You are on page 1of 53

1

সময় ! তু মি বৃদ্ধ যাযাবর !!


জনরাঃ অকাল্ট, ফ্যান্টাসি থ্রিলার
রচনায়ঃ অরুপ ঘোষ
2

অধ্যায় – এক

ধূসর সকাল
অন্ধকার প্রান্তর, দিগন্ত বিস্তৃ ত আকাশ হু হু বাতাস, এর মাঝখানে পা টেনে টেনে এগিয়ে যাচ্ছে
“সে”, বেশ কিছু দর ূ যাবার পর তার হঠাৎ মনে হল, পেছন থেকে কেউ তাকে দেখছে, অনুভূতিটা
এত প্রবল, সে পেছনে তাকাতে বাধ্য হল, তাকিয়েই তার মনে হল না তাকালেই বুঝি ভাল
হত...।। বেশ খানিকটা পেছন থেকে একটা ...না একটা না দুটো ঘন লাল বিন্দু এগিয়ে
আসছে... যে গতিতে আসছে খুব দ্রুতই পৌঁছে যাবে...।তার মাথার ভেতর থেকে কেউ চিৎকার
করে বলছে...।।“পালাও, বাঁচতে চাইলে পালাও!!”...।সেটা শুনেই সে প্রাণপণ গতিতে দৌড়ানো শুরু
করল, পেছন থেকে একটা জান্তব ঘড়ঘড় শব্দ আর নিঃশ্বাস শুনতে পাচ্ছে সে, তার গোটা শরীর
বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে...।। “ওটা” এসে পরেছে...।এই লাফিয়ে পড়লো বলে, “সে” পা হড়কাল, নাঃ
আর আশা নেই...এই বুঝি ঘাড়ে লাফিয়ে পড়লো সাক্ষাৎ মৃত্যু!!!

ধড়মড় করে বিছানাতে উঠে বসলো তপু, ঘামে ভিজে গেছে সে, একটু ধাতস্থ হয়ে সে নামলো তার
ছোট্ট বিছানা থেকে, আট বাই পাঁচের ঘুপচি ঘরটাতে নড়াচড়ার বেশি জায়গা নেই, ঘরে একটা খাট
, একটা টেবিল আর একটা তিন ড্রয়ার অলা পিচ্চি ওয়ারড্রব রাখতেই জায়গা শেষ। উপরে অনেক
আওয়াজ করা সিলিং ফ্যান টা নড়াচড়া করছে না, মনে হয় লোডশেডিং , টেবিল থেকে নিয়ে ছোট্ট
এলুমিনিয়ামের জগটা প্রায় পুরোটাই গলাতে ঢেলে দিল তপু, আর মনে মনে কারেন্ট কে শাপ শাপান্ত
করল, আর ছোট ঘরকেও দোষারোপ করল গরমের জন্য, অবশ্য অনাথাশ্রমে এর থেকে আর বেশি
কিই বা আশা করা যায় !!

তপুর অনাথাশ্রমে আসার গল্পটা ছোট কিন্তু মর্মান্তিক, তার বাবা ছিলেন দিল দরিয়া মানুষ, পৈত্রিক
সুত্রে অনেক জায়গা জমির মালিক ছিলেন তিনি, তাঁরা ছিলেন দুই ভাই, ভরা সংসার, তপুর
কাকাকে বিয়ে করানোর পরেই বাধল বিপত্তি, আলাদা হবার জন্য কাকা শুরু করলেন জোরাজুরি,
কিন্তু তপুর বাবা কিছু তেই রাজি হয়না । শেষে একদিন তু মুল ঝগড়াঝাঁটির পর তপুর বাবা ঠিক
করলেন ,কোথাও থেকে বেড়িয়ে আশা যাক, সেই মতো সকালে কক্সবাজারের উদ্দেশে

যাত্রা করল তপু, মা আর বাবা। কিন্তু বিধি বাম, মাঝপথে ভয়ঙ্কর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান মা
আর বাবা, কোন এক অলৌকিক শক্তি যেন হাতে ধরে তপুকে রক্ষা করল, বেঁচে গেল সে!!!
তারপর যা হয়, কাকা সব দখল করলেন, আর বিপুল সম্পত্তির অধিকারী মল্লিক পরিবারের বড়
ছেলে তপুর জায়গা হল অনাথ আশ্রমের ঘুপচি ঘরে।
3

সে এসে দাঁড়ালো তার ছোট্ট জানালার ধারে, সকাল হয়ে আসছে, সূর্য উঠার বদলে আকাশে দেখা
গেল মেঘ , দীর্ঘশ্বাস ফেলে তপু ভাবল , আরেকটি দিন এল তার জীবনে, তার ধূসর জীবনে
আরেকটি ধূসর সকাল !!

বিবর্ণ দুপুর
দুপুরে সাধারণত ঘুমাতে চায়না সায়নী, কিন্তু আজ অনেকটা ভোরে উঠে সেলাইয়ের কাজ শুরু
করতে হয়েছে, উপায় ছিল না, আজকেই ডেলিভারির দিন ছিল, না দিতে পারলে বদনাম হয়ে যেত,
আর একবার বদনাম হলে আর কাজ পাওয়া মুশকিল !! আজকালকার ঝাঁ চকচকে টেইলর
দোকানের জামানাতেও অনেক পরিবার আছে যারা সেটা পোষাতে পারে না, তাদের জন্য ঘরে ঘরে
সেলাই মেশিন চালানোরাই ভরসা । হাতে কিছু এসেছে, সংসারের একমাত্র সদস্য দিম্মার ওষুধ
এর টাকা টান ছিল, সেটা পুষিয়ে যাবে। বিছানাতে গা এলিয়ে দিতেই ঘুম নেমে এল চোখে , পিছু
পিছু এল স্বপ্ন। সেটা সুখ স্বপ্ন হলেও হত, কিন্তু সে কপাল করে ত সায়নী আসেনি !!......

একটা উঁচু টিলা, সেখানে বিশাল এক মন্দির, সেখানে যে দেবীর পুজা হচ্ছে, সেরকম দেবি সায়নী
এ জীবনে দেখেনি, দেবী মূর্তি এক শব দেহের উপর বসে আছেন তাঁর এক হাতে গদা অন্য হাতে
তিনি অসুরের জিহ্বা টেনে ধরে তাকে প্রহারে উদ্যত, পূজারীগুলিও কেমন অদ্ভু ত, গম্ভীর স্বরে
মন্ত্রোচ্চারণ করেই চলেছে , কাসর ঘণ্টা কিছু র বালাই নেই, শুধু দেবী মূর্তি র সামনে বিশাল এক
অগ্নিকুণ্ড দাউ দাউ জ্বলছে। উঁচু উঁচু থাম, চারদিকে উথাল পাথাল বাতাস, সায়নী দাঁড়িয়ে আছে
বিশাল চাতালের এক পাশে, নিচে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক বিশাল প্রান্তর, এর মাঝখানে হঠাৎ সায়নী
দেখতে পায়, দূরে দুটো লাল বিন্দু যেন ছু টে আসছে, আর সেই বিন্দু গুলোর সামনে একটা
আবছায়া মাঝারি মূর্তি যেন সেই বিন্দু গুলির থেকে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই ছু টে আসছে , দুটো
জিনিসেরই গন্তব্য যেন এদিক পানেই, সায়নী দৌড়ে নামলো চাতাল থেকে, সিড়ি ঁ অর্ধেক নেমেছে, এই
সময় ওর পথ রোধ করে দাঁড়ালো , ওটা কি !! এরকম বীভৎস মূর্তি এর আগে চোখে পড়েনি
সায়নীর , আরও আশ্চর্য , মূর্তি টা মনে হচ্ছে পাথরের, কিন্তু সেই মূর্তি ই মুখ হাঁ করে বিকট এক
হুঙ্কার দিয়ে তেড়ে এল ......

ঘামে ভিজে সায়নীর ঘুম ভাঙ্গল, টিনের চালের ঘর হলেও ওদের টা বেশ ঠাণ্ডা ঘর,কিন্তু এই মুহূর্তে
গরমে সায়নী জানলা পুরোটা খুলে দিল, রট আইরন এর জানলার গ্রিল ধরে বাইরের দিকে তাকাল,
...।। ওর মা ওর জন্মের সময়েই পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছে, সেই থেকে বাবাও বিমুখ ওর প্রতি,
স্ত্রীকে তিনি ভু লতে পারেননি, অন্যমনস্ক ভাবে রাস্তা পার হতে গেছিলেন, ফলে যা হবার তাই হল,
সায়নীর পাঁচ বছর বয়সেই এক কালান্তক যন্ত্র দানব তাঁর প্রাণ কেড়ে নিল, সেই থেকে দিম্মার
কাছে মানুষ সায়নী, দিম্মার সরকারী পেনশনের টাকা, আর সেলাই ফোঁড়াই টু কটাক কাজ আর
হালকা বেতের জিনিস পত্র তৈরি করে আর বিক্রি করে টেনে টু নে সংসার চলে।

অনাথ সায়নী বাইরের এলুমিনিয়াম রঙের বিবর্ণ দুপুরের দিকে তাকিয়ে রইল.........!!

অস্থির বিকেল
সকাল থেকেই সুমিত্রার কেমন জানি লাগছিল !! সে কাউকে না পারছে বলতে, না পারছে স্থির
হতে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল...সুমিত্রার অস্থিরতা কমল না !! শেষমেশ সে তাদের একতলা
4

বাড়ির ছাদের ছোট্ট চিলেকোঠাতে এসে বসলো, এখানে সে ছোটবেলা থেকে অনেক খেলেছে। ভাঙ্গা
পুতুল, আধভাঙ্গা সাইকেল এগুলির মাঝখানেই এক চিলতে জায়গা , সেখানে একটা ভু তের বই নিয়ে
বসলো, বাইরের আকাশ বেশ খানিকটা মেঘলা, ভু তের বই পরার উপযুক্তই বটে... পড়তে পড়তেই
কখন চোখ লেগে এসেছে সুমিত্রা নিজেও জানেনা।

পুরানো একটা আধভাঙ্গা বাড়ি, সেটার দরজাতে দাঁড়িয়ে আছে সুমিত্রা । সামনে বিশাল এক
অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রান্তর!! হু হু বাতাস বইছে, সে ঘর থেকে বেড়িয়ে দূরে দেখতে পেল একটা টিলার
মাথাতে একটা আগুন জ্বলছে, ভাল করে লক্ষ করলে মন্দির এর কাঠামো বোঝা যায়। আর সামনে
বেশ খানিকটা দূরে মনে হচ্ছে কে যেন দুটো লন্ঠন জ্বালিয়ে দোলাতে দোলাতে নিয়ে যাচ্ছে !!
দাঁড়াও দাঁড়াও , লন্ঠন না তো !! মনে হচ্ছে কোন জন্তুর চোখ !! হ্যাঁ তাই তো, অই তো, কি
যেন দেখতে পেয়ে চোখ দুটোর গতি যেন বেড়ে গেল মনে হচ্ছে !! কি করছে বোঝার আগেই
সুমিত্রা নিজেকে দেখল সে দৌড়ানো শুরু করেছে, একটা ছোট টিলার উপরে দাঁড়িয়ে তারার
আলোতে দেখতে পেল সামনে দূরে একটা ছায়ামূর্তি যেন ছু টে যাচ্ছে , আর সেই লালচোখ দুটো সেই
ছায়ামূর্তি টাকে তাড়া করছে। টিলা থেকে নামতে যাবে, তার আগেই সামনে এসে দাঁড়ালো এক
অদ্ভু তু ড়ে জীব, উপরের অংশ মানুষেরই , কিন্তু নিচের অংশ যেন কাঁকড়া বিছের !! সেটা বিশাল
হাঁ করে তেড়ে এল সুমিত্রার দিকে, পিছাতে গিয়ে হোঁচট খেল সে, মানুষ কাঁকড়াটার পাশ দিয়ে
গড়িয়ে নামতে শুরু করল নিচের দিকে......সেই টিলার নিচেই নরকের মতো গভীর এক খাদ
!!!!

উঠতে গিয়ে ভাঙ্গা সাইকেলে বাড়ি খেল সুমিত্রা, “আউ” করে মাথাতে হাত বুলাতে গিয়ে টের
পেল, ঘেমে নেয়ে গেছে সে !! পরিস্কার বাতাসের জন্য ছাদে চলে এসে দেখতে পেল, গুঁড়ি গুঁড়ি
বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে সাথে উথাল পাথাল বাতাস...ভিজতে ভিজতে অস্থির সুমিত্রা আরও অস্থির
এক বিকেলে দাঁড়িয়ে রইল তাদের আধভাঙ্গা বাড়ির ছোট্ট ছাদে ।

বন্য রাত
নিজেদের বিশাল ম্যানশন এর দোতালার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো আরসান। ভাল লাগছেনা কিছু ই
তার, ধনী মা বাবার একমাত্র সন্তান সে, যখন যা চায়, এমনকি না চাইলেও তার পায়ের কাছে
লুটোপুটি খায়। ফলে যা হবার তাই হয়েছে, বখে গেছে সে, এখন কি চাইতে হবে তাই সে ঠিক
করে উঠতে পারছে না !! ছোটবেলা থেকে গান , বাজনার তালিম, একটু বড় হয়ে ব্যায়াম ,
সাথে মার্শাল আর্টে র প্রশিক্ষণ সবই হয়েছে, কিন্তু কোনটাই শেষ অবধি যেতে পারেনি, তার আগেই
আস্তাকুড়ে চলে গেছে, খালি মার্শাল আর্ট টাই শেষমেশ টিকে গেছে, কারন তার বল্গাহীন উদ্দাম
জীবনে রাত বিরাতে ওটা এখন ও মাঝে মাঝে কাজে লাগে তাই !! ঘড়ির দিকে একটু তাকাল ,
মাত্র নয়টা বাজে , The Night is still Young !! , একটু ঘুমান যাক !! সাড়ে এগারোটার দিকে
বেরোলেই হবে, বিশাল বিছানাতে উপুড় হয়ে ঘুমে তলিয়ে গেল , আর ওর জীবনে যেটা কমই হয়,
স্বপ্ন দেখা শুরু করল !!......

মাটি থেকে একটু উঁচুতে হেঁ টে যাচ্ছে সে !! ভয় পেয়ে নিচে তাকিয়েই বুঝতে পারল, ও হরি!!
একটা সাদা ঘোড়ার উপর বসে আছে সে! মৃদু ঠক ঠক শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে ওটা, আরে , সে
আবার ঘোড়াতে কখন চড়তে শিখল !! চড়তে কিন্তু খারাপ লাগছে না, একটু দূরে একটা নদী
5

দেখা যাচ্ছে , ডানে মোড় নিল সে, এবার সামনে ধু ধু প্রান্তর , এবং অন্ধকার হলেও তারার
আলোতে সামান্য আলোকিত। দূরে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে , আরও দূরে একটা অগ্নিকুণ্ড ! এই
দুইয়ের মাঝখানে একটা জায়গাতে দেখা গেল একটা বিরাট ছায়া আরেকটা ছোট ছায়াকে যেন তাড়া
করেছে !! ঘোড়ার জিন (ঘোড়ার উপর বসার জন্য চামড়ার তৈরি ছোট আসন) এর পাশেই
খাপে মোড়া তলোয়ার, সেটা একটানে বের করে সেদিকে ঘোড়া চালাল দুঃসাহসী ঘোড়সওয়ার ।
কিন্তু কিছু দর
ূ যেতেই হঠাৎ ঘোড়া থেমে গেল ! কি হল সেটা দেখার জন্য সামনে একটু ঝু কে
বসতেই , আরে ওটা কি ! সামনের একটা ঝোপড়া থেকে বিশালাকৃ তির একটা ছায়া শরীর বের
হয়ে এসে মুখ ব্যাদান করে এক বিকট হাঁক দিল !! ঘোড়াটা ভয়ে পেছনের দু পায়ে দাঁড়িয়ে
যাওয়াতে তাল সামলাতে না পেরে পিছলে ধপাস করে মাটিতে পড়লো সে ! সাথে সাথে সেই ছায়া
শরীর ও ছু টে এল হাঁক দিতে দিতে !! .....

আরসানের ঘুম ভাঙ্গল ঘামে ভিজে সপসপে অবস্থাতে ওর বিছানার পাশে মেঝেতে !! ও এই স্বপ্ন
হঠা ৎ কেন দেখতে গেল !! যাকগে , ঘড়িতে বারোটা পনেরো, কিছু অসুবিধা নেই, বাবা কোন
ক্লাব এ, মা কোন তথাকথিত “সমাজসেবা” ক্লাব এ , বাধা দেবার বা মানা করার কেউ নেই,
আমেরিকা থেকে সদ্য আনানো “Mercedez- AMG-GT-Coupe” এর চাবি হাতে ঝু লিয়ে বেরিয়ে
পড়লো উদ্দাম তরুণ বন্য রাতে হারিয়ে যাবার জন্য !!!

অধ্যায় – দুই

অতঃপর তপু
অনাথাশ্রমের একটাই সুবিধা, কারো ধার কেউ তেমন একটা ধারেনা ! খালি সকালের নাস্তা,দুপুরের
খাবার আর রাতের খাবারের সময় উপস্থিত থাকতে হয় ! ঘড়ির কাঁটা একটু এদিক ওদিক হলেই,
আর কিচ্ছুটি পাওয়া যায় না ! সকালের নাস্তাটা খেয়েই রুমে চলে আসলো তপু, বিছানার নিচ
থেকে টেনে বের করল তার অস্থাবর সম্পত্তির একমাত্র ধারক, ছোট্ট ট্রাঙ্কটা , যৎসামান্য কাপড়
চোপর সরিয়ে বের করে আনল দাদু চন্দ্র মল্লিকের উপহার দেয়া “বৃহৎ তন্ত্র সারঃ” । ভেতর থেকে
বের করে আনল পুরানো কিন্তু এখনও চকচক করতে থাকা একটা পাতলা তামার পাত, তাতে
অদ্ভু তভাবে কয়েকটা সোজা , কয়েকটা উলটো ত্রিভু জ আর চতু র্ভু জ আঁকা !! তার দাদু তার
সাত বছর বয়সে এই বই দিয়ে বলেছিলেন, “দাদু, তন্ত্র-মন্ত্র একই সাথে সোজা, আবার একই সাথে
অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ! নির্ভ র করে তু ই এটা কিভাবে ব্যবহার করছিস তার উপর। তন্ত্রে অনেক দেব
দেবী, ডাকিনী, যোগিনীর সাধনা করা যায়, তোকে আমি একটাই কথা বলব, মা মঙ্গলময়ী
বগলামুখীর সাধন পদ্ধতিটি এই বই থেকে অনুসরণ করিস, এখানে একটা তামার পাতে তাঁর যন্ত্র
আঁকা আছে, সেটা সবসময় নিজের কাছে রাখবি, অপবিত্র কোন জায়গাতে এটাকে রাখবি না, আর
মাঝে মাঝে বের করে একটা নির্দি ষ্ট মন্ত্র আওড়াবি। তাহলেই হবে, আর যদি কোন বড় বিপদে
পড়িস, তাহলে এই বইতে যেভাবে বলা আছে ঠিক সেভাবে যন্ত্রের পূজা করবি ,মা বগলামুখী স্বয়ং
তোকে রক্ষা করবেন !! ” আসলে আজ পর্যন্ত সেরকম বড় কোন বিপদে তপু পড়েনি বাবা-মা
মারা যাবার পর থেকে। তবে দাদুর কথা অনুযায়ী প্রতিদিন তামার যন্ত্রটা বের করে বিড়বিড় করে
একটি নির্দি ষ্ট মন্ত্র আওরায় সে। আজো তাই করছিল, তবে একটু বেশি মনোযোগ আর ভক্তির সাথে
! অন্যান্য দিন চোখ বন্ধ করেই করে, আজ কেন জানি চোখ খোলা রেখেছিল, হঠাৎ দেখল,
6

তামার পাতটা একটু যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল !! সে ভয়ে ভয়ে পাত টা ছুঁ য়ে দেখল, সেটা কেমন
জানি বেশ গরম হয়ে আছে ! আর একটা আশ্চর্য ব্যপার ঘটল, কালকে রাতের স্বপ্নে সে যেন
আবার ঢু কে গেল ! চারদিক কেমন আঁধার হয়ে এলো, তার পেছনে যেন সেই লাল চোখ অলা
শ্বাপদ তাড়া করে আসছে !! “ঠক ঠক ঠক” শব্দে সম্বিৎ ফিরল তপুর, ফ্লোর ওয়ার্ডে ন টোকা
দিয়ে হেঁ কে গেল “পড়তে বস সবাই !! সামনে পরীক্ষা !!” পরীক্ষা তো আরও ছ মাস বাকি!
তপু মনে মনে ঠিক করে রাখল, রাতে আরেক টু ভাল করে ট্রাই করে দেখতে হবে !!

সায়নীর সায়ান্হ
সন্ধ্যাটা দিয়ে পূজা দিতে বসেও দুপুরের স্বপ্ন নিয়ে চিন্তা করছিল সায়নী। পূজা সেরে দিম্মাকে
বিকালের জন্য মুড়ি মাখা দিয়ে নিজেও খানিকটা খেল, তারপর বই নিয়ে বসলো, কিন্তু দুপুরে ভাল
ঘুম হয়নি, একটু যেন ঝিমুনি মতো এলো .........

পাথরের মূর্তি টা ছু টে আসছে , সায়নীর পা যেন মাটিতে গেঁথে গেছে, হঠাৎ তার নজর গেল নিজের
ডান হাতের দিকে, একটা গদা আকৃ তির আলোকিত জিনিস তার হাতে কোথা থেকে যেন চলে
এসেছে !! সেটাকেই আঁকড়ে ধরে জোরে ঘোরালো সায়নী , “ধাম” শব্দের সাথে পাথরের বীভৎস
মূর্তি টার মাথা গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো চারদিক, এক মুহূর্ত থমকাল সে, তারপর দৌড়ে গেল
যাকে সাহায্য করার জন্য দৌড়ে নামছিল সেদিকে ......

এবারের টা আর স্বপ্ন বলে মানতে কষ্ট হল সায়নীর , যেন ঠিক তার সাথেই আরেক জীবনে ঘটে
যাওয়া ঘটনা দেখে যাচ্ছে সে ! তন্দ্রা কাটিয়ে উঠে দিম্মার কাছে দৌড়ে গেল সে, খুলে বলল তার
স্বপ্নের কথা আদ্যোপান্ত। শব শুনে দিম্মা বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন, বললেন “শোবার ঘরের তাকের
উপর একটা কাঠের বক্স আছে, কাল রঙ্গের,ওটা নিয়ে আয়!! ” সায়নী দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এলো
সেটা, অনেক দিন ধরেই পুরানো জিনিস পত্রের মধ্যে পড়ে ছিল সেটা, কিন্তু যতবারই সায়নী
ফেলতে চেয়েছে , হাঁ হাঁ করে বাধা দিয়েছেন দিম্মা, ভেতরে কি আছে জিজ্ঞেস করলে প্রতিবারই
বলেছেন “যথাসময়ে জানতে পাবি, এত দিক করিস নাতো !!” দিম্মার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে
সেই “যথাসময়” উপস্থিত ! পানের বাটা খুলে একটা পান মুখে গুঁজে দিম্মা বলা শুরু করলেন
“শোন তবে, তোর তখনও জন্ম হয়নি......”

সুমিত্রার মিত্রতা
ছোটবেলাতে বাবা হারানো সুমিত্রা এক ভাই আর মাকে নিয়ে অনেকটা আত্মনির্ভ রশীল হিসাবেই বেড়ে
উঠেছে, ছিঁচকাঁদনে
ু স্বভাব ওর মধ্যে একেবারেই কম। ভাগ্যিস বাবা বেঁচে থাকতেই এই বাড়িটা করে
গেছিলেন, নিচতলার একপাশটা ভাড়া দিয়ে সেই আয় দিয়েই এই পর্যন্ত চলে গেছে কোনমতে। নিচে
নেমে পূজা দিতে বসেও অন্যমনস্ক ভাবে স্বপ্নটা নিয়েই ভাবছিল, ঘণ্টা নাড়তে নাড়তে হঠাৎই
চারদিকে যেন অন্ধকার নেমে এলো ! ...................

টিলার উপরে হঠাৎ ই দেখা গেল একটা সাদা ঘোড়া, ঢালু টিলার ধার ঘেঁষে বিপজ্জনক গতিতে ছু টে
এলো ঘোড়াটা , কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিল অজানা সাহায্যকারী, সেই হাত আঁকড়ে ধরল সুমিত্রা,
7

এক ঝটকাতে ঘোড়ার পিঠে তাকে তু লে নিয়ে আধা মানুষ, আধা কাঁকড়াকে ফাঁকি দিয়ে ছু টল
খোলা প্রান্তরের দিকে, যেখানে এখনও দুটো ছু টন্ত লাল বিন্দু দেখা যাচ্ছে !!

সম্বিৎ ফিরলে সুমিত্রা দেখল ওকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে ওর মা “এইসুমিত্রা , তোর কি হলরে !! ওভাবে
পড়ে আছিস কেন আসনের উপর !!” এবার সুমিত্রা সবটা খুলে বলে মাকে, সব শুনে গম্ভীর হয়ে
যান মা, “সুমিত্রা, আজকে তোকে এমন কিছু কথা বলব, তাতে তোর জীবনটা পুরোটা পালটে
যেতে পারে, হয়ত তু ই আমাকে আগের মতো আর ভাল নাও বাসতে পারিস, কিন্তু তবু তোকে
সবটা বলা আমার কর্ত ব্য, তু ই তৈরি তো সত্যিটা জানার জন্য ?” অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে বসে
সুমিত্রা, একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে “তু মি যাই বলনা কেন, তোমার প্রতি আমার ভালবাসা বিন্দুমাত্র
কমবে না, আর আমি সবধরনের পরিস্থিতির সাথে সেদিন থেকেই লড়াই করতে শিখে গেছি, যেদিন
থেকে বাবা মারা গেলেন, তু মি বল , আমি শুনছি ”। বিষণ্ণ মুখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে মা শুরু
করলেন “শোন তবে..................।।”

আরসানের বাকী রাত


থ্রাশ মেটাল, ডেথ মেটাল এসব রক্তে উন্মাদনা আর এখন জাগাতে পারেনা আরসানের, গতানুগতিক
নেশা গুলোও আর ওকে টানে না, ওর বর্ত মান ক্রেজ হচ্ছে Lysergic acid Diethylamide (LSD)
, এটা খাওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যে আপনি তথাকথিত “নন্দনকানন” থেকে ঘুরে আসতে পারবেন
!! হ্যালুসিনেসন হবে আপনার, মনে হবে আপনি বাতাসে ভাসছেন, বা এমন কিছু আপনি দেখবেন
যার কোন অস্তিত্বই নেই, অত্যন্ত দামি এই ড্রাগ টি খুবই রেয়ার এই দেশে, যাদের কাছে টাকা
পয়সা খোলামকুচি করার মতো যথেষ্ট আছে তারা নিয়মিত এটার আস্বাদ নিতে পারে, আরসান
তাদের মধ্যে একজন, সুগার কিউব এর মধ্যেও পাওয়া যায় এটা, সেরকম একটা গরম চায়ে
ডু বিয়ে চু মুক দিতে যাবে......।তার আগেই ..................

মাটিতে পড়েই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল সে , তলোয়ার টা সোজা করে ধরে এক দুর্বোধ্য মন্ত্র
আওরাল সে , একটা আলোর শিখা ছু টে গেল ছায়া অবয়বটির দিকে, মিলিয়ে গেলো সেটা তীক্ষ্ণ
একটা চিৎকার দিয়ে !! আবার ঘোড়াতে উঠে ছু টল সে, সামনের একটা ঢাল পার হতেই চোখে
পড়লো আধা মানব, আধা কাঁকড়া রুপি দানবটার দিকে, বিরক্তিতে ভ্রু কুঁ চকালো সে, নাঃ এদের
জ্বালা আর পারা গেলো না, পরক্ষনেই চোখে পড়লো এক তরুণী অসহায় ভাবে গড়িয়ে যাচ্ছে ঢালের
পাড়ে খাদের দিকে, সেদিকে ঘোড়া ছোটাল কিছু চিন্তা না করেই, কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল,
এক ঝটকাতে তু লে নিল ঘোড়াতে , তারপর ছোটাল দূরবর্তী খোলা প্রান্তরের দিকে, যেখানে এখনও
দুটো ছু টন্ত লাল বিন্দু দেখা যাচ্ছে !! না জানি কোন প্রজা আবার বিপদে পড়েছে !!

ঝনঝন শব্দে বাস্তবে ফিরল আরসান, হাত থেকে চায়ের কাপ মাটিতে পড়ার শব্দ ওটা, কি ব্যাপার
, আজকাল কি এল এস ডি না খেয়েই হ্যালুসিনেসন দেখা শুরু করেছে সে ! নাঃ, এবার বাড়ি
ফেরা যাক, আর এটা নিয়ে বাড়ির পুরানো চাকর রঘুবীরের সাথে একটু কথা বলতে হবে, আরসান
দের বংশে পাগলামির আর মনোরোগের ইতিহাস আছে, এসব কি তারই লক্ষন কিনা, সেই ভাল
বলতে পারবে ! বাইরে বেরিয়ে মারসিডিজটা ছোটাল সে, ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি, হুম ম,
আধুনিক কালের দ্রুতগামী ঘোড়ার পিঠেই চড়েছে বটে সে ! বাড়ি ফিরে অনেক কষ্টে রঘুবীর কে
ঘুম থেকে তু লে সব খুলে বলতেই সদা হাস্যময় রঘুবীর এর মুখে কে যেন কালি মেরে দিল ,
8

“আরসু বাবু, তু মি একটু মন দিয়ে আমার কথা শোন, তোমার বংশের অনেকেই যে শেষ বয়সে
পাগল হয়ে যায় এটা তো জান, এবার কারণটা শোন..................।”

তপুর আবিষ্কারের রাত !!


রাতের খাওয়া শেষ করে খাটের নিচ থেকে ছোট্ট ট্রাঙ্কটা আবার বের করে বইটা বের করে
একপাশে রাখল তপু, কিনে আনা দুটো লাল মোম বাতি জ্বালাল , তামার যন্ত্রটার সামনে দুটো লাল
জবা ফু ল রাখল, তারপর বিড়বিড় করে আবার মন্ত্রটা আওরাতে শুরু করল , আধ ঘণ্টা টাক
পরে একটা উজ্জ্বল বর্ণচ্ছটায় ছেয়ে গেলো পুরো ঘর , হঠাৎ করে ঘরের তাপমাত্রা যেন বেশ
খানিকটা গরম হয়ে উঠল, অথচ সকাল থেকে বৃষ্টি হওয়াতে আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডাই ছিল। ......

বিশাল প্রান্তরে সে আর যেন একা নয়, ঐ তো , সাদা ঘোড়াতে করে টগবগিয়ে ছু টে আসছেন
রাজকুমার, দিন রাত তাঁর কাছে সমান, প্রজাদের যেকোনো বিপদে পাশে দাঁড়ানো তাঁর স্বভাব,
পেছনেও কে যেন বসে আছে ! আরেকদিকে তাকাল তপু , দৌড়ে আসছে মন্দিরের দিক থেকে ,
যেন স্বয়ং মা দুর্গা !! খোলা চু ল উড়ছে বাতাসে, আধো অন্ধকারেও চোখ দুটো ধক ধক জ্বলছে,
হাতে উজ্জ্বল রঙের কিছু একটা ধরা, তবে ওরা পৌঁছার আগেই যা করার করতে হবে তপুকে,
নাহলে ঐ লাল চোখ অলা বিশাল শ্বাপদের হাতে নিশ্চিত মৃত্যু লেখা আছে। ওর হাতে হঠাৎ আলোর
রেখা দেখা গেলো, সেটা আকৃ তি নিলো এক বিশাল খড়গে, “জয় মা কালী !!” বলে হুঙ্কার দিয়ে
সেটা সামনের আগুয়ান শ্বাপদের ঘাড়ে চালিয়ে দিল তপু !!...............

চোখ খুলে চারদিকে চাইল তপু, নাঃ, সে তো তার ছোট্ট ঘরেই আছে !! তবে ঘরের তাপমাত্রা
মরুভু মির মতই গরম !! সামনে তাকাল তপু, ঘরের এক কোণাতে দাঁড়িয়ে হাসছেন তার দাদু,
সেই পুরানো দিনের মতো, তিনি বললেন “আমি খুব খুশি হয়েছি তু ই আমার কথা মনে রেখে জপ
চালিয়ে গেছিস বলে, আমার অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ (ঊর্ধ্বতন অষ্টাদশ পুরুষ) ছিলেন স্বয়ং কৃ ষ্ণানন্দ
আগমবাগীশ এর অনেক ভাবশিষ্য দের একজন! তাঁর সম্পর্কে বলতে গেলে রাত ফু রিয়ে যাবে,
সংক্ষেপে জেনে রাখ , কৃ ষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ছিলেন সপ্তদশ শতকের এক উচ্চস্তরের তন্ত্রসাধক,
যিনি নদীয়া জেলার নবদ্বীপ শহরে জন্মগ্রহণ করেন, তো আমার সেই পূর্বপুরুষ তন্ত্রসাধনার
অনেকদূর গিয়েছিলেন, এমনকি তিব্বতে গিয়ে বৌদ্ধদের বজ্রযান তন্ত্রমতেও দীক্ষা নিয়েছিলেন,
অন্ধকার পথে বেশ কিছু দর ূ যাবার পর তাঁর বোধোদয় হয়, তিনি ফিরে আসেন আলোর পথে,
মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন, আরেকটা আশ্চর্য ব্যাপার হল, তোর চেহারা হুবহু তাঁর
ছোট বেলাকার মতো !! আমাদের বাড়িতে একজন সাধু এসেছিলেন , তু ই তখন অনেক ছোট,
উনি তোর কপালের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘এ কে ! এর কপালে তো গুঢ়
তন্ত্রসাধনার চিন্হ আছে !!’ তু ই এখন আপাতত জপ চালিয়ে যা, সময়মতই মা ব্রহ্মময়ী তোর
গুরুর দেখা পাইয়ে দেবেন, আমাকে আর দেখতে পাবিনে, তবে হ্যাঁ, তোর যদি কখনো খুব জীবন
সংশয় হয়, তখন আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে যাবো এইটু কু জানিস !! এখন বিদায়
!!”...............।

“দাদুউউ ” বলে চিৎকার দিল তপু, লাফিয়ে উঠে ধরতে গেলো তাঁকে , কিন্তু দাদু যেভাবে বাতাস
থেকে এসেছিলেন, সেই বাতাসেই মিলিয়ে গেলেন! পাশের ঘর থেকে বিরক্তির আওয়াজ এলো “ কে
র‍
্যা?? এত রাতে চিল্লাচ্ছিস ক্যান ?” জিভ কাটল তপু, চু পচাপ গিয়ে বিছানাতে শুয়ে পড়লো,
9

কিন্তু মনে গভীর আনন্দ, অনেকদিন পর, অনেক অনেক দিন পর, ওর কাছে মনে হচ্ছে বেচে
থাকার অনেক আনন্দ আছে !!

