তম্ভের মতন যদি কেউ সাথে দিয়ে
থাকে, প্রকৃ ত বন্ধু র মত, তাহলে সেটা দীপ ছাড়া কেউ নয়।

-"ব্যবসা দাঁড়াক, না দাঁড়াক, যাই হয়ে যাক না কেন, আমাদের


বন্ধু ত্বটা কিন্তু একই থাকবে, এটা মনে রাখিস।"

-"আরে হ্যাঁ, এটা আবার বলার কথা? অর্জুন আর তু ই একসাথে


পারবি এটা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। অর্জুনের সাথে যতটুকু

​41
কথা হয়েছে, হি ইজ আ সার্প মাইন্ড। হি ক্যান ডু ইট।"

-"হুম। অনেক হয়েছে, থাম এবার। নিজে এবার একটা দেখে শুনে
বিয়ে কর, আমরাও যাতে খাওয়ার সুযোগ পাই।"

-"খুঁজে দিস তু ই, তোর মতন কাউকে। তোর উপর ভরসা রাখতে


পারি।"

বহু প্রতীক্ষিত ট্রেনের এনাউন্সমেন্ট মাইকে, অবশেষে ট্রেন


আসছে।

দীপের সাহায্যে বাক্স-প্যাটরা গুছিয়ে বাগিয়ে ট্রেনে চড়ে বসল


লাবণ্য রায়চৌধুরী। বিদায় গুজরাট। তারিখ: ১২/০৫/১৯৯৫

***

কলিং বেলের আওয়াজে যেন চমকে উঠল সুদীপ্তা। যেন ডু বে


গিয়েছিল কোন এক অতল গভীরতায়। বড় সুন্দর, বড় মধুর লাগে
কখনও কখনও পিছন ফিরে তাকাতে। মনে হয় যেন শেষ না হয়।
চলতেই থাকু ক, ঠিক যেন একটা সিনেমা, হোক না সাদা-কালো।

ডায়েরিটা বন্ধ করে উঠল সুদীপ্তা। রাতু ল এসে গেছে। ওকে


দরজাটা খুলে দিয়ে নিজের ঘরে ঢু কে এল আবার। ও চায় না এই
আমেজটা কাটুক। ঘোরটার মধ্যেই থাকতে বেশ লাগছে। আবার শুরু
করল।

***

আজ বাড়িতে পুজো। ব্যবসাটা এখন মোটামুটি ঠিকঠাকই


দাঁড়াচ্ছে, ঐ জন্য শ্বশুরমশাই বললেন, পুজোটা করতে। অনেকদিন

​42
বাড়িতে সত্যনারায়ণের পুজোও হয়নি, আর পরশু ডাক্তারের
রিপোর্ট টা আসার পর লাবণ্যরও খুব মনটা চাইছিল হোক আজ
পুজোটা। দিনটাও ভাল, গুরুপূর্ণিমা।

বাড়িতে অনেকদিন পর দু'টো সুখবর একসাথে। আশপাশের


লোকজন আর কাছের আত্মীয়স্বজনদেরই ডাকা হয়েছে শুধু।
শাশুড়িমা অবশ্য বলে দিয়েছেন এখনই কাউকে কিছু না বলতে। শুধু
দুই বাড়িই জানে, ব্যস। তিন মাস হোক, তারপর সবাইকে জানানো
হবে।

এবার অর্জুনের সাথে সম্পর্ক টাও ঠিক হবে নিশ্চয়। কপালে টিপটা
পরতে পরতে জানলার গরাদ দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক
হয়ে গেল লাবণ্য। এই লাল পাড় শাড়িটা আগের বছর অর্জুনই
দিয়েছিল ওকে, পরাই হয়নি। আজই প্রথম পরল, কই একবারও তো
অর্জুন বলল না, কেমন লাগছে।

সুখবরটা জানার পর খুশী ছিল অর্জুন, সেটা স্বীকার করছে লাবণ্য,


কিন্তু ওর খুশিটা ওর চোখ অবধি পৌঁছাচ্ছিল না যেন। হতে পারে
ওটা লাবণ্যের মনের ভু ল, ইনফ্যাক্ট ও চায় এটা যেন ওর মনের ভু লই
হয়।

ড্রেসিং টেবিলটার সামনের টুলটায় বসে পড়ল লাবণ্য। শরীরটা


আনচান করছে। অর্জুনকে ও সেই কোন ছোট থেকে চেনে। দুজনে
একসাথে পড়াশোনা, কাজ, সব। দুজন কাজের জায়গায় একটা
অসাধারণ জুটি। সবাই একবাক্যে তা স্বীকার করে। বহু মানুষের থেকে
বহুবার এই প্রশংসা শুনেছে ও। কিন্তু অর্জুন যেন এখন কেমন পাল্টে
গেছে। না, অর্জুন আর এই সম্পর্ক টা নিয়ে খুশী নয় বা টেকন ফর
গ্র্যান্টেড করে নিয়েছে তাও কিন্তু নয়। কিন্তু লাবণ্যর সবসময় মনে
হয়, প্রতিটা মুহূর্তে অর্জুন ওকে এটাই অনুভব করায়, এই সম্পর্ক টা

​43
বা এই বিয়েটাকে সুন্দর রাখার সব চেষ্টা অর্জুনই করেছে আর করছে।
হ্যাঁ, অর্জুন করেছে, অনেক করেছে, কিন্তু লাবণ্যর কি কোন অবদান
নেই? ও কি কিছুই করেনি? বহুবার বহুভাবে অর্জুন বলেছে,
বুঝিয়েছে ওকে। বহু অশান্তি হয়েছে, বহু ঝগড়া বাকবিতন্ডাও
হয়েছে। সব ঠিক হয়েছে, কিন্তু আবার যে কে সেই। অর্জুনকে
ভালবেসে বিয়ে করেছিল লাবণ্য। অর্জুন বরং চেয়েছিল আরও
কিছুদিন পর। লাবণ্যই আর দেরী করতে চায়নি। অর্জুনের সাথে
থাকলেই ও ভাল থাকবে, এই বিশ্বাসেই বিয়ের পিঁড়িতে তড়িঘড়ি
বসে পড়েছিল লাবণ্য। কিন্তু অর্জুন যে তখন বিয়েটা চায়নি, এটা
লাবণ্য ভাবেনি। কেন চায়নি অর্জুন? জীবনটা আরেকটু গুছিয়ে
নিতে চেয়েছিল। লাবণ্য কি ওর জীবনে ঢু কে পড়ে বরং আরও
এলোমেলো করেছিল ওর জীবনটাকে?

চোখের জল মুছে নিল লাবণ্য। কই এইভাবে তো আগে কখনও


ভেবে দেখেনি। আগেই কি ভেবে দেখা উচিত ছিল?

লাবণ্য সবদিন বাকী সবার খুশীর সাথে সাথে নিজের খুশীটাকেও


প্রায়োরিটি দিয়ে এসেছে। আর সেই কারণেই অর্জুন মনে করে,
লাবণ্য এই সম্পর্ক টার জন্য কিছু করে না তেমন। যা করে অর্জুনই
করে। আসলেই কি লাবণ্য স্বার্থপর? এটা এখন মাঝে মাঝে সত্যি
মনে হয় লাবণ্যর।

গুজরাটে যাওয়ার ডিসিশনটাও লাবণ্যই নিয়েছিল। নিতেই হত।


নিজের পরিবারটাকেও তো দেখতে হবে, টাকার দরকার ছিল।
অর্জুনকে নিজের বাড়ির এত সমস্যার কথা কোনদিনই বলেনি
লাবণ্য। তাই অর্জুনের ভু ল বোঝা বা ঠিক বোঝা, যাই হোক, আর
বদলানোর চেষ্টা করেনি ও।

​44
***

মোবাইলে কলটার সাথে সাথে দরজায় টোকার শব্দে আবার


বর্ত মানে ফিরে এল সুদীপ্তা। রাতু ল ডাকছে, আর সাথে মিসডকল
দিচ্ছে। ও কি কোন খোঁজ পেয়েছে তাহলে? তাড়াতাড়ি উঠে
দরজাটা খুলল সুদীপ্তা।

-"কিছু এগোল? কোন প্রগ্রেস? কোন লিড?"

-"হুম।"

মুখটা বেশ গম্ভীর রাতু লের। রাতু ল যখন বাড়ি ফিরল তখনই ওর
সাথে একবার কথা বলা উচিত ছিল সুদীপ্তার।

-"ফোনটা কাছে রাখ, ফোন আসবে এখুনি তোর কাছেও।"

-"মানে?" - বলতে বলতেই ফোনটা বেজে উঠল সুদীপ্তার।

রাতু লের দিকে একবার, আর ফোনের দিকে একবার তাকিয়ে


রিসিভ করল ফোনটা।

-"হ্যালো।"

-"হ্যাঁ, ম্যাডাম, একবার থানায় আসতে হবে, আসলে লাবণ্য


সান্যালের কেসটা তো আপনার আন্ডারে, তাই বাধ্য হয়ে এখন
আপনাকে ফোন করলাম।"

-"কি হয়েছে?" বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্নটা করল দাঁ-কে সুদীপ্তা।

-"আসলে একটা বডি পাওয়া গেছে... সাস্পেক্ট করা হচ্ছে ওটা


লাবণ্য সান্যালেরই বডি। আপনি প্লিজ তাড়াতাড়ি একবার থানায়

​45
আসুন।"

আর কিছু বলল না সুদীপ্তা, ফোনটা কেটে দৌড়ে বেরিয়ে গেল


ফ্ল্যাট থেকে।

​46
চতু র্থ পর্ব

।।১।।

মুখে যতই বলুক অর্জুন যে বৃষ্টির কারণে আজকে যেতে বারণ


করছে, খুব ভাল করে বুঝতে পারছে লাবণ্য ওর বাধা দেওয়ার
কারণটা কি? বেশ কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছে ও, এখন দীপ-এর
প্রসঙ্গ উঠলেই অদ্ভু ত ব্যবহার করছে অর্জুন। কারণটা সত্যিই জানা
নেই ওর। প্রথম প্রথম অতটা পাত্তা দেয়নি, কিন্তু এখন রীতিমতো
চোখে পড়ছে।
এমনিতেই পেখম হওয়ার পর থেকে এখনো অব্দি কোথাও
বেরোনো হয়নি লাবণ্যর, এমনিতেই বিরক্ত হয়ে গেছে ও এই চার
দেওয়ালের মধ্যে। অর্জুনের তো সময়ই নেই। আজ বহুদিন পর যখন
ওর পুরোনো অফিসের বন্ধু রা কলকাতা আসছে একটা বিয়েবাড়ি
অ্যাটেনড করতে, তখন ওকেও বলল দেখা করতে পারবে কি না।
সাথে সাথে লাফিয়ে উঠেছিল লাবণ্য। আজ দুপুরবেলা যখন

​47
বেরোনোর জন্য একেবারে রেডি, তখন এই অশান্তিগুলোর কি
মানে? অর্জুনকে তো ও আগে থেকে বলেনি তা নয়।
তাহলে বেরোনোর মুখে হঠাৎ এরকম করে কি প্রমাণ করতে চাইল
ও? এক প্রকার জিদ করেই গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে এলো লাবণ্য।
রঘুদা গাড়ি চালাচ্ছিল, ও ওর ডায়েরিটা নিয়েই ব্যস্ত ছিল, আর
কাঁচের বাইরে তাকাচ্ছিল এটা দেখতে যে কতদূর এলো।
অর্জুনকে অনেক ছোট থেকে চেনে লাবণ্য, এখন কেন কে জানে
অর্জুনকে ঠিক চিনতে পারে না ও। নাকি আগেই চিনতে ভু ল
করেছিল, তাই এখন এত অচেনা লাগছে? লাবণ্য কোনোদিন
স্বপ্নেও ভাবেনি অর্জুন এরকম চিন্তাভাবনা পোষণ করতে পারে
কখনো, আর আজ যখন কথাগুলো...
যাক গে জোর করে কথাগুলো মন থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
করল লাবণ্য। পুচকিটাকে ছেড়ে আজ অব্দি বেরোয়নি ও এখনো।
এই তো সবে এক বছর হল গত ফেব্রুয়ারিতে, কি করছে কে জানে।
ঠাকু মার কাছে তো ভালই থাকে, মাকে বেশি না খুঁজলেই হল,
নয়তো কান্নাকাটি করবে। ও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে
আসবে। সামনের দিকে আবার তাকাল লাবণ্য।
কিন্তু হঠাৎ করেই যে কি হয়ে গেল আচমকা। রং সাইড থেকে
একটা ম্যাটাডোর একেবারে গাড়ির কাছে চলে এল কোথা থেকে।
এত তাড়াতাড়ি সব কিছু হয়ে গেল যে কিছু বুঝে উঠতেই পারল না
লাবণ্য। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জানলার এই পাশ থেকে ওই পাশে
যাওয়ার চেষ্টা করল।
রঘুদা গাড়ির স্টেয়ারিংটা যতটা সম্ভব ডান দিকে ঘোরানোর চেষ্টা
করছিল যাতে কোনভাবে ধাক্কাটা এড়ানো যায়, কিন্তু শেষ রক্ষাটা
আর হলো না। ম্যাটাডোরটা সজোরে এসে ধাক্কা মারল গাড়ির বাম
দিকের দরজায়। লাবণ্য বাম দিকেই বসে ছিল, নিজের মুখটা
ওইপাশে সরিয়ে নিল। নিজেও যতটা সম্ভব সরে গেছে ডান দিকে,
কিন্তু বাম হাতটায় একটা অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করল ও। তারপর

​48
আর সেভাবে কিছু মনে নেই, শুধু ঐ কথাটা ছাড়া।
হসপিটালের বেডে অর্জুন সহ বাড়ির বাকি লোকজন যখন
পৌঁছালো তখনও লাবণ্যর সম্পূর্ণ চেতনা নেই, তবু ঐ সময়েও ও
ওর পেখম আর অর্জুনের কথাই ভাবছিল। বাচ্চাটা এবার ওকে ছাড়া
কি ভাবে থাকবে। ওর আধবোজা চোখ দুটো এদিক ওদিক খুঁজছিল।
এত ছোট বাচ্চাকে তো আর হাসপাতালে নিয়ে আসা সম্ভব না, ওর
মাথায় তখন এসব আসেনি, কিন্তু তখনও অর্জুন ওর পাশে বসে
একই কথা বলছিল, "এত বার বারণ করলাম, এখন এলো তোমায়
তোমার দীপ বাঁচাতে? কে দেখছে এবার? সেই তো আমিই। "
আর চোখ দুটো খুলতে ইচ্ছে করেনি লাবণ্যর। ওর বাম হাতটা
ভেঙেছিল, মাথাতেও চোট লেগেছিল কিন্তু সেরকম গুরুতর নয়,
স্টিচ হয়েছিল খান চারেক। সেই প্রথমবার জীবনে মনে হয়েছিল
কেন মাথার চোটটা আরো বেশি গুরুতর হলো না? তাহলে আর
চোখ দুটো খুলতেই হতো না এসব শোনার জন্য।

।।২।।
গাড়ির তীব্র হর্ণে যেন জেগে উঠল সুদীপ্তা। বাইরে বৃষ্টিও আরম্ভ
হয়ে গেছে।
রাতু ল গাড়ি চালাতে চালাতে একবার সুদীপ্তার দিকে দেখল, ও
হঠাৎ চমকে উঠল কেন?
"কিরে কি হলো তোর আবার?"
"আর কতক্ষণ?"
"কি করব বল জানিসই তো যা ট্রাফিক। তার মধ্যে আজ আবার
বৃষ্টি, এখনো ১৫ মিনিট লাগবে মনে হচ্ছে।"
সুদীপ্তা যে ভিতরে ভিতরে কতটা উশখুশ করছে আর অস্থির হচ্ছে,
সেটা জানে রাতু ল। ও বুঝতে পারছে কিন্তু ওর কিছু করার নেই।"
ফোনটা বাজছে রাতু লের। সুদীপ্তা নিজের ফোন টা চেক করতে
গিয়ে দেখল ফোনটা চার্জ আউট হয়ে সুইচ অফ হয়ে গেছে।

​49
-"ইস!"
ফোনটায় একবিন্দু চার্জ নেই, এরকম কখনো করেনা সুদীপ্তা,
আজ কি করে এটা করল কে জানে।
"কটা বাজে?"
"৮ টা বেজে গেছে মনে হয়। কেন ঘড়িটা পরেও বেরোসনি?"
"পরে বেরোলে কি আর তোকে জিজ্ঞাসা করতাম?"
"আমার উপর চোটপাট করছিস কেন? আমি কি করলাম? আর
এত চাপ তো তু ই কখনো নিতিস না, আরে বডিটা তো লাবণ্য
সান্যালের নাও হতে পারে। "
"আর যদি হয়?"
আর কিছু বলল না রাতু ল, গাড়িটা ডান দিকে হাত দেখিয়ে
ঘোরাল। ব্যস, এটাই লাস্ট মোড়।
***
এদিকটায় এমনিতেই প্রচুর ঝিল,পুকু র। পুলিশি প্রহরায় মোড়া
পুরো রাস্তাটা। ব্যারিকেড সরিয়ে ভিতরে ঢু কে গেল ওরা, তখন
ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। আজ গিয়ে আর কিছুতেই
ইনভল্ভ হতে পারছে না ও, রাতু লই এগিয়ে গিয়ে কাজ শুরু করল।
সুদীপ্তা পুরো ব্ল্যাঙ্ক হয়েই দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। আশেপাশে কে কি
দেখছে, কে কি বলছে, কে আছে না আছে কিছুই দেখার মতো
মেন্টালিটি নেই আর ওর।
ঝিলটার পাশে একটা বেশ বড় লাইট জ্বলছে, জলের নীচ থেকে
এখনো ওঠেনি লোকগুলো, একটা বাচ্চা ছেলে জলে নেমেছিল
খেলতে। এরা এখানকার লোকাল, প্রায়দিনই এরা নামে, আজও
বিকেলে নেমেছিল, কিছু একটা দেখে ভয় পেয়ে উঠে এসেছে।
তারপর স্থানীয়রা জানতে পেরে পুলিশ কে খবর দিয়েছে।
ওদিকে লাবণ্য সান্যালের বাড়ির লোকজনও এসে গেছে। বাড়ির
লোকজন বলতে মা বাবা আর ওই সাবিত্রী পিসি। পেখমকে এখনও
কিছু জানায়নি হয়ত, কই ওকে তো দেখছে না।

