You are on page 1of 3

ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি র শতবর্ষ পূর্তি র দিন আজ- ১৭ অক্টোবর ২০২০। দ্বিতীয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল (কমিনটার্ন)

মস্কো ও পেট্রোগার্ডে শুরু হয় আগস্ট ১৯১৯ সালে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২১৮ জন প্রতিনিধি যোগ দেন। সোশালিস্ট
পার্টি ও সোশাল ডেমোক্রাটদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন ৫৪ জন। এশিয়া থেকে ৩০ জন প্রতিনিধিত্ব করেন।
ভারতের প্রতিনিধি ছিলেন যুগান্তর দলের কমরেড মানবেন্দ্র নাথ ( এম এন) রায় যার আসল নাম নরেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য ও
অনুশীলন সমিতির কমরেড অবনী মুখার্জী ( রাসবিহারী বসুর সহযোগী ছিলেন)। কমরেড লেনিনের পরামর্শে এঁদের
দুজনের উদ্যোগে ১৭ অক্টোবর ১৯২০সালে গঠিত হয় ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি যার সদস্য ছিলে এম এন রায়, ইভলিন
রায়, অবনী মুখার্জী, রোজা মুখার্জী, মহম্মদ আলি, মহম্মদ শফিক ও আচার্য। ভারতীয় মুহাজির যারা হিজ্রত মেনে ভারত
থেকে নির্বাসিত হন তারাই ছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি র ( তাসকন্দ গ্রুপের) প্রথম সদস্য ও সমর্থক।
কমিউনিস্ট পার্টি র শতবার্ষিকী উপলক্ষে ৪ঠা ডিসেম্বর ২০১৯ পার্টি “Communist Party @ 100 with the People,
for Freedom 1920-1947.” নামে এক পুস্তিকা প্রকাশ করে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূ মিকা প্রসঙ্গে
মূলত চারটে বিষয়ের উল্লেখ করা হয়।
প্রথমতঃ পূর্ণ স্বরাজের পক্ষে দাবি তু লেছিল কমিউনিস্টরা ১৯২০ সালে । গান্ধীজীর আপত্তি থাকায় দাবিটি কংগ্রেসে
গৃহীত হতে সময় লেগে যায়। অবশেষে ১৯৩১ সালের করাচী কংগ্রেসে পূর্ণ স্বরাজ স্বীকৃ তি সনদে স্থান পায়।
১৯২১ সালে আহমেদাবাদ কংগ্রেসে কমরেড হস্রত মোহানি ও স্বামী কু মারানন্দ পূর্ণ স্বরাজের দাবি পেশ করেন,
তাতে স্বাক্ষর করেন কমরেড এম এম রায় ও অবনি মুখার্জি । সেসময় জহরলাল নেহেরু ও সুভাষ চন্দ্র বসু এই
দাবিতে সোচ্চার হন।
দ্বিতীয়ত সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রথম কন্ঠস্বর কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ওঠে। ১৯২২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে
কমিউনিস্ট পার্টি এই সিদ্ধান্তে আসে যে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ঐক্য গড়ে শান্তি ও সংহতির বাতাবরণ সৃষ্টি করে
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ করতে হবে। আজও তা অপ্রতিহত আছে।
বিশেষ করে যে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কংগ্রেসের সহায়তায় কমিউনিস্টরা প্রতিহত করতে পেরেছিল, বিশ্বব্যাপী
আর্থিক সংকটে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতার কারণে তা আজ আবার ভয়াবহ বিপদের সম্ভাবনা নিয়ে
ভারতের সংবিধান, সংহতি ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে আঘাত করছে। এই সময়ে ভোটে হেরে যাওয়া কমিউনিস্টদের
ভূ মিকা ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে; তারা বৃহত্তর বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের যৌথ মঞ্চ গড়ে দেশব্যাপী ছাত্র
যুব মহিলা ও সর্বস্তরের শ্রমজীবী মানুষের সমাগম ঘটিয়ে আন্দোলন দুর্বার করে তু লেছে।
তৃ তীয়ত ভু মি সংস্কারের দাবিতে অনবরত সংগ্রামের ডাক দিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি যা কিনা স্বাধীনতা সংগ্রামে কৃ ষক
শ্রেণীর অংশগ্রহণে মুখ্য ভূ মিকা পালন করে। সে সময়ে তেলেঙ্গানা, ওরলি, পুন্ন্যাপ্পা ভায়লার, সুর্মা, তেভাগা ভূ মি
সংস্কারের দাবিতে এসব কৃ ষক আন্দোলন গড়ে তু লেছিল কমিউনিস্ট পার্টি । এই আন্দোলনের সুফল হল জমিদারি
নির্মূল করতে আইন প্রণয়ন।
তিনটি প্রদেশে শাসনভার হাতে আসার পরে ভু মি সংস্কারের কাজ সফল করা হয়। কৃ ষকের হাতে জমি চলে
যাওয়ায় জোতদারি ব্যবস্থার অবসান ঘটে। সামন্তবাদি মানসিকতা কিন্তু থেকে যায় এক শ্রেণীর মানুষের মনে।