অধ্যায় – তিন

সবার গল্প

সায়নীর দিম্মা বলে চলেছেন “এই যে বাক্সটা, এটা আমাকে দিয়েছিলেন এক সাধু, তোর
জন্মের এক বছর আগে তিনি হঠাৎ একদিন এসেছিলেন, আমরা ভাবলাম, সাধু মানুষ, সেবা করলে
পুণ্য হবে, ও মা ! তো সেই সাধু তৃ প্তি ভরে খাওয়া দাওয়া সেরে তোর মায়ের কপালের দিকে
খানিক চেয়ে থেকে বলল, ‘মা ! তু মি অনেক ভাগ্যবতী , তোমার ঘরে স্বয়ং শক্তি আবির্ভূ তা
হবেন, তবে মা, তাঁর জন্মমুহূর্তে তোমার যে জীবন সংশয় !!’ তো তোর বাবা এতে গেলেন
রেগে, ভণ্ড টণ্ড বলে গালাগালির একশেষ করলেন ! সেই সাধু কিন্তু মোটেও রাগলেন না! বরং ,
আমার হাতে এই বাক্সটা দিয়ে বললেন, ‘মা জননী, এটা আপনার কাছে রাখুন, সেই শক্তিমতী যখন
কোন বিশেষ স্বপ্নের কথা আপনাকে এসে বলবে, তাঁকে এই বাক্সটা দেবেন, তাঁর আগে নয়। আমি
জিজ্ঞেস করেছিলাম, কি আছে এতে ? সাধু কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, এতে একটি বিশেষ কমলা
রঙের তিনকোনা নিশান (মন্দিরের মাথাতে যেগুলি চূ ড়ার আশেপাশে উড়তে থাকে) আছে, আর
ঁ র
বেশ খানিকটা মন্ত্রপূত সিদ ু , এগুলি কিভাবে কাজে লাগাতে হবে উনি সময়মত জেনে যাবেন !!
” সায়নী বাক্সটা খুলল, দেখল সত্যিই সেখানে একটা কমলা রঙের কাপড় পেঁচানো আছে, আর
একটা বড় সিদ ঁ রে
ু র কৌটা ও দেখা যাচ্ছে ! কাপড়টা হাত দিয়ে স্পর্শ করা মাত্রই , মনে হল যেন
অনেক অনে এ এ ক দিন আগেকার কোন পরিচিত জিনিস ! সে যেন আবার তার পূর্বজন্মের
কোন জিনিস ফেরত পেয়ে গেছে !!!! নিজের ভেতর কেমন এক অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি টের
পেল সে !

সুমিত্রার মা ওর দিকে খানিক চেয়ে থেকে বললেন “সু, তোর কি মনে আছে ? তু ই
ছোটবেলাতে মানে প্রায় তিন চার বছর বয়সে প্রায়ই স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে কেঁ দে উঠতি আর
বলতি ‘বাবা মলে দাবে, বাবা মলে দাবে!!! মনে আছে তোর ? ” সুমিত্রা মাথা নাড়ে “একটু
একটু ! ও তো পিচ্চি কালে অনেকেই করে !” “না !” তীব্র স্বরে বলে উঠলেন মা ! “তোরটা
সেরকম কিছু ছিল না ! তোর বাবা মারা যাবার এক মাস আগে এক সাধু এসেছিলেন, তু ই তখন
এক বছরের, তোর দিকে তাকিয়ে উনি বলেছিলেন, এই মেয়ে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ! এ ভবিষ্যৎ দেখতে
পাবে ! একে সামলে রেখো হে ! খারাপ কোন সাধকের হাতে পড়লে সর্বনাশ , এর নিজেরও,
পৃথিবীর আর সবার ও !! তখন কথাটা বিশ্বাস হয়নি, কিন্তু তু ই যখন আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিস,
তখন প্রায়ই কোন একটা ভবিষ্যতের ঘটনা কিভাবে জানি বলে দিতিস ! স্বপ্নে নয়,এমনি হয়ত
কোন দিকে তাকিয়ে আছিস , হঠাৎ করে বলে বসলি ‘মা, কালকে অমুকের অমুক খবর আসবে,
বা অমুকের খুব বিপদ মা !’ আমি সবটাই প্রথম দিকে উড়িয়ে দিতাম, কিন্তু তোর মামার
ঘটনাটার পর.........। তোর মনে আছে? ” মাথা নাড়ে সুমিত্রা, খুব মনে আছে , সেবার মামার
বিদেশে যাবার কথা ছিল, টিকিট ভিসা সব কনফার্ম, অভাবের সংসার , যাওয়াটাও খুব জরুরী,
কিন্তু এয়ার পোর্টে গিয়ে তু ই কান্নাকাটি শুরু করলি , কি? না , মামাকে যেতে দেব না ! দিলে
10

আর মামাকে দেখতে পাব না, এই প্লেন টা ভাল না ! এটা ভেঙ্গে যাবে ! তখন তোর মাত্র নয়
বছর বয়স ! সবাই হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছিল, আমি তোর মামিকে এক পাশে ডেকে তোর ব্যাপারে
বললাম । টিকিট ক্যান্সেল হল, তোর মামা পরের ফ্লাইটে গেলেন, কিছু টাকা গচ্চা গেলো । আসল
ব্যাপার জানা গেলো পরদিন, তখন তো আর এখনকার মতো এত ইন্টারনেট , ফেসবুক এসবের
ছড়াছড়ি ছিল না ! যে প্লেনে তোর মামার যাবার কথা ছিল, সে প্লেনটা মাঝ আকাশে বিস্ফারিত
হয়েছিল ! আক্ষরিক অর্থেই ভেঙ্গে টু করো হয়ে গেছিল ! তোর মামীর সে কি কান্না ! সেই থেকে
তোর মামা প্রতি বছর তোর আর ভাইয়ার লেখাপড়ার জন্য একটা ভাল পরিমাণ পয়সা পাঠিয়ে
দেয়, আমি প্রতিবারই মানা করি আর ও প্রতিবার বলে “ দিদি , সুমিত্রা না থাকলে আমি তো
কবেই মরে ভূ ত হয়ে যেতাম ! এটু কু করার সুযোগ দাও ! “ আসল কথাটা হল, তু ই মাঝে
মাঝে ভবিষ্যৎ দেখতে পাস, ব্যাপারটা তোর নিয়ন্ত্রণে নেই, কিন্তু তু ই দেখতে পাস ! “ মায়ের
সামনে স্থম্ভিত হয়ে বসে রইল সদ্য নিজের ক্ষমতা জানতে পারা সুমিত্রা !!

রঘুবীরের দিকে তাকিয়ে রইল আরসান “তু মি এতদিন পর এখন এসব এখন কেন বলছ
! ‘ প্রভু ভক্ত রঘুবীর মাথা নিচু করে বলল “ তোমার ছোটবেলাতে একজন সাধু এ বাড়িতে
এসেছিলেন, তু মি তখন বাগানে খেলছিলে , তোমার দিকে তাকিয়ে অস্ফু টে বলে উঠেছিলেন তিনি
“আরে ! এ যে রাজকুমার আরিয়ান ! সেই মুখ, সেই ঠোঁট, সেই চোখ, কপালে অদৃশ্য রাজ টিকা
! হুম , এই ছেলেই পারবে পূর্বপুরুষদের পাপ স্খালন করতে ! তারপর কেন জানিনা , আমাকে
একটা কালো রঙের বাক্স দিয়ে বললেন ‘ ওর বাবা মাকে দিয়ে লাভ নেই ! মর্ম বুঝবে না, এই
ছেলে যদি তোমাকে এসে কোনদিন কোন বিশেষ দৃশ্য বা স্বপ্নের কথা বলে, তাহলে এইবাক্সের
ভেতরে যে সিদ ঁ র
ু আছে, সেটা কোন পুণ্য তিথিতে ওকে স্নান করিয়ে কপালে পরিয়ে দিও ! “আর
আরসু বাবু, তোমার কোন এক ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ কোন এক তান্ত্রিক কে অপমান করেছিলেন ,
সেই তান্ত্রিক অভিশাপ দিয়েছিলেন , তোমাদের বংশের লোকজন প্রাপ্তবয়স্ক হবার সাথে সাথে মস্তিষ্ক
বিকৃ তি ঘটবে , তো সেই পূর্বপুরুষ নিজের ভু ল বুঝতে পেরে ওনার পা ধরে কান্নাকাটি শুরু
করাতে উনি খানিক নরম হয়ে বলেছিলেন “যাঃ , তোদের বংশে একজন আসবে, কপালে থাকবে
রাজ টিকা , সেই তোদের বংশের পাপ দূর করতে পারবে, কিন্তু তোর নিস্তার নেই, তু ই ভু গেই
যাবি !!” তো আরসু বাবু, তোমার বাবারও আস্তে আস্তে লক্ষন দেখা দিচ্ছে, তোমার হাতে খুব
বেশি সময় নেই ! “ এই বলে রঘুবীর একটা ছোট্ট কালো বাক্স এনে দেখাল আরসান কে , সেটা
খুলতেই একটা আশ্চর্য সুগন্ধে চারদিক ভরে গেলো ! ভেতরের ছোট্ট কৌটাটা খুলতেই, ভেতরে
দেখতে পেল , এতদিন পরেও যেন ফ্লুরসেন্ট বাতির মতো জ্বলজ্বল করছে অদ্ভু ত সবুজ রঙের সিদ ঁ র
ু ,
সেদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আরসান!!!

দেখা হল সবার
দুদিন পর। রাত বারোটা দশ , আজ সারাদিন ধকল গেছে, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে তপুর,
ঘুমাল সে অবশেষে , স্বপ্ন এলো ঘুমের হাত ধরে ...............।

ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে গেলো শ্বাপদটা , মিলিয়ে গেলো হাতের আলোময় খড়গ টাও ! রাজকুমার
আরিয়ান !! বলে আভূ মি আনত হয়ে প্রণাম জানাল সে ! ঘোড়া থেকে নেমে ওর কাঁধে হাত
রাখলেন রাজকুমার ”ওঠো তপস্রী”, ঘোড়ার দিকে তাকিয়ে বললেন “নেমে এসো সুমিত্রানী”,
11

আরেকদিকে তাকিয়ে , যেদিকে স্বয়ং মা দুর্গা যেন দাঁড়িয়ে আছেন , বললেন “ পূজারিণী শ্রেষ্ঠা
সায়ন্তনী দেবীও এসে গেছেন দেখি ! ভালই হল !!” এবার ওরা চারজনই একদিকে হাঁটতে লাগলো

অনেকক্ষণ আলোচনার পর ওরা একটা টিলার উপর গুছিয়ে বসলো , ছোট একটা আগুন ঘিরে,
তপস্রীকে অন্ধকারের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাতে দেখে হাসলেন রাজকুমার “ভয় নেই, এই জায়গা মন্ত্র
দিয়ে ঘেরা, ঐ শয়তান টার চ্যালা চামুণ্ডা রা এখানে হানা দিতে পারবে না ! চল আমরা আজকে
শপথ নেই ,ঐ শয়তানটাকে রুখবার জন্য একসাথে জোট বেঁধে কাজ করবো , ও এত বেশি
শক্তিশালী যে, একা আমরা কেউ ওর সাথে পেরে উঠবো না । ” সবাই একসাথে হাত রাখল ,
চার হাতের সংযোগ স্থলে সৃষ্টি হল এক জ্যোতির্ময় গোলক !!

বিছানাতে ছটফট করছে সায়নী , একই স্বপ্ন দেখছে সেও ! কি জীবন্ত !! এমনকি হাতে গরম
আভাও টের পাচ্ছে সে ! অপরিচিত বাকী তিনজন কে মনে হচ্ছে যেন জন্ম জন্মান্তর ধরে চেনে সে
! তিনজনের মুখই সেই অনির্বচনীয় আলোর আভাতে জ্বলজ্বল করছে , এর মাঝেই তার চোখ গেলো
তপস্রীর দিকে, চোখ বন্ধ তার , বিড়বিড় করে কি জানি আউরে চলেছে সে, রাজকুমার আরিয়ান
ও তাই করছেন, তার নিজের মাথাতেও হঠা ৎ যেন ঢু কে পড়লো মন্ত্রটা, বুঝতে পারল সে,
অবিচ্ছেদ্য মন্ত্র বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে ওরা তিনজন, এরপর থেকে ওরা যে যেখানেই থাকুক না কেন ,
মুহূর্তে র মধ্যে একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে ! এসব কিভাবে জানল সে তা
জানেনা, কিন্তু মাথার ভেতর একটি বজ্র গম্ভীর স্বর তাকে বলে চলেছে “তোর আর ভয় নেই !
আর ভয় নেইইইইইইইইইই!!!”

আশ্চর্যের ব্যাপার হল , আরসান কোন এক অদ্ভু ত কারনে আজ রাতে বাইরে যায়নি, ঘুমাচ্ছে সে,
আর স্বপ্নে হুবহু তাই দেখছে , যা তপু আর সায়নী দেখছে ! আউরে চলেছে সম্পূর্ণ অজানা এক
মন্ত্র “ওম হ্রিং বগলামুখী সর্ব দুষ্টানাম.....................ওম স্বাহা !” স্বপ্নের সে পরে আছে রাজকীয়
পোশাক , চোখ বন্ধ তার, মাথাতে তারও বাজছে “ এদের সাথে সংযুক্ত হয়ে থাকবি এ জন্মে ,
তার পরের জন্মে, তার পরের জন্মে, তারও পরের জন্মে.....................”

এবং .........সুমিত্রা অনেকদিন পর দুঃস্বপ্নের বদলে স্বপ্নে তপু, সায়নী, আরসান দের দেখছে ! তার
পুরো শরীর জুড়ে এক অদ্ভু ত ভাল লাগা ছড়িয়ে পড়ছে, তার সংগ্রাম ক্লিষ্ট জীবনে অনেকদিন পর
যেন সুবাতাস বইতে শুরু করল , ঘুমের মধ্যেই আনন্দে কেঁ দে ফেলল সে ! তার প্রায় বন্ধুহীন
জীবনে এই স্বপ্নের বন্ধুদের সে দেখতে চাইল ভীষণভাবে ! সে জানত না, তার আকুতি ভগবান
খুব তাড়াতাড়িই শুনবেন, আর সেটা তাকে নিয়ে যাবে তার জীবনের ভয়ঙ্করতম ঘটনাপ্রবাহের দিকে
!!!

অধ্যায় – চার

ঘুম ভাঙ্গা শহরে


ঘুম ভাঙ্গল আরসানের, বেশ সকাল সকালই , রিমোট দিয়ে বিশাল উফার লাগানো মিউজিক সিস্টেম
চালিয়ে দিল সে, আইউব বাচ্চু গেয়ে উঠলেন “একদিন, ঘুম ভাঙ্গা শহরে, মায়াবী সন্ধ্যায়, চাঁদ
জাগা এক রাতে। একটি কিশোর ছেলে, একাকী স্বপ্ন দেখে, হাসি আর গানে, সুখের ছবি আঁকে,
12

আহা কি যে সুখ ! ” সুখ ! হাঃ সে একটা মরীচিকা হয়েই রইল এখন পর্যন্ত, বলতে গেলে
রঘুবীরের কাছেই মানুষ হয়েছে, বিছানা থেকে পা নামাল আরসান , কিন্তু একি ! এটা কোন
ঘরের মেঝে ! তার রুম টাই বা এত ছোট হয়ে গেলো কেমন করে ! একটু পর দেখতে পেল
তারই মতো একটা ছেলে বিছানাতে শুয়ে আছে, চেহারাটা কেন জানি চেনা লাগছে ! কোথায়
দেখেছে একে ! আরররে ! তার বিছানাটা কোথায় গেলো , এই পিচ্চি বিছানা কোথা থেকে এলো,
ব্যাক গ্রাউন্ডে আইউব বাচ্চু তখনও গেয়ে যাচ্ছেন “একদিন, ঘুম ভাঙ্গা শহরে, মায়াবী সন্ধ্যায়, চাঁদ
জাগা এক রাতে............!!” বিছনাতে শোয়া ছেলেটা চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসলো, কেমন
যেন হকচকানো গলাতে বলল “আরে আমি কোথায়? আর আপনি কে? ”

বিকট গানের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো তপুর , একটা পরিচিত গানই সেটা , দুর্গাপূজার মণ্ডপে গত
বছরও শুনেছিলো , ও হ্যাঁ মনে পড়েছে , আইয়ুব বাচ্চুর ‘ঘুম ভাঙ্গা শহরে ’, কিন্তু তাদের
অনাথাশ্রমে এত ভলিউম এ গান শোনার সাহস আশ্রমের সব চেয়ে গুন্ডা ছেলেটারও নেই ! উঠেই
আরেকটা চমক খেল সে ! কোথায় তার ছোট্ট ঘর, এত বিশাল এক কি জানি বলে বেডরুম ,
যেরকম বেডরুম সে স্বপ্নেও দেখেনি কখনো ! একপাশে বিশাল মিউজিক সিস্টেম এ গানটা বাজছে
, আর সামনে দাঁড়িয়ে তার মতই একটা ছেলে, “আরে আমি কোথায়? আর আপনি কে? ” বলে
উঠল সে ! আরে , দাঁড়াও দাঁড়াও, একে কোথায় জানি দেখেছে সে !!

আস্তে আস্তে ঘুম ভাঙ্গল সায়নীর , একটা গান বাজছে কোথায় , ঘুম পুরোপুরি ভাঙলে সে বিছানা
থেকে নেমে যেই এগোতে যাবে , তার সামনে পৃথিবীটা দুলে উঠল ! চোখ বন্ধ করেই আবার খুলে
সে দেখল ,একটা বিশাল বেডরুমে দাঁড়িয়ে আছে সে, আর সামনে বিছানার পাশে দুটো তারই
বয়সী ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ! ভয়ে চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে গেলো সে, আরে এদেরকে তো সে
চেনে ! কোথায় জানি দেখেছিল , কোথায়, কোথায় ............!!?

সুমিত্রার ঘুম ভাঙ্গল তার প্রিয় গান গুলির একটা শুনে , একদিন, ঘুম ভাঙ্গা শহরে, মায়াবী
সন্ধ্যায়, চাঁদ জাগা এক রাতে.........কিন্তু কথা হল, তার বাড়িতে এত সকালে কে গান বাজাচ্ছে !
আর কেনইবা !! বিছানা থেকে নেমেই সে এগোল বারান্দার দিকে, কিন্তু হঠাৎ তার সামনে যেন
একটা পর্দ া সরে গেলো , সে দেখল , সে একটা বিশাল বেডরুমে দাঁড়িয়ে আছে , যেরকমটা
সিনেমাতে বড় লোকদের বাড়িতে দেখা যায়, আর তার সামনে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছে দুটো
ছেলে , আর একটা মেয়ে !!!

এবার চারজনই কথা বলে উঠল “ স্বপ্ন ! স্বপ্ন ও ও ও !!! ” “রাজকুমার আরিয়ান !”
“তপস্রী, বন্ধু আমার !” “ সুমিত্রানী দেবী !!” “ আরে ! সায়ন্তনী তু মি!!” চারজনই বলল একে
অপরের দিকে তাকিয়ে !! সবার আগে সামলে উঠল আরসান , “ দাঁড়াও , দাঁড়াও , আমাদের
বাড়িতে কোটি টাকার সিকিউরিটি অ্যালার্ম, চারটা আলসেসিয়ান কুকুর, দুইটা এলিট গার্ডে র লোক ,
সি সি ক্যামেরা , এগুলো পার হয়ে আমার বেডরুমে তোমরা কি করে এলে !!” তপু খানিকক্ষণ
থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল, এরকমটা কোথায় যেন পড়েছে সে , মনে করতে পারছে না ! বলল ,
“দাঁড়াও, আমি মনে হয় খানিকটা বুঝেছি, তোমরা সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা ’ পড়েছ কেউ
? ” সবাই একসাথে মাথা নাড়ল , বাঙ্গালী হয়ে সত্যজিৎ পড়বে না, উনি তো গোয়েন্দা ফেলুদা,
বিজ্ঞানী শঙ্কুর স্রষ্টা, একাধারে থ্রিলার, সাসপেন্স আর সায়েন্স ফিকশনের গ্র্যান্ডমাস্টার ! “তাহলে
শোনো, সেখানে মুকুলের কথা মনে আছে ? যার পূর্বজন্মের কথা মনে পরে যেত ? আমরাও কোন
13

কারণে খানিকটা সেরকম হয়ে গেছি ! পার্থক্য হল, আমরা টাইম টু টাইম স্বপ্নে দেখছি পূর্বজন্মের
ঘটনা ! আর আমাদের সবারই একটা ক্ষমতা জন্মে গেছে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করার ,
কোনরকম আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই !!” “আমাদের নামগুলো অবশ্য বদলে গেছে ! ”
বলল সায়নী, সেও অনেকটা সামলে নিয়েছে “আমি সায়নী, তোমরা ?” সবাই নিজেদের নাম বলার
পর আরসান বলল “তাহলে তোমরা এখানে আছ, নাকি নেই ? ” মুচকি হাসল সুমিত্রা “আমিও
বুঝেছি ! আমরা নিজেদের জায়গাতেই আছি, কিন্তু কোনভাবে .........ঐ যে কি জানি বলে না,
ভার্চু য়ালি কানেক্টেড হয়ে আছি ! ” আরসানের কেন জানি হাসিটা খুব সুন্দর লাগলো ! এমন
নিষ্পাপ হাসি সে কোনোদিন দেখেনি !! সে বলল “তোমরাও কি আইয়ুব বাচ্চুর গানটা শুনতে
পাচ্ছ সবাই !!” সবাই সম্মতিসূচক মাথা নাড়লে আরসানের চোখ কপালে উঠল ! সে জিজ্ঞাসা
করল “তোমরা কে কোথায় থাক বলত ?” সবাই যার যার ঠিকানা বললে সে আরেকদফা
চমকাল, সবগুলো লোকেশনই তার বাসা থেকে কমপক্ষে একদিনের পথ!! তপু বলল “সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে , আমরা সবাই বয়সে কিশোর, এতদিন আমাদের সাথে এটা ঘটল না কেন
? ” সবাই তপুর দিকে নতু নভাবে তাকাল ! এই ছেলেটা র তো দেখা যাচ্ছে ভালই বুদ্ধি !
একটু থেমে আবার বলল তপু , “আর এই যে আমরা একজন আরেকজনকে দেখছি সেটাই বা
কিভাবে ঘটছে আর কতক্ষন স্থায়ী হবে ? ” এটার জবাব পেয়ে গেলো সে সাথে সাথেই ,
ওয়ার্ডে নের গলা শুনতে পেল এর মধ্যেও ! “সবাই এসেম্বলিতে ! জলদি !” তপুর মনোযোগ
সেদিকে যেতেই ওর সামনের দৃশ্য কাঁপতে শুরু করল, উফ ! ব্যাটা ওয়ার্ডে ন বাগড়া দেবার আর
সময় পেলে না ! সায়নী হঠা ৎ বলে উঠল “ঐ মন্ত্রটাই মনে হয় আমাদেরকে কানেক্ট করেছে ! ”

সুমিত্রা বলে উঠল “ওম হ্রিং বগলামুখী সর্ব দুষ্টানাম.....................ওম স্বাহা !” “দাঁড়াও দাঁড়াও
” আরসান বলে উঠল “আমি আবার এসব মনে রাখতে পারিনা!” বিছানা থেকে স্মার্ট ফোনটা
নিয়ে ভিডিও রেকর্ড ার চালিয়ে দিল , ধরল সুমিত্রার দিকে , সুমিত্রা চোখ বন্ধ করে অদ্ভু ত শান্ত
স্বরে আউরে চলেছে ““ওম হ্রিং বগলামুখী সর্ব দুষ্টানাম..............ওম স্বাহা !” কিন্তু তপু জরুরী
স্বরে বলল “আমি এখন যাই ! জেনেই তো গেলাম কিভাবে যোগাযোগ হবে ! ইয়ে, পরশু রাত
বারোটায়, মানে তার আগে সবাই জেগে থাকে কিনা ! সে সময় সবাই মিলে ঐ মন্ত্রটা পড়তে
থাকব নিবিষ্ট মনে, দেখা হবে আশা করি !! বিদায়” বলে কেন কে জানে , সায়নীর দিকে
তাকিয়ে হাসল ! এই মেয়েটার চোখেমুখে ও ওর নিজের মতই সংগ্রামক্লিষ্টতা দেখতে পেয়েছে !
মেয়েটাও প্রতি উত্তরে হাসল , ভোরের শিশিরের মতো !

আরসান বলল “ও কে, তাহলে পরশু রাতে দেখা হচ্ছে ! কজ সেদিন সবারই আশা করি বন্ধ?
হুম ?” প্রশ্নটা অবধারিতভাবেই , সুমিত্রাকে করা , সুমিত্রা মেঘের কোলে এক চিলতে সূর্যকিরণের
মতো হাসি দিয়ে জবাব দিল “ আচ্ছা !”

আরসান এগিয়ে গেলো সবার সাথে হ্যান্ড সেক করার জন্য, কিন্তু তার আগেই ধোঁয়ার মতো
মিলিয়ে গেলো সবাই, আরসান ফিরে এলো তার ঘরে, অবশ্য সে বরাবর এখানেই ছিল, দাঁড়িয়ে
রইল একরাশ শূন্যতা নিয়ে , রহস্যময় অনাগত সময়ের জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে, ঘুম ভাঙ্গা শহরে
!!

মহাকাল ভৈরব
14

অন্ধকার ঘর ! ঘরের ঠিক মাঝখানে নীলচে কালো রঙের একটি বীভৎস মূর্তি ! চার হাত বিশিষ্ট
সেই মূর্তি র ডান দুই হাতে ত্রিশূল ও চক্র, বাম দুই হাতে কাঁচি ও নরকরোটি !! তিন চোখ আর
শ্বদন্ত বিশিষ্ট মুখ, চু লের বদলে মাথাতে জড়িয়ে আছে ভয়াল দর্শন সাপ ! গলাতে নর করোটির
মালা, সারা গায়ে হিল হিল করছে সাপেরা , তিনি দাঁড়িয়ে আছেন জ্বলন্ত পাঁচটি নরকঙ্কালের উপর,
তাঁর বাহন হচ্ছে একটি কালো কুকুর ! তিনি হলেন শ্মশানের অধিষ্ঠানকারী , কাল পিতা! সকল
কাল (সময়) ভক্ষণকারী , কাল বিনাশক মহাকাল ভৈরব !

ভয়ঙ্কর সেই মূর্তি র সামনে ততোধিক ভয়াল দর্শন এক মানুষ বসে রয়েছে, শালপ্রাংশু দশাসই
চেহারার সাথে মানানসই জলদগম্ভীর স্বরে মন্ত্র আউরে চলেছে, সামনে সাজানো আছে সিদঁ র
ু মাখানো
কলাপাতা, তার উপরে সাজানো আছে মাঝারি আকৃ তির পদ্মফু ল পুড়ে তৈরি করা একটি পিঠা,
পিঠার পাশে আরেকটা পাত্রে রাখা আছে মানব বীর্য দিয়ে তৈরি তেল , সেই তেলে ডু বানো সিম
বিচি , তিল , তিসি !! একটা কালো ঘোড়ার করোটির মধ্যে বেশ খানিকটা নর রক্ত !! মন্ত্র
পড়ছেন বজ্রধর ,

"ওঁ মহাকালং যজেদব্যং দক্ষিণে ধূমবর্ণকম।

বিভ্রতং দন্ড খটাঙ্গৌ দংস্ট্রাভীমমূখম্ শিশুম্।।

ব্যাঘ্রচর্মাবৃতকটীং তূ ন্দীলং রক্তবাসসম্।

ত্রিনেত্রমূর্ধং কেশঞ্চ মুণ্ডমালা বিভূ ষিতম্।

জটাভার লসচ্চচন্দ্র খন্ডমুগ্রং জলন্নিভম্

ওম মহাকাল .................................হুম ফট!!!

বৌদ্ধ ধর্মের গুঢ়তম তন্ত্রবিদ্যা হীন যান তন্ত্র মতে, মহাকালের সাধনা করছেন বজ্রধর, সাধক
হিসাবে এটা তাঁর নাম, কিন্তু পার্থিব নাম অন্য ! তিনি একটি স্বনামধন্য কলেজের অ্যাপ্লাইড
ফিসিক্সের (Applied Physics) প্রফেসর । হিন্দু ধর্মমতে শিবের একটি রুদ্র অবতার হলেন মহাকাল
ভৈরব ! কিন্তু এঁকে বৌদ্ধ ধর্মের তান্ত্রিক শাখা হীনযান তন্ত্রেও পূজা করা যায় একটু ভিন্ন রুপে ,
বৌদ্ধ তান্ত্রিক ধর্মমতে , মহাকাল ভৈরব হলেন সময় পিতা, সময় ভক্ষণকারী । টাইম মেশিনের
নাম আজকাল সাইন্স ফিকশন গল্পের কল্যাণে সবাই জানে। কিন্তু সত্যিকারে বানাতে পেরেছে এরকম
নজির আজ অবধি নেই ! প্রফেসর সিদ্ধার্থ সোম, ওরফে বজ্রধর, আধুনিক কোন পদ্ধতির ধার না
ধেরে , প্রাচীনতম তান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে টাইম মেশিন তৈরির একটি অদ্ভু ত কিন্তু তাঁর মতে
কার্যকরী ফর্মুলা বের করেছেন ! এর জন্য কি করেননি তিনি, স্পেশাল পারমিশন নিয়ে তিব্বতের
গুম্ফায় গুম্ফায় ঘুরেছেন, পাড়ি দিয়েছেন বহু বিপদসঙ্কুল পথ । হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছেন বছরের
পর বছর, যদি কঠিন প্রাণ লামাদের হৃদয় একটু গলে! শেষমেশ তিব্বতের অনেকটা ভেতরে একটি
গুম্ফার প্রধান লামার একটি প্রাণঘাতী অসুখে তাঁর সাথে থাকা একটি ওষুধে আশ্চর্য ফল দেওয়াতে
তাঁর কপাল খুলে যায় ! তাঁর কাছে একটি যুগ যুগ ধরে সংরক্ষণ করা মহাকালের পুথি ঁ ছিল,
যেটার বর্ণনা দিতে গেলে আরেকটা মহাভারত লেখা যায় ! সংক্ষেপে সেখান থেকেই টাইম ট্রাভেল
এর আইডিয়াটা পান সিদ্ধার্থ । সেটাই একটু ঘষামাজা করে লন্ডনের রয়েল সোসাইটির একটি
15

সভাতে উপস্থাপন করেন। সভাস্থ বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা সবাই সেদিন তাঁর মুখের উপর
হেসেছিল ! জার্মান বিজ্ঞানী জারগেন হফম্যান তো বলেই বসলেন , “ওয়েল মিঃ সোম, আপনি মিঃ
এইচ জি ওয়েলস কেও হার মানাবেন দেখা যাচ্ছে !” দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিলেন সোম “উনি
মেশিনের কথা বলেছিলেন, আমি আমার পদ্ধতিতে মেশিন ছাড়াই সময় পরিভ্রমণ করতে পারব ! ”
মার্কি ন বিজ্ঞানী মাইকেল ট্রাম্প ব্যাঙ্গ ভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন , “তাহলে সেটা নিয়ে একটু আপনার
অতীতে ঘুরে আসুন না ! বংশে যদি কেউ পাগল টাগল............ইউ নো হোয়াট আই মিন !!”
রাগে অপমানে অগ্নিশর্মা হয়ে সেখান থেকে গট গট করে বেরিয়ে এসেছিলেন সোম। ওদেরকে তিনি
দেখিয়ে দেবেন, টাইম ট্রাভেল সম্ভব কি সম্ভব না !

তাঁর থিওরী দাঁড়া করেছেন তিনি এভাবে , মহাকাল হলেন সময়ের পিতা, তিনি সকল প্রকার
সময়ের সীমার উর্দ্ধে । সময়ের তিনটি প্রকার অতীত , বর্ত মান ও ভবিষ্যতের ধারণা তাঁর ক্ষেত্রে
খাটে না। তিনি একই সাথে সময়ের স্রষ্টা ও সংহার কর্ত া ! সৃষ্টির আদিতে সময়ের কোন বিভাজন
ছিল না , ছিলেন শুধু ক্ষরা আর অক্ষরা ! সময়ের দুই রুপ । বিশাল এক বিস্ফোরণ এর পর
সৃষ্টি শুরু হল, ক্ষরা বিলুপ্ত হলেন, রয়ে গেলেন অক্ষরা, আদিগন্ত হীন সময়ের ব্যাপ্তি, যা শুধু বয়েই
চলে। এঁকে থামাতে পারেন একমাত্র মহাকাল ! মহাকালই একমাত্র শক্তি , যার আরাধনা করে তাঁকে
সন্তুষ্ট করতে পারলে সাধক সময়ের উপর কতৃ ত্ব করতে পারবেন। সময় তাঁর ইচ্ছাধীন হবে। কিন্তু
সে পথ বড় বন্ধুর, সময় সাপেক্ষও বটে ! সেই পুথি ঁ তে যে পরিমাণ সময়ের কথা বলা হয়েছে ,
প্রায় একশো বছর সময়কাল, অত সময় সোমের কাছে নেই ! কিন্তু ভরসার কথা হল , সেই
পুথি
ঁ টার আসল লেখার পাশে পাশে কোন এক লামা আরেকটি শর্ট কাট পথের কথা লিখে গেছেন।
সেই পদ্ধতিতে চারজন বিশেষ শক্তিধারী মানুষ লাগবে। একজন তান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মানুষ লাগবে
, যার পূর্বপুরুষ কেউ না কেউ তান্ত্রিক ছিলেন ! একজন দেবীর অংশে গুণান্বিত মেয়ে লাগবে,
একজন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা লাগবে। আরেকজনের একটা অদ্ভু ত ক্ষমতা থাকতে হবে, তাঁকে যে জায়গারই
ছবি দেখানো হোক না কেন, সে সশরীরে সেখানে উপস্থিত হয়ে যেতে পারবে ! আধুনিক কল্প
বিজ্ঞানের ভাষাতে যাকে বলে টেলি পোর্টে শান !! এরকম চারজনের খোঁজ তিনি বিশ্বজুড়ে লাগিয়ে
রেখেছেন গত পাঁচ বছর ধরে। অবশেষে , অকল্পনীয় ভাবে এই উপমহাদেশেই, বলতে গেলে একটি
দেশেই এই চার বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মানুষের খবর তিনি পেয়ে গেছেন !! গত পাঁচ বছরে অন্ধকার
পথের তন্ত্র সাধনা করে তিনি এমনই ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়েছেন যে, তিনি তাঁদের স্বপ্নে ঢু কতে সক্ষম
হয়েছেন ! এমনকি তাদের পূর্বজন্মের স্মৃতি ও তাদের মনে করিয়ে দিতে পেরেছেন ! কিন্তু
তাদেরকে মানসিক ভাবে এখনও তিনি আকর্ষণ করে কাছে ডেকে আনতে পারছেন না ! কোন
এক অদৃশ্য শক্তির বলয় যেন তাদেরকে আগলে রেখেছে ! আরও একটা অদ্ভু ত ব্যাপার ঘটেছে ,
কিছু ক্ষন আগে তাদের চারজনকেই এক জায়গাতে অবস্থান করতে দেখা গেছে ! এই ব্যাপারটা চিন্তা
করে কপাল কুঁ চকে উঠল মিঃ সোমের , এটা তাঁর হিসাবের বাইরে ছিল, এ ব্যাপারটা কিভাবে ঘটল
সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। আসল কাজে হাত দেবার পর কোন ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলে সর্বনাশ হবে
!