​50
একটা মূর্তি র মতন দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা, মানে সাবিত্রী দেবী। মা
বাবা তু লনামূলকভাবে একটু যেন স্বাভাবিক।
সাবিত্রী দেবীর চোখগুলো দূর থেকে দেখছিল সুদীপ্তা। না, এই
মানুষটা সত্যিই ভালবাসে লাবণ্যকে, চোখের ভাষা এতটা মিথ্যে
হতে পারে না।
নিজেকে কখনো এতটা অসহায় লাগেনি ওর। এখনো সময়
লাগবে, বৃষ্টির জন্য আরো দেরি হচ্ছে। ছায়াতে গিয়ে বসল ও। বার
বার ওর মাথার মধ্যে লাবণ্যর লেখা ডায়েরিটার শব্দগুলোই ঘুরপাক
খাচ্ছিল।
।।৩।।
ঘরে বাইরে যেখানেই হোক মানুষের একটা অন্তত মাথা রেখে শ্বাস
ফেলার জায়গা থাকে। লাবণ্য এতটা সাকসেস এতটা অ্যাচিভমেন্টও
চায়নি যার সামনে ওর ভাল থাকার ইচ্ছেটাও লোকের কাছে খুব কম
গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। আজকের দিনটার কথা অর্জুনকে অনেকদিন
ধরেই তো বলে রেখেছিল ও। আজকের দিনটা অন্তত একটা সন্ধ্যে
কি অর্জুন ওর জন্য রাখতে পারতো না?
পারতো, মনে থাকলে নিশ্চয় পারতো। আর শুধু অর্জুন কেন। ওর
নিজের মা বাবা? সকলেই তো ওর নিজের। নাকি সকলেই ওকে
ছেড়ে এগিয়ে গেছে, ও তো এগোতে চায়নি একা।
আজ সকাল থেকে কেউ একবারের জন্যও একটি উইশ অব্দি
করেনি ওকে, প্রথমে ও ভেবেছিল হয়তো ওকে সারপ্রাইজ দেবে
বলে সবাই নাটক করছে। কিন্তু যখন সারাটাদিন কেটে গেল, তখন
ওর বুঝতে বাকি রইলো না যে আসলেই কারো সত্যিই মনে নেই।
শুধু পিসি আর পেখম ছাড়া। পেখম সকাল বেলাতেই আধো আধো
গলায় উইশ করে স্কু লে গেছিলো, ওই শিশু টা আর কি বা জানে।
আর সাবিত্রী পিসি ওর ফ্লাইট ধরতে বেরোবার আগে ওকে পায়েস
টুকু করে খাইয়ে দিয়েছিলো। তারপর ওর কলকাতা থাকে বেঙ্গালুরু
পৌঁছে সারাটাদিন কেটে গেছে, কারো একবার মনেই পড়লো না।

​51
উল্টে মায়ের ফোন করার কারণ এটা ছিল যে মিটিং সাকসেসফু ল
হলো কিনা সেটা জানা। ব্যস! এটুকু ই। প্রত্যেকটা মানুষ যাদের
নিজের বলে জানত লাবণ্য, এভাবে লাভ ক্ষতি হিসেব করে ওকে
হারিয়ে দিয়ে চলে যাবে ও স্বপ্নেও ভাবেনি। মাঝে মাঝে মনে হয় ওরই
কি দোষ ছিল? কিন্তু ও তো কোনোদিনই এতটা উচ্চাকাঙ্খী ছিল না,
ও তো শুধু অর্জুনের স্বপ্নের সাথে তাল মিলিয়ে ওকে সাথ দিতে
চেয়েছিল মাত্র, তার পরিবর্তে ও কি এগুলোই ডিজার্ভ করে? ওর
দোষটা কোথায়? অর্জুনের সাথে কেজো কথা ছাড়া আর কিছুই কথা
হয়নি সারাদিন। নিজের উপর নিজেরই হাসি পাচ্ছিল লাবণ্যর।
হোটেল থেকে শহরটা ভারী সুন্দর দেখা যায়, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে
রেলিঙের উপর হাতে ভর দিয়ে আলো ঝলমলে শহরটাই দেখছিল
লাবণ্য। তখনি আবার বাজল ফোনটা।
আননোন নম্বর, এখন আর সেভাবে যেকোনো নম্বর তোলে না
লাবণ্য, অনেক সমস্যা হয়। কিন্তু ফোনটা বারবার বাজছে, তাই
অবশেষে রিসিভ করলো ফোনটা।
-"হ্যালো"
-"হ্যালো"
-"আপনার সাথে দুমিনিট কথা বলতে পারি ম্যাডাম। "
-"আপনি কে বলছেন বলুন আগে সেটা।" বেশ বিরক্তি নিয়েই
বললো কথাটা লাবণ্য।
-"ম্যাডাম আপনার মেজাজটা দেখছি এখনো একইরকম আছে,
বরং আরো বেড়েছে। তা থাকবে নাই বা কেন। মেজাজ করা
আপনার মানায় বৈকি। "
-"এক সেকেন্ডের মধ্যে মাথাটা খেলানোর চেষ্টা করলো লাবণ্য।
খুব চেনা চেনা লাগছে। অর্জুন? অর্জুন কি তাহলে... চিৎকার
করতেই যাচ্ছিল অর্জুন বলে তখনি ওপাশ থাকে মানুষটার বলা
শব্দগুলো সব তালগোল পাকিয়ে গেল লাবণ্যর।
-"কিরে! এই বুদ্ধি নিয়ে তু ই ব্যবসা করিস? এখনো চিনতে পারলি

​52
না? তোর জন্মদিন আর তু ই এখন আমার শহরেই এসেছিস, সেটা
জেনেও কি করে ফোন না করে থাকি বলতো? তা সেই কখন থেকে
রিসেপশনে আমায় আটকে রেখেছে, পারমিশন নেই বলছে। তাই
বাধ্য হয়ে তোকে ফোনটা করতেই হলো। নীচে আসবি নাকি এখনো
বুঝতে পারছিসনা কিছু?"
-"দীপ!"
কাঁপা গলায় শুধু এটুকু ই বলতে পেরেছিল লাবণ্য। অজানা অচেনা
শহরে একলা এই বন্ধু টার সাথেই সেদিন নিজের জন্মদিন পালন
করেছিল লাবণ্য।
***
-"কিরে! আরে এই সুদীপ্তা। তোর কি হয়েছে বলতো! কখন থেকে
ডাকছি।"
চমকে উঠলো সুদীপ্তা, ডায়েরির ব্যাপারটা মাথা থাকে বেরোছেই
না ওর।
"সরি। "
হাত দুটো দিয়ে এলোমেলো চুলটা ঠিক করে চোখ মুখটা মুছে
নিলো সুদীপ্তা। তারপর বলল, "বল কি বলছিলি। "
"দীপ মজুমদার ফোন করেছেন, উনিও জানতে পেরেছেন
ব্যাপারটা। উনিও এখানে একবার আসতে চাইছেন, বারবার
রিকোয়েস্ট করছেন। গলা শুনেই মনে হলো ভীষণ টেনশন করছেন,
একলা আর থাকতে পারছেন না। কিন্তু সবাইকে তো এলাউ করতে
পারি না। কি বলি বলতো? এত বড় একটা লোক, কিছু বলতেও
পারছি না। "
-"আসতে বলে দে, উনি যেকেউ নন। উনি অন্তত এখানে থাকাটা
ডিজার্ভ করেন, বাকি অনেকের থেকে। "
কথাগুলো অদ্ভু ত ভাবেই বলল সুদীপ্তা, বলে উঠে গিয়ে দাঁড়ালো
সামনেটায়।
তখনই শোরগোল শোনা গেল, বডিটা এবার উঠছে।

​53
এত টেনশন এর আগে জীবনে কোনোদিন হয়নি সুদীপ্তার। বুকের
ভিতর যেন ঝড়ের বেগে কেউ হাতু ড়ি পিটে চলেছে। মাথাটা পুরো
ব্লক হয়ে গেছে, আশেপাশের কোনো শব্দও আর কানে আসছে না
ওর। কানে তালা পড়ে গেলে যেমনটা হয় অনেকটা তেমন। শুধু
লোকজনকে দেখছে, সবাই দৌড়াদৌড়ি চেঁচামেচি কিন্তু কোনো শব্দ
আর ওর কানে পৌঁছচ্ছে না। ওর সম্পূর্ণ কন্সেন্ট্রেশন এখন জলের
দিকে। জল থেকে বডিটা যত উঠছে তত একটা পচা গন্ধে চারিদিক
ভরে যাচ্ছে। সবাই নাকে মুখে রুমাল চাপা দিচ্ছে, কিন্তু সুদীপ্তার যেন
কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই। জলাশয়ের পাশে ঘাটের কাছে বডিটা সম্পূর্ণ
তোলা হতেই ঝড়ের গতিতে এগিয়ে গেল ও। ওকে শুধু এটুকু
জানতে হবে এটা লাবণ্য কি না। এক একটা সেকেন্ডও যেন এক
একটা যুগ লাগছে এখন। বাড়ির লোকই পারবে ডিটেক্ট করতে, তারা
এখনো খানিকটা দূরেই দাঁড়িয়ে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে, তাদের
দিকে তাকালো সুদীপ্তা। চোখের ইশারায় বললো তাড়াতাড়ি এগিয়ে
আসতে এদিকে।
বডি ডিগ্রেড করেছে যেরকম তাতে চিনতে পারা বেশ মুশকিল।
একমাত্র নিজের লোকই যদি পারে চিনতে। আর যদি এটা লাবন্যর
বডি না হয় তাহলে তো... হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে সুদীপ্তা। ভগবানকে
ডাকছে শুধু ও, আর একটু সময় চাই। ও মানুষটাকে খুঁজে বের
করবেই।
প্রথমেই এগিয়ে এলেন লাবণ্য সান্যালের বাবা, আতঙ্কগ্রস্থ চোখ
মুখ। মা এখনো পিছনেই দাঁড়িয়ে, সাবিত্রী দেবী সামলাচ্ছেন, কিন্তু
চোখ এদিকেই। লাবণ্য সান্যালের মা ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছেন।
যতই যাই হোক, মা তো। সুদীপ্তা খুব ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল
ওই মানুষ দুটোকে। এই মানুষ দুটোর উপর তো সন্দেহ করতে মন
চাইছে না কিন্তু রাতু ল যা বললো আর ডায়েরি থেকেও ও যতটুকু
বুঝলো তাতে তো... তখনি আর্ত স্বরে চিৎকার করে উঠলেন লাবণ্য
সান্যালের বাবা।

​54
-"লাবু"!
প্রচন্ড রকমভাবে চমকে উঠল সুদীপ্তা। ও সত্যিই মনে প্রাণে
এক্সপেক্ট করেনি এটা। সাবিত্রী দেবীর চোখ বিস্ফারিত। অরুন্ধতী
দেবী জ্ঞান হারাচ্ছেন হয়তো, বসে পড়লেন সামনের টিলাতে।
সুদীপ্তা তাকাল মরদেহটার দিকে।
রাতু ল ফোন নিয়ে বেরিয়ে গেল বলতে বলতে," হ্যাঁ, বডিটা
লাবণ্য সান্যালের, ফ্যামিলি এই মাত্র কন্ফার্ম করেছে!"
বসে পড়ল সুদীপ্তা!

​55
পঞ্চম পর্ব

।।১।।
আজ সকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি। থামার কোনো নামগন্ধই নেই।
আজ মনে হয় সমস্ত ঘরে ঘরেই টিভি চলছে। নিউজ
চ্যানেলগুলোতে এখন একটাই খবর। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক, এত
বড় একটা ঘটনা ঘটলে এখন নিউজ চ্যানেলগুলোর আর কি চাই।
এটা নিয়েই চলবে কিছুদিন।
কফি মাগটা নিয়ে চেয়ারটা টেনে বসল সুদীপ্তা। এরকমটা কখনোই
হয়নি, এইবারই প্রথম হল ওর সাথে যে একটা কেস ওকে এভাবে
নাড়িয়ে দিয়ে গেল। কিছু স্বাভাবিকভাবে আর ভাবতেই পারছে না ও,
কন্সেন্ট্রেশনই করতে পারছে না। বার বার ভেসে আসছে মুখটা
কালকের। অথচ এসব তো আর ওর কাছে নতু ন নয়। রাতু ল ঠিকই
বলছিল, ও একটু বেশিই এটাচড হয়ে গেছে। অবসেসড? না না।
হাতের আঙ্গুলটা নিয়ে বার বার টোকা মারছিল আনমনেই
টেবিলটাতে, বাইরের বর্ষণের দিকে তাকিয়ে। এবার উঠে পড়লো,
ল্যাপটপটা নিয়ে এসে বসল এই ঘরটায়। কেমন যেন তারটা জুড়ছে

​56
না। যদিও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট না পাওয়া অবধি কিছুই বোঝাও
যাচ্ছে না, কিন্তু তাও ইন্সটিঙ্কট যেন একটা অন্য রকম ইঙ্গিত করছে।
ল্যাপটপটা খুলে গুগল সার্চ বার-এ কারসরটা নিয়ে গিয়ে থামল
সুদীপ্তা। গুগল যা বলবে তা সবাই জানে। কিন্তু ডায়েরির কথাগুলো
কেউ জানে না। ওগুলো তো ধ্রুব সত্য। মানে তাই তো হওয়া
উচিত।
আচ্ছা ডায়েরিটায় লেখা সবকিছু লাবণ্যরই লেখা তার কি
নিশ্চয়তা আছে? সত্যিই তো, এটা তো কখনো ভেবে দেখেনি ও।
খুব সহজেই ওই ডায়েরিটা ওর হাতে চলে এসেছিল, কেউ যেন
চাইছিল ওটা ওর হাতে পৌঁছাক। বড় বেশিই মসৃণভাবে ওর হাতে
এসেছিল ডাইরিটা। এইভাবে তো ভাবেনি ও।
গুগল-এ গিয়ে নামটা লিখে সার্চ করল ও। মনটা কাল থেকেই খচ
খচ করে চলেছে, শান্ত হতে পারছে না, মানতেই পারছে না, বিশ্বাসই
হচ্ছে না এখনো। যেন এটা অস্থায়ী এক মুহূর্ত , পরমুহূর্তে ই সব ঠিক
হয়ে যাবে। অথচ লাবণ্য সান্যাল তো ওর কেউ হয় ও না।
অনেকগুলো লিংক ভেসে উঠলো সামনে, বিভিন্ন জিনিসের মধ্যে
ওর হাতের আঙ্গুল আর ওর নিউরনগুলো ঠিক কি খুঁজে চলেছে
ও নিজেও জানে না।
একটা খবরে গিয়ে আঙ্গুলটা থমকে দাঁড়ালো ওর। ডোমেস্টিক
ভায়োলেন্স! সিরিয়াসলি!
খুব ছোট্ট করে একটা জায়গায় লেখা, দুই চার লাইনের মধ্যে,
চোখে পড়বার মতো নয়ও।
আরো কয়েকটা লিংকে গিয়ে ক্লিক করে খবরটা ভেরিফাই করার
চেষ্টা করল। সেরকম কিছু পেল না, মানে যদি এরকম কিছু হয়েও
থাকে সেটা নিয়ে বেশি জলঘোলা হওয়ার আগেই ধামাচাপা দিয়ে
দেওয়া হয়েছে সবকিছু। আর এখন ডেডবডি পাওয়ার পর এই
জিনিসগুলো সম্পর্কে নাড়াচাড়া করাও... এখন আর কতটা ওরা
সহযোগিতা করতে চাইবে বা পারবে? ২৪ ঘন্টার মধ্যে ময়নাতদন্তের

