You are on page 1of 6

মাতলো রে ভু বন

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

ওঁ ভবতাপ প্রনাশিন্যৈ আনন্দঘন মুর্ত্যয়ে জ্ঞান ভক্তি প্রদায়িন্যৈ মাতৃ স্তুভ্যম নমহোনমঃ।

সর্ব মঙ্গল্যামঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরী নারায়নী নমস্তুতে।

(দেবীমাহাত্ম্যম)

The oldest surviving manuscript of the Devi Māhātmyam, on palm-leaf, in an early Bhujimol script, Bihar or Nepal, 11th century

দুর্গা পুজা ভারতের সবচেয়ে খরচা বহুল সবচেয়ে জনপ্রিয় বর্ণাঢ্য ধর্মীয় উৎসব। শুধু ধর্মীয় অভিধায় এর মান
হানি করা হয়। এই পূজার এক ব্যাপ্তি আছে এক গভীরতা আছে। এই পুজাকে ঘিরে কয়েক হাজার কোটি
টাকার নগদ অর্থনীতি আছে। প্রাচীন সময়ে যখন এই বঙ্গ দেশে জাতপাত ও ধর্মান্ধতা তীব্র ছিলো তখনও
মূর্তি কূ মোর পাড়ার, মূর্তি র কেশ মুসলমান কন্যাদের হাতে তৈরি, ঢাকিরা চামার শ্রেণীর, পুজোর প্রথম মাটি
পতিতা বাড়ির, পুজা সামগ্রী বিভিন্ন শ্রমজীবী শ্রেণীর, পূজার ফু ল মালাকার শ্রেণীর, পুজারি ব্রাহ্মণ শ্রেণীর
এদের অবদানে সমৃদ্ধ হত দুর্গা পূজো। সম্ভবত শ্রেণী সমন্বয় ও ধর্ম নিরপেক্ষতার তাৎপর্য এই পুজাকে
এতকাল বিস্তৃ ত করে রেখেছে।

এই পূজার মুল সময় বসন্ত কাল তাই তাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। রাবণ ছিলেন শিবের পূজারী শিবের পূজোর
বিপরীতে চণ্ডী পূজা চালু করা হয়তো একটা কারণ হতে পারে। যেমনটা আছে চণ্ডী মঙ্গল কাব্যে। রামায়নে বলা
আছে শ্রীরাম রাবণ বধের নিমিত্ত এই পুজা শরত কালে করেছিলেন তাই একে অকাল বোধন বলা হয়। আর
এই পূজা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় যে রাজ্যে সেইখানে শ্রীরামের কোনদিন আসা হয়নি অন্তত কোন পুরাণ পৌন্ড্র
দেশে রামের পদধুলির কথা লেখেনি। বঙ্গ দেশে মা দুর্গার বাপের বাড়ি। বঙ্গ দেশে কন্যা সন্তানকে ‘মা’ বলে
ডাকার রেওয়াজ আছে। আবার বর্ষা বিদায়ের পর ক্ষেতের নতু ন ফসলের পূজোর প্রচলন আছে। ওদিকে
আবার এই সময়েই ভারত জুড়ে চণ্ডী পাঠের রেওয়াজ আছে। বঙ্গ দেশে চন্ডীমঙ্গল কাব্যে কালকেতু ফু ল্লরার
উপাখ্যান ও ধনপতি সওদাগরের উপাখ্যান আছে। মা চন্ডীর কৃ পাতে কালকেতু র গুজরাত রাজ্য সৃষ্টির কথা
আছে। ধনপতি সওদাগরের কমলে কামিনী দর্শনের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার পূজার প্রচলনের কথা

1
আছে। আবার গুজরাতে অর্থাৎ প্রাচীন সুরাটে সুরত রাজার ওপর মা চণ্ডীর কৃ পার কথাও চালু আছে।
সাঁওতালদের মধ্যে ‘হুদুর দুর্গা’ পূজোর চল আছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এক জম্পেশ উৎসবের সূচনা কেউ
একজন করে গেছিলেন যে উৎসবের নাম দুর্গা পূজো।

