You are on page 1of 17

ব্রিগেডিয়ার খালেদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু ভীষণ উচ্চাভিলাসী। তার উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করার জন্য অতি কৌশলে

যুদ্ধের সময় থেকেই তিনি তার শক্তি এবং প্রভাব বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা করে আসছিলেন।

১৫ই আগষ্ট পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে আগষ্ট বিপ্লবের পূর্ব অবস্থায় দেশকে নিয়ে যাবার এক গভীর
ষড়যন্ত্রের সূচনা ঘটানো হল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে।

www.majordalimbubangla.com/100.html

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা একটি গোপন তারবার্তা থেকে ইঙ্গিত মিলছে যে ১৯৭৫ ঢাকা-০৫৪৭০ ক্রমিকের ওই
তারবার্তাটি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর অবমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ দলিল থেকে আরও একটি বিষয়
স্পষ্ট হয় যে, ৭ নভেম্বরকে সিপাহি-জনতার বিপ্লব হিসেবে গণ্য করে এর একটি রাজনৈতিক রূপ দেওয়া হলেও মার্কিন
রাষ্ট্রদূত বোস্টারই তা সমর্থন করেননি। বরং তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। অথচ বোস্টারকে ব্যাপকভাবে আগস্ট
অভ্যুত্থানকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ধারণা করা হয়ে থাকে। বোস্টার লিখেছেন, ‘পঁচাত্তরের নভেম্বরের ঘটনায়
ভারতের হাত থাকার কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। খালেদ মোশাররফকে ভারতপন্থী মনে করেই বিদ্রোহী সাধারণ
সৈনিকেরা জিয়াউর রহমানের দিকে ঝুঁকেছিলেন।’রাষ্ট্রদূত বোস্টার বাংলাদেশের ইতিহাসের রক্তক্ষয়ী নভেম্বরের প্রথম
সপ্তাহের ঘটনাবলির চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। বিশ্ব এ সময় বাংলাদেশ তিনটি সরকারের পালাবদল প্রত্যক্ষ করেছিল।
বোস্টারের ভাষায়, এ সরকারগুলো আমেরিকাবিরোধী ছিল না। তারা ছিল না ভারত কিংবা সোভিয়েতপন্থী।

বোস্টার তাঁর দীর্ঘ বিশ্লেষণ শুরু করেন এভাবে, ‘চিফ অব দ্য আর্মি জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ
পদোন্নতি না পেয়ে ব্যর্থতায় বিষণ্ন ছিলেন। ১৫ আগস্ট মুজিবকে হত্যার পর খালেদের কিছু সহকর্মীর পদোন্নতি হলেও
তাঁর হয়নি বরং মেজররা সন্দেহভাজন যেসব কর্মকর্তার তালিকা তৈরি করেছিলেন, এর মধ্যে খালেদ মোশাররফের নামটিও
ছিল। আমরা এটা নিশ্চিতভাবে জানি না যে মোশাররফ সংঘাতের রূপকার ছিলেন কি না। যদিও অনেকে তেমনটা মনে
করেন। একটি ভালো সূত্র আমাদের জানিয়েছিল, মোশতাক সরকারে মেজরদের বিশেষ ভূমিকা পালনকে যাঁরা সুনজরে
দেখেননি, খালেদ মোশাররফ তেমন কিছু অধীনস্থদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। মেজরদের বিশেষ ভূমিকার কারণে যেসব
বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তার মধ্যে কিছু সামরিক কর্মকর্তাদের হয়রানি অন্যতম। এই সূত্র আরও জানিয়েছে,
খালেদ মোশাররফের অন্যতম লক্ষ্য ছিল, তেমন কোনো রক্তপাত ছাড়াই পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। তার
অধীনস্থদেরও পরিকল্পনা ছিল সেটাই। যদিও তিনি সন্দেহাতীতভাবে নিজের ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ সম্পর্কেও মনোযোগী
ছিলেন।’

বোস্টার লিখেছেন, ‘খালেদ মোশাররফ ও তাঁর মিত্ররা সোমবার (নভেম্বর ৩) খুব সকালে সেনানিবাস
ও ঢাকা নগরের বেশির ভাগ জায়গার নিয়ন্ত্রণ তুলে নেন। এবং মোস্তাক সরকারের বিরুদ্ধে নিজেদের
সামরিক শক্তি প্রদর্শনে ঢাকার আকাশে মিগ যুদ্ধবিমান ও সশস্ত্র হেলিকপ্টার চক্কর দেয়। এর
আরেকটি লক্ষ্য ছিল মোস্তাক সরকারের অনুগত ট্যাঙ্ক বাহিনীকে ভয় দেখানো। এই প্রেক্ষাপটে
খালেদ মোশাররফ মোশতাকের কাছে চারটি শর্ত দিলেন। প্রথমত, মোশাররফ চিফ অব স্টাফ
হিসেবে ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্থলাভিষিক্ত হবেন, দ্বিতীয়ত,
মেজরদের সেনাবাহিনীর নিয়মিত শৃঙ্খলার মধ্যে আসতে হবে, তৃতীয়ত, সরকারের প্রতি অনুগত
ট্যাঙ্ক বাহিনীকে নিরস্ত্র করতে হবে। এবং চতুর্থত, মোশতাক স্বপদে বহাল থাকবেন। খালেদের পক্ষে
এসব দাবির দৃশত বড় লক্ষ্য ছিল রক্তপাত এড়ানো, যা কি না ভারতের হস্তক্ষেপ ডেকে আনতে
পারত। মোশতাক দিনভর আলোচনা শেষে শেষ পর্যন্ত খালেদের এসব দাবি মেনে নিলেন। তবে
মোশতাক তাঁকে রাষ্ট্রপতি বানানোর জন্য কৃতজ্ঞ মেজর ও তাঁর কিছু সহকর্মীর জন্য বাংলাদেশ
ত্যাগের ব্যবস্থাও সেরে নেন। মোশাররফের সঙ্গে এ ধরনের আপসে পৌঁছানোর আগে মোশতাক
সরকার কুমিল্লা থেকে সেনাবাহিনীর সাহায্য আশা করেছিল। কিন্তু কুমিল্লার অধিনায়ক তখন এই
যুক্তিতে মোশতাকের নির্দেশনা নাকচ করলেন যে শুধু সেনাবাহিনী প্রধান কিংবা চিফ অব জেনারেল
স্টাফের নির্দেশ ছাড়া তাঁরা কোনো অভিযানে যেতে পারেন না। সেনাপ্রধান জিয়া তখন অন্তরিন আর
চিফ অব জেনারেল স্টাফ ছিলেন মোশাররফ।

বোস্টার এরপর মেজরদের দেশত্যাগে খালেদ মোশাররফদের সম্মতি সম্পর্কে মন্তব্য করেন। তাঁর কথায়, ‘ওই দিন (৩
নভেম্বর) শেষ বিকেলে মেজরদের দেশত্যাগে মোশাররফের সম্মতি রহস্যাবৃত বলে মনে হয়। অবশ্য একটি পক্ষের ভাষ্য,
জেল হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মোশাররফ তখনো জানতেন না। অনেক পর্যবেক্ষক অবশ্য উল্লেখ করেন, জেল হত্যাকাণ্ড
ঘটনানোর একটি প্রভাব হলো, সরকারের ভেতরে কোনো ভারতপন্থী নেতৃত্বকে অপসারিত করা।’

উল্লেখ্য, কর্নেল শাফায়াত জামিল, যিনি খুনি চক্রের সঙ্গে সমঝোতাকারী দলের সদস্য ছিলেন, তিনি তাঁর বইয়ের ১৩৬
পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘তাঁরা বিষয়টি জানতেন না। জানলে এভাবে খুনিদের নিরাপদে চলে দেওয়া হতো না।’

জিয়া জনপ্রিয়: বোস্টার লিখেছেন, ‘কিন্তু এটা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট যে মোশাররফের ক্ষমতা গ্রহণ সেনাবাহিনীতে ছিল
অপ্রীতিকর। কারণ জেনারেল জিয়া স্পষ্টতই সেনাবাহিনীতে তাঁর চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। এখানে অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ হলো, সত্যতা থাকুক আর না-ই থাকুক, মোশাররফকে ব্যাপকভাবে ভারতীয় নীতির একজন চালিকা হিসেবে
দেখা হতো। সেনাবাহিনীর মধ্যে এই যে ধারণা তা আরও অতিরঞ্জিত হয় ৪ নভেম্বর (মঙ্গলবার) যখন মুজিবপন্থীদের মিছিল
বের হয় এবং পরদিন জেল হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে হরতাল ডাকা হয়। শুক্রবার খুব সকালের দিকে সেনাবাহিনীর নিম্নপদের
সদস্যরা বিদ্রোহ শুরু করেন। তাঁরা দ্রুততার সঙ্গে মোশাররফের সমর্থকদের উত্খাত করেন। এবং সব রকমের বিবরণ
থেকে জানা যায়, তাঁরা এ সময় মোশাররফকে হত্যাও করেন। সারা রাত ধরে শহর জেগে থাকে গুলির শব্দে। এটা চলে
শুক্রবার সারা দিন। মোশাররফের অপসারণের পর অধিকাংশ গোলাগুলির ঘটনা ছিল উল্লাসসূচক। একটি কর্তৃপক্ষীয় সূত্র
আমাদের বলেছে, মোশাররফকে উত্খাতের ঘটনায় প্রায় ৩০ জন খুনের শিকার হয়। অবশ্য অন্যান্য সূত্রগুলো এই সংখ্যা
কয়েক শ বলেছে।’

