You are on page 1of 5

রাগ দীপক আর দেশভাগ

- জাভেদ হুসেন

রাগ দিপক নিয়ে গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মিয়াঁ তানসেনের নাম। তানসেন ছিলেন বাদশাহ আকবরের নবরত্নের
একজন। এই দীপক রাগের জন্য তিনি প্রায় মরতে বসেছিলেন।
তানসেন ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ভারতের গোয়ালিয়র শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মোগল সম্রাটরা শিল্পকলার
পৃষ্ঠপোষকতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। মুঘল সম্রাট আকবর যখন তাকে তার দরবারে নিয়ে আসেন তখন তাঁর
বয়স ৫৬ বছর। ১৫৮৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তানসেন মুঘল দরবারে বসবাস করেন।
রাজদরবারের ইতিহাসবিদ আবুল ফজল তানসেন সম্পর্কে লিখেছেন, তাঁর মতো গায়ক গত হাজার বছর ধরে
ভারতে জন্ম নেননি। আকবরের ছেলে বাদশা জাহাঙ্গীর তাঁর জীবনীতে তানসেন সম্পর্কে লিখেছেন তাঁর গানে
না কি সুন্দর মুখের মানুষ, তাঁর সামনে আধ ফোটা পদ্ম আর পদ্মের পাপড়ির মাঝ দিয়ে উড়ে যাওয়া ভ্রমরের
ছবি স্পষ্ট দেখতে পেতো শ্রোতারা।
তানসেনের সঙ্গীত নিয়ে অনেক কিংবদন্তি রয়েছে। তিনি যখন মেগ মালহার রাগ গাইতেন, নিমষের মধ্যে মেঘ
জড়ো হয়ে বৃষ্টি শুরু হতো। তার অদ্ভু ত সঙ্গীত দিয়ে বন্য জন্তুদের পোষ মানাতে পারতেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত
কিংবদন্তি হল দীপক রাগ পরিবেশন করে আগুন জ্বালানো।
আকবরের কিছু দরবারী তানসেনের প্রতি খুব ঈর্ষান্বিত ছিল। এর কারণও আছে। কোত্থেকে এক লোক এসে
তাদের কদর কমিয়ে যত পুরষ্কার সব লুটে নিচ্ছে! তারা তানসেনকে তার নিজের সঙ্গীত দিয়ে হত্যা করার ষড়যন্ত্র
করেছিল। সবার বিশ্বাস যে যদি কেউ নিখুঁতভাবে দীপক রাগ গায় তবে তার চারপাশ এত উত্তপ্ত হয়ে উঠে যে
গায়কের গায়ে আগুন ধরে যায়। গায়ককে সেই রাগ পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। দরবারীরা বাদশা আকবরকে গিয়ে
ধরলো। সম্রাট যদি হুকু ম করেন তো তানসেনের কন্ঠে সেই কিংবদন্তি রাগ শুনে তাদের ইহকাল আর পরকাল ধন্য
হয়। বাদশা আকবরের কাছে সেই রাগের কাহিনী তারা ফু লিয়ে ফাপিয়ে শোনাতে ভু ললো না। আর সম্রাট যাকে
এমন আদর করে ডেকে এনে দরবারে ঠাঁই দিয়েছেন তার যোগ্যতারও তো একটা পরীক্ষা হওয়া দরকার।
আকবর ফরমাশ করলেন তানসেনের কাছে। রাগ দীপক শোনাতে হবে। সম্রাটের উপাধি ‘জিল্লে সোবহানি’।