দেবী মাহাত্ম্যমে পূজিত দেবীর নাম চন্ডিকা বা চন্ডী। বঙ্গে চন্ডী পাঠ জনপ্রিয় করে গেছেন বানী কু মার ও বীরেন্দ্র
কৃ ষ্ণ ভদ্র মহাশয়। বঙ্গবাসী দুর্গা পূজো করবে আর মহালয়া প্রোগ্রাম শুনবে না তা হবে না । দেবীমাহাত্ম্যম থেকে
মহালয়া এত হাজার বছরের বিবর্ত নের মধ্য দিয়ে পাওয়া গেছে আজকের কর্পোরেট দুর্গা পূজোকে। যেখানে
পূজোর আনন্দের চেয়ে পূজোর আড়ম্বর বেশি। যদিও এখনও বাড়ির পূজো ও বারোয়ারি পূজো দুইই প্রাচীনত্বের
পাল্লায় সমান মর্যাদা পায়। রাজা, জমিদার, ধনী ব্যবসায়ীর পূজো হল বাড়ির পূজো। আর সম্মিলিত চাঁদার
জোরে যে পূজো হয় তার নাম বারোয়ারি পূজো। ১৭৯০ সালে হুগলীর গুপ্তি পাড়ার বারোজন বন্ধু (ইয়ার)
জমিদারের বাড়ির তোয়াক্কা না করে এক গণতান্ত্রিক পূজোর সূচনা করেন তারা নাম দিয়েছিলেন বারো ইয়ারি
পুজো। সে সময় ১৬৮৬ সালে কলকাতা নগরীর পত্তন হলেও হুগলীর গুপ্তিপাড়ার পৃথক ঐতিহাসিক
তাৎপর্য ছিল বেশ কয়েক শতক।

পণ্ডিতেরা এই পূজো নিয়ে ভিন ভিন্ন মত পোষণ করেন। কেউ বলেন এটি প্রকৃ তি পূজা। সাঁওতালদের ‘হুদুর
দুর্গা’ অবশ্য তাই। পূজার উপাচারেও তারই লক্ষণ। সাঁওতালদের মতো অন্য আরণ্যক উপজাতিরাও মনে
করেন মহিষাসুর দ্রাবিড় জাতির রাজা ছিলেন এবং যেহেতু তাদের সমাজে নারীশক্তির অবমাননা নেই তাই
বৈদিক শ্রেণীর দেবতারা শ্বেতবর্ণা দেবীর হাতে অস্ত্র তু লে দিয়ে মহিষাসুর নিধন করেছিলেন। মহিষাসুর নারীর
বিরুদ্ধে লড়াই করতে চান নি। এমনটা মহীশুরের আদিবাসীরাও বিশ্বাস করেন এবং তারা মহিষাসুরের পুজো
করে শোক পালন করেন নয় দিন।

পুরাণের কথা ধরেই এগোনো যাক।

দুর্গাকে কেউ বলেন সিন্ধু সভ্যতার আদি দেবী ঊষা। দেবী ঊষাকে দেবরাজ ইন্দ্র পরাজিত করতে না পেরে তার
রাজ্যের মাটির তৈরি কৃ ষিবাঁধ (বৃত্রাসুর) বজ্রাঘাতে ধ্বংস করে বন্যায় রাজ্য ভাসিয়ে দেন, ঊষাকে পর্বতে নিয়ে
গিয়ে ধর্ষণ করে বশে আনতে না পেরে অগত্যা ব্রহ্মার কাছে নিয়ে যান। ব্রহ্মার কাছে ঊষা আত্ম সমর্পণ করেন
এই শর্তে যে তার নাম গান সব দেবদেবীর আগে করতে হবে এবং যুগে যুগে তাকেই ফসলের দেবী হিসেবে
পুজো দিতে হবে। ব্রহ্মা উষা লগ্ন সৃষ্টি করেন ও যুগে যুগে ত্রিলোকে তাকে ফসলের দেবী হিসেবে পুজো চালু
করেন। ঋক বেদের আদি দেবী শাকাম্ভরী শাক অর্থাৎ ফসলের প্রতীক। কোরানেও এক উষা দেবীর উল্লেখ
আছে। দেবী পূজা নির্মূল করতে যে তিনজন দেবীর বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মের নবী হজরত মহম্মদ যুদ্ধ করেন তারা
হলেন ঊষা লতা ও সোমান্নত । ঊষাকে এখানে যে বেশে বর্ণনা করা হয়েছে তা মহাকালীর নগ্ন রূপের মতোই।