তিন সিদ্ধান্ত: বোস্টার এতক্ষণ অনেকটাই ঘটনার বিশ্লেষণ দিচ্ছিলেন। তারবার্তাটির শেষে তিনি স্পষ্ট অভিমত দেন।
বোস্টার লিখেছেন, ‘এতক্ষণ ধরে যে আলোচনা করা হলো তা থেকে তিনটি সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়। প্রথমত, অভ্যুত্থান এবং
পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রধান অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন অরাজনৈতিক। কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু খালেদ মোশাররফ। তাঁর
একটু বাড়তি অসুবিধা ছিল যে তাঁকে ভারতপন্থী বলে মনে করা হতো। সেনাবাহিনীর যে অংশটি খন্দকার মোশতাকসহ
মেজরদের উত্খাত করল, তাদের কিন্তু প্রাথমিক ক্ষোভের কারণ ছিল আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মেজররাই। ৭
নভেম্বরে পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটিয়েছিল সেনাবাহিনীর নিচের পদের লোকেরা। যারা খালেদ মোশাররফের চেয়ে
জিয়াকেই বেশি পছন্দ করছিল। কারণ তারা মোশাররফের আনুবন্য উল্লাস: এ কথার পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টার একটি
মন্তব্য করেন। আর তা হলো ‘গত সপ্তাহে বাংলাদেশে আমরা যতগুলো সরকার দেখেছি, চরিত্রগতভাবে তার কোনোটিই
আমেরিকাবিরোধী, ভারতপন্থী কিংবা সোভিয়েতপন্থী ছিল না। দ্বিতীয় হলো, আমাদের কাছে এমন কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই
যে এ সপ্তাহের ঘটনাবলিতে ভারত দায়ী ছিল। তৃতীয়ত, এসব ঘটনাবলি এটাই নিশ্চিত করছে যে এই বাংলাদেশের শীর্ষ
নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সমাজের নিম্নতম স্তর পর্যন্ত ভারতবিরোধী মনোভাব কত শক্তিশালী ও পরিব্যপ্ত। যদিও মোশাররফ
যে ভারতপন্থী ছিলেন সে বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই এবং কারও মতে তিনি তা ছিলেনও না। কিন্তু তাঁকে
ব্যাপকভাবে সেভাবেই দেখা হয়েছিল। এবং তাঁকে উত্খাতের ঘটনায় যে বন্য উল্লাস এখানে হয়েছে, তাতে ভারতবিরোধী
মনমানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।গত্য কোথায় নিহিত, তা নিয়ে সন্দিহান ছিল।’

‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ১৯৩৭ সালের নভেম্বরে ময়মনসিংহ
জেলার একটি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, গ্রামীণ মধ্য শ্রেণীর পরিবারে জন্ম নেন। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের অন্যতম শীর্ষ
নেতা মেজর ফারুক রহমানের সম্পর্কে তিনি চাচা হন বলে জানা যায়। মোশাররফ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৫৮ সালে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি মেজর ছিলেন। তিনি বাঙালি কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম, যিনি চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের
অধিনায়কত্ব গ্রহণ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তিনি ছিলেন সিলেট ও কুমিল্লার রণক্ষেত্রে। যুদ্ধ
শেষে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে লিয়াঁজো রক্ষা করেন। তাঁকে প্রথমে কর্নেল পদে পদোন্নতি এবং পরে ব্রিগেডিয়ার
করা হয়। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে অবশ্য তিনি মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পেতে ব্যর্থ হন। এ সময় তাঁর জ্যেষ্ঠ
সহকর্মী সফিউল্লাহ ও জিয়াউর রহমান মেজর জেনারেল হতে পেরেছিলেন। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পরও মোশাররফ
নিজের পদমর্যাদার উন্নতি ঘটাতে পুনরায় ব্যর্থ হন। তিনি চিফ অব জেনারেল স্টাফ হিসেবেই থেকে যান। বাংলাদেশ
সেনাবাহিনীতে এ অবস্থান তৃতীয়। মোশাররফ একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব এবং তাঁকে অব্যাহতভাবে উচ্চাভিলাষী হিসেবে
বর্ণনা করা হয়ে থাকে। ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর প্রধানের পদ নিয়ে সফিউল্লাহ ও জিয়াউর রহমানের মধ্যকার
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি সফিউল্লাহর পক্ষ নিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াউর
রহমান স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পর থেকে আমরা থেমে থেমে এমন খবরই পাচ্ছিলাম যে মোশাররফকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে
দেওয়া হবে এবং সম্ভবত তাঁর চাকরি সফিউল্লাহর মতোই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হবে।’

‘পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খালেদ মোশাররফকে একজন রাজনৈতিক ধাঁচের জেনারেল হিসেবে মনে করে। আর
জিয়াউর রহমানকে তারা বিপরীতক্রমে মনে করে তিনি একজন পেশাদার জেনারেল। তবে আমাদের অবশ্যই স্মরণ রাখতে
হবে যে আমাদের চেয়ে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের অনেক ভালো চেনে। এর একটি উদাহরণ দিই, আমরা একটি তথ্য সম্পর্কে
অবগত রয়েছি যে তাঁদের কাছে থাকা পুরোনো ফাইলে খালেদ মোশাররফের অতীত দক্ষতা সম্পর্কে তথ্য রয়েছে।’

জিয়ার মতো খালেদ মোশাররফও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই দুজনের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের ইতিহাসও ভিন্ন। জিয়া অনেকটা
পরিস্থিতির চাপে আর খালেদ মোশাররফ পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে খালেদ মোশাররফের
যতো বীরত্বগাঁথা পাওয়া যায়, জিয়ার ততোটা নয়। খালেদ ছিলেন মনেপ্রাণেই একজন বিপ্লবী। ‘৭৫-এর ৩ নভেম্বর খালেদ
মোশাররফের অভ্যূত্থান সফল হলে হয়তো ইতিহাস আজ অন্যভাবে লেখা হতো বলে আমার মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
পড়ে খালেদ মোশাররফকে আমার সময়ের সবচেয়ে “মিসআন্ডারস্টুড” (এই শব্দটার যথার্থ বাংলা পাচ্ছি না) চরিত্র মনে
হয়।

মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা, বিশেষ করে সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে খালেদ মোশাররফ সম্ভবত ছিলেন সবচেয়ে মেধাবী।
তার সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে শোনা তার একটা উদ্ধৃতি আমি কখনোই ভুলতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধে মূলতঃ গেরিলা
যোদ্ধাদের সংগঠিত করেন সেক্টর দুই-এর এই প্রধান। এক সম্মোহনী চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তিনি। অনেকটা
চেগুয়েভারার মতো। তার ভাষণ শুনে গেরিলারা পতঙ্গের মতো মরনপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো। খালেদ মোশাররফ সে
সময় প্রায়ই বলতেন, “স্বাধীন দেশের সরকার জীবিত গেরিলাদের চায় না, নো গভর্নমেন্ট ওয়ান্টস অ্যান অ্যালাইভ গেরিলা,
নিতে পারে না………”।
কিন্তু ৭ নভেম্বর পরিকল্পিতভাবে খালেদ মোশাররফ ও হায়দার- মুক্তিযুদ্ধের দুই সহযোদ্ধাকে ‘৭৫-এর খুনি বাহিনী হত্যা
করে। নাকি এ কাজ করেছিল গণবাহিনী?

এই জায়গাটাতে আমি দ্বিধান্বিত । স্বাধীনতার পর যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ঝান্ডা উড়িয়ে জাসদ গঠন করেছিলেন, তার
আগ পর্যন্ত কিন্তু তাদের কারো সমাজতান্ত্রিক ইতিহাস ছিলোনা । বরং তারাই ছিলেন কট্টর মুজিববাদী ।

মুজিববাদী ছাত্রলীগের দুই উপদলঃ একদলে শেখ ফজলুল হক মনি আরেক দলে আসম রব'রা । একই দিনে দুই উপদল
সম্মেলন আহবান করে এবং দুইদলই শেখ মুজিবকে প্রধান অতিথির নিমন্ত্রন জানায় । শেখ মুজিব তার ভাগ্নের আতিথ্য
গ্রহন করেন ।

আমার মনে প্রশ্ন জাগে সেদিন যদি শেখ মুজিব তার ভাগ্নেকে রুষ্ট করে রব'দের সম্মেলনে যোগ দিতেন, তাহলে কি জাসদ
নামের কোনো রাজনীতির জন্ম হতো ।

হয়তো হতোই । ঠিক সেই সময়টাতে জাসদের প্রয়োজন তৈরী হয়েছিল । প্রশ্ন হলো কাদের জন প্রয়োজনীয়?

