Professional Documents
Culture Documents
Test 12
Test 12
পপসায় চলে
সেরেছে। অত্যন্ত সভগফদ ূূ টএম শ হতে বেজে গেলো চারটা। সুশান্ত বললেন, “এখন গফ খুলেগগ
দিলো পারু। হালকা গোলাপী শাড়ী পরেছে সে। লম্বা চু ল পিঠময় ছড়ানো। ফিরতে
দহপরর টিপলে দরজা পিঠময় ফিরতছদয়টা বেজে যাবে। জেআমি বরং সায় চলে যাই। আপনার বাসাও তো
কাছে।ন ব্যাংর এজিএম”
এই সময়টাতে ইলা ঘুমায়। ইশতিয়াক বাসায় ঢু কে জুতো খুলে সুকেসে রাখলো। হাতের
ব্যাগটা ডাইনিং টেবিলে রেখে বেডরুমে চলে আসলো। ইলা সেখানে নেই। এটাচড
বাথরুমের সুইচটা অন কিনা দেখলো। সুইচ অফ। মানে ইলা সেখানেও নেই। পারু
রান্নাঘরে কিছু একটা করছিল। সে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে বললো, “তোমার আপা
কী বাইরে গেছে?”
পারু কোন কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো।
ইশতিয়াক বললো, “কোথায় গেছে জানো?”
ইশতিয়াক নিজের ঘরে এসে জামা-কাপড় পাল্টালো। গরমকালে সে বাসায় লুঙ্গি পরে
খালি গায়ে থাকে। অভ্যাসবসে শার্ট , গেঞ্জী খুলে লুঙ্গি পরলো। তার খালি গায়ে থাকতে
কেমন লজ্জা লাগতে লাগলো। বাসায় পারু আছে। সে একটা হাতাকাটা গেঞ্জী পরলো।
তাতেও তার লজ্জা ভাবটা গেল না। শেষে একটা টি-শার্ট গায়ে দিয়ে বেডরুম থেকে
বের হলো।
কিন্তু ইশতিয়াক চা চাইলো না। মেয়েটা তাকে এড়িয়ে চলছে। তার সাথে কথা বলা
তো দূরে থাক, তার দিকে তাকাচ্ছেও না। পারুর কাছ থেকে তার অনেক কিছু
জানার ছিল। পুরো ব্যাপারটা রহস্যে ঘেরা। ঘটনাক্রমে ইছেখাদা গ্রামে দেখা একটা
তরুণী, যে তার জীবন বাচিয়েছিল, সে কেমনভাবে তার বাড়ীতে আত্মীয় পরিচয়ে
হাজির হলো? বাসায় শুধু পারু আর সে। এখন তার কাছ থেকে সবকিছু জানা যেতে
পারে। সে রান্নাঘরের দরজার সামনে গিয়ে আবার দাড়ালো। পারু দরজার দিকে
পিছন ফিরে উবু হয়ে বসে বটিতে তরকারী কুটছে। তার পদশব্দ শুনতে পেলো কিনা
বোঝা গেল না।
ইশতিয়াক কিভাবে কথা শুরু করবে ভাবছে। তখন সামনের ফ্লাটের রান্নাঘরের
জানালায় তার চোখ গেল। জিয়া ভাবী রান্না করছেন। দুই ফ্লাটের রান্নাঘর দুটোর
জানালা একদম সামনা-সামনি। মাঝখানে দশফিট মত দূরত্ব। সামনা-সামনি দুই
ফ্লাটের মহিলারা রান্না করতে করতে গল্প করে। আলো জ্বালানো থাকলে এক রান্নাঘর
থেকে আরেকটার ভিতর ভালোভাবে দেখা যায়। জিয়া ভাবী তাকে আর পারুকে
একসাথে রান্নাঘরে দেখলে কিছু একটা মনে করতে পারেন। সে দ্রুত সরে আসলো।
