Professional Documents
Culture Documents
Caste Census
Caste Census
দেবেশ দাস
বিজেপির মৌচাকে কি ঢিল ছুঁড়ে দিল বিহারের নীতিশ সরকার? ২০১১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সারা
দেশে জাতগণনা করেছিল, তার রিপোর্ট ১২ বছর বাদেও বের করতে পারেনি। আর ২০২৩ সালেই
শুরু করে বিহারের জাতগণনার রিপোর্ট পেশ করে দিল বিহার।
বিহারে জাতগণনার নেপথ্যে
২০১১ সালের জাতগণনার রিপোর্ট প্রকাশের দাবিতে যে কয়েকজন সাংসদ সংসদে খুব
সোচ্চার ছিলেন, তার মধ্যে বিহারের লালুপ্রসাদ যাদব অন্যতম। বিহারেও তিনি এই দাবিতে সোচ্চার
হন। ২০১৫ সালে বিধানসভা নির্বাচনে লালুপ্রসাদের আরজেডি ও নীতিশের জেডি(ইউ) যখন
একসাথে লড়াই করে, সেখানে তাঁদের ইস্যু ছিল জাতগণনার রিপোর্ট প্রকাশ। তাঁরা যৌথভাবে সরকার
করেন। ২০১৭ সালে জোট ভেঙে যায় ও নীতিশ বিজেপিকে নিয়ে সরকার গড়েন। কিন্তু বিহারে
জাতগণনার ইস্যু শেষ হয় না। বিরোধী আসনে থেকেও আরজেডি জাতগণনার কথা বলতেই থাকে।
২০২১ সালে সারা দেশে জনগণনা হওয়ার কথা। ২০১৯-র ফেব্রুয়ারি ও ২০২০-র
ফেব্রুয়ারিতে বিহার বিধানসভায় সর্বসম্মতিতে আসন্ন ২০২১ সালের আসন্ন জনগণনার সাথে
জাতগণনা করার পক্ষে প্রস্তাব পাশ হয়। ২০২১ সালে বিহার বিধানসভা থেকে নীতিশের নেতৃ ত্বে
সর্বদল দেখা করে প্রধানমন্ত্রীর সাথে - তাদের দাবি ছিল আসন্ন ২০২১ সালের জনগণনার সাথে
জাতগণনা করার। প্রধানমন্ত্রী সর্বদল প্রতিনিধিদের কথা শোনেন, কিন্তু জাতগণনা দূরের কথা, পরে
সারা দেশে জনগণনাই বন্ধ করে দেন।
২০২২ সালে নীতিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় বিহারে আলাদা করে জাতগণনা হবে। সব দলই তা
সমর্থন করে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কয়েকমাস বাদে বিজেপির সাথে নীতিশের জোট ভেঙে যায়,
সরকারে চলে আসে আরজেডি।
বিপাকে বিজেপি
বিহারে বিজেপি জাতগণনাতে অংশগ্রহণ করেছে। আর ওদিকে কেন্দ্রে বিজেপি ২০১১
সালের জাতগণনার রিপোর্ট প্রকাশ করছে না।
২০১১ সালের জাতগণনা জনগণনার সাথে হয়নি, আলাদা করে সেই কাজ করেছিল গ্রামীন
বিকাশ দফতর এবং হাউসিং ও শহুরে দারিদ্র্য দূরীকরণ দফতর। একে বলা হয়েছিল সামাজিক
অর্থনৈতিক জাতগণনা (Socio Economic and Caste Census -SECC)। প্রায় ৫০০০ কোটি টাকা
খরচ করে যে রিপোর্ট তৈরি করা হল, আজ ১২ বছর হয়ে গেল, তার রিপোর্ট বেরোল না। দ্বিতীয়