স্বাধীনতার পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিবেশ বাংলাদেশে গড়ে উঠা শুরু করেছিলোই । অনেক বছর, সেই সময় থেকে
নিরাপদ দুরত্ব এসে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই কিন্তু দাবী করেন, জাসদ কোনো বিপ্লবী সংগঠন ছিলোনা । ছিলো
মুলতঃপ্রতিবিপ্লবী । বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র তো সুদূর পরাহত, এর নিউক্লিয়াসের লোকজন মুলতঃ সমাজতান্ত্রিকঅই ছিলোনা ।

বরং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের যে স্বাভাবিক সম্ভাবনা ছিলো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, সেই সম্ভাবনাকে সমাজতন্ত্রের নামেই
কবর দেয়ার জন্য জাসদ ছিলো সি আই এ'র বানানো এক গেম প্ল্যান মাত্র ।

এই রাজনৈতিক বিশ্লেষন সর্বাংশে সত্য কিনা জানিনা কিন্তু ঘটনা পরম্পরায় চিহ্ন পাওয়া যায় ।

সেই অতি বিপ্লবী বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিকদের পরবর্তী চেহারা ছবি কেমন? আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ,মেজর
জলিল এবং অতি অবশ্যই সিরাজুল আলম খান দাদা ভাই ।

এরা ব্যর্থ বিপ্লবী ও নয় । বিপ্লব করে যে ব্যর্থ হয় তাঁর জন্য ও শ্রদ্ধাটুকু থাকে । কিন্তু বিপ্লবকে বিভ্রানত করার জন্য যারা
অতি বিপ্লবী সাজে?

কিন্তু ৭৫ এর হত্যাকান্ডের মাধ্যমে যখন প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে,ধ্বসে পড়ছে মুক্তিযুদ্ধের সকল
অর্জন সেই সময় খালেদ মোশাররফের পালটা অভ্যুত্থানকে আমার কাছে এক মরিয়া হয়ে উঠা দেশপ্রেমিকের শেষ চেষ্টা
বলেই মনে হয় ।

জিয়ার সমর্থনে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে পালটা অভ্যুত্থান এবং তাঁকে হত্যা করা- কর্নেল তাহের এই ভুমিকা আমার
কাছে হঠকারী মনে হয় ।
বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অবঃ) তাজুল ইসলাম। বীর সেক্টর কমান্ডার মোশাররফ
তথাকথিত ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লবের কোন সিপাহীর হতে মৃত্যুবরণ করেননি।” তার তথ্যমতে, সেনানিবাসে যাবার
পথে আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে জিয়াউর রহমান দেয়া নির্দেশে কর্ণেল জলিল ও কর্ণেল আসাদ গাড়ীর ভেতরে খালেদ
মোশাররফ ও কর্নেল হায়দারকে হত্যা করে।

‘৭৫ সালের ৭ নভেম্বর রাত ১২ টায় বঙ্গভবনে সিপাহী বিপ্লবের খবর পেয়ে জেনারেল খালেদ কর্নেল হুদা ও হায়দারকে
সঙ্গে নিয়ে প্রথমে ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের বাসায় যান । সেখান থেকে শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ১০ম বেঙ্গল
রেজিমেন্টে যেতে সিদ্ধান্ত নেন । উল্লেখ্য ১০ ম বেঙ্গলকে বগুরা থেকে খালেদই আনিয়েছিলেন তার নিরাপত্তার জন্য । পথে
ফাতেমা নার্সিং হোমের কাচে তার গাড়ি খারাপ হয়ে গেলে তিনি হুদা ও হায়দারসহ পায়ে হেটেই ১০ম বেঙ্গলে গিয়ে
পৌছেন । উক্ত ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল নওয়াজিস । খালেদের আগমনের খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ তিনি
টেলিফোনে টু ফিলডে সদ্যমুক্ত জেনারেল জিয়াউর রহমান কে তার ইউনিটে খালেদের উপস্থিতির কথা জানান । তখন ভোর
প্রায় চারটা । জিয়ার সাথে ফোনে তার কিছু কথা হয় । এরপর তিনি মেজর জলিলকে ফোন দিতে বলেন । জিয়ার সাথে
মেজর জলিলের কথা হয় ।ভোরবেলা দেখতে দেখতে সিপাহী বিদ্রোহের প্রবল ঢেউ ১০ম বেঙ্গলে এসে পড়ে । পরিস্থিতি
কর্নেল নওয়াজিসের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায় ।আফিসার মেসে বসে খালেদ-হায়দার -হুদা সকালের নাস্তা করছিলেন ।
হুদা ভীত হয়ে পড়লেও খালেদ ছিলেন ধীর , স্থির , শান্ত । হায়দার নির্ভীক নির্বিকারভাবে পরটা মাংস খাচ্ছিলেন । এমন
সময় মেজর জলিল কয়েকজন উত্তেজিত সৈনিক নিয়ে মেসের ভিতর প্রবেশ করে । তার সাথে একজন বিপ্লবী হাবিলদারও
ছিল ।সে চিৎকার দিয়ে জেনারেল খালেদকে বলল-”আমরা তোমার বিচার চাই “!খালেদ শান্তকণ্ঠে জবাব দিলেন ,” ঠিক
আছে , তোমরা আমার বিচার করো । আমাকে জিয়ার কাছে নিয়ে চলো ।”স্বয়ংক্রিয় রাইফেল বাগিয়ে হাবিলদার চিৎকার
করে বললো-”আমরা এখানেই তোমার বিচার করবো ।”খালেদ ধীর স্থির । বললেন, “ঠিক আছে , তোমরা আমার বিচার
করো ।” খালেদ দু’হাত দিয়ে তার মুখ ঢাকলেন ট্যারর-র-র-র ! একটি ব্রাস ফায়ার । মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন
সেনাবাহিনীর চৌকস অফিসার জেনারেল খালেদ মোশাররফ যার ললাটে ছিল বীরযোদ্ধার জয়টিকা , মাথায় ছিল মুক্তিযুদ্ধের
বীর উত্তমের শিরোপা আর মাথার বাম পাশে ছিলো পাকিস্তানী গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের গোলার গভীর ক্ষতচিহ¡ ।
কামরার ভেতরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করলেন আগরতলা ষড়যন্ত্রমামলার অন্যতম আসামী মুক্তিযুদ্ধে ৮নং সেক্টরের
সাবসেক্টর কমান্ডার বীর বিক্রম কর্নেল নাজমুল হুদা ।কর্নেল হায়দার ছুটে বেরিয়ে যান কিন্তু সৈনিকদের হাতে বারান্দায় ধরা
পড়েন । উত্তেজিত সৈনিকদের হাতে তিনি নির্দয়ভাবে লাঞ্চিত হন । তাকে সেপাহীরা কিল ঘুষি লাথি মারতে মারতে
দোতলা থেকে নিচে নামিয়ে এনে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয় ।কি মর্মান্তিক ! আজ পর্যন্ত এই হত্যার বিচারের কোন
উদ্যোগই নেয়া হয়নি ।বর্তমান নবনির্বাচিত সরকারের নিকট দাবী-

খালেদ -হায়দার -হুদা হত্যার বিচার চাই ।খুনি যে হোন না কেন -বিনা বিচারে এই হত্যাকান্ড সমর্থন করা যায় নাতাই এর
বিচার চাই

References :

1. তিনটি সেনা অভ্যুথান ও কিছু না বলা কথা, লে ক.এম এ হামিদ

2.মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বরূপ , মেজর রফিকুল ইসলাম পি এস সি

3. লে ক গাফফার বীরউত্তমের ইন্টারভিউ , ভোরের কাগজ ৬ নভে ২০০৬


২৪ আগস্ট জেনারেল জিয়া সেনাপ্রধান হওয়ার পর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের প্রভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং সেনা
কর্তৃত্বকে ঘিরে ক্ষমতালোভী, স্বার্থান্বেষী ও ষড়যন্ত্রকারীদের দৃশ্য-অদৃশ্য তৎপরতায় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী
বহুমুখী গ্রুপের সৃষ্টি হয়। যার প্রথম গ্রুপে ছিলেন জেনারেল জিয়া ও তার অনুসারীরা। দ্বিতীয় গ্রুপে ছিলেন জেনারেল
খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়েত। তৃতীয় গ্রুপে ছিলেন কর্নেল তাহের ও তার জাসদের গণবাহিনী। এবং চতুর্থ গ্রুপে
ছিলেন বঙ্গভবনে অবস্থানকারী ও সবচেয়ে ক্ষমতাধারী ১৫ আগস্টের খুনি মেজররা ও মোশতাক। ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে না
পারায় জেনারেল জিয়া সব গ্রুপের প্রতিই ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ ছিলেন। কিন্তু বঙ্গভবনে খুনি মেজররা ও কর্ণেল তাহেরের
সঙ্গে জিয়া প্রকাশ্যে ও গোপনে সব সময় একটা যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন। খুনি মেজরদের উচ্ছৃক্সখলতা ও ঔদ্ধত্য
আচরণ এবং জিয়া কর্তৃক এদের প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে সেনানিবাসের বেশিরভাগ অফিসার জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও
কর্নেল শাফায়েতের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সৈনিকদের মধ্যে ছিল চতুর্মুখী বিভ্রান্তি। জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল
শাফায়েত সুযোগ বুঝে নিজেদের অধীনস্থ ৪৬ ব্রিগেড ও তার সব বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে ২ নভেম্বর দিবাগত মধ্য রাতে
পাল্টা ক্যু শুরু করেন। রাত ১-২টার মধ্যে মোটামোটি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ও শহরের প্রায় সর্বত্রই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করতে
সক্ষম হন; শুধু বঙ্গভবন ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ট্যাংক বহর ব্যতিরেকে।