​57
রিপোর্ট ও এসে যাবে হাতে। রিপোর্ট যাই আসুক, ব্যাপারটা যতটা
দ্রুত ঘটে গেল ততটা সহজ সরল লাগছে না ওর। মিডিয়ার
প্রেসারও বাড়ছে। আজ রাত্রে ওর ডিউটি, রাতু ল আর কিছুক্ষণের
মধ্যেই এসে যাবে, ওর সাথেও কথা বলাটা দরকার। পুরোনো খবরের
কাগজের থেকে ডিটেইলে যদি কিছু পাওয়া যায় তাহলে অন্তত
কতটা সত্যি মিথ্যে খবরটা তার একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে।
মোবাইলটা নিয়ে ফোন লাগাল। কাজে যাওয়ার আগেই একবার
সুকান্তদার সাথে দেখা করে যেতে হবে। সুকান্তদা জিনিয়াস, ও জানে
না এরকম ঘটনা সারা পৃথিবীতেই হাতে গোনা। ডিটেইলে না
জানলেও সমস্ত বিষয়ে অসাধারণ ক্লারিটি মানুষটার। হেল্প করতে না
পারলেও কোথা থেকে হেল্প পাওয়া যাবে সেটা ও বাতলে দিতে
পারে। আর দেরি করা যাবে না। কথা বলে ফোনটা রেখে ঘড়িটা
দেখল একবার, এখনই বেরিয়ে পড়া উচিত, বৃষ্টিটাও একটু ধরেছে।
উঠে পড়ল ও।
***
সুকান্তদার বাড়ি এর আগে একবারই এসেছিল সুদীপ্তা। বেশিরভাগ
সময় অফিসেই দেখা করতে গেছে। আজ বলল ছুটি নিয়েছে তাই
অগত্যা এখানে। খুঁজে পেতে একটু অসুবিধা লাগল বটে, আসলে
অনেক দিন আসা হয় নি। রাস্তাঘাট দোকান বাজার অনেকটা বদলে
গেছে। কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলল বৌদি। এক্সপেক্ট করেনি
রমাদিকে সুদীপ্তা তাই প্রথমে কি বলবে খুঁজেই পাচ্ছিল না। মুখে হাসি
টেনে কু শল বিনিময় শুরু করতেই বৌদি ডেকে ড্রয়িং রুমে বসাল।
ফ্ল্যাটটা বেশ চেঞ্জ হয়ে গেছে তো, ইন্টেরিয়র ডেকরেটর বেশ
ভালই কাজ করে গেছে তাহলে। বৌদি সুকান্তদাকে ডেকে দিয়ে
ভিতরে গেল।
-"দেখ সুকান্তদা আমার হাতে একদম সময় নেই..."
সুকান্ত দা ওকে শেষ করতে না দিয়েই বলল, যা বলছি চুপচাপ
শোন, আর এই কাগজগুলোয় তোর অনেকটাই কাজ হয়ে যাবে

​58
আশা করি। "
-"ওকে। ফোনে বলতেই কাজ শুরুও করে দিয়েছ!"
-"না করে উপায় কি? দ্যাখ, আমার কাছে যা ইনফরমেশন আছে
তাতে এই ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স এর ব্যাপারটা পুরোপুরি মিথ্যে
নয়। বরং এটাকে মেন্টাল এবিউস বলা বেটার। ইনফ্যাক্ট এই মেন্টাল
টর্চারই ওদের ডিভোর্সের একটা কারণ। দীপ মজুমদারের সাথে কি
ছিল সেটা আমার জানা নেই, বাট অর্জুন রায় চৌধুরীর সাথে সব
কিছু ঠিক ছিল না এটা ফর সিওর।"
-"হ্যাঁ সেটা তো আমিও জানি যে সব কিছু ঠিক ছিল না। কিন্তু এটা
এক্সপেকটেড ছিল না। তু মি এগুলো জানলে কি ভাবে? মানে
সোর্স... "
-"আমার সোর্স যে অথেন্টিক এই বিষয়ে আসা করি তোর সন্দেহ
নেই।"
-"না না... তা বলছি না... "
-"আরো একটা সোর্স হচ্ছে তোর বৌদি... "
-"মানে?"
-"মানে এটাই যে ও লাস্ট কয়েক বছর ধরে 'গোল্ডেনট্রি' তে কাজ
করছে, তো অফিসে তো সব খবরই ছড়ায়, আর দেখাও যায়। তো
এখন কেসটা হয়েছে বলে এসব নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, কিন্তু
জানতাম এসব কেচ্ছা অনেক আগে থেকেই। তোর বৌদি বাড়ি ফিরে
সবই বলতো তো।"
-"ওহ মাই গড! এটা তো জানতামই না। এটা তো দারুন লিড,
বৌদির সাথে একটু কথা বলা যাবে প্লিজ?"
-"হ্যাঁ বল। অফিস ওদের তো আজ ছুটি। ও আরো কিছু যদি
বলতে পারে। এই রমা, একবার এস না।"
***
-"দেখো অফিস এ যা কিছু শুনেছি আমি সেগুলোই তোমায়
বলছি, কারণ আমার কাছে তো আর কোনো ফু লপ্রুফ প্রমাণ নেই

​59
তাই যাচাইটা তোমাকেই করতে হবে। অনেক কথা সত্যিও হয় না
বাড়িয়ে চাড়িয়ে লোকে বলে, এর মধ্যে সত্যি যেমন আছে তেমনি
অসত্যও কিন্তু আছে। যাই হোক, সবার আগে এটাই বলব যে
মানুষটা ভীষণ ভীষণ ভাল একজন মানুষ ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবন
নিয়ে বলছি না, কিন্তু অফিস এ যতবারই দেখেছি বা আমাদের জন্য
কোম্পানির জন্য যথেষ্ট করেছেন। প্রতিটি কর্মচারী এই কথা বলবে।
আর এই আনুগত্য ওনার প্রতি এই কারণেই, কারণ উনি কর্মচারী
আর কোম্পানির জন্য সত্যিই ভাবতেন আর অনেক করেওছেন।
মানে অর্থের অহংকারে মাথা ঘুরে যায়নি, সবদিন পা-টা মাটিতেই
ছিল তাই কর্মচারীদের জন্যও একইভাবে ভেবেছেন করেছেন। এবার
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যদি বলতে হয় আমি বার তিনেক ওনার
সাথে মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। যতবারই গেছি ভীষণ
পসিটিভ একটা ফিলিং আসত। কেন জানি না কিন্তু ওনার কথা বলার
ধরণ, ওনার হাম্বলনেস এগুলো খুব টানত আমায়। আর অর্জুন রায়
চৌধুরী সম্পূর্ণ বিপরীত ধারার মানুষ ছিলেন। আমি এখানে ভাল
খারাপ এসব বলছি না কিন্তু উনি একদম আলাদা ছিলেন। অফিস খুব
কমই এসেছেন বা আমাদের সাথে কখনো দেখাও হয়নি। এখানেই
তফাৎ, একজন এলে সবাই ভয় পেত আরেকজন এলে সবাই খুব
খুশি হত। আশা করি বোঝতে পারছি তোমায় কি বলতে চাইছি। "
-"হুম। বুঝলাম। আচ্ছা আরেকটা কথা, এই যে দীপ মজুমদারের
সাথে সম্পর্ক টা, এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারবে?"
-"দেখো সত্যি মিথ্যে তো জানি না। তবে হ্যাঁ, শুনেছি কিছু একটা
সম্পর্ক ছিল যার জন্য অর্জুন রায়চৌধুরীর সাথেও সম্পর্ক খারাপ
হয়। এবার এখন আমাদের সমাজের নিয়মই হচ্ছে কখনো কারো
সাথে একটু বেশি কথা বললে বা বেশি বন্ধু ত্বপূর্ণ হলেও লোকে সেটা
বাঁকা চোখেই দেখে। এবার জানি না। আর একটা কথা, আর যে যাই
বলুক, আমি এটা বিশ্বাসও করব না কোনোদিন যে লাবণ্য সান্যাল
আত্মহত্যা করতে পারে। অসম্ভব। কেউ বিশ্বাস করবে না। কিছু তো

​60
ঘটেছে, ইনভেস্টিগেশন দরকার।"
একমনে কথাগুলো শুনলো সুদীপ্তা, কিছু বলল না। রমাদির কথায়
লাবণ্য সান্যালের বিষয়ে একটাও খারাপ কথা শুনলো না, হয়তো
রাতু ল-এর কথা মতো ইনিও সুদীপ্তার মতো অবসেসড লাবণ্য
সান্যালকে নিয়ে।
-"আচ্ছা, লাবণ্য সান্যালের এমন কোনো বিষয়ে কিছু খেয়াল
করেছেন বা জেনেছেন কখনো যেটাকে নেগেটিভ বলা যায়। আই
মিন... "
-"হ্যাঁ দোষে গুণেই মানুষ, গুণ থাকলে দোষ তো থাকবেই। তবে
আমার ঠিক জানা নেই। ওনার কাছের মানুষরা এটা ভাল বলতে
পারবেন।"
-"হুম। ওনার মা বাবা মেয়ে প্রাক্তন স্বামী শ্বশুরবাড়ি কারো কাছ
থেকেই সেভাবে ভাল কিছু শুনিনি। কিন্তু বাইরের সমস্ত মানুষ এত
ভালবাসে এত শ্রদ্ধা করে। এইজন্যই অদ্ভু ত লাগছে প্রথম থেকেই। "
-"সেকি। তারমানে..."
-"তারমানে এটাই দুটো সম্পূর্ণ আলাদা পৃথিবীতে দুটো সম্পূর্ণ
আলাদা মানুষ হয়ে বাঁচেন লাবণ্য সান্যাল। নয়তো এরকম তো
হওয়ার কথা নয়। "
-"বাঁচতেন। "
-"ও হ্যাঁ, সরি। "
-"হয়তো। কর্মজীবন আর ব্যক্তিগত জীবন কি সম্পূর্ণ আলাদা?
তাহলে সাধারণ কর্মচারীদের জন্যও এত এম্প্যাথি কেন ছিল? এ
থেকে তো এটাই বোঝায় যে মানুষটা সত্যিই ভাল ছিল?"
-"প্রশ্নটা ভাল খারাপের নয়, প্রশ্ন হল এমন কোনো ঘটনা যেটা
তার ব্যক্তিগত জীবনকে তিক্ত করে তু লেছিল, কর্মজীবনে সেই
ঘটনার প্রভাব পড়েনি তাই সব কিছু ঠিক-ই ছিল।"
-"আচ্ছা। কিন্তু তার সাথে মৃত্যু... "
-"সেটাই তো খোঁজার চেষ্টা করছি। যাক গে, রিয়েলি থ্যাংক ইউ।

​61
আজ উঠি। দরকারে আবার যোগাযোগ করে নেব। আপনি কিছু
জানাতে চাইলে আমায় একটা ফোন করে নেবেন। "
-"হ্যাঁ হ্যাঁ,একদম। "
।।২।।

-"দেখুন আমি তো বুঝতে পারছি না এখন এই কথাগুলোর কি


মানে। আমাদের একটু শান্তি দিন আর নিজের কাজটা ঠিকভাবে
করুন। এখন যখন বডি পাওয়া গেছে তখন জানতে এসেছেন
পারিবারিক জীবন নিয়ে? ইয়ার্কি হচ্ছে? এর আগে কি করছিলেন?
তাকে বাঁচাতে তো পারলেন না। এসব নাটক না করে নিজের কাজটা
করুন নয়তো উপরমহলে আপনার এগেইনস্ট কমপ্লেইন করতে
আমার কিন্তু দু মিনিট লাগবে না।"
শ্রাদ্ধের কাজের জোগাড় চলছিল একদিকে, তার পাশের ঘরটায়
ওই সময় সকলেই উপস্থিত ছিল, দেবীপ্রসাদ সান্যাল কথাগুলো
ঝাঁঝালো মেজাজে শুনিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বাকি লোকজন আজ
ভীষণ রকম চুপচাপ।
কিছু বলল না সুদীপ্তা। উনি বেরিয়ে যেতে অরুন্ধতী সান্যালের
পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসল সুদীপ্তা। যার মনে যাই চলুক একজন
মায়ের মনে কি চলছে তা বোঝার ক্ষমতা আর কারো নেই।
-"দেখুন যা হওয়ার হয়ে গেছে। কিন্তু যদি এর পিছনে যে বা যারা
আছে তাদের যদি না ধরতে পারি তাহলে এর থেকে বড় ইনজাস্টিস
তো আর কিছু হতে পারে না। আপনার যদি কাউকে সন্দেহ হয়, যদি
চান এই কেসের সঠিক ইনভেস্টিগেশন হোক তাহলে প্লিজ সত্যি
বলুন আর সাহায্য করুন।"
পেখমের দিকে তাকাল সুদীপ্তা, ও তাকাতেই পেখম ওর নজর
সরিয়ে নিলো ঝট করে। সাবিত্রী দেবীও ওখানেই ছিলেন, অসম্ভব
রকম শান্ত। সুদীপ্তার ধৈর্যের বাঁধ সত্যি ভাঙছে এবার। কথা বলতে
বলতেই মেসেজ ঢু কলো ফোন এ। ওর বিশ্বস্ত দুই লোককে ও কাজে

​62
লাগিয়ে এসেছে, খুব জরুরি কাজটা, কিন্তু আনফিসিয়াল। উঠে
বারান্দায় বেরিয়ে ফটোটা দেখে আবার ঘরে ঢু কে এলো সুদীপ্তা।
-"প্লিজ কিছু বলুন!!!"
-"আরে আমি কি বলবো আর? কি বলবো আমি? কিছু বলার মুখ
আছে আর আমার?" হঠাৎ করেই চিৎকার করে উঠলেন অরুন্ধতী
দেবী। কান্নায় ভেঙে পড়লেন আর্ত কণ্ঠস্বরে।
সুদীপ্তা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার চিৎকার করে উঠলেন
অরুন্ধতী দেবী, বেশভূ ষা আলুথালু, চোখ লাল।
-"কিছু বলার মুখ নেই আর আমার। কম বয়স থেকেই সংসারের
সমস্ত দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তু লে নিতে বাধ্য হয়েছিল মেয়েটা।
সবদিন নিজের দায়িত্বটুকু পালন করে গেছে কিন্তু নিজের জীবনে
কোনোদিন শান্তি পায়নি। স্বার্থপরের মতো কোনোদিন ওর কথা
বোঝার চেষ্টাই করিনি। আজ ওর পরিণতির জন্য আর যেই দায়ী
হোক, আমরাও নিজের দায় অস্বীকার করতে পারি না। আমি হয়তো
সত্যিই ভাল মা হতে পারিনি,দুজনকেই..."
-"তু মি দয়া করে এখন নিজেকে একটু সামলাও অরুন্ধতী।"
বাইরে থেকে দেবীপ্রসাদের গলার স্বর ভেসে এলো, কখন থেকে
উনি ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন?
***
-"ওদের জীবনে সমস্যা অনেক দিন থেকেই শুরু হয়ে গেছিল,
কিন্তু আমি বা আমরা কোনোদিনই সেটা বোঝার বা দায়িত্ব নিয়ে
সেটা ঠিক করার চেষ্টা করিনি। অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভাল
ছিল না। যখন একটু একটু করে সব ঠিক হচ্ছিল তখন ওদের মধ্যে
সমস্যাও বাড়ছিল, কিন্তু আমরা সেই দিকটা কোনোদিন দেখতেই
চাইনি, তখন মাথায় এটাই ঘুরত যে ওদের মধ্যে ঝামেলার কারণে
তার এফেক্ট ওদের বিজনেসে না পড়ে। কোনোভাবেই নিজেদের যে
দিন ফিরেছিল সেটাকে হারাতে চাইছিলাম না। এতটাই স্বার্থপরের
মতো ভাবতাম মা হয়ে। সবসময় ঐদিকেই মন দিতে ওকে বাধ্য

​63
করতাম, আর সমস্যাটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করতাম।
বেশিরভাগ ব্যবসার অংশীদারি সব অর্জুনের নামেই ছিল, তাই যখন
দীপের কথা সামনে আসে তখন কিছু জানার বোঝার চেষ্টা না করে
ওকেই দোষারোপ করে গেছি। ওর দোষটাকেই দেখে গেছি, কখনও
জানার চেষ্টাই করিনি আদৌ কি ছিল? অর্জুনের প্রতিটি কথাকে
সত্যি মেনে গেছি। আর আজ, সে সুখেই আছে, আর আমরা আবার
সব হারিয়ে সেই শুন্যে ফিরে এসেছি। আমি জানিনা কে বা কারা
দায়ী, কি হয়েছে, কিন্তু ওর মানসিক যন্ত্রণার অনেকগুলো কারণের
মধ্যে আমি ও একজন। আর এটা আজ স্বীকার না করলে আমার
নরকেও ঠাঁই হবে না।"
***
বাড়ি থেকে যখন বেরোল সুদীপ্তা তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় সাড়ে ৯
টা। থানায় পৌঁছে নিজের কেবিনে ঢু কে গেল ও, ফোনে আসা
ফটোটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। এখন অর্জুন রায়চৌধুরীর
সমস্ত মুভমেন্টস জানার জন্যই ওর এই সিদ্ধান্ত। এটা ছাড়া ওর আর
কোনো উপায় ছিল না। ও সিওর সবাই নিজের দিকটা লুকিয়েই বলে
চলেছে। অরুন্ধতী দেবী আর রমাদির থেকে ব্যাপারটা অনেকটা
পরিষ্কার হলো তাও। ছবিটা বাড়ির বাইরের গাড়িবারান্দার দিক থেকে
তোলা। ওখানেই হাতে একটা সিগারেট নিয়ে দাঁড়িয়ে অর্জুন, চোখ
মুখ অশান্ত, বিধ্বস্ত সেটা তো স্পষ্ট। মেয়ে যখন নিজে বলছে বাবার
প্রতি বিশ্বাস নেই তখন এতটাও সহজে ছাড়া যাবে না একে। ফোনটা
নিয়ে নম্বরটা ডায়াল করল আবার ও।
"আমার আর একটা কাজ করতে পারবি?"
বেশি ভনিতা না করে ওপারের মানুষটার দিকে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ল
সুদীপ্তা।
-"---"
-"তোকে একজনের ফোন ট্যাপ করতে হবে। আমি জানি তু ই কি
ভাবছিস বাট আমার এটা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। প্লিজ।"

​64
-"---"
-"ঠিক আছে আমায় জানাস।"
ফোনটা রাখতে না রাখতেই দরজায় রাতু লের মুখ। ফোনটা সরিয়ে
রাখলো সুদীপ্তা, ভাগ্যিস ফোনে কথা হয়ে গেছিল।
-"রিপোর্ট এসে গেছে।" দরজা দিয়ে ঢু কে কথাগুলো বলে চেয়ারটা
টেনে বসল রাতু ল।
-"দেখি।"
রাতু লের হাত থেকে রিপোর্ট টা একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে নিলো
সুদীপ্তা, বুকের ভিতর হাতু ড়ি পিটছে। দ্রুত হাতে রিপোর্ট খুলে মেলে
ধরল চোখের সামনে সুদীপ্তা। রাতু ল বলল, "জলে ডু বেই মৃত্যু।
কোনোরকম টর্চার বা কোনো রকম আঘাতের চিহ্নমাত্র নেই। "
-"মানে?"
-"মানে এটাই জলে ডু বে মৃত্যু কোনোরকম ধস্তাধস্তিও হয়নি তো
সুইসাইডই তো মনে হচ্ছে।"
-"কেউ তো জলে ধাক্কাও দিতে পারে। "
রাতু ল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে। সুদীপ্তা আবার বলল,
"সুইসাইডই করতে হলে বাড়ি থেকে এত দূরে গিয়ে সুইসাইড করল
কেন? জায়গাটা ওনাদের বাড়ি থেকে অন্তত ৩৫ কিলোমিটার দূরে।
তার বেশি ও হতে পারে। অনেকটা ডিসটেন্স। এরকম কেন করবে?"
-"যাতে পরিচিত কেউ দেখতে না পায়?"
-"কেউ যাতে দেখতে না পায় এটা যে সুইসাইড করছে সে ভাবে
নাকি যে খুন করছে সে ভাবে? আর লাবণ্য সান্যাল কে সবাই চেনে,
কাছে হোক বা দূরে। আর কেউ নিজে সুইসাইড করার আগে এইসব
ভাবতে বসে না। তখন তার সেই মানসিক পরিস্থিতিও থাকে না। আর
ওরকম নিরিবিলি জায়গা অনেক ছিল ওনার বাড়ির কাছেও। এত
দূরে গিয়ে ওখানেই কেন? আর গেলই বা কি ভাবে? গাড়ি তো
নিয়ে যায়নি?" খানিক থেমে আবার বলল, "সিসিটিভি ফু টেজ চেক
হয়েছে?"