অধ্যায় – পাঁচ
তাঁর চোখ খুলে গেলো ! সর্বনাশ , ঐ অসুরটা তো তাঁর সন্তানদের খবর পেয়ে গেছে ! যাদেরকে
তিনি তাদের ছোটবেলাতে দেখে এসেছেন, আর রক্ষাকবচ ও দিয়ে এসেছেন, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে
16

এই আধুনিক অসুরের সামনে সেই রক্ষাকবচ যথেষ্ট নয় ! তাঁকে নিজেই যেতে হবে তাদের রক্ষা
করতে.........। ঝোলা, কম্বল আর ত্রিশূল গুছিয়ে নিলেন তিনি, যজ্ঞের আগুনটা নিভিয়ে গুহা থেকে
বাইরে বেরিয়ে এলেন । হিমালয়ের ঠাণ্ডা হাওয়া একটু কি কাঁপিয়ে গেলো তাঁকে ? না, হাওয়া নয়,
তিনি কাঁপছেন ভয়ে, অনাগত অসুরের হাতে তাঁর সন্তানদের অনিষ্ট চিন্তাতে !!!! সময় নেই ,
সময় নেই , একদম সময় নেই, জোর কদমে তিনি রওনা হয়ে পড়লেন সমতলের উদ্দেশে !!

তান্ত্রিক তপু
একমনে বগলামুখী মন্ত্র জপ করে চলেছে তপু। এটা তার এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, প্রতিদিন
ঘুমানোর আগে একঘণ্টা করে জপ করে, আর টের পায় , ধীরে ধীরে তার ভেতরে একটা অন্য
“আমি” যেন জেগে উঠছে ! এই “আমি”র শক্তি অনেক, অনেক বেশি, অনেক গাঢ়, আলোর
ভাগটাই বেশি, কিছু টা যেন অন্ধকারের ছোঁয়াও আছে ! ও টের পায়, নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে
এই শক্তি সামনে যা পাবে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে ! ও টের পেল, ওর দুই হাতের তালুই গরম
হয়ে উঠছে ! হঠা ৎ চোখ খুলে সে দেখল তার হাতের তালুতে প্রদীপের শিখার চেয়ে সামান্য বড়
একটা আগুন জ্বলছে ! কিন্তু সে হাতে কোন তাপ অনুভব করছে না ! সামনে তাকিয়ে দেখল
তার পরম আরাধ্য দেবীর যন্ত্র টি জুড়ে উজ্জ্বল হলুদ রঙের ছোপ লেগেছে ! তার মনে পড়ে গেলো
, হলুদ হল দেবী বগলামুখীর রঙ ! শরীরে প্রচণ্ড এক শক্তি অনুভূতি হতেই সে সটান দাঁড়িয়ে
গেলো ! সামনে লাগানো আয়না (এটা নতু ন সংযোজন তাদের প্রতিটি রুমে ) তে দেখল, একটা
হলুদ রঙের উজ্জ্বল বলয় যেন তার গা বেয়ে উঠে মাথার পেছনে স্থির হল। সবচেয়ে আশ্চর্য হল
নিজের চোখ দেখে, দুটো চোখই উজ্জ্বল হলদেটে নীল হয়ে গেছে ! একটা ঠাণ্ডা, কিন্তু প্রচণ্ড
শক্তিশালী আগুন যেন তার ভেতরে জেগে উঠছে !! পূর্বজন্মের তপস্রী , বর্ত মান জন্মের তান্ত্রিক
তপুতে রুপ নিচ্ছে ধীরে ধীরে !!

শক্তিময়ী সায়নী
গলাতে কমলা রঙের নিশান জড়ান, কপালের সামনেটা সিদ ঁ র
ু মাখানো , পূজা ঘরে চোখ বন্ধ করে
একমনে জপ করছে সায়নী, পূর্ব জন্মের সায়ন্তনী দেবী যেন জেগে উঠছে তার ভেতরে ! চারদিক
চন্দনের গন্ধে ভরে গেলো, চোখ খুলে পাশে দেখতে পেল তার বাবা মা দুজনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন
আর মিটি মিটি হাসছেন ! অন্য কেউ হলে ভয় পেত বা চিৎকার করে উঠত , কিন্তু সায়নী
সেরকম মেয়েই নয় ! ওনারা আশীর্বাদের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন, মাথা পেতে আশীর্বাদ টু কু নিলো
সায়নী , আবার জপে রত হল । চন্দনের গন্ধটা আরও তীব্র হল, নিজের ভেতর এক অভূ ত পূর্ব
শক্তির আবির্ভ াব টের পেল সে, সামনে লক্ষ্মী ঠাকুরের ফটোর আয়নাতে দেখতে পেল সে নিজেকে ,
তার শরীরের চারদিকে একটা সোনালি আভা যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে !! কপালের মাঝখানে প্রচণ্ড
একটা যন্ত্রণা হল হঠা ৎ, এরপর যেটা দেখল সে, সেটা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে,
দেখতে পেল কপালের মাঝখানে আড়াআড়ি লম্বাটে আরেকটা চোখ , যেটা সে তৃ তীয় নয়ন হিসেবে
জেনে এসেছে এতদিন , সেরকম একটা চোখ দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেলো, এবার ভয় পেল সায়নী,
চোখ বন্ধ করে ফেলল ! অনেক অনে এ এ ক দূর থেকে একটা কণ্ঠ যেন বলে উঠল , ‘ভয়
নেই রে পাগলী, এটা তু ই নিজেই, বিশেষ বিশেষ সময়ে তোর এই ক্ষমতা প্রকাশ পাবে, যেগুলি তু ই
17

জড়িয়ে আছিস, এগুলি অনেক পুরানো একটা মন্দিরের জিনিস, তোর মধ্যে যেহেতু দেবীর অংশ
আছে, তারই খানিকটা দেখতে পেলি এখন !! ’ চোখ খুলল সে, সোনালি আভাটা আরও বেড়ে
গেছে , আলোতে ভেসে যাচ্ছে পুরো পূজা ঘর , সেই সাথে তার নিজের মনের ভেতরটাও !

ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা সুমিত্রা


চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে সুমিত্রা, মনে মনে জপ করাটা তার এখন অভ্যাস হয়ে গেছে, সেটা
করতে করতেই, হঠা ৎ যেন বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল মাথার ভেতর ! সে দেখতে পেল একটা
আদ্যিকালের মন্দির , পাতা ঝরা চাতালে বসে আছে সে সহ সদ্য পরিচিত বাকী তিনটি ছেলেমেয়ে,
সামনে বসে আছেন একজন সৌম্য কান্তি দাড়ি গোঁফ জটাজুট ধারী সন্ন্যাসী ! তিনি যেন কি একটা
বলছেন , কান পাততে চাইল সুমিত্রা , কিন্তু হায় ! ভবিষ্যৎ দর্শনে তো আর কান পাতা যায়
না ! সেই দৃশ্য মুছে গেলো , একটা বাস দেখা যাচ্ছে , ওরা চারজন , সাথে সেই সাধু, বাসের
সামনের জানলা দিয়ে রাস্তা বা ঘরবাড়ি বা দৃশের বদলে দেখা যাচ্ছে একটা বীভৎস মুখ ! শ্বদন্ত
আর নীল রঙের সেই বীভৎস মুখ যেন নীরব অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ছে !! ঘোর ভেঙ্গে গেলো
সুমিত্রার, ধাতস্থ হয়ে নিয়ে সে ভাবল ,এই ব্যাপারটা তাদের পরশুর সাক্ষাতে অবশ্যই বলতে হবে
সবাইকে, বিশেষ করে আরসান কে ! ওর কথা ভাবতেই নিজের অজান্তেই গাল রাঙ্গা হয়ে উঠল
তার, এদের সাথে জীবন জড়িয়ে যাওয়ার পর অনেক অনেকদিন পর নিজের জীবনের একটা মানে
যেন সে খুজে ঁ পাচ্ছে !!

অভূ তপূর্ব আরসান


নিজের বিছানাতে শুয়ে ‘ ঘুম ভাঙ্গা শহরে ’ শুনছে লো ভলিউমে, সেদিনের সেই ঘটনাটার পর
থেকে এই গানটা তার ফেভারিটে পরিণত হয়েছে, হাঃ, কোন ধরনের মেটাল নন মেটাল গানই
যার মন ভরাতে পারেনি এতদিন, সেই প্রথম দিক কার ভালোবাসা আইয়ুব বাচ্চুর কাছেই হার
মানল সে ! এর জন্য অবশ্য সেই মেয়েটাও, ঐ যে সুমিত্রা নাম, সেই মেয়েটাও খানিকটা দায়ী !
বিছানা থেকে উঠে স্নান সেরে রঘুর সাথে পারিবারিক মন্দিরে বসলো ধ্যান করতে ! কপালে মেখে
নিলো সেই অদ্ভু ত সিদঁ র
ু ! চোখ বন্ধ করে ভাবল আরসান, অদ্ভু ত অভিজ্ঞতাই বটে ! জীবনে
ঠাকুর দেবতা কে প্রণাম অনেক করেছে , কিন্তু জপ তপ এই প্রথম ! এই সব ভাবছে, মাথার
ভেতর আচমকাই চলে এলো সেই মন্ত্র, সামনে মা কালীর মূর্তি , মনে বগলামুখীর মন্ত্র ! অবশ্য
বগলামুখী আর মা কালী তো দশ মহাবিদ্যার ই ভিন্ন ভিন্ন রুপ ! সে চোখ খুলল , চোখ গেলো
পাশের দেয়ালে টাঙ্গানো বৃন্দাবনের শ্রী রঙ্গনাথ মন্দিরের অপূর্ব ছবি , সেদিকে তাকিয়ে থাকতে
থাকতেই আরসান টের পেল ওর চারপাশ কাঁপতে শুরু করেছে , “ হুউউউউস” করে একটা শব্দ
হল, আর কিছু বুঝে উঠার আগেই আরসান নিজেকে আবিষ্কার করল বৃন্দাবনের শ্রী রঙ্গনাথ
মন্দিরের সামনে, সশরীরে !! এটা ইন্ডিয়ার উত্তর প্রদেশে অবস্থিত , সেখানকার মন্দির তখনও
18

খোলেনি , ইতস্তত কয়েকজন স্থানীয় মানুষ ঘোরাফেরা করছিলেন, আরসান কে এভাবে শূন্য থেকে
উদয় হতে দেখে তারা বেশ ভালরকম হকচকিয়ে গেলো ! কিংকর্ত ব্যবিমুঢ় আরসান সেই অবস্থাতেও
রঙ্গনাথ মন্দিরের অপূর্ব কারুকাজ দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারল না, কিন্তু এখন কি করা , হুম সে
চোখে দেখে যেহেতু এখানে এসেছে, তাহলে নিজেদের পূজা ঘরটা মনের চোখে কল্পনা করে দেখা
যাক, সেই মত চেষ্টা করতেই ............ধপাস করে নিজের পূজা ঘরের আসনে নিজেকে আবিষ্কার
করল আরসান ! সেই অবস্থাতেই দেখতে পেল , রঘু মরা কান্না জুড়েছে , ‘ও ও ও আমার
আরসু বাবু ...।তু মি কোথায় চলে গেলে ! আমি আর কি নিয়ে বাঁচব গো ! ’ আরসান ফিরে
আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরল সে , ‘তু মি কোথা গেছিলে আরসু বাবু ? কোথা গেছিলে ? আমি
তো ভয়েই মরে গেছিলাম !’ আরসান বুঝতে পারল , এই বৃদ্ধ তাকে প্রানের চেয়ে বেশি ভালবাসে
! তবে তার সারা শরীর তখন রোমাঞ্চে ভরপুর, সে টেলিপোর্ট (সশরীরে কোন মাধ্যম ছাড়া এক
জায়গা থেকে আরেক জায়গাতে চলে যাওয়া) করতে পারে ! উরিব্বাস ! এ তো ঝাক্কাস ক্ষমতা !
এটা দিয়ে তো সে যা খুশি তা করতে পারে ! তার মাথার ভেতর একটা কণ্ঠ তাকে সাবধান
করে দিল “এই ক্ষমতা অপব্যবহার করার জন্য দেয়া হয়নি, সঠিক সময়ে সঠিক পথে এটার
ব্যাবহার কোরও, নাহলে ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হবে !!!” এদিক ওদিক তাকাল আরসান, যেই
কথাটা বলে থাকুক, ঠাট্টা যে করেনি এটা পরিষ্কার ! নাঃ এটা তাহলে বেশি ব্যাবহার না করাই
ভাল, আর তাছাড়া পরশু তো সবার সাথে দেখা হচ্ছেই !!

আগমবাগীশের আগমন
নিচের বিস্তৃ ত সমতলের দিকে তাকালেন সাধু , তাঁর ঊর্ধ্বতন চতু র্থ পূর্বপুরুষের সঁপে যাওয়া
দায়িত্বের টানে তাঁকে নেমে আসতে হয়েছে সমতলে, তাঁরা ঊর্ধ্বতন বেশ কয়েক পুরুষের বিখ্যাত
তন্ত্র সাধক বা সাধিকা, এক সময় সাধু সন্ন্যাসীদের যথেষ্ট কদর ছিল সমগ্র ভারত উপমহাদেশে।
কিন্তু এখন সময় বদলেছে, স্মার্ট ফোন, ফাস্ট ফু ড আর দ্রুতগামী পৃথিবীর এই যুগে তাঁরা বিস্মৃত
প্রায়। কিন্তু তবু, মানুষের ধর্ম বিশ্বাস এখনও টিকে আছে, টিকে আছে পূজা আচ্চা, সেই সাথে টিকে
আছে কালো জাদু আর শয়তানের দল ! তবে যুগে যুগে অধর্ম আর অন্ধকারের বিরুদ্ধে ধর্ম আর
আলোরই জয় হয়েছে। গলাতে ঝোলানো রুদ্রাক্ষের মালাতে হাত বুলালেন সাধু, বিড়বিড় করে ইষ্টনাম
জপ করে ,প্রায় পনেরো বছর পরে সমতলে পা রাখলেন তিনি, একটা বাস ধরে এই দেশটির
রাজধানীতে পৌঁছাতে হবে তাঁকে, খুব দ্রুত, হাতে একদম সময় নেই। তাঁদের অনেকদিন আগেকার
পূর্বপুরুষদের কুলগুরু ছিলেন স্বয়ং কৃ ষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, তিনি সরাসরি তাঁদের কাউকে দীক্ষা
দেননি, তাঁরা তাঁর ভাব শিষ্য ছিলেন শুধু, কিন্তু তাঁদের ভক্তি দেখে তু ষ্ট হয়ে তিনি তাঁদের
আশীর্বাদ করেছিলেন, “যা, তোদের বংশে প্রতি প্রজন্মেই এক জন করে শক্তিশালী তন্ত্র সাধকের জন্ম
হবে, কিন্তু বয়ঃপ্রাপ্ত হলে সবাইকেই গৃহত্যাগ করতে হবে ! এর অন্যথা হলে তারা কিন্তু ক্ষমতা
হারিয়ে ফেলবে !!” সেই শুরু, এখনও চলেছে এই ধারা , তাঁর অধস্তন বর্ত মান বংশেও হিসাব
মতো একজন তন্ত্র পথে যাত্রা শুরু করার কথা, তার অবস্থান কিছু নিগুঢ় প্রক্রিয়াতে তিনি প্রায়
বের করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে, আগে তার সাথেই দেখা করতে হবে, তারপর বাকিরা আপনাতেই
এসে পড়বে ! আগম তন্ত্রের সাধনাতে সিদ্ধিলাভ করে “আগমবাগীশ” হয়েছেন তিনি, এবার সময়
হয়েছে উত্তরপুরুষকে সেই পথ দেখানোর ! প্রথম “আগমবাগীশ” মহামহোপধ্যায় কৃ ষ্ণানন্দ ভট্টাচার্যের
উদ্দেশ্য করে কপালে হাত ঠেকালেন তিনি ।
19

অধ্যায় – ছয়

আবার হোল দেখা !!


চোখ বন্ধ করে নিজের নিজের শোবার ঘরে বসে আছে তপু, আরসান, সায়নী আর সুমিত্রা। জপ
করে চলেছে মন্ত্র ! বেশ খানিকক্ষণ পরে চোখ খুলে সবাই দেখতে পেল, সবাই আরসানের শোবার
ঘরের মেঝেতে বসে আছে ! সবসময় এখানেই কেন সবাই জড় হয় এটা ওদের কেউই বুঝতে
পারল না ! তবে সেটা নিয়ে পরেও ভাবা যাবে চিন্তা করল সবাই !আপাতত ওরা একত্রিত হতে
পেরেই খুশি ! আরসান প্রথমেই যে কাজটা করল তা হল, সবার মোবাইল নাম্বার নিয়ে নিলো,
খালি তপুর বেলা নিতে হল একটা টি এন্ড টি নাম্বার , সেটাও আবার অনাথ আশ্রমের অন
রিকোয়েস্ট নাম্বার, কিছু করার নেই ! সবার বিস্তারিত ঠিকানা একে অপরকে জানাল তারা, সব
কিছু একটা গাবদা খাতাতে টু কে রাখল সুমিত্রা, সায়নী একটা প্যাডে , তপু আর আরসান নিজেদের
ছোট্ট ডায়রিতে ! তারপর সুমিত্রা ওদেরকে স্বপ্নের কথা বলল, তপু বলল তার অনুভুতির কথা,
সায়নী বলল তার শক্তির কথা, আর আরসান যখন বলল তার ক্ষমতার কথা, সবাই বেশ
ভালমত চমক খেল। মজার ব্যাপার হল, আরসান আর তপুর বাসা খুব কাছাকাছি, সুমিত্রা আরও
সিরিয়াস , কোত্থেকে একটা ম্যাপ নিয়ে এসে ওদের বাসার অবস্থান গুলো পিন পয়েন্ট করে রাখল,
সেটার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে ছিল তপু, সে হঠাৎ বলে উঠলো, দাঁড়াও দাঁড়াও, পিন পয়েন্ট গুলোকে
একত্র করে একটা রেখা আঁক দেখি, কথামত সুমিত্রা তাই করল, সেটা দেখে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে
উঠলো তপু, “আরে!! এটা ত দেখি একটা ত্রিভু জ ! আমি একটা বইয়ে পড়েছি , এরকম ত্রিভু জের
ঠিক মাঝখানে একটা শক্তি বলয় থাকে , সেটা কোন বস্তু বা ব্যাক্তি যে কোন কিছু হতে পারে !
” আরসান সবার আগে ধরতে পারল , “তু মি বলতে চাচ্ছ আমাদের এই হঠাৎ শক্তি লাভের পেছনে
এটার কোন ভু মিকা আছে ?” “হুম” মাথা ঝাঁকাল তপু, “এই মাঝখানের পয়েন্ট টা যেখানে নির্দে শ
করছে, সেই জায়গাটা আমি চিনি, ”বলল সায়নী, “তাহলে চল সেখানে যাই , সবাই মিলে ” বলল
সুমিত্রা, “ দাঁড়াও, আমি যেটা চিন্তা করছি সেটাই যদি হয়”, বলল তপু “তাহলে সেখানে যাবার
আগে কিছু প্রস্তুতি নেয়ার দরকার আছে, কারন সেখানে যা আছে সেটা ভাল নাকি খারাপ আমরা
কেউ জানিনা”...।“হুম্মম, তোমার যুক্তি মানছি, কিন্তু প্রস্তুতি নিতে তোমার কিরকম সময়
লাগবে?” বলল আরসান ‘আজ রবিবার, এই ধর আগামী শুক্রবারের ভেতর হয়ে যাবে আশা করি,
আর এর মাঝে বুধবারে আবার আমরা আবার দেখা করব’।তপু বলল “এভাবে না প্লিজ, একটা
আসল জায়গাতে আসল আমরা দেখা করি ?” অনুনয় ঝরল সায়নীর কণ্ঠে ! “ওকে , ” বলে
ম্যাপের উপর জয়দেব পুরের একটা জায়গা দেখিয়ে বলল, “এখানে আগামী বুধবার দুপুর ১ টায়
সবাই দেখা করব, কেমন ? তারপর আমাদের সেই পয়েন্ট টাতে যাব সবাই মিলে ! ” সবাই
হাসিমুখে সম্মতি জানাল , হাজার হোক, পরস্পরকে রক্ত মাংসে দেখতে চায় সবাইই !! কিন্তু তারা
তখনও জানত না, সেখানে তাদের জন্য এক অনাকাঙ্ক্ষিত বিস্ময় আর ভয়ঙ্কর বিপদ অপেক্ষা করে
আছে!!
20

ত্রিভু জের শক্তি


কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এর কাছের একটা মোটামুটি মানের হোটেল থেকে বের হয়ে এলেন এক
দীর্ঘদেহী দাড়ি গোঁফ এ ঢাকা এক ব্যাক্তি, পরনে অতি সাধারণ মানের শার্ট প্যান্ট, কাঁধে একটা
বিরাট আকৃ তির ঝোলা, অন্য কেউ হলে তার কাঁধ ঝু লে যেত, কিন্তু ইনি দীর্ঘদেহী হওয়াতে ওনার
তেমন কোন কষ্ট হচ্ছে না। ওনার গন্তব্য ঢাকার অদূরেই , যেতে এক দেড় ঘণ্টার বেশি লাগার
কথা না কিন্তু ঢাকার জ্যাম এর যে বদনাম শুনেছেন, তাতে এক ঘণ্টার পথ কয় ঘণ্টাতে
যাওয়া যাবে কে জানে ! ঢাকা পরিবহনের একটা গাড়িতে চেপে বসলেন উনি ‘দুর্গা দুর্গা’ বলে ।
আসলে উনি যাচ্ছেন ভাওয়াল রাজবাড়িতে, সঠিক ভাবে বলতে গেলে রাজবাড়ি ফেলে আরও এক
মাইল ভেতরে, যেটার স্থানীয় নাম ভাওয়াল রাজ শ্মশানেশ্বরী ! সেখানে আগেকার দিনের রাজাদের
ও রাজ পরিবারের সদস্যদের শুধু পোড়ানোর অনুমতি ছিল। তাঁর বিশেষ ক্ষমতা বলে তিনি জানতে
পেরেছেন, সেখানে দু-একদিনের ভেতর কোন বিশেষ ঘটনা ঘটবে, তখন সেখানে তিনি সশরীরে
উপস্থিত থাকতে চান। ম্যাপ এ একটা জবাফু ল রেখে তিনদিনের মাথাতে সেটা নিজে নিজে নড়ে
গিয়ে যে অবস্থান দেখাচ্ছিল, চিলাই নদীর ধারের এই প্রাক্তন শ্মশানকেই তাঁর সবচেয়ে উপযুক্ত মনে
হয়েছে ঘটনাস্থল হিসাবে !

কাঁধের ব্যাকপ্যাকটা আরেকটু টেনে টু নে উপরে তু লে নিল আরসান , নিজের গাড়িটা ইচ্ছে করেই
আনেনি সবার নজরে পড়ে যাবে বলে, মা বাবাকে বলে এসেছে কিছু বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবে
বলে, তাঁরা নিজেদের স্মার্ট ফোনের থেকে অনেক কষ্টে মাটির পৃথিবীতে একটু নেমে বলেছেন ‘ ও
আচ্ছা !! যাও না, ভাল ত !!’ কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে , কবে ফিরবে, আদৌ ফিরবে কিনা,
কোন জিজ্ঞাস্য নেই , শুধুই ও আচ্ছা !! তপু বাদে বাকি দুজনকে মোটামুটি সি আই ডির জেরার
মুখেই পড়তে হয়েছে । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরসান , এই জায়গাটার নাম শিব বাড়ি ,
জয়দেবপুর এ জায়গাটা , এখান থেকে রিকশা নিলেই ওদের ত্রিভু জ এ চিন্হিত সেই জায়গাটার
কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। নিজের স্মার্ট ফোনটা বের করল আরসান, গন্তব্য থেকে এখনও মাইল
দুয়েক দূরে আছে। বাকিরা কতটু কু এসেছে কে জানে, সায়নী আর সুমিত্রার কাছে মোবাইল আছে ,
জানা যাবে , তপু টা কদ্দুর এসেছে কে জানে !

পিঠে একটা ধার করা ব্যাক প্যাক নিয়ে তপু যখন ঢাকা পরিবহনের বাসটাতে উঠলো, তখন এক
টাই সিট খালি ছিল, সেটা দাড়ি গোঁফ অলা এক দীর্ঘদেহী লোকের পাশে, সেখানেই বসলো তপু,
লোকটা ঘুমচ্চে ু , ঘুমাক। জয়দেবপুর পৌঁছাতে আরও ঘণ্টা খানেক লাগবে, চোখ বুজল তপু, একটু
ঘুমিয়ে নেবে। কিন্তু পাশের লোকটা ধড়মড়িয়ে সোজা হয়ে বসলো, এক অদ্ভু ত শক্তির উপস্থিতি টের
পেয়েছে সে, ঠিক একটা ছোটখাটো সূর্যের পাশাপাশি এসে গেছে এমন এক অনুভূতি, তবে কি,
তবে কি এই সেই উত্তর পুরুষ যার সন্ধানে প্রায় একটা গোটা মহাদেশ পাড়ি দিয়েছেন তিনি, মা
ব্রহ্মময়ী কি তবে তার ডাক শুনেছেন ? তিনি খুব সাবধানে পাশের সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলেটির
দিকে তাকালেন, ওই তো কপালে দেখা যাচ্ছে তাদের বংশের চিন্হ !! অর্ধ চন্দ্র ! যা স্বয়ং শিবের
মাথাতে শোভা পায়, এটা কপালের উপরের দিকে তৃ তীয় নয়নের কাছাকাছি থাকে , বিশেষ ক্ষমতা
সম্পন্ন দৃষ্টি ছাড়া অন্য কেউ সেটা দেখবে না, গভীর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন পূর্ণানন্দ আগম
বাগীশ , এখন আর সন্দেহ নেই , এ ই সেই ! তবে এখনি নিজের পরিচয় দেবেন না সাধু, একে
21

লক্ষ্য রাখবেন, কোথায় যায় , কি করে , সব দেখে বুঝতে হবে এখনি তন্ত্র সাধনার উপযোগী
হয়েছে কিনা, হলে ভাল সাথে নিয়ে যাবেন, আর না হলে ............ সে তখন দেখা যাবে খন।

আশ্চর্যজনকভাবে সায়নী আর সুমিত্রা একই বাসে উঠলো, সাথে সুমিত্রার মা, তিনি কিছু তেই মেয়েকে
একলা ছাড়তে রাজি হননি, যা দিনকাল পড়েছে ! ওরা বাসে উঠেই পরস্পরকে চিনতে পারল ,
আর তারপরই গল্পে মেতে গেল সুমিত্রার মাকে ভু লে ! উনি আর কি করবেন, উদাস চোখে দরজার
দিকে তাকিয়ে রইলেন, বাস ছেড়ে দিল।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই এ সি ফিট করা নোয়াহ গাড়িটাতে উঠলেন সিদ্ধার্থ সোম, সাথে তার
সার্বক্ষণিক বডি গার্ড রুস্তম, বিশালদেহী লোকটা দুই হাতেই গুলি চালাতে পারে, প্রায় সবধরনের
আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে পারে, আনআর্মড কমব্যাটে কমান্ডো প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত, তার প্রভু ভক্তি প্রায়
কুকুরের কাছাকাছি, প্রভু টি তাকে ছোটবেলাতে একটা ডাস্টবিন থেকেই কুড়িয়ে পেয়েছিল, তখনও
সিদ্ধার্থ সোম পুরোপুরি পিশাচ হয়ে যায়নি, এটা তখনকার কথা। সে যথেষ্ট বিরক্ত এই সামান্য
কাজে প্রভু নিজে এসেছেন বলে, কয়েকটা পুচ ঁ কে ছেলে মেয়েকেই তো তু লে নিতে হবে, এ আর বেশি
কি কথা ! এস এস ওরফে সিদ্ধার্থ সোমকে সে কথা বলতেই উনি গম্ভীর গলাতে বলেছেন , ‘এরা
সাধারণ ছেলেমেয়ে নয়, ভীষণ শক্তিশালী একেকটা , শারীরিকভাবে যতটা না, মানসিকভাবে অনেক
বেশি, নিজেদের পূর্ণ শক্তিতে এখনও আসেনি, নিজেরা সে ব্যাপারে ভালোভাবে ওয়াকিফহাল ও নয়,
তাতেই অনেকটু কু শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছিল , নাঃ, এদের জন্য আমাকেই যেতে হবে রুস্তম !’
তন্ত্রের নিগুঢ় যে প্রক্রিয়াতে এদের তিনি ট্র্যাক করেছেন, তা যথেষ্ট ভয়ংকর ও কষ্টসাধ্য, সেটা আর
রুস্তমের কাছে ভাঙ্গলেন না । নিঃশব্দ গতিতে জয়দেবপুরের দিকে চলল ব্ল্যাক কালারের নোয়াহ,
সময় নষ্ট করতে রাজি নন এস এস, ওরা পৌছার আগেই জাল পেতে রাখতে চান। প্রভাবশালী এক
বাংলাদেশী বন্ধুকে দিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে খবর দেয়া আছে, ওরা যথাসাধ্য সাহায্য করবে এস এস
কে তথাকথিত “জঙ্গি নেটওয়ার্ক ” এর চারজন কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েকে ধরতে ! সব প্ল্যান ছকা
আছে, ধরার পরপরই এই নোয়াহ তে চড়িয়েই এয়ার পোর্টে নিয়ে আসবেন ওদেরকে , বেশি গাঁই
গুই করলে ক্লোরোফর্ম দিয়ে দেবেন ভারী ডোজ এর !!