জেলখানা হত্যাকাণ্ডের খবর পান খালেদ মোশাররফ ৪ নভেম্বর দুপুরের আগে; ঘটনার প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পর। ক্যু-পাল্টা ক্যুর
ঘটনায় এতবড় অদূরদর্শিতার পরিণাম যা হওয়ার তাই-ই হয়েছে। ৪ ও ৫ নভেম্বর মোশতাককে রাষ্ট্রপতি রেখে খালেদ
মোশাররফ সারাক্ষণ বঙ্গভবনে বসে নিজের সেনাপ্রধানের পদ নিয়ে যদি দেন দরবার না করে, সেনাবাহিনীর ভিতরে প্রচণ্ড
টলটলায়মান পরিস্থিতিকে বোঝার চেষ্টা করতেন, তাহলে ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড হয়তো ঘটতো না। জেনারেল খালেদের
অদূরদর্শিতা এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতাকে পুঁজি করে কর্নেল তাহের অতি বিপ্লবী মনোভাবের দ্বারা তাড়িত হয়ে তার
বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা দ্বারা জেনারেল খালেদের ক্যু নস্যাৎ করে দেন। জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে আনেন। তাঁর এই
কার্যকরণ যে কতবড় হঠকারী ও আত্মবিধ্বংসী ছিল, তা তিনি নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। জেনারেল খালেদ
জেনারেল জিয়াকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু জেনারেল জিয়া ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টার পরই মুক্ত হয়ে যান। রাত ২-
৩০টার সময় জিয়া-তাহের সেনানিবাসে বসে নিজেদের মধ্যে সলাপরামর্শ ও দর কষাকষি করেন। আর খালেদ
মোশাররফকে হত্যা করা হয় ৭ নভেম্বর সকালে নাস্তা খাওয়ার পরে, শেরেবাংলা নগরে খালেদেরই পছন্দের ব্যাটালিয়নের
অভ্যন্তরে। জেনারেল খালেদকে কাদের হুকুমে হত্যা করা হলো বা জেনারেল জিয়া ও কর্নেল তাহের যথেষ্ট সময় পেয়েও
কেন খালেদকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেন না; এসব প্রশ্নের মীমাংসা এখনও হয়নি। তথাকথিত বিপ্লবের নামে উচ্ছৃক্সখল
সেনারা ২৪ জন নিরীহ অফিসারকে হত্যা করল।।

আমি তোমাদের দেশপ্রেম শেখাবো না। দেশপ্রেম এমনিতেই তোমাদের আছে, দেশপ্রেম না থাকলে তোমরা এখানে আসতে
না। আমার কাজ তোমাদের যুদ্ধ শেখানো, আর যেভাবে যুদ্ধ শেখানো উচিৎ তার সময় ও সুযোগ এখানে নেই। তোমরা
এখানে যুদ্ধ করতে করতেই যুদ্ধ শিখবে, যুদ্ধের ময়দান হলো তোমাদের ট্রেনিং একাডেমী।

-মেজর খালেদ মোশাররফ

খালেদ মোশাররফ একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন, বীর ছিলেন, বাংলাদেশকে বুকে ধারণ করা একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক
ছিলেন। আর দেশপ্রেমিক ছিলেন বলেই যুদ্ধে রওয়ানা দেওয়ার ঠিক আগ মূহুর্তে খালেদ মোশাররফ ছেলেদের হাতে
বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া একমুঠো মাটি দিয়ে শপথ করাতেন, বলতেন, তোমাদের হাতে একমুঠো বাংলাদেশের মাটি,
এই মাটি আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। আমাদের দরকার পুরো বাংলাদেশ, পুরো বাংলাদেশের মাটি।
খালেদ মোশাররফের সাহসিকতার গল্প আমরা একাত্তরের ইতিহাসের পাতায় পাতায় খুঁজে পাই, তার দেশপ্রেমের গল্প
শুনে আমরা এক সাহসী যোদ্ধাকে স্যালুট জানাই, যেমনি তাকে স্যালুট করতো, ত্রিপুরার ক্যাম্পে যুদ্ধ করতে যাওয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আহবাব, অথবা ক্ষেতমজুর রমিজ আলী।

ঘুমের মধ্যেই আমার চোখে প্রায়ই ভেসে উঠতো একটা প্রামাণ্যচিত্রের দৃশ্য, সবুজ উর্দি পড়া এক লোক, চোখে মুখে প্রচন্ড
সাহস, সুদর্শন, কন্ঠে দেশপ্রেম মাখিয়ে হাজার মানুষকে হ্যান্ডমাইকে কিছু বলছেন, কি ছিলো তার সেই কথা, কেমন ছিলো
তার কন্ঠের দরদ আর দেশের প্রতি ভালোবাসা জানতে ইচ্ছে হলো, আমি শুনতে চাই, শুনতে চাই এই বীরের কথা, এই
বীরের ব্যথিত দু্ঃখগাঁথা। ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমার মনে পড়ে, আমি একটা প্রামাণ্যচিত্র দেখেছি, যেখানে ছিলেন খালেদ
মোশাররফ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক সাহসী সমরনায়ক, সবুজ উর্দি ছিলো তার পড়নেই। সবুজ রঙের উর্দি পড়া,
যেনো বাংলাদেশকে জড়িয়ে আছেন নিজের শরীরে, দেখেছি, তার দীপ্ত প্রত্যয়ী ভাষণ, শুনেছি, তিনি বলছেন, বাংলাদেশ,
আমরা পুরো বাংলাদেশ চাই।

খালেদ মোশাররফের সাহসের কাছে সামরিক বাহিনীর তার সমবয়সী অন্য কর্মকর্তারা সবসময় নতজানু ছিলেন। তাই
শফিউল্লাহকে সরিয়ে কালো চশমা পড়ে জিয়া যখন দেশের প্রধান সেনানায়ক, তখন তিনি পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তা
কর্ণেল এরশাদকে একের পর এক প্রমোশন দিয়ে মেজর জেনারেল বানিয়ে নিজের কাছে টেনেছেন শুধুমাত্র খালেদ
মোশাররফকে ভয় পেতেন বলে খালেদের সাহসের আরেকটি গল্প বলি, একাত্তরের এপ্রিলে ত্রিপুরার মতিনগরের ক্যাম্পে
বসে একসাথে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন খালেদ, জিয়া ও ভারতীয় ডেলটা সেক্টরের কমান্ডার ব্রিগ্রেডিয়ার সাবেগ সিং। কথা
প্রসঙ্গে সাবেগ সিং খালেদকে প্রশ্ন করে বসেন, খালেদ তোমার এত রেশন লাগে কেন ? খালেদ প্রতিউত্তরে বললেন, স্যার
আমি ঢাকার খুব কাছে, কুমিল্লা নোয়াখালীর শরীর ঘেঁষে, সকালে যদি থাকে ৫০০ ছেলে, বিকালে থাকে ১০০০, রাতে দেখা
যায় ২০০০ হয়ে গেছে, কোনো কোনো রাতে ৩০০০ হাজারও ছাড়িয়ে যায়। সাবেগ সিং এবার সবচেয়ে কঠিন কথাটা
বললেন, আমি দু্ঃখিত খালেদ, আমাকে তোমার রেশনের হিসেবটা নিতে হবে। খালেদ তখনই বুঝে ফেললেন সাবেগ সিং
প্রশ্ন তুলছেন খালেদের সততার, খালেদ ডান হাতে তার খাবারের প্লেটটি ধাক্কা দিয়ে সামনে ঠেলে দিলেন। তারপর
ব্রিগ্রেডিয়ার সাবেগ সিংয়ের চোখে চোখ রেখে বললেন, ব্রিগ্রেডিয়ার সাবেগ সিং আপনি নিশ্চয়ই চান না আমি আমার
লাইফেলের ব্যারেল দুই দিকে ঘুরাই ?