​65
-"এক মিনিট দাঁড়া।"
***
নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে ভাবে স্ক্রল করছিল
সুদীপ্তা। পুরো পরিবারটাকেই সন্দেহ হচ্ছে। সবাই নিজের মতো করে
একটা গল্প বুনে চলেছে। আর সেই জন্যই লুপহোলটা ধরতে পারছে
না ও। ডাকল রাতু ল পাশের ঘরে।
-"কিছু পাওয়া গেল সিসিটিভি ফু টেজ থেকে? "
-"তেমন কিছুই না। সেইদিন রাত্রে লাবণ্য সান্যাল একাই বেরোচ্ছে
বাড়ি থেকে। ব্যস এটুকু ই। সাথে লাগেজ গাড়ি কিছুই নেই।"
-"আচ্ছা ওনার ব্যাঙ্ক একাউন্ট বা কার্ড এ কোনো রিসেন্ট
এবনরমাল ট্রানসাকশান?"
-"নাথিং। রেগুলার যেমন হতো তেমনই, আর তো কিছু চোখে
পড়েনি।" আইটি-র প্রশান্তদা কনফিডেন্স নিয়েই বলল।
-"আর সবকিছু বাড়িতেই রেখে গেছে তাই ট্র্যাক করবার মতোও
কিছু সুযোগ নেই। আর লাস্ট যে সমস্ত কল হয়েছিল সেগুলোও
নরমাল কলস, বিসনেস কলস, এইসব। "
-"লাস্ট বেরোনোর আগে কাকে কল করেছিল?"
-"লেট্ মি চেক।"
কয়েকমিনিট এর মধ্যেই আবার বলল প্রশান্তদা, "লাস্ট কল আর
ওনার বাড়ি থেকে বেরোনোর মধ্যে প্রায় ৩ ঘন্টার পার্থক্য রয়েছে।
আর লাস্ট কলটা ওনার মেয়ে মানে পেখমকে।"
-"পেখম? ওকে। মানে পেখমের সাথে এমন কিছু হতে পারে যার
কারণে উনি এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। আর পেখম ওই
জন্যই ভয় পেয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল যাতে আমি
ওকে আর সন্দেহ না করি?"
-"মানে?"
-"কিছু না। তার আগের কল?"
-"দেখছি।"

​66
-"তার আগের কলটা অনেক আগে, অফিস কল। অফিসে বসেই
করেছিলেন। সন্ধ্যেবেলা।"
-"অফিস কল কিভাবে জানলে?"
-"প্রায়ই কল হয় এতে, নম্বরটা পি মুখার্জীর নামে আছে, যিনি
ওনার কোম্পানির CFO।"
-"ওকে। "
-"নম্বরটা আমায় ফরওয়ার্ড করো।"
ঘর থেকে বেরোতে বেরোতেই বাজল সুদীপ্তার ফোনটা।
-"হ্যালো। "
-"---"
-"হোয়াট! কি বলছটা কি? ওকে ওকে, কোন হসপিটাল?"
-"--"
ফোনটা রাখল সুদীপ্তা।
-"কি হয়েছে বলবি একটু?"
-"অর্জুন রায় চৌধুরী,হসপিটালে, মোস্ট প্রোবাবলি সুইসাইড
এটেম্পট।"
-"কি?"
-"হ্যাঁ। লেটস গো।"

​67
ষষ্ঠ পর্ব

।।১।।
-"স্টপ স্টপ স্টপ। এই তো এন্ট্রান্স, এই দিকেই রাখো গাড়িটা।"
গাড়িটা হাসপাতাল গেটের সামনে দাঁড়াতেই প্রায় দৌড়ে নামল
রাতু ল আর সুদীপ্তা। রিসেপশনে কথা বলে লিফটের বোতাম টিপল।
অধৈর্য হয়ে এদিক ওদিক দেখছিল সুদীপ্তা। কি অবস্থা এখন কে
জানে? সুইসাইড এটেম্ট করেছে মানে ডাল মে কু ছ তো কালা হে।
লিফ্ট এসে গেছে। লিফ্ট আসতেই ভিতরে ঢু কে থার্ড ফ্লোরের বোতাম
টিপে দিল রাতু ল, দরজাটা বন্ধ হওয়ার মুহূর্তে ই দেখলো সুদীপ্তা
সামনের সিঁড়ি দিয়ে এক প্রকার ছুটে কাঁদো কাঁদো মুখে বেরিয়ে গেল
পেখম। সুদীপ্তা ডাকতে গেল কিন্তু ততক্ষণে লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে
গেছে। ও কি একবার পেখমের কাছে যাবে নীচে? সত্যিই তো। মা
বাবার একসাথে এইসব। কত নেবে ওইটুকু একটা মেয়ে। ভাবতে
ভাবতে লিফ্ট এসে থামল থার্ড ফ্লোর এ। লিফ্ট থেকে বেরোতেই
সামনের করিডোরে বেশ অনেক লোক। যদিও হওয়ারই কথা। এই
এরিয়ার লোকাল পুলিশও ছিলে। সুদীপ্তা ভালই চেনে জয়ন্ত দাসকে।

​68
অল্প হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিল। হ্যান্ডশেক করে আর সময় নষ্ট না
করে আসল কথা শুরু করল। রাতু ল গেল বাড়ির লোক আর
ডাক্তারের সাথে কথা বলতে।
-"কি করে হল এসব? কিছু জানতে পেরেছেন?"
সুদীপ্তার প্রশ্ন শুনে জয়ন্ত দাস হেসে বলল, "আপনারা এখানে?
আচ্ছা বললো লাবণ্য সান্যালের কেস-এর জন্য? এটাতো
সুইসাইড এটেম্পট, হাতের শিরা কেটেছে। এখন তো ডাক্তার দেখা
করতে দিচ্ছে না। কথা বললে জানতে পারবো। তবে যেটুকু জানতে
পারলাম মেন্টালি আনস্টেবল ছিলই। সাইকিয়াট্রিস্ট-এর সাথে কথা
বলতে হবে। সে আরো বেটার বলতে পারবে। সেও আসছে। অন দ
ওয়ে।
-"সাইকিয়াট্রিস্ট? মানে?"
-"হ্যাঁ। অনেকদিন ধরেই ট্রিটমেন্ট চলছিল। আমার যতদূর মনে
হচ্ছে যতই হোক, স্ত্রী ছিল তো। খবরটা শুনে আর থাকতে পারেনি।
এমনিই মানসিকভাবে সমস্যা তো ছিলই, এটার কারণে আরো...
তারপর দেখা যাক, কতটা কি জানতে পারি।"
সুদীপ্তা আর কিছু বললো না। এত বড় একটা কথা এরা কিভাবে
এড়িয়ে গেল! অর্জুন রায়চৌধুরী? আনবিলিভেবল!
***
-"পেশেন্টের এখন যা অবস্থা তাতে এখন দেখা করতে দেওয়া যাবে
না। রিয়েলি সরি। আপনারা কাল আসুন। "
-"কিন্তু আমাদের তো আমাদের কাজটা করতে হবে, বুঝতেই তো
পারছেন ব্যাপারটা কতটা সিরিয়াস। কেসটার জন্য উপরমহল
থেকেও প্রেসার আছে। বোঝার চেষ্টা করুন। "
-"সবই বুঝতে পারছি। আপনারা কাল আসুন। এখন সত্যি
পেশেন্টের কথা বলার মতো অবস্থা নেই। সরি। আসুন। "
-"হুম।"
আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। উঠে পড়ল সুদীপ্তা। গাড়িতে চাপলো

​69
যখন তখন ১০টা ৪০।
-"তু ই বাড়ি যাবি তো?"
-"হ্যাঁ। "
-"দ্যাখ এত স্ট্রেস নিস না, আমাদের হাতে যা আছে যতটা আছে
ততটুকু ই তো করব। আর তাছাড়া এখনো যদি মানুষটাকে নিয়ে
কোনো আশা থাকতো ঠিক ছিল, এত তাড়াহুড়ো, প্রেসারের একটা
মানে ছিল। এখন যখন মানুষটাই নেই তখন... "
-"ঠিকই বলছিস। ভীষণ পাজেল্ড, কনফিউসড আমি। সব কিছু
এদিক ওদিক হয়ে যাচ্ছে। তবে আমি জানি লাবণ্য সান্যাল সুইসাইড
করেনি। কে বা কারা এর পিছনে আছে সেটা যতক্ষণ না বের করতে
পারছি ততক্ষণ শান্তিতে ঘুমাতে পারব না রে।"
-"তু ই কিন্তু আবার সেই একই ভু ল করছিস। লাবণ্য সান্যালের প্রতি
এতটা অবসেসড বলেই কিন্তু তু ই সমস্ত ফ্যাক্টসকেও ইগনোর
করছিস।"
-"কিসের ফ্যাক্টস? আর আমি যা কিছু বললাম সেগুলোও কি
যথেষ্ট সন্দেহের কারণ নয়?"
-"তার বডিতে এমন কোনো সাইন নেই যাতে প্রমাণ হয় খুন বা
খুনের চেষ্টাও করা হয়েছিল। সব কিছু ক্লিয়ার। তাহলে?"
-"সেটাই তো ধাঁধা। আমি যদি এতটুকু ও বুঝে থাকি লাবণ্য
সান্যালকে সে সুইসাইড করার মানুষই নয়। ওর আর্লি লাইফ প্রেসেন্ট
লাইফ সব জেনেই বলছি। অর্জুন রায়চৌধুরী কে এত সহজে ছাড়া
যাবে না। বড়লোকরা সব পারে। আই ওয়াশ করাটা কোনো বড়
ব্যাপার নয় ওদের জন্য।"
ফোনটা বাজল সুদীপ্তার।
-"হ্যাঁ বল।"
-"অর্জুন রায় চৌধুরীর ফোন ট্যাপ করা ইস নট এ জোক। নেক্সট টু
ইম্পসিবল। আমি এবার তাই পারব না রে তোকে হেল্প করতে। "
-"উফফফ! আচ্ছা ঠিক আছে, থ্যাংক্স। "

​70
বিরক্ত হয়ে ফোনটা রেখে দিল সুদীপ্তা। গাড়িটা ক্রসিং এ দাঁড়াল।
***
ডিউটি সেরে বাড়ি এসেও কিছুতেই দু'চোখের পাতা এক করতে
পারল না সুদীপ্তা। একটা চাপা কষ্ট, যেন কিছু একটা ঠিক হচ্ছে না।
কিন্তু ও কিছুতেই ধরতে পারছে না কি হচ্ছে। সব কিছু একসাথে
মিলে মিশে তালগোল পাকিয়ে চলেছে শুধু। কোথাও কোনো ক্লু
নেই।
কাল লাস্ট আরেকবার ট্রাই করব অর্জুন রায়চৌধুরীর সাথে কথা
বলতে। আচ্ছা, পার্সোনালি তো ওই ডাক্তারের চেম্বারে গিয়েও কথা
বলা যায়। যদি কিছু জানতে পারা যায়। কি যেন নাম ছিল? আজ
একটা ভিসিটিং কার্ড নিয়ে নিয়েছিল রাতু ল। নাম ঠিকানাটা খুঁজে
বের করল, এভাবে এমনিও ঘুম আসছিল না।
***
( পরেরদিন )
-"দেখুন আপনাকে বলতে আমার খারাপও লাগছে এভাবে কিন্তু
আমার ডাক্তারি পেশারও তো কিছু এথিক্স আছে। তারপর এরকম
একজনের কথা জিজ্ঞাসা করতে এসেছেন আপনি, আমি কিভাবে
বলব আপনিই বলুন?"
-"আপনি যদি কেসটার গুরুত্ব বুঝতেন তাহলে বলতেন, যাই
হোক। ছাড়ুন। আচ্ছা ওনার যা মানসিক অবস্থা তাতে আপনার কি
মনে হয় উনি কতটা স্ট্যাবিলিটির সাথে কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত নিতে
সক্ষম?"
-"আপনি আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই জায়গায় আসছেন
অফিসার। দেখুন একটা কথা বলি আমার পেসেন্ট যে এই মুহূর্তে
মানসিক ভাবে খুব সেনসিটিভ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এখন
ওনার যা অবস্থা তাতে ওনার যেকোন গতি বিধি বা যেকোন সিদ্ধান্তে
ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার মতো অবস্থায় নেই। না তো কথা বলার।
আগে অনেকটাই সুস্থ হয়ে গেছিলেন। ভাল ও ছিলেন। হঠাৎ

​71
রিল্যাপ্সের কারণ অবশ্যই লাবণ্য সান্যালের ডেথ। তবে তার আগে
উনি অনেক সুস্থ ছিলেন, আনস্টেবিলিটির কোনো লক্ষণ ছিল না।
এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারব না ম্যাডাম। আর কিছু জিজ্ঞাসা
করবেন কি নয়তো আমার একটা মিটিং আছে আসলে।"
খুব ভদ্র ভাবে মিষ্টি ভাষায় তাড়িয়ে দেওয়া বোধহয় একেই বলে।
তবে মানুষটির ব্যবহার খুবই ভদ্র নম্র তাই বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।
-"যদি কিছু আর বলতে পারেন তো ফোন করবেন।" নমস্কার
জানিয়ে উঠল সুদীপ্তা। লিফটের বোতাম টিপে অপেক্ষা করছিল ও,
তখনই রাতু লের ফোন।
-"বল।"
-"কোথায়?"
-"আসছি। কেন কি হয়েছে?"
-"বাড়িতেই আসছিস তো?"
-"হ্যাঁ, কেন কি হল আবার?"
-"আয়। তোকে কিছু দেখানোর আছে। ফোনে বলা সম্ভব নয়।"
-"আচ্ছা আসছি। " ফোনটা কাটল সুদীপ্তা, আবার কি নতু ন ঘটল
কে জানে।
কাল রাত থেকেই দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনি সুদীপ্তা।
যতক্ষণ না একটা কিছু হাতে আসছে শান্তি নেই। অন্যমনস্ক ছিলই,
কখন যে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজেই ফ্ল্যাটের চাবি খুলে সোফাটায়
গিয়ে বসেছে নিজেই জানে না। রাতু লের গলার আওয়াজে তাকাল
ফিরে।
-"কি ব্যাপার? কি এত ভাবছিস? কখন থেকে ডাকছি তোকে।"
-"সরি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। বল কি বলবি বলছিলি। "
-"একটু না, পুরোই অন্য দুনিয়ায় আছিস তু ই। এত কেন প্রেসার
নিচ্ছিস তু ই বুঝতে পারছি না। আর এখন দয়া করে এইটা পড়বার
পর আমার মনে হয় না তোর আর টেনশন নেওয়ার কোনো দরকার
আছে।"