2
শ্রী রাম থেকে সাঁওতাল রাজা পর্যন্ত ‘মহিষাসুর বধ’ গল্পে শ্বেতকায় বনাম কৃ ষ্ণকায় , আর্য বনাম অনার্য,
হিমাচল বনাম বিন্ধ্যাচলের লড়াইয়ের কাহিনীর রোমাঞ্চ আছে। আর্য ধর্মে সিত, অসিত, তাম্র ও পীত জাতির
বর্ণ ভেদ ছিল। বৈদিক ধর্মে জাতি ভেদে তা হয়ে যায় আর্য, দ্রাবিড়, নিষাদ, কিরাত। ব্রাহ্মন্য ধর্মে সেই বর্ণভেদ
পেশাভিত্তিক হয়ে দাঁড়ায় ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। যুগে যুগে এদের মধ্যে বর্ণ যুদ্ধ চালু ছিল। যেহেতু শেষ
অবধি বৈদিকরা জয়ী হয়েছিল তাই বাকিদের জয় পরাজয়কে তু চ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয়েছে বৈদিক স্তোত্রে।

দেবী দুর্গা কোথাও বিন্ধ্যবাসিনী কোথাও দধিমতী মাতা নামে পূজিত হন। দধিমতী মাতা রাজস্থানের নাগৌর
জেলার দধীচি ব্রাহ্মণদের দেবী। এই দেবী মন্দিরে যে লিপিতে তার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা আছে তার নাম দধিমতী
মাতা লিপি। স্থানীয় বিশ্বাস এই দেবী দধীচি মুনির বোন। ইনি বিকটাসুর দৈত্যকে বধ করেছিলেন। এই দেবীকে মা
লক্ষ্মীর অংশ বলে মানা হয়। দধিমতী মাতা লিপির অস্তিত্ব খৃস্ট পূর্ব ৬০৮ শতাব্দীতে ছিল। এখানকার দধিমাতা
মন্দিরে দেবীমাহাত্ম্যম লিখিত আছে।

সবচেয়ে প্রাচীন ভূ র্জ পত্রে লেখা পুঁথি হল মার্ক ন্ডেয় পুরাণ যার ৮১-৯৩ অধ্যায়ে ‘দেবীমাহাত্ম্যম’ এর উল্লেখ
আছে। ওই গ্রন্থে ‘দেবীমাহাত্ম্যম’ যুক্ত হয়েছে পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগে। দেবী মাহাত্ম্যম এসেছে ঋক
বেদে উল্লিখিত ‘দেবীসুক্ত’ থেকে। ‘দেবীসুক্তম’ এর এই দেবী প্রথম স্বীকৃ ত এক মহীয়সী নারী যার থেকে
শক্তিপূজার শুরু। পুরাণ শাস্ত্রে এঁকে ঋষিকা নামে অভিহিত করা হয়েছে।

অহং রাস্ট্রী সগমিনি বসুনা চিকিতু ষি প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম ।

তা মা দেবা ব্যায়াদধু পুরুত্রা ভু রিস্তাত্রা ভূ র্জা ওয়েশয়নতিম্‌।।

আমিই মহাবিশ্বের অধিশ্বরী, আমিই বসুধার ঐশ্বর্য,‌আমিই প্রথম পুজার যোগ্যা দেবী

তাই দেবতাকু ল বিভিন্ন প্রকারে বিভিন্ন আকারে আমায় পূজিত করে ( তৃ তীয় স্তোত্র দেবীসুক্ত)

এই প্রকাশের দর্শন ঋষি মার্ক ন্ডেয় তার শিষ্য জৈমিনিকে উপাখ্যান (parable) আকারে বলছেন দেবীমাহত্ম্যমে
দুটি ভাগে। প্রথম ভাগ আলোকিত সগুনা স্বরূপা দ্বিতীয় ভাগ অনালোকিত নির্গুণা নিরূপা। প্রথম ভাগের গল্প
মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহা সরস্বতী। দ্বিতীয় ভাগের গল্প সত্ত্ব রজঃ তম।

ত্রিদেবীর মাহাত্ম্যকে কোন কোন পণ্ডিত এই ভাবে বর্ণনা করেছেন। শক্তি বা বিমর্ষ পরম চেতনায় সমাহিত,
তিনিই সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংসের প্রয়োজনীয় রসদ। তাকে ছাড়া পরম চেতনায় উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। যেমন
শক্তিকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, শুধু এক শক্তি থেকে অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হয় মাত্র, তেমনি আদি
পরাশক্তি বিভিন্ন কার্য সম্পন্ন করতে নিজের রূপের বারংবার পরিবর্ত ন ঘটান। ভগবান পুরুষ ও নারী ― দুই
রূপেই উপস্থিত। কিন্তু শক্তির সমস্ত স্বরূপই ত্রিদেবীর মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী ও মহাকালী রূপে প্রকাশিত।
অর্থাৎ, নিরাকার ঈশ্বর সৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন (সরস্বতী বা শ্রুতি বা বিদ্যা), স্থিতিশক্তির মাধ্যমে