তারপর নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে আবার অফিসের জামা-কাপড় পরে নিলো এবং
পারুকে দরজা বন্ধ করে দিতে বলে বেরিয়ে গেল।
ইশতিয়াক লিফটের বাটন টিপে অপেক্ষা করছিল। তখন কী একটা মনে করে সে
ডোরবেল বাজালো। পারু খুলে দিলে বললো, “আমি যে এসেছিলাম, তা তোমার
আপাকে বলো না।”
সে বাসায় ফেরে রাত আটটার দিকে। অফিস থেকে বের হতে হতে সাতটা বাজে।
তারপর মতিঝিল থেকে মোহাম্মদপুর আসতে কমসে কম ঘন্টা খানেক লেগে যায়। এখন
বাজে সাড়ে চারটা। আরো সাড়ে তিন ঘন্টা তাকে অন্য কোথাও কাটাতে হবে।
সে বাসা থেকে বের হতে হতে চিন্তা করছিল কোথায় যাওয়া যায় এই সাড়ে তিন
ঘন্টা কাটানোর জন্য। টাউন হল কাঁচাবাজারে যাওয়া যায়। কিন্তু বৈশাখের বিকেলে
ভাঁপ ওঠা গরমের মধ্যে ফু লহাতা শার্ট গায়ে বাজার করা খুব কষ্টকর। তাছাড়া রাত
আটটায় সবজি নিয়ে হাজির হলে ইলার মনে নানা প্রশ্ন জাগবে। কোন একটা শপিং
মলে যাওয়া যায়। যেতে আসতে এক ঘন্টা আর দোকানে দোকানে ঘুরে দুই ঘন্টা
কাটানো যাবে। ভাবতে ভাবতে সে বাসার গেটে চলে আসলো। একটা রিক্সা যাচ্ছিল।
সে তাতে উঠে বসলো। তৎক্ষণাৎ ঠিক করলো সংসদ ভবনের পিছনের ক্রিসেন্ট
লেকটাতে যাবে। আওরঙ্গজেব রোডের মাথায় এসে রিক্সা থামলো সিগন্যালে। সামনে
মিরপুর রোড। তার ওপারে একপাশে গণভবন, অপর পাশে সংসদ ভবন। সে
সিগন্যালে বসে আশে পাশে তাকাচ্ছিল। তখন চোখে পড়লো পাশেই একটা বড়
ফার্নিচারের শোরুম। সে ভাড়া মিটিয়ে রিক্সা থেকে নেমে গেল। ফার্নিচারের
শোরুমটাতে ঢু কলো। বেশ কিছুদিন ধরে ইলা সোফা সেট পাল্টানোর কথা বলছে।
কয়েকটা সোফা দেখলো। ইলা কারুকাজ পছন্দ করে। কিন্তু এদের সব কিছুই প্লেইন
ডিজাইন। দামও খুব বেশী।
দোকানের সবগুলো ডিজাইনের সোফা দেখে তাদের কাঠের ব্যাপারে খোজ খবর নিয়েও
সে আধা ঘন্টার বেশী কাটাতে পারলো না। শেষে তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো।
সে ইলাকে ফোন করলো। বললো, “আমাকে গাড়ী পাঠাতে হবে না।”
তার বিষয়ে স্ত্রীর আগ্রহের অভাব দেখে তার খুব রাগ হলো। তবে রাগের আসল
কারণ ইলার অনাগ্রহের জন্য তার প্লান ভেস্তে যেতে বসেছে। সে আশা করেছিল ইলা
জানতে চাইবে কেন গাড়ী পাঠাতে হবে না। তখন সে জানাবে যে সে কাছেই আছে।
এজিএম থেকে সরাসরি বাসায় ফিরছে। কিন্তু ইলা সেদিকে গেলই না।
স্ত্রীর অনাগ্রহ হজম করে সে বললো, “তু মি কী বাইরে, অনেক শব্দ শোনা যাচ্ছে।”
ইশতিয়াক রাপা প্লাজায় গিয়ে স্ত্রী-কন্যার সাথে কেনাকাটা করে বাসায় ফিরলো।
১৫.
