You are on page 1of 3

দ্রৌপদী সুকুমারী ভট্টাচার্য

বহুলপ্রচারিত একটি শ্লোকে শুনি, 'অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা, মন্দোদরী তথা। পঞ্চ কন্যা: স্মরেন্নিত্যং মহাপাতক
নাশনম।। শ্লোকটিতে সব কটি নারীকেই কন্যা বলা হয়েছে। যদিও কন্যা শব্দটি কুমারী সম্বন্ধে প্রয়োগ বেশি। ওই পাঁচজন
কেউই কুমারী নয়; কিন্তু প্রত্যেকেই দ্বিচারিণী; কেউ স্বেচ্ছায় কেউ বা ঊর্ধ্বতন কারো নির্দে শে। পঞ্চপাণ্ডব যখন দ্রুপদ
রাজার সভা থেকে দ্রৌপদীকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তখন, স্নানের ঘরে কুন্তী, ছেলেরা বললেন, দেখো মা কী এনেছি। কুন্তী
ভাবলেন মূল্যবান বা স্বাদু বস্তু এনেছেন বুঝি, ঘরের ভেতর থেকে নির্দে শ দিলেন ''যা এনেছ সকলে সমান ভাগে ভাগ করে
নাও।'' একসময় দ্রুপদ রাজা দ্রোণের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হলে 'যাজ' ও 'উপযাজ' নামে দুই পুরোহিতের শরণাগত হয়ে
রাজা বলেন আমাকে এমন পুত্র কন্যা দাও যারা দ্রোণের মৃত্যু ঘটাতে পারবে। দুই পুরোহিত যজ্ঞ করলে প্রথমে অস্ত্র-মণ্ডিত
সুসজ্জিত অত্যন্ত সুদর্শন এক পুরুষ যজ্ঞাগ্নি থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি ধৃষ্টদ্যুম্ন। পরে বেরিয়ে এলেন যিনি তিনি মনোরম
এক উজ্জ্বল কন্যা দ্রৌপদী। ধীরে ধীরে এই দুই তরুণ তরুণী দ্রুপদ রাজার কাছে বাড়তে লাগলেন। পুত্রটি বসুবিদ্যা ও
অন্যান্য অস্ত্র শিক্ষায় বিভূ ষিত শিক্ষিত হয়ে উঠলেন। রূপে গুণে বিভূ ষিত কন্যাটির বীর্যশুল্কা হবার জন্য দ্রুপদ এক
মহতী সভার আয়োজন করলেন। পাণ্ডবরা দ্রুপদ রাজ্যের কাছাকাছি ছিলেন, তাঁরা ওই সভায় যোগদান করার উদ্দেশ্যে
সেখানে গেলেন। অর্জু ন অপরাজেয় ধনুর্ধর, তাঁর জানাই আছে যে বীর্যশুক্লা দ্রৌপদী তাঁরই হবে। এদিকে অর্জু নকে দেখে
পর্যন্ত দ্রৌপদী উদভাসিত। বড়ো মোটা সাদা ফু লের একটি গোড়ে মালা দু-হাতে স্মিতহাস্যে ধরে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন
অর্জু নের দিকে। মুখে শুভ্র স্মিত হাস্য, চোখে বিজয়িনীর উজ্জ্বল দৃষ্টি। মাল্যদান করে দ্রৌপদী ও অর্জু ন ধীরে ধীরে
রাজসভা থেকে বেরিয়ে এলেন সঙ্গে এলেন আর চার ভাই। বাড়ি এসে মাকে এই মূল্যবান প্রাপ্তি নিবেদন করলেন; কুন্তী
স্নান করতে করতে বললেন, 'যা এনেছ পাঁচভাই সমান ভাগে ভাগ করে নাও'। বলা বাহুল্য, এখনও যদিও উত্তর-পূর্ব
