You are on page 1of 308

1

কনস্টেনটিন
মুভি নভেলাইজেশনঃ জন শার্লি
ওয়ার্নার ব্রোস এর ছায়াছবি অবলম্বনে

অনুবাদঃ অরূপ ঘোষ


2

ঃ উৎসর্গ ঃ

দান দান তিন দান। এটা আমার তিন নাম্বার বই। আগেও বলেছি, তিন সংখ্যাটি অত্যন্ত রহস্যময়
একটি সংখ্যা। তবে, যাকে এই বইটি উৎসর্গ করতে চাই, তিনি রহস্যময় কেউ নন, অত্যন্ত
সাদাসিধে একজন মানুষ। হ্যাঁ, এবারের বইটি আমি উৎসর্গ করতে চাই আমার সহধর্মিণী সুমি
চৌধুরীকে। যিনি আমার লেখালেখির সময়ে আমাকে কল্পলোকে বিচরণ করতে দেন, সকল
খামখেয়ালিপনা সহ্য করে, নীরব সমর্থন দিয়ে যান সবসময়। বাচ্চাদের দুরন্তপনা আর সংসার ,
দুটোই চমৎকারভাবে সামলে নেন ।
3

এক

“ঠিক যখন পৃথিবী এটা আশা করছে না, যখনই আমরা আমাদের সম্বন্ধে পুরোপুরি নিশ্চিত – ঠিক
তখনই পুরানো দেবতারা ফিরে আসবেন আর আমাদের শহরগুলোকে ঝেঁটিয়ে----

সোজা নরকে নিয়ে ফেলবেন !”

--- ব্লু অলিস্তার কাল্ট, ‘দ্যা ওল্ড গডস রিটার্ন’ ফ্রম কার্স অব দ্যা হিডেন মিরর ।

---------------------------------------------------------------------------------------------------

সনোরান মরুভু মি – মেক্সিকো...

শয়তানটা মাথা তু লল, ‘হিসস’ করে একটু শব্দ তু ললো ফ্রান্সিস্কোর দিকে তাকিয়ে, বালিতে
আবার মাথা গোঁজার আগে। এটা স্রেফ একটা ‘বালি শয়তান’ ছিলো, মরু বাতাসের একটা ছোট্ট
ঘূর্ণি । কিন্তু ফ্রান্সিস্কোর কাছে , মরুভু মির জনবসতিবিহীন অঞ্চলগুলো ছিলো অদৃশ্য বাসিন্দাদের
আবাসস্থল। আর ‘বালি শয়তান’ হলো সেটারই লক্ষণ।

সে বিড়বিড় করে ‘হোলি মাদার’ এর উদ্দেশ্যে একটা প্রার্থনা বাক্য উচ্চারণ করলো । তারপর
ফিরলো সামনের আস্তাকু ড় এর দিকে, জায়গাটা চিহুয়াহুয়া থেকে বেশী দূরে না। এখানে, ময়লার
ডিপোর ফাঁকে ফাঁকে ডজনখানেকের মতো ময়লা-আহরণকারী লোকজন অলস পায়ে ঘোরাফেরা
করছে। ওপরে, মেঘাচ্ছন্ন বিকেলের আকাশ। ওঁরা হল ‘ধাঙ্গড়’ , ফ্রান্সিস্কোর মতোই , গরীবস্য
গরীব। ঝুঁকে আছে সামনের স্তূ পীকৃ ত বিশাল ময়লার ঢিবির ওপর, আহরণ করছে আপাত দৃষ্টিতে
কাজে লাগে এরকম সব জিনিস । উত্তরের ওঁরা আহরণ করে স্ট্রবেরী, আর এরা খুঁজছে বিক্রি
করা যায় এরকম কাপড়চোপড়, জুতা, তামার টু করো, ব্যাটারি , এমনকি খাওয়া যায় এ ধরণের
খাবারের টু করোও !
4

পুরো পরিবার। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ময়লার স্তূ পের ভেতরে খুঁড়ে যাচ্ছে, ইঁদুর , কাক আর
কখনও কখনও টার্কি শকু নের সাথে পাল্লা দিয়ে । এই বাচ্চারা কখনও কখনও অসুস্থ হয়ে পড়ে,
এসব ময়লার ভেতরে থাকা নানান জিনিসের সংস্পর্শে এসে। পুরানো কম্পিউটার এর ভেতরের
বিষ, জমে থাকা রাসায়নিক, সিরিঞ্জ, দূষিত খাবার ইত্যাদি। এটা খুবই বিপজ্জনক কাজ, কিন্তু
আপনি জানেন না , সেখান থেকে হয়তো অনেক দামী কিছু বেরিয়ে পড়তে পারে............

একবার, ফ্রান্সিস্কো একটা পুরানো মানিব্যাগের ভেতর কিছু টাকা খুঁজে পেয়েছিলো। এক বিকেলে
হেরোইন খাবার জন্য যথেষ্ট টাকা ছিল সেটা। এই পার্সের কথা মনে পড়ে যাওয়ায়, সামনের দিকে
ঝুঁকে একটা স্টাইরোফর্ম কু লারের ভেতর সন্তর্পণে হাত চালাল সে। গত মাসে, এরকম একটা
কু লারের ভেতর থেকে এক ঝাঁক বোলতা বের হয়ে ওকে এমন কামড় দিয়েছিল যে, ও এক
সপ্তাহের মতো অসুস্থ ছিল। কিন্তু তবুও............

কু লারটা খালিই ছিল, কেবল কয়েকটা মরা মাছি বাদে।

একটা শ্বাস ফেললো ফ্রান্সিস্কো । সেদিন একজোড়া ছেঁ ড়াখোঁড়া টেনিস শু ছাড়া আর কিছু
কপালে জোটেনি ওর। সেগুলো বিক্রি করতে পারবে কিনা, সে ব্যপারে ওর যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
আস্তাকু ড়টা প্রায় পুরোটাই ঘাঁটা শেষ ।

হেরোইনের কথা মনে করে একটু কেঁ পে উঠলো সে। এই অভ্যাস ধরে রাখার পক্ষে ও অনেকখানি
গরীব, নেশাটাও অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। কিন্তু সে কেবল আরও একটু খানি নেবার কথাই
কেবল ভাবতে পারলো। রক্তে হেরোইন ছড়িয়ে পড়ার সেই অনুভূ তি, ব্যথা থেকে মুক্তি, যতক্ষণ
নেশা থাকে রক্তে।

এই জীবন থেকে মুক্তি পাবার একটা পথ অবশ্যই আছে। মা মারা যাবার, আর বাপ ছেড়ে যাবার
পর, সে তার জানা সব কিছুই করার চেষ্টা করেছে। ১২ বছর বয়সে সেটা ঘটেছিলো। ‘চাপেরো’ তে
সে অনেকদিন যাবত আছে, কিন্তু হোমোসেক্সুয়াল’দের মাগী’তে পরিণত হয় নি কখনও, সে
ওরকম না !
5

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, সে টেনিস শু জোড়ার দিকে তাকাল। বাম হাতে ঝু লছে ওগুলো। অকেজো,
ধূসর হয়ে যাওয়া, অনেকগুলি ছিদ্র অলা। এমনকি ওর নিজের অনেকগুলি টেপ মারা কাউবয়
বুটের সাথেও বদল করা যাবে না। ও জুতাগুলি একদিকে ছুঁ ড়ে ফেলে দিয়ে বিড়বিড় করলো
“আমার কাছে একটা বালের পেসোও নেই !” ও কিছুই পায়নি, আর কাছে একটা ফু টো পয়সাও
নেই !

“ওয়ে, ফ্রান্সিস্কো ! মি হিজো , কোয়ে পেদো ? ” (ও ফ্রানসিস্কো, ছোট্ট ছেলে ,কি হয়েছে ? ) হেঁকে
বললো হারভ। সে হল একজন হোঁৎকা, ধুলি ধূসরিত , প্রায় দাঁতবিহীন বয়স্ক লোক। হয়তো সে
তেমন বয়স্ক নয়, কিন্তু ওর চু লগুলো খাবলা খাবলা, চামড়া টকটকে লাল হয়ে থাকে সবসময়
অন্যান্য ধাঙ্গড়দের মতোই সারাদিন বাইরে বাইরে রোদের মধ্যে থাকার কারণে। ওর আঠা শোঁকার
বদ অভ্যাসও আছে একটা। সে হয়তো ফ্রান্সিস্কোর চাইতে বেশী একটা বয়স্ক না, কিন্তু সে বুড়ো
লোকদের মতোই আচরণ করে। একটা জোঁক ছাড়া আর কিছু না ।

“আমি তোমার ছোট্ট ছেলে নই , হারভ ! আর সেই মাদকের খবর কি , যেটা তু মি আমাকে দেবে
বলেছিলে তোমায় রেডিওটা দেয়ার পর ? ” ফ্রান্সিস্কো স্প্যানিশে জিজ্ঞেস করলো।

“আসছে ওটা , মাই বয় ! হেই, ঐ পুরানো চার্চ টা দেখেছো ওদিকে ? ”

“চার্চ ?” ফ্রান্সিস্কো চোখ কুঁ চকে , দূরের ধুলোময় দিগন্তের দিকে তাকালো। সে আকাশের গায়ে ঝু লে
থাকা একটা ক্রস দেখতে পেলো কেবল, আর কিস্যু না ! সম্ভবত আধ কিলোমিটার , বা আরও
দূরে হবে। “যেখানে চার্চ ছিলো, সেখানে এখন একটা গর্ত ছাড়া আর কিছুই নেই !”

“আমি শুনেছি একটা লোক ওটার কথা জিজ্ঞেস করছিলো – গ্রামে গিয়ে জিজ্ঞেস করছিলো যে ,
কে জমিটার মালিক । বলছিলো কি রকমের জানি প্রোফেসর, ইতিহাস না কিসের যেন। সে মনে
করে ওখানে কিছু একটা খুঁজে পাওয়া যাবে ! আমরা যদি ওখানে যেতে পারে উনি সেটা কিনে
নেয়ার আগে.........”
6

ফ্রান্সিস্কো উৎসাহী হয়ে উঠলো, সেই সাথে সন্দিহান “তু মি আমাকে ওসব জিজ্ঞাসা করছ কেন ?
তু মি যদি সত্যিই মনে করো সেখানে কিছু আছে...... ” হারভের একদম কাছে চলে এলো
ফ্রান্সিস্কো। অন্য কেউ যাতে শুনতে না পায় সেরকম নিচু স্বরে বলল “তু মি একা যাচ্ছ না কেন ?”

“ওহ—কারণ , ঐ যে তু মি বললে, আমি তোমার কাছে ঋণী !” দেঁতো হাসি ফোটাল মুখে হারভ ।

হারভ উদাসভাবে আকাশের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস্কো গোমড়া মুখে ভাবতে লাগলো , হারভ
মোটেই ঋণ শোধ করার কথা ভাবছে না ! এর একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে – হারভ ঐ জায়গাটাকে
ভয় পায় ! সে যথেষ্ট কু সংস্কারাচ্ছন্ন, ফ্রান্সিস্কোর চাইতেও অনেকগুণ বেশী ।

“তু মি কিছু একটা নিয়ে ভয় পাচ্ছ, হারভ । ঐ জায়গাটা অভিশপ্ত না ? ” বললো সে।

হারভ কাঁধ ঝাঁকালো “কেউ কেউ বলে, আমি না । যেমন বলেছি, তু মি আমার ছেলের মতো।
আমি শেয়ার করতে চাই ......”

“পথ দেখাও , আমার মা !” নাক দিয়ে একটা শব্দ করলো ফ্রান্সিস্কো , তারপর ইঙ্গিত করলো চার্চ
যেদিকে , সেদিকে !

হারভ জঞ্জালের স্তূ পের ভেতর দিয়ে পথ দেখাল। একটা মরচে ধরা ফ্রিজের ওপর দিয়ে, একটা
পচে যাওয়া সোফাসেট ঘুরে, একটা কাক’কে লাথি মেরে , যেটা কিনা একটা রক্তমাখা পুঁটলি
ঠোকরাচ্ছিল।

ফ্রান্সিকোর মনে হল পুঁটলি’টার ভেতর একটা ছোট্ট হাত দেখতে পেয়েছে সে ! সে মাথা ঝাঁকিয়ে
সামনে তাকাল, অনেকদূর হাঁটতে হবে , চার্চ পর্যন্ত যেতে গেলে।

------

গোধূলি নেমে এসেছে, ধাঙ্গড় দুজন যতক্ষণে চার্চে র কাছে পৌঁছেছে, ততোক্ষণে বেশ বাতাসও
বইতে শুরু করেছে। চার্চ টার দেয়ালের খানিকটা দাঁড়িয়ে আছে কেবল, ঝুঁকে আছে জায়গায়,
7

ছাদের কিছু কিছু জায়গা ঠেস দিয়ে রেখেছে কেবল। কিছু কিছু দেয়াল ভেঙ্গে চূ র্ণ বিচূ র্ণ হয়ে গেছে।
দরজাগুলো অনেক আগেই খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চার্চে র ভেতরেই বেশ কয়েক জায়গায়
বালির ঢিবি তৈরি হয়ে আছে ।

দরজার বাইরে, স্তূ পাকৃ তিতে ময়লা জমে আছে। কোন এক সময়ে , এই চার্চ কেও ময়ালার
আস্তাকু ড় হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে ! এটা পবিত্রতার অসম্মান , তাই না ? তাতে কিই বা এসে
যায় ! ঈশ্বর যদি মেক্সিকোর এই অংশে কখনও এসেও থাকেন – ফ্রান্সিস্কো ভাবলো—তিনি চলে
গেছেন !

“হেই- এখানে খানিক জিনিসপত্র স্তূ প করা আছে , যেগুলিতে মনে হয় কেউ হাত দেয়নি !” হারভ
বললো। তারপর বৃষ্টিতে পচে যাওয়া একগাদা কাপড়ের একটা স্তূ পের ওপর ঝুঁকে পড়লো সে।
“ওয়ে ! এখানে হেবি গন্ধ ! আরে, এখানে সুন্দর একটা হাফপ্যান্ট আছে, বেশী একটা ময়লা লেগে
নেই ! ”

ফ্রান্সিস্কো চার্চে র আরও ভেতরের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলো, যেখানে কড়িবরগার ওপর ছাদটা
কোনভাবে টিকে ছিলো। ভেতরের অন্ধকারের সাথে নিজের চোখ সইয়ে নিচ্ছিল। মেঝেটা ঢেকে
ছিলো আবর্জ নাতে আর উড়ে আসা বালিতে। বেশীরভাগ আবর্জ নাই মূল্যহীন, সেটা একনজর
দেখেই বুঝে গেছিলো সে। একটা পুরানো, ভাঙ্গা ক্রস দেয়ালে হেলান দেয়ানো ছিলো, বালিতে
অর্ধেক বসে গেছে সেটা।

কিন্তু – ওখানে ওটা কি ! আলো লেগে কি একটা চকচক করে উঠলো না ? সম্ভবত একটা
জপমালা বা ঐ জাতীয় কিছু হবে, যেটা হয়তো বিক্রি করা যাবে ! ওটা রূপারও হতে পারে ।

ফ্রান্সিস্কো আরেক পা এগোলো , আর থেমে গেলো । যেন কোন খুব ঠাণ্ডা একটা জায়াগায় এসে
পড়েছে সে ! ওর মুখের ভেতরটা শুকিয়ে গেলো , ঠোঁট ভিজিয়ে সে ডাক দিলো “হারভ , একটু
এদিকে আসবে ?”
8

“হ্যাঁ, হ্যাঁ আসছি ! এখানে খানিকটা তামা পেয়েছি .........”

ফ্রান্সিস্কো বুড়োর গলা শুনেই বুঝতে পারলো ব্যাটা অজুহাত তৈরি করছে। হারভ ভেতরে আসতে
চায় না ! সে এই জায়গা সম্বন্ধে কিছু একটা শুনে থাকবে ।

সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো “ঘোড়ার ডিম আছে এখানে !” সে চার্চে র আরও
ভেতরের দিকে এগোল। ওর মনে হল , বাতাস যেন ওকে সামনে এগোতে বাঁধা দিচ্ছে, যেন ওকে
সাবধান করছে ।

ঐ চকচকে জিনিসটা কি ? সে ওটা হারিয়ে ফেলেছে।

কড়কড় করে শব্দ হল পায়ের নিচে, ওর বুট কিছু একটার ভেতর ঢু কে গেছে। সে পা’টা বের করে
ঝুঁকল দেখার জন্য। একটা পুরানো ক্রেটের পচা কাঠের ভেতরে পা ঢু কে গেছিলো। দেখে মনে হল
মেঝের টাইলসের ভেতরে ছিল ওটা , কেউ বা কারা ওটাকে খুঁড়ে তু লেছে সম্প্রতি। কিন্তু ওরা
ক্রেট’টা ছোঁয়নি। কেন ?

ও আরেকটু ঝুঁকে এলো, জবাবে বাতাসে একটা শব্দ কম্পন তু ললো। যেন লাখখানেক
পোকামাকড় কাঠ চিবোচ্ছে আর ওদের পাখা নাড়ছে। সে কল্পনা করলো , কিভাবে গুবরে পোকা
আর শূককীটেরা কফিনের ভেতর মানুষের হাড় চিবোয়। সেই শব্দটাই যেন হাজার গুণে বেড়ে গিয়ে
ভেসে এলো বাতাসে।

কিন্তু শব্দটা ওর কানে ধরা পড়ছে না --- ওটা ওর মনের ভেতর ভেসে আসছে !

এটা ভয়ের কারণে হচ্ছে – ও সিদ্ধান্তে এলো। হারভ ওর ভেতরের কু সংস্কার জাগিয়ে তু লেছে ।

উপেক্ষা করো , ফ্রান্সিস্কো । ঐ ক্রেটের ভেতর কিছু একটা আছে – সম্ভবত ঐ প্রোফেসর যা
খুঁজছিল , সেটাই হবে ।

এই পরামর্শটা ওর মাথায় একটা স্বরের মতো আঘাত করলো। এমনকি ওর নাম ধরেই এলো সেটা
!
9

ও ওর মাথা নাড়ল। অবাক হয়ে গেলো, ওর কল্পনা কিভাবে এতো জীবন্ত হয়ে পড়লো !

শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে, ও ক্রেটের ভেতরে হাত চালালো । আশা করছে, ইঁদুরের তীক্ষ্ণধার দাঁতের
কামড় খাবে ! যেটা ময়লার ডিপোর ভেতর ও সবসময়ই খেয়ে অভ্যস্ত।

ও ক্রেটের যত ভেতরে গেলো, সেই চিবানোর শব্দটা বেড়ে যেতে লাগলো। চড়া থেকে চড়ায়
উঠছে শব্দটা।

ক্রেটটা প্রথমে খালিই লাগলো। কিন্তু এরপর ওর হাত ঠেকল শক্ত কিছুতে, কাপড় দিয়ে মোড়ানো
আছে সেটা। সেই বস্তুটি থেকে একটা অদ্ভু ত অনুভূ তি এসে কাঁপিয়ে দিলো ওকে। সেই অনুভূ তি ,
যেটা হেসে, গর্জে উঠে ওকে দুই পায়ের ওপর খাড়া দাঁড় করিয়ে দিলো !

ও আস্তে আস্তে জিনিসটা বের করে আনলো। সোজা করে ধরলো আলোর বিপরীতে। কাপড়টা
হয়তো কোন পতাকার ছেঁ ড়া অংশ। এটা কি সেই ক্রু র ক্রসটা না, যেটা জার্মানরা সেই বড় যুদ্ধে
ব্যবহার করেছিলো ? যারা কিনা ইহুদীদের ঘেন্না করতো ?

হাত কাঁপছে, তবু সে জিনিসটা অনাবৃত করলো পতাকার ওপরে রেখেই।

কাপড়ের ভেতর, ছিল একটা তিনকোণা লোহার স্পাইক। জং ধরে বাদামী হয়ে গেছে, ওটার গায়ে
খোদাই করা লেখাগুলো পড়া যাচ্ছে না। কোন একটা অদ্ভু ত ভাষা, বা সিম্বল হবে। ওটার ডগা
মোটেই তীক্ষ্ণ ছিল না, কিন্তু ঐ স্পাইকটার কিছু একটা ব্যপার ছিলো। ওটা দেখতে একটা দাঁতের
মতো দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো , ওটা যেন খুন করতে পারে, এর আগে করেছেও !

ও কাপড়টা ফেলে দিয়ে , লোহার স্পাইকটা হাতে ধরে রইলো। আর , ওর ভেতরে সেই অদ্ভু ত
অনুভূ তিটা যেন দ্বিগুণ হয়ে গেলো। এটা ছিলো সেই উষ্ণ , মজাদার অনুভূ তি , যেটা হয়েছিলো
কিছুদিন আগে। সেটা হয়েছিলো সেই লোকটাকে আঘাত করার সময়, যে কিনা ওকে এমনকি
টাকা না দিয়েই রেপ করতে চেয়েছিল। ফ্রান্সিস্কো লোকটাকে ওর গাড়ির পেছনে রাখা ধাতব
ফ্ল্যাশলাইটটা দিয়ে আঘতের পর আঘাত করেছিলো। ব্যাটা মনে হয় মরেনি, ও ব্যাটার মানিব্যাগ
10

নিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল। কিন্তু কি এক অনুভূ তি ছিলো সেটা ! লোকটার মাথায় একের পর
আঘাত করার সেই মিষ্টি , মুক্তির অনুভূ তিটা। ঠিক যেন রক্তের ভেতর ঘোড়দৌড় চলছে ! সেই
একই অনুভূ তি, কিন্তু আরও নিগুঢ় । সেটা প্রবাহিত হচ্ছে সেই পুরানো লোহার টু করোটা থেকে,
ওর হাতের ভেতর দিয়ে ওর সারা শরীরে। ওর মেরুদণ্ডে ছড়িয়ে পড়ছে ঠাণ্ডা , বেগুনি আগুনের
মতো ধিকিধিকি করে। কিন্তু .........

কেউ একজন ওকে দেখছে ! হারভ নয় – ছায়ার ভেতর থেকে কেউ।

ফ্রান্সিস্কো পাঁই করে ঘুরলো সেদিকে...... কিন্তু কাউকে দেখলো না । ও হলফ করে বলতে পারবে
ওখানে কেউ একজন ছিল। কিন্তু সেই চার্চে র ধ্বংসাবশেষের ভেতর, সে একাই ছিলো। কিন্তু, তু মি
কি আসলেই কখনও একা ছিলে ?

এখানে আর কিছুই নেই , ফ্রান্সিস্কো । তু মি এর মধ্যেই মহান জিনিসটা পেয়ে গেছো। এই লোহার
জিনিসটা ! এটা মহাশক্তি ! এটাকে এখান থেকে নিয়ে যাও !

ঐ যে, আবারও ওর মাথার ভেতর সেই কণ্ঠটা ! ওটা কি আরেকটা স্বর, নাকি ওর নিজেরই মনের
চিন্তা !

ও আবারও মাথা ঝাঁকালো। আবারও কল্পনা করছে ! কিন্ত এই লোহার স্পাইকটা , এটা তো
সত্যি। একটা বিস্ময়কর পুরাতাত্ত্বিক জিনিস । এটাই নিশ্চয় সেই জিনিসটা যেটা ঐ প্রোফেসর
খুঁজে বেড়াচ্ছে। ও সেই লোকটাকে খুঁজে তার কাছে এটা বিক্রি করতে পারবে। এটাকে হারভের
কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে হবে, দ্রুত।

ও লোহার টু করোটা ওর শার্টে র ভেতর গুঁজে নিলো। সেটাকে নিজের চামড়ার সাথে লাগিয়ে
রাখতে চাইলো, ও জানেনা কেন।

ঘুরে বাইরে বেরিয়ে এলো সে। মরে যাওয়া আলোয়, উদ্দাম বাতাসের ভেতরে।

“ফ্রান্সিস্কো !” হারভ ওর পেছনে কোথাও থেকে ডেকে উঠলো “তু মি কি কিছু খুঁজে পেয়েছ ?”
11

“ফাক ইওর মাদার ! ” ফ্রান্সিস্কো জবাব দিলো, এমনকি পেছন দিকে না ফিরেই ! ওর খুব ভালো
লাগছিলো ! শেষবার নেশায় চু র হয়ে যাবার পর থেকে, ওর এতো ভালো আর কখনও লাগেনি ।
ওর অঙ্গপ্রত্যঙ্গে যেন নতু ন শক্তি খেলা করছে, সামনে অপেক্ষা করছে নতু ন ভাগ্য !

ও চার্চে র কাছ দিয়ে ময়লার ডিপো থেকে বেরিয়ে এলো। রাস্তার গাড়িঘোড়ার শব্দের দিকে এগিয়ে
গেলো। আরেহ ! বাইরে পুরো পৃথিবী পড়ে আছে, আর ও কিনা এখানে ময়লার ভেতর ধুঁকে মরছে
!

হারভ ওর পেছনে কিছু একটা চিৎকার করছে, ও বুঝতে পারলো না কি সেটা।

জাহান্নামে যাক ব্যাটা ! ঐ তো সামনে রাস্তা দেখা যাচ্ছে।

ও সেখানে পা রাখলো। অনুভব করলো , এই ফাটা, গর্ত ভরা , ধূলিধূসরিত রাস্তাই ওকে গৌরবের
দিকে নিয়ে যাবে। ও আর কখনও পেছনে তাকাবে না। ও উত্তরে যাবে, হ্যাঁ , উত্তরে ............

ও সবসময় আমেরিকাতে যেতে চেয়েছে, কিন্তু ঐ কয়োট গুলোকে দেবার মতো টাকা কখনও
জোগাড় করে উঠতে পারেনি।

ও উত্তর দিকে তাকাল, পেছনের বাড়তে থাকা গর্জ নের ব্যাপারে সামান্যই ওয়াকিফহাল। একটা
ট্রাক তীক্ষ্ণ শব্দে ব্রেক কষল, হর্ন বাজাতে বাজাতে ওর একদম কানের পাশ দিয়ে চলে গেলো।

হ্যাঁ, উত্তরের দিকে, ফ্রান্সিস্কো ......... লস অ্যাঞ্জেলসের দিকে...... ওখানেই আছে টাকা । টাকা
আর সুন্দরী রমণী যারা সারাদিন বিকিনি পড়ে থাকে। আর, সবচেয়ে সেরা মাদক, এখানকার মতো
সস্তা নয় ।

নারী আর মাদক, আর শক্তি ।

ঠিক সেই সময় ও শুনতে পেলো তীক্ষ্ণ স্বরে ব্রেক কষার শব্দ , তারপর কারটা ওকে ধাক্কা দিলো ,
ঘণ্টায় ষাট মাইল বেগে......
12

মেনডেজ আর রডরিগেজ, রক্ষী বাহিনীর দুই সদস্য একটা পুরানো ঝরঝরে ইম্পালা
চালাচ্ছিল। ধ্বংসস্তূ পের কাছে গাড়ি থামাল , দুজনেই আশা করছে, কেউ যাতে বেঁচে না থাকে !
কাউকে হাসপাতালে নিতে হলে হয়রানির শেষ থাকবে না । কিন্তু তখন, মেনডেজ চিন্তা করলো ,
বেঁচে যাওয়া লোকটার কাছ থেকে টাকা দাবী করবে এম্বুলেন্স ডাকার বদলে ! অথবা একটা দুইটা
মানিব্যাগও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এই ধ্বংসস্তূ পের ভেতর কিছু বেঁচে আছে কিনা, কে বলবে !
আগুন লাফিয়ে উঠছে, সাথে কালো ফেনিয়ে ওঠা ধোঁয়া নিয়ে।

এটা কি ধরণের কার ছিল ? এটা দাঁড়িয়ে আছে , যেটাকে আঘাত করেছে সেটার সামনেই।
ড্রাইভার, ভেতরে সেদ্ধ হচ্ছে গাড়ির আগুনের ভেতর। কারটা আঘাত করেছে ---

মেনডেজ রডরিগেজের দিকে তাকাল। ও ও কি সেটা দেখেছে ? রডরিগেজ সম্মতিসূচক নড


করলো, একটু দূরে সরে গেছে এর মাঝেই। ওখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে , অক্ষত !
একজন পাতলা চেহারার, সর্বাঙ্গে ময়লা মাখা, গর্তে চোখ ঢু কে যাওয়া লোক। ব্যাটার বয়স বোঝা
যাচ্ছে না, তবে চেহারা দেখে মনে হচ্ছে পাশের ময়লার ডিপো থেকে উঠে এসেছে। কিন্তু , কারটা
ওর চারপাশে পেঁচিয়ে আছে, ঠিক মনে হচ্ছে ও একটা শক্ত স্টিলের থাম !

দৃষ্টিবিভ্রম হবে ! ব্যাটা হয়তো এক্ষু নি এসে ওখানে দাঁড়িয়েছে ।

মেনডেজ ক্রু জার থেকে বেরিয়ে হেঁকে বলল “ওয়ে ! কারের ভেতর কিছু খুঁজে পেলে ? মৃতের
ওপর ডাকাতি করছ নাকি ? ”

ধাঙ্গড়টি ওদের দিকে ফিরে তাকাল, চকচকে , নির্ভীক চোখে।

না না না, এটা তো হতে দেয়া যায় না। একটা স্থানীয় গুণ্ডাকে তো চোখে চোখে তাকানোর সাহস
দেয়া যায় না কিছুতেই।

মেনডেজ ওর বন্দুক বের করলো .........


13

ফ্রান্সিস্কো রক্ষীবাহিনীর দিক থেকে চোখ ফেরাল, তাকালো কারটির ধ্বংসস্তূ পের দিকে। এটা
কি সত্যিই ওকে আঘাত করেছে, আর মোটেই কোন ব্যাথা দিতে পারেনি ? !!

হ্যাঁ , ফ্রান্সিস্কো । তু মি কি শক্তিটা দেখতে পাচ্ছ ? তোমার শক্তিকে উত্তরে নিয়ে যাও !

পুলিশগুলো দাঁত খিচিয়ে কি জানি বলছে ওকে। একজন আবার বন্দুক বের করলো। ওরা ওর
সাথে একটা কু কু রের মতোই আচরণ করতে চলেছে, যেভাবে সবসময় করে থাকে।

কিন্তু এবার নয় !

ঐ হাড় চাবানোর শব্দটা আবার হচ্ছে মাথার ভেতর, এটা ওকে উত্তেজিত করে তু লছে !

আরেকটা জিনিস ওর নজর কাড়ল, ওর কব্জিতে একটা অদ্ভু ত সদ্য আঁকা উল্কি দেখা যাচ্ছে।
একটা ভয়াল দেখতে সিম্বল সেখানে লাল হয়ে জ্বলজ্বল করছে !

পুলিশ দুটো আরও কাছে এগিয়ে এলো।

ফ্রান্সিস্কো খেকিয়ে উঠে লোহার টু করোটা নিয়ে তেড়ে গেলো হতভম্ব রক্ষী বাহিনীর দুই সদস্যের
দিকে। ওঁরা তড়িৎ গতিতে ফায়ার করলো নিজের নিজের সাইড আর্ম থেকে। বুলেটগুলি বিইইং
শব্দ করে আরেকদিকে চলে গেলো ! মনে হল , ফ্রান্সিস্কো কোন জাদুবলে যেন সেগুলোকে ফাঁকি
দিয়ে দিয়েছে !

এরপর , ফ্রান্সিস্কো হামলে পড়লো ওদের ওপর। ওদের মাথাগুলো হাতু রি দিয়ে ডিম ফাটানোর
মতো করে ফেটে গেলো । মাথাবিহীন ধড়গুলো , ছটফট করতে করতে নেতিয়ে পড়লো।

একটা গানের সুর শিস দিতে দিতে , ওদের পকেট হাতাতে লাগলো ফ্রান্সিস্কো। নাহ ! পুলিশের
তু লনায় অনেক কম টাকাকড়ি দেখা যায় ।
14

“ফ্রান্সিস্কো , কি করেছো তু মি ? ” হাইওয়ের পাশ থেকে ডাক দিলো হারভ, চোখগুলো বড় বড় হয়ে
আছে। ও দেখে ফেলেছে পুলিশদেরকে খুন করতে। ফ্রান্সিস্কো ওকে হামলা করলো, মুহূর্তে র মধ্যে
খুন করে ফেললো ওকে।

পালাও , ফ্রান্সিস্কো , পালাও ! আরও অনেকে আসবে , আরও অনেকে ...

ও একবার চাইলো পুলিশদের পেট্রোল কারটার দিকে। কিন্তু ওর মাথার ভেতরের সেই কণ্ঠটা
আবার কথা বলে উঠলো –

ওটাকে ছেড়ে যাও , ফ্রান্সিস্কো , ওটা পুলিশের গাড়ি। তোমাকে প্রশ্ন করা হবে ......

খানিক সময় পর। শহরের প্রান্তে, থমকে দাঁড়ালো সে, দুলকি চালে এগোল রোদে পোড়া , ধূলি
ধূসরিত পথ ধরে। গরীবস্য গরীব এলাকার ভেতর দিয়ে।

এখানে সবাই গরীব না, ঐ যে লোকটা, সবাইকে ধার দেয়। কেবল একটা হ্যান্ডগান ওকে রক্ষা
করে, ওকে মেরে ওর টাকাপয়সা আর কাপড়চোপড় নিয়ে নাও। তারপর উত্তরে যাও, মরুভূ মির
ভেতর দিয়ে পথ খুঁজে পাবে ......

স্বরটা মনে হচ্ছে ওর চারদিকে থেকে, আবার একইসাথে ওর ভেতর থেকেও আসছে। ও দম
নেয়ার জন্য একটু থেমে চারপাশে তাকাল, মনে হচ্ছে আশেপাশে আরও কেউ আছে।

কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না।

ফ্রান্সিস্কো কিন্তু সেই একজনের উপস্থিতি টের পাচ্ছিলো । অদৃশ্য, কিন্তু কেউ না কেউ ওখানে
আছেই।

ব্যাপার না, ফ্রান্সিস্কো। উত্তরে যাও, আমায় বিশ্বাস করো, ঐ লোহার স্পাইকটাকে বিশ্বাস করো ......
এটা তোমাকে কার আর পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। যে কোন কিছুই সম্ভব !

তো, ফ্রান্সিস্কো উত্তরের দিকে যাত্রা শুরু করলো, লস এঞ্জেলসের দিকে।


15

দুই

লস এঞ্জেলস , ক্যালিফোর্নিয়া

ছোট্ট কন্সুয়েলা’র ঠাণ্ডা লেগেছে একটু , এইই তো। ওর মা, দিয়েরদ্রে, ফ্লু মেডিসিনের পাউডার ভরা
মগের ভেতর গরম পানি ঢালতে ঢালতে সেটাই ভাবছিলেন। মেয়েটা যে ওইসব কু ৎসিত
কথাবার্তা বলছে, সেটাও হয়তো জ্বরের ঘোরে বকা প্রলাপই হবে। একই কারণে, ল্যাম্পটাও ছুঁ ড়ে
মেরেছে বেচারী !

দিয়েরদ্রে ওর মেয়েকে অ্যাসপিরিন, খানিক থেরাফ্লু দিয়ে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।
সকালের এই সময়ে ডাক্তারের দেখা পাওয়া খুব মুশকিল। কিন্তু শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ভদ্রলোক ১০
টায় ওকে দেখতে রাজী হয়েছেন। ঠিক হয়ে যাবে কন্সুয়েলা ।

“মা............ মা ম্মা আ আ আ আ আ ...” একটা উচ্চ সুরে কান্না ভেসে এলো। হুম, মেয়েটা
কেবল ৭ বছর বয়সী, প্রলাপ ওকে ভয় পাইয়ে দিতেই পারে। কিন্তু --- মেয়েটার স্বরে এমন একটা
কিছু ছিলো , যেটাতে দিয়েরদ্রে’র হৃদয় যেন মুচড়ে উঠলো !

“আমি আসছি , সোনা। তোমার ওষুধ আছে আমার কাছে .........” ওনার কাজে যাওয়া খুবই
প্রয়োজন। কিন্তু এই অসুস্থ বাচ্চাকে নিয়ে উনি সমস্যায় পড়ে গেছেন। ঐ ব্যাটা ফ্রেডের বাচ্চা যদি
কোন কাজে আসতো ! ওর মনে হল, ওকে মনে হয় আরও একটা সুযোগ দেয়া দরকার ছিলো।
কিন্তু ...... ব্যাটা কু কু রের মতো সব জায়গায় মুখ না দিলে হয়তো ............

নিজের পশ্চিম হলিউডের ছোট্ট ফ্ল্যাটের দুইটা বেডরুমের একটাতে থাকে মেয়ে। সেখানে ঢু কেই,
একটা শক খেয়ে থেমে গেলো।
16

ওঁর ছোট্ট মেয়ে, কন্সুয়েলা, সিলিঙের কাছাকাছি দেয়াল থেকে ঝু লছে। ঠিক পোকামাকড়ের মতো,
অমানুষিক এক সরীসৃপের মতো মাথাটা তাক করা নিচের মেঝের দিকে ! চেহারাটা চাবুকের মতো
ছায়ার ভেতরে আছাড় পিছার খাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে না মোটেও।

আর......... আর ওর গলা থেকে এমন এক আওয়াজ আসছে , যে মনে হচ্ছে যেন হাজার
আত্মাকে বেঁধে কেউ নির্যাতন করছে !

অনেক দূর থেকে যেন ভেসে এলো ট্রে মাটিতে পড়ার আওয়াজ, মগ ভাঙ্গার শব্দ। তারপর সব
শব্দ চাপা পড়ে গেলো দিয়েরদ্রে’র তীক্ষ্ণ হাহাকারের মতো চিৎকারে !

লস এঞ্জেলসের নোংরা সূর্যাস্ত। জ্বলন্ত সূর্যটা ধোঁয়াশার ভেতরে পাটে যেতে বসেছে। একটা
ট্যাক্সি এসে থামলো একটা এপার্ট মেন্ট বিল্ডিঙের সামনে। পশ্চিম আকাশের দিকে তাকালো
কনস্টেনটিন। সেখানে পাম গাছের সারির আড়ালে বিষণ্ণ শেষ বিকেলের আলোয় ডু বে যাচ্ছে
সূর্যটা।

ঐ ধোঁয়াশার মধ্যে কত যে রঙ ! ভাবলো কনস্টেনটিন । বিষ কিভাবে এতো সুন্দর হতে পারে !
একটা মেয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে, যে জানতো আমি একটা ব্যান্ডে আছি। কি যেন নাম ছিলো
মেয়েটার ......

কনস্টেনটিন – লম্বা রোগা এক লোক , পরনে জীর্ণ একটি কালো কোট, নিকোটিনে হলুদ
হয়ে যাওয়া দুই আঙ্গুলের মাঝে একটা শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেট ধরা। ট্যাক্সি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে
চ্যাজ’কে ইশারা করলো অপেক্ষা করতে। চ্যাজ’ও বেরোচ্ছিল। ক্যাজুয়াল হিপ হপ জ্যাকেট
পরনে, হাতে একটা নন হিপ হপ শিল্পকর্ম আঁকড়ে রেখেছে ! ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখা মারটিনিস্ট
সিম্বোলজির বই সেটা। কনস্টেনটিন এর কাছ থেকে অপেক্ষা করার সঙ্কেত পেয়ে , চ্যাজ একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো গাড়ির ওপর।
17

কিছুদিনের মধ্যে, বিল্ডিঙের ভেতরে যেতে যেতে ভাবলো কনস্টেনটিন, চ্যাজকে আমার সাথে
নেবো। শিক্ষানবিশের কি দরকার যদি সে তোমাকে সাহায্যই করতে না পারলো ? কিন্তু, এটা নিয়ে
হয়তো পরে দুঃখ পেতে হবে !

সিগারেটে আরেকটা টান দিলো সে, দেখলো শেষ হয়ে গেছে ওটা। নিচে ফেলে দিয়ে বুট দিয়ে পিষে
দিলো ওটা। এপার্ট মেন্ট বিল্ডিঙের ভেতরে যেতে যেতে কোটের পকেট চাপড়ে আরেকটা সিগারেট
বের করলো সে। একটা ‘লাকি স্ট্রাইক’ ধরালো সে, আধ্যাত্মিক সিম্বোলজি খোদাই করা একটা
লাইটার দিয়ে।

বড় হলঘরে, দাঁড়িয়ে ছিলেন ফাদার হেনেসি। গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারার ঘামতে থাকা এক মাঝবয়সী
লোক তিনি – বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছেন। সারা মুখে লাল শিরা উপশিরা ফু টে আছে , গলায়
পাদ্রীদের সাদা কলার। কনস্টেনটিনকে দেখে নার্ভাস ভঙ্গিতে বললো “আমার মনে হয়......... মনে
হয় আমি তোমার জন্য একটাকে খুঁজে পেয়েছি !”

হেনেসির গলায় এখনও কলারটা আছে, দেখলো কনস্টেনটিন । তাহলে চার্চ ওকে এখনও বিদায়
করে দেয়নি।

“আমি ...... আমি রিহ্যাবে যাচ্ছি , জন। কয়েক মাসের মধ্যেই । ওঁরা আমাকে আরেকটা সুযোগ
দিচ্ছেন। শোন – আমি একটাকে খুঁজে পেয়েছি, এখানে !”

কনস্টেনটিন স্রেফ তাকিয়ে রইলো ওঁর দিকে। বেচারা হেনেসি, বাতিল মাল ।

“শোন, আমি তোমাকে কল করেছি , তাই না ? ” হেনেসি বললো । কাঁপতে থাকা হাত দিয়ে নাকের
ডগা থেকে ঘাম মুছলো “যে মুহূর্তে আমি ওটাকে বের করে আনতে ব্যর্থ হয়েছি, সাথে সাথে
তোমাকে কল করেছি , জন ।”

কনস্টেনটিন ছোট্ট করে মাথা নেড়ে, দরজা দিয়ে এগোলো সিঁড়ির দিকে। পরের তলার ল্যান্ডিং এ,
সে জটলা করতে থাকা ফিসফিস করতে থাকা ছোট্ট একটা ভিড়ের সামনে পড়লো। ওখানে
18

ছিলো মেক্সিকান, কিছু এশিয়ান , অল্প ককেসিয়ান , সবাই সিঁড়িতে বসে থাকা দুইজন মানুষকে
ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলো। একজন সাদা চু লের কালো মহিলা, একজন কৃ শকায় মহিলাকে জড়িয়ে ধরে
বসে ছিলেন। কৃ শকায় মহিলাটির পা খালি, নিজের হাঁটু দুটো জড়িয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে
সে। কাঁধ দুটো কেঁ পে কেঁ পে উঠছে ওপরের এপার্ট মেন্ট থেকে ভেসে আসা প্রতিটা আওয়াজের
সাথে সাথে। তীক্ষ্ণ , মর্মভেদী যন্ত্রনাকাতর আর্ত নাদ ভেসে আসছে ওপর থেকে, সাথে ধুপধাপ
শব্দ। কনস্টেনটিন বুঝলো , ইনিই বাচ্চাটার মা। ওনার জন্য এই মুহূর্তে ওর কিছু করার নেই।

“ওটা ঠিকই আছে...... ” মহিলাদের একজন সান্ত্বনাসূচক সুরে বললো মা’টিকে “ওকে তোমার
বেঁধে রাখতেই হতো !”

ওঁদেরকে পাশ কাটিয়ে এগোলো কনস্টেনটিন, তেড়ছা চোখে সব দেখতে দেখতে এগোলো ওপরের
শব্দগুলোর দিকে। এই বেশী নড়াচড়ায় ওর ফু সফু সের জ্বলন্ত ব্যাথাটা আরও বেড়ে গেলো – যেটা
কখনোই পুরোপুরি দূর হয় না । ও জানে , ওর সিগারেটের আসক্তির মতোই, এটাকেও সারা
জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। ওর জীবনের অনেকগুলো দুর্ভাগ্যের মধ্যে এটাও একটা।

গোল্লায় যাক ! ডাক্তারের কথা মেনে চলার কি কোন প্রয়োজন আদৌ আছে আর ?

এগুলো ভাবতে ভাবতেই , এখানে যেটার জন্য এসেছে, সেই কাজ শুরু করে দিয়েছে সে। বেরিয়ে
এলো ওর দ্বিতীয় সত্ত্বা, অনেকটাই প্রবৃত্তিজাত। এই সত্ত্বাটিকে অসুখ কাবু করতে পারে না, ওর
চারপাশের পরিবেশকে অনুভব করার অভূ তপূর্ব শক্তি লুকিয়ে আছে সেটার মধ্যে। এটা সবার
মধ্যেই আছে, পার্থক্য হল জন কনস্টেনটিন সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মাথার ওপরে, মেঝে
আর দেয়াল ভেদ করে , ঐ রুমের দিকে পাঠিয়ে দিলো সে সেই তরঙ্গ । বেশ ভয়ংকর ধরণের
সাড়া পেয়ে পিছিয়েও এলো সাথে সাথে ! ঐ ‘জিনিস’ টা ওর সেই মানসিক তরঙ্গ ধরতে
পেরেছে, আর সাথে সাথে ঘৃণা ভরে প্রতিরোধ করেছে। তারপর, ওটা সমগ্র মানব সত্ত্বাকেই
প্রতিরোধ করা শুরু করলো , সর্ব শক্তি দিয়ে !
19

কনস্টেনটিন সন্দেহ করলো, ওটা এখনও ওকে চিনতে পারেনি। ওটা জানেনা কার সাথে লড়তে
চলেছে। সে সেই অনুভূ তি অনুসরণ করে সামনে এগোল, দরজাটা আধখোলা দেখা যাচ্ছে।
সেখান দিয়ে ক্রোধের উত্তাপ ভেসে আসছিলো ঢেউয়ের মতো, আগুন লাগা কোন বাড়ি থেকে
বয়ে আসা তাপ তরঙ্গের মতো।

কনস্টেনটিন দরজার নবে হাত রাখলো, আর ভেতরের জিনিসটা ওকে অনুভব করতে পারলো
......

পুরো বিল্ডিং কিছু সময়ের জন্য নীরব হয়ে গেলো। তারপর একইসাথে ‘দুম’, ‘ঝনঝন’ তারপর
ভীষণ এক গজরানির আওয়াজ ভেসে এলো ভেতর থেকে। সেইসাথে গ্লাস ভেঙ্গে পড়ার ঝনঝন
আওয়াজ।

ও এপার্ট মেন্টটাতে ঢু কলো । পৈশাচিক শক্তির ঢেউয়ের মধ্যে পা রাখা মানে, ঠিক যেন একটা
স’না বাথ (গরম বাষ্পে স্নান করার এক রকম পদ্ধতি) এর ভেতর পা রাখা ! কিন্তু, এই শক্তির
প্রকাশের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু একটা ছিলো। এটা ছিলো অনেক বেশী গভীর, পরিষ্কার আর
এটার তরঙ্গ গুলো ছিল ক্রিস্টালের মতো পরিষ্কার আর ধারালো ! আর...... অনেক বেশী
শক্তিশালী।

একটা ভাঙ্গা চেয়ার, চু রমার হয়ে যাওয়া একটা টেলিভিশন সেট ডিঙ্গিয়ে সরু এপার্ট মেন্ট হলওয়ে
ধরে এগোল সে। ওর কাছে মনে হচ্ছিলো , ও একটা অদৃশ্য স্রোত ঠেলে এগোচ্ছে । ওর সমস্ত
সত্ত্বা কুঁ কড়ে গেলো , কারণ একটা নারকীয় দুর্গন্ধ ধাক্কা মারলো ওর নাকে। ঠিক পোড়া মলমুত্র,
সালফার আর পচে যাওয়া রক্তের গন্ধের মতো । ওটা কিন্তু বাতাসে ভাসছিল না, ও মনের ভেতর
সেই গন্ধটা টের পাচ্ছিলো ।

মেয়েটার বেডরুম পুরো একটা ধ্বংসস্তূ পে পরিণত হয়েছে। সবকিছুই টু করো টু করো হয়ে চারপাশে
ছড়িয়ে আছে। বিছানার পাশের দণ্ডগুলো ভেঙ্গে গেছে, একটা খেলনার বক্স টিং টিং করে
আওয়াজ করে যাচ্ছে। খেলার পুতু ল কু টি কু টি করা ছেঁ ড়া, ড্রেসার শতখান করে ভাঙ্গা,
20

কাপড়চোপড় ছিঁ ড়েখুঁড়ে ফেলা হয়েছে। এখানে ওখানে অনেকখানি চাপ চাপ রক্ত । কিছু কিছু ঐ
মেয়েটির, দেয়ালে লাল লাল হাতের ছাপ লেপা দেখে সেটা আন্দাজ করলো কনস্টেনটিন।

বিছানার অবশিষ্টাংশের সাথে বাঁধা আছে মেয়েটি। একটা অরুচিকর খড়খড় শব্দ করে চলেছে মুখ
দিয়ে। যেন কোন কমেডিয়ান ঘেন্নার সাথে নকল করে চলেছে মৃত্যুপথযাত্রী কোন মানুষের শেষ
শব্দগুলো ! বারবার , বারবার , অনেকবার .........

ও কনস্টেনটিনের দিকে ফিরে তাকালো, ওর চেহারা নিজের মধ্যেই পাল্টে পাল্টে গেলো
কয়েকবার !

কনস্টেনটিন অন্য দিকে তাকালো । সে এইমাত্র যা দেখলো, সেগুলি সাধারণত ‘পজেসন’ গুলির
ক্ষেত্রে ওর চোখে পড়ে না কখনও। আর ওর মন বলছে, ওটার দিকে বেশিক্ষণ তাকানো
বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। নিজের ‘মন’ কে পুরোপুরি বিশ্বাস করে কনস্টেনটিন, জানে, এটাকে
কখনও, কখনোই কেন উপেক্ষা করতে নেই !

মেয়েটার ক্ষীণ, ক্ষতবিক্ষত তনুর ভেতরে আশ্রয় নেয়া পিশাচটা একটু চিন্তিত বলে মনে হল। মনে
হল, এটা এখনই কনস্টেনটিনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে – তারপর সেটা ইতস্তত করতে লাগলো ,
সেন্স করতে লাগলো কিছু।

কনস্টেনটিনকে চিনতে পারলো সেটা, জানতে পেরে গেলো, ওর মতো আরও অনেককে এই
লোক নরকে ফেরত পাঠিয়েছে। অন্ধকার আত্মাটা মোচড় খেলো ভয় আর রাগে, তারপর একটা
দমকা বাতাস ছুঁ ড়ে দিলো কনস্টেনটিন এর দিকে। এটা এতোটাই পৈশাচিক শক্তি দিয়ে করা হল যে,
কনস্টেনটিন একটু দুলে উঠে পেছনে চলে আসতে বাধ্য হলো, প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো সে। তারপর,
শক্ত হয়ে দাঁড়ালো কনস্টেনটিন, কোটের আস্তিন গোটাল, যাতে ওর হাতের ট্যাটু গুলো দেখা যায়।
ওর হাতে আঁকা সিগিল (জাদুতে ব্যবহার করা এক ধরণের প্রতীক যা ট্যাটু করে রাখা যায়) যেন
কিলবিল করে উঠলো। এগুলো, ও যে প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছে , সেটারই পূর্বাভাস ঘোষণা করলো।
21

পিশাচটা ট্যাটু র ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। মরণ আঘাত করার জন্য তৈরি করছে নিজেকে।

কনস্টেনটিন ওর ঘড়ির দিকে তাকাল , তারপর হেঁটে হেঁটে গেলো রুমের অন্য প্রান্তে জানালার
কাছে। ইচ্ছা করেই ভয় প্রকাশ করছে না, পেছনেও তাকাচ্ছে না । এটা একইসাথে আধ্যাত্মিক
আর মনস্তাত্ত্বিক একটা চাল। এমনকি পিশাচদেরও মনস্তত্ত্ব থাকে ! কনস্টেনটিনকে ওখানে
আধিপত্য বিস্তার করতেই হতো। পিশাচটা ওটা প্রতিরোধ করবে ঠিক আছে, কিন্তু কনস্টেনটিনের
মনস্তাত্ত্বিক যে সুবিধাটা দরকার ছিলো, সেটা পেয়ে গেছে সে !

দিনের আলো পছন্দ করে না বলে, পিশাচটা জানালার পর্দাগুলোতে হাত দেয়নি, ওগুলো অক্ষতই
আছে, আর বন্ধ করা। কনস্টেনটিন এক টানে পর্দাগুলো সরিয়ে দিলো এক পাশে, রুমটা ভরে
গেলো সূর্যাস্তের হলদেটে আলোয়।

সেই আলো আঘাত করলো মেয়েটির ভেতরের পিশাচটাকে। ওটা সেই অসুস্থ খড়খড় আওয়াজ
করে উঠলো , সেই ভাষাহীন বিড়বিড়ানি উঠে এলো ওর ভেতর থেকে। তারপর, মাথাটা
ভীষণভাবে নাড়তে নাড়তে , গোঙাতে শুরু করলো সে। সেই গোঙানি ক্ষণিকের জন্য একটা ছোট্ট
মেয়ের গলার মতো লাগলো। তারপর আবার সেটা ফিরে গেলো আগের সেই রাগান্বিত
গরগরানিতে।

কনস্টেনটিন ওর হাত প্রসারিত করেই রাখল। আধ্যাত্মিক শক্তি ওর ভেতরে প্রবাহিত হতে দিলো।
একটা খুব মসৃণ শক্তি প্রবাহ যেটাকে হারমেসিটিস্ট’রা (একটা নির্দি ষ্ট ধরণের দার্শনিক ধর্ম এটা)
ডাকে ‘এস্ট্রাল লাইট’ বলে। সে এটা ওপর থেকে , মাথার পেছন দিয়ে মেরুদণ্ড বেয়ে হাতের দিকে
বইয়ে দিলো। তারপর সেই শক্তিকে ঘনীভূ ত করে কনস্টেনটিন সেটাকে ব্যবহার করলো
পিশাচটাকে এক জায়গায় ধরে রাখার কাজে। ও ঐ হাতে বানানো স্ত্র্যাপগুলোকে বিশ্বাস করতে
পারছিলো না। ঐ শক্তিটা ওটাকে যথেষ্ট সময়ের জন্য আটকে রাখতে পারবে।

হাত নামিয়ে, ঠোঁটের সিগারেটের ধোঁয়ায় কিছুটা চোখ কুঁ চকে গায়ের কোটটা খুলে একপাশে
রাখলো। কেসে উঠলো সে, তাতে ওর ঠোঁটের কোণায় খানিক রক্ত দেখা দিলো ! সেটা মুছে
22

সিগারেটে আরেকটা টান দিলো সে। একটা টেবিলের ধ্বংসাবশেষের ওপর ঠেস দিলো সে, পকেট
থেকে বের করলো একটা চাবির চেইন। ওটাতে আটকানো ছিলো ঘরের চাবি, গাড়ির চাবি (যেটা
আইনত এখন আর ও চালাতে পারবে না ), একটা সোয়াইপ কার্ড আর এক সেট অনেককালের
পুরানো ছোট্ট রূপার মেডেল – প্রত্যেকটার গায়ে খোদাই করা আছে বিভিন্ন সাধুদের ছবি।
সেগুলো উল্টাতে উল্টাতে কনস্টেনটিন মরুভূ মির সাধু সেইন্ট অ্যান্থনির কাছে এলো, যিনি কিনা
দাঁড়িয়ে আছেন এক পায়ে আর চেহারা কদাকার । তখন, পিশাচটা , অর্থহীন , ভেজা কণ্ঠে
প্রতিক্রিয়া জানালো।

হুম – পাওয়া গেছে ! কনস্টেনটিন ভাবলো, মেয়েটার বিছানার দিকে এগোতে এগোতে।

হাত থেকে ফিল্ড এনার্জি বের করে আঙ্গুলে জড় করতে করতে , কনস্টেনটিন ওর হাত তু ললো
ওপরে, বিভিন্ন ভঙ্গি করতে লাগলো । রুনিক হরফ আঁকতে লাগলো বাতাসে, যাতে শক্তিটা
ঠিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে।

এবার পিশাচটার উদ্দেশ্যে গর্জে উঠলো সে, যাতে এটার প্রভু – সে যেই হোক , শুনতে পায়ে
কনস্টেনটিন কি বলছে “আমি কনস্টেনটিন। জন কনস্টেনটিন , জারজের বাচ্চা !”

সে মেয়েটার কপালে রূপার মেডেলটিকে চেপে ধরলো। ধাতব মুদ্রাটি লাল টকটকে হয়ে গরম হয়ে
উঠলো , পোড়া চামড়া থেকে ধোঁয়া বেরোতে লাগলো। মেয়েটি, সাথে পিশাচটিও --- খিঁচু নি দিয়ে
কাঁপতে লাগলো।

এই পুরো সময়ে , কনস্টেনটিন সতর্ক ছিলো ও যাতে ভু লেও সরাসরি মেয়েটির মুখের দিকে না
তাকায়। কারণ সেটা ছায়ার ভেতর ক্রমাগত রূপ পালটাচ্ছিল, আর চোখের কোণা দিয়ে তার
খানিক আভাস কনস্টেনটিনও পাচ্ছিলো। যেগুলো কিনা জাগতিক জগতে কারো চোখে পড়া
উচিত নয়।
23

মেয়েটি ভীষণভাবে ঝাঁকু নি দিয়ে উঠলো বিছানার ভেতর, বাঁধনগুলো কব্জি আর পায়ের গোছায়
কেটে বসে গেলো। তারপর ওর চোখ খুলে গেলো, কনস্টেনটিন নিজেকে আবিষ্কার করলো তাকিয়ে
আছে সেদিকেই। পিশাচটা খেকিয়ে উঠলো “ভামোস জুন্তস আ মাতারালা ! – চলো একসাথে
মেয়েটাকে শেষ করে দেই !”

কিচ্ছু না বলে, কনস্টেনটিন এক হাতে মেয়েটিকে চেপে ধরে রাখলো বিছানার সাথে, আরেক হাতে
ধরে থাকলো সেই রূপার চাকতিটা। ওর হাতের নিচে ভীষণভাবে মোচড় খাচ্ছে মেয়েটার দেহ।

তারপর, মেয়েটা একদম নিথর হয়ে গেলো, ঠিক যেন একটা মৃতদেহ ! কোন নড়াচড়া নেই !

“কি হল ?” হতবুদ্ধি হয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করলো কনস্টেনটিন। এটা তো মেয়েটাকে এখনই মেরে
ফেলার কথা না, আরও বেশ কিছুক্ষণ লড়াই করার কথা।

ও ঝুঁকে এলো মেয়েটার চেহারার দিকে, তখনই, হঠাৎ করে কিছু একটা মেয়েটার ঘাড়ের কাছ থেকে
লাফ দিয়ে মাথার দিকে চলে গেলো ! সেখানকার চামড়া এমনভাবে ফু লে উঠলো যেন একটা
মুখমণ্ডল যেন ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে সেদিক দিয়ে ! কামড়ে নিজের পথ করে নিতে
চাইছে ভেতর থেকে।

কনস্টেনটিন পেছনে সরে এলো । কিন্তু পিশাচটা ওর দিকে তেড়ে আসতে চাইলো, বিছানার
ফ্রেমসহ খাটটা শূন্যে তু লে ফেলল প্রচণ্ড শক্তিতে ! চোয়াল অস্বাভাবিকভাবে বাইরে বেরোনো, ঠিক
একটা নেকড়ের মতোই যেন নিজের খাঁচা নাড়িয়ে চলেছে ওটা ! মুখ ব্যাদান করে নিজের প্রসারিত
দাঁত বের করে ওটা লাফিয়ে ধরে ফেলতে চাইছে কনস্টেনটিনকে, ধরতে পারলে ছিঁ ড়ে ফেলবে টু টি।

পিশাচটা ভীষণ গর্জ ন করে, চেহারা সম্পূর্ণ বিকৃ ত করে বিছানার ফ্রেমটা কড় কড় করে চিড় ধরিয়ে
ফেলতে লাগলো।
24

আর কনস্টেনটিন, না, কোন মন্ত্র তন্ত্র না, কেবল পুরানো দিনের বিশুদ্ধ অশ্লীল গালাগালি দিতে
লাগলো ! তারপর, সামনে এগিয়ে এসে, মেয়েটার মাথার একপাশে সজোরে একটা ডানহাতি ঘুষি
জমিয়ে দিলো !

ফুঁ পিয়ে উঠলো মেয়েটা, চোখের মণি উঠে গেলো ওপরে। তারপর, বিছানা সমেত, পেছনের দিকে
পড়ে গেলো, ঠাণ্ডা মেরে গেলো একদম !

হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে বুকের খাঁচার ভেতরে, মাথা ঘোরাচ্ছে , কনস্টেনটিন এবার ওর পেছনে মানুষের
গলার স্বর সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠলো। পেছনে তাকিয়ে সে দেখলো, আধখোলা দরজার ওপাশে
জড় হয়েছে ছোট্ট একটা ভিড়। অনেক মেয়ে পুরুষ, হাঁ করা মুখ আর বিস্ফারিত চোখে , চেয়ে
আছে ভেতরের দিকে।

কনস্টেনটিন আশা করলো , ওঁরা ওকে মেয়েটার মাথায় ঘুষি মারার চাইতেও বেশী কিছু দেখতে
পেয়েছে। আর, ওঁরা যদি দেখেও থাকে, তাঁদের চোখে দোষারোপের কোন চিন্হ দেখতে পেলো না
সে। ওঁদের চোখে কেবল বোবা ভয়, চেয়ে আছে অচেতন বাচ্চা মেয়েটার দিকে।

কনস্টেনটিন জানে কখন হতবাক লোকজনের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে হয় , তড়পে উঠলো
সে “আমার একটা আয়না দরকার , এক্ষু নি !” ফিরে মেয়েটার দিকে তাকালো একবার । তারপর
বললো “কমপক্ষে তিন ফু ট উঁচু , যান , এক্ষু নি যান !”

তিনজন লোক একে ওপরের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো খানিক। কাছের এপার্ট মেন্টে গেলো
ওরা, সেখানে সেরকম আয়না পেলো না। আরেকটা দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে ঢু কে পড়লো। এক
বৃদ্ধা মহিলার চিৎকার শোনা গেলো। কারণ ওনার রুমের বড় মেঝে ছোঁয়া আয়না স্ট্যান্ড থেকে
খুলে নিয়ে, কনস্টেনটিনের রুমের দিকে নিয়ে আসছিলো লোকগুলো।

এগুলি সম্বন্ধে অনেকখানি উদাসীন , কনস্টেনটিন জানালার কাছে গেলো। নিচে দাঁড়ানো
শিক্ষানবিশের উদ্দেশ্যে চিৎকার করলো, যে এখনও ট্যাক্সিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
25

“ইয়ো , চ্যাজ !”

“কিইই ? ” চ্যাজ পাল্টা চিৎকার করলো ।

“তোমার ক্যাব, সরাও ওটা !”

“কিহ ! কেন ? ”

“স্রেফ সরাও ওটা, এক্ষু নি !” রাগে চেঁ চিয়ে উঠলো কনস্টেনটিন।

“তোমার আয়না এনেছি !” ভেতরে তাকানো লোকেদের মধ্যে সবচেয়ে মোটা জন চেচিয়ে উঠলো,
বিশাল আয়নাটা ঘরে ঢোকাতে রীতিমতো কু স্তি করছে। কনস্টেনটিন ফিরল, তারপর বিশাল
ওভাল শেপের আয়নাটার দিকে তাকালো।

নিচে, চ্যাজ বিরক্তিভরে ঢু কে বসলো নিজের ট্যাক্সিতে। নাক দিয়ে ঘোঁত করে একটা শব্দ
করে সেটা স্টার্ট দিলো। ব্যাক গিয়ারে দিয়ে কয়েক ফু ট পেছনে আনলো সে সেটা “নাও, বালের
গাড়িটা পেছনে এনে দিলাম !”

তারপর গাড়িটা বন্ধ করে, নিজের বইতে ফেরত গেলো।

কনস্টেনটিন বিশাল কাঠের ফ্রেম অলা আয়নাটা ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে ঝালর অলা
দড়ি দিয়ে ঝু লিয়ে দিলো। যাতে সেটা ও আর অর্ধ চেতনে কাঁপতে থাকা বাচ্চা মেয়েটার ওপরে
ঝু লতে থাকে। ও চোখ বুজে পড়ে ছিলো বিছানায়, পিশাচটা ওর ভেতরে ঘুমন্ত আছে, কিন্তু ধীরে
ধীরে জেগে উঠছে। আয়নাটা গ্লাস নিচে দিয়ে ঝু লছে, সেই মানুষগুলো দুইপাশে দাঁড়িয়ে সেটার
ভারসাম্য রক্ষা করছে।
26

“চোখ বন্ধ করে রাখুন” কনস্টেনটিন বললো তাঁদেরকে “যাই ঘটু ক না কেন, মেয়েটার দিকে
তাকাবেন না ! ”

সে মেয়েটার চোখের ওপর হাত রাখলো , সেগুলি পিটপিট করে খুলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। দ্রুত
লয়ে ফিসফিসানির সুরে বলতে শুরু করলো কনস্টেনটিন “ইন নমিনি পাত্রিস এত ফিলি এত
স্পিরিতাস সানকটি এক্সতিঙ্গুয়াতু র ইন তে অমিনিস ভিরতাস দ্যাবলি পের......... --- পিতা এবং
পবিত্র পুত্রের নামে, তোমার মধ্যেকার পবিত্র শয়তানের আলো নিভে যাক ! ”

“ইম্পসিতিনেম মানুম নস্ত্রারুম এত পের ইনভচতিওনেম গ্লরিওসে এত সাঙ্কতাএ দেই গেনেত্রসিস


ভার্জি নিস মেরি ......... ---- আমাদের হাতের ওপর আহ্বান করছি পবিত্র মাতা মেরীর শক্তিকে
......”

কাছেই কে যেন ফুঁ পিয়ে উঠলো – মেয়েটি নয়। সে ফিরে দেখলো, বাসিন্দাদের একজন, মধ্যবয়সী
লোক। চেয়ে আছে সরাসরি মেয়েটির মুখের দিকে।

“নাআআআ !” ঘেউ করে উঠলো কনস্টেনটিন।

কিন্তু ততোক্ষণে দেরী হয়ে গেছে, লোকটি পেছনে সরে গেলো। বড় বড় চোখে পানি ভর্তি , ফুঁ পিয়ে
উঠে বলতে লাগলো “ওহ না ...... না না না ”

লোকটি হাত ছেড়ে দেয়ায়, আয়নাটা কাত হয়ে গেলো। অন্য মানুষগুলো নড়ে উঠলো আয়নাটা
ধরার জন্য, কিন্তু ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে। মেয়েটি কনস্টেনটিনের হাতের নিচে মোচড়াতে
শুরু করেছে, মুখটা ঘন ঘন ঝাঁকি মারছে সে। স্ত্র্যাপগুলো ছিঁ ড়ে ফেললো সে একটানে, তারপর
ভেসে উঠতে শুরু করলো শূন্যে ! কনস্টেনটিন কেবল চোখ দুটো ঢেকে রাখতে পারলো ওটার।
পিশাচটা ওর ঘাড় পেঁচিয়ে ধরলো, আঙ্গুলগুলো বাঁকা হয়ে চাপ দিচ্ছে গলাতে। এদিকে
কনস্টেনটিন ভাবছে সেই ভীষণ চোয়ালের কথা, সেগুলো ওর হাতের কি অবস্থা করতে পারে
সেটা। ও অনুভব করলো, মেয়েটার চোয়াল ফু লে উঠছে ......... কনস্টেনটিনের শ্বাস বন্ধ হয়ে
এলো।
27

ওকে, এটা এখনই করতে হবে , কনস্টেনটিন ভাবলো , নয়তো একটা ছোট্ট মেয়ে তোমার গলা
টিপে মারবে।

“সুন্দর করে হাসো , ব্যাটা বিফল শয়তান !” ও বললো পিশাচটাকে , আর একপাশে সরে গেলো।
এবার ও আর আয়নাটা ব্লক করে নেই, ওর হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে নিলো মেয়েটার চোখ থেকে।
মানসিক ভাবে, সে আদেশ করলো পিশাচটাকে , তাকা ওদিকে !

মেয়েটার চোখগুলো আয়নায় নিজের প্রতিবম্বের দিকে তাকিয়ে রইলো......... আর কনস্টেনটিনও


তাকালো।

আয়নায় যেটা দেখা যাচ্ছে, সেটার সাথে একটা ছোট মেয়ের কোন সম্পর্ক ই নেই। এটা দেখাচ্ছে
একটা মাথা, যেটার ওপরের অর্ধেক অংশই নেই ! ওটার মাথার খুলির ওপরের অংশ চোখ পর্যন্ত
কাটা। পিশাচদের ব্রেইনের কোন প্রয়োজন নেই, ওরা কেবল নির্দে শ অনুসরণ করে, আর নির্ভ র করে
প্রবৃত্তির ওপর। সাথে থাকে বিশুদ্ধ খিদে , আর নিন্মাঙ্গের প্ররোচনা । এটার আছে বিশাল চোয়াল
আর সূচের মতো ধারালো দাঁত, লিকলিকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর আঁশযুক্ত সারা শরীর......

আর ছোট্ট মেয়েটা হঠাৎ মাথা পেছনে হেলিয়ে দিলো, ফুঁ পিয়ে উঠলো স্বস্তিতে। পিশাচটা এবার বন্দী
হয়ে গেছে আয়নাতে ! বন্দী কিন্তু হাল ছাড়তে রাজী নয়, প্রচণ্ড লড়াই লাগিয়ে দিয়েছে আয়না
জগত থেকে বেরোবার জন্য। লম্বা লম্বা নখ দিয়ে আঁচড়ে চলেছে আয়নার ওপর, ওটার ফ্রেম আর
গ্লাসে ফাটল ধরে যাচ্ছে.........

পিশাচটা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চলেছে, ওটার শরীর জাগতিক পৃথিবীতে প্রবেশ করতে
চলেছে। এটা... ভাবলো কনস্টেনটিন, নিয়মের বিরুদ্ধে চলে যায়।

“দড়িটা টানুন, এক্ষু নি !” সে চিৎকার করে উঠলো।

পাশের লোকগুলো দড়িতে টান দিলো, আয়নাটা ঝাঁকি খেয়ে এগোলো জানালার দিকে। কিন্তু
আটকে গেলো জানালার বাজু’তে।
28

“না, তু মি থাকবে না !” তড়পে উঠলো কনস্টেনটিন। তারপর লাফিয়ে উঠে সর্ব শক্তিতে ঠেলা
দিলো আয়নাতে। ভাঙ্গা জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো আয়নাটা, পাল্টি খেতে খেতে রওনা দিলো
নিচের রাস্তার দিকে।

পড়ে যাওয়ার সময় , সে দেখতে পেলো, নিচে পড়তে পড়তে পিশাচটা ভাঙ্গা কাঁচ দিয়ে ওর দিকে
চেয়ে আছে ! কনস্টেনটিন মাঝখানের আঙ্গুল তু লে দেখালো ওটাকে “তোর বসের জন্য !”

তারপর, আয়নাটা সরাসরি গিয়ে পড়লো চ্যাজের ট্যাক্সির হুডের ওপর। সেটার ভেতরে একটা
গভীর গর্ত করে ফেললো , যার ফলে শতখান হয়ে ভেঙ্গে পড়লো আয়নাটা। চারদিকে ছড়িয়ে
পড়লো চকচক করতে থাকা আয়নার টু করা। সেই টু করোগুলো ছড়িয়ে গেলো চারদিকে, সাথে
নিয়ে গেলো পিশাচটার অস্তিত্ব। একটা সরীসৃপ সুলভ কটু গন্ধ ছড়িয়ে , হারিয়ে গেলো আসন্ন
রাতের শহরে।

ক্যাবের ভেতর, চ্যাজ হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো ভাঙ্গা আয়নার কাঁচ, ফেটে যাওয়া কাঠ , আর
নিজের গর্ত হয়ে যাওয়া হুডের দিকে !

মেয়েটির বেডরুমে, কনস্টেনটিন রক্তে ভিজে যাওয়া স্ত্র্যাপ গুলো খুলছিলো মেয়েটির হাত থেকে।
তখনই মেয়েটির মা ভেতরে ঢু কলেন।

“মা আমার !” বলে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি, দুলতে থাকলেন নীরব কান্নার দমকে দমকে।

কনস্টেনটিন এবার তাকালো সেই লোকটার দিকে, যে পিশাচটার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। সে
পিঠের ওপর হেলান দিয়ে বসেছিলো নির্বাক । কাঁপছে , বিড়বিড় করছে আর মাঝে মাঝে শিউরে
উঠছে ! ওর মনের ভেতরে কিছু একটা ভেঙ্গে গেছে !

হেনেসি ঢু কে এলো ভেতরে, গলা খাঁকারি দিয়ে বললো “ম্যা’ম, ঐ টাকাটার ব্যাপারে............”

কনস্টেনটিন ওর সিগারেটের অবশিষ্টাংশ তু লে নিলো, টান দিলো অভ্যাসবশে – কিন্তু ওটা আর


জ্বলছে না। ওর মনে হলো , নড়াচড়া না করলে এক্ষু নি পড়ে যাবে। কোটটা তু লে নিয়ে হলওয়ের
29

দিকে চলে এলো সে, ছোট্ট কিচেনটার দিকে। ওর পেট মোচড় দিচ্ছিলো। ও আজ কিস্যু খায়নি,
কিছুই না ! তাই বমি করলো না।

ওখানে, ফ্রিজের ভেতর খানিকটা দুধ রাখা ছিলো। একটু শুঁকে নিয়ে, লম্বা একটা চু মুক দিলো
সেটায়। ওর পেটের ভেতরে যেন শীতল একটা হাত বুলিয়ে দিলো কেউ। ফ্রিজটা বন্ধ করে, সেটার
গায়ে চু ম্বক দিয়ে আটকানো বাচ্চাদের কিছু পেইন্টিং এর দিকে তাকিয়ে রইলো। সবগুলি একইরকম
, একটা কদাকার শরীর – দুইপাশে হাত ছড়িয়ে রেখেছে। আরেকটা শরীর সেটাকে একটা লাঠি
দিয়ে পাশ থেকে খোঁচাচ্ছে। যেন ছুরি মারছে পাশ থেকে। দেয়ালে আরও অনেকগুলি আছে।
মা’টি একটু চমকে গেলেও, বাচ্চার আঁকা গুলো রেখে দিয়েছে গর্বের জিনিস মনে করে।
কনস্টেনটিন সেগুলো ছিঁ ড়ে নিলো , ভরলো কোটের পকেটে, তারপর বাসিন্দাদের মাঝ দিয়ে পথ
করে এগোলো। করিডোরে চলে এলো সে, কাশছে অনবরত।

নিচে, এপার্ট মেন্টের সামনের দেয়ালে হেলান দিয়ে, সামনের দৃশ্য দেখছে কনস্টেনটিন। চ্যাজ, একটা
নীল ঝারুনি দিয়ে গর্ত হয়ে যাওয়া হুড পরিষ্কার করছে। আশেপাশে লোক জড় হয়ে তাকিয়ে আছে
এপার্ট মেন্টের জানালার দিকে, এ ওকে দেখাচ্ছে আর কিচিরমিচির করছে। যদিও দুর্বল, কিন্তু
কনস্টেনটিনের অনুভবকারী সত্ত্বা এখনও কাজ করে চলেছে, আর দেখার ক্ষমতা এখনও তু ঙ্গে
। তাই...... সে ভূ তদের দেখতে পাচ্ছে আশেপাশে ভিড়ের ভেতর ! ভূ ত দেখতে পছন্দ করে না
ও। অন্তত, এখানে যে ভূ তগুলো আটকা পড়েছে , সেগুলো তো নয়ই। ওগুলো এখনও নিজেদের
প্রায়শ্চিত্তও শেষ করতে পারেনি। ঐ যে, ফ্যাকাসে দেখতে এক বুড়ো দাঁড়িয়ে আছে ফাঁক হয়ে
যাওয়া গলা নিয়ে ! ওর পাশে, দাঁড়িয়ে আছে ওর স্ত্রী, এখনও সেই কসাইয়ের ছুরিটা ধরে আছে
যেটা দিয়ে স্বামীর গলা ফাঁক করেছিলো ! নিজের কপালেও একটা বুলেটের গর্ত আছে তার, যেটা
তার স্বামী উপহার দিয়েছে মারা যাবার সময় । দুটো ভূ তই শোকার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে
কনস্টেনটিনের দিকে। একসাথে থাকার জন্য অভিশাপগ্রস্থ মনে হচ্ছে। ও তাকিয়ে থাকতে
থাকতেই একজন পুলিশ ওঁদের ভেদ করে চলে গেলো, দেখতেই পায়নি ।
30

আর, ঐ যে, ফায়ার হাইড্রেন্টের পাশে – দাঁড়িয়ে আছে গালে বসন্তের দাগ অলা , চর্বি মাখানো
চু লের এক ভূ ত। নড করলো সেদিকে চেয়ে, ব্যাটা কনস্টেনটিনের আশেপাশেই ঘোরে সব সময়।
কে জানে, কনস্টেনটিনই হয়তো ওর মৃত্যুর কারণ হয়েছিলো কোন এক সময় !

চিকন ভূ তটা বিষন্নভাবে নড করে, বাতাসে মিলিয়ে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে। কারণ কনস্টেনটিন
ওর আধ্যাত্মিক দৃষ্টি বন্ধ করে দিচ্ছে আস্তে আস্তে। ওটা বেশীরভাগ সময় বন্ধ করে রাখাই ভালো,
মনের সুস্থতা বজায় রাখাটা জরুরী খুব।

সিগারেটের অবশিষ্টাংশ জ্বালালো সে, হেনেসি যোগ দিলো ওর সাথে।

“যেরকম বলেছিলাম, জন ! আমি তোমাকে ‘কিছু একটা’ খুঁজে দিয়েছি, তাই না ? বলো ?”

কনস্টেনটিন কাঁধ ঝাঁকিয়ে আশেপাশে তাকালো ভূ তের খোঁজে। কিছু দেখতে পেলো না। কিন্তু সে
জানে, আছে ওরা।

“ওপরে ওটা কি ঘটলো ?” হেনেসি জিজ্ঞেস করলো ।

কনস্টেনটিন কেবল মাথা নাড়লো , কাশতে কাশতে কোটের পকেট হাতড়াতে লাগলো কিসের
জানি খোঁজে।

“ভেতরের পকেট, বামপাশে” বলে উঠলো হেনেসি।

হেনেসি ঠিক বলেছিল। ওখান থেকে একটা কাশির লজেন্স মুখে পুরতে পুরতে কনস্টেনটিন
বললো “তোমার ঐ সব আধ্যাত্মিক চমক, কাস্টমারদের জন্য তু লে রাখো ! ”

“সরি, সরি, ঠিক আছে, সরি !” বলে হেনেসি নিজের কোটের ভেতরের পকেট থেকে একটা বাদামী
কাগজের ঠোঙ্গা বের করলো, ভেতরে সন্দেহজনক দেখতে একটা বোতল। এদিক ওদিক তাকালো
সে, তারপর লম্বা এক চু মুক দিলো সেটায়।

“অনেকবার দেখা হতে যাচ্ছে ওদের সাথে ” শুকনো ভাবে বললো কনস্টেনটিন।
31

“এটা ওদেরকে দূরে রাখে , যাতে আমি ঘুমাতে পারি। আমার ঘুম দরকার ” কৈফিয়তের সুরে
বললো হেনেসি।

কনস্টেনটিন বুঝতে পারলো ও কি বলতে চাইছে “আমার নিজেরও কিছু সাহায্যের দরকার, ফাদার
হেনেসি !”