পারুর গুনপনায় ইলা মুগ্ধ। প্রতিদিন সে বোনের নতু ন নতু ন প্রতিভা আবিষ্কার করে
আর ইশতিয়াক বাসায় গেলে তাকে সবিস্তারে জানায়। রান্নায় সে অসম্ভব পটু । মোচা
ঘন্ট থেকে শুরু করে সরসে ইলিশ পর্যন্ত সে রাধতে পারে। তার প্রমাণ অবশ্য
ইশতিয়াক পাচ্ছে। প্রতিদিনই নতু ন নতু ন খাবার দেখা যাচ্ছে টেবিলে। সকালে পাতলা
রুটির সাথে গরুর ভু না মাংশ, সুজির হালোয়া, আলু ভাজি – ইত্যাদি জুটছে। দুপুরে
হটপটে করে খাবার দেয়া হচ্ছে। চিকন চালের মাড় ঝরানো ঝরঝরে ভাত। সাথে
দুটো তরকারী। সন্ধ্যায় ভাজা-ভু জি নাস্তা – কখনো ছোলা ভু না, কখনো চটপটি,
একদিন স্যুপও হয়েছে। রাতের মেনুও পাল্টে গেছে। ভর্তা, ভাজি, সবজি, মাছ, মুরগী
– হরেক পদের খাবারে রাতের ডাইনিং টেবিল সাজানো থাকে। আগে বাজারের
ব্যাপারে অনেক বাধা-নিষেধ ছিল ইলার। ঝামেলার তরকারী আনা যাবে না। ছোট
মাছ কেনা যাবে না। গরুর মাংশ কিনলে ছোট ছোট টু করে করে কেটে আনতে হবে।
মোদ্দা কথা এমন বাজার আনতে হবে যা পানিতে চু বিয়েই চু লোয় বসিয়ে দেয়া যায়।
সে নিষেধাজ্ঞা এখন উঠে গেছে। শাক-পাতা, কচু -ঘেচু যা পায়, তাই ইশতিয়াক
কিনে আনে আর পারু নিপুন হাতে সেগুলোকে পরিণত করে লোভনীয় ব্যঞ্জনে।
সুযোগ পেয়ে দূর সম্পর্কে র বোনটির হাতে সংসারের পুরো দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ইলা
নিশ্চিন্ত মনে খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে আর টিভি দেখছে। মাত্র সপ্তাহখানেক সময়ের মধ্যে পারু
এই পরিবারের সাথে এমনভাবে মিলে গেছে যে মনে হবে এখানেই তার জন্ম। সে শুদ্ধ
বাংলায় কথা বলে। মাঝে মাঝে যশুরে টান যে একটু ধরা পড়ে না, তা নয়। কিন্তু,
সেই টানটা সবার কাছে মিষ্টিই লাগে। গ্রামের মেয়েদের মত প্রগলভা সে নয়। যথেষ্ট
ব্যক্তিত্বসম্পন্না। কথা বলে গুছিয়ে সুন্দর করে। ইলা তো পারু বলতে পাগল, ইলোরাও
তাকে নিয়েছে বন্ধু হিসাবে। শুধু ইশতিয়াকের থেকে সে দূরে দূরে থাকছে। ইশতিয়াক
যেখানে থাকে, সেখানে সে আসে না। সামনা-সামনি পড়ে গেলে অন্যদিকে চোখ
ফিরিয়ে নেয়।
পারুর ব্যবহারের কোন মানে খুজে পাচ্ছে না ইশতিয়াক। ইছেখাদা গ্রামে পারুদের
বাড়ীতে সে যতবার গেছে, ততোবার পারু তার সাথে মিশেছে সহজভাবে। তাকে
পানি থেকে তু লে বাঁচিয়ে আনার পর পারুর চোখে যে আকুলতা ছিল, তার সে অন্য
মানেও করে ফেলছিল। অথচ, এখন মনে হচ্ছে পারু তাকে চেনেই না। এমনকি যারা
পারুর সত্যিকারের অচেনা, ইলা আর ইলোরা, তাদের সাথেও তো পুরোপুরি মিশে