তপুদের আর সায়নীদের বাসটা প্রায় একই সাথে পৌছল শিব বাড়িতে, বাস থেকে নেমেই ওরা
দেখল লম্বামত একটা ছেলে , কাঁধে ব্যাক প্যাক , টং এ দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে আর উদাস ভঙ্গিতে
এদিক ওদিক তাকাচ্ছে , সুমিত্রা দূর থেকেই চিনে গিয়ে ডাকল ‘এই যে, আরসান ! আমরা এখানে
!!” ওর গলা শুনে তপুও এদিকে তাকাল , একই সাথে আরসান কেও দেখতে পেল। সবাই গিয়ে
ওই টং দোকানের সামনে জড় হল, হাই হেলো ইত্যাদি শেষ হবার পর ওরা ঠিক করল কিছু খাওয়া
দাওয়া করে মোটামুটি মানের একটা হোটেল ঠিক করেই ওরা ম্যাপ এ যে জায়গাটা দেখেছিলো সেটা
খুজ
ঁ তে বেরোবে, অবশ্য গুগল মামার (আজকালকার পোলাপান গুগল কে মামাই ডাকে ! )
কল্যাণে আজকাল যে কোন জায়গা খুজে বের করা পানিভাত ! তারপর ও ওরা অজানা একটা
উত্তেজনা টের পেল রক্তের ভেতর । ওরা টের পেল না, দূর থেকে ওদের দিকে অবাক হয়ে
তাকিয়ে আছেন পূর্ণানন্দ , ওদের চারজনই যে বিশেষ কেউ, সেটা সামান্য তম ক্ষমতা আছে এমন
যে কেউ চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে ! তাঁর মনে হচ্ছে তিনি যেন শক্তির একটা মোটামুটি
নদীর কাছে দাঁড়িয়ে আছেন ! তিনি ঠিক করলেন, দূর থেকে ওদের লক্ষ্য করবেন, আর তাঁর সাথে
22

যে ছেলেটি এসেছে, তাকে আলাদা পেলে সব খুলে বলবেন। ওর জানার অধিকার আছে যে ও কোন
বংশের ছেলে আর কি কি শক্তি ও ধরে তা জানবার।

ওরা নিজেদের নিয়ে ব্যাস্ত না থাকলে আরও দেখতে পেত, বেশ খানিকটা দূরে একটা ব্ল্যাক
কালারের নোয়াহ ঠায় বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে কালো চশমা পরা এক দশাসই
লোক এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে , আর বিড়বিড় করে বলছে , “জয় মহাকালেশ্বর,
তোমার নৈবেদ্য পেয়ে গেছি বাবা ! এখন সময় সুযোগ বুঝে তোমার পায়ে নিবেদন করার অপেক্ষা
!” ওদিকে পূর্ণানন্দের নাক কুঁ চকে উঠলো হঠাৎ, কি ব্যাপার, শ্মশানের মরা পোড়ার গন্ধ আসে
কোত্থেকে, এদিক ওদিক তাকালেন তিনি, কাছে পিঠে তো কোন শ্মশান দেখা যাচ্ছে না ! অদ্ভু ত
ব্যাপার হল, একটা কালো রঙের গাড়ির দিক থেকেই যেন আসছে গন্ধটা !! পাশ থেকে তিনি এস
এস কে দেখে ফেললেন, সাধারণ মানুষের ইন্দ্রিয় যা ধরতে পারেনা, তা তিনি নিমিষে ধরে ফেলেন,
অন্যরা যেখানে এস এস কে মানুষ হিসাবে দেখত, সেখানে তিনি দেখলেন এক বীভৎস আধপোড়া
মুখ , যার দাঁত আর জিহ্বা বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে, আর গা থেকে ভেসে আসছে বিশ্রী মরা
পোড়ানোর গন্ধ ! তিনি অঘোরী সন্ন্যাসী , এ গন্ধে তিনি অভ্যস্ত থাকার কথা, কিন্তু এ লোক
দুরাত্মা, এর গন্ধ তাঁর কাছে অসহ্য ঠেকছে, তিনি নিজের অজান্তে শার্টে র ভেতর হাত ঢু কিয়ে গলার
রুদ্রাক্ষের মালাটা চেপে ধরে গাড়িটার দিকেই এগচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু গাড়িটা সচল হয়ে তাঁর সামনে
দিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল ! তিনি নাম্বার প্লেট টা মুখস্ত করে নিলেন, লোকটা ছেলেমেয়েগুলির
দিকে তাকিয়ে ছিল, বুঝতে পারলেন তিনি , ওদের জন্য তাঁর বেশ চিন্তা হতে শুরু করল। তিনি
ঠিক করলেন, ওরা যেখানেই উঠু ক না কেন তিনি দেখা করে সব বিস্তারিত বলবেন।

অধ্যায় – সাত
ওরা উঠলো “হোটেল সোনার তরী” তে, মোটামুটি মানের হোটেল, ম্যানেজার কোণা চোখে তাকাচ্ছে
দেখে আরসান ওর বাবার পরিচিত এক এস আই ( উনি গাজীপুর থানাতে আছেন) এর নাম
বলল, তাতেই লোকটা ঠাণ্ডা মেরে গিয়ে গদগদ হয়ে বলল , “কিছু লাগলে জানাবেন” , আরসান
আর তপু এক রুমে , সায়নী, সুমিত্রা আর মা আরেক রুমে, অনেকক্ষণ আড্ডার ফাঁকে আরসান
আর তপুর নাড়ি নক্ষত্র জেনে নিলেন মা, তপুর কাহিনী শুনে আহা উহু করলেন, আরসানের বাবার
পরিচয় শুনে চোখ কপালে তু লে বললেন , “তু মি উনার ছেলে, ওরে বাপরে ! এভাবে এখানে
আসতে দিল !” জবাব দিতে আরসান ইতস্তত করছে দেখে সায়নী বাচাল , “আসলে আঙ্কেল
আন্টি অনেক ব্যাস্ত থাকেন, তাই ওকে একটু একা ঘোরার সুযোগ দিচ্ছেন আর কি !” কৃ তজ্ঞ
দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল আরসান, ভাবটা হল “বাঁচালে !” মাকে আর বেশি কথা বলার সুযোগ
দিল না সুমিত্রা, হোটেলের বয়ের আনা খাবার খেল ওরা একসাথে, তপুরা অনাথাশ্রমে একসাথেই
খায় সবাই, বাকিরাও তাই, কিন্তু আরসান কে একাই খেতে হয় সবসময়, ওর চোখে পানি চলে এল
যখন মা বললেন “এই, বড় টু করাটা আরসু বাবুকে দে, বেচারা ঠিকমতো খেতে পায়না দেখেই
বোঝা যাচ্ছে ! মুখটা এতোটু কুন !! তপু তু মিও নাও বাবা, বাপ মা মরা ছেলে আমার , আহারে
!” আরসান তপু দুজনেই আরেকদিকে তাকিয়ে রইল, চোখের পানি বন্ধুদের দেখাতে চায়না !!
খাবার দাবার এর পাঠ চোকার পর যে যার রুমে শুয়ে পড়ল, কালকে অনেক কাজ ।

ঠক ঠক করে দরজাতে আওয়াজ হচ্ছে, তপুর ঘুম পাতলা, ওই উঠলো আগে, আরসান কে ধাক্কা
দিয়ে জাগাল, “ উম্ম। কি হল ! ” বলে পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছিল আরসান , ওকে আরও জোরে
23

ধাক্কা দিল তপু “ওঠো তো, কে জানি দরজা ধাক্কাচ্ছে !” এবার তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো
মার্শাল আর্টে র ট্রেনিং পাওয়া আরসান, মুহূর্তে সজাগ হয়ে গেছে সমস্ত ইন্দ্রিয়, “দরজা খোল, ভয়
নেই , আমি আছি !” মুচকে হাসল তপু, ও ভয় পায়নি, সতর্ক থাকছিল কেবল, অচেনা জায়গা ,
কে কোন মতলব নিয়ে ঘুরছে কে জানে ! দরজা হালকা খুলে উঁকি দিল তপু, বারান্দার মিটমিটে
আলোতে দেখল দীর্ঘদেহী দাড়ি গোঁফ অলা এক লোক দাঁড়িয়ে আছে, “কে আপনি ? এতরাতে
আমাদের কাছে কি চান ?” দাড়ি গোঁফের আড়ালে ফিকে হাসলেন পূর্ণানন্দ, সাহস আছে ছেলেটার,
এত রাতে তিনি হলে ভয়েই দরজা খুলতেন না । “আমাকে তু মি চিনবে না, আমি পূর্ণানন্দ
আগমবাগীশ, ধুর্যটি মোহন মল্লিক নামটা কি তোমার চেনা মনে হয় ? ” মাথাতে তোলপাড় শুরু
হল তপুর , সে কি ! এ যে তার দাদুর বাবার নাম বলছে ! তাঁকে ইনি কিভাবে চেনেন, বেঁচে
থাকলে ( মানুষ অতদিন কি বাঁচে ! ) তাঁর বয়স এতদিনে দুশোর কাছাকাছি হত ! তবে মনে
যাই হিসাব করুক, লোকটিকে ভেতরে ঢু কতে দিল সে, হাসিটা দেখেছে সে, এমন সদয় হাসি যে
হাসতে পারে সে খারাপ লোক হতে পারেনা ! দরজার আড়ালে মার্শাল আর্টে র এক বিশেষ ভঙ্গিতে
দাঁড়িয়ে ছিল আরসান, তপু ইঙ্গিত করলেই বাঘের মত শত্রুর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে প্রস্তুত, সেদিকে
তাকিয়ে প্রায় আঁতকে উঠলেন পূর্ণানন্দ, আর মনে মনে হাসলেন, তাঁর শরীর লোহার মত শক্ত,
তাঁকে কাবু করতে গেলে কমপক্ষে বিশ জন লোকের প্রয়োজন ! সেটা এর এদের কাছে ভাংলেন না
তিনি, কিছু জিনিস গুপ্ত থাকাই ভাল। ভেতরে ঢু কে সব আদ্যোপান্ত বললেন পূর্ণানন্দ তপুকে,
শুনতে শুনতে অবিশ্বাসে কুঁ চকে যাচ্ছিল তপুর ভ্রু জোড়া, কিন্তু তিনি যখন “বৃহৎ তন্ত্র সার ” এর
কথা বললেন, তখন সে টলে গেল, এটা ইনি কিভাবে জানলেন, “আমি অন্তত তোমাদের সম্পর্কে
সব কিছু জানি!” পূর্ণানন্দ বললেন, আশ্চর্য ! লোকটা থট রিডিং জানে নাকি ! “এই শক্তি
তোমার ভেতরেও আছে ! শুধু সময় নিয়ে জাগিয়ে তু লতে হবে !” ওকে আবার চমকে দিয়ে
বললেন পূর্ণানন্দ ! তিনি শিব বাড়িতে কালো মাইক্রো এবং তার আরোহীর কথা বলেও এদেরকে
সতর্ক করে দিলেন, ঠিক হল, কালকে দিনের বেলা ওরা গাজীপুরের দর্শনীয় জায়গা গুলি দেখবে,
বিকালে সবাই মিলে ত্রিভু জ এর জায়গাটাতে যাবে, আরসান রা সামনে থাকবে, ব্যাক আপ হিসাবে
থাকবেন পূর্ণানন্দ, তিনি প্রথমেই দেখা দিতে চান না, আরসানের পরিচিত এস আই আঙ্কেল কে বলে
রাখা হবে, বিপদ আপদ কিছু হলে উনি যাতে ছু টে আসতে পারেন। পাশেই একটা বোর্ডি ং এ
উঠেছেন পূর্ণানন্দ, বিকালে ওদেরকে দূর থেকে অনুসরণ করবেন, সকালে ওনার নিজের কিছু কাজ
আছে। অনেকদিন পর মনে একই সাথে উত্তেজনা আর আনন্দ নিয়ে ঘুমাতে গেল আরসান আর তপু
!!

সকালে উঠে বাকি সবাইকে রাতের আগন্তুক এর কথা বলল আরসান, শুনে ওরা যার পর নাই
উত্তেজিত, এখনি ওনাকে দেখতে চায়, কিন্তু তপু ওদের নিরস্ত করল এই বলে, যে সেক্ষেত্রে ওই
কালো মাইক্রোর আরোহী সতর্ক হয়ে যাবে, আর ওদের এই মুহূর্তে একজন রক্ষক এর খুবই
প্রয়োজন। তো, ওরা ঘুরলো ভালোই, নুহাশ পল্লী, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক , ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্ক
ইত্যাদি ঘোরা শেষে ওরা বেশ কিছু ছবিও তু লল আরসান এর Fujifilm Instax Mini 11 দিয়ে, ফটো
তোলার এক মিনিটের ভেতর যখন সেগুলি ক্যামেরা থেকেই প্রিন্ট হয়ে বের হয়ে এলো, সেটা দেখে
বাকিরা হাঁ হয়ে গেল, মুচকি হাসল আরসান , এতেই হাঁ ! ওর কাছে আরও সব যা গ্যাজেট আছে
সেগুলি দেখে ওদের হাঁ তো বন্ধই হবে না ! যা হোক এরা তার বন্ধু মানুষ,সবই দেখাবে সময়মত,
ফটোগুলি সবাইকে বিলি করল সে স্মৃতি হিসাবে রাখার জন্য, নিজেও চু পি চু পি সুমিত্রার সাথে তোলা
কয়েকটা ছবি রেখে দিল, আর সুমিত্রাকে দিলো কেবল ওর নিজের সাথে তোলা কয়েকটা ছবি !
24

হোটেল নিরিবিলি তে বসে যখন ওরা লাঞ্চ করছিল, তখন কয়েক টেবিল দূরেই কালকে রাতের
লোকটাকে দেখল তপু, সেদিকে তাকাতেই লোকটি ইশারাতে আরও কয়েক টেবিল দূরের তিনজন
লোকের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, কনুই এর গুঁতো দিয়ে আরসান কেও দেখাল তপু, ওদের মধ্যে
একজন বেশ দশাসই। “সঙ্গে অস্ত্র আছে !” ফিসফিস করে বলল আরসান। তপু আরেকটু ভাল
করে তাকাতেই দেখল, আরে তাইত ! এই গরমেও জ্যাকেট পরা লোকটার বগলের দিকটা ফু লে
আছে ! তপু ভ্রু উচাল পূর্ণানন্দের দিকে তাকিয়ে , উনি ইশারাতে দু পাশে মাথা নাড়লেন, যার
একটাই অর্থ হতে পারে ,এখন না !

ওদিকে মনে মনে ফুঁ সছে রুস্তম, ভারী তো কাজ, কয়েকটা দুধের বাচ্চাকে কিডন্যাপ ! এস এস যে
কেন ওকে পুরো দায়িত্ব দিলেন না কে জানে, রুস্তম কারো পরোয়া করে না, দরকার পড়লে
কয়েকটা লাশ ফেলে এখনি এগুলিকে তু লে নিত, কিন্তু কথার অবাধ্য হলে এস এস এর যা একটা
রুদ্রমূর্তি দেখতে হবে, সেটা মনে পড়লে ওর মত টাফ লোকেরও হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় !
একটা অপারেশনে রুস্তমের অনুপস্থিতিতে আরেকজন মাস্তান এস এস এর কথার অবাধ্য হয়েছিল,
ওকে সবার সামনে খালি হাতেই খুন করে ফেলেছিলেন এস এস , তারপর লোকটার রক্ত মহাকাল
ভৈরব কে উৎসর্গ করেছিলেন খাঁড়া দিয়ে কেটে। বাপরে ! না না দরকার নেই বাবা !

অভিযান শুরু !
বিকেলের দিকে ম্যাপের নির্দে শনা অনুযায়ী রওয়ানা দিল আরসান রা, এবার সুমিত্রার মা এলেন না,
ওনার বয়স হয়েছে, উনি বললেন একটু রেস্ট নেবেন, ওরাও আর না ঘাঁটিয়ে বের হয়ে গেল, ওরা
বের হলে ওদের পিছু পিছু পূর্ণানন্দ ও বের হলেন, দূর থেকে অনুসরণ করে যাবেন উনি, বিপদ
আপদ দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। তপু একটা ঝোলা নিয়েছে, সেখানে কিছু মন্ত্রপূত ফু ল আর
আশীর্বাদী কিছু জিনিস, আরসান পড়েছে ঢিলে ঢালা পোশাক, প্রয়োজন পড়লে যাতে মার্শাল আর্টে র
ভেল্কি দেখাতে পারে, সায়নী হালকা সিদ ঁ র
ু নিয়ে এসেছে, সেগুলি জামার পকেটে আছে, আর সুমিত্রার
মনের জোর ই ভরসা ! ও ওর স্বপ্নের কথা সবাইকে বলেছিল, সবাই যথেষ্ট গুরুত্তের সাথে নিয়েছে
ওর কথা আর সেইমত প্রস্তুত ও হয়েছে ! ওরা যে জায়গাতে যাচ্ছে সেটার নাম হল ভাওয়াল রাজ
শ্মশানেশ্বরী ! চিলাই নদীর ধারের এই শ্মশানে শুধু ভাওয়াল রাজ পরিবারের সদস্যদেরই পোড়ানোর
অনুমতি ছিল, পুরান শ্মশান মন্দিরের অবস্থা করুণ, তার পাশে একটা নতু ন মন্দির উঠেছে । এই
দুই মন্দিরের পেছনে নদীর পাড়েই পোড়ানোর ব্যাবস্থা ছিল, ওরা যখন সেখানে পৌঁছল তখন শেষ
বিকেল, একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে । জায়গাটাতে ঢোকার পর থেকেই চারজনেরই কেমন যেন অস্বস্তি
লাগছিল, একটু পরেই তপু দেখল ওর দুই হাতের তালু খুব ধীরে ধীরে যেন জ্বলে উঠছে !
আরসানের চোখের সামনে যেন বাইস্কোপ এর মত ও যেসব জায়গাতে ও গিয়েছে বা ছবি দেখেছে ,
সেসব সরে সরে যাচ্ছে, সায়নীর সারা শরীর হঠাৎ করে আলো ছড়াতে লেগেছে, আর সুমিত্রার
স্বপ্নের সেই কুৎসিত মুখটা যেন বীভৎস হাসি মাখা মুখে নিঃশব্দে চিৎকার করে চলেছে, “আমি খুব
কাছেই আছি, হাহাহাহা!!” একটু দূরেই অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে এদিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছেন
স্বয়ং পূর্ণানন্দ, এরা যা শক্তি বিচ্ছুরণ করতে লেগেছে কোন অন্ধও তা দেখতে পেয়ে যাবে, এখানে
নিশ্চয়ই এমন কোন শক্তি আধার আছে যেটার কারণে এমনটা হচ্ছে ! সেটা কি বের করতে যেই
উনি আড়াল ছেড়ে বেরোতে যাবেন, অমনি ওকি ! ওরা কারা !
25

তপুরাও দেখল হঠা ৎ করেই যেন মাটি ফুঁ ড়ে উদয় হল পাঁচ ছয়জনের একটা দল, সকলের পরনে
কালো পোশাক , হাতে বেঁটে বেঁটে কিসব অস্ত্র, এই অল্প আলোতেও ওগুলি চিনতে পারলো অস্ত্র শস্ত্রে
আন অফিসিয়াল পি এইচ ডি করা আরসান (অবশ্যই গুগল মামার কল্যাণে!) , “ইস্রাইলি উজি
সাব মেসিন গান! অল্প জায়গাতে ছোট নিশানাতে দারুন কার্যকর !” ফিসফিস করে সঙ্গীদের বলল
সে ! “ ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাও, ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ কর ! ” বলতে বলতেই তপু
লাফিয়ে সরে গেল একদিকে । চারজন চারদিকে ছু ট লাগাল, কিন্তু ওদের হিসাবে একটু ভু ল ছিল,
লোকগুলি ওদের মারতে আসেনি ধরতে এসেছে, ‘পপ’ করে একটা শব্দ হল আর ওরা দেখল সুমিত্রা
একটা জালে জড়িয়ে মাটিতে পড়ে ছটফট করছে ! ও দৌড় শুরু করতে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ দেরি
করে ফেলেছিল ! তপু ওর হাতে চোখের পলকে তৈরি হওয়া আগুনের গোলা ছুঁ ড়ে দিল ছায়া মূর্তি
গুলির দিকে, তাতে ওরা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ! এরকমটা ওরা আশা করেনি, সেটার
সুযোগ নিল আরসান, নিঃশব্দে উড়ে গেল খোলা তলোয়ারের মত , দুই পায়ের ‘ফ্লাইং কিক’ মারল
ওর প্রিয় নায়ক র‍ ্যাভেন এর জেফ্রি মিক এর মত ! দুইজন লুটিয়ে পড়ল অ্যাডামস অ্যাপল
(গলার কণ্ঠার হাড়) বরাবর লাথি খেয়ে, গলা চেপে ধরেছে দুজনই ! তপুর আগুনে দুইজনের
কাপড়ে আগুন ধরে যাওয়াতে ওরা মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া ধরল আগুন নেভানর জন্য ! সায়নী
অন্ধকার থেকে ভূ তের মত বাকি দুজনের পেছনে উদয় হয়ে স্রেফ মাথা দুটো সর্বশক্তি দিয়ে ঠু কে
দিল, ওর ভেতর স্বয়ং দেবী ভর করেছেন, সুতরাং সেই দুজনের মাথার ভেতরে হাজারটা তারা
বাতি জ্বলে উঠলো ! পকেট থেকে সুইস আর্মি নাইফ টা বের করে সুমিত্রার জাল আরসান কেটেছে
কি কাটেনি, হঠাৎই জায়গাটা উজ্জ্বল আলোতে ভরে গেল ! “কতগুলি গাড়ল কে দিয়েছে আমার
সাথে ফাইট করার জন্য, ছ্যা !” রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূ ত হলেন স্বয়ং সিদ্ধার্থ সোম ওরফে এস এস ,
আরসান দের নাক কুঁ চকে উঠলো , বিশ্রী মরা পোড়ানোর গন্ধটা ওরাও পাচ্ছে, যেমন পূর্ণানন্দ
পেয়েছিলেন , কেবল সুমিত্রা শিউরে উঠলো , কারন সে দেখতে পাচ্ছে এক বীভৎস আধপোড়া মুখ
, যার দাঁত আর জিহ্বা বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে, চামড়া বলতে কিছু ই নেই শরীরে , সুটেড বুটেড
একটা বীভৎস নরকঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে সামনে ! এবং এই মুখটাই স্বপ্নে দেখেছিলো সে ! সেটা
আরসান কে বলতেই শক্ত হয়ে দাঁড়ালো সে, পাশাপাশি দাঁড়ালো চার মূর্তি ! প্রায় সাথে সাথে
আক্রমণে গেল ওরা, শত্রুকে সুযোগ দিতে চায়না। তপু ওর সব থেকে বড় আগুনের গোলা,
আরসান ড্রাগন ফিস্ট (বিশেষ ধরণের মার্শাল আর্ট মুদ্রা ) , সায়নী জ্বলন্ত গদা, সুমিত্রা ওর মনের
ভেতর থেকে অদ্ভু তভাবে বাইরে বের হওয়া হলুদ রঙের কুয়াশা (যেটা ওর রাগের প্রতিরূপ বলে
পরে বুঝতে পেরেছিল!) নিয়ে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল এস এস এর উপর । সম্মিলিত আক্রমণে
প্রথমে একটু পিছিয়ে গেল এস এস, কিন্তু সে হল মহাকাল ভৈরবের সাধক, হোক শয়তান ! একটা
অদ্ভু ত সবুজ শিল্ড তৈরি করল নিজের সামনে, তপুর গোলা আটকাল সেটা দিয়ে, গলার দিকে ধেয়ে
আসা আরসানের বিষাক্ত ড্রাগন ফিস্টের মার বামহাত দিয়ে ডাইভার্ট করে ওর ভারসাম্য নড়িয়ে
দিল, সায়নীর গদাটা শিল্ড ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হলেও এস এস এর ক্ষতি করতে পারলো না ,
ডানহাত মুখের সামনে এনে অদ্ভু ত ভঙ্গিতে ফুঁ দিল এস এস , আগুনের একটা ঝটকা দিয়ে উড়িয়ে
দিল সুমিত্রার হলুদ কুয়াশা। তরুণ রক্ত এত সহজে হাল ছাড়ল না, সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে
সামলে নিয়ে প্রতি আক্রমণে গেল চার মূর্তি , আনআর্মড কমব্যাটে কেউই প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত নয়, শুধু
আরসান মার্শাল আর্ট জানে, এরপরও ওরা বুঝতে পারলো , শত্রু যথেষ্ট পরাক্রমশালী ! মিনিট
বিশেক তু মুল লড়াই এর পর একটা বিশাল ঝটকা দিয়ে চারজনকেই একটু দূরে ছুঁ ড়ে ফেলতে সক্ষম
হল এস এস ! তারপর ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা দেখল সবুজ একধরনের লতা ওদের
আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে ! যতই ছটফট করছে সেগুলি আরও এঁটে বসছে ! ঠোঁটের কোণের রক্ত
26

মুছে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো এস এস , “আই এম ইম্প্রেসড!! রিয়েলি ইম্প্রেসড!!! আমি
ভেবেছিলাম এক সেকেন্ড ও টিকতে পারবে না, এখন দেখা যাচ্ছে তোমাদেরকে আন্ডার এসটিমেট
করেছিলাম !”

ওদিকে পূর্ণানন্দ এতক্ষণ শ্বাসরোধ করে ওদের ফাইট দেখছিলেন , এবার বুঝলেন তাঁর হস্তক্ষেপের
সময় এসে গেছে ! তিনি এগোতে যাবেন, মাথার পাশে শীতল নলের স্পর্শ পেলেন, “নড়লে খুলি
উড়ে যাবে !” হিস হিস করে উঠলো এস এস এর বডিগার্ড রুস্তম ! ও এতক্ষণ ঘাপটি মেরে
প্রভু কে দেখে যাচ্ছিল কোন সাহায্য লাগবে কিনা তা দেখতে , প্রভু নিজের কাজ নিজেই ভালোই
সামলেছেন। এবার এই গুপ্ত টিকটিকিটাকে ধরে প্রভু র পায়ে ফেলতে হবে। উনি আগেই বলেছিলেন ,
তৃ তীয় একটা শক্তির উপস্থিতি টের পাচ্ছেন তিনি, সেটার জন্য সতর্ক থাকতে বলছিলেন রুস্তমকে,
এখন দেখা যাচ্ছে তাঁর অনুমানই সঠিক ! প্রভু র প্রতি আরেকবার শ্রদ্ধাতে মাথা নত হয়ে এল
রুস্তমের ! এসব ভাবতে ভাবতে সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল, এই সুযোগে ঝট করে বসে
পড়লেন পূর্ণানন্দ, দুই হাতে থুতু মাখিয়ে বিড়বিড় করে কি একটা বলে দুই হাতের চেটো চেপে
ধরলেন রুস্তমের মাথার দুই পাশে, সাথে সাথে যেন হাজার ভোল্টের ঝটকা খেল রুস্তম ! মাথা
চেপে ধরে বসে পড়ল সে ! ওদিকে তখন প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক ঘিরে ধরেছে আরসান দের,
সেদিকে আক্ষেপের সাথে তাকালেন পূর্ণানন্দ , এতজনের সাথে তিনি একা পাল্লা টানতে পারবেন না,
সেটা আত্মহত্যার সামিল হবে । তাঁর চাইতে এদেরকে দূর থেকে অনুসরণ করবেন তিনি, কোথায়
নিয়ে যায় সেটা দেখে পরবর্তী করনীয় ঠিক করবেন । মুহূর্তে ই পিছনের গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য
হয়ে গেলেন তিনি !

কড়া ডোজের সিডেটিভ দিয়ে আরসান দের তোলা হল আগে থেকে তৈরি করে রাখা এ্যাম্বুলেন্সে !
সামনে কালো নোআহ মাইক্রো আর পেছনে এ্যাম্বুলেন্সের বিচিত্র বহর ছু টল ঢাকা এয়ার পোর্ট এর
দিকে ! ওরা কেউ লক্ষ্য করল না, পেছনে একটা রেন্ট এ কারের স্টেশন ওয়াগন পিছু নিয়েছে
ওদের, যেটার সিটে বসে আছেন পূর্ণানন্দ, মোবাইল এ সান্ত্বনা দিচ্ছেন ক্রন্দনরত সুমিত্রার মাকে,
আর বলে দিচ্ছেন সায়নীর দিম্মা, তপুর হোস্টেল আর আরসানের বাবা মায়ের কাছে এই দুর্ঘটনার
খবর পৌঁছে দিতে !

এয়ার পোর্ট এ পৌঁছে আরেকটা অপেক্ষারত এয়ার এ্যাম্বুলেন্স এ সবাইকে তু লল এস এস, সর্বনাশ !!
ভাবলেন পূর্ণানন্দ, এবার কি হবে ! তিনি তো চট করে প্লেনে উঠতে পারবেন না, পরমুহুরতে তাঁর
মনে পড়ল, আরে ! এসব তিনি কি ভাবছেন ! তপুর সাথে দেখা করার সময়ই তো তিনি তপুর
চু লের একটা ছোট্ট একটা গোছা চেয়ে নিয়েছিলেন ! সেটার সাহায্যেই তিনি অন্তত তপুকে পৃথিবীর
যে প্রান্তেই থাকুক না কেন , খুজে বার করে ফেলতে পারবেন না, সেটা না হলেও পারতেন, সাধে
তো তিনি আগমবাগীশ নন ! মাথাতে একটা বেসবল ক্যাপ চাপিয়ে এয়ার পোর্টে র দরজার দিকে
এগিয়ে গেলেন তিনি, দেখতে হবে কোন দেশে ওদেরকে নিয়ে যাচ্ছে ওই পিশাচটা ! তাঁর মন
আনন্দে ভরে গেল যখন তাঁর অনুমান সত্যি করে দেখতে পেলেন ওরা ভারতেই যাচ্ছে ! কপালে
হাত ঠেকালেন তিনি “জয় মা দক্ষিণা কালী ! জয় মা !!”

অধ্যায় – আট
27

মহাকালেশ্বরের সাক্ষাৎ
ইন্দোর এয়ার পোর্ট এ ল্যান্ড করল এস এস এর ব্যাক্তিগত এয়ার এ্যাম্বুলেন্স । ছেলেমেয়েগুলি এখনও
অজ্ঞান ! থাকুক, উঠলেই ঝামেলা , ভাবলেন এস এস। বেশি সময় হাতে নেই, তিনি এখান থেকে
যাবেন উজ্জইন এ, সেখানে আছেন স্বয়ং মহাকালেশ্বর জ্যোতিরলিঙ্গ ! শিব পুরাণ মতে, ব্রহ্মা এবং
বিষ্ণু এক সময়ে কলহে লিপ্ত হন কে জগত সৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় তা নিয়ে, এই কলহ থামাতে শিব
ঠাকুর স্বর্গ , মর্ত ্য (পৃথিবী) , পাতালকে একটি বিরাট আলোক স্তম্ভ দিয়ে বিদ্ধ করলেন, যেটি পরে
ঠাণ্ডা হয়ে আন্নামালাই পর্বতে (বর্ত মান তামিলনাড়ুতে অবস্থিত ) পরিণত হয়। ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু
এরপর এই স্তম্ভের আদি অন্ত খুজ ঁ তে গেলেন দুইজন দুই ধারের দিকে , উপরে আর নিচে। কিন্তু
এই অনাদি স্তম্ভের শেষ তাঁরা কেউই খুজে ঁ পেলেন না ! কিন্তু ব্রহ্মা মিথ্যা করে বললেন তিনি এক
ধার খুজে ঁ পেয়েছেন ! তাঁর এই মিথ্যাচারে শিব ঠাকুর অসন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে অভিশাপ দেন , যদিও
ব্রহ্মা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা, কিন্তু জগতের কেউ তাঁর পুজা করবে না ! যাই হোক , বলা হয় ,
সারা ভারতে ছড়িয়ে আছে এরকম বারোটি জ্যোতিরলিঙ্গ, তার মধ্যে প্রধানতম হল উজ্জইন এর
মহাকালেশ্বর জ্যোতিরলিঙ্গ। এখানে মহা শিবরাত্রির সময় নয়দিন ধরে বিশাল মেলা আর পূজা হয়,
যার স্থানীয় নাম ‘নবরাত্র’। আর একদিন পরই নবরাত্র শুরু হবে , দেশ বিদেশ থেকে , বিশেষত
ভারত থেকেই অনেক সাধু সন্ন্যাসী এসে থানা গাড়েন এই সময়। আর এটাকেই কাজে লাগাতে
চাচ্ছেন এস এস, এই সময় সাধু সন্ন্যাসীর বেশে তাঁর সেই মহাকালের বিগ্রহের সামনে এই সুলক্ষণ
যুক্ত চারজন ছেলেমেয়েকে বলি দিতে পারলেই তাঁর সিদ্ধিলাভ ঘটবে সময়ের অধীশ্বর হিসাবে !
বিগ্রহ নিয়েও সমস্যা নেই, ছয়ফু টের সেই বিগ্রহটি তিনি বিশেষ ব্যবস্থাতে একটি লৌহ কফিনে
রেখেছেন, তিনি যেখানেই যান না কেন , প্রয়োজনের সময় সেটি রুস্তমকে দিয়ে আনিয়ে নেন। এত
ঝামেলা করার উদ্দেশ্য হল সেই যে লামা শর্ট কাট পদ্ধতির কথা লিখে রেখেছেন, সেখানে স্পষ্ট
ভাষাতে লেখা আছে, এই বিশেষ আচার যে কোন জ্যোতিরলিঙ্গ এর কাছেই করতে হবে, সেখান
থেকে বিরাট পরিমাণ শক্তি ধার করতে হবে এই আচার পালনের সময়, এবং অবশ্যই বিশেষ মন্ত্রের
সাহায্যে তান্ত্রিক পদ্ধতিতে! একটা বড় তাঁবু খাটিয়ে সেখানে এই বিগ্রহ স্থাপিত করে পূজা করে
আচার সব পালন করতে পারলেই কেল্লা ফতে ! আর উজ্জইন কে বেছে নেবার কারন হল এটি
তাঁর কর্মস্থলের খুব কাছে আর এখানকার স্থানীয় প্রশাসন তাঁর পরিচিত, যে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত
ঘটনা ঘটলে ধামাচাপা দেয়া যাবে সহজেই ! এমনি সময়ে মহাকালেশ্বর জ্যোতিরলিঙ্গ মন্দিরের
আশেপাশে অতবড় তাঁবু খাটানও যেত না, ‘কাজ’ ও করা যেত না , কিন্তু নবরাত্র এর সময়ে
মহা হই চই এর মধ্যে নির্বিঘ্নে তিনি তাঁর কাজ সমাধা করে সরে পড়তে পারবেন, কেউ ভাল করে
লক্ষ্যও করবে না ! গোঁফে তা দিয়ে মনে মনে হাসলেন তিনি, এরপর ওই দাম্ভিক বিদেশী বিজ্ঞানী
গুলোকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন , সিদ্ধার্থ সোম ওরফে বজ্রধর কি জিনিস ! !

তাঁর একজন পুরান ভক্তের সাহায্যে খবর নিয়ে ইন্দোর এয়ার পোর্ট এ নামলেন পূর্ণানন্দ , প্রাইভেট
ফ্লাইট গুলির গন্তব্য বের করা একটু কঠিন ই হত তাঁর জন্য , তিনি নিয়মকানুন তেমন জানেন না
বলেই ! এখন সমস্যা হল , এই বিশাল মধ্য প্রদেশ এ কোথায় নিয়ে গেল ছেলেমেয়েগুলিকে ! সেই
ভক্তই তাঁকে বেশ অর্থের ও যোগান দিয়েছে , দেবে নাই বা কেন ! আজ থেকে বিশ বছর আগে
তাদের পুরো পরিবারের উপর নেমে এসেছিল দেবী মাতঙ্গীর ভয়ঙ্কর অভিশাপ ( দেবী মাতঙ্গী দশ
মহাবিদ্যার একজন )। অনেক কষ্টে অনেক উপচার আর পূজার মাধ্যমে সেবার তাদের প্রাণ রক্ষা
করেছিলেন তিনি। তিনি না থাকলে মা বাবা ভাই বোন ছেলে মেয়ে সহ সবাই প্রাণ হারাত তারা।
28

সেই ভক্ত কাঁদো কাঁদো গলাতে টেলিফোনে বলল , ‘আপনি চাইলে প্রাণ টাও দিয়ে দিতে পারি ঠাকুর
!! কি লাগবে শুধু বলুন !! ” জবাবে পূর্ণানন্দ স্বভাবসুলভ বিনয়ের সাথে কিছু জিনিস আর
কিছু তথ্য চেয়েছিলেন, যা তিনি সময়মত পেয়েও গেছেন। কাছাকাছি একটা সস্তার হোটেলে
উঠলেন তিনি, মোবাইল এর জন্য একটা ইন্ডিয়ান সিম তিনি আগেই পেয়েছেন সেই ভক্তের কাছে,
এখন হোটেলে উঠে আরসান দের বাবা মায়ের কাছে খবর দিতে হবে। যা করার তাঁরাই করতে
পারবেন বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে ভারতের প্রশাসনের সাহায্যে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের
অবস্থানটা নিগুঢ় এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বের করতে হবে তাঁর, সেটার জন্য একটা নিরিবিলি জায়গা
দরকার, যেটার জন্য আপাতত হোটেল রুমই প্রশস্ত !