ইউপিএ সরকার ২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সাল এই তিন বছর রিপোর্ট বার করেনি, তারপরে
বিজেপি সরকার গত ৯ বছরে এই রিপোর্ট বার করেনি। কিন্তু বর্ত মানে কংগ্রেস দল থেকে এই রিপোর্ট
বার করার দাবি জানানো হয়েছে। বিরোধী দলগুলির অনেকে এই দাবি তু লেছে।
গ্রামীন বিকাশের সংসদীয় কমিটি ২০১৬ সালের এক রিপোর্টে জানিয়েছে যে ২০১১ সালের
জাতগণনার যে তথ্য আছে তার ৯৮.৮৭ শতাংশ মানুষের তথ্য নির্ভু ল, বাকি ১.১৩ শতাংশ মানুষের
তথ্য ঠিক করার কথাও তারা বলে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই তথ্য ঠিক করা হল না।
সরকার এই রিপোর্ট প্রকাশ করলে দেশের বিভিন্ন জাতের কী অবস্থায় আছে সেটা প্রকাশ হয়ে
যাবে। বিজেপি তা প্রকাশ করতে চাইছে না। কেন? তাতে কি দেখা যাবে যে যাদের অন্যান্য অনগ্রসর
শ্রেণি বলা হয়, তাদের অবস্থা যে বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রকাশ হয়েছে, বাস্তবে অবস্থা তার চেয়েও খারাপ?
সেই তথ্য হয়তো সরকারের অস্বস্তির কারণ হতে পারে। রিপোর্ট প্রকাশের দাবিতে খুব হই চই হলে
বিজেপি সরকার আংশিক রিপোর্ট বার করে ২০১৬ সালে, কিন্তু সেখানে আসল তথ্যই নেই, তা হচ্ছে
জাতের তথ্য।
২০১৮ সালের ৩১ শে আগষ্ট আসন্ন ২০২১ সালের জনগণনা সম্বন্ধে প্রস্তুতি বিষয়ে সরকারি
স্তরে একটি সভা হয় তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিং-এর সভাপতিত্বে। এই সভার পর সরকারের
পক্ষ থেকে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় - “ওবিসি সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করার পরিকল্পনা হয়েছে"।
আসলে ২০১১ সালের জাতগণনার রিপোর্ট কে কি চাপা দিতেই ২০১৮ এই প্রেস বিজ্ঞপ্তি? নাকি
আসন্ন ২০১৯-র লোকসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে এক জুমলা ছিল এই বিজ্ঞপ্তি?
এই প্রেস বিজ্ঞপ্তির পর সরকার একেবারে চু প। ২০২১ সালে মন্ত্রী জানান যে স্বাধীনতার পর
সরকারের এটা নীতি যে তপশিলি জাতি ও তপশিলি জনজাতি বাদে আর কারও ক্ষেত্রে জাতভিত্তিক
গননা হবে না (রাজ্যসভা প্রশ্নোত্তর, UNSTARRED প্রশ্ন ১৮১৩, ১০ মার্চ, ২০২১)। একেবারেই
অসত্য। স্বাধীনতার পর সরকারের এই নীতি ঠিক হলে ২০১১ সালে জাতগণনা কেন করালো হল
সরকারের দুটি দফতর দিয়ে?