“তাই ?” হেনেসি বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করলো “আমার কাছ থেকে ? কি ধরণের .........” প্রবৃত্তির
বশে , ওর হাত চলে গেলো ঘাড়ের চারপাশে ঝু লতে থাকা এমুলেট’টার দিকে।

কনস্টেনটিন ওটার দিকে তাকালো । চারটা পরস্পরকে ভেদ করে যাওয়া ক্রস ...... হ্যাঁ !

কনস্টেনটিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে গুঙিয়ে উঠলো হেনেসি “ওহ, ওটা। ওহ , জন, না, শোন ,
আমি এটা করতে পারি না ......”

“পাদ্রে, ঐ এক্সরসিজম’টা সঠিক ছিলো না। আমি চাই তু মি কিছু......... গবেষণা করো ।”

“আমি ওসব আর করতে পছন্দ করি না .........”

“কাম অন ! ইথারে একটু কান পাতো আমার জন্য ! অল্প কিছুদিন কেবল , এটা তু মি করতেই
পারো আমার জন্য। যে কোন অস্বাভাবিক কিছু , যে কোন কিছু, আমাকে জানাবে , প্লিজ”

হেনেসির হাত দুটো কাঁপছিল । মনে হচ্ছিলো, সে বাসের টিকেট করে, ভেগে যাবার চিন্তা করছিলো।

কনস্টেনটিন ওর হাত দুটো হেনেসির কাঁধে রাখলো “একদম পুরানো দিন গুলির মতো ” বলে
হেনেসির গলা থেকে এমুলেটটা খুলে নিতে শুরু করলো ।

“না ! জন, আমার ওটা দরকার -----”

“অল্প কিছুদিন......” হেনেসি যদি ওর হয়ে ইথারে কান পাতে, তবে এই এমুলেটটা খুলে রাখতে হবে
পুরো নেটওয়ার্কে ঢোকার জন্য। ও সেটা হেনেসির কোটের পকেটে ঢু কিয়ে দিলো।
32

হেনেসি এক মুহূর্ত তাকালো কনস্টেনটিনের দিকে, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। বন্ধু ত্বের
ছিটেফোঁটা তখনও রয়ে গেছিলো । একসাথে কাজ করার সেই দিনগুলোর স্মৃতি , হেনেসি ভেঙ্গে
পড়ার আগে। চেহারায় ফু টে ওঠা নরক যন্ত্রণা তেমন কারো নজরে পড়ে না। শুধু পথ চলে যাওয়া,
জীবন যে ভু তগ্রস্থ হয়ে পড়েছে অনেক আগে, সেই সত্য উপেক্ষা করে চলা প্রতিনিয়ত ! পুরো
পৃথিবীটাই তো একটি শত্রু পরিবেষ্টিত দুর্গের মতো। সবাই অপেক্ষা করছে একটু ফাটলের দেখা
পাবার জন্য, পেলেই ঝাঁপিয়ে ঢু কে পড়বে। আপনি যদি সত্যি এটা উপলব্ধি করতে পারেন, এটা
আপনাকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে ফেলতে পারে।

হেনেসি একটা ঢোঁক গিলে বললো “ওকে, ওকে...... জন। শুধু তোমার জন্য, আগেকার
দিনগুলোর মতো । ঠিক আছে !”

হেনেসি এরপর , লম্বা আরেকটা চু মুক দিলো ।

কনস্টেনটিন ঘাড়ে একটা সুড়সুড়ি অনুভব করলো। কেউ একজন ওর দিকে লক্ষ্য রাখছে,
এপার্ট মেন্ট বিল্ডিঙের ওপর থেকে। কেউ একজন, যে আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে একটা অনেক
পুরানো সোনার কয়েন ঘোরাচ্ছে...... কেউ একজন...............

সেই দৃষ্টির অদ্ভু ত আধিভৌতিক বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করে, ঘাড় ফেরালো কনস্টেনটিন, কিন্তু সেই
‘কেউ একজন’ ততোক্ষণে গায়েব হয়ে গেছে ।

কনস্টেনটিন দেখতে পেলো, চ্যাজ ওর ট্যাক্সির হুড খুলে, উলটোদিক ডেকে ঘুষি মেরে
মেরে গর্ত টা সমান করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তেমন কোন লাভ হচ্ছে না।

“জন, এটা আমার ক্যাব না ! তোমার সমস্যাটা কি বলো তো ? ”

“আমি তোমাকে ওটা সরাতে বলেছিলাম !”


33

“হুম, তোমার আমাকে এটাও বলা উচিত ছিলো , যে একটা তিনশো পাউন্ডের আয়না ফেলছ
তু মি ওপর থেকে । তার ভেতরে আবার একটা রেগে যাওয়া পিশাচও আছে, সেটা জানলে আমি
আরও দূরে নিয়ে রাখতাম গাড়িটা......... ” রাগের সাথে ধাম করে হুডটা নামিয়ে রাখলো চ্যাজ।
তারপর গাড়ির ভেতরে গিয়ে বসলো। কনস্টেনটিন ভেতরে ঢু কে ওর পাশে বসলো।

“ওরা এবার এটাকে কি বলবে বলে তোমার ধারণা ? ” চ্যাজ বললো, দূর থেকে কাছে চলে আসতে
থাকা সাইরেন শুনতে শুনতে “পিসিপি ? ক্রিস্টাল মেথ ?”

“ওরা কিছু একটা ডেকে নেবে, সমসময় তাই করে ” কাশতে কাশতে আর আরেকটা কাশির
লজেন্স চিবোতে চিবোতে বললো কনস্টেনটিন। ড্যাশ বোর্ডে র ওপরে রাখা বইয়ের স্তূ পের ভেতর
হাত চালালো সে, এলিস্তার ক্রাউলি, এলিফাস লেভি, ডিওন ফরচু ন, মানলি পি হল । “লস
এঞ্জেলস, কখনও আনন্দ দেয়া বন্ধ করে না ............ ”

চ্যাজ ট্যাক্সির স্পিড তু ললে, বইগুলো কনস্টেনটিনের কোলে এসে পড়লো । সেই সময়
পুলিশের গাড়িও এসে পড়লো।

“আল্ভারাডোর দিকে যাও...............” বলল কনস্টেনটিন।

“আমি জানি কিভাবে যেতে হয়, ঠিক আছে ?”

তিন

ইকো পার্ক , লস এঞ্জেলস


34

ডিটেকটিভ এঞ্জেলা ডডসন, এলএপিডি, দৌড়াচ্ছে, হাতে ধরা বন্দুক। এটা করতে ঘৃণা করে সে।
একটা বন্দুক হাতে দৌড়ানো, ছুরি হাতে দৌড়ানোর চাইতে খারাপ। একটা ছুরি নিয়ে দৌড়াও,
সম্ভবত বড়জোর নিজেকে আহত করতে পারো তু মি। একটা বন্দুক হাতে দৌড়ালে, দুর্ঘটনাবশত
যদি ফায়ার হয়ে যায়, এটা যে কাউকে মেরে ফেলতে পারে ! ওর পরনে ফ্ল্যাট সোলের জুতা, স্যুট,
স্কার্ট , সাদা ব্লাউজ আর পার্স। কিন্তু তা স্বত্বেও, হোঁচট খেয়ে বন্দুক ছুটে যেতে পারে।

এ ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সময় আপাতত নেই। একটা লোক, তিনজন লোককে গুলিবিদ্ধ করেছে
একটু আগে, তাঁদের মধ্যে ওর নিজে পার্ট নার জেভিয়ার’ও আছে। ব্যাটা সামনেই কোথাও আছে,
এ ব্যাপারে এঞ্জেলা নিশ্চিত। যদিও ও জানেনা কিভাবে । ঐ যে, জেভিয়ার, একটু আগে ওয়াকি
টকিতে শুনেছিলো ওকে। হেলান দিয়ে আছে একটা গাছের সাথে, নিজেরই রক্তের পুকু রের
ভেতর।

“এখান থেকে সরে যান সবাই !” চিৎকার করলো সে আশেপাশের স্থির দাঁড়িয়ে থাকা
মানুষজনেদের উদ্দেশ্যে। দৌড়ে যাচ্ছে জেভিয়ারের দিকে, পার্স থেকে ব্যাজটা বের করে নাড়তে
লাগলো দ্রুত “এলএপিডি ! এখান থেকে চলে যান ” জেভিয়ার হাফাচ্ছে, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে
চেহারা। বাম কাঁধে গুলি খেয়েছে। “নিচু হন, কিছুর পেছনে আড়াল নিন !” একটা পরিবারকে
চিৎকার করে বলতে বলতে হাঁটু গেড়ে বসলো এঞ্জেলা।

ওর ব্যাকআপ কোথায় গেলো ? এই এলাকার আশেপাশে দুইজন বাইসাইকেল পুলিশ থাকার


কথা। ঐ বন্দুকবাজ, সিরিয়াল কিলার, ও কি ওদেরকেও গুলি করেছে নাকি ?

জেভিয়ারের ক্ষতের ওপর একটা কাপড় দিয়ে চাপা দিলো সে, আর অন্য হাত দিয়ে ওর বন্দুকটা
সরিয়ে নিতে চাইলো। কিন্তু ও সেটা ছাড়তে চাচ্ছে না।

“তু মি আঘাত পেয়েছ ” এঞ্জেলা বলল “ছেড়ে দাও ওটা ”


35

“ঠাণ্ডা মরা আঙ্গুল থেকে নিতে হবে, এঞ্জি ” বলল জেভিয়ার কর্ক শভাবে। পুরানো এনআরএ
(ন্যাশনাল রাইফেল এসোসিয়েশন) এর স্লোগান আওড়াচ্ছে , ভাবল এঞ্জেলা।

নড করে, ভিড়ের দিকে তাকালো সে, চেহারাগুলো দেখছে সতর্ক ভাবে। ওর মন বলছে , স্যুটার
এখানেই আছে কোথাও। দাঁড়িয়ে পড়ে, নিজের ব্যাজটা বের করে ভিড়ের উদ্দেশ্যে চিৎকার
করলো “এলএপিডি, সবাই মাথা নামান !”

জেভিয়ার বেচে আছে এখনও, এঞ্জেলার মন বলছে বন্দুকবাজ লোকটা ওকে মেরে ফেলতে চায়।
তাই, ও এখানেই কোথাও আছে।

এদিক ওদিক তাকিয়ে , বিড়বিড় করছে সে “কোথায় তু মি ? কোথায় তু মি ......” বেশীরভাগ


লোকজন ওর চিৎকারের পর, দৌড়ে চলে গেছে। কিন্তু কিছু ক্লিছু লোক রয়ে গেছে, যেমন ঐ যে,
একজন সুন্দর দেখতে ধূসর স্যুট পরা লোক। একটা ভেন্ডর কার্টে র পাশে, এক মহিলা আর তার
দুই বাচ্চার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বোকা বোকা হাসি নিয়ে।

এঞ্জেলা পেছনে জেভিয়ারের ফুঁ পিয়ে ওঠা শুনল ব্যাথায়। ওর মনে পড়লো , এম্বুলেন্স ডাকা হয়নি।
ছোট্ট ওয়াকি টকিটা বের করে বলা শুরু করলো “অফিসার ডাউন। একজন বন্দুকবাজ।
অফিসার ডাউন, সাহায্য দরকার ......... ”

বোকা বোকা হাসি অলা লোকটার হাত ওর দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে ।

এরপর, হঠাৎ ই উপলব্ধি করলো এঞ্জেলা, সে ঘুরে যাচ্ছে, বন্দুক উঠিয়ে সে ফায়ার করছে, এমনকি
চিন্তা করারও আগে। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে এসব ঘটে গেলো, আর ওর ভেতরে কেউ
একজন চিৎকার করে বলতে লাগলো – আমি পারবো না এসব করতে, থামো !

কিন্তু প্রবৃত্তির চাইতেও শক্তিশালী কিছু একটা নিজের ভেতর টের পেলো সে । একটা আদিম
নিশ্চয়তা আর দৃঢ় আত্মবিশ্বাস , মনের একদম ভেতর থেকে। সে টের পেলো , সে যদি এটা করতে
36

না পারে, সে, জেভিয়ার আর বাকিরা যারা আশেপাশে আছে, সবাই মারা যাবে, এমনকি একটা
শব্দও উচ্চারণ করার আগে।

তাই, ও বোকা বোকা হাসি হাসতে থাকা লোকটার কপালে একটা বুলেট বিঁধিয়ে দিলো।

আমি কি ভু ল লোককে গুলি করলাম ? হোলি মাদার অব গড, আমার ওপর দয়া করো ......

আশেপাশের লোকেরা ডানে বামে সরে যেতে লাগলো চিৎকার করতে করতে । ঠিক যেন একটা
পর্দার মতোই, ওরা সরে গিয়ে ঐ লোকটাকে উন্মুক্ত করে দিলো । হাঁটু গেড়ে পড়ে যাচ্ছে সে......
একটা সাইলেন্সার লাগানো নাইন এম এম পিস্তল ধরা তার হাতে !

সামনের দিকে ঝুঁকে, মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো লোকটা। একটু ও কাঁপলো না, একদম স্পট ডেড।

বন্দুক নামিয়ে, জেভিয়ারের দিকে তাকালো এঞ্জেলা, ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে লোকটা।
মুখ বাঁকা করে হেসে বললো “তু মি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ !”

গলা শুনে মনে হলো, মোটেই সে ঠাট্টা করছে না ।

এঞ্জেলা নিজের হাতের বন্দুকের দিকে তাকালো। চোখ বন্ধ করে ফেললো তারপর............

এটা আবার ঘটেছে,

“কি জানো, এঞ্জেলা। এটা কিছু কিছু মানুষকে নার্ভাস করে তু লছে। ” ক্যাপ্টেন ফোরম্যান
বললেন , তাঁর ক্রু -কাট চু লে হাত বোলাতে বোলাতে। তিনি এক্স-মেরিন, তাই চু লের কাটটা রেখে
দিয়েছেন। তিনি এঞ্জেলার দিকে তাঁর ছোট , নীল চোখে তাকালেন, ভ্রু কুঁ চকানোর ফলে ওনার
ট্যান করা চামড়ায় ভাঁজ পড়লো “ছয় মাসে চারজন মানুষকে গুলি করা – এটা সবসময় ঘটে না।
‘ডার্টি হ্যারি’ মুভিগুলোর কথা বাদ দিলে ! ”

“হ্যাঁ, স্যার। কিন্তু – ওগুলোর কোনটাতেই আমার হাত ছিলো না ” এঞ্জেলা বললো।
37

“তু মি সামনের ঐ চেয়ারটাতে বসতে পারো ” ক্যাপ্টেন বললেন।

তাঁর ডাউনটাউন অফিসের ডেস্কের সামনে, প্রায় এটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে এঞ্জেলা।
ওনার ছেলেমেয়েদের ছবি ঝোলানো দেয়ালে, সাথে নানান ধরণের সার্টি ফিকেটের জঙ্গল। পাইপের
তামাকের গন্ধ ভাসছে বাতাসে। “না, ধন্যবাদ , স্যার” জবাব দিলো সে।

ও জানে ও খানিকটা খিটখিটে আচরণ করে ফেলেছে বসতে রাজী না হওয়ায় । কিন্তু ওর কাছে
মনে হচ্ছে, নিজের ডিউটি করার জন্য ওকে কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে !

“তু মি ভাবছো, তোমাকে ঝামেলায় না ফেলে, মেডেল দেয়া উচিত ” ফোরম্যান বললেন। চেয়ারে
হেলান দেয়ায় সেটা আর্ত নাদ করে উঠলো।

নিজের চেহারা খানিক লাল হয়ে গেছে টের পেলো এঞ্জেলা “মেডেল – না স্যার । কিন্তু, সম্ভবত ,
ঝামেলা চাই না !”

“আমি বলছি কি ঘটেছে। আমার মনে হয় এটা তোমাকেও বিরক্ত করছে – এতো অল্প সময়ে
এতো বেশী বন্দুকবাজি, এতো অল্প সময়ে। ”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো এঞ্জেলা। এখানে সে ধরা খেয়ে গেছে। ঐ চারটা শুটিংই ছিলো
প্রবৃত্তিজাত। চারটাই ছিলো এক-গুলিতে-হত্যা কেস। সেই চারজন লোকই ছিলো এমন লোক,
যাদের জন্য কেউ শোক করবে না, কেউ অভিযোগও করবে না তাদের হারিয়ে। প্রত্যেকটা ছিলো
খুনি। একটা বাচ্চা হত্যাকারী, একটা ড্রাগ গ্যাং এর ভয়ংকর মাস্তান, একটা ব্যাংক ডাকাত যে
একজন হোস্টেজকে মেরে ফেলেছিলো, আর এখন , একটা উন্মাদ শুটার।

আর, প্রত্যেকবারই, সে নিজেকে ঘটনাস্থলের কাছাকাছিই আবিষ্কার করেছিলো। কেবল নিজের


অনুভূ তিকে অনুসরণ করছিলো, এবং, প্রত্যেকবারই সে ঠিক ছিলো !

ও নিজের বোনের ব্যাপারে ভাবতে চাইলো না। ভাবতে চাইলো না , ইসাবেলের সাথে যা ঘটেছে,
সেটা হয়তো ওর নিজের সাথেও ঘটতে চলেছে। যেসব কণ্ঠস্বর সে শুনতো, কিংবা ছোটকালে
38

যেসব ভূ ত সে দেখত, সেসব নিয়েও ভাবতে চাইলো না ! ওসব আবার ফিরে আসুক , সেটা সে
কিছুতেই চাইতে পারে না। কারণ সেই সময়টা ছিলো পাগল করা সময়।

কিন্তু এগুলো পাগলামি কি করে হতে পারে। সে তো .........

“......প্রত্যেকবার সঠিক ছিলে। ” ক্যাপ্টেন বলে চলেছেন “ওটাই সবচেয়ে জঘন্য ! ওগুলো
একদম হাড়ে হাড়ে চেক করা হয়েছে। যখন সবকিছু ঠাণ্ডা হয়ে আসবে, তু মি হয়তো একটা প্রশংসা
পত্র পেতেও পারো। কিন্তু , তবুও আমাদের তোমাকে সাসপেন্ড করতে হবে তদন্ত চলাকালীন। এটা
স্রেফ রুটিন, আমি নিশ্চিত এটা ঠিক হয়ে যাবে।”

“আমি জানি, ক্যাপ্টেন”

“ডডসন – এ ব্যাপারে তোমার কি কিছুই বলার নেই আমাকে ? ”

“যেমন...... কিরকম ?”

“আমি জানি না ...... স্রেফ...... পরেরবার তোমার যখন এ ধরণের কোন অনুভূ তি হবে , তখন
অন্য কাউকে কল করে সেটা......... ফলো আপ করতে বলবে। মানে আমি বলতে চাচ্ছি, সেখানে
যদি কোন শুটার উপস্থিত থাকার সম্ভাবনা থাকে, তখন নয় , কিন্তু ............ ”

“আমি জানি আপনি কি বলতে চাচ্ছেন , স্যার”

“ওকে। কাল সকালে, তদন্তের সময় দেখা হবে ”

এঞ্জেলা নড করলো, তারপর হেঁটে বেরিয়ে এলো। উনি ঠিকই বলেছেন, আমি নিজেও এটাকে ভয়
পাচ্ছি !

চ্যাজ টু য়েন্টি লেনের পারকিং লটের একটা নিভৃ ত কোণায় নিজের ট্যাক্সি থামালো।
কনস্টেনটিনের ব্যাগটা নিলো ট্রাঙ্ক থেকে, তারপর ওকে অনুসরণ করতে শুরু করলো । বোউলিং
39

এলি’র দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলো সে “কখনও কি এই চিন্তা মাথায় এসেছে, যে
আমিও তোমায় সাহায্য করতে পারি ?”

“নোপ !” চ্যাজের দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলো কনস্টেনটিন। ভেতরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে।

অন্য কোন জায়গায় হলে, এখানে যে শব্দগুলো হচ্ছে , গুড়গুড় ধুম ধাম ক্রাশ , সেগুলো
ভু মিদ্ধসের শব্দ মনে করে সবাই জান বাঁচানোর জন্য ছুট লাগাতো ! কিন্তু বোউলিং এলি’তে , এই
শব্দগুলো খুবই স্বাভাবিক। একপাশে উজ্জ্বল রঙের বোউলিং শু ভাড়া দিচ্ছে এক লিকলিকে
লোক। সবগুলি লেনেই ধুন্ধু মার বোউলিং চলেছে।

এরপর, বোউলিং এলি’তে ১৩ নাম্বার রো এর কাছে একটা কালো টি শার্ট পরা লোকের কাছে
গিয়ে বললো “আমার বী ম্যান’কে দরকার , যত দ্রুত সম্ভব। ”

কনস্টেনটিন এবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো চ্যাজের দিকে । সে ‘বাফেলো বিল’ এর মতো
সরাসরি গুলি করতে পারে, কু ত্তার বাচ্চার মতো ঘুষি কসাতে পারে, সে ফায়ার স্প্রাইট আর
বাতাসের দৈত্যকে আহ্বান করতে পারে , একটা পিশাচকে আয়নায় বন্দী করতে পারে, এমনকি
নক্ষত্রজগতের আনাচেকানাচে উঁকি মারতে পারে। কিন্তু বোউলিং এর জগতে, সে একেবারেই
আনাড়ি। বোউলিং কৌশল , চিরকাল ওর কাছে রহস্যময়ই থেকে গেলো।

এবার চ্যাজের পালা “আমাকে একটা কথা বলো , তোমার দাস হিসাবে আমাকে আর কতদিন
থাকতে হবে ?”

“তু মি আমার দাস নও, চ্যাজ। তু মি হলে আমার অত্যন্ত প্রশংসিত শিক্ষানবিশ। ঐ যে, টনটো ,
রবিন আর ঐ যে পুরানো মুভিতে যে দেখায়, একটা মোটা লোকের সাথে একটা চিকন লোক –
তু মি হলে সেই ! ”

চ্যাজ, রো থেকে একটা বল তু লে নিলো । গ্রিজ পেনসিল দিয়ে সেটার গায়ে লিখলো ‘নতু ন
খেলা’
40

তারপর নিপুণভাবে সেটা গড়িয়ে দিলো এলি দিয়ে, পারফেক্ট হিট !

খানিক বাদে, দুজনেই চড়ে বসলো চ্যাজের ট্যাক্সিতে।

কনস্টেনটিনের এপার্ট মেন্টটা ছোট। কিন্তু যতটা ছোট দেখায়, ততটাও ছোট না। ভেতরে
ঢু কে, ডানদিকের একটা চেইন টেনে দিলো সে। দূরের একটা শাটার খুলে গেলো, আরেকটা রুম
উন্মুক্ত হয়ে পড়লো সেদিকে। ঠিক একটা বোউলিং এলি’র মতোই লম্বা মনে হলো এবার
রুমটাকে। আর , একসময় সেটা তাইই ছিলো। পাশের দরজা থেকে পিনের গুড়গুড় শব্দ ভেসে
এলো। দূরতম প্রান্তে , একটা বিছানা দেখা গেলো , লোহার খাঁচায় বন্দী ! নানারকম ‘খারাপ
জিনিস’ কে দূরে রাখতেই এই ব্যবস্থা।

মেঝেতে , চার দেয়ালের প্রত্যেকটার সাথে ঘেঁষে রাখা হয়েছে বড় স্পারক্লেটের বোতল। প্রত্যেকটার
গায়ে হাতে আঁকা ক্রস অলংকৃ ত আছে। হোলি ওয়াটার । এটা কিছু কিছু সত্ত্বাকে দূরে রাখে।
অন্যরা, পাত্তাই দেয় না !

কনস্টেনটিন জানালার সিলগুলো পরীক্ষা করলো। জাগতিক বা মহাজাগতিক, কোন ধরণের


অনুপ্রবেশের চিন্হ চোখে পড়লো না।

জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা ছোট্ট বক্স বের করে , ওটার জন্য তৈরি করা একটা শেলফে
রাখলো সেটা। চারপাশে তাকালো, ভাবলো , এখানে খুব সময়ের জন্য থাকা হয় ওর।

“হোম , স্যুইট হোম !” বিড়বিড় করলো সে। একটা সিগারেট ধরালো সে, কোট খুললো , তারপর
টেবিলে বসলো বী ম্যান এর জন্য অপেক্ষা করতে। বেশীক্ষণ লাগলো না, সিগারেটের অর্ধেক
পোড়ার আগেই এলো সে।

“’নতু ন খেলা’ জন ? ” বী ম্যান বললো, কনস্টেনটিনের এপার্ট মেন্টে নক না করেই ঢু কতে ঢু কতে।

কনস্টেনটিন সিগারেটের ধোঁয়া গিলে ফেলল, তারপর সাথে সাথে কাশতে শুরু করলো।
41

“সবচেয়ে বড়টা, বড় খনি – যেটার জন্য তু মি অপেক্ষা করছিলে ?”

কনস্টেনটিন ওর বেদনাদায়ক কাশিটা কোনমতে নিয়ন্ত্রণে আনলো। একটা টিস্যুতে থুঃ করে
একদলা রক্তমাখা কফ ফেলে সে কর্ক শভাবে বললো “মজা দাও দেখি আমায় !”

এর ফাঁকে তাকালো বী ম্যানের দিকে। ছোট্টখাট্টো , কেতাদুরস্ত চেহারা। শয়তানি ভরা ভাবভঙ্গী ,
কাপড়চোপড় একদম পরিপাটি। কনস্টেনটিনের ঠিক উল্টো।

“সব সময় কি তাই করি না ?” বলতে বলতে নিজের কাস্টম বোউলিং ব্যাগটা বের করে দরজার
সামনে ছোট্ট কিচেন কেবিনেটের ওপরে রাখলো বী ম্যান।

জন গায়ে গরুর ছবি অলা একটা ক্যানের দিকে তাকালো । বী ম্যান তু লে নিলো ওটা হাতে। ও
অনুরোধ করেছিলো ওটার জন্য।

“বাধিত হলাম” বলে ক্যানটা পকেটে রেখে দিয়ে বললো বী ম্যান। তারপর নিজের ব্যাগটা খুলে
সেখান থেকে বের করলো পানিভরা বেলুনের মতো দেখতে হোলি ওয়াটার এর এম্পুল। আর বেশ
কয়েক প্যাকেট লাকি স্ট্রাইক । রাখলো ওগুলো টেবিলের ওপর। কনস্টেনটিন ওগুলো কু ড়িয়ে
নিয়ে, নিজের কোটের পকেটে রেখে দিলো ।

“কেমন বোধ করছ তু মি , জন ?” জিজ্ঞেস করলো বী । মানে হলঃ ডাক্তারের কাছে গেছিলে,
চেকাপ করিয়েছ ?

কনস্টেনটিন ওসব নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী না, ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে বললো “তো , নতু ন কি
আছে ? ”

বী ম্যান ওর ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করতে লাগলো “দামাস্কাসের রাস্তার পাথরের টু করো,
পোপকে হত্যা চেষ্টার বুলেটের খোসা, আহ...... এই যে , এটা পছন্দ হবে তোমার .........”
42

একটা ছোট্ট ম্যাচবক্স বের করলো সে, গায়ের ওপর হাতে বানানো হাসিমুখের একটা পোকার ছবি
“একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার করা গুবরে পোকা, এমিটিভিল থেকে ! ”

সে ম্যাচবক্সটা নাড়া দিলো। হাতে আঁকা গুবরে পোকাটার ডানা একটা ক্লিক শব্দ করে অনেক
দ্রুতগতিতে নড়া শুরু করলো। অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ একটা শব্দ ভেসে এলো, একটা নীরব
চিৎকারের মতো।

কনস্টেনটিন হাসলো একটু ।

“হুম, তোমার জন্য মজারই বটে, কিন্তু ‘ফলেন’ দের কাছে এটাই চকবোর্ডে র ওপর নখ
আঁচড়ানোর মতো শব্দ করবে ! ” বী ম্যান মন্তব্য করলো।

“এই, তোমার সাথে এই পোকামাকড়দের সম্পর্ক টা কি ?”

“আমি স্রেফ ওদের পছন্দ করি , এই তো ”

“হুম, কে করে না” কনস্টেনটিন মৃদু হাসলো। বী ম্যানকে সে পছন্দই করে।

এক সেট ব্রাস নাকল (আঙ্গুলে পড়ার জন্য এক ধরণের অস্ত্র বিশেষ) বের করলো বী ম্যান।
ওগুলো ছিলো খাঁটি সোনার তৈরি আর ওগুলোর গায়ে ক্যাথলিক চিন্হ খোদাই করা। জন পরে
দেখলো , ওর আঙ্গুলে ওগুলো অসম্ভব আরামদায়কভাবে ফিট করে গেলো !

“এই সোনা, বিশপ ‘এনিকট’ ক্রু সেডের সময় আশীর্বাদ করে দিয়েছিলেন। ” জনান্তিকে বললো বী
ম্যান।

কনস্টেনটিন সেগুলো পকেটে ভরে, বী ম্যানের ব্যাগে আরেকটা অদ্ভু ত জিনিসের দিকে নজর
দিলো। সেখান থেকে বের করে আনলো একফু ট লম্বা একটা তামার টিউব, একপাশের ভাল্বটা
আঁকড়ে ধরে বললো “এটা কি , বাইসাইকেলের হর্ন ?”

“ধীরে, হিরো, ধীরে .........”


43

কনস্টেনটিন সেই ভাল্বটা চাপ দিলো , আর সেটা সাথে সাথে ‘হুঊঊঊশ’ করে দশ ফু ট লম্বা
একটা আগুনের হল্কা ছুঁ ড়ে দিলো সামনের দিকে ! পলক ফেললো কনস্টেনটিন, নাক ঘষল
তারপর। বাতাসে সালফার আর সরীসৃপের নিঃশ্বাসের তীব্র গন্ধ ভাসছে !

“এটা হলো ‘ড্রাগনের নিঃশ্বাস’ !”

“আমি ভেবেছিলাম, এটা এখন আর পাওয়া যায় না” বললো কনস্টেনটিন।

বী ম্যান কাঁধ ঝাঁকাল “আমি একজনকে চিনি, সে চেনে আরেকজনকে, সে আরেজনকে...... এই


আর কি !”

এরপর , বের করলো একটা পুরানো , ছেঁ ড়া দেখতে কম্বলের টু করো। কনস্টেনটিন ড্রাগনের
নিঃশ্বাস টিউবটা ওটার পাশে রাখতে গেলো।

হাঁ হাঁ করে উঠলো বী ম্যান “ করো কি, করো কি , জন -- বুম ! এটা হল সেই রোবের টু করো যেটা
মুসা (আঃ) গায়ে দিয়েছিলেন ! অনেক, অনেক দাহ্য ।”

কনস্টেনটিন সাবধানে টু করোটা তু লে নিলো । মুসা (আঃ) কি এটা আসলেই পড়েছিলেন ! সব


স্মরণ-চিন্হই তা হয় না, যা দাবী করা হয় । তবে ও কিছু একটা টের পাচ্ছিলো, প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে
তাকালো সে বী ম্যানের দিকেঃ এটা কি আসল ?

বী ম্যান নড করলো “হাঁ এবং হ্যাঁ । তো , একশন প্ল্যান কি তোমার ?”

কনস্টেনটিন টু করোটা আলোতে পরীক্ষা করতে করতে বললো “আমি সবে একটা সৈনিক
পিশাচকে একটা ছোট্ট বাচ্চার মধ্যে থেকে টেনে বের করেছি। মনে হল, ওটা জাগতিক পৃথিবীর
জগতে প্রবেশ করতে চাচ্ছে !”

বী ম্যান ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। কনস্টেনটিন নিশ্চয়ই, ‘সশরীরে’ বোঝাতে চাইছে না ? !!

“আমি জানি এটা কেমন শোনাচ্ছে ......” বললো কনস্টেনটিন।


44

বী ম্যান নাক দিয়ে একটা শব্দ করে বললো “আমরা ওদের খেলার পাপেট , সেটা ঠিক আছে।
কিন্তু আমরা তো দরজা নই । ওরা আমাদের নিয়ে খেলতে পারে, কিন্তু আমাদের জগতে কখনোই
আসতে পারে না। তু মি জানো সেটা ”

“স্ক্রল গুলি চেক করো তারপরও। এরকম আগেও কোন নজির আছে কিনা , ভালো করে দেখ,
ঠিক আছে ?”

বী ম্যান নড করলো । কনস্টেনটিনের মনে হলো, বেশ মজাই পাচ্ছে লোকটা।

“অবশ্যই, জন। আর কিছু ?”

কনস্টেনটিন কাশলো “তোমার কাছে ......খুক খুক খুক ...... এই বালের কাশির জন্য ......
কিছু............”

বী ম্যান নড করলো। জ্ঞানী ভঙ্গিতে, ব্যাগ থেকে বের করে আনলো একটা বোতল । ভিক্স ফর্মুলা
৪৪ , বললো “অন দি হাউস ”

“ধন্যবাদ , বি । অফিসে বেশ লম্বা দিন গেছে আজ ” কনস্টেনটিন বাতাসে টোস্ট করে, বিশাল এক
চু মুক মারলো কফ সিরাপে।

লস এঞ্জেলসের মাঝখানে, দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল মোচাকৃ তি গম্বুজঅলা বিল্ডিং।


এটাকে রৌদ্রকরোজ্জল লস এঞ্জেলসের চাইতে বাইরের কিছু মনে হচ্ছে। ওটাকে, উনবিংশ
শতাব্দীর ফ্রান্সের কোন বিল্ডিং মনে হচ্ছে, একবিংশ শতাব্দীর শেরম্যান ওকসের চাইতে।

বিল্ডিঙের এক সময়কার সাইন বোর্ড বলছে ‘ক্যাথলিক থিওজফিকাল সোসাইটি’। কিন্তু , এটার
এখনকার প্রধান , এটাকে এখন নাম পাল্টে রেখেছেন ‘ক্যাথলিক থিওলজিকাল সোসাইটি’।
রহস্যবাদ আর ধর্মবাদের বহু পুরানো দন্দ্ব।
45

এঞ্জেলা চোখ তু লে বিশাল , গথিক ভবনটার দিকে তাকালো। সাথে লাগোয়া একটা শিক্ষাভবন
আছে। ভাবলো , এই থিওলজিক্যাল সোসাইটির বদলে , গতানুগতিক কোন চার্চে গেলেই মনে হয়
ভালো হতো ‘কনফেসন’ (পাপ স্বীকার) করার জন্য।

কিন্তু ফাদার গ্যারেট অনেক বছর ধরেই তার পরিবারের বন্ধু মানুষ। এঞ্জেলা ওনাকে বিশ্বাস করে।

“আশীর্বাদ করুন, ফাদার, আমি যে পাপ করেছি তার জন্য ” একটু পর , কনফেসন বুথের ভেতর
বসে বিড়বিড় করছিলো সে। এটা শান্ত, ঠাণ্ডা আর একান্ত গোপনীয় একটা জায়গা। কাঠ পালিশের
ক্ষীণ গন্ধ টের পাওয়া যাবে সাবধানী নাকে। “অনেক দিন হয়ে গেলো...... আমি যদি বলি আমার
শেষ কনফেসন কবে করেছি, আপনি হয়তো আমাকে ছুঁ ড়ে ফেলে দেবেন। আর.........” গলা
শুকিয়ে গেছে এঞ্জেলার। পান করার মতো কিছু থাকলে ভালো হতো আশেপাশে। ও আসলে
বলতে চাচ্ছে না ......

বুথের স্ক্রিনের অন্যপাশে, ফাদার গ্যারেট স্রেফ অপেক্ষা করে রইলেন। ওনার নীরবতাতেই, প্রশ্ন ফু টে
উঠছিল।

“আমি......আমি আজকে আরেকজন মানুষকে খুন করেছি । আরেকজনকে ......”

“আমি খুবই দুঃখিত তোমাকে ওটা করতে হয়েছে, এঞ্জেলা ”

“আমি এমনকি ওর মুখও দেখিনি। আমি স্রেফ ট্রিগার টেনেছি, আর ও নেই হয়ে গেলো, অন্যদের
মতোই !”

ফাদার গ্যারেট একটু ক্ষণ কি ভাবলেন, তারপর গলা খাঁকারি দিলেন। শেষে বললেন “এটা কি ঐ
শুটার, যার খোঁজ তু মি করছিলে ? ”

“হ্যাঁ। ওকে থামানোর দরকার ছিলো। কিন্তু বেশীরভাগ পুলিশই , বছর বিশেকের মতো কাটিয়ে দেয়
কোন বন্দুক না ছুঁ ড়েই। আর খুব কম মানুষই মারা যায় তাদের হাতে। প্রিসিঙ্কটে (থানার আরেকটি
46

নাম) আমাকে ওরা আড়ালে অন্য নামে ডাকে। মনে করে আমি শুনতে পাই না। মাঝে মাঝে,
আমার মনে হয় আমারই কোন সমস্যা আছে। মনে হয় ......... ”

“এঞ্জেলা ! ...... না ! ”

“সম্ভবত আছে কিছু। সম্ভবত...... আমি, অভিশপ্ত !”

একটা পুরো দিন এদিক ওদিক ঘুরে বেরিয়ে আর শপিং করে কাটিয়ে দেয়ার পর, বিকেলে
ঘরে ফিরলো এঞ্জেলা। তদন্তের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছে সে। ঘরের ভেতরে ঢু কে, দরজা
লক করে, নিজের সাবধানে সাজানো এপার্ট মেন্টের দিকে তাকালো। একটু অপেক্ষা করলো ,
তারপর এলো ওটাঃ

ওর ধূসর , দোআঁশলা বিড়ালটা ! ওরা একে অপরকে আদর করে দিন কাটিয়ে দেয়। বিড়ালটা
ওটার ডিশের দিকে এগিয়ে গেলে , ডিশে ক্রিম ঢেলে দিলো এঞ্জেলা। মনে মনে কনফেসনের
কথাবার্তা ভাবছে।

আমি আমার বিশ্বাসের সাথে লড়াই করছি, ফাদার ! কি ধরণের ঈশ্বর আমাকে খুনি হিসাবে দেখতে
চান ?

তোমার পেশায়, এ ধরণের চিন্তাভাবনা আসাই স্বাভাবিক , এঞ্জেলা ! আমি উদ্বিগ্ন হতাম, এগুলো
যদি তোমার মধ্যে না আসতো, তবে।

এঞ্জেলা লাথি মেরে জুতো ছুঁ ড়ে দিলো একদিকে, তারপর সোফায় হেলান দিয়ে বসলো। বিড়ালটা
লাফ দিয়ে কোলে উঠে বসলো।

এঞ্জেলা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ও ক্লান্ত হয়ে গেছে। চোখগুলো ভারী হয়ে আসছে...............
47

কিন্তু তোমাকে শক্তিশালী হতে হবে, এঞ্জেলা। ঈশ্বরের তোমার জন্য আলাদা পরিকল্পনা আছে।
আমাদের সবার জন্যই আছে। তোমার বিশ্বাসকে , অপরাধবোধের ছায়া দিয়ে ঢেকে দিও না।

আমি চেষ্টা করছি, ফাদার। আমি আসলেই চেষ্টা করছি।

ও অনেক ক্লান্ত ছিল............

ও চোখ বুজল, এলো ঘুম। সাথে নিয়ে এলো বার্তা.........

রেভেন্সকার হসপিটালে রাত নেমে এসেছে।

এঞ্জেলা...... এটা কি এঞ্জেলা , এখানে, এই হসপিটাল থেকে ইস্যু করা নাইট-গাউন গায়ে ? ওর
চোখগুলো নির্ঘুম থেকে থেকে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, সারামুখে ঘামের চিন্হ । আর, ভয়
– এঞ্জেলার চেহারায় কি কখনও এতো ভয় দেখা গেছে ? একজন পুলিশের চেহারায় এতো ভয়
থাকলে, অপরাধীরা ওর কাছে সারেন্ডার করবে নাকি ?

এখানে, এঞ্জেলা আনাচে কানাচে তাকাচ্ছে। একজন নার্স একটা নোটিশ লাগাচ্ছে পিন দিয়ে , হল
রুমের দূরতম প্রান্তে জেনিটার ফ্লোর পরিষ্কার করছে। সে ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগোলো, দুই তলা
উঠে , লক ভাঙ্গা লোহার দরজা খুলে বেরিয়ে এলো খোলা ছাদে।

আলকাতরা লেপা ছাদ দিয়ে সে খালি পায়ে দৌড়ে গেলো অন্য প্রান্তের দিকে। এলুমিনিয়ামের
পাত লাগানো রেলিঙের ওপর উঠে দাঁড়ালো সে, তাকালো নিচের দিকে। নিচের হাইড্রোথেরাপি
সেন্টারের ছাদ অনেএএএক খানি নিচে !

একটা ঠাণ্ডা বাতাস এসে ওর গাউনের প্রান্ত নেড়ে দিলো, পাল্টে দিলো গাল বেয়ে নেমে আসা
অশ্রুর গতিপথও।
48

নিচু হয়ে হসপিটাল ব্রেসলেটের দিক্লে তাকালো সে, চেহারা বিকৃ ত করে হাসলো একটু । তারপর
দাঁত দিয়ে ছিঁ ড়ে ফেললো সেটা , উড়িয়ে দিলো উদ্দাম বাতাসে।

আলোময় শহরের মায়াবী আলোকসজ্জার দিকে তাকালো একবার.........

কিন্তু...... ও দেখলো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। সে দেখলো, ঐ মায়াবী আলোকসজ্জা ছাপিয়ে উঠছে
লকলকে আগুন। ঐ লাল আগুন গিলে নিচ্ছে পুরো শহর। দেখলো , আকাশ কালো হয়ে আছে
উড়ন্ত পিশাচের দঙ্গলে, আর নির্দোষ মানুষজনের চিৎকারে ভারী হয়ে আছে বাতাস। সেসব মানুষের
চিৎকার, যারা নিশ্চিত ছিলো , এ ধরণের কোন ঘটনা কখনোই ঘটবে না।

ও হাতের কব্জি ডললো – ঐ চিন্হটা। অদ্ভু ত ঐ গোল চিন্হটা , যেটা জ্বলছে প্রচণ্ড। অন্তরের
অন্তঃস্থল থেকে সে জানে, ওটার মানে কি ! এর মানে হল , ওকে বেছে নেয়া হয়েছে এবার ! কিন্তু,
সে ওটা কিছুতেই হতে দিতে পারে না ............ !!

তাই, ও মনঃস্থির করে ফেলেছে। ছাদ থেকে লাফ দিলো সে। পড়ছে তো পড়ছেই ......... সে
কাঁচের তৈরি ছাদ ভেঙ্গে ঢু কে পড়লো হাইড্রোথেরাপি হল রুমের ভেতর। সারা গায়ে ভাঙ্গা কাঁচ
নিয়ে, পড়লো গভীর সুইমিং পুলের ভেতর। ওর রক্তে লাল হয়ে যাওয়া পানি পাক খেতে লাগলো
সেখানে। শরীর ঝাঁকু নি দিয়ে রক্ত বেরোতে লাগলো । ভাঙ্গা কাঁচের ফাটা দিয়ে রক্ত বেরোতে
লাগলো , এমনভাবে ছড়িয়ে যেতে লাগলো চারদিকে , যে দেখে মনে হল কোন অতিপ্রাকৃ ত প্রাণীর
পাখা যেন ! ওর চোখ তাকিয়ে রইলো , অনন্ত মৃত্যুর কু য়ার দিকে, অপলক.........

এখন সে কিছুই অনুভব করছে না। সে অনন্ত শূন্যের মাঝ দিয়ে নেমে যাচ্ছে .........

ওহ , না !

এঞ্জেলা শুয়ে ছিলো সোফায়। জানালা দিয়ে আসা সকালের আলোয় , চিৎকার করতে
করতে জেগে উঠলো সে ! বিড়ালটা নেমে গেলো কোল থেকে , হতচকিত চেহারা।
49

দুঃস্বপ্নটা, একটা জীবন্ত প্রাণীর মতোই সেখানে ছিলো তখনও। ওর মাথার কাছে আঁকা জীবজন্তুর
পেইন্টিং এর মতোই। সে যেন নিজের ঘাড়ে ওটার গরম নিঃশ্বাস টের পাচ্ছিলো !

আড়মোড়া ভেঙ্গে, আড়ষ্টভাবে উঠে বসলো সে।

স্রেফ একটা স্বপ্ন, এটা সত্যিই ঘটবে, সেটার কোন মানে নেই।

ঐ হসপিটাল, রেভেন্সকার ! ওহ, মাতা মেরী ! এটা হতে পারে না .........

ঐ একই সকালের আলো। আরেক ধরণের দুঃস্বপ্ন , হেঁটে চলে বেড়ানো ধরণের !

কনস্টেনটিন বাথরুম সিঙ্কে থুঃ করে একদলা রক্ত ফেললো ! তারপর, আরও খানিকটা। তারপর
এলো দীর্ঘ , বেদনাদায়ক কাশির দমক। সাথে আরও রক্ত, সেগুলোও ফেললো সে সেখানে।
সেগুলো পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে লাগলো সে। ঐ যে যাচ্ছে আমার জীবন, টু করো টু করো হয়ে, ড্রেন
ধরে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে !

ও নিশ্চিত, আজকের দিনটা খুবই খারাপ যাবে। কারণ সকালটা অত্যন্ত বাজে গেছে। আজ
তোমার জীবন শেষের প্রথম দিন ......... !!

ও আয়নার দিকে তাকালো, অনকোলজিস্ট (ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ) ঠিকই বলেছিলো !

মৃত্যু নিয়ে ওর ভয় পাওয়া উচিত নয়। ছোটবেলায়, ও যখন অদেখা ভু বনের দেখা পেয়েছিলো,
নানান ধরণের অদেখা জিনিসের দেখা পেয়েছিলো, তখনকার কথা মনে পড়লো ওর। তখন , ওর
একটা জ্ঞান ছিলো , যেটা অন্য কারো ছিলো না – সে জানতো , পরকাল বলে একটা জিনিস
আছে ! সে এটা নিশ্চিতভাবে জানতো, সে দেখেছিলো সেটা ! সেই অন্য ভু বনের জানালা ওর
কাছে সবসময়ই খোলা ছিলো ! সেসবের মধ্যে, সব জায়গাই খারাপ ছিলো না !
50

তাই, ঐ সময়ে অন্যদেরকে যা যা ভীত করে তু লতো , ওকে তেমন ভয় লাগাতে পারতো না !
অন্তত তখন নয়। মৃত্যুকে ভয় পেয়ে লাভ কি, আপনি যদি সত্যিই মারা না গিয়ে থাকেন ? ও
নিশ্চিত ছিলো, নিজের মৃত্যুর পর, ঐ ভালো জায়গাগুলোর একটাতে সে যেতে পারবে । তেমন
কঠিন কিছু ছিলো না । শুধু বাজে ব্যাপারে জড়িয়ে না গেলেই হল । অভিশাপ দাও, তু মি
অভিশপ্ত হবে না !

ঐ সময়ের জীবনের কথা চিন্তা করতেই কষ্ট লাগে এখন। উন্মাদগ্রস্থ জীবন যাপন। ওর বাবা মা,
রাস্তাঘাটের জীবন।

ও লড়াই করতে শিখেছিল – দুই জগতেই। তোমার ‘বিশেষ গুণ’ গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখো,
এক জাদুকর বলেছিলো ওকে – নয়তো সেগুলোই তোমাকে ধ্বংস করে দেবে !

ও সাদা আর কালো – দুই ধরণের জাদুই শিখতে চাইতো। সাধু সন্তের জীবনও বেছে নেয়নি, কোন
ধরণের কৃ চ্ছতা সাধনের পথেও হাটে নি সে। কিন্তু সে ছিলো শক্তিশালী আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ । সে
অনেক কঠোর পরিশ্রম করেছে যেসব স্বর ওকে তাড়া করে ফেরে, সেসব কণ্ঠকে নিয়ন্ত্রণ করা
শিখতে। যে অদৃশ্য শক্তির বলয় ওর চারপাশে ঘূর্ণি বাতাসের মতো পাক খেয়ে বেড়ায়, সেসবের
ওপর দখল আনতে। ছোট জাতের শিক্ষকদের কাছে , যারা কিনা টাকার বিনিময়ে শেখাত।
অভিজাত শিক্ষক দের কাছেও, যারা কিনা ওর আত্মার ভেতর পুষে রাখা রাগকে অনুকম্পার
চোখে দেখতেন।

অকাল্টের ওপর লেখা প্রত্যেকটা বই পড়েছে সেঃ ফ্লু ড আর ফ্লামেল, প্যারসেলসাস এবং
প্লটিনাস (আলকেমি আর দর্শন) , প্রাচীন সন্তদের কাহিনী আর সোনালি সকালের কথা। আইসিসের
মিথ, আর দিব্যতত্ব আর ধর্মতত্ত্বের যত রহস্য। ল্যাটিন, গ্রিক আর সংস্কৃ ত শিখেছে , যাতে মূল
পুঁথি গুলো পড়তে পারে, আর যথেষ্ট সতর্ক ছিলো এসব ব্যাপারে।

কিন্তু, এরপর ওর জীবনে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেলো – সবকিছু খারাপের দিকে যেতে
লাগলো কেবল। ও একটা মারাত্মক ভু ল করে বসলো , আর ............
51

আর এখন মারা যাবার জন্য খুব একটা সুবিধার সময় না ! ঐ ঘটনার পরে, ওর সাথে যেটা ঘটতে
চলেছে, সেখান থেকে বের হবার উপায় এখনও ও খুঁজে বের করতে পারেনি।

আরেকবার কেশে আরও একদলা রক্ত ফেললো সে সিঙ্কের ভেতর “ইন্ডিয়ানদের নিকু চি করেছে!
আজকে মরার জন্য মোটেই ভালো দিন না !”

চার

মেক্সিকালি’র বাইরে, মেক্সিকো

পুরানো ফোর্ড পিকআপ’টা , সন্ধ্যার রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো গর্ত ভরা রাস্তা পেরিয়ে।
ঘনবসতিপূর্ণ, ধূসর টাইলসে ঢাকা ছাদঅলা বাড়িঘর পেরিয়ে এগিয়ে গেলো সেটা। আরেকটু কম
বসতিঅলা এলাকায় চলে এলো যেখানে ওয়ারহাউজ, গ্যাস স্টেশন, স্ট্রিপ জয়েন্ট আর ক্যানটিনা
রয়েছে অনেক।
52

পিকআপটার পেছনে, কার্ড বোর্ড বাক্স আর চটের বস্তার মাঝখানে, ফ্রান্সিস্কো সন্ধ্যার বাতাসের স্বাদ
নিচ্ছিলো। ও এমনকি ট্রাকের এক্সস্ট , উড়ে যাওয়া ধুলোরও স্বাদ নিচ্ছিলো। একটা নতু ন জীবন।
উত্তরের জীবন।

ঐ যে, আড়াআড়ি পথ !

ফ্রান্সিস্কোর কব্জিতে খোদাই করা আকৃ তিটা হঠাৎ জ্বলতে শুরু করলো আর কাঁপতে শুরু করলো
!

ঐ পথে , ফ্রান্সিস্কো। এই পথে না। বর্ডার গার্ডে রা তোমাকে আটকে দেবে। প্রথমে পূবে, তারপর
উত্তরে যাও।

কিন্তু ...... কিন্তু এই মেক্সিকালি’তেই নয় কেন ? এই ধরণের শক্তি দিয়ে ও সব গ্যাং’কে হাতের
মুঠোয় নিয়ে নিতে পারবে। ও টাকা জোগাড় করে, ভু য়া পরিচয় আর পাসপোর্ট বানিয়ে নিতে পারে

কিন্তু ওর কব্জিতে থাকা প্রতীক অনেকখানি গরম হয়ে উঠেছে। আর আবার, সে শুনতে পেলো
বিজবিজ শব্দ, চাবানোর শব্দ, দশ লক্ষ মুখ যেন চিবোচ্ছে ধীরে ধীরে কি জানি...... তারপর ঐ
ফিসফিসানি.........

না, ফ্রান্সিস্কো ! কোন দেরী নয়, আমেরিকা – যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। লস এঞ্জেলস ...... গৌরব
অপেক্ষা করছে সেখানে । গৌরব আর শক্তি .........

ট্রাকটা আড়াআড়ি পথ পেরিয়ে যাবার সময় একটু লাফিয়ে উঠলো ।

“থামো” ট্রাকের ছাদে ধুম ধুম করে বাড়ি দিলো সে “ক্রসরোড ! এখানে থামো , অথবা পূবে
যাও।”

ক্যাবের ভেতর থেকে জবাব শুনতে বেশ কষ্টই হলো “প্রথমে আমরা যাবো......... চাচাতো ভাইয়ের
কাছে ............ আরও বেশী টাকা দিতে হবে............”
53

“আমি এক পয়সাও দেবো না !” ফ্রান্সিস্কো খেকিয়ে উঠলো। সে বুঝতে পারলো, এই ব্যাটা ওকে
বন্দী করে রাখতে চাচ্ছে ! এটা মানুষের সাথে প্রায়ই হয়, ওর নতু ন কাপড়চোপড় দেখে ব্যাটা হয়তো
মনে করেছে, কোথাও না কোথাও ও টাকা লুকিয়ে রেখেছে।

সেই ভীষণ চিবানো , গুনগুন আর কানে তালা ধরানো বিজবিজ শব্দ বহুগুণ বেড়ে গেলো – যখন
ফ্রান্সিস্কো ওর কোটের পকেট থেকে সেই লোহার স্পাইকটা বের করলো। তারপর ট্রাকের পেছনের
জানালা ভেঙ্গে ফেললো। ভারী কাঁচগুলো স্রেফ কাগজের মতো ফেড়ে গেলো ওর হাতের ছোঁয়া
পেয়ে ! ও চিৎকার করতে থাকা দাড়িঅলা ড্রাইভারের গলা পেছন থেকে টেনে ধরলো জোরে।
তারপর একটা জোরালো তীক্ষ্ণ টান দিয়ে , ড্রাইভারের মাথাটা পেছনের জানালার ফ্রেমের সাথে
থেঁতলে দিলো !

ট্রাকটা হঠাৎ গতিপথ পাল্টে ফেলায়, ফ্রান্সিস্কো জানালা ধরে টাল সামলালো। সেটা একপাক ঘুরে,
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। সে নেমে, ড্রাইভারের দরজা খুললো। ড্রাইভারকে একটানে ক্যাব থেকে
মাটিতে ছুঁ ড়ে ফেললো , তারপর উঠে বসে ট্রাক ছেড়ে দিলো । ক্রসরোড ধরে, পূবে যাওয়া শুরু
করলো। মরুভূ মির মাঝ দিয়ে একটা পথ খুঁজে নিতে হবে ওকে – উত্তরের দিকে।

লস এঞ্জেলস , রেভেন্সকার হসপিটাল

এঞ্জেলা টের পেলো, শঙ্কার একটা ঢেউ ওর মেরুদণ্ড বেয়ে উঠে যাচ্ছে । ও হেঁটে যাচ্ছে
হাইড্রোথেরাপি সেন্টারের ভেতর দিয়ে, ছোট স্পা গুলো পার হয়ে ভেতরের সুইমিং পুলের দিকে।
পুলের পাশে একদল ইউনিফর্মধারী পুলিশ জটলা করছে। ওরা দুজন পুরুষ নার্সকে ঘিরে দাঁড়িয়ে
আছে, যারা কিনা একটা শরীরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।

ডিটেকটিভ জেভিয়ার ছিলো সেখানে, ওর কাঁধ আর বাহু ব্যান্ডেজ করা, আসতে দেখলো সে
এঞ্জেলাকে। এঞ্জেলা ওকে পার হয়ে গেলো, কথা বলতে চায় না ।
54

“এঞ্জি !” জেভিয়ার বললো “তোমার এটা দেখার দরকার নেই......... ”

এঞ্জেলা উপেক্ষা করলো ওকে, ভাবছে। আসলে, জেভিয়ারেরই এখানে থাকা উচিত নয়। ওর
বিশ্রামের প্রয়োজন, কিন্তু ও তো ঘরে বসে থাকার ছেলে নয়।

সে হেঁটে হেঁটে শরীরটার দিকে এগোতে লাগলো । করোনার হলেন একজন চাইনিজ লোক, ঝেন
নামের এক ডাক্তার। সে এঞ্জেলার দিকে তাকালো , একটু ইতস্তত করলো, তারপর লাশের
ওপরের ঢাকাটা তু লে দিলো ।

“না, না , না, না ............” এঞ্জেলা নিজেকে বলতে শুনলো “না, ইসাবেল.........”

সে লাশের পাশে হাঁটু গেড়ে বসলো । ওর চোখ বেয়ে বোনের ফ্যাকাসে, ক্ষত বিক্ষত চেহারার ওপর
কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়লো। ওর যমজ বোন, ইসাবেল, একটা রক্তাক্ত নাইট গাউন পরা। ঐ
স্বপ্নটা সারা সকাল ওকে তাড়া করে ফিরেছে। ও জানতো, এমনকি রেভেন্সকার হসপিটাল থেকে
একটা আত্মহত্যার খবর শোনার অনেক আগে থেকেই। যে ঐ স্বপ্নটা সত্যিকারেরই ছিলো, আর
সেটা ছিলো ইসাবেল সংক্রান্ত, এঞ্জেলার নিজের ব্যাপারে নয়। কিন্তু, ইসাবেল , এঞ্জেলার আত্মার
একটা অংশের মালকিন ছিলো ! জমজদের জন্য, এটাই সত্যি।

নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে, সে তাকালো ইসাবেলের কব্জির দিকে। স্বপ্নে , একটা চিন্হ দেখতে
পেয়েছিলো ও বোনের কব্জিতে। ওটা এখন দেখা যাচ্ছে না।

ওর মনে হলো, ওর মন ভেঙ্গে টু করো টু করো হয়ে গেছে। মৃত্যু এমনই অকাট্য , এবং প্রশমনের
অতীত। ও আর কখনও ওর বোনকে সান্ত্বনা দিতে পারবে না। ও সেই সপ্তাহেই বোনকে দেখতে
আসবে ভেবেছিলো ..................

এঞ্জেলা টের পেলো, ওর পেছনে জেভিয়ার দাঁড়িয়ে আছে। নিজের স্বর ফিরে পেতে রীতিমতো
সংগ্রাম করতে হলো ওকে, বেশ কয়েকবার ঢোঁক গিলে তারপর বললো “ও............ কি ছাদ
থেকে পড়ে গেছে ?”
55

জেভিয়ার একটু ইতস্তত করলো, তারপর স্বীকার গেলো “ও লাফ দিয়েছিলো !”

লাফ দিয়েছে ? না, ইসাবেল কখনও এটা করবে না, অন্তত ওর বিশ্বাস মতে না।

“আমি জানি এটা মেনে নেয়া খুব কষ্টের ” জেভিয়ার আস্তে করে বললো “কিন্তু সে অসুস্থ ছিলো
......”

ইসাবেল কখনও নিজেকে খুন করবে না।

“এঞ্জি......”

“সে কখনও এটা করতে পারে না, কথা শেষ !”

“ডিটেকটিভ ” জেভিয়ার বললো এই একটা শব্দের ওপরেই জোর দিয়ে “সারভেইলেন্স ক্যামেরার
ফু টেজ আছে............”

এঞ্জেলা করোনারকে ইশারা করলো লাশটা আবার ঢেকে দিতে।

চাকরিটা, নিজেকে বললো এঞ্জেলা , ওটার সাথেই ঝু লে থাকো আপাতত। তু মি ইতিমধ্যে


গানফাইটের জন্য অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে আছো। এখন ভেঙ্গে পোড় না।

“সারভেইলান্স ? সিকিউরিটি ক্যামেরা ? তাহলে...... আমি দেখতে চাই ওটা ”

জেভিয়ার শ্বাস ফেললো একটা “তু মি নিশ্চিত নিজেকে ওটার ভেতর দিয়ে যেতে দেবে তু মি ?”

“স্রেফ ব্যবস্থা করো। প্লিজ, আমার জন্য !”

“ঠিক আছে। এক্ষু নি করা যাবে। সিকিউরিটি দোতলায়। ”

এঞ্জেলা ঘুরে দাঁড়ালো, তারপর নিজেকে বাধ্য করলো বোনের মৃতদেহ পেছনে ফেলে যেতে।

কিন্তু ওকে পরিত্যাগ সে করতে পারবে না কখনও, জীবিত অথবা মৃত।


56

রেভেন্সকার হসপিটালের একটা বেশ বড়সড় ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ বিভাগ আছে, যেখানে
ইসাবেল মারা গেছে। কিন্তু হসপিটালের বাকিটা, কার্ডি ওলজি আর অনকোলজি’র (হৃদরোগ আর
ক্যানসার) এর জন্য বরাদ্দ। ক্যান্সার এর কেমো দেয়ার পরে, রোগীদের রাখা হয় ছোট ছোট রুমে।
সেখানে শেষ অবস্থার রোগীরা অপেক্ষা করে শেষ ডাক্তারের জন্য, যার নাম মৃত্যু !

কনস্টেনটিন সেরকম একটা রুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় ভেতরে উঁকি দিলো । খোলা দরজা
দিয়ে দেখতে পেলো , একজন কৃ শকায় , চু লহীন মাথার মহিলা শুয়ে আছে একটা কটে। তাকিয়ে
আছে শূন্য দৃষ্টিতে, ওয়াল মাউন্টেড টিভি’টা দেখছে বলে মনে হচ্ছে না।

অন্তিম অবস্থায় এসে, এটা স্রেফ জীবনটা কেড়ে নেয় না কেন ? সে আশ্চর্য হয়ে ভাবলো। ঈশ্বরকে
কেন এইসব দুর্দ শা টেনে নিয়ে যেতেই হবে ?

সে টের পেলো, নিজের অজান্তেই একটা সিগারেট বের করে ফেলেছে সে ! সেটা এ আঙ্গুলে ও
আঙ্গুলে নড়াচড়া করতে করতে ভাবলো – ডাঃ আর্চারের চোখে এটা পড়াটা ঠিক হবে না । ওটা
সরিয়ে রেখে, এক্সামিনেশন রুমের ভেতরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো ।

হসপিটালের অন্য একটা অংশে, সিকিউরিটি স্যুইটের ভেতরে, এঞ্জেলা একটা সুইভেল
চেয়ারে বসে আছে। তাকিয়ে আছে একটা ভিডিও মনিটরের দিকে, আশা করছে, সে যদি ভারী
ওষুধে আচ্ছন্ন থাকতো !

সে দেখছে, তার নিজের যমজ বোন ছাদের এলুমিনিয়ামের ধারের ওপর উঠেছে। এদিক ওদিক
তাকাচ্ছে।

রোগীর ব্রেসলেট খুললো হাত থেকে, বাইরের রাতের দিকে তাকালো। মাথা নাড়লো একবার ,
কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকালো। তারপর , কিনারা থেকে, ধীরেসুস্থে, ইচ্ছাকৃ ত ভাবে , লাফ
দিলো। সামনের দিকে ডিগবাজি খেয়ে, স্রেফ নেই হয়ে গেলো !
57

এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ছেড়ে এঞ্জেলা বলে উঠলো “ওহ !”

কাঁধের ওপর একটা সান্ত্বনাসূচক হাত এসে পড়ায়, কেঁ পে উঠলো সে ।

জেভিয়ার বললো “হেই, এঞ্জি ? ফোরম্যানের সাথে কথা বলো—তোমাকে কিছুদিনের ছুটি দিয়ে
দেবে সে, হেল, কিছু সপ্তাহও হতে পারে ......... ”

এঞ্জেলা মাথা নেড়ে, কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে দিলো। তারপর ফিরে তাকিয়ে দেখলো , জেভিয়ার
রুমের অন্য প্রান্তে দুইজন সিকিউরিটি গার্ডে র সাথে দাঁড়িয়ে আছে। সে সেখান থেকেই কথা
বলেছে ওর সাথে । তাহলে , ওর কাঁধে কে হাত রেখেছিলো ? !!

কনস্টেনটিনের মৃত্যুটি দেখতে, একটা উজ্জ্বল সাদা বক্সের ভেতর লেপা কালো দাগের
মতো ! ঠিক যেন একটা মাকড়শা অপেক্ষা করছে , এটার জালের ভেতর।

লাইট বক্সগুলি আলো ফেলছে ওর বুকের এক্সরে-র ওপর, ভূ তু ড়ে নৈর্ব্যক্তিকতার সাথে । একটা
কালো দাগ ছড়িয়ে গেছে দুই ফু সফু সেই। কনস্টেনটিন ওটার দিকে তাকিয়ে রইলো , ওর মনে হলো
, এটা দেখতে ‘রুন’ বর্ণমালার একটা অক্ষরের মতো !

এটা ওর সাথে প্রথমবার হচ্ছে না। ও হয়তো কোন আধ্যাত্মিক আক্রমণের শিকার হয়েছে। ওর
পুরানো শত্রুদের মধ্যে কেউ ওকে এই অসুস্থতা দিয়ে অভিশাপ দিয়েছে ! এটা আরও সরাসরি
আক্রমণও হতে পারে, একটা আততায়ী আত্মা হয়তো ছদ্মবেশে বাসা বানিয়েছে ওর রক্তমাংসে !
ও নিজেকে রক্ষা করে চলে সব সময় , সেটা ঠিকই আছে। কিন্তু মন্ত্র আর মন্ত্রপূত এমুলেটগুলি
হচ্ছে কম্পিউটার ‘ফায়ারওয়াল’ এর মতো। ওদেরকে ‘হ্যাক’ করা সবসময়ই সম্ভব !

কিন্তু সেরকম কিছু হলে ও টের পেতো। সেরকম কিছুই ও টের পাচ্ছে না , এতো দীর্ঘ সময় ধরে
ধূমপানই , ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট ছিলো।

“আরও আশাপ্রদ কিছু তোমায় দেখাতে পারলে খুশি হতাম, জন ” ডাঃ আর্চার , সাদা কোট পরা
মহিলা ডাক্তার বললেন। তিনি ওর অনেকদিনের চেনাশোনা মানুষ।
58

“যেসব জিনিসকে আমি লড়াইতে হারিয়েছি !” কনস্টেনটিন বললো ধীরে ধীরে , এক্সরে গুলির
দিকে তাকিয়ে “সেসব জিনিসের অধিকাংশের নামই মানুষ কখনও শোনেনি ! আর , এখন এই
ক্যান্সার আমার বারোটা বাজিয়ে দিলো ?”

“তু মিই প্রথম নও, জন”

“কাম অন। তু মি আমাকে আগেও বাঁচিয়েছ ! তু মি আবারও সেটা করতে পারবে, তাই না ?”

“এটা............ এটা বেশ আক্রমণাত্মক !”

মানে হলো, অনেক দেরী হয়ে গেছে ! কনস্টেনটিন শ্বাস ফেলে বললো “তত সহজ নয়, তাই না?”

আক্রমণাত্মক ! বেশ ইন্টারেস্টিং শব্দ , কনস্টেনটিনের জীবন চিন্তা করলে।

কনস্টেনটিন গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলো , ওর নিজের জাদু ওকে রক্ষা করতে পারবে না। ও
ওপরের থেকে শক্তি নিয়ে চলাফেরা করলেও, ওগুলি ওকে এ পর্যন্তই বহন করে এনেছে।
ক্যান্সারকে সত্যিকার অর্থেই ধ্বংস করতে হলে, ওর দরকার একটা মিরাকল । আর ঈশ্বরের
খাতায়, ও লেজারের সঠিক দিকে নেই আসলে ! যেখানে থাকলে , কালেভদ্রে একটা আধটা
মিরাকল কপালে জুটে গেলেও যেতে পারতো !

ও নিজেকে সুস্থ করে তোলার জন্য জাদু প্রয়োগ করার সময় এক ধরণের বাধা অনুভব করে। সে
ভাবে, এটা হয়তো সম্পূর্ণ মানসিক একটা বাধা। কারণ জাদুকরের মন , জাদু করার ক্ষেত্রে সব
সময় সমস্যা তৈরি করে। জাদুকরের মন, একটা নির্দি ষ্ট অবস্থায় থাকতে হয়, জাদু করার জন্য। কিন্তু
কনস্টেনটিন আত্মধ্বংসী মুডে ছিলো দীর্ঘদিন ধরে। ওর আশেপাশে , অনেক অনেক বেশী
লোকজন মারা গেছে । ঐ বিবর্ণ ভূ তটা, যেটাকে রাস্তায় দেখেছিলো, ওটার কাছে ফেল মেরেছিল
সে। আরও আরও লোকজন যারা মারা গিয়েছে। নিজেকে ব্যার্থ হতে দেখে, হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে
গেছে সে। সেটা ওকে আরও অনেক বেশী দুর্বল করে দিয়েছে।
59

কিন্তু , এটা সেরকম না-ও হতে পারে। হয়তো অন্ধকারের শক্তিরা ওকে সরাসরি আক্রমণ করেনি।
ওরা সারিয়ে তোলার আত্মাদেরকে আটকে দিচ্ছে , ও যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছে তখন !

আর, ওর বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, নরকের বাসিন্দারা ওকে মৃত দেখতে চায় ! ওরা
ক্ষু ধার্ত মনে ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে ! ওদের কাছে , ওর অনন্তকালের নরকভোগ পাওনা
আছে, ওদের অনেক পরিকল্পনা ব্যার্থ করে দেয়ার জন্য !

ও তাকিয়ে রইলো নিজের ফু সফু সের কালো দাগের দিকে, লাইট না নেভানো পর্যন্ত। অসুস্থ ফু সফু স
অদৃশ্য হয়ে গেলো। ও স্রেফ বসে রইলো সেখানে, শূন্যের দিকে তাকিয়ে।

“বিশ বছর আগেও, তু মি এখানে থাকতে চাইতে না , কনস্টেনটিন ! ” ডাঃ আর্চার বললেন,
দুঃখিত চেহারায় “আর এখন তু মি যেতেই চাইছ না ! তোমার আমার কথা শোনা উচিত ছিলো ।”

কনস্টেনটিন একটা লাকি স্ট্রাইক ধরালো, আর্চার যদি ওকে সুচই ফোটায় ............

আর্চার নাক দিয়ে একটা শব্দ করে চাইলো সিগারেটের দিকে “এটা ভালো নয় !”

একটা লম্বা, প্রতিহিংসাপরায়ণ টান, এটা ভালোই বোধ হল । তারপর, এটা ওকে দীর্ঘ , ভেজা
কাশির পথে টেনে নিয়ে গেলো।

কোটের পকেট থেকে ভিক্সের বোতলটা বের করে , সেটা থেকে ঢক ঢক করে গলায় ঢালল
কনস্টেনটিন। কাশি একটু শান্ত হল। আরেক ঢোক গিলে, একটা ধোঁয়ার রিং ছাড়ল ওপরের দিকে।
স্টেইনলেস স্টিলের ট্রে-তে টিপে নেভাল সিগারেট।

আর্চার ধোঁয়া তাড়িয়ে দিলো হাত দিয়ে, কাশতে কাশতে বললো “জন – তোমার তৈরি হওয়া
দরকার। ব্যাবস্থা করো। ”

বিষণ্ণ একটা হাসি দিলো কনস্টেনটিন। দরজার দিকে যেতে যেতে বললো “দরকার নেই। আমি
জানি আমি ঠিক কোথায় যাচ্ছি !”
60

এঞ্জেলা হলওয়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো , লিফটের খোঁজে। সে কেবল এই হসপিটাল থেকে
বেরোতে চাইছিল। কেবল রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলো না ! সে এখানে অনেকবার এসেছে, কিন্তু এখন,
ওর কাছে সবকিছু কেমন অদ্ভু ত ঠেকছে। মাথার ওপরের ফ্লু রোসেন্ট লাইটগুলি যেন একটু বেশী
শব্দ করছে না ? অপারেটিং রুমের বাইরে, একটা চাকা লাগানো , সাদা কাপড় ঢাকা টেবিল দাড়
করানো ছিলো। ওর মনে হলো, ও যদি কাপড়টা ওঠায়, তাহলে ভয়ংকর কিছু একটা দেখবে !

হাস্যকর !

এই লিফটগুলি কোথায় ?

ওর মনে পড়লো , ওর মা যখন মারা গিয়েছিলেন। প্রথমে সে কিছুই অনুভব করেনি, বা সেরকমই
সে মনে করেছিলো। কিন্তু পরের কয়েক সপ্তাহ, সে চালচলনে বেশ ঢিলে হয়ে গেছিলো, সব সময়
হাত থেকে জিনিস পত্র ফেলে দিতে লাগলো। শেষমেশ সে উপলব্ধি করতে পেরেছিল, যে , সে
এতোটাই আবেগী হয়ে পড়েছিলো যে – বুঝতেই পারেনি । সেটা থামাতে গিয়ে নিজের ওপর প্রায়
নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। যতক্ষণ না সে, সেই কষ্টের মুখোমুখি হয়নি, এই অবস্থা থেকে ও নিস্তার
পায়নি।

এটা আবার ঘটছে – হসপিটালে সে হারিয়ে গেছে কারণ ----

ইসাবেল মারা গেছে। সে আসলেই চলে গেছে। করোনারকে বলতে শুনেছে সে – গ্লাসগুলোই
সর্বনাশটা করেছে। ওগুলো , ওর গলা কেটে ফেলেছে। রক্তপাতের ফলে , ঐ পুলেই ওর মৃত্যু
হয়েছে।

এঞ্জেলা কেঁ পে উঠলো, ঈশ্বর ! ও এই জায়গা থেকে বেরোতে পারলে বাঁচে ।


61

একটা লিফটের দরজা ‘টিং’ করে উঠলো। এঞ্জেলা কোণ ঘুরে দ্রুত এগোল ওটার দিকে। ঐ যে,
একজন ফ্যাকাসে দেখতে লোক, এলোমেলো কালো কোট গায়ে লিফটের ভেতরে ঢু কে যাচ্ছে।
দুদিনের না কামানো দাড়ি গালে, বুনো , অবিন্যস্ত ভাব ভঙ্গি।

“দাঁড়ান ” এঞ্জেলা চিৎকার করলো “দরজাটা ধরুন ”

ও কেবল কয়েক পা দূরে ছিলো। লোকটা স্রেফ ওর দিকে একবার তাকালো, চোখ পিটপিট করছে।
মুখের সামনে হাত তু লে রেখেছে কাশি ঠেকানোর জন্য ।

“আপনি নিচে যাচ্ছেন ?” এঞ্জেলা জিজ্ঞেস করলো, প্রায় পৌঁছে গেছে।

“যদি অন্য কোথাও যেতে না পারি , তবে তাই ” লোকটা বললো। দরজাগুলি বন্ধ হয়ে গেলো
এরপর।

ঐ উজ্জ্বল বিকেলে , হলিউড বুলেভার্ডে যেন মানুষের মেলা বসে গেছিলো। ওখানে ছিল
সাতজন হাস্যোজ্জল জাপানি টু রিস্ট , এক বাস ভর্তি জার্মান টু রিস্ট , যারা কিনা বের হয়েছিলো
রাস্তার পাশে হাঁটতে থাকা পছন্দের তারকাদের সাথে ছবি তু লবে বলে। আরও ছিলো দুজন পাঙ্ক
রকার মেয়ে , তাদের এঁটু লি ওঠা কু কু র সহ ভিক্ষা করার জন্য । ছিলো এক লোক, যে কিনা
পানিভর্তি কনডম নিয়ে জাগ্লিং করছিলো, একজন কালো লোক যে ফ্রি স্টাইলে র‍্যাপ গান
গাচ্ছিল, একটা হোস্টেল থেকে আসা টিনএজ পোলাপান, যারা কিনা একটা পাইপে গাঁজা
টানছিল, আর থোড়াই কেয়ার করছিলো বাকিদের। ছিলো এক উঠতি নায়িকা, সিলিকন দিয়ে ভারী
করা বুক আর ভীষণ আঁটসাঁট কাপড় পরা , উজ্জ্বল সোনালি রঙা চু লে যেন আগুন লেগেছে।

কিন্তু ফাদার হেনেসিই এদের সবার চাইতে বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন !

বেগুনি স্কার্ফ পরা এক মেক্সিকান মহিলা, ওর ছোট্ট ছেলেটাকে স্বামীর সুভেনির শপে তাড়া দিয়ে
ঢোকাতে ঢোকাতে , ফাদারের দিকে তাকালো। তারপর একটা অদৃশ্য ক্রস আকলো উনি পার
হবার সময়। হেনেসি বুঝতে পারলেন , মহিলা ক্রস এঁকেছে তিনি যাজক বলে নয়, ক্রস এঁকেছে
62

কারণ ওনার মধ্যে কিছু একটা ঠিক নেই ! একজন জাপানি মেয়ে ওঁর ছবি নিলো। আরেকজন
হিজড়া টাইপের লোক, ওঁর কাছ থেকে ছিটকে সরে গেলো, পালাতে পালাতে বারবার পেছন ফিরে
দেখছিলো লোকটা।

লোকেরা অভিশপ্ত লোকজনকে চিনতে পারে, যাজক ভাবলেন। একটা পর্যায় পর্যন্ত , ওরা ঠিকই
চিনতে পারে !

একটা সুভেনির শপ আর ইলেকট্রনিকসের দোকানের মাঝের সরু সিঁড়ি দিয়ে , নিজের স্টু ডিও
এপার্ট মেন্টে উঠে এলেন হেনেসি। ওনাকে অন্য কোথাও বাসা করতেই হবে। কিন্তু জায়গাটাকে
ঠিকভাবে সুরক্ষিত করে নিতে হবে আগে। যাজকদের বাসস্থানে যেটা ওনাকে কেউ করতে দেবে না
!

তিনি ওপরের তলায় ফিলিপিনো বাড়ি-উলি’কে ওনার স্বামীর সাথে বাদানুবাদ করতে শুনলেন।
তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ভেতরে সেধিয়ে গেলেন তিনি। বেটি এসে না আবার ভাড়া চেয়ে বসে ! দুই
সপ্তাহ দেরী হয়ে গেছে এরই মাঝে।

ঢু কেই, গতানুগতিক প্রার্থনা গুলো আউরে গেলেন তিনি। কিন্তু ভেতরে অহর্নিশি ছেড়ে রাখা
টেলিভিশনের শব্দে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটলো তাঁর।

বিছানার পাশে, একটা টেবিলে রাখা সেটা। পাশেই বোতলের ছড়াছড়ি, একপাশে জেরি স্প্রিঙ্গার
শো এর পোস্টার। সেটাই চলছে টিভি-তে । এই শো গুলি পৈশাচিক লাগে হেনেসির কাছে, কিন্তু
ঐ কন্সুয়েলার সাথে যা ঘটেছে, সেটা বেশ অন্যরকম একটা ব্যাপার ছিলো !