কথাটা বলেই খালেদ ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। সাবেগ সিং সেদিন খালেদের সাহসের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন,
এরপর তিনি খালেদকে ঠিকই বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। ।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে অস্বস্তি ছিল পাকিস্তানিদের। তাই তারা বাঙালি
সেনাদের বিরুদ্ধে নানা ধরণের পরিকল্পনা করছিলো । পাকিস্তান সেনা বাহিনীর তত্‍কালীন মেজর খালেদ মোশাররফকে
নিয়েও পাকিস্তান বাহিনী বিভিন্ন কুট-কৌশলের আশ্রয় নেয় ৷ কারণ তিনি ছিলেন বাঙালি ৷ সেই সময়ে খালেদ মোশাররফ
ছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে ৷ সেখান থেকে তাঁকে ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেড অফিস কুমিল্লাতে
উপপ্রধান হিসেবে বদলি করা হয়৷ তিনি ২২ মার্চ তাঁর পরিবারকে ঢাকায় রেখে কুমিল্লা চলে যান ৷কুমিল্লায় ইউনিটে পৌঁছার
সাথে সাথেই তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর সৈন্যরা বেশ উদ্বিগ্ন ৷ পাঞ্জাবিদের কমান্ডো এবং গোলন্দাজ বাহিনী বেঙ্গল
রেজিমেন্টের চারপাশে পরিখা খনন করে মেশিনগান লাগিয়ে অবস্থান নিয়েছে ৷ নির্দেশ পেলেই যে কাউকে হত্যা করতে
পাঞ্জাবিরা যেনো প্রস্তুত ৷
২৪ মার্চ সকালে খালেদ মোশাররফ উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার সময় লে. কর্নেল খিজির হায়াত খান তাঁকে
ডেকে পাঠালেন ৷ অফিসের ভিতর ঢুকে দেখলেন, তিনি বেশ উদ্বিগ্ন ৷ খালেদকে জানালেন, সিলেটের শমসের নগরে
নকশালপন্থিরা বেশ তত্‍পর হয়েছে এবং ভারত থেকে অনুপ্রবেশ করছে ৷ এসব কারণে ৪র্থ বেঙ্গলের একটি কোম্পানী নিয়ে
আজই খালেদকে কুমিল্লা ছেড়ে যেতে হবে তাদের দমন করতে ৷ জবাবে তিনি বললেন একটা কোম্পানী যখন যাবে তখন
কোনো জুনিয়র মেজরকে সেখানে পাঠানো যেতে পারে ৷ সাধারণত কোনো উপপ্রধান একটি কোম্পানী নিয়ে এসব
অপারেশনে যায় না ৷ তাঁর কথায় তিনি অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, আপনি এখন যান ৷ কিছুক্ষণ পরে তিনি তাঁকে ব্রিগেড
কমান্ডারের কাছে নিয়ে যান ৷ ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার শফি তাকে বললেন, এটি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাই
তোমাকে নির্বাচিত করেছি ৷ আশা করি নিরাশ করবে না ৷ খালেদ বুঝলেন তাকে যেতেই হবে ৷ শমসের নগরে যাওয়ার
পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছাত্র জনতা খালেদের দলকে বাঁধা দেয়। উত্তেজিত জনতা খালেদকে জানায় যে, পূর্ব বাংলার অনেক
জায়গায় পাক সেনারা গুলি চালিয়েছে ৷ পাকিস্তানি কর্মকর্তারা ইচ্ছা করেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের কুমিল্লা থেকে
দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছে ৷ তিনি তাদের বুঝিয়ে শান্ত করে আবার রওনা দিলেন শমসের নগরের পথে৷

২৫ মার্চে শমসের নগরে পৌছার পর তিনি দেখলেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক ৷ স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করে আরও
জানতে পারলেন সেখানে কোনো অঘটন ঘটেনি ৷ কোথাও নকশালপন্থিদের কোনো চিহ্ন খুঁজে পেলেন না তিনি ৷ বুঝতে
পারলেন তাঁকে কৌশল করে এখানে পাঠানো হয়েছে এবং যা কিছু তারা বলেছিল তার সবটাই মিথ্যা ৷ কারণ বাঙালি
সৈন্যদের নিয়ে গঠিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের দেশের নানা অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখাই ছিল তাদের মূল
উদ্দেশ্য ৷ যাতে আক্রমণ করলে বাঙালি সেনারা ঐক্যবদ্ধভাবে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারে৷

খালেদ মোশাররফ ওয়ারলেসের মাধ্যমে হেডকোয়ার্টারে শাফায়াত জামিল এবং ক্যাপ্টেন হায়দারের সঙ্গে যোগাযোগের
চেষ্টা করলেন ৷ অনেক কষ্টে পরের দিন যোগাযোগ হয় তাঁদের৷ তাঁরা জানান, ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় সান্ধ্য আইন জারি হয়েছে
এবং ৪র্থ বেঙ্গলকে তা কার্যকর করতে বলা হয়েছে ৷ লোকজন সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে মিছিল করছে ৷ এ অবস্থায় তারা কি
করতে পারেন ? প্রায় একশো মাইল দূরে অবস্থান করে খালেদের পক্ষে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন ছিলো ৷ একদিকে
সামরিক শৃঙ্খলা আর কর্তব্যবোধ আর অন্যদিকে বিবেকের দংশন তাঁকে পীড়িত করছিলো ৷ এই উভয় সংকটে পড়ে তিনি
ক্ষণিকের জন্য চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেললেন ৷ মেজর শাফায়াত জামিলকে তিনি বললেন, আমাকে কিছুটা সময় দাও ৷
সেনাবাহিনীর কারো প্রতি কোনো রাজনৈতিক নির্দেশ সেই মুহূর্তে ছিল না ৷ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণার কথা তাঁর মনে পড়ে
গেল ৷ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলতে হবে ৷ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’৷ তিনি লে. মাহবুবকে
বললেন, ‘এই মুহূর্তে আমি স্বাধীন বাংলার আনুগত্য স্বীকার করলাম ৷ স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দাও৷ আর সব
সৈনিকদের বলে দাও আজ থেকে আমরা আর কেউ পাকিস্তানের অনুগত নই৷ তখনই সর্বপ্রথম কোনো সামরিক কর্মকর্তা
হিসেবে খালেদ মোশাররফ বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার করে বেঙ্গল রেজিমেন্টের তার দলকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে
দেন।

সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে খালেদ সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে মাধ্যমিক পাশ করার পর
ভর্তি হন ঢাকা কলেজে ৷ঢাকা কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে নির্বাচন করে সমাজকল্যাণ এবং
সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন৷ এছাড়াও ১৯৫৪ সালের রাজনৈতিক আন্দোলনেও তিনি জড়িত ছিলেন৷ ১৯৫৫ সালে
খালেদ মোশাররফ সেনাবহিনীতে যোগ দেন এবং ১৯৫৭তে তিনি কমিশন পান ৷
পচাত্তরে ফারুক রশিদের অভ্যূত্থান সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি খালেদ মোশাররফ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী মেজরদের
প্রতি তার প্রচন্ড ক্ষোভ ছিলো। কিন্তু দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি হয়ে যাবে বলে ১৫ আগস্টের পরপরই ফারুক রশিদের
বিরুদ্ধে কিছু করেননি খালেদ। কিন্তু অপেক্ষায় ছিলেন সুযোগের। খুনী মেজরদের যেমন তিনি মেনে নিতে পারেননি, তেমনি
সফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়ার সেনাপ্রধান হওয়াটাকেও তিনি ভালো ভাবে দেখেননি। খালেদ মোশাররফ আর শাফায়েত
জামিল বঙ্গভবন থেকে মেজরদেরকে সরানোর জন্য চেষ্টা বহুদিন থেকেই করছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন খালেদ মোশাররফ শাফায়েত জামিলের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার
জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন মধ্যরাতে আঘাত হানার জন্য সৈন্য সামন্ত প্রস্তুতও রাখা হয়েছিলো। কিন্তু ঐ অ্যাকশন আর
নেওয়া হয়নি। কারণ, এর আগেই খালেদ মোশাররফকে বঙ্গভবনে ডেকে পাঠানো হয়েছিলো এবং তিন দিন তিনি আর
শাফায়েত জামিলের সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। ( বাংলাদেশ রক্তের ঋণ, পৃষ্ঠা- ১২৫ )