গেছে। শুধু ইশতিয়াকে সাথেই তার যত সমস্যা।
পারু তাকে এড়িয়ে চলার কারণে বয়াতীর বিষয়েও কিছু জানা যাচ্ছে না। সে এসেছে
সপ্তাহখানেক হলো। কিন্তু এই এক সপ্তাহে পারু রহস্যের কোন কূল কিনারা করতে
পারেনি ইশতিয়াক। প্রচন্ড অস্থিরতায় ভু গছে সে। তার যেমন রাগ হচ্ছে পারুর
উপর, তেমনি উদ্বিগ্ন হচ্ছে বয়াতীকে নিয়ে। বিষয়টি নিয়ে কারো সাথে আলোচনাও
করতে পারছে না। এমনকি নাসিরের সাথে কথা বলবে – সে সুযোগও মিলছে না।
বাসায় থাকাকালীন এ নিয়ে আলাপ করা ঝু কিপূর্ণ। অফিসে যাতায়াতের পথে ফোন
করলে ড্রাইভার সবকিছু জেনে যেতে পারে। সে লক্ষ্য করেছে ড্রাইভার গাড়ী চালানোর
সময় কান তার দিকে খাড়া করে রাখে, তার দৃষ্টিকেও অনুসরণ করে।
বিষয়টির কোন কূল কিনারা করতে না পেরে সে নাসিরকেই ফোন করলো রাতে,
ছাদে হাটতে যাবার নাম করে। নাসির কিছুই জানে না। মাস খানেক আগে
ইশতিয়াকের কথামত সে ইছেখাদী গিয়েছিল। ফিরোজ বয়াতীর জমি তার মেয়ের
নামে লিখে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল। তারপর আর সেখানে যায়নি। যতশীঘ্র সেখানে
গিয়ে বিস্তারিত খবর নিয়ে আসতে ইশতিয়াক বন্ধু কে অনুরোধ করলো। কিন্তু নাসির
বললো সে বউ-বাচ্চা নিয়ে শ্বশুরবাড়ী রয়েছে। দিন দশেকের আগে ফিরবে না।
এখন বয়াতীর খবর নেয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে পারু। ইশতিয়াক সুযোগ খুজতে
থাকলো, কখন পারুকে একা পাওয়া যায়। অফিস থেকে আগে-ভাগে বাসায় ফেরা
যায়। কিন্তু তা হবে বিপদজনক। ফ্লাট বাড়ি। গেটে দারোয়ান থাকে। সে কখনো
ইলাকে জানিয়ে দিতে পারে। সামনের ফ্লাটের ভাবী সব সময় একটা চোখ এদিকে
নিয়োজিত রাখেন। তিনিও ব্যাপারটি পেঁচিয়ে ফেলতে পারেন। পারুকে একা পাবার
একমাত্র নিরাপদ সময় হচ্ছে সকাল। পারু আসার পর থেকে অন্য অনেক কাজের মত
সকালে মেয়েকে ঘুম থেকে তোলা, খাইয়ে স্কু লে পাঠানো ইত্যাদি দায়িত্ব ইলা পারুকেই
দিয়েছে। ইশতিয়াকের খাবারও পারু তৈরী করে। ইলার ঘুম ভাঙে নয়টার দিকে,
ইশতিয়াক অফিসের জন্য বের হবার সময়। ফলে সকালটাই পারুর মুখোমুখি হবার
মোক্ষম সময়।
পরদিন ভোর সাতটায় উঠলো ইশতিয়াক। ইলোরাকে লিফটে দিয়ে পারু ফ্লাটের দরজা
বন্ধ করছিল। ইশতিয়াক তখন তাকে ড্রয়িং রুমে ডেকে নিয়ে গেল। চাপা স্বরে
বললো, “পারু, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমাদের কী ঘটেছে? বয়াতী
কোথায়? তু মি আমার শ্বশুরবাড়ী গেলে কী করে?”