মাটির পৃথিবীতে তিনি পরম কৃ পাময় ওপরওয়ালার ছায়া। আদশ না মানলে সেই ছায়া সরে যাবে। প্রাণসংশয়
দেখা যাবে তাতে সন্দেহ কী? সব বুঝলেন তানসেন। কিন্তু রাজি না হয়ে উপায় নেই। তবে বললেন, ‘মহামহিম
সম্রাট, আপনার আদেশ আমার নিশ্বাসের সমান। তবে হুজুর, প্রস্তুতির জন্য কয়েকদিন সময় দিন।‘
চিন্তিত মনে তানসেন বাড়ি ফিরলেন। তাঁর মেয়ে বললেন, ‘বাবা, তোমার মুখ এমন শুকনো কেন?’ সব
শোনালেন তানসেন। মেয়ে উপায় বাতলে দিলেন। বাবার কাছ থেকে শিখে নিলেন রাগ মেঘ। বৃষ্টির রাগ।
নির্ধারিত দিনে পুরো ফতেহপুর সিক্রি যেন জমা হলো আগ্রা কেল্লার কাছে। যেখানে এখন লোকে জমা হয়
তাজমহল দেখতে। খোলা জায়গায় সেই আসর বসলো। তানসেন শুরু করলেন রাগ দীপক গাওয়া। পুরো
জমায়েত যেন বিবশ হয়ে যাচ্ছিল সুরের আবেশে। সময় যত যায় একটু একটু করে কেমন যেন অস্বস্তি ভর
করলো সবাইকে। গরমের কাল নয়। কিন্তু চারপাশে যেন কেমন গুমোট হয়ে উঠছে। সবার গা বেয়ে দরদর করে
ঘাম পড়তে লাগলো। চারপাশে সাজানো ছিল হরেক রকমের প্রদীপ। দপ করে জ্বলে উঠতে লাগলো সব প্রদীপ
এক এক করে। তানসেনের গায়ে তখন জ্বরে পড়া রোগীর উত্তাপ। আসরের এক ধারে চিকের আড়ালে
মেয়েদের বসার জায়গা। সেখান থেকে তানসেনের মেয়ে ধরলেন রাগ মেঘ। চারদিক আঁধার করে মেঘ জমে
এলো। নামলো বৃষ্টি অঝোরধারে। রাগ দিপকের প্রভাব কাটলো রাগ মেঘে। তানসেনের প্রাণ বাঁচলো।
বোম্বেতে প্রিন্স অফ ওয়েলস মিউজিয়ামে তানসেনের একটি প্রতিকৃ তি রয়েছে। পেইন্টিংয়ের পিছনে লেখা
আছে, ‘তানসেন রাগ দীপক গেয়েছিলেন। তাঁর অপূর্ব সঙ্গীতে জ্বলে উঠেছিল আগুন।‘ ভারত পাকিস্তানের
সব পাকা গাইয়েরা কোন না কোনভাবে তানসেনের সঙ্গে নিজেদের পরম্পরা জুড়ে দেন। তানসেনের সমাধি
আছে গোয়ালিয়রে। সেখানে আছে আছে এক বৃদ্ধ তেঁ তু ল গাছ। সবার বিশ্বাস যে আপনি যদি এই গাছের একটি
পাতা চিবিয়ে ভক্তিভরে সংকল্প করে খান তবে আপনার কন্ঠটি মহান মুঘল যুগের মহানায়কের মতো সুরেলা
হয়ে উঠবে।
1
মোগল সম্রাটরা শিল্প সংস্কৃ তির কদর করতেন। মোগলদের শেষ দিকে সেই কদর ছিল প্রত্যক্ষ। রাজত্ব আর কিছু
নেই যখন তখন তো সম্রাটদের আর কিছু করারও ছিলো না। শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর কবি ছিলেন।
সঙ্গীতের সমঝদার ছিলেন। উর্দু কবিতা লিখতেন। আবার ঠেট হিন্দিতে হোলির গা লিখতেন ‘শোখ’ নামে।
এমনই একটা গান আজও গাওয়া হয়:
কিউঁ মোপে মারি রংগ কি পিচকারি
দেখ কুঁ য়ারি দুংগি গারি