ভারতে কোনো অঞ্চলে বাড়ির এক বা দুই পুত্রের একটিমাত্র স্ত্রী তখনও তাই ছিল। কিন্তু দ্রুপদ রাজের অমন অসামান্য
কন্যার পাঁচ স্বামী হবে একথা দ্রুপদরাজ মানতে পারেননি, এজন্য যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ বাক বিতণ্ডা চলে; অবশেষে
ব্যাস কুন্তীর কথার নির্দে শ যাতে মিথ্যা না হয় সেজন্যে কুন্তীর নির্দে শ অবশ্য পালনীয় বললেন। এর মধ্যে হস্তিনাপুর বা
রাজসভাতেও এই অচলিত রীতির পুনরুভ্যুত্থান নিয়ে একপ্রস্থ তর্ক হয়ে গেছে। ধৃতরাষ্ট্র কর্ণ, বিদুর, দ্রোণ ইত্যাদি শাস্ত্রজ্ঞ
মহারথীরা অচলিত রীতির বিরুদ্ধে তর্ক করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এঁরা দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামিত্ব মেনে নিলেন। দ্রৌপদীর
একার ওপর তাঁর পরিবার ও আগন্তুক অতিথিদের আতিথ্য দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না বলে একদিন সূর্য দেখা দিয়ে বৃহৎ
একটি তামার থালা তাঁকে দিয়ে বলেন, অতিথি এলে এই থালাখানি উচ্চে ধরে আমাকে স্মরণ করলেই এটা সুখাদ্যে ভরে
উঠবে। এতে দ্রৌপদীর কার্যভার অনেকটাই কমে গেল। সেই মতোই চলতে লাগল কুন্তী, পাণ্ডবগণ ও দ্রৌপদীর সংসার।
একে একে দ্রৌপদী পাঁচটি পুত্রের জননী হলেন— প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্ম্ম া, শতানীক ও শ্রুতসেন। দ্রৌপদীর পাঁচ
স্বামী আর একজন সখা— কৃ ষ্ণ, দ্রৌপদীর সখা ছিলেন। অনাত্মীয় নারী পুরুষের এধরনের সখ্য শুধু বিরল নয়, অজ্ঞাতই
ছিল। দৈনন্দিন জীবনে খুচরো বিপর্যয় তো লেগেই ছিল, কিন্তু দ্রৌপদী তাতে বিচলিত না হয়ে সমাধান করতেন। সংসার
চলছিল শান্ত লয়ে। কতকটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে নেবার পরে পাণ্ডবরা পরামর্শ করে দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়েন এবং সফলও হন।
ফলে তাঁরা এবার রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন, এ যজ্ঞে তাঁরা কৃ ষ্ণকে প্রধানের আসনে অভিষিক্ত করেন। রাজসূয়
যজ্ঞে যজ্ঞসম্পাদনকারী রাজা যজ্ঞ শেষে রাজাদের মধ্যে প্রধান বলে গণ্য হত। তবে কৌরবপক্ষ এর মধ্যে এক
দ্যূতক্রীড়ার আয়োজন করেন। যুধিষ্ঠিরের নেশা দ্যূতক্রীড়া কিন্তু যোগ্যতা কম। তা একে একে সব সম্পত্তি ও চার ভাই
খেলায় পণ রেখে হারলেন। বাকি ছিলেন দ্রৌপদী। মতিভ্রষ্ট যুধিষ্ঠির বাজি রেখে তাঁকেও হারলেন। দ্যুতসভা থেকে হুকুম