তাঁবর ু ভেতর অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন এস এস, নাহ ! এই রুস্তম টাকে নিয়ে আর পারা
গেলনা, মারদাঙ্গাতে এক নম্বর, কিন্তু কোন সূক্ষ্ম কাজ ওকে দিয়ে হবার নয়। বেশিরভাগ উপকরণ
যোগার করাই আছে, কিন্তু কে আর সাথে করে শুকরের রক্ত, কালো বেড়ালের কাটা মাথা, গরুর
সামনের দুটি ক্ষু র এই ধরণের জিনিস নিয়ে ঘোরে ! এই ধরণের ইত্যকার আপাত দৃষ্টিতে ঘৃণ্য কিন্ত
জরুরী জিনিস গুলো যোগাড় করতে পাঠিয়েছেন তিনি রুস্তমকে প্রায় চার ঘণ্টা হল। তার উপর
বাংলাদেশে ব্যাটার হাত ফস্কে কোন এক দাড়ি অলা লোক নাকি পালিয়েছে ! মন্দির এর পাশে
দাঁড়িয়ে নাকি উঁকি ঝুঁ কি মারছিল ! আরে ব্যাটা , তোর মত অসুরের হাত গলে কিভাবে একটা
ছুঁ চো পালিয়ে যায় !! এই বলে যখন ঝাড়ছিলেন তিনি, তখন ব্যাটা মিনমিন করে বলল , “কর্ত া
! ব্যাটা নির্ঘাত কোন তান্ত্রিক বা যাদুকর হবে, মাথাটা এখনও আমার ঝিমঝিম করছে বিশ্বাস
করেন কর্ত া ! ” “নিকুচি করেছে তোর যাদুকর আর তান্ত্রিকের ! ওদের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই
এই নেই আঁকড়া ছেলেমেয়েগুলির উপর নজরদারি করতে !” মুখে বললেও একটা কাঁটা ঠিকই
খচখচ করছে মনের ভেতর এস এস এর, কে বলতে পারে, কত মানুষ ই তো কত ধান্দা নিয়ে
ঘোরে ! হয়ত তাঁর রিসার্চ এর কথা কেউ জেনে গিয়ে তাঁর পিছু নিয়েছে ! তিনি অবশ্য রিস্ক
নেননি, এই তাঁবর ু বাইরে একটা ভাড়াটে মার্সেনারি (ভাড়াটে যোদ্ধার দল) দল বিভিন্ন ছদ্মবেশে
ওঁত পেতে আছে, ওয়াকিটকি তে তাঁর নির্দে শ পাওয়া মাত্র ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়েখুড়ে ঁ ফেলবে যে
কাউকে ! হুম্মম ! ওই যে বাইরে রুস্তম গাধাটার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে ! যাই হোক ,মাহেন্দ্রক্ষণ
কাছিয়ে আসছে, তাঁকে রেডি হতে হবে , ছেলেমেয়েগুলিকেও বলির জন্য প্রস্তুত করতে হবে। তিনি
কলারের কাছে লুকান মাইকে বললেন, ‘প্যাকেজ ১ জায়গামত রাখার ব্যাবস্থা কর, আর প্যাকেজ ২
তাঁবর ু ভেতর নিয়ে আস !’ প্যাকেজ ১ হচ্ছে সেই লৌহ কফিন, যেখানে মহাকাল এর মূর্তি টি আছে,
প্যাকেজ ২ হচ্ছে আরসান রা !

চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আঁতকে উঠলেন পূর্ণানন্দ , সর্বনাশ ! তপুদের যে ভীষণ বিপদ ! সাক্ষাৎ
মানুষরূপী ব্রহ্মপিশাচের পাল্লাতে পড়েছে ওরা ! এরা করতে পারেনা এমন কোন কাজ নেই । তপুর
চু লের গোছাটা নিয়ে দ্রুত তৈরি হয়ে নিলেন, ঝড়ের বেগে বেড়িয়ে পড়লেন একমাত্র সম্বল কাঁধের
ঝোলাটা নিয়ে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে, তাড়াতাড়ি !!

প্রসন্ন চিত্তে পূজাতে বসলেন এস এস , রুস্তমটাকে যতটা গাড়ল ভেবেছিলেন সে ততটা নয়, সব
ঠিকঠাক এনে দিয়েছে ছেলেটা ! সামনে সাজানো যজ্ঞ বেদী, হাড়িকাঠ (যেটা বলির জন্য ব্যবহার
হয় ), আর ভয়াল মহাকাল ভৈরবের মূর্তি র দিকে একবার তাকালেন , বাঁ পাশে আধা অচেতন
ছেলেমেয়েগুলির দিকে তাকালেন, অজ্ঞান অবস্থাতে যতটু কু সম্ভব পরিস্কার করে তারপর রক্তচন্দন
লেপে দেয়া হয়েছে ওদের হাত পা আর মুখে, মাথার সাথে বেঁধে দেয়া হয়েছে লাল জবা ফু ল।
29

হাতের পাশেই রাখা আছে ভয়াল দর্শন খড়গ, পূজা শেষে ছেলেমেয়েগুলিকে বলি দেয়া হবে ! ডানে
একটু পিছনে রুস্তম দাঁড়িয়ে , বাইরে তু মুল হট্টগোল , শিব চতু র্দ শীর মাহেন্দ্রক্ষন উপস্থিত প্রায়,
তাদের সাথে মিশে সতর্ক প্রহরাতে মার্সেনারি দল, ওদের দায়িত্ব আপাতত রুস্তমের। তিনি চোখ বুজে
গম্ভীর ভরাট কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন ...............

"ওঁ মহাকালং যজেদব্যং দক্ষিণে ধূমবর্ণকম।

বিভ্রতং দন্ড খটাঙ্গৌ দংস্ট্রাভীমমূখম্ শিশুম্।।

ব্যাঘ্রচর্মাবৃতকটীং..................।

তু মুল “হর হর মহাদেব !” “জয় শিব শম্ভু !” অট্টরোলের মাঝখানে জায়গা করে নিয়ে ছু টে
চলেছেন পূর্ণানন্দ , হে দক্ষিণা কালী ! দেরী হয়ে যায়নি তো ! অদূরে একটা তাঁবু দেখতে পেলেন
তিনি, হাতের তালুতে চু লের গোছাটা রাখলেন তিনি, সেটা আপনা আপনি ঘুরে গেল তাঁবট ু ার দিকে
, লাফিয়ে উঠে সেদিকে ছু টলেন পূর্ণানন্দ, কিন্তু কাছাকাছি যেতেই, একি ! কালো পোশাকে এরা
কারা ঘিরে ধরল তাঁকে ! রুস্তমের ওয়াকি টকি খড় খড় করে উঠলো , ‘বস ! একটা অদ্ভু ত
দেখতে দাড়ি অলা লোক তাঁবর ু বাইরে, ওকে আমরা ঘিরে ফেলেছি !’ আরে , ওই ব্যাটা নয় তো,
যে ওকে মাথাতে ঝাঁকি মেরেছিল, নিজ হাতে ওকে মারার তীব্র ইচ্ছাটা অনেক কষ্টে দমন করল
রুস্তম, প্রভু র ওকে দরকার এখানে, “শেষ করে দাও !” হিস হিস করে উঠলো সে !

একটু একটু করে জ্ঞান ফিরে আসছে সবার , মনে সবার একটাই প্রশ্ন, ওরা কোথায় ! সবার
মাঝে কষ্টসহিষ্ণু তপুই আগে সজাগ হল, আর যা দেখল তাতে তার মনে হল জ্ঞান না ফিরলেই
বোধ করি ভাল ছিল ! ওদের পাশেই অদ্ভু ত সব জিনিসের ছড়াছড়ি এর মধ্যে সিদ ঁ র
ু মাখানো
কলাপাতা, যজ্ঞ বেদী, হাড়িকাঠ, রক্ত, কালো বেড়ালের কাটা মাথা, দুটি কিসের জানি ক্ষু র এসব
চিনতে পারলো সে, সর্বনাশ , এসব তো তান্ত্রিক পূজাতে ব্যাবহার হয়, ওই দশাসই চেহারার লোকটা
কি তাদের নিয়ে কোন তান্ত্রিক পূজা করছে নাকি ! পাশে নড়ে উঠলো আরসান, আরসানের ও
একি কথা মনে হল যা তপুর মনে হয়েছিল, তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে , সে দেখতে পেল নীলচে
কালো রঙের একটি বীভৎস মূর্তি ! চার হাত বিশিষ্ট সেই মূর্তি র ডান দুই হাতে ত্রিশূল ও চক্র,
বাম দুই হাতে কাঁচি ও নরকরোটি !! তিন চোখ আর শ্বদন্ত বিশিষ্ট মুখ, চু লের বদলে মাথাতে
জড়িয়ে আছে ভয়াল দর্শন সাপ ! গলাতে নর করোটির মালা, সারা গায়ে হিল হিল করছে
সাপেরা , তিনি দাঁড়িয়ে আছেন জ্বলন্ত পাঁচটি নরকঙ্কালের উপর, তাঁর বাহন হচ্ছে একটি কালো
কুকুর ! সায়নী আর সুমিত্রাও জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখল একই দৃশ্য, ভয়ঙ্কর এক মূর্তি র সামনে
ততোধিক ভয়াল দর্শন এক মানুষ বসে রয়েছে, শালপ্রাংশু দশাসই চেহারার সাথে মানানসই
জলদগম্ভীর স্বরে মন্ত্র আউরে চলেছে, সামনে সাজানো আছে বিভিন্ন ভয়াল দর্শন ও অদ্ভু ত পূজা
উপকরণ !

মাথা তু ললেন সিদ্ধার্থ সোম , ওই তো, ওই তো , মহাকালেশ্বর জেগে উঠছেন, সাপ গুলি নড়াচড়া
শুরু করেছে, পায়ের নিচে নরকঙ্কাল গুলি যেন প্রাণ ফিরে পাচ্ছে ! ভয়াল দর্শন কালো কুকুরটাও
যেন ধীরে, অতি ধীরে নিঃশ্বাস ফেলতে লেগেছে ! এইবার মহা শিব রাত্রির মহাদেবের জ্যোতির
লিঙ্গ শক্তিকে এখানে আহ্বান করতে হবে, তাঁর সামনে শক্তিসালী চারজনকে বলি চড়িয়ে আয়ত্ত করা
যাবে সময় ভক্ষণের শক্তি, যেটা একমাত্র স্বয়ং মহাকাল করতে পারেন, আর তাতেই , হ্যাঁ, তাতে
30

করেই তিনি পরিণত হবেন এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের এক ও অদ্বিতীয় মানুষ যে সময় পরিভ্রমণ করতে
পারে ! তা সে অতীত ভবিষ্যৎ যাই হোক না কেন, “সময় ভক্ষণ করিলে ভবিষ্যতের দিকে
যাইবে, আর সময় উগরাইলে অতীতে চলিয়া যাইবে !” পুথি ঁ তে সেই লামা সাইড লাইনে এটাই
লিখেছিলেন , কিন্তু তিনি সফল হয়েছিলেন কিনা সেটা কোথাও উল্লেখ নেই, এমনকি সুস্থ করে
তোলা লামাকেও অনেক চাপাচাপি করেও বের করতে পারেননি তথ্যটা, কুলুপ এঁটে বসে ছিলেন
তিনি, এ ব্যাপারে নাকি কথা বলা বারণ । যাকগে যাক, এখন সংশয়ের সময় নয়, কাজের সময়,
উঠে দাঁড়ালেন তিনি , মন্ত্রের শেষের দিকে চলে এসেছেন প্রায়, মহাদেবের জ্যোতির লিঙ্গ শক্তিকে
আহ্বান করতে শুরু করলেন তাঁর নিজের তৈরি করা মহাকাল ভৈরবের মূর্তি তে !

ঝোলা থেকে ডোরাকাটা একটা বাঘের ছোট্ট পুতুল বের করলেন পূর্ণানন্দ, যোদ্ধার দল অবাক হয়ে
গেল, ব্যাটার কি মাথা খারাপ নাকি, মরতে লেগেছে আর এখন খেলতে চাইছে পুতুল ! ওদের
মনের কথা আঁচ করেই যেন মুচকে হাসলেন পূর্ণানন্দ , মনে মনে মা সন্তোষীকে প্রণাম জানালেন,
কারণ উপমহাদেশীয় বনের রাজা বাঘ তো তাঁরই বাহন , “ ওম ব্যঘ্রানং হ্লিং ক্রিং শত্রু নাশায়ঃ
দিক চতু রদস্তানম ............” বলে সেই বাঘের ছোট্ট পুতুল ছুঁ তেই , যোদ্ধা দলের ছানাবড়া
চোখের সামনে সেই বাঘের ছোট্ট পুতুল পরিণত হল পূর্ণবয়স্ক পুরুষ বাঘে ! মুখ ব্যাদান করে সেই
বাঘ বিরাট এক হুংকার দিল , দিয়েই সবচেয়ে কাছের যোদ্ধার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ! সেই হুংকার
শুনেই না , সেই বিরাট মন্দির প্রান্তরে হুটাপুটী লেগে গেল ! কে কার আগে পালাবে তারই
প্রতিযোগিতা শুরু হল !! বাঘটা ওদেরকে কিছু করত না, কিন্তু সেটা তো আর বেচারারা জানে
না ! ওদিকে মন্দিরের ভেতরে পুরোহিত রা এক অদ্ভু ত দৃশ্য দেখতে পেলেন, শিব লিঙ্গ থেকে একটা
জ্যোতি বের হয়ে যেন ধীরে ধীরে ভাসতে ভাসতে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল, আর সাথে সাথে
মন্দিরের সমস্ত বৈদ্যুতিক বাতি আর প্রদীপ নিভে গেল ! প্রধান পুরোহিত দৌড়ে যেতে নিলেন
বাইরে, সেই মুহূর্তে শোনা গেল বাঘের ভয়ংকর হুংকার, কি আশ্চর্য ! উজ্জয়নী তে বাঘ এলো
কোথা থেকে! কাঁপতে কাঁপতে গর্ভ গৃহে বসে পড়লেন প্রধান পুরোহিত, “হে শিব শম্ভু ! ইয়ে ক্যাআ
হো রাহা হায় !! ”

এস এস দেখতে পেলেন , সেই জ্যোতি যেন প্রবেশ করছে তাঁর মহাকাল বিগ্রহে ! তাঁবর ু দরজাতে
সেই মুহূর্তে এসে দাঁড়ালেন পূর্ণানন্দ, সর্বনাশের মাথায় বাড়ি ! এই লোক তো কালভৈরবের মূর্তি তে
স্বয়ং শিব লিঙ্গকে আহ্বান করে বসেছে ! বিরাট এক তন্ত্রোপচার যে এখানে হচ্ছে তাতে কোন
সন্দেহ নেই, সেটা কি তিনি জানতেও চান না এই মুহূর্তে , তিনি ওই বাচ্চা গুলোকে বাঁচাতে চান
আপাতত , মানুষরূপী এই ব্রহ্ম পিশাচ কে তিনি পরে দেখে নেবেন। বাঘটা এসে দাঁড়ালো তাঁর
পাশে, গগনবিদারী আরেকটা হুংকার দিল সে ! সেই হুংকারে এস এস চমকে তাকালেন এদিকে !
তাঁর মুখ ভয়ংকর ভাবে বিগড়ে গেল , আহ ! এই শুভক্ষণে এ কোন আপদ ! তিনি রুস্তমকে
ইশারা করলেন, “রুস্তম ! শেষ করে দাও ব্যাটাকে !” রুস্তম এতক্ষণ বাইরের সব শব্দই শুনেছে,
কিন্তু প্রভু র পাশে নিশ্চল দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর ব্যঘাত ঘটে বলে ! এবার দাঁত বের করে তেড়ে গেল
পূর্ণানন্দের দিকে, সুযোগ পাওয়া গেছে ব্যাটার ঘাড় ভেঙ্গে দেবার ! এস এস একটা সবুজ আগুনের
গোলা ছুঁ ড়লেন বাঘটার দিকে ! বাঘটা অদ্ভু ত কৌশলে সেটা পাশ কাটিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত
কামড়ে ধরল এস এস এর ! শুরু হল বাঘে মানুষে তু মুল ঝটাপটি ! ঐদিকে মন্ত্রে ছেদ পড়াতে
জ্যোতির লিঙ্গের জ্যোতি আবার স্বস্থানের দিকে রওয়ানা দিল , একটানা মন্ত্রোচ্চারণ না করলে একে
31

ধরে রাখা বা কোথাও স্থাপন করা যায়না ! আর নড়তে থাকা মহাকালের মূর্তি ও অনেকটা
নির্জীব হয়ে আসছে ! এটা একমাত্র তপু ছাড়া আর কেউ লক্ষ্য করেছে বলে মনে হলনা !

যঃ পলায়তি , সঃ জীবতিঃ
আরসান রা নিশ্চল হয়ে দেখছিল শক্তিশালীদের মধ্যেকার লড়াই, পূর্ণানন্দ চিৎকার করে উঠলেন ,
“তপু ! বগলামুখী মন্ত্র পড় সবাই একসাথে ! আর আরসান কে ওর ক্ষমতা কাজে লাগাতে বল!”
বলেই এক মুঠো সিদ ঁ র
ু ছুঁ ড়ে মারলেন আরসানের দিকে ! রুস্তমের প্রথম জোরাল আঘাত ঠেকিয়ে
পাল্টা কুংফু চপ কসালেন একটা ! এসেছে ব্যাটা ! মনে করেছে সন্নিসি মারামারি করতে জানেনা
! ও তো আর জানেনা যে চাইনিজ মন্দিরের পুরোহিতদের কাছে বছর দশেক আধ্যাত্মিক আর
শারীরিক , দুরকম কসরতই করেচেন তিনি ! একযোগে ওই চারজনই বগলামুখী মন্ত্র পড়তে শুরু
করল ! সেই সাথে আরসানের মাথাতে ঝড়ের গতিতে চিন্তা চলতে লাগল, ও নিজের ক্ষমতা
ব্যবহার করবে কিভাবে ! কি বলতে চাইলেন পূর্ণানন্দ জী ! ছবি ! কোন জায়গাতে যেতে হলে
সেই জায়গা চোখের সামনে দেখতে হয় ওকে, আর , আর, আর ওহ !, ওরা সবাই মিলে না
গাজীপুরে ছবি তু লেছিল ! হাত বাঁধা থাকলেও পকেটে ঢু কল, অনেক কষ্টে সেখান থেকে বের করে
আনল ওর আর সুমিত্রার তোলা একটা ছবি, ভাগ্য অনেক ভাল ওরা পকেট হাতড়ালেও ছবিগুলো
কেন জানি নেয়নি ! ও সেটার দিকে গভীর মনোনিবেশ করল ! গতবার সে একলা টেলিপোর্ট
করেছিল, এবার বাকি তিনজনকে সাথে নিয়ে পারবে তো ! পূর্ণানন্দের সিদ ঁ র
ু ওর গায়ে আর
কপালেও খানিকটা পড়েছে । ও পাশে শোয়া তপুকে ফিসফিস করে বলল , “আমি তোমার হাত
ধরছি, তু মি সায়নীর হাত ধরে ওকে বল সুমিত্রার হাত শক্ত করে ধরতে! দেখি আমাদের
চারজনকেই উদ্ধার করতে পারি কিনা একসাথে! ” তপু বলল, “কিন্তু পূর্ণ কাকা ! ” “উনি
নিজেকে ভালোই সামলাতে পারবেন !” দাঁতে দাঁত চেপে বলল আরসান, “তাছাড়া শুনলে না , উনি
বললেন আমার ক্ষমতা ব্যাবহার করতে ! এখন চু পচাপ হাত শক্ত করে ধরে রাখ !” বলে ছবির
দিকে ভাল করে মনোযোগ দিল আরসান, একটু পরেই ওদেরকে যে স্ট্রেচার গুলির সাথে বেঁধে রাখা
হয়েছে , সেগুলি খটখট করে কাঁপতে শুরু করল ! বাকিরা প্রায় নিঃশব্দে বগলামুখী মন্ত্র পড়ে
চলেছে ! ঘাম বেড়িয়ে এলো আরসানের কপাল থেকে, যা কোনদিন করেনি আগে, সেটাই করল,
“হে মা কালী, আমাদের এখান থেকে উদ্ধার কর মা !” আরসানের মনে হল তার চারদিক হঠাৎ
সাদা অত্যুজ্জ্বল আলোতে ভরে যাচ্ছে, সেই সাথে শরীর হালকা লাগা শুরু করেছে !

ওদিকে দুই জোড়াতে চলছে যেন সুম্ভ-নিসুম্ভের লড়াই ( দুই অসুর ছিল এরা )। একবার এ উঠে
দাঁড়ায় তো আরেকবার ও, রক্তে স্নান করছে উভয় পক্ষই , এস এস অবাক হয়ে যাচ্ছেন, এই বাঘ
নিশ্চয় রক্ত মাংসের নয়, নাহলে এতগুলো আগুনের গোলা, পাঁজর বরাবর লৌহ কঠিন ঘুষি, প্রচণ্ড
চাপর, তাঁর এতদিন কার মন্ত্রলব্ধ মারণ বাণ, সব সহ্য করেও মুখের কষের পাশে রক্ত গড়িয়ে পড়া
ছাড়া আর কোন বিকার নেই কেন ! তিনি নিজেও কম আহত নন ! হাতের মাংস চিরে ঝু লছে
যেখানটায় কামড়ে ধরেছিল, অনেক কষ্টে ছাড়িয়েছেন হাতটা, বুকের উপর থেকে আড়াআড়ি পেটের
32

কাছ পর্যন্ত তেরছা বাঘের নখের তৈরি আঁচড়, উরুর উপর গভীর থাবার দাগ ! এর মাঝেই
খটখট শব্দে সচকিত হয়ে উঠলেন তিনি, এই শব্দ কোত্থেকে আসে !

এক চোখ প্রায় বুজে গেছে, পাঁজরে প্রচণ্ড ব্যাথা, হাড়ে চিড় খেয়েছে নির্ঘাত, ডান পা মচকে
অদ্ভু তভাবে বেঁকে আছে, আনআর্মড কমব্যাটে কমান্ডো প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত রুস্তমের অহংবোধ অনেকটাই
ঘা খেয়েছে এই আধবুড়ো লোকটার সাথে লড়তে গিয়ে ! হাত পা গুলি মনে হয় লোহার তৈরি
লোকটার ! যতবারই আঘাত করতে গেছে, দ্বিগুণ আঘাত নিজে পেয়েছে রুস্তম, আজ পর্যন্ত কোন
বাপের ব্যাটা ওর সামনে দু তিন মিনিটের বেশি টিকতে পারেনি, তা সে যেই হোক না কেন !
কিন্তু টানা বিশ পঁচিশ মিনিট লড়েও চোখের নিচে কালশিটে আর উরুতে একটু মাংস থেঁতলে
দেওয়া ছাড়া আর কিছু সে করতে পারেনি এই অদ্ভু ত দাড়ি অলা লোকটাকে ! সেই সময় সে লক্ষ্য
করল জ্যোতির লিঙ্গের জ্যোতি স্বস্থানের দিকে রওয়ানা দিল, তাঁবু ছেড়ে বেড়িয়েই গেছে প্রায় !
তার চোখ বড় বড় হয়ে উঠলো, মনোযোগ সেদিকে সরে গেল তার। চিৎকার করার জন্য হাঁ করল
সে, প্রভু কে সাবধান করে দিতে চায়। সেই অমনোযোগের সুযোগে চূ ড়ান্ত আক্রমণ শানালেন পূর্ণানন্দ
, মুঠিকে নিয়ে গেলেন কুংফু /কারাতের “রটোকেন”, মানে মাঝখানের আঙ্গুল বাড়িয়ে ধরা
পজিশনে, বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে শক্তি জড় করতে লাগলেন তড়িৎ গতিতে !

স্ট্রেচারের খটখট যখন তু ঙ্গে, এস এস এর মনোযোগ সেদিকে এখন, পূর্ণানন্দ দেখলেন সর্বনাশ !
আরসান মনে হয় ওর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে যাচ্ছে , এখন সেদিকে এস এস এর নজর গেলেই
সেরেচে ! কিছু একটা করতেই হবে ওর মনোযোগ এদিকে ফেরাতে, কিন্তু তাঁকে কষ্ট করতে হলনা,
রুস্তম ই চিৎকার করে উঠলো , “প্রভু , আলোটা বাইরে চলে যাচ্ছে !” এস এস ঝট করে তাঁবর ু
ফ্ল্যাপ অলা দরজার দিকে তাকালেন, সর্বনাশ ! জ্যোতির লিঙ্গের জ্যোতি স্বস্থানে রওয়ানা দিয়েছে
দেখা যাচ্ছে ! যাবেই তো, তিনি যে মন্ত্রোচ্চারণ বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি বিড়বিড় করে আবার
মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন । এদিকে বাঘ মামা তার চূ ড়ান্ত পজিশনে চলে গেছে, লেজ পেছনে খাড়া,
সামনের মাথা একটু নিচু করে ঝাঁপ দেবার জন্য তৈরি অবস্থাতে গেল সে !

এরপর অনেকগুলি ঘটনা একসাথে ঘটল, প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে মনে হল সময় যেন থমকে গেছে,
“ইয়াআআআ” করে রটোকেন ফিস্ট হাঁকালেন পূর্ণানন্দ, আঙ্গুলের ডগাতে জড় করা তাঁর বিশেষ
শক্তি সহ, বিদ্যুতের এক বিশাল ঝটকা খেল যেন রুস্তম , সেই সাথে একটন ওজনের ধাক্কা ! উড়ে
গিয়ে তাঁবর ু এককোণে পড়ল সে ! বাঘটা ঝাঁপিয়ে পড়ল এস এস এর উপর, ছেঁ চড়ে নিয়ে গেল
তাঁবর ু আরেক কোণাতে, না কামড়ে ধরল না, এস এস কে চিত করে ফেলে থাবা দিয়ে চেপে ধরে
রাখল , নড়তে দিতে চায়না এস এস কে, রক্ত হিম করা হুংকার ছাড়ল একটা ! এদিকে আলোয়
ভেসে গেল হঠাৎ আরসান রা তাঁবর ু যেদিকে আছে সেদিকটা । এস এস অবাক হয়ে তাকালেন
সেদিকে, তিনি দেখতে পেলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে অদ্ভু ত দৃশ্য, চারটা ছেলেমেয়ে যেন দ্রুতগতিতে
আলোর বিন্দুতে পরিণত হচ্ছে , এপাশের ছেলেটার হাতে একটা , কি ওটা ! আরে ! একটা ছবি
ধরা ছেলেটার হাতে ! ছেলেটা সেই ছবিটার দিকেই তাকিয়ে আছে!! চূ ড়ান্ত বিস্ময়ের সাথে তিনি
দেখলেন , “হুউউউউউউসসসসস” করে একটা শব্দ হল, আর ছেলেমেয়েগুলি , হ্যাঁ, ছেলেমেয়েগুলি
স্ট্রেচার সহ চোখের সামনে দিয়ে নেই হয়ে গেল !

অক্ষম রাগে বাঘটাকে ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিলেন এস এস, তাঁর এতদিনের সাধনা , শ্রম সব
বিফলে গেল, ওই , ওই লোকটাই এর জন্য দায়ী, ভেতরের ব্রহ্মপিশাচ মুখের আদলে ধরা দিল
33

তাঁর, মাথাতে আক্ষরিক অর্থেই আগুন জ্বলে উঠলো, জ্বলন্ত নরকরোটিতে পরিণত হল তাঁর মাথাটা !
ওদিকে ততক্ষণে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন পূর্ণানন্দ, ভালোই মার খেয়েছেন তিনি, সর্বাঙ্গে জ্বলুনি
ছড়িয়ে পড়ছে, তবু তার মধ্যেই হাসলেন তিনি, “বিদায়, মানুষরূপী ব্রহ্মপিশাচ ! আমাদের আর
দেখা না হলেই ভাল হবে !” বলতেই এক লাফে বাঘটা তাঁকে নিয়ে তাঁবর ু ফ্ল্যাপ দরজা গলে
বাইরে লাফিয়ে পড়ল ! “দেখে নেব তোমাকে, যেই হও না কেন !” নিষ্ফল আক্রোশে হুংকার দিয়ে
উঠলেন আপাত ব্যর্থ পরাক্রমশালী সিদ্ধার্থ সোম ওরফে এস এস !

“ধড়াম” করে স্ট্রেচার চারটা এসে পড়ল বাংলাদেশের গাজীপুরের “নুহাশ পল্লী” নামক একটা
জায়গাতে , আরসান রা চারজনই সেই স্ট্রেচার চারটাতে বাঁধা ! তেমন ব্যাথা ওরা পায়নি কেউই,
পাশে তাকাল ঝট করে আরসান, ওই তো দেখা যাচ্ছে ট্রি হাউসটা ! যেটার সামনে দাঁড়িয়ে
কালকে দুপুরে সে আর সুমিত্রা ছবি তু লেছিল , ভাগ্যিস তু লেছিল ! এমনিতে আরসান নিজের ছবি
তোলা বিশেষ পছন্দ করে না ! সুমিত্রা তখন জোরাজুরি করে ছবি কটা তু লিয়েছিল বলেই না !
কৃ তজ্ঞ চিত্তে বাকি চারজনের দিকে তাকাল সে ! তপু বাস্তববাদী ছেলে, সে বলল , “আগে
আমাদের বাঁধনগুলি ছোটাতে হবে।” তাই তো ! সেটা কিভাবে করা যাবে , তপু বলল ‘দাঁড়াও !
উপায় একটা মাথাতে এসেছে !’ একটু চেষ্টাতেই হাতে আগুন জ্বালিয়ে ফেলল সে, সেটা দিয়ে বেশ
কসরত করেই গলিয়ে ফেলল নাইলনের দড়ি ! বাকিদের খুলে দিতেই ঝাঁজিয়ে উঠলো আরসান ,
“আরে ! তাহলে ওই তাঁবতে ু আমাদের মুক্ত করলে না কেন এভাবে !” “ওখানে আমাকে সময়
দিলে কই ! আর এভাবে দড়ি পোড়াতে গেলে ওরা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকত ভেবেছ !” কথাতে
যুক্তি আছে, “সরি !” বলল আরসান, “এবার আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে আগে !”
“হুম! যে হোটেলটাতে উঠেছিলাম সেখানে যেতে হবে আগে , সেখান থেকে কাপড়চোপড় আর টাকা
পয়সা গুলি আগে নিয়ে নিই !” বলল সায়নী । “হুম একটু পরিষ্কার হয়ে নেয়াও দরকার,
আমাদেরকে নিশ্চয়ই ভূ তের মত লাগছে !” বলল সুমিত্রা ! হায়রে মেয়েমানুষ ! সকৌতু কে ভাবল
আরসান , কিছু ক্ষণ আগেই মরতে বসেছিল আর এখন চিন্তা করছে নিজেকে কেমন দেখাচ্ছে সেটা
নিয়ে , হাহাহাহা !!!

পথে ওদের একটা পুলিশের টহল গাড়ি আটকেছিল, আরসান সেই পরিচিত এস আই এর নাম
বলতেই জাদুমন্ত্রের মত কাজ হল, ফোন করে ওনার সাথে কথা বলার পর উনি থানাতে যেতে
বললেন, এই চারজনের খোঁজে নাকি গতকাল থেকে গাজীপুরের প্রতিটা ঘাসের ডগা সহ ওলট পালট
করে ফেলা হয়েছে ! আরসানের বাবা সুনন্দ চৌধুরী যথেষ্ট প্রভাবশালী লোক, প্রশাসন থেকে যথেষ্ট
চাপের মুখে নাকি পড়েছে গাজীপুরের পুলিশ ! আরসান কোনমতে বলল, “আঙ্কেল, আজ রাতটা
একটু রেস্ট নেই ? কালকে না হয় থানাতে যাব ! আপনি একটু কাইন্ডলি বাবাকে জানিয়ে দেবেন
যে আমাদেরকে পাওয়া গেছে !” “ওকে, তাই হবে, আর তু মি না বললেও আমি জানিয়ে দিতাম !”
ওদিক থেকে অসন্তুষ্ট গলাতে বললেন এস আই , ভি ভি আই পির ছেলে বলে কথা, না করেন
কিভাবে ! টহল গাড়িটাকে বললেন ওদেরকে যেন নিরাপদে হোটেলে পৌঁছে দেয়া হয় ।

বাঘের পুতুলটা ঝোলাতে ভরে ফেললেন পূর্ণানন্দ, ইন্দোর এয়ার পোর্ট থেকে বাংলাদেশ গামী একটা
ফ্লাইট এ সিট বুকিং দিয়েছেন তিনি, এখন তাঁকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না আধঘণ্টা আগেই
এই লোকটা চারটা ছেলেমেয়েকে বাঁচাতে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন । নিতান্ত সাধারণ
বেশভূ ষা , মাথাতে বেসবল ক্যাপ, ইমিগ্রেসনের দিকে এগিয়ে গেলেন, প্রথম দেখাতে কবি সাহিত্যিক
বলে ভ্রম হয় কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চু ল দেখে। ওদিকের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন, এখনও ফুঁ সছেন সিদ্ধার্থ সোম,
34

রুস্তম দ্রুত হাতে ব্যর্থ পূজার উপকরণ একপাশে স্তুপ করে প্যারাফিন দিয়ে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে
দিল, ছ ফু ট লোহার কফিনসহ মূর্তি টা ঝটপট তু লে ফেলল একটু দূরে পারকিং করে রাখা একটা
কালো পিকাপের পেছনে, তারপর আহত কিন্তু রাগান্বিত এস এস কে কাঁধের নিচে হাত দিয়ে
ড্রাইভিং সীটের পাশে বসিয়ে স্টার্ট দিল পিকাপ। দূরে পুলিশের সাইরেন শোনা যাচ্ছে, আপাতত এখান
থেকে কেটে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে ! যঃ পলায়তিঃ .....................

অধ্যায় - ৯

স্বদেশে স্বস্তির নিঃশ্বাস


নিজের মা বাবা যে ওকে এত ভালবাসে, সেটা আরসান টের পায়নি এতদিন ! ও ঘরে ঢোকার
সাথে সাথে প্রথমে জড়িয়ে ধরলেন মা , “আরসু বাবা আমার !” নিঃশব্দ কান্নাতে শার্টে র সামনের
দিকটা ভিজে যেতে যেতেই টের পেল বাবার শক্ত হাত, ওদের দুজনকেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছেন
তিনি ! “যেই তোকে নিয়ে গিয়ে থাকুক না কেন, খুজেঁ বের করে কঠিন শাস্তি দেব আমি !”
বললেন তিনি ভেজা কণ্ঠে ! আরসানেরও কান্না পেল অনেকদিন পর, মনে মনে নিজের অজান্তেই
ধন্যবাদ দিল এস এস কে, ওই ব্যাটাই তো ওর বাবা মাকে আবার কাছে এনে দিয়েছে !

ঘরে ঢোকামাত্র সুমিত্রার মা ওকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে রাখলেন যে সুমিত্রার মনে হল দমবন্ধ হয়ে
মারাই যাবে বুঝি ! “মা ! ছাড়ো ছাড়ো, আমি তো ফিরে এসেছি, নাকি ?” কান্না জড়িত কণ্ঠে
মা বললেন , “তোর বাবাকে হারিয়েছি, আমি ভাবলাম বুঝি এবার তোকেও হারাবো ! ওই সব
কিডন্যাপার রা তো মানুষ না !” “মা বগলামুখীর কৃ পাতে কেউ আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে
না !” দৃঢ় কণ্ঠে বলল সুমিত্রা, আরেকজনের কথাও মনে আসলো , আরসান ! ও আর পূর্ণানন্দ
জী না থাকলে ওরা সবাই এতক্ষনে বলি হয়ে যাচ্ছিল প্রায় ! শিউরে উঠে মাকে আরও ভালোভাবে
জড়িয়ে ধরল সুমিত্রা !

দিম্মা মরাকান্না জুড়ে দিলেন সায়নীকে দেখেই, “ও আমার মিষ্টি নাতিন রে ! তু ই কোথায় হারিয়ে
গেচিলি রে !” সায়নী অনেকক্ষণ দিম্মাকে ধরে রাখল শক্ত করে , ধূপ , ধুনো আর মোমবাতির
মিশ্র গন্ধে হারিয়ে যেতে যেতে সেও মনে মনে কৃ তজ্ঞতা জানাল আরসান আর পূর্ণানন্দ জীর প্রতি !