পারু অন্য দিকে চেয়ে বললো, “আপনার জন্যই তো আমার আব্বা মারা গেলেন।”
ইশতিয়াক যেন খুব বড় একটা ধাক্কা খেলো। বললো, “বয়াতী মারা গেছে?
কিভাবে?”
পারু কান্না আটকে রাখতে পারলো না। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ভেজা গলায় জানালো,
ইশতিয়াকের পরামর্শমত নাসিরের সাথে শহরে গিয়ে বয়াতী তার সব সম্পত্তি মেয়ের
নামে লিখে দেয়। ব্যাপারটা কিভাবে যেন পারুর চাচারা জেনে যায়। তারা ফিরোজ
বয়াতীকে জমির ধান দেয়ার নাম করে ডেকে নিয়ে যায়। তাদের বাসাতেই বয়াতী
দুপুরের খাবার খায়। সন্ধ্যায় নিজ বাড়ীতে ফিরে তার শুরু হয় বমি। রাত শেষ
হতে না হতেই মারা যায় সে।
পারু আচলে মুখ ঢেকে নি:শ্বব্দে কাঁদছে। কষ্ঠে ইশতিয়াকে বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। সাব-
রেজিস্টারের অফিসে গিয়ে মেয়েকে জমি লিখে দেয়ার ঘটনা গ্রামে গোপন থাকার কথা
নয়। সে খবর জানলে পারুর নিকটাত্মীয়রা ক্ষেপে যেতেই পারে। ছেলে না থাকায়
বয়াতীর জমির বড় অংশ তার মৃত্যুর পর শরীকেরাই পেত। বিষয়টা ইশতিয়াকের
মাথায় রাখা উচিৎ ছিল। সে ভেজা গলায় বললো, “দোষ আমারই। শরীকেরা বার
বার তোমায় আব্বাকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করেছে। এতোবড় ঘটনার পর আবারো
চেষ্টা করতে পারে – এই চিন্তা আমার মাথায় আসেনি কেন!”
ইশতিয়াকের আরো দু:খ লাগলো এ কথা মনে করে যে, ফিরোজ বয়াতীর সাথে
তাদের আত্মীয়তার বিষয়টি আগে জানা গেলে পুরো ঘটনাটাই অন্য রকম ঘটতো।
পারু আর তার বাবাকে সে নিজের বাড়ীতে এনে তাদের সম্পত্তির বন্দোবস্ত করতে
পারতো।
পারু নিজেকে সামলে নিয়েছে। মুখ থেকে আচল সরিয়ে নতমুখে দাড়িয়ে রয়েছে।
ইশতিয়াক কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখন ইন্টারকম বাজলো। ইশতিয়াক দ্রুত গিয়ে
ধরলো। গেট থেকে ফোন করেছে। ইলোরাকে স্কু লে দিয়ে গাড়ী ফিরে এসেছে।
১৬.