​72
-"মানে?"
ডায়েরির একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে পৃষ্ঠাগুলো ওল্টাতে লাগল
রাতু ল।
ও হঠাৎ এই ডায়েরি নিয়ে কখন বসল আর পড়ল? জিজ্ঞাসু
দৃষ্টিতে রাতু লের দিকে তাকাল সুদীপ্তা।
রাতু ল বলল, "তু ই হয়তো পুরোটা পড়িসনি, আমি পুরোটা পড়েই
বলছি।" এগিয়ে দিল ডায়েরিটা সুদীপ্তার দিকে।
হ্যাঁ, এতদূর অব্দি তো পৌঁছায়নি ও, সত্যিই। মুক্তাক্ষরে
লেখাগুলোয় চোখ বোলাতে লাগল সুদীপ্তা। ডায়েরিটা যে নিয়মিত
ভাবে লেখা হয়েছে তা নয়, বেশ অনিয়মিত। তাই আর শেষ অব্দি
পড়বার তাগিদ ছিল না সুদীপ্তার। যদি পড়ত তাহলে অনেক আগেই
দেখতে পেত, কতখানি যন্ত্রনা আর অসহায়তা জড়িয়ে আছে
পৃষ্ঠাগুলোয়। কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর আর না বাঁচার ইচ্ছেটা কতটা
তীব্র হয়ে ফু টে উঠেছে বারবার। মানুষ শুধু বাইরেটাই দেখেছে,
ভিতরে ভিতরে ওই কঠিন মানুষটা কবেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে
গেছে কেউ দেখেইনি, দেখার বা বোঝার চেষ্টাও করেনি। মানসিক
অশান্তি, সাংসারিক সমস্যা, ব্যবসায়িক ঝামেলা এই সব কিছুই একে
একে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছিল, যেন সমস্ত রাস্তা বন্ধ। সব কিছু
ঠিক করার যেন একটাই রাস্তা। আর সেই রাস্তাটাই বার বার বেছে
নেওয়ার চেষ্টা করেছে লাবণ্য সান্যাল। কিন্তু পারেনি কিছুতেই।
পিছুটান, জীবনের মোহ, দায় দায়িত্ব এই সব কিছুই বার বার বেঁধে
ফেলেছে তাকে, তাই চলে যাওয়ার চেষ্টাটা আর করা হয়নি। কিন্তু
এবার যেন সব ভেঙে চুরে বেরিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছেটা কারো
রোখার ক্ষমতা ছিল না। এবার চলে না গেলে আর যে কোনভাবেই
কিছু ঠিক হবে না। জীবনে বেঁচে থেকে অনেক কাজ তো হল। এবার
যদি এই জীবনে না থাকলে কিছু শুধরায়, কিছু ভাল হয় তবে ক্ষতি
কি। একজন চলে গিয়ে যদি বাকি সকলে ভাল থাকে তাহলে
একজনের চলে যাওয়াটাই কাম্য।

​73
ডায়েরির হলুদ হয়ে যাওয়া, জীর্ণ, শেষের পাতাগুলোয় এভাবেই
নিজের কথাগুলো ব্যক্ত করেছেন লাবণ্য সান্যাল।
অর্জুন রায়চৌধুরীর সাথে সমস্যা তো সর্বজনবিদিত। কিন্তু নিজের
মেয়ে, মা বাবা সবার ব্যাপারে বাইরের পৃথিবী কতটুকু জানতো?
কেউ তো ছিল না পাশে, আর এটাই তো সত্যি। দীপ মজুমদারের
সাথে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধু ত্বটাও বড় ভু ল সময়ে, অনেকটা দেরি করে।
আগে হলে হয়তো...
নির্বাক হয়ে এলোমেলো এই কথাগুলোই ভাবছিল সুদীপ্তা। তখন
আবার মুখ খুলল রাতু ল, "আর একটা কথা বলার ছিল তোকে।"
-"হুম। "
-"উপরমহল থেকে এবার কেসটা বন্ধ করার জন্য চাপ আসছে,
তাড়াতাড়ি সলভ করে ফাইল দিতে হবে নয়তো কেস সিবিআই এর
হাতে হ্যান্ডওভার হবে। আর যখন সবকিছু ক্লিয়ার হয়েই গেছে তখন
বেকার কেসটাকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ানোর কি মানে?"
-"কি ক্লিয়ার?"
-"আরে এই সুইসাইডটার জন্য পরোক্ষ ভাবে সিচুয়েশনও দায়ী।
ক্লিয়ার তো হয়েই গেল সব কিছু। আর সমস্ত ডকু মেন্টসও একই কথা
বলছে। সবার স্টেটমেন্ট রয়েছে আমাদের কাছে। আর কি চাই?"
-"এটা সুইসাইড নয়, ভেবে চিনতে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে,
বা আত্মহত্যা করার প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে। আর এটা খুনের থেকে
কোনো অংশে কম নয়। "
-"দেখ, আমরা আমাদের তরফ থেকে সব জমা দেব। এবার
বড়লোকদের ব্যাপার কেসটা ঘোরাতে কতটুকু সময় লাগবে ওদের?
কিছু করতে পারবো না আমরা। আর এটা আমাদের কাজও নয়।
আমাদের কাজ কেস ফাইল জমা করা উইথ ফ্যাক্টস। আমরা সব জমা
করব, দ্যাটস ইট। "
চুপচাপ শুনে হাসল শুধু সুদীপ্তা, রাতু লের দিকে তাকিয়ে বললো,
"হুম, সিস্টেমের ভিতর থেকে সিস্টেমের বিরুদ্ধে কি বা বলতে পারি

​74
বল? আর সিস্টেম চালাচ্ছেই যারা তাদের এগেইনস্টে কিছু বলার
কথা ভাবতেই পারা যায় না, ঐ জন্যই তোর এত তাড়া তাই না?
টিকি উপর থেকে যে নাড়ছে কথাগুলো তারই, তোর আদৌ নয়।"
এটুকু বলেই উঠে নিজের ঘরে ঢু কে সজোরে দরজা লাগিয়ে দিল
সুদীপ্তা।
।।২।।
( পাঁচ মাস পর )
-"বিয়ের আর কদিন মাত্র বাকি, যে কটা জিনিস বাকি আছে কিনে
নে না মা, বাকি তো আমি সবই করে নিয়েছি। তোর আবার পছন্দ
হবে না হবে।"
ফোনটা কানে গুঁজে ব্যাগটা গোছাচ্ছিল সুদীপ্তা, এটা রোজকার
ব্যাপার। মা রোজ ফোনে কথা বলার শুরুতে আর শেষে একই কথা
বলে চলেছে। মায়ের দোষ নেই। সত্যিই তো মা আর কত করবে।
ডিউটির দোহাই দিয়ে সব কিছু মায়ের উপরেই তো দিয়ে দিয়েছে ও।
-"ঠিক আছে। আজ হাফ ডে নিয়েছি, কিনে নেব ফেরার পথে।"
ফোনটা রেখে ঘড়িটা দেখল সুদীপ্তা।
এক বন্ধু র পরিচিত ডিজাইনার-এর থেকেই ওড়না শাড়ি এগুলো
করাচ্ছে, কথা আগেই হয়ে গেছিলো, আজ যাবে একবার তার
স্টু ডিওয়। সোনারপুর এলাকায় তার ষ্টু ডিও। ওই জন্যই আজ অব্দি
গিয়ে উঠতে পারেনি, আজ সেরে নেবে কাজগুলো।
***
ডিজাইনারের সাথে কথা বলে বেরোলো যখন সুদীপ্তা তখন প্রায়
৩ টা বাজছে। মাস দুয়েক আগে একটা স্ক্যুটি কিনেছে ও, এখন তাই
যাতায়াতে বেশ সুবিধা হয়েছে। পেটে পুরো ইঁদুর দৌড়াচ্ছে খিদের
জ্বালায়, সামনেই একটা ফাস্টফু ড চপ সিঙ্গারার দোকান দেখে দাঁড়
করাল স্কু টিটা, এই ভর দুপুরে ভাত খেলেই ভাল হতো কিন্তু এখানে
ভাতের হোটেল কাছাকাছি তো দেখতে পাচ্ছে না, আর ঘোরাঘুরি
করে খোঁজার মতো অবস্থাও নেই ওর। পেট এ কিছু একটা না পড়লে

​75
এবার আর থাকা যাচ্ছে না যে। দোকানে অর্ডারটা দিয়ে ফোনটা স্ক্রল
করছিল ও। মিনিট দশেকের মধ্যেই গরম গরম মোগলাই এসে হাজির।
ফোনটা রেখে তাড়াতাড়ি হাত আর মুখের কাজ শুরু করল সুদীপ্তা,
আর দেরি নয়।
***
ফোনে ইম্পরট্যান্ট মেইলগুলো দেখতে দেখতে মোগলাই-এর
টুকরোগুলো মুখে পুরছিল সুদীপ্তা। স্যালাডটা একটা কাগজের উপর
দিয়েছিল ওরা। স্যালাডটা শেষের পথে, শেষ পিঁয়াজের টুকরোটা
মুখে পুরে আরেকবার স্যালাড দিতে বলল সুদীপ্তা। আবার যথারীতি
খেতে শুরু করতেই স্যালাডের খালি কাগজটার দিকে হঠাৎ চোখ
গেল ওর। ব্যস, চোখের সামনে ভেসে উঠলো টুকরো টুকরো
মুহূর্ত গুলো, আবার, এতদিন পর। ওর হেরে যাওয়ার মুহূর্ত । ছেলেটা
স্যালাড দিয়ে চলে গেল, সাথে আরো কিছু বলেও গেল কিন্তু
সুদীপ্তার কানে কিছুই ঢু কলো না। ফাইল তো জমা পড়ে গেছে কবেই,
কেসও ক্লোস্ড, কিন্তু তাও কেন ওর ইনস্টিংক্ট একটাই কথা বলে, যা
সামনে আছে তা সত্যি নয়। কিছুতেই নয়। কিছু একটা যেন ও মিস
করে গেছে, ও দেখতে পায় নি। কেউ দেখতে পায়নি। কিন্তু সেটা
কি? সুইসাইড, মার্ডার উফফ! উঠে পড়ল সুদীপ্তা। পুরোনো কাগজ
জুড়ে হেডলাইন "লাবণ্য সান্যাল কেস ক্লোস্ড" , মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলে
দিল সুদীপ্তা। দ্রুত ব্যাগ নিয়ে বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ল ও। আর
ভাববে না, কিছুতেই না। কিন্তু ওর ইনস্টিংক্ট কখনো ভু ল বলতে পারে
না। তাহলে?

​76
সপ্তম পর্ব

( দিন দশেক পর )

বেশ কিছু কাগজপত্র ডাই করা টেবিলে, সামনের ডেস্কটপে চোখ,


উন্মত্তের মতো চোখের তারা দুটো ঘুরছে কাগজের ভিড়ে বা
ডেস্কটপের স্ক্রিনে, খুঁজছে কিছু। কয়েক সেকেন্ড রুমের বাইরে থেকে
দেখে অবশেষে সুদীপ্তার কেবিনে ঢু কল রাতু ল। কিন্তু সেদিকে
ভ্রূক্ষেপই নেই সুদীপ্তার।

-"কি এত করছিস বলতো? এখন তো কোনো কেসও আসেনি।


এত ব্যস্ত কেন ম্যাডাম? আর ক'দিন পর বিয়ে সেটা নিয়ে একটু
ভাবতে পারিস তো।"

বলতে বলতে চেয়ারটা টেনে বসতেই যাচ্ছিল রাতু ল তখনি


সুদীপ্তা বলল, " হাঁ একটু ব্যস্ত আছি। তোকে বলে কোনো লাভ নেই
তাই বলিনি। এটা নিয়ে আবার মাকে নালিশ করে দিস না।

​77
এমনিতেও রোজ বিয়ে নিয়ে মাথা... যাক গে ছাড়। "

ভাবটা এমনি দেখাল সুদীপ্তা যে রাতু ল ওর সামনে বসুক সেটা


একেবারেই চাইছে না ও। রাতু ল উঠে চলেই যাচ্ছিল কিন্তু কি মনে
হল শেষ মুহূর্তে সুদীপ্তার ডেস্ক থেকে একটা কাগজ তু লে চোখ
বোলালো ও। বুঝতে বাকি রইল না সুদীপ্তা ঠিক কোন কেসের মধ্যে
ডু বে রয়েছে আবার।

-"আই মিন সিরিয়াসলি! এখনো? বছর ঘুরে গেল প্রায় আর তু ই


এখনো সেই নিয়েই পড়ে আছিস? একটা আজগুবি চিন্তা মাথার
মধ্যে ঢু কিয়ে... আমাদের বিয়ে আর কদিনের মধ্যে। সেসব ছেড়ে...
আমার আর কিছু বলার নেই। "

-"আমি জানতাম তু ই এটাই বলবি, সেই জন্যই তোকে কিছু


বলিনি। জানি, তোকে বলে কোনো লাভ নেই। না তু ই আমায় বিশ্বাস
করবি না আমাকে কোনো সাহায্য করবি।"

-"না করব না সাহায্য। কারণ আমি তোর মতো পাগল নই। আমি
সত্যিটা মানতে জানি।"

-"হয় তু ই অন্ধ নয়তো তু ই একটা গাধা। যাক গে, আমি জানি


আমি ঠিক কি করছি। আমি তোকে কৈফিয়ত দিতে চাইও না। আর
এটা আমার কেবিন, বের এখান থেকে।"

-"নিজেকে খুব বড় অফিসার ভাবছিস আজকাল।"

-"সেইটা তো তু ই।"

-"তু ই একটা থার্ড পার্সনের জন্য আমার সাথে ঝামেলা করছিস


যার সাথে তোর দু'দিন পর বিয়ে? আর ইউ আউট অফ ইওর

​78
মাইন্ড?"

-"নো, এখানে তোর আমাকে বিশ্বাস করা উচিত ছিল এটলিস্ট


একবার। আমি যখন বারবার বলছি তখন একবার অন্তত আমার কথা
শোনা উচিত ছিল তোর।"

-"তু ই পাগল হয়ে গেছিস।"

-"হাঁ আমি পাগল, সেই জন্য লাবণ্য সান্যাল এর মৃত্যুর পরেই


কোম্পানির শেয়ার প্রাইস, ব্যালান্স শিট, সবকিছু ঊর্ধ্বমুখী। একদম
পারফেক্ট। লাবণ্য সান্যাল বেঁচে থাকা কালীন যখন কিছু ঠিক করতে
পারল না, তখন সে চলে যেতেই... "

-"লাবণ্য সান্যাল আর দীপ মজুমদার অর্জুন রায় চৌধুরীর


কন্ট্রোভার্সিয়াল রিলেশনশিপের একটা নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট তো
কোম্পানির শেয়ার প্রাইসের উপর পড়েছিল। তারপর সেটা চলে
যায়, ইন্সুরেন্সের টাকা এই সব কিছু মিলিয়ে কোম্পনি আবার ঘুরে
দাঁড়াচ্ছে।"

-"ওহ প্লিজ। সব কিছু একটু বেশিই পারফেক্টলি মিলে গেল, এটাই


হোক কেউ চাইছিল, আর সেটাই হল। সব কিছু খাপে খাপ, একদম
পারফেক্ট। নাহ। "

-"ইউ আর ইম্পসিবল। বলতেটা কি চাইছিস তু ই?"

-"তু ই প্লিজ যা না এখান থেকে।"

***

( দিন কয়েক পর )

​79
বাবার পায়ের অবস্থা খুব একটা ভাল না, তাই কিছু নিমন্ত্রণের কাজ
সুদীপ্তাকেও করতে হচ্ছে। অবিনাশকাকু বাবার অত্যন্ত কাছের
একজন মানুষ, কিন্তু তার বাড়িটা অনেকটা দূর, রূপপুর। অতদূর
যাওয়ার থেকে তাকে তার অফিসে নিমন্ত্রণটা সেরে ফেলাই ভাল।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে হঠাৎ ব্যাংকে ছুটতে হল বাবাকে তাই সুদীপ্তাকেই
আসতে হল।

অবিনাশবাবু এই হসপিটালে একজন সুপারভাইসারের কাজ করেন


আজ বহু বছর। ছোট থেকেই অবিনাশকাকু কে দেখে আসছে সুদীপ্তা,
তবে এখানে কখনো আসেনি। বার তিনেক ফোন করে ঠিকানা খুঁজে
এখানে এসে পৌঁছালো ও। খুব একটা জমজমাট নয় জায়গাটা, বেশ
ফাঁকাই। তবে খুব সুন্দর সাজানো গোছানো। ওর আসতে তাও প্রায়
ঘন্টা দেড়েক লাগল। বেশ বড় প্রপার্টি । সাথে বাগান, চাষবাস, পুকু র,
সব কিছুই আছে। শহরের মধ্যে যেন একটা আস্ত ছোট্ট গ্রাম।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে রিসেপশনের সামনেই অবিনাশকাকু বসেন একটা


ছোট্ট কিউবিকলে। এখন কোথাও গেছেন হয়তো। অপেক্ষা করছিল
সুদীপ্তা পায়চারি করতে করতে, হাতে কার্ড টা নিয়ে। হঠাৎই সামনে
চোখ পড়তেই দেখল দ্রুত গতিতে একজন পেরিয়ে গেলেন, ভাবটা
এমন যেন এদিকেই আসছিলেন, কিন্তু ওকে দেখেই উল্টোদিকের
সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন। অদ্ভু ত লাগল, কিন্তু তার থেকেও যেটা
লাগল সেটা হল কেমন যেন একটা পরিচিত লাগল সুদীপ্তার।
এনাকে কোথাও একটা দেখেছেন। আর ওকে দেখে এভাবে সরেই বা
গেল কেন?

এক মুহূর্ত ও আর দেরি না করে উল্টোদিকের সিঁড়ির দিকে দ্রুত


হাঁটতে লাগল ও। পিছু করতে

করতে কখন বিল্ডিং পেরিয়ে বাগান পেরিয়ে একেবারে গেটের

​80
কাছে এসে গেছে খেয়াল করেনি। সামনে একটা ছোট ভ্যান এসে
গেল, ওই মহিলা ততক্ষণে রাস্তা পার হয়ে ওদিকের ফু টপাথে
যাওয়ার লক্ষ্যে, ওনার সামনে একটা এসইউভি কখন এসেছে
কোনোদিকে নজর নেই। উদ্ভ্রান্তের মতো হেঁটে যাচ্ছিল, গাড়িটা
সামনে ব্রেক কষে দাঁড়াল সজোরে, তখন যেন টনক নড়ল।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এদিকে তাকাতেই মুখটা দেখতে পেল সুদীপ্তা।


নাহ, একে এর আগে তো কখনো দেখেনি, কিন্তু তাও এত পরিচিত
কেন লাগছে। মাঝবয়সী, পরনে শাড়ি, অত্যন্ত সাদামাটা
সাজপোশাক, হাতখোপা বাঁধা, শ্যামবর্ণ, মুখটা বেশ উজ্জ্বল, বিশেষ
করে চোখদুটো, ভয়ের আড়ালে সরল সাধাসিধে দৃষ্টিটা চোখ
এড়ায়নি সুদীপ্তার। কিছু একটা যেন খুব চেনা, কিন্তু কি?