দেওয়া হল দ্রৌপদীকে সভায় আনা হোক, দুঃশাসন পাণ্ডব প্রাসাদে গিয়ে দ্রৌপদীকে হিড়হিড় করে টেনে আনলেন।
রাজকন্যা রাজকুলবধূকে রজস্বলা অবস্থায় প্রকাশ্য টেনে আনা হল। তাঁর সমস্ত মিনতি অগ্রাহ্য করে তাঁর পরনের শাড়িটা
ক্রমাগত টানতে লাগলে, কিন্তু ছাড়িয়ে নেওয়া শাড়ির স্থানে তৎক্ষণাৎ দেখা দিল নতু ন এক বস্ত্র— ফলে দ্রৌপদীকে
বিবসনা করা গেল না। কোনো সংস্করণে কৃ ষ্ণ স্বয়ং উপস্থিত থেকে বস্ত্রহরণ নিবারণ করেন। দ্রৌপদীর সখা কৃ ষ্ণ সখীর
বিপদে অলৌকিক ক্ষমতা দ্বারা, তাঁর লজ্জানিবারণ করলেন, এইটেই পণ্ডিতগণের সুচিন্তিত অভিমত। যখন পাণ্ডবরা
অজ্ঞাতবাসে ছিলেন তখন এক কামুক কীচকের নজর পড়ল দ্রৌপদীর ওপরে। তার হাত থেকে বাঁচবার জন্যে দ্রৌপদী
গেলেন ভীমের কাছে। সব শুনে ভীম লুকিয়ে থেকে কীচককে সম্মুখ সমরে হারিয়ে মেরে ফেললেন। পরে তাঁর অনুচররা
এসে ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে গিয়ে আহত হয়ে চলে গেলেন। বনবাসকালে জয়দ্রথ রাক্ষস দ্রৌপদীকে নিয়ে
পালিয়েছিলেন পাণ্ডবরা তাঁকে ফিরিয়ে আনেন। অর্থাৎ স্বামী শ্বাশুড়ির কাছে সম্মানের আসনে থাকলেও নানা হীন জাতি ও
রাক্ষসের দ্বারা দ্রৌপদী আক্রান্ত হয়েছিলেন; তাদের কাছে তিনি কেবলমাত্র লোভনীয় নারী, রাক্ষসের কাছে খাদ্যও বটে।
বলা বাহুল্য এইসব আতঙ্ক ও অবমাননায় দ্রৌপদী বিচলিত হলেও স্থৈর্য হারাননি। অপমানিত হয়েছিলেন আপন জ্যেষ্ঠ
স্বামী যুধিষ্ঠিরের কাছে যিনি এই অলোকসামান্য নারীকে পণ্য বস্তুর মতো পণ রেখেছিলেন, নারীর চূ ড়ান্ত অপমান
করেছিলেন। প্রথমত দ্রৌপদী রূপেগুণে অদ্বিতীয়া, দ্বিতীয়ত তিনি একা যুধিষ্ঠিরের স্ত্রী ছিলেন না, অপর চার ভাইয়ের মত
না নিয়ে দ্রৌপদীকে পণ রাখার কোনো অধিকারই তাঁর ছিল না এবং এই দুষ্কর্মের জন্য দ্রৌপদীর কাছে ক্ষমা চাওয়াও তিনি
দরকার মনে করেননি। পাঁচ রাজপুত্রের একক ভার্যা হয়েও যে সু-উচ্চ সম্মান তাঁর একান্ত প্রাপ্য ছিল তা-ও তিনি পাননি
এবং পঞ্চপাণ্ডব তাঁকে বধূ রূপেই দেখতে চেয়েছিলেন ও পেয়েছিলেন। দ্রৌপদী, তাদের এত ভালো বুঝতেন যে যেচে মান
কেঁ দে সোহাগকে তিনি তাঁর যথার্থ মর্যাদার নীচে মনে করতেন। এখন কত অলক্ষিত অস্বীকৃ ত মর্যাদায় ভূ ষিত হয়ে তিনি
বেণুদণ্ডের মতো উচ্চ থেকে পাঁচ বিচিত্র স্বামীর বিভিন্ন প্রকাশে বিচলিত না হয়ে আত্মগৌরবের সঙ্গে জীবনের পথ অতিক্রম
করে চলেছিলেন। দৈনন্দিন জীবনে, দ্রৌপদীর ওপরে যে চাপগুলি পড়েছিল সুদীর্ঘকাল ধরে ও অরণ্যবাসের সময়েও, এবং