খালেদের অভূত্থান পরিকল্পনায় তার সহযোগী জুনিয়র কর্মকর্তারা জিয়াকে হত্যা করতে চেয়েছিলো। কিন্তু খালেদ এই
বিষয়টাতে ভেটো দিয়ে শুধু জিয়াকে গ্রেফতার করার কথা বলেছিলেন। এটাই হয়তো তার জীবনের অনেক বড় ভুল ছিলো।
কিন্তু পুরো অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, খালেদ দেশে নতুন করে কোনো রক্তপাত চাননি। তিনি চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর
খুনী মেজরদেরকে শাস্তি দিতে এবং সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে। এই লক্ষ্যে তাদের অভ্যূত্থান সফল
হলেও দুজনের কেউই সরকারের ক্ষমতা দখল ও নিজেদের সেই ক্ষমতা নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেননি।
তেমনি তারা বঙ্গবন্ধুর পারেননি খুনীদেরকেও কিছু করতে। তাদের সাথে দেন দরবার করে খুনীরা দেশ ছেড়ে ব্যাংককে
চলে যায়। খালেদ এবং জামিল তখন মনে করেছিলেন রাষ্ট্রের সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর খুনীরা দেশ ছেড়ে
চলে গেলেও খুনী মুশতাক তখনো রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসেছিলো। মুশতাককে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেনে নেওয়া খালেদের
রাজনৈতিক দুরদর্শিতার পরিচয় বহন করে না। এই বিষয় থেকেই খুব সহজেই বোঝা যায়, খালেদ মনে করেছিলেন, খুনী
মেজররা দেশ ছেড়ে চলে গেলে দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাই মেজরদের বিরুদ্ধে অভ্যূত্থান করতে গিয়ে
তিনি জিয়াকে বন্দী করেছিলেন, অথচ জুনিয়ররা যখন জিয়াকে হত্যার কথা বলেছিলো তখন খালেদ তাদেরকে ভেটো
দিয়েছিলেন। অথচ তাদের অভ্যূত্থানের পর পরবর্তীতে জিয়াই সবচেয়ে বেশি একটি সফল অভ্যূথান মানেই ক্ষমতার
অধিকারী হতে পারা, খালেদ যদি তখন ইচ্ছে করতেন তাহলে দেশের সর্বময়ী ক্ষমতার অধিকারী হতে পারতেন। তিনি তা
চাননি। কিন্তু নিজে সেনাপ্রধান হওয়ার জন্য মুশতাক সরকারের সাথে যে দেন দরবার শুরু করেন তা তার ব্যক্তিত্বের
পুরোপুরি বিপরীত। এই সুযোগে কর্ণেল তাহের সেনাবাহিনীর ভিতরে জাসদকে ছড়িয়ে দেন। সিপাহীদের হাতে হাতে পৌছে
যায় লিফলেট। সেইসময়ে খালেদের প্রতিপক্ষরা তার শরীরে ভারতীয় একটি সিল লাগিয়ে দিতে সমর্থ হয়। জাসদ আর
মুসলিম লীগ সমস্ত ঢাকা শহরে লিফলেট আর পোস্টারে ছড়িয়ে ফেলে, সবকিছুতেই ছিলো শুধু খালেদবিরোধী কথা।
জাসদের প্রকাশিত সাম্যবাদ পত্রিকায় খালেদের চারদিনের অভ্যূত্থান নিয়ে প্রচলিত ইতিহাস তুলে ধরে, খালেদ মোশাররফ
ক্ষমতায় এসেই দেশে সোভিয়েত ভারত রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কাজে লেগে যায়। আওয়ামীলীগ ও তার লেজুড় মণি
মোজাফফর চক্র প্রকাশ্যে শেখ মুজিবের ভাব মূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে লেগে যায়।’ এই কথা বিশ্লেষণ করলে খুব সহজেই
বোঝা যায় জাসদ তখন খালেদকে একজন সেনানায়কের চেয়ে একজন আওয়ামীলীগার হিসেবেই সব জায়গায় তুলে
ধরেছিলো। পরবর্তীতে আওয়ামীলীগের মিছিলে খালেদের মা ও ভাই যখন নেতৃত্ব দেয় তখন সাধারণ সৈনিকদের মনে এই
ভয় ঢুকে যায় খালেদ মোশাররফ তাহলে এবার বিদ্রোহীদেরও বিচার করবে।
৬ নভেম্বর মধ্যরাতের পর থেকেই খালেদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যূত্থান শুরু হলে খালেদ সেটা বুঝতে পারেন। কিন্তু তিনি এর
বিরুদ্ধে পাল্টা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। ৭ নভেম্বর সকালে জোয়ানরা ব্যারাক থেকে বের হয়ে অস্ত্রাগার ভেঙ্গে ফেলে।
জাসদের শ্রেণী সংগ্রামের ডাকে সাড়া দিয়ে তখন তারা অফিসার নিধনে বেরিয়ে পড়ে। ঐদিন সকালে শেরে বাংলা নগরে
ক্যাপ্টেন জলিল ও ক্যাপ্টেন আসাদ মিলে খালেদ মোশাররফ, কর্ণেল হুদা ও হায়দারকে গুলি করে হত্যা করে।

খালেদ মোশাররফের মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় এক সাহসী জীবনের, এক বীরের, কে ফোর্সের কমান্ডারের,
বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা এক মানুষের। লাভবান হয়েছিলেন।

অনেকের কাছেই খালেদ মোশাররফ বাংলাদেশের রাজনীতির এক রহস্য মানব হয়ে আছেন। অথচ খালেদ মোশাররফ
ছিলেন একজন উচ্চাবিলাসী সেনা কর্মকর্তা, খাঁটি দেশপ্রেমিক, একজন সাহসী বীর। রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার কারণেই
তিনি তার কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারেননি। খালেদ মোশাররফের মৃত্যু বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় পুরোপুরি
পাল্টে দেয়। জন্ম হয় এক কালো চশমার। ৩ নভেম্বরে খালেদ মোশাররফের সংগঠিত অভ্যূত্থান কি তাহলে জিয়া আর
তাহেরের ক্ষমতা আরোহণের সিঁড়ি ছিলো। সেই সিড়ি দিয়ে তাহের উঠতে পারেননি বলেই কি আনোয়ার হোসেনদের কাছে
আজ জিয়া বেঈমান আর বিশ্বাসঘাতক ?

বঙ্গবন্ধুর খুনীরা যখন বঙ্গভবনে ক্যান্টনমেন্টে সবত্র দাপটের সাথে ছিলো তখন কেন তাহের বা তার বিপ্লবী জাসদ কোনো
অভ্যূত্থান করেনি ?

জাসদ কেন ঢাকা শহরে খালেদবিরোধী লিফলেট আর পোস্টারে ছড়িয়ে ফেলে?

বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিরুদ্ধে যখন খালেদ অভ্যূত্থান করে বসেন তখন তাহের কেন সিপাহীদের নিয়ে পাল্টা অভ্যূত্থানের জন্য
মাঠে নেমে যান ?

কেন খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে জাসদ আর তাহেরের বাহিনী মিথ্যে অপ্রপ্রচার করতে শুরু করে ?

আমরা কি তাহেরকে আজ বিপ্লবী বলবো, নাকি ক্ষমতালোভী বলবো ?

খালেদ মোশাররফ কি তাহলে জিয়া তাহেরের ক্ষমতার সিঁড়ি ছিলেন ?


যা হোক, বলা হয়ে থাকে খালেদ মোশাররফের লক্ষ্য ছিল অবনতিশীল পরিস্থিতির রাশ টেনে ধরা এবং সেনাবাহিনীতে
শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। উপরন্তু অভ্যুত্থানটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষেও পরিচালিত হয়েছিল এমন ধারণা ছিল। দুই.
বাকশাল ও ভারতপন্থিদের সপক্ষে ছিল এই অভ্যুত্থান। এমন অভিমত তৈরি হওয়ার কারণ ছিল অভ্যুত্থান হওয়ার পরপরই
খালেদ মোশাররফের মা'র নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি অভিমুখে মিছিল যাওয়া। মিছিলটি যে কারণেই হোক না কেন, তা খালেদ
মোশাররফের জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। তিন. সেনাপ্রধানের পদ করায়ত্ত করার লক্ষ্যে খালেদ মোশাররফের
ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে এ অভ্যুত্থান। If Khaled Mosharraf were cruel and shrewd, then he would kill
Ziaur Rahman before the event of 7th November. Then BNP would not have created and most probably
no body would make statements to hightlight Major Zia as the procliamer of Bangladesh independance.
Khaled Mosharraf was one of the three brigade commanders during the Liberation War. Of all the
commanders of the Mukti Bahini, he most accurately assessed the psychological aspect of the war. He
assessed correctly that Pakistanis would have won the war if the majority of Bangladeshis, particularly
the urban educated classes, came to believe that the struggle for Bangladesh was lost. He also correctly
assessed the importance of the media in the struggle.

Accordingly, he adopted a two-pronged, mutually reinforcing strategy.

Firstly, he raised a special guerrilla force comprised of the youth from Dhaka — students of the city’s
major educational institutions, young professionals, and political activists of the city. This group
included men like the current Dhaka mayor Sadeq Hossain Khoka, AL leader Mofazzal Chowdhury Maya,
former editor of Bichitra Shahadat Chowdhury, actor Raisul Islam Assad, Jahanara Imam’ son Shaheed
Rumi etc.

They carried out daring operations inside the occupied city. Bombs were exploded in the
Intercontinental Hotel, USIS building, or DIT building. Pakistanis were engaged in firefight in Farm Gate
or Dhanmondi. Power stations were blown up. And collaborators like Monem Khan were assassinated.
These incidences not only struck terror at the heart of the Pakistani establishment, as the news was
relayed throughout the country by the BBC or other foreign broadcasters, ordinary Bangladeshis knew
that struggle was continuing.