ধূসর দরজাটা ঠেলে ধীরে ধীরে সুপারের ঘরে ঢু কল তপু, রাম বকা খাওয়ার জন্য মনে মনে তৈরি
! বেরই করে দেয় কিনা কে জানে ! বেশ কড়া আর রাশভারী হিসাবে নাম আছে সুপারের। তপু
অবাক হয়ে গেল দেখে যে চশমার উপর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মিটমিটি হাসছেন সুপার !
“তোমার সাহস আছে হে ছেলে ! পুলিশ কর্তৃ পক্ষ আর সুনন্দ চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে
তোমার সাহসের প্রশংসা যেভাবে করা হয়েছে , আমি ইম্প্রেসড ! অবশ্য তু মি যেদিন প্রথম
এসেছিলে, তোমার চোখ দেখে আমি বুঝে গেছিলাম, তু মি সাধারণ কেউ নও, যাই হোক”...এবার
স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যের মুখোশ পড়ে ফেললেন সুপার, “প্রশংসা করচি বলে সাপের পাঁচ পা দেখ না
আবার, যাও, রুমে যাও, হিরো গিরি ছেড়ে এবার পড়ালেখাতে মনোযোগ দাও !” মনে মনে খুশিতে
লাফাতে লাফাতে রুমে এসেই কপালে হাত ঠেকাল মা বগলামুখী আর পূর্ণানন্দ জীর উদ্দেশে , উনি
ঠিকমতো ফেরত আসতে পেরেছেন কিনা কে জানে !

চেনা জানা
35

রমনা পার্কে খুব কমই এসেছে আরসান, এখানে দেখা করার বুদ্ধিটা সুমিত্রার, তাই আর না করেনি
সে ! গেট দিয়ে ঢু কে মাঝামাঝি যে লেক টা আছে সেদিকে এগোল সে , ওখানেই মিট করার কথা
সবার, আসলে গাজীপুরের ট্যুরটা একটু বেশি উত্তেজনাকর হয়ে গেছিল সবার জন্যই , আরেক টু
হলে সবার প্রাণই চলে যাচ্ছিল ! ওই তো দেখা যাচ্ছে সুমিত্রাকে , সায়নী ও হাত নাড়ল ! কিন্তু
তপু কই ! যা হোক , সুমিত্রার পাশে বসে পড়ল, “তারপর , কি খবর তোমার ?” অকারণেই
লাল হয়ে যাওয়া গালে জবাব দিল সুমিত্রা , “ভালোই !” “হ্যাঁ, ভালোই তো, এতক্ষণ আমার
কানের পোকা নড়িয়ে দিচ্ছিল , এই বলনা আরসু কখন আসবে, কখন আসবে !” খলবল করে
উঠলো সায়নী ! “যাহ্‌ , আমি এতবার বললাম কখন, একবারই তো জিজ্ঞাসা করলাম !” আত্মরক্ষা
করল সুমিত্রা ! “তপু কই, ও কখন আসবে ?” আরসান জিজ্ঞেস করল, সুমিত্রা ওকে ডাকনামে
খুজে
ঁ ছে এই ভাল লাগাটা উপভোগ করতে করতে ! “ওর আশ্রমে ফোন দিয়েছিলাম, বলল কে এক
দাড়ি গোঁফ অলা লোকের সাথে বেরিয়েছে রমানাতেই আসবে বলে !” বলল সায়নী । “তপুর
আপডেট এখন থেকে ওর কাছেই নিও, কেমন ?” বলে উঠলো সুমিত্রা ! এবার সায়নীর লজ্জা
পাবার পালা ! “ভাল হবে না সুমিদি !” তেড়ে উঠলো সায়নী ! হা হা হা করে হেসে উঠলো
আরসান, ভালোই উপভোগ করছে দুই বান্ধবীর খুনসুটি । এই সময় দূরে দেখা গেল তপু আর
পূর্ণানন্দ জী হেঁ টে হেঁ টে আসছেন, ওনারা কাছে আসতেই প্রণাম করল বাকিরা , “আয়ুষ্মান ভবঃ !”
হাত তু লে ওদের আশীর্বাদ করলেন পূর্ণানন্দ। “বাবারা তোমরা সবাই এসেছ ভালোই হয়েছে ,
তোমাদের সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে !” সবাই সিরিয়াস মুখ করে ওনাকে ঘিরে বসলো,
সাথে আনা আপেল আর স্যান্ডউইচ খেতে খেতে সবাইকে বললেন পূর্ণানন্দ সব কথা, কিভাবে তিনি
সুদর ূ হিমালয়ে বসে তাঁর উত্তরপুরুষ অর্থাৎ তপুর বিপদের কথা টের পেলেন, কিভাবে মা ব্রহ্মময়ী
আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করা মাত্র তপুর সাথে দেখা করিয়ে দিলেন , কিভাবেই বা তিনি
গাজীপুরে ওই মানুষরূপী ব্রহ্মপিশাচটাকে চিনতে পেরে ছিলেন, আর ওদেরকে ফলো করে কিভাবে
তিনি উজ্জয়িনিতে গিয়ে তাদেরকে সাহায্য করলেন, ফাঁকে আরসান বাধা দিল , “বাঘটা আপনি
কোথা থেকে যোগাড় করলেন স্বামীজি, এরকম পোষা বাঘ পেলেনই বা কোথায়? বাপরে ! যা
একটা হুঙ্কার দিয়েছিল, ভয়ে আমার পেটের ভাত চাল হয়ে গেছিল প্রায়! ” জবাবে মুচকি হাসলেন
পূর্ণানন্দ জী , “সময়ে সবই জানতে পারবে, তবে আগে তোমাদের সবাইকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে এই
ধরণের লৌকিক আর অলৌকিক সব ধরণের আক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য ! তবে অপ্রস্তুত
অবস্থাতেও তোমরা ওই শয়তানটার ঘাম ছু টিয়ে ছেড়েছিলে ! আর” এবার আরসানের দিকে
তাকালেন তিনি , “তোমার সাহসের আর বুদ্ধির কারনেই তু মি সহ ওরা বেঁচে ফিরতে পেরেছে!
এবার কাজের কথা, তোমাদের যে কারো বাসস্থানে আমাকে কিছু দিন থাকতে হবে আর একটা
বড়সড় ঘর লাগবে তোমাদের প্রশিক্ষণের জন্য!” “আরে , আপনি আমাদের বাড়িতে সাচ্ছন্দে থাকতে
পারবেন , আর আমাদের উঠানের একপাশে বিশাল একটা পুরান জিমনেশিয়াম আছে, অনেকদিন
পুরান, কেউ ব্যাবহার করেনা আজকাল !” বলল আরসান, একটু ইতস্তত করে রাজি হয়ে গেলেন
পূর্ণানন্দ জী, ঠিক হল , পরদিন থেকেই শুরু হয়ে যাবে “লৌকিক অলৌকিক ট্রেনিং !” এটাকে
ইতিমধ্যে নাম দিয়ে ফেলেছে সুমিত্রা ! আরসান দের ড্রাইভার সবাইকে নিয়ে প্রতিদিন দুপুরে চলে
আসবে, যতক্ষণ ট্রেনিং হয় তারপর সবাইকে যার যার বাসাতে নামিয়ে দিয়ে আসবে, তপুর আশ্রমে
বলা আছে, ওর সমস্যা হবে না , বাকি সায়নী আর সুমিত্রা ওদের অভিভাবক দেরকে বোঝানর
দায়িত্ব নিল। এরপর আরসান ওদেরকে একটা লোভনীয় প্রস্তাব দিল, “চলো , সবাই মিলে আজকে
হাতিরঝিল থেকে ঘুরে আসি !” না বলার কোন কারণ ছিল না, সুমিত্রা ওর মাকে আর সায়নী
ওর দিম্মাকে জানিয়ে দিল, একটু গাঁইগুই করছিলেন দুজনই, সেসবে আর কে কবে কান দিয়েছে !!
36

তবু পূর্ণানন্দ জী কে কথা দিতে হল যে উনিও সাথে যাবেন , এবার আরসান আর তপু একে
অপরের দিকে তাকাল, ওরা আসলে সায়নী আর সুমিত্রার সাথে একটু একান্তে সময় কাটাতে চাচ্ছিল,
সোজা বাংলাতে যাকে বলে ডেটিং ! ওদের ব্যাজার মুখ দেখে পূর্ণানন্দ জী মুচকে হাসলেন দাড়ির
আড়ালে, তরুণ প্রাণের চাহিদা তিনি ভালোই বোঝেন, কিন্তু ওদের নিজেদের স্বার্থেই তাঁর ওদের
কাছাকাছি থাকা দরকার, বিশেষ করে যখন চারজন একসাথে থাকে, কারণ সেই পরাক্রমশালী ব্রহ্ম
পিশাচকে যতটু কু দেখেছেন, সে ব্যাটা আবার ছোবল বসাবে, এখন বসে কোথায় প্ল্যান আঁটছে
ভগবান জানেন, অবস্থান নির্ণয় করার সবরকম চেষ্টা বিফলে গেছে, জাদুর পরিভাষাতে এটাকে
“ক্লোক” করে রাখা বলে , অর্থাৎ নিজের অবস্থান লুকিয়ে রাখা ! বেশ ভালোরকমের তান্ত্রিক জ্ঞান
না থাকলে এটা সম্ভব না । পূর্ণানন্দ জী মনে মনে ঠিক করে রাখলেন, এদেরকে দিন পনের ট্রেনিং
দিয়েই তিনি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে যাবেন, চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠে বাবা শম্ভুনাথ দর্শন করে আসবেন,
বলা যায়না , কোন পথ পেয়েও যেতে পারেন।

এই পথ যদি না শেষ হয় !
রমনা পার্ক থেকে বেরিয়ে ওরা মগবাজার রোড আর হাতিরঝিল লিঙ্ক রোড হয়ে হাতিরঝিল লেক
পার্কে যখন পৌঁছল, তখন সন্ধ্যা হব হব , হাতিরঝিলের ব্রিজের নয়নাভিরাম রঙ বেরঙের বাতি
গুলি আস্তে আস্তে জ্বলে উঠছে, সেই মায়াময় আলোতে এমনকি পূর্ণানন্দের মত শক্ত তান্ত্রিকও
খানিকটা ভাবালু হয়ে উঠলেন। ছেলেমেয়েগুলি একটু দূরত্ব রেখে বসেছে, ওদের নিচু গলার
কথাবার্ত া, মাঝে মাঝে তরল গলাতে হেসে ওঠা শুনতে পাচ্ছেন তিনি, আহা , একটু আনন্দ করুক
বাছারা !

গল্পের এতদূর এসে, পাঠক, আপনাদের আরসান , সুমিত্রা, তপু, সায়নী র সাথে ভালোভাবে পরিচয়
করিয়ে দেবার দরকার হয়ে পড়েছে, ওদের পারাবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড মোটামুটি জেনে গেছেন এতক্ষনে
আশা করি। ওরা ওদের নিজেদেরকে চিনে জেনে নিক, ফাঁকে আমারাও ওদেরকে একটু ব্যাক্তিগত
ভাবে চিনে নিই, কি বলেন ?

আগেই বলেছি, বড়োলোকের প্রায় বখে যাওয়া ছেলে আরসান, (ইদানীং সুমিত্রাদের সাথে মিশে
আচার আচরণ কিছু টা জাতে এসেছে !) বয়স সতের, উজ্জ্বল শ্যামবরণ মোটামুটি লম্বা চেহারা,
কোঁকড়ানো চু ল, ভালোবাসে রক , অলটারনেটিভ রক, বাংলাদেশী ব্যান্ড এর গান, মেটাল (সব
রকমের ) , ওর প্রিয় খেলা মার্শাল আর্ট ! শুনতে অদ্ভু ত শোনালেও এটাই সত্যি ! আর
ভালোবাসে প্রচু র বই পড়তে, বন্ধু অন্তপ্রান (যদিও তপুদের আগে ওর সত্যিকারের তেমন কোন বন্ধু
ছিল না , যা ছিল সব ধান্দাবাজ সুখের পায়রা ! ) বন্ধুদের বিপদে সবার আগে ওকেই দেখা
যায়, প্রাণ তু চ্ছ করে হলেও ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্ধুদের বিপদে, যেটার প্রমাণ কিছু দিন আগেই দিয়ে
এসেছে ভারতের উজ্জইনিতে ।

সুমিত্রা , মধ্যবিত্ত ঘরানার মেয়ে, অত্যন্ত মিষ্টি স্বভাবের আর ধার্মিক মেয়ে সে, রবীন্দ্রনাথের
বিখ্যাত “ডাগর আঁখির” অধিকারীনি, (সাধে তো আর আরসান ওর চোখে হারায়নি !), বয়স
ষোল , ভালোবাসে রবীন্দ্র সঙ্গীত, ইংরেজি আর হিন্দি সফট গানের প্রতিও দুর্বলতা আছে, কবিতা
ওর পছন্দের জিনিস।
37

তপু, ছোটবেলায় দুর্ঘটনাতে মা বাবা হারানো অনাথাশ্রমে মানুষ, যথেষ্ট সংগ্রাম করে বড় হয়েছে
সে। জমিদারী রক্ত শরীরে, সতের বছরের এই দীর্ঘ সংগ্রাম ওর সোনা রঙ মুছতে পারেনি, হলদেটে
ফর্সা সে, ভালোবাসে বাংলাদেশী ব্যান্ড এর গান, আর ওর স্বভাবে একটা আলাদা গাম্ভীর্য আছে
যেটা সবার মনে একটা আলাদা ভরসা যোগায়। সেও বন্ধু অন্তপ্রান,(যদিও আরসানদের আগে ওর
সত্যিকারের তেমন কোন বন্ধু ছিল না! ) , আর বিপদে কাউকে ফেলে আসা ওর স্বভাববিরুদ্ধ !
যেটা ও করতে বাধ্য হয়েছিল উজ্জইনিতে, পূর্ণানন্দ জী ফিরে না এলে ও নিজেকে বা আরসান কে
কখনও ক্ষমা করত না !

বাকি থাকল সায়নী, নিন্মবিত্ত পরিবারে প্রায় তপুর মত সংগ্রাম করেই মানুষ সে, মিষ্টি চেহারাটা
বিশেষত্ব পেয়েছে থুতনি টা ঠিক মাঝখানে দু ভাগ হওয়াতে, বয়স ষোল , ভালোবাসে রবীন্দ্র সঙ্গীত,
বাংলাদেশী ব্যান্ড এর গান । ওর বন্ধু বলতে গেলে কেউ ছিলনা তপুদের আগে, জীবন সংগ্রামে বন্ধু
বানাবার সময় কোথায় !

এইই তো, এবার গল্পে ফেরা যাক ! তো হাতিরঝিল পার্ক থেকে ওরা গেল কাছের একটা বেশ
ভাল রেস্তুরান্ট এ, সেখানে রাতের খাওয়াটা সারল সবাই, পূর্ণানন্দ জী শাকআহারী হওয়াতে তাঁর
জন্য স্পেশালি তিন চার ধরণের ফলমূল আর জুসের ব্যাবস্থা হল, সেগুলির বিশাল ঝু ড়ি টেবিলে
রাখার পর তিনি আঁতকে উঠলেন, “এত ফল খাবে কে ! ” “চিন্তা নেই, আপনি যতটু কু পারেন
আহার করুন, বাকিটা প্যাকেট করে যাবার সময় এক জায়গাতে নিয়ে যাব !” হাসতে হাসতে বলল
আরসান। পূর্ণ জী ভাবলেন বড় লোকের ছেলের অদ্ভু ত খেয়াল ! কিন্তু সত্যি সত্যি যখন দেখলেন
বাসাতে ফেরার পথে একটা বস্তিতে থেমে কয়েকটা অত্যন্ত গরীব পরিবারে ফল গুলি দিয়ে দিল
আরসান, তখন তিনি একই সাথে অবাক আর খুশি হলেন ! এক বুড়ি মা যখন হাত তু লে
আশীর্বাদ করলেন আরসান কে ‘বেঁচে থাক বাবা !’ তখন আর সবার সাথে সুমিত্রারো গর্বে বুকটা
ফু লে উঠলো এরকম একজন উদার মনের ছেলে ওদের বন্ধু বলে। বাসাতে ফেরার পথে আর সবার
মত সায়নীর ও মনে হচ্ছিল “এই পথ যদি না শেষ হয় !!” ওকে চমকে দিয়ে প্রথমে তপু গেয়ে
উঠলো , তারপর বাকিরাও (পূর্ণজী ছাড়া! ) গলা মেলাল ......রাতের ঢাকা কয়েকটি তরুণের
কাঁচা মিঠা কণ্ঠে দুলে উঠলো ...............।

এই পথ যদি না শেষ হয় !

তবে কেমন হত তু মি বলোতো ?

যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়

তবে কেমন হত তু মি বলোতো ?

আবার চক্রান্ত !!
নিজের প্রাসাদোপম বাড়ির স্টাডিতে চোখ বুজে Glenallachie হুইস্কির বোতল থেকে সরাসরি চু মুক
মারছে সিদ্ধার্থ সোম , তার এমন মাস্টার প্ল্যান কেঁ চে যাবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি ! ধুর ! এখন
আবার কেঁ চে গণ্ডূষ করতে হবে ! টাকা যা গেছে যাক, কিন্তু কাজটা যে এভাবে ভণ্ডুল হয়ে গেল
সেটাই বেশি পোড়াচ্ছে এস এস কে ! যা হোক , এখন ওদের অবস্থান নির্ণয় করে একটা নিখুত ঁ
38

ফাঁদ পাততে হবে, আর এবার জাল কেটে কিছু তেই পাখি বেরোতে দেয়া যাবেনা ! কষে ভাবো,
সিধু ! নিজেকেই ধমক লাগাল এস এস ! প্রায় পাঁচ মিনিট পর, ক্রূর একটা হাসি খেলে গেল এস
এস এর ঠোঁটে , পেয়েছে সে, ফাঁদ পাতার নিখুত ঁ একটা আইডিয়া পেয়েছে, তবে কিছু দিন অপেক্ষা
করতে হবে এই যা ! বলা হয়, মহা শিবরাত্রি হল যে কোন বছরের মাঝে শিবের পূজা করার
সর্বোৎকৃ ষ্ট দিন ! কিন্তু শিব রাত্রী প্রতি মাসে একবার করে আসে, আর মহা শিবরাত্রির ঠিক পরের
শিবরাত্রীটি অন্ধকারের পূজারীদের কাছে অনেকটাই কাম্য, বলা হয়, সেদিন শিবের রুদ্র অবতার
মহাকাল ভৈরব তাঁর পূর্ণ শক্তিতে বিরাজ করেন, হ্যাঁ , ওইদিন , ওইদিনই হবে প্রশস্ত সময়, কপালে
হাত ঠেকালেন এস এস , “তাই হবে মহাকালেশ্বর ! তোমার হয়ত তাই ইচ্ছা, ওই দিনই তু মি বলি
গ্রহণ করে আমায় সময় পরিভ্রমণ করার শক্তি দান করবে ! তাই হোক তবে ! তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ
হবে ঠাকুর !” তিনি এবার সাহায্য নেবেন মায়া মারীচ এর , হ্যাঁ, সেই রামায়ণের মায়া মারীচ ,
তাকেই তন্ত্রবলে ডেকে এনে লেলিয়ে দেবেন ওই বিচ্ছুগুলির উপর, ওদেরকে আলাদা আলাদা কব্জা
করতে হবে, তবে খুব কম সময়ের ব্যাবধানে, কারণ ওদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ আছে,
টেলিপ্যাথির সেই শক্তি তিনি নিজেই ওদের মধ্যে প্রবিষ্ট করিয়েছিলেন , এখন সেটা নিয়ে আফসোস
করে লাভ নেই, এছাড়া ওদেরকে পরস্পরের সাথে পরিচয় করানোর আর দ্রুততম কোন উপায় ছিল
না ! এস এস প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন, মায়া মারীচ কে ডেকে আনা চাট্টিখানি কথা নয়।
গতানুগতিক তন্ত্র উপচার দিয়ে তাঁকে তু ষ্ট করা যায়না, নিজের আত্মার খণ্ডাংশ ও আহুতি দিতে হয়
! হুম দরকার পড়লে তাই করবে এস এস ! ভয়ংকর নিঃশব্দ হাসিতে ভরে গেল সিদ্ধার্থ সোম এর
মুখ । এবার ওনার হাত গলে আর ওদের পালানো হচ্ছে না !

ট্রেনিং শুরু !
“ধ্রাম” করে দেয়ালে বাড়ি খেল আরসান, ঘষে ঘষে মাটিতে পড়ে উপলব্ধি করল, মার্শাল আর্টে র
এখনও অনেক শিক্ষা ওর বাকি, পূর্ণজী যা জানেন , সেটার অর্ধেকও ও জানেনা ! ট্রেনিং এর
প্রথম আধ ঘণ্টা ওয়ার্ম আপ, তারপর টানা দুই ঘণ্টা বিভিন্ন রকম ব্যয়াম ও খালি হাতে
আত্মরক্ষার ট্রেনিং , বেশিরভাগটাই মার্শাল আর্টে র সাথে মিল থাকলেও তার মধ্যে কুংফু কারাতে
আর ভারতীয় যোগীদের অদ্ভু ত ফাইটিং স্টাইল এর মিশ্রণও আছে। সেটারই একটার স্বাদ পেল
এইমাত্র আরসান। বেসিক মুভ গুলো প্রথমে ওই দেখিয়ে দিয়েছিল সবাইকে, আজকে ট্রেনিং এর
তৃ তীয় দিনে এসে বুঝল , দিল্লী এখনও অনেক দূর ! সবাইই অনেকটাই খাত খাটনি করছে পূর্ণ
জীর কাছ থেকে সব ধরণের কৌশল করায়ত্ত করতে । শারীরিক কসরতের পর আধঘণ্টা বিশ্রাম
আর হালকা রিফ্রেশমেন্ট , তারপর শুরু হয় আধ্যাত্মিক ট্রেনিং, এটাতে তপুর সহজাত দক্ষতা
থাকলেও, ও নিজেই বুঝতে পারলো , এখনও অনেক শেখার বাকি !

সন্ধ্যা হয় হয়, পুরান জিমনেসিয়ামের একপাশে বগলামুখী যন্ত্রের সামনে ধ্যানে বসেছে চারজন,
পূর্ণজীর মতে বগলামুখী দশ মহাবিদ্যার একজন , ওনাকে ডাকলেই মাতৃ মূর্তি র সবাইকে ডাকা হয়
! এবং , পূর্ণ জীর মতে, মহাকালীর সবচেয়ে কাছের তম জন হলেন মা বগলামুখী, কারণ
মহাকালী হলেন এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র শক্তি যিনি মহাকালেশ্বর কে থামাতে পারেন। হ্যাঁ, প্রথম
দেখায় সেই শয়তানটার তাঁবতে ু ওটাকে কালভৈরবের মূর্তি বলে ভু ল করলেও ঠাণ্ডা মাথাতে চিন্তা
করে আর কিছু বেশ পুরান পুথি ঁ পত্র ঘেঁটে তিনি জানতে পেরেছেন, ইনি স্বয়ং মহাকালেশ্বর , কাল
পিতা, ক্ষরা অক্ষরার সমসাময়িক, এবং সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হল ইনি সময় ভক্ষণ করতে
পারেন, ইনি কালভৈরবের বৌদ্ধ তান্ত্রিক সংস্করণ , তবে শতগুণ শক্তিশালী ও খল (বজ্রযান তন্ত্র
39

মতে) ! একমাত্র বিশেষ শক্তিধারী বজ্রধররাই পারেন এঁকে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাবহার করতে, সেটা
কেবলমাত্র সীমিত সংখ্যক বৌদ্ধ লামাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বলে জানতেন তিনি এতদিন ! এও
জানতেন , এই সুপ্রাচীন লামাদের মধ্যে কোন এক দুর্বিনীত লামা এঁকে ব্যাবহার করে সময়
পরিভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন , কিন্তু তাঁর প্রচণ্ড শক্তি সহ্য করতে না পেরে, নাকি কোন আচারের
ভু লের কারণে উনি সফল হননি ! যেখানে তিনি এই নিষিদ্ধ সাধনা করেছিলেন, সেই বৌদ্ধ গুম্ফা
(বৌদ্ধদের উপাসনা মন্দির তিব্বতি ভাষাতে ) এর অর্ধেকটা সহ তিনি নাকি স্রেফ বাতাসে মিলিয়ে
গিয়েছিলেন ! তারপর থেকে লামাদের কমিউনিটি তে ( খুবই স্বল্প সংখ্যক গুম্ফা নিয়ে যা গঠিত
) মহাকালেশ্বর সংক্রান্ত যে কোন আচার অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ ! কিন্তু ওই ব্যাটা কিভাবে জানি
মহাকালেশ্বর এর পূজা দিচ্ছিল, কে জানি ঠিক হচ্ছিল কিনা, মাঝে গিয়ে তিনি বাগড়া না দিলে
হয়ত সেই হতভাগ্য লামার পরিণতি বরন করতে হত সবাইকে ! তো , এখন এই মহাকালীই
হলেন একমাত্র আদ্যাশক্তি যিনি মহাকালেশ্বরকে থামাবার শক্তি ধরেন, তাঁকে জাগানো যেমন তেমন
কথা নয়, পূর্ণ জীর ঊর্ধ্বতন দ্বিতীয় পুরুষের একজন, রঘুনাথ আগমবাগীশ, জাগিয়েছিলেন তাঁকে
, হয়ত সেই দুর্বিনীত লামাকেই থামাতে কিনা তাই বা কে জানে ! শুধু জাগালেই হবেনা, তাঁকে
বুঝিয়ে সুজিয়ে শান্ত করে দেব লোকে ফেরত পাঠাতে হবে। সেই ক্ষমতা অনায়াস লব্ধ ছিল এক মাত্র
বামা ক্ষ্যাপার ! তিনি সামান্য আগমবাগীশ , তাঁর কি সাধ্য হবে এই দুরূহ কাজ করার ! মা
ব্রহ্মময়ীই জানেন !

এবার অলৌকিক ট্রেনিং এ ফেরা যাক , আরসান কে বলা হয়েছে ছবির সাহায্য না নিয়ে আর
অন্য কিভাবে সে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গাতে টেলিপোর্ট করতে পারে সেটা চেষ্টা করতে, এ
পর্যন্ত সে ব্যাপারে কোন আশার আলো দেখাতে পারেনি সে । তবে একটা সূক্ষ্ম যোগাযোগ বের
করতে পেরেছে, যেসব জায়গাতে সে আগে কোন এক সময় গেছে আর যেগুলির একটা পরিষ্কার
ছবি তার মনে গেঁথে আছে , সেখানে সে যেতে পারছে , তবে এটা এখনও তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে
রয়ে গেছে, প্রথমবার চেষ্টা করতে গিয়ে সে নিজেকে নিজের বেডরুমের লাগোয়া বাথরুমে আবিষ্কার
করেছিল ! পরেরবার আরও ভালোভাবে চেষ্টা করতে গিয়ে একেবারে গিয়ে হাজির হয়েছিল
কক্সবাজার সী বীচ এ ! সেখান থেকে আবার নিজের বাথরুমেই তাকে ফেরত আসতে হয়েছে !
সেটা করতে গিয়ে তাকে আরও সাত আটটা ভিন্ন ভিন্ন জায়গা ঘুরে আসতে হয়েছে ! কোন
ছবিটা মনে ভাসাতে হবে সেটার উপর যতক্ষণ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না আসছে, ততক্ষন একটু ভু গতে হবে
বৈকি ! পূর্ণ জী ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন , “কোন ভয় বা চিন্তা মনে স্থান দিওনা বাবা !
একাগ্র মনে চিন্তা করে যাও আর ফাঁকে ফাঁকে বগলামুখী মন্ত্র পড়, সফলকাম হবেই ! ”

তপু খুব দ্রুত শিখছে , আগুনটা অনেক নিয়ন্ত্রিত আর স্থির লক্ষে ছোরার দিকে জোর দিয়েছেন পূর্ণ
জী, ছু ড়তে সে পারছে ঠিকই , কিন্তু কখনও কখনও সেটা হলদে আগুনের বদলে নীলচে বজ্রপাতের
সংক্ষিপ্ত সংস্করণ হয়ে যাচ্ছে ! এটা নিয়ে সে যতটা না চিন্তিত , বেশি বিস্মিত স্বয়ং পূর্ণ জী ! এই
ছেলে তো বজ্র ছুঁ ড়ছে হাত দিয়ে ! এটা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, নাহলে সমূহ বিপদ !
নিজের সাথে সাথে এ তো সব্বাইকে ধ্বংস করে দেবে ! “নিজের হতাশা আর রাগকে একত্রিত করে
শুভ শক্তির দিকে প্রবাহিত কর আর মা ব্রহ্মময়ীকে স্মরণ কর, তু মি কতটা শক্তিশালী তা তু মি
নিজেও জাননা ! ”

সুমিত্রা এদের দুজনের তু লনাতে অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত , হলদে মেঘটাকে ও এখন যেমন খুশী নিয়ন্ত্রণ
করতে পারে, দিতে পারে যে কোন আকার ! তবে সেটার মধ্যে কেন জানি সিংহের আকার নেবার
40

প্রবণতা দেখা যাচ্ছে ! এখনও অনেকটাই ধোঁয়া ধোঁয়া , তবে এর মাঝেই দুবার আরসান কে আর
একবার তপুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল, পড়ে গিয়ে দুজনেরই চেহারা দেখবার মত হয়েছিল !
আজকে মনটা অনেকটাই বিক্ষিপ্ত ছিল , পাড়ার কয়েকটা বখাটে ছেলে ওকে জ্বালাচ্ছে বেশ কদিন
ধরেই , মন সংযোগের মাঝখানেই তাদের কথা মাথাতে চলে এলো ঝট করেই ! বিকট একটা গর্জ ন
শুনেই চমকে চোখ খুলে দেখে, হলুদ ঘন মেঘে তৈরি এক বিকট দর্শন সিংহ সামনেই দাঁড়িয়ে !
সেটারই গর্জ ন শুনেছে সে আর সেটা তারই তৈরি ! পাশ থেকে মাথাতে হাত রাখলেন পূর্ণ জী ,
“তোকেও তপুর মতই রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে, সামনে যেটা দাঁড়িয়ে আছে এটা তোর
রাগের তৈরি ! সাবধান না হলে এ আশেপাশের সবার সাথে তোকেও ছিঁড়েখুড়ে ঁ ফেলবে ! মা
বগলামুখী মন্ত্র পড় এক মনে !”

রইল বাকী সায়নী, তার ব্যাপারটা হল, বগলামুখী মন্ত্র পড়তে পড়তে হঠাৎ করেই তার হাতে একটা
বিকট আকৃ তির সোনালি আভা ছড়ান গদা এসে উপস্থিত হয়, আর সেই গদা থাকা অবস্থাতে সে
অনায়াসে এমন সব ভারী ভারী জিনিস তু লে অবহেলা ভরে দূরে ছুঁ ড়ে ফেলে যে, স্বয়ং গামা
পালোয়ান ও বেঁচে থাকলে চমকে উঠতেন! আধমণ ওজনের বারবেল টা ছুঁ ড়ে জিমনেসিয়ামের
একদিকের দেয়ালে ফাটল ধরিয়ে দেবার পর থেকে ওকে পূর্ণ জী বলেছেন, “তু মি মা স্বয়ং বগলামুখী
! রক্ষে কর মা ! শুধু গদার আবির্ভ াবের সময়টা স্থির কর, তোমার আর কিচ্ছু করা লাগবে না
মা জননী ! ”

অধ্যায় – ১০

শিথিলতার সুযোগে আক্রমণ


উফফ !! হাঁফ ছেড়ে ভাবলেন পূর্ণানন্দ আগমবাগীশ , সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ কয়েকটা ছেলে
মেয়েকে “লৌকিক অলৌকিক ” ট্রেনিং দিতে গিয়ে তাঁর বারোটা বেজে গেছে ! এর থেকে আগম
তন্ত্রের সাধনাও বোধ করি সহজ ছিল ! ওদের প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে তিনি নিজেও অনেক কিছু
শিখেছেন ! বিশ দিনের ট্রেনিং শেষে আরসান মনে মনে মন ছবি তৈরি করে টেলিপোর্ট করতে
পারছে (কাছাকাছি যেতে পারছে আর কি ! যেমন শোবার ঘরে যেতে চাইলে উপস্থিত হচ্ছে
লাগোয়া বাথরুমে !) , তপু বেশ ভালোভাবে আগুন (বেশি উত্তেজিত হয়ে গেলে সেটা কিভাবে
জানি বজ্রপাতে বদলে যাচ্ছে !) তৈরি করছে , সুমিত্রা ওর হলুদ সিংহকে আরসান দের বাড়ির
চৌহদ্দি পুরোটা ঘুরিয়ে এনেছে, ওর চোখের আড়ালে ও সেই সিংহটার চোখ দিয়ে সব দেখছিল ! (
41

সেটাকে দেখার পর থেকে আরসান দের বাড়ি পাহারা দেয়া সিকিউরিটি কোম্পানির লোকজনের এক
সপ্তাহব্যাপী লুজ মোশন শুরু হয়ে গেছিল ! যতই তারা সাহসী হোক, সামনাসামনি পশুরাজ এসে
দাঁড়ালে কে আর ঠিক থাকতে পারে !) , আর সায়নী ! সে জিমনেশিয়ামের আগের ভারী ভারী
যন্ত্রপাতি পাটকাঠির মত মটমট করে ভেঙ্গে ফেলছে দেখে আরসান কে বাধ্য হয়ে নতু ন যন্ত্রপাতির
অর্ড ার করতে হয়েছে ! (আর তার সোনালি গদার আঘাতে জায়গায় জায়গায় বসে যাওয়া দেয়াল
আর কংক্রিটের মেঝের কথা নাই বা বললাম !) এবার তিনি কিছু টা বিশ্রাম চান ! চট্টগ্রামের
সীতাকুণ্ডে ব্যাসকুণ্ড আর বাবা চন্দ্রনাথের মন্দির দর্শন করতে চান তিনি , আরসানদের একটা
মাইক্রো নিয়ে যাবে তাঁকে, তিনি শত নিষেধ করলেও শোনার ছেলে তো আরসান নয় ! ওরাও
যেতে চাইছিল, তিনি নিষেধ করে দিয়েছেন , অনেক লোক সঙ্গ হয়েছে , এবার কিছু দিন নির্জ নে
সাধনা করতে চান তিনি , বাবা ভোলানাথের পদচরনে খানিক একা সময় কাটাতে চান । সময়
আর কদিন তাঁর জীবনে বাকি আছে মা ব্রহ্মময়ীই জানেন ! সময় কারো জন্য থেমে থাকেনা, সে
তার নিজস্ব গতিতেই বয়ে যায় । অসুরদের সাথে তাদের এবারকার লড়াইটাও তো সময় নিয়েই !
তাঁর মনে পড়ে গেল অনেএএএক দিন আগে কোথায় জানি পড়া একটা ইংরেজি কবিতা
...............।

Time, You Old Gypsy Man


Will you not stay,
Put up your caravan
Just for one day?
All things I'll give you
Will you be my guest,
Bells for your jennet
Of silver the best,
Goldsmiths shall beat you
A great golden ring,
Peacocks shall bow to you,
Little boys sing.