যেভাবে তিনি অবলীলাক্রমে সেগুলির সম্মুখীন হয়ে অতিক্রম করেছিলেন তার কোনো তু লনা নেই। এক সময়ে অন্য
রাজবাড়িতে পাঁচ ভাই ভিন্ন ভিন্ন নামে বিভিন্ন বৃত্তি নিয়ে বেশ কিছু কাল কাটিয়েছিলেন। সেখানে দ্রৌপদী সৈরিন্ধ্রী।
এমনিতেই তাঁর রান্নার সুখ্যাতি সকলেই জানত, ওই রাজবাড়িতেও তাঁর এই যশ সকলে জানত এবং তাঁর সমাদর ছড়িয়ে
গিয়েছিল। সেখানে দ্রৌপদী পাঁচ স্বামীর কারো কারো দেখা পেতেন লুকিয়ে চু রিয়ে। মনে একটা সান্ত্বনা ছিল যে স্বামীরা
তাঁর মর্যাদা রক্ষা করবেন। করেওছিলেন। অজ্ঞাতবাসের মধ্যেই কীচক তাঁকে কামনা করবেন জেনে দ্রৌপদী গোপনে
ভীমকে সে কথা জানায়। মহাবলশালী ভীম কীচক ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গকে বধ করে দ্রৌপদীকে বিপদ মুক্ত করেন। দিন
ফু রোলে পাণ্ডবরা এসে তাঁদের যথার্থ পরিচয় দিলেন। দ্রৌপদীও। এমন একটি মহিমান্বিত পরিবারের সান্নিধ্যে ছিলেন বলে
রাজা মনে ও প্রকাশ্যেই গৌরব ও আনন্দ প্রকাশ করেন। মহিষী বিশেষভাবে দ্রৌপদীকে আশীর্বাদ করলেন। তারপর যুদ্ধ।
প্রতিদিনই আত্মীয়বিয়োগের খবর পেতেন দ্রৌপদী। তার পাঁচ স্বামী ও পুত্ররা যুদ্ধে আহত হচ্ছেন এ সংবাদ রোজই পেতে
হচ্ছে তাঁকে। এতে তাঁর মুক্তি নেই। প্রচণ্ড ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দিন কাটছে তাঁর, অথচ এ ভার নামাবার স্থান নেই দ্রৌপদীর।
কুন্তীর মতো তিনিও যথেষ্ট কষ্ট পাচ্ছেন কিন্তু অন্তঃপুরে নিভৃ ত বিষাদদিগ্ধ চিত্তে দিন কাটাচ্ছেন। একদিন কৃ ষ্ণের স্ত্রী
সত্যভামা এলেন দ্রৌপদীর সঙ্গে গল্প করতে। প্রশ্ন একটাই : আমার একটিমাত্র স্বামী, তাকে তু ষ্ট রাখতে পারি না বহু
পরিশ্রম করেও আর তোমার দেখছি পাঁচ-পাঁচটা স্বামী একজন শাশুড়ি, এঁরা সবাই তোমার গুণে পঞ্চমুখ। তাই জিজ্ঞাসা
করতে এসেছি, কোন গুণী বা জ্যোতিষীর দেওয়া কবচ, মাদুলি ব্যবহার করে তু মি এই অসাধ্য সাধন করে চলেছ আমাকে
একটু সন্ধান দিয়ো, আমার সব শ্রম সার্থক হবে। নেহাতই অপারগ হয়ে দ্রৌপদী বললেন, ''তু মি বিশ্বাস করো, ভাই, আমি
ঋষি গুণিনের কোনো সাহায্য কখনো নিইনি স্বামীদের তু ষ্ট রাখতে।'' ''তবে কোন উপায়ে তু মি এই অসাধ্য সাধন করে
চলেছ, বছরের পর বছর?'' ''আমার কলাকৌশল শুনবে, সখি?'' ''বলো, আমি উৎকণ্ঠ হয়ে আছি দীর্ঘকাল ধরে তোমার
কাছে এই কথাটি শুনব বলে।'' ''তবে শোনো সত্যভামা। আমার পাঁচটি স্বামীর ইচ্ছে-অনিচ্ছে, রুচি, অরুচি লক্ষ করে