3
সেই জগতের সংরক্ষণ করেন (লক্ষ্মী বা আলোক বা সম্পদ) এবং সংহারশক্তির মাধ্যমে ধ্বংস করেন
(মহাকালী বা তাপ বা সামর্থ্য, ধংস)। দেখা যায়, দেবতারা সৃষ্টি, পালন কিংবা ধ্বংস করতে পারেন না, কারণ
তাদের সেই গুণ নেই। তাই আদ্যাশক্তি গৌরী পার্বতী অসুর বিজয়ে তাদের রক্ষা করেন। পরব্রহ্ম নিজে তিনটি
ভাগে বিভক্ত হন ও তিনটি কু ষ্মাণ্ড তৈরি করেন। প্রথম অণ্ড প্রস্ফু টিত হয়ে প্রথম পুরুষ নারায়ণ এর উৎপত্তি
হয় আর এই ব্রহ্ম ছিলেন নারায়ণী (ইনি লক্ষ্মী নন, এখানে নারায়ণী হলেন বিষ্ণু র বোন পার্বতী পুরান অনুসারে
নারায়ণী শব্দের অর্থ বিষ্ণু র বোন) জন্ম হয়। নারায়ণীকে গৌরী পার্বতী দেবীও বলা হয় অন্যান্য দেবীর তার
অংশ তিনি শিবের জায়া। এই সময় তিনি সাকার স্বরূপে ছিলেন না। ব্রহ্মা আদ্যাশক্তির পূজা করলে, দেবী
বিষ্ণু র নেত্র থেকে সাকার স্বরূপে আবির্ভূ ত হন। দ্বিতীয় অণ্ড থেকে সংহারক শিব ও চতু র্থ মুখ থেকে জন্ম নেয়
বিদ্যার দেবী সরস্বতী। অণ্ড থেকে শিবের জন্ম হয় প্রধান পুরুষ রূপে, এবং সরস্বতীর জন্ম হয় নিরাকার স্বরূপে,
যিনি পরে চারটি বেদের জন্ম দেন। বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে ব্রহ্মা পরম জ্ঞানকে আহ্বান করেন, তখন সরস্বতী
সাকার স্বরূপে প্রকট হন ও ব্রহ্মার লীলা সঙ্গিনী হন। তৃ তীয় অণ্ড থেকে ব্রহ্মা ও শিবের তৃ তীয় মুখ থেকে জন্ম
হয়। ব্রহ্মা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির দায়িত্ব নেন এবং লক্ষ্মী তার রসদ জোগান দেওয়ার ভার নেন।

মহালক্ষ্মী অংশে সবচেয়ে জনপ্রিয় মহিষাসুর বধ উপাখ্যান।

দুর্গা সপ্তশতী ( সাত শত শ্লোক) মার্ক ণ্ডেয় পুরাণেরই অংশ। দেবতাদের সহায়তা দানে মাতা অম্বিকার বিভিন্ন
রূপে অসুর দলনী ভূ মিকা বর্ণিত হয়েছে। বিষ্ণু র কানের ময়লা থেকে দুই অসুরের জন্ম হয় তারা হলেন মধু ও
কৈটভ। এরা দুই ভাই যখন ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উদ্যত হয় তখন ব্রহ্মা মা ভগবতীর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণু র চক্ষু
উন্মীলিত করেন অম্বিকা এবং বিষ্ণু ৫০০০ বছর যুদ্ধ করার পর মধু ও কৈটভকে পরাজিত করেন।