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো জন কনস্টেনটিন , যে কিনা কোণ যাজকই নয়, সফল হয়েছে ,
যেখানে তিনি নিজে ব্যার্থ হয়েছেন। কিন্তু ওখানে, খুব কম পাদ্রীই সফল হতে পারতেন। কনস্টেনটিন
ঠিকই বলেছিল। ওখানে স্বাভাবিকের চাইতে বেশী কিছু একটা ছিল অবশ্যই।
63

নিয়ে আসা বোতলে হামলা চালালেন তিনি। কিন্তু ওটা খালি হয়ে গেছে। ওয়ার্ড রোব এর ড্রয়ার
থেকে আরেকটা বোতল বেরোল । সেটাতে চু মুক দিতে দিতে ঘরের চারপাশের আবর্জ নার দিকে
নজর চালালেন তিনি। ঠিক একটা ডাস্টবিনের মতো দেখতে হয়েছে ঘরটা, বাড়ি উলি এসে দেখলে
আরেক দফা চিৎকার চেঁ চামেচি শুরু করে দেবে। দেয়ালের প্রত্যেকটা ইঞ্চিতে এলুমিনিয়াম ফয়েল
লাগানো, দুই প্রস্থ করে। হলুদ রঙের খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনের স্তূ প হয়ে আছে চার পাঁচ
ফিট উঁচু হয়ে। সব আসবাবপত্রে ম্যাজিক মার্কার দিয়ে নানান ধরণের চিন্হ আঁকা ।

জন এইগুলো সরিয়ে ফেলার পক্ষপাতী থাকবে। এগুলো নাক্ষত্রিক সংকেতকে দুর্বল করে দেয়।

ওঁর এ ব্যাপারে খুব খারাপ অনুভূ তি হচ্ছে। ওনার কনস্টেনটিনকে বলা উচিত ---

হুম, নাহ ! সেটা ওকে বলাটা ঠিক হবে না। কিন্তু, সে পরাবাস্তব আর নাক্ষত্রিক জগতে খোঁজাখুঁজি
করার ব্যাপারটাতে না করতে পারে। কাগজে কাগজে কোন অকাল্ট সংক্রান্ত ঘটনা খোঁজাটাও
বাতিল করে দিতে পারে। এটা ‘শুঁকতে থাকা’ সত্ত্বাদের ওঁর কাছে টেনে আনবে। আর, ওইসব
ভয়াবহ শুঁকতে থাকা সত্ত্বাদের আবার দেখার কথা ভাবতেই ওঁর গায়ের রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে !

“এটা করতেই হবে” নিজে নিজেই বিড়বিড় করলেন তিনি “ওয়ে জন। ও আমাকে পয়সা দেবে,
সেটা দিয়ে ঘর ভাড়া দেবো। ” আরেকটা কারণ আছে। যতই নিচে নামুক না কেন, হেনেসি এখনও
ঈশ্বরের সেবা করতে চায়। সে সন্দেহ করে, কনস্টেনটিন ঈশ্বরের মহাজাগতিক দাবা খেলার একটা
ঘুঁটি না হয়েই যায় না ! মাঝে মাঝে এটা যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক না কেন।

ওঁর প্রতিরক্ষা সরানোর ব্যাপারে ভয় পেতে পেতে, ফাদার হেনেসি গলায় হাত চালালেন
এমুলেটটার খোঁজে। তারপর মনে পড়লো , ওটা ওখানে নেই। উনি সেটা পকেট থেকে বের
করলেন, তাকালেন সেটার দিকে, তারপর নিরাসক্তভাবে টেলিভিশনের এন্টেনাতে পরিয়ে
রাখলেন। টিভি বন্ধ করলেন তিনি, বুরবনের বোতলে শেষবারের মতো চু মুক দিলেন। তারপর ঘরের
অন্য প্রান্তে গিয়ে, এলুমিনিয়াম ফয়েল ছিঁ ড়ে ফেললেন একদিককার।
64

নারকীয় জীবেদের চিৎকার শুরু হয়ে গেলো প্রায় সাথে সাথেই !

পাঁচ

সানসেট বুলেভার্ডে র মোটেল রুমগুলির কিছু একটা ব্যাপার আছে, কনস্টেনটিন ভাবলো।
বিছানার প্রান্তে বসে , জ্যাক ডানিয়েলসের বোতলে ধীর লয়ে চু মুক দিতে দিতে কথাগুলো
ভাবছিলো সে। সকাল হবে হবে করছে, সে মনে মনে সাজিয়ে যাচ্ছে নানারকম সংকেত। ভাবছে,
জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত আর সবকিছুই আবর্জ না – এখন তু মি কিভাবে বাঁচো , সেটা একান্তই
তোমার ব্যাপার। এখন নিজেকে সুখী অনুভব করাও, আর সেটা এখনই করো। সে , ঐ দেয়ালে
ঝোলানো সস্তার সাগরের পেইন্টিং, একটা চিপা ড্রেসার, একটা টিভি সেট , যেটা কিনা শব্দহীন
এমটিভি দেখয়ে যাচ্ছে – এগুলো থেকে এই চিন্তাটা কিভাবে বের করে আনলো, সে-ই জানে।
সাথে আছে রোঁয়া ওঠা কার্পেট, নীল পর্দা , কটকটে গোলাপি বেড সীট, ওপরে নগ্ন হয়ে বসে থাকা
সে !

“ওহ , খামোশ !” সে এবার শব্দ করেই বলে উঠলো “তু ই মাতাল হয়ে গেছিস !”

“তু মি কি এমন কারো সাথে কথা বলছো, যার ব্যাপারে আমি সচেতন নই ?” এলি জিজ্ঞেস
করলো। সে ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করেনি সেটা। ওকে দেখে মনে হয়, ও সদ্য বিশে পা দিয়েছে, কিন্তু
ওর বয়স নিয়ে আসলে নিশ্চিত হবার জো নেই। কনস্টেনটিনের পাশে, নিজের পেটের ওপর শুয়ে
আছে সে, বড় বড় চোখগুলোতে এমটিভি’র প্রতিবিম্ব খেলা করে যাচ্ছে। সেও নগ্ন, কিন্তু অভ্যস্ত
ভঙ্গিতেই শুয়ে আছে সে, যেন পশমের ভেতরে কোন আদুরে বেড়াল ! সে একইসাথে পাতলা কিন্তু
খাঁজ ভাঁজ সমৃদ্ধ। একইসাথে ধারালো এবং তন্বী দেহী, টানটান পেশী , কিছুটা পৃথুলাও বটে !
65

কনস্টেনটিন একটা ছোট টান দিলো সিগারেটে, কাশি এলো না। তারপর সেটা ফেরত দিয়ে দিলো,
এলি উঠে জ্যাকের বোতলে লম্বা এক চু মুক মারলো ।

“লাং ক্যান্সার , না ?” সে বললো । তারপর গভীর ভাবে টান দিলো সিগারেটে , হাসলো
নরমভাবে। হাসির সাথে মুখ থেকে ধোঁয়াও বের হতে লাগলো “ওটা খুবই হাস্যকর, জন” বোতলে
আরেকটা চু মুক দিয়ে সেটা মেঝেতে রাখলো এবার।

“হ্যাঁ, হাস্যকরই বটে । তো , এলি – তু মি এর আগে আমার কলের জবাব দাও নি --”

“আমরা ছিটকে গেছিলাম। তোমাকে খুশিই মনে হচ্ছিলো ।”

“ঠিক আছে। কিন্তু – কোন অস্বাভাবিক আত্মার মিছিল , সম্ভবত ? নতু ন ভবিষৎবাণী ? অদ্ভু ত
কোন পুরাতাত্ত্বিক শিল্পকর্ম সামনে চলে আসা ?”

মেয়েটি সিগারেটের ধোঁয়ার মাঝখান দিয়ে ভ্রু কুঁ চকে তাকালো , তারপর ওর লম্বা নখ দিয়ে
কনস্টেনটিনের মেরুদণ্ড বরাবার আঁচড়ানো শুরু করলো ! বিদ্বেষপরায়ণ ভাবে হাসছে – আয়না
দিয়ে সেদিকে দেখতে পাচ্ছে কনস্টেনটিন।

কনস্টেনটিন ভাবছেঃ দেয়ালে ফিট করা টিভি সেই অন্তিম শয্যায় শায়িত ক্যান্সার পেশেন্টের মতো!

“লাং ক্যান্সার , জন ! বস যে খুব ভালো মুডে আছে, এতে আর অবাক হবার কিছুই নেই !”

কনস্টেনটিন মুখ বাকিয়ে হাসলো। দি বস !

এলি আরও জোরে, গভীরভাবে আঁচড়াতে লাগলো “সেইসব সাধু সন্ত আর শহীদেরা, যারা ওঁর
হাত ফস্কে গেছে। ওঁর নিজেরই পদাতিক সৈন্যদের ওনার কাছে খণ্ড খণ্ড করে পাঠানো .........”

“এলি ...... ?”

“উনি ঐ সব কিছুর শোধ তু লবেন তোমার ওপর, জন। সময়ের শেষ পর্যন্ত , তোমার আত্মা টু করো
টু করো করে ছিঁ ড়ে নিতে খুবই ভালো লাগবে তাঁর ! ”
66

“এলি .........”

“একমাত্র তোমার আত্মাকে সংগ্রহ করার জন্য হলেও , তিনি এখানে আসতেন। আর তু মি জানো
, তিনি এই জায়গাকে কতখানি ঘৃণা করেন !”

“এলি, একটু থামো এখন !”

এলি মুখ থেকে সিগারেট বের করে , একটা ধোঁয়ার রিং ছাড়লো। কনস্টেনটিন বাইরে ক্লিনিং কার্ট
টেনে নেয়ার শব্দ শুনতে পেলো।

এলি একটু ভাবলো “নাহ ! আমার দৈনিক জীবনে তেমন কিছু ছন্দপতন চোখে পড়েনি। ”

“উনি কি আসলেই তোমার বস ?”

“ঠিক সেরকম না—আমি আসলে একজন কন্ট্রাক্টর এর মতো কাজ করছি ইদানীং । উনি যদি
আমার বসই হতেন, তবে তু মি এতক্ষণে মারা যেতে। আমি জিন হাতে খুন করতাম তোমায় !”

কনস্টেনটিন নড করলো । এটা সত্যি কথাই !

এলি মাথা একপাশে কাত করলো “বৃষ্টি হবে !”

“আবহাওয়া রিপোর্ট সেরকম বলছে না ”

কিন্তু , এরপর , সে ছাদে বৃষ্টির টপ টপ শব্দ শুনতে পেলো। বেশ ভারী বৃষ্টি।

“আমি ধরে নিচ্ছি, জন কনস্টেনটিন এখনও বড় একটা ‘কাজ’ এর জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছে !
সবকিছু আবার ঠিক করে দেয়ার জন্য।”

“তোমার আর কোন ভালো আইডিয়া আছে ?”

এলি হাতের সিগারেটটা ছুঁ ড়ে ফেললো এস-ট্রে তে। তারপর টেবিল থেকে আরেকটা তু লে, ধরিয়ে,
গলগল করে ধোঁয়া ছাড়লো।
67

“যাই হোক, এলি” কাশলো কনস্টেনটিন। একবার , দুবার । ঠিক আছে, তিনবার , কিন্তু ছোট ছোট
কাশি ! “তোমার কান মাটিতে পেতে রেখো ”

“বেশীরভাগ রাতই, সেখানেই কাটে অবশ্য !” ফ্যাকাসে ভাবে হাসলো এলি “তু মি যখন
আত্মধ্বংসী মুডে থাকো, আমার খুব ভালো লাগে সেটা । তু মি জানো, আমি আসলেই মিস
করবো , এখানে ওপরে , কেউ একজনকে , যার সাথে – একাত্মতা অনুভব করা যায় .........”

সে জ্যাক ডানিয়েলসের বোতলটা তু লে দিলো কনস্টেনটিনের হাতে। ঘাড়ে চু মু খেলো, নিজের


লেজটা পেছনে নিয়ে গেলো তারপর ! কনস্টেনটিন দেখলো, রোঁয়া রোঁয়া গোলাপি লেজটা,
আয়নাতে !

সে বোতল থেকে গভীর এক চু মুক দিলো ।

চ্যাজ আর কনস্টেনটিন ক্যাবে বসে রয়েছে। পাতলা বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে , তাকিয়ে আছে
থিওলজিকাল সোসাইটির বিল্ডিঙের দিকে।

“এটা মনে হচ্ছে স্রেফ এখানে গজিয়ে উঠেছে ! ” চ্যাজ বলে উঠলো “আমি দেখতে পাচ্ছি না ,
এটা এখানে কিভাবে তৈরি হলো। একজন প্রকৌশলী আসলেই তৈরি করেছে এটা ?”

“ফ্রান্সের একটা ছোট্ট ক্যাথেড্রাল থেকে প্ল্যানটা এসেছিলো ” জনান্তিকে বললো কনস্টেনটিন।

বৃষ্টিটা সকাল সাতটার দিকে ধরে এসেছিলো , জন তখনও মদ্যপ অবস্থায় ছিলো। কফি আর
এস্পিরিন অনেকটা সাহায্য করেছে হ্যাংওভার কাটাতে, একবার বমির ওপর দিয়ে গেছে ধাক্কাটা।
নার্ভাস ধরণের লাগছে ওর এখন। ক্লান্তি খুব তাড়াতাড়িই জেঁ কে বসবে। ওর খুব তাড়াতাড়ি কাজ
সারতে হবে , সে বলে উঠলো “আমি নিশ্চিত যে, আমি তোমাকে ভেতরে ঢু কিয়ে দিতে পারবো,
চ্যাজ !”
68

চ্যাজ ঘাড় ফিরিয়ে থিওলজিকাল সোসাইটির প্রাচীন থামগুলির দিকে তাকালো “কিহ !? উন্নাসিক
লোকজনকে দেখার জন্য ? নাহ !”

সে ঝং করে ট্যাক্সির মিটার ডাউন করে দিলো , সেটা তার নির্দ য় টিকটিক শব্দ করা শুরু করে
দিলো। কনস্টেনটিন ঘোঁত করে একটা বিরক্তির শব্দ করে উঠলো। এই সবকিছু ওকে
মরণশীলতার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে !

নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করো , বোকা !

সে ক্যাব থেকে বেরিয়ে, বিল্ডিঙের দিকে এগোনো শুরু করলো । ঘামে ভেজা কপালে, ভালোই
লাগছে বৃষ্টির ছোঁয়া।

একজন পাদ্রী , গির্জার মাঝখানে একজন বিশপের সাথে কথা বলছিলেন। ওনাদেরকে অতিক্রম
করে এগিয়ে গেলো কনস্টেনটিন, হোলি ওয়াটার রাখার জায়গায় একটু থামলো। একটু ছিটিয়ে
নিলো, ক্রস করে নিলো সেগুলো দিয়ে। সেইন্ট এন্থনির বেদীতে কয়েকটা মোমবাতিও জ্বেলে
নিলো। সে ক্যাথলিক নয়, কিন্তু , কি আসে যায় ?

লাইব্রেরীতে, দুইজন লোককে একটা বিশাল ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সে।
এটা এতোটাই বড়, সেই ছোট্ট মেয়ে কন্সুয়েলা এতে মাথা সোজা রেখেই ঢু কে পড়তে পারবে।
কনস্টেনটিন একটু থেমে , দুইজন কে ভালো করে দেখে নিলো । ওঁদের একজন, উমম, মানুষ !
অন্যজন , কেবল দেখতে মানুষের মতো ! সে ওকে চিনতে পারলো, ওঁর বাহ্যিক রূপ আর আত্মা ,
দুটোই। সেই রূপটা পরে ছিলো একটা ক্রিম কালারের আরমানি স্যুট। সে অভিজাত ধরণের
সুদর্শন, উঁচু চোয়াল আর চিকন থুতনি, ঘন চু ল। সুন্দর রকমের ফ্যাকাসে, চকচকে সবুজ চোখ ।
শরীর একইসাথে পুরুষালী আর রমণীয় । একজন উভলিঙ্গ । কনস্টেনটিন জানতো , এই
উভলিঙ্গ মানুষটি, সে রুমে ঢোকামাত্র , ওর অস্তিত্ব টের পেয়েছে। এমনকি , হয়তো আরও অনেক
আগে থেকেই !
69

ফায়ারপ্লেসের সামনে অন্য মানুষটি হলেন, অনেকটাই রুক্ষ চেহারার ফাদার গ্যারেট।

একজন তরুণ চাকর , সম্ভবত শিক্ষানবিশ পাদ্রী হবে, কনস্টেনটিনের কনুই এর কাছে এসে বললো
“আমি কি আপনার কোট পেতে পারি , মিঃ কনস্টেনটিন ?”

“না, ধন্যবাদ। আমি বেশীক্ষণ থাকবো না ”

“আপনার , ম্যা’ম ?”

কনস্টেনটিন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, একজন তরুণী। সুন্দরী কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর। লালচে
বাদামী চু ল, পুষ্ট ঠোঁট, হালকা বাদামী চোখ। কখনও মেকআপ নিয়ে মাথা না ঘামানোর মতোই
সুন্দর । একটা শক্তি, সাথে বিপদের আভাস টের পাওয়া যাচ্ছে। স্কার্ট আর সাদা ব্লাউজ পরে
আছে। ওকে দেখতে......... অনেকটা পুলিশের মতোই ভাবভঙ্গী। এগুলো বুঝতে আধ্যাত্মিক জ্ঞান
লাগে না। আর...... ওকে কোথায় জানি দেখেছিলো আগে। ওহ, হসপিটালে, লিফটের সামনে।

সেখানে দুর্বলতাও ছিলো, ওর অনুভবকারী সত্ত্বা জানান দিলো , মেয়েটা শোকের মধ্যে দিয়ে
যাচ্ছে। সে সম্প্রতি কাউকে হারিয়েছে। কনস্টেনটিন অনুভূ তির এন্টেনা গুটিয়ে নিলো , অনুপ্রবেশ
করতে চায় না। অন্তত প্রয়োজন হবার আগ পর্যন্ত না ।

“আমিও বেশীক্ষণ থাকবো না ” তরুণী জবাব দিলো ।

তরুণীটির অন্য কিছু একটা ব্যাপার আছে......... ওর চারপাশে ঘিরে থাকা বলয়টি বেশ
শক্তিশালী। আর কিছু একটা সর্বক্ষণ নিক্ষেপ করে যাচ্ছে, এমনকি ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই !

“আমার ওনার সাথে কথা বলতেই হবে ” তরুণী বললো “এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ”

“প্রথমে যে এসেছে, সে আগে সার্ভি স পাবে ” কনস্টেনটিন বললো, তরুণীর প্রতিক্রিয়া দেখতেই
কথাটা ইচ্ছে করে বললো সে।

“তো , আপনি সবসময়ই অভদ্র, যেখানেই থাকু ন না কেন !”


70

তরুণীটি এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো কনস্টেনটিনের দিকে, মাপছে ওকে। এদিকে, কনস্টেনটিন
অস্বস্তিতে পরে গেলো ঐ দৃষ্টির সামনে। ওর মনে পড়ে গেলো, পরনের কাপড় ধোয়া হয়নি বেশ
কিছুদিন, শেভ করা হয়নি, দাঁতও ব্রাশ করা হয়নি, আর ওর গা থেকে হয়তো মদের গন্ধ বেরোচ্ছে
ভু র ভু র করে !

ও আশা করলো ওকে দেখতে যাতে মদ্যপ না লাগে। আরেহ ! ও কি মনে করলো তাতে তোমার
কি আসে যায় ?

এটা একটু অদ্ভু ত। ও সাধারণত ভাবে না মানুষে কি ভাবলো সেটা।

গ্যারেট আর অন্য লোকটা হাত মেলালো। ক্ষীণ একটা বাউ করলো গ্যারেট লোকটাকে,
উচ্চপদস্থের স্বীকৃ তি ।

তরুণীটি সোজা এগিয়ে গেলো গ্যারেটের দিকে, কনস্টেনটিন গেলো অন্য লোকটির দিকে।
গ্যাব্রিয়েল, ফায়ারপ্লেসের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে – ডানা দুটো মেলে দিয়ে ! ওগুলো দেখার জন্য
আপনাকে ভালো করে তাকাতে হবে। ওগুলো এই জগতে অদৃশ্য।

মহিলা পুলিশটি গ্যারেটের সাথে বেরিয়ে গেলো, আর গ্যাব্রিয়েল একটা বিশাল, পিঠ উঁচু কাঠের
চেয়ারে বসে পড়লো। সেখানে বসে, ফায়ারপ্লেসের আগুনের দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইলো।

কনস্টেনটিন সাবধানে হাঁটতে লাগলো যেন ওকে দেখে বোঝা না যায় যে , ও ড্রিংক করছিলো ।
কিন্তু ও জানে, এতে লাভ নেই, গ্যাব্রিয়েল বুঝে ফেলবে এমনিতেই।

গ্যাব্রিয়েল কথা বলে উঠলো , টেলিপ্যাথির মাধ্যমে “আগুন কাঠ খেয়ে ফেলছে। সময় আগুনের
মতো, কনস্টেনটিন, মরণশীলদের কাছে। সময় সবকিছু খেয়ে ফেলে।” আর শোনা যায় মতো
বললো “আমি জানি তু মি কি চাও, ছেলে !” গ্যাব্রিয়েলের স্বর ছিলো মসৃণ – কিন্তু কোমল ধরণের
মসৃণ নয়। তাঁকে সবসময়ই উন্নাসিক মনে হয়। সম্ভবত, ঐশ্বরিক হওয়াই এর কারণ।

“তোমার সবজান্তা চোখ এখনও আমার ওপর রেখেছ , গ্যাব্রিয়েল ? আমি পুলকিত !”
71

“আমি , একজন মেষপালককে তার সবচেয়ে দিশেহারা অবস্থায়ও পথ দেখাতে পারি, কিন্তু তোমার
কাছে সেটা কোন গোপন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হতে পারে !”

“তো , তু মি কি আমাকে তোমার কাছে ভিক্ষা চাইতে বলবে ?”

“উঁহু, লাভ হবে না। তু মি ইতিমধ্যে তোমার মুক্তির সুযোগ হারিয়ে ফেলেছ। ” গ্যাব্রিয়েল হাসলো ,
কিন্তু ওঁর চোখগুলো সেরকমই নীল সাগরের পানির মতো বরফশীতল রয়ে গেলো “তু মি,
পরিষ্কারভাবে যাচ্ছ না , জন ”

“ওইসব নরকের প্রাণীদের ব্যাপারে কি , তাহলে ? যাদেরকে আমি ফেরত পাঠিয়েছি ? ওদেরকে
নরকে পাঠিয়ে আমি অনেক নিষ্পাপ জীবন রক্ষা করেছি। সেগুলোই আমার প্রবেশের জন্য
গ্যারান্টি হতে পারে ---- ”

“এখনও স্বর্গে যাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছো, ছেলে ? কতবার বলবো, যে এটা স্রেফ কাজ করবে
না ! ”

কনস্টেনটিন ওর মুঠি গুলো শক্ত করে পকেটে ভরে রাখলো – ওগুলি ব্যবহার থেকে বিরত থাকার
জন্য “আমি কি ওনার হয়ে যথেষ্ট কাজ করে দেই নি ? উনি আমার কাছে কি চান ? ”

“গতানুগতিক। আত্ম বিসর্জ ন, বিশ্বাস ”

“আমি বিশ্বাস করি, যীশুর দিব্যি !” দাঁতে দাঁত চেপে বললো কনস্টেনটিন।

গ্যাব্রিয়েল আস্তে করে মাথা নেড়ে , কনস্টেনটিনের দিকে তাকালো। কেঁ পে উঠলো সে, রক্তমাংসের
ভেতর দিয়ে ওর আত্মাতে গ্যাব্রিয়েলের দৃষ্টি অনুভব করে। “না , তু মি জানো। এখানে একটা
পার্থক্য আছে। আমি তোমাকে বারংবার বলে এসেছি, স্বর্গে প্রবেশের চাবিকাঠি হলো – বিশ্বাস ।
মানে হলো, কোন প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস। তু মি বিশ্বাস করো , কারণ তু মি দেখেছ ! ”
72

“এখানে একটা টেকনিক্যাল ব্যাপার আছে। আমি কখনোই দেখতে চাইনি, আমি এই অভিশাপ
নিয়েই জন্মেছি !” রেগে গিয়ে বললো কনস্টেনটিন।

“এটা একটা উপহার , জন ! যেটা তু মি নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তছনছ করে ফেলেছ ।”

কনস্টেনটিন, হঠাৎ করেই, অপরিসীম ক্লান্তি অনুভব করলো। ওর মন আরেকটা ড্রিংক চাইলো ,
কিংবা একটা আইরিশ কফি।

“তু মি আরেকটা ড্রিংক ছাড়াই ভালো থাকবে , জন ”

“আমি ছোট মেয়েদের ভেতর থেকে পিশাচ টেনে বের করছি, কার জন্য করছি এগুলো ?”

গ্যাব্রিয়েল গা-জ্বালানো অনুকম্পার হাসি হেসে বললো “তু মি এ পর্যন্ত যা যা করেছো, সবই নিজের
জন্য । আবারও পরমপিতার আশীর্বাদ পুষ্ট হবার জন্য – সহজ অংক ! এখন আমার কাছে
কাঁদুনি গাইতে এসো না, যে তু মি নরকে যেতে ভয় পাও ! ”

কনস্টেনটিন একটা সিগারেট জ্বালালো, কাছের একটা বাইবেলের দিকে তাকিয়ে বললো “আমি
ম্যানুয়াল পড়েছি। কখনও চিন্তা করে দেখেছ, যে আসল সমস্যা আসলে তোমরাই ? অসম্ভব সব
নিয়মকানুন। কে ওপরে যাবে। কে যাবে নিচে। আর কেন ? কেন ? তোমরা আমাদের এমনকি
বুঝতেও পারো না !” গ্যাব্রিয়েলের দিকে একটা ধোঁয়ার রিং ছাড়লো সে “আসলে, তোমারই নরকে
যাওয়া উচিত, দো-আঁশলা ! ”

চোখের পলকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো গ্যাব্রিয়েল , ক্রু দ্ধভাবে তাকালো কনস্টেনটিনের দিকে “আমি
তোমার ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করছি, কিন্তু আমাকে বেশী জ্বালাতন কোরো না ! ”

“আমিই কেন, গ্যাব্রিয়েল ?”

জবাবটা এলো টেলিপ্যাথির মাধ্যমে “তু মিই কেন ? সব মরণশীলই মারা যায়, আর তখন তারা
বলে ‘আমিই কেন ?’ ”
73

“এটা ব্যাক্তিগত , তাই না ? আমি চার্চে যথেষ্ট পরিমাণে যাই নি ? যথেষ্ট প্রার্থনা করি নি ?
কালেকশনের প্লেটে পাঁচ ডলার কম ছিলো ? কেন ? ”

গ্যাব্রিয়েল ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো “তু মি মারা যাবে কারণ, তোমার পনেরো বছর বয়স
থেকে, তু মি প্রতিদিন ত্রিশটা করে সিগারেট খেয়ে এসেছ ! আর তু মি নরকে যাবে, কারণ তু মি যে
জীবন বেছে নিয়েছ, সেজন্য ! ” সে নরম আর বিষণ্ণভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো “তু মি শেষ !”

রুমের অন্যপাশে, এঞ্জেলা কথা বলছিলো ফাদার গ্যারেটের সাথে। ওনার কাঁধের ওপর
দিয়ে তাকিয়ে বললো “ঐ লম্বা লোকটা কে, ফাদার ?”

“আহ- আমি বললেও তু মি আমাকে বিশ্বাস করবে না ! শোন – তোমার বোনের যেটা হয়েছে – সে
ব্যাপারে কঠিন পরিস্থিতি তোমাকেই মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের নিজেদের বোঝা, নিজেরাই
বহন করতে হয়, এঞ্জেলা ! ”

“আপনি কিছু একটা করতে পারবেন, ফাদার। ও একটা ক্যাথলিক শেষকৃ ত্য পায়। পেতেই হবে
ওকে। ”

“এঞ্জেলা, আত্মহত্যা, এখনও পাপ হিসাবেই দেখা হয় ”

“ও আত্মহত্যা করেনি !”

“বিশপ অন্য কিছু বিশ্বাস করেন। এটা আমার হাতের বাইরে, তু মি নিয়মগুলি জানো , এঞ্জেলা।”

মিনতি ভরা দৃষ্টিতে ফাদারের দিকে চেয়ে বললো এঞ্জেলা “ফাদার...... ডেভিড, এটা ইসাবেল !”

ফাদার মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন, বুঝতে পারছেন না কিভাবে উত্তর দেবেন।

এঞ্জেলা বলে চললো “আমি মনে করি, একমাত্র ঈশ্বরকেই সে তার জীবনে ভালবেসেছে !”
74

নির্বাক তাকিয়ে রইলেন ফাদার।

“প্লিজ, ফাদার ............”

থিওলজিকাল সোসাইটির বাইরে যখন এলো , তখন এঞ্জেলার চোখ ভেজা। বৃষ্টি পড়ছে
বাইরে, সামনের সান সেটের নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলো সে। হাজার হাজার ফোঁটা নেমে
আসছে পৃথিবীর বুকে। ওর মনে ভেসে উঠছে ইসাবেলের পড়ে যাওয়ার দৃশ্য, পুলের পানিতে
দেহটা ডু বে যাওয়া, ওর শরীর থেকে রক্ত বের হওয়ার দৃশ্য।

একটা কাশি শুনে পাশে তাকালো সে। দেখতে পেলো সেই রুঢ় আচরণ করা লোকটা দাঁড়িয়ে
আছে অন্যপাশে। মুখের সিগারেটটা হাতে নিয়ে দেখছে, ফিল্টার সহ পুড়িয়ে ফেললো কিনা !

লোকটা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো “অন্তত আজকের দিনটা খুবই সুন্দর !”

এঞ্জেলা স্রেফ তাকিয়ে থাকলো সেদিকে, কি অদ্ভু ত লোক ! কিছু একটা আছে লোকটার
ভেতর...............

“ ঈশ্বর ” কনস্টেনটিন বললো “ওনার রসবোধ সবসময় খুবই পচন ধরা ! ” সিগারেটটা একদিকে
ছুঁ ড়ে ফেলে যোগ করলো “আর ওনার পাঞ্চ লাইনগুলি সবসময়ই প্রাণঘাতী !”

কাছেই, একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিলো – ভেতর থেকে তরুণ দেখতে এক ড্রাইভার মাথা বের করে
চিৎকার করতে লাগলো “কনস্টেনটিন ? ভেতরে এসো , বৃষ্টি পড়ছে তো ! হেই ! ”

তো, লোকটার নাম কনস্টেনটিন। এঞ্জেলা দেখতে পেলো , লোকটা ট্যাক্সিটাকে উপেক্ষা করলো,
আর বৃষ্টির চাদরের আড়ালে হারিয়ে গেলো।
75

সেই একই বৃষ্টি, ফাদার হেনেসির এপার্ট মেন্টেও ঝরে চলেছে। ছেঁ ড়া এলুমিনিয়াম ফয়েলের
জঞ্জাল, পাওয়ার বারের মোড়ক (যেগুলি বেশীরভাগই ও নিজেই খেয়েছে ), ডায়েট কোকের
বোতল এগুলির মাঝখানে লাথি মেরে মেরে কি জানি খুঁজে চলেছে। একটা বাদামী সোফার ওপর
সাম্প্রতিক অনেক জার্নাল আর সংবাদপত্রের কপি রাখা।

একটা নিঃশ্বাস ফেলে , এক হাতে একটা জেলি জার নিয়ে, ছোট্ট সোফাটায় গা এলিয়ে দিলো ।
কাজে নামার সময় এসে গেছে।

স্বর গুলি আসছে আর যাচ্ছে, অর্ধেকটা শোনা যাচ্ছে কেবল। সস্তা হোটেলের পাতলা দেয়াল ভেদ
করে আসা কথাবার্তার মতন। কিন্তু এগুলো ভেসে আসছে , অন্য ভু বনের দেয়াল ভেদ করে, অন্য
এক মহাজাগতিক ভু বন সেটা ! যেসব আত্মারা পাপমোচনের জন্য বিভিন্ন স্তরের মাঝখানে আটকে
আছে, এগুলো তাদেরই শব্দ। ঠিক নরক না, ওদের নিজেদের তৈরি নরক । বিড়বিড় করছে ,
ঠেলাঠেলি করছে , নিজেদের শব্দ জাগতিক পৃথিবীতে শোনানোর জন্য !

“...... আমি জানি ওরা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, ওরা আমাকে এখানে পাঠিয়েছে
কারণ আমার টাকা পয়সা যাতে ওরা পায়। কিন্তু ওরা আবিষ্কার করবে, ওসব কিছুই নাই , আর
আমি এখানে অট্টহাসি হাসবো। ...... ওহ আমার হাত নেই কেন ...... আমার হাতগুলো যদি
দেখতে পেতাম ! .........”

“মা ? আমি দুঃখিত মা , মা ? আমি দুঃখিত মা , মা ? আমি দুঃখিত মা , মা ? মাআআআআ??”

“তো, ব্যাটা ভাবে আমরা কাল্পনিক, আমরা ওর আবিষ্কৃ ত চরিত্র মাত্র। অথবা ওর পড়া বইয়ের
কোন ভূ ত। আমরা ওর ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকি সব সময়, সঠিক সুযোগের অপেক্ষায় ...... ”

“ও কোন কারণ ছাড়াই মারা গেছে, এর মানে কি ? ঐ লাল রুশেরা যদি উত্তর ভিয়েতনাম দখল
করে নেয়, তবে ওরা উত্তর পূর্ব এশিয়া পুরোটাই দখল করে নেবে। আর কমরেডরা এরপর সান
76

ডিয়েগোর উপকু লে পৌঁছে যাবে আরামসে ! এটা ওঁর শেষ কথা কিভাবে হতে পারে ? আমি
অর্ডার ফলো করছিলাম, ঈশ্বরের দিব্যি ! .........”

“.........।আমি দুঃখিত মা , মা ? মা ? ”

হেনেসি সেগুলো শোনা বন্ধ করে দিলো। এগুলো কোন কাজেরই না। আর এদেরকে প্রশ্ন করেও
কোন জবাব পাওয়া যাচ্ছে না।

বুরবনে আরেকটা লম্বা চু মুক দিলো সে। তারপর সেটা একপাশে রেখে , ম্যাগাজিন আর
সংবাদপত্রগুলোর দিকে মনোযোগ দিলো । চোখ বন্ধ করে, হাত দুটো ওগুলোর ওপর মেলে দিলো,
তালু নিচের দিকে। প্রত্যেক পেজের ওপর থেকে একটু ওপরে রাখা হাত দুটো , মাঝে মাঝে
থামছে। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায়ই, পাতা উল্টে যাচ্ছে । চোখের মণি উঠে গেছে ওপরে, বিড়বিড়
করে কি জানি বকে চলেছে। কম্পন তু লে নিচ্ছে হাতে, তথ্যের পরতে পরতে ঢু কে পড়ছে। ইথারে
উঁকি মারা—কনস্টেনটিন এটাকে বলে। এক স্তূ প থেকে অন্য স্তূ পে চলে যাচ্ছে হাত দুটো।

হেনেসির বাম হাত হঠাৎ থেমে গেলো , টান খেয়েছে সেটা, একটা জরুরী কিছুতে ধাক্কা খেয়েছে !
অতিপ্রাকৃ ত শক্তি , সম্প্রতি এই জগতে হানা দিয়েছে, বেশ ভালো পরিমাণ শক্তি নিয়ে। আর
সেটা এই সংবাদপত্রের বিষয়ের সাথে জড়িত হয়ে গেছে –

মনোরোগ সংক্রান্ত ওয়ার্ডে আত্মহত্যা

দীর্ঘদিন মানসিক রোগে ভু গতে থাকা ইসাবেল ডডসন, রেভেন্সকার হসপিটালের ছাদ থেকে
লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার, ফিল্ড থেকে করোনারের রিপোর্ট
অনুযায়ী ............

এঞ্জেলা ওর সোফাতে বসে, হসপিটালের সিকিউরিটি থেকে পাওয়া সিসিটিভি ফু টেজটা


দেখছে, একবার, বারবার। মনে হচ্ছে , ও যেন ইসাবেলের নরকের ভাগ পাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে!
77

আরও একবার রিওয়াইন্ড দিলো সে, তারপর প্লে বাটনে চাপ দিলো ।

ঝির ঝির করা কালো সাদা ছবিতে দেখা যাচ্ছে ইসাবেল ওর নাইট গাউন পড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
হাঁটছে, যেন সে ইতিমধ্যে ভূ তে পরিণত হয়েছে, এগিয়ে যাচ্ছে ছাদের দরজার দিকে।

এঞ্জেলার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে, এখনও জ্বালা করছে ওগুলো। ভেতর থেকে আবারও
একটা কান্নার দমক উঠে এলো , ছবিটা থেকে অন্যদিকে তাকিয়ে , রিমোট হাতাতে লাগলো , বন্ধ
করে দেবে ওটা। বিড় বিড় করে সজল চোখে বলছে “আমি দুঃখিত , ইজি ...... !” ওর মনে হচ্ছে
এটা ডিলিট করে দিলেই ভালো হবে।

তখনই, ও শুনতে পেলো, একদম পরিষ্কারভাবে , ইসাবেলের কণ্ঠ “কনস্টেনটিন ............ ”

কেঁ পে উঠে, এঞ্জেলা টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকালো । ইসাবেল ঝাঁপ দেয়ার জন্য তৈরি – কিন্তু এখন,
সে সরাসরি তাকিয়ে আছে এঞ্জেলার দিকে !

তারপর লাফ দিলো সে।

ভিডিওটা এরপর আরও মুহূর্ত খানেক চললো , তারপর আবার ঝিরঝিরে ফেরত গেলো।

সে আবারও ওটা রিওয়াইন্ড করলো, দেখলো আবার প্রথম থেকে, সোফাতে সামনে ঝুঁকে বসলো।
পুরোটা আবার দেখবে –

ইসাবেল ছাদের কিনারে উঠে দাঁড়ালো , ব্রেসলেট ছিঁ ড়লো , সামনের শহরের দিকে তাকালো ।
কাঁধের ওপর দিয়ে তাকালো , তারপর লাফ দিলো..................

কিন্তু এখন, সে এঞ্জেলার দিকে তাকালো না, কিছু বললোও না ।

এঞ্জেলা বসে রইলো সেখানে, দুঃখের মধ্যে, হ্যালুসিনেশন হয়েছে, আর কিছু না ।


78

কিন্তু , মনের গভীরে, কিছু একটা ওকে বলছে, এটা তা ছিলো না। ইকো পার্কে ঐ বন্দুকধারী
পাগলটাকে গুলি করার সময় যে নিশ্চয়তা অনুভব করেছিলো , অনেকটা সেরকম অনুভব
করলো এখন। সেই একইরকম ভূ তু ড়ে নিশ্চয়তা !!

নশ্বর জগতের ওপার থেকে, মৃত্যু সাগর পার হয়ে .........

ইসাবেল ওর সাথে কথা বলেছে !!

ছয়

বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু রাস্তা এখনও ভেজা সাপের মতোই সিক্ত । কনস্টেনটিন মবিল স্টেশন থেকে
বেরিয়ে এলো আর্দ্র সন্ধ্যাবেলায়। ওর চোখ জ্বলে গেলো, সেই সাথে টের পেলো, শহরের ধোঁয়াশার
সাথে মিশে যাচ্ছে এসফল্টের বাষ্পীভূ ত পানি। এ কারণেই, নিজের ভেতরে কাশিটা জেগে ওঠা
টের পেলো সে।

খুসখুসে ভাবটা বিদায় নেয়ার পরে, ঠোঁটে একটা সিগারেট ঝোলাল সে। বিস্মিত হয়ে দেখল ,
একটা বড় ইঁদুর দৌড়ে গেলো সামনে দিয়ে। সানসেট বুলেভার্ডে , বেশী ইঁদুর দেখা যায় না।

কনস্টেনটিনের রাস্তার অন্য পাশে একটা বিলবোর্ডে র দিকে চোখ গেলো। সেদিকে তাকিয়ে রইলো
সে কিছুক্ষণ –

তোমার সময় ফু রিয়ে আসছে !

মনে হল, মেসেজটা যেন ওকেই দেয়া হচ্ছে ! যদিও বিলবোর্ডে র নিচে ছোট অক্ষরে লেখা আছে,
একটা শেভি কেনার জন্য !

কনস্টেনটিন হাসলো একটু । এমনকি ও-ও চমকে গেছিলো এটা ভেবে , যে ঐ বিলবোর্ড টা ওখানে
ওর কোন শত্রু রেখে গেছে , যে কিনা জানতো ও শীঘ্রি মারা যাচ্ছে !
79

অন্য কারো জন্য , এটা হতো মস্তিষ্কবিকৃ তির লক্ষণ। মানসিক অসুস্থতা। কিন্তু কনস্টেনটিনের জন্য,
সেটা সত্যি না !

“হেই” পেছন থেকে পাকিস্তানী এক্সেন্টে একজন লোক চেঁ চিয়ে উঠলো “প্লিজ এই গ্যাস ষ্টেশনের
ভেতরে ধূমপান করবেন না !”

কনস্টেনটিন পেট্রোল পাম্প থেকে , রাস্তার পাশে উঠে এলো। একটা কমলা রঙের কোন আর
ওপরে একটা ফ্ল্যাশ করতে থাকা লাইট দিয়ে একটু জায়গা আলাদা করা আছে, সেখানে কেউ
পাইপ মেরামত করছে। সেদিকে তাকিয়ে একটু হাসলো কনস্টেনটিন, কম বয়সের কথা মনে পড়ে
গেছে। কলেজে থাকার সময় , এরকম একটা চু রি করে নিয়ে গিয়েছিলো সে। নিজের লিভিং রুমে
রেখে দিয়েছিলো, সবসময় যাতে জ্বলতেই থাকে। ও যখনই ঘরে থাকতো, সেটার দিকে তাকিয়ে
পিট পিট করে ওটার জ্বলা দেখতো। যতক্ষণ না ব্যাটারি শেষ না হয়। ওটা অনেকদিন টিকে
ছিলো। পিট পিট পিট করে জ্বলেছিল অনেকদিন ধরে, ঠিক হৃদস্পন্দনের মতোই। আর......... ঠিক
হৃদ স্পন্দনের মতোই, ওটাও এক সময় থেমে গিয়েছিলো।

মাথা নাড়লো সে, মৃত্যু সম্পর্কে না ভাবাটাই অনেক কঠিন।

ও বেশ খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়েছে, অল্প সূপ খেয়েছে। এখন, ওর মাথা বেশ ভোঁতা লাগছে। ও
একটা সিগারেট ধরানোর পর, ওপরে কয়েকটা কাক উড়ে গেলো, এতো নিচু দিয়ে যে মনে হলো
এখুনি নিচে নেমে আসবে। আর ঐ যে দ্যাখো, একটা ইঁদুর ! আরেহ ! এখানে তো দেখি
চিড়িয়াখানা বসে গেছে ! এরপর কি ? ব্যাঙ ?

আরে, ঐ তো, একটা ব্যাঙ যাচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

“হাহ !” কনস্টেনটিন বলে উঠলো । ভাবছে, আরেকটা ড্রিংক পাওয়া যাবে কোথায় !

একটা ব্যাঙ ? একটা কাঁকড়া দৃষ্টি আকর্ষণ করলো ওর !

“হেই, তোমার কাছে লাইট আছে ?”


80

কনস্টেনটিন পেছনে ফিরে , দেখলো গ্যাস স্টেশনের আলোর বিপরীতে একজন লোক দাঁড়িয়ে
আছে। হাতে ধরা একটা না জ্বালানো সিগারেট।

লোকটা কাশলো “আমাদের একসাথে থাকা উচিত, তাই না ?”

কনস্টেনটিন লোকটির দিকে যেতে যেতে , ‘এস্ট্রাল লাইট’ (আমাদের চারপাশের স্পর্শ করা যায়
এরকম এবং স্পর্শ করা যায় না এরকম জগত থেকে আহরণ করা মহাজাগতিক শক্তি ) জড়ো
করলো নিজের ভেতর। বী ম্যানের দেয়া ম্যাচ বক্স টা বের করলো কোটের পকেট থেকে। লোকটার
গা থেকে একটা অদ্ভু ত গন্ধ বের হচ্ছে – অনেককিছুর মিলিত একটা গন্ধ !

কনস্টেনটিন ম্যাচ বক্সটা দেয়ার ভান করলো, তারপর ওটা ঝাঁকাতে শুরু করলো ! ওর আর
আগন্তুক লোকটা মাঝখানে । বক্সটা ওর হাতের ভেতর লাফিয়ে উঠে, কাঁপতে কাঁপতে ভীষণ
তীক্ষ্ণ একটা চিঁ চিঁ শব্দ করতে শুরু করলো – এতো ছোট্ট একটা জিনিসের পক্ষে বেশ উচ্চ
স্বরের শব্দ! আগন্তুকটি প্রায় সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া দেখালো, হোঁচট খেতে খেতে পিছু হটা শুরু
করলো সে । সারা দেহ থরথর করে কাঁপছে।

“আগহ ! থামাও ওটা, ওরা .........”

কনস্টেনটিন এখন নিশ্চিত হয়ে গেলো। চিৎকার করা গুবরে পোকা, যেটা ওকে বী ম্যান দিয়েছিলো
, সেটাই নিশ্চিত করে দিলো ওকে। কিন্তু বেশ দেরী করে ফেলেছে সে । আগন্তুক লাফ দিলো ওর
দিকে , ঠিক একজন মহাকাশচারী চাঁদে লাফ দেয় ! সেই লাফে, এসফল্টের রাস্তা থেকে সাত ফু ট
ওপরে উঠে গেলো সে ! দুর্গন্ধযুক্ত একটা হাত বাড়ালো সে কনস্টেনটিনকে আঘাত করার জন্য !

অন্ধকার লোকটার কোট খুলে গেলো। এতে বোঝা গেলো , লোকটার দেহ আর চেহারা পুরোটাই
বিভ্রম ছিলো। ছোট ছোট অনেকগুলি প্রাণীর সমষ্টি নিয়েই দেহটা তৈরি ! জ্যান্ত ইঁদুর আর
পোকামাকড়, বিষধর সাপ আর ব্যাঙ আর কাঁকড়া আর কাঁকড়াবিছা ! প্রত্যেকটি সেই ধাঁধাঁর এক
81

একটা অংশ , কিলবিলে কিন্তু একসাথে বাঁধা ! সব জগাখিচু ড়ি মিলে , একজন মানুষের
প্রতিকৃ তি!

কনস্টেনটিন ছিটকে পেছনে সরে গেলো পিশাচটার থেকে। এটার হাতের বৃশ্চিকের লেজের
আঙ্গুলের নাগাল থেকে সামান্যের জন্য রেহাই পেলো । সে ম্যাচ বক্সটা আবারও নাড়া দিলো ,
গুবরে পোকাটা আরও জোরে চিৎকার করে উঠলো। পিশাচটা নিচু হয়ে গেলো, আর ওটার শরীর
শতখান হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে গেলো। এক মুহূর্তে র জন্য , প্রাণীগুলো একটা আরেকটা থেকে
ছিটকে গেলো বিভিন্ন দিকে, আর ভু য়া লোকটার কাপড় লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।

ওগুলো পিলপিল করে এক জায়গায় ঘুরতে লাগলো, তারপর আবার একসাথে হলো খুব কম
সময়ের মধ্যেই। তারপর , সার্কাসের দড়াবাজিকর’দের মতো একটার পর একটা ডিগবাজি খেতে
খেতে , মানুষের মতো আকৃ তি তৈরি করতে লাগলো আবার !

“ভালো কৌশল !” কর্ক শভাবে বলে উঠলো কনস্টেনটিন। বিস্ময়ের সাথে ভাবতে লাগলো, এটার
সাথে পেরে উঠবে কিনা ।

পিশাচটার একটা হাত, যেটা কিনা ইঁদুর আর সাপ দিয়ে তৈরি, এগিয়ে এসে কনস্টেনটিনের কব্জি
পেঁচিয়ে ধরলো মুহূর্তে র মধ্যে !

কনস্টেনটিন হোঁচট খেয়ে পিছু হটলো, তারপর স্রেফ বসে পড়লো। শেষমেশ দেখা গেলো , ও
নিতম্বের ওপর ভর দিয়ে আছে, পিশাচটা ঝুঁকে আছে ওর ওপর। একটা কাঁকড়া নেমে এলো
জীবটার হাত বেয়ে , উঠে পড়লো কনস্টেনটিনের কব্জিতে। এগিয়ে আসতে লাগলো ওর মুখের
দিকে, পেছনে লাইন করে আসছে ইঁদুর আর টারান্টু লা মাকড়শার দল। ওর ঘাড় বেয়ে মাথার ওপর
উঠে পড়ার মতলব।

কনস্টেনটিন অনেক কষ্ট করে চিৎকার করা আটকালো, মুক্ত হাত দিয়ে ম্যাচ বক্সটা খুব জোরে
জোরে ঝাঁকাতে লাগলো । কিন্তু ওটা কোন সাড়া দিলো না !
82

ও এবার সেটা মাটিতে আছড়ে ভেঙ্গে ফেললো ।

গুবরে পোকাটা এবার এমন তীক্ষ্ণ , ঝাঁঝালো এক মরণ চিৎকার দিলো – যে কনস্টেনটিনের কান
দিয়ে রক্ত বের হয়ে গেলো ! এই শব্দটা, পিশাচটাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিলো , আর ছোট ছোট প্রাণীর
মিশেলটা কেঁ পে উঠলো সজোরে। অংশগুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। ও দেখলো, প্রাণীটার
পেছনে , রাস্তায় , শ্লেষ্মার পুরু স্তর জমা হচ্ছে ধীরে ধীরে।

ও ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলো। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, চেহারা আর মাথা থেকে পোকামাকড়ের
জঞ্জাল ঝেড়ে ফেললো। ও সবচেয়ে কাছে যে জিনিসটা পেলো, সেটাকেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার
করার জন্য তু লে ধরলো – সেই কমলা রঙের কোনটা । সে ফ্ল্যাশ করতে থাকা জিনিসটা দিয়ে
সর্ব-শক্তিতে ঘুরিয়ে মারলো পিশাচটাকে – ওটা আবার নিজের রূপে ফিরে যেতে চেষ্টা করছে !

সে ওটার কাঁপতে থাকা, কিলবিল করতে থাকা মাঝখানটাতে , ওটার দুর্বলতম সময়ে আঘাত
করতে পেরেছে ! ওটা ধূসর একটা ছেঁ ড়া কম্বলের আকৃ তি নিয়ে দুইভাগ হয়ে গেলো। তারপর
পরিণত হলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বেশ কিছু পোকামাকড় ইত্যাদির সাগরে !

হৃদপিণ্ড তখনও লাফাচ্ছে, কনস্টেনটিন কাঁকড়াবিছা গুলোকে কোন পেটা করলো ইচ্ছেমত ,
বাকিগুলোকে পাঁই পাঁই করে ছুটে, শহরের অন্ধকার কোণ গুলোতে লুকিয়ে যেতে দিলো ।

নিজের নিঃশ্বাস ফিরে পেতে পেতে, কোট খুলে চেক করে নিলো বোনাস সাইজের মাকড়শা আর
অন্য কোন কিলবিলে ভেতরে রয়ে গেছে কিনা। তারপর ওটা আবার পরে নিলো ।
এলোমেলোভাবে কয়েক কদম এগোলো, তারপর উগড়ে দিলো সব ভেতর থেকে !

হাঁটু র ওপর বসে, ড্রেনের ঝাঁজরির দিকে তাকিয়ে , সে ভাবলোঃ

ওটা কোন এলোমেলো আক্রমণ ছিলো না ! ওটা এক আততায়ী ছিলো , নরক থেকে পাঠানো।
কেউ একজন, আমি ক্যন্সারে মারা যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায় না !
83

উঠে দাঁড়ালো সে, নিজেকে কেমন অপরিষ্কার লাগছে। আর যখন বৃষ্টি আরম্ভ হলো, সত্যিকারের
খুশি হলো সে ।

এঞ্জেলা টাইপ করছে, জন কনস্টেনটিন.........লস এঞ্জেলস......

অপেক্ষা করতে লাগলো সে, পুলিশ কম্পিউটার টার দিকে তাকিয়ে রইলো । সে এটা কোণ এলএ
পিডি কেসের জন্য খুঁজছে না । ওটাও চেষ্টা করে দেখেছে, কিন্তু এই কনস্টেনটিন এর ওপর তেমন
কোন রেকর্ড নেই ! তবে, ডজন খানেকের মতো পার্কিং টিকেট, অল্প কিছু বিপজ্জনক কাজের
ফিরিস্তি , কিছু স্পিড রেকর্ড ভাঙ্গার কেস। ওর ড্রাইভিং লাইসেন্স নাকচ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু,
আসল অপরাধের মতো , কিস্যু নেই ।

এবার, এঞ্জেলা শরণাপন্ন হলো ইন্টারনেটের , গুগলে সার্চ মারলো সে। লস এঞ্জেলস এর ওপর
ভিত্তি করে, কনস্টেনটিনের ওপর অনেক তথ্য ভেসে উঠলো এবার। একটা নাস্তিকতাবাদী সংস্থার
আর্টি কেল থেকে পড়লো সেঃ

কনস্টেনটিন, জন

...... গুজব আছে, এই বেতনভু ক তদন্তকারী , অতিপ্রাকৃ ত বিষয় আশয়ের ওপর তদন্ত চালিয়ে
থাকে, ধারণা করা হয়, সে নিজেই একটি অতিপ্রাকৃ ত জীব ! ...... ওর আধিভৌতিক অনেক
ক্ষমতার কাল্পনিক অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে......... এইসব হিস্টিরিয়া-গ্রস্থ কিংবদন্তী , নিজের
ব্যাবসার প্রসারের জন্য সে নিজেই ছড়িয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়...... অন্য অনেক ভণ্ডের মতোই
, সে ...............

এঞ্জেলা পুলিশ ষ্টেশনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো , গ্লাসের ওপর আবার বৃষ্টি পড়ার শব্দ
শুনতে পেলো সে। এমন না যে, লস এঞ্জেলসে বৃষ্টি হয় না, কিন্তু এতখানি বৃষ্টি, এটা একটু অদ্ভু তই
84

বটে ! ঐ নরম শব্দটাও , খালি ঘরের ভেতরে অনেক জোরালো শোনাল। অন্য ডেস্কগুলোর দিকে
তাকালো সে, প্রত্যেকটার সামনে পাহাড় সমান ফাইল জমা । সে একটা স্টাফ রুম বেছে
নিয়েছিলো , যেটা এখন আর তেমন ব্যবহার করা হয় না। প্রাইভেসির জন্য এটা করেছিলো সে,
কিন্তু এখন ওর মনে হলো , এখানে আরও কেউ থাকলে খুব ভালো হতো। ও জানে না কেন।

সে ওর সুইভেল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। তারপর স্ক্রল করে করে দেখতে লাগলো
কনস্টেনটিন সম্বন্ধে আর্টি কেল গুলো। ওগুলোর হেড লাইনগুলো ছিলোঃ

অকাল্ট কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে

আর

‘পজেশন’ এর সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলেন বিশপ

আর

শয়তানের অনুষ্ঠান ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে

সেইসব আর্টি কেলের সাথের ছবিগুলি বেশ বিব্রতকর। দেয়ালে রক্ত দিয়ে আঁকা বিভিন্ন নকশা।
একটা ছাদে বিভিন্ন নকশা পুড়ে খোদাই হয়ে আছে । একটা ক্রু সি ফিক্সের আধপোড়া অংশ। আর,
সেখানে আরও আছে কনস্টেনটিন স্বয়ং। হ্যান্ডকাফ পরানো অবস্থায় , এক শিশু-কোলে মায়ের
দিকে দুঃখিত ভাবে চেয়ে আছে। সাথে দাঁড়ানো আরেকজন, হ্যান্ডকাফ ছাড়া, ওকে ‘ফাদার
হেনেসি’ নামে ডাকা হচ্ছে। ঐ আর্টি কেল থেকে একটা লাইন ওর নজর কাড়ল – আদালতে
অভিযুক্ত করার জন্য অপর্যাপ্ত প্রমাণাদি .........

সে স্ক্রল করে নামতে লাগলো নিচে, দেখতে লাগলো কিরকম ভিন্ন ভিন্ন শহরে কনস্টেনটিন ঢেউ
তু লে এসেছে। লন্ডন, প্যারিস, রোম , বুদাপেস্ট , মস্কো ...... লস এঞ্জেলস।
85

সে ফিরে গেলো এলএপিডি কেস ফাইলে, খুঁজতে লাগলো যতক্ষণ না কনস্টেনটিনের শেষ জানা
ঠিকানা পাওয়া যায়। তারপর কম্পিউটার থেকে ওটা প্রিন্ট করে নিলো।

প্রিন্টার গুঞ্জন তু লে প্রিন্ট করা শুরু করলো ...... তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। নীরবতার মাঝে
ওটা এতোই জোর শোনাল, যে এঞ্জেলা ওর চেয়ারেই চমকে উঠলো বেশ। সামলে নিয়ে,
রিসিভারটা তু লে নিলো সে।

“ডডসন...... হ্যালো ? ”

কেউ নেই ওখানে । এমনকি ডায়াল টোন ও না ! অন্য পাশে , কারো কোন সাড়া শব্দ পাওয়া
যাচ্ছে না ।

ফোনটা রেখে দিলো সে – তারপরই পাশের ডেস্কের ফোনটা বেজে উঠলো । এঞ্জেলা উঠে দাঁড়িয়ে,
ওটাতে হাত রাখতেই...... পাশের আরেকটা ডেস্কের ফোন বাজতে শুরু করলো ! তারপর
আরেকটা, তারপর আরেকটা, আরেকটা, এরপর ঐ রুমের সবগুলি ফোন একসাথে বাজতে শুরু
করলো !

সে নার্ভাস হয়ে পড়লো , তারপর ভাবলোঃ শান্ত হও । শান্ত থাকো , আর দেখো কি ঘটে ......

আর , ভয় পেতে ওর প্রত্যাখানের ফলেই কিনা কে জানে, সবগুলি ফোন একসাথে বাজা বন্ধ হয়ে
গেলো !

ও একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে চারদিকে তাকালো, কিন্তু ওখানে দেখার মতো কিছুই ছিলো না !

ও প্রিন্টারের কাছে গিয়ে, কনস্টেনটিনের ঠিকানা প্রিন্ট করা কাগজটা নিলো। তারপর বিল্ডিং থেকে
বেরিয়ে গেলো, বেশ তাড়াহুড়া করেই ।
86

চ্যাজ ট্যাক্সির দরজা ধাম করে বন্ধ করে, কনস্টেনটিনের পেছন পেছন হাঁটা ধরলো।
সবসময় অনুসরণ করেই গেলো সে। “এটা , সাধারণত ভাল্লুক হয়,তাই না ?” সে জিজ্ঞেস করলো
“অথবা মেঘের ভেতর তিনটা হাঁস ?”

কনস্টেনটিন কেবল মাথা নাড়লো ।

ওরা এল কারমেন এ যেতে যেতে , বৃষ্টি কমে গিয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে পরিণত হলো। চ্যাজ
জিজ্ঞেস করলো “তো, আমি তোমার সাথে ভেতরে আসছি ?”

“চেষ্টা করে দেখো ” কনস্টেনটিন বললো।

“চেষ্টা করে দেখব ? তার মানে কি ?” চ্যাজ অবাক হয়ে গেলো।

কিন্তু কনস্টেনটিন এর মাঝেই ক্লাবের বাইরের ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেছে। বেশ পশ লোকজনের
সমষ্টি এখানে, চ্যাজ খেয়াল করলো । সে শুনতে পেলো , কালো চকচকে গাউন পরা এক মহিলা
, ফিসফিস করে বলছে “আমার জানা মতে , এখানে একটা ‘ক্লাবের ভেতরে ক্লাব’ আছে, যেখানে
প্রায় কেউ যেতে পারে না !”

মহিলার টাক্সেডো পরা , সুদর্শন সঙ্গী জবাব দিলো “তু মি সেরকম জায়গায় যেতে চাইবে না, আমি
যতদূর শুনেছি ! ”

কনস্টেনটিন আর চ্যাজ সেই ভিড় ভেদ করে , বারে পৌঁছে গেলো। সেখানে, ‘মারিয়াখি’ ব্যান্ডের
সুরের মূর্ছ না , বাতাসে আনারসের ফ্লেভারের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। চ্যাজের হঠাৎ একটা
পিনাকোলাডা খেতে মন চাইলো , কিন্তু সেটার সময় ছিলো না । কনস্টেনটিন ক্লাবের পেছনের
উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে, একটা সাইড ডোর দিয়ে।

চ্যাজ দ্রুত অনুসরণ করলো ওকে, বাথরুমগুলোর কোণায় গিয়ে পেলো। ওখানে, বেশ বড়সড়
দেখতে এক বাউন্সার একটা ছোট্ট টেবিলে বসে আছে। ছোট্ট ধাতব চেয়ারে বসতে বেশ অস্বস্তি
হচ্ছে ওর, বোঝাই যাচ্ছে ।
87

ওর লাল ব্লেজার আর টাইয়ের ভেতর, বিশাল এক বুকের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দেখতে ঠিক
একটা মাস্তানের মতোই , কিন্তু বেশীরভাগ মাস্তানের চাইতে ও অনেক বেশী জানে – সেটা দেখেই
বোঝা যাচ্ছে। ওর পেছনে লাল ভেলভেটের পর্দার পেছনে যা আছে, সেখানে যে কারো প্রবেশে
বাঁধা দেয়ার জন্যই বসে আছে – সেটাও বুঝতে পারলো চ্যাজ।

বিশাল লোকটা কনস্টেনটিনের দিকে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে একটু তাকিয়ে রইলো। তারপর ছোট
টেবিলটার ওপরে রাখা কিছু ‘ট্যারট কার্ড ’ থেকে একটা কার্ড উঠিয়ে নিলো । সেটা এমনভাবে
ধরলো , কনস্টেনটিনরা কেবল ওটার পেছনে আঁকা বাতাসে ভেসে থাকা দুটি ডলফিন দেখতে
পেলো কেবল। সে নিজেই কেবল সামনের দিকটা দেখতে পাচ্ছে !

কনস্টেনটিন কার্ড টার দিকে তাকালো একটু । তারপর চোখ বন্ধ করলো। এক মুহূর্ত পর, বলে
উঠলো “একটা বেঞ্চের ওপর দুইটা ব্যাঙ !”

কার্ড টা দুম করে টেবিলে রাখা হলো, সামনের দিকটা ওপরে রাখা। সেখানে দেখা গেলো, একটা
বেঞ্চের ওপর দুইটা ব্যাঙ বন্ধু র মতো বসে আছে। বাউন্সার চোখের ইশারায় কনস্টেনটিনকে সামনে
যেতে বললো।

কনস্টেনটিন এগিয়ে গেলো টেবিল পার হয়ে, পর্দা ভেদ করে ভেতরে যেতে গিয়ে, সেটা খানিক
ফাঁক রেখে গেলো। চ্যাজকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্যই কি ?

চ্যাজ অনুসরণ করতে শুরু করলো – আর বাউন্সারের হাতে বাঁধা পেলো ! তারপর আরেকটা
ট্যারট কার্ড তু লে নিলো টেবিল থেকে, আগের মতোই সামনেটা নিজের দিকে ঘোরানো। এবার
চ্যাজের পালা পরীক্ষা দেয়ার !

সেই কার্ডে র পেছনে , সেই একই রকমের দুটো ডলফিন। চ্যাজ বললো “দুটো ব্যাঙ, একটা বেঞ্চের
ওপর !”
88

বাউন্সার ভ্রু কুঁ চকে, চাপড় মেরে কার্ড টা রাখলো টেবিলের ওপর , সামনেটা ওপরে রেখে। এটা
দেখাচ্ছে, একটা নাচু নে ভাল্লুক, পোশাক পরা !

বাউন্সার , কোন কথা না বলে, বাইরের দরজার দিকে দেখিয়ে দিলো চ্যাজকে।

“হেই, আমি ওর সাথে আছি” চ্যাজ চিৎকার করে উঠলো কনস্টেনটিনের উদ্দেশ্যে “তাই না ,
জন? জন ! ওহ, এতোটা বাজে আচরণ করো না , জন !”

কনস্টেনটিন এমনকি পেছন ফিরেও তাকালো না । এবার বাউন্সারটি ভীতিকরভাবে উঠে


দাঁড়ালো।

চ্যাজ পিছু হটে এলো , ভাবচেঃ

কোন একদিন , জন, কোন এক দিন !

কনস্টেনটিন একটা লোহার দরজা পার হলো , তারপর আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে, একটা
ল্যান্ডিং এ এসে দাঁড়ালো। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে, একটা বিশাল রুম, ওপরের নাইটক্লাবের
চাইতে অনেক খানি বড়। বলা অসম্ভব আসলে, নিচের দিকে কতখানি বিস্তৃ ত সেটা। এটা একটা
সুবিশাল চেম্বার, ভেতরে অনেকগুলি লাইট, আর ঝকমকে অনেকগুলি বল সহ, কিন্তু তারপরও ,
অনেকখানি অন্ধকার। দূরের দেয়ালটা দেখাই যাচ্ছে না, আলো-আঁধারির খেলা যেন অনন্ত পথ
জুড়ে বিস্তৃ ত। লাইট গুলি যেন অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে তু লছে, নিজেদের চক্রের বাইরে তেমন
আলো ছড়াতে পারছে না। উদ্দাম , ধুপ ধুপ শব্দে নাচের বাজনা বাজছে, সামনের দেয়ালের কোন
একটা অংশ থেকে।

কনস্টেনটিন পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নামা শুরু করলো। লেভেলের পর লেভেল পার হয়ে যেতে
লাগলো , টেবিল আর বারে ভর্তি । একটা টেবিলে, একদল স্যুট পরা ব্যবসায়ী বসে ছিলো ।
আপাতদৃষ্টিতে তাঁদেরকে দেখতে খুবই সাধারণ মনে হচ্ছিলো । কিন্তু তাদের মধ্যে একজন
89

গ্লাসগুলোতে ‘এভিয়ান’ ঢালল , আরেকজন সেগুলোর ওপর দিয়ে হাত বুলিয়ে আনার পর দেখা
গেলো, সেগুলো রেড ওয়াইন এ পরিণত হয়েছে ! আর, কনস্টেনটিন জানে, ওগুলো দেখতে
যেরকম, স্বাদও সেরকমই হবে !

আরেকটা টেবিলের সামনে দিয়ে যাবার সময়, দেখলো বিশের কোঠার দুই মেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে
আছে। ওদের চোখগুলো জ্বলে উঠলো সে ওদের সামনে দিয়ে যাবার সময়। সে ওদের
তোষামোদপূর্ণ ফিসফিস কথা, মুখ টিপে হেসে ওঠা শুনতে পেলো। আর, ওর নিজেকে কেমন
জানি নগ্ন মনে হলো। মেয়েদুটো ওদের এক্স-রে চোখ দিয়ে, ওকে আসলেই নগ্ন করে দেখে নিয়েছে !

কনস্টেনটিন এরপরও নেমে চললো। সিঁড়ির একপাশে বসানো অনেকগুলি বারের একটার সামনে,
এক তরুণ বসে আছে টু লের ওপর। ওর লম্বা লেজ দিয়ে পাশে বসা এক মেয়ের কোমর আঁকড়ে
আছে। মেয়েটার চোখ দুটো কু চকু চে কালো , কোন সাদা অংশ নেই, শুধুই কালো ! ওই একই বারে,
একটা মানুষের মতো দেখতে জন্তু, যে কিনা সম্ভবত দশ ফু ট লম্বা, কনস্টেনটিনকে আসতে খেয়াল
করলো। আর তারপরই, বেশ নার্ভাসভাবে , বাইরের দরজার দিকে সরে পড়তে চাইলো ।

কনস্টেনটিন একটু থামলো – ঐ দৈত্যটার জন্য না । ও ব্যাটা পুরানো হয়ে গেছে । ও থেমেছে ,
কারণ বারঅলা ব্যালকনিটার প্রান্তে, একটা টেবিলে বসে – এলি হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে ! ও
বসেছিল দুজন লোকের সাথে, একজন সাদা আর একজন কালো। ওরা যখন ফিরে কনস্টেনটিনের
দিকে তাকালো , ওদের ভেতর ক্ষীণ একটু অলৌকিক দীপ্তি দেখতে পেলো সে ! এলি’র কোন
দীপ্তি ছিলো না, বলাই বাহুল্য।

ওদের সাথে ওকে দেখাটা মজাদারই ছিলো – কিন্তু এই ক্লাবের জন্য অস্বাভাবিক নয়। এটাই
‘মিডনাইট ক্লাব’ এর বৈশিষ্ট্য ! এটা অতিপ্রাকৃ ত জীবেদের জন্য ‘নিরপেক্ষ জায়গা’ , সেইসাথে
ওদের সাথে যারা চলাফেরা করে, তাদের জন্যও !

“হেই , জন ! পার্টি করতে চাও ?” এলি জিজ্ঞেস করলো , ওর লেজটা আমন্ত্রণের ভঙ্গিতে বেঁকে
গেলো !
90

“আজ রাতে সময়ের একটু অভাব আছে !”

“আমি ওটা ঠিক করে দিতে পারবো ।”

সে, আর যাই হোক, একজন কর্মী ...... জীব ।

কনস্টেনটিন মাথা নাড়লো, তারপর হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে দিলো। এলি তার উপ-ফেরেশতাদের
কাছে ফিরে গেলো। আর কনস্টেনটিন নেমে যেতে লাগলো সিঁড়ি বেয়ে, মানুষ আর না-মানুষদের
পেরিয়ে ! চোখের কোণে সরে সরে যেতে লাগলো পাখনা, লেজ, শিং – মাঝে মাঝে থেমে পরখ
করতে লাগলো বিশেষ কোন কিছু চোখে পড়লে। ক্রূ র ভাবে হাসতে থাকা এক লোক, যার হাত পা
মাথা শরীর থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে শূন্যে ভাসছে ! ওগুলি শরীরের যেখানে যেখানে থাকার
কথা, সেখানকার কাছাকাছিই ভাসছে। আর এমনভাবে মোচড় খাচ্ছে, যেভাবে জোড় অলা অঙ্গ
প্রত্যঙ্গের পক্ষে কখনোই করা সম্ভব নয়। একজন লোক , যার কাঁধে বসে আছে পাখনাঅলা একটা
মানুষের মাথার খুলি ! একটা পোষা কাকাতু য়ার মতোই , সেটা লোকটার মাথায় নাক দিয়ে ঠেলা
দিচ্ছে । আর , লোকটা , একটা মানুষের হৃদপিণ্ড ছিঁ ড়ে ছিঁ ড়ে সেটাকে খাওয়াচ্ছে। একজন কালো
মহিলা, যার গাউনটা দেখে মনে হচ্ছিলো খুব সুন্দর লাল ঢেউ খেলানো সাটিনের মতো । কিন্তু
এরপর দেখতে পেলো , সেটা আসলে অগ্নি-শিখার তৈরি, যেটা বেরোচ্ছে মহিলার গা থেকেই।
একজন বিশিষ্ট সিনেটর’কে দেখা গেলো একজন মহিলার সাথে কথা বলছেন , যার মাথা’টা একটা
সাপের। এমন একটি জীব , যেটাকে কিনা ঐ বৈসাদৃশের মাঝেও, দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে !

শেষমেশ, কনস্টেনটিন পৌঁছল সেই লেভেলে, যেটার খোঁজে সে এসেছে। সেটার করিডোর ধরে
এগিয়ে গেলো সে। সেই করিডোরের শেষে, সে খুঁজে পেলো দুটো জবরদস্ত দরজা। যেগুলো কি
দিয়ে তৈরি , সে নিজেও জানে না, মনে হচ্ছে যেন সময়কে থামিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে।

সে অপেক্ষা করতে লাগলো, জানে, ‘মিডনাইট’ জেনে গেছে যে সে এসেছে। সেকেন্ডের কাঁটা
ঘুরতে লাগলো দ্রুত গতিতে।
91

ক্লান্তির একটা ঢেউ ভেসে এলো, আর ওর ওপর দিয়ে বয়ে গেলো ! একটু টলে গেলো সে,
তারপর শক্তি সঞ্চয় করে চিৎকার করলো “মিডনাইট ! আমি কি এখানে ভারী নিঃশ্বাস ফেলতে
থাকবো খালি ?”

দীর্ঘ একটা মুহূর্তে র পর, যেন দরজাগুলোই বিবেচনা করছে খুলবে কি-না। তারপর, গোঁ গোঁ করে
খুলে গেলো দরজাগুলো । একজন ভীষণ লম্বা লোক, অনেক পুরানো ক্ষত সারা গায়ে – জায়গা
করে দিলো কনস্টেনটিনকে ভেতরে যাওয়ার জন্য। ও ভেতরে ঢোকার সময় , তেরছাভাবে তাকিয়ে
রইলো ওর দিকে।

কনস্টেনটিন মিডনাইটের অফিসে ঢু কলো । একটা বিশাল রুম, অনেকগুলি মুখোশ, দুষ্প্রাপ্য
গাছপালা, আর বিভিন্ন ধরণের ফোন আর কম্পিউটার দিয়ে বোঝাই। মিডনাইট বসেছিলো একটা
টেবিলের সামনে । সেখানে একটা তামার ওরেরি (কৃ ত্রিমভাবে তৈরি সৌরজগতের মডেল)
রয়েছে। সেটা, স্থির হয়ে আছে এই মুহূর্তে । আর এই ওরেরিটা’র বিশেষত্ব হলো, এটা মহাজগতের
আদিম শক্তিগুলির প্রতিনিধিত্ব করছে। আর সেই বিশ্বগুলোর ছোট্ট গায়ে খোদাই করা আছে
নানারকম জাদুই প্রতীক আর প্রাচীন পরিভাষা, গ্রিক আর ইংরেজি ভাষায় সেগুলোর মানেও
লেখা আছে পাশে। বস্তুগত, মহাজাগতিক, আধিদৈবিক, প্রতিকী , এরকম আরও অনেক অনেক
প্রকাশ লেখা আছে সেখানে। সেই ওরেরিটা’র ঠিক মাঝখানের গোলকটার গায়ে লেবেল লাগানো
আছে, সেটার নাম হলো ‘স্রষ্টা’ !

একটা টেবিলে বসে, সেই ওরেরিটা’র ওপর কাজ করে চলেছে মিডনাইট , মাঝরাতের মতোই
কালো সে। এককালের হাইতিয়ান ‘জাদুকর চিকিৎসক’, এখন আরও পরিণত। জাদু
চিকিৎসকের ছাপ এখনও তার চেহারা থেকে মুছে যায়নি। কিন্তু, এখন সে আরও অত্যাধুনিক
জাদুতে নিজের হাত পাকিয়েছে। সে একজন বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী, এই ক্লাবের কর্ণধার। আর ওর
অনেকগুলি খুব সুন্দরভাবে সেলাই করা স্যুট জ্যাকেট আছে, যেগুলোর একটা এখন পরে আছে
সে। গলায় ঝু লছে রূপার তৈরি একটা কাঁকড়াবিছা আকৃ তির লকেট। কনস্টেনটিন দেখেছে,
লকেটটা জীবিত হয়ে, মানুষজনকে অনেকবার হুল ফু টিয়ে দিয়েছে।
92

কনস্টেনটিন ঢোকার পরও, সে তার মেরামতি কাজ থেকে চোখ তু ললো না।

“ওটা কখনও ব্যালেন্স হবে না ............” কনস্টেনটিন বলে উঠলো ।

“আহ” মিডনাইট বলে উঠলো , একটা যন্ত্রাংশকে ব্রেইন সার্জ নের দক্ষতায় ওয়েল্ডিং করতে করতে
“কিন্তু এটা সবসময়েই হয়। আমাদেরকে কেবল এটা দেখা শিখতে হবে , যে কিভাবে ওটা ব্যালেন্স
হয় ” ওর হাইতিয়ান একসেন্ট ওকে এখনও ছেড়ে যায় নি।

“কেউ একজন খুব বেশী বেশী ‘ভাগ্যগণনা পাতা’ পড়ছে !”

মৃদু বিরক্ত চোখে, ওর দিকে তাকালো মিডনাইট “তু মি বেশ অনেকদিন আসোনি। এখন কি, কোন
বিশেষ পুরাতাত্ত্বিক জিনিস বিক্রি করতে এসেছ ? ”

“নাহ, ওসব এখন আর করি না, অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি ”

“নাকি ভু য়া জিনিসপত্র ফেরি করে করে সরীর খারাপ করে ফেলেছ ?”

কনস্টেনটিন ওঁর দিকে তাকিয়ে রইলো খানিক “আমার সাথে যা ঘটেছে, সেটার পেছনে কি তোমার
হাত আছে , সেটাই বলতে চাও ?”

মিডনাইট মাথা নাড়লো , ক্ষীণ হেসে বললো “না, আমি জানি না কি ঘটেছে, কিন্তু আমি কোন
কিছুর পেছনে নেই – অন্তত তোমার সাথে যা ঘটছে, সেটার পেছনে অন্তত নয় ” ওর হাসিটা হঠাৎ
বিষাক্ত হয়ে পড়লো “কিন্তু সেটা যাই হক না কেন, আমি নিশ্চিত, ওটা তোমার প্রাপ্য। ওই
পুরাতাত্ত্বিক জিনিসটার পেছনে আমার অনেক ক্রু গারান্ড (সাউথ আফ্রিকান স্বর্ণ মুদ্রা) খরচ করতে
হয়েছে ।”

“জেসাস ! মিডনাইট – আমি ভেবেছিলাম ওই জিনিসটা আসল। তু মি নিশ্চয়ই এখনও ওই


জিনিসটা নিয়ে বিরক্ত নও.........”
93

ওরা একে অপরের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে রইলো। একে অপরের ইচ্ছাশক্তি পরীক্ষা করছে।
সমানে চোখে চোখে তাকিয়ে রইলো কনস্টেনটিন, যতক্ষণ না ছোট্ট একটা কাশি এসে ওকে থামিয়ে
না দিলো।

মিডনাইট একটা শ্বাস ফেলে কাঁধ ঝাঁকালো।

“কিহ ?” কনস্টেনটিন দাবী করলো “আমি চোখের পাতা ফেলিনি ! ওটা কাশি ছিলো। তু মি
কখনও কাশ না ? ”

মিডনাইটের চোখ সরু হয়ে এলো । একটু ক্ষণ তাকালো কনস্টেনটিনের দিকে , মনে হল ওর
ভেতরটাও সে দেখে নিচ্ছে ! তারপর বললো “আহ...... দেখছি । তোমার স্বাস্থ্য খারাপ...... অন্য
কারণে। কতদিন ধরে ?”

এবার কনস্টেনটিনের নিঃশ্বাস ফেলার পালা। সে ‘স্রষ্টা’ লেখা ছোট্ট গোলকটার দিকে তাকিয়ে
বললো “অল্প কিছু মাস, হয়তো এক বছর ।”

“হুম, আমি আমার মনে হল , একটা বজ্রপাতের শব্দ শুনেছিলাম গত রাতে। ওটা নিশ্চয়
শয়তানের পেটের ভেতর গুড়গুড়ের শব্দ ! উনি তাহলে তোমার আত্মা সংগ্রহ করার জন্যই নিজে
নেমে এসেছেন !”