জেনেছি কে কী পছন্দ করে বা করে না। কিন্তু আমার নিয়ম হল স্বামীরা বা শাশুড়ি জাগবার অনেক আগেই আমি উঠে
ঘরদোর পরিষ্কার করি তারপর প্রাতঃকৃ ত্য স্নানাদি সেরে বয়স ও মর্যাদা অনুসারে গুরুজনদের অভিবাদন করে সাধ্যমতো
যত্ন ও নিষ্ঠা দিয়ে সংসারের কাজে প্রবৃত্ত হই। সব কাজ সেরে ওঁরা ঘুমোতে গেলে পরে আমি শুতে যাই। দেখেছি এতেই
ওঁরা সকলেই আমার ওপরে প্রসন্ন থাকেন। এ ছাড়া আমি আর কোনো দৈব, তান্ত্রিক, গুণী বা ঋষির দ্বারস্থ হইনি। কারণ
তার কোনো প্রয়োজনই হয়নি।'' সত্যভামা দ্রৌপদীর কথা বিশ্বাস করলেন। পরে দুই সখী যার যার কাজে চলে গেলেন।
ব্যবহারিক জীবনে এই-ই ছিল দ্রৌপদীর সাধনা, সমস্ত শক্তি ইচ্ছা ও নিষ্ঠা নিয়ে একাগ্রচিত্তে দৈনন্দিন কাজকর্ম সাঙ্গ
করতেন। এ ছাড়া কোনো ব্যবহারিক, রাজনৈতিক সমস্যা দেখা দিলেও পাণ্ডবরা দ্রৌপদীর সঙ্গে পরামর্শ করতেন।
এমনকী যুধিষ্ঠিরও দ্রৌপদীর সঙ্গে ধর্মনীতি ও রাজনীতি বিষয়ে বাক্যালাপ উত্তর-প্রত্যুত্তর করতেন। অর্থাৎ সংসার
প্রতিপালনের জন্য যেসব ক্ষমতার প্রয়োজন, শারীরিক শক্তি ও মানসিক শক্তি তাঁর তা ছিল। উপরন্তু ধর্ম ও শাস্ত্রবিষয়ক
চিন্তা ও আলাপের ক্ষমতাও তাঁর ছিল। এই সমস্ত শক্তি বুদ্ধি ও জ্ঞান একটি আধারে বিধৃত ছিল বলে চারপাশের লোকেরা
যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের চোখে তাঁকে দেখতেন। নারী বলে হীন মনে করতেন না, বা তাঁর সঙ্গে তর্ক করতে বিমুখ হতেন
না। নিজের অন্তনির্হি ত গুণেই দ্রৌপদী একজন বিশিষ্ট নাগরিকের সম্মান পেয়েছিলেন। এ তো গেল দ্রৌপদীর বাইরের
দিক। তাঁর প্রকৃ ত সমস্যা অন্তরে এবং তাঁর প্রকৃ ত মহিমাও অন্তরে। তাঁর সমস্যা তাঁর একারই, কারণ সমাজের অন্য
মেয়েদের প্রত্যেকের একটি করে স্বামী যাঁর যথাযথ সেবা বা দেখাশোনা করা অপেক্ষাকৃ ত সহজ। কিন্তু পাঁচজন পাঁচটি
পৃথক ব্যক্তি, তাঁদের প্রত্যেকের রুচি ও বোধ পৃথক। সকলকে পৃথকভাবে লক্ষ করে জানতে হয় কী পছন্দ ও অপছন্দ
করে। প্রত্যেককে পৃথকভাবে প্রসন্ন রাখা অনেক সহজ কাজ। যাঁর সঙ্গে যে বছর কাটাতে হবে, তাঁকে সম্পূর্ণভাবে জেনে
নিলে বাকি বছরগুলো চালানো সহজ। এ তো হল দ্রৌপদীর বাইরে অর্থাৎ পারিবারিক জীবনের অপেক্ষাকৃ ত সহজ সমস্যা
ও সংকট। প্রকৃ ত যেখানে তাঁর যন্ত্রণা সে হল অর্জু নকে নিয়ে। বিয়ের দিন যে তরুণীর মুখে মাখানো ছিল পরিতৃ প্ত প্রেমের