পারুর সাথে কথা হবার পর ইশতিয়াকের মনের মেঘ কেটে গেল। পারুও তার
খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসলো। গোসল করতে বাথরুমে ঢু কবে সে। লুঙ্গি-গামছা নিয়ে
পারু দাড়িয়ে। সকালের নাস্তা খাবে। পারু গ্লাসে পানি ঢেলে দিল, প্লেটে রুটি দিল,
ডিম ভাজির পিরিচটা এগিয়ে দিল। অফিসে যাবার সময় খাবার ভর্তি হটপট হাতে
দিল। যতক্ষণ সে বাসায় ছিল, পারু ছায়ার মত তার পাশে পাশে থাকলো। অফিস
থেকে ফিরলে সেই দরজা খুলে দিল। চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে হাতের ব্যাগ আর
হটপটটা নিল। হাত-মুখ ধুয়ে সে ইলার সাথে টিভির সামনে বসলে পারু দুজনের
জন্য চা-নাস্তা নিয়ে এলো।
ইশতিয়াক আড়চোখে একবার পারুকে দেখলো। তার চেহারার মলিন ভাবটা কেটে
গেছে। চোখ ঝলমল করছে। মুখমন্ডল থেকে যেন আলো ছিটকে পড়ছে। খাওয়া শেষে
পাত্রগুলো সে যখন নিয়ে গেল, তখন ইশতিয়াকের মনে হলো পারু যেন পাখির মত
নেচে নেচে চলছে।
সারাটা দিন পাখির মত ইশতিয়াকও নেচেছে। অফিসে গিয়ে গুনগুন করে গান
গেয়েছে আর কাজ করেছে। অকারণে সহকর্মীদের সাথে গল্পও জুড়েছে।
ইলা রাতে ঘুমাতে যায় দেরী করে। এখন তার কাজ নেই। সব পারু সামলায়। কিন্তু
অভ্যাসটা রয়ে গেছে। ইশতিয়াক আগে আগে শুয়ে পড়ে। আজ সে আরো আগে
ঘুমাতে গেল। সকালে উঠে পারুর সাথে তার অনেক কথা আছে।
তার ঘুম ভাঙলো সকাল সাড়ে ছয়টায়। এতোক্ষণে পারু উঠে গেছে। কিন্তু এখন
তাকে একলা পাওয়া যাবে না। অপেক্ষা করতে হবে ঘন্টাখানিক। সে আবার ঘুমানোর
চেষ্টা করলো, কিন্তু ঘুম আসলো না। কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে পড়লো। পারু
রান্নাঘরে। ইলোরা দাঁত ব্রাশ করছে। সে ড্রয়িং রুমে গেল। এই ঘরটার সাথে পূব
দিকে বড় একটা ব্যালকনী আছে। সে ব্যালকনীতে গিয়ে দাড়ালো। গ্রীষ্মের সূর্য্য এর
মধ্যেই জোরালো হয়ে উঠেছে। ব্যালকনীতে অনেকগুলো টব বসানো। টবে কামিনী,
গন্ধরাজ, বেলী, গোলাপ ইত্যাদি লাগানো। একটা টবে মরিচ গাছ লাগনো হয়েছে।
এক ফু টেরও কম উচু ঝাকড়া মরিচ গাছে অসংখ্য সাদা ফু ল ফু টে রয়েছে। কয়েকটা
ফু ল থেকে সবুজ মরিচের আভাস দেখা যাচ্ছে। উচ্ছের চারা লাগানো হয়েছে একটা
টবে। ছোট লতাটা সুড় উচু করে ধরেছে সূর্য্যের দিকে। এক কোনায় একটা টবে
কলাবতীর চারাও লাগানো হয়েছে। সকালের রোদে গাছগুলো ঝকমক করছে।
ব্যালকনীটা কয়েকদিন আগেও স্টোর রুমের মত ছিল। পারু এসে সব পাল্টে দিয়েছে।
কলিং বেল বাজলো। ড্রাইভার এসেছে নিশ্চয়। দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল।
ইলোরার গলা শোনা যাচ্ছে। আদুরে গলায় সে পারুকে কী একটা বলছে।
ইশতিয়াক দ্রুত এসে পারুকে ড্রয়িং রুমে ডেকে নিয়ে গেল। বললো, “তোমার সাথে
কথা আছে?”