কনস্টেনটিন একটা ক্ষীণ হাসি হেসে বললো “আমিও সেরকমই শুনেছি !”

“হুমম, আমি নিশ্চিত তু মি কান্নাকাটি করার জন্য একটা কাঁধের খোঁজে নিশ্চয়ই আসোনি ! তবে?”

কনস্টেনটিন একটা সিগারেট নিয়ে খেলা করতে লাগলো ধরাচ্ছে না “একটা পিশাচ , আমাকে
আক্রমণ করেছে, প্রকাশ্য রাস্তায়, সানসেট বুলেভার্ডে !”

“তেমন অবাক করা কিছু না । ওরা তোমাকে পছন্দ করে না, জন। ওদের কতজনকে তু মি নরকে
ফেরত পাঠিয়েছ ? ”
94

“না, তু মি বুঝতে পারছো না। ওটা স্রেফ একটা রাগী দো-আঁশলা ছিলো না। ওটা পুরোদস্তুর একটা
পিশাচ ছিলো ! এখানে, আমাদের জগতে । একদম স্বয়ং উপস্থিত ছিলো সে। ”

মিডনাইট এবার ওর ভ্রু ওপরে তু লে ফেললো এবার “তোমাকে নিশ্চয় মনে করিয়ে দিতে হবে না,
যে সেটা অসম্ভব !”

“আর, একটা সৈনিক পিশাচকে দেখেছি, একটা ছোট্ট মেয়ের শরীর থেকে ঘুষি মেরে পথ করে বের
হতে চেষ্টা করছে ! স্কাউটের দিব্যি। ” গলা পরিষ্কার করলো কনস্টেনটিন, ভেতরের রক্ত থুতু দিয়ে
ফেলে দেয়ার জন্য কিছু একটা খুঁজছে “মানে আমি যদি স্কাউট হতাম আর কি ”

“অথবা কোন সম্মান যদি থাকতো ! কিন্তু, তু মি নিশ্চয়ই ভু ল করছো । এখানে আছে কেবল দো
আঁশলা আর রিমোট কন্ট্রোল, যেগুলোকে লোকজন ‘পজেশন ’ বলে ডাকে, জন। পিশাচেরা
থাকে নরকে, ফেরেশতারা স্বর্গে। সত্যিকারের মহাশক্তিদের মধ্যেকার পুরানো কূ টনীতি !”

মিডনাইট চিন্তিতভাবে স্পর্শ করলো ওরেরির সেই অংশটা, যেখানে স্বর্গ আর নরকের চক্র ,
পৃথিবীর কক্ষপথকে ভেদ করেছে। “বর্বরদের ফ্যান্টাসি, নরক থেকে লুটপাট করতে আসা
সেনাবাহিনীর গল্প তো , স্কু লের বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য বলা হয় !”

কনস্টেনটিনের কণ্ঠে বিদ্রুপ ঝরল “ইতিহাস পাঠের জন্য ধন্যবাদ ! অনেক সাহায্য করলে তু মি !”

তারপর বললো “এখন – মিডনাইট , আমার চেয়ারটা ব্যাবহার করা লাগবে ”

মিডনাইট মাথা নাড়লো “জন, জন। এটা ভু লে গেছো যে, ওটা তোমাকে প্রায় খুন করে ফেলতে
পারে...... তু মি জানো আমি হলাম সুইজারল্যান্ড। নিরপেক্ষ। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যালেন্স ঠিক থাকছে,
আমি কোন পক্ষ নেব না । এছাড়া অন্য কিভাবে আমি এই ধরণের প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছি, যেখানে যে
কেউ – তাদের নিজেদের সত্ত্বায় নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। ”
95

কনস্টেনটিনের মনে হলো, এবার মিডনাইটকে পুরানো ঋণ মনে করিয়ে দেয়ার সময় এসেছে “তু মি
বারটেন্ডার হবার আগে, তু মি ছিলে কেবল একজন জাদুকর ডাক্তার । ওদের , কতজন জানি, হ্যাঁ,
ত্রিশজন আশগার (কু মিরমুখো মানুষের আকৃ তির পিশাচ) এর বিরুদ্ধে ? আর আমি --”

“ছিলে কনস্টেনটিন ” মিডনাইট বলে উঠলো , হালকা নড করে বলে উঠলো “দি জন
কনস্টেনটিন ” একবার কনস্টেনটিনের দিকে তাকিয়ে , সামনের শিল্পটির দিকে তাকালো সে “এক
সময়। ” বিষণ্ণ হেসে যোগ করলো “ব্যাল্যান্স পাল্টে গেছে , পাল্টে গেছে সময় । আর .........
আমি সবসময়ই একজন ব্যবসায়ী ছিলাম। তু মি জানো সেটা। ”

“এটা প্রতিনিয়ত খেলার মতো না ” কনস্টেনটিন জোর দিয়ে বললো “আমি অনুভব করতে
পারছি। কিছু একটা ঘনিয়ে আসছে ”

“উউউহ !” দরজা থেকে বলে উঠলো একটা কণ্ঠ “ভূ তু ড়ে !”

কনস্টেনটিন ঘুরে তাকালো সেদিকে । দেখলো, শীর্ণ, মানুষের মতোই দেখতে , বরফের মতো ঠাণ্ডা
আত্মবিশ্বাস , একই সাথে তরুণ এবং বৃদ্ধ একজন দাঁড়িয়ে আছে ! পশ ধরণের কালো পোশাক-
আশাক পরনে।

“বালথ্যাজার ......”

বালথ্যাজার সম্মতির ভঙ্গিতে হাসলো , এক আঙ্গুল থেকে আরেক আঙ্গুলে একটা সোনার কয়েন
ঘোরাতে ঘোরাতে। “তোমার মুখের যে চেহারা হয়েছে, সেটা দেখেই আমার আজকের রাত
সার্থক!”

কনস্টেনটিন ওর দিকে এক পা এগোল, তারপর আরেক পা, আরেক পা। ভেংচি কেটে হেসে
বললো “আমি করে দিচ্ছি সার্থক ! তোমাকে এক্ষু নি এখান থেকে তাড়াচ্ছি আমি , ব্যাটা নোংরা
দো-আঁশলা কোথাকার !”
96

ও আরেক পা এগোল , ওর হাত তু ললো যার মাধ্যমে বালথ্যাজার’কে তাড়িয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া
শুরু করা যাবে।

“কনস্টেনটিন !” ঘেউ করে উঠলো মিডনাইট।

কনস্টেনটিন থেমে গেল, ও জানে.........

“আমার এখানকার নিয়ম জানো তু মি। আর এখানে থাকা অবস্থায়, ওগুলো মেনে চলবে তু মি !”

বালথ্যাজার এমনকি চোখের পাতাও নাড়েনি। সে দরজায় দাঁড়িয়ে হেসেই যাচ্ছে , আর আঙ্গুলের
ডগায় কয়েন ঘুরিয়েই যাচ্ছে, ঘুরিয়েই যাচ্ছে.........

শেষমেশ সে বলে উঠলো “জনি বয়- তোমার ক্ষত এখনও শুকায়নি ? আমি স্রেফ একটু কান
কথা বলেছিলাম। মেয়েটার স্বাধীনতা ছিলো বেছে নেয়ার, মনে আছে ? ”

ও আরেকটু ঝুঁকে এলো রুমের ভেতর, কয়েন খেলা করে যাচ্ছে আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে “কথাটা
হলো, তু মিই হলে সেই লোক, যে কিনা পাতালে রওনা হচ্ছ ! আহ, নতু ন মাংস !” ও এবার ওর
আঙ্গুল চাটতে লাগলো ওর চেরা জিভ দিয়ে।

কনস্টেনটিন এবার অভিযোগের দৃষ্টিতে চাইলো মিডনাইটের দিকে “মিড নাইট, ঐ ব্যাটা আক্ষরিক
অর্থেই ঐ ঘুমের ওষুধগুলো খাইয়েছিল মেয়েটাকে...... ”

বালথ্যাজার হেসে উঠলো “শান্তি, শান্তি, মরা মানুষ ! ”

মিডনাইট কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো “আমাদের একটা মিটিং আছে এখন, জন। ওর এপয়েন্টমেন্ট
আছে, দুঃখিত । ”

কনস্টেনটিন রাগত ভাবে কিছু বলতে গেলো – কিন্তু বেরিয়ে এলো এক দমক কাশি । সে রক্তের
স্বাদ পেলো।

বালথ্যাজার বিশ্রীভাবে হাসলো “কি ? আমি শুনতে পাই নি !”


97

কনস্টেনটিন শ্বাস ফিরে পাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু পারলো না ! একটা চরম
ভয়ের শিহরণ খেলে গেলো ওর শরীরে, বিদুচ্চমকের মতো। এটাই কি সেই মুহূর্ত ? ও কি এক্ষু নি
মারা যাবে, ঐ হতচ্ছাড়া বালথ্যাজার ওর দিকে বাঁকা ভাবে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় ? বালথ্যাজার,
যে কিনা ওর সবচেয়ে কাছের একজনকে লোভ দেখিয়ে, তারপর ধ্বংস করে দিয়েছিলো !

অন্তত ও অন্য কোন জায়গায় মারা যেতে চায়। এই টিটকারি মারতে থাকা কু ত্তার বাচ্চাটার সামনে
না। যে কিনা কনস্টেনটিনের আত্মাটা শরীর ছেড়ে বেরোনো মাত্র কব্জা করে নেবে ? তারপর নিজে
বয়ে নিয়ে গিয়ে শয়তানকে তু ষ্ট করবে ?

কাশতে কাশতে , বালথ্যাজারকে অতিক্রম করে বাইরে বেরিয়ে এলো। কালো করিডোর ধরে
এগিয়ে যেতে লাগলো। তারপর পড়তে পড়তে সিঁড়ির দিকে যেতে গিয়ে, একটা বারের পেছনে
বাথরুমের দরজা দেখতে পেলো। ঝটকা দিয়ে সেখানে ঢু কে গেলো সে। কেবল বেসিনের কাছে
এসেছে, তখনই বেরিয়ে এলো রক্ত, গাল ভর্তি করে। বেসিন লাল করে দিলো সেটা।

পাগলের মতো নিজের কোট হাতড়ে ভিক্সের বোতল বের করলো সে, যেটাতে সে জ্যাক
ডেনিয়েলস ভরে রেখেছে। সে ঢক ঢক করে গিলতে শুরু করলো, যতক্ষণ না বুকের ভেতর
সামান্যতম খিঁচু নি বাকি রয়ে গেলো।

আস্তে আস্তে, অগভীরভাবে , শ্বাস ফিরে পেতে লাগলো সে। তাকালো আয়নার দিকে, নিজের
ফ্যাকাসে চেহারার দিকে। তারপর ওর চোখ গেলো পেছনের একটা কু প থেকে বেরিয়ে আসছে
একজোড়া ডানা, সেটার পেছনে কাঁটা অলা একটা লেজ !

ও নিচের বেসিনের দিকে আবার তাকালো । রক্তের ছিটে এমনভাবে পড়েছে, যে সে ওটা প্রায়
পড়ে ফেলতে পারছে, প্রায় চা পাতার মতোই। হ্যাঁ, ওটা ছিলো একটা প্রাচীন জাদুকরী চিন্হ যার
মানে দাঁড়ায়ঃ

মৃত্যুর মাধ্যমে জয়ী হও !


98

সাত

ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা , মেক্সিকান সীমান্ত

ফ্রান্সিস্কো চাবি ট্রাকের ভেতরেই রেখে এসেছে। ওটা ঐ বেড়ার ওপর চালানো যাবে না। আর
ওটাকে মরুভূ মির ওপর দিয়ে এতদুর আনতে গিয়ে, প্রায় ধ্বংসই করে ফেলেছে সে। রেডিয়েটর
দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, আর সামনের ডান দিকের টায়ার ফেঁ সে গেছে অনেক আগেই।

বেড়ার কাছে গিয়ে ওটার দিকে চাইলো সে। ওটা অনেক উঁচু , চেইনের তৈরি, ওপরে কাঁটাতার
দেয়া।

ওটা তোমাকে থামাতে পারবে না , ফ্রান্সিস্কো। ওটা তোমাকে ব্যাথা দিতে পারবে না।

কিন্তু বেড়ার ওপাশে.........মরুভূ মি, আর বড় বড় পাথরে ভর্তি ন্যাড়া পাহাড়ের মেলা।


‘দেসিওরতো দে অলটার’ এর সর্ব উত্তর বিন্দু। এখানে, অনেক ‘সম্ভাব্য ইমিগ্রান্ট’ পায়ে হেঁটে
পেরোতে গিয়ে মারা গেছে, এই রকমই কোন গরমের দিনে। ওর হাড়গুলো সূর্যের তাপে ঝলসে
যাবার জন্য ফেলে যাবার কোন ইচ্ছাই নেই ওর।

ও লোহার স্পাইকটা ধরলো আবার, যেটা একটা চিকন দড়ি দিয়ে গলার সাথে ঝু লিয়ে নিয়েছে সে।
ওর স্পর্শে, সেই সমবেত চিবানো, বিজবিজ শব্দ আর শত শত ক্ষু ধার্ত শব্দ বেজে উঠলো......ওর
সাথে কথা বলছে কোন শব্দ ছাড়াই। ওকে তাগিদ দিচ্ছে !

“সি (হ্যাঁ)” সে বললো শব্দ করে।

সে হেসে উঠে , ছুটে গেলো বেড়ার দিকে, লাফ দিলো একটা। চেইনের ফাঁকে ফাঁকে আঙ্গুল ঢু কিয়ে
, বেয়ে ওঠা শুরু করলো। এটা, আশ্চর্যজনকভাবে সহজ। ওপরের কাঁটাতারের বেড়া খুব
99

অবহেলাভরেই পার হয়ে গেলো। ওর যে হাত কেটে গেছে, থাইয়েও যে রক্ত বেরোচ্ছে, সেদিকে
কোন ভ্রুক্ষেপই নেই ! সে ক্ষীণভাবে টের পেলো একটু , পাত্তা দিলো না।

সে ফিরে তাকালো মেক্সিকোর দিকে। এখানে দাঁড়িয়ে দুই দিকই একইরকম দেখতে লাগছে। বাদামী
আর ধূসর ধুলোর জগত ওদিকেও, এদিকেও তাই। কিন্তু ওইদিকে মেক্সিকো, এদিকে আমেরিকা।
এক অলৌকিক জায়গা !

ফ্রান্সিস্কো ফিরল, তারপর অট্টহাসি দিয়ে উঠলো একটা। এক হাতে লোহার স্পাইকটা এক হাতে
ধরে, উত্তরে এগোল দৃঢ় পায়ে। রক্ত পরা বন্ধ হয়ে গেলো একটু পরেই। ওর মনে হচ্ছিলো ওর
পায়ের নিচে বুট গুলো ছিঁ ড়ে ছিঁ ড়ে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও সে হেঁটে চললো নিঃসাড়ে,
ক্লান্তিহীন ভাবে।

মাইলের পর মাইল............

ওর তৃ ষ্ণা পাওয়ার কথা ছিলো, কথা ছিলো প্রচণ্ড গরম লাগার। কিন্তু এসবের কিছুই হলো না।

শেষ বিকেলে, সে একটা পাথুরে ঢালের মাথায় উঠলো , আর দূরের দিকে তাকালো। ওটা ... ওটা
কি একটা রাস্তা ? ঢেউ ওঠা তাপ তরঙ্গের মধ্যে নাচছে ? হ্যাঁ, একটা ছোট ট্রাক ঝলসে উঠলো
সূর্যের আলোতে, এতদুর থেকে ওটাকে দেখতে খেলনার মতোই লাগছে। কিন্তু, ওটা একটা রাস্তাই
বটে।

উত্তরের দিকে গেছে ওটা।

আমেরিকাতে ওর জন্য আসলে কি অপেক্ষা করছে ? সে জানতো, আমেরিকাকে অনেকেই,


মেক্সিকোর দরিদ্রতম অঞ্চলগুলোর মতোই নরকতু ল্য দেখতে পেয়েছে। উত্তর আমেরিকাতে, অবৈধ
অভিবাসীদেরকে রীতিমতো শোষণ করা হয়, একদম নামমাত্র বেতন দেয়া হয়। ওর সাথে ময়লা
কু ড়ানো এক লোক, ভিক্টোরিয়ানো , যার দুটো আঙ্গুল নেই, সে একটা গল্প বলেছিলো ওকে। ও
সেই পয়সাখেকো কয়োট দেরকে অনেক টাকা দিয়েছিলো ওকে উত্তরে নিয়ে আসার জন্য।
100

টেক্সাসে , একটা মাংস প্যাকিং করার কারখানায় চাকরি নিয়েছিল সে। কারণ চাকরি দাতারা ওকে
বলেছিলো , ঘণ্টায় দশ ডলার করে পাবে সে। কিন্তু , ওরা ওকে দিলো ছয় ডলার, সেখান থেকেও
আবার অর্ধেক কেটে রাখলো ওর ‘থাকার ব্যবস্থা’ করার কথা বলে। একটা মোবাইল হোমে
মাটিতে শুত সে , অন্য আরও ছয়জন লোকের সাথে। কাজটা খুবই দ্রুত গতির ছিলো, আর
অনেক লম্বা সময় ধরে কাজ করতে হতো। কোন ধরণের ওভার টাইম ছিলো না সেখানে। যার
ফলে ক্লান্তিতে একদিন মাংস ছাঁটার অটোমেটিক ছুরিতে ওর দুটো আঙ্গুল কাটা পড়লো । সে
ক্ষতিপূরণ চাইলে, ওকে প্রশাসনের কাছে সোপর্দ করলো ওরা। ওকে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে
দেয়া হলো আবার। কপর্দ ক শূন্য , দুটি আঙ্গুল নেই ।

কিন্তু ওটা ফ্রান্সিস্কোর জন্য নয়। ও এখনও একজন ধাঙ্গড়, আর লস এঞ্জেলসে কেবল টাকার
পাহাড়, সোনার তাল , হীরার ঝকমকি আর মাদকের মেলা , কেবল সংগ্রহ করার অপেক্ষা।

এসব ভাবতে ভাবতে, একটা উঁচু টিলার ওপর উঠে, সে নিচে দেখতে পেলো হাইওয়ে বিছিয়ে
আছে। আর... একটা ট্রাক থামার জায়গা।

ওখানে একটা ড্রাইভ-ইন রেস্তোরাঁ আর একটা নুড়ি বিছানো পার্কিং লট আছে। সেখানে কেবল
একটা সেমি ট্রাক আর একটা কার দাঁড়ানো। সে নামতে নামতে , নীল ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সেমি
ট্রাকটা বেরিয়ে গেলো। একলা কার’টার ভেতরে এক লোককে দেখা গেলো একটা হ্যামবার্গারে
কামড় বসাতে। এক মুহূর্ত ভাবলো ফ্রান্সিস্কো , ও যদি এখন গাড়িটা রাহাজানি করতে যায়, তবে
ড্রাইভ ইনে থাকা প্রত্যেককে ওকে হত্যা করতে হবে। ওরা হাইওয়ে পেট্রোলকেও ডেকে বসতে
পারে, যদি ওকে গাড়িতে নিতে দেখে।

ও দৌড়ে ঢু কলো রেস্তোরাঁ’তে । স্রেফ দুইজন মানুষ। একজন বয়স্ক ল্যাটিনো কু ক আর একজন
মধ্যবয়সী সাদা মহিলা ওয়েট্রেস । ওরা খুব বেশী আওয়াজ করার সুযোগ পেলো না, ফ্রান্সিস্কো
ওদের মাথা লোহার স্পাইকটা দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার আগে। লাইট বাল্ব ভাঙ্গার মতোই সহজ !
101

ক্যাশ রেজিস্টার থেকে বড় বড় নোটগুলো টেনে নিয়ে, বাইরে বেরিয়ে এলো। কার’টার দিকে পেছন
থেকে এগোল সে। সে যখন দরজা খুলে ঢু কছে, ওর দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলো
ভেতরে বসা লোকটা। মুখের হাঁয়ের ভেতর বার্গারটা চিবানো শেষ হয়নি তখনও, ফ্রান্সিস্কো ওকে
বাইরে টেনে বের করে মাটিতে ফেলে, মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দিলো বুটের তলায় !

ঐ লোহার স্পাইকটার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে, অবশ্যই। একটা লোহার টু করো, ভেতরে পুরানো
দেবতাদের শক্তি ঠাসা।

‘পুরানো দেবাতারা ফেরত এসেছেন, ফ্রান্সিস্কো। আমাদের বিশ্বাস করো ! এখন , গাড়িটা নাও।
উত্তরে যাও। লস এঞ্জেলস...... বেশী জোরে চালিও না। পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ কোরো না। স্পীড
লিমিটের ভেতরে থেকো, এখান থেকে লস এঞ্জেলস বেশী দূরে না.........

লস এঞ্জেলস, ক্যালিফোর্নিয়া

কনস্টেনটিন , ওর ঘরের জানালার গোবরাটের ওপর বসে আছে। এক হাতে মদের গ্লাস, আরেক
হাতে সিগারেট। পাশে রাখা আছে ছোট্ট একটা কালো বাক্স, দেয়ালের স্পেশাল সেলফ থেকে এনে
রাখা। ওটা ওখানেই রাখা, খোলা হয়নি।

জ্যাক ডেনিয়েলসের বোতল থেকে আরেক পেগ ঢাললো সে গ্লাসে। তারপর সেটাকে তু লে
ধরলো আলোর দিকে। পীতাভ রঙের বোতলটার ভেতরকার তরল শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। “তু মি
প্রায় মৃত, সৈনিক !” সে বোতলটাকে বললো।

একটা কালো মাকড়শা, একটা আধুলির চেয়ে বড় হবে না, দৌড়ে এসে বসলো ওর পাশে।
কনস্টেনটিন দ্রুত গ্লাসটা ওটার ওপর চাপিয়ে দিলো উপুর করে। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে,
গ্লাসের একপাশ উঁচু করে ধোঁয়া ঢু কিয়ে দিলো ভেতরে। মাকড়শা’টা ভেতরের দূষিত বাতাসে
102

এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো । অদৃশ্য গ্লাসের বাধায় ধাক্কা খাচ্ছে বারবার, বন্দী আর
মৃতপ্রায়।

“আমার জীবনে স্বাগতম ” কনস্টেনটিন মাকড়শাটাকে বললো।

“মিঃ কনস্টেনটিন ?”

চোখ পিটপিট করে, মাকড়শাটার দিকে চাইলো সে। তারপর টের পেলো , অর্ধেক খোলা দরজাটার
কাছ থেকেই কেউ কথা বলছে। ওটা ......... সেই মহিলাটা। হসপিটালে, আর থিওলজিকাল
সোসাইটিতে দেখেছিলো ওকে।

এঞ্জেলা কনস্টেনটিনের লম্বা, সরু , হোলি ওয়াটারের লাইন দেয়া এপার্ট মেন্ট এর ভেতর নজর
বোলাল । এটার আবছা, ছায়াঘেরা , ব্লাইন্ড দিয়ে আসা তেড়ছা আলোয় আলোকিত এলাকা
দেখলো একবার । বললো “আমি আপনাকে দেখেছিলাম.........”

“মনে আছে.........”

“আর.........”

কনস্টেনটিন নড করলো “নিয়মিত ভাগ্য ”

“আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই, যদি কিছু মনে না করেন ”

“আমি এই মুহূর্তে কথা বলার মেজাজে নেই ”

“তাহলে , স্রেফ শুনবেন , দয়া করে ?”

“আপনি একজন পুলিশ , তাই না ? ওরা কখনোই ‘না’ শুনতে চায় না, দেখেছি আমি ! ”

“আমি ডিটেকটিভ এঞ্জেলা ডডসন । ” সোয়েটারের ভেতর থেকে এলএপিডি ব্যাজটা বের করে
দেখালো সে “প্লিজ ?”
103

“সব সময় কিছু না কিছু আছেই.........”

এঞ্জেলা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো । দরজার ফ্রেমের ভেতরের দিকে খোদাই করা কিছু অদ্ভু ত
চিন্হের ওপর কৌতূ হলের সাথে হাত বোলাতে লাগলো। ওগুলো ছিলো জাদুশক্তি সম্পন্ন কিছু
চিন্হ , যেগুলো কিনা কিছু নির্দি ষ্ট খারাপ আত্মাকে বাইরে রাখে। “আমার বোন গতকালকে খুন
হয়েছে ।”

“শুনে খারাপ লাগলো ”

ওদের চোখাচোখি হলো । কনস্টেনটিন দেখলো , বিষণ্ণতায় ছাওয়া একজোড়া চোখ , নজর মিলিয়ে
রাখা কষ্টকর। আর, ঐ চোখের ভেতরে আরও কি জানি আছে ............

ও অন্যদিকে তাকাতে বাধ্য হলো।

“ও রেভেন্সকারের একজন রোগীনি ছিল ” এঞ্জেলা বললো “মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগ। ও ছাদ
থেকে লাফ দিয়েছে ”

“এইমাত্র না বললেন , খুন হয়েছে ?”

হাত মুঠি পাকিয়ে বললো এঞ্জেলা “ইসাবেল কখনও নিজের জীবন নেবে না”

কনস্টেনটিন নাক টানলো , তারপর বললো “কি ধরণের মানসিক রোগী নিজের জীবন নিয়ে নেয়?
এটা স্রেফ উন্মাদনা ”

এঞ্জেলা দাঁতে দাঁত চেপে বললো “ও অন্তত খাঁচার ভেতর ঘুমাতো না ”। এক মুহূর্তে র জন্য মনে
হল, সে ভেতরে ঢু কে কনস্টেনটিনকে চেপে ধরবে। কনস্টেনটিন দেখলো , অনেক কষ্টে নিজেকে
সামলালো মেয়েটা “দেখুন, আমি জানি আমার কথা এলোমেলো লাগছে আপনার কাছে। আমি
নিজেও জানি না এখানে আসলে কি করছি আমি। আমি স্রেফ...... আমি পুলিশ স্টেশনে
আপনার নাম শুনেছি। আপনি যাদের সাথে চলাফেরা করেন। অকাল্ট, পিশাচবিদ্যা, এক্সরসিজম
104

--- আর...... আরও কিছু নিদর্শন দেখে মনে হলো আপনিই সেই লোক যার সাথে আমার কথা বলা
উচিত !”

কনস্টেনটিন ফিরে তাকালো মাকড়শাটার দিকে, ওটা কি মারা গেছে ? যদি না গিয়ে থাকে, শীঘ্রি
যাবে, ওটা ফাঁদে পড়েছে।

“ওকে হাসপাতালে দেয়ার আগে” এঞ্জেলা বলে চললো “ইসাবেল কিছু কিছু বিষয়ে কথা বলতো।
ফেরেশতাদের ব্যাপারে, পিশাচদের ব্যাপারে। আমার বিশ্বাস ওকে কেউ খুন করতে চেয়েছিল, মিঃ
কনস্টেনটিন। ওকে ব্রেইনওয়াশ করে, ছাদ থেকে লাফ দিতে বাধ্য করেছে। কোন ধরণের গোপন
সংঘ বা......... ধর্মীয় কোন কাল্ট ।”

“হুম, একটা থিওরির মতোই শোনাচ্ছে” কনস্টেনটিন উঠে দাঁড়িয়ে, ঢু লতে ঢু লতে এগিয়ে আসতে
লাগলো দরজার দিকে। দেখতে পেলো, এঞ্জেলার একটা হাত পেছনে চলে যাচ্ছে, ওখানে ওর
বন্দুকটা আছে “গুড লাক” ।

দরজার একদম সামনে দাঁড়িয়ে, ফ্রেমের ওপর হাত রেখে দাঁড়ালো কনস্টেনটিন। ওর খুব ইচ্ছে
হচ্ছিলো দরজাটা ধাম করে বন্ধ করে দিতে, কিন্তু খুব বাধ্য না হলে সেটা করতে চায় না।

“আমি ভেবেছিলাম, আপনার পেছনের ইতিহাস দেখে” এঞ্জেলা শেষ চেষ্টা করলো “যে আপনি
অন্তত সঠিক দিক নির্দে শনা দিতে পারবেন অন্তত !”

“হুম, ঠিক আছে” নিজের কাছে নিজেকেই কেমন অসহ্য লাগছিলো কনস্টেনটিনের । মেয়েটার
কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনের দিকে আঙ্গুল তু লে বললো “বাইরে, বাইরের দিকটাই হলো সঠিক দিক
!”

এঞ্জেলা হাসলো না, হালও ছাড়ল না “আমার বোন কখনোই নিজের জীবন নেবে না, মিঃ
কনস্টেনটিন। ও একজন গভীর বিশ্বাসী ক্যাথলিক ছিলো । আপনি কি জানেন এর মানে কি ?”
105

কনস্টেনটিন এঞ্জেলার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো “ওর আত্মা সরাসরি নরকে যাবে। যেখানে
ওকে রক্তাক্ত টু করোয় ছিঁ ড়ে খুঁড়ে ফেলা হবে বার বার , বার বার, আর ও ভীষণ যন্ত্রণায় চিৎকার
করে যাবে অনন্তকাল ধরে ! ” নিজেকে ওর রক্ষা করতেই হতো ।

এরপর, কাশি দিয়ে বললো “এটাই কি ঠিক না ?”

এঞ্জেলার মুখ হাঁ হয়ে গেলো, দপ করে জ্বলে উঠলো চোখ।

কনস্টেনটিন জানতো , ওর এক্ষু নি কথাটা ফিরিয়ে নেয়া উচিত। ওর মেয়েটাকে ভেতরে ডেকে
নিয়ে ড্রিংক বা চা অফার করা উচিত। সাথে কিছু উপদেশও দেয়া উচিত। সাধারণ অবস্থায়,
এভাবেই সবকিছু এগোতো। কিন্তু আত্ম-ধিক্কারে ভরপুর একটা লম্বা রাত পেরোনোর পর, সেখান
থেকে নিজেকে বের করে আনা বেশ কঠিনই বটে।

এঞ্জেলাকে দেখে মনে হলো , এখুনি ওকে মেরে বসবে। বদলে, সে খুব সাবধানে , সহজাত নির্ভু ল
প্রবৃত্তির বশেই সে বললো “আপনিও কি নরকের ভয় পান ?”

তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে , সোজা হাঁটা ধরলো।

কু ত্তী ! আমার ভেতরটা দেখে ফেলেছে ! ভাবল কনস্টেনটিন।

ও মেয়েটার চলে যাওয়া দেখতে লাগলো। ওর যাওয়া দেখতে দেখতে, আবারও বাঁচতে ইচ্ছে হলো
ওর।

জাহান্নামে যাক। ধুম করে দরজা বন্ধ করে, নিজের জানালার কাছে আবার এসে বসলো
কনস্টেনটিন। ভগবান ওকে পরিত্রাণ দিন। যেন ও নিজেই সমস্ত পৃথিবীর দুর্দ শা একাই বহন করতে
পারবে ! কাল্পনিক ঘোড়ায় চড়ে , মহিলা ডিটেকটিভদের উদ্ধার করতে যাবে, যেখানে অর্ধেক পথেই,
ঘোড়া থেকে মুখ থুবড়ে পরে যেতে পারে।
106

হঠাৎ, একটা দমকা বাতাস এসে ধাক্কা মারলো জানালায়। বাতাসটার মধ্যে কিছু একটা আছে......
একটা প্রতিধ্বনি , একটা নারকীয় মর্মর ধ্বনি...... একটা জঘন্য কড়কড় শব্দ.........

সারা জীবন ধরে লৌকিক আর অলৌকিকের পার্থক্য ধরতে অভ্যস্ত কনস্টেনটিন, সাথে সাথে ধরে
ফেললো। অন্য ভু বনের কিছু ক্ষতিকর বাসিন্দার আগমন ঘটেছে মর্ত্যে। ও খেই’টা ধরতে পারেনি,
তাতে ‘ওদেরকে’ যারপরনাই খুশি মনে হচ্ছে।

মাকড়শাটাকে ছেড়ে দিয়ে, হুকে ঝোলানো কোটটা তু লে নিয়ে , বেরিয়ে পড়লো সে।

“ডিটেকটিভ !”

কনস্টেনটিন ওর বিল্ডিঙের নিচের ফু টপাথ ধরে দৌড়াচ্ছে, স্যাঁতস্যাঁতে লস এঞ্জেলসের রাতে।


“একটু দাঁড়ান, আজকে রাতে আমি দৌড়ানোর মতো ফিট নেই। আপনাকে তাড়া করতে পারবো
না। ”

এঞ্জেলা ঘাড়ের ওপর দিয়ে ঘুরে তাকালো , একটু ধীর হলো গতি “জাহান্নামে যাও !”

“ওটার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। ” কনস্টেনটিন ওর বাছাই করা মিষ্টি হাসি দিলো এবার –
যদিও দেখতে বেশ কঠোর লাগলো সেটা “কি হবে, যদি আপনাকে আমি বলি যে, ঈশ্বর আর
শয়তান একটা বাজি খেলছেন ? একটা তূ রন্ত বাজি খেলা, সমগ্র মানব জাতির সমস্ত আত্মাকে
নিয়ে.........”

ওর পেছনে, স্ট্রিট লাইটগুলো একটা একটা করে নিভে যাচ্ছে। “বিশ্বাস করুন। মানুষের সাথে
কোন সরাসরি যোগাযোগ নেই। এটাই নিয়ম। শুধুই প্রভাব বিস্তার করা যাবে। দেখার জন্য, কে
জেতে !”
107

এঞ্জেলা স্রেফ হেঁটে যেতে লাগলো। কনস্টেনটিন একটা কাশির দমক থামাতে সক্ষম হলো।
দেখলো, স্ট্রিট লাইটগুলো একটার পর একটা নিভে যাচ্ছে, একের পর এক। ও তাকিয়ে রইলো
সেদিকে .........

“ঠিক আছে” শেষমেশ বললো এঞ্জেলা “বিশ্বাস করবো তোমাকে, কেন ?”

“কেন ?” কনস্টেনটিন ওপরের দিকে তাকালো , তারপর সামনে রাস্তার দিকে। এটা কি লোড
শেডিং ? “কেন ওনারা এই বাজি লাগিয়েছেন ? কে জানে ? হয়তো স্রেফ মজা পাবার জন্য ! কে
বলতে পারে ! ”

এঞ্জেলা মাথা নাড়লো “ওহ, এটা মজা ! তো, কোন মহিলা খুন হয়ে গেলে, বা কোন মা তার
সন্তানকে পানিতে চু বিয়ে মারলে, আমাকে কি করতে বলেন ? আমি কাকে খুঁজতে যাবো ? শিং
অলা একটা শয়তান ? মনে হয় না । মানুষ হলো অশুভ , মিঃ কনস্টেনটিন, মানুষ !”

ওরা একটা রাস্তার সংযোগস্থল পার হলো। ওদের দুইপাশের রাস্তাগুলোর বাতিও নিভে যাচ্ছে
আস্তে আস্তে, দেখলো কনস্টেনটিন। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে ওদের দিকে, একটা একটা করে বাতি
নেভাতে নেভাতে ! অন্ধকারের সরোবর এগিয়ে আসছে ওদের দিকে, আঁধারের বন্যায় ভাসিয়ে
দিতে। আর, ওখানে কোন গাড়ি চলাচল নেই, শুধুই পার্কিং করা গাড়ির লাইন। চারপাশের কিছুই
আর দেখা যাচ্ছে না।

“তু মি ঠিকই বলেছ ” কনস্টেনটিন বললো , ভাবছে, আক্রমণটা আসবে কোন দিক থেকে।
অন্ধকার থেকে – যে অন্ধকার ওদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে। “আমরা জন্মগতভাবেই,
ভয়ংকর সব কাজ করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মাই। তারপর, অন্য কিছু একটা কোথাও থেকে এসে
আমাদেরকে আলোড়িত করে, আর আমরা সত্যিকারের অশুভ কাজ করতে থাকি ! ”

“কি – পিশাচ, ভূ ত ?”

“হ্যাঁ !”
108

“ওয়াও, বলার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি শয়তানে বিশ্বাস করি না ”

“আপনার করা উচিত” অনুভূ তিপূর্ণ সুরে বললো কনস্টেনটিন “কারণ সে আপনাকে বিশ্বাস
করে!”

ওদের কাছাকাছি থাকা শেষ বাতিটাও নিভে গেলো। আর প্রায় নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে
গেলো ওরা। কনস্টেনটিন দেখতে পেলো, শহরের দূরতম প্রান্তে আলোর ক্ষীণ রেখা দেখা যাচ্ছে ।
দেখতে পেলো অন্ধকারে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে এঞ্জেলা “লোডশেডিং ?”

“না সম্ভবত” কনস্টেনটিন বললো “সেই ধরণের কিছু না। আমাদের যাওয়া উচিত.........”

কনস্টেনটিন দেখলো , হাঁটা দূরত্বে কেবল একটা আলো দেখা যাচ্ছে। কালো নোংরা ভেলভেটের
মতো রাতের আঁধারে, ঐ একটা আলোই জ্বলছে কেবল। একটা খড় খড় আর খ্যানখ্যানে শব্দের
বাতাস ধেয়ে এলো ওদের দিকে। খানিকক্ষণ আগে নিজের বাসা থেকে যে দূষিত বাতাসের শব্দ
শুনেছিলো কনস্টেনটিন, সেটা এই বাতাসেরই পূর্বাভাস ছিলো। কালো, দুর্গন্ধযুক্ত , ঝটপট শব্দ
করতে থাকা ডানার শব্দ আর দমকা বাতাস।

“...... জলদি !” কনস্টেনটিন চেঁ চিয়ে উঠলো। এঞ্জেলার হাত চেপে ধরলো সে, “আসুন ” বলে
দুজনেই দৌড়ানো শুরু করলো।

মাথার খুব বেশী ওপরে না, অনেকগুলি কি যেন উড়ে বেড়াচ্ছে – কনস্টেনটিন সেগুলির সরীসৃপ
ধরণের আত্মার গন্ধ পাচ্ছে। ওটার ছায়ায় ঘৃণাযুক্ত ঠাণ্ডা কামড় অনুভব করতে পারছে, উড়ে যাচ্ছে
ওটা সেই একমাত্র আলোটা নিভিয়ে দিতে।

আর......... ঐ শব্দটা, চামড়ার সাথে চামড়া ঘষা খাওয়ার শব্দ।

“ওটা কি ?” এঞ্জেলা ফুঁ পিয়ে উঠলো কনস্টেনটিনের পেছনে আসতে আসতে। ও সেই শব্দ
গুলোর কথা বোঝাতে চাচ্ছে।
109

“ডানা...”কনস্টেনটিন বললো “অনেক অনেক ডানা .........”

কাশতে কাশতে, কোটের পকেটে হাত চালালো সে , বী ম্যান ওকে যে পবিত্র কাপড়ের টু করো
দিয়েছিলো , সেটা খুঁজে পেলো সে।

“আর সম্ভবত নখের আঁচড় ” যোগ করলো সে।

সামনের লাইটটা ছিলো একটা ভার্জি ন মেরীর আলোকিত মূর্তি । লস এঞ্জেলসের একটি
পরিত্যাক্ত মুভি থিয়েটারের বাইরে, সেটার ওপরে আলোটা জ্বলজ্বল করছিলো । ওপরে একটা
সাইন জ্বলছেঃ ইউনিভার্সেল মিশন – জেসাস ক্রিস্তো এস এল সেনর (যীশু খ্রিস্টই হলেন ঈশ্বর )।
স্থানীয়রা মূর্তি টাকে সুন্দরভাবে ফু ল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে, সাথে মানানসই আলোকসজ্জা।
পুরানো থিয়েটারটাকে মেক্সিকান-আমেরিকানদের জন্য চার্চে রুপান্তর করা হয়েছে।

কিন্তু ওটার ওপরের আলোটাও আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছিলো ওরা সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে ।
আর চামড়ার ডানার শব্দ আরও বেড়ে গেছে এখন।

ওরা হাঁফাতে হাঁফাতে থিয়েটারের সামনে এসে পৌঁছল। কনস্টেনটিন সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লো স্থির
হয়ে, শ্বাস ফিরে পাবার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ওর ফু সফু সে মনে হচ্ছে কেউ গুঁড়ো কাঁচ ঢেলে
দিয়েছে একগাদা ! পুরানো পবিত্র কাপড়টার কথা মনে পড়ায়, ওটা ওর ডান হাতের সাথে
প্যাঁচাতে শুরু করলো। এঞ্জেলা ওর বন্দুক বের করে, অন্ধকারের দিকে চোখ কুঁ চকে তাকাতে
তাকাতে বললো “ওখানে ওগুলো কি ?”

কিছু একটা আছে ওখানে – ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে গজ দশেক দূরে । নিজের
তৈরি অন্ধকারের ভেতর ঘুরছে, যেন একটা স্কু ইড (সামুদ্রিক এক ধরণের অতিকায় মাছ) নিজের
কালির মেঘের ভেতরে বসে আছে।

“আপনি কি নখের আঁচড়ের কথা বললেন ?” এঞ্জেলা বলে উঠলো “কিসের নখ ?”

“কিছু একটা, যেটার এখানে থাকার কথা না .........” কনস্টেনটিন বললো।


110

এখন সে ওদের প্রায় দেখতে পাচ্ছে। অন্ধকারের ভেতর, মৃত্যুর ছিটেফোঁটা হয়ে ঘুরে বেড়ানো ,
চামড়ার পাখনা-অলা আর আস্ফালন করতে থাকা বাঁকানো নখ। অন্য ভু বন থেকে আসা উড়ন্ত
শিকারি খুনের দল, জড়ো হচ্ছে খুন করবে বলে............

“চোখ বন্ধ করো !” কনস্টেনটিন বলে উঠলো, ওর লাইটার বের করতে করতে।

“কিহ !? কেন ?”

এঞ্জেলা ওকে প্রায় দেখতেই পাচ্ছে না।

কনস্টেনটিন কাঁধ ঝাঁকালো “মানিয়ে নাও !” বলে লাইটারটা ধরালো, একটা ছোট্ট শিখা জ্বলতে
শুরু করলো , জমাট বাঁধা অন্ধকারের বিপরীতে। হাতে পেঁচিয়ে রাখা কাপড়ের টু করোটাতে আগুন
জ্বালিয়ে নিলো সে। সেই কাপড়ের টু করো, যেটা হজরত মুসা (আঃ ) সিনাই পর্বতে যাওয়ার সময়
যে আলখাল্লাটা পড়েছিলেন, সেখান থেকে নেয়া !

সে হাতটা ঘোরালো সামনের অন্তহীন অন্ধকারের দিকে, কাপড়টা এক অতিপ্রাকৃ ত ঔজ্জ্বল্যের


সাথে জ্বলে উঠলো । সেটা এতোই উজ্জ্বল ছিলো যে, এঞ্জেলা আর্ত নাদ করে , চোখে ঢেকে
ফেললো হাত দিয়ে।

সেই ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইটের মতো আলোর বৃত্ত – ওদের দিকে এগোতে থাকা ডজন খানেক
ডানা অলা পিশাচকে আলোকিত করে তু ললো। কালো চকচকে, সরীসৃপের মতো শরীরের গঠন,
গারগয়েলের মতো চেহারা কিন্তু আরও মসৃণ, চোয়ালে সারি সারি সূচের মতো ধারালো দাঁত।
মাথার মগজের অংশ উধাও, বেশীরভাগ সৈনিক পিশাচের মতোই, বাদুড়ের মতো ডানা কনডর
(দক্ষিণ অ্যামেরিকার একরকম শকু ন) পাখির চাইতেও বিস্তৃ ত। নখগুলো ঠিক ঈগল পাখির মতোই
তীক্ষ্ণ আর ধারালো , ঠিক যেরকম ইঁদুর ধরার সময় থাকে, সেরকম ভাবে বাঁকানো। সবচেয়ে
কাছেরটা , এঞ্জেলার গলার চেয়ে কয়েক সেকেন্ডের দূরত্বে চলে এসেছে।
111

কিন্তু সেই কাপড় থেকে বেরোনো আলোকরশ্মি , ঠিক শাস্তি চেয়ার মতো করে ছড়িয়ে পড়লো
চারপাশে, পিশাচগুলোকে গিলে নেয়া শুরু করলো। সেই ভীষণ আগুনে রশ্মি চারপাশে বিস্তার
লাভ করলো, পিশাচগুলোর শরীরগুলোকে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিলো একেবারে ! অল্প একটু
দূষিত , কালো ধোঁয়া রেখে গেলো কেবল।

দূরে, বেচে যাওয়া কিছু পিশাচ, ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে, তীক্ষ্ণ চিৎকার করতে করতে তল্লাট
ছেড়ে পালালো।

আর সেগুলো চলে যাওয়ার পর, স্ট্রিট লাইটগুলো একে একে জ্বলে উঠলো আবার। আগের
মতোই উজ্জ্বল ভাবে, যেন একটু আগে এখানে কিছুই হয়নি !

একটা পিশাচ তখনও পুরোপুরি পুড়ে যায়নি, এটার শরীরটা ঠিক একটা আধপোড়া টায়ারের মতো
দেখাচ্ছিল। সেটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো কনস্টেনটিন “পিশাচেরা নরকে থাকে , হাহ ?
ওদেরকে বলো সেটা !”

এঞ্জেলা হঠাৎ উপুর হয়ে ওয়াক ওয়াক শব্দে বমি করা শুরু করলো।

“চিন্তা করো না ” কনস্টেনটিন বললো “প্রথমবার সবারই এমন হয়। সালফারের কারণে ।”

সে মনে মনে চিন্তা করছিলো, পিশাচটার দেহাবশেষ নিয়ে যাবে মিডনাইটের কাছে প্রমাণ হিসাবে।
কিন্তু একটা সেমি-ট্রাক কোণা ঘুরে এসে, ওটার ওপর দিয়ে চলে গেলো। বাকি যা ছিলো , সেগুলো
মিশিয়ে দিলো রাস্তার সাথে।

থুতু ফেলতে ফেলতে, এঞ্জেলা এসে যোগ দিলো ওর সাথে। কনস্টেনটিন খুঁজে পেতে একটা
রুমাল বের করলো কোটের পকেট থেকে, সেখান থেকে কিছু খাবারের টু করো ঝেড়ে, তু লে দিলো
ওর হাতে। মেয়েটা সেটার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো।

“আমার রুমাল ‘বিশেষভাবে দাহ্য’ না !” বললো কনস্টেনটিন।


112

মুখ মুছে এঞ্জেলা বললো “আমি দেখেছি অনেক পাখনা ..... আর ধারালো দাঁত...... ওগুলো
উড়ছিল। ঐ বালের জিনিসগুলো কি ?”

কনস্টেনটিন কাঁধ ঝাঁকালো “পিশাচ আর মড়াখেকো সব ”

সে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাতে লাগলো। বুঝতে চেষ্টা করছে, আবার কোন আক্রমণ আসছে
কিনা। “ওরা আসলে দাস। নারকীয় ধাঙ্গড় বলা যায় ”

এঞ্জেলা মাথা নাড়লো “আপনি ঠাট্টা করছেন ! এটা অসম্ভব ......”

“হুম, সেটাই সবাই আমাকে বলে যাচ্ছে ক্রমাগত। আর আপনি জানেন – আমার মনে হয়, ওরা
আমার জন্য আসেনি। ”

ও এঞ্জেলার দিকে তাকালো , সন্দেহ ঘনীভূ ত হচ্ছে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে, অনেকগুলি শক্তি
একসাথে কাজ করছে। অন্ধকার আর আলোর শক্তি, দুটোই। ‘কেউ একজন’ ওদেরকে মেরে
ফেলতে চেয়েছে, আর কেউ বা কিছু একটা এঞ্জেলাকে ওর কাছে এনে দিয়েছে। আর এটা, ‘নরক’
চাইতেই পারে না !

ওর একটা ড্রিংকের দরকার। সেইসাথে, আরও একটা জিনিস টের পেলো সে নিজের ভেতর,
একটা ছোট্ট আলোর রশ্মি। একটা সুযোগ।

“আমার দিকে ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন ?” ভ্রু কুঁ চকে বললো এঞ্জেলা।

“আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন, সে কখনোই আত্মহত্যা করতো না ? এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত?”

কোঁচকানো ভ্রু সোজা হয়ে, গোমড়া হয়ে গেলো মুখ। “ইসাবেল ?” বলে নিজের পার্স ঘেঁটে একটা
মিন্ট গাম বের করে মুখে ফেললো এঞ্জেলা। রাতের আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেটা
চিবোতে লাগলো । কনস্টেনটিনের মতো সেও যীশুর মাতা মেরীর মূর্তি র কাছ থেকে খুব
তাড়াতাড়ি সরে যেতে চাইছে না ।
113

অবশেষে উত্তর এলো “লক্ষ বছরেও না ”

কনস্টেনটিন মনস্থির করে ফেললো “চলুন নিশ্চিত হওয়া যাক। ” নিজের এপার্ট মেন্টের দিকে
রওনা দিলো সে। ওখান থেকে কিছু জিনিস নিতে হবে। সে মনে মনে ভাবলো, কে জানে
ডিটেকটিভ ডডসন ওকে সাহায্য করবে কিনা “চলুন দেখি, ও নরকেই আছে কিনা !”

আট

অনেক বছর পর, একজন সম্মানী মহিলার সাথে একা , ওর এপার্ট মেন্টে এসেছি ! -- ভাবলো
কনস্টেনটিন। আর সেটা কেন ? না, দুনিয়ার মধ্যে শেষ যে জিনিসটা আমি করতে চাই, সেটার জন্য
!

সোফাতে বসে, রেভেন্সকার হসপিটাল থেকে পাঠানো একটা কার্ড বোর্ড বক্স হাঁটকাচ্ছিল
কনস্টেনটিন। এঞ্জেলা, রান্নাঘরে একটা বড় প্লাস্টিকের গামলাতে পানি ভরছিল।

ও সাবধানে গামলাটা নিয়ে এলো , পেছনে আসছে ওর বিড়ালটা। “এটা কি গরম লাগবে, নাকি
ঠাণ্ডা হলে চলবে ?”

ওটা কোন বিষয় না, কনস্টেনটিন উত্তরও দিলো না । কেবল বললো “এগুলোই কি ইসাবেলের সব
জিনিসপত্র ?”

“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে, আমি এটা করছি.........”


114

কনস্টেনটিন বক্স থেকে মুখ তু লে চাইলো এঞ্জেলার পায়ে গা ঘষতে থাকা বিড়ালটার দিকে “এই
বিড়ালটা নিলে কেমন হয় ?”

“ডাক ? হ্যাঁ, কেন ...... আহম ?”

“ডাক ?” হেসে বিড়ালটাকে তু লে নিলো কনস্টেনটিন “বিড়ালরা ভালো ! অর্ধেক বাইরে, অর্ধেক
ভেতরে এমনিতেই ! ”

এঞ্জেলা ওর শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বললো “তো এটা কি কোন ধরণের জাদু মন্ত্র বা ঐ রকম কিছু
.........”

সোফাতে বসে, বিড়ালটার দিকে তাকিয়ে রইলো কনস্টেনটিন। যেন ওটার চোখের ভেতর দিয়ে
এমন কিছু দেখার চেষ্টা করছে , যেটা সময়ের অতীত কোন একটা জগতের সন্ধান দেবে।

“......... এটা করতে কি, কোন মোমবাতি বা পেন্টাগ্রামের দরকার নেই ? ” বললো এঞ্জেলা।

কনস্টেনটিন তাকালো , ভাবলেশহীন ভাবে “কেন – আপনার কাছে আছে নাকি ? ” হাসলো ,
এটা দেখানোর জন্য যে সে ঠাট্টা করছিলো , আর নিজের ভয় ঢাকার জন্য অনেকটা। সে
অনেককিছুর সাথেই অভ্যস্ত। কিন্তু সে এখন যেটা করতে যাচ্ছে, সেটার সাথে আপনি দশ হাজার
বছরেও অভ্যস্ত হতে পারবেন না।

কেউ, কেউ সেই পরিমাণ সময় ধরে, কিংবা তার চেয়েও বেশী সময় ধরে চেষ্টা করে গেছে।

এঞ্জেলা গামলাটা ওর সামনে নিচে রাখলো। সোফার হাতলে বিড়ালটাকে বসতে দিয়ে, নিজের
জুতো মোজা খুলে ফেললো সে। তারপর পা ডু বিয়ে দিলো গামলার পানির মধ্যে।

“এটা পাগলামি ” এঞ্জেলা বললো, গামলাতে ডু বিয়ে রাখা কনস্টেনটিনের পায়ের দিকে তাকিয়ে
আছে।

“হ্যাঁ” একমত হলো কনস্টেনটিন।


115

কিন্তু সে এটা ভিন্ন অর্থে বলেছে। একটু আশ্চর্য হয়েই সে ভাবছে, যতটা ভয় পাবে বলে সে
ভেবেছিলো, ততটা ভয় সে পাচ্ছে না ! একজন লোক যতটা ভয় পেতে পারে, সে ততটাই ভয়ে
আছে । স্বভাবতই, ভয়ের কোন উচ্চ সীমা নেই দেখা যাচ্ছে !

নিজের গলা পরিষ্কার করলো সে। গলা যাতে কেঁ পে না যায়, সেটা খেয়াল রেখে বললো
“আপনাকে ঘরের বাইরে যেতে হবে ! ”

এঞ্জেলা চারপাশে তাকালো , এটা ওর এপার্ট মেন্ট। তারপর কনস্টেনটিনের দিকে তাকিয়ে বললো
“অ্যাঁ ! কি বললেন ?”

“এঞ্জেলা ? প্লিজ !”

একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে, হলওয়ের দরজার দিকে এগিয়ে গেলো এঞ্জেলা।

কনস্টেনটিন চারপাশে তাকালো। চোখে পড়লো ওয়াল মাউন্টেড টেলিভিশন, নিচের ডিভিডি
শেলফের ওপর রাখা একটা ছোট্ট অর্কি ড গাছের টব। টার্নার আর হুইস্লারের পেইন্টিং । একটা
বইয়ের কেবিনেট, ক্লাসিক আর কিছু বেস্টসেলার উঁকি মারছে সেখানে। বাইবেল, ডিকশনারি, কিছু
পুলিশ ম্যানুয়াল, একটা বই চিনতে পারলো ‘টাইম এন্ড ডি সউল’ , জাকব নিডলম্যানের লেখা।

সে হাসলো, এটা এঞ্জেলার বাসা, ওর রুচির ছাপ ছড়িয়ে আছে চারপাশে। আর সেগুলোর দিকে
তাকাতে, ওর বেশ ভালোই লাগছে। কিন্তু মুহূর্ত খানেকের মধ্যে, এগুলো সব বদলে যাবে.........

“ঈশ্বর ” কনস্টেনটিন বিড়বিড় করলো “আমি এই অংশটা ঘৃণা করি !”

একটা গভীর শ্বাস নিয়ে, বিড়ালটাকে নিজের কোলে তু লে নিলো সে। এটা নিজে থেকেই এলো,
হয়তো বুঝতে পেরেছে কোন বিশেষ কাজে ওকে ব্যবহার করা হবে। কনস্টেনটিন ওটার সবজে
সোনালী চোখের দিকে তাকালো...... একটা সংযোগ আছে সেখানে। এটা...... অনেকটা বুস্টার
এন্টেনার মতো।
116

ও ওর সত্ত্বার বিশেষ অংশটা জাগ্রত করলো, যেটাকে জাদুকরেরা ‘অরা’ বলে ডাকে। সেটা দিয়ে
সে বাতাস পরীক্ষা করলো, একটা নির্দি ষ্ট তরঙ্গের খোঁজ চালালো চারপাশে। ওর এই খোঁজটা
আরও জোরদার হলো ধূসর বিড়ালটার উপস্থিতিতে।

কনস্টেনটিন একটা নির্দি ষ্ট, তীক্ষ্ণত্বর কম্পনের খোঁজ করছেঃ যেটা ‘নেদারওয়ার্ল্ড ’ (মৃতদের
জগত) এ ঢোকার চাবিকাঠি । এই তরঙ্গ , আমাদের চারপাশে সবসময় বিদ্যমান। এই সুক্ষ্ন কম্পন
, যেটা আমূল পরিবর্ত নের জন্ম দেয়, আর হত্যা বা আত্মহত্যার মতো দুর্ঘটনাও সৃষ্টি করে। প্রাচীন
লোকেরা ভাবতেন মাটি, বাতাস আর আগুন হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূল উপাদান। আর, অবশ্যই,
আগুন বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু পৃথিবী আগুন ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যেতো। ‘ইয়াং’
কখনও ‘ইন’ ছাড়া সম্পূর্ণ হতে পারে না। ও যেটার খোঁজ করছে সেটা অশুভ কিছু নয়, কিন্তু
সেটা এমন একটা জগতের দরজা খোলার চাবি, যেখানে সত্যিকারের অশুভের বসবাস। সেই
জগত, যেটা শয়তানেদের মনোজগতের তৈরি।

সে সেই তরঙ্গকে আহ্বান করলো, খুঁজে পেলো , তারপর সেটাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে এলো।
ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত, মাথা থেকে পা পর্যন্ত । পুরো সময়টা সে তাকিয়ে ছিলো বিড়ালটার চোখের
দিকে.........

কনস্টেনটিনের পায়ের চারপাশের পানি ফু টতে শুরু করলো, সে বিড়ালটাকে মুক্ত করে
দিলো.........

চারপাশের লাইট বাল্বগুলি দপ দপ করে উঠলো , সেগুলোর দীপ্তি পাল্টে গেলো সম্পূর্ণ বিষাক্ত
আরেক ধরণের আলোতে। জঙ্গলে আগুন লাগলে যে হলদেটে আলো দেখা যায়, অনেকটা
সেরকম রং। পুরো রুম জুড়ে একটা ঢেউ উঠলো, আর কিছু একটা যেন বদলে গেলো......

কনস্টেনটিন উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালো। রুমটা একই আছে – কিন্তু সবকিছুই বেশ ভিন্ন।
টেলিভিশনটা সেখানেই আছে, দাচাউ থেকে সম্প্রচার করা নাৎসিদের একটা ফু টেজ লুপ করছে
সেখানে। পেইন্টিং টা হয়ে গেছে দাঁত বের করা একদল ক্লাউনের, যেটা কিনা জেলখানায় বসে
117

এঁকেছে শিশু হত্যাকারী জন ওয়েন গ্রেসি। অর্কি ডের গাছ গুলো ক্রমাগত সজিব থেকে নির্জীব
হয়ে যাচ্ছে, পোড়া ছাইয়ে পরিণত হয়ে চলেছে বারংবার। সোফাটা তৈরি মানুষের চামড়া দিয়ে ,
সাথে জীবিত মানুষের মুখও দেখা যাচ্ছে সেখানে ! বিড়ালটাকে দেখা যাচ্ছে না ...... না , না আছে
, ঐ যে, কেবল চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে ওটার, বাতাসে ভেসে আছে। পুরো দেহ এখানে দেখা যাবে
না ওর, বোঝাই যাচ্ছে।

ও একটা ভীষণ গরম বাতাসের হলকা টের পেলো। সেদিকে তাকিয়ে দেখলো, সামনের দেয়ালটা
বেশীর ভাগই ছিঁ ড়েখুঁড়ে গেছে, যেন কোন বোমা হামলা হয়েছে এখানে। সেই ফাঁক দিয়ে আসছে
এক ধরণের অসুস্থ কালচে বাদামী রঙের আভা.........

সে দেয়ালের সেই জীর্ণ গর্ত টার কাছে এগিয়ে গেলো, শুনছে। কাছাকাছি যাবার পর, ওর মনে হলো
, লক্ষ লক্ষ ছোট্ট চোয়াল, কিছু যেন চিবিয়ে চলেছে একসাথে...... সে চেহারা বিকৃ ত করে ফেললো
সাথে সাথে। মনে পড়লো , ও খালি পায়ে আছে , পায়ের নিচের কার্পেটটাও বদলে গেছে। টের
পেলো, সেই খালি পায়ের নিচে অনেকগুলি জিহ্বা চেটে চলেছে ওর পা, আর ছোট্ট ছোট্ট দাঁতের
কামড়ও টের পেলো সেই সাথে। ও সেই গর্ত দিয়ে তাড়াতাড়ি ওপাশে চলে গেলো, তারপর থেমে
গেলো একগাদা ধোঁয়া ওঠা পাথরকু চির ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে। দেখতে পেলো, সামনে বিছিয়ে আছে
নির্দি ষ্ট এক ধরণের নরকঃ এটা হলো ‘লস এঞ্জেলসের নরক !’

এটা লস এঞ্জেলসই, তবে এটার সর্বোচ্চ যতটা খারাপ রূপ কল্পনা করা যায়, এটা ছিলো
তার চাইতেও খারাপ। বেশীরভাগ পরিচিত বিল্ডিঙেই আগুন জ্বলছে, আকাশে উদ্গিরণ করছে
কালো ধোঁয়া। সময়টা না দিন না রাত । সে জানতো আপনি যদি দিন পছন্দ করেন, তবে সেখানে
থাকবে চির রাত, আর রাত পছন্দ করলে উল্টোটা। কনস্টেনটিন আসলে ‘সেখানে’ ছিলো না, ও
অভিশপ্তদের একজন ছিলো না, যাকে কিনা ওখানে থেকে যেতে হবে। ওর কিছু অংশ তখনও
মরণশীল লস এঞ্জেলসে রয়ে গেছিলো ............ তাই, ওকে নরকের সত্যিকারের ‘অভিজ্ঞতা’
118

থেকে খানিকটা রেহাই দেয়া হচ্ছিলো । ও সত্যিকারের নরকের স্বাদ পেতে পারতো, সেক্ষেত্রে ওকে
‘নরকদ্বার’ দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করতে হতো ! ও চিরস্থায়ী ধরণের যন্ত্রণা পাচ্ছিলো না,
কেবল সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়া অদ্ভু ত এক ধরণের যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছিলো।

কিন্তু এই ‘সাময়িক’ নরকবাসও যথেষ্ট ছিলো আসলে। মানুষের আকৃ তির কিছু জিনিস,
পাথরকু চির পথের দুপাশে ক্রমাগত পাক খাচ্ছিলো আর মোচড় মারছিল। সেই বিরতিহীন
চিবানোর শব্দটা কনস্টেনটিনের মাথায় একটা ছবির জন্ম দিলো । সেটা হলো এরকম , অন্তহীন
দাঁতের , হ্যাঁ, দেহবিহীন কেবল দাঁতের সারি মেঘের মতো এগিয়ে আসছে চারপাশ থেকে সবকিছু
চিবাতে চিবাতে ! পথে যা পড়ছে , কিছুকেই রেহাই দিচ্ছে না । শব্দটা অনেকখানি ওপরে উঠে
আবার মিলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঠিক যেন একটা জঙ্গলের ভেতর ঝিঁ ঝিঁ পোকার কোরাসের মতো !
যেটা ওখানকার পরিবেশেরই একটা অংশ। ঠিক যেমন আপনি নরকে আশা করেন, সেই উচ্চকিত
আর্ত নাদের ধ্বনি। কিন্তু সেগুলো এতো বেশী পরিমাণে ছিলো যে, সবগুলো মিলে এক গম্ভীর কানে
তালা ধরানো শব্দের সৃষ্টি করে চলেছে। ওটা কনস্টেনটিনকে মনে করিয়ে দিলো পেনডেরেকির
‘হিরোশিমার জীবন্ত বলি’ দের শোকগাথার বা বিলাপগীতির কথা !

ও এগিয়ে চললো। নুড়ি পাথর বিছানো পথ ধরে। একপাশে ছিলো একটা ইটের দালান। আর, ভু ল
করে সেদিকে তাকিয়ে ফেললো সে। ওর চোখে পড়লো , ইটগুলোর মাঝখানে একটা অস্বাভাবিক
নড়াচড়া , ইটগুলো যেন নিজে থেকেই ঝাঁকি খাচ্ছে ক্রমাগত। প্রত্যেক জোড়া ইটের মাঝখানে,
মানবদেহের বিভিন্ন টু করো দেখা যাচ্ছে ! ঠিক যেন হামানদিস্তায় ফেলে মানুষ পিষছে কেউ !
ইটগুলোর নিষ্পেষণে , সেসব মানুষের রক্তাক্ত আত্মাগুলো ক্রমাগত বিলাপ করে যাচ্ছে, ক্ষমা
ভিক্ষা করে যাচ্ছে অনন্তকাল ধরে। সেই ইঞ্চিখানেক জায়গাতেই, মানুষগুলো কিভাবে জানি বেঁচে
আছে । আর ইটগুলো ঠিক মানুষের দাঁতের মতোই আগুপিছু করে , বলতে গেলে পুরো বিল্ডিঙটাই
মানুষের চোয়ালের মতো নড়াচড়া করছে ---

কনস্টেনটিন দ্রুত অন্যদিকে তাকালো, ওদিক থেকে ভেসে আসা অন্তহীন আর্ত নাদের শব্দ
উপেক্ষা করলো পুরোপুরি। সে একটা ক্ষয়ে যাওয়া নিচু দেয়ালের কাছে এলো, সেটার ওপর দিয়ে
119

লাফিয়ে পার হলো। তারপর , একটা পুড়ে যাওয়া বাঁধ দিয়ে নেমে এলো উঁচু দেখতে একটা
পরিত্যাক্ত হাইওয়েতে । সেই দিগন্ত বিস্তৃ ত রাস্তাটা কোন এক অদ্ভু ত উপায়ে, অক্ষত রয়ে গেছে।
সেখান থেকে যতদূর চোখ যায়, কেবল ধোঁয়া ওঠা ধ্বংস স্তূ প ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।

সেই সুদূর প্রসারী ছাইয়ের গাদা আর মৃত শহরের ভেতর দিয়ে ভ্রু কুঁ চকে তাকালো
কনস্টেনটিন। এই নরক লস এঞ্জেলসে, ওর নির্দি ষ্ট একটা গন্তব্য আছে অবশ্যই। কিন্তু এসবের
মাঝে, ও কি সেটা আদৌ চিনতে পারবে ? ঐ তো ! ঐ যে বিল্ডিঙটা , ধ্বংসস্তূ পের মাঝখানে
দাঁড়িয়ে আছে, এখান থেকে বেশী দূরে নাঃ রেভেন্সকার হসপিটাল।

গভীর একটা নিঃশ্বাস নিলো সে – কুঁ চকে ফেললো নাক সাথে সাথে কি যেন পচনের দুর্গন্ধে ।
তারপর, হাত মুঠি করে ছুটতে শুরু করলো, গাড়ির জঙ্গলের মাঝ দিয়ে, যত দ্রুত সম্ভব।

ওখানে যাও, কাজ সারো , তারপর বেরিয়ে যাও ! তু মি এখানে কেন এসেছ, সেটা জানতে গিয়ে,
নরকের কৌতূ হলের বাঁধ ভেঙ্গে যেতে পারে।

আর আরেকটা বিষয় আছে এখানে। ও এখনও অভিশাপগ্রস্থ হয়নি, ওদেরকে ওর জাগতিক


দেহটাকে খুন করতে হবে, যদি এখানে ওকে রেখে দিতে চায়। কিছু কিছু নিচু শ্রেণীর খুনেরা, উচ্চ
শ্রেণীর পিশাচদের মতো নিয়মনীতির দ্বারা অতোটা বাঁধা নয়।

এই চিন্তাটা আসার সাথে সাথে , ওর মনস্চক্ষের দৃষ্টিতে ও দেখতে পেলো – একটা ফোর্ড
এক্সপ্লোরার গাড়ির ভেতরে অত্যন্ত লোভী কিছু একটা মুচড়ে উঠেছে ! এটা অসুস্থ আত্মা খেতে
খেতে বিরক্ত হয়ে গেছে, ওর আরও শক্ত কিছু দরকার। ওহ, জিভে জল এসে যাচ্ছে যে, স্বয়ং
জন কনস্টেনটিন সামনে উপস্থিত ! নরকের অনন্ত দিনের মাঝখানে, উপহারস্বরূপ।

কনস্টেনটিন সেই গাড়িটার পাশ দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে গেলো। সেই খুনেটা সামনের উইন্ড শিল্ড
ভেঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলো। শতপদী কেন্নোর মতো, কিন্তু একটা অজগরের চাইতেও বিশাল শরীর
120

নিয়ে পড়লো তেলতেলে রাজপথে। বিশ্রীভাবে দাঁত বের করে হাসতে থাকা একটা মোটা মানুষের
মতো মাথা আর খিস খিস হাসি নিয়ে , তেড়ে গেলো কনস্টেনটিনের দিকে।

কিন্তু কনস্টেনটিনের একমাত্র মনোযোগ ছিলো রেভেন্সকারে পৌঁছানোর দিকে। হাইওয়ের ভেঙ্গে
পড়া কিনারায় চলে এলো সে, নিচে তাকালো ছাইয়ের ঘূর্ণির ভেতর দিয়ে। সেখানে, সে দেখতে
পেলো অগণিত সৈনিক পিশাচদের, যেগুলোর একটা সেই যে কন্সুয়েলার ভেতরে আশ্রয়
নিয়েছিল। ওরা অভিশপ্ত আর দণ্ডপ্রাপ্তদের শিকার করছে, খেয়ে ফেলছে । কখনও খুনে মেজাজে
দলবদ্ধ হয়ে, কখনও হাহাকার করতে থাকা ভিড়ের মাঝখানে লাফিয়ে লাফিয়ে। ছিঁ ড়ে ফালাফালা
করে, গিলে ফেলছে স্রেফ ! এক অন্তহীন তিক্ত দৃশ্য । আর, কনস্টেনটিন জানে, এই গিলে
ফেলাতেই শেষ নয়, আপনাকে স্রেফ আরও ভয়ংকর নরকের দিকে নিয়ে যাবার প্রথম ধাপ হচ্ছে
সেটা !

সংঘবদ্ধ পিশাচদের ভেতর কেউ কেউ তাদের মাথা ঘোরালো – সেই মাথাতে, কেবল মুখ ছাড়া
আর কিছুই নেই ! ওরা কনস্টেনটিনকে অনুভব করতে পারলো, তারপর গুটি গুটি সেদিকে
আসতে শুরু করলো। ওরা মুহূর্তে ই বুঝে গেছে, ও ভিন্ন কেউ। ওরা এ পর্যন্ত যাদের গলাধঃকরণ
করে চলেছে – ও সেরকম কেউ নয়। ও হলো – তাজা মাংস !

কনস্টেনটিন তখনই ওর ডান পাশে একটা ঢালু পেঁচানো পথ দেখতে পেলো, যেটা রেভেন্সকারের
দিকে যাবার একটা পথে মিশেছে । এটা বেশ দূরে, কিন্তু তবু কনস্টেনটিন ছোটা শুরু করলো,
ভাবছেঃ

স্রেফ এগিয়ে যেতে থাকো, তু মি ওদের থেকে অনেক এগিয়ে থাকতে পারবে। অনেকখানি,
অনেকখানি......

কিন্তু পিশাচগুলো হাইওয়েতে উঠে পড়লো হাচরে-পাঁচরে। পিছু নিলো কনস্টেনটিনের। লাফিয়ে ,
ঝাঁপিয়ে যেটা যেভাবে পারলো। অনেক দূরে আছে ওরা, কিন্তু ধীরে ধীরে দূরত্ব কমিয়ে আনছে।
121

কনস্টেনটিন যে বিল্ডিঙের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে, সেই বিল্ডিঙের ছাদটা ফেটে চৌচির হয়ে
আছে, ধোঁয়া বেরোচ্ছে, আগুন লকলক করে উঠছে বিভিন্ন ফাঁক দিয়ে। সেটা হলো রেভেন্সকার
হসপিটালের নারকীয় সংস্করণ ! ইসাবেল ডডসনের আত্মা দাঁড়িয়ে আছে সেই ছাদের কিনারে।
আত্মহত্যা করায়, সে যে দণ্ড প্রাপ্ত হয়েছে, সেটার সাজা ভোগ করার জন্য। টলটায়মান ভাবে
দাঁড়িয়ে আছে সে, একটা আপাত মনুষ্য শরীরে, হসপিটালের গাউন গায়ে, চোখের তারায়
প্রতিফলিত হয়ে চলেছে নরকের আগুন। নিঃশব্দে কাঁদছে সে , ঠোট দুটো জপে চলেছে ......
এঞ্জেলা, আমি দুঃখিত, এঞ্জেলা .........

অল্প সময়ের মধ্যে, ওকে ঝাঁপ দিতে হবে। এখানে আসার পর থেকে ক্রমাগত সেটাই করে চলেছে।
ওকে সেটাই করে যেতে হবে, অনন্তকাল ধরে, একবার, বারবার।

ওর নিচে , হাসপাতাল থেকে ভেসে আসছে চিৎকারের শব্দ। দাঁত কড়মড় করার শব্দ ভেসে
আসছে সেখান থেকে। পৈশাচিক একটা হাসির শব্দ শোনা গেলো , তারপর এক অভিশপ্ত
আত্মার আত্মপক্ষ সমর্থনের কথা শোনা গেলঃ

“প্লিজ, শয়তানকে বলুন আমি দুঃখিত। ঈশ্বর, যীশু আর মোহাম্মদকেও বলুন , আমি দুঃখিত !
ওরা...... ওরা আমাকে এখানে ভর্তি করে দিলো। আমি জানতাম আমার আর কোন আশা নেই।
তাই আমি জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়লাম – ঈশ্বরকে বলুন আমি দুঃখিত , ওহ ওটা করবেন না ,
প্লিজ , প্লিজ............”

কিন্ত ইসাবেল সেই চিৎকারের দিকে সামান্যই মনোযোগ দিচ্ছে। অন্য আরও আরও চিৎকার ভেসে
আসছে ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে। আসলে, আশাহীন অনুশোচনা, আর নিষ্ফল কপটতা , নরকের
প্রধান উপাদানগুলোর একটা। নিরর্থক ক্ষমা ভিক্ষা এখানকার মৌলিক বিষয়।

এখন , ইসাবেল অনুভব করলো, ওর পালা এসে গেছে। সময় হয়েছে। সে হসপিটালের
ব্রেসলেটটা হ্যাঁচকা টানে ছিঁ ড়ল সে .........
122

কনস্টেনটিন দৌড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছে , হাইওয়ে ধরে দৌড়ে যাচ্ছে আবছায়া রেভেন্সকারের


বিল্ডিঙটার দিকে। সেদিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেলো, ইসাবেল প্রস্তুত লাফ দেয়ার জন্য ।
পেছনের আকাশ ঠিক একটা খেঁক শেয়ালের চোখের মতোই রঙে রাঙ্গানো । সে দৈহিকভাবে কোন
ক্লান্তি অনুভব করছিলো না, কারণ তার শরীর তো আসলে এখানে নেই। কিন্তু ওর মনের ওপর
প্রচণ্ড চাপ পড়ছিলো , নরকের সমস্ত পাপাত্মাদের মিলিত প্রচণ্ড একটা টান। আর ওটা ওকে
ভেতরে টেনে নেয়ার জন্য হুমকি দিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। নিজেকে একটা মোমের মূর্তি হিসাবে কল্পনা
করলো কনস্টেনটিন, যেটা কিনা গলে গলে যাচ্ছে সেই রাজপথের ওপর, যেটা দিয়ে ও এখন
দৌড়াচ্ছে। তারপর মিশে যাচ্ছে ঘৃণ্য নরকের পরতে পরতে......

ও সেই কল্প-দৃশ্য থেকে নিজের মন ফিরিয়ে আনলো। ওকে অবশ্যই লক্ষ্যে অটল থাকতে হবে।
ওকে নরকের রেভেন্সকারের জানালাগুলোতে দেখা যাওয়া চেহারাগুলোর দিকে তাকালে চলবে না।
দৌড়ে দৌড়ে সে উঠতে লাগলো বিল্ডিং বেয়ে।

তাকিও না, জন । আধভাঙ্গা জানালার গায়ে মাথা কূ টতে থাকা , চিৎকার করতে থাকা
চেহারাগুলোর দিকে তাকিও না ! কড়মড় করতে থাকা দাঁত আর রক্তের ছিটে – এখানে রক্ত,
সবকিছু প্রকাশের একটা মাধ্যম। কারণ, নরকের সবকিছুই এক মহান অন্ধকার মনের সৃষ্ট মায়া
মাত্র। লুসিফার রোফোকালের মন , যাকে স্যাটান, শয়তান , ইবলিশ নামেও ডাকা হয়। পতিত
ফেরেশতাদের প্রধান সে। এই পুরো জগতটা , সেই মহা পিশাচের ক্ষু ব্ধ উন্মাদ চেতনার অংশ মাত্র।
কারণ, এখানকার সব কিছুই সে গিলে নিয়েছে অনেক আগেই !

মন, ভাবলো কনস্টেনটিন, বস্তুগত বাস্তবতার সৃষ্টি করে অন্য ভু বনে । আর এই মন-ই ওকে রক্ষা
করবে, ও যদি লক্ষ্যের ছবি ক্রমাগত মনে ভাসাতে পারে.........

রেভেন্সকার, আর ইসাবেলের বন্দী আত্মা। কাছেই, এই তো সামনে !

চোখের কোণা দিয়ে সে দেখতে পেলো, রাস্তায় তাড়া করে আসা সেই পিশাচের দল, কাছিয়ে
আসছে। ওর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে প্রায়। ওদের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস যেন ওর ওপর অনুভব করতে
123

পারছে। ওরা যখন ওদের মুখ খুললো গর্জ ন করার জন্য, মনে হলো একটা একটা করে হাজার
কণ্ঠ চিৎকার করে উঠলো । ওরা গর্জ ন করছে তাজা মাংসের প্রত্যাশায়, জন কনস্টেনটিন, তাজা
মাংস !

কনস্টেনটিন জানে, ও যদি পেছনে তাকায়, তাহলে দেখতে পাবে এক দঙ্গল অতিমানবীয় , অন্য
ভু বনের শিকারি ওর পিছনে ধেয়ে আসছে। একটা জীবন্ত পিশাচের ধ্বস, ওর জুতার হিলে আঁচড়
কাটছে ।

এক হিপি আর পাঙ্ক রকারকে পাশ কাটালো সে, ওরা একে ওপরের গলা দাবিয়ে ধরছে অনন্তকাল
ধরে, আঁচড়ে কামড়ে ছিঁ ড়ে খুঁড়ে ফেলছে একে অপরকে। ওখান থেকে একটু দূরেই, ‘ইঙ্কু ইজিশন
পাদ্রী’ রা ক্রমাগত অত্যাচারিত হয়ে যাচ্ছে.........

ওপরে, ইসাবেল ওর হসপিটাল ব্রেসলেট খুলে শূন্যে ভাসিয়ে দিলো ......

কনস্টেনটিন একটা চারজনের উপযোগী মার্সিডিজকে পাশ কাটালো। সেখানে কমপক্ষে সাতাশটা
আটকে পড়া প্রেতাত্মা ক্রমাগত মোচড় খেয়েই যাচ্ছে, একে অপরকে আঁচড়ে কামড়ে একাকার
করে যাচ্ছে। ওগুলো সবই সেইসব ড্রাইভারের আত্মা , যারা মদ্যপ অবস্থায় নির্দোষ মানুষজনকে
গাড়ির তলায় পিষে দিয়েছিলো কোন এক সময়।

ইসাবেলের ব্রেসলেট পড়ে যাচ্ছে...... সেটাকে অনুসরণ করতে যাচ্ছে ইসাবেল......