আনন্দে উজ্জ্বল হাসি, দু-হাতে ধরা ছিল একটি স্থুল শ্বেতপুষ্পের মালা ও বীর্যশুল্কা নারীর গর্ব ও গৌরবের স্মিত হাস্যটি।
সভার মধ্যে এই সুন্দরী তরুণীটি ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এসে হাতের মালাটি পরিয়ে দিলেন। মনে জানলেন চির কাঙ্ক্ষিত
স্বপ্নে দেখা অর্জু নপত্নী হয়ে তাঁর কুমারীজীবনের আশা, আকাঙ্ক্ষা এতদিনে পূর্ণ হল: আজ থেকে দ্রৌপদী অজুর্নের স্ত্রী। কিন্তু
শ্রেয়াংসি বহুবিঘ্নানি, বিঘ্ন সেদিন থেকে শুরু হল। ছেলেরা কুন্তীকে বললেন দুর্মূল্য বস্তু তাঁরা এনেছেন। ব্যক্তি 'না বলে'
বস্তু বলাতে নেপথ্য থেকে কুন্তীর নির্দে শ: যা এনেছ পাঁচ ভাই সমানভাগে ভাগ করে নাও। পরিতৃ প্ত এক পত্নীত্বের আনন্দ
গর্বগৌরব সব নিষ্প্রভ, ম্লান হয় দ্রৌপদীর জীবনে। যদিও দ্রৌপদী একনিষ্ঠভাবে অর্জু নকেই ভালোবেসে বিবাহের মাল্যদান
করেছিলেন, আজ কুন্তীর এই প্রত্যাদেশে তাঁর সেই অতিযত্নে গাঁথা বরণমালাটি পাঁচখণ্ডে বিভক্ত হয়ে তার সৌন্দর্য ও মহিমা
হারাল। আর অর্জু নের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠতাও সমস্ত মহিমা হারাল। আজ থেকে তিনি পঞ্চপাণ্ডবের স্ত্রী। এমন নারীর
কর্ত ব্য নির্ধারিত হল প্রত্যেক পাণ্ডবের সঙ্গে এক বৎসর করে থাকতে হবে। সম্ভবত সন্তানের পিতৃ ত্ব নিরূপণ করার জন্য।
কর্ত ব্যে শিথিল ছিলেন না, সেদিক থেকে কোনো ত্রুটি ছিল না তাঁর। যন্ত্রণা ছিল অতি সংগোপনে চিত্তের কেন্দ্রস্থলে। এঁদের
বিয়ের অল্পকালের মধ্যেই তাঁর প্রিয় স্বামী অর্জু ন নাগরাজকন্যা উলুপী ও মণিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করেন।
একনিষ্ঠ দ্রৌপদীর দুটি সপত্নী হল। যে প্রেমে তিনি একান্তবর্তী সেখানেই আরো দুই রাজকন্যা রাজসপত্নী হওয়াতে দ্রৌপদীর
গৌরব খানিকটা ম্লান হল বই কী। কিন্তু দ্রৌপদী কথায় বা কাজে এ নিয়ে কোনো ক্ষোভ জানাননি। নিভৃ তে একা অর্জু নকে
কিছু বলে থাকলেও তার কোনো প্রমাণ নেই। তবে মনে হয় তাও বলেননি, কারণ তাঁর অহংকার। দ্রুপদের রাজসভা
থেকে বাড়ি ফিরে অন্তরালে থেকে কুন্তীর নির্দে শ কী শোনার আগে পর্যন্ত তাঁর একজীবন, যা মনে পূর্বপ্রস্তুতি থেকে তিনি
নিজেকে অর্জু নের একমাত্র প্রিয়তমা পত্নী ভেবে এসেছেন। রাজসভা থেকে বাড়ি এসেও কুন্তীর আদেশ শোনা পর্যন্ত তিনি
লজ্জারুণা পরিতৃ প্তা অজুর্নের পত্নী ছিলেন। দ্রুপদ, তাঁর পুত্র এবং সম্ভবত অন্যদের কথার নিষ্পত্তি হবার পর যখন দ্রৌপদী