পারু চোখ বড় করে বললো, “কী এমন কথা যে বলার জন্য রাতে ঘুম হয়নি?”
পারু রহস্য করে বললো, “উনি পাননি, আমি নিজেই তার কাছে গেছি।”
পারু বললো, “আব্বাকে দাফন-কাফন করে সবাই চলে গেল। বিরান মাঠের মধ্যে
আড়া-বেড়াহীন বাড়ীতে আমি একা একটা মেয়ে। গ্রামের একজন বয়স্ক মহিলা আমার
সাথে রাতে থাকবেন বলেছিলেন। তাকেও দেখলাম না। সন্ধ্যা নামতেই আমার ভয়-ভয়
করতে লাগলো। ভু ত-প্রেতের ভয় নয়। মাঠের মধ্যে একা বাড়িতে একটা মেয়ের যে
ভয় হয় সেই ভয়। কী করবো ভাবছি, তখন উঠোনে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।
আমি হাতে বটি নিয়ে বেরিয়ে এলাম।”
“যাকে দেখলাম, তাকে আমি চিনি। ভয় পাবো না ভরসা করবো বুঝতে পারছিলাম
না। সে বললো, এই গ্রামে থাকা তোমার জন্য নিরাপদ না। রাতেই কোন আত্মীয় বাড়ী
চলে যাও।”
পারু রহস্যের সমাধান হলো। ইশতিয়াকের ইচ্ছা করছে আরো কিছুক্ষণ পারুর সাথে
কথা বলতে। সে বললো, “তোমাকে যে নদী পার করে নানাবাড়ী দিয়ে আসলো, সে
লোকটা কে?”
পারু হেসে বললো, “আমার বন্ধু ।”
পারু রহস্য করে বললো, “আমার ব্যাপারে কতটু কুই বা শুনেছেন আপনি!”
ইন্টারকমের শব্দে তাদের খেজুরে আলাপ সেদিনের মত শেষ হলো বটে, কিন্তু
প্রতিদিনই চলতে থাকলো। পারুর সাথে একান্তে কথা বলার প্রতীক্ষায় ইশতিয়াকের ঘুম
ভেঙ্গে যায় খুব ভোরে। সে অপেক্ষা করতে থাকে ইলোরার স্কু লে যাবার জন্য, তারপর
ড্রয়িং রুমে গিয়ে গল্প জুড়ে দেয়।
এভাবে কয়েকদিন চলার পর পারু একদিন বললো, “আপনার মতলবটা কী? প্রতিদিন
একটা না একটা ছুতো খুজে এই সময় আমার সাথে গল্প করেন?”
ইশতিয়াক সুবোধ বালকের বেডরুমে গেল প্যান্ট আর টিশার্ট পরতে। ইলা গভীর ঘুমে
মগ্ন। সতের বছর ঘর করছে একসাথে। অথচ, ইলা কী লক্ষ্য করেছে কখনো যে তার
ভু ড়ি বেড়ে যাচ্ছে কিনা! পারু এসেছে সতের দিনও হয়নি। এসেছে বড় একটা আঘাত
খেয়ে। তারপরও তার চোখ এড়াইনি বিষয়টা। শুধু খেয়াল করেই সে ক্ষান্ত থাকেনি,
বহু বছর ব্যবহার না করা কেডস খুঁজে বের করেছে, পরিস্কার করে অবশেষে তাকে
পাঠিয়ে দিচ্ছে মর্নিং ওয়াকে। পারুর প্রতি বুকভর্তি কৃ তজ্ঞতা নিয়ে সে হাটতে বেরিয়ে
গেলো।
১৭.