And not just visible targets inside Dhaka, to hamper the Pakistani supply line, Khaled devised a plan to
destroy bridges and culverts across the country. But he was aware that the infrastructure would have to
be rebuilt in the newly liberated country. So he asked engineers (both inside the occupied country as
well among his men) to identify the structural weaknesses in each bridge such that maximum damage
could be done with minimum future repair needs.
Meanwhile, to facilitate the guerrilla operations, Khaled’s forces engaged the Pakistanis in a series of set
piece battles across the Sylhet-Comilla-Noakhali-Tripura border. These battles drew out the Pakistani
forces, and stretched their supply lines, which made it difficult for them to conduct counterinsurgency
measures inside the country. And sometimes, Pakistanis were defeated in these battles. The Battle of
Kasba is particularly notable as an epic battle of 1971. Khaled was hit with a shrapnel in his forehead in
the battle, but the victory was Mukti Bahini’s.

Khaled was successful on both counts. The full ramifications of the overstretched Pakistani supply line
became clear in December, when the Indian army joined the fray and marched on to Dhaka within two
weeks. And the guerrilla actions in Dhaka gave Khaled, and his deputy ATM Hyder, legendary status.

Khaled Mosharraf was often described as an ‘intellectual’. He was trained in special operations in the
west. And he was well read in the theory and practice of insurgency. In the Liberation War Museum,
one can see how he read about urban guerrilla warfare in the Nazi occupied Europe and liberation
struggles in Algeria and Indochina even as he planned his moves. It should be noted that his plan of
conducting highly visible operations in the occupied Dhaka was very similar in nature to the actions of
the Palestinian Liberation Organisation and its off shoots against Israel and its backers. A decade later,
Ahmad Shah Massoud would adopt his two-pronged tactics against the Soviets in Afghanistan.

Khaled contributed to the liberation struggle not just in the battle-field, but also by showing political
acumen.

As early as the last week of March, he implored Rehman Sobhan to convey to the political leadership
that a government is formed immediately, and the Mukti Bahini is given formal commission. This was
important because without a government and commission, Mukti Bahini would be considered
illegitimate rebels, mercenaries, or terrorists in the eyes of the law. Note the reference to ‘legally
constituted’ in this oath of freedom fighters commanded by Khaled.

In July-August 1971, Khondoker Mushtaq negotiated a ‘deal’ with the Pakistanis through the US (with
India’s knowledge) whereby Sheikh Mujibur Rahman would govern Bangladesh, which would continue
to be a part of 6-points based Pakistani Confederation — that is, what Mujib formally demanded in
March. This deal was vetoed by India because it didn’t allow for the return of Hindu refugees to
Bangladesh. The deal also allowed for full amnesty to civilian freedom fighters and political activists, but
not the military men who rebelled against Pakistan. This, and actions of Mujib Bahini, created
discontent among the professional soldiers who formed the backbone of the Mukti Bahini. Many of
them, including Ziaur Rahman and Abul Manzur, wanted a War Council headed by MAG Osmani to
replace the Mujibnagar government. Others such as Abu Taher and MA Jalil wanted to raise forces of
their own outside the command of Osmani. Khaled played a crucial role in ensuring that civilian political
leadership retained command of the Mukti Bahini.

He was also acutely aware of the dependence on India and future political risks this might cause to
independent Bangladesh. To reduce the reliance, he had formulated a plan to buy arms and
ammunition in the European black market through the Bangladeshi community in Britain. This plan was
approved by the Mujibnagar government, but the war was over before it could be enacted.

These days, even people who fought against us in 1971 claim to be defenders of our sovereignty, while
the political-intellectual establishment consists of people who claim to be defenders of the spirit of
1971. Isn’t it peculiar that Khaled Mosharraf, who attained legendary status in 1971, is largely forgotten
now?

Hardly a day goes by when we don’t hear of correcting historical wrongs, of setting the history right.
How come we don’t hear about bringing to justice the murderers of Khaled Mosharraf?

Further reading:

1. Khaled’s own account of the war is here.

2. Jahanara Imam’s Ekatturer Dinguli.

3. ‘Brave of Heart’ by Habibul Alam Bir Pratik.

4. Muldhara Ekattur by Muyeedul Hasan.

একাত্তরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে তিনি ছিলেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে, কুমিলস্না সেনানিবাসে। সেনাবাহিনীর সদস্য
হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্দেশ মানতে বাধ্য ছিলেন মোহাম্মদ আব্দুল বারিক। কিন্তু তাঁর মতো যাঁরা মুক্তির
লড়াইয়ের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলেন, তাঁদের উদ্বেগ আরো বেড়ে যায়। ২৫ মার্চ বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটার পর তাঁরা নিশ্চিত
হয়ে গেলেন, বাঁচতে হলে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার কোনো বিকল্প নেই । ওই সময় তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার
নিয়াজ মোহাম্মদ কলেজে। ওখানকার বাঙালি সৈনিকদের তখন দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। একটির অধিনায়ক নিয়োগ হলেন
মেজর শাফায়াত জামিল, ক্যাপ্টেন আব্দুল মতিনও ছিলেন সেই গ্রুপে। অন্যটির অধিনায়ক হলেন মেজর খালেদ
মোশাররফ। আব্দুল বারিক ছিলেন খালেদ মোশারফের অধীনে।

খালেদ মোশাররফ তখন অধিনায়কোচিত ভূমিকা পালন করলেন। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পরামর্শ করলেন। ঘনিষ্ঠজনদের
স্থানীয় একজনের মাধ্যমে চিরকুট পাঠালেন নিয়াজ মোহাম্মদ কলেজে সেন্ট্রির হাতে যেন দেওয়া হয়। সেই চিরকুটে লেখা
ছিল, বন্ধুরা, আমাদের ঘুম শেষ। দ্রুত চলে আসো। চুপিচুপি এসো, পাঠানরা যাতে বুঝতে না পারে। এখন থেকে ওরা
আমাদের প্রাণের শত্রু। বাঁচতে চাইলে সবাই মেড্ডা মাঠে জড়ো হও। মেড্ডায় রাত আনুমানিক ২টায় খালেদ মোশাররফ,
মেজর মতিন, ক্যাপ্টেন আব্দুল গাফফার, মেজর শাফায়াত জামিল, লে. হারুনুর রশীদসহ উপস্থিত বাঙালি সৈনিকের সংখ্যা
ছিল ৭০ জন। সিদ্ধান্ত হলো_নাশতার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তাদের। নাশতা খাওয়া শুরু হলে খালেদ মোশাররফ
বাঙালি সৈনিকদের অভিযুক্ত করবেন। বাঙালিরা একেকজন পাকিস্তানি সৈনিকদের পাশে গিয়ে করজোড়ে দাঁড়াবে। এর
উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাকিস্তানিরা যাতে উত্তেজিত না হয়। আর একবারে কাছাকাছি হয়ে পাকিস্তানি সৈনিকদের ডিজআর্ম করতে
হবে। নির্দেশের কৌশলও জানিয়ে দেওয়া হলো। সেই অনুযায়ী বাঙালি সৈনিকরা আবার ফিরে যায় কলেজে। নাশতার সময়
হয়ে এলে শুরু হয় সেই কৌশলে পাকিস্তানিদের বন্দি করার কাজ। আব্দুল বারিককেও কপট ধমক দেওয়া হলো। তিনি সঙ্গে
সঙ্গে পাকিস্তানি একজন অফিসারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। হাতজোড় করা অবস্থা তাঁর। অফিসারটি খালেদ মোশাররফের
কথা শোনার পর উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সে বলে, ওদের ফায়ারিং স্কোয়াডে ঢোকানো হোক। পাকিস্তানি অফিসার ও
জওয়ানরা তখন একটি লাইনে দাঁড়ায় এবং প্রত্যেকেই উত্তেজিত, তা বোঝা যায়। ঠিক ওই সময় খালেদ মোশাররফ চোখ
টিপে নির্দেশ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি সৈনিকরা পাকিস্তানিদের ডিজআর্ম করে ফেলে। অবস্থা দেখে ওরা হতবাক হয়ে
যায়। খালেদ মোশাররফ বাঘের মতো গর্জন করে বলে ওঠেন, এই মুহূর্তে তোমরা আত্মসমর্পণ করো, না হলে প্রত্যেককে
গুলি করে হত্যা করা হবে।

জানজুয়া খালেদ মোশাররফকে বলে, এসব কি বলছ খালেদ? আমি তোমার কমান্ডিং অফিসার। খালেদ মোশাররফ নিজেই
অস্ত্র তাক করে ধরেন ওদের দিকে। হুংকার ছাড়েন, আত্মসমর্পণ করো, তা না হলে গুলিবিদ্ধ হবে এই মুহূর্তে।

এখানে বলে নেওয়া ভালো, এই অপারেশন নির্বিঘ্ন করার জন্য আগেই এক পস্নাটুন বাঙালি সৈন্যকে উজানিসার ব্রিজের
কাছে পাঠানো হয়েছিল। যাতে করে কুমিলস্না সেনানিবাস থেকে কোনো পাকিস্তানি সৈন্য না আসতে পারে।