পিশাচগুলো ওর গোড়ালির নাগাল পেয়ে গেছে প্রায়। কনস্টেনটিন মার্সিডিজের হুডের ওপর
লাফিয়ে উঠলো , সেটাকে ওপরের দিকে লাফ দেয়ার জন্য স্প্রিং বোর্ড হিসাবে ব্যবহার করার ইচ্ছা।
হাত বাড়িয়ে রেখেছে , একজন জাদুকরের সহজাত প্রবৃত্তির বশে, পড়তে থাকা ব্রেসলেটটা ধরার
জন্য ............
124

ওদিকে ইসাবেল, ছাদ থেকে লাফ দিলো , আর গিয়ে পড়লো অগণিত পিশাচের চোয়ালের মধ্যে।
যারা ওকে মুহূর্তে র মধ্যে ছিঁ ড়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেললো, যাতে ও আবার ছাদের ওপর ফিরে যেতে
পারে !

আর, আবার ইসাবেল হেঁটে এলো কিনারায়। ব্রেসলেট খুললো , ছুঁ ড়ে ফেললো। তারপর লাফ
দিলো । আর গিয়ে পড়লো অগণিত পিশাচের চোয়ালের মধ্যে। যারা ওকে মুহূর্তে র মধ্যে ছিঁ ড়ে
চিবিয়ে খেয়ে ফেললো.........

একই চক্র , অনন্তকালের জন্য ।

কনস্টেনটিনের লাফ, ওকে পিশাচের অপেক্ষমাণ চোয়ালের ভেতর নিয়ে ফেললো না। তার বদলে,
ওর হাতের ভঙ্গিমায় ফু টে উঠলো কিছু রহস্যময় মুদ্রা। সেগুলো বাতাসে ঘোরাতেই, আরেকটা পথ
খুলে গেলো । ওকে নিয়ে এলো এঞ্জেলার এপার্ট মেন্টে, মরণশীল মানুষদের জগতে।

এঞ্জেলা কেবল হলওয়েতে পা রেখেছে। পেছনে দরজাটা কেবলমাত্র বন্ধ করেছে। মুহূর্ত
খানেক আগেই কেবল , জন কনস্টেনটিন ওকে বলেছে “আপনি বাইরে গিয়ে দাঁড়ান, এঞ্জেলা ,
প্লিজ।” ও কেবল এতোটু কু ভাবার সময় পেয়েছেঃ লোকটা যথেষ্ট আবেদনময়, ধ্বংসাত্মক, বিষণ্ণ
ধরণের .........

তারপরই, ও শুনতে পেলো গামলা ফেটে যাওয়ার শব্দ ! পেছনে, রুমের ভেতরে ভারী কিছু পড়ে
যাওয়ার শব্দ।

নয়
125

সহজাত প্রবৃত্তির বশেই, এঞ্জেলা ছুটে গেলো নিজের লিভিং রুমের দিকে। দেখতে পেলো, ভাঙ্গা
কাঁচের ওপর উপুর হয়ে শুয়ে কাশছে কনস্টেনটিন, বিষাক্ত ধোঁয়া উঠছে ওর শরীর থেকে।

এঞ্জেলা ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসলো । নরম ভাবে ওর কাঁধ স্পর্শ করে বললো “কনস্টেনটিন, কি
হয়েছে ? আপনি ঠিক আছেন ?”

ও উঠে বসলো কনুইতে ভর দিয়ে। কাঁপছে, ঘাম ঝরছে সারা শরীরে। এঞ্জেলার ঘরের দিকে
চাইলো, ওটা আবার আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত এসেছে। ওর বাছাই করা বইগুলি,
টেলিভিশন বন্ধ, দেয়াল অক্ষত। কিন্তু, ওর ভেতরে, ও তখনও বহন করে চলেছে নরককে। অনেক
ভেতরে কোথাও, এমন এক স্মৃতিতে, যেটা ওর সাথে আছে বলে ওর দুঃখের শেষ নেই।

“কনস্টেনটিন ?”

ওর কর্ক শ কণ্ঠটা , বাতাসে ভেসে রইলো খানিক “আমি দুঃখিত ।”

ও নরক থেকে কিছু একটা বহন করে নিয়ে এসেছে, এখানে রূপ দিয়েছে সেটার। ইসাবেলের
পরিত্যাক্ত জিনিসপত্রের মধ্যে যেটা ছিল না......

ওর মুঠি খুলে সেটা দেখালো সে – একটা ভাঙ্গা হসপিটাল ব্যান্ড , নরকাগ্নির জ্বালানি --
সালফারের গন্ধযুক্ত। ওটার ওপরে লেখাঃ ইসাবেল ডডসন !

“আমি এটা নিশ্চিতভাবে জেনেছি ” কনস্টেনটিন বললো , উঠে বসতে বসতে। “ও নিজেই
নিজের প্রাণ নিয়েছে। আর............ এজন্য ও সাজাও পাচ্ছে। ”

এঞ্জেলা ওর হাত থেকে ব্যান্ডটা নিলো । শক্ত করে ধরে রাখলো , যেন ওটা ওকে শক্ত থাকতে
সাহায্য করবে। গাল বেয়ে নেমে এলো অশ্রুধারা।

কনস্টেনটিন অসহায়ভাবে ভাবতে লাগলো , কিভাবে ওকে সাহায্য করবে সেটা ভেবে।
126

সাহায্য করো ওকে ! ঐ মেয়েটা, যার বোন চিরকালের জন্য আটকে আছে নরকে, সাহায্য করো
বেচারিকে ! কি অহংকারী আমি !

তবুও, কনস্টেনটিন ওর দুইহাত বাড়িয়ে ধরলো ওর দিকে। এটাই ঠিক মনে হলো এই
সময়ে............

এঞ্জেলা সেই বাহুডোরে ভেঙ্গে পড়লো , কাঁধ ফু লে ফু লে উঠছে অদম্য কান্নায় “ও না ” কেঁ দে
কেঁ দে বলতে লাগলো সে “আমি ! ও না , কিছুতেই না , আমি !”

সম্ভবত ওর বোনের জায়গা নিতে চাইছে, কনস্টেনটিন ভাবলো। যদি ও জানতো ওই জায়গাটা
আসলে কেমন । কি অন্তহীন নির্যাতন, বারবার , অনেকবার। কতোটা অন্তহীন হতে পারে নিরাশার
অন্ধকার। সেটা জানলে ও হয়তো এতোটা মহান হতে পারতো না, বোন হোক বা না হোক।

কিন্তু ও কেবল এঞ্জেলাকে ধরে রইলো , কিচ্ছুটি না বলে । একটু অদ্ভু ত লাগছিলো ওর –
অনেকদিন ধরেই, কাউকে ওর এতো আপন লাগেনি। অবশ্য ও মেয়েদের সাথে সেক্স করেছে,
অনেক অরধেক-মানুষদের সাথেও। ওটা কেবল শারীরিকভাবে কাছে এনেছে। কিন্তু এটা......
সম্পূর্ণ নতু ন ধরণের ঘনিষ্ঠতা। যেটা কিনা , অনেকটা ভেতরে পৌঁছে যায়। হৃদয়ের এমন একটা
এলাকা স্পর্শ করে যায়, যেটা ওর ধারণা ছিলো অনেক আগেই মরে গেছে।

কিছু মুহূর্ত পর, এঞ্জেলা সোজা হয়ে বসে, চোখ মুছলো “কিভাবে ......... ?”

কনস্টেনটিন জানতো ও কি বলতে চাচ্ছে। যে মেয়েটা আত্মহত্যার নাম শুনলেই ভয়ে কাঁপত,
সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করতো, সে কিভাবে এই কাজ করলো ?

ওর কাছে এটার কোন উত্তর ছিলো না। কেবল তাকিয়ে রইলো মেয়েটার চোখের দিকে। সেদিকে
তাকিয়ে, একটা ধাক্কার মতো খেলো সে। অন্যদিকে তাকাতে চাইলো, পারলো না। মেয়েটা কোন
চেষ্টা ছাড়াই ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে নিস্পলকভাবে।
127

শেষমেশ, একটা প্রচণ্ড শারীরিক দুর্বলতা গ্রাস করলো কনস্টেনটিনকে, ভেতর থেকে। সে কম্পিত
কণ্ঠে বললো “আমার...... খেতে হবে কিছু ”

এঞ্জেলা নড করে বললো “অবশ্যই, চলুন এখান থেকে বের হয়ে যাই। ” কনস্টেনটিনকে উঠে
দাঁড়াতে সাহায্য করলো সে।

আসলে, কনস্টেনটিন চাচ্ছিলো এই ঘর থেকে বের হয়ে যেতে – সেইসাথে মেয়েটার দৃষ্টির সামনে
থেকেও। এই দুর্বলতার বোধ ভালো লাগছিলো না ওর কাছে। ওর সেই সব-কিছু-জাহান্নামে-যাক
ধরণের ব্যাক্তিত্বে ফেরত যেতে চাচ্ছিলো সে। সেই ব্যাক্তিত্ব, যেটা সবসময় লড়াইয়ের জন্য তৈরি
থাকে, সেটাতেই সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বেশী। এটা অনেকটা পুরানো বন্দুকের হাতলের মতো,
অনেক ব্যবহারে হাতের সাথে যেটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

কিন্তু, প্রশ্নটা তখনও বাতাসে ভেসে আছে।

কিভাবে ?

একটা বর্ণহীন, সঙ্কীর্ণ পরিসর অফিস। একটা কম্পিউটার, অনেকগুলি অব্যবহৃত পুরানো
ফাইলিং ক্যাবিনেট , একটা ক্যালেন্ডার। একটা দরজা, চলে গেছে মর্গের দিকে ............

লাইটগুলো তখনও জ্বলছে, রাতের এই সময়েও। ওরা মনে হয় ওগুলো কখনও বন্ধই করে না –
ভাবলো ফাদার হেনেসি। খুন কখনও ঘুমায় না – তাহলে করোনারের অফিস কেন ঘুমাবে ?
ফেরেশতাদের শহরে, লস এঞ্জেলস কাউন্টি করোনার , সবসময় খোলা আছে ব্যবসার জন্য !

মর্গের ধাতব দরজাটা খোলা ছিলো। মানে হলো , কেউ একজন এখানে ছিলো, আর সে দ্রুতই
ফিরে আসবে।

হেনেসির এরেস্ট হয়ে যাবার খুব ভালো সম্ভাবনা আছে, পারলে জেলও হয়ে যেতে পারে --যদি সে
এটা নিয়ে আর এগোয়।
128

সে স্থির করলো , সুযোগটা নেবে। সে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটার পেছনে লেগেছে। সে জানে না
ওটা কি, কিন্তু এটা জানে, এটা অনেকের কাছেই মূল্যবান হয়ে দাঁড়াবে।

এর মানে হলো, সে নিজেও মূল্যবান হয়ে পড়বে । অনেকদিন হলো , এরকম অনুভব করেনি সে।
আপনি কোন কিছুতে অবদান রাখতে পারছেন, কোন সত্যিকারের কাজে লাগছেন , এই
অনুভূ তিটা অনেকের কাছে নেশার মতো। এই নেশাটা অনেকদিন ধরেই মিস করছে সে।

ওর মনে হলো , সাথে করে খানিকটা মদ নিয়ে এলে খারাপ হতো না, ভাবলো সে। মৃতদের সাথে
একা থাকবে – আর ঐ কণ্ঠস্বরগুলো আবার ফেরত এসেছে , ওর ভেতরের কানটাকে ঝালাপালা
করতে। সে জানে , পাপমোচন মা হওয়া কিছু মৃত মানুষের আত্মা ওদের দেহের আশেপাশে ঘুরতে
থাকে কিছু সময়ের জন্য। ওদের কেউ কেউ এই অবস্থাটাকে যতদিন সম্ভব টেনে নিয়ে যায়,
অবধারিত সত্যের কাছে নতি স্বীকার করার আগে।

মরে যাওয়ার পর, যেহেতু সত্যিকারের ব্রেনের যুক্তির সাহায্য পায় না, মৃত মানুষেরা দিনের পর দিন
তাদের জাগতিক দেহের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। বুঝতে চেষ্টা করে, আসলে যেটা
পোশাকের মতোই পরে ছিলো এতদিন, সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হলো কিভাবে ! আসলে, বোকা
জীবিত মানুষের মতোই, বোকা মৃত মানুষেরও অভাব নেই !

ঐ রকমই কিছু জড়বুদ্ধি প্রেতাত্মা ঘুর ঘুর করছিলো , যখন হেনেসি চকচকে স্টিলের দরজাটা খুলে
ভেতরে এলো। ভেতরে অনেক ঠাণ্ডা, ওর নিঃশ্বাস বাস্প হয়ে যাচ্ছিলো । পুরানো বুরবনের গন্ধ
মিশে যাচ্ছিলো , ক্ষয়ের গন্ধ আর ফর্মালডিহাইডের গন্ধের সাথে। অনেকগুলি স্টিল ভল্টের মাঝে,
ওর অতীন্দ্রিয় অনুভূ তি ওকে নিয়ে এসেছে এই নির্দি ষ্ট ভল্টের দিকে।

দেয়ালের গায়ে সারি শেলফে সাজানো মৃতদেহ। ও একটা হাত তু লে, হাতের তেলো থেকে
নিঃসরণের মাধ্যমে ওর অলৌকিক চেতনা দিয়ে খুঁজে বের করতে চাইলো সেই মৃতদেহ – যেটা
সংবাদপত্রে পড়েছিলো।
129

ইসাবেল...... ইসাবেল ডডসন.........

ও একটা টান অনুভব করলো, ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সিটে ঢাকা একটা স্লিম দেহের দিকে –
তারপর কেউ একজন ওর পথে এসে দাঁড়ালো।

ওটা ছিলো এক বৃদ্ধা মহিলা, ওনার ফিউনারেল পোশাক পরা। ঐসব ক্লান্তিকর, একগুঁয়ে ভু তেদের
একজন। হেনেসি বৃদ্ধার মনের ভেতরের কথা শুনতে পেলোঃ

“সরে যা ! তোর ঐ নোংরা হাতে আমাকে ধরবি না !”

“ম্যা’ম” বললো হেনেসি “আপনার দেহকে যেতে দিন । কোন কিছুই আপনার এই অবস্থা
পরিবর্ত ন করতে পারবে না। আপনি মৃত। ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করুন, আর সামনে এগিয়ে
যান............”

বলেই, মহিলাকে ভেদ করে সামনে চলে গেলো সে – ইচ্ছা করেই এটা করলো যাতে মহিলা আর
ওকে বিরক্ত করতে না পারে। সে মহিলার ক্ষোভ অনুভব করতে পারলো, তারপর সে অদৃশ্য হয়ে
গেলো।

হেনেসি ইসাবেলের মৃত শরীরের দিকে এগিয়ে গেলো। সিটটা তু লে ফেললো। নীল চামড়া, গর্তে
বসা বন্ধ চোখ। কানে বাঁধা দুলের মতো ট্যাগ।

বেচারি মেয়ে, সে ভাবলো। এতো অল্প বয়স ! আর এখানে একজন মদখোর পাদ্রী দাঁড়িয়ে আছি
পাশে।

সে হাত বাড়িয়ে, হাত রাখলো মেয়েটার কপালে। বিশেষ কিছু অনুভব করতে পারলো না। স্রেফ
একটা খোসা, আত্মা যাকে ছেড়ে গেছে। সারা গায়ের ওপর শূন্যে হাত বোলালো সে, থেমে গেলো
কব্জির কাছে এসে।
130

এই তো। খুব আলাদা। ব্যাথা দেয়ার মতো তীক্ষ্ণ......... নরকের সাথে সরাসরি সংযোগ......
একটা চিন্হ। ওর মনের চোখে দেখতে পেলো ওটা .........

“হেই, ওখানে কি করছ ? ” পেছন থেকে একটা কর্ক শ কণ্ঠ ভেসে এলো “তোমার ঐ বালের
হাতগুলো সরাও ওখান থেকে, নোংরা মনের মানুষ কোথাকার ! ”

হেনেসি পেছনে ফিরলো একটা ভূ তকে ধমক দিয়ে ভাগিয়ে দেবে বলে। দেখলো , ভূ তের জায়গায়
দাঁড়িয়ে আছে একটা জলজ্যান্ত, নিঃশ্বাস ফেলতে থাকা জোয়ান মর্দ সিকিউরিটি গার্ড । সে একটা
হাসি দিলো , তারপর হঠাৎ সামনের দিকে ঝাঁপ দিলো একটা। গার্ড কে একপাশে ধাক্কা দিলো যত
জোরে পারে, তারপর খোলা দরজা দিয়ে দৌড়ে উধাও হয়ে গেলো।

গার্ড বেচারা একপাশে পড়ে গিয়ে, মাথায় আঘাত পেলো। স্থির হয়ে গেলো সে।

এক মুহূর্তে র জন্য ওর মনে হলো , সে ফিউনারেলের পোশাক পরা এক মহিলাকে দেখতে পেলো।
ওর দিকে নিচু হয়ে তাকিয়ে আছে আর বলছে “ঐ ব্যাটা আমাকে রেপ করতে চেয়েছে ! ঐ সিটের
নিচে আমি তো পুরো ন্যাংটো , পুরাই ন্যাংটো !”

তারপর মিলিয়ে গেলো মহিলা ! আরে, মাথায় আঘাত পেলে মানুষ কতই না ভু লভাল দেখে !

গার্ড টি এরপর পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে , যে লোকটা মর্গের ভেতর চু রি করে ঢু কেছে, ওকে খুঁজতে
বেরোল।

কিন্তু যে সময়ের মধ্যে ও পায়ের ওপর দাঁড়ালো আর ব্যাক আপের জন্য কল করলো, ততোক্ষণে
ফাদার হেনেসি হাওয়া হয়ে গেছেন।

মলি’স বার্গার দোকানটাতে বেশ ভিড় দেখা গেলো, এতো দেরীতেও। কনস্টেনটিন আর
এঞ্জেলা বাইরে টু লে বসে, লোকজনকে ভেতরে ঢু কতে আর বেরোতে দেখছে। মানুষ জন বাইরের
টেবিল গুলোতে বসে আছে, স্থানীয় ছেলে পেলে আড্ডা দিচ্ছে কাছের মোড়ে।
131

কনস্টেনটিন ওর দ্বিতীয় বার্গারের উচ্ছিষ্ট একপাশে সরিয়ে রাখলো। ওর মনে হলো , যথেষ্ট হয়েছে,
এর মাঝেই প্রমাণ হয়ে গেছে যে, সে মরণশীল পৃথিবীতেই ফিরে এসেছে আবার ! অন্য ভু বনের
দুঃস্বপ্নকে ফাঁকি দিতে পেরেছে আরও একবার।

সে পেছনে হেলান দিয়ে বসে, একটা সিগারেটের আশা করলো। কিন্তু এখন, এঞ্জেলার সামনে
ধরাতে চাইলো না। বদলে, খানিকটা চা খেলো সে , কাশলো খানিক। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে ,
এঞ্জেলা যাতে শুনতে পায় সেভাবে বললো “ঈশ্বর এবং শয়তান। ইতিহাসের সবচেয়ে পুরানো
খারাপ সম্পর্ক । খুব, খুবই প্রতিযোগিতামূলক। ”

একটু চু প করে থেকে আবার খেই ধরলো “ফেরেশতা আর পিশাচেরা আমাদের জগতে আসতে
পারেনা। পরিবর্তে , আমরা দেখি – যাদেরকে আমি ডাকি দো-আঁশলা বলে। ধরুন, আপনি
আপনার জীবনে খুবই ভালো মানুষ ছিলেন, অথবা খুবই খারাপ। তো , ‘ওরা’ আপনার আত্মাটা
একটা মানুষের চামড়ায় পুরে দিয়ে , সোজা এখানে পাঠিয়ে দেবে ‘বিশেষ মিশন’ দিয়ে ! চিরশান্তিতে
থাকু ন, বাল আমার ! ”

সে চারপাশে তাকালো একবার। এডের বেশীরভাগই , স্রেফ মানুষ।

বেশীরভাগ ।

এঞ্জেলার দিকে আরও একটু ঝুঁকে, গলা আরও এক পর্দা নামিয়ে বললো সে “ওরা আমাদের
মতো দেখতে হয়, যাতে আমাদের মাঝে মিশে যেতে পারে...... ওদেরকে পাঠানোই হয় মানুষের
মাঝখানে মিশে যাবার জন্য। পিশাচের মিশ্র অংশ নিয়ে, ফেরেশতাদের খানিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে , ওরা
বাস করে যায় আমাদের মাঝে। সেইসব দো-আঁশলারা । ওরা কেবল আমাদের কানে কানে
ফিসফাস করতে পারে। কিন্তু একটা শব্দই আপনার মনে সাহস জোগাতে পারে। অথবা আপনার
সবচেয়ে আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতাকে পরিণত করতে পারে , ভয়ংকরতম দুঃস্বপ্নে। ওরা এটাকে
বলে, ভারসাম্য। ” খানিকটা চা খেলো ও, গলা শুকিয়ে গেছে। মোটা গোড়ালির , আগুনে লাল
চু লের মহিলার দিকে না তাকানোর চেষ্টা করলো, এইমাত্র পাশ দিয়ে হেঁটে গেলো। অনুভব করতে
132

পেরেছে, সে-ও ‘ওদের’ একজন। মহিলা শোনার মতো দুরত্বের বাইরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা
করলো সে। তারপর আবার শুরু করলো “তো , এইসব দো-আঁশলা যখন নিয়ম ভাঙ্গে, মুক্ত
ইচ্ছার ওপর হস্তক্ষেপ করতে চায়, অথবা কোন আত্মাকে রাহাজানি করে – আমি সেইসব কু ত্তার
বাচ্চাদেরকে সোজা নরকে ফেরত পাঠিয়ে দেই ! এদের সবাইকে আমি নাগালে পাই না , কিন্তু আমি
অবসরে যাবার আগ পর্যন্ত বেশ ক’টাকে নাগালে পাবো বলে আমার বিশ্বাস। ”

“আপনার...... অবসর ?”

“আমি মরণ-কামী এক লোক , এঞ্জেলা ! আমি যখন মারা যাবো , নিয়ম অনুযায়ী , একটা জায়গাই
আছে যেখানে আমি যাবো ।”

এঞ্জেলা ওর দিকে তাকিয়ে রইলো “আমাকে সোজা ভাবে বুঝতে দিন। আপনি স্বর্গে আপনার
জায়গা নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন ?”

“আপনি হলে কি করতেন – এমন একটা জেলে যদি আপনাকে পাঠানো হতো – যেখানকার
বেশীরভাগ কয়েদীদেরকে আপনি নিজেই সেখানে পাঠিয়েছেন ? ”

এঞ্জেলা ওকে নিরিক্ষা করতে লাগলো । কনস্টেনটিনের মনে হলো , ও একজন উন্মাদ লোক, আর
এঞ্জেলা একজন মনস্তত্ত্ববিদ ! কিন্তু এঞ্জেলা এরপর যেটা বললো , সেটাতে ওকেই পাগল বলে মনে
হলো “কেউ নরক থেকে কিভাবে পালাতে পারে ? ”

কনস্টেনটিন ওর কাপ ঘোরাতে ঘোরাতে বললো “আমার কোন ধারণা নেই ”

একটা ঢোঁক গিলে , তিক্তভাবে বললো এঞ্জেলা “আন্দাজ করতে দিনঃ আমাদের সবার জন্য
ঈশ্বরের আলাদা আলাদা পরিকল্পনা আছে ! ”

“ঈশ্বর হলেন, একটা পিঁপড়া কলোনির সামনে একজন কিশোর , ম্যা’ম। ওনার কোন পরিকল্পনা
নেই ! ”
133

“আমরা যখন ছোট ছিলাম, ইসাবেল কিছু জিনিস দেখতো, যেমন আপনি দেখেন। ”

নাকে শব্দ করলো কনস্টেনটিন। মনে করতে চায় না সেসব কথা “আমি যখন বাচ্চা ছিলাম...... ”

নিজের বাচ্চাকালের ছবি মনে ভাসাতে চেষ্টা করতে লাগলো কনস্টেনটিন। সেখানকার কিছু স্মৃতি,
ও এঞ্জেলাকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চায়।

“আমি এমন কিছু জিনিস দেখেছি, যেগুলো মানুষেরা কখনও দেখেনি.........”

আর, ওর মনে পড়ে গেলোঃ

বালক কনস্টেনটিন, লিকলিকে শরীরের জিন্স আর সাইজে অনেক বড় একটা জ্যাকেট


পরা। এলোমেলো চু ল, ওর এপার্ট মেন্ট বিল্ডিঙের হলওয়ে ধরে হেঁটে যাচ্ছে। একটা খোলা দরজা
পার হয়ে যাচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, একজন বড় বড় চোখের মেয়ে, মুখে আঘাতের চিন্হ, একটা
রাক্ষসকে টাকা দিচ্ছে।

সেই রাক্ষস মেয়েটাকে বিনিময়ে কিছু একটা দিলো – একটা বন্দুক !

গায়ে গতরে রাক্ষস নয়। একটা মানুষের আকৃ তির খাপছাড়া জিনিস, সবগুলি চোখই কালো ।
ওটার সারা শরীর ঢাকা , কিলবিলে ধরণের, পাটকিলে রঙের ঘিনঘিনে তেলাপোকায় !

ছেলেটা একটু সংকু চিত হয়ে, আবার হাঁটা শুরু করলো । এ ব্যাপারে কাউকে কিছু না বলাটাই
ভালো মনে করলো সে। সে এর মধ্যেই জেনে গেছিলো, সে যেরকম দেখে, অন্য মানুষেরা সেরকম
রাক্ষসদের, পিশাচদের দেখতে পায় না............

আর এখন, কনস্টেনটিন ওর চোখ বন্ধ করলো “আমি এমন অনেক জিনিস দেখেছি,
যেগুলো তোমার মোটেই দেখা উচিত নয়, এঞ্জেলা............”
134

আর ও স্মরণ করলোঃ

বালক কনস্টেনটিন বসে আছে একটা সিটি বাসে, সেটা ছুটে চলেছে শহর ভেদ করে। সেই
বেশী রাতের বাসের যাত্রী বেশীরভাগ ছিলো মানুষ । কিন্তু, কিছু কিছু যাত্রী.........

একজন বৃদ্ধা মহিলা ছিলো , একটা বাচ্চা, আর দুটো কিশোর কিশোরী। একসাথে বসে ছিলো
সবাই। এতদুর পর্যন্ত ঠিক আছে, কেবল ওদের চামড়া ছিলো অসম্ভব শক্ত, আর পেছনে ছিলো
লম্বা লেজ – আরও ছিলো শ্বদন্ত !

বাচ্চাটা ওর শ্বদন্ত বের করে ওর দিকে তাকিয়ে বিশ্রীভাবে হাসলো। আর কিশোর-কিশোরী দুজন,
ঠোঁট চাটতে লাগলো !

কনস্টেনটিন এঞ্জেলার দিকে তাকালো, ইতস্তত করছে।

“বলে যান” সে বললো ।

মেয়েটা নিবিষ্ট মনে শুনছে। কিন্তু ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে কনস্টেনটিনের সন্দেহ হলো, সে আদৌ
ওর কথা বিশ্বাস করছে তো ? ও হয়তো সন্দেহ করতে শুরু করেছে এপার্ট মেন্টে যা , ঘটেছে , সেটা
আসলে কি ? ও কি মনে করছে কনস্টেনটিন ওকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছে ? কিন্তু, মেয়েটা উড়ন্ত
পিশাচদের তো দেখেছে, ওগুলো তো আর যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। যদিও, মানুষ এসবের
বিরুদ্ধে কত অদ্ভু ত অদ্ভু ত ‘যুক্তি’ই না দাড় করায় ......

“আমার মা বাবা তা-ই করলেন, যা অন্য যে কোন মা বাবাই করতেন। ” কনস্টেনটিন নরম ভাবে
বললো “যখন তাদের ছেলে তাঁদেরকে বললো যে – সে রাস্তায় পাপী আত্মাদের দেখেছে। মানুষের
ছদ্মবেশে থাকা পিশাচদের দেখেছে, দেখেছে রাক্ষসদের। ওরা ওঁদের বালের দায়িত্ব পালন করলেন –
আমাকে একটা মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন !”
135

আর ওর আবার মনে পড়ে গেলোঃ

দুইজন সাদা কোট পরা লোক – বিশাল শরীর, বিরক্ত কিন্তু দয়ামায়াহীন – চৌদ্দ বছরের
কনস্টেনটিনকে টেনে নিয়ে ফেলছে একটা টেবিলে । সেখানে স্ত্র্যাপ দিয়ে বাঁধা হবে ওকে, দেয়া হবে
‘ইলেকট্রিক শক থেরাপি’। ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেললো ওরা, মাথাসহ।

ডাক্তার এগিয়ে এলো ওর দিকে, আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো ছেলেটা। ও দেখেছে,
ডাক্তারটির কোন মুখ নেই, মুখের কোন চিন্হই নেই ! স্রেফ উপহাসের মতো একটা গোলাপি
শূন্যতা সারা চেহারা জুড়ে, আর ... আর ঐ ভীষণ ব্যাস্ত হাত দুটো, যন্ত্রপাতি নড়াচড়া করে চলেছে
সেগুলো ! .........

“ইলেক্ট্রো-শক থেরাপি......” বিড়বিড় করে বললো এঞ্জেলা।

ও নড করলো “খুব ভালো ওষুধ !!”

এঞ্জেলা নিঃশ্বাস ফেললো একটা “ওরা ইসাবেলের সাথেও ওটা করেছে। এটা কখনোই সাহায্য
করেনি । কিন্তু, তা-ও , ওরা এটা করেই গেছে । ”

“ঐ ‘থেরাপি’ ব্যাপারটাকে আরও খারাপ করে তু লেছে । ” দুঃখের সাথে বললো কনস্টেনটিন।
তারপর, ও এখন যা, সেটা তৈরি করার শেষ ধাপটা মনে করার চেষ্টা করলোঃ “শেষ যেখানে ওরা
আমাকে পাঠালো, সেটা চালাতো চার্চ .........”

ষোল বছরের জন কনস্টেনটিন , বসে আছে একটা প্রায় খালি কংক্রিটের সেলে। একটা
চার্চে র ভেতরে সেটা। গুঁড়ি মেরে বসে আছে এক কোণাতে , সামনে দাঁড়ানো সাদা পোশাক পরা
136

যাজক থেকে যতটা দূরে সম্ভব। পাদ্রী ‘এক্সরসিজম’ অনুষ্ঠান করছেন, মন্ত্র আওড়াচ্ছেন, আর ওর
ওপর পবিত্র জল ছিটাচ্ছেন.........

তা “রেভারেন্ড ফাদার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমি পজেসড.........” বললো কনস্টেনটিন।


তারপর.........

দ্বিতীয় একজন পাদ্রীর আগমন ঘটলো , সেলের অন্ধকার কোণা থেকে। যেন ঐ অন্ধকার থেকেই
জন্ম হয়েছে ওর। কাছিয়ে এলো সে , একটা গোপন উল্লাস নিয়ে দেখতে লাগলো , ঠোঁট চাটলো ,

চোখ চকচক করছে......... ঢেকে আছে ছোট ছোট পোকামাকড় দিয়ে......... তেলাপোকার চাইতে
অনেক ঘৃণ্য জিনিস ওগুলো, কারণ প্রত্যেকটার মুখ মানুষের মতো দেখতেঃ হাজার হাজার দাঁত
বের করা পোকামাকড়, নিরলসভাবে কু রে কু রে খেয়ে ফেলছে ওর আত্মা !! .........

কনস্টেনটিন হাসলো, শুকনো , বিষাক্ত হাসি “ওরা আমার ওপর এক্সরসিজম করলো, ঠিক
একটা দাঁত তোলার মতো, যেটা ওখানে ছিলোই না ! ”

কিশোর জন কনস্টেনটিন মোচড় খেতে লাগলো , ঐ শব্দগুলো ওকে আঘাত করার পর। সেই
শব্দগুলোর ভেতর প্রচণ্ড শক্তি ছিলো, যেগুলো ওর ভেতরে অনুরণন তু ললো। ওর ভেতরে
সার্জ নের ছুরির মতোই খুঁড়ে চলেছিল – যদিও ‘এক্সরসাইজ’ করার মতো সেখানে কিছুই ছিল না
! কেবল ছিলো ঐ পিশাচটার লোভী চাহনির যন্ত্রণা , যে কিনা পবিত্র জলের ছিটে থেকে সাবধানে
দূরে সরে দাঁড়িয়ে আছে ...... ছেলেটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠছে, সত্যিটা না বলতে পারার যন্ত্রণা।
পরিস্থিতির ভণ্ডামি এতোটাই জটিল ছিল, পবিত্র জল হাইড্রোক্লরিক এসিডের মতো হয়ে পড়ছিল

এখন, কনস্টেনটিন ওর কব্জি ঘষলো। এঞ্জেলার নিবিষ্ট, সহানুভূ তিশীল দৃষ্টির সামনে
অসহায় বোধ করছে ! জানে – এঞ্জেলা কিছু সময়ের জন্য ওর ভেতরের কিশোরটিকে দেখতে
পাচ্ছে।
137

ও কাঁধ ঝাঁকালো “আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, আমি উন্মাদ ! আপনি যদি অনেক সময়
ধরে ভাবতে থাকেন আপনি উন্মাদ......... তবে আপনি একটা পথ খুঁজে নেবেন নিজে থেকেই। ”

সে বুঝতে পারলো , এঞ্জেলা ওর কব্জির খাঁজটার দিকে তাকিয়ে আছে “আপনি নিজেকে মেরে
ফেলতে চেষ্টা করেছিলেন......”

কনস্টেনটিন হেসে ফেললো “আমি কিছুই করতে চেষ্টা করিনি......”

সতেরো বছরের জন কনস্টেনটিন বসে আছে হাঁটু গেড়ে, নিজের বেডরুমে। হাতে একটা
কাঁচি, আর...... সেখানে ও একা ছিলো না............

ওখানে ছিলো শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবী , ময়লা ফেলার লোক। তাদের কাজের পোশাক আর
ভাবভঙ্গী দেখেই তাদের চেনা যাচ্ছে। কিন্তু আপনি যেটা সাদা চোখে দেখবেন না , যেটা ও এখন
দেখতে পাচ্ছেঃ ওদের কু কু রের মতো শ্বদন্ত, লেজ, শিং আর কাঁটা । মানুষের পোশাক পরা ওইসব
পিশাচেরা , ওর ওপর ঝুঁকে আছে । অনেকে দেয়ালে হেলান দিয়ে, বুকের ওপর হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে
আছে। সবাইই পরোক্ষভাবে ওকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করছে। অপেক্ষা করছে, কখন ও
নিজের প্রাণ নিয়ে নেবে।

ওটা কেবল আনন্দের জন্য ছিল না। এটা ওদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ যে, ও নিজের প্রাণ যাতে নিজেই
নিয়ে নেয় ! এর ফলে , মানুষজনের কাছে ওদেরকে আর প্রকাশ করে দিতে পারবে না সে। আর এর
ফলে , ওদের প্রভু র করায়ত্বে চলে যাবে সে, চিরকালের জন্য। যেটা কিশোর কনস্টেনটিন তখনও
বুঝতে পারেনি।

কনস্টেনটিন ওদের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ হাসলো। ও ওদেরকে ফাঁকি দিয়ে, পরকালে চলে যেতে
চায়।
138

সে জানতো না, বা বিশ্বাস করতো না – যে আত্মহত্যা হলো চিরকালীন অভিশাপের দিকে ওয়ান-
ওয়ে টিকেট । নরকের পথে ......... আর অবশ্যই সশরীরে নয়।

ও নিজের কব্জি কেটে ফেললো , অনেক গভীরভাবে। রক্ত বেরোল ফিনকি দিয়ে, চারপাশের ভিড়
করে থাকা পিশাচেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো বেশ শব্দ করেই।

আর ...... হাততালিতে ভরে গেল সারা ঘর।

ক্ষতটা অনেক গভীর ছিলো। ওর ব্লাড প্রেশার একদম নেমে গেলো। ওর চোখের সামনে পুরো
রুমটা ঘুরে উঠলো একবার............

“আমি কিছুই চেষ্টা করিনি” বললো কনস্টেনটিন আবার।

“কিন্তু আপনি এখানেই আছেন, জীবিত ” এঞ্জেলা মৃদুভাবে নির্দে শ করলো । নিজের চায়ে চু মুক
দিতে দিতে , ওর দিকে চেয়ে রইলো সে।

“ওটাতে আমার কোন ভু মিকা ছিলো না......... যার কারণে আমি এখনও এখানে আছি। ”
কনস্টেনটিন বললো।

তার মনে পড়লো ......... আর সেই স্মৃতি এতো বছর পরেও, ওর শরীরে কাঁপুনি তু লে দিলো ।
ওর কাঁধ শক্ত হয়ে গেলো, টেবিলের কোণা শক্ত করে ধরে রাখলো সে।

ঘামে ভেজা প্যারামেডিকরা ঘন ঘন হাঁফাচ্ছে। ওরা ঝুঁকে আছে কিশোর জন


কনস্টেনটিনের ওপর, একটা এ্যাম্বুলেন্সের পেছনে বাঁধা একটা স্ট্রেচারে। একটা আই ভি সেট আপ
করা আছে, গাড়ির গতির সাথে সেটাও দুলছে। ওরা ছেলেটাকে একটা শট দিলো। ও অজ্ঞান,
মুমূর্ষু , কিন্তু এ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে কি চলছে সে ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকেফহাল ! তরুণ ডাঃ আর্চারও
ছিলেন সেখানে, সদ্য মেডিক্যাল পাশ করা তরুণী, উনি একজন প্যারামেডিক ছিলেন।
139

ইমারজেন্সি মেডিক্যাল টিমের লোকেরা ওকে লক্ষ্য করছে। কিন্তু সে সেই শটের বিপরীতে কোন
সাড়া দিচ্ছিল না !

আর্চার ডিফিব্রিলেটার প্যাডেল নিয়ে তৈরি হয়ে ছিলো , ওর হার্টে শক দেবার জন্য তৈরি।

সম্ভবত অনেক দেরী হয়ে গেছেঃ কনস্টেনটিন টের পেলো, ও ওর শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে !

ও এ্যাম্বুলেন্সের ছাদ ফুঁ ড়ে উড়ে এলো , ওর আত্মা ছেড়ে এলো ওর শরীর। বেশ খানিকক্ষণ, এই
মুক্তি উপভোগ করলো সে। অবশেষে, অবশেষে ......... সে এই পৃথিবীর কষ্ট থেকে রেহাই পেতে
যাচ্ছে ! সম্ভবত, ঈশ্বরের সাথে সাক্ষাৎ হবে তার, আর উনিই সবকিছু বুঝিয়ে দেবেন ওকে .........

আশার ডানায় উড়ছিল সে – অবশ্যই, কারণ শয়তান তার শিকারদের ওভাবেই দেখতে পছন্দ
করে ! সে ওদেরকে ভাবতে দিতে চায়, যে ওরা স্বস্তিদায়ক টানেল ধরে , সেই আলোময় , প্রশান্তির
দেশে পদার্পণ করবে......

ওদেরকে ওটা নিয়েই খুশি থাকতে দিতে পছন্দ করে শয়তান, এতে, কেড়ে নেয়ার সময় অনেক
বেশী আনন্দ পায় সে ! ঠিক একজন শিশু তার মায়ের কোলের দিকে দৌড়ে যাবার সময়, একটা
গাড়ির ধাক্কা খাওয়ার মতো !!!

আর কনস্টেনটিন, লস এঞ্জেলসের আকাশে ঘুরতে ঘুরতে উড়ে যাবার সময়, নিচের শহরের লক্ষ
লক্ষ মরণশীল মানুষের দিকে তাকাতে লাগলো। সে হঠাৎ উপলব্ধি করতে পারলো , শয়তানের
ছোট্ট কৌতু ক, পাঞ্চ লাইনের কাছে পৌঁছে গেছে প্রায়..................

মুহূর্তে র মধ্যে, ওর পরিচিত চিরচেনা লস এঞ্জেলস পাল্টে গেলো , নরক লস এঞ্জেলসে !

একইভাবে, এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত জুড়ে একটা পৈশাচিক খল খল হাসির ঢেউ বয়ে
গেলো। প্রসন্ন শহরটার ওপর দেখা গেলো , নরকাগ্নির লকলকে হলুদাভ শিখা ! ধোঁয়ার মোটা রেখা
উঠে যেতে লাগলো আকাশে, ছাইয়ের ঘূর্ণি ঘুরতে লাগলো দিকবিদিক , বিল্ডিং ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়তে
140

লাগলো বিকট শব্দে। আর পিশাচেরা উদয় হলো প্রায় শূন্য থেকে, শহরের ক্ষতস্থানের গ্যাংগ্রিন
ক্ষতে জন্মানো পোকার মতো !

আপনি নিউ ইয়র্কে মরলে, নিউ ইয়র্কে র নরকে যাবেন। ব্যাংককে মরলে, যাবেন নরক ব্যাংককে।

কিন্তু এই লস এঞ্জেলস , খেঁক শিয়ালের চোখের হলদে মণির মতো রঙের মধ্যে ধারণ করা একটা
শহর। যেখানে কেবল পিশাচেরা রাজত্ব করে, যেখানে মানবতা ক্রমাগত মরতেই থাকে, যেখানে
সবাই চিরটাকাল মরতেই থাকেঃ দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গাড়িতে, ধ্বসে যাওয়া মার্কে টে, পুড়ে যাওয়া
প্লাস্টিকে , দালানকোঠার ইটের পাঁজায় .........

অথবা হলিউডের কখনও শেষ না হওয়া কোন চলচ্চিত্রের ট্রেলারে............

কনস্টেনটিনের আত্মা ঘুরতে লাগলো নরক লস এঞ্জেলসের ওপর – আর ও নিজেকে বলতে


লাগলো, সে ওখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। সে ওপরের দিকে উড়ে যাচ্ছিলো , নিচের দিকে না। কিন্তু
ঐ হাসিটা, পরাজগতের একটা মাধ্যাকর্ষণ এর মতো কাজ করেছে। ওর ওপরের দিকে ওঠা বন্ধ
হয়ে গেলো। ভীষণ আতঙ্কের সাথে সে তাকালো নিচের নরকের দিকে...............

আর সেদিকে ধেয়ে যেতে লাগলো সে, সৈনিক পিশাচেরা ওর জন্য দুই হাত তু লে, খোলা চোয়ালে
অপেক্ষা করছিলো.........

একটা আত্মা কি ব্যাথা অনুভব করতে পারে ? ওহ, হ্যাঁ, অতি ক্ষীণতর থেকে এটা বাড়তেই থাকে।
হঠাৎ করেই মনে হল , ওখানে ব্যাথা ছাড়া আর কিছুর যেন অস্তিত্ব নেই !

“সময় আপেক্ষিক ?” কনস্টেনটিন নিজে নিজেই হাসলো “এঞ্জেলা, আইনস্টাইনের কোন


ধারণাই ছিল না ............”

তরুণ কনস্টেনটিনের আত্মা কেবল মুহূর্ত খানেক ছিলো নরকে............ তারপর ও আবার ফেরত
এলো সেই এ্যাম্বুলেন্সের ভেতর ! এ্যাম্বুলেন্সের স্ট্রেচারে ক্রমাগত ঝাঁকি খেতে খেতে উঠে বসে
141

পড়লো । দেখতে পেলো, ওকে সদ্য মৃত অবস্থা থেকে ফেরত আনা ডেফিব্রিলেটর প্যাড থেকে
ধোঁয়া বেরোচ্ছে তখনও।

“আস্তে, ছেলে ” বললেন তরুণী আর্চার “তু মি মারা গেছিলে—বেশী নড়াচড়া কোরোনা ! শুয়ে
পড়ে, বিশ্রাম নাও......... ”

কনস্টেনটিন সেই ধোঁয়াশা স্মৃতির জগত থেকে বেরিয়ে এলো। ওখান থেকে সভয়ে
পিছিয়ে এলো সে, সাথে নিয়ে এলো একটা ভয়াবহ জ্ঞান।

বিড়বিড় করে বললো এঞ্জেলাকে “আমার থেকে শুনুন, নরকে দুই মিনিট মানে, আপনার কাছে
সারাজীবনের মতো লাগবে .........”

সে সোজা হয়ে বসলো, কারণ লোকজন ওর দিকে তাকাতে শুরু করেছে। প্রায় ভ্রূণের ভেতরের
অবস্থার মতো বাঁকা হয়ে বসেছিল ও এতক্ষণ।

এঞ্জেলা, একটু এগিয়ে বসে কনস্টেনটিনের হাতে হাত রাখলো। কনস্টেনটিন অবাক হয়ে গেলো,
এই সামান্য ছোঁয়া , কতোটা অনুভূ তিরই না আদান প্রদান করতে পারে ! কতোটা উষ্ণতা, জীবন
আর স্নেহ বর্ষণ করতে পারে। কিন্তু তবুও, সে ভাবলো, ও একজন পুলিশ। এখানে আসার পথে ও
যা যা বলেছে, আর যেভাবে ওর বন্দুক ব্যবহার করতে চেয়েছে, সেসবই চিন্তা করছিলো মনে মনে।

নিজের গলা পরিষ্কার করে বললো “আমি যখন ফেরত এলাম, আমি জানলাম। আমি যেসব
জিনিস দেখতে পাই, সেসবই সত্যি। একটা জিনিস জানেন ?” ঘোঁত করে একটা শব্দ করলো সে
“পাগল অবস্থায়ই মনে হয় ভালো ছিলাম।”

এঞ্জেলা ওর চায়ে চু মুক দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।

“আমি পিশাচদের আর মৃতদের না দেখা শিখলাম ” কনস্টেনটিন বলে চললো “কিছু নির্দি ষ্ট
আধিভৌতিক ও মানসিক ক্রিয়ার মাধ্যমে ওদেরকে দেখি আমি ...... এমনকি তখনও আমি ভান
142

করি যে ওরা ওখানে নেই............ যদি না যেসব লোক এটা জানে, তাদের মধ্যে না থাকি। সেসব
লোক , যারা কিনা আমায় কিছু শেখাতে পারে – অন্য ভু বনের প্রাণীদের কাছ থেকে আত্মরক্ষা
করার কৌশল । ”

এঞ্জেলা চারদিকে নার্ভাস ভাবে তাকালো “তো , আপনি বলছেন , আপনি যখনই চান তাদেরকে
দেখতে পান ......... উম। এখানে কি...... সেরকম কেউ আছে ? ”

কনস্টেনটিন ওর দিকে তাকিয়ে রইলো “আপনি নিশ্চিত , যে আপনি জানেন না ?”

“কেন জানব আমি ?”

কনস্টেনটিন কাঁধ ঝাঁকালো । চারপাশে তাকালো । ওর আধ্যাত্মিক চোখ প্রসারিত করলো সে।
এক ঝিংচ্যাক জোড়ার দিকে চোখ আটকে গেলো। দুজনেই ফ্যাশন সম্বন্ধে অতি মাত্রায় সচেতন।
ওরা একে অপরের নতু ন পার্স, গুক্কি জুতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দুজনেই ফিরে তাকালো এদিকে ,
নিজেদের লেজ নড়াচড়া করলো , সাপের মতো জিহ্বা বের করলো , আর ড্রাগনের মতো চোখ
দিয়ে সতর্ক করলো ওকে । ওরা ওর উপস্থিতি টের পেয়েছে ! ওকে মারার জন্য ওদেরকে এখানে
পাঠানো হয়নি, কনস্টেনটিন বুঝতে পারলো। কিন্তু ওদেরকে নজরে রাখতে হবে। পোকামাকড় সমৃদ্ধ
সেই পিশাচ , বা সেই ডানাঅলা নরকের দুতের দলের কথা মাথায় আছে ওর। আরেকটা আক্রমণ
খুব শীঘ্রি আসতে চলেছে.........

ওর খেয়াল হলো ,এঞ্জেলা ওর রিপোর্টে র জন্য অপেক্ষা করছে “নাহ ! এখানে সেরকম কেউ
নেই!”

ওর খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছা হচ্ছিলো । ওর নার্ভ টানটান হয়ে আছে। তোমার মন অন্যদিকে
সরিয়ে রাখো, বুড়ো খোকা – নিজেকেই দাবড়ি লাগালো সে।

“স্বর্গ আর নরক ঠিক এখানেই আছে, এঞ্জেলা। প্রত্যেক দরজা, প্রত্যেক জানালার পেছনে – এক
জগতের পেছনে আরেক জগত। আর আমরা আছি মাঝখানে চ্যাপ্টা হয়ে ! ভারসাম্য ? ” ঠক
143

করে হাতের কাপটা টেবিলে রাখলো সে, চা ছলকে পড়লো টেবিলে “আর আমি এটাকে বলি
ভণ্ডামিপূর্ণ আবর্জ নার গাদা ......”

ওদিকে, একটা মদের দোকানের সামনে, ব্লক খানেক দূরে – ফাদার হেনেসি রাস্তা পার
হচ্ছেন। ঘামে , কাপড়চোপড় গুলো ওনার শরীরের সাথে লেপটে গেছে।

সম্ভবত এই ফোনটা কাজ করছে। এই রাস্তায় আরও দুটো পে ফোন পার হয়ে এসেছে ও, সেগুলো
ব্যবহারের অতীতভাবে ভাংচু র করা হয়েছে। ইস ! ওর মোবাইল ফোনটা যদি কাজ করতো !
বিলটা দিয়ে দিলেই হতো ! ওর বোঝা উচিত ছিলো, জন কনস্টেনটিন যেহেতু সাহায্য চেয়েছে,
জরুরী অবস্থায় পড়তেই পারে সে ।

ঈশ্বর, ওর একটা ড্রিংক দরকার এখন। মৃতদের ফিসফিসানি যেন কিছু একটা ইঙ্গিত করে যাচ্ছে।
ওরা এখন ব্যাক্তিগত ব্যাপার স্যাপার নিয়ে কথা বলছে......

“ফাদার...... আপনি কি তৃ ষ্ণার্ত ? কিছু একটা ............”

“ওহ, ও ঠিকই আছে, মর্গে ও পানই করছিলো ......”

“...... আমাদেরকে দেখে হাসছে, আমাদেরকে উপেক্ষা করছে, আমরা যখন ওকে আর যীশু আর
মাতা মেরী’র সাথে যোগাযোগ করতে বললাম, কিন্তু কেউ সাহায্য করলো না। শয়তান অন্তত
আমাদের সাথে কথা বলে, অন্তত আপনার দিকে নজর হলেও দেয়। ”

“এটা নাকি সুরে কথা বলে তোমাকে খুজছে, ফাদার ! এটা কাছিয়ে আসছে .........” বি

ওহ ! এদেরকে কোনভাবে যদি চু প করানো যেতো !


144

ঘরে ফিরে গিয়ে, এলুমিনিয়াম ফয়েল গুলো জায়গামত লাগিয়ে দাও আবার। তারপর এক গ্লাস
বুরবন ঢেলে , চু প করিয়ে দাও এদের। কিন্তু , নিজের বাসা আর বোতলের কাছে ফেরত যাবার সময়
এখনও আসেনি। ওকে কনস্টেনটিনের সাথে যোগাযোগ করতেই হবে।

ও পে ফোনের বুথে ঢু কলো , ভাংতি কয়েন ফেললো ভেতরে। রাস্তায় বৃষ্টির ছাঁট কমে এসেছে,
নর্দ মায় জমে আছে ভেজা আবর্জ নার স্তূ প। একটা হলুদ সোয়েটার, লস এঞ্জেলস টাইমসের একটা
পাতাও দেখা যাচ্ছে সেখানে।

ডায়াল টোন ! ফাদার হেনেসি দ্রুত পে ফোনের বাটন চাপতে লাগলেন।

“থেকো ওখানে , জন ” সে বললো , শব্দ করে “প্লিজ.........”

কনস্টেনটিনকে সতর্ক করতে হবে ওনাকে। ও ঐ চিন্হটা দেখেছে সে, ইসাবেলের কব্জিতে যেটা
ফু টে উঠেছে। অন্য একটা ভু বনের, গভীরতম অন্ধকার একটা জগতের জানালা খুলে গেছে।
ওখানকার এক ভয়ংকর বাসিন্দা , ওর দিকে তাকিয়ে , ওটা কনস্টেনটিনের নাম বলেছে। ওটার
নখ তাক করেছে ওর দিকে.........

ওরা কনস্টেনটিনের পেছনে লেগেছে, ওরা হেনেসির নিজের পেছনেও লেগেছে। কারণ সে
কনস্টেনটিনকে সাহায্য করছে। আর, কেবল কনস্টেনটিনই জানে ওদেরকে কিভাবে আবার নরকে
ফেরত পাঠাতে হয়।

ফোনটা বেজেই চলেছে, ক্রিং ক্রিং , ক্রিং ক্রিং ......

“ও বাসায় নেই, ফাদার, আর তোমার পেছনে কিছু একটা আছে...... এটা কাছিয়ে আসছে,
শয়তানের মতো কাছে, ফাদার......”

ফাদার ওদের বকবকানির দিকে কান দেয়ার মতো অবস্থায় নেই, অন্তত এখন তো না-ই। ওরা তু চ্ছ ,
বিরক্তিকর আর...... সবকটা মিথ্যেবাদী।
145

“তু মি শুনতে পাচ্ছ না ? ওটা তোমার পেছনেই, ফাদার ! এখনই পেছনে ফিরে তাকাও, আর দেখো
ওটার দিকে, বোকা বুড়ো কোথাকার ! ”

ও ওদেরকে খুশি করে, পেছনে তাকাতে চায় না। ওরা স্রেফ ওনাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছে, ওর
পেছনে কিছুই ঘোরাফেরা করছে না।

“ফাদার, এখনই দৌড়ে পালান এখান থেকে !” ওরা ওকে সতর্ক করছে।

ওনার পেছনে, কিছু একটার খড়খড় শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। ঘুরে তাকানোর পর, তিনি টের
পেলেন, কিছু একটা এগিয়ে এসে ওনার গোড়ালি পেঁচিয়ে ধরল । ওটার স্পর্শ ছিলো বিরক্তিকর,
ঘিনঘিনে, আর ওটার অনেকগুলি পা আছে বলে মনে হচ্ছিলো । পা ঝাড়া দিয়ে নিজেকে মুক্ত
করতে চাইলেন তিনি, কিন্তু গাছের গায়ে সেঁটে থাকা মসের মতোই , এটা লেপটে আছে ওনার
পায়ে।

“হোলি মাদার অব গড – যীশু – সাহায্য করো – এটাকে সরাও ! ”

ওটা হেনেসির পা বেয়ে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে, নিতম্ব বেয়ে, নিকটবর্তী প্রবেশ পথের দিকে
এগিয়ে যাচ্ছে।

ফোন টোন ফেলে, বাইরে বেরিয়ে দৌড় দেয়ার চেষ্টা করলো সে। যেন গা বেয়ে ওঠা কিলবিলে
জিনিসটা থেকে ওভাবে সরতে পারবে ! ওটা ওর মেরুদণ্ড হয়ে , নার্ভে র রাজা মস্তিষ্কের দখল
নিলো, ওকে তাড়িত করলো মদের দোকানের দিকে......

“তো যখন ঐ দো-আঁশলা গুলো নিয়ম ভাঙ্গে” কনস্টেনটিন বলে চলেছে , হাতে একটা
সিগারেট নিয়ে নড়াচড়া করে চলেছে ক্রমাগত “অথবা কারো স্বাধীন ইচ্ছায় বাদ সাধে বা কোন
আত্মা চু রি করে --”
146

“স্যার—এখানে আসলে, ধূমপান করা যাবে না” মহিলা ম্যানেজার , পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে
উঠলো, শুকনোভাবে।

“আমি স্রেফ ওটা হাতে ধরে আছি ” খ্যাঁক করে উঠলো কনস্টেনটিন , তারপর চোখ বুজলো
“দুঃখিত, যাই হোক ......”

“......... আত্মা চু রি করে” এঞ্জেলা কথা জুগিয়ে দিলো ।

ওটা শুনে, ম্যানেজার হাতের কাপের স্তূ পের ওপর দিয়ে ওদের দিকে তাকালো, ভ্রু ওপরে তু লে
ফেলেছে।

“হ্যাঁ, ওরা ওরকমই কিছু টেনে নেয় ” কনস্টেনটিন এঞ্জেলার দিকে ঝুঁকে এলো, এখন আর গলা
নিচু নেই “আর আমি ওদের কদাকার চেহারাগুলোকে আবার নরকে ফেরত পাঠিয়ে দেই...... ”

ওর মনে হলো, আরও বলে যাবে কিনা। ও এঞ্জেলাকে মিথ্যে আশা দিয়ে যাচ্ছে যে ও সাহায্য
করতে পারবে – কিন্তু কনস্টেনটিনের কাছে মনে হয়েছে, মেয়েটার সবটা বোঝা উচিত আগে।

কোনভাবে , সে বুঝতে পেরেছে, ওরা দুজন এটাতে এক সাথেই জড়িয়ে পড়েছে। ঐ ডানাঅলা
পিশাচেরা যখন রাস্তায় ওদেরকে আক্রমণ করেছিলো, তখনই সে বুঝতে পেরেছিলো সেটা। আর
যখন ও গামলাতে করে পানি নিয়ে এসেছিলো কনস্টেনটিনের জন্য, তখনও। ওরা দুজনেই সেটা
অনুভব করেছে। এটা অনেকটা, কোন দুইটি বাদ্যযন্ত্রের কর্ড বা সুর পরিবর্ত ন করার মতো, যাতে
ওরা একই সুরে বাজতে পারে ! আর কনস্টেনটিনের মতো অতিন্দ্রিয়বাদী লোকের কাছে , সবকিছুই
নির্দি ষ্ট কম্পনের তৈরি। ও আর এঞ্জেলা , দুজনেই, একই কম্পনে মিশে গেছে। ওর সহজাত প্রবৃত্তি
বলছে, এটা ওদের ভাগ্যতেই লেখা ছিলো। আর...... হয়তো...... হয়তো ওপরের কারো সাহায্য
.........

আপনি এই ধরণের অনুভূ তি কখনও উপেক্ষা করতে পারবেন না, ঠিক যেমন আপনি উপেক্ষা
করতে পারবেন না একটা শক্তিশালী নদীর স্রোতকে। আপনি স্রেফ এটার স্রোতের সাথে গা
147

ভাসিয়ে দেবেন, এটাকে ব্যবহার করবেন, আপনি যেদিকে যেতে চান, সেদিকে যাবার জন্য। জীবন
নিজেই তো একটা জাদু !

কেউ কিভাবে নরক থেকে পালাতে পারে ? মেয়েটা জিজ্ঞেস করেছে ওকে। কেউই পারেনা,
অবশ্যই। ওকে সত্যিটা এখনই বলে দেয়া উচিত......... অন্তিম সত্য কথাটা। কিন্তু ও কি
ইসাবেলের ব্যাপারে ওভাবে সারা জীবন চিন্তা করে যেতে পারবে, সহ্য করতে পারবে সেটা ?

“এঞ্জেলা.........” ডাক দিলো সে।

ওর দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালো মেয়েটা। অপেক্ষা করছে। গলা পরিষ্কার করলো
‘ডেয়ারডেভিল’ জন কনস্টেনটিন “চলুন...... একটু হাটি আমরা ......”

ফাদার হেনেসি পাকিস্তানী লোকটার শরীরের ওপর দিয়ে পার হয়ে এলো। লোকটাকে, আর
সেইসাথে আরও অনেক মদের বোতল ধরাশায়ী করেছে হেনেসি একটু আগে, ওর ভেতর এক
অনন্ত মদ্যপানের তৃ ষ্ণা জেগে উঠেছে হঠাৎ করে। যেন ওর ভেতর কেউ নরকের আগুন জ্বেলে
দিয়েছে, আর কেবল মদই সেটা নিভাতে পারে। মদ আরও আগুন জ্বালিয়ে দেয়, সবাই জানে
সেটা। কিন্তু তাতে কিছুই এসে যায় না, ওর পান করতে হবে, আরও আরও পান করতে হবে।

একটা জ্যাক ড্যানিয়েলের বোতল স্ক্রু দিয়ে খুলে নিলো সে, তারপর চু মুক দিলো সেখানে।
ক্ষণিকের জন্য সোনালি তরলের প্রবাহ দেখা গেলেও, তারপরই এটা উধাও হয়ে গেলো ! ভ্রু
কুঁ চকে বোতলটার দিকে তাকালো হেনেসি, খালি ওটা। সম্ভবত প্রথম থেকেই খালি ছিলো ওটা।

“কিসব বালছাল বিক্রি করো তোমরা এখানে ?” মেঝেতে গোঙাতে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে
ঝাড়ি লাগালো সে।

আরেকটা বোতলের দিকে তাকালো সে, পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ক্যাপ খুললো। উপুড় করে দিলো গলার
ওপর, একই অবস্থা ! আরও আরও আরও বোতল, বোতলের পর বোতল । সব খালি !
148

কিন্তু তৃ ষ্ণা গেলো না, ওটা কেবল দ্বিগুণ, দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হলো । সেই শুকনো গর্ত টা যেন
আরও বেশী গভীর আর অন্ধকার হয়ে উঠেছে।

বালথ্যাজার, দাঁড়িয়ে আছে শ্যাম্পেনের আইল (লাইন) এ। ঠোঁটে হালকা আমুদে হাসি নিয়ে সে
দেখে যাচ্ছে হেনেসির অবস্থা। হাতে ধরা একটা দামী শ্যাম্পেনের বোতল, সিল করা।

সে দেখলো , হেনেসি জেএন্ডবি এর একটা বোতলের মাথা ভেঙ্গে ফেললো সে, সেটা মুখে উপুড়
করতে গিয়ে, ঠোঁট কেটে গেলো তার। রক্তের সাথে বাদামী মদ, ওর মুখ উপচে পড়ে বাইরে পড়ে
গেলো। লাল আর সোনালী বাদামী রং, প্রিস্টের সাদা কলারে অভূ তপূর্ব এক রং সৃষ্টি করলো।
বেশ মজাদায়ক ব্যাপারটা।

কিন্তু হেনেসির কাছে, এখনও বোতলটাকে খালিই মনে হচ্ছে।

তখনই, ফেরেশতাটিকে দেখতে পেলো সে। ঈশ্বরের দাস, বালথ্যাজার সেরকমই ভেবে থাকে
ওঁদের। একজন হিস্পানিক স্টক বয়ের দেহের ভেতর আছে ফেরেশতাটি। পেছনের রুম থেকে
বেরিয়ে, এগিয়ে আসছে মেঝেতে শুয়ে কাতরাতে থাকা বসের দিকে। হেনেসির পাশে দৌড়ে গেলো
তারপর। প্রাক্তন পাদ্রী তখন হাফিয়ে, লম্ফ-ঝম্প করে, কর্ক স্ক্রু টা দিয়ে নিজের হাতেই একের পর
এক আঘাত করে চলেছে। ওর কিছু একটা পান করতেই হবে......... যে কোন কিছু। যদি কিছু না-ই
পাওয়া যায়, তাহলে নিজের রক্ত......... !

কিন্তু নিজের হাত মুখে দেয়ার আগেই, হেনেসি পড়ে যেতে লাগলো। স্টক বয়টি ধরে ফেললো ওকে,
সাবধানে শুইয়ে দিলো মদ আর রক্তে ভেসে যাওয়া মেঝেতে। চোখ দুটো জ্বলছে ওর, জানে, কি
ঘটে চলেছে এখানে।

চোখ তু লে তাকালো স্টক বয়, বালথ্যাজারের সাথে চোখাচোখি হলো ।

বালথ্যাজার দাঁত বের করে হাসলো। আনমনে আঙ্গুলের ফাঁকে কয়েনটা নড়াচড়া করছে, তারপর
দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে।
149

স্টক বয় এবার ফিরলো হেনেসির দিকে। হেনেসির দেহ থেকে বের হতে থাকা আত্মাটির উদ্দেশ্যে মৃদু
হাসলো । ভৌতিক হেনেসির দিকে তাকিয়ে নড করলো , এটা নিশ্চিত করতে , যে –

আপনি পেরেছেন !!

হেনেসি এক পলকের জন্য ফিরে তাকালো নিজের ধ্বংসপ্রাপ্ত দেহের দিকে। ওহ, কি যে ভালো
লাগছে ওখান থেকে বের হতে পেরে। পিশাচটা , শাপে বর হয়ে এসেছে ওর জন্য, ওর উপকারই
করেছে।

ছোটকালে, একবার এক জঙ্গলের ভেতর হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, পড়ে গিয়েছিলেন একটা
পিঁপড়ার ঢিবির ওপর। পিঁপড়াগুলো ওনার কাপড়চোপড়ের ভেতর দিয়ে, ওনার ঘামে ভেজা
শরীরে প্রচণ্ড কামড় বসাচ্ছিলো । শেষমেশ উনি একটা পরিষ্কার ঝর্না খুঁজে পেয়েছিলেন, তারপর
কাপড়চোপড় খুলে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। সেখানে গোসল করার পর, কি এক
অনির্বচনীয় শান্তি যে লেগেছিল তাঁর, সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয় –

ওনার এখন ঠিক সেরকমই লাগছে ওনার। ওনার নোংরা , কাপড়ের পুঁটু লির মতো দেহটা দলা
পাকিয়ে পরে আছে এক পাশে, ওনার নিজেকে পরিষ্কার লাগছে এখন। পিশাচ নেই, মদের তৃ ষ্ণা
নেই। কেবল , নেপথ্যে একটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের অভাব বোধ করছিলেন উনি, যেটার তালে
তালে নাচতে পারেন উনি !

সামনে, দেখতে পাচ্ছেন এক দিগন্ত বিস্তৃ ত হলদেটে তৃ ণভূ মি। সেটার ওপাশে , একটা অত্যন্ত
আদিম লেক দেখা যাচ্ছে, যেটার পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে একটা আলোর শহর ! উনি দেখতে
পেলেন, পুরানো বন্ধু রা এগিয়ে আসছে, পরিবারের সদস্যরা , দাদা-দাদীরাও আছেন। ওঁদের
অনেকেই এখানে আসতে পেরেছেন।

হেনেসি ঈশ্বরের প্রশংসা করলেন। কৃ তজ্ঞ বোধ করছেন, কারণ ওনার প্রতি কখনও বিশ্বাস হারান
নি তিনি। তিনি ভু ল করেছেন, মদ দিয়ে নিজেকে অপবিত্র করেছেন, টাকার জন্য পরজীবীর মতো
150

জীবন যাপন করেছেন। কিন্তু কখনো নিজের বিশ্বাস হারান নি, ওটা তাঁর ভেতরে থেকে গেছিলো,
একটা সরিষার ডানার চাইতেও ছোট আকারে। সেটা যথেষ্ট বড়ই ছিলো, কারণ সময় যখন এলো,
তিনি যখন ক্ষমা চাইলেন, সেটা পুরো পৃথিবী দখল করে, ওনাকে সেখানে প্রবেশ করিয়ে নিলো ,
মুহূর্তে র মধ্যে !

দশ

কনস্টেনটিন খেয়াল করলো, এঞ্জেলা ওপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা একসাথে রাস্তা
ধরে হাঁটছে অলস পায়ে। সে হয়তো উড়ন্ত পিশাচদের থেকে আরেকটা আক্রমণ আশা করছে !

“ওরা আবারও একইভাবে আক্রমণ করবে না, অফিসার এঞ্জেলা ! ঐ ব্যাটা কু ত্তার বাচ্চা ওর
আক্রমণের জন্য আপনাকে তৈরি থাকতে দেখতে পছন্দ করে না ! যখনই বুড়ো খোকা বুঝতে
পারবে আপনি অন্যমনস্ক, তখনই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত দিক থেকে আক্রমণ শানাবে সে ! ”

“তো- আমরা যে এখানে খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এখানেও ওরা আমাদের টার্গেট
করে আছে ? ” এঞ্জেলা মাথা নাড়লো “আমি কি আপনাকে জিজ্ঞেস করবো, যে আপনি কোন
ফাঁকে আমাকে ড্রাগ খাইয়ে বা পুশ করেছেন কিনা ? শহরের মাঝখানে ওটা কি আমি
হ্যালুসিনেশন দেখেছি ? এগুলো কি আসলেই সত্যি ?”

“আপনি জানেন এগুলো সত্যি । আপনি অনুভব করতে পারছেন !”

এঞ্জেলা কনস্টেনটিনের দিকে তাকালো পূর্ণ দৃষ্টিতে “এটা দিয়ে আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন ?”

“আমি বলতে চাইছি—আমাদের দুজনের মধ্যে কিছু কিছু ব্যাপারে মিল আছে...... ”
151

কনস্টেনটিন কাশলো , রক্ত উঠে এলো এবার। নর্দ মাতে থুতু ফেললো সে। একজন
মোটরসাইকেল আরোহী পুলিশ পার হয়ে গেলো, কনস্টেনটিনের দিকে বাঁকা চোখে তাকালো
হেলমেটের ভেতর থেকে। রাস্তায় থুতু ফেলা আটকাতে সে হয়তো থামবে না, কিন্তু আইনের প্রতি
একটু সম্মান তো দেখাতে হবে, না-কি !

কনস্টেনটিন উৎফু ল্লভাবে হাত নাড়তে নাড়তে বললো “পাছায় চু মো খাও, ট্র্যাফিক পুলিশ !”

এঞ্জেলা কনুই মারলো ওকে “থামো ! এটা খুবই বিব্রতকর হবে যদি আমাকে ...... যাই হোক। তু মি
স্রেফ ওইসব ট্র্যাফিক টিকিটের জন্যই বিরক্ত হয়ে আছো, সম্ভবত । যেগুলোর সবই হয়তো তোমার
প্রাপ্য ছিলো। কারণ আমি তোমার বাসায় যখন গেলাম, তু মি মদ খাচ্ছিলে ! ”

“তো, তু মি আমার রেকর্ড ঘেঁটে ফেলেছ ! বড় ভাই দেখছেন সবই – অথবা বড় বোন । অবশ্যই
ওগুলো আমার প্রাপ্য ছিলো । আমরা সবাই তা-ই পাই যা আমাদের প্রাপ্য থাকে , তাই না ? কোন
মহিলার ছেলে এক উন্মাদের হাতে খুন হয়ে গেলো, তাঁর সেটা প্রাপ্য ছিলো। হিরোশিমার
প্রত্যেকেরই প্রাপ্য ছিলো তাদের সাথে যা ঘটেছে ! ”

“একই রকম নয়। ওরা পরিস্থিতির শিকার। কিন্তু তোমার কাছে অন্য পথ ছিল । তু মি মাতালের
মতো , বা বলা ভালো মাতাল হয়ে রাস্তায় গাড়ি না চালালেই পারতে ! ”

“তাই ? আমার মানসিক অবস্থা আমি স্থির করতে পারি না আর, বেশীরভাগ সময়। আমি কখনই
মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাই নি – কখনও কখনও প্রচণ্ড রাগেও চালিয়েছি ! ” কনস্টেনটিন কাঁধ
ঝাঁকালো “আমাদের সাথে বেশীরভাগ যা ঘটনা ঘটে, সবই কোন পাহাড় ধ্বসের মতোই আকস্মিক
ঘটনা। দুঃখের হঠাৎ সমাপতন। এলোপাথাড়ি সহিংসতা। আর এটাই, বালের সব জায়গাতেই
এটাই ঘটে চলেছে ! ”
152

“এসবের পেছনে অবশ্যই কোন কারণ আছে। ওইসব লোকেদের সাথে, তোমার সাথে যা যা ঘটেছে
সেসবের পেছনে। আমাদের সাথে গত কয়েক ঘণ্টায় যা যা ঘটেছে , এসবের পেছনে অবশ্যই কোন
কারণ আছে............ ”

কনস্টেনটিনের ঠোঁটের ডগায় চলে এসেছিলো , যে ইসাবেলা যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে , সেটার
পেছনেও ? কিন্তু এর মধ্যে মেয়েটাকে বেশ খানিকটা পছন্দ করে ফেলেছে সে, তাই ওকে মনে ব্যাথা
দিতে চাইলো না।

“এখানে, একটা পরিকল্পনা তো অবশ্যই আছে” এঞ্জেলা জোর দিয়ে বললো “আমরা স্রেফ ওটা
দেখতে পাচ্ছি না , এই যা ”

কনস্টেনটিন একটা নিঃশ্বাস ফেললো, ওর মুখভঙ্গি বেশ নরম হয়ে এলো “হুম, আমি স্রেফ এটু কু
বলবো। ঈশ্বর নরক সৃষ্টি করেন নি । অনন্ত নরকভোগের ঐ সুবিশাল গহ্বর , আমি যতটু কু বুঝতে
পেরেছি – আমাদের আর শয়তানের পারস্পরিক সহযোগিতায় তৈরি ! ভেতরের নোংরা কথাটা
বলি এবার। মানুষ যদি ঈশ্বরের কাছে খোলাখুলি কিছু না বলে, কিংবা ওনার কোন প্রধান নিয়ম
ভঙ্গ করে বসে। যেমন কিনা আত্মহত্যা করা , সেটা তাদেরকে ঈশ্বরের ‘মহান আলো ’ থেকে
বঞ্চিত করে ফেলে, মৃত্যুর পর। আর তখন তারা, ঈশ্বরের সুরক্ষা থেকেও বঞ্চিত হয়ে যায়। হয়ে
যায় , বাইবেলের মতে ‘বহির্জ গতের অন্ধকার’ এর বাসিন্দা। যেখানে দাঁত খিঁচিয়ে, মুখ ব্যাদান করে
ঘুরে বেড়ায় অন্ধকারের জীবেরা। সেখানে, আত্মারা অনেকটা ‘পারলৌকিক জঙ্গলে’ ঢু কে পড়ে।
সেখানে আর কে কে আছে ? কে আবার, লুসিফার আর তাঁর চেলারা ! পিশাচেরা হলো সেই
জঙ্গলে ঘোরাফেরা করা নেকড়ের মতো। আর ওরা তোমাকে শিকার করে ফিরবে সেখানে। তো,
তু মি তখন নিজে থেকেই ঈশ্বরের করুণা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে ফেলেছ – আমি
এরকমভাবেই শুনেছি গল্পটা। আর ঈশ্বর বলবেন ‘দুঃখিত, ব্যাক্তিগত কোন ব্যাপার নয়। আমি তো
সাহায্যই করতে চাই। কিন্তু ওখানে, তোমরা নিজদের দেখাশোনা নিজেরাই করতে হবে, বন্ধু রা’ আর
তু মি যেহেতু সেই জঙ্গলে একা, ওরা তোমাকে খেয়ে নেবে ! এটা কোন মহাজাগতিক বিশাল সত্ত্বার
লেখা কোন রুল বুক নয় যেখানে লেখা – মারা যাও আর তারপর তু মি অনন্তকাল নরকে পচে
153

মরবে। আত্মহত্যার পরিণতি কিন্তু , এটার সাথেই আছে। কিন্তু আমি তোমায় আরেকটা কথা বলি,
এঞ্জেলা। এটা এমন নয় যে, সেই মহান ঈশ্বরের সাধ্য নেই তোমাকে এই মহা অন্ধকার থেকে উদ্ধার
করার। আর, ঠিক এটাই, এই অংশটাই আমাকে জ্বালিয়ে মারে সবসময় । কারণ , আমি কখনও
এই সব বালের নিয়মকানুনের মাঝে জন্মাতে চাই নি......... ”

“মানুষজন এটা প্রায়ই বলে, এই জন্মাতে না চাওয়ার ব্যাপারটা” চিন্তামগ্নভাবে বললো এঞ্জেলা
“কিন্তু, আসলে – তু মি কিভাবে জানো যে , তু মি জন্মাতে চাও নি ? এখানে আসার আগে,
জন্মানোরও আগে – তু মি কোথায় ছিলে ? তোমার কি সেটা স্মরণ করতে পারো ? সম্ভবত
কোনভাবে তোমার অস্তিত্ব ছিলো । সম্ভবত, তু মি ‘চেয়েছিলে’ জন্মাতে ! ”

ঘোঁত করে শব্দ করে উঠলো কনস্টেনটিন। প্রায় সমঝোতায় এসে পড়েছিলো এই ব্যাপারটাতে।
ভাবলোঃ গভীরতা আছে এই মেয়ের মধ্যে ! মন্তব্য করতে নিলো, কিন্তু কাশি এসে ক্রমাগত বাধা
দিতে লাগলো ।

“এটা কতোটা খারাপ ?” এঞ্জেলা জিজ্ঞেস করলো “মানে- তোমার এই অসুখ , সেটা যা-ই হোক
না কেন ।”

কনস্টেনটিন একটা শ্বাস ফেললো । সে বেশ কিছুক্ষণ ধরে মনের ভেতর আঁতিপাঁতি করে খুঁজে
যাচ্ছিলো এই ধরণের একটা শব্দের জন্য। যাতে করে মেয়েটার ওকে আকর্ষণীয় লাগে। আর এখন
মেয়েটা স্বয়ং ওকে জিজ্ঞেস করছে ওটা । অন্য এক ধরণের নৈকট্য অনুভব করলো সে। কিন্তু
একজন শেষ পর্যায়ের ক্যান্সার রোগীর সাথে, কেই বা জড়িয়ে পড়তে চাইবে ?

যদি মেয়েটা জড়িয়ে পড়েও, তবে সম্পূর্ণ ভু ল কারণে জড়াবে। ওকে মিথ্যে বলে লাভ নেই কোন।

“এটা বেশ খারাপ ” সে বললো “লাং ক্যান্সার”

এঞ্জেলা বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা বললো না। ওরা একটা কোণাতে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে।
কাছাকাছি একটা ডিস্কো বার দেখা যাচ্ছে। সঙ্গিনীদের বাহুডোরে বেঁধে বের হচ্ছে লোকজন, তরল
154

গলায় হাসছে। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরের উদ্দাম মিউজিক ভেসে আসছে। কনস্টেনটিন
দেখতে পেলো, সিলিঙে ঝু লছে আলোয় ঝিকমিক করতে থাকা একটা গোলক। ঘুরছে, বাজে
রুচির কোন ঈশ্বরের বানানো কোন গ্রহের মতো !

“আমরা যখন ছোট ছিলাম” এঞ্জেলা হঠাৎ বলে উঠলো “ইসাবেলও অনেক জিনিস দেখতো।
তোমার মতোই। আর.........”

ওর পার্সটা শব্দ করতে লাগলো। হাতড়ে হাতড়ে সেখান থেকে ফোনটা বের করে কানে দিলো সে
“লেফটেন্যান্ট ডডসন.........” ওর চেহারা অন্ধকার হয়ে গেলো “আমি কাছেই আছি। হ্যাঁ। একটা
গাড়ি পাঠিয়ে দিন.........”

“এখান থেকে ব্লক খানেক দূরে” ডিটেকটিভ জেভিয়ার বলছিলো “ওখানে একটা মর্গ
আছে............”