সেদিন সন্ধ্যায় পারুর আরেকটি বিরাট প্রতিভার সন্ধান দিল ইলা। পারু গান জানে।
হারমোনিয়াম বাজাতে পারে। ইলা এখন মেয়েকে গান শেখাতে চায়। পারু হবে তার
শিক্ষক। পরদিন ছিল শুক্রবার। চারজন মিলে গিয়ে এলিফ্যান্ট রোড থেকে
হারমোনিয়াম কিনে আনলো।
বাসায় এসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে পারু তাদের গান শোনালো। তার গলা মিষ্টি ও
ভরাট। গানগুলো সবই তার বাবার লেখা। একই বাউল সুর। দেখা গেল পারু শুধু
তার বাবার গানগুলোই জানে।
ইশতিয়াককে আলাদা করে ডেকে নিয়ে ইলা বললো, সে ইলোরাকে বাউল গান শেখাতে
চায় না। সে চায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতে। সেমত ব্যবস্থাও করা হলো। একজন গানের
শিক্ষক ঠিক করা হলো দুজনের জন্য। সপ্তাহে দুইদিন এসে শিখিয়ে দিয়ে যাবে।
শনিবার সন্ধ্যায় গানের শিক্ষকের আসার কথা। ইশতিয়াক, ইলা ও ইলোরা টিভি
দেখছিল আর তার জন্য অপেক্ষা করছিল। আটটার দিকে গেট থেকে দারোয়ান ফোন
করে জানালো, গানের শিক্ষক এসেছে।
গানের শিক্ষক আসার খবর শুনে ইলোরার মনে পড়লো তার জামাটা পাল্টানো
দরকার। সে নিজের ঘরে ছুটলো। পারু গেল রান্নাঘরে নাস্তার আয়োজন করতে।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। এপার্ট মেন্টে জেনারেটর আছে। তার এখনই বিদ্যুৎ চলে
আসবে।
দরজা ধাক্কানোর শব্দ হচ্ছে। ইশতিয়াক অন্ধকারের মধ্যেই উঠে গেল দরজা খুলতে।
হঠাৎ তার শরীরের সাথে ধাক্কা লাগলো একটি নারী দেহের। তার শরীরে যেন বিদ্যুৎ
প্রবাহিত হয়ে গেল। সে নিজেকে সামলে নিয়ে নিশ্চল নিশ্চু প হয়ে দাড়িয়ে গেলো।
তারপর মৃদুস্বরে বললো, “তু মি যাও, আমি খুলছি।”
মাঝ রাতে ইশতিয়াকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। অভ্যাসবসে সে বামপাশে ফিরে স্ত্রীর দিকে
হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু সাপের গায়ে হাত পড়ার মত অতি দ্রুত সে হাত টেনে
নিল। তার মনে হলো একটি নির্জীব, নিস্পৃহ, শিথিল, রাবারের পুতু লের পাশে সে
শুয়ে আছে। সন্ধ্যায় অন্ধকারে লাগা স্পর্শের কথা মনে পড়লো তার। মনে হলো, মাত্র
একটা দেয়াল ওপারেই তার জন্য অপেক্ষা করে আছে একটি উষ্ণ, সতেজ, উন্মুখ
অপরাজিতা লতা।
বাকী রাতটা ইশতিয়াক ঘুমাতে পারলো না। এপাশ-ওপাশ করতে থাকলো। তার
নড়াচড়ায় একবার ইলার ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিরক্ত হয়ে বললো, “এ্যই তু মি এতো
নড়া-চড়া করছো কেন?” তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
ইশতিয়াকের ইচ্ছা হলো পূব দিকের ব্যালকনীতে গিয়ে বসে। কিন্তু সম্ভব নয়। তার
কখনো ঘুমের সমস্যা হয়নি। আজ রাতে তাকে ব্যালকনীতে বসে থাকতে দেখলে ইলার
মনে নানা সন্দেহ দেখা দিতে পারে। ইশতিয়াক একশ থেকে এক পর্যন্ত গোনার চেষ্টা
করলো। এসি বাড়িয়ে দিলো। ভেড়ার পাল গুনলো। কিছুতে তার ঘুম আসলো না।