নিশ্চিতভাবে জানালেন যে তিনি পাণ্ডবদের পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র পত্নী, সেই হিসেবেই অর্জু নের এক পঞ্চমাংশ পত্নী এবং
তিনি ছাড়া আরো দুই রাজকন্যাও তাঁর সপত্নী; তখন বিশেষ করে অর্জু নের পত্নী হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে তিনি আর আমল
দিলেন না। 'সত্য যে কঠিন/কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।' এইটিতেই দ্রৌপদী প্রেমে একান্ত একা হয়ে গেলেন। যে-অন্তরে
অর্জু নের একাধিপত্য ছিল, তাই রইল; কিন্তু এ একাধিপত্য বিবাহের বাতাবরণে মণ্ডিত। এর মধ্যে তাঁর অন্তরের
গভীরতম স্থানে অর্জু নের প্রতি ঐকান্তিক যে প্রেম অনির্বাণ দীপশিখার মতো জ্বলে রইল আমৃত্যু, যার শুধু দীপ্তি নেই,
জ্বলন্ত বহ্নিশিখার দাহিকা জ্বালা আছে, সেই অনির্বাণ প্রেমের শিখাটির দীপ্তি ও জ্বালায় সারাজীবনই তিনি দীপান্বিতা ও
দহ্যমানা হয়ে রইলেন। দ্রৌপদীর একান্ত নিজস্ব সময় সম্ভবত খুব কমই ছিল। স্বামীদের কেউ বাইরে গেলে সেই সময়টু কু
তাঁর একান্ত নিজস্ব, হয়তো একান্তে কোথাও বসে নিজের অন্তরের দীপ্ত শিখাটির জ্যোতি ও তাপ অনুভব করতেন। এই
ছিল তাঁর গোপন বিলাস। যখন অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকতেন, তখনও তাঁর অন্তরের বেদনাদিগ্ধ উপলব্ধি তাঁর জীবনে
এক ধরনের মহিমা সৃষ্টি করত। তিনি নিজে হয়তো সর্বদা সচেতনভাবে তা উপলব্ধি করতেন না। কিন্তু অন্তরের একান্ত
গভীরে ওই অনির্বাণ প্রজ্বলন্ত বহ্নিশিখাটি তাঁর চতু ষ্পার্শ্বে যে জ্যোতির্বলয় সৃষ্টি করেছিল তা তাঁকে অনন্যা করে রেখেছিল।
দ্রৌপদী অনন্যা তাঁর অপরিমেয় বেদনায়। বহির্বিশ্বে তাঁর এই নিরন্তর বেদনার কথা কেউ জানতে পারেনি। জানতেন
হয়তো যুধিষ্ঠির। মহাপ্রস্থানের পথে প্রথম ভূ পতিত হলেন দ্রৌপদী। যুধিষ্ঠির ভাইদের বললেন, এঁর পাপ হল ইনি অর্জু নকে
সর্বাধিক ভালোবাসতেন। কিন্তু এ অতলান্ত সুগভীর প্রেমের প্রত্যাখানের যন্ত্রণাই যে তাঁকে একক মহিমা দান করেছে এবং
তিনি যে সে প্রত্যাখ্যানকে অন্তরে নৈবেদ্যের মতো স্থান দিয়ে অহরহ দাহের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করলেন একথা
যুধিষ্ঠিরের উক্তির আগে কেউ জানতেও পারেনি। একনিষ্ঠ প্রেমের আসনে যে নিরন্তর যন্ত্রণা সেইটি দ্রৌপদীকে অনন্য এক
বিরহিণীর মাহাত্ম্যে ভূ ষিত করেছিল, কেই বা তা জানত? এই যন্ত্রণাই দ্রৌপদীকে অনন্যা করে তু লেছিল।

You might also like