(কেন আমার গায়ে মারলি রঙের পিচকারি


দেখ, আমি কিন্তু গালমন্দ করবো)

রঙের পিচকারিতে সখীর নাজেহাল অবস্থা। আর কতো পালিয়ে বেড়ানো যায়? রাগ করে সে সখীদের বলছে:
ভাগ সাকুঁ ম্যায় ক্যায়সে মোসে ভাগো নাহি জাত
আব দেখুঁ ম্যায় ওয়াকো কওন জো সুন মুখ জাত

(আর ছুটতে পারি না, পায়ে ব্যাথা হয়ে গেল


এই দাঁড়ালাম, দেখি কে আমার গায়ে রঙ ছোড়ে)
দেশভাগের আগেও দিল্লিতে পাকা গাইয়ের কোন অভাব ছিল না। এর মধ্যে মুজাফফর খাঁ , চান্দ খাঁ, রমজান
খাঁ, সারেঙ্গিবাদক মম্মন খাঁ আর বুন্দু খাঁ, সেতার বাজিয়ে বরকত খাঁ ছিলেন প্রণম্য। এঁদের নাম নিলে কানে হাত
দিয়ে সম্মান জানাতে হয়। তাল বাদকদের মধ্যে ছিলেন আল্লাদিয়া খাঁ, নাত্থু খাঁ পুরো হিন্দুস্তানের মধ্যে ছিলেন
বিখ্যাত। মোগল দরবার আর নেই। এরা সব হিন্দুস্তানের বিভিন্ন দেশি রাজা জমিদারদের দরবারে আশ্রয়
নিয়েছিলেন।
মোগল আমলে শিল্পীরা বড় জায়গির পেতেন। উস্তাদ নিয়ামত খাঁ, যিনি সদারংগ নামে ভারতবিখ্যাত, বাদশার
দরবারে বাদশার সামনে কেবল গাইতেন। আর আসর বসাতেন নিজের বড়িতে। সেখানে দরবারের আমির আর
শাহজাদারা আসার সুযোগ পেয়ে ধন্য হতেন। ১৮৫৭-র পর সেই যুগ শেষ হয়ে গেল। বড় বড় শিল্পীরা
রুটিরুজির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ সাহেবের চাচা উস্তাদ কালে খাঁ সাহেব ঢাকা
পর্যন্ত থেকে গিয়ে শেষে দারিদ্রে কোথায় মারা গিয়েছিলেন তাও জানা যায় না।
ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার শ্রীব্রজেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় সেতারের শ্রেষ্ঠ উস্তাদ ও
শিল্পী এনায়তে খাঁ (ভারতের বিখ্যাত উস্তাদ বিলায়েত খাঁর বাবা), তানসেনের বংশধর বিখ্যাত রবাবী মোহাম্মদ
আলী খাঁ এবং দিল্লীর সুরেলা তবলার উস্তাদ মাসিদ খাঁ (তবলাবাদক উস্তাদ কেরামাতু লা খাঁর বাবা), উস্তাদ
উজির খাঁ (যিনি নমস্য আলাউদ্দিন ও হাফিজ আলী খাঁর উস্তাদ), হাফিজ আলী খাঁ, দবীর খাঁ ও অন্যান্যরা
গৌরীপুরে এসে স্থায়ীভাবে উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা করেছেন।
শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের দরবারের সভা গায়ক ছিলেন তানরস খাঁ। বিদ্যুতের মতো তান করতেন বলে
মির কু তু ব বখশের নাম হয়েছিল ‘তানরস’। দিল্লিতে গলি তানরস খাঁ ছিল। সেখানে তানরস খাঁ সাহেবের
বিশাল হাওয়েলি বহাল ছিল। ১৯৪৭ সালে দিল্লিতে অবস্থা খারাপ হলো যখন, সন্ধে ছয়টা থেকে ভোর ছয় পর্যন্ত
কারফিউ দেয়া হলো। দিল্লির কিছু রইসের খেয়াল হলো যে এই কারফিউতে সন্ধ্যার পর থেকে সময় কাটে কী
করে? তানরস খাঁয়ের হাওয়েলিতে একটা সঙ্গীত আসর করলে কেমন হয়? এমন জায়গায় আসর করলে
হিন্দুস্তানের কোন বড় ওস্তাদ কেউ না এসে থাকবেন না।
আসরের কাহিনী লিখে গেছেন শাহিদ আহমদ দেহলভি সাহেব ‘রাগ রংগ কি ইক রাত’ প্রবন্ধে। প্রায় দুইশ বড়
গায়ক বাদক এসে জমা হলেন। সন্ধ্যে ছয়টার পর হাওয়েলির দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। বাইরে কারফিউ।
সকাল ছয়টার আগে আর কী বের হতে পারবেন না। ভেতরে খাওয়া, পান তামাক আর বরফ জলের
আয়োজন। প্রথমে গাইলেন বাজালেন ওস্তাদদের বড় শিষ্যরা। বিরিয়ানি, কোর্মা, শিরমাল দিয়ে রাতের খাওয়া
শেষে ওস্তাদদের পালা শুরু হলো।
ওস্তাদদের শিক্ষা তিন রকম—মিরাসি, মানে গোলা লোকের শিক্ষা, রইসদের জন্য দেয়া শিক্ষা আর বেটা দামাদ,
মানে নিজের ছেলে জামাতাদের দেয়া শিক্ষা। শেষের জনেরা পেতেন ‘ইলমে সিনা’ মানে ওস্তাদদের বুকের