কৃ ষকের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি হওয়ার ফলে প্রয়োজন হয় শিল্প গঠনের দিকে। শিল্প উন্নয়নে হাত দিতেই রামধনু জোট
সৃষ্টি হয় উগ্র বাম, দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, ধর্মীয় ও সমাজসেবী এন জি ও, সোশ্যাল ডেমোক্রাট ও
সুখে থাকা শিল্পী সাহিত্যিক প্রমুখদের। এবং তারা সফল হয় তেত্রিশ বছরের ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকারের
পতন ঘটাতে।
চতু র্থত কমিউনিস্টরাই প্রথম ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের ডাক দেয়। পরবর্তী কালে যা আইনগত ভাবে কার্যকরী করা
হয়।
এই পুস্তিকাতে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর
পূর্তি উপলক্ষে সংসদের মধ্যরাত্রি কালীন অধিবেশনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মা বলেন-“কানপুর জামশেদপুর
ও আহমেদাবাদের ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘটের সময় দিল্লি থেকে ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪২ লন্ডনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এক বার্তা পাঠানো
হয় যাতে বলা হয় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি র বেশীরভাগ সদস্যদের ব্যবহার থেকে সর্বতোভাবে পরিষ্কার যে এই পার্টি
ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের দ্বারাই গঠিত”। জহরলাল নেহেরু ১৯৩৩ সালে লেখেন- “The true civic ideal is the
socialist ideal, the communist ideal.”
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু তাঁর ইন্ডিয়া দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল ( ১৯২০-৪২) গ্রন্থে পৃষ্ঠা ২১৩ লিখেছেন- কংগ্রেসের
দ্বিতীয় জনপ্রিয় নেতা জহরলাল নেহেরু ১৮ ডিসেম্বর ১৯৩৩ এক প্রেস বিবৃতিতে জানান-
“ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বিশ্বের সামনে এখন মাত্র দুটি পথ খোলা আছে, এক যে কোন ধরণের
কমিউনিজম অথবা যে কোন ধরণের ফ্যাসিজম এবং আমি অবশ্যই প্রথম পথটির পক্ষে আছি। আমি
ফ্যাসিজমকে ভীষণভাবে ঘৃণা করি কারণ ফ্যাসিজম হল এক নিখাদ নির্মম প্নথা যা বর্ত মানের পুঁজিবাদী
ব্যবস্থাকে যেন তেন প্রকারে বাচিয়ে রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কমিউনিজম ও ফ্যাসিজমের মধ্যে কোন তৃ তীয় বিকল্প
থাকতে পারে না, দূটর যে কোন একটিকে গ্রহণ করতে হবে, তাই আমি কমিউনিজমকেই আদর্শ পথ হিসেবে
বেছেছি। এই আদর্শ প্রয়োগের পদ্ধতি প্রকরণ নিয়ে প্রাচীনপন্থী কমিউনিস্টদের অনুসৃত অনেক পদ্ধতি নিয়ে
আমার মতপার্থক্য আছে। আমার বিশ্বাস এই পথ সময়ের সঙ্গে ও দেশভেদে মানানসই ও ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু
কমিউনিজমের মূল মতাদর্শ ও তাঁর বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা নিয়ে আমি সহমত পোষণ করি”।
নেতাজি এই বইতে ২৮ তম অধ্যায়ে বিস্তৃ ত ভাবে বর্ণনা করেছেন ন্যাশনাল ফ্রন্ট, কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি ,
ফরোয়ার্ড ব্লক, লেফট কো অর্ডি নেশন কমিটি, র‍্যাডিকাল লীগ ও কংগ্রেস ইত্যাদির মধ্যে সংহতি ও লাইনের
মতানৈক্যের বিষয় যা রাজনীতিতে স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এটা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করেছেন যে আকারে ছোট
হয়েও কমিউনিস্ট পার্টি তার শ্রমজীবী শ্রেণীর স্বার্থে সংগ্রামে একচু লও বিচ্যুত হয়নি বরঞ্চ গুরুত্বপূর্ণ ভূ মিকা
পালন করেছে।
পূর্ণ স্বরাজ ছাড়াও ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শ্লোগান কমরেড হসরত মোহানির সৃষ্টি। হসরত মোহানি, ভগত সিং,
বটু কেশ্বর দত্ত, রাজ গুরু, চন্দ্রশেখর আজাদ, শচীন্দ্র নাথ স্যান্যাল, সুখদেব থাপার, সোশালিস্ট রিপাবলিকান
পার্টি তে ছিলেন। এইসব দেশপ্রেমী কমিউনিস্টরা কারাগারে শ্লোগান দিতেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ‘সাম্রাজ্যবাদ