আব্দুল বারিক তখন গোকর্ণঘাট নিরাপদ রাখার দায়িত্বে। শহর থেকে কিছুটা দূর হওয়ার কারণে শহরের খবর তিনি পাননি।
একদিন একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক এসে খবর দিল যে, শহর থেকে বাঙালি সৈনিকরা চলে গেছে। ফলে তিনি রওনা হন
শহরে। তিনি জেলখানায় গিয়ে কয়েদিদের ছেড়ে দেন। আর তাদের হাতে কিছু অস্ত্র দিলেন। তারপর তেলিয়াপাড়া হয়ে
গেলেন ভারতে।
এরই মধ্যে মতিনগরে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট হেড কোয়ার্টার প্রতিষ্ঠা করেছে।

চার-পাঁচ দিন পর জানা গেল, আখাউড়া রেলওয়ে হাই স্কুলের নিচতলায় রাখা হয়েছে ট্যাংক এবং উপরতলায় স্থাপন করা
হয়েছে মেশিনগান। মেশিনগান ছিল বেশ কয়েকটি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এই অবস্থান খুবই বিপজ্জনক। কারণ আখাউড়ায়
তারা প্রবেশ করতে গেলেই মেশিনগানের মুখে পড়তে হবে। পাকিস্তানিদের এ অবস্থান সম্পর্কে বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাওয়া
গেল। আইনুদ্দিন সাহেব বললেন, সেসব মেশিনগান ও ট্যাংক ধ্বংস করতে হবে। তখন আব্দুল বারিকের কাছে ছিল ৪০
পাউন্ড ওজনের ছয়টি বোমা। আইনুদ্দিন সাহেব বললেন, উপরতলায় দুটি এবং নিচতলায় একটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে
হবে।

কাজটা অসম্ভব কঠিন। কারণ আরআর নিয়ে যেতে হবে এমন পথে যা মোটেও গাড়ি চলার উপযোগী নয়। যে জিপ নিয়ে
তিনি ভারতে ঢুকেছিলেন, সেই জিপটি নিয়েই তিনি রওনা হলেন আখাউড়ার উদ্দেশে। সিঙ্গারবিল বিমানবন্দর পেরিয়ে
কিছুদূর গেলেন তিনি গাড়ি চালিয়ে। খড়মপুরের কাছাকাছি গিয়ে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিলেন। সেখান থেকে গাড়ি ঠেলতে
ঠেলতে নিয়ে গেলেন রেললাইনের কাছে। রেললাইনের ওপর গাড়ি রেখে নিশানা ঠিক করলেন বাইনোকুলার ব্যবহার করে।
টার্গেট নির্ভুল হয়েছে কি না, তা তিনি নিশ্চিত হলেন। আর এক মিনিটের মধ্যে বোমাগুলো নিক্ষেপ করা হলো। এইচসিও
ফোটানো হলো নিচতলায়। সর্বমোট সময় নেওয়া হলো দেড় মিনিট। ছয়টি বোমাই সফলভাবে বিস্ফোরিত হলো। ফেরার
পথে গাড়ি চালিয়ে যেতে আর অসুবিধা রইল না। রেললাইনের পাশ দিয়ে কাঁচা পথে গাড়ি চালালেন দ্রুত। তার পরও
সিঙ্গারবিল যেতে সময় লাগল প্রায় পাঁচ মিনিট। ইতিমধ্যে বৃষ্টির মতো আর্টিলারি শেলিং শুরু হয়ে গেছে। আর্টিলারি শেলিং
হচ্ছিল উজানিসার ব্রিজ থেকে এবং মর্টার আক্রমণ হয় আখাউড়া ইপিআর ক্যাম্প থেকে। কিন্তু আব্দুল বারিক চলে এসেছেন
ভারতের অভ্যন্তরে।

এই অভিযানে আব্দুল বারিকের সঙ্গে ছিলেন চট্টগ্রামের জালাল নামের একজন । আরেকজন ছিলেন তাঁর সঙ্গে কিন্তু নাম
মনে নেই। বাকি দুজন ছিলেন সিপাহি।

ফিরে আসার পর এক সপ্তাহ বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পেলেন তিনি। এরই মাঝে একদিন খালেদ মোশাররফ বললেন, জরুরি
একটা অপারেশনে যেতে হবে তোমাকে। আর আখাউড়ার যে অপারেশন তুমি করেছ, সত্যিই এর তুলনা হয় না। আশা
করি, এবারের অপারেশনের ব্যাপারেও তুমি একইভাবে দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হবে।

আব্দুল বারিক জিজ্ঞেস করেন, কোথায় যেতে হবে।


কিন্তু তিনি কোনো জবাব দিলেন না। বললেন, এটা জানতে পারবে মতিনগর যাওয়ার পর। মতিনগর যাওয়ার পরও
অপারেশন সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা গেল না। বলা হলো, হাতিমারা ক্যাম্পে গেলে বিস্তারিত জানা যাবে। ওখানে
দিদারুল আলম সাহেব বিস্তারিত জানাবেন। বিকেল ৫টায় হাতিমারা পেঁৗছানোর পর ক্যাপ্টেন দিদার বিস্তারিত বুঝিয়ে
দিলেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও হস্তান্তর করলেন। আখাউড়া কিংবা অন্য যেসব জায়গা যেমন আব্দুল বারিকের কাছে
অচেনা নিজ থানা বুড়িচংও তার কাছে অচেনা। কারণ তিনি কখনো বুড়িচং যাননি।

যা-ই হোক, তিনি হাতিমারা ক্যাম্পের পাশে দিয়েই হাঁটছিলেন আর ভাবছিলেন, কিভাবে সেখানে গিয়ে আক্রমণ পরিচালনা
করবেন। পথে দেখা হয় জগৎপুর গ্রামের ইপিআর সদস্য নান্নু মিয়ার সাথে। তাকে জিজ্ঞেস করেন, বুড়িচং যাওয়ার পথ
কোনটা। কিন্তু সে জানাল, ম্যাপ অাঁকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন তিনি নিজেই মাটিতে অাঁকতে থাকেন। দুজনে
পরামর্শ করে বুড়িচং যাওয়ার একটা দিকনির্দেশনা তৈরি করা সম্ভব হলো।

তারপর রাত ১০টার দিকে তাঁরা রওনা হলেন বুড়িচংয়ের উদ্দেশে। বুড়িচং পেঁৗছাতে তাদের ঘণ্টা দুই সময় লেগে যায়।
বুড়িচং থানা আক্রমণ করার জন্য সঙ্গে আসা সৈনিকদের তিনি তিন ভাগে ভাগ করে দিলেন। এক ভাগ উত্তর দিক দিয়ে,
এক গ্রুপ পশ্চিম থেকে আরেক গ্রুপ দক্ষিণ থেকে। গ্রেনেড মারবেন আব্দুল বারিক।

অন্ধকার রাত। আনুমানিক ১টা হবে। সন্তর্পণে এগিয়ে যেতে থাকেন আব্দুল বারিক। পা টিপে টিপে চলে যান একবারে
বাংকারের কাছে। দেরি না করে বাংকারের ভেতর মারেন গ্রেনেড। আসলে পাকিস্তানি সৈন্যরা চিন্তাও করতে পারেনি যে,
এভাবে কেউ এসে রাতের অন্ধকারে থানা আক্রমণ করতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় তিন দিক থেকে ফায়ার। বৃষ্টির মতো
গুলি হলেও সেটা ছিল প্রায় একতরফা। অর্থাৎ থানার ভেতর থেকে কোনো গুলিই হচ্ছিল না। আর মনে হচ্ছিল, থানায় থাকা
সৈনিকরা পাশের উত্তর দিকের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু এর পরও একজন মুক্তিযোদ্ধা সেখানে শহীদ হলেন।
এলাকার মানুষ সেই বীর শহীদকে যথাযোগ্য মর্যাদায় দাফন করেন ওই এলাকায়ই। পাকিস্তানি সৈনিকদের ধরা সম্ভব হলো
না। রাত সাড়ে ৩টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আব্দুল বারিক হাতিমারায় ফিরে যান।

অথচ বোস্টার নিজেই নিশ্চিত ছিলেন না মোশাররফ ভারতপন্থী। ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম স্যাক্সবি অবশ্য
তা-ই মনে করতেন। আর পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হেনরি বাইরোড এক তারবার্তায় লিখেছিলেন, খালেদ
মোশাররফকে নিয়ে পাকিস্তান সন্দিগ্ধ। তাঁকে তারা রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী ভাবে। আর মার্কিন সাংবাদিক অ্যান্থনি
ম্যাসকারেনহাস লিখেছেন, মোশাররফ বোকা ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারতেন। তিনি তা করেননি। তিনি
আসলে কিছুই করেননি। জনগণকে আস্থায় নিতে পারতেন, তা-ও করেননি। আসলে কোনো ভূমিকা না রাখার কারণে তাঁকে
প্রাণ দিতে হয়।

You might also like