2
ভেতরের কাছ থেকে পাওয়া বিদ্যা। আসরে ওস্তাদরা গাওয়া বাজানোর সঙ্গে সেসব গল্পও করলেন। উস্তাদ গামি
খান বসলেন জোড়া তবলা নিয়ে। বাজানোর সঙ্গে তিনি নিজের ঘরাণার গল্প শোনালেন। উস্তাদের কয়েক প্রজন্ম
আগে গিয়ে সম্পর্ক উস্তাদ মাখখু খানের সঙ্গে। মাখখু খান বিখ্যাত সুফি, কবি, সঙ্গিতবিদ দিল্লির খাজা দর্দ
দেহলভির আসরে পাখোয়াজ আর তবলা বাজাতেন। দিল্লির তামাম শাহজাদা ছিলেন তাঁর শিষ্য। দাদা মাখখু
খাঁ প্রতিদিন মাগরিবের পর লাল কেল্লায় যেতেন শাহজাদাদের তালিম দিতে। তেমনই গেছেন এক সন্ধায়।
দেউড়িতে পৌঁছাতে খাদিম জানালেন, বাদশা নামদার উস্তাদের হাজিরা তলব করেছেন। বাদশার প্রকোষ্ঠের কাছে
যেতে আরেক সেবক থামিয়ে বললেন, ‘বাদশা হুজুর পাখিদের গান শুনছেন’। একটু পর তলব হলো। মাখখু
খান সাহেব ভেতরে গিয়ে সাত সালাম পেশ করে এগোলেন। উস্তাদ ছিলেন বেঢপ লম্বা মানুষ। মাথা ঝুঁকিয়ে
সালাম দিয়ে এগোতে গিয়ে ছাদ থেকে ঝোলানো সোনার খাঁচায় মাথা ধাক্কা লাগলো। চমকে গিয়ে পাখিরা বন্ধ
করে দিলো গান। বাদশা চোখ বুজে শুনছিলেন। তিনি ভ্রু কু ঞ্চিত করে চোখ মেললেন। মুখ থমথমে। উস্তাদ হাত
জোর করে বললেন, ‘ক্ষমা চাই হুজুর। এই অধম লক্ষ্য করেনি’। বাদশা বললেন, ‘গান তো বন্ধ হয়ে গেল।
পাখি তো এখন আর গাইবে না।‘ উস্তাদ আরজ করলেন, ‘হুজুরের সৌভাগ্যে চার চাঁদ লাগুক। আপনার
সৌভাগ্যের কসম, পাখি এখনই আবার গাইবে।‘ বাদশা কৌতু ক না বিরক্তি নিয়ে কে জানে , বললেন, ‘দেখো,
যদি গাওয়াতে পারো। তবে না গাইলে কিন্তু তোমার রক্ষা নেই। উস্তাদ মনে মনে আঁতকে উঠলেন। কি জানি
আজ কপালে কী আছে! যা আছে কপালে—ভেবে সামলে নিয়ে জোড়া তবলা নিয়ে বসে পড়লেন পাখির
খাঁচার একেবারে নিচে। শুরু করলেন গৎ বাজানো। কী আশ্চর্য! কিছুক্ষণ পরই তবলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাখি
গাওয়া শুরু করলো। তবলার লয় যত বাড়ে, মিলিয়ে পাখিও তত দ্রুত গায়! বাদশা উচ্ছসিত হয়ে বললেন—
সুবহানাল্লাহ, এমন বাজনা কেউ কখনো শোনেনি, শুনবেও না। বলেই ডাক দিলেন সেবকদের। হুকু ম হলো—
উস্তাদের হাত দাবিয়ে দাও। হাত এমন দলাই-মলাই করা হলো যে ভাঙতে বাকি রইলো। বহুত পুরষ্কার আর প্রায়
ভাঙা হাত নিয়ে মাখখু খান সাহেব পালকি চড়ে ফিরলেন ঘরে। ব্যাথায় হাত আর নড়ে না। দিন কয়েক এমনি
পড়ে রইলেন ঘরে। শেষে কোন রকমে গিয়ে হাজির হলেন তাঁর পির দাতা মলন শাহের কাছে গিয়ে কেঁ দে