দীর্ঘ এক সপ্তাহের কঠোর চেষ্টা শেষে মায়া মারীচ কে ডেকে এনেছেন সিদ্ধার্থ সোম, তার বাড়ির
সেলারে বসেই কাজটা সেরেছেন তিনি। বিকট অট্টহাস্য করে তার সামনে উপস্থিত হয়েছে তাড়কা
রাক্ষসীর ছেলে মায়া মারীচ রাক্ষস ! শ্বদন্ত ব্যাদান করে জানতে চেয়েছে তাকে ডেকে আনার
কারণ! এক এক করে ওই চারজনের কাপড় থেকে ছেঁ ড়া টু করোগুলি আহুতি দিয়েছেন আগুনে,
তারপর সমস্ত উপচার শেষ করে , বিভিন্ন দোহাই দিয়ে মারীচ কে লেলিয়ে দিলেন এস এস ওই
চারজনের উপর ! ক্লান্তিতে সেলারেই শুয়ে পড়লেন তিনি, আহহ! এবার শান্তি ! ছলে বলে কৌশলে
ওদের চারজনকেই এনে তাঁর পায়ে ফেলবে এবার মারীচ , এবং মহাকালেশ্বর এর যজ্ঞ সম্পূর্ণ না
হওয়া পর্যন্ত তাঁর কাছ ছেড়ে নড়বে না ! কারণ তাকে মন্ত্রে আবদ্ধ করে রাখা ছাড়াও লোভনীয়
এক পুরষ্কারের লোভ দেখানো হয়েছে, সেটা হল , এস এস এর কাজ সমাধা হয়ে গেলে এই
ধরাধামে সে নিজের ইচ্ছামত ঘুরে বেড়াতে পারবে আর মানুষ খেতে পারবে ! একজন রাক্ষসের
পক্ষে এই লোভ সামলানো সত্যিই কঠিন !
42

আধ ভাঙ্গা জিমনেশিয়ামে বসে আছে আরসান , আজকাল এখানেই বেশির ভাগ সময় কাটায় সে ,
তপুরা এখানেই এসে দেখা করে ওর সাথে , আড্ডা দেয় । ওদেরকে শত চেষ্টা করেও নিজের ড্রইং
রুমে , নিদেন নিজের শোবার ঘরেও বসাতে পারেনি আরসান, সুমিত্রা ওর সাথে বেশ সহজ এখন ,
সে সরাসরি বলেই বসেছে , “তোমাদের ঘরগুলিতে না, জিনিস বড্ড বেশি আরসু ! আমার মত
বাকিদেরও মনে হয় একই অনুভূতি হয় এখানে আসলে, অনেকটাই আড়ষ্ট আর বেশিটাই কেমন
জানি হাঁসফাঁস ভাব ! তাইনা সায়নী ? ” ঝট করে সায়নীর দিকে প্রশ্নটা ছুঁ ড়েছিল সে, জবাবে
বেশ বিব্রত বোধ করলেও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়েছিল সায়নী , সাথে তপুও কেন জানি ! আর
জোরাজোরি করেনি আরসান। জিমনেশিয়ামই সই ! বন্ধুদের সাথে দেখা হলেই হল ! আর এরাই ,
আরসান দেখেছে, তার এতদিন কার বন্ধুদের চাইতে পুরোটাই আলাদা ! ও যে এত বড়োলোকের
ছেলে, সেটা এরা পাত্তাই দেয় না, ওর অন্যান্য তথাকথিত বন্ধুদের মত চাটু কারিতাও নেই, আলগা
ধান্দাবাজিও নেই ওর মাথাতে কাঁঠাল ভাঙ্গার ! পেটে গুঁতো মেরে হাসতে হাসতে ওকে পচাতে থাকে
সমানে ! ও ও অবশ্য কাউকে ছাড় দেয়না, সুমিত্রা ব্যাতিক্রম , ওকে কখনও পচানোর কথা
ঘুণাক্ষরেও ভাবেনা আরসান ! এই নিয়ে তপু আর সায়নী চোখ ঠারাঠারি থেকে শুরু করে ওদেরকে
“কপোত কপোতী ” ডাকা সহ কিচ্ছু বাদ রাখেনি , আরসান ড্যাম কেয়ার , তপুকে একলা পেয়ে
পাকড়াও করেছিল একবার, সায়নীর সাথে ও কোন ইটিস পিটিস করছে কিনা , তপু চোখ কপালে
তু লে বলেছিল , “ইটিস পিটিস ! সেটা আবার কি ?” পনের মিনিট লাগলো আরসানের বুঝতে যে
তপু আসলে ইটিস পিটিস শব্দটার মানেই বুঝেনা ! তারপর তার কি হাসি , পরের এক সপ্তাহ তপু
আর সায়নীকে পচানর মশলা হিসাবে এটাকে ভালই ইউজ করেছিল সে ! আনমনে এসবই ভাবছিল
আর হাসছিল আরসান ! সেই মুহূর্তে একটা মিষ্টি কণ্ঠ ভেসে এলো জিমনেশিয়ামের দরজার দিক
থেকে , “আরসু ! একটু এদিকে আসবে ?” গলাটা সুমিত্রার ! বেশিটাই অবাক আর খানিকটা
খুশির ভাব নিয়ে এগোল আরসান, ওর মনেই রইল না, একটু আগেই ওদের তিনজনকেই গাড়িতে
করে বাসাতে পাঠিয়ে দিয়ে এসেছে সে নিজেই ! ওর আর দোষ কি ? স্বয়ং অবতার শ্রী রাম
চন্দ্রও ধরা খেয়ে গেছিলেন মায়া মারীচের মায়ার কাছে, সে তো সামান্য মানুষ মাত্র ! হ্যাঁ, ওটা
সুমিত্রার ছদ্মবেশে মায়া মারীচ স্বয়ং ! মায়াবলে সে গেট তো পেরিয়ে এসেছেই, সাথে করে নিয়ে
এসেছে রুস্তমকেও ! কিন্তু মায়া রাক্ষসের সেই পুরানো সীমাবদ্ধতা, লক্ষ্মণ গণ্ডি যেমন সে পেরুতে
পারেনি, তেমনি অনাহুত কারো ঘরেও সে প্রবেশ করতে পারেনা ! আরসান কে তাই দরজাতে
দাঁড়িয়েই ডাক দিয়েছে , অসতর্ক আরসান দরজা পেরুতেই বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল রুস্তম
ক্লোরোফরমের রুমাল হাতে , নাকে চেপে ধরে ছটফটানি থামতেই আরসান কে কাঁধে ফেলে নিল
অনায়াসে ! রওনা দিল গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা কালো নোয়াহ গাড়িটার দিকে , কিন্তু
ওরা দুজনেই একটা জিনিস ভু লে গেল, ত্রেতা যুগের মায়া মারীচ মানুষের চোখকে ফাঁকি দিলেও,
আরসান দের বাড়ির চারপাশে ফিট করে রাখা যান্ত্রিক চোখগুলিকে মোটেও ফাঁকি দিতে পারেনি,
যেগুলির আধুনিক নাম হল সিসিটিভি ! সেখানে মারীচের মায়াবলের ছবি নয়, তার আসল
চেহারার ছবিই উঠে যে বসে আছে, সেটা সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, আর স্থূলবুদ্ধি রুস্তমের
মাথাতেও ব্যাপারটা আসেনি !

সুমিত্রা বাসাতে এসে সবে ফ্রেশ হয়ে বিছানাতে বসেছে, ওমনি জানালার বাইরে থেকে ডাক এলো ,
“এই সুমি, একটু বাইরে আসবে প্লিজ ? ” আরসানের গলাটা শুনেই বুকের রক্ত ছলকে উঠলো
সুমিত্রার, বলল , “আরে বাইরে কেন আরসু, ভেতরে এসো !” “না না , তু মি একটু বাইরে আস,
জরুরী কথা আছে !” অধৈর্য কণ্ঠে বলল আরসান ! আরে ! এই না ওদের বাসা থেকে এলো,
43

এর মধ্যে এতোটা পথ ভেঙ্গে এসে বাইরে দাঁড়িয়ে আবার কি জরুরী কথা ! বেশ অবাক হয়েই
বাইরে বেরুল সুমিত্রা, আর পা দিল মারীচ আর রুস্তমের পাতা ফাঁদে !

“এই সানী ! একটু বাইরে আসো তো প্লিজ !” সায়নীর দরজাতে হাজির মায়া মারীচ, তপুর রুপ
ধরেছে এবার ! সরল সোজা মেয়েটা এগিয়ে গেল সেই ফাঁদের দিকে যেভাবে আগুনের দিকে এগিয়ে
যায় পতঙ্গেরা, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও !

তপুদের আশ্রমে নিয়ম কড়া হলেও পূর্ণানন্দ জীর জন্য সাত খুন মাফ ! কিন্তু উনি কেন জানি
আশ্রমের উঠানেই দেখা করতে চাইলেন তপুর সাথে ! একটু অবাক হলেও তপুকে ডেকে দেয়া হল,
সে এসে দাঁড়ানোর পর পেছনের ঝোপ থেকে রুস্তম ঝাঁপিয়ে পড়ল শিকারির ক্ষিপ্রতায় ! চোখেমুখে
অবাক ভাব নিয়েই অজ্ঞান হয়ে গেল তপু, সে সবে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল যে পূর্ণ জীর তো এত
তাড়াতাড়ি আসার কথা না !

সেই পুরানো রুটিনেই ওদেরকে নিয়ে আসা হল ভারতে, কড়া সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হল
এস এস এর প্রাসাদোপম বাড়ির একটা নিভৃ ত কক্ষে ! ক্রুর হাসি নিয়ে পুরো কার্যক্রম তদারকি
করলেন এস এস , এবার ওদের বিছানাগুলো যথেষ্ট দূরে রাখা হয়েছে, কোন ছবি টবি কারো
পকেটে নেই , কষে বাঁধা হয়েছে হাত পা, মায়া মারীচ আরেকটা পথ বাতলে দিয়েছে , এস এস
এর সাহায্যে ওদের সবার স্বপ্নে প্রবেশ করে ভু লভাল দেখাচ্ছে সে ! বিনিময়ে তাকে অবশ্য রোজ
একটা মানুষ দিতে হচ্ছে, সেটা এস এস এর জন্য কোন সমস্যা না, আর চার পাঁচদিন পরেই সব
ভালয় ভালয় সমাধা হয়ে গেলে ছেড়েই তো দেয়া হবে, তখন চরে খাবে নিজেই !

আরসানের স্বপ্নে সে দেখছে, একটা বিশাল বনে সে একা দাঁড়িয়ে আছে, তাকে কেউ বলে দেয়নি
কিন্তু সে জানে সে পথ হারিয়ে ফেলেছে ! দিশেহারা হল না সে, স্বপ্নে সেটা সম্ভবও না, চু পচাপ
একদিকে হাঁটা দিল ! কিন্তু আধ ঘণ্টা টাক হাঁটার পর অবাক হয়ে আবিষ্কার করল , যেখান থেকে
সে হাঁটা ধরেছিল, আবার সেখানেই ফিরে এসেছে ! কোথায় জানি শুনেছিল সে , কামরূপ
কামাখ্যাতে এমনটা হয়, সেখানে কিছু জায়গা আছে , সেসব জায়গা থেকে কেউ সকালে হাঁটা ধরলে
বিকাল অবধি সেখানেই থেকে যায়, এক পাও এগোতে পারেনা ! সে নিজেও কি এরকম কোন
মায়ার জায়গাতে এসে পড়ল, চিৎকার দিতে গিয়ে আবিষ্কার করল তার গলা দিয়ে আওয়াজই
বেরোচ্ছে না ! ভীষণ আতঙ্কে আরও আবিষ্কার করল তার ঠোঁট বলতে কিছু র অস্তিত্ব সে টের
পাচ্ছে না ! হাত মুখে বুলিয়ে আরও চমকে গেল সে, তার তো নাকও নেই ! কাছেই একজায়গাতে
জল জমে আছে খানিকটা , সেখানে অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিজের চেহারা দেখতে গেল সে, নাক মুখ কান
বিহীন সে নিজের সেই বীভৎস চেহারা দেখে মাথা ঘুরে পড়ে গেল, স্বপ্নের মধ্যেই !

তপু দেখছে একটা বিশাল পাহাড়ের মাথাতে তাকে কারা জানি হাত পা বেঁধে দাঁড় করিয়ে রেখেছে,
সে কোথায়, কি তার অপরাধ ,কিছু ই জানেনা সে,পায়ের নিচে মুখ ব্যাদান করে আছে অতল খাদ
! পেছনে বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সে টের পাচ্ছে, পেছনে ঘুরতে যেতেই শক্ত কিছু একটার
বাড়ি পড়ল মুখে, “উহ !” করে উঠে তপু টের পেল নোনা রক্তের স্বাদ তার ঠোঁট বেয়ে নিচে
গড়িয়ে যাচ্ছে ! “সামনে দেখো !” হিন্দি উচ্চারণে কেউ কর্ক শ কণ্ঠে বলে উঠলো । আরও বেশ
কিছু ক্ষণ পর অনেক পেছন থেকে আদেশ এলো “ধাক্কে মারকে ফেক দো নিচে !” কিছু বুঝে উঠার
আগেই প্রবল ধাক্কার চোটে নিচের দিকে পড়তে শুরু করল তপু ! সাঁই সাঁই করে বাতাস কেটে
44

নিচে পড়তে লাগলো সে ! নিচে , অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে চোখা চোখা পাথর, যেখানে একটু
পরেই ভর্ত া হয়ে যাবে তার শরীরটা ! দাঁতে দাঁত চেপে সেই অবস্থাতেই সে ইষ্টনাম স্মরণ করতে
পারলো সে ! কিন্তু এই বিভীষিকা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলো না, জ্ঞান হারিয়ে ফেলল আছরে
পড়ার আগেই ।

সুমিত্রাকে কারা জানি হাত পা বেঁধে ফেলে রেখেছে একটা অন্ধকার ঘরের এক কোণে, সে ঘরের
কোণাতে কোণাতে কি জানি কারা জানি ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ফিস ফিস করছে, “আয় ! আয় য় !
আয় না !” নিদারুণ আতঙ্কে সুমিত্রা দেখছে সেই ছায়াশরীর গুলি গড় গড় এক ধরণের শব্দ করতে
করতে এগিয়ে আসছে ওর দিকে ! ওদের শ্বদন্ত গুলি ঝিকিয়ে উঠছে থেকে থেকে , আতঙ্কে সুমিত্রা
চোখ বন্ধ করে ফেলল, সে এই দৃশ্য আর দেখতে চায়না !

চোখ খুলেই সায়নী আবিষ্কার করল তাকে উলটো করে ঝু লিয়ে রাখা হয়েছে, আর খানিক খানিক
বিরতি দিয়ে সপাং , সপাং করে চাবুক পড়ছে তার শরীরে ! যে মারছে সে মানুষ না অপদেবতা
সায়নী বলতে পারেনা, তবে এরকম কুৎসিত চেহারা সায়নী জীবনে দেখেনি, দেখেনি এরকম
হায়েনার মত খিক খিক হাসিও ! বেশ কয়েকটা চাবুকের বাড়ি খাবার পড়ে সে আর সহ্য করতে
না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল !

এই সবই ছিল মায়া মারীচের কারসাজি ! সে মানুষকে এবং দেবতাদেরও, যা খুশি দেখাতে পারে
! স্বপ্নের ভেতর দেখাতে পারার ব্যাপারটা নতু ন, মানুষরূপী ব্রহ্মপিশাচ সিদ্ধার্থ সোম তাকে সেই
ক্ষমতা ধার দিয়েছে, সে বেশ মজাই পাচ্ছে , সাথে প্রতিদিন একটা করে মানুষ তো আছেই , ওই
পাগলটা তাকে নেহাৎ মন্ত্রের বাঁধনে আটকে রেখেছে দেখেই, নাহলে সবার আগে ওরই ঘাড় মটকাত
মারীচ, এস এস ও ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেই ওর বেশি কাছাকাছি কখনও আসেনা,
ছেলেমেয়েগুলিকে অপহরণের সময় রুস্তম ও বেশ দূরত্ব বজায় রেখেছিল ! এখন ওই ছেলেমেয়েগুলিকে
বিভীষিকা দেখাচ্ছে সে, একটার পর একটা, শুধু ওই কোঁকড়া চু লো ছেলেটাই একটু ঝামেলা
বাধাচ্ছে, খানিক পরপরই ওর স্বপ্ন দৃশ্যগুলি থেকে কিভাবে জানি বের হয়ে যেতে চেষ্টা করছে
ছেলেটা, ওর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গাতে যাবার ক্ষমতা সম্পর্কে এস এস জানিয়েছে মারীচ
কে, নাহ ! ওকে স্বপ্ন দৃশ্য থেকে পালাতে দেয়া যাবেনা কিছু তেই ! আর ব্যাপারটা এস এস কে
দ্রুত জানাতে হবে, যাতে ছেলেটাকে আরও কড়া ঘুমের ওষুধ দেয় !

থমথমে মুখে সুনন্দ চৌধুরীকে রিপোর্ট জানালেন নগর পুলিশের ডিটেকটিভ প্রধান সাইফু ল করিম,
“স্যার, সিসিটিভি ফু টেজে দেখা যাচ্ছে একটা ষণ্ডা মত লোক আর একটা বিকট কালো আকৃ তির
লোক বিনা আয়াসে আপনার গেট দিয়ে ঢু কেছে, আপনাদের পুরানো জিম্নাসিয়ামের দরজাতে
দাঁড়িয়েছে, একটু পড়ে আপনাদের ছেলে বেরিয়ে এসেছে, ওর মুখে ষণ্ডা মত লোকটা সম্ভবত
ক্লরফরম ভেজানো রুমাল চেপে ধরে স্রেফ কাঁধে তু লে নিয়ে গেট দিয়েই আবার বেরিয়ে গেছে !
ওদেরকে ঢোকার মুখে বা বেরবার মুখে কেন আপনার এত গুলি সিকিউরিটির লোকে বাঁধা দিল না,
সেটা বড়ই আশ্চর্যের বিষয়, একটা গুলিও খরচ করতে হয়নি অপহরণকারীদের, এটা আমার দেখা
স্মরণ কালের সবচেয়ে অদ্ভু ত অপহরণ ! সিকিউরিটির লোকদেরকে আমি নিজে জেরা করেছি, সবাই
হলপ করেছে যে, ওরা দেখেছে আপনার ছেলের বান্ধবী সুমিত্রা ভেতরে ঢু কেছে, তারপর সে আর
আপনার ছেলে বেরিয়ে গেছে একটু পরে !” সুনন্দ চৌধুরী আরও থমথমে মুখে জানালেন, “উইথ
অল ডিউ রেসপ্যাক্ট, সেটা সম্ভব নয়, কারণ সুমিত্রাও নিখোঁজ, সেই সাথে নিখোঁজ তপু আর সায়নী
45

নামের দুই ছেলেমেয়েও ! এবং ফর ইউর ইনফরমেশন, ওরা গত মাস খানেক আগেও একইভাবে
নিখোঁজ হয়ে গেছিল ! আরও ভালোভাবে বললে , ওদেরকে অপহরণ করা হয়েছিল ! ”
“তাহলে, তাহলে ............উম্মম্মম” আমতা আমতা করতে লাগলেন সাইফু ল করিম, “তাহলে তো
ব্যাপারটা অন্য এঙ্গেল থেকে দেখতে হচ্ছে ! ” এবার সুনন্দ চৌধুরীর প্রভাবশালী ব্যাক্তিত্ত্ব বেরিয়ে
এলো বাইরে , “যে এঙ্গেল থেকেই দেখুন না কেন, আমার ছেলের সাথে বাকীদেরও আমি চব্বিশ
ঘণ্টার মধ্যে ফেরত চাই ! সেজন্য যদি বাংলাদেশের সমান একটা চালুনি লাগে, আমি ব্যাবস্থা করে
দেব ! কিন্তু আমি আমার ছেলেকে ফেরত চাই, উইদিন টু য়েন্টি ফোর আওয়ার !” কিছু একটা
বলতে গিয়েও চেপে গেলেন সাইফু ল সাহেব, এই লোক প্রধানমন্ত্রীর কাছের লোক, উল্টাপাল্টা কিছু
বলে বিপদে পড়তে চান না “উই উইল ডু আওয়ার বেস্ট , স্যার !”

অধ্যায় – ১১

অন্তিম সংঘর্ষ
আপনা থেকেই চোখ খুলে গেল পূর্ণানন্দের , সীতাকুণ্ডের “শঙ্কর মঠ” এর সন্ন্যাসীদের থাকার জন্য
নির্দি ষ্ট একটি ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি, চন্দ্রনাথ পাহাড় আর আশেপাশের অন্যান্য মন্দির ঘুরে
শরীর ক্লান্ত ছিল বেশ । ঘুমে যেন জ্যোতির্ময় মহাদেব এসে তাঁকে দেখা দিলেন, বললেন , “এখানে
ঘুমিয়ে থাকলে চলবে ? তোর শিষ্যদের তো ভয়ানক বিপদ ! ” ধড়মড় করে বিছানাতে উঠে
বসলেন তিনি, স্বয়ং মহাদেব তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন, বলেছেন তাঁর শিষ্যরা ভয়ানক বিপদে আছে
! তাঁর বুকটা ধড়ফড় করতে লাগলো, তবে কি সত্যিই ওদের কিছু হয়েছে ! পাশে রাখা ঝোলা
থেকে বের করলেন একটা বাটন মোবাইল, এই যন্ত্রটা চালাতে খুব একটা জানেননা তিনি, কয়েকটা
নাম্বার খালি সেভ করা আছে , তার মধ্যে একটা হল সেই মাইক্রো যেটা তাঁকে এখানে এনে
দিয়েছে, সেটার ড্রাইভারের নাম্বার, বেশ কয়েকবার রিং হবার পর ওপাশ থেকে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে
“কে ?” বলার সাথে সাথে জবাব দিলেন , “আমি পূর্ণানন্দ, আরসু বাবুদের কি খবর ? ” আসলে
এত রাতে আরসানের বাবা মাকে বিরক্ত করতে চাননি পূর্ণানন্দ, কিন্তু জবাবে যা শুনলেন , তাঁর
শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। সর্বনাশ ! ওই পিশাচটা আবার আঘাত হেনেছে, এবার
একদম বাড়ির ভেতর ! তিনি ফোন কেটে দিয়ে আরসানের বাবার নাম্বারে ফোন দিলেন এবার,
তিনি তু ললেন সাথে সাথে , জেগেই ছিলেন বোঝা গেল, তিনি বললেন মাইক্রো পাঠিয়ে দিচ্ছেন তিনি
যত দ্রুত সম্ভব, গতবার পূর্ণ জীই যে ওদের বাঁচিয়েছিলেন সেটা মনে আছে সুনন্দ বাবুর।

আরসান দের বিশাল ড্রইং রুম, এ সি চলছে প্রায় নিঃশব্দে , একপাশে বসান মেহগনি কাঠের
সেক্রেটারিয়েট টেবিল ঘিরে গম্ভীর মুখে বসে আছেন সুনন্দ বাবু, পূর্ণ জী, ঢাকা মহানগর পুলিশের
ডিটেকটিভ বিভাগের সেকেন্ড ইন কমান্ড তউসিফ রুডলফায (সাময়িক বিরতিতে গেছেন সাইফু ল
সাহেব , তাঁর তো একটা কিডন্যাপ কেস নিয়ে পড়ে থাকা চলেনা ) , পুলিশের আই জির
সেক্রেটারি ( আই জি সাহেবের জরুরী মিটিং আছে ) । তাঁদের সামনে একটা ল্যাপটপে আরসান
কে কিডন্যাপ করার ফু টেজ টা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হচ্ছে, অদূরেই পুলিশের একটা ছোট্ট কম্যান্ড
সেন্টার বসান হয়েছে , সেখানে ফু টেজ থেকে পাওয়া মুখাবয়ব গুলি লোকাল আর ইন্টারন্যাশনাল
ক্রিমিনাল ডাটা বেজে খুজে
ঁ দেখা হচ্ছে কোন মিল পাওয়া যায় কিনা ! খানিক পরেই পিং করে
46

একটা শব্দ আর কম্যান্ড সেন্টার ঘিরে একটা উত্তেজনা ! একটা প্রিন্ট আউট নিয়ে একজন এইড
দৌড়ে এলো , আইজির সেক্রেটারির হাতে সেটা দিয়ে অনুচ্চ কিন্তু উত্তেজিত স্বরে কিছু একটা বলল,
সেক্রেটারির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো , কাজ দেখাতে পারলে কার না আনন্দ হয় ! গলা খাঁকারি
দিয়ে তিনি বললেন “ওয়েল, জেন্টেলম্যান ! আমরা একজন অপরাধীকে মনে হয় সনাক্ত করতে
পেরেছি ! ওকে বিভিন্ন অপরাধের জন্য আমাদের পাশের দেশ ভারতে খোঁজা হচ্ছে, একবারও
গ্রেফতার করা যায়নি, কাজ সেরে দ্রুত কেটে পড়ার দুর্লভ গুণের অধিকারী লোকটা, ‘ফ্যান্টম
কিলার’ হিসাবে বেশি পরিচিত, আসল নাম জানা যায়নি! ” ছবিটা বাকিদের দিকে ঘুরিয়ে ধরতেই
, অস্ফু ট স্বরে বলে উঠলেন পূর্ণ জী , “রুস্তম !!” “আপনি চেনেন একে ? ” বিস্মিত স্বরে বলে
উঠলেন তউসিফ , “উনি গতবার আমার ছেলেকে কিডন্যাপারদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন ,
ওই লোকটা সম্ভবত কিডন্যাপার দলের সদস্য ছিল, তাইনা ?” সুনন্দ বাবু ব্যাখ্যা দিলেন ।
সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন পূর্ণ জী , “এরাই ওদেরকে গতবার নিয়ে গিয়েছিল, আমাকে একটা
খালি ঘর আর একদিন সময় দিন , আমি ওদেরকে ঠিক খুজে ঁ বের করব !” “সারা ভারতের
পুলিশ যাকে খুজে ঁ বেড়াচ্ছে আপনি একদিনে তাকে খুজেঁ বের করে ফেলবেন ?” অবিশ্বাসে মুখ
বাঁকালেন তউসিফ ! তাঁর দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকালেন পূর্ণ জী, “আমি আরসান দের খুজ ঁ ব,
রুস্তমকে নয় !”এই সব অবিশ্বাসীদের সাথে কথা বলার মানে সময় নষ্ট, এমন একটা ভঙ্গী করলেন
সেই সাথে ! “হুম, সেই সাথে আমরাও খুজ ঁ তে থাকি, হাজার হলেও আমরাই তো প্রথম রুস্তম না
কে , ওকে খুজে ঁ বের করে দিলাম! ” আবার গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন আই জি সেক্রেটারি ,
আর ওরা যদি ভারতে থাকে , তাহলে এমব্যাসির মাধ্যমে ওখানে অপারেশন চালানোর অনুমতিও
তো লাগবে ! ” হার মানতে রাজী নন রুডলফাজ।

উত্তেজনাতে গতকাল রাতে ঘুমই হয়নি এস এস এর । গতবারের মত ভিড়ের সাপোর্ট এবার পাবেন
না, তাই আগে থেকে ঠিক করে রাখা একটা বিশাল বাড়িতে সব সরঞ্জাম ( ছেলেমেয়েগুলি সহ !
) নিয়ে এসেছেন কালকেই । বাড়িটা উজ্জইন এর মহাকালেশ্বর জ্যোতিরলিঙ্গ মন্দিরের কাছাকাছিই
। গতবারের ঘটনার পর পাণ্ডারা মন্দিরের ধারে কাছে কাউকে ঘেঁষতে দিচ্ছে না, অদূর ভবিষ্যতে
দিবে বলে মনেও হয়না ! আর স্থানীয় প্রশাসন থেকেও কড়াক্কড়ি চলছে, তাই এই ব্যাবস্থা ! সময়
সমুপস্থিৎ !

বিশাল উঠানে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে পূজার আয়োজন হয়েছে, কফিন থেকে বের করা হয়েছে
মহাকালেশ্বর এর বিকট মূর্তি , তাঁর সামনে গতবারের মতই সব উপচার সাজানো হয়েছে একটা
হাড়িকাঠ আর ভয়াল দর্শন একটা খড়গ সহ ! নতু ন সংযোজন মায়া মারীচ রাক্ষস, একটা চক্রের
মাঝখানে শেকল দিয়ে বাঁধা হয়েছে তাকে, কাজ সমাধা হবার আগে কিছু তেই যাতে ছু টে পালাতে না
পারে ! আগেরবারের মতই একপাশে একটু দূরে দূরে স্ট্রেচারে বেঁধে রাখা হয়েছে তপুদের, একটু
একটু চেতনা আসছে ওদের, বলির সময় অজ্ঞান থাকলে চলবে না, তাই ওদের দয়া করে চেতনার
কাছাকাছি এনেছে এস এস, নাহলে অজ্ঞান অবস্থাতেই ............বাইরে ছোটোখাটো সেনাবাহিনী
মজুদ , কিয়দংশ ভেতরেও আছে। যে কোন ধরণের অপ্রত্যাশিত লৌকিক আঘাত এলে সামাল
দেবার দায়িত্ব তাদের, এবারো ওদের নেতৃ ব্তে রুস্তম দি গ্রেট ! মূর্তি র সামনে প্রণাম করে লাল
শালু আর কপালে রক্ত চন্দন পড়া সিদ্ধার্থ সোম শুরু করলেন তার অশুভ আচার, দ্বিতীয়বারের
মত !!!
47

ঝটিকা আক্রমণ

HAL Light Combat Helicopter এর জানালা দিয়ে অধৈর্য ভঙ্গিতে বাইরে তাকিয়ে আছেন
পূর্ণানন্দ আগমবাগীশ, বিশেষ পূজা আর তাঁর তান্ত্রিক জ্ঞানের সবটু কু নিংড়ে অবশেষে বের
করেছেন আরসান দের অবস্থান, ওদেরকে আবার উজ্জইনিতেই আনা হয়েছে, আরেকটা জিনিস তিনি
আবিষ্কার করেছেন, সেই শয়তানটার সাথে এবার যোগ দিয়েছে আরও সুপ্রাচীন একটা সত্ত্বা, যেটার
সাথে তাঁর চেনা অপদেবতাদের কোন মিল তিনি খুজে ঁ পাননি, তবে সেটার মায়ার প্রবল প্রভাবেই
আরসান দেরকে তিনি সহজে খুজে ঁ পাচ্চিলেন না, আর সেটার কারণেই সম্ভবত আরসান মন ছবি
তৈরি করে টেলিপোর্ট করতে পারছে না। সেই পূজার পাশাপাশি তিনি তাঁর পূর্বপুরুষ রঘুনাথ কেও
স্মরণ করেছিলেন বিভিন্ন আচারের মাধ্যমে, আশ্চর্যের ব্যাপার হল, তিনিও তাকে স্বপ্নে এসেই বললেন
, “তু ই জাগা মা ব্রহ্মময়ী মহাকালীকে , তারপর সে বেটিকে শান্ত করার দায়িত্ব আমার !” সেই
অদ্ভু ত কিন্তু জীবন্ত স্বপ্নের উপর ভিত্তি করেই একটু আগে তারা নেমেছিলেন অনতিদূরের বগলামুখী
মন্দিরে, সেখান থেকে পুরোহিতের সাথে একান্তে পাঁচ মিনিট কথা বলে কি একটা জানি কাছাতে
গুঁজে নিয়ে এসেছেন পূর্ণ জী । এই হেলিকপ্টার এর পেছনে আরও একটা হেলিকপ্টার আসছে আর্মি
বোঝাই হয়ে, সুনন্দ চৌধুরী আর পূর্ণানন্দের সেই ভক্তের মিলিত শক্তি আর প্রভাবের ফল এটা, পূর্ণ
জীও আপত্তি করেননি, গতবার ধাক্কা খাওয়ার পর এবার সেই শয়তানটা ভালোরকম প্রতিরক্ষাই
নেবে যে কোন আক্রমণের বিরুদ্ধে, এদের সাহায্য লাগবে তাঁর সেই প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা ভেঙ্গে
ভেতরের আসল জায়গাতে যেতে। একটু পরেই দেখা গেল একটা প্রায় দুর্গ মতন বাড়ি, সেটার
আশেপাশে দেখা গেল অগুনতি কালো পোশাক পরা ( যেগুলো আসলে কমব্যাট ড্রেস ) মার্সেনারির
(ভাড়াটে সৈন্য) দল , “ওয়াও !” শিস দিয়ে উঠলেন পূর্ণ জীর পাশে বসে থাকা ভারতীয়
সেনাবাহিনীর মেজর পাণ্ডে “বহত লোগ জমা কর রাখখা হায় আপকে ইয়ে কিডন্যাপার ! কোই
বাত নেহি হাম আর্মি লোগ সব সামহাল লেঙ্গে, পেহেলে হাম ইস লোগোকো সাফ করনে কে বাদ
আপ আন্দার ঘুস যাইয়ে গা, আপকে লিয়ে দস মিনিট ওয়েট করনে কে বাদ হামলোগ আন্দার আ
জাউঙ্গা, ঠিক হ্যাঁয় ?” হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন পূর্ণ জী, দশ মিনিটের ভেতর কিভাবে তিনি কি
করবেন নিজেও জানেন না , এদের জন্য তাঁর করুণাই হচ্ছে, এরা জানেওনা কিসের বিরুদ্ধে লড়তে
যাচ্ছে ।

"ওঁ মহাকালং যজেদব্যং দক্ষিণে ধূমবর্ণকম।

বিভ্রতং দন্ড খটাঙ্গৌ দংস্ট্রাভীমমূখম্ শিশুম্।।

ব্যাঘ্রচর্মাবৃতকটীং তূ ন্দীলং রক্তবাসসম্।

ত্রিনেত্রমূর্ধং কেশঞ্চ মুণ্ডমালা বিভূ ষিতম্।

জটাভার লসচ্চচন্দ্র খন্ডমুগ্রং জলন্নিভম্

ওম মহাকাল .................................হুম ফট!!!