মাতা দনু তার দুই পুত্র রম্ভ এবং করম্ভকে তপস্যা করে বর পাবার জন্য কৃ চ্ছ সাধন করতে আদেশ দেন। সেই
মতন দুই ভাই একজন জলে অপর জন স্থলে দাঁড়িয়ে ব্রত শুরু করেন । রম্ভ অগ্নি পূজা এবং করম্ভ বরুণ
পূজায় নিমগ্ন হন। দেবরাজ ইন্দ্র কু মীর এর রূপ ধরে এসে জলের মধ্যে করম্ভকে হত্যা করেন। কিন্তু রম্ভ অগ্নির
বর লাভ করেন। এই বরের ক্ষমতায় রম্ভর পুত্র ত্রিলোকের রাজা হবেন । রম্ভ কিছুকাল পরে এক মহিষীর প্রেম-
বিবাহ করেন। মহিষী গর্ভ বতী হন। এদিকে মহিষীর প্রেমিক এক মহিষ মহিষীকে নিয়ে পালিয়ে যান। রম্ভ তার
পত্নীকে উদ্ধার করতে গিয়ে প্রেমিক-মহিষ এর সাথে লড়াইয়ে প্রাণ হারান। রম্ভকে যখন চিতায় তোলা হয় মহিষী
তার সতীত্ব প্রমাণ করতে সেই আগুনে ঝাঁপ দেন। যমদেব তাকে বাঁচান এবং রম্ভের আত্মাকে মহিষীর গর্ভে
প্রবেশ করান। একই গর্ভ থেকে জন্ম নেন রক্তবীজ ( রম্ভ) এবং মহিষাসুর। মহিষী মাতা এবং মানুষ পিতার
অংশ হওয়ায় মহিষাসুর মহিষ এবং মানুষের রূপ ধরতে পারতেন। রক্ত বীজের উপর বর ছিল তার প্রতিটি
রক্ত বিন্দু থেকে নতু ন এক রক্তবীজ সৃষ্টি হবে। মহিষাসুরের উপর ব্রহ্মার বর ছিল কোন পুরুষ মানুষ জলে স্থলে
অন্তরীক্ষে তাকে নিধন করতে পারবে না।

মহিষাসুরের বিশাল অসুর বাহিনীর সাথে ইন্দ্রের বিশাল দেব বাহিনীর প্রবল যুদ্ধ হয় এবং ইন্দ্র পরাজিত হন।
মহিষাসুর স্বর্গের দখল নিয়ে নেয়। ইন্দ্র তার সাকরেদ দেবতার বাহিনী নিয়ে এসে ব্রহ্মা বিষ্ণু শিবের কাছে সাহায্য

4
প্রার্থনা করেন। দেবতাদের ক্রোধাগ্নির লেলিহান শিখা থেকে এক তেজস্বিনী মোহিনীর সৃষ্টি হয়। ইনি হলেন
আদ্যাশক্তি মহামায়া। সেই মোহিনী নারীর কান্তি অপরূপ, মাথায় কালো চু লের ঢল, দুটো নয় তার অনেক হাত
এবং পরনে মলিন বসন। দেবতাদের যার কাছে যা ছিল তাই দিয়ে দেবীকে সাজালেন। ফর্সা রঙের রূপ মঞ্জরী
সেজে উঠলো লাল কাপড়ে , অঙ্গ ভূ ষণে, অস্ত্রাদিতে এবং বাহন হিসেবে পেলেন সিংহ। অম্বা বা অম্বিকা মূর্তি
কিন্তু বাঘের উপর আসীনা।

(বাহন নিয়ে বিতর্ক আছে। হিমালয়ে সিংহ বা বাঘের অস্তিত্ব প্রমাণিত নয়। বিন্ধ্যাচলে কিন্তু সিংহের অস্তিত্ব ছিল। বাঘের অস্তিত্ব
বঙ্গদেশে ছিল। বঙ্গ দেশ বিন্ধ্যাচল এর অন্তর্গত ছিল কিনা বিতর্ক আছে।)

‘শ্রী দুর্গা সপ্তশতী রহস্যম’ অনুযায়ী আদ্যাশক্তি মহামায়া হলেন মহালক্ষী। ইনিই তিন রূপে তিন দেবতাকে
শ্রেষ্ঠকে বরন করেছিলেন। ব্রাহ্মনী, বৈষ্ণবী এবং মহাকালী বা মহেশ্বরী। দুর্গা শক্তি দুই ধরণের নিয়ন্ত্রণ শক্তি
হিসেবে কাজ করেন। প্রাকৃ তিক ভাবে তিনি আত্ম শক্তি, প্রাকৃ তিক শক্তি, পঞ্চ মহাভু ত শক্তি। সাধারণ শক্তি
হিসেবে তিনি যদাশক্তি এবং তমাশক্তি । প্রাকৃ তিক শক্তি দ্বারাই আবার সাধারণ শক্তি নিয়ন্ত্রিত হয়।

দুর্গার মহিষাসুর বধ এবং বিজয়ের দিনটিকে বঙ্গ দেশে বিজয়া দশমী , নেপালে দশান, হিন্দী বলয়ে ( উত্তর
ভারতে) দশেরা নামে অভিহিত। ওই দিনটিতে রাবনকে জ্বালানোর অনুষ্ঠান হয়। উত্তর ভারতীয়রা ওই দিনটি
রামের জয় রাবনের পরাজয়ের দিন বলে মানেন।