পড়লেন। সব শুনে পির সাহেবের চোখ ক্রোধে জ্বলে উঠলো। নিজের দুই হাত মাখখু খাঁ সাহেবের দুই হাত তু লে
নিয়ে বল্লেন—যা, তোর হাত ঠিক হয়ে গেল। আর কী আশ্চর্য! এতো দিনের অকেজো হাত নিমেষে ঠিক হয়ে
গেল।
এই গল্প শুনিয়ে উস্তাদ গামি খাঁ সাহেব বললেন—‘আমার উস্তাদদের কাছ থেকে পরম্পরায় সেই গৎ আমার
কাছে পৌঁছেছে। আজ এখানে সব মান্য জনেরা আছেন। হুকু ম হলে তা শোনানোর দুঃসাহস করতে পারি’।
ভরা আসর হইহই করে উঠল। এমন সুযোগ কি আর ফি হপ্তায় হয়?
উস্তাদ গৎ বাজানো শুরু করলেন। ধীরে ধীরে লয় বাড়তে লাগলো। আর কি আশ্চর্য, মনে হচ্ছিলো যেন সত্যিই
এক ঝাঁক পাখি নানা লয়ে গান গাইছে! প্রশংসায় আসর যেন ভেঙে পড়লো। এক রইসজাদা কবি যওকের
কবিতা ধার করে বলে উঠলেন: বেজান বোলতা হ্যাঁয় মসিহা কে হাথ মেঁ। মানে—মসিহার স্পর্শ পেয়ে মৃতও
কথা বলে ওঠে।
আসরে হাজির ছিলেন সারেঙ্গি নওয়াজ উস্তাদ বুন্দু খান। ২৭ বছর ইন্দোরের সভাগায়ক ছিলেন। ১৯৩৫ সাল
থেকে নিয়মিত অল ইন্ডিয়া রেডিওতে বাজাতেন। ভারতীয় প্রাচিন সঙ্গীত নিয়ে জানবেন বলে সংস্কৃ ত
শিখেছিলেন। বাঁশ আর বেত দিয়ে নিজের জন্য আলাদা সারেঙ্গি বানিয়েছিলেন। সেটাই বাজাতেন। শিলা ধরের
লেখা Here’s Someone I’d Like You To Meet বইতে উস্তাদ বুন্দু খান সম্পর্কে আশ্চর্য সব ঘটনা
জানা যায়। শিলা ধরের বাবা ছিলেন ব্যারিস্টার। দিল্লির ধনী বিগত দরবারি মেজাজের মানুষ। উস্তাদ বুন্দু খান
ছিলেন তাদের পরিবারের প্রিয় লোক। হলি, বিয়ে, অতিথি আপ্যায়ন…যে কোন অনুষ্ঠানেই তিনি আসতেন,
বাজাতেন। খাবারের পর উস্তাদের সারেঙ্গি বাদন ছিল অতিথিদের জন্য বিশেষ সম্মানের ব্যাপার। বাজনার আগে
ব্যারিস্টার সাহেব দীর্ঘ ভূ মিকা দিয়ে শিল্পী, বাদ্যযন্ত্র, বিগত কালের সঙ্গীতের গল্প বলে এই বাজনাকে আরও
রহস্যময় আকর্ষণীয় করে তু লতেন। আর উস্তাদকে কেউ কখনও সারেঙ্গি ছাড়া দেখেছে বলে জানা যায় না। হাত
পায়ের মতই সারেঙ্গি ছিল তাঁর শরীরের অংশ। বাচ্চা , বুড়ো, ঘরের পরিচারক, রাজা জমিদার…যে কারোর জন্য
তিনি বাজাতে শুরু করতেন। কেউ না থাকলে একাই চোখ বুজে বাজিয়ে যেতেন। দরবারের উস্তাদ, গ্রামের পথে
দেখলেন দেহাতি কেউ সুর করে তু লসিদাসের রামচরিত মানস গাইছে, তিনি সারেঙ্গি নিয়ে পাশে বসে পড়তেন।
আবার লালকেল্লার সামনে প্যারেড গ্রাউন্ডে রামলীলাতেও বাজাচ্ছেন।