ওরা দাঁড়িয়ে ছিলো মদের দোকানে। অ্যালকোহল, রক্ত আর ভাঙ্গা কাঁচের মাঝখানে। এঞ্জেলা আর
জেভিয়ার দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, যেখানে হেনেসি তাঁর তাণ্ডব চালিয়েছিলেন। ওদের সাথে ছিলো
তিনজন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ। জন কনস্টেনটিন দাঁড়িয়ে ছিলো দরজার ফ্রেমে হেলান দিয়ে ,
ওদের পেছনে।

ও হেনেসির কথাই ভাবছিলো মনে মনে। বুঝতে পারছিলো , এই ঘটনার জন্য ও-ই দায়ী, কোন না
কোনভাবে। অনুভূ তিটা ভালো লাগছিলো না ওর।

“আর এই লোকটা ----” ওয়েইস হেনেসির শরীরের দিকে ইঙ্গিত করে বললো “ওই মর্গে
গিয়েছিলো। গার্ড বলছিলো , একটা মেয়ের মৃত দেহ হাতাচ্ছিলো সে ---”

“ও কি করছিলো মেয়েটার সাথে ?”


155

জেভিয়ার মাথা নাড়লো “তারপর এখানে এসে, পুরো দোকানের ওপর হামলে পড়ে।
অ্যালকোহলের বিষক্রিয়া। লোকটা মিনিটখানেকের মধ্যে অনেকগুলো বোতল খালি করে ফেলে।
আমার ভ্রাতৃ সংঘে নিতে পারলে ভালো হতো ”

সে কনস্টেনটিনকে দেখে নাক দিয়ে শব্দ করলো “এই বালের লোকটা এখানে কি করছে ?”

কনস্টেনটিন সাবধানে হেনেসির দেহের কাছে এগিয়ে আসছিলো। তাকিয়ে আছে ফ্যাকাসে হয়ে
যাওয়া দেহটার দিকে।

“হেই !” ইউনিফর্ম পরা এক পুলিশ অফিসার খেঁকিয়ে উঠলো ওকে এগিয়ে আসতে দেখে “এখান
থেকে বেরোও ......”

এঞ্জেলা সেই পুলিশ আর কনস্টেনটিনের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। ওর ব্যাজ দেখিয়ে বললো
“দেহটা খানাতল্লাশি আর দাগানো হয়ে গেছে না ? ওকে ওর কাজ করতে দাও ......”

কনস্টেনটিন হেনেসির হাত আর মুখের রক্ত মুছিয়ে দিলো। ওঁর কোট হাতড়ে বের করে আনলো
একটা সুরক্ষা এমুলেট (তাবিচ বিশেষ)। ওটা তু লে ধরে ভাবতে লাগলোঃ

ও কি এখনও বেঁচে থাকতো আমি যদি এটা ওকে পরে থাকতে দিতাম ?

“শিট” বিড়বিড় করে বললো সে “তু মি আমাকে কল করলে না কেন ...” ওর কণ্ঠ অস্বাভাবিক
নরম শোনাল এরপর “ব্যাটা কু ত্তার বাচ্চা !”

ও এরপর হেনেসির হাতের দিকে তাকালো , সেখানে কর্ক স্ক্রু দিয়ে তৈরি একটা ক্ষত দেখা যাচ্ছে।
একটা সিম্বলের মতো ...... বোঝাই যাচ্ছে না প্রায়............

ও চারপাশে তাকাল। ওয়াইনের ফ্রিজারে কিছু বরফ পেলো, সেগুলো নিয়ে এলো এখানে।
হেনেসির হাতের তালুতে ঘষতে লাগলো, শুকনো রক্ত মুছে ফেলছে। কোন এলোমেলো কাটা নয়,
এটা একটা রক্তাক্ত সিম্বল বলে মনে হচ্ছে।
156

একটা টিস্যু খুঁজে নিয়ে, সেটা হাতের তালুর ওপর চাপ দিয়ে ধরল সে। উঠিয়ে সেটার দিকে
তাকালো সে, রক্তের ছাপ একটা চিন্হ তৈরি করেছে । ও এই গোলাকার চিন্হটা আগে কোথাও
দেখেছে।

ও উঠে দাঁড়িয়ে , শেষবারের মতো হেনেসির দেহের দিকে চাইলো । এক সময়কার যুদ্ধের সাথী,
এমনকি বন্ধু ও, মদ ওকে দখল করার আগে।

কিন্তু পুরোটা সময় ধরেই, এমনকি ওঁর পরের ড্রিঙ্কটার জন্য কাতরানোর সময়টাতেও , ও আমার
চাইতে ভালো মানুষ ছিলো, কনস্টেনটিন ভাবলো। আর আমি ওঁর সাথে যা-তা ব্যবহার করেছি সব
সময়, ওঁর আরও ভালো ব্যাবহার প্রাপ্য ছিলো !

“আমি দুঃখিত, ফাদার”

ও ঘুরে দাঁড়ালো, সন্দেহ করছে --- অনুভবও করছে, সত্যিই – যে হেনেসি শান্তি পেয়েছে অবশেষে।
হয়তো এমন এক পন্থায়--- যেভাবে কনস্টেনটিন কখনও শান্তি খুঁজে পাবে না !

ও এঞ্জেলার দিকে ফিরলো “ইসাবেল কোথায় মারা গেছে, আমি দেখতে চাই।”

“লস এঞ্জেলসের এই অংশ অনেক পশ ছিলো এক সময়” এঞ্জেলা বলছে , তাকিয়ে


আছে ক্ষয়ে পড়তে থাকা উঁচু বিল্ডিং গুলোর দিকে, রেভেন্সকারের ছাদের ওপর। “কিন্তু যখন
অর্থনীতির বারোটা বেজে গেলো............”

কনস্টেনটিন বুঝতে পারলো , এঞ্জেলা ওর মন অন্যদিকে ব্যস্ত রাখতে চাইছে। এই জায়গাটা ওর


আসার জন্য বেশ বেদনাদায়কই বটে।

ওরা ছাদের কিনারে চলে এলো, যেখান থেকে ইসাবেল ঝাঁপ দিয়েছিলো। সেখান থেকে , তাকালো
রাতের শহরের জ্বলজ্বলে আলোর দিকে। ভেলভেটের মতো কালো রাতের আঁধারে, মধ্যরাত
পেরিয়ে একটু কি স্তিমিত হয়েছে আলো ? কনস্টেনটিন ভাবছিলো, ঠিক যেন জ্বরের ঘোরে প্রলাপ
157

বকতে থাকা এক রোগী, ঘুমের মাঝে মোচড় খাচ্ছে ক্রমাগত। এক্ষু নি জেগে উঠবে
আবোলতাবোল বকতে বকতে !

আর কনস্টেনটিন ইসাবেলের আত্মহত্যার ঘটনা অনুভব করতে পারছে এখানে – ঠিক এক্ষু নি
ফোসকা ফেলে দেওয়া গরম ছ্যাকার মতো !

শেষ পর্যায়ের রোগী, সে ভাবলো। ইসাবেল, লস এঞ্জেলস – আর আমি । একজন নেই, দুইজন
বাকি, আমি এর পর।

লস এঞ্জেলস, রাতের এই সময়ে গাড়ি ঘোড়ার একটা মৃদু শব্দ করে যাচ্ছিলো। জেট প্লেন বাইরের
শহর গুলো থেকে টু রিস্ট নিয়ে আসছিলো। কাছাকাছি কোথাও থেকে সাইরেন ভেসে আসছিলো।
ওটা কি একটা গুলির শব্দ ? আরেকটা ?

শহর নিজের সাথেই কথা বলে চলেছে অস্ফু টে। ব্রেকের তীক্ষ্ণ শব্দ, সেমি ট্রাকের ঘড়ঘড় , একটা
গাড়ি চলে যাচ্ছে এটার সাউন্ড বক্স সর্বোচ্চ নিনাদে বাজিয়ে। কেউ কেউ গুলি খাচ্ছে – কেউ
কোন হসপিটালের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ছে --- আর শহর তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজের কাজে ফিরে
যাচ্ছে !

“চলো , যেখানে ও পড়ে গিয়েছিলো , সেখানে যাই” কনস্টেনটিন শান্তভাবে বললো।

ওরা চলে এলো সেখান থেকে। লিফটে করে নীরবে নেমে এলো হাইড্রোথেরাপি সেন্টারে।
কনস্টেনটিনের মনে হলো , সান্ত্বনাসূচক কিছু একটা বলা উচিত ওর – কিন্তু, তার সান্ত্বনাবাণীতে
অনেক আগেই পচন ধরে গেছে যে ! পুলের কাছে এগিয়ে গেলো ওরা । পুলিশ টেপ এখনও ঘিরে
রেখেছে সেটা।

প্রায় শোনা যায়না এরকম কণ্ঠে বলে উঠলো এঞ্জেলা “আমার মনে হয়, ও সবসময় ব্যাপারটার
রহস্যোদ্ধার করতে চাইতো। এটার মানে বের করতে চাইতো। সিয়ান্সে, ওইজা বোর্ড , চ্যানেলিং ...
বাবা ভাবতেন , ও মনোযোগ পেতে চাইছে। ” একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো সে। দুঃখের সাথে
158

হাসলো একটু “ও অবশ্য সেরকমই আচরণ করছিলো, সবাইকেই বলে বেড়াচ্ছিল, সে যেসব
জিনিস দেখতে পাচ্ছিলো , সেসব সম্বন্ধে। পাগলাটে জিনিসপত্র, দৈত্য দানো । যেমন আপনি
দেখেছেন। মায়ের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া করে ফেলত সে প্রায়। তারপর, একদিন সে ওইসব কথা
বলা বন্ধ করে দেয়, প্রায় এক বছর এরকম থাকে সে। ”

কনস্টেনটিন ওর দিকে তাকালো । তারপর অন্যদিকে তাকালো । এটা ভয়ঙ্করভাবেই , অবধারিত


“তো , তোমরা ওকে হাসপাতালে দিয়ে দিলে !”

এঞ্জেলার শ্বাস কর্ক শ হয়ে উঠলো “প্রথমদিকে, তোমাকে তো কেউ বলে দেয় না, তাই না ? তু মি
জানোও না এটা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তাহলে, কি করবে তু মি ? ”

“আমাকে ওর রুমটা দেখাও ” কনস্টেনটিন বললো।

একটা লম্বা , হাসপাতালের করিডোরে ওদের পদধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। একজন
কালো নার্স কোণা ঘুরে এগিয়ে এলেন, একটা ছোট ছেলেকে প্রায় তাড়িয়ে নিয়ে আসছেন তিনি।
এঞ্জেলাকে দেখা মাত্র, ছেলেটা স্থির দাঁড়িয়ে পড়লো , তারপর নার্সের হাত ছাড়িয়ে , হাত বাড়িয়ে
এগিয়ে এলো এঞ্জেলার দিকে ! ওর বাহুতে ঝাঁপিয়ে পড়লো সে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে।
এঞ্জেলা খানিকটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেও, আলিঙ্গন ফিরিয়ে দিলো।

“ব্যারি !” নার্সটি বলে উঠলেন “ওহ ঈশ্বর ......” বলে ছেলেটাকে এঞ্জেলার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে
নিতে নিতে বললেন তিনি “না, ব্যারি, উনি ইসাবেল নন !”

এঞ্জেলা, চোখ ভেজা, উবু হয়ে বসে ছেলেটির চোখের দিকে তাকালো। আসলে কিছুই বলার নেই,
কিন্তু কিছু একটা বলার মতো শব্দ খুঁজে ফিরছিলো সে মনে মনে। ব্যারি হাত বাড়ালো , বিভ্রান্ত,
আঙ্গুলের ডগা দিয়ে এঞ্জেলার চেহারা ছুঁ য়ে দেখলো একবার !

“হাই, স্যুইটহার্ট !” এঞ্জেলা বললো, অবশেষে।


159

“আমি দুঃখিত ” নার্স বলে উঠলেন “ওরা বন্ধু ছিলো । ছেলেটা আপনার বোনের খুব ন্যাওটা
ছিলো ”

এঞ্জেলা নড করলো। নার্স ছেলেটিকে অন্যদিকে নিয়ে গেলো। ছেলেটা , কোণা ঘুরে অদৃশ্য হয়ে
যাওয়ার আগ পর্যন্ত, বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলো এঞ্জেলাকে।

কনস্টেনটিন বললো “তোমরা যমজ ছিলে !”

এঞ্জেলা আবারও নড করে, ওকে নিয়ে ইসাবেলের রুমে ঢু কলো, লাইটের সুইচ অন করলো।

“বেচারা ছেলেটা” বিড়বিড় করে বললো সে “ওর মতো এরকম আরও অনেক আছে। হারানো
ছেলেমেয়ে। কেউ ওদের দেখাশোনা করে না। ওদের বাবা মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে, কোন
একটা এরকম প্রতিষ্ঠানে দিয়ে দেয়া হয়, যেন এটাই খুব ভালো ব্যবস্থা ! ওরা এইসব তথাকথিত
লালনপালনের প্রতিষ্ঠানে অনেক রকম নির্যাতনের শিকার হয়। এমনকি ওদেরকে যৌন নির্যাতনও
করা হয় প্রায় সময়......... ”

রুমটার আসবাব খুবই কম। ধাতব হাসপাতালের বিছানা, একটা ড্রেসার । জাল দিয়ে ঢাকা একটা
জানালা।

“কতদিন ধরে ?” কনস্টেনটিন জিজ্ঞেস করতে করতেই , ওর অতীন্দ্রিয় অনুভব ক্ষমতা দিয়ে
খোঁজা শুরু করে দিয়েছে। ও অবশ্য জানেনা, আসলে কি খুঁজছে সে।

“মাস দুয়েক” চিন্তিত স্বরে বলে উঠলো এঞ্জেলা “ও একবার ভালো হয়ে উঠত, আরেকবার
খারাপ। কিন্তু এবার, অবস্থা খুবই খারাপের দিকে মোড় নিয়েছিলো। ” আঙ্গুলের নখ কামড়াতে
কামড়াতে যোগ করলো “ওই মৃত লোকটার হাতে কেটে বসা সিম্বলটার সাথে, এসবের কোন
সম্পর্ক আছে ?”

কনস্টেনটিন ওর দিকে তাকালো এবার, বেশ অবাক হয়েছে।


160

“আমি একজন পুলিশ, জন। মনে আছে ?”

ও কাঁধ ঝাঁকালো । একটার পর একটা ড্রেসারের ড্রয়ার পুরোটাই টেনে টেনে , নিচে দেখতে
লাগলো মনোযোগ দিয়ে।

“তু মি জানো , আমি ইতিমধ্যে এসব কাজ করেছি ” এঞ্জেলা বিড়বিড়ালো । ঘুমের অভাব, ার
ক্লান্তিতে বিরক্ত বোধ করছে। ওর চাকরি নিয়ে ওর মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন অহংকার আছে অবশ্যই।

কনস্টেনটিন এবার স্টিলের বিছানার ফ্রেমের নিচে আঙ্গুল বোলাতে লাগলো।

এঞ্জেলা নাক দিয়ে শব্দ করলো “এবার তু মি আমায় অপমান করছো !”

“তু মি কখনোই , একটা বিল্ডিং ছেড়ে যাবে না, পেছনে কিছুই না রেখে !” কনস্টেনটিন বললো ,
শব্দ করে চিন্তা করছে।

এঞ্জেলা ক্লান্তভাবে নিজেকে নিজেই জড়িয়ে ধরে, জায়াগায় দাঁড়িয়ে একটু দুলতে দুলতে বললো “ও
যা যা রেখে গেছে , সবই তু মি দেখেছ, ওই বাক্সটার মধ্যে। ”

“ও সম্ভবত আরও কিছু রেখে গেছে” কনস্টেনটিন ওর দিকে তাকালো “এমন কিছু, যেটা খুবই
ব্যাক্তিগত। শুধু তোমার জন্য ” তাকালো জানালার দিকে। বাইরের আকাশ , নীলচে ইস্পাত রং
থেকে এলুমিনিয়ামের রং ধারণ করছে। সকাল হচ্ছে সেখানে।

“তোমরা যমজ ছিলে, এঞ্জেলা” সে বলে চললো “যমজেরা একইভাবে চিন্তাভাবনা করে ”

“আমি আমার বোনের মতো নই ” একটা ঠাণ্ডা, জেদী সুরে বললো এঞ্জেলা। যেন নিজেকে নিজেই
নিশ্চিত করতে চাইছে।

“কিন্তু তোমরা এক সময় , একই রকমই ছিলে। যখন তোমরা বাচ্চা ছিলে, যখন প্রতিটা সেকেন্ড
একসাথে কাটাতে তোমরা। তু মি হয়তো একটা শব্দ শুরু করলে, ও সেটা শেষ করলো। ” ও কি
এটাও অস্বীকার করবে নাকি ? “হয়তো তু মি ব্যাথা পেলে, আর কেঁ দে উঠলো সে !”
161

“ওটা......... অনেক আগের কথা ”

কনস্টেনটিন মাথা নাড়লো। ওর হাত দুটো পকেটে ভরে ফেললো । ঠাণ্ডা হয়ে গেছে হাত দুটো। ও
বুঝতে পারলো না, সেগুলো কি শারীরিক নাকি মানসিক কারণে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে । “ওই ধরণের
বন্ধন , স্রেফ উবে যায় না একেবারে । ”

“কিছুই আর অবশিষ্ট নেই” এঞ্জেলা জোর দিয়ে বললো ।

ওকে কেমন জানি এলোমেলো লাগছিলো । ক্রমাগত রক্ষণাত্মক আচরণ করে চলেছিল সে।
কনস্টেনটিন ভাবছিলো আর অবাক হচ্ছিলো । “ও ওর মৃত্যুর পরিকল্পনা করেছিলো এই ঘরে
বসেই। ও ঠিক এইখানে, যেখানে তু মি দাঁড়িয়ে আছো , সেখানে দাঁড়িয়েই চিন্তা করেছিলো সেটা!”
এঞ্জেলার দিকে আরেক পা এগোল সে। ওকে খোঁচাচ্ছে, কথা দিয়ে , আর নিজের উপস্থিতির শক্তি
দিয়ে। এঞ্জেলা এক পা পিছিয়ে গেলে সে বললো “ও জানতো তু মি আসবে এখানে। ও তোমার
ওপর বিশ্বাস রেখেছিলো এই ভেবে , যে ও যা দেখেছে, সেটা তু মিও দেখবে। ও যা অনুভব
করেছিলো , সেটা তু মিও অনুভব করবে। ও যা জানে, সেটা তু মিও জানবে। ও কি করেছিলো ,
এঞ্জেলা ?”

এঞ্জেলার ঠোঁট শক্ত হয়ে গেলো। চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো , এখুনি আঘাত করবে
কনস্টেনটিনকে। “আমি কিভাবে জানবো ?”

কনস্টেনটিন আরও এক পা এগোল “ও কি করেছিলো , এঞ্জেলা ?” আরেক পা, ইচ্ছা করে কাছে
ঘেঁষে যাচ্ছে এবার।

এঞ্জেলার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলো “আমি জানি না !”

“তু মি হলে কি করতে ?”

ও কনস্টেনটিনের দিক থেকে অন্যদিকে তাকালো এবার।


162

নিষ্করুণ সুরে বলে চললো কনস্টেনটিন “তু মি হলে, ওর জন্য কি রেখে যেতে ? ”

আর একটু ঝুঁকে এলো সে, ওর চোখে তাকাতে বাধ্য করার জন্য। ওরা কেবল নিঃশ্বাসের দূরত্বে
দাঁড়িয়ে ছিল এখন। “এটা কোথায় থাকতে পারে ?” দাবী করলো সে। ওর গলা চড়ছে ক্রমশ
“তু মি হলে কি রেখে যেতে ওর জন্য ? ” আরও জোরে বললো “এটা কোথায় থাকতে পারে
.........?”

ওকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে , এঞ্জেলা দৌড়ে গেলো জানালার দিকে। চোখ বন্ধ, জোরে জোরে
শ্বাস ফেলছে।

কনস্টেনটিন স্রেফ তাকিয়ে রইলো , বুঝতে পারছে, বেরিয়ে আসছে কিছু একটা।

এঞ্জেলার চোখ খুলে গেলো , একটা বোঝা নেমে গেছে, এরকম মনে হচ্ছিলো ওকে দেখে।
জানালার আয়নার আরও কাছে এগিয়ে গেলো সে, আর সেখানে ফুঁ দিতে লাগলো। জানালায়
বাষ্প জমতে লাগলো এতে করে। এরপর, আবারও দিলো ফুঁ , এবার আরেকটু নিচের দিকে। এবার,
জানালায় একটা আকার ফু টে উঠতে লাগলো ।

এরপর, ও চমকে দিলো কনস্টেনটিনকে। ঘুরে, মেঝে থেকে পাপোষটা তু লে নিলো হাতে। তারপর
ওটা দিয়ে বাড়ি মারতে লাগলো স্টিল বেডের ফ্রেমে। মেঘের মতো ধুলো উড়তে শুরু করলো
সেখান থেকে। “......... আমরা একে অন্যের জন্য মেসেজ রেখে যেতাম ”

ও আরও জোরে বাড়ি মারতে লাগলো পাপোষটাতে, আরও ধুলো উড়ল। “নিঃশ্বাসের মধ্যে –
আলোর মধ্যে ”

আরেকবার বাড়ি মারলো সে । কনস্টেনটিন আপ্রাণ চেষ্টা করলো না কাশতে, কাজটা খুবই কঠিন,
কিন্তু সে বেশ কয়েকটা সুড়সুড়ি দমিয়ে রাখতে পারলো।

“জানালার মধ্যে ............”

পাপোষটা ফেলে, দরজার কাছে গিয়ে ঘরের লাইটটা নিভিয়ে দিলো সে।
163

ভোরের আলো আসছিলো জানালা দিয়ে, আঙ্গুল দিয়ে লেখা একটা অক্ষরকে আকার দিচ্ছিল
সেটা। দেয়ালে, ধুলোর তৈরি একটা অক্ষর ভেসে উঠলো – কোর ১৭-০১ !

“আমার একটা চার্চ দরকার” বলে উঠলো কনস্টেনটিন।

ও দৌড়ে বেরোল রুমটা থেকে, করিডোর ধরে দৌড়াতে লাগলো । এঞ্জেলা পিছু নিলো হন্তদন্ত হয়ে।

“করিন্থিয়ান্স ” কনস্টেনটিন ছুটতে ছুটতে বললো।

“আমি বাইবেল সম্বন্ধে জানি, জন” এঞ্জেলা বললো , ক্লান্তিতে চোখ ডলতে ডলতে। “করিন্থিয়ান্সের
মধ্যে কোন সতেরতম অ্যাক্ট নেই। আমি ক্লান্ত , কিন্তু ছোটবেলায় আমাদেরকে বাইবেল মুখস্থ করানো
হয়েছিলো । আমি ওইসব অকাজের জিনিস ভালোই মনে রেখেছি............”

“দ্বিতীয় করিন্থিয়ান্স , বুক অব এথিনিয়াসের একু শতম অ্যাক্টকে নির্দে শ করে ” কনস্টেনটিন কাঁধ
ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো।

এঞ্জেলা ওর দিকে তাকালো “ওটা কি ?? !!”

“ওটা হলো নরকের বাইবেল !” কনস্টেনটিন জবাব দিলো ।

এগারো

কনস্টেনটিন ব্যাখ্যা করলো না , ‘বুক অব এথিনিয়াস’ এর কথা সে কিভাবে জানলো। বা ওই


নির্দি ষ্ট ‘বাইবেল’ এর সাথে জড়িয়ে থাকা ওর কষ্টদায়ক স্মৃতির কথা।

ওর পাশে দৌড়াতে দৌড়াতে, এঞ্জেলাকে দেখে মনে হলো গত চব্বিশ ঘণ্টায়, সে একটু বেশী
রকমের অদ্ভু ত তথ্য হজম করে চলেছে ! “ওই নরকে আবার বাইবেল ও আছে ?? !!”
164

“শয়তানী বাইবেল। দি বুক অব এথিনিয়াস , জগতকে সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখায়।
ওটা বলে, পৃথিবী ঈশ্বরের হাতে ধ্বংস হবে না, ওটা কেবল নরকে অভিশপ্তদের মাঝে আবার
পুনরুজ্জীবন লাভ করবে মাত্র ! ”

স্প্রিং লাগানো দরজা ঠেলে ঠেলে ওরা উপস্থিত হলো হসপিটালের প্রার্থনা কক্ষে। ‘প্রার্থনা কক্ষ’
কথাটা এমনভাবে দরজার ওপর লাগানো, যে ওটাকে ‘রেস্ট রুম’ বা ‘মর্গ’ লেখা দরজার লেখার
চাইতে আলাদা করা গেলো না।

“যদি তু মি আমাকে জিজ্ঞেস করো” কনস্টেনটিন বললো “আগুন তো আগুনই !”

ওটা একটা ছোট্ট প্রার্থনা কক্ষ। দাগে ভর্তি ছোট্ট জানালা, ঘেরা অল্প কিছু আসন, একটা বেদী ,
সেখানে নির্দি ষ্ট কোন ছবি নেই। পুরোটা দেখতে অনেকটা অসাম্প্রদায়িক তোমার-যাকে-খুশি-তাকে-
ডাকো ধরণের একটা পরিবেশ। একজন যাজক এক দম্পতিকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। কনস্টেনটিন
বুঝতে পারলো, ওনারা সদ্য তাদের সন্তান হারিয়েছেন।

কিন্তু সেদিকে তেড়ছা দৃষ্টি ফেলে , কনস্টেনটিন এগিয়ে গেলো একপাশে রেফারেন্স বইয়ের তাকের
দিকে।

এঞ্জেলা ফিসফিস করে বললো “আর, এরকম একটা বই ওরা হসপিটালের প্রার্থনা কক্ষেও রেখে
দেয় ?”

“হ্যাঁ, এবং না !”

কনস্টেনটিন হোলি ওয়াটার এর একটা গামলার পাশে থামলো, ওর হাত ডু বিয়ে দিলো সেখানে
“এই জগতে ওটার কোন অস্তিত্ব নেই ! ”

কিন্তু কনস্টেনটিন ওর চোখ বুজে ফেললো --- আর ওর হাতের আশেপাশের পানি ফু টতে শুরু
করলো । ও নিজের আধ্যাত্মিক সত্ত্বা প্রসারিত করলো আরেকবারের মতো। ওর সাথে এখন আর
165

কোন বিড়াল নেই। কিন্তু ওর অতি সাম্প্রতিক নরক ভ্রমণ , ওর সাথে তখনও আঁকড়ে ছিলো।
সালফারের গন্ধ, সেইসাথে কম্পনের মাধ্যমেও ও নরকের অনেক কাছে ছিলো তখনও !

“ওহ ঈশ্বর ......” এঞ্জেলা বিড়বিড় করে বললো , পানি ফু টতে দেখে “কিন্তু জন, ওটা দিয়ে তু মি কি
বোঝাতে চাইলে যে ----”

কনস্টেনটিন ইশারায় চু প করিয়ে দিলো ওকে, তারপর ঘুরে তাকালো প্রার্থনা কক্ষের দিকে.........

......... ওটা পাল্টে গেছে এখন। এটা এখন নরকের একটা চার্চে পরিণত হয়েছে ! জানালাগুলো
স্লেটের মতো কালো হয়ে গেছে। ক্রু সিফিক্সে , যীশুর বদলে একটা পিশাচকে দেখা যাচ্ছে ! আর
একজন পাগল পাগল দেখতে নান’কে দেখা যাচ্ছে পিশাচের শ্বদন্ত থেকে ঝরে পড়া রক্ত সংগ্রহ
করছে। খিল খিল করে হাসছে মহিলা । ওখানে , অন্যান্য পূজারীরাও রয়েছে। কনস্টেনটিন ওদের
বায়বীয় শরীর দেখতে পাচ্ছিলো। বেদীর নিচেই, চাপা হাসি হাসতে হাসতে ব্যাভিচারে লিপ্ত ওরা।
পুরোটা সময়ে একজন আরেকজনকে নখ দিয়ে , ভীষণ ভাবে আঁচড়ে কামড়ে দিচ্ছে ওরা।
অভিশপ্ত আত্মারা, যারা জীবিত অবস্থায় হয়তো যৌন জাদুবিদ্যা ব্যবহার করতো, লুসিফারের নামে!
এখন ওরা যন্ত্রণা ভোগ করছে, একজন আরেকজনকে ছিঁ ড়ে খুঁড়ে ফেলছে, মিলিত হচ্ছে কোন
ধরণের আনন্দ ছাড়াই ! আর, ওদের ক্রমাগত আর সম্মিলিত দাঁত কিড়মিড়ের শব্দে কান পাতা
দায়।

প্রার্থনা কক্ষের থেকে বাইরে যাবার রাস্তাটা বন্ধ। একদম সিল করে দেয়া। কিন্তু কনস্টেনটিন যেই
দরজার দিকে তাকালো, কিছু একটা গর্জ ন করে উঠলো বাইরে থেকে ! আর দরজাটা থরথর করে
কেঁ পে উঠলো এক বর্বর আঘাতে। কিছু একটা দরজা ভেঙ্গে ঢু কতে চাইছে।

ওরা ইতিমধ্যে ওর গন্ধ পেয়ে গেছে !


166

আরেকটা ধাক্কা পড়লো দরজার ওপর – দরজাটা ভেতর দিকে দেবে গেলো একটু । নখের
আঁচড়ের দাগ পড়ে যাচ্ছিলো দরজায়, কিছু একটা নখ দিয়ে দরজা আঁচড়াচ্ছে আর কনস্টেনটিনের
নাম ধরে গর্জ ন করছে ! ক্ষু ধায় কাতর কিছু একটা।

ওই যে ! ওই কালো আর লাল বইটা – কনস্টেনটিন ওর মুক্ত হাত দিয়ে ওটা ধরলো । তারপর ওর
অন্য হাত তু লে নিলো হোলি ওয়াটারের গামলা থেকে। ঘুরলো সে , ফিরে গেলো আবার............

............... মরণশীল জগতের হসপিটাল প্রার্থনা কক্ষে !

আর এঞ্জেলা কেবল ওর প্রশ্ন শেষ করলো , “---- ওটা এই জগতে নেই ?”

কনস্টেনটিন, এঞ্জেলার দুই বাক্যের মাঝখানের সময়টার ভেতরেই, নরকে গিয়ে আবার ফিরে
এসেছে !

এঞ্জেলা তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। দেখলো, ও এখন ঢেকে আছে ঘামে, ধোঁয়া বেরোচ্ছে ওর গা
থেকে, নারকীয় দুর্গন্ধে ভারী হয়ে আছে বাতাস। ও ইতিমধ্যে হাতে ধরা অদ্ভু ত বইটার পাতা
উল্টাতে শুরু করে দিয়েছে – বিড়বিড় করছে সমানে।

এঞ্জেলা মাথা নেড়ে অবিশ্বাসের সাথে বললো “আরে ! এই বইটা কোথা থেকে এলো ? ”

পাশে বইয়ের সেলফের দিকে তাকালো। নাহ ! ওখান থেকে তো কোন বই নড়চড় হয় নি !

কনস্টেনটিন নরকের নিজস্ব বাইবেলে ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ পড়ে চলেছে “তের একু শ, তের ত্রিশ
......... এই যে। ” পাতাটার ওপর টোকা দিলো সে। ও যেটা খুঁজছিল , পেয়ে গেছে সেটা
“’একজন পিতার কৃ ত পাপকে, কেবল তার সন্তানের পাপই ছাড়িয়ে যেতে পারে ’ ”

“উম – কার ছেলে ?”


167

“হেনেসির হাতের সেই সিম্বলটা ” হঠাৎ বুঝতে পারার ভঙ্গিতে এঞ্জেলার দিকে তাকালো
কনস্টেনটিন “ওটা পৈশাচিক কোন সিম্বল ছিলো না । সেজন্যই ওটা চিনতে পারিনি আমি। ওটা,
নিছক একটা পিশাচের চাইতেও হয়তো আরও অনেক শক্তিশালী কিছু একটা । ”

“জন- তু মি কি নিয়ে কথা বলছো বলো তো ?”

কনস্টেনটিন শব্দ করে ভাবতে শুরু করলো আবার “কিন্তু সে অতিক্রম করতে পারে না.........
পুত্রের পক্ষে অতিক্রম করা সম্ভব নয়......... ” ওটার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পেরে কাঁপুনি উঠে
গেলো ভেতরে ভেতরে। শয়তানদের জন্য, খুব তাড়াতাড়িই উৎসব আসতে চলেছে একটা।

“কার ছেলে ?” এঞ্জেলা মরিয়া ভাবে জিজ্ঞেস করলো এবার “ঈশ্বরের ?”

“না, অন্যজনের !”

এঞ্জেলা বেকু বের মতো তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ কনস্টেনটিনের দিকে, বুঝতে সায় দিচ্ছে না মন।
ধীরে ধীরে, বুঝতে পেরে কোনমতে বললো “লুসিফারেরও একটা ছেলে আছে ? !!”

বী ম্যান যে একটা বোউলিং এলি’র পেছনে বাস করে, সেটার যথেষ্ট কারণ আছে।
লেনগুলোর মাঝখানে, একটা কোলাহলপূর্ণ অত্যন্ত সরু করিডোর আছে। সেখানে পিন সেটিং
মেশিনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সারা হয়। পিনগুলো সারাদিন মহা হইচই লাগিয়ে দেয়। সেই
সরু করিডোরের শেষে, বেশ খানিকটা খোলা জায়গা আছে।

বী ম্যান ‘কানে ভোঁ ভোঁ ’ শব্দের এক অদ্ভু ত হতচ্ছাড়া রোগের রোগী ! একটা এলকেমিক্যাল
বিকারের বিস্ফোরণের ফল। ফিলসফার স্টোন তৈরি থেকে কেবল চু ল পরিমাণ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল
সে ! ‘এব্রিমালিন দ্যা মেইজ’ এর এলকেমিক্যাল ডায়েরি’র একমাত্র কপি দেখে বানাচ্ছিল
জিনিসটা। কেবল এক দানা বেশী গন্ধক দিয়ে ফেলেছিল মিশ্রণে , এই যা ! বিস্ফোরণটা ওকে
রুমের অন্যপ্রান্তে ছিটকে ফেলেছিল , আর যে বইটা দেখে কাজ করছিলো , সেটাকে পুরো গায়েব
168

করে দিয়েছিলো । ও বুঝতে পেরেছিলো যে, ওটা স্রেফ একটা দুর্ঘটনা ছিলো না ! কেউ একটা, বা
কিছু একটা চায় না – সম্ভবত এঞ্জেল গ্যাব্রিয়েল’ই হবে -- যে ও ফিলোসফার স্টোন বানায়। এটা
অমরত্বের দিকে নিয়ে যায় মানুষকে, সেটাতে মানুষ মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে পারবে। আর তার ফলে
মরণশীল জগতের নিয়ম ভঙ্গ হবে। আর গ্যাব্রিয়েল ওকে একবার সতর্ক ও করেছিলো।

সম্ভবত , কানের ভোঁ ভোঁ শব্দ সেটারই নিষ্ঠু র স্মৃতিচিন্হ ............

ওর ভেতরকার কানে ক্রমাগত বাজতে থাকে গুঞ্জন, শিসের মতো শব্দ......... আর সেটা ঘুরতে
থাকে মাথায় সারাদিন ! সেই শব্দের চাইতে উচ্চ গ্রামের কোন শব্দের মাঝে না থাকলে , ওর মাথা
পুরো খারাপ হয়ে যায়। কিছু একটা, যে কোন কিছু , যেটা ওই শব্দ গুলোকে ঢেকে দিতে পারে।
আর , বোউলিং সে এমনিতেও বেশ পছন্দ করে।

তো , এখন সে বসে আছে ওর ডেস্কে, কথা বলছে টেলিফোনে কনস্টেনটিনের সাথে। হাঁসের
নাকের মতো দেখতে একটা রিডিং ল্যাম্পের আলোয় , তাকিয়ে আছে প্রাচীন কিছু স্ক্রলের দিকে।
ওর পেছনে, বোউলিং পিনগুলো শব্দ করে যাচ্ছে । কেবল একটা লেনেই শব্দ হচ্ছে, কারণ এখন
সকাল । ম্যানেজার মানুষের জন্য দরজা খোলার আগে, নিজে নিজে একদান খেলে নেয়, নিজের
সাথেই !

বী ম্যানের একটা টেলিফোন আছে, কানের সাথে সেটার রিসিভার চেপে আছে সে এই মুহূর্তে ।
নাহলে শুনতে পায় না সে, ওর ঘাড় ব্যাথা করছে সেটা চেপে ধরে রাখতে রাখতে।

“১৬-১৯......... ১৬-৩০......... হ্যাঁ, এই যে ” সে বললো কনস্টেনটিনকে “পেয়েছি ওটা ” সেই


পাতায় , সেই একই ধরণের একটা নারকীয় সিম্বল আঁকা ছিলো। নিচে , কালি দিয়ে আঁকা একটা
ছবি, সেখানে দেখা যাচ্ছে, লুসিফার উঠে আসছে একটা মানব দেহের ভেতর থেকে।

সেই জন্তুটার ওপরে, একটা পরিচিত চেহারা, ক্রু সিফিক্সে বিদ্ধ হয়ে আছে। কাঁদছে আর স্বাগত
জানাচ্ছে লুসিফারকে মানুষের পৃথিবীতে !
169

“ওহ ঈশ্বর !” বী ম্যান বললো ফোনে। কনস্টেনটিন বসে আছে এঞ্জেলার এসইউভি
গাড়িতে, স্পিকারফোনে দিয়ে রেখেছে ফোনটা। “এটা ...... এটা অবশ্যই ভালো কিছু না ! .........”

এঞ্জেলা ড্রাইভিং করছে, আরেক হাতে একটা ‘স্টারবাক্স’ কফিতে চু মুক দিচ্ছে। পাশেই বসে আছে
কনস্টেনটিন। এঞ্জেলা বললো “এই পৃথিবী অবশ্যই আক্রান্ত হয়েছে, স্টারবাক্স দ্বারা, আর আমরাই
সেটা হতে দিয়েছি !!”

কনস্টেনটিন তাকালো ওর দিকে, একটু হাসলো। ভাবছে, ক্লান্তিতে মেয়েটা ভেঙ্গে পড়ছে আস্তে
আস্তে।

“তু মি জানো ” বী ম্যান বলে চললো, ওর গলা, দূরাগত কোন ভূ তের মতো শোনাচ্ছে “মিথ বলে,
ম্যামন , সর্ব পিতার আগমনের আগেই ওর মায়ের গর্ভে এসেছিলো – কিন্তু সে জন্মেছিল পরে।”

সেই সংকীর্ণ জায়গার মধ্যে, বী ম্যানের মনে হলো সে একটা অস্বাভাবিক শব্দ শুনেছে।
বোউলিং এলির আরেক মাথায় বল যাওয়া ছাড়াও, ওর মনে হলো একটা দরজা খোলার শব্দ
শুনেছে সে।

ও পেছনে ঘুরে তাকালো করিডোর ধরে। কেবল অন্ধকার গলিপথ আর বোউলিং লেন ধরে আসা
ক্ষীণ আলো দেখা গেলো সেখানে। লেন নাম্বার সাতের পিনটা কেবল বিরাট রোবটের চোয়ালের
মতো নড়াচড়া করছিলো ।

“বী ম্যান......... ? ” কনস্টেনটিনের গলা ভেসে এলো ফোনে।

“দুঃখিত ” বী ম্যান বললো , স্ক্রলে ফিরে এলো মনোযোগ “দুঃখিত , এই যে ” ও নিজের ওপর
জোর খাটাল মনোযোগ দেয়ার জন্য । কিন্তু সেই অস্বস্তিকর অনুভূ তিটা যাচ্ছে না। কাঁধের ওপর
দিয়ে আবার তাকালো সে, কিন্তু কিছুই দেখলো না।
170

ওখানে, যা-ই কিছু প্রবেশ করতে চাক না কেন, সেগুলোকে আটকে দেয়ার জন্য নানান ব্যবস্থা
রেখেছিলো সে। সম্ভবত এটা পুরানো আমল থেকে আসা কোন আধিদৈবিক সত্ত্বা, পড়ে থাকা হাড়
কু ড়াতে এসেছে। ঘোরাফেরা করছে কেবল। যেতে দাও – সে ভাবলো, আশা করলো , ওটা ও
পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে না ।

আলোটা স্ক্রলের আরও কাছে নিয়ে গেলো সে “উম......... শয়তানের মতো , শয়তানের ছেলে
কখনোই ঈশ্বরের ছত্রছায়ায় ছিলো না। যার কারণে সে ওনাকে ভয়ই পেতো না। কোন শ্রদ্ধাও ছিল
না , সেইসাথে। আর সেই অবজ্ঞা আমাদের প্রতি ছিলো দ্বিগুণ – ঈশ্বরের সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি –
মানুষের প্রতি। ”

বী ম্যান ভাবলো – আমরাই যদি ঈশ্বরের প্রিয় সৃষ্টি হয়ে থাকি , তবে ওনার আরও ভালো ম্যানের
কিছুর কথা চিন্তা করার সময় এসেছে !

“ম্যামন- শয়তানের পুত্র – হবে শেষ পিশাচ যে কিনা আসতে চাইবে ......”

ওটা কি ? আরেকটা অস্বাভাবিক শব্দ ? হাসির শব্দ – অনেক অনেক দূর থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে
ওর মরণশীল ছোট্ট প্রাসাদে ?

“......... আমাদের জগতে ”

কিছু একটা অবশ্যই ওর কাছে আসার চেষ্টা করছে। কিছু একটা, যেটা ওর বাধাদানকারী সিম্বলের
বাধা না মানার মতো শক্তিশালী । যেভাবে মানুষ ভারী বুটের লাথি দিয়ে ছোট্ট ক্যাম্পফায়ার
নিভিয়ে দেয় ? ওর মনে হচ্ছিলো , ও একটা ধীর চু ল্লিতে সিদ্ধ হচ্ছে ! ওর চেহারা আর ঘাড় বেয়ে
ঘাম নামছে। এখানে, অস্বাভাবিক গরম লাগতে শুরু করেছে হঠাৎ করেই। কিন্তু এখানে স্বভাবত
বেশ ঠাণ্ডাই থাকে.........
171

কিন্তু এই তথ্যটা কনস্টেনটিনকে জানানো খুবই জরুরী। ওদের নিজেদের দুজনের চাইতে অনেক
বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আর বী ম্যান, অনেক কাল আগেই নিজের পথ বেছে নিয়েছিলো। ও আলোর
পথের যাত্রী, চিরকাল।

“কিন্তু পিশাচেরা অতিক্রম করতে পারে না ” ফোনের ওপাশে ব্যাকু ল হয়ে উঠছে কনস্টেনটিন
“তাই না ? মনে আছে ? বী ম্যান ?”

“দাঁড়াও ......” সেই প্রাচীন লিপি ওর সামনে যেন সাঁতার কাটতে লেগেছে। এই ভীষণ তাপে,
সেগুলো চেনা দুষ্কর হয়ে উঠেছে। ওর ডেস্কের ওপর কিসব জানি হামাগুড়ি দিতে লেগেছে,
কিভাবে মনোযোগ দেবে সে ? ছোটাছুটি করতে লেগেছে ওগুলো, এক ধরণের পোকা, মাছিও
দেখা যাচ্ছে অনেক। হাত দিয়ে তাড়িয়ে , স্ক্রলের দিকে ভালো করে তাকাতে চাইলো সে। কিছু
একটা ওর ঘাড় বেয়ে উঠে যাচ্ছে ! ঝেড়ে ফেলে দেয়ার পরে, আরও দুইটা এসে উপস্থিত হলো
কোত্থেকে জানি ।

“দাঁড়াও...... জন, দাঁড়াও। আমি পড়ছি। এখানে একটা ...... ফাঁকি দেখতে পাচ্ছি আমি। অনেক,
অনেক পুরানো। অনুবাদটা বেশ কঠিন। স্বর্গে গর্ভে এসেছিলো, নরকে জন্ম নিয়েছিলো ---
স্বাভাবিক বাধাগুলো হয়তো কাজ করবে না.........”

ও চোখ তু লে তাকালো। কোণার ছায়ার মাঝে, কিছু একটা আকার নিচ্ছে। শত শত ক্ষু দ্র কণা,
একটা নির্দি ষ্ট আকৃ তি তৈরি করছে । কিন্তু, ওকে যে কনস্টেনটিনকে স্ক্রলটা সম্পর্কে বলে শেষ
করতে হবে। ওর এ যাবতকালের করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেটা। কোণার আবছায়াটার একটা
কাঠামো রূপ নিচ্ছে। বী ম্যান চিৎকার করতে চাইলো , কিন্তু বদলে কর্ক শ স্বরে বললো “এটা বলছে
......” আবার স্ক্রলের দিকে তাকালো সে “প্রথমে, ম্যামন’কে , একজন ওরাকল কে ‘পজেস’
করতে হবে ”
172

এঞ্জেলা ওর গাড়িটা একটা লাল বাতিতে দাড় করালো। কনস্টেনটিন ওকে বললো “এর
মানে হলো , একজন আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ, খুব খুবই শক্তিশালী আধ্যাত্মিক ক্ষমতা
সম্পন্ন মানুষ। ”

“আমি জানি ওরাকল মানে কি ” এঞ্জেলা বললো , দূরাগত কণ্ঠে.........

তারপর, সে শব্দ করে বলে উঠলো, মনঃস্থির করতে পেরেছে যেন “...... ইসাবেল ”

“কিন্তু সেটাই যথেষ্ট হবে না ” বী ম্যানের গলা ভেসে এলো । স্পিকারফোনের অল্প আওয়াজেও,
ওর কণ্ঠের ভয় চাপা থাকছে না “সীমা অতিক্রম করার জন্য , ওর এরপরও দরকার হবে ...... ”

স্পিকার ফোনের নেপথ্যে , কিসের জানি আওয়াজ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বী ম্যানের ওখান
থেকেই আসছে ওটা ......... কিরকম যেন একটা ফাঁপা বিজ বিজ শব্দ।

“......... ওর ঐশ্বরিক কোন সাহায্য লাগবে। সীমা অতিক্রম করতে গেলে, ম্যামনের , ঈশ্বরের
সাহায্য লাগবে ! এটা বলছে --- আলামতের খোঁজ করো। ওর আসার আলামত ”

“কি ধরণের আলামত ... বী ম্যান ?”

“ছোট ছোট পিশাচেরা। ওরা এই জগতে চলে আসতে চেষ্টা করবে। ”

ওই বিজ বিজ শব্দটা............

“জন” বী ম্যান বলে চললো, ওর গলা ভেঙ্গে আসছে “আমি জানি তোমার তেমন ঈশ্বর বিশ্বাস
কখনোই ছিলো না । বিশ্বাস করার তেমন কারণও ছিল না ......”

কনস্টেনটিন ফোনের দিকে তাকালো । বী ম্যানের স্বরে কিছু একটা আছে । ও কি বিপদে আছে –
এই মুহূর্তে ?

“বী ম্যান ?”
173

বী ম্যানের গলায়, কেমন যেন একটা সমর্পণের সুর “কিন্তু মনে রাখবে , জন – তার মানে এই নয়
যে, আমাদেরও বিশ্বাস নেই -- তোমার ওপর ! ”

ওই বিজ বিজ শব্দটা প্রচণ্ড বেড়ে উঠলো হঠাৎ। তারপর লাইন কেটে গেলো, কোন গলার
আওয়াজ নেই, কোন শব্দ নেই – স্রেফ ডায়াল টোন ।

কনস্টেনটিন এঞ্জেলার দিকে তাকিয়ে তড়পে উঠলো “চালাও , তাড়াতাড়ি !”

বারো

“ওটা কিসের গন্ধ ? সালফার ? ” এঞ্জেলা জিজ্ঞেস করলো। ওরা দাঁড়িয়ে আছে , বী ম্যানের
স্বরচিত , ছোট্ট , অদ্ভু ত ধরণের এপার্ট মেন্টের সামনে।

কনস্টেনটিন নাক টানলো – আর ভ্রু কুঁ চকালো । গন্ধটা কিসের ? কাঁচা নর্দ মা – আর রক্ত ?

রক্ষণাবেক্ষনের দরজাটা বন্ধ, তালা দেয়া। কনস্টেনটিন ম্যানেজারকে খুঁজে পায়নি, যদিও বাইরের
দরজাটা খোলাই ছিলো। মেইন ডেস্কের পেছনে, একটা সকালের টক শো চলছিলো আওয়াজ
ছাড়া। এছাড়া, প্রাণের কোন চিন্হ চোখে পড়ছে না কোথাও ।

এঞ্জেলা, দরজার নিচ দিয়ে আসতে থাকা মাছিদের থেকে সরে গেলো। ওদের একটা বড়সড় পাল,
তড়িঘড়ি করে পালিয়ে গেলো। সেই বিজ বিজ শব্দ আবার শোনা গেলো, কাঁপছে এবার।

কনস্টেনটিন ওর গোড়ালির কাছে সুড়সুড়ি অনুভব করলো – ঝাঁকালো ওটা, আর অনেকগুলি


বড় বড় ঘরোয়া মাছি বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। বোউলিং লেনের ভেতর থেকে, দরজার নিচ
থেকে, আরও আরও মাছি এসে , বাতাস অন্ধকার করে তু ললো।
174

ও পিছিয়ে এলো। দরজার দুর্বল অংশ খুঁজে বের করলো। তারপর , খুব জোরে একটা লাথি
কষালো সেটার গায়ে। ওর অনেকদিনের অভ্যাস দরজা ভাঙ্গার, সেটা হাট করে খুলে গেলো।

সেই দরজার ভেতরে, যেখানে সাধারণত খুব ঠাণ্ডা থাকে – বদলে সেখানে এখন কেমন জানি
আঠালো এক ধরণের গরম। ওরা সেই সঙ্কীর্ণ করিডোর ধরে দৌড়ে গেলো , শেষমেশ পৌঁছাল গিয়ে
যে জায়গাটা বী ম্যানের জন্য খানিকটা উন্মুক্ত করা হয়েছিলো, সেই অংশে।

সেই অন্ধকারটা যেন বী ম্যানের ডেস্ক ঘিরে জমাট বেঁধে আছে।

বিজবিজ শব্দ করছে, কালো আর ঘন।

“তু মি দেখছ ওটা ?” এঞ্জেলা বললো, ওর কণ্ঠ উৎকণ্ঠায় টানটান হয়ে আছে।

কনস্টেনটিন এগিয়ে গেলো – আর মাছিগুলো তেড়ে এলো ওর দিকে, যেন ওকে সাবধান করছে।
ঠিক যেন মৌমাছির চাকের মৌমাছি। এঞ্জেলা ওর সাথেই রইলো, মুখ ঢেকে রেখেছে। চিৎকার
করতে চাইছে, কিন্তু ফোঁপাচ্ছে কেবল।

সেই মাছির ঝাঁকের একটা ঘনতম কেন্দ্র আছে।

মেঝেতে , একটা বিরাট মাছির ঢিপি দেখা যাচ্ছে।

“ওহ যীশু !” কনস্টেনটিন মৃদু সুরে বললো “না .........”

কোট খুলে, সেই ঢিপির ওপর এলোপাথাড়ি চালালো কনস্টেনটিন। আর বিজবিজ করতে থাকা
মাছির দল সরে গেলো বী ম্যানের শরীরের ওপর থেকে। যতটু কু অবশিষ্ট আছে আর কি !
বেশীরভাগই খেয়ে নিয়েছে মাছির দল। বী ম্যানের মুখ আর কান থেকে মাছি গড়িয়ে পড়ছে।

এঞ্জেলার দম আটকানোর আওয়াজ পাওয়া গেলো “ওহ, ঈশ্বর ”

“কে ?” কনস্টেনটিন জানতে চাইলো। কে এই অবস্থা করেছে ওর বন্ধু র ?


175

মাছিগুলো ছায়ার ভেতর মিলিয়ে যাচ্ছে। ওকে ওগুলোর পালিয়ে যাওয়া থামাতেই হবে.........

শার্টে র স্লিভ গুটিয়ে নিয়ে, ওর হাতের বাহুতে আঁকা উল্কি দুটো দৃশ্যমান করলো, যেগুলো ও
জাদুবিদ্যার কাজে ব্যাবহার করে। ওই দুটোকে একত্র করলে, দুটো মিলে একটা ছবি তৈরি করে।
ট্যাটু গুলোতে বাড়ি মেরে , সে আহ্বান করলো মহাজাগতিক শক্তিকে , বী ম্যানের দেহের
আশেপাশের বাতাসে আসার জন্য । মুখে উচ্চারণ করলো “আলোর শক্তির দোহাই দিয়ে, আমি
আদেশ করছি তোমাদেরকে !” শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো ওর, ফু সফু সের অসুখ এই জটিল মুহূর্তে
ওর সাথে প্রতারণা করতে চাইলো । ও হয়তো এখনও বী ম্যানকে সাহায্য করতে পারবে, অন্তত
পরজগতে হলেও...... যদি সে বের করতে পারে কোন পিশাচ ওকে মেরে ফেলেছে “আলোর
দোহাই দিয়ে, আমি আদেশ করছি !”

কাশি দিও না , এখন না। মনোযোগ দাও। এই মুহূর্ত পার হয়ে যাবে, আর তখন অনেক দেরী হয়ে
যাবে। কাশি দিও না !

“আলোর দোহাই , আদেশ করছি আমি !”

ওর বাহুর চারপাশের বাতাস যেন হঠাৎ পাক খেতে শুরু করলো , ডাকে কাজ হচ্ছে ! এঞ্জেলা
পিছিয়ে গেলো খানিক, ভয় পেয়েছে। মাছিগুলো মাথার ওপর ঘুরে ঘুরে উড়ছে......

“আলোর দোহাই, আদেশ করছি আমি, আলোর দোহাই ...... ”

তখনই, কাশির দমক এলো একটা। কনস্টেনটিন মোটেই শ্বাস নিতে পারছে না। ক্লান্তিতে মাথা
ভেঙ্গে পড়তে চাইছে, অক্সিজেনের অভাব বোধ করছে ও – সেইসাথে হতাশা। রক্ত উঠে এলো
ফু সফু স থেকে মুখে। থুতু ফেলে, হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়লো ও।

এঞ্জেলাও বসলো পাশে, ওর কাঁধের ওপর একটা হাত রাখলো। মাছিগুলো চলে গেছে। বী ম্যানের
ছেঁ ড়াখোঁড়া শরীরটা পড়ে আছে কেবল। আর মেঝেতে কনস্টেনটিনের রক্তের খানিকটা ফোঁটা।

কাশির দমক থামলো, কিন্তু ততোক্ষণে দেরী হয়ে গেছে।


176

“এটা আমার দোষ ” কনস্টেনটিন কর্ক শভাবে বললো “একটা অভিশপ্ত মানুষের প্লেগ !”

“জন, তোমার একজন ডাক্তার দরকার ”

কনস্টেনটিন গলার ভেতর বিতৃ ষ্ণার শব্দ করলো একটা, তারপর মাথা নাড়লো “আমি ডাক্তার
দেখিয়েছি।”

ও উঠে দাঁড়ালো, আর ওর চারপাশে রুমটা যেন ঘুরতে শুরু করলো। নিঃশ্বাস নিতে এখনও কষ্ট
হচ্ছে। ভয় হচ্ছে, মুখ থুবড়ে পড়ে না যায়। দুলতে শুরু করলো সে, হাত ছড়িয়ে দিয়েছে দু পাশে।
এঞ্জেলা দাঁড়িয়ে , ওকে সাহায্য করতে চাইলো।

“সরে যাও ” ওকে বললো কনস্টেনটিন। আশা করছে , মেয়েটা বুঝতে পারবে। ও চাইছে
এঞ্জেলাকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে , নিরাপদ কোথাও। প্রথমে হেনেসি, তারপর বী ম্যান। হয়তো
মেয়েটা’র পালা এরপর। “প্লিজ ...”

কনস্টেনটিন তাকালো বী ম্যানের ডেস্কের দিকে, খুব বেশী অবাক হলো না এটা দেখে – যে
স্ক্রলগুলো সব ছাই হয়ে গেছে।

এঞ্জেলা একটা শ্বাস ফেলে ওর পোর্টে বল ওয়াকি-টকি বের করলো । “টেন-টু য়েলভ টু বেস।
অফিসারের সাহায্য দরকার। আমরা একটা ......”

থেমে বী ম্যানের শরীরের দিকে তাকালো সে। এটাকে কোন দলে ফেলবে ও ? ম্যানুয়ালের কয়
নাম্বার এ পড়ে এই অদ্ভু ত হত্যাকাণ্ড ?

“উম......... অফিসারের সাহায্য দরকার ”


177

কনস্টেনটিনের এপার্ট মেন্ট। ওর জানালার পাশের সিটে বসে আছে সে, তাকিয়ে আছে
বাইরে রাস্তার দিকে। দেখছে, পুলিশের গাড়িগুলো বোউলিং এলি থেকে চলে যাচ্ছে সাইরেন
বাজিয়ে।

“ওটা কেবল ইসাবেল ছিলো না। ” দরজার কাছ থেকে বললো এঞ্জেলা “আমিও অনেক ধরণের
জিনিসপত্র দেখতে পেতাম, জন ”

কনস্টেনটিন ফিরে তাকালো ওর দিকে। ও কি মেয়েটাকে ওর থেকে দূরে চলে যেতে বলেনি ? এরা
কি কেবল একটা ঠুঁটো জগন্নাথের সামনে কেবল আনন্দের শিস দিতে দিতে , খুবই খুশি মনে
নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে হেঁটেই যেতে থাকবে ?

“কিন্তু তু মি সেটা জানতে ” এঞ্জেলা বলে চললো “তাই না ?”

কনস্টেনটিন সন্দেহ করেছিলো। কিন্তু কিছু বলেনি। এঞ্জেলা ঘরে ঢু কে এলো এক পা। ওই এক পা
ফেলার মধ্যে যেন কিছু একটা ছিলো, যেন – একটা রেখা পার হয়ে , ওর দিকে এগিয়ে এলো
মেয়েটা।

“তু মি কিছু একটা দেখেছ আমার মধ্যে” সে বললো “কিছু একটা, যেটা ইসাবেলেরও ছিলো...”

“বাড়ি যাও, এঞ্জেলা ” কনস্টেনটিন ওর হাতের সিগারেটের দিকে তাকালো । প্রায় পুড়ে গেছে
ওটা। একটা সিগারেটের মতোই, ওর জীবনও জ্বলতে জ্বলতে এক সময় শেষ হয়ে যাবে।

এঞ্জেলা ভেতরে ঢু কে এলো, ঘুরঘুর করতে লাগলো আশেপাশে। দেখতে লাগলো , যেসব অদ্ভু ত
অদ্ভু ত জিনিস দিয়ে নিজের ঘর ‘সাজিয়েছে’ কনস্টেনটিন !

“আমার বুঝতে হবে, কনস্টেনটিন ”

কনস্টেনটিন কেবল মাথা নাড়লো “ওখানে যে কি কি আছে, ওসব তু মি জানতে চাইবে না। এ
ব্যাপারে আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারো। ”
178

“আমি ইসাবেল নই ”

“না, ও ওর ক্ষমতাকে মেনে নিয়েছিলো। তু মি , তোমারটাকে অস্বীকার করেছো। অস্বীকার করাই


ভালো আসলে। এজন্যই তু মি এখনও বেঁচে আছো। আমার সাথে লেগে থাকলে, পাল্টে যাবে
সেটা। আরেকটা ভূ তকে আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখতে চাই না আমি ! ”

আরেকটা ভূ ত, সে ভাবলো, ভর্সনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে আমার দিকে। জিজ্ঞেস করতে
থাকবে “কেন তু মি কিছু করলে না ? কেন আমাকে বাঁচালে না ?”

কনস্টেনটিন উঠে দাঁড়ালো, মেয়েটা যদি না-ই যায়, ও চলে যাবে তাহলে। জীবন শেষ হয়ে যাবার
আগে আরও কিছু বেশীদিন সময় পাবে হয়তো তাহলে......... যদি সে জন কনস্টেনটিন এর কাছ
থেকে দূরে থাকে !

“গোল্লায় যাও – জন। ওরা আমার বোনকে হত্যা করেছে !”

ও এই কথা শুনে থেমে গেলো। বুঝতে পারলো, মেয়েটা এটা নিয়ে এগিয়েই যাবে, এই ধরণের
অনুপ্রেরণা নিয়ে যদি আগাতে থাকে, তাহলে......

এঞ্জেলা বলে চললো “ওর সাথে যদি জায়গা বদল করা যেতো, তবে আমি তাই করতাম। ”

কনস্টেনটিন স্রেফ চেয়ে রইলো ওর দিকে, অপেক্ষা করছে।

এঞ্জেলা থামলো না “আমি ভান করতাম যে, আমি কিছু দেখি না। আমরা যখন দশ বছরে
পড়লাম, ওরা ইসাবেলকে ওষুধ খেতে বাধ্য করতো, চিকিৎসা নিতেও। ” ওরা ওকে যখন ধরতে
আসতো , ও আমার দিকে তাকিয়ে বলতো “বল ওদেরকে, ওদেরকে বল , এঞ্জি । যে তু ইও এই
ভূ তদের দেখতে পাস !”

এঞ্জেলার চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। কিন্তু ওর চোখে অদ্ভু ত এক দীপ্তি দেখা যাচ্ছিলো , সেই জলের
মাঝেও।
179

“কিন্তু আমি মিথ্যে বলতাম, আমি বলতাম যে আমি কিছু দেখতে পাই না । আর তারপর, একদিন,
আমি কোনকিছু আর দেখতে পেলাম না। আমি ওকে ত্যাগ করেছিলাম, জন। সম্পূর্ণ একা ”
অন্যদিকে তাকিয়ে , শক্ত গলায় যোগ করলো “আমি আর অন্যদিকে তাকাতে পারবো না।”

ও তাকালো কনস্টেনটিনের দিকে। এটা ওর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো , যে এগিয়ে যাবার
ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আর তদন্তও চালিয়ে যাবে সে এই ব্যাপারে। আর, ওকে দেখে মনে হচ্ছে এটা
একা করার ব্যাপারে ও যথেষ্ট ভয় পাচ্ছে । কিন্তু , কনস্টেনটিন বুঝতে পারলো ও সেটা করবেই,
ওকে নিয়ে হোক বা ওকে ছাড়া। যেভাবেই হোক না কেন, শত্রু ওকে খুঁজে পেয়ে যাবে। কিন্তু তখন
যদি কনস্টেনটিন ধারে কাছে না থাকে, মেয়েটা স্রেফ সিটিং ডাকে পরিণত হবে। সম্পূর্ণ অসহায়।
একটা শ্বাস ফেললো সে। আসলে ওর সামনে সত্যিকার অর্থেই , আর কোন পথ খোলা নেই ......

“তু মি যদি এটা করতেই চাও” কনস্টেনটিন আস্তে আস্তে বললো “তাহলে সেখান থেকে ফেরত
আসার আর কোন রাস্তা নেই। তু মি ওদেরকে দেখবে – ওরা তোমাকে । বোঝা গেছে ?”

এঞ্জেলা স্রেফ নড করলো।

গাড়িটা পেছনের একটা রাস্তায় ভেঙ্গে পড়ে আছে, লস এঞ্জেলস এয়ারপোর্ট আর খানিকটা
আগে। ফ্রান্সিস্কো একটা হলুদ ট্যাক্সি নিয়েছে, যেটা চালাচ্ছে একজন লম্বা দোহারা চেহারার নিগ্রো।
ওর মাথার দুপাশের চু ল চাঁছা ডলারের মতো করে ! একটা রেইডার জ্যাকেট পরে আছে, যেটা ওর
চাইতে কমপক্ষে দু’সাইজ বড় হবে। রেডিওতে একটা বিট সমৃদ্ধ মিউজিক বাজছে।

ফ্রান্সিস্কো , চিহুয়াহুয়াতে এটার একটা ভার্সান শুনেছে । বিরক্তিকর জিনিস, কিন্তু ওটা ওকে কেমন
জানি আগ্রহী করে তু ললো। ও লোহার স্পাইকটা ধরে, শুনতে লাগলো। আশেপাশের শহরটা
নিয়ন্ত্রণ করা, শত্রুকে নিকেশ করা, বড় বড় পার্টি দেয়া, দুটো ডবকা মেয়েমানুষ নিয়ে বিছানায় গিয়ে ,
ওদের বুকের ভাঁজে ডলার গুঁজে দেয়া............
180

ফ্রান্সিস্কো সিদ্ধান্ত নিলো, ও আমেরিকাকে পছন্দই করবে ... আ

কিন্তু ওর কানে কানে আবার সেই ফিসফিস শব্দ ওকে সাবধান করে দিলোঃ ফ্রান্সিস্কো , তু মি বিপদে
আছো......... এই লোকটাকে বিশ্বাস করা যাবে না......... ড্যাশ বোর্ডে র ফটোটার দিকে তাকাও।

ফ্রান্সিস্কো তাকালো । ড্যাশ বোর্ডে র লাইসেন্সের ফটোটা , সম্পূর্ণ ভিন্ন এক লোকের !

“কথা বলো এখন, তোমার কাছে অ্যামেরিকান টাকা আছে, ঠিক ? ” ট্যাক্সি ড্রাইভার জিজ্ঞেস
করলো “আমি কোন পেসো চাই না। আর তোমার ইংরেজি না বলা আর এদিক ওদিক তাকানো
দেখে বুঝতে পারছি, তু মি কেবল এসেছ এখানে...... ” বলতে বলতে ভাড়ায় দেয়ার জন্য রাখা
গাড়ি ভর্তি একটা পার্কিং লটে গাড়ি দাড় করালো। আশেপাশে কেউ নেই।

ফ্রান্সিস্কো লোহার স্পাইকটার ওপর হাত বুলালো , আর বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। কিন্তু সে
ইংরেজিতে বলতে পারলো না , স্প্যানিশে জবাব দিলো “আমার টাকা পরিবর্ত ন করে নিতে হবে।”

নিগ্রোটা মাথা নাড়লো “বোকা ! তু মি কি বলছো আমি কিছুই বুঝছি না। তোমার কাছে ......”
এবার সে টাকাপয়সার আন্তর্জাতিক সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যাবহার করলো , দুই আঙ্গুল একে অপরের
সাথে ঘষে জিজ্ঞেস করলো “অ্যামেরিকান ডলার আছে ?”

ফ্রান্সিস্কো মাথা নাড়লো।

“মাদারচোদ, তু ই ব্যাটা কেলেঙ্কারি লাগাবি দেখছি ! তোর ওই বালের টাকা চেঞ্জ করার জন্য আমি
দাঁড়িয়ে থাকবো, ভেবেছিস তু ই ? দেখি , গাড়ি থেকে নাম, গায়ে কি কি পরে আছিস আর সাথে কি
কি আছে দেখে নিই । তারপর তু ই আমাকে ধন্যবাদ জানাস যে তোর মাথাটা যে উড়িয়ে দিইনি
এইজন্য ”

ফ্রান্সিস্কো কাঁধ ঝাঁকিয়ে , বেরিয়ে এলো। ড্রাইভারটা ওর পাশে এসে দাঁড়ালো , কাঁধের সাথে বাধা
হোলস্টারে একটা রিভলবার দেখা যাচ্ছে “আমি তোর পাছায় এমনিতেও লাথি কষাতাম, ভেজা
181

পাছা কোথাকার। তোকে নিয়ে কোথাও আটকে রেখে, তোর আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা
খোঁজা যেতে পারে। তাহলে কিন্তু টাকার পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে, ব্যাটা বুরবক --- ”

“আমি ভেজা পাছা নই, এসেছি ওই মরুভূ মি দিয়ে। টেক্সাসের নদী দিয়ে না । ” ফ্রান্সিস্কো বললো,
ওর নিজের ভাষায়। তারপর ওর লোহার স্পাইকটা বের করে , চালিয়ে দিলো ওটা।

ড্রাইভারটা বন্দুক বের করে ফেলেছিলো, স্পাইকটা ওর হাত বন্দুক, দুটোই ভেদ করে চলে গেলো।
যদিও ওটার সেরকম ধার ছিলো না , যে একটা কাগজকেও ভেদ করতে পারে না, হার মাংস তো
দূরে থাক। ড্রাইভারটা চিৎকার করে সরে যেতে চাইলো, কিন্তু ওর হাতটা কেবল আরও
ভালোভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো তাতে।

ফ্রান্সিস্কো এরপর, খুব রেগে গিয়ে, ভীষণ জোরে লাথি মারলো ব্যাটার কুঁ চকি বরাবর। শরীরের
মাঝখান বরাবর ভাঁজ হয়ে, বাউ এর ভঙ্গিতে উবু হয়ে গেলো সে। “হ্যাঁ, বাউ কর আমার সামনে!
তু ই ব্যাটা একটা নর্দ মার ময়লা। আমাকে ডাকাতি করবি, এতো সাহস ? আমি এই শহরের দখল
নেব, সব চোর-ডাকাতদের রাজা হবো আমি। ”

বলতে বলতেই, হাতের স্পাইকটা তু লে, ট্যাক্সি ড্রাইভারের মাথা বরাবর গোলাকারভাবে ঘুরিয়ে
এনে মারলো সে। ওর মনে হলো , স্পাইকটার নিজস্ব যেন একটা গতি সঞ্চার হলো – যেন এটার
নিজের ভেতরের কোন ক্ষু ধা আছে। ওটা লোকটার মাথায় ঢু কে গেলো ঠিক যেন কোন সেদ্ধ করা
ডিমের ভেতরে, কোন পেরেক ঢু কে যাচ্ছে।

ড্রাইভার পড়ে গেলো মাটিতে, কাঁপছে। ফ্রান্সিস্কো লোহার স্পাইকটার দিকে তাকালো – ওটাতে
লেগে থাকা রক্ত, মুহূর্তে র মধ্যেই , একদম শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেলো।

সন্তুষ্টির একটা শব্দ করলো সে, তারপর ওটা রেখে দিলো পকেটে। ড্রাইভারের পকেট হাতড়ে অল্প
কিছু ডলার পেলো, ট্যাক্সির ভেতরে পেলো ইগনিশনে লাগানো চাবি। স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু
করলো সে।
182

কিন্তু কোথায় ? যে কোনখানে ! সম্ভবত একটা ব্যাংক এ, এই স্পাইকটা একটা ব্যাংক ভল্ট খুব
সহজেই খুলে ফেলতে পারবে.........

ওটার জন্য অনেক সময় আছে । প্রথমে, তোমার প্রবৃত্তিকে অনুসরণ করো। তোমাকে পথ
দেখানো হবে। অন্য আরেকটা জায়গায় যাওয়া প্রয়োজন তোমার.........

হ্যাঁ, ডাকাতি করার জন্য পরে অনেক সময় পাওয়া যাবে। ও পুবের দিকে গাড়ি ছোটাবে, সেটাই
ঠিক মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে । সেখানে কিছু একটা আছে, এই বিরাট শহরের পূর্ব পাশে। ওখানে
একটা , বিশেষ জায়গা আছে, যেটা ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

কনস্টেনটিন আর এঞ্জেলা , কাপড়চোপড় পরেই, খানিক ঝাপসা আর অনিশ্চিত সময়ের


জন্য ঘুমিয়ে গেলো। কনস্টেনটিনের আফসোস হলো, বেড শিট অনেকদিন ধরে পালটায়নি বলে,
কিন্তু এঞ্জেলা’র সেগুলো নিয়ে কোন মাথাব্যাথা দেখা গেলো না। পরে.........

কনস্টেনটিন কিছু ওষুধ খেলো, দুজন একসাথে বেঁচে যাওয়া ব্রেকফাস্ট খেলো। তারপর, যেন
গ্যালন খানেক কফি গেলার পর, ওরা কথা বললো। কিছু নির্দি ষ্ট আলোচনা আর সঙ্কল্প করলো।

ওদের আসলে , নির্দি ষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই এই মুহূর্তে । কিন্তু একটা লক্ষ্য আছে ঠিকই। ঠিক
যেমন আপনি কোন জঙ্গলে হারিয়ে গেলে, আপনি ঝর্না ধরে এগোতে থাকেন। জানেন যে, ওটা
আপনাকে সভ্যতার দিকে নিয়ে যাবে। তেমনি ওরাও , পানি ধরে এগিয়ে যাবে সামনে – নরকের
দিকে !

তো, কনস্টেনটিন ওর পুরানো আমলের চিনামাটির বাথটাবে পানি ভরলো। নিচের পায়াগুলো
দেখতে থাবার মতো। ঠিক যেন আপনি সেখানে বসলেই, আপনাকে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাবে
সেটা।
183

এঞ্জেলা পেছন থেকে গলা পরিষ্কার করলো “উম – জন ? আমি কি কাপড়চোপড় খুলে ফেলব,
নাকি পরাই থাকবে ওগুলো ?”

কনস্টেনটিন মুচকি হাসলো, অপেক্ষা করিয়ে রাখলো ওকে।

“জন ?”

“ভাবছি আমি ............”

“জন !!”

এঞ্জেলাকে হাসিয়ে দিয়ে অবশেষে সে বললো “পরেই থাকো কাপড়চোপড় ।”

এঞ্জেলা পেছনে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। ভয় তাড়াতে কথা বলা শুরু করলো সে
“পানিই কেন ?”

“পানি হলো , সার্বজনীন পরিবাহী। এটা যে কোন কিছুকে , এক তল বা জগত থেকে আরেক
জগতে নিয়ে যায়। এখন আমাকে জিজ্ঞেস করো, নরকে পানি আছে কিনা ......”

এঞ্জেলা ওর কাঁধ ধরে, বাথটাবের কু সুম গরম পানিতে নামলো, একদম পুরোদস্তুর কাপড় পরা
অবস্থায়।

“সাধারণত ” কনস্টেনটিন বললো “কেবল শরীরের খানিকটা অংশ ডু বন্ত থাকলেই হয়। কিন্তু তু মি
তো ক্রাশ কোর্স করতে চেয়েছ ......”

“পানি কি আরেকটু গরম করা যায় না ?”

“খুব তাড়াতাড়িই এটা অনেকখানি গরম হয়ে উঠবে ”

“আমি কি দেখতে পাবো ?”


184

এটার জন্য ওকে তৈরি করার আসলে কোন রাস্তা নেই। কিন্তু ও সম্ভবত কনস্টেনটিনের চোখের
দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো , সেখানে ওর জন্য কি অপেক্ষা করে আছে। ঢোঁক গিললো ও।

“আরেকটু নিচে যাও ” কনস্টেনটিন বললো।

“আরও নিচে ?”

“তোমাকে পুরোটা ডু বে থাকতে হবে, যেহেতু একদম নতু ন এই লাইনে !”

এঞ্জেলা চোখ পিটপিট করে তাকালো ওর দিকে। কনস্টেনটিন ওর চোখে দেখতে পেলো, ওকে
সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করার সিদ্ধান্তে এসেছে মেয়েটা “কতক্ষণ লাগবে ?”

“যতক্ষণ লাগে, এই যে ............” বলে এঞ্জেলার পুরো শরীরটা ডু বিয়ে দিলো পানির তলায়।
কেবল চেহারাটা ভেসে রইলো পানি ওপর । ঘাড়ের পাশে , ওর পালস অনুভব করছিলো
কনস্টেনটিন, দ্রুত দৌড়াচ্ছে সেটা।

“শেষ সুযোগ” সে বললো।

এঞ্জেলা স্রেফ একবার মাথা নাড়লো।

“তাহলে, লম্বা একটা নিঃশ্বাস নাও ”

এঞ্জেলা বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে, সেটা আটকে রাখলো। কনস্টেনটিন আস্তে করে ওর হাত
সরিয়ে নিলো , এঞ্জেলা ধীরে ধীরে পুরোটা তলিয়ে গেলো বাথটাবের পানির নিচে। কনস্টেনটিন
এবার মেয়েটার হাত ধরে রাখলো শক্ত করে, দেখলো পানির নিচে থেকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে
সে।

কনস্টেনটিন এবার ওর আধিভৌতিক সত্ত্বাকে জাগিয়ে তু লে, মহাজাগতিক রশ্মিকে আহ্বান


করলো ওর দিকে। হাত বেয়ে পৌঁছে দেয়া শুরু করলো এঞ্জেলার ভেতরে। নরকের দরজা খোলার
জন্য যে কম্পনের দরকার হয়, সেটা যাতে সে খুঁজে বের করতে পারে।
185

সে দেখলো, ফু সফু সে বাতাস কমে যাওয়ার কারণে, আতংক ফু টে উঠছে মেয়েটার চেহারায়।
ওপরের দিকে ভেসে উঠতে চাইছে সে, কিন্তু আশ্বাসের হাসি হেসে ওকে, নিচে চেপে ধরে রাখলো
কনস্টেনটিন। সে অনুভব করতে পারলো , প্রধানতম কম্পনগুলো পানিতে আসতে শুরু করেছে,
বেঁধে ফেলছে মেয়েটাকে। কিন্তু ও এখনও শারীরিকভাবে বাধা দিয়ে চলেছে......

যেতে দাও , মানসিকভাবে জোর করলো মেয়েটাকে সে , যাচ্ছই যদি, চলে যাও !!!

ওই যে – কনস্টেনটিন টের পেলো , দরজা খুলে যাচ্ছে। রুমের লাইট দপ দপ করতে শুরু করেছে,
প্রত্যেকবার , আলো কমে যাচ্ছে একটু একটু করে।

পানি ফু টতে শুরু করেছে, ঘোলা হয়ে যাচ্ছে আর বাষ্প বেরোচ্ছে একটু একটু করে !

কল থেকে বের হওয়া একটা পানির ফোঁটার দিকে দৃষ্টি গেলো ওর, কাঁপছে ওটা। বের হতে নিয়েও
আটকে গেছে যেন, পড়লো ওটা, এরপর আটকে গেলো বাথটাব আর কলের মাঝখানে। চোখের
কোণা দিয়ে ও দেখতে পেলো , একটা কালো মসে’র আবরণ ছেয়ে ফেলছে পুরো দেয়াল। ফাটল
ধরছে দেয়ালে, ফেটে বেরোচ্ছে রক্ত আর এসিড , অনেক অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে লক্ষ
লক্ষ চোয়ালের কিছু একটা চাবানোর শব্দ ।

সময় থেমে গেলো, তারপর, লাফ দিলো একটা......