রিপোর্ট বার করছে না, কিন্তু কাজে লাগাচ্ছে গোপনে
২০১১ সালের রিপোর্ট প্রকাশ না করলেও বিজেপি ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে সেই
রিপোর্ট । SECC-র রিপোর্ট তো সরকারের কাছে আছে, সেখান থেকে সরকার জানে কোন জাতের
কত জনসংখ্যা ও কোন জাতের কী অর্থনৈতিক, সামাজিক, ইত্যাদি অবস্থা , কোন জাতের কাছে কি
দাবি অগ্রাধিকার হতে পারে। সেসব দেখে বিভিন্ন রাজ্য সরকারে ও কেন্দ্রীয় সরকারে নানা পরিকল্পনা
করছে বিজেপি। কোন্ রাজ্যে বা কেন্দ্রীয় সরকারে কোন্ জাতের প্রতিনিধিকে মন্ত্রী করলে রাজনৈতিক
সুবিধা হবে , তা বিজেপি জানে, এবং সেই অনুযায়ীই কাজ করছে। এমনকি কোন্ জাতের বিরুদ্ধে
কোন্ জাতকে কী ইস্যুতে লাগালে ওই দুই জাতের রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠবে না, সেসব জেনেই
তা কাজে লাগাচ্ছে বিজেপি। এই কাজে লাগিয়েই তাঁদের ভাষায় তাঁরা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করছে।
উত্তরপ্রদেশে ওবিসিদের নিয়ে সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ভোটে ভালো ফল এনে দিয়েছে বিজেপিকে। ২০০৯ সালে বিজেপি
ওবিসি ভোটের ২২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, যেখানে আঞ্চলিক দলগুলি পেয়েছিল ৪২ শতাংশ।
সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করেই ২০১৯ সালের ভোটে বিজেপি ওবিসি ভোটের ৪৪ শতাংশ পায়,
আঞ্চলিক দলগুলির ওবিসি ভোট কমে যায় ২৭ শতাংশে।
যে তথ্যে বিজেপির একছত্র অধিকার, সেখানেই বিহারের ক্ষেত্রে থাবা বসিয়েছে বিহারের রাজ্য
সরকার। পশ্চাৎপদ জাতগুলির উন্নয়নের জন্য কেউ আসল ইঞ্জিনিয়ারিং করলে বিজেপির সোশ্যাল
ইঞ্জিনিয়ারিং মাঠে মারা যাবে। আরও বিপদ হচ্ছে বিহারের এই জনগণনার রিপোর্টে র মর্মবস্তু।
বিহার জনগণনার রিপোর্টে র মূল কিছু বিষয়
বিহারে জনগণনাতে দেখা যাচ্ছে মোট ১৩.০৭ কোটি লোকের মধ্যে মুসলিম হচ্ছে ১৭.৭
শতাংশ। ১৯৩১ সালের জনগণনাতে মোট ৩৩ কোটির মধ্যে মুসলিমরা ছিল ১৪.৬ শতাংশ। মানে
প্রায় এক শতাব্দীতে (৯২ বছরে) মুসলিমরা বেড়েছে মাত্র ৩.১ শতাংশ। বিজেপি যে প্রায়ই ভয়
দেখায় যে মুসলিমরা বেড়ে দেশে সংখ্যাগরিষ্ট হয়ে গেল বলে, তা আসলে এক বিশাল আজগুবি। যদি
এক শতাব্দীতে মাত্র ৩ শতাংশ বেড়ে ১৭.৭ শতাংশ হয়, তবে আরও কয়েক শতাব্দী লেগে যাবে ৫০
শতাংশ পেরিয়ে সংখ্যাগরিষ্ট হতে।
বিহারের এই জনগননা রিপোর্টে বিভিন্ন সম্প্রদায় জনসংখ্যার যত শতাংশ তা সারণি-১ তে বলা
হল, তাঁদের জন্য সরকারি চাকরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্ত্তির ক্ষেত্রে যে সংরক্ষণ চালু আছে সেটাও
বলা হল। দেখাই যাচ্ছে, মোট ৬০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত, বাকি ৪০ শতাংশ অসংরক্ষিত আসনে
বাস্তবে উচ্চবর্ণের প্রাধান্য। ৬৩ শতাংশ পশ্চাৎপদ জাতির (ওবিসি) জন্য সংরক্ষণ মাত্র ৩৪ শতাংশ,
ফলে আগামীদিনে এদের জন্য বাড়তি সংরক্ষণের দাবি উঠতে পারে।
সারণি-১ঃ বিহারে বর্ত মানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার ও তাদের জন্য সংরক্ষণের শতাংশ