3
তো এমনই এক রবিবারের দিন। শিলা ধরদের বাড়ি এসেছেন উস্তাদ বুন্দু খান। বারান্দা পর্যন্ত তাঁকে আসতে দেখা
গেছে। ব্যারিস্টার সাহেব এগিয়ে গেছেন তাঁকে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে আসতে। কয়েক মুহুর্তে র ব্যাপার। কিন্তু
উস্তাদজিকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। খোঁজ খোঁজ, কিন্তু উস্তাদ উধাও। বাড়িতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। এ
কী ভু তু রে ব্যাপার। আধ ঘন্টা পরে কোথা থেকে যেন মৃদু সারেঙ্গির আওয়াজ ভেসে আসতে শোনা গেল। মনে
হলো বাগান থেকে যেন। শব্দ ধরে এগিয়ে দেখা গেল বিশাল বাগানের এক কোনে এক ফু লের ঘন ঝাড়ের নিচে
আধ শোয়া হয়ে তিনি সারেঙ্গি বাজাচ্ছেন। চোখ তাঁর বোজা। পুরোপুরি মগ্ন হয়ে বাজাচ্ছেন। ডেকে তোলার
বেআদবি তো করা যায় না। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর বাজানো শেষ করে তিনি চোখ মেললেন। ব্যাপার কী?
না, কয়েকদিন আগে এই ঝাড়ে ফু ল ফু টেছে কম, গাছটাও কেমন যেন বিবর্ণ। উস্তাদের মনে হয়েছে বসন্ত
কালেও গাছটা কোন কারণে মন খারাপ করে আছে। তাই তার মন ভালো করানোর জন্য তিনি ওকে সারেঙ্গি
বাজিয়ে রাগ বাহার শোনাচ্ছিলেন।
বুন্দু খাঁ সাহেব নিজে অজাতশত্রু মানুষ ছিলেন। সহজে রাগতেন না। তবে রাগলে সহজে ঠান্ডাও হতেন না।
তবে তাঁরও এক অপছন্দের মানুষ ছিলেন। সেতার বাজিয়ে। নাম উমরাও খান। দুইজন দুই ঘরাণার বাজিয়ে।
কোন এক রাগে কোথায় কোন স্বর লাগবে তাই নিয়ে দুজনের মতের অমিল। তাই থেকে অপছন্দ। বুন্দু খাঁ
সাহেবের প্রথম ছেলে জন্মালো। নাম রাখলেন উমরাও খান। কারণ জানা গেলো পরে। যখনি অপছন্দের
বাজিয়ে উমরাও খানের সঙ্গে কোন বিষয়ে ঝামেলা বাঁধতো, ঘরে ফিরে ছেলে উমরাও খানকে খুব বকাঝকা
করতেন। ঈতে তাঁর মেজাজ ঠান্ডা হতো।
একবার এলাহাবাদ থেকে আমন্ত্রণ এলো। যাওয়া আসা থাকা খাওয়া বাদে সম্মানি দেওয়া হবে হাজার টাকা।
ভদ্রস্থ ভাষায় তিনি আয়োজকদের চিঠি লিখলেন যে তাঁকে পাঁচশ আর ছেলে উমরাও খাকে দুইশ টাকা সম্মানি
দেয়া নাআ হলে তিনি যেতে অপারগ। অনেক কষ্টে তাঁকে বোঝানো হলো যে তিনি যা চাইছেন আয়োজকরা
এমনিতেই তারচেয়ে বেশি টাকা দিচ্ছে। তবু তিনি বার বার আঙু লে গুনে বোঝার চেষ্টা করে শেষে হাল ছেড়ে
দিলেন।
জেড এ বুখারি ছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিও বোম্বের প্রধান। তিনি উস্তাদকে ডেকে এনেছেন। তখন রেকর্ড করা
অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা ছিলো না। শিল্পীরা মাসখানেক রেডিওর অতিথি হয়ে থেকে অনুশঠান করে যেতেন। বুন্দু খাঁও
এসেছেন। তাঁর সন্ধে বেলার আফিমের জোগার করতে গিয়ে বুখারি সাহেব পড়েছেন ঝামেলায়। আফিমের খরচ
তো আর রেডিওর ইংরেজ বড় কর্তাকে দেখানো যায় না। সে যাই হোক, একবার বুখারি সাহেবের বিশ্বস্ত কর্মচারি
রাতে ঘুমোনোর সময় উত্তেজিত হয়ে ছুটে এলো। দক্ষিণি মানুষ। ঘন ঘন ডানে বায়ে মাথা নাড়ছে। এর অর্থও
বোঝা যায় না। বুখারি প্রশ্ন করলেন—কী ব্যাপার? সেই ডানে বায়ে মাথা নাড়তে নাড়তে উত্তর এলো—উস্তাদ
বুন্দু খাঁ, ভেরি ব্যাড ম্যান…ভেরি ব্যাড ম্যান! কি ব্যাপার? উস্তাদ বুন্দু খানের ঘরে কোন মেয়ে এসে উঠেছে।
সে নিজের কানে তাদের কথা শুনে এসেছে। বুখারি সাহেবের হতভম্ব অবস্থা। বুড়ো বয়সে উস্তাদের এ কি
ভিমরতি। বিছানা থেকে উঠে উনি উস্তাদের ঘরের দরজায় কান লাগালেন। শুনলেন বুন্দু খাঁর গলা—‘আরে ,
ঘুমা তো, এ দিকে, আমার কাছে এসে ঘুমা। ঘুমা তো’! এর পর কিছুক্ষণ নীরবতা। তার পর আবার শোনা গেল
—আহ হা। আবার নিচের দিকে সরে যাস কেন? ওপরে, ওপরে, এ দিকে এসে ঘুমা’। বুখারি সাহেবের আর
এসব সহ্য হলো না। তিনি টান মেরে দরজা খুলে বাতি জ্বালিয়ে দেখেন উস্তাদ বুন্দু খাঁ গলায় জড়িয়ে ধরে তাঁর
সারেঙ্গিকে ঘুম পাড়াচ্ছেন।
আবার আসরে ফেরা যাক। উস্তাদ বুন্দু খাঁ তাঁর বাঁশের সারেঙ্গি তু লে নিলেন। টিউন মিলিয়ে নিয়ে বললেন,
‘আজকে আমিও আপনাদের এক আজব জিনিস বাজিয়ে শোনবো’। সবাই নড়েচড়ে বসলেন। ‘আপনারা তো
রাগ দিপকের নাম শুনেছেন। তবে কাউকে বোধহয় এই রাগ গাইতে বাজাতে শোনেননি। আজ আপনাদের
দীপক রাগ বাজিয়ে শোনাবো। আসরে উস্তাদের মামাতো ভাই আরেক বড় বাজিয়ে উস্তাদ চান্দ খাঁ সাহেবও
ছিলেন। তিনি শুনে চমকে উঠে বললেন, ‘ভাই সাহেব, দীপক বাজাবেন না’। বুন্দু খাঁ সাহেব হেসে বললেন,
‘চান্দ খাঁ, ভয় পেও না। দিপকে আগুন লাগবে না’। চান্দ খাঁ বললেন, ‘ভাই সাহেব, এই তো শুনে এসেছি যে
দীপক রাগে নেভা প্রদীপ জ্বলে ওঠে, আগুন ধরে যায়। আগুন লাগা তো ভালো কোন কথা না। এজন্যই তো
এই রাগ কেউ গায় না বাজায় না। এই প্রথা যদি নাও মানেন, এ তো মানতে হবে এই রাগ অপ্রচলিত। বড় বড়
ওস্তাদরা যে একে এড়িয়ে যান এর কোন কারণ তো থাকবে’। বুন্দু খাঁ সাহেব বললেন , ‘চান্দ খাঁ, তু মি পন্ডিত
মানুষ। বইপত্র পড়ে পড়ে আজব সব কথা বলো’। দুই বড় ওস্তাদের মধ্যে তর্কে র অবতারণা দেখে আসরের
সবাই আগ্রহী লুকিয়ে রাখতে পারল না। বুন্দু খাঁ সাহেব বলে চললেন, ‘শোন, দীপক হচ্ছে সন্ধ্যার রাগ। সন্ধ্যা