পানির ফোঁটাটা নিচে পড়লো।

এঞ্জেলা পানির নিচে ভীষণ ছটফট করতে লাগলো , চোখ বড় বড় হয়ে গেলো নীরব চিৎকারে।
পানি, ওর চিৎকারের শব্দ আটকে দিলো , কিন্তু মুখ থেকে ক্রমাগত বুদ্বুদ বেরোতে লাগলো।

কনস্টেনটিন ওকে টেনে বসিয়ে দিলো। এঞ্জেলা বাজেভাবে কেশে উঠলো, কাশি থামার পর উচ্চ
কণ্ঠে কেঁ দে উঠলো। তারপর আবার কেশে পানি বের করে দিলো বেশ খানিকটা, তারপর আবার
শুরু করলো বিলাপের সুরে চিৎকার। এরপর, কনস্টেনটিনের কাঁধ আঁকড়ে ধরে , ঝাঁপিয়ে নামলো
বাথটাব থেকে। ওকেসহ নিয়ে পড়লো মেঝেতে, পানি ছিটকে পড়লো দুজনেরই ওপর।
186

এঞ্জেলার চিৎকার , বিলাপে পরিণত হলো, তারপর গোঙানিতে। কনস্টেনটিনের ওপর পড়ে থেকে,
কাঁপতে লাগলো সে ভীষণভাবে।

“ওহ, ঈশ্বর, জন। ওইসব লোকজনেরা, ইসাবেল।” ফুঁ পিয়ে ফুঁ পিয়ে কাঁদছে সে এখন “আমি সব
সময়ই জানতাম খারাপ লোকেরা কোথায় থাকে......... ওদেরকে কোথায় খুঁজে পাবো.........
কোথায় লক্ষ্য স্থির করতে হবে, কখন মারতে হবে...... আমি দেখতে পাই......... আমি সবসময়
জানতাম......... আর...... আর আমিই ওদেরকে ওখানে পাঠিয়েছি, ভাবো, আমিই পাঠিয়েছি
ওদের ওখানে ...... ”

ও জোর করে চোখ বন্ধ করে ফেললো, তারপর ওর হাত অনির্দি ষ্ট ভাবে নড়তে লাগলো বাতাসে।
যেন জাদু করছে কোন, ঘুমিয়ে থাকা কোন প্রবৃত্তির বশেই হয় তো বা।

“এঞ্জেলা ?”

সে তাকালো কনস্টেনটিনের দিকে “এখানে কেউ একজন এসেছিলো ......”

লাফ দিয়ে উঠে , সেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো এঞ্জেলা। একটু ক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থেকে –
কনস্টেনটিনও অনুসরণ করলো ওকে।

পুরো শরীর ভেজা, এঞ্জেলা দৌড়ে বেরোল এপার্ট মেন্ট থেকে। তারপর পার্কিং লট হয়ে, বোউলিং
এলি’র স্টিল দরজা পার হয়ে ছুটতে লাগলো।

কনস্টেনটিন পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে, চিৎকার করে বললো “দাঁড়াও, বাল। আস্তে যাও, আমাকে
বলো কি --- ”

এঞ্জেলা দৌড়ে বী ম্যান যেখানে মারা গেছে, সেখানে পৌঁছে গেলো। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।
পুলিশের দেয়া হলুদ টেপ ছিঁ ড়ে, বী ম্যানের শরীরের আউটলাইন আকা যেখানে, সেটার খুব কাছে।

“এটা ওর ছিলো, গড়াচ্ছিলো --- ” সে বলে উঠলো “বল নয়, আরও ছোট কিছু, চকচকে !”
187

“ও বী ম্যানকে মরতে দেখেছে ......” আবারও বললো সে , যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে
সবকিছু “ঠিক খাওয়ার মতো। এক ধরণের খাবারই বটে , পুরোটা। অনেক ভালো ......”

আশেপাশে তাকালো এঞ্জেলা , কিছু একটা টের পাচ্ছে সে। কনস্টেনটিনও টের পাচ্ছে কিছু
একটা, কিন্তু সে এঞ্জেলাকে সুযোগ দিলো সেটা বের করার। ওর প্রতিভা মাত্র আলোয় এসেছে
অনেকদিন পরে, ওটাকে স্বাধীনভাবে বিকশিত হবার সুযোগ দেয়া উচিত।

নিচের স্টিলের ঝাঁজরির ফাঁক থেকে আঙ্গুল চালিয়ে , এঞ্জেলা বের করে আনলো একটা পয়সা।
একটা সোনার পয়সা। ওটাকে , স্বপ্নালু ভাবে, আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে ঘোরাতে লাগলো বেশ একটা
পরিচিত ভঙ্গিতে।

কনস্টেনটিন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেটার দিকে।

“বালথ্যাজার” বললো সে।

এঞ্জেলার জন্য কিছু শুকনো কাপড় খুঁজে দিলো কনস্টেনটিন। বোতাম ছাড়া একটা শার্ট ,
কিছু জিন্স যেগুলো কমবেশী ফিট করে গেলো। এখন এঞ্জেলা তাকিয়ে দেখছে, কনস্টেনটিন ওর
এপার্ট মেন্টের একটা শো কেস থেকে বিভিন্ন পুরাতাত্ত্বিক খ্রিষ্টীয় জিনিসপত্র নামাচ্ছে নিচে।

বিশুদ্ধ প্লাটিনাম এর ‘ফ্লাস্ক অব ডিভিনিটি ’ ইত্যকার আরও আরও জিনিসপত্র।

এঞ্জেলা জিজ্ঞেস করলো “এগুলি সব খ্রিষ্টীয় জিনিসপত্র ? ইসলাম , হিন্দুইজম আর বুড্ডিজম


এর কি হলো , ওগুলো কি সম্পর্ক যুক্ত নয় ?”

“অবশ্যই, কিন্তু আমি খ্রিস্টান সংস্কৃ তি থেকে এসেছি বলে, এগুলো আমার জন্য ভালো কাজ
করে” জবাব দিলো কনস্টেনটিন। একটা অলংকৃ ত, স্বচ্ছ ফ্লাস্ক ধরলো সে জানালা দিয়ে আসা
আলোর বিপরীতে। রুপালির ছিটে দেয়া গোলাপি রং । “ওদের সম্পর্কে নির্দি ষ্ট জ্ঞান, আমার শক্তি
বৃদ্ধি করে। আর অন্ধকারের সাথে লড়তে লড়তে , কিছুটা অভিজ্ঞতাও লাভ হয়েছে বৈকি। কিন্তু
188

কোন নির্দি ষ্ট ধর্ম, এক ধরণের পুরাতাত্ত্বিক জিনিসপত্র আর নিয়মকানুন , কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে
পারে না এককভাবে। আর , তু মি যদি ওগুলোর দিকে ভালোভাবে তাকাও, সব ধর্মেই কিছু
সাধারণ নিয়ম আছে যেগুলি পুরোপুরি মিলে যায়। সব ধর্মেই, কোন একটা স্বর্নালি নিয়ম থাকবেই।
একই ধরণের জিনিসের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরণের চিন্হ, নাম। আর শয়তানকে আমাদের ধর্মে ডাকা
হচ্ছে স্যাটান, মুসলিম সংস্কৃ তিতে ডাকা হচ্ছে ইবলিশ, হিন্দু ধর্মে শায়তান – কিন্তু সবই আসলে
একই সত্ত্বা। আবার গ্যাব্রিয়েলকে হিন্দু ধর্মে অন্য আরেকটা নামে ডাকা হয়। আমরা খ্রিস্টানরাও
অনেক কিছু ভু লভাল জানি। এমন না যে, আমি সবকিছুই জানি – কিন্তু অন্য অনেকের চাইতে
অন্তত বেশী জানি। কিন্তু তু মি যদি সত্যিই জানতে চাও , তাহলে তোমার থাকতে হবে ‘গ্ননোসিস’

“আমার কি থাকতে হবে ?”

কনস্টেনটিন সতৃ ষ্ণ নয়নে তাকিয়ে রইলো জানালা দিয়ে চু ইয়ে আসা সোনালি আলোর দিকে “মানে
হলো , সরাসরি ঐশ্বরিক জ্ঞান অর্জ ন এবং ব্যবহার করার ক্ষমতা, বন্ধু । তোমাকে সেজন্য ঈশ্বরের
প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। কিন্তু, আমি , কাউকে বা কিছুতে বিশ্বাস করি না, অন্তত বেশিদূর পর্যন্ত না
!”

এঞ্জেলা কোন কথা বললো না, কনস্টেনটিন এই ফাঁকে ‘জীবনের নদী’ থেকে সংগ্রহ করা ‘পবিত্র
ভু ষি’ ঢোকাল ওর ব্যাগে।

তখন এঞ্জেলা আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো “তোমার কি ধারণা , তু মি কখনও শিখতে পারবে ?”

“শিখতে পারবো , কি ?” হাত থেমে গেছে, জিজ্ঞেস করলো কনস্টেনটিন। কিন্তু আসলে সে
জানে।

“বিশ্বাস করা, যে কাউকে ”

“আমি.........” কাঁধ ঝাঁকালো কনস্টেনটিন “এটাতে এখন আর কিছু এসে যায় না ”


189

বাকি যেটা সে উচ্চস্বরে বললো না, সেটা হচ্ছেঃএখন যেহেতু আমি মারাই যাচ্ছি ।

একটু ক্ষণের অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এলো এরপর। কনস্টেনটিনের মনে হলো , ওর আরও
খানিক বেশী কিছু বলা উচিত। “আমি বী ম্যানকে প্রায় বিশ্বাস করেছিলাম, তাই ওকে আমার
হারাতে হলো ............” নিজের ভেতরে বেশ রাগ টের পেলো সে। পাবলিক ইমেজ লিমিটেড এর
একটা গান মনে পরে গেলো ওরঃ

“রাগ একরকম শক্তি......... রাগ একরকম শক্তি ”

ওর হাসি , এঞ্জেলার মনে কাঁপুনি ধরিয়ে দিলো “এটাই আসলে ঠিক ” শব্দ করে বললো সে।

এঞ্জেলা বললো এবার “তো, তু মি বালথ্যাজার’কে মেরে ফেলবে ? তু মি স্রেফ ওকে মেরে ফেলতে
পারবে ? তাহলে ওই ভারসাম্যের ব্যাপারটা কি, যেটার সম্বন্ধে তু মি আমাকে বলেছিলে ?”

“ওই ব্যাটা দো–আঁশলা সেই ভারসাম্য নড়িয়ে দিয়েছে, যখন থেকে সে আমার বন্ধু দের হত্যা
করতে শুরু করেছে। আমি স্রেফ পাল্লার অন্যপাশে খানিক ওজন রাখতে যাচ্ছি , এই যা ”

ও , সুন্দরভাবে খোদাই করা একটা খ্রিস্টান ক্রশ নামিয়ে আনলো, রুপা আর স্টিলের তৈরি। অদ্ভু ত
আকৃ তির টু করোগুলো , সুন্দরভাবে এঁটে আছে সেখানে। ওটাকে কয়েক ভাগে ভাগ করে
ফেললো সে, তারপর সেটাকে সম্পূর্ণ নতু নভাবে সাজালো। ‘দ্যা হোলি শটগান’ । যে ক্রশ পিসটা
ক্রু সিফিক্সের দুইবাহুর কাজ করছিলো , সেটা এখন পরিণত হলো গান ব্যারেলের আলাদা একটা
হাতলে !

“ওটা কি এক ধরণের বন্দুক ?” এঞ্জেলা জিজ্ঞেস করলো , পেশাদারী কৌতূ হল নিয়ে।

“একটা বিশেষ ধরণের বন্দুক। অনেকটা ‘এইস অব উইনচেষ্টার’ এর মতো একটা জিনিস।
আমাকে পরে কোন এক সময়, ওটা সম্পর্কে বলার জন্য মনে করিয়ে দিও । ”
190

ওটা দেখতে হোলি ক্রশের মতোই আছে এখনও। কিন্তু ওটাকে ঠিক একটা শটগানের মতোই
মাঝখানে ভেঙ্গে, স্পেশাল রাউন্ড ভেতরে ঢোকালো কনস্টেনটিন। ঘুরে , এপার্ট মেন্টের দূরতম
প্রান্তের দিকে ফিরে ফায়ার করলো সে । বন্দুকটা গর্জে উঠে উগড়ে দিলো আগুন। শটগানের ছররা
পেছনে আগুনের লেজ রেখে , সেখানে রাখা এক কার্ট ন ‘লাকি স্ট্রাইক’ এ আগুন ধরিয়ে দিলো !

তের

ফ্রান্সিস্কো ঠিক করলো , সে গাড়ি পাল্টে ফেলবে। এই ট্যাক্সির আসল ড্রাইভারের লাশ খুঁজে
পেলেই, এই গাড়ি খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যাবে। যাকে ও মেরে ফেলে এসেছে, সে সম্ভবত কোন
চাচাতো/ মামাতো ভাইয়ের ট্যাক্সি চালাচ্ছিলো।

হ্যাঁ – বলে উঠলো সেই ফিসফিসে কণ্ঠ – এটাই ভালো কাজ হবে। ওরা এই গাড়িটা খুঁজছে। কিন্তু
তাড়াতাড়ি পাল্টে ফেলো এটা। সময় খুবই সন্নিকট.........
191

ওকে এটা বেশ তাড়াতাড়িই করতে হবে। ওর মনে হচ্ছে , একটা মিশন ওকে শেষ করতে হবে,
কিন্তু আদপে ওর কোন ধারণাই নেই সেটা আসলে কি। কিন্তু লোহার স্পাইকটা তো ওকে ভু ল
দিকে নেয়নি এ পর্যন্ত , তাই না ? না, সে তো আমেরিকাতে এসেই পড়েছে, যেখানে আসার জন্য
অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করে ছিলো সে। কারা নেই এখানে – চিকানো গ্যাং, নিগ্রো গ্যাং,
ইটালিয়ান মাফিয়া, আলবেনিয়ান মাফিয়া, কিউবান মাফিয়া, রাশিয়ান মাফিয়া, চাইনিজ টং,
আর্মেনিয়ান সিন্ডিকেট, জিপসি সিন্ডিকেট। আর এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী – ধনী সাদা
লোকেদের সিন্ডিকেট।

এই নর্দ মার মধ্যে আরেকটা শুয়োরের জায়গা হয়েই যাবে ! আর ও নিজেকে , কোন একটা
শুয়োরের পালের মাথা করে নেবে.........

ওই যে – একটা কার লট। এখানে , এই আপাদমস্তক গ্লাসে ঘেরা বিল্ডিঙটার মধ্যে অনেক গাড়ির
চাবি পেয়ে যাবে সে।

বেশ কয়েক ব্লক দূরে , ট্যাক্সি রেখে দিলো সে। হেঁটে হেঁটে গেলো সে সেই কার লট এ। সেখানে,
এক মেক্সিকান-অ্যামেরিকান লোক বসে আছে, ওর দিকে পেছন ফিরে একটা সাবওয়ে স্যান্ডউইচ
চিবাচ্ছে। আর একটা পোর্টে বল টিভি’র দিকে তাকিয়ে আছে নিবিষ্টমনে। ঠিক একটা উপহারের
মতো, যেন কেউ প্যাকিং করে সাজিয়ে রেখেছে ওর জন্য !

ফ্রান্সিস্কো দেয়ালের পরিবর্তে ব্যাবহার করা বিশাল আয়নাটার দিকে তাকালো। খেয়াল করলো,
সেখানে কোন তার বা সেরকম কিছু লাগানো আছে কিনা। ও হাসলো মনে মনে – ভাবলো এই
কোম্পানি এই ভু লো মনা, অন্যমনস্ক , বিরক্ত মোটা একটা লোকের ওপর এই লাখ লাখ ডলারের
জিনিসপত্রের ভার দিয়ে রেখেছে ! যেন একটা ল্যাপ ডগ রেখে দেয়া আছে , একদল নেকড়ের
আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য।

গার্ড টি , ফিরলো ওর দিকে, ভ্রু কুঁ চকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো , সে কি চায়। গ্লাসের কারণে,
কথা ভালোমতন বোঝা গেলো না ।
192

ফ্রান্সিস্কো ভয়ংকর একটা হাসি দিলো , তারপর স্প্যানিশে চিৎকার করে বললো “ওয়ে ! কি খবর,
জারজের বাচ্চা !” বলেই গ্লাসের ওপর লোহার স্পাইকটা চালালো, একবার, বারবার। ওটা এমন
নারকীয়ভাবে গ্লাস ভেদ করে গেলো যে, ভেতরের গার্ড কেও বেশ কয়েকবার ভেদ করে গেলো
ওটা। বেচারা ওর চেয়ারেই বসে রইলো, মুখের ভেতরে স্যান্ডউইচ , খিঁচু নি দিচ্ছে থেকে থেকে, রক্ত
মিশে যাচ্ছে সেটার ম্যেওনিজ এর সাথে। ওর ঘাড়, মাথা, বুক বেয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে,
মারা যাবে অল্পক্ষণের মধ্যেই। একটু খানি সেই দৃশ্য দেখে, ভেতরে ঢু কে এলো ফ্রান্সিস্কো। ভেতরে ,
সে একটা তালা মারা কেবিনেট দেখতে পেলো। স্পাইক দিয়ে সহজেই সেটা খুলে, ভেতর থেকে
একটা দ্রুতগামী স্পোর্ট স কারের চাবি বেছে নিলো সে।

ওর মাথার ভেতরে সেই কণ্ঠটা আবার কথা বলে উঠলো – না ফ্রান্সিস্কো। চকচকে জিনিস দৃষ্টি
আকর্ষণ করবে, আর তু মি ওটা অনেক জোরে চালাবে। পুলিশ তোমার দেরী করিয়ে দিতে পারে,
এতো এতো পুলিশ মারার সময় নেই হাতে ! তোমাকে এমন একটা গাড়ি বেছে নিতে হবে,
যেরকমটা শহরের রাস্তায় সাধরণত চলাচল করে। ওই যে...... যেটার সামনে আঙ্গুল নিলে সুড়সুড়ি
লাগছে, সেটা নিয়ে নাও ।

হুম, একটু সাধারণ কিছু নিলেই ভালো , তাহলে পুলিশ খেয়াল করবে না।

মিনিট দুয়েক বাদে, ফ্রান্সিস্কোকে দেখা গেলো একটা নতু ন ভ্যান চালিয়ে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে...... কিন্তু
কোথায় ? এই বিশাল শহরে, উদ্দেশ্যহীন ভাবে কি ঘোরাঘুরি করবে সে ? ওটা কি ...... একটা
বেশ্যা ? সম্ভবত সে একটু মজা লুটে নিতে পারে.........

সময় নেই ওসবের। এখানে ডানে ঘোরো, ফ্রান্সিস্কো। এই রাস্তা ধরে আগাও কিছুটা, হ্যাঁ, এবার বামে
ঘোরো , আরও মাইলদুয়েক সামনে যাও......... ওই যে, ওই বিল্ডিঙটার দিকে যাও।

ওটাকে দেখতে একটা হাসপাতালের মতো লাগলো ফ্রান্সিস্কোর কাছে।


193

সে ওই সময় স্পাইকটা ধরে ছিল না সে , তাই সে সাইনবোর্ড টা পড়তে পারলো না যেটাতে লেখাঃ
রেভেন্সকার হসপিটাল।

রাতটা ইঞ্জিনের গুঞ্জনে ভর্তি ছিলো, ক্রোমিয়াম অরণ্যে বৈদ্যুতিক বাতির ঝলকানি , নিয়ন
বাতি বেরিয়ে যাচ্ছিলো সাঁই সাঁই করে একজস্ট পাইপের পেছনে। এসইউভি আর হামারের ঘোঁত
ঘোঁত , একটার অপরটার সাথে প্রতিযোগিতা, যেন জঙ্গলের পানির উৎসের দিকে ছুটছে একদল
গণ্ডার ! এঞ্জেলা আর কনস্টেনটিন , ঠিক একজোড়া চিতাবাঘের মতোই ছুটে যাচ্ছিলো লস
এঞ্জেলসের রাত চিরে। সরাসরি তাকাচ্ছিলো না কোনদিকে, কিন্তু সবকিছু সম্মন্ধেই ওয়াকেফহাল
ছিলো।

এঞ্জেলার এসইউভি টা এসে থামলো বিজিআর ব্রোকারেজের কাছে একটা স্টপ সাইনের কাছে।
সে মুখ তু লে তাকালো কালো , বিশাল বিল্ডিঙটার দিকে। এটা হলো সেইসব বিল্ডিঙদের একটা,
যেগুলো দেখলে মনে হয়, এগুলো চারপাশের সব ধরণের আলো শুষে নেয় ভেতরে ! অন্য
বিল্ডিঙগুলোর প্রতিবিম্ব দেখা যায় সেখানে, মনে হয়, সেখানে যেন আটকা পরে গেছে সেগুলো ।

সে পাশে বসে থাকা কনস্টেনটিনের দিকে তাকালো। ভীষণ গম্ভীর আর ফ্যাকাসে মুখে বসে আছে
ওর পাশে। ওর মনে হলো , ‘সোয়াট’ টিমের কথা বলবে কিনা । সে কোন একটা অজুহাতে,
কাছাকাছি পুলিশ স্টেশন থেকে ব্যবস্থা করতে পারে মুহূর্তে র মধ্যে। যদি এটা কাজ না করে, তবে
এটা ওর ক্যারিয়ার শেষ করে দেবে। কিন্তু তাতে আর কিইবা এসে যায় ? ও এ পর্যন্ত যা যা দেখেছে,
ওর মনে হয়েছে, পৃথিবীর অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে – যদি না ওরা দুজন সেটা থামাতে পারে। যে
কোন ঝুঁকি নেয়াই যায়।

কিন্তু সে জানে কনস্টেনটিন কি বলবেঃ পুলিশ ? ওরা কেবল এই ধরণের অপারেশনে বাঁধার সৃষ্টি
করবে ।
194

কিন্তু, সুযোগ থাকতে থাকতেই , ওর কনস্টেনটিনকে একটা প্রশ্ন করতেই হবে । “জন, যদি ইসাবেল
মানবজাতিকে বাঁচাবার জন্যই আত্তাহুতি দিয়ে থাকে, তবে ও নরকে গেলো কেন ?”

“তু মি হতাশা থেকে নিজের জীবন নিয়ে নিলে......... তোমাকে নরকেই যেতে হবে। আধ্যাত্মিক
পদার্থবিজ্ঞান। কোন বিশাল পরিকল্পনা নয়, স্রেফ নিয়ম। ” বিজিআর বিল্ডিঙের পার্কিং গ্যারেজের
দিকে ইঙ্গিত করলো সে “ওখানে, বামে ঢু কে যাও।”

গ্যারেজের ভেতরে, অনেকগুলি লেভেল উঠে যাবার পর, একটা জায়গা পেলো এঞ্জেলা। পার্ক
করলো সেখানে। কনস্টেনটিন ওর দিকে ঘুরে বসলো । ওর চোখ আটকে গেলো এঞ্জেলার চোখে।
পকেট হাতড়ে কি একটা জিনিস বের করে , এঞ্জেলার ঘাড়ের পেছনে দুই হাত নিয়ে গেলো সে।
দুজনের চিবুক ঠেকে গেলো প্রায়। মুহূর্তে র জন্য, একটা যৌন কামনার ঝলক যেন খেলে গেলো
দুজনেরই ভেতর। ওর হাত এঞ্জেলার ঘাড়ের পেছনে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলো।

বেশ অদ্ভু ত একটা জায়গা বেছে নিয়েছে যা হোক ! ভাবছিলো সে। কিন্তু এটাই হয়তো শেষ সুযোগ
ওদের জন্য, এই ধরণের স্মৃতি তৈরি করে নেয়ার জন্য। ওরা দুজন এই বিশাল স্টিল আর কাঁচের
বিল্ডিং এ প্রাণ হারানোর আগে। হয়তো .........

তখনই, কনস্টেনটিন সোজা হয়ে বসলো। ওকে আর ছুঁ চ্ছেই না একদম। এঞ্জেলা দেখলো, হেনেসির
এমুলেটটা বেঁধে দিয়েছে সে এঞ্জেলার গলায়।

ও বুঝতে পারলো , ও ওর মানসিক ক্ষমতা’কে আবার সংক্ষেপিত করে ফেলেছে। নাহলে সে


বুঝতে পারতো , কনস্টেনটিন কি করতে চলেছে। কিন্তু , একটা দিক দিয়ে তো সে ঠিকই ছিলো।
কেবল সময়ের একটা ব্যাপার ছিলো , এই আর কি। ওদের মধ্যে, ব্যাক্ত করা যায় না সে ধরণের
একটা অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়ে গেছে এর মধ্যে। ও জানে, কনস্টেনটিন সেটাকে ভয় পাচ্ছে – কিন্তু সে
একইসাথে আরও জানে, এটাই ঠিক মনে হচ্ছে ওর কাছে। ওরা, কোন একভাবে – একে অপরের
সাথে খাপ খেয়েই যায় !
195

কনস্টেনটিন নড করলো এঞ্জেলার বুকের ওপর ঝু লতে থাকা এমুলেটটার দিকে “মনে করো ওটা
একটা বুলেত-প্রুফ ভেস্ট !”

“আমি ওপরে যাবো ?” জিজ্ঞেস করলো এঞ্জেলা।

“তু মি গাড়িতেই থাকবে ” কঠিন স্বরে বললো কনস্টেনটিন।

এঞ্জেলা একটু ক্ষণ ভাবলো এটা নিয়ে। এটা কি মেল সৌভনিজম ? নাকি এটা একজন
বিশেষজ্ঞের হাতে পরিস্থিতির দায়িত্ব তু লে নেয়া – যেরকম একজন হোমিসাইড ডিটেকটিভ , দায়িত্ব
তু লে নেয় ইউনিফর্ম পরা পুলিশদের হাত থেকে।

সম্ভবত এ ব্যাপারে কনস্টেনটিনই ঠিক। এঞ্জেলা হয়তো ওর কথাই মেনে নেবে, হয়তো না।

ও ওর মানসিক শক্তির এন্টেনা দিয়ে অনুভব করতে চাইলো , যখন কনস্টেনটিন গাড়ি থেকে বের
হলো। ও বুঝতে পারলো, সেখানে ওর জন্যও খানিকটা কাজ বাকি আছে।

বালথ্যাজার দাঁড়িয়ে আছে , বিজিআর ব্রোকারেজ এর একটি এক্সিকিউটিভ বাথরুমে।


নিজের কলার, চু ল আর চেহারা ঠিকঠাক করছিলো। একটা ঝকঝকে পরিষ্কার আয়না, স্টিলের
ফ্রেমঅলা , পরিপাটি টাইলস আর লাইটিং ।

ও ভাবছিলো, এটার নারকীয় সংস্করণ দেখতে কেমন হবে। ও পার্থিব সংস্করণের জিনিসপত্র
দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। সুন্দর পরিষ্কার বাথরুম, মাঝে মাঝে, মেঝে থেকে মানুষের
খুলি বের হয়ে থাকা ছাড়া ! ঝর্ণা, যেগুলো আঠালো কাদা উদ্গিরণ করে না। মানুষজন, ঘা,
পোকামাকড় আর অন্তহীন দুঃখে মোড়ানো নয় , এমন।

ও এখানে থাকতে থাকতে থাকতে সম্ভবত দূষিত হয়ে যাচ্ছে বলে তার মনে হলো। ‘দ্যা বস’ এটা
পছন্দ করবেন বলে মনে হয় না।
196

তবুও, এটা ওর কাছে একদমই ঠিক মনে হলো না। যে , এই পুরো জগতটা স্রেফ নরকের
আরেকটা স্তরে পরিণত হবে ! এখানকার যা কিছু , সবকিছু ছাতা পড়া, ধ্বংসপ্রাপ্ত আর ধর্ষিত
কোন শিশুর মতো কলুষিত হয়ে যাবে !

তবে, এই ধ্বংসকাণ্ডে ওর অংশটা নিয়ে ও বেশ মজা লুটবে। ওহ হ্যাঁ, বেশ অনেকখানি মজা হবে
তখন ......... সেইসব খুন, নষ্টামি আর মরুভূ মির মতো আদিগন্ত কষ্টের সমুদ্র – সেটা ওর জন্য
বেশ অনেকখানি সান্ত্বনা বয়ে নিয়ে আসবে।

ও ঘুরতে শুরু করলো নিজের প্রতিবিম্বের দিক থেকে -- তারপর আবার ফিরে তাকালো। ওর
প্রতিচ্ছবিটা মুহূর্তে র জন্য খানিকটা বিকৃ ত হয়ে গেলো , তাই না ?

ওটা কি ওর ভেতরের পিশাচটাকে , একটু ক্ষণের জন্য হলেও দেখিয়ে ফেলেছিলো ? এটা তো
চলতে দেয়া যায় না ।

ওটা কারণ হতে পারে না। ও তাকিয়ে থাকতে থাকতেই , ওর মনুষ্য চেহারা ভীষণভাবে বিকৃ ত হয়ে
গেলো। ওর সত্যিকারের পৈশাচিক সত্ত্বা যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে , যেন কোন মানুষের
আসল চেহারা বেরিয়ে পড়তে চাইছে রাবার মাস্কের আড়াল থেকে ।

মন্ত্রটা নিশ্চয়ই দুর্বল হয়ে পড়েছে ! এখন, এটা কিভাবে ঘটতে পারে ? এটা কি একটা নির্দি ষ্ট
ঝামেলাবাজ, ঘাড়তেড়া , অনেকগুলি ট্যাটু আঁকা কোন মানুষের কাজ, যার নাকি অনেক আগেই
মরে যাওয়ার কথা ছিলো ?

বালথ্যাজার মুখ দিয়ে অদ্ভু ত একটা শব্দ করে, চেহারায় হাত বুলালো । আয়নার আরও কাছে
গিয়ে দেখতে লাগলো সে। সম্ভবত ওর কোন ভু ল হচ্ছে .........

তখনই, ওর চেহারায় ঢেউ খেলে গেলো কয়েকটা, যেন তরলে পরিণত হচ্ছে সেটা। আয়নার
সার্ফে সটাতেও যেন অনেকগুলো ফোসকা পরে গেলো, কাঁপতে লাগলো সেটা।

তারপর ওটা বাইরের দিকে বিস্ফারিত হলো !


197

আয়নার ভেতর থেকে একটা আগুনে গোলা বেরিয়ে এলো, সাথে আনলো গ্রেনেডের শ্রাপনেলের
মতো আয়নার শত টু করো। বালথ্যাজারকে আঘাত করলো সেগুলো, ধুম করে পেছনের দেয়ালে
নিয়ে ফেললো । মেঝে দিয়ে গড়িয়ে গেলো সে খানিকটা, ওর পার্থিব দেহ স্থির হয়ে গেলো। ওর
চারপাশে আগুন নাচানাচি করতে লাগলো । আগুন ?

“আগুন !” রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে “আমি তো আগুন থেকেই জন্মেছি !”

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চারপাশে তাকাতে লাগলো সে, কার এতো সাহস ?

তারপর , সে দেখতে পেলো একটা ছায়াচ্ছন্ন অবয়ব, ঠিক যেখানে আয়নাটা ছিলো, সেখানে।
ওটার পেছনে একটা করিডোর ছিলো , আর সেখানেই এখন দাঁড়িয়ে আছে – আর কেউ নয় স্বয়ং
কনস্টেনটিন ! ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা, হাতে শটগানের মতো কিছু একটা ধরা।
দাঁড়িয়ে আছে একটু আগে ঠিক যেখানে বালথ্যাজারের চেহারা দেখা যাচ্ছিলো , সেখানে।

এক মুহূর্তে র জন্য মনে হলো , ওটা যেন বালথ্যাজারেরই প্রতিবিম্ব, নকল করে মুখ ভ্যাংচাচ্ছে
ওকে !

“কেমন করছি আমি ?” কনস্টেনটিন শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো । দেয়ালের অবশিষ্টাংশটা লাথি
মেরে, ঢু কে এলো বাথরুমে।

কনস্টেনটিন সন্তুষ্টির একটা খোঁচা অনুভব করলো। কারণ বালথ্যাজার পরে আছে ওর স্মার্ট
বাথরুমের ধ্বংসস্তূ পের ভেতর, স্যুট কোট ছেঁ ড়া, ধোঁয়া উড়ছে গা থেকে। আর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। তু মি
যদি ওকে খেপিয়ে দিতে পারো, তবে ধরে নিতে হবে তু মি ওকে পেয়ে বসেছ।

কিন্তু ওটা যথেষ্ট ছিলো না, বালথ্যাজারকে হেনেসির কাছে , বী ম্যানের কাছে জবাবদিহি করতে
হবে। আর, ঈশ্বর জানেন আরও কতজনের কাছে !
198

“ম্যামন কিভাবে সীমা অতিক্রম করার প্ল্যান করেছে ?” গর্জে উঠলো কনস্টেনটিন “ব্যাটা
দোআঁশলা জারজের বাচ্চা !”

বালথ্যাজার গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছিলো ওর দিকে লাফ দেবে বলে। কিন্তু কনস্টেনটিন এর
মধ্যেই একটা কাঁচের বাল্ব ভর্তি হোলি ওয়াটার ছুঁ ড়ে দিয়েছে ওর দিকে। এটা সরাসরি ওর মুখে
আঘাত করলো , বেশিরভাগটাই স্রেফ পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। কারণ হোলি ওয়াটার সমস্ত অপবিত্র
ফাঁকি ফক্কিকারি নিমিষে দূরে ছুঁ ড়ে দেয়, আর নারকীয় ফাঁকি সবসময়ই অত্যন্ত অপবিত্র হয়। নরকের
অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের এক পিশাচ তার চামড়া বহুল , পৈশাচিক দাঁত বের করে, ভয়ঙ্করভাবে
হাসলো ওর দিকে তাকিয়ে............

বালথ্যাজার তার পুরানো মনুষ্য চেহারা সম্পূর্ণ ত্যাগ করে, লাফ দিলো কনস্টেনটিনের উদ্দেশ্যে।
শটগানটা একপাশে ঝাপটা মেরে সরিয়ে দিলো, শরীর দিয়ে ধাক্কা দিলো ওর মানুষ শিকারের গায়ে।

কনস্টেনটিন দেয়ালের সাথে বাড়ি খেলো। পিশাচটার চামড়া আর নখবহুল হাত ওর ঘাড়ের
আশেপাশে অনুভব করলো সে। ওর গলা দাবিয়ে ধরেছে ওটা, ওর সামনে কেবল পিশাচটার খুনে
উল্লসিত দৃষ্টি ভাসতে লাগলো !

এঞ্জেলা মনঃস্থির করে ফেললো ।

এটা কেবল মেল সৌভনিজম এর ব্যাপার নয়। ওর মনে হচ্ছিলো – কনস্টেনটিনের ওর প্রয়োজন
পড়েছে। ‘উচ্চ কোন পর্যায় থেকে কোন গাইডলাইন’ যেরকমটা কনস্টেনটিন ওকে
বলেছিল............

‘আমারও এক সময় ছিলো সেটা। তারপর, আমি ওটা হারিয়ে ফেলি। সম্ভবত আমি যখন হতাশ
হয়ে গেছিলাম, আর কোন দিক থেকে কোন সাহায্য এলো না, আর......... আমি আমার কব্জি কেটে
নরক থেকে ঘুরে এলাম। আমি পাগলপ্রায় হয়ে গেলাম, আর ওই ভীষণ রাগ ভেদ করে ওটা আমি
199

পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারতো না। গ্যাব্রিয়েল যে ধরণের গাইডলাইন দেয়, সেরকম কিছু না। কিন্তু আমি
জানি এটার অস্তিত্ব আছে, বাছা ! সেন্ট ফ্রান্সিস, রামকৃ ষ্ণ , রুমি, তেরেসা অব এভিলা – ওইসব
মহামানবেরা , এই ধরণের গাইডলাইন নেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন ! আর, আমার মনে হয়, ওসব
পাবার পক্ষে আমার যথেষ্ট দেরী হয়ে গেছে। কিন্তু...... তোমার জন্য বেশী দেরী হয়নি এখনও।
এটা...... এক ধরণের আধ্যাত্মিক জগতের দরজা খুলে যাওয়ার মতো , অনেক ওপরের জগতের
সাথে যোগাযোগের দরজা। মহাজাগতিক রশ্মির সাথে সংযোগ স্থাপন, আর এটা পুরোটাই হলো
শক্তির রুপান্তর নিয়ে ব্যাপারস্যাপার , বুঝলে ? কিছু কিছু শক্তি আছে , বুদ্ধিমান ! ওদেরকে খুঁজে
বের করে, তোমার গাইড হিসাবে বেছে নাও। তু মি জানো...... যা কিছু হয়ে যাক না কেন পরে..... ’

এঞ্জেলা এতক্ষণ ধরে গাড়ির ভেতরে বসে, সেটাই করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো । টের পাচ্ছিলো ,
একটা দূরাগত শিহরণ । কোথা থেকে যেন ভেসে এসে, ওকে ঠাণ্ডা কবলিত কোন দিনে উষ্ণ
আদরের মতো বয়ে যাচ্ছিলো ওর ওপর – দাঁড়াও এক মিনিট ! ওর মনে হলো, ও যেন একটা কণ্ঠ
শুনতে পেলো, না না , কোন কণ্ঠ নয় -- ওর মনে হলো , একটা বিশুদ্ধ সমঝোতা যেন আদানপ্রদান
হলো !

তোমার ওকে সাহায্য করতে হবে, এক্ষু নি !!

তো, ও বের হয়ে এলো গাড়ি থেকে। বন্দুক চেক করলো, ঠিক আছে। সম্ভবত, কোন এক ছোট্ট
শয়তানের সাহায্যে, ও জ্যাকেটটা খোলার সময়, গলার এমুলেটটার চেন ছিঁ ড়ে গেলো। জ্যাকেটটা
গাড়ির ভেতরে ছুঁ ড়ে ফেললো সে, সেটার সাথে রয়ে গেলো এমুলেটটাও রয়ে গেলো সেখানে।
সেটা রয়ে গেলো সেখানেই, এঞ্জেলা রওনা হলো বিল্ডিঙের দিকে – খেয়াল করেনি ।

সিঁড়ি ভাঙ্গার সময় আবার মনে পড়ে গেলো ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা .........

ও আর ইসাবেল , ছোটকালে , একটা পার্কে খেলা করছিলো। সি-সো মেশিনে চড়ছিল ওরা,
অনেক অনেক ওপরে উঠে যাচ্ছিলো। খিলখিল করে হাসছিল , আর বালি ছুঁ ড়ে মারছিল একে
অন্যের দিকে।
200

হঠাৎ ইসাবেল নেমে দাঁড়িয়ে, ঘুরে একজন লোকের দিকে তাকিয়ে রইলো। একটা মোটা, ন্যাড়া
লোক, ট্রেঞ্চ কোট পরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দিকে তাকিয়ে আছে সদয় হাসি , কিন্তু মরা চোখ নিয়ে
! সেই একই অভিব্যাক্তি, যে লোকটাকে এঞ্জেলা অনেক বছর পরে, ইকো পার্কে গুলি করেছিলো ,

হুবহু সেরকম !

এঞ্জেলা আর ইসাবেল লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ঠিক যেন একটা মাকড়শা তাকিয়ে আছে
তার শিকারদের দিকে, আর শিকারেরা আটকে গেছে গাছের আঠায় !

সেই ক্ষণিকের তাকিয়ে থাকাটাই মনে হলো , অনন্তকাল লম্বা............

আর তারপর, মাকড়শাটা এগিয়ে এলো ওদের দিকে। এঞ্জেলা এরপর দেখতে পেলো আরেকটাকে
– ওটাকে প্রথমে দেখা যায়নি । কোন মানুষের ওরকম চেহারা থাকতে পারে না। গম্ভীর,
চামড়াবহুল, আর নাল পড়া মুখ। ঠিক যেন একটা লোভী বাচ্চার সামনে হ্যালোউইনের পরের
সকালে চকলেটের থলে রাখা হয়েছে ! সে কোন না কোন ভাবে খাবার খাবেই, যদি সে সামনের
লোকটাকে প্ররোচিত করতে পারে সেই কাজ করতে, যেটা ওই লোকটা আগেও করেছে.........

এঞ্জেলা আর ইসাবেল দুজনেই এরপর দেখতে পেলো -- সেই লোকটা এর আগে যা করেছে সেটার
একটা ঝলক। মেইনে – একটা একাকী সি বীচে একটা তের বছর বয়সী মেয়েকে গলা টিপে মেরে
রেখে এসেছে লোকটা.........

‘আশেপাশে কেউ নেই ’ পিশাচটা ফিসফিস করে বলছে সামনের লোকটাকে ‘আমি হলফ করছি
সেটা। তু মি আর ওই দুটো ক্ষু দে মেয়েছেলে ছাড়া ’

কিন্তু ওই লোকটা সেভাবে পিশাচটার কথা শুনল না , যেরকমটা এঞ্জেলা শুনেছে। ওর কাছে সেটা
কেবল একটা আত্মিক তাড়না হয়ে ধরা দিলো, অবচেতন মনে সেটা বুদ্বুদ তু ললো সামনে আসার
জন্য। কিন্তু এঞ্জেলা আর ইসাবেল স্পষ্ট শুনলো , পিশাচটা লোকটাকে বলছে ওদেরকে মেরে
ফেলার জন্য।
201

‘ওরা দৌড় দেয়ার আগেই’ হিসহিস করে উঠলো পিশাচটা , লোকটাকে তাড়া দিয়ে চলেছে ।
তারপর ভ্রু কুঁ চকে তাকালো দুই বোনের দিকে, বুঝতে পেরেছে , এদের ওকে দেখার মতো
আধ্যাত্মিক দৃষ্টি আছে ! ‘ধরো ওদেরকে’

লোকটা এবার আসতে শুরু করলো ওদের দিকে। পকেটে হাত দিলো, দড়ি আর ক্লোরফরম বের
করার জন্য।

‘ওখানে একটা পিশাচ দাঁড়িয়ে আছে , আপনাকে বলে দিচ্ছে কি করতে হবে, মিস্টার ’ ইসাবেল
বলে উঠলো ‘ও আপনার ঠিক পেছনে, বাম দিকে দাঁড়িয়ে আছে......’

লোকটা চোখ পিটপিট করে তাকালো। পেছনে তাকানোর ঝোঁকটা সামলাতে পারলো না সে। ও
কি কোনভাবে একটা কু ৎসিত খেঁকিয়ে ওঠা চেহারা দেখতে পেয়েছে ?

লোকটার দ্বিধা ওদেরকে সময় পাইয়ে দিলো। “দৌড়াও !” এঞ্জেলা চিৎকার করে উঠলো। তারপর
নিচু হয়ে মাটি থেকে একগাদা বালি তু লে ছুঁ ড়ে মারলো মোটা লোকটার চোখে। তারপর দুই বোন
ঝেড়ে দৌড় দিলো। খেলার মাঠের গাছপালা আর খেলার সামগ্রীর মধ্যে দিয়ে দৌড়াতে লাগলো
আর সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে লাগলো দুই বোন।

লোকটা রাগে নিজের চেহারা আঁচড়ে রক্তাক্ত করে ফেলচে,আর চিৎকার করছে। এঞ্জেলা এটা না
ফিরেও শুনতে পেলো। তারপর লোকটা নিজের গাড়ির দিকে ফিরে গেলো।

মেয়ে দুটো ফিরে গেলো বাবা মায়ের কাছে হাঁফাতে হাঁফাতে। চেহারা সাদা হয়ে গেছে ভয়ে, কিন্তু ওরা
এমন ভাব করলো যেন কিছুই হয়নি ।

“পুলিশকে একটা রিপোর্ট দেয়া দরকার ছিলো” বর্ত মানের এঞ্জেলা বিড়বিড় করে বললো । দরজা
খুলে সিঁড়ি বেয়ে যেতে যেতে।
202

কিন্তু এই স্মৃতিটা এখন ফেরত আসার একটা কারণ আছে। ও যখন ওই পিশাচটাকে দেখেছিলো,
ওর মনে হয়েছিলো , ওকেও কেউ নেপথ্যে থেকে কিছু একটা বলছে ! অন্য একটা কিছু। যেটা ও
চোখে দেখতে পায় না, সেরকম কিছু .........

ওপরে...... কোথায় তু মি কনস্টেনটিন ?

ও প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। বালথ্যাজার সময় নিচ্ছিলো , কনস্টেনটিনের ধীরে ধীরে
মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া উপভোগ করছিলো। ওটাকে আরও কয়েক সেকেন্ড দীর্ঘায়িত করতে
চাইছিলো সে। উল্লাসের সাথে দেখছিলো পিশাচটা , যদিও কনস্টেনটিন বলতে পারবে না – ওটা
সে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে শুনছে , নাকি সত্যি সত্যি শুনছে –

“এই তো , কনস্টেনটিন, একটু বাতাস টেনে নাও – আমি আমার হাত আলগা করছি একটু ।
এরপর আবার গলা টিপে বাতাস বের করে দিচ্ছি......... এখন , আরও একটু বাতাস নাও। এখন,
আমি আবারও গলা দাবাবো – আর এবার , কাজটা সম্পূর্ণ করবো আমি !”

কনস্টেনটিন এতো দুর্বল হয়ে পড়েছে যে......... তৈরি হয়ে গেছে সে হাল ছেড়ে দেয়ার জন্য।
সম্ভবত , ও ওর কাছের বন্ধু দের রক্ষা করতে না পারার মাশুল দিতে যাচ্ছে অবশেষে।

সেটাই , কনস্টেনটিন -- বালথ্যাজারের কাছ থেকে এলো কথাটা – টেলিপ্যাথিক , অবশ্যই।


তোমার টিকে থাকার কোন অধিকার নেই – হাল ছেড়ে দাও...... আর ওষুধ খেয়ে নাও !

ওটাই ছিলো বালথ্যাজারের ভু ল। ওর সেই উল্লাস দৃষ্টি, কনস্টেনটিনকে রাগে অগ্নিশর্মা করে
তু ললো নতু ন করে। প্রচণ্ড ক্রোধের একটা ঢেউ , সাথে করে নিয়ে এলো অমানুষিক শক্তি। ওর
কোটের পকেট থেকে একটা নির্দি ষ্ট পুরাতাত্ত্বিক জিনিস বের করে আনার জন্য যথেষ্ট ছিলো সেটা।

সেই পবিত্র সোনার তৈরি ব্রাস-নাকল, যেটা বী ম্যান দিয়েছিলো ওকে। ওর ডান মুঠিতে পরে নিলো
সেটা ---
203

শক্ত মুঠিতে আঘাত হানলো সে, পিশাচটার মাথার ডানপাশে। সেটার ভেতরের পবিত্র শক্তি –
বালথ্যাজারকে ঘুষির শক্তির চাইতে অনেক বেশী জোরে আঘাত করলো। কনস্টেনটিনের বাম
পাশে গড়িয়ে পরে গেলো পিশাচটা।

বাতাসের জন্য খাবি খেতে খেতে, ওর সদ্য পাওয়া সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য মরিয়া
কনস্টেনটিন উঠে পড়লো পিশাচটার গায়ের ওপর। চেহারাটা ওর নিজের দিকে ঘুরিয়ে, ঘুষির পর
ঘুষি মেরে চললো ‘পবিত্র ব্রাস-নাকল’ দিয়ে। পিশাচটার সারা শরীর কেঁ পে কেঁ পে উঠছিল
প্রত্যেকটা আঘাতের সাথে সাথে। প্রত্যেকটা আঘাতের সাথে সাথে , মরণশীল জগতের সাথে
পিশাচটার বাঁধন শিথিল হচ্ছিলো ক্রমশ।

গরগর করতে থাকা নরকের কীটটাকে আঘাতের পর আঘাত করে চললো সে, আর প্রত্যেকটা
ঘুষির সাথে সাথে চিৎকার করতে লাগলোঃ

“ওরা -- !”

ধুম !

“--- ছিলো !”

ধুম !

“—আমার !”

ধুমম !!

“--- বন্ধু !”

কনস্টেনটিনের ডান হাত ক্লান্তিতে অবশ হয়ে এলো। তাই ও এবার নাকল- ডাস্টার’টা বাম হাতে
পরে নিলো । তারপর চালিয়ে গেলো ঘুষি-বৃষ্টি। প্রত্যেকটা ঘুষির সাথে সাথে ওর মনে হচ্ছিলো , ও
পিশাচটার আত্মিক কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও চর্ম চক্ষে দেখা যাচ্ছে চামড়া আর মাংস
204

ফেটে যাচ্ছে, রক্ত উড়ছে বাতাসে। কিন্তু কনস্টেনটিনের মনে হচ্ছে , ও একটা হাতু রি দিয়ে, চু ম্বক
প্রতিরোধী জায়গায় আঘাত করে যাচ্ছে বারংবার। টের পাচ্ছে , পিশাচটার আত্মাটা , ক্ষয়ে যাচ্ছে
আস্তে আস্তে পৃথিবী থেকে। বাহ্যিক রূপটা মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, স্বচ্ছ একটা আকার ধারণ
করছে ওর শরীর।

শেষমেশ থামলো কনস্টেনটিন । বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে লাগলো সে, ঘাম ঝরছে
টপটপ।

বালথ্যাজারকে দেখে মনে হচ্ছিলো , অন্তিম শ্বাস নিচ্ছে সে নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে, চর্ম চক্ষে
সেটা দেখতে সেরকমই লাগছিলো।

“আমি......... খুব তাড়াতাড়িই তোমাকে দেখব ” খরখরে স্বরে বললো পিশাচটা।

“নাহ ! দেখবে না !” উঠে বসে বললো কনস্টেনটিন, পকেট হাতড়াচ্ছে অন্য আরেক ধরণের অস্ত্রের
জন্য ।

“তু মি এবার আর ফাঁকি দিতে পারবে না ” বালথ্যাজার গর্জে উঠলো চাপা স্বরে “তু মি নরকে
ফেরত যাচ্ছ, কনস্টেনটিন !”

“সত্যি। কিন্তু তু মি যাচ্ছ না ” বললো কনস্টেনটিন।

পিশাচটার চোখ বড় বড় হয়ে উঠলো । এটা দিয়ে ও কি বোঝাতে চাইলো ?

কনস্টেনটিন ওর পকেট থেকে ধীরে ধীরে বের করলো একটা ছোট্ট কালো বক্স। যেটা ওর
এপার্ট মেন্টে একটা বিশেষ তাকে সংরক্ষণ করতো সে। আর বালথ্যাজার তাকিয়ে রইলো ওর
চেহারার অবশিষ্টাংশের ভেতর দিয়ে। কনস্টেনটিন যাই প্ল্যান করে থাকু ক না কেন, সেটার বিরুদ্ধে
শক্তি সঞ্চয় করতে লাগলো। ও নিজেকে নির্লিপ্ত রাখতে চাইলো যখন কনস্টেনটিন বক্স থেকে বের
করে আনলো একটা অস্ত্র, যেটা ও খুব কমই ব্যাবহার করেঃ দ্যা বাইবেল।
205

“কি করছো তু মি ?” বালথ্যাজার বলে উঠলো , উঠে বসতে চাইলো সে। কনস্টেনটিন ধাক্কা দিয়ে
ওকে ফেলে দিলো আবার।

“তোমার শেষকৃ ত্য করছি ! ” বলে উঠলো সে।

বালথ্যাজার ওর থেঁতলে যাওয়া ঠোঁট চেটে বলে উঠলো “তোমার আরোগ্যকারী মন্ত্র , আমাদের
প্রজাতির ওপর কাজ করবে না ! ”

“তু মি কি অর্ধেক মানুষ নও ?” কনস্টেনটিন বললো শান্তভাবে। যেন খুব ভদ্রভাবে কারো জাতিসত্বা
কি, সেটা জিজ্ঞেস করছে।

বালথ্যাজার জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো । ওরা দুজনেই জানে, সে আত্মিকভাবে পিশাচ,
দৈহিকভাবে আংশিক মানুষ।

“দ্যাখো ” যেন রবিবারের চার্চে কোন বাচ্চাকে বোঝাচ্ছে , এমন ভঙ্গিতে বলে চললো কনস্টেনটিন
“এটা তোমাকে ক্ষমার যোগ্য বানিয়ে তোলে। তু মি তো জানোই, পুরোপুরি ক্ষমা পাওয়ার অর্থ কি?
ঈশ্বরের রাজধানীতে পা রাখার যোগ্য হওয়ার মানে কি ? ”

বালথ্যাজার ঢোঁক গিললো একটা । কনস্টেনটিন আনন্দের সাথে, এইমাত্র স্পষ্টভাবে যেটা বললো,
সেটা প্রত্যেক পিশাচের কাছে ভয়ংকরতম দুঃস্বপ্ন !

কনস্টেনটিন হাসলো শব্দ করে।

“একটা পিশাচ, স্বর্গে !” মজারু সুরে বললো সে। চিন্তা করেই আনন্দ পাচ্ছে সে। কণ্ঠে বিদ্বেষ ঝরে
পড়লো ওর “ওই দেয়ালের মাছি হতে পারলে খুব ভালো লাগবে ”

“তু মি কোন পাদ্রী নও ” বালথ্যাজার প্রতিবাদ করলো , ওর কণ্ঠে মনুষ্যসুলভ ভয় প্রকাশ পেলো
“তোমার কোন ক্ষমতাই নেই !”
206

“নেই ?” কনস্টেনটিনের হাসি ক্ষু রধার হয়ে উঠলো “আমি নরক থেকে পালিয়ে এসেছি – এরকম
আর কাকে দেখেছ , যার ওটা করার ক্ষমতা আছে ?”

বালথ্যাজার--- কনস্টেনটিনের আক্রমণ আর নড়বড়ে আধিভৌতিক জগতের মাঝখানে পড়ে


টলোমলো অবস্থা ওর। ভাবছে, পিশাচেরা কেবল নরকে যায়, তাই না ?

কনস্টেনটিন, হাতে ব্রাস-নাকল উদ্যত, ওর সরীসৃপ সুলভ চোখের দিকে তাকিয়ে বললো
“আমাকে স্রেফ বলো ম্যামন কিভাবে আমাদের জগতে আসতে চাচ্ছে, তাহলে তু মি তোমার
ময়লার গর্তে চলে যেতে পারবে ......”

বালথ্যাজারের চেহারা শক্ত হয়ে গেলো। শয়তানের পুত্রের সাথে বেঈমানি করে এই ক্ষণজীবী
জাদুকরকে খুশি করবে ? নাক দিয়ে শব্দ করলো সে।

কনস্টেনটিন কাঁধ ঝাঁকিয়ে , উঠে দাঁড়ালো। বাইবেলের সেই পৃষ্ঠাটা খুললো যেটা আগেই নির্দি ষ্ট
করে রেখেছিলো। “ঈশ্বর তোমার ওপর সদয় হন , আর ক্ষমা করে দিন তোমার সকল পাপ......”

ও একটা হাত রাখলো বালথ্যাজারের কপালের ওপর। পিশাচটা খুনে দৃষ্টিতে তাকালো , আর
আদেশ দেয়ার ভঙ্গিতে উঁচু তে চড়ে গেলো কনস্টেনটিনের গলা।

“তু মি পৃথিবীতে যাই পাপ কাজ করে থাকো না কেন, স্বর্গে সেসব সকল কিছুই ক্ষমা করে দেয়া
হবে। আমি তোমাকে মুক্ত করছি ............”

“এটা এমনকি কাজ নাও করতে পারে !” বালথ্যাজার বাদ সাধলো , যাতে কনস্টেনটিনের স্থির
নিশ্চিত বাইবেল আওড়ানোতে বাধা পড়ে। পিশাচটার এর মধ্যেই আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার
জোগাড় হয়ে গেছে।

কনস্টেনটিন একটু থামলো। হাসলো ভয়ঙ্করভাবে । তারপর বালথ্যাজারের দিকে তাকিয়ে বললো
“ও কিভাবে করছে সেটা ?”
207

বালথ্যাজারের চোখ ঘুরতে লাগলো পালাবার রাস্তার খোঁজে । কিন্তু আঘাতে আঘাতে জর্জ রিত
হয়ে আছে সে, একদম শক্তিহীন হয়ে পড়েছে।

কনস্টেনটিন নড করে , আবার পড়া শুরু করলোঃ

“তোমার সন্তানকে , তোমার রাজধানীতে প্রবেশের অনুমতি দাও.........”

বালথ্যাজার রীতিমতো মোচড়াতে শুরু করেছে। হাহাকার করতে শুরু করলো সে, অনুভব করতে
পারছে, স্বর্গে যাবার দরজা আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করেছে ওর জন্য !!

কনস্টেনটিনের কণ্ঠে দৃঢ় ভঙ্গিমা আর ওর নিষ্ঠার সাথে করা আচার দেখে, ওর বিশ্বাস হতে শুরু
করলো – ও হয়তো সত্যি সত্যি ক্ষমা পেতে যাচ্ছে ! ওহ, ঈশ্বরের ক্ষমা পেয়ে নিরবিচ্চিন্ন শান্তির
প্রদেশে যাওয়া যে কি ভয়ংকর ! সেই নিঃশব্দ প্রশান্তি, আত্মার কোণায় কোণায় ছড়িয়ে যাওয়া সেই
ভীষণ অসহ্য আলোর কণা !

কনস্টেনটিন বলে চলেছেঃ

“......... সেই পরমপিতার নামে ......”

না ! ওই তো গেট খুলে যাচ্ছে ! ওই আলো, যেটা সবই দেখতে পায় , ওর ভেতরে প্রবেশ করতে
শুরু করেছে—অপেক্ষা করছে কিছু একটার !

পিশাচটি নিজেকে মহাবিশ্বের এক প্রান্তে অনুভব করলো , সেই মহাজাগতিক প্রান্তসীমা -- যেটা পার
হয়ে গেলে, তু মি ওপরে উঠে যাবে ! সেখান থেকে যদি তু মি পড়ে যাও, তু মি ওপরে উঠে যাবে, নিচে
নয় ! ও কিছুতেই ওপরে যেতে চায় না !

“...... আর সেই পুত্র ” কনস্টেনটিন বলেই চলেছে “আর সেই পবিত্র .........”
208

“সাঙ্গরে ডে ডিও !” বালথ্যাজার চিৎকার করে উঠলো , ওকে বাধা দিয়ে। কনস্টেনটিনকে থামাতে,
যে কোন কিছু বলতে রাজী আছে । কিন্তু ম্যামন না জানি ওর কি অবস্থা করবে – যখন সে
জানতে পারবে যে সে কনস্টেনটিনকে গোপন তথ্যটা দিয়ে দিয়েছে !

আর, কনস্টেনটিন তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কথাটা হজম করার চেষ্টা করছে । ও কি বললো ?
সাঙ্গরে ডে ডিও ?

বালথ্যাজার নড করলো “ঈশ্বরের রক্ত !”

“কিভাবে ?” কনস্টেনটিন বললো। বাইবেল হাতে নিয়ে হুমকি দিলো পড়া শুরু করার।

বালথ্যাজার গুঙিয়ে উঠলো “ঈশ্বরের পুত্রকে যেটা হত্যা করেছে, সেখান থেকেই শয়তানের পুত্র
জন্ম নেবে !”

কনস্টেনটিন অবশেষে বুঝতে পারলো। যীশুখ্রিস্টের রক্ত ! সেই খুলিগুলোর কাছ থেকে......

সে বইটা বন্ধ করলো । শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো বালথ্যাজারের দিকে। “যাই হোক – ওরা আসলে
তোমাকে ভেতরে ঢু কতে দিতো না । তোমাকে পাপমোচনের জন্য প্রার্থনা করতে হতো – ব্যাটা
জারজ কোথাকার !”

বালথ্যাজারকে দেখে মনে হলো , পারলে কনস্টেনটিনকে এখনই টু করো টু করো করে ফেলত। কিন্ত,
এরপর সে কনস্টেনটিনকে ছাড়িয়ে পেছনে তাকালো......... আর হাসলো ওর রক্তমাখা ভাঙ্গা শ্বদন্ত
বের করে “আমার কাজ শেষ !”

চোখ রাঙ্গালো কনস্টেনটিন “কার দিকে তাকিয়ে হাসছিস তু ই ?”

“ওর দিকে” বালথ্যাজার তাকিয়ে আছে এঞ্জেলার দিকে “তু মি ওকে সরাসরি আমাদের কাছে
নিয়ে এসেছ !”
209

খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো এঞ্জেলা, হাঁ করে তাকিয়ে আছে বালথ্যাজারের দিকে। চোখ বড় বড়
হয়ে গেছে। হাতে ধরা ভু ল ধরণের বন্দুক। চারপাশের ধ্বংসস্তূ প, আগুন আর বালথ্যাজারের দিকে
এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে সে।

কনস্টেনটিন চাইলো না বালথ্যাজার কোন অভিশাপ ছুঁ ড়ে দিক এঞ্জেলার দিকে। সে চট করে
শটগানটা তু লে নিলো হাতে, আর উড়িয়ে দিলো বালথ্যাজারকে, আক্ষরিক অর্থেই। পিশাচটার
পার্থিব দেহ শটগানের ব্লাস্টে উড়ে গেলো, আর ওর আত্মা ছিঁ ড়ে মুক্ত হয়ে গেলো। মেঝেতে তৈরি
হলো একটা অনেএএক লম্বা আর গভীর একটা সুড়ঙ্গ ! সেই আগুন ওগড়ানো, ছাইয়ের গাদা
পোড়ানো সুড়ঙ্গ পথ টেনে নিয়ে গেলো ওর আত্মাটাকে, যেখানে অপেক্ষা করছে ম্যামনের
প্রতিশোধ .........

খানিক পরেই , সুড়ঙ্গ উধাও হয়ে গেলো। মেঝেতে পড়ে রইলো আধা-মানুষের একটা ছিন্ন ভিন্ন
মৃতদেহ !

এঞ্জেলা গলা দিয়ে একটা শব্দ করলো , মনে হলো এক্ষু নি বমি করে দেবে । কোন কথা না বলে
কনস্টেনটিন ওকে নিয়ে গেলো হলওয়েতে।

জাদু বাস্তবতার আশ্রয় নেয়ার মতো সময় আর নেই। ও এখন জ্ঞানের অস্ত্রে সজ্জিত, যেটা হয়তো
ব্যবহার করার জন্য ইতিমধ্যে অনেক দেরী হয়ে গেছে।

ফ্রান্সিস্কো দাঁড়িয়ে ছিলো হসপিটাল সিকিউরিটি গার্ডে র শরীরের ওপর, মাথা নাড়ছিল আর
বিস্মিত হয়ে কি জানি ভাবছিলো।

এই অ্যামেরিকান সিকিউরিটি গার্ড গুলো, একদম খেলনার মতো ! ধ্বংস করা একদম সোজা !
এটাকে সে খালি হাতেই মেরে দিয়েছে, দেখার জন্য যে, আগের এলেম তার মধ্যে এখনও আছে
কিনা। সে এমনকি লোহার স্পাইকটাও ব্যবহার করেনি !
210

ও এখানে করছে টা কি ? সামনে বিছিয়ে থাকা সবজে নীল করিডোর ধরে তাকালো সে। মাথার
ওপরে একটা লাইট বিজ বিজ করে শব্দ করছিলো পোকামাকড়ের মতো.........

পোকামাকড়......... লস এঞ্জেলসে আসার পথে , গাড়ির মধ্যে খানিক ঘুমিয়েছিল সে। তখন
একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলো সে । দেখেছিলো , একটা ধাতব টেবিলে উজ্জ্বল আলোর নিচে শোয়ান
নিজের নগ্ন মৃতদেহের সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে, ভূ ত হয়ে ! ওখানে আরও ছিলো সার্জি কাল মাস্কে
সারা মুখ ঢাকা আরও কিছু লোকজন , কেবল চোখ দেখা যাচ্ছিলো ওদের। ওরা যন্ত্রপাতি নিয়ে,
ওকে কেটে ফেলার মতলব করছিলো !

নাআআ ! ফ্রান্সিস্কো বলে উঠেছিলো , ওই দেহটা কেটো না !

ও লোকগুলোকে মারতে চাইলো, কিন্তু ওর হাতগুলো মনে হচ্ছিলো হাড়বিহীন, রাবারের মতো,
কোন আঘাত করার উপযোগী নয় ! ওরা যন্ত্রপাতি বেছে নিয়ে কাটাকু টি শুরু করে দিলো।
ফ্রান্সিস্কো একটা দূরাগত সুড়সুড়ি অনুভব করলো । তখন ওদের মধ্যে একজন অস্বাভাবিক বড়
একটা সার্জি কাল যন্ত্র বের করলো, স্টিলের তৈরি, কিন্তু দেখতে হুবহু লোহার স্পাইকটার মতো ! ওর
ওটা সরাসরি ঢু কিয়ে দেয়া হলো ফ্রান্সিস্কোর ডান চোখে, তারপর, ঠিক একটা আলমারির তালা
খোলার মতো ঘুরিয়ে দেয়া হলো। ফ্রান্সিস্কোর মাথার তালু খুলে গেলো, ঠিক যেমন প্লাস্টিকের
ডাস্টবিনগুলো খুলে যায় পা দিয়ে নিচের লিভার চেপে ধরলে । ভেতরে, ঘিনঘিনে উপচে পড়া
পোকার দল, হামাগুড়ি দিচ্ছে, চিবাচ্ছে কি জানি .........

আর সেই পোকারা , একসাথে , চিবাচ্ছে, বিজবিজ শব্দ করছে ...... সেই একই শব্দ , একই ধরণের
একত্রে কিছু একটা চিবানোর হাড় হিম করা শব্দ – যেটা সে পায় সেই লোহার স্পাইকটা হাত দিয়ে
ধরলে।
211

স্রেফ একটা খারাপ স্বপ্ন, ফ্রান্সিস্কো, ওটার কোন মানে নেই......... এখন তাড়াতাড়ি করো, তোমার
ডানের সিঁড়িটা দিয়ে নিচে নেমে , বামের প্রথম বড় দরজাটা ...... তোমাকে জোর খাটাতে হবে,
ওখানে বিরাট একটা তালা ঝু লছে।

ফ্রান্সিস্কো সিকিউরিটি গার্ড টার গোড়ালি ধরে টেনে নিয়ে গেলো একটা বালতি আর মপ রাখার
ঘরে, সেখানে গাদা করে রেখে দিলো সেগুলির পাশে। ভালো হয়েছে সে লোকটাকে গলা টিপে
মেরেছে, তাই কোন রক্তের দাগ পড়েনি। দরজাটা বন্ধ করে, কোটের পকেটে রাখা স্পাইকটাতে
আবার হাত দিলো সে – থামল একটু , শুনছে।

সে আবারও সেই শব্দটা শুনলো , সেই অনেকগুলি চোয়ালের কিছু একটা চাবানোর শব্দ,
বিজবিজ, বিংগগগগ ! কাঁধ ঝাঁকিয়ে সেই বড় দরজাটার কাছে এলো। বিরাট তালা লাগানো
সেখানে, স্পাইকের এক মোচড়ে খুলে গেলো সেগুলো, খুলে গেলো দরজাটা।

সে নিজেকে একটা বিশাল, মাটির নিচের রুমে আবিষ্কার করলো। সেখানে অনেকগুলো বাথটাব !
ওখানে অনেকগুলি পাইপ ছড়ানো, ওপরের সবুজ সিলিং বেয়ে নেমে এসেছে সেগুলি।

রুমটা দেখে ওর ভয়ে কাঁপুনি উঠে গেলো। ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে ওর মনে পড়লো , এটা একটা
হসপিটাল, তো, এটা একটা থেরাপি রুমই হবে। একটা সাইন দেখলো সে, স্পাইকে হাত রাখার পর
ওটা পড়তে পারলো সে, হাইড্রোথেরাপি – পানির চিকিৎসা !

সেই রুমের মাঝখানে , একটা বিশাল গরম পানির পুল দেখতে পেলো সে। দেখতে সুইমিং পুলের
মতো, কিন্তু তত গভীর নয়। ওটার কাছে হেঁটে গেলো সে, ওটার ক্লোরিন ব্লু পানির দিকে তাকালো।

ও এখানে কি করছে ? ওর শহরের অন্ধকার দিকের খোঁজ করার কথা, যেখানে ও ওর সিন্ডিকেট
তৈরি করতে পারবে।

তোমাকে এখানেই অপেক্ষা করতে হবে, এই হসপিটালে, ফ্রান্সিস্কো। গৌরব আসছে। একটা মেয়ে
আসবে এখানে তোমার কাছে। একজন সুন্দরী মেয়ে।
212

একটা মানসিক ছবি ভেসে এলো ওর মনে। যেন টেলিভিশনে ছবি দেখছে। এটাই কি মেয়েটা ?
বেশ সুন্দর দেখতে। কিন্তু একইসাথে ওর ভেতরে শক্তিও প্রকাশ পাচ্ছে, যেটা ওর কাছে বেশ
পছন্দ হলো। এজন্যই লোহার স্পাইকটা ওকে এখানে নিয়ে এসেছে ? এই মেয়ের জন্য ? নাম কি
মেয়েটার ? কে সে ?

ওর নাম হলো এঞ্জেলা। আর বাকিটার জন্য – অপেক্ষা করো , ফ্রান্সিস্কো। সবকিছু পরিষ্কার হয়ে
যাবে। গৌরব অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।

ওর নাম হলো এঞ্জেলা............

কনস্টেনটিন ওকে নিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। বিজিআর বিল্ডিঙের ভেতরে।

“ও তোমাকে আঘাত করেছে। ” এঞ্জেলা বলে উঠলো “তোমার ঘাড়ে............”

“এটা ঠিকই আছে এখন” কনস্টেনটিনের স্বর অন্য সময়ের চাইতে অনেক কর্ক শ “কিন্তু তোমার
ওখানে যাওয়া উচিত হয়নি – দেরী করিয়ে দিয়েছ অনেকটা। আমাদের এখন দেরী করলে চলবে
না, অফিসার ডডসন।”

“আমাকে ওখানে যেতেই হতো আগুন নেভানোর জন্য। ওখানে নির্দোষ মানুষ থাকতে পারতো।
ফায়ার স্প্রিংক্লার গুলো কেন যে চালু হয়নি, বুঝতে পারলাম না !”

“কারণ আমি অ্যালার্ম সিস্টেমটা খুঁজে পেয়ে , সবকিছু ছিঁ ড়ে খুঁড়ে একপাশে ফেলে দিয়েছি,
সেজন্য। ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম সহ !”

ওর ভেতরের পুলিশ স্বত্বাটা প্রতিবাদ করে উঠতে চাইলো, কিন্তু --- কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাল ছেড়ে দিলো
এঞ্জেলা। পৃথিবীই যেখানে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেখানে এটাতে আর কিই বা এসে যায় !
213

“গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে কেন ?” কনস্টেনটিন জিজ্ঞেস করলো, আরেকটা কোণা ঘুরতে ঘুরতে।
বালের লিফটগুলো কোথায় গেলো ?

“তু মি বিপদে ছিলে ”

“ওহ, এখন বিপদের বার্তাও পাচ্ছ দেখা যাচ্ছে !” শুকনোভাবে বলে উঠলো কনস্টেনটিন।

“তাড়াতাড়ি করছ তু মি, এর মানে কি কিছু খুঁজে পেয়েছ ?” এঞ্জেলা জিজ্ঞেস করলো।

এঞ্জেলার কব্জি ধরে দ্রুত চলতে চলতে বলে উঠলো কনস্টেনটিন “যীশু খ্রিস্ট কিন্ত ক্রসে বিদ্ধ হয়ে
মারা যাননি – আসলেই না। উনি মারা গিয়েছিলেন একজন সৈন্যের বল্লমে আটকে পড়ে। কিছু
ঘটনার সমষ্টি, কিন্তু সেই বল্লমটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। ওটাকে মাঝে মাঝে ‘ভাগ্যের বল্লম’ বলেও
ডাকা হয় ।”

“আমি ক্যাথলিক, জন। ক্রু সিফিক্সন এর গল্প আমারও জানা আছে !”

কনস্টেনটিন বেশ কষ্ট করে শ্বাস নিচ্ছিলো, ওর ফু সফু স ব্যাথা করছিলো। সমস্ত
মহাজাগতিক শক্তিকে একত্র করে, ওকে পথ চলতে হচ্ছিলো। “বী ম্যান বলেছিলো, ম্যামনের
ঐশ্বরিক সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে, বেরিয়ে আসার জন্য। ঈশ্বরের একমাত্র পুত্রের রক্ত কোথায়
পাওয়া যাবে ?”

“যীশু খ্রিস্টের রক্ত – ওই বল্লমে ?”

“হুম, সেটাই। ডিটেকটিভ ডডসন। ”

“তো, সে ভাগ্যের বল্লম খুঁজে বের করলো। তারপরও ওকে শক্তিশালী আধ্যাত্মিক গুণ সম্পন্ন
কাউকে খুঁজে বের করতে হবে, তু মি বলেছিলে সেটা.........” এঞ্জেলার গলা মিলিয়ে এলো এরপর।

“আসলে নয় ” কনস্টেনটিন ওর দিকে তাকালো।


214

এঞ্জেলা এরপর বুঝে গেলো। ম্যামন আরেকজন ওরাকল খুঁজে পেয়েছে। “যমজ” রুদ্ধশ্বাসে বলে
উঠলো সে। ও আর ইসাবেলের একই শক্তি ছিলো। ওর নিজের মধ্যে, কিছুদিন আগ পর্যন্তও সেটা
ঘুমন্ত ছিলো। কিন্তু শক্তিটা ছিলোই সেখানে। ম্যামন ইসাবেলকে হারিয়ে ফেলেছে , কারণ সে
ম্যামনের পথের কড়ি হবার বদলে নিজেই আত্মহত্যা করে ফেলেছে। কিন্তু ওদের হাতে আরেকজন
ছিলো , সবসময়। এমন কেউ, যে কাজে আসবে ।

ম্যামন এঞ্জেলাকে ব্যাবহার করে, এই জগতের দরজা খোলার কাজটা পুরো করতে পারবে।
পৃথিবীতে এনে ফেলতে পারবে নরকের নাগরিকদের ! একদমই কিছুই সন্দেহ না করা এই জগতের
বাসিন্দাদের ওপর , নামিয়ে আনতে পারবে নরক ।

সম্ভবত, কনস্টেনটিন ভাবলো, সেই উড়ন্ত পিশাচের দল হয়তো এঞ্জেলাকে নয়, ওকেই মারতে
এসেছিলো ? হুম, কিন্তু ওরা এঞ্জেলার নাগাল তো পেয়েই গেলো শেষমেশ।

“এমুলেট টা কোথায় ? ” এঞ্জেলাকে জিজ্ঞেস করলো সে হঠাৎ করেই।

সহজাত প্রবৃত্তির বশে, এঞ্জেলার হাত চলে গেলো গলার কাছে। ওটা নেই ! ওরা হলওয়তে থেমে
গেলো, হাঁফাচ্ছে জোরে জোরে। কনস্টেনটিন এঞ্জেলার দিকে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকালো।

“আম...... ওটা ...... নিশ্চয়ই ”

থেমে গেলো এঞ্জেলা, চেহারাটা কেমন জানি হয়ে গেলো হঠাৎ।

“কি হয়েছে ?” কনস্টেনটিন জিজ্ঞেস করলো।

“আমি জানি না , আমার কেমন যেন একটা লাগছে......”

হঠাৎ, ওর শরীরটা ভাঁজ হয়ে গেলো। জায়গায় দাড়িয়ে কাঁপতে লাগলো সে, তারপর, ঠিক যেন
স্বপ্নোত্থিতের মত কনস্টেনটিন এর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো সে। পায়ের হিলগুলো
215

অনেক কষ্টে সামনে টেনে ধরে রাখলো। বড় বড় চোখে তাকালো কনস্টেনটিনের দিকে, মরিয়া হয়ে
সামনের দিকে আগাতে চাইলো – যেন অদৃশ্য কিছু একটা ওকে পেছনের দিকে টানছে !

কনস্টেনটিন ক্ষণিকের চমক কাটিয়ে ওকে ধরার জন্য হাত বাড়ালো। কিন্তু সেকেন্ডের ভগ্নাংশ দেরী
করে ফেললো সে।

এঞ্জেলা এরপর গিয়ে সোজা বাড়ি খেলো পেছনের দেয়ালে। ও বাড়ি খাওয়ার পরপর, দেয়ালটা
যেন চূ র্ণবিচূ র্ণ হয়ে গেলো ভেতর থেকে ! যেন কেউ ওর জন্য পথ তৈরি করে নিতে চাইছে সেই
প্লাস্টার, কাঠ আর ধাতব কাঠামোর ভেতর দিয়ে। সেগুলোর ভেতর দিয়ে, বিদ্যুৎ গতিতে কেউ
ওকে পেছন দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে !

কনস্টেনটিন সেই দেয়ালের ভাঙ্গা অংশের ভেতর দিয়েই ওকে অনুসরণ করতে লাগলো। কিন্তু
এঞ্জেলা ক্রমশ মিলিয়ে যেতে লাগলো দেয়ালের ভাঙ্গা অংশের মধ্যে দিয়ে, যেটাই ওকে নিয়ে যাক
না কেন, সেটা ওর পেছনের দেয়ালগুলোকে স্রেফ কাগজের মত ফেড়ে ফেলছে আগে থেকেই,
যাতে ওর কোন ক্ষতি না হয় ! ও উড়ে গেলো একসারি অফিস কিউবিকলের ওপর দিয়ে, একটা
কনফারেন্স রুমের ভেতর দিয়ে, একটা বিশাল টেবিলের ঠিক মাঝ বরাবর......

কনস্টেনটিন সেগুলোর মাঝ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, এঞ্জেলার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে। ধ্বংসস্তূ পের
মাঝ দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে, হাঁ হয়ে যাওয়া দেয়ালের মাঝ দিয়ে, কিন্তু কখনোই ওর খুব কাছাকাছি
যেতে পারলো না !

যখনই এঞ্জেলা কিছুতে আঘাত করছে, কনস্টেনটিন দেখতে পাচ্ছে যে জিনিসটা ওকে টেনে নিয়ে
যাচ্ছে। যেহেতু আঘাতটা ওটার ওপরেই পড়ছে। বাতাসের তৈরি কিছু একটা হবে, ম্যামনের
দাসানুদাস কেউ ? মনুষ্যাকৃ তির একটা জন্তু, কিন্তু বিশাল দেখতে। কনস্টেনটিন কেবল অবয়বটা
দেখতে পাচ্ছিলো।

সে শুনতে পেলো এঞ্জেলার ভয়ার্ত চিৎকার “কনস্টে------


216

ধুম করে একটা শব্দ, বিল্ডিঙের এক পাশ দিয়ে এঞ্জেলাকে বের করে নিয়ে যাওয়া হলো।

----------নটিইইইন !!”

এঞ্জেলার শরীরটা ঝাঁকি মেরে বেরিয়ে গেলো , মাটি থেকে প্রায় বিশ তলা ওপরে। ওর চারপাশে
কাগজ, ফার্নিচার আর আবর্জ না ঘুরপাক খাচ্ছে।

কনস্টেনটিন একটা ধ্বসে যাওয়া ডেস্কের ওপর দিয়ে লাফ দিয়ে, সেই বিরাট গর্তে র কাছে এসে
দাঁড়ালো। ধাতব কাঠামো, সাথে কংক্রিটের ধ্বংসস্তূ প আর বৈদ্যুতিক তার ঝু লে আছে সেদিক
দিয়ে। সেদিক দিয়ে তাকিয়ে রইলো বাইরের দিকে, ধোঁয়ায় কাশছে, কিন্তু পাত্তা দিচ্ছে না।

ও স্রেফ দাড়িয়ে রইলো সেখানে, ভাঙ্গা দেয়াল ধরে, বাতাসের জন্য হাসফাঁস করছে । অনেক দূরের
একটা বিল্ডিঙের ছাদে অনেক আবর্জ না পড়ে থাকতে দেখলো। কিন্তু কোন শরীর চোখে পড়লো না
ওর।

এঞ্জেলার কোন চিন্হই নেই আশেপাশে !