মনের ভিতর এই খচখচানি নিয়েই স্কু টি চালিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে


রওনা হল সুদীপ্তা, অবিনাশকাকু র সাথেও ভাল করে কথা বলতে
পারেনি ও।

এত পরিচিত কেন লাগছে? কি কারণে ওর মনের ভিতর অস্বস্তিটা


কিছুতেই দূর হচ্ছে না? কখনো কখনো এমন একটা পরিস্থিতি হয়
যেখানে আমাদের পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছে না এরকম হয়
ভাবটা। এমন যখন পরিস্থিতি হয় তখন এরকমই অস্বস্তি হয়। অদ্ভু ত
মুখের মিল কিন্তু মিলটা যে কার সাথে সেটা কিছুতেই ধরতে পারছে
না সুদীপ্তা।

***

বিয়ের আগের কিছুদিন আর রাতু লের সাথে ফ্ল্যাটে নয় বরং


নিজের বাড়ি থেকে যাতায়াত করছে সুদীপ্তা। রাত্রে খাবার টেবিলে
বসেও একই কথা মাথায় ঘুরছিল, বাবার প্রশ্নের উত্তর দায়সারা

​81
করেই দিচ্ছিল ও। মা তিনবার যখন বলল সবজির বাটিটা এদিকে
দিতে তখন টনক নড়ল ওর।

মা বাবা কথা বলছিল বিয়ের জোগাড়যন্ত্র নিয়ে, ওর কানে অতসব


কিছু ঢু কছিল না, রাতু লের সাথে কদিন ধরেই সব কিছু ঠিকঠাক
আদৌ নেই। মা বাবাকে বললে বেকার তারা চিন্তা করবে তাই আর
কিছু বলেনি। বিয়েটা তাড়াহুড়ো হয়ে গেল না তো? কিন্তু বিয়ে তো
ও-ই করতে চেয়েছিল, তাহলে এখন এসব ভাবার কি মানে? ধুৎ!

-"বিয়ের কটাদিনের জন্য মানসীকে বলেছিলাম একটা লোক দিতে।


হাতে হাতে সব করে দেওয়ার জন্য। ও তো পারবে না বলল। কাল
নিয়ে আসবে একজনকে, সাবিত্রী না কি নাম। বলল তো বিশ্বাসী,
এবার দেখি আগে কথা বলে, কত কি চায় আবার।"

মায়ের কথার আর কিছু কানে আসছিল না সুদীপ্তার। ওর মাথায়


যেন এখন হাজার ওয়াটের বালব জ্বলে গেছে। ঠিক ঠিক ঠিক,
সাবিত্রী। ওই সাবিত্রীর সাথেই আজকের দেখা মহিলার প্রচুর মিল,
সেইজন্যই অত চেনা চেনা লাগছিল একে, এর আগে কখনো না
দেখেও। এবার মাথাটা একটু ঠান্ডা হল যেন সুদীপ্তার। এবার শান্তিতে
খেতেও পারবে।

***

বিয়ের তোড়জোড় জোরকদমে চলছে। রাতু লের সাথে আর শেষ


ক'দিন দেখা হবে না, ছুটি নিয়ে নিয়েছে বিয়ের ৩ দিন আগে থেকে।
শুক্রবারই শেষ অফিস করবে। তারপর আবার বিয়ের পর। রাতু লের
সাথে বেশ ক'দিন ধরে ভালভাবে কথা অবধি হচ্ছে না। ও চেষ্টা করছে
স্বাভাবিক হতে কিন্তু পারছে কি? ওর মাথার ভিতর একটা জিনিসই
শুধু ঘুরছে, যে বিয়ের আগেই ওর উপর ওর কথায় কোনো ভরসা

​82
করে না কোনো বিশ্বাস করে না, বোঝার চেষ্টা করে না, তাহলে তার
সাথে ও আদৌ সসম্মানে পারবে বাস করতে?

বিয়ের ক'দিন আগে এসব ভাবনা ড্রামাটিক, সিনেমায় হয়, এসব


ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারে ভাবাও সম্ভব নয়। তাও কিছুতেই...

***

বাড়ি থেকে স্কু টি নিয়ে বেরতে যাবে যখন তখনই মা হাতে আবার
একটা লিস্ট গছিয়ে দিয়ে বলল, "এগুলো তোর অফিসের কাছে
সস্তায় পাওয়া যাবে, দশকর্মার জিনিস, বেশিরভাগ ওই তত্ত্বতাবাসের
জিনিস, কিনে আনিস। " আজ আর তেমন রাগ হলো না মায়ের
উপর। কিছু বলল না তাই। এই দশকর্মার দোকান ওদের অফিস থেকে
বেশ খানিকটা দূরে। ঠিকই আছে, স্কু টি নিয়ে যেতে কতটুকু ? বাবাকে
বেকার আর আসতে হবে না। লিস্টটা পকেটে পুরে নিল সুদীপ্তা।

বাড়ি ফেরার পথেই জিনিসপত্র কিনে একেবারে চলে যাবে তাই


একটু আগেই বেরিয়ে পড়ল আজ থানা থেকে। থানাতেও সমস্ত
কলিগদের নেমন্তন্ন হয়েই গেছে। তাদের তো আবার ডবল ডবল
নেমতন্ন। ওর আর রাতু ল দুই তরফ থেকে।

কাল লাস্ট আসবে, বেরিয়ে পড়ল ৩ টের একটু পরেই। দোকানটা


একটু অন্যদিকে পড়ে, বড়রাস্তায় বিশাল ট্রাফিক। ঘড়িটা দেখে নিল
আরেকবার, হেলমেট পরে বীভৎস গরম লাগছে। প্রায় ৭ -৮ মিনিট
ধরে দাঁড়িয়ে। এদিক ওদিক থেকে কোনো ফাঁক ফোকরও নেই,
অগত্যা অপেক্ষা। কিন্তু এই অপেক্ষা করতে করতেই সামনে যে
এরকম সুযোগ চলে আসবে ও তা স্বপ্নেও ভাবেনি। যার কথা ভেবে
সেদিন থেকে এত মাথা খারাপ করছিল সেই মহিলাই না, এরকম
একটা দামি গাড়িতে? হ্যাঁ, ঠিকই দেখছে ও। গাড়িটা ওনার নয়

​83
সেটা ওনার জড়োসড়ো হয়ে বসা বা পোশাকআশাক চেহারা দেখেই
বোঝা যাচ্ছে, আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আরেকবার
যখন দেখা হয়েছে তখন নিশ্চয় ভগবান কিছু জানাতে চাইছে বা
বোঝাতে চাইছে, এসব কথা একটু আজগুবি হলেও এগুলো ভীষণ
মানে সুদীপ্তা। সুতরাং ট্রাফিক সিগন্যাল সবুজ হতেই আর এদিক
ওদিক না দেখে পিছু ধাওয়া করল গাড়িটার। একটু দূরত্ব রেখেই পিছু
করতে লাগল ও।

চলতে চলতে কখন যে বেশ অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে, টনক


নড়ল একটা তীব্র হর্ণে। পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে কখন রং সাইডে
এসে গেছে খেয়াল করেনি। সময় দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়। একটা
গাছতলার কাছে গিয়ে স্ট্যান্ড করল স্কু টিটা। রেঞ্জ রোভারটা ওর
থেকে দশ হাত দূরে, একটা গেটের সামনে। ওই মহিলা গাড়ি থেকে
নামলেন, সঙ্গে সঙ্গে সুদীপ্তাও, হেলমেটটা পরেই থাকল যাতে মুখ
ঢাকা থাকে। ওর মন বলছে সেদিন ওই মহিলা ওকে দেখেই
পালিয়েছিল মানে কিছু তো গোলমাল আছে। মহিলা রাস্তা পেরিয়ে
গেটের ভিতর ঢু কতেই এবার গেট সংলগ্ন বিল্ডিংটা দেখল সুদীপ্তা,
এতক্ষণ পাখির চোখের মতো ওই মহিলা আর ওই গাড়ি ছাড়া আর
কোনো দিকেই তাকায়নি ও। আরে এ তো সেই হাসপাতাল, ও
যেখানে অবিনাশকাকু কে নেমন্তন্ন করতে এসেছিল দিন কয়েক আগে।
মানে এই মহিলা এখানে নিয়মিত আসেন, আসতেই পারেন। একটু
বেশিই পেঁচিয়ে ভাবছে সুদীপ্তা। গেট পেরিয়ে ভিতরে চলে গেলেন
ওই মহিলা। কিন্তু এটা তো একটা মেন্টাল হসপিটাল, এখানে?

এক মুহূর্তে র জন্য মাথায় এলো অর্জুন রায় চৌধুরীর কথা, উনিও


তো... উফফ! সুদীপ্তা সোজাভাবে কিছু ভাবতেই পারছে না। যে
ভাবেই হোক তার জুড়েই দিচ্ছে ওই কেসটার সাথে। রাতু লই ঠিক, ও
সত্যিই অবসেসড। মহিলা চলে যেতে ও ঢু কল ওখানে। অবিনাশকাকু

​84
নিশ্চয় থাকবে। ওনার থেকেই সাহায্য নিয়ে একবার দেখবে অর্জুন
রায়চৌধুরী এখানে আসে কি দেখাতে?

***

ভিসিটর্স-এর খাতায় ওই মহিলার নাম লেখাই ছিল সামনেই, কিন্তু


তাতে কি যায় আসে। মহুয়া নাম ওই মহিলার। দেখা করতে আসে
কার সাথে ওই মহিলা? সে প্রশ্ন তু লতেই কনফিডেনশিয়ালিটির
পাহাড় সামনে দাঁড় করিয়ে দিল রিসেপশনিস্ট, অগত্যা আঙ্গুল
তো বেঁকাতেই হবে। বলা যায় না, খবর ভিতরে চলে যেতে পারে ওর
পৌঁছানোর আগেই। এই হাসপাতালে এমনিও নামি দামি লোকজন
আসেন ট্রিটমেন্ট করাতে, সাথে মেন্টাল হসপিটাল ট্যাগটা লাগানো
থাকে বলে কেউ আর এটাকে পাবলিক করতে চায় না। তাই
ব্যাপারটা একটু সেনসিটিভ। অবিনাশকাকু র থেকে ডিটেলস পেতে
সময় লাগল প্রায় ১৫ মিনিট, কিন্তু ও যে নামটা এক্সপেক্ট করছিল
সেই নাম তো নেই-ই উল্টে এই নাম তো কখনো শোনেনি। রুক্মিণী,
রুক্মিণী সান্যাল, কোনো কিছুর সাথে কোনো লিংক খুঁজে পেলো না
ও। বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করতেও পারছে না, না আছে ওর কাছে
কোন কারণ, না আছে কোনো লিগাল ডকু মেন্টস, না কোনো প্রুফ,
যার ভিত্তিতে ও কারো ব্যাপারে সমস্ত ইনফরমেশন বের করে দিতে
বলবে। আর হাইপ্রোফাইল লোকজনের কারণে এদের থেকে কিছু
ইনফরমেশন বের করাটাও খুব মুশকিল। কোথাও কোনো লিংক নেই,
একজন অজানা লোকের পিছনে শুধুই নিজের ইনস্টিংক্ট-এর বশে
এতদূর চলে এসেছিল ও। ওর মাথাটা এবার সত্যিই খারাপ হয়ে
গেছে। আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে আসছিল, কিন্তু জায়গাটা ফাঁকা
হতেই অবিনাশকাকু ফিসফিসিয়ে বলল, "আরে ইনি তো অনেকদিন
ধরেই এখানে আছেন। হাইপ্রোফাইল কেস, তাই আমাদের কিছু
ডিসক্লোজ করার পারমিশন নেই। আমি শুধু এটুকু ই জানি, ইনি

​85
লাবণ্য সান্যাল-এর বোন, বহু বছর ধরে রয়েছেন। আমি তো এই
আট বছর হল এখানে কাজ করছি, তার অনেক আগে থেকে। ব্যস,
এটুকু ই বলতে পারি।"

চোখ দুটো জ্বলে উঠল সুদীপ্তার, এটা তো জানতো না, কেউ


কোথাও বলেওনি, শোনেওনি যে লাবণ্য সান্যালের বোন মানসিক
চিকিৎসাধীন! এবার তো দেখতেই হচ্ছে! যে ভাবে হোক ওকে
একবার দেখা করতেই হবে, কিন্তু কিভাবে। ওর কাছে কোনো
পারমিশন ডকু মেন্টস কিছু নেই, আর ও কোনোভাবেই আর অপেক্ষা
করতে পারবে না। অসম্ভব, অবিনাশকাকু কেই হেল্প করতে হবে।

"আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি হয়ে যাবে, সারা জায়গায়


সিসিটিভি লাগানো আছে, কিভাবে সম্ভব? আর ওনার কাছে যে
কেউ যেতেও পারে না, ওনার রুম ব্যবস্থা, ওনার আয়া নার্স সবই
আলাদা। শুধু ওনার জন্যই তারা কাজ করেন, বাকি আর কোন
পেশেন্টের জন্য তারা কাজ ও করে না। কিভাবে নিয়ে যাবো
তোমাকে?"

-"কাকু যেতে তো আমাকে হবেই, সোজা পথে না হোক বাঁকা


পথে, ৫ মিনিটের জন্য হলেও আমি যাবো। এত বড় সত্যিটা যখন
লোকচক্ষু র আড়ালে রেখে দিয়েছে সবাই মিলে, এত নিপুণতার
সাথে, তখন একবার তো যেতেই হচ্ছে। প্লিজ তু মি ব্যবস্থা করো। "

***

অপেক্ষা করতেই হল যতক্ষণ না ওই মহিলা বেরোয়, ছদ্মবেশে


যাওয়া ছাড়া আর উপায় কি? পুলিশের পোশাকে তো যাওয়া
অসম্ভব, একজন আয়ার পোশাকে তৈরী হয়ে অপেক্ষা করছিল
সুদীপ্তা, কখন ওই মহিলা বেরিয়ে যায় হাসপাতাল থেকে ভিসিটিং

​86
আওয়ার্স শেষ হলে। হাতে সময় খুব কম। বেশিক্ষণের জন্য সিসিটিভি
অফ রাখা যাবে না ওই হল-এর, তাই যা করার কয়েক মিনিটে করতে
হবে। কিন্তু যার মানসিক স্থিতিই নেই সে একজন অপরিচিতকে দেখে
তো রিএক্ট করতেই পারে, আর এটাই ভয় লাগছিল সুদীপ্তার।
চিৎকার চেঁচামেচি হলে ও কোথায় পালাবে ও নিজেও জানে না।
ফোনটা সাইলেন্ট করে দিল সুদীপ্তা, তারপর অবিনাশকাকু র থেকে
গ্রীন সিগন্যাল পেতেই ফোর্থ ফ্লোরের দিকে রওনা হল। এই ফ্লোরটা
বাকি ফ্লোরগুলোর থেকে বেশ আলাদা, রীতিমতো ঝা চকচকে।
অবিনাশকাকু বলছিলেন হাইপ্রোফাইল কেসের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা
ব্যবস্থা এদের, স্বাভাবিক, এখনকার যুগে টাকাই তো কথা বলে।
করিডোর পেরিয়ে কোণের দিকে একদম ঘরটার সামনে এসে
দাঁড়ালো সুদীপ্তা। কাঁচের দরজা, ভিতরে আলো জ্বলছে, ঘরটাকে
কোনো হাসপাতালের ঘর তো মনে হচ্ছেই না বরং কোনো
বড়োসড়ো হোটেলের রুম মনে হচ্ছে। হা করে ভিতরের সাজসজ্জা
দেখছিল সুদীপ্তা। কিন্তু রুক্মিণী কোথায়? কাঁচের দরজা পেরিয়ে দৃষ্টি
এদিক ওদিক খুঁজছিলো তাকে, তখনি দেখা মিলল তার। পরনে সাদা
সিল্কের স্লিপিং গাউন মতো, চুল খোলা, চোখে চশমা, হাতে বই
নিয়ে ঘুরে ঘুরে কিছু পড়ছে, মুখটা ভাল করে দেখতেই হৃদপিন্ড বন্ধ
হয়ে যাওয়ার জোগাড় হলো সুদীপ্তার। এ কি দেখছে ও? কাকে
দেখছে ও? ওর তো মাথা কাজ করছে না। লাবণ্য সান্যাল স্বয়ং ওর
সামনে দাঁড়িয়ে! কিন্তু এ কি করে সম্ভব? ও নিজে বডি
শনাক্তকরণের সময় সামনে ছিল, নিজে হাতে লাবণ্য সান্যালের
ডেডবডি মর্গে পাঠিয়েছিল ও, তাহলে এই অসম্ভব সম্ভব হল কি
ভাবে?

কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথাটা পুরো ব্ল্যান্ক হয়ে গেছিল সুদীপ্তার,


এ তো অসম্ভব! কিন্তু তারপর ফোনের ভাইব্রশনে টনক নড়ল, ওর
হাতে মাত্র ৫ মিনিট আছে, ওই জন্যই অবিনাশকাকু ফোন করছেন।

​87
ও আর দেরি না করে সন্ধ্যার জলখাবার সাজানো টেবিল নিয়ে ঘরে
ঢু কল। ঐদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, ভাগ্যিস! কেমন অদ্ভু ত ভাবে
মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ঘুরে ঘুরে হাতের বইটা নিয়ে পড়ছিল সে যেই
হোক। হা করে তার কার্যকলাপ দেখছিল সুদীপ্তা, মাথা কাজ করছে
না কিছুই। অবশেষে ঘরের ভিতর ঢু কে প্লেটগুলো টেবিলে সাজিয়ে
রাখতে রাখতে যতটুকু সময়, কিন্তু সেদিকে তার যেন কোনো
ভ্রূক্ষেপ-ই নেই। অপ্রকৃ তস্থ তো লাগছে অবশ্যই, কিন্তু সে যেন
নিজের জগতেই মগ্ন। প্লেটগুলো টেবিলে সাজিয়ে বেরিয়ে এলো
সুদীপ্তা, ঠিক ভু লের সব হিসেব গুলিয়ে গেছে।

***

-"লাবণ্য সান্যাল আর ওনার বোন মানে রুক্মিণী সান্যাল দুই যমজ


বোন, সরি এটা বলতে ভু লে গেছলাম, সেই জন্যই এত অবাক
হয়েছিস। যাক গে, এবার তু ই যা এখান থেকে। আর কোনো ঝামেলা
হওয়ার আগে আমাকে সিসিটিভিও অন করতে হবে। আর দাঁড়াস না
নয়তো এবার সমস্যা বাড়বে। "

অবিনাশকাকু জোরাজুরি করতে আর বেশিক্ষণ দাঁড়াল না ওখানে


সুদীপ্তা, ও এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। ভূ ত দেখার মতোই অবস্থা
হয়েছিল ওর। হার্ট ফেল হয়ে যায়নি এই অনেক। উফফফ!

বেরিয়ে এলো হাসপাতাল থেকে। কি খুঁজতে গিয়ে কি দেখতে


পেল আজ সুদীপ্তা? মানে ওই মহিলা এনার সাথে দেখা করতেই
আসেন নিয়মিত, দ্যাটস ইট। এইটুকু সময়ের মধ্যে যতটুকু দেখতে
পেয়েছে সুদীপ্তা সেটাই বার বার ভাবছিল। কাল এই পোশাক ফেরত
দিয়ে দেবে। বেরিয়ে এলো ও কম্পাউন্ড থেকে। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল
পড়ল ফোনটা কোথায়? ফোনটা কি হাসপাতালেই ফেলে এলো
আবার? ওহ! কি বিরক্তিকর! আবার ব্যাক করে হাসপাতালের দিকে

​88
যাচ্ছিল সুদীপ্তা, তখনি হল ঘটনাটা।

​89
অন্তিম পর্ব

ফোর্থ ফ্লোরে আবার একবার সবার নজর এড়িয়ে ওঠা আর সম্ভব


ছিল না। তাই অন্য রাস্তা নিতেই হল। ট্রেনড অফিসারের জন্য সেসব
যদিও কিছুই না। প্রথমবার ঘরে ঢু কেই দেখে নিয়েছিল এই রুমটার
সাথে একটা লাগোয়া ব্যালকনিও আছে। এ সুযোগটা আর হাতছাড়া
করেনি সুদীপ্তা। ও জানে ও যা করছে একদম ঠিক করছে। এত সিওর
এর আগে আর কখনো বোধহয় হয়নি যতটা ও আজ সিওর।
ব্যালকনিতে নেমে কাঁচের স্লাইডিং ডোরটায় ধাক্কা দিল হালকা। ওটা
খোলাই ছিল। ঘরে ঢু কতেই দেখল সেই মহিলা নিজের সোফায়
উল্টো দিক করে বসে আছে, হাতে সেই একই বই ধরা। খুব সম্ভবত
সুদীপ্তার উপস্থিতি টের পায়নি, নাকি পেয়েছে? কোনোরকম ভনিতা
না করেই সুদীপ্তা বলল, "লাবণ্য সান্যাল?"

ওইপ্রান্ত থেকে কোনো শব্দ এলো না ১ - ২ সেকেন্ড, পরক্ষণেই


হাতের বইটা রেখে সম্পূর্ণ সুস্থ ভাবেই ঘুরে দাঁড়ালেন ওই মহিলা,
যার চোখের চাহনি এখন দেখে কেউ একবার ও বলবে না এই

​90
মানুষটাই একটু আগে অপ্রকৃ তস্থর মতো আচরণ করছিল! কি
অসাধারণ অভিনয়! সুদীপ্তা চোখে চোখ রেখেই বলল, "আপনার
অভিনয় শেষ হলে এবার কথা শুরু করা যাক?"

-"ইউ আর রিয়েলি ইন্টেলিজেন্ট! আমি জানতাম তু মি আবার


আসবে, এই ফোনটা ইচ্ছে করেই ফেলে গেছিলে তাই তো?"

-"সরি, আমার এখনো অবধি আপনার মতো অভিনয় ক্ষমতা নেই।


আমি জেনুইনেলি ফোনটা ভু লে গেছিলাম, কিন্তু এখন ভাবছি
ভাগ্যিস ভু লে গেছিলাম! যাক গে, বলুন এবার সবটা লাবণ্য
সান্যাল। "

-"ধরলে কিভাবে?"

স্মিত হাসল সুদীপ্তা, তারপর বললো, "আপনার হয়তো মনে নেই,


কিন্তু আপনি একবার আমাদের কলেজে এসেছিলেন, স্পিচ দিতে।
সেই তখনি আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম। আর তখনি লক্ষ্য
করেছিলাম আপনার এই বদ অভ্যাসটা।" বলে লাবণ্য সান্যালের বাম
হাতের দিকে ইশারা করল সুদীপ্তা। "মানুষ যতই অভিনয় করুক,
নিজের অভ্যাস ছাড়তে পারে না, আপনিও পারেননি, আপনি যে
নিজের অজান্তেই আপনার বাম হাতের আঙ্গুলগুলো অবিরাম
নাড়াতে থাকেন। আপনার এই অভ্যাসটা আমি আমার কলেজেই
প্রথম নোটিশ করেছিলাম। এভাবে এত স্পষ্ট এই কারণে মনে আছে,
কারণ ছোট থেকেই আপনার খুঁটিনাটি সমস্ত যা কিছু যেখান থেকেই
জানতে পারতাম আমি রীতিমতো আত্মস্থ করার চেষ্টা করতাম,
এটাও করেছিলাম। পরে যখন বুঝেছিলাম এটা বদ অভ্যাস তখন
ছেড়ে দি। ছোট থেকে আপনার মতো হতে চাইতাম, বলতে পারেন
এক প্রকার অবসেসড। তাই যখন আজ আপনার এক হাতে বই দেখি
আরেক হাত ঐরকম ভাবে, ঐমুহুর্তে বুঝতে না পারলেও পরে হঠাৎ

​91
আমার মাথায় আসে যখন আমি আমার মোবাইলটা নিতে ফেরত
আসছিলাম। দুই বোন যতই যমজ হোক, বদ অভ্যাসও দুজনের
সম্পূর্ণ এক, এটা সম্ভব না। তাই চান্সটা নিয়েই নি।"

-"হুম। আই এম ইম্প্রেসেড।" এটুকু বলেই নিজের সোফাটায়


সুদীপ্তার দিকে সোজাসুজি মুখ করে বসল লাবণ্য সান্যাল, সামনের
সোফায় সুদীপ্তাকেও বসতে বলার ইঙ্গিত করে। তারপর আবার
বললেন, 'আমার মতো হতে চাইতে কেন?"

সুদীপ্তা খুব সাবলীল ভাবেই উত্তর দিল, " জানি না। সেটা বলতে
পারবো না। কিন্তু আমাকে ছাড়ুন, আপনি নিজেরটা বলুন। এসবের
মানে কি? কেন? আপনি জানেন আপনার কি কি শাস্তি হতে
পারে?"

-"তা কে দেবে শাস্তি? তু মি? কে বিশ্বাস করবে তোমার কথা?


প্রমাণ কোথায়?"

-"প্রমাণ? আপনি নিজেই তো প্রমাণ। আপনি এখনো বেঁচে


আছেন এটাই তো সবথেকে বড় প্রমাণ।"

-"কিভাবে প্রমাণ করবে আমি রুক্মিণী নয়, লাবণ্য? লিগালি


সবকিছু জোগাড় করে আমার অবধি পৌঁছাতে তোমার অর্ধেক জীবন
কেটে যাবে। আর যদিও বা পৌঁছাও তখন আর আমি বেঁচে থাকব না
এটা বলবার জন্য যে আমি বেঁচে ছিলাম।" এটুকু বলে স্মিত হাসল
লাবণ্য সান্যাল।

-"ডিএনএ, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, রেটিনা স্ক্যান বহু পদ্ধতি আছে আপনি


কে প্রমাণ করার জন্য, আর তাছাড়া আপনার এগুলো বলতে লজ্জা
করছে না? আপনি যা করেছেন আর করছেন সেটা অপরাধ। আর
তারপরেও... আপনাকে আমি একজন ভাল মানুষ, স্ট্রং ইন্ডিপেন্ডেন্ট

​92
বিসনেস আইকন হিসেবে দেখতাম। একজন নারী হয়ে আর একজন
নারীর প্রতি সম্মান ছিল আমার, আর আপনি তো?"

-"হুম। ইন্টেলিজেন্ট তো তু মি বটেই, কিন্তু এখনো তোমার মধ্যে


লাবণ্য সান্যালের মতো সেই বিচক্ষণতা, সেই দূরদর্শিতা আসেনি।
আর তোমার এখনও মনে হয় তু মি এসব টেস্ট করানোর পারমিশন
এই জীবনেও আনতে পারবে? আর দূরদর্শী নয় তাই তু মি আমার
এই ডিসিশনের পিছনের কারণটা এখনো বুঝতেও পারোনি কিছু
দেখতেও পাওনি। একথা সত্যি তু মি এতদূর পৌঁছে যাবে এটা আমি
সত্যিই ভাবিনি, এই কেস যত দ্রুত বন্ধ হোক সেটা আমিই
চাইছিলাম। তু মি যদি আমার সম্পর্কে এতটুকু ও জেনে বুঝে থাকো
তাহলে এটা নিশ্চয় বুঝেছ যে আমি বেঁচে থাকলে আর কোনো কিছুই
ঠিক থাকতো না। না আমি না আমার পরিবারের লোক।"

-"তাও আপনি বেঁচে আছেন, আর একজনের পরিচয়ে বেঁচে


আছেন যার সাথে আপনি কি করেছেন তার কোনো ক্লু নেই পুলিশের
কাছে। আবার সে সম্পর্কে আপনার বোন। সিরিয়াসলি? আপনি
মানুষ?"

-"না জেনে বেশি কথা বলা এখনকার জেনরেশনের একটা স্বভাব।


তোমার কোনো আইডিয়া-ই নেই আদৌ কি হয়েছে আমার আর
আমার বোনের মাঝে।"

-"যাই হয়ে থাকু ক, আপনি গল্পটা এমনভাবে পোর্ট্রে করবেন যাতে


আপনি ক্লিনচিট পান। তাই আমি আপনার কথা কেন বিশ্বাস করব?"

-"সেটা তোমার উপর, আমাকে যদি একটু বলতে দাও তো বড়


ভাল হয়।"

​93
সুদীপ্তা ইশারায় ওনাকে শুরু করবার জন্য বলল।

লাবণ্য সান্যাল বরাবরই বাকচাতু র্যে পটু। উনি যখন কিছু বলেন
তখন সত্যি শুনতে ইচ্ছা করে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আজ
যখন উনি বলতে শুরু করলেন, সুদীপ্তা মনেপ্রাণে নিজেকে বাঁধার
চেষ্টা করল যেন কোনোভাবেই সেই কথায় ভেসে না যায়। খুঁটিয়ে
খুঁটিয়ে সামনের মানুষটাকে দেখছিল ও, সেই একইরকম তেজ, কথা
বলার ধরণ, হাতের ভঙ্গিমা, কোনো ভু ল করেনি সুদীপ্তা।

-"আমার ফ্যামিলি ক্রাইসিসের সাথে সাথে আমার বিজনেসেও


চলছিল মারাত্মক টানাপোড়েন। এমন একটা অবস্থা দাঁড়ায় যেখানে
আমি বেঁচে না থাকলেই একমাত্র সব সমস্যার অবসান হতে পারে।
শেয়ার প্রাইস, কোম্পানির ভ্যালুয়েশন, প্রফিট মার্জিন সব কিছু
তলানিতে পৌঁছেছিল। তার সাথে বাড়িতে সবসময় চরম অশান্তি।
বহুবার চেষ্টা করেছি ভাল থাকার, বিয়ের আগে, বিয়ের পরে,
ডিভোর্সের পরে। কোনোবারই সফল হইনি। ভাল থাকা আর আমার
হয়নি। এবার যখন সব আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের ভাগ্যকে মেনেই
নিয়েছিলাম, তখনই ভাগ্য আমায় এরকম মর্মান্তিকভাবে সুযোগ এনে
দিবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম, কিন্তু
একটা বিয়ের জন্য শুধুই ভালবাসা যথেষ্ট নয় এটা বুঝতে পারিনি।
বিশ্বাস সবথেকে জরুরি যেটা অর্জুন আর আমার মধ্যে কোনোদিনই
ছিল না। আমি চেষ্টা করেছিলাম আমার মতো করে, হয়নি। জানি না
কেন। আমি আমাদের বিয়ের আগের দিনগুলো খুব মিস করতাম,
যখন কোনো জটিলতা ছিল না জীবনে। দুজন দুজনকে বন্ধু হিসেবে
বিশ্বাস করতাম, ভালবাসতাম। অগাধ ছিল সেই বিশ্বাস সেই
ভালবাসা। তারপরই সব কিছু কেমন বদলে গেল যখন থেকে অর্জুন
জীবনটাকে টাকা পয়সা আর সাফল্যের দাঁড়িপাল্লায় মাপতে শুরু
করল। আমিও চেষ্টা করেছিলাম ওর সাথে পাল্লা দিতে, ওর সাথে

​94
চলতে। ও কখন দৌড়ে বেরিয়ে গেল আমি বুঝতেই পারিনি। বড্ড
তাড়া ছিল ওর, কেন কে জানে। আমরা দুজন এটা ভেবে বিয়ে
করেছিলাম যে আমাদের পথ, আমাদের এই জীবন থেকে চাওয়া
পাওয়া একই, কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম আমাদের দুজনের
প্রায়োরিটিস কতটা আলাদা। হয়তো আলাদাই ছিল, আমিই চিনতে
বুঝতে ভু ল করেছিলাম। আমাদের বন্ধু ত্বটা এই প্রেম ভালবাসা
বিয়ের চাপে শেষ হয়ে গেল। আমি একা হয়ে গেছিলাম অনেক
আগেই, অর্জুন বুঝতে ও পারেনি। ইনফ্যাক্ট ওর বোঝার মতো
সময়ও ছিল না। আমিও বলার আর প্রয়োজন বোধ করিনি। ফাঁকা
জায়গা ছিল বলেই দীপ আসতে পেরেছিল। একটা প্রকৃ ত বন্ধু র
অভাব ছিল। দীপ আমার প্রকৃ ত বন্ধু ই। কিন্তু সেটাকে ভু ল নজরে
দেখে বার বার অর্জুন আমাদের মধ্যে যা কিছু অবশিষ্ট ছিল সেটাকে
শুধু রক্তাক্ত করে গেছে, ক্ষতবিক্ষত করে গেছে। হ্যাঁ, দীপের আমার
প্রতি যে অনুভূ তি ছিল বা আছে তা আমি জানতাম।

কিন্তু যখন দেখলাম অর্জুন নিজের হাতে সব শেষ করতে উদ্যত,


আমার কথা শোনার প্রয়োজন অবধি বোধ করেনি, তখন আমি-ই
কেন সব সময় দায় নেব নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার? যখন আমি
সত্যিই নির্দোষ ছিলাম! আমি একটা মেয়ে বলে? মা বলে, স্ত্রী
বলে? ও ওর দায় পালন করেনি আমিও আমার দায় পালন করার
আর প্রয়োজন বোধ করিনি। এটাই ধ্রুব সত্য।

আমার ভাল থাকার অন্তরায় শুধু অর্জুনই নয়, আমার নিজের


মেয়ে মা বাবা সকলেই... প্রত্যেকে এটাই ভেবেছিল আমিই অর্জুনকে
ঠকিয়েছি। কিন্তু আমি কি ঠকিনি? একসাথে পথ চলা শুরু করে যখন
সব কিছু ওলোটপালোট করে দিয়ে ও চলে গেল সেটা কি ঠকানো
ছিল না? আমার কি ভাল থাকার কোনো অধিকার নেই? আমি
আমার সীমা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। যে যাই ভাবুক আমি আমার

​95
লিমিট তো কোনোদিন ক্রস করিনি। দীপের সাথে থাকলে ওর সাথে
গল্প করলে ওর সাথে সময় কাটালে কোথা দিয়ে সময় কেটে যেত,
আমি বুঝতেই পারতাম না। আমি ভাল থাকতাম, আমি খুশি
থাকতাম। এতে কি অপরাধ? অপরাধ এটাই আমি আমার ভাল
থাকার হিসেব করতে গিয়ে এটা ভেবে দেখিনি দীপ কোথায় গিয়ে
দাঁড়াবে এবার? এটা আমার ভু ল নয় শুধু, বিরাট অন্যায়। এতটা
স্বার্থপরের মতো কিভাবে ভেবেছিলাম আমি এখন নিজেই ভাবতে
পারি না। ও তো আমার বন্ধু । ওর খারাপ থাকার কারণ আমি হতে
পারি না কিছুতেই, কিন্তু যখন সেটাই হল সেদিন থেকে আজ অবধি
আমি পুড়ে চলেছি, মরেও শান্তি পাবো না।

আমার বাড়ির প্রতিটা সদস্য আমায় সবদিন ভু ল বুঝেছে, আমায়


আমার দায়িত্ব মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে বারবার, অন্যের জন্য
বাঁচতে গিয়ে নিজে বাঁচতে ভু লে গেছিলাম। আমায় সবদিন সাপোর্ট
করেছে, আমার পাশে থেকেছে, দীপ ছাড়া আরো দুজন - সাবিত্রী
পিসি আর রুকু , আমার বোন।

আমরা যমজ বোন ছিলাম কিন্তু ও আর আমি ভীষণ আলাদা


ছিলাম। ও জন্ম থেকেই মানসিকভাবে একটু অন্যরকম ছিল, কিন্তু যে
কোনো মানসিক পরিস্থিতেই আমার প্রতি ওর ভালবাসা কোনোদিন
বদলায়নি। আর সবাই যাই করুক ওর আর আমার সম্পর্কে র
সমীকরণটা সবদিন একই ছিল আছে আর থাকবেও। ও কোনোদিনই
সুস্থ হবে না এটা আমরা জানতে পেরেছিলাম যখন আমাদের বয়স
হয়তো ১৪ -১৫ হবে। আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় তখন ও আমাদের
সাথে বাড়িতেই থাকতো, তারপর ওর স্থায়ী ঠিকানা হয় এই 'আলো'।
বাইরের জগতের কালিমা ওর মনটাকে কোনোদিন ছুঁতে পারেনি
বলেই হয়তো ও কোনোদিন বদলে যায়নি, ভাগ্যিস! সাবিত্রী পিসিও
তাই। অত বুদ্ধি, লাভ ক্ষতির হিসেব নিকেশ জানে না মানুষটা।"

​96
একটানা এতক্ষণ বলার পর থামল লাবণ্য, তাকাল সুদীপ্তার দিকে,
চোখ দুটো যেন জানতে চাইছে, ভ্যালিডেশন চাইছে, কোনটা ঠিক
কোনটা ভু ল বিচার করতে পারবে তো?