মন্রচ্চারণ চলছে , জেগে উঠেছেন মহাকাল, তাঁর ভাঁটার মত চোখ জ্বলছে, তাঁর মাথাতে আর সারা
গায়ে পেঁচিয়ে থাকা সাপেরা নিচে নেমে উঠানময় ঘুরে বেড়াচ্ছে, পায়ের নিচের শবদেহরা আশেপাশে
খিস খিস করে হাসতে হাসতে তাণ্ডব নৃত্য জুড়েছে, ভীষণদর্শন কালো কুকুরটা গর গড় শব্দে অস্থির
48

ভাবে পায়চারী করছে এদিক ওদিক, জ্যোতির লিঙ্গ থেকে শিব তেজ এসে মহাকালেশ্বরের মূর্তি তে
প্রবিষ্ট হতেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বাজ পড়ল যেন কাছেই কোথাও, ঘন মেঘে ঢেকে গেল
চারদিক, ঘন ঘন বাজের শব্দ হতে লাগলো , তাঁর মধ্যেই মহাকালেশ্বরের গমগমে গলা বেজে
উঠলো, “বলি চড়া !!” “জয় বাবা মহাকালেশ্বর !” বলে আরসানের স্ট্রেচারের দিকে এগোল
এস এস , আগে এটাকে চড়ানো যাক। এই ব্যাটাই গতবার সবাইকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। বজ্র
আঁটুনিতে ধরল আরসান কে এস এস , হিস হিস করে বলল , “বিদায় নিয়ে নে সবার কাছ
থেকে! ” করুন দৃষ্টিতে বাকিদের দিকে তাকাল আরসান, শরীরে মোটেও শক্তি পাচ্ছেনা, চোখ জলে
ভরে এলো তার , এই কি তবে শেষ ? ঠিক তখনই.........বজ্রপাতের শব্দ ছাপিয়ে একটা অন্য
বিস্ফোরণের শব্দ কানে এলো তার, এস এস ঝটকা দিয়ে ঘুরলো কাছে দাঁড়ানো এক ভাড়াটে সৈনিক
এর দিকে , “দেখো ক্যা হুয়া !!”

আর ক্যা হুয়া ! বাইরে তখন কুরুক্ষেত্র বেঁধে গেছে ! ভাড়াটে সৈনিক আর ভারতীয় সেনাবাহিনীর
মাঝে, দুই দল লড়ছে দুই কারণে, ভাড়াটেরা লড়ছে স্রেফ পয়সার জন্য, আর ভারতীয় সেনাবাহিনী
লড়ছে নিজেদের দেশে অনুপ্রবেশকারী দুষ্কৃতি দের শায়েস্তা করার জন্য, স্বভাবতই দ্বিতীয় পক্ষ জান
প্রাণ দিয়েই লড়ছে , তাই একটু পরেই যুদ্ধের পাল্লা তাদের দিকেই ঝুঁ কে গেল। এই হুর যুদ্ধের মাঝে
এক লাল শালু পরা জটাজুটধারী সন্ন্যাসীকে দেখা গেল দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে , স্বভাবতই তাঁর
ধারে কাছে কেউ ঘেঁষছে না, তাঁর হাতে এ কে ফরটিসেভেন বা এই জাতিয় কিছু ই নেই , কিন্তু
দুই পাশে দুই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার যাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে , সাধ করে কে মরতে যাবে
তাঁর কাছাকাছি ? বেশ খানিকটা দূর থেকে মেজর পাণ্ডে রসগোল্লার মত চোখ করে তাকিয়ে
আছেন সেদিকেই, এই লোক তো সারাক্ষণ তাঁর পাশে বসেই এলো, এই বাঘ মামাদের আবার
আমদানী করল কখন !

উঠানে ঢু কেই একটু থমকালেন পূর্ণানন্দ , পূজার সেট আপটা একটু বুঝে নিলেন, একটু দূরে চক্রের
মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মায়া মারীচের দিকে কটমট করে তাকিয়ে ওই দিকেই হাত দেখিয়ে দিলেন
প্রথমে, শয়তানটাকে বিলক্ষণ চিনেছেন তিনি, রামচন্দ্রের সংসারে আগুন লাগিয়ে শান্তি হয়নি,
কলিযুগে এসেছে মরতে ! মা সন্তোষীর বাহন কোন ছাড় দিল না, “উঁ আ উঁ উঁ উঁ ” করে বিকট
হুংকার ছাড়ল একটা , ঝাঁপিয়ে পড়ল দুরাত্মা মারীচের উপর, কামড়ে ধরল আত্মরক্ষা করার জন্য
উঁচু করে রাখা ডান হাতটাই ! এটা শেষ করে বাকি শরীর ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলবে !

বাকি বাঘটা গিয়ে এস এস কে ধাক্কা মেরে বেশ খানিকটা দূরে ফেলে দিল, তারপর এক কামড়ে
খুলে দিল আরসানের হাতের বাঁধন, একে একে তপু, সায়নী আর সুমিত্রাকেও মুক্ত করে দিল। পূর্ণ
জী কি একটা কালো পাতার মত ছুঁ ড়ে দিলেন তপুদের দিকে, “এটা চাবাও সবাই, এক্ষু নি শক্তি
ফিরে পাবে, তোমাদেরকে পূর্ণ শক্তিতে দরকার আমার !” ল্যাগ ব্যাগ করতে করতে আরসান রা
সবাই একটু একটু করে সেই পাতা মুখে দিতেই, সবার মধ্যে যেন শক্তির বিস্ফোরণ ঘটল। সোজা
হয়ে দাঁড়িয়ে ওরা এবার ঘুরে গেল এস এস যেদিকে পড়েছে সেদিকে, কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দেবে
এবার, কত ধানে কত চাল ! ওদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন পূর্ণানন্দ, তিনিও দেখতে চান, তাঁর
উত্তরপুরুষের গায়ে আর হাত লাগায় কে !
49

মহাকালেশ্বরের বাহন সেই ভয়াল দর্শন কুকুরের সাথে তু মুল লড়াই বেঁধে গেল সন্তোষী মায়ের বাহন
সেই বাকি বাঘের, হিস হিস করে ছু টে এলো ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা সাপের দল ! রাক্ষসের বিরাট
থাবার আঘাতে একপাশে ছিটকে পড়ল সেই বাঘ যেটা তার হাতের পর আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত
করছিল গণ্ডারের মত শক্ত চামড়া ! এস এস উঠে দাঁড়ালেন ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে, ভেতরের
ব্রহ্মপিশাচ মুখের আদলে আবার ধরা দিল তাঁর, আবার, আবার, জ্বলন্ত নরকরোটিতে পরিণত হল
তাঁর মাথাটা ! লাল আগুনে বীভৎস সেই চেহারা, দুই হাত জড় করে ছুঁ ড়ে দিল হাজার হাজার
সবুজ বরফের গোলা ! উদ্দেশ্য , ছিন্ন ভিন্ন করে দেবেন শত্রুদের, বলি হবে পরে !

এক পা সামনে এগিয়ে গেলেন পূর্ণানন্দ, দুই হাত একবার ছড়িয়ে দিলেন দুপাশে , আবার ঝট করে
একসাথে করে হাততালির মত শব্দ করলেন একটা, ঠাস ঠাস করে কিসব জানি ফাটল তাঁর
চারপাশে , বাতাস থেকে তৈরি হল একটা কাঁচের শিল্ড , যেটা তাঁকে তো বটেই, পেছনে দাঁড়িয়ে
থাকা তপুদেরও ঢেকে দাঁড়িয়ে গেল ঢালের মত ! সেটা এক জায়াগাতে দাঁড়িয়ে রইল না , এস এস
এর ছুঁ ড়ে দেয়া বরফের গোলাগুলি প্রতিহত তো করলই, সেগুলিকে চু রমার করে এগিয়ে যেতে
লাগলো এস এস দের দিকে ! এস এস একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও সামলে নিল, তাঁর হাতে
দেখা দিল একটা চিকন লাঠি , সেটা এগিয়ে ধরে দাঁড়ালো, কাঁচের ঢালটা সেই লাঠিতে স্পর্শ করা
মাত্র শত চিড় ধরে গেল প্রথমে, তারপর বিকট শব্দে ভেঙ্গে পড়ল হাজার টু করো হয়ে !

একটা বিকট গর্জ নে সবারই পিলে চমকে গেল প্রথমে, খুবই স্বাভাবিক, পশুরাজ এসে পড়েছেন যে ,
তাঁর গর্জ নে পিলে চমকাবে না তো কি ! সুমিত্রার চোখ টকটকে হলুদ হয়ে গেছে, হাঃ হাঃ হাঃ
করে বিকট অট্টহাস্য করে সে দেখিয়ে দিল এস এস এর দিকে, তার সেই মূর্তি দেখে আরসান
ভালোই ভড়কে গেলেও ঠাণ্ডা মাথাতে একটা রাউন্ড সাইড কিক বসিয়ে দিল পেছন থেকে
ইলেকট্রিক স্পার্ক করা ব্যাটন হাতে ছু টে আসা এক মার্সেনারিকে, আরসান দেরকে হত্যা করার
অর্ড ার নেই ওদের উপর। ছিটকে গিয়ে হাত পাঁচেক দূরে পড়ল ব্যাটা ! এবার ছু টে এলো আনাচে
কানাচে থাকা আরও মারসেনারি , এতক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে ছিল ওরা এই সব অতিপ্রাকৃ ত কাণ্ড দেখে,
এখন রক্তমাংসের এই ছেলেকে কাবু করতে চায়! কিন্তু একি ! এই দেখা যায় ছেলেটা সামনেই
দাঁড়িয়ে আছে, এই দেখা যায় দোতলার বারান্দাতে ! ওরা দল বেঁধে সেখানে দৌড়ে যেতেই আবার
দেখা গেল ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে মিটমিটি হাসছে ছেলেটা ! হন্তদন্ত হয়ে ছাদে গিয়ে দেখা গেল
নিচে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসছে অদ্ভু ত ছেলেটা ! রোখ চেপে গেল ওদের,
জগদ্বিখ্যাত বেলজিয়ান মারসেনারিদের এমন অপমান! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা ! আসলে আরসান
কোথায় যেতে হবে তা তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে পরিষ্কার ! সে মজাসে টেলিপোর্ট করে
এদেরকে ছু টিয়ে মারছে ! আধঘণ্টা পর সবাই যখন হেদিয়ে পড়ল, তখন আরসান শুরু করল
অদ্ভু ত কায়দার মার্শাল আর্ট ! কুংফু , কারাতে আর ভারতীয় যোগীদের কনুই আর হাঁটুর সমন্বয়ে
এক অদ্ভু ত ফাইটিং স্টাইল সেটা ! ওকে মারা দূরের কথা , ধারেকাছেও যেতে পারছে না কেউ,
অত্যন্ত লাকি কেউ ওকে খামছে ধরতে পারলে ওদের পরিণতি হচ্ছে আরও ভয়ানক, খামছে ধরার
পরমুহুরতে ওরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছে চারতলা বিল্ডিঙের কার্নিশে ঝু লন্ত অবস্থাতে ! ওদিকে
পশুরাজ বিশাল এক লাফ দিয়েছেন এস এস এর দিকে, মা দুর্গার বাহনকে চট করে কি দিয়ে
প্রতিহত করবে বুঝতে না পেরে এক পাশে লাফিয়ে সরে গেল এস এস, সেই বিশাল চারমণি নখ
দাঁত সহ হলুদ ঝলক গিয়ে পড়ল পেছনে বশংবদের মত দাঁড়িয়ে থাকা রুস্তমের উপর ! সে বেচারা
কিছু দিন আগেই রয়্যাল বেঙ্গল সামলেছে, কিন্তু এ তো স্বয়ং পশুরাজ ! ভয়ে তার পেটের অর্ধেকের
বেশি ভাত চাল হয়ে গেল ! আগে পিস্তল বের করবে নাকি ব্যাটন, এই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে
50

মূল্যবান তিন সেকেন্ড নষ্ট হয়ে গেল তার, ততোক্ষণে উঁচিয়ে রাখা বাম হাত এক কামড়ে বাহুমুল
থেকে ছিঁড়ে নিয়েছেন পশুরাজ, সময় নষ্ট করতে নারাজ তিনি ! ভয়ংকর এক আর্ত নাদ করে
কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে পেছন দিকে ছু ট লাগাল অসম সাহসী (!!) রুস্তম। বেশি দূর যেতে
হলনা, আরেক লাফে গিয়ে এক থাবাতে ঘাড় মটকে দিল ব্যাটার, পাপী জীবনের অবসান ঘটল
ভারতের বিখ্যাত ‘ফ্যানটম কিলার’ এর !

যেসব শবেরা মহাকালেশ্বরের চারপাশে নৃত্য করছিল, তারা এগিয়ে আসছিল এবার, নরমাংসের স্বাদ
পেতে চায় ! লাল টকটকে হয়ে গেছে তপুর দুই চোখ, দুইহাত একত্র করে ছিল সে, এবার হাতের
তালু খুলতেই দেখা গেল সেখানে খেলা করছে আকাশের গায়ে দেখা যাওয়া বজ্রের খুদে সংস্করণ !
“জয় মা বগলামুখী !” বলে হাত ঝটকা দিয়ে ছুঁ ড়ে দিল সেই ভীষণ বজ্র আগুয়ান শবের দলের
দিকে ! সামনের সারি পুড়ে ছাই হয়ে যেতেই আরেক সারির আবির্ভ াব হল সেখানে, আরও ভীষণ
শব্দে বাজ আছড়ে পড়ল তাদের উপরও, এরপর সারির পর সারি তৈরি হতে লাগলো আর অক্লান্ত
তপু ইন্দ্র দেবের মত বজ্রপাত করতে লাগলো তাদের উপর ! এদিকে সায়নীর হাতে সৃষ্টি হয়েছে
লম্বাটে ধরণের একটা বিশাল হলুদ উজ্জ্বল গদা , যেরকমটা দেখা যায় স্বয়ং মা বগলামুখীর হাতে !
সেটা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে গদাম করে বসিয়ে দিল বিকট আকৃ তির মায়া মারীচ রাক্ষসের মাথাতে ,
সে বেচারা মাত্রই বাঘ মামাকে একটা ঝটকা মেরে খানিক দূরে পাঠিয়ে উঠে দাঁড়ানর চেষ্টা করছিল
! সাধারণ অবস্থাতে এই বিকট রাক্ষস মূর্তি দেখে সায়নী হয়ত দাঁত কপাটি লেগে পড়ে যেত, কিন্তু
এখন তার উপর স্বয়ং মা বগলামুখী ভর করেছেন, ভয় ডর কি জিনিস সে জানেনা, পেছন থেকে
ব্যাটন হাতে ছু টে আসছিল কিছু মারসেনারি , বোকাগুলো চোখের সামনেই দেখছে যে এই মেয়েটা
ওই ভয়ংকর রাক্ষসকেও ভয় পাচ্ছে না, কপালে দুঃখ থাকলে যা হয় আরকি ! আশ্চর্য ক্ষিপ্রতাতে
ঠিক যেন শচীণ তেন্দুলকারের দক্ষতায় গদাটা ঘোরালো সায়নী, ধাম করে বিকট একটা শব্দ হল,
আর আক্রমণকারী অবাক হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করল দোতলার বারান্দায় ! অর্ধেক পাঁজর ভেঙ্গে
গেছে , ঠোঁটের কষ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে রক্ত ! ধাম, ধাম করে আরও কয়েকটা শব্দ আর
মারসেনারিদের বিকট আর্ত নাদে ভারী হয়ে উঠলো বাতাস ! স্বয়ং মা দুর্গা যেন নেমে এসেছেন
!! খোলা চু ল উড়ছে বাতাসে, চোখ দুটো ধক ধক জ্বলছে, গদা নিয়ে এবার সায়নী ফিরল মায়া
মারীচ এর দিকে, এর শেষ দেখে ছাড়বে সে !

এস এস ধুলো থেকে তৈরি করা একরাশ আগুনে বালি ছুঁ ড়ল পূর্ণ জীর দিকে, ঠাণ্ডা পানি দিয়ে সে
আগুনে পানি ঢেলে দিলেন তিনি হাতের ইশারাতে ! জিহ্বা থেকে হাতের তালুর মধ্যে দিয়ে বিশাল
এক আগুনের তৈরি ড্রাগন পাঠালেন এস এস, নাচতে নাচতে সেটা এগোল পূর্ণ জীর দিকে , বিশাল
এক জটায়ু বেরল পূর্ণ জীর হাত থেকে ! বিশাল ডানার দুই তিন ঝাপটাতেই কোথায় উড়ে নিভে
গেল সেই ড্রাগন ! আর সময় দিতে রাজী নন পূর্ণ জী, “রটোকেন” ফিসট তৈরি করে, সেটার
মাথাতে বল্লমের মত আলোময় শক্তি শেল জুড়ে দৌড়ে এগলেন এস এস এর দিকে, সেটা দেখে
অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল এস এস এর , প্রাণসংহারী এই মুদ্রা ভালোই চেনা আছে তার, বুকের
মাঝখানে এটা পড়লে আর দেখতে হবে না ! চোখ বন্ধ করে কি একটা মন্ত্র পড়লেন বিড়বিড়
করে আর লাঠি দিয়ে আঘাত করলেন মাটিতে, অবাক হয়ে পূর্ণ জী দেখলেন, তিনি যতই এগোতে
যান, তাঁর পায়ের নিচে মাটি যেন সরে সরে পেছনে চলে যাচ্ছে, তাঁকে সামনে এগোতেই দিচ্ছে না,
এ তো শুধু কামরূপ কামাখ্যাতে হয় শুনেছিলেন তিনি, এখানে এ লোকটা কিভাবে এটা করছে !
এবার নিরুপায় সিদ্ধার্থ সোম এতক্ষণ নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে থাকা মহাকালের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে
উঠলেন , “হে মহাকাল ভৈরব ! রক্ষা কর আমায় !”
51

ভীষণদর্শন মহাকালভৈরব কথা বলে উঠলেন, “এতক্ষণ তোদের ছেলেখেলা দেখছিলাম, সময় হয়েছে
বড়দের হস্তক্ষেপ করার !” তাঁর মূর্তি এবার উঁচু হতে হতে সামিয়ানা ছিঁড়ে ফেরে উপরের দিকে
উঠতেই থাকল, উঠতেই থাকল ! একটা বিশাল শক্তির ঝটকা এলো সেই সাথে , তপু আরসান রা
ছিটকে পড়ল বিভিন্ন দিকে, ব্যাথা পেল ভালভাবেই সবাই , পূর্ণজীও বাদ গেলেন না, ছিটকে পড়ে
ঁ র কোণাতে লেগে কপালে রক্ত বেরিয়ে এলো তাঁর। মহাকাল ভৈরবের সেই ভীষণ মূর্তি এবার
সিড়ি
বিশাল হাতের তালুতে তু লে নিলেন আরসান, তপু, সুমিত্রা আর সায়নীকে , “বলি এবার আমি স্বয়ং
ভক্ষণ করছি !” বলেই যেন সারা আকাশ জুড়ে থাকা তাঁর বিকট শ্বদন্ত সম্বলিত মুখ হাঁ করলেন,
মুখে পুরে নেবেন মানুষ নামের এই খুদে জীব গুলিকে !

কোঁকাতে কোঁকাতে উঠে দাঁড়ালেন পূর্ণানন্দ আগমবাগীশ, কোমরে সযত্নে বগলামুখী মন্দির থেকে
লুকিয়ে আনা ছোট্ট সোনালি খড়গ টা তু লে এনে বিড়বিড় করে কি জানি বললেন, সেটা আশ্চর্য এক
আভাতে জ্বলজ্বল করে উঠলো, বলেই পূর্ণজী আবার হুংকার দিয়ে উঠলেন “জয় মা কালী , জয় মা
করালবদনী ! জয় মা বগলামুখী ! দেখা দাও মা ! দেখা দাও! তোমার সন্তানদের যে ভীষণ
বিপদ মা ! এই ভয়াল মহাকালেশ্বরের হাত থেকে ওদের একমাত্র তু মিই রক্ষা করতে পার মা !
দয়া করে দেখা দাও নাহলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে !”

আকাশে ভীষণ শব্দে বাজ পড়ল, বিশ্ব চরাচর যেন তু মুল ভূ মিকম্পে কেঁ পে উঠলো ! সেই ভু কম্প
বেশ খানিকক্ষণ থাকল, যে বাড়ির উঠানে পূজা হচ্ছিল, সে বাড়িতে বেশ খানিক জায়গাতে ফাটল
ধরে গেল ! তারপর সারা আকাশ ভরে গেল শকুনী, গৃধিনী আর যত মড়াখেকো পাখিতে ! ঝপ
ঝপ করে মাটিতে পড়তে লাগলো বিকট দর্শন, গলায় মুণ্ড মালা ঝোলানো বিকট নারী মূর্তি ! এঁরা
হলেন ডাকিনী যোগিনী ! যুদ্ধ ক্ষেত্রে মৃত সৈনিকদের নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল তাঁদের মাঝে, মহা
ভোজ লেগেছে যে আজ, আশ মিটিয়ে পাপীদের রক্ত পান করা যাবে আজ ! মৃদু হাসি ফু টল পূর্ণ
জীর মুখে, মা তাঁর ডাক শুনেছেন, তিনি আসছেন , এই ডাকিনী যোগিনী তারই প্রমাণ ! একটু
পরেই বিশাল একজোড়া নীলচে পা দেখা গেল প্রথমে, তারপর ধীরে ধীরে প্রকটিত হলেন স্বয়ং
করাল বদনী মা কালী ! বিশাল রক্তলাল জিহ্বা তাঁর, চার হাতের এক হাতে ধরা আছে ভয়াল
দর্শন খড়গ ; সেটা নিয়ে ছু টে গেলেন তিনি করাল দর্শন মহাকালভৈরবের দিকে ! ভয়ংকর গমগমে
কণ্ঠে চিৎকার করে বলে উঠলেন , “আমার ভক্তদের ছেড়ে দে বলছি !” মহাকালভৈরবের বিকট
মূর্তি থমকে গেল, হাত থেকে নামিয়ে রাখল আরসান দের সবাইকে , সায়নী আর সুমিত্রা অজ্ঞান
হয়ে গেছে এই ভীষণ মূর্তি সহ্য করতে না পেরে, আরসান আর তপু চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল,
ইষ্টনাম স্মরণ করছিল এতক্ষণ, পায়ের নিচে মাটি পেয়ে ধপাস করে বসে পড়ল দুজনেই ! অদূরেই
চোখ বুজে বসে ধ্যানে মগ্ন পূর্ণানন্দ আগমবাগীশ, তাঁর পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন , উনি কে ! আরে
, উনি তো চন্দ্র মল্লিক স্বয়ং ! তিনি তাঁর কথা রেখেছেন, তপুর ভয়ংকর বিপদের সময় তার
পাশে দাঁড়াবেন বলেছিলেন তিনি। তিনি হাত নাড়তেই তাঁর পাশে বাতাসের ভেতরেই একটা দরজা
যেন খুলে গেল ! সেখান দিয়ে বেরিয়ে এলেন এক দিব্য কান্তি পুরুষ ! দিব্য জ্যোতিতে ছেয়ে আছে
তাঁর গা, অথচ ছাই ছাড়া কিছু মাখেনই না তিনি শরীরে ! তপুদের দিকে ছেয়ে সস্নেহ একটা হাসি
দিলেন তিনি, তাকালেন মহাকাল ভৈরব আর মহাকালীর রণক্ষেত্রের দিকে ! তাঁর পালা আসবে ,
তবে এখন নয় !
52

“ক্ষরা ! কিন্তু কিন্তু......... তু মি তো বিলুপ্ত হয়ে গেছো ! সৃষ্টির আদিতে সেই প্রবল বিস্ফোরণে
তু মি তো বিলুপ্ত হয়ে গেলে আমার চোখের সামনে , এখন কিভাবে ফিরে এলে ! আমি তো এসেছি
অক্ষরাকে থামাতে আর উল্টে পাল্টে দিতে , এই অর্বাচীন মনুষ্য সন্তানের ডাকে ! কারণ অক্ষরার
সাথে আমার অনেক পুরানো বিরোধ, ও বয়ে যায় খালি, আর আমার প্রধান খাদ্য যে সময়,
তাকেও বইয়ে নিয়ে যায়! ছিটেফোঁটা যা পড়ে থাকে তা মহা বিস্তীর্ণ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষণিক কণা
মাত্র ! তাই দিয়ে কি অস্তিত্ব রক্ষা করা যায় বল ! কিন্তু তু মি, তোমার সাথে আমার তো কোন
বিরোধ নেই ! আমি তো সময়কে উল্টে পাল্টে দিয়ে আরেকটা মহাপ্রলয়ের সুচনা করতে চাই ! ”
খল মহাকালভৈরব কথা বলছে আর চার হাতের এক হাতে ধরা ত্রিশূলে শক্তি জমা করছে, জানে
মহাকালীর সাথে যুদ্ধে জেতার কোন সম্ভাবনা নেই, তবু চেষ্টা করতে দোষ কি ! এত হাজার বছর
পরে কি একটু ও শক্তি হ্রাস পায়নি অক্ষরার ! ওদিকে চমকে উঠেছে সিদ্ধার্থ সোম, এ তো মহা খল
দেখা যাচ্ছে, তিনি ভেবেছিলেন তিনিই এঁকে ব্যাবহার করছেন, কিন্তু প্রকারান্তরে এই তো এস এস
কে ইউজ করেছে দেখা যায় ! হা হতোস্মি !!

হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ করে বিকট অট্টহাস্য করে উঠলেন মহাকালী ! “রে পামর ! তু ই শিবের অবতার
আর এটা জানিস না, যে ক্ষরা, অক্ষরা, কালী এঁরা সব একই শক্তির ভিন্ন ভিন্ন রুপ মাত্র! ক্ষরা
বিলুপ্ত হননি বিস্ফোরণে, ছড়িয়ে গিয়েছিলেন মাত্র, শত সহস্র টু করো হয়ে মহাবিশ্বের আনাচে কানাচে
, রাত্রে বেলা যেগুলিকে তারা , নক্ষত্র ইত্যাদি হিসাবে দেখা যায় ! সেগুলি নজর রাখে মহাবিশ্বের
উপর, তবে প্রকৃ ত ভক্তের ডাকে সাড়াও দেয়, দিতে হয় যেমন আজ দিয়েছি, আর তোকে সংহার
করতে এসেছি ! ” বলতে না বলতেই মহাকালেশ্বরের ত্রিশূল ছু টে এলো মহাকালীর দিকে , তিনি
কিছু ই করলেন না , আকাশ থেকে মাটি অবধি একটা হাঁ করলেন কেবল, সেখানে অনায়াসে ঢু কে
গেল প্রবল শক্তিধারী সেই ত্রিশূল ! এরপর মহাকাল ভৈরব ছুঁ ড়লেন অনেক শক্তি বাণ, তু মুল বজ্র,
হাজার হাজার শব দেহ জ্বলন্ত করোটি নিয়ে জ্বালিয়ে দিতে এলো মহাকালীকে, তাঁর কিন্তু নির্বিকার
চিত্তে তাদেরকে মুখগহবরে স্থান দিলেন মহাকালী ! প্রবল বিক্রমে একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে
পড়লেন দুই মহাশক্তি, একজন সময়কে ভক্ষণ করে মহাবিশ্বের সমস্ত হিসাব উল্টে পাল্টে দিতে চান,
এবার খড়গ দিয়ে চারটা কোপ দিলেন মহাকালী, মহাকাল ভৈরবের চারটা হাত কেটে গেল ,
চারদিকে ডাকিনী যোগিনীদের খি খি হাসিতে কান পাতা দায়, এর মাঝখানেই বিশাল এক হাত
দিয়ে তু লে নিলেন মহাকাল ভৈরবকে, তাঁর সৃষ্টি বিনাশী সেই করাল মুখে চালান করে দিলেন তাঁকে
! বিশাল এক উদ্গার তু লে রক্তচক্ষু তে এবার তাকালেন সেই বাড়িটার দিকে , যেখানে চোখ বুজে
বসে আছেন পূর্ণানন্দ আগমবাগীশ, পাশে দাঁড়িয়ে আছেন গত হয়ে যাওয়া চন্দ্র মল্লিক হাত জোর
করে , এই ভীষণ দৃশ্য দেখে কাঁপছেন ঠক ঠক করে, পাশে দাঁড়িয়ে আছে রঘুনন্দন ওরফে রঘুনাথ
আগমবাগীশ, হাত জোর করে তাঁকে বলছেন , “শান্ত হও মা ! শান্ত হও, যে পথে নেমে এসেছ,
সেই দিব্বৌঘ পথ ধরেই ফিরে যাও নিজ ধামে ! রক্ষে কর মা করাল বদনী !” যে আজকে থেকে
পঞ্চাশ বছর আগে এক তিব্বতি গুম্ফাতেও দাঁড়িয়ে ছিল! সেখানে তাঁকে বাধ্য হয়ে আহ্বান করেছিল
এই মহাকাল ভৈরবকেই নিধন করার জন্য, কিন্তু সে যে শিবের অবতার, তাঁকে বিলীন করে ফেলা
যায়, কিন্তু তিনি আবার সৃষ্টি হন মহাদেবের জটা থেকে! সেই তিব্বতি গুম্ফাতেও আরেক বোকা
মনুষ্য সন্তানই সময় কে নিয়ন্ত্রণ করার মানসে ডেকে এনেছিল মহাকালভৈরবকে। এখন এসেছে তাঁকে
শান্ত করে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে, দশ মহাবিদ্যার একজন , বগলামুখীর মাধ্যমে তাঁকে ডেকে এনেছে
পূর্ণানন্দ আগম বাগীশ, সাথে আহবাণ করেছে রঘুনাথ কেও, কারণ সে জানে, এই প্যানডোরার বাক্স
সে শুধু খুলতেই পারবে, বাঁধতে পারবেন একমাত্র রঘুনন্দন আগমবাগীশ, বামা ক্ষ্যাপার পরে যে
53

তাঁর একমাত্র প্রিয় সন্তান , এঁর শান্ত হবার প্রার্থনা তিনি ফেলতে পারবেন না, নচেৎ যে সমূহ
বিপদ ! মহাকালেশ্বর ওরফে মহাকালভৈরব তো কেবল সময় খাবে, কিন্তু তিনি যে পুরো
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই খেয়ে ফেলবেন ! ধীরে ধীর তিনি ফিরে চললেন দিব্বৌঘ পথের দিকে, সেটা দিয়েই
মিলিয়ে গেলেন মহাশূন্যের নিজস্ব ধামের পথে ! তাঁর পিছু পিছু চলল ডাকিনী যোগিনীর বিশাল
বহর ! আকাশ থেকে শকুনি , গৃধিনী ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল!

সিদ্ধার্থ সোম দেখলেন আর উপায় নেই , পরাজিত ও বিধ্বস্ত তিনি হাতের লাঠিটা মাটিতে সজোরে
আঘাত করে বিজাতীয় ভাষাতে কি জানি বলে উঠলেন ! সাথে সাথে মাটিতে বিশাল এক সবুজ
বৃত্ত তৈরি হল, তার ভেতরে একটা পেনটাগ্রাম ! সেখানে পা রেখে আরসান , তপুদের আর
পূর্ণানন্দের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “আমি আবার আসব !” এদিকেই ছু টে আসছিল
তপুরা, এমনকি একটা বজ্রও ছুঁ ড়ে দিয়েছিল, কিন্ত ততোক্ষণে সবুজ বৃত্তের ভেতরে শূন্যে মিলিয়ে
গেছেন প্রফেসর সোম !

পরিশিষ্ট
আধভাঙ্গা জিমনেশিয়ামে বসে আছে সবাই, সবাই মানে সবাইই, আরসান, তপু, সুমিত্রা , সায়নী
আর ওদের বাবা, মা , দিম্মা সবাই ! সুনন্দ বাবু কথা দিয়েছেন জিমনেশিয়ামের প্রতিটা কোণা
তিনি আবার নতু ন করে দেবেন, সেখানেই পূর্ণানন্দের থাকার ব্যাবস্থা করে দেবেন তিনি যেহেতু ঘরে
থাকতে রাজিই হচ্ছেন না ! নির্লিপ্ত হেসে তিনি বলেছেন , “আমি সন্নিসি মানুষ, সংসারে আমাকে
মানাবে না সুনন্দ বাবু, তবে এই যে দেখছেন , এই ছেলেমেয়েগুলি কিন্তু একেকটা রত্ন, এদেরকে
দেখে রাখবেন, কেউ যাতে বিপথে না যায় ! আর তোমরা ” ছেলে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে
বললেন , “তোমাদের বিপদ কিন্তু এখনও কাটেনি, সিদ্ধার্থ সোম এখন আহত বাঘের চেয়েও
ভয়ংকর ! তোমাদের সবাইকে গলাতে যে ছোট্ট কবচ গুলি দিয়েছি সেগুলি কখনও কাছ ছাড়া
কোরোনা , আর সেগুলি স্পর্শ করে বগলামুখীর মন্ত্র পড়লেই সব দিপদ কেটে যাবে ! ” সবার
অনেক অনুরোধ , তপুর অনেক কান্নাকাটি উপেক্ষা করে ঝোলাটা কাঁধে তু ললেন পূর্ণানন্দ
আগমবাগীশ, ঠিক হয়েছে , পাঁচ বছর পরপর তপুকে দেখতে আসবেন যতদিন বেঁচে থাকবেন,
বিপদে পড়লে যে কোন সময় ! হাত ছানি দিয়ে ছেলেমেয়েগুলিকে ডাকলেন তিনি , গেটের কাছে
দাঁড়িয়ে প্রত্যেককে আলিঙ্গন করলেন পরম স্নেহে , ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাবারা, মায়েরা ,
একটা জিনিস সারা জীবন মনে রাখবে, তোমরা এই যে এত ভয়ংকর বিপদ থেকে বেঁচে ফিরতে
পেরেছ তা কিন্তু তোমাদের পরস্পরের প্রতি গভীর ভালবাসা থেকে, আমিও তপুকে রক্ষা করতে এসে
তোমাদের সবাইকে ভালবেসে ফেলেছি, সেই ভালবাসাই তোমাদের রক্ষা করেছে, আরও মনে রাখবে
তন্ত্র মন্ত্র কিসসু না ! ভালবাসাই হল সবচেয়ে বড় যাদু, সবচেয়ে বড় তন্ত্র !!! ভাল থেকো সবাই
!” গেটে দাঁড়িয়ে তাঁর অপসৃয়মাণ ছায়ার দিকে সজল চোখে তাকিয়ে রইল আরসান, তপু, সুমিত্রা,
সায়নী। এখন তাদের অনেক খারাপ লাগছে বটে মানুষটার জন্য, কিন্তু সময় সব কিছু ভু লিয়ে দেবে
একসময় ! !!!

!!!সময় ! তু মি বৃদ্ধ যাযাবর !!!

You might also like