মুর্দাবাদ’। জাতীয় ফ্রন্টে ও কংগ্রেস সোশালিস্ট পার্টি তে বহু বামপন্থী দল ছিলেন যারা মার্ক্সবাদে ও সর্বহারার
একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। অগণিত বিপ্লবীরা নামে ছোট ছোট বিপ্লবী পার্টি করেও কমিউনিস্ট পার্টি র সঙ্গে
সংযোগ রেখে চলতেন। কারণ কমিউনিস্টরা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা চেয়েছিলেন স্বরাজ,
স্বাধীনতা, আজাদি যে শব্দেই অভিহিত করা হোক না কেন কমিউনিস্টদের কাছে এর অর্থ স্পষ্ট ছিল। সর্বহারার
শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই তাই আজাদির মানে হল একটি সুনির্দি ষ্ট পথে সামাজিক ও অর্থনৈতিক
পরিবর্ত নের হদিশ খোঁজা যেখানে জমিদারতন্ত্র থাকবে না, সামন্ততন্ত্র বিলুপ্ত হবে, জাত পাত ধর্মীয় মেরুকরণ
উচ্ছেদ হয়ে এক সাম্যবাদী সমাজতান্ত্রিক সরকার রাজত্ব করবে। এইসব পার্টি র একত্রীকরণ ঘটে কানপুরের প্রথম
সম্মেলনে ২৬শে ডিসেম্বর ২০২৫ সালে। অবিভক্ত বঙ্গের নেতা কমরেড মুজফফর আহমেদ, অবিভক্ত বোম্বের
নেতা কমরেড এস এ ডাঙ্গে, অবিভক্ত মাদ্রাজের নেতা কমরেড সিঙ্গারাভেলু চেত্তিয়ার, এবং যুক্ত প্রদেশের
নেতা কমরেড সওকত ওসমানি গঠন করেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি । এর আগে যে কমিউনিস্ট পার্টি
ভারতে ছিল তা গঠিত হয়েছিল ১৭ অক্টোবর, ১৯২০ সালে কমরেড এম এন রায় ও তাঁর পত্নী ইভলিন,
কমরেড অবনী মুখার্জি ও তাঁর পত্নী রোজা, মহম্মদ আলি, মহম্মদ শফিক ও আচার্য। ভারতীয় মুহাজির যারা
হিজ্রত মেনে ভারত থেকে নির্বাসিত হন তারাই ছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি র ( তাসকন্দ গ্রুপের) প্রথম
সদস্য ও সমর্থক।
প্রগতিশীল লেখক সংঘ, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, গঠনের মধ্য দিয়ে সাংস্কৃ তিক জগতের শিল্পী কলা কু শলীদের
ভূ মিকা অনবদ্য করে গড়ে তোলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি । যাদের অবদানে এই সু সংস্কৃ তি ভারতব্যাপী
ছড়িয়ে পড়ে তারা হলেন- ডক্টর মেঘনাদ সাহা, কে এ আব্বাস,ডক্টর হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা, শম্ভু মিত্র, শাহির
লুধিয়ানভি, মজরুহ সুলতানপুরি, বলরাজ সাহনি, চেতন আনন্দ, মুল্ক রাজ আনন্দ, সলিল চৌধুরী, পণ্ডিত
রবিশঙ্কর। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কানু ঘোষ, দুর্গা খোটে, স্ত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, হাবিব তনভির কৈফি আজমি,
শাবানা আজমি, ইস্মত চু ঘতাই, শৈলেন্দ্র, দীনা পাঠক, এ কে হাঙ্গল, জাভেদ আখতার, ফনি মজুমদার,
হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটক, বাসু ভট্টাচার্য এম এস সাথ্যু প্রমুখ অগণিত সৃষ্টিশীল শিল্পী,
সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার ও অভিনেতারা।
কমিউনিস্ট পার্টি র মানসিকতার সঙ্গে সহমত বহু শিল্পী অধ্যাপক বিজ্ঞানীদের গ্রেপ্তার হতে হয়েছে জেল খাটতে
হয়েছে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। বারংবার বৃটিশ সরকার কমিউনিস্টদের জেলে পাঠিয়েছে ফাঁসি দিয়েছে নিষিদ্ধ
করেছে কারণ তারা পূর্ণ আজাদির দাবি থেকে তখনও নড়েনি আজও নড়ছে না। তাই ঘটছে জে এন ইউ,
যাদবপুর, জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃ তি ছাত্রদের দেশদ্রোহীর তকমা তাও এমন এক দলের সরকারের
কাছ থেকে যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল যারা বরাবর সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী, যারা
পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল , যারা ফ্যাসিবাদের সমর্থক।
তেভাগা আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, সাতের দশকে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসে সর্বশেষ বিজেপি- তৃ নমূল
সরকারের মদদে সৃষ্ট সন্ত্রাসে মৃত লড়াকু কমরেডরা, কমরেড সুদীপ্ত, কমরেড সফদার হাসমি, থেকে রোহিত
ভোমুলা, গোবিন্দ পান্সারে, গৌরি লঙ্কেশ ভারাভারা রাও কমিউনিস্টদের এক শহাদত-পরম্পরা।

You might also like