সুদীপ্তা চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, "আপনি রুক্মিণী সান্যালের


সাথে কি করেছেন সেটা বলুন। ডেড বডিটা তো আপনার যমজ
বোনের ছিল, যেটা সারা শহর জানে আপনার। আর আপনি এখন
রুক্মিণী সান্যাল পরিচয়ে বাঁচছেন। আর আপনার মৃত্যুর পর যে
যাবতীয় সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল ফিন্যানসিয়াললি অর
হোয়াটেভার, সমস্তকিছু আপনি দিব্য বেঁচে থেকেই ভোগ করছেন।
বাহ্! আপনার পুরো পরিবার তার মানে..."

-"না,না, আমার পরিবার এর মধ্যে নেই, ওরা কিছু জানে না,


জানে শুধু একজন। সাবিত্রী পিসি। ব্যস, আর কেউ না।"

-"মানে আপনার পরিবারকেও আপনি আপনজনের মৃত্যুযন্ত্রণা


দিতে একবার ও ভাবলেন না?"

-"আমার পদ্ধতি ভু ল, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না। এতে


সকলেই ভাল থাকবে, আছেও।"

-"রুক্মিণী সান্যাল ও তার মায়ের মেয়ে, আপনি কোন অধিকারে


একজন মানুষের মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী সমস্ত কন্সিকু য়েন্সেসকে
নিজের মতো করে ভেঙে চুরে নিজের ফেভারে বানিয়ে নিতে
পারেন? আপনার কোনো আইডিয়া আছে আপনি কি করেছেন?
আপনি যাই বলুন না কেন আপনার অপরাধ কম হয়ে হবে না,
রুক্মিনীর মৃত্যু কি ভাবে হলো দয়া করে বলুন। ওকে কি আপনি... "

"না না, আমি ওকে কিছু করতে পারি এটা ভাবলে কি করে তু মি?
হ্যাঁ এটা ঠিক যে আমার কাছে কেন প্রমাণ নেই কিন্তু আমি শুধু

​97
সত্যিটাই বলতে পারি যে সেদিন যখন আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে
গিয়েছিলাম শেষবারের মতো ওর সাথে একবার দেখা করতে আমি
এসেছিলাম, সেই মুহূর্তে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে আমার
কোনো ধারণাই ছিল না।"

-"মানে?"

-"মানে ও এর আগেও দুবার সুইসাইড এটেম্পট করেছে, ও


মানসিকভাবে অসুস্থ তাই এটার মধ্যে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
ট্রিটমেন্টের দ্বারা ও ভালই ছিল,সেদিন যখন ও আমার সাথে
শেষবার কথা বলল, আমায় বলল বাইরে কোথাও নিয়ে যেতে। কিছু
ভাল লাগছে না,দমবন্ধ লাগছে। এই মানসিক অসুস্থতা ছাড়াও ওর
সবসময় হাজারো শারীরিক অসুস্থতাও লেগেই থাকতো। কোনোদিনই
ও শান্তিতে একটু ঘুমাতে পায়নি। পাগলামি করে হাত পা কাটা এসব
তো আকছার সে আমি ছেড়েই দিলাম। আমি নিজেও এতটাই
বিধ্বস্ত ছিলাম যে আমি আর না করিনি ওকে নিয়ে বেরোই। যে
লোকেশন থেকে বডিটা পাওয়া যায় ওই জায়গাটা ওর খুব প্রিয়
ছিল, আমারও। বাঁধানো ঘাটে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে কেটে যেত এত
শান্তি, পুকু র নয় ঝিল বলা ভাল। সেদিনও গিয়ে বসি। অনেকটা রাত
তবে সবসময় খোলাই থাকে জায়গাটা। আমি একদম চুপ ছিলাম,
জলের দিকে তাকিয়ে। পূর্ণিমা ছিল সেদিন। ও হঠাৎ আমার এই গাল
দুটো টিপে আমায় বলল, "তোর খুব কষ্ট, আমি সব জানি, আমারও
খুব কষ্ট রে। সবসময় ওষুধ ইনজেক্শন এত যন্ত্রণা আমার আর
বাঁচতে ইচ্ছে হয় না রে বনু। এবার আমায় যেতে দিবি?"

আমি তখন কিছু শোনার বা বোঝার মতো মানসিক অবস্থায় ছিলাম


না, আমি স্থির করেই নিয়েছিলাম, ওকে হাসপাতালে ফিরিয়ে দিয়ে
এসেই আমি আমার জীবন শেষ করব। মানসিক পরিস্থিতি কি ছিল
সেটা আর আলাদা করে কি বলব, হঠাৎ আমায় আবার বলল, "

​98
তু ইও ভাল থাক, আমিও একটু ভাল থাকি, প্লিজ, রাগ করিস না
কেমন। আমার পিছু করিস না আর বনু, এবার মুক্তি দে তোরা।"
ব্যস, এটুকু ই, মুহূর্তে র মধ্যে ও যে আমার চোখের সামনে ঝাঁপ দেবে
আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত হয়ে
যাই! কি করব কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না, আমি নিজেও সাঁতার
জানি না। নিজের মৃত্যু ভেবে এসেছিলাম, কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাঁচার
তীব্র ইচ্ছাকে সম্বরণ করি কিভাবে, ওকে বাঁচাতে জলে ঝাঁপ দিতেই
যাচ্ছিলাম কিন্তু তখনই ওর লাইনটা আমার কানে বাজল। যেটার
মানে ওই মুহূর্তে বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, কিন্তু শেষ বারের
মতো ভাল থাকার ইচ্ছেটা আরেকবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
তারপরে সব ঘটনাই তু মি জানো, কিন্তু মানো আর নাই বা মানো
সত্যি এটাই। রুনু আমায় নতু ন জীবন দিয়ে গেছে নিজের জীবন
দিয়ে, যাতে ও শান্তি পায় আর আমিও একটু ওর পরিচয়ে ভাল
থাকতে পারি, শান্তিতে থাকতে পারি।"

চুপ করল লাবণ্য সান্যাল। সুদীপ্তার মাথায় মনে হচ্ছিল একসাথে


একশোটা হাতু ড়ি পিটছে কেউ, মাথাটা এবার ফেটেই যাবে, কিছু না
বলে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। বাড়ি ফিরতে হবে, অনেক দেরি হয়ে
গেছে।

বেরোনোর সময় লাবণ্য সান্যাল বলল, "তোমার যদি মনে হয়


আমি অপরাধী তু মি তোমার কাজ করতে পারো, আমি তোমায়
আটকাবো না। আমার আর কিছু প্রমাণ করার নেই।"

-"আপনার কর্মের প্রাপ্য ফল আপনি পাবেন, আমিও দেখছি


আপনাকে কে বাঁচায় এবার" এটুকু বলে বেরিয়ে এলো সুদীপ্তা, শুধু
বেরোনোর পর ফোনে রেকর্ড করে নেওয়া পুরো অডিও ফাইলটা
সেভ করে নিলো ও। এটাই একমাত্র প্রমাণ আপাতত ওর কাছে।
নয়তো লাবণ্য সান্যালকে বাগে আনতে পারে এ সাধ্য পুলিশেরও

​99
নেই। আর লাবণ্য সান্যাল যদি একবার আঁচ করতে পারে, তাহলে
সে নিজেকে বাঁচাতে সব করতে পারে, সুদীপ্তার প্রাণ সংশয় হওয়াও
অস্বাভাবিক না। এতদিন শ্রদ্ধা করত সুদীপ্তা মানুষটাকে, রাতু ল এর
সাথে এর জন্য কত অশান্তি করেছে, না, আর ভাবতে পারছে না।

***

বাড়ি ফিরেও কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না সুদীপ্তা, নিজের ঘরের


দরজা বন্ধ করে চুপচাপ ঘর অন্ধকার করে বসে ছিল ও।
অডিওফাইলটা এখুনি উপরমহলে পাঠিয়ে দিবে? তাহলে লাবণ্য
সান্যালের সত্যিটা বাইরে আনতে পারবে ও, কেসটা তাহলেই
একমাত্র সলভ হবে। এখনো যেন বিশ্বাস হচ্ছে না, কারো মাথাতেও
আসবে না! ফোল্ডারটার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত ভাবল সুদীপ্তা,
এত দোলাচল কেন ওর মধ্যে? যা ভু ল তা তো ভু লই, উনি যা
করেছেন সেটা অপরাধ। কিন্তু উনি যা কিছু বললেন তা যদি সত্যি হয়
তাহলে ওনার মানসিক অবস্থাটা ঠিক কতটা খারাপ ছিল যে নিজেকে
শেষ করতেই যাচ্ছিল সব কিছু ঠিক করবার জন্য। যে সারাটা জীবনে
এতটুকু শান্তি পায়নি প্রকৃ ত অর্থে, সঠিক মানুষের থেকে ভালবাসা
পায়নি, সব কিছু থেকেও সে কতটা অসহায় আর একা বলেই
নিজেকে শেষ করতে গেছিল। তাহলে ওই ভাবে কথাগুলো বলে কি
ভু ল করল সুদীপ্তা? সত্যিই তো, ভাল থাকতে, একটু শান্তিতে
বাঁচতে কে না চায়। রুক্মিণীর এমনিতেও বাঁচা না বাঁচা তো সমানই
ছিল, নিজেও বেঁচে থেকে কষ্ট পাচ্ছিল, আশেপাশের লোকগুলোও
তার সাথে কষ্ট পাচ্ছিল। সেও যদি মৃত্যুতেই তার শান্তি খুঁজে নেয়
আর আর একজন তার জীবনে, তাহলে ক্ষতি কি? কিন্তু একটা
আইনকানুন বলেও তো জিনিস আছে। সুদীপ্তা নিজে পুলিশ হয়ে
কিভাবে এত বড় একটা মিথ্যেকে সাপোর্ট করতে পারে? কিন্তু
কোনো মিথ্যের জন্য যদি কিছু ভাল হয় তাহলে সেই মিথ্যে তো

​100
কোনো অন্যায় নয়। এতে তো সকলেরই ভাল হবে, ইনফ্যাক্ট সবাই
ভাল আছে। এই খবরটা বাইরে বেরোলে যে ফিনান্সিয়াল ক্র্যাশ হবে
মার্কে টে, কোম্পানি তো ধুলোয় মিশবেই, তার সাথে কত মানুষের
চাকরি যাবে। তারা তো কেন দোষ করেনি, কিন্তু যে সুবিধা গুলো
লাবণ্য সান্যাল নিচ্ছে, সেটাও তো ঠকানোই, ইন্সুরেন্সের টাকায়
কোম্পানি ঘুরেও দাঁড়াচ্ছে, কিন্তু এক একটি টাকা দেশের সাধারণ
মানুষের। এটাও কি ঠকানো নয়? উফফফ! মাথা কাজ করছে না
আর। চোখ দুটো বুজে একটু চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিল সুদীপ্তা,
কখন চোখ লেগে গেছে বুঝতে পারেনি। ঘুম ভাঙল যতক্ষণে
ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে। ও ভেবে নিয়েছে, ও লাবণ্য সান্যালের
এগেইনস্ট এ সমস্ত প্রুফ জমা করবে, তারপর কি হবে সেটা
উপরমহলের ব্যাপার, নয়তো ও নিজেকে কি উত্তর দিবে? এত বড়
একটা ঘটনা এভাবে মুখ বুজে হজম করে নেওয়া, অন্যায় কে প্রশ্রয়
দেয়া আর তারপর নিজের চোখে চোখ রাখা, না না, সম্ভব নয় ওর
পক্ষে।

স্নান করে এসে মাকে তাড়াতাড়ি ভাত বাড়তে বলল ও, এখন


অনেক বেশি সাবধানে থাকতে হবে। লাবণ্য সান্যাল ওকে ছেড়ে কথা
বলবে না, কিন্তু ও ও হেরে যাওয়ার পাত্রী নয়, তাতে যদি লড়তে হয়
লড়বে ও। ওর নিজের থেকেও বেশি ওর পরিবার নিয়ে চিন্তা বেশি।
ফোনটা বাজছে, ঘড়িটা দেখে ফোনটা রিসিভ করলো ও। বাইরে
ততক্ষণে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

-"হ্যালো। "

-"---"

ওপাশ থেকে ভেসে আসা শব্দগুলো ওর পায়ের তলা থেকে মাটি


সরিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ধপ করে সোফায় বসে পড়ল ও। মা

​101
বাবা কিছু বুঝতে না পেরে ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল, তাড়াতাড়ি
নিজেকে সামলে নিয়ে টিভিতে নিউস চালিয়ে দিল ও, ভিড়ে ভিড়
চারদিক। পাঠিকার কণ্ঠে আজকের খাস খবর, "লাবণ্য সান্যালের
বোন রুক্মিণী সান্যালের মৃতদেহ উদ্ধার হাসপাতালের ঘর থেকে,
পুলিশের প্রাথমিক ধারণা সুইসাইড। লাবণ্য সান্যালের বোন চিরকাল
মিডিয়ার আড়ালেই থেকেছেন, ওনার পরিচয় কোনোদিনই তেমন
প্রকাশ্যে আসেনি। বেশিরভাগ মানুষের কাছেই তাই তার পরিচয়
অজ্ঞাত, সেই অজ্ঞাতবাসেই মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন রুক্মিণী
সান্যাল। অনেকেরই অজানা যে ওনারা দুই যমজ বোন। এত কম
সময়ের ব্যবধানে একই পরিবারে পরপর দুই মৃত্যু, ভেঙে পড়েছেন
পরিবার। "

টিভি চলতে লাগল, সুদীপ্তা নিজের ঘরে চলে এলো, নতমস্তকে।


ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন লাবণ্য সান্যাল। হেরেও জিতে গেলেন! ঐ
জন্যই কাল বলেছিলেন আমি আর থাকবো না এটা বলবার জন্য যে
আমি বেঁচে ছিলাম! ইস! ঘুণাক্ষরেও টের পেল না সুদীপ্তা! কে ঠিক
কে ভু ল? কোনটা সঠিক কোনটা অন্যায়? কে জিতল কে হারল
অবশেষে? সব দোষ কি লাবণ্য সান্যালেরই ছিল? নাকি এই মৃত্যুর
দায় লাবণ্য সান্যালের পরিবার, স্বামী, সন্তান, সুদীপ্তা, এমনকি এই
সমাজের উপরেও বর্তায়? সব কিছু আজ ধূসর। লাবণ্য নিজের মৃত্যু
দিয়ে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর চিৎকার করে বলে গেল, ভাল
থাকার অধিকার সকলের আছে, কিছু নতু ন শুরু করবার জন্য
কোনো বয়স হয় না। একটা সফল দাম্পত্যের নেপথ্যে শুধু প্রেম নয়,
বরং বিশ্বাস, বন্ধু ত্ব অনেক বেশি জরুরি। জরুরি নয় একজন প্রেমিক
বা প্রেমিকা একজন ভাল স্বামী বা স্ত্রী হয়ে উঠতে পারে, একজন
প্রকৃ ত বন্ধু হলেই একমাত্র তা সম্ভব। একটা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে
আরেকটা সংসার একটা মেয়েও শুরু করতে পারে আর তার সেই

​102
সিদ্ধান্তে তার পরিবারের তাকে সবার আগে বোঝা উচিত।

বুকের ভিতরটা চিনচিন করছে বড্ড, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সুদীপ্তা,


বাইরে মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে।

মুক্তধারা চলে আপনাদের সমর্থন ও ভালোবাসায়। তাই


আপনাদের সমর্থন না পেলে মুক্তধারার পক্ষে এগোনো আর
সম্ভব নয়।
তাই বিনীত অনুরোধ, বইটি ভালো লাগলে আপনার বন্ধু দের
বইটি কেনার পরামর্শ দিন। কপি / ফরওয়ার্ড করবেন না। এটি
শুধু বেআইনি নয় অনৈতিক ও বটে। বাকিটা আপনাদের
উপর।আপনাদের এটুকু সমর্থন প্রয়োজন।
♥♥♥

আরও অনেক গল্প পড়ুন মুক্তধারা ব্লগ :-


muktodhara.online

ও ফেসবুক পেজ-এ :-
Muktodhara-Tulika Roy

​103
​104

You might also like