মূলতঃ বঙ্গ আসাম ত্রিপুরা এবং নেপালে দুর্গা পূজা নামে চালু, পশ্চিম এবং উত্তর ভারতে নব রাত্রি উৎসব
নামে খ্যাত, নয়টি রূপের পুজা নয়দিন ধরে হয় তাই নব দুর্গার পূজা বলে তারা। অন্ধ্র প্রদেশে এর নাম কনক
দূরগাম্মাথাল্লি, কাশ্মীরে সারিকা, মহীসুরে ( মহিষাসুরের ভূ মি) অর্থাৎ কর্ণাটকে ইনি চামুন্ডেশ্বরী, গোয়াতে
শান্তেরি বা শান্ত দুর্গা বা গৌরী , মহারাস্ট্রে তু লিজা, অম্বাবাই, ভবানী , সপ্তশ্রুঙ্গি , যোগাই, ইয়ামাই, রেনুকা
এরকম ভিন্ন ভিন্ন নামে পূজিতা হন। পর্তু গীজদের কাছে এটি তাদের দেবী দিউমাস এর মূর্তি ।

এই যুদ্ধে মহিষাসুর ছাড়াও শ্রী দুর্গা যাদেরকে নিধন করেছিলেন তারা হলেন অসুর সাম্রাজ্যের সেরা সেনাধ্যক্ষ –
চিক্সুর, চামার, উগ্রসেন, উৎপল, বিদাল, বিধান, উগ্রবীর্য, তাম্রা, ত্রিনেত্র, উগ্রসুর, করলাসুর, বশকাল, দুর্ধরা,
মহাহনু, উগ্রাশয়, বস্কালাসুর, উদয়তারাসুর, বীরলক্ষা, দুর্মুখ, উদগ্র, অসিলোম এবং পরিবারিতা।

কেরলে এর পরও অনুক্রমনিকা আছে। মহিষাসুরের ভগিনী মহিষী যে কিনা মহিষাসুরের খুল্লতাতর( কাকার)
দত্তক পুত্রী অসুর সাম্রাজ্যের রানী হন। তিনি ব্রহ্মার কাছে বর লাভ করেন যে তাঁকে বিষ্ণু এবং শিবের পুত্রই
শুধু বধ করতে পারবে। তার উদ্দেশ্য ছিল পার্বতী (দ্রাক্ষায়নী, দুর্গা) কে বধ করে ভ্রাতৃ হত্যার প্রতিশোধ নেয়া।

উপাখ্যান হল গল্প কথা যার মধ্য দিয়ে পুরাতন ইতিকথা নৈতিকতা বিবৃত হয়, লোককথা একই উদ্দেশ্যে বিবৃত
হয় তবে তার বিকৃ ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিংবদন্তী হল সেই উপাখ্যান বা লোককথা যা শত বছরে

5
বা হাজার বছরের প্রাচীন এবং জনগণ তা ইতিহাস বলে বিশ্বাস করে কারণ তা তাদের জীবন যাপনের অংগ
হয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাস হল প্রমান যোগ্য দলিল যা শুধু বিশ্বাসের ওপর নির্ভ রশীল নয়। কোন কোন কিংবদন্তি
ইতিহাসে পরিণত হতে পারে কিন্তু ইতিহাস কোন দিন কিংবদন্তি হয় না।

ময়া সো অন্নমত্তি য়ো বিপশ্যতি য প্রাণিতি য ঈ শ্রুণোত্যুক্তম।

অমন্ত উওমন্ত উপক্ষিয়ন্তি শ্রুধিশ্রুত শ্রদ্ধিয়ম তে বদাম।।

আমার মধ্য দিয়ে অন্ন গৃহীত হয়, দৃষ্টি শ্বাস শ্রবণ সব শক্তি আমার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়,

যারা আমার এই শক্তি উপেক্ষা করে তাদের ধ্বংস অবধারিত তারা এ বিশ্বাস উপলব্ধি করতে শিখুক।
(দেবীসুক্ত চতু র্থ শ্লোক)।

I resemble in form Brahman, from me emanates the world, which has the Spirit
of Prakriti and Purusha

I am empty and not empty, I am delight and non-delight, I am knowledge and ignorance,
( Devi Mahatmyam)
( 2162 words)

You might also like