4
বেলা প্রদীপ জ্বালানোর সময় গাওয়া হয়। এর জন্য এর নাম দীপক। প্রদিপ জ্বললে এই রাগ গাওয়া হয়। গাইলে
প্রদীপ জ্বলে না’।
সবাই এই কথা মেনে নিলেন। কিন্তু উস্তাদ চান্দ খাঁ তাঁর মতে অটল রইলেন। বুন্দু খাঁ বললেন , ‘আচ্ছা ঠিক
আছে। এইবারের মতো শোনো। কথা দিলাম। আর বাজাব না’। বুন্দু খাঁ বাজানো শুরু করলেন। শুনে সাধাসিধে
রাগ বলেই মনে হলো। তবে আসরের সবাই কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। বোধহয় এতক্ষণের
আলোচনার ফল মনের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
বাজনা শেষ হওয়ার একটু পরেই ভোরের আজান শুরু হলো। আজান শেষ হতে শেষবারের মতো চা এলো।
সবার মুখে আসরের প্রশংসা। উপস্থিত কেউ এমন আসর কখনো দেখেনি। ছয়টায় কারফিউ শেষ হলো। যে
যার ঘরে ফিরে গেলেন।
এর পরের গল্প সবার জানা। ১৯৪৭ এর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দিল্লি উজাড় হলো। দিকে দিকে দাঙ্গা , আগুন,
নিহত মানুষের রক্তের স্রোত। ক্যারল বাগ, সবজি মন্ডি, পাহাড়গঞ্জ…সব উজাড়। আধা দিল্লি শহর জ্বলে ছাই
হলো। শহরের কয়েক লাখ মুসলমান লাল কেল্লা আর বাদশাহ হুমায়ুনের সমাধিতে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। পুরনো
দিল্লিতে ভৈরবের নাচ! এই সমাধিতেই ১৮৫৭এর যুদ্ধে হেরে শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর আশ্রয়
নিয়েছিলেন।
৪৭এর দেশভাগ উস্তাদ বুন্দু খানকে স্তম্ভিত করেছিল। কী হলো কেন হলো তিনি কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না।
তখন তাঁর বয়স ষাটের মতো। যৌথ পরিবারের প্রায় সবাই পাকিস্তান চলে গেছে। চলে গেছে তাঁর স্ত্রী , পুত্র,
ভাই। তিনি যেন নিশ্চল হয়ে গেলেন। কোথাও গেলেন না। নিজেদের বাড়ির শুন্য চাতালে শুয়ে থাকেন। তিন
বছর এমনিই রইলেন। মাঝে মাঝে ব্যারিস্টার সাহেবের বাড়ি যান। চোখ বুজে বসে থাকেন। অনুরোধ না করলে
সারেঙ্গি আর বাজান না। একদিন দেখা গেল তাঁর চোখে জল। জিজ্ঞাসা করায় বললেন, ‘আমি চেষ্টা করেছি
ব্যারিস্টার সাহেব। কিন্তু কঠিন, খুব কঠিন। আমার ছেলেরা চলে গেছে, স্ত্রী চলে গেছেন’।
শেষ পর্যন্ত তিন বছর পর একদিন উস্তাদ বুন্দু খাঁ সাহেব নিজের শেকড় উপড়ে চলে গেলেন। ব্যারিস্টার সাহেব
প্রাণান্ত চেষ্টা করলেন তাঁকে নিরাপদে পাকিস্তান পৌঁছে দেয়ার। উস্তাদের প্রিয় রেডিও, বিশাল সারেঙ্গির সংগ্রহ।
সব পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা গেল।
পাকিস্তানে বুন্দু খাঁ সাহেব সুবিধে করতে পারলেন না। জীবনের শেষ দিন তাঁর খুবই আর্থিক কষ্টে কেটেছিল। স্ত্রী
সন্তান নিয়ে তিনি আবার ভারতে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। চেষ্টাও করেছিলেন। অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে
সুপারিশ করা হলো। কিন্তু পাকিস্তানের একজন নাগরিককে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ব্যারিস্টার
সাহেব একটা চিঠি পেয়েছিলেন বুন্দু খাঁ সাহেবের কাছ থেকে। পরিস্কার উর্দু লেখা। বোধহয় কাউকে দিয়ে
লিখিয়েছেন। তলায় উস্তাদের কাঁপা হাতের স্বাক্ষর। চিঠিতে দুটো মাত্র লাইন। প্রথম লাইনে ব্যারিস্টার সাহেবকে
ধন্যবাদ। দ্বিতীয় লাইন দীর্ঘ। সেখানে রাগ মালকোষের বিশটি তান। ব্যারিস্টার সাহেব তাঁকে যে সহযোগিতা
করেছেন তার প্রতিদান। উস্তাদ তাঁর সবচেয়ে দামি জিনিস উপহার দিয়েছেন।
বছর কয়েক পর শাহিদ আহমদ দেহলভি একবার দিল্লিতে এসেছিলেন। নিজের পুরোনো শহর পুরোনো মানুষ
কাউকে খুঁজে পাবেন না জেনেও সারা দিল্লি ঘুরে বেড়ালেন। মনে পড়লো উস্তাদ চান্দ খাঁয়ের কথা। তিনি দিল্লিতে
থেকে গিয়েছিলেন। দেখা করলেন বয়স্ক চান্দ খাঁয়ের সঙ্গে। মুখে হাসি আর চোখে জল নিয়ে তাঁকে জড়িয়ে
ধরলেন। অনেক কথা অনেক পুরনো গল্প। বিদায়ের সময় চান্দ খাঁ বললেন, ‘দেখলেন তো রাগ দিপকের বিপদ?
কত বারণ করলাম সেদিন ভাই সাহেবকে। তিনি শুনলেন না। বাজালেন রাগ দীপক। দিল্লি পুড়ে ছাই হলো। সেই
একই দিল্লিতে রয়ে গেলাম বিচ্ছেদের আগুন বুকে নিয়ে। এই আগুন তো চোখের জলেও নেভে না’।

হৃদয়-বাসনা থেকে জ্বলে উঠলো হৃদয়ের যত ক্ষত


ঘরের প্রদীপ থেকেই আগুন লাগলো ঘরে

দিল কে ফফোলে জ্বল উঠে সিনে কে দাগ সে


ইস ঘর কো আগ লাগ গ্যায়ি ঘর কে চারাগ সে

You might also like