চৌদ্দ

চ্যাজের ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো কনস্টেনটিনের পাশে। ও বিল্ডিঙের কোনায় দাড়িয়ে একটা লাকি
স্ট্রাইক থেকে ধোঁয়া ছাড়ছিল, তাকিয়ে ছিল বিশতলা ওপরের বিশাল গর্ত টার দিকে।

ও দেখতে পেলো, জায়গাটা লাল নীল ঝলকানো আলোতে ভরে গেছে। পুলিশ আর ফায়ার
ফাইটাররা উকি মারছে ওপরের গর্ত টা থেকে। কিছু একটা আন্দাজ করতে চাইছে ওরা, যেটা সত্য
থেকে অনেকখানি দূরে, ভাবল কনস্টেনটিন।

কিন্তু কেউই এঞ্জেলার শরীর খুজে পায়নি ! কারো শরীরই পাওয়া যায়নি।
217

“ওহহহ !” ওপরের ধোঁয়া ওঠা বিশাল গর্ত , আর নিচের ধ্বংসস্তূ পের দিকে তাকিয়ে বলল চ্যাজ
“ওটা তোমার কাজ ? ”

কনস্টেনটিন একটু ভাবলো, ভাবছে। ওটা একদিক দিয়ে ধরতে গেলে তো ওরই কাজ। “হ্যাঁ”
একটা কাশির দমক সামলে , আকাশে একটা রিং ছেড়ে বললো “তাই তো মনে হয় !”

“ধূর্ত শব্দটা তো শোনা আছে তোমার, তাই না ?” বললো চ্যাজ।

কনস্টেনটিন কাঁধ ঝাঁকিয়ে, ট্যাক্সিতে উঠে বসলো। মনে মনে ভাবছে, এঞ্জেলা কি তবে মারা গেলো
?

যদি সে মারা গিয়ে থাকে, সে উপসংহারে এলো, তবে ওই অট্টালিকার গায়ের গর্তে র চাইতে
আরও অনেক বেশী কিছু নেমে আসতে চলেছে এই পৃথিবীর বুকে।

দরজাটা আস্তে আস্তে বন্ধ করতে চাইলো সে, কিন্তু মাঝপথে বাধা পেলো ওটা। খুলে ধরলো
দরজাটা কেউ, এলএপিডি ডিটেকটিভ জেভিয়ার, দরজা দিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

“কনস্টেনটিন...............”

“জেভিয়ার”

“আমি কেন যেন অবাক হতে পারছি না !”

ওরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইলো, কনস্টেনটিন বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজী নয়। কোন তথ্যও
নয়। যদি কোন সময় পুলিশ ওর পথে আসে, সেটা ঠিক এখনই ঘটে যাবে, এরকমই মনে হলো ওর

“আমি ডডসনকে বেশ কিছু সময় ধরে খুজে পাচ্ছি না ” জেভিয়ার বললো।

কনস্টেনটিন বিষণ্ণ হাসি দিলো “না, আমারও তাই ধারণা”


218

জেভিয়ার ইতস্তত করছে। কনস্টেনটিনের আধ্যাত্মিক শক্তির প্রয়োজন পড়লো না বের করতে যে,
জেভিয়ার ভাবছে। অনুমান করতে পারলো সে।

আমি কি কনস্টেনটিনকে ধরে রেখে দেব ? এটা কি প্রমাণ করা যাবে, ওই বিল্ডিঙের ধ্বংসযজ্ঞের
পেছনে যে এর হাত আছে ? ডডসন কোথায় উধাও হয়ে গেছে এ কি আমাকে বলতে পারবে ? যদি
আমি সেটাই করি, তবে কোনভাবে কি আমি ডডসনের মুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবো না তো
আবার ?

শেষ প্রশ্নের উত্তরটা হ্যাঁ হতেও পারে। কারণ জেভিয়ার অবশেষে বলে উঠলো “তোমার যা করার,
করে যাও তু মি !”

কনস্টেনটিন মাথা নাড়ল। নিজেকে বেশী বেশী আত্মবিশ্বাসী দেখানোর চেষ্টা করলো সচেতনভাবে।

“সেটাই প্ল্যান আমার” বললো সে জেভিয়ারের দিকে তাকিয়ে।

চ্যাজ ওকে ট্যাক্সি চালিয়ে নিয়ে যাবার সময়ও, নিজের পেছনে জেভিয়ারের দৃষ্টি অনুভব করতে
পারলো। চ্যাজও বুঝতে পেরেছে, আপাততের জন্য কনস্টেনটিন রেহাই পেয়ে গেলো পুলিশের
হাত থেকে।

কিন্তু এরপর, এরপর কনস্টেনটিন যাবে কোথায় ?

কনস্টেনটিনের ধাঁধার শেষ টু করোটা খুজে বের করতে হবে যে ! ওকে যীশু খ্রিস্টের রক্ত খুজে বের
করতে হবে। ওটা এই মরজগতে কেবল দুটো জায়গায় থাকতে পারে – ‘হোলি গ্রেইল’ খ্যাত সেই
বিখ্যাত পেয়ালায়, আর সেই বল্লমের টু করো যেটা ওনার একপাশ চিরে দিয়েছিলো। কনস্টেনটিন
নিশ্চিত ম্যামন ‘হোলি গ্রেইল’ খুঁজে পাবে না। তাহলে বাকী থাকে বল্লমটা। ওটা কোথায় পাওয়া
যাবে ?

একটাই জায়গা আছে, যেখানে ওটা পেয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।


219

“কোথায় যাবো এখন ?” চ্যাজ জিজ্ঞেস করলো, একদম ঠিক সময়ে।

“পাপা মিডনাইটের ওখানে চলো ” কনস্টেনটিন বললো।

চ্যাজ আর কনস্টেনটিন সেই বাউন্সারের মুখোমুখি হলো আবার। সেই অদ্ভু ত দেখতে ট্যারট
কার্ডে র মেলা। চ্যাজ বিড়বিড় করে বললো যে এবার সে পেছনে পড়ে থাকতে চায় না.........

কিন্তু কনস্টেনটিনের মাথা এত ব্যাথা করছিলো, যে সে নিশ্চিত ছিলো না এবার সে আদৌ ভেতরে
যেতে পারবে কি না। ও ক্লান্ত, ওর ফু সফু স ব্যাথা করছে, মাথায় অনেক আধিভৌতিক সত্ত্বার
আঘাতের দাগ। ও এই মুহূর্তে বাউন্সারের মন পড়তে পারবে বলে মনে হয় না ।

চেষ্টা করে দেখলো সে একবার, কিন্তু ট্যারট কার্ডে র টেলিপ্যাথিক চিত্রটা কেমন জানি ঝাপসা হয়ে
গেলো।

“একটা সিঁড়ির ওপর একটা পাখি ” কনস্টেনটিন তবুও চেষ্টা করে দেখলো।

বাউন্সারটি মাথা নাড়ল “দুঃখিত ”

কনস্টেনটিন নড করলো , ঘুরতে শুরু করলো হতাশ ভঙ্গিতে। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে পেল্লায়
এক ঘুষি কষিয়ে দিলো বাউন্সারের মুখ বরাবর !

ওর গালের নাগাল পেলো সে, থুতনির বদলে। কিন্তু ঘুষিটাতে যথেষ্ট শক্তি ছিলো, সাথে
টেলিকাইনেটিক শক্তিও যোগ হয়ে থাকবে কিছু। বাউন্সার সোজা পেছনে উল্টে পড়লো চোখ
কপালে তু লে।

এরপর, ওরা দাঁড়িয়ে ছিল সেই অনন্তের দিকে চলে যাওয়া পাথরের সিঁড়ির মাথায়। এখন, নাইটক্লাব
বন্ধ থাকাতে, এমন একটি উৎস থেকে আলো আসছিলো, চ্যাজ সেটা কিছুতেই বুঝতে পারলো
না !
220

“এখানেই দাঁড়াও” কনস্টেনটিন চ্যাজের দিকে তাকিয়ে বললো, তারপর রওনা দিলো নিচের দিকে।

চ্যাজ নড করলো কেবল, সে আর সামনে যেতে চায় না। ও অবশ্যই এখনও তৈরি না, অন্তত
আজকে তো নয়ই।

ও দেখলো কনস্টেনটিন নামছে, নামছে............ ছোট থেকে ছোট হতে হতে, এক সময় মিলিয়ে
গেলো।

চ্যাজ ওই অনন্ত অন্ধকার থেকে বয়ে আসা একটা ঠাণ্ডা হাওয়া টের পেলো নিজের শরীরে। সেই
বাতাস যেন ওর গন্ধ শুঁকছে, ওর স্বাদ নিচ্ছে ! ও কি সেই অন্ধকারেরই প্রাণী কিনা, সেটাই মনে হয়
বুঝতে চাইছে।

চ্যাজ ঘুরে দাঁড়ালো, আর দেখলো , পেছনের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। আর এই দিকের দরজার
গায়ে কোন নব নেই ! এদিক থেকে খোলার কোন উপায় নেই।

সেই কৌতূ হলী বাতাস ওর ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ ......

চ্যাজ সেই নব ছাড়া দরজার গায়েই উবু হয়ে হেলান দিয়ে বসে পড়লো, হাঁটু দুটো আঁকড়ে ধরে।

খানিক পরে সে ডেকে উঠলো “উম...কনস্টেনটিন ? হেই, ইয়ো , উহ – আমাকে কি , এম্মম ...
মানে ... কনস্টেনটিন ?”

মিডনাইট ওর চওড়া ব্রিমের কালো বরসালিনো হ্যাট পরা ছিল, শার্টে র বুকের কাছের
বোতাম খোলা। শেষ মুহূর্তে র কিছু কাগুজে কাজ সেরে নিচ্ছিল, বাইরে কোথাও যাবার আগে,
কনস্টেনটিন সেরকমই ধারণা করলো।

এই সময়ে, সে হয়ত যাচ্ছে একটা স্পেশাল স্টেজে, যেখানে গ্ল্যাডিয়েটর’সুলভ ক্রীড়া অনুষ্ঠান
চলে। ওটা হলিউডের অবক্ষয়ে আক্রান্ত পয়সা-অলাদের জন্য একটা শো। যেটা কিনা এই কালো
221

জাদুর বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজকেরই কাজ। সেখানকার দর্শকদের মধ্যে অনেক বড়লোক দো -


আঁশলাও আছে। গ্ল্যাডিয়েটরেরা সাধারণত জম্বি হয়ে থাকে, ম্যাশেটি আর চেইন স’ দিয়ে ওদেরকে
নামিয়ে দেয়া হয় সেখানে। জনবলের অভাব হয় না, কারণ জম্বিদের ছোটখাটো একটা সেনাবাহিনীর
অধিকর্তা হলো মিডনাইট। আগেকার দিনে, হাইতিয়ান জম্বিদেরকে নিয়ে আসতো এখানে সে। কিন্তু
এখন, ঝরে যাওয়া ফ্যাশন মডেল, সোপ অপেরা অভিনেতা, রিয়েলিটি টিভি শো এর ব্যার্থ
ডাইরেক্টর – যারাই মিডনাইটের ৭ নাম্বার লেভেলের জুয়ার টেবিলগুলোর দেনা শোধ করতে পারে
না, তাদেরকে পাকড়াও করে সে। ওদেরকে এত সহজেই জম্বিতে রুপান্তর করে সে, যে মনে হয়
ওরা আগে থেকেই অর্ধেক জম্বি হয়েই ছিল।

“রিগ্যালের ওখানে জম্বি ফাইটের আয়োজন করেছ নাকি ?” নিজের শক্তিমত্তা ফিরে পাচ্ছে ধীরে
ধীরে কনস্টেনটিন।

সে মিড নাইটের চোখে ঠাণ্ডা রাগটা উপেক্ষা করলো, তেমন একটা অবাক হলো না অবশ্য।
কনস্টেনটিনের অবশ্য এখানে থাকার কথা না। আর যেহেতু সে এখানে অনুমতি ছাড়া এসে
পড়েছে, মিডনাইটের কাছে সে একজন ডাকাত। বাউন্সারকে বলাই ছিল, কনস্টেনটিন এলে যেন
সে সব কার্ড ই ভু ল হয়েছে বলে।

“জম্বি ফাইটগুলো সবসময়ই আমার কাছে অসুস্থ মনে হয়েছে।” কনস্টেনটিন বলে চললো, একটা
সিগারেট ধরাতে ধরাতে “সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার হলো, ওরা যখন একে অপরকে ছিঁ ড়ে ফেলে
কোনকিছু অনুভব করা ছাড়াই। দেখলে রীতিমতো বমি চলে আসে আমার। মানে, ওদের ব্রেইন
বাইরে বেরিয়ে এসেছে, তারপরও দেখা যাচ্ছে একজনের গলা আরেকজন চেপে ধরে আছে।
একজনের অণ্ডকোষ ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরেকজন--- কিন্তু কোন ব্যাথাই পাচ্ছে না ! মনে হচ্ছে,
ব্যাথা তোমাকে খানিকটা মনুষ্যত্বের স্বাদ দেয়। সম্প্রতি, নিজেকে আমার মানুষ বলে মনে হচ্ছে ।”
একগাদা নীলচে ধোঁয়া ছাড়লো সে “স্থানীয় মুভি এজেন্টরা অবশ্য ওসব পছন্দই করে। মুভি হিট
করতে সাহায্যই করে ওগুলো ”
222

কনস্টেনটিন ‘ওরেরি’ টার দিকে তাকালো , মিডনাইটের মনোযোগ ওদিকে সরানোর জন্য। এর
মাঝে নিজের পেছনে ঝোলানো ‘হোলি শটগান’ এর বাঁটে হাত রাখলো সন্তর্পণে।

কিন্তু মিডনাইট দেখে ফেললো সেটা “তু মি কি পাগল হয়ে গেছো ?” ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়িয়ে
গেলো সে “এখানে জোর করে ঢু কে এসেছ, তাও সশস্ত্র !”

ওর হাত নড়ছিলো , আঙ্গুলগুলো মেলে দেয়া, বাতাস থেকে শক্তি আহরণ করছে। কনস্টেনটিন
দেখলো শক্তি বলয় ঘুরছে সেখানে, মিডনাইট আক্রমণে যাচ্ছে !

“উঁহু, ওটি কোরোনা !” কনস্টেনটিন বললো ‘হোলি শটগান’ টা বের করে মিড নাইটের দিকে তাক
করতে করতে।

মিড নাইট জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ও জানে, ওরা একটা অচলাবস্থায় পড়ে গেছে। ওই
বন্দুকটা একটা পুরাকীর্তি দিয়ে তৈরি, সেখানে আঁকা আছে নানারকম পবিত্র চিন্হ । এখন, সে যদি
ওটাকে জ্যাম করে দেয়ার চেষ্টা করে বা একদিকে ঝেড়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে – ওর নিজের
শক্তিই ওর দিকে ফেরত আসবে। প্রচণ্ড হিংস্রভাবে – ‘কার্মা’ – এবং এটার বিশুদ্ধ , তাৎক্ষণিক
প্রতিক্রিয়া।

হাত নামিয়ে নিলো সে, অপেক্ষা করছে।

“চেয়ারটা কোথায় ?” কনস্টেনটিন বললো।

মিডনাইট একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললো । একটু ঘুরে দাঁড়িয়েছে , ওর ডান হাতের জাদুকরী ভঙ্গিমা
যেন কনস্টেনটিন দেখতে না পায়। যদি সে বন্দুকটা এড়িয়ে একটা জাদুর কম্পন পাঠাতে পারে
কনস্টেনটিনের দিকে.........

“আমি কোন পক্ষকেই সাহায্য করি না” সে বললো , হাতের মধ্যে শক্তি জমা হচ্ছে টের পেলো সে
“ভারসাম্য বজায় রাখি আমি ”
223

“ভারসাম্যের খেতা পুড়ি ” কনস্টেনটিন খুব স্বাভাবিকভাবে বললো।

সে নিজের পক্ষ থেকে জানতো কি আসতে যাচ্ছে, সে মিডনাইটকে গুলি করতে চায় না,
কিন্তু.........

কনস্টেনটিন যখন কি করবে না করবে ইতস্তত করছে, মিড নাইট আঘাত হানলো। হাত বের করে
এনে একটা জাদুকরী শক্তি ছুঁ ড়ে দিলো অকালটিস্ট এর দিকে। সেটা কনস্টেনটিনকে নিয়ে ফেললো
দরজার পাশে দেয়ালের ওপর। হাত থেকে শটগানটা ছিটকে চলে গেলো আরেকদিকে।

নিজের ওপর ভীষণ রাগ হলো কনস্টেনটিনের , এভাবে অন্যমনস্ক অবস্থায় ধরা খাওয়ার জন্য।
সবটু কু বাতাস বেরিয়ে গেলো বুক থেকে।

মিডনাইট ঠিক একটা মেল ট্রেনের মতোই দৌড়ে এলো “তোমার এত সাহস ! আমারই বাড়িতে
এসে আমাকেই হুমকি দাও !”

মিডনাইট ওর হাত ধুম করে বসিয়ে দিলো কনস্টেনটিনের বুকে, ওর হাতের আঙ্গুলগুলোতে
তখনও শক্তি বিচ্ছু রিত হচ্ছে। ঠেলে ওকে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দিলো সে। কনস্টেনটিনের যে
কোন দুটো হার্ট বিটের মাঝখানে, ওর হার্ট বিট থামিয়ে দিতে প্রস্তুত।

মিডনাইট হলো শক্তিমান একজন মানুষ। নিজের ওপর ওর অগাধ বিশ্বাস , আর নিজের সমগ্র
এলাকার ওপর ওর সম্পূর্ণ মানসিক দখল আর প্রচণ্ড কর্তৃ ত্ব আছে। আর কনস্টেনটিন সেটাকেই
চ্যালেঞ্জ করে বসেছে। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো কনস্টেনটিন ওকে অস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখিয়েছে।
ওই ...... ওই ফ্যাকাসে চেহারার ম্যাজিশিয়ান ওরই জায়াগায় এসে ওর কাছ থেকেই জিনিসপত্র
দাবী করছে।

মিড নাইটকে বিরক্ত করার জন্য খেসারত দিতেই হবে- সে অতিপ্রাকৃ তই হোক বা শারীরিক।

“তু মি কি জানো ?” কনস্টেনটিন তড়পে উঠলো “এখনও সময় আছে, ঠিক কাজটা করতে
পারবে তু মি। ” মিডনাইটের চোখে চোখ রাখলো সে। দুজনের দৃষ্টি আটকে গেলো, আর
224

কনস্টেনটিনেরটা যথেষ্টই শক্তিশালী ছিল দৃষ্টি ধরে রাখার জন্য। একটুঁ শাস নিয়ে সে বলে উঠলো
“নিরপেক্ষ, মিড নাইট ? তু মিই একমাত্র লোক যে নিয়ম মেনে খেলছে। আর তু মি যখন
সুইজারল্যান্ডের নকল করছ, মানুষজন মারা যাচ্ছে। ওরা জম্বি নয়, সত্যিকারের মানুষ যারা
আসলেই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। হেনেসি, বী ম্যান। ওরা একসময় তোমারও বন্ধু ছিল। হত্যা করা
হয়েছে ওদের ! আরও অনেক রক্ত ঝরবে, তু মি কি সেটা বুঝতে পারছ না ? আমরা যুদ্ধে আছি !
কেউ নিরপেক্ষ নই, অন্তত এখন তো নয়ই । ”

মিড নাইট স্রেফ তাকিয়ে রইলো, স্রেফ কথার জালে পড়ে সে নিজের সতর্ক তা খোয়াতে রাজী নয়।

কনস্টেনটিন ওর শেষ তু রুপের তাস ফেললো “আমার তোমার সাহায্য লাগবে ”

বাঁকা হাসলো সে। সে জানতো,এখানে এভাবে ঢু কে আবার সাহায্য আশা করা বোকামি। কিন্তু ওরা
একে অপরকে চেনে দীর্ঘদিন ধরে। আর... কনস্টেনটিন মিডনাইটের জীবন বাঁচিয়েছিল একবার।
“এটা আমার তরফ থেকে শেষ অনুরোধ ধরে নাও। ”

মিডনাইট দীর্ঘ একটা সময় ধরে তাকিয়ে রইলো কনস্টেনটিনের মুখের দিকে। তারপর পিছিয়ে
এলো। “তু মি বেশ বিপজ্জনক খেলা খেলছ ।”

“আসলে” কনস্টেনটিন বললো দুঃখ ভরা কণ্ঠে “আমার কিইবা আছে হারাবার ?”

ওরা দুজনেই জানে ও কি বলতে চাইছে। কনস্টেনটিন, মারা যাবার পর নরকেই যাবে, এরকমই ওর
ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে আছে। সেই আত্মহত্যাটা কাজে লেগেছিল, যদিও ওকে আবার ফেরত নিয়ে
আসা হয়েছে। মিডনাইট আর এমন কি করবে ওর সাথে , যেটা নরকের চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারে
?

মিডনাইট নাথা নেড়ে , পকেট থেকে একটা চাবি বের করলো। পাশের একটা সরু দরজার দিকে
এগোল সে।
225

কনস্টেনটিন পিছন পিছন গেলো। ওর শার্টে র যে জায়গায় মিড নাইট হাত রেখেছিল, সেখানটা
জাদুর আগুনে ঝলসে গেছে !

মিড নাইটকে সেদিকে তাকাতে দেখে দেঁতো হাসি হেসে বললো “দুইশ ডলারের শার্ট , সত্যি বলতে
কি !”

ওরা সেই চিকন গলি ধরে শেষ মাথায় গেলো, যেখানে মিড নাইট আরেকটা দরজা খুললো ,
বললো “ওই বালের আবর্জ নাটা” – ম্যামনকে বোঝাতে চাইলো সে “ওর বাবার ছায়া থেকে
যুগযুগান্ত ধরে বেরোতে চাইছে। ”

মিড নাইট একটা বাতি জ্বালাল , একটা বিশাল স্টোর রুম আলোকিত হয়ে উঠলো। ওটাকে
অনায়াসে একটা ছোটখাট ‘জাদুঘর’ বলে চালিয়ে দেয়া যেতো , যদি না সেখানকার ভেতরের
জিনিসপত্রগুলো ওরকম বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থাকতো।

“কিহ !! ??” কনস্টেনটিন বিস্ময়ে অভিভু ত হয়ে বলে উঠলো । সেখানকার বেশ কিছু পুরাতাত্ত্বিক
জিনিসপত্র চিনতে পেরেছে সে। কিছু খ্রিস্টানিক, কিছু কালো জাদু সংক্রান্ত, কিছু ইফা, সান্তেরিয়া,
হার্মেটিক , মিশরীয় --- কিছু কিছু একেবারেই অচেনা।

কনস্টেনটিন একটা মানুষের শরীরের দিকে তাকালো – দেখে ঠিক মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছে। যদিও
বুক উঠানামা করছে না ওটার – শুয়ে আছে একটা কাঁচের বক্সে। পরে আছে একটা রুক্ষভাবে
বোনা রোব, মাঝখানে দিয়ে বাঁধা। বক্সটার আশেপাশে ফু লের গন্ধ ভাসছে।

“একজন সাধু ?” কনস্টেনটিন জিজ্ঞেস করলো “কোন জন ?”

“দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, আমি জানি না ” বললো মিডনাইট “কিন্তু আমি জানি উনি একজন
সাধু ছিলেন, কারণ ওনার শরীর একদম ক্ষয়প্রাপ্ত হয়নি। যদিও , এ জগতে উনি মৃত। আর ফু লের
গন্ধও একটা কারণ, অবশ্যই। উনি ...... সম্ভবত তের’শ শতাব্দীর কেউ হবেন। ”
226

কনস্টেনটিন মিড নাইটের দিকে তাকালো, তারপর তাকালো সাধুর দিকে “তু মি চোখের সামনে
দেখতে পাচ্ছ খ্রিস্টানিটির শক্তি, কিন্তু তু মি পাত্তাই দিচ্ছ না ? তু মি জান ...”

“ধর্মান্তরিত হব ? ভু ’ডাউন ওরফে ভু ডু (হাইতিয়ান এক ধরণের কালো জাদু সংক্রান্ত কাল্ট বা ধর্ম
বিশেষ) হলো খ্রিস্টানিটি আর আফ্রিকার পুরানো ঈশ্বরদের জাদুর সংমিশ্রণ......” কাঁধ ঝাকালো সে
“কিন্তু এটা সত্যি যে , আমি খ্রিস্টান নই। কিন্তু , দিন শেষে, সবই তো একই , তু মি জানো। একই
নিয়ম খাটে সবখানে। তু মি ভু ডু র নরকেও যাবে, একই রকম কাজকর্মের জন্য !”

চারপাশে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে কনস্টেনটিন মাথা নাড়লো “এখানে বেশ কিছু
শক্তিশালী জিনিস পত্র রয়েছে। আমি এটা ভেবে অবাক হচ্ছি যে, তু মি বড়সড় কোন ভল্ট কেন
রাখোনি জটিল কম্বিনেশন সহ। কিংবা ধরো লেজার মুভমেন্ট ডিটেক্টর বা নিদেন পক্ষে স্পাইক
অলা ট্র্যাপ ডোর ! ”

“এটা যথেষ্ট ভালোভাবেই সুরক্ষিত আছে ! এখানে কম করে হলেও সাত সাতটা খুনে আত্মা
পাহারা দিচ্ছে ! ওদের মধ্যে দু’জন হচ্ছে রিচার্ড র‍্যামিরেজ আর চার্লস ম্যানসন -- ”

“দাঁড়াও দাঁড়াও দাঁড়াও ! ওরা তো এখনও জীবিত আছে !”

“ওদের ‘শরীর’ গুলো জেলের ভেতর চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, ঠিক আছে ” মিডনাইট নেকড়ের
মতো হাসলো “কিন্তু আমি অনেক আগেই ওদের আত্মা নিয়ে নিয়েছি ! আর তু মি যদি এখানে
আমার সুরক্ষা বলয়ের ভেতরে না থাকতে, তবে এতক্ষণ ওরা মাথাটা ছিঁ ড়ে নিয়ে তোমার আত্মা
চু ষে খেয়ে নিতো। ”

“এখন, হয়তো আমি ওদেরকে স্বাগতই জানাবো। ” ওর নিজেকে ছিবড়ে মনে হচ্ছিলো। ক্যান্সার
ওকে আবার পেড়ে ফেলছিল । মিড নাইট যেখানে ওকে আঘাত করেছে, সেখানটা ব্যাথা করছে।
আর এঞ্জেলার ব্যাপারে দুশ্চিন্তা ওকে কু রে কু রে খাচ্ছিলো ভেতর থেকে। ও রুমের অন্যপ্রান্তে গিয়ে
ওর সেই চেয়ারটার সামনে যাওয়ার আগে, একটু দাঁড়ালো । একটা রুপার ক্রসের সামনে থামলো
227

সে, ওটা কোনভাবে সেইন্ট এন্থনির সাথে জড়িত, পিশাচদের বিরুদ্ধে এক মহান যোদ্ধা। ওটার
কাছেই ছিলো একটা জার। সেখানে খুব ভালোভাবে সংরক্ষণ করা আছে একটা দাড়িগোঁফ
সম্বলিত মানুষের মাথা । ও যেদিকে যাচ্ছে, মাথাটাও সেদিকে ঘুরে যাচ্ছে !

“ওটা হলো ব্ল্যাকবার্ড দ্যা পাইরেটের মাথা ” গর্বিত মালিকের সুরে বলে উঠলো মিডনাইট।

ওখানে আরো আছে একটা কব্জি থেকে কাটা মানুষের হাত। ওপরের দিকে উঁচানো আঙ্গুলের
মাথায় লাগানো একটা করে কালো রঙের মোমবাতি। ওটা কোন সাধারণ মানুষের হাত নয়, নিশ্চয়ই
কোন শক্তিশালী কোন মানুষের হাত হবে। আরেকটা জার ভর্তি হয়ে আছে ছোট্ট ছোট্ট অনেক
মানুষের দঙ্গলে, ওরা সেখানে পাগলের মতো নেচে বেড়াচ্ছে। আছে অনেকগুলি মমি,
সারকোফেগি, হরেকরকম মুসলিম সাধুদের নানান পুরাতত্বের একটা বিশাল বক্স, আর .........

মিড নাইট একটা আকৃ তি থেকে তেরপল সরালো। ধুলো উড়ল বেশ খানিকটা। রুমের কোন এক
প্রান্তে , একটা ভু ত খলখল করে হেসে উঠলো, কারণ ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা চেয়ার।
সিং সিং কারাগারের একটা ইলেকট্রিক চেয়ার ওটা।

কনস্টেনটিন ঢোঁক গিললো “ভু লেই গিয়েছিলাম যে ওটা কত বড় !”

মিডনাইট নড করলো “সিং সিং কারাগারে, এই কাঠ আর স্টিলের কাঠামোর ভেতর দিয়ে দুইশ
আত্মা পার হয়ে গেছে!”

“হুম” কনস্টেনটিন মাথা নাড়ল। সে জানে , সেইসব আত্মাদের মধ্যে একটা আত্মা , ম্যাজিকে
সিদ্ধহস্ত ছিলো। সে ওই চেয়ারে থাকা অবস্থাতেই, জাদুমন্ত্রের মাধ্যমে একটা পালানোর পন্থা বের
করতে চেয়েছিল। সেই জাদু কর্ক শ আর তেড়ছা একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে ফেলে, কারণ
ইলেক্ট্রিসিটি আঘাত হেনে ফেলেছিল তখন। আর, সেই ঘটনার প্রভাব এখনও আঁকড়ে আছে এই
ভয়ংকর দেখতে চেয়ারটাতে।
228

“তু মি জানো ” কনস্টেনটিন বললো চেয়ারটার দিকে চিন্তিতভাবে তাকাতে তাকাতে “উনিশ’শ
শতকের ওরা ভাবতো – ইলেক্ট্রিসিটি জিনিসটা কাউকে মেরে ফেলার জন্য পরিষ্কার একটা পন্থা ।
হাস্যকর, তাই না ? কিভাবে সেটা তোমাকে একদম ফ্রাই বানিয়ে ফেলে। মাংস পোড়ার গন্ধ, জীবন্ত
মগজ সেদ্ধ হওয়া। থমাস এডিসন শুরু করেছিলেন এটা – ১৮৮৭ সালের দিকে। উনি কু কু র ,
বেড়াল , এমন কি একবার একটা সার্কাসের হাতিকে পর্যন্ত বিদ্যুৎ-স্পৃষ্ট করে মেরে ফেলেছিলেন।
এটা বোঝানোর জন্য , যে এ সি কারেন্ট কতোটা ভয়ংকর--- ”

“তু মি থেমে যাচ্ছ” বাঁধা দিয়ে বলে উঠলো মিডনাইট “তু মি কি এটা করতে চাও কি চাও না ?
আমার হাতে সারারাত সময় নেই । ”

কনস্টেনটিন একটু পিছিয়ে এলো। মিডনাইট ঠিকই বলেছে, সে একটু থমকেই গেছে বটে।

সে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসলো। একটা ভূ তু ড়ে কম্পন অনুভব করলো সেখানে বসামাত্র। ওর
আধ্যাত্মিক সত্ত্বা , সেই চেয়ারের কাঠে লেগে থাকা আবেগ অনুভু তি টের পাচ্ছিলো যেন।
আতংক, হতাশা। সাহায্যের জন্য চিৎকার যেটা কিনা কেউ শুনতে পাবে না – সবই ওই চেয়ার
থেকে উদ্গত হচ্ছিলো ও সেখানে বসামাত্র। কোন হত্যাগৃহ থেকে বের হওয়া পুঁতি গন্ধের মতোই।

কনস্টেনটিন একটা শ্বাস ফেলে জুতো আর মোজা খোলা শুরু করলো।

“কত বছর হলো , তু মি সেখানে গেছ ?” মিড নাইট জিজ্ঞেস করলো।

“এটা মোটর সাইকেল চালানোর মত অনেকটা” কনস্টেনটিন জবাব দিলো।

“হুম, সেরকম কিছুই না ” মিড নাইট প্রত্যুত্তর দিলো। তারপর একটা সিঙ্কের কাছে গিয়ে একটা
গামলাতে পানি ভরতে লাগলো।

সে পানি ভরতে ভরতে কনস্টেনটিনের দিকে তাকালো “আমাকে এটা বলো যে, এটা তো ওই
মেয়েটার সম্মন্ধে কিছু নয় ?”
229

“অবশ্যই, বেশীরভাগই ওর সম্মন্ধে নয় !”

মিডনাইট হাসলো। ক্ষণিকের জন্য ওদের এক সময়কার গাঢ় বন্ধু ত্ব যেন ছুঁ য়ে গেলো ওদেরকে।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে , কনস্টেনটিনের কাছে এসে ওর খালি পায়ে পানিটা ঢেলে দিলো। কংক্রিটের
মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো সেগুলো।

“ঠাণ্ডা” কনস্টেনটিন বললো। পানিটার কথাই বললো সে। একইসাথে ওর মনে পড়লো , ওর
দেহটা কত দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে যাবে মারা যাবার পর – যদি এই ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
মিড নাইটের ম্যাজিক তৈরি করবে ইলেক্ট্রিসিটি, আর সাথে থাকবে চেয়ারে আটকে থাকা জাদু –
কিন্তু সেটা যে ওকে মেরেই ফেলবে না , কে বলতে পারে ?

মিড নাইট একটা জিন এর বোতল টেনে নিলো, সেখান থেকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মতো করে চু মুক
মারলো কনস্টেনটিন। ওর ঠাণ্ডা নার্ভ পুড়িয়ে দিয়ে, জ্বলতে জ্বলতে নেমে গেলো তরলটা।

“একটু স্বাদ নেই ” বলে মিডনাইটও এক চু মুক খেলো বোতলটা থেকে। হাতে করে খানিকটা নিয়ে,
তিনদিকে ছিটিয়ে দিলো সেগুলি। তারপর একটা শেড ছাড়া টেবিল ল্যাম্পের দিকে এগিয়ে
গেলো। সেটা অন করলো সে। ল্যাম্পের গোড়াটা আঁকড়ে ধরে বাল্বটা আছাড় মেরে ভাংল
টেবিলের ওপর। ফু লকি উঠলো সেখান থেকে। ফিলামেন্টটা চেপে ধরলো সে, বৈদ্যুতিক শক্তির
স্ফু রণ হচ্ছে এখনও সেখান থেকে।

“তু মি এ ব্যাপারে নিশ্চিত ?” কনস্টেনটিনের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো সে।

“না !” উত্তর এলো। মিডনাইটের কাছে মিথ্যে বলে লাভ নেই কোন। ও স্টিলের দরজার ওপাশ
থেকেও ভয়ের গন্ধ পায় !

মিডনাইট কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো , তারপর কনস্টেনটিনের পায়ের আশেপাশে ভেজা
মেঝেতে , ল্যাম্প থেকে আনা জ্যান্ত ফিলামেন্টটা ছোঁয়াল।
230

আর কনস্টেনটিন সাথে সাথে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পড়লো !

পনেরো

“পাটের ডে কায়েলিস, ডিউস, মিসেরে নবিস ” মিডনাইট একটানা সুরে আবৃত্তি করে চলেছে ।

কনস্টেনটিন সেই শব্দগুলো শুনতে পাচ্ছিলো, যেন এক জগত দূর থেকে, ইলেক্ট্রিসিটি ওর রন্ধ্রে
রন্ধ্রে সেঁধিয়ে গেছে। ওর শরীর শক্ত হয়ে গেছে, দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে সে। ইলেকট্রিক ওর
অস্থি মজ্জায় ঠিক একটা সাপের মতই বিস্তৃ ত হয়ে চলেছে। ওর চু ল পুরে যাচ্ছে চড়চড় করে, টের
পেলো সে।

“ফিলি রেদেম্পর মুন্দি , ডিউস, মিসেরে নবিস। ফিলি রেদেম্পর মুন্দি , ডিউস মিসেরে......”

ঘরটা কনস্টেনটিনের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে যেন, কনস্টেনটিন অনুভব করতে পারলো। ঠিক
যেমন রকেটের নিচ থেকে মাটি সরে সরে যায়। আর সেই ইলেকট্রিক প্রবাহ একটা তীব্র
আলোকচ্ছটা তৈরি করে, ক্রমশ চারপাশের জগতটা যেন আচ্ছন্ন করে ফেলছে। সেই আলো
ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আর পরিণত হচ্ছে প্রায় অনন্ত পর্যন্ত বিস্তৃ ত একটা লম্বা আলোর রেখাতে।
কনস্টেনটিনের আত্মা ঝু লে রয়েছে কয়েক ভু বনের মাঝখানে, বাঁধা আছে সেই রুপালি সুতার
সাথে। সেই সুতা, কনস্টেনটিন জানে, কয়েকটা মহাবিশ্ব সমান লম্বা হতে পারে, যেটা আঁকড়ে ধরে
আছে একজন অসম্ভব মানসিক শক্তির অধিকারী লোক – পাপা মিডনাইট।

“ফিলি রেদেম্পর মুন্দি , ডিউস, মিসেরে নবিস। ফিলি রেদেম্পর মুন্দি , ডিউস মিসেরে......”
231

সেই স্বর যেন কয়েকটা গ্যালাক্সি জুড়ে ধ্বনিত হচ্ছে , অনেএএএক অনেক দূর থেকে , সময়ের শুরু
থেকে যেন। কনস্টেনটিনের মনে হচ্ছিলো , ও যেন সময়ের শেষপ্রান্তে এসে পড়েছে। এটার যেন
কোন শেষ নেই, হয়ত আছে, একসাথে সব কিছুই শেষ হয়ে যাবে হয়তো। সকল আপাতবিরোধী
জিনিস যেন এখানে আছে, সসীমতা আর অসীমতা , এমন এক স্থান যেটা অসীমের দিকে চলে
গিয়েছে, একটু বাঁকাভাবে। সময় আর সময়হীনতা যেন একইসাথে অবস্থান করছে। সময়......
এটাই দরকার ওর, সময়ের স্রোতের ভেতর দিয়ে সাঁতার কাটতে চায় ও, একটা স্পিড বোট নিয়ে
এগিয়ে যেতে চায় সময়ের স্রোতের বিরুদ্ধে।

এখন, ও সেই সময়ের স্রোতের ভেতরে যে জায়গাতে ও যেতে চায়, সেটা ওকে খুজে নিতে হবে।
যদি ও ওর আধ্যাত্মিক মনন দিয়ে সেটাকে খুজে নিতে পারে, সেটাই ওকে টেনে নেবে সেখানে।
সেই নির্দি ষ্ট জায়গা আর সময়...... পৃথিবী .........

আর, ও দেখতে পেলো , পায়ের নিচে পৃথিবীটা ঘুরতে শুরু করেছে ! এখন – ওকে সময় আর
স্থান দুই ক্ষেত্রেই নড়াচড়া করতে হবে। বল্লমটা মনে ভাসাও ! সাঙরে ডে ডিও... ক্রু সিফিক্সনের
সেই রক্তাক্ত বল্লম.........

ও নিজের মনে ছবিটা ভাসিয়ে তু ললো , ক্রু শে বিদ্ধ যীশু খ্রিস্ট ......

ওই যে তিনি ! সেই একমেবাদ্বিতিয়ম – সময়ের ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছে তাকে কনস্টেনটিন !
সাবধান , এই সেই মহান যীশু খ্রিস্ট !

উনার গায়ের রঙ বেশ গাঢ়। লম্বা কালো চু ল বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, মাথায় পরানো কাঁটার মুকু ট।
কৃ শকায় শরীর, ঘন ভ্রু , ওনার কালো চোখ , ওহ , সেই অসম্ভব কালো চোখ ---

--- তাকালো কনস্টেনটিনের দিকে ! এটা কিছুতেই সম্ভব নয়, কনস্টেনটিন তো অদৃশ্য থাকার কথা।
তবুও যীশু খ্রিস্ট ওর দিকে তাকিয়ে আছেন !
232

কনস্টেনটিন কেঁ পে উঠলো। টের পেলো, সেই অন্তর্ভে দী দৃষ্টি ভেদ করে যাচ্ছে তাকে। একটা বিশাল
করুণাধারা যেন ধুইয়ে দিলো অত অন্তর । এটা খুবই অদ্ভু ত, যে ব্যাক্তি নিজেই কিনা ক্রু শে বিদ্ধ,
তিনিই আবার অন্য কারো জন্য করুণা অনুভব করতে পারেন ! একটা কাক যীশু খ্রিস্টের কাধে
বসে ওনার চোখে ঠোক্কর মারার চেষ্টা করে যাচ্ছে । কিন্তু তবুও তিনি কনস্টেনটিনকে কৃ পা করছেন ।
তিনি পুরো বিশ্বকেই কৃ পা করছেন ।

এটা কি একটা সুযোগ ? মুক্তির একটা সুযোগ – নরকের নিশ্চিত গন্তব্য থেকে পরিত্রাণ পাবার
একমাত্র উপায় ? কনস্টেনটিনের একবার মনে হলো যীশু’র কাছে সাহায্য চাইবে – কিন্তু নিজের
মিশন আর এঞ্জেলার কথা মনে পড়ে গেলো। যীশু খ্রিস্ট যে ধরণের মুক্তির কথাই বলবেন না কেন,
সেটার জন্য সময়ের প্রয়োজন। মিড নাইট অনন্তকাল সময় মন্ত্র বলে যেতে পারবে না । ইতস্তত
করতে করতেই , কনস্টেনটিন দেখতে পেলো একজন রোমান সৈন্য যীশু’র দিকে এগিয়ে এসে,
একটা বল্লম গেঁথে দিলো ওনার একপাশে মৃত্যু তরান্বিত করার জন্য।

বল্লম থেকে রক্ত আর পানি ছিটকে পড়লো, ঠিক যেমন বাইবেলে বলা আছে। আকাশ চিরে গেলো
বজ্রধ্বনিতে, পৃথিবী যেন দুলতে লাগলো। কনস্টেনটিন ওর মনোযোগ জোর করে বল্লমটার দিকে
ধরে রাখলো। সেটাকে অনুসরণ করতে শুরু করলো সে। সেই রোমান সৈন্যটার জীবন অনুসরণ
করলো সে, যে কিনা বল্লমটা বিক্রি করে দেয় এক খ্রিস্টান সাধুর কাছে। তাঁর কাছ থেকে চু রি যায়
সেটা, আবার চু রি যায় , তারপর রোমের একটা অন্ধকার গর্ভ গৃহে ওটাকে লুকিয়ে রাখা হয়।
তারপর একজন নাৎসি আরকিওলজিস্ট সেটাকে আবিস্কার করে। পাঠিয়ে দেয় তাদের গোপন
অকাল্ট রিসার্চ সেন্টারে, যেটা কিনা মেক্সিকোতে অবস্থিত ছিলো।

কনস্টেনটিন সময়ের স্রোতকে একটা নির্দি ষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছিল। ও যেন জীবন্ত মানুষের
টানেলের ভেতর দিয়ে স্রোতের মত বয়ে যাচ্ছিল। নিরন্তর এক জন্ম মৃত্যুর প্রবাহ, একটা নির্দি ষ্ট
ছন্দের ঢেউ এর মত।

কনস্টেনটিনের আত্মা সময় পরিভ্রমণ করে চলেছিল। এসে গেলো বর্ত মান সময়ের মেক্সিকোতে।
233

একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত চার্চে । একজন কৃ শকায় লোক, এক মানুষ ধাঙ্গড় – ধ্বংসস্তুপের ভেতর দিয়ে
এগিয়ে যাচ্ছে। তারপর নিচু হয়ে কি জানি একটা তু লে নিচ্ছে নিচে থেকে......

সাঙ্গরে ডে ডিও ! ঈশ্বরের রক্ত। সেই বল্লমটা – কেবল ফলাটা রয়ে গেছে। যেটাকে যীশুর শরীরের
পাশে ঢু কিয়ে দেয়া হয়েছিলো। একটা পুরাকীর্তি , যেটা কিনা ঐশ্বরিক শক্তির আধার।

ধাঙড়টি পেছনে ফিরে তাকালো – মনে হলো দেখতে পেয়েছে কনস্টেনটিনকে। না , ওকে ভেদ
করে পেছনে তাকিয়েছে সে। কিন্তু ওর উপস্থিতি টের পেয়েছে সে।

কনস্টেনটিন ওকে অনুসরণ করলো, দেখলো কারটা ওকে ধাক্কা মারলো , কিন্তু লোকটার কিছুই
হলো না। ওই ঈশ্বরের রক্ত লেগে থাকা বল্লমটাই কেবল এটা ব্যাখ্যা করতে পারে।

আর, দেখতে পেলো, কি অবলীলায় সেই লোকটা মানুষজন খুন করে যাচ্ছে, জিনিসপত্র ধ্বংস
করছে ! সে বাঁধা দিতে চাইলো কয়েক জায়গায়, কিন্তু সেই ঘটনা গুলো ইতিমধ্যে ঘটে গেছে।
সেখানে ওর কোন জারিজুরি আর খাটবে না। বেশ তৃ প্ত ভঙ্গিতে খুন করে যাচ্ছে লোকটা, দেখে
মনে হচ্ছে বেশ আনন্দও পাচ্ছে। এতো শক্তিশালী একটা পুরাকীর্তি এই জাত খুনে লোকটার
কাছে করছে টা কি ?

সেই লোকটার সাথে , অন্য আরেকটা কিছুর অস্তিত্বও টের পেলো কনস্টেনটিন। অন্ধকারময়,
ভয়ঙ্কর একটা সত্ত্বা, ধাঙ্গড়টিকে কানে কানে ফু স মন্তর দিচ্ছে, দেখছে ওকে। ওটা একটা নারকীয়
সত্ত্বা, অদৃশ্য কিন্তু অনেক শক্তিশালী। আর পরিস্থিতির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে ওর, পাপেট
মাষ্টারের ভু মিকা পালন করছে, কলকাঠি নাড়ছে পেছন থেকে।

কনস্টেনটিন একবার ভাবলো খুজে বের করে ওই লোকটা আসলে কে। তারপর ওকে পুলিশে
ধরিয়ে দেয়। কিন্তু পরক্ষণে ভাবলো , ম্যামন যখন পৃথিবীর দখল নেবে, তখন কি আর পুলিশ
বলতে কিছুর অস্তিত্ব থাকবে ? তখন কেবল অপরাধী আর অপরাধের শিকারেরা থাকবে, আর
কেউ না ।
234

ওই পুরাকীর্তি টার ভেতরে অসম্ভব এক শক্তি রয়েছে, টের পেলো কনস্টেনটিন। যদি কোন ধরণের
জাদু শক্তি না থাকা সত্ত্বেও একজন লোক ওটা দিয়ে দেয়াল ফেড়ে ফেলতে পারে অবলীলায়।
তবে একজন জাদুকর বা একটা পিশাচ ওটা দিয়ে অনায়াসে দুটো জগতের দেয়াল ধসিয়ে দিতে
পারে।

ম্যামন কি কেবল পৃথিবী দখল করেই থেমে যাবে ? ও কি নরকের সীমা স্বর্গ পর্যন্ত বিস্তৃ ত করতে
চাইবে না ?

তারপর, হাইড্রোথেরাপি রুমে দেখতে পেলো লোকটাকে, কান খাড়া করে কি জানি শুনছে।
কনস্টেনটিন শুনতে পাচ্ছে না কি বলা হচ্ছে ওকে, হয়তো ওর মনের ভেতর গিয়ে বলা হচ্ছে
সেগুলি। লোকটা একটা বেড খুজে নিলো একপাশে, তারপর চাদর গায়ে দিয়ে প্রায় সাথে সাথে
ঘুমিয়ে গেলো।

কনস্টেনটিন লোকটার কাছে এগোল অদৃশ্যভাবে। ও কি কোনভাবে সেই বল্লমের মাথাটা নিয়ে
আসতে পারেনা এখানে ? ওটার ভেতরে যে ঐশ্বরিক শক্তি আছে, সেটার বলে কি ওটাকে একটু ও
তু লে ধরতেও পারবে না ? লুকিয়ে ওটাকে কোথাও রেখে দিয়ে, পরে এসে তু লে নিতে পারবে না?

ধাঙ্গড়টি হঠাৎ উঠে বসে , ওর গলা চেপে ধরে বসলো ! যেটা কিনা সম্পূর্ণ অসম্ভব।
তবুও সে এক হাতে কনস্টেনটিনের গলা চেপে ধরলো, আরেক হাতে ধরে থাকলো সেই বল্লমের
মাথাটা। ওই স্পর্শটাই ওকে শক্তি যোগাচ্ছে, একটা সম্পূর্ণ অদৃশ্য আত্মাকে গলা চেপে ধরতে
পারছে।

কনস্টেনটিন সংগ্রাম করছে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য, কিন্তু কোন পথ খুজে পাচ্ছে না। চেয়ারে
বসে থাকা ওর শরীরটাও একইসাথে ছটফট করছে, হয়তো কোন সাজেশনের মাধ্যমেই হবে !

ওই অবস্থার মধ্যেও, কনস্টেনটিন নিজেকে আচ্ছাসে গালাগালি করলো মনে মনে। ওর জানা
উচিত ছিল, আগেও সেই ধাঙ্গড়টা ওর উপস্থিতি টের পাচ্ছিলো। হয়তো সেই নারকীয় সত্ত্বাটা
235

ওকে অপেক্ষা করতে বলেছে যতক্ষণ না কনস্টেনটিন কাছে না আসছে। ম্যামন হয়তো ওই
লোকটার মাধ্যমে কনস্টেনটিনকে মারার পথ খুঁজে নিয়েছে। কোন এক অন্ধকার আর গভীর কোণ
থেকে যেন ভেসে আসছে ভীষণ এক অট্টহাসি !

এটার কোন মানে নেই । কনস্টেনটিন ভাবলো, হাল ছেড়ো না, শরীরকে দিয়ে কথা বলাও। চেয়ারে
বসে থাকা শরীরটাকে নিয়ন্ত্রণ করো। ওটাও গলা চেপে ধরার ফলে দম আটকে আছে, কিন্তু
কোনভাবে যদি শব্দ করানো যায়ঃ

“মিডনাইট !”

তখনই সে টের পেলো, শক্ত দুটো হাত ওকে ফিরিয়ে আনলো। মিড নাইটের স্টোর রুমে এসে,
দমাস করে নিজের মরণশীল দেহে ঢু কে পড়লো সে। নিজেকে সেই চেয়ারেই বসা অবস্থায় আবিষ্কার
করলো, শ্বাস নেয়ার জন্য হাফাচ্ছে। নড করে মিডনাইটকে ধন্যবাদ জানালো সে।

“এনি লাক ?” মিড নাইট জিজ্ঞেস করলো দায়সারাভাবে, ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে।

কনস্টেনটিন জবাব দিলো না। ওর কেমন জানি অদ্ভু ত লাগছিলো, ইলেকট্রিফাইড হবার পরে শরীর
থেকে বের হয়ে যাওয়া, নিজের কাছেই নিজের শরীর ভারী মনে হওয়া। শরীরে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ
যেন নতু নভাবে টের পাচ্ছিলো সে। নিজেই নিজের গন্ধ পাচ্ছিলো সে, পুরানো তামাক আর কফির
স্বাদ মুখ জুড়ে। ভেতরকার প্রত্যেকটা ব্যাথা চিৎকার করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। নিজের
পরনের কাপড়ই খড়খড়ে লাগছে নিজের কাছে। নিজের ফু সফু সের ভেতরের টিউমারটাও
পরিষ্কার অনুভব করতে পারলো সে, যেটা কিনা ওকে কু রে কু রে খেয়ে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে
ধীরে ধীরে।

কিছু সময় পরে, নিজেকে পুরোপুরি ফিরে পেলো সে আবার। গলা ডলতে ডলতে ভাবতে
লাগলো, রেভেন্সকারে যেতে হবে ওকে। ওই বল্লমটার কাছে। কিন্তু ‘সাঙ্গরে ডে ডিওস’ অবশ্যই
ভালোভাবে সুরক্ষিত থাকবে ওইসব নারকীয় জীবের দ্বারা।
236

“কু উউল !” চ্যাজ বলে উঠলো , রুমের চারপাশে, পুরাকীর্তি গুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে ।
বিশেষ করে ব্ল্যাকবিয়ার্ডে র মাথাটার দিকেই নজর ওর।

কনস্টেনটিন আর মিড নাইট দুজনেই ওর দিকে তাকিয়ে কড়া নজর হানলো একটা। কনস্টেনটিন
কেবল বিরক্ত হলো, কিন্তু মিডনাইটের দৃষ্টিতে সতর্ক তা। চ্যাজ এমন ভাব করলো যেন দেখতেই
পায়নি, যেন ওর এখানে হুট করে চলে আসাটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।

“আপনি পাপা মিডনাইট” ভু ডু মাষ্টারের দিকে ইঙ্গিত করে বললো চ্যাজ।

মিড নাইট চোখ রাঙ্গাল “তু মি ভেতরে কিভাবে এলে ?”

চ্যাজ কাঁধ ঝাকালো “নিজের পথ নিজেই খুঁজে নিয়েছি। ওখানে, ওপরে অপেক্ষা করতে
চেয়েছিলাম। ধ্বংস পাহাড়ের ওপর বসে থাকা ‘গোলেম’ এর মতো লাগছিলো নিজেকে।
তাছাড়া, ওখানে কিছু একটা আমাকে খেয়ে ফেলার ষড়যন্ত্র করছিলো ! ”

“বাজে কথা ” মিডনাইট বলে উঠলো “ওটা কেবল তোমার স্বাদ নিচ্ছিল, বড়জোর দুয়েক কামড়
দিতো বেশী হলে ! ”

“ওহ, সেটা অনেক ভালো একটা ব্যাপার, তাই না ?” মুখ বাঁকালো চ্যাজ।

“ধরে নিচ্ছি তু মি কনস্টেনটিনের সাথে এসেছ ?” মিডনাইট বললো। তারপর পালা করে
কনস্টেনটিন আর চ্যাজের দিকে তাকাতে লাগলো ।

“আমার শিক্ষানবিশ ” কনস্টেনটিন একটা শ্বাস ফেলে বললো।

“যখন ও আমাকে সুযোগ দেয় আর কি ” গজগজ করে বললো চ্যাজ।

“তোমার শিক্ষানবিশ ? সত্যিই ?” ভ্রু কপালে তু লে জিজ্ঞেস করলো মিডনাইট “এটাই পেলে তু মি
শেষমেশ ?”

“তোমার যা আছে, তাই নিয়েই তো কাজ করতে হবে ” কনস্টেনটিন বললো।


237

মিডনাইট ওর জম্বি গ্ল্যাডিয়েটরদের ফাইটের দায়িত্ব দিলো ওর এক অধঃস্তনকে। আর


কনস্টেনটিনকে ওর ‘রান্নাঘর’ ব্যাবহার করার অনুমতি দিলো। তাত্ত্বিকভাবে – সেটা ওর
তত্ত্বাবধানেই হবার কথা। কিন্তু সেটা কেবল ‘তাত্ত্বিকভাবেই’ , এটা অনেক আগেই মিড নাইট
জানতো।

সে সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো কিভাবে কনস্টেনটিন ধর্মীয় গুরুত্বসম্পন্ন পুরাকীর্তি গুলো
একটা ফ্রাইং প্যানে নিয়ে , একটা স্টোভে সিদ্ধ করছে ! ছোট ছোট জপমালা, রুপার তৈরি, একটা
সোনার ক্রশ যেটা কিনা জোয়ান অব আর্কে র ছিলো, একদম প্রথম সেইন্ট খ্রিস্টোফারের মেডেল,
একটা রুপার ক্রশ যেটা কিনা রাজা আর্থারের ছিলো , আরেকটা কয়েন যেটার কথা স্বয়ং যীশু
খ্রিস্ট বাইবেলে বলেছিলেন (ওটার গায়ে কার জানি মুখ খোদাই করা......) । আরও আছে সেন্ট
পিটারকে আঘাত করা তীরের মাথা, জুডাসের ব্যাবহার করা পেষণযন্ত্র......

কাছেই একটা কাউন্টারে রাখা আছে একটা ছাঁচ , যেখানে এইসব পবিত্র জিনিসের গলিত তরল
ঢালা হবে।

কনস্টেনটিনকে ওসব জিনিস চূ র্ণ বিচূ র্ণ করে, গলাতে গলাতে দেখতে লাগলো মিডনাইট। সে
নিজে কখনও ওসব জিনিস ওভাবে মেশাত না। ও একটা দৃষ্টি নিয়ে কনস্টেনটিনের দিকে
তাকালো , যার মানে হলো – একমাত্র তু মিই পারো , এভাবে এসব করতে !

রান্নাঘরটা বিশাল, একটা ক্যাফেটেরিয়ার সমান বড়। চকচকে টাইলস, স্টেনলেস স্টিলের সিঙ্ক আর
বিরাট বিরাট সব স্টোভ রাখা, যেগুলো অকল্পনীয় তাপ সহ্য করতে পারে। চ্যাজ অনেক
গভীরভাবে চিন্তা করতে করতে কনস্টেনটিনের দিকে তাকাতে লাগলো । ওখানে রাখা
ফ্রিজগুলোতে কৌতূ হলী দৃষ্টি বোলাতে গিয়ে রীতিমতো গা গুলিয়ে উঠেছিলো ওর। ওখানে
জমিয়ে রাখা জিনিসপত্রের মধ্যে মানুষের বিভিন্ন কাটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গও দেখতে পেয়েছে সে –
মিডনাইট সেগুলোর ব্যাখ্যা দিয়েছে এভাবে –
238

ওগুলো স্রেফ মৃত কিছু অপরাধীদের দেহাবশেষ। শিশু হত্যাকারী বা ওই ধরণের লোকেদের। আর
জেলখানার গার্ডে রা ‘উপযুক্ত মুল্যের’ বিনিময়ে ওগুলো আমার কাছে বিক্রি করে দেয়। আর তু মি
জানো , আমার বেশ কিছু কর্মচারী মানুষ না – হা হা হা ! আর ওরা মানুষ ছাড়া আর কিছু খেতে
পারে না !

অন্যান্য সেলফে আছে দুটো ইয়র্ক শায়ার টেরিয়ার কু কু র, একটা বরফে জমে যাওয়া কু কু রছানা ,
একটা এনাকোন্ডা, পশমি পার্কা গায়ে এক আস্ত এস্কিমো (ওটার পেছনে বিরাট এক ইতিহাস
আছে বলে মিডনাইট দাবী করেছে )। একটা জেব্রার মাথা , অজগরের সমান বড় একটা কেঁ চো,
একটা পুরো ব্যারাকু ডা, একটা ছ’ফিট লম্বা স্কু ইড , একটা ছোট্ট ভালুকছানা, অনেকগুলো গুবরে
পোকা, বাজে রকমের বড় দেখতে মাকড়শা, অনেকগুলো অজানা প্রাণীর হৃৎপিণ্ড , ছয় ধরণের
ব্রেইন, অনেকগুলো কোকু ন আর একটা কু য়েলাকাঁথ। আরও আছে অনেকগুলি মুরগী, হ্যাম,
সসেজ, টার্কি , জমে যাওয়া পিজ্জা, জ্যামাইকান মশলাদার গরুর মাংস, আর অনেক গ্যালন
ব্রায়ার এর আইসক্রিম।

“ওটা কি ওই লোহা গলানোর মতো যথেষ্ট তাপ দিতে পারবে ?” চ্যাজ ওর একটা কব্জি কামড়াতে
কামড়াতে বলে উঠলো।

“ওহ, হ্যাঁ। আমাদের এখানে অনেক বেশী পরিমাণ তাপের দরকার হয়” জবাব দিলো মিডনাইট
“বিশেষ করে যখন একটা পুরো শরীর রান্না করতে হয় ......”

চ্যাজ আঁতকে উঠলো , ইস, কেন যে জিজ্ঞেস করতে গেলো ।

“আর কিছু আছে, আশীর্বাদপুষ্ট এবং বহনযোগ্য ?” হাতের পটটা তাপনিরোধক গ্লাভস দিয়ে ধরে
নাড়তে নাড়তে জিজ্ঞেস করলো কনস্টেনটিন “এমনকি ধর্মীয় বা জন্তু জানোয়ারের মূর্তি হলেও
চলবে ”
239

মিডনাইট ইতস্তত করলো একটু , তারপর একটা চাপা গজরানির সাথে ওর অসন্তুষ্টি প্রকাশ
করলো। সে ইতিমধ্যেই অনেক কিছু দিয়ে ফেলেছে কনস্টেনটিনকে। তারপর হাত থেকে মিশরীয়
বিশেষ এক চিন্হ আঁকা একটা সোনার আংটি খুলে ধরলো আলোর সামনে “তোমার কি কোন
ধারণা আছে এটার কত দাম ?”

“হ্যাঁ—আমিই বিক্রি করেছিলাম ওটা তোমার কাছে। চিন্তা করোনা, ওটা একটা নকল !”

মিডনাইট ওর দিকে খুনে দৃষ্টিতে তাকালো এবার ।

“আরেহ ! ” কনস্টেনটিন বলে উঠলো “আমি তো ঠাট্টা করছিলাম ”

চ্যাজ গলা খাঁকারি দিলো , আশা করলো কনস্টেনটিন ওর এই বাজে ধরণের ঠাট্টা বন্ধ করবে।
মিডনাইটের মেজাজের পারদ চড়ে আছে, বোঝাই যাচ্ছে। সে যদি রেগে গিয়ে বজ্র টজ্র ছোড়াছুঁ ড়ি
শুরু করে দেয়, তবে চ্যাজ সেই ক্রসফায়ারের মাঝখানে পড়ে যেতে পারে।

মিড নাইট সোনার আংটিটা প্যানের মধ্যে ফেলে দিলো। মুখ বাঁকা হয়ে গেলো ওটাকে গলতে শুরু
করতে দেখে।

“ওই বল্লমের সাথের লোকটাই কেবল চিন্তার কারণ নয়” বললো মিডনাইট “এ ধরণের কাজের
জন্য শতাব্দিব্যাপী পরিকল্পনার প্রয়োজন। ”

কনস্টেনটিন জানে ও কি বলতে চাচ্ছে। ম্যামন সব ধরণের সম্ভাবনার কথাই মাথায় রাখবে। কিন্তু,
সে তো কনস্টেনটিনকেও মাথায় রেখে ওকে মারার জন্য আততায়ী পাঠিয়েছে, সম্ভবত ওই
ক্যান্সারও ওরই পাঠানো। কিন্তু, তবুও কনস্টেনটিন টিকেই আছে শেষমেশ।

কনস্টেনটিন চ্যাজের দিকে ইশারা করলো ছাঁচটা ধরার জন্য। চ্যাজ ওটা তু লে নিলো, শক্ত করে
ধরে রাখলো ধাতব কন্টেইনারটার হাতল। ওর ভয় হলো , কনস্টেনটিন এতক্ষণ মিডনাইটের তৈরি
ব্রান্ডি টানছিলো দেদারসে, সে হয়তো ওই গলিত লোহা ফেলে দেবে ওর হাতে।
240

কনস্টেনটিনের আগে থেকেই এসব অভ্যাস আছে। ও স্থির হাতে , সেই ছাঁচের ওপর গলিত লোহা
ঢালতে লাগলো সে, বুলেটের ছাঁচ ওগুলো। রুম ভরে গেলো খনিজ পদার্থের গন্ধে, যেন কোন
লাভা ভর্তি গুহায় এসে উপস্থিত হয়েছে ওরা।

ওদের নিজস্ব আকৃ তি হারিয়ে ফেলায়, কিছু কিছু পুরাকীর্তি র শক্তি কমে গেছে অনেকটাই। কিন্তু
কনস্টেনটিনের ধারণা, এর পরেও সেগুলি থেকে ঐশ্বরিক শক্তি ঠিকই নির্গত হবে, একটু তরল
আকারে, এই যা।

মিডনাইট বললো “তু মি আরেকবার একটু ভেবে দেখতে যদি......”

ফলাফলটা অব্যক্তই রয়ে গেলো। যদি কনস্টেনটিন কিছু না-ই করে, তবে যখন পৃথিবী আর নরক
একাকার হয়ে যাবে, তখন কোথায় গিয়ে আশ্রয় পাওয়া যাবে ? আসলে, আর ভাবার কিছুই নেই।

“তু মি আমার সাথে আসতে পারো” কনস্টেনটিন বললো অপ্রস্তুতভাবে “দুইজন বোকাও, একজন
বোকার মতোই সহজেই মারা পড়বে !”

মিডনাইট হাসলো ওর অসম্ভব সাদা রঙের দাঁত বের করে । এই ধরণের মন্তব্য ওরা আগেও
একজন আরেকজনকে করেছে।

“মনে হয় না” সে বললো “পৃথিবী যে-ই শাসন করুক না কেন , সেখানে দুঃখ, ভয়, হারানোর ব্যাথা
থাকবেই। আর আমি আরামসে আমার বার চালাবো ”

কনস্টেনটিন সন্দেহ করলো , যে ধরণের সুরক্ষার কথাই মিড নাইট ভেবে থাকু ক না কেন, সেটা
কাল্পনিক। আর ওটা ওর শক্তিশালী ইগো থেকেই এসেছে সেটা। সত্যিটা হলো , মিডনাইটের
শক্তিই কিন্তু ওর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। ও এমন ধরণের জাদু সম্মন্ধে বিশেষজ্ঞ, যেটা কিনা
আত্মবিশ্বাস আর ব্যাক্তিত্বের শক্তিকে জাদু শক্তিতে রুপান্তর করতে পারে। আর আপনি যতই
দাম্ভিক হবেন, জাদুর এই এলাকায় আপনি ততই শক্তিশালী হবেন। ওর ক্ষেত্রে, ইগোটাই শক্তিতে
রুপান্তর হয়ে যায় কোনভাবে। ওটা এমনকি জাদুকর নয়, এমন লোকদের বেলাতেও অনেক দেখা
241

গেছে, বিশেষ করে ইতিহাসের বিখ্যাত সব ব্যাক্তিত্বের মাঝে। যেমন, নেপোলিয়ন এর শক্তিগুলোর
মধ্যে একটা ছিলো ওনার নিজের ওপর অস্বাভাবিক রকমের বিশ্বাস। কিন্তু ওটাই আবার ওনাকে
প্ররোচিত করেছিলো শীতের আগ দিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করতে, একটা ভয়ঙ্কর ভু ল সিদ্ধান্ত।
নেপোলিয়ন আর মিড নাইটের মতো মানুষদের ক্ষেত্রে, নিজেদেরকে আত্মবিশ্বাসের দুর্গে আবদ্ধ করে
রাখে ওরা। বাইরের কোন কিছু যে ওদের অস্তিত্বের পক্ষে হুমকি হতে পারে, সেটা ওরা দেখেই না।
মিড নাইটের ক্ষেত্রে যেমন , সে নিজেকে শয়তানের পুত্রের সমকক্ষ একজন গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে
ভেবে বসে আছে !

ম্যামন সেরকম ভাবে না-ও ভাবতে পারে।

কিন্তু কনস্টেনটিন এগুলোর কোনটাই ভু ডু মাষ্টারকে বলতে পারছে না। ভু ডু মাষ্টার উপদেশ নেয়ার
মতো করে তৈরি হয়নি। যদি সে নেয়, তবে সে নড়বড়ে হয়তে যেতে পারে। এটাই ওর শক্তির
পরস্পরবিরোধী রুপ।

কনস্টেনটিন ছাঁচে গলিত তরল ঢালা শেষ করে, সেটা তু লে পাশের একটা বিশাল ঠাণ্ডা পানির
পটে ডোবাল। হিসসস করে বাষ্প বেরোতে লাগলো। সেই বাষ্পে যেন সন্তদের সদ্গু ণাবলীর ক্ষীণ
সুগন্ধ পাওয়া গেলো !

“কিভাবে ?” মিডনাইট জিজ্ঞেস করলো “তু মি এই বুলেটগুলো ব্যবহার করার মতো কাছে যেতে
পারবে বলে ভাবছ ?”

কনস্টেনটিন একপাশে মাথা হেলিয়ে ভাবতে লাগলো। মিডনাইটের কথায় যুক্তি আছে বটে।

উত্তরটা এলো সম্পূর্ণ একটা অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে। চ্যাজ খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে,
দুই জাদুকরের দিকে তাকালো একটু , তারপর কথা বলে উঠলো।

“ওরা এঞ্জেলাকে কোনরকম সুরক্ষা ছাড়া রাখবে বলে মনে হয় না......” চ্যাজ ইতস্তত করতে
লাগলো।
242

কনস্টেনটিন ভ্রু কু চকে তাকালো ওর দিকে , এই ট্যাক্সি ড্রাইভার কি ট্যাক্সি চালানো ছাড়াও
আরও কিছুতে কাজে আসতে যাচ্ছে শেষমেশ ?

“আমরা এখন জানি ” চ্যাজ বলে চললো “দো-আঁশলারা দুর্বল হয়ে পড়ে যখন কিনা ওদের
বাইরের ত্বকে হোলি ওয়াটার ছেটানো হয় কিংবা কিছু নির্দি ষ্ট জিনিসের সংস্পর্শে আসে ওরা।
বেশীরভাগ সাধারণ পানির উৎসকেই এই দুই ধরণের জিনিস দিয়ে আশীর্বাদ পুষ্ট করে তোলা যায়।
এমনকি বৃষ্টির পানিকেও। ”

ও আবারও ইতস্তত করতে লাগলো। ও কি নিজেকে বোকা প্রমাণ করতে চলেছে ? সামনে
এগোবার সিদ্ধান্ত নিলো ও, এখন আর পেছোবার রাস্তা নেই।

“ওই ধরণের কিছু যদি পাওয়া যায়” বলে চললো সে “তবে ভালো মানুষদের ওটা একটা সুবিধা
এনে দিতে পারে বটে ”

মিডনাইট ওর দিকে তাকিয়ে রইলো ।

চ্যাজ কাঁধ ঝাকালো “বেঞ্চে বসে থাকারও কোন মানে নেই যদি তু মি খেলার জন্যও প্রস্তুত না
থাকো ! ”

কনস্টেনটিন ওর দিকে কঠোর দৃষ্টি হানলো একটা।

মিডনাইটের দিকে সিরিয়াস দৃষ্টি হানলো চ্যাজ “তো , আপনার কাছে ওই ধরণের কোণ ম্যাজিক
ক্রশ আছে কয়েকটা, আছে কোন কোণায় ? ”

মিডনাইট খলখল করে হেসে উঠলো এবার ।

চ্যাজ নড করলো “কিছু মনে করোনা , জন। কিন্তু আমি মনে করিনা পৃথিবী রক্ষা করার জন্য স্রেফ
তোমাকে একলা পাঠানো ভালো কোন আইডিয়া !”

হাসি থামিয়ে দরাজ গলায় বললো মিডনাইট “নিয়ে যাও ওকে, পরে মেরে ফেলো !”
243

চ্যাজ হাসলো। একটা অসুস্থ হাসি, যেটা কোন কূ টবুদ্ধি সম্পন্ন লোকের মুখেই কেবল মানায়।

ষোল

এঞ্জেলা একটা কক্ষপথ ধরে ঘুরছে।

আপাত দৃষ্টিতে সেরকমই মনে হচ্ছে। একটা মহাজাগতিক গোলাঘরে ওকে আটকে রাখা হয়েছে।
ম্যামন যতক্ষণ সিদ্ধান্ত না নিচ্ছে যে সঠিক সময় এসেছে , ওভাবেই থাকবে সে। ডাইমেনশন
গুলোর মাঝখানে , বেশ কিছু নো- ম্যানস-ল্যান্ড আছে, পৃথিবী আর নক্ষত্র জগতের মাঝে অনেক
চির গোধূলির রাজ্য আছে । এঞ্জেলা সেরকমই একটা জায়গায় আছে, একটা সেলফের মতো
জায়গায় যেখানে হাত বাড়ালেই ওকে পাওয়া যাবে। জন কনস্টেনটিনের নাগালের বাইরে।

ওর নিচে রেভেন্সকার হসপিটাল দেখতে পাচ্ছে এঞ্জেলা। বুঝতে পারলো , ম্যামন ওকে আনার
জন্য বেশ শক্তিশালী একটা ‘কিছু ’ কে পাঠিয়েছিলো। আর রেভেন্সকার-ই হয়তো ওর পরবর্তী
গন্তব্য হতে যাচ্ছে, কারণ ওটাকে ঘিরেই বেশ জোরে জোরেই ঘুরছে সে, অনেকখানি ওপরে।
অদৃশ্যভাবে, পৃথিবীর মধ্যে , ঠিক মেলাতে থাকা নাগরদোলার মতো ।

ও সেখানে, সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্নভাবে থেকে, অনেক কিছুই চিন্তা করছিলো। ওর শরীরটা একটা
সময় আর স্থানের একটা বৃত্তে আটকে গেছে, কিছুতেই যেন আর কিছু এসে যায় না ,
এরকমভাবেই মৃত্যুকে বরণ করে নিতে সে প্রস্তুত করে নিচ্ছে নিজেকে।

সব মাংসই ঘাসের মতো, বাইবেলে আছে। এখানে, এই মহাজাগতিক বিচ্ছিন্নতার মাঝে থেকে –
ওর মনে হচ্ছিলো , ওই নিচে মানব সন্তানেরা যা যা করছে , সেসব কিছুরই আসলে কোন মানে
নেই। সেসব যেন খুবই ক্ষণস্থায়ী । ওর কক্ষপথ থেকে ও পরিষ্কার দেখতে পেলো , সময়ের গতিতে
244

ভ্রমণ করতে করতে – মানুষ আসছে আর যাচ্ছে। উত্থান ঘটছে , পতনও। সময়ের স্রোতের সাথে
পাল্লা দিয়ে ছুটছে মানব স্রোত। মানুষের মরণশীল জীবনে যেটাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, সময়ের
স্রোতে সেটা একটা শামুকের নড়াচড়ার চাইতে বেশী কিছু মনে হয় না।

ওর মনে পড়ে গেলো যেসব মানুষকে ও মেরেছে, সেই সময়কার বিভিন্ন উপলব্ধির কথা। ও
জানতো কিভাবে ওর ভেতরকার আধ্যাত্মিক শক্তি বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছিল আর কিভাবেই
বা তা পেয়েও গেলো। ও ওইসব লোকেদের খুনি স্বত্বা আর ইচ্ছা টের পেয়ে যেতো আর সহজাত
প্রবৃত্তি বশেই ওদেরকে থামাতো। এক দিক দিয়ে বলতে গেলে , সে ওইসব খুনিদেরকে ক্ষমা
পাওয়ার রাস্তাই করে দিত, কারণ ওরা নিজেরাও তো বন্দীই ছিলো একরকম।

সে আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে লাগলো পৃথিবীকে। ওখানে আছে দুই ধরণের অস্তিত্ব, একটা
ক্ষতিকর , আরেকটা সদাশয়। ক্ষতিকরদের সে চেনে, ওদের কয়েকটাকে সে নিজের হাতে যমালয়ে
পাঠিয়েছে। কিন্তু অন্যটা, ওর কাছে বেশ অচেনা লাগলো।

‘বোধিসত্ব’ শব্দটা ভেসে এলো ওর কাছে, ওর পড়াশোনা থেকে। মহান লোকেরা, যারা মরণশীল
পৃথিবী ছেড়ে আসার পরেও, ওদের দেখিয়ে যাওয়া পথে হেঁটে মানুষের নিরন্তর কল্যাণ সাধন হয়ে
চলেছে। ও সেসব সত্ত্বাকেও সেখানে খুঁজে পেলো, ওরাও সেরকম কক্ষপথে ঘুরে চলেছে। সাহায্য
করার চেষ্টা করে চলেছে মানুষকে, তাদের দুঃখ দুর্দ শা কমানোর চেষ্টা করে চলেছে।

ক্লেশ, কষ্ট, দুঃখভোগ । একটা বেসুরো সঙ্গীতের মতো ওটা পৃথিবী থেকে অনুরণন তু লে চলেছে
ক্রমাগত—ভেঙ্গে যাওয়া হর্নের ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসা ভেঁ পুর আওয়াজের মতো।

সেই সময় , এঞ্জেলা বুঝতে পারলো , এসব কিছুরই একটা মানে আছে। মানুষের জীবন যতই
ক্ষণস্থায়ী হোক না কেন। পৃথিবীতে যাই ঘটু ক না কেন, সেসবের আসলেই মানে আছে। শয়তান,
সাইকোপ্যাথ আর লোভী মানুষদের থাকারও মানে আছে। দুর্দ শাই এসবকে মানে দিয়েছে, কেবল
দুর্দ শা। কারণ সেইসব দুর্দ শা কমানো, সেগুলোকে আরেকটু ভালো অবস্থায় নিয়ে আসা, হ্যাঁ, সেটার
একটা গতি করাও একটা মানে রাখে বই কি !
245

আর এঞ্জেলা বুঝতে পারলো , সে অন্ধকারে প্রায় ডু বে যেতে বসেছে। কারণ ম্যামন ওর অবচেতনে
ওকে বলে চলেছেঃ

দ্যাখো, ভালো করে দ্যাখো। কিছুরই কোন মানে নেই ! আমাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করোনা,
সংগ্রাম করে লাভ নেই। বিশাল পটভূ মিতে কোন কিছুই কোন মানে রাখে না। সব মাংসই ঘাস,
ওগুলো সবই মারা যায় আর মিলিয়ে যায়। এটার সাথে লড়াই করে কেবল নিজের কষ্টই
বাড়াচ্ছ...... আত্মসমর্পণ করো, এঞ্জেলা !

কিন্তু ওকে দমানো এত সহজ নয়। ও এত সহজে আত্মসমর্পণ করবে না।

সময় এলে, ও লড়াই করবে। ওই ‘বোধিসত্ত্ব‘ দের সাহায্যে , লড়াই করে যাবে সে। ওর সুযোগ
ঠিকই আসবে।

কারণ সে জানে, সে কি, পৃথিবীতে ওর কাজই বা কি। একজন ওরাকল ? হ্যাঁ, কিন্তু সত্ত্বার
গভীরে......

...... এঞ্জেলা ডডসন একজন যোদ্ধা ।

মিড নাইট, চ্যাজ আর কনস্টেনটিন দাঁড়িয়ে আছে ই আই কারমেন এর বাইরে, ভ্যাপসা


গরমের রাতের মাঝে।

পৃথিবী, দিনের জন্য একভাবে জেগে ওঠে। আরেকভাবে জেগে ওঠে , রাতের জন্য। লস এঞ্জেলস
শহর, রাতের জন্য জেগে উঠছে। গাড়ির হর্ন, সাইরেনের শব্দ, রেডিও থেকে ভেসে আসা উচ্চ
লয়ের মিউজিক। আর নেপথ্য সঙ্গীতের মতো রয়ে গেছে ক্রমাগত ট্রাফিক লাইটের পরিবর্ত ন,
আর বয়ে যাওয়া গাড়িঘোড়ার মৃদু গর্জ ন।
246

কিছু মানুষ ক্লাবের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে, কিছু মানুষ বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়েছে হাঁটতে। যুগলেরা
বেরিয়েছে ডেটিং এ, এমন কাজের প্ল্যান নিয়ে, যেগুলো ওরা নিজেরাই জানে না আলোর মুখ
দেখবে কি না ! কেবল নিজেদের আবেগ আর প্রবৃত্তিকে অনুসরণ করে চলেছে সবাই......

কনস্টেনটিন মাথা নাড়ল । ওর নিজের আবেগ ওকে বলছে চিৎকার করে বলার জন্য – ইডিয়টের
দল ! পৃথিবী অন্ধকারের শক্তির সাথে যুদ্ধের সন্মুখিন ! নরকের দরজা খুলে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়িই।
তোরা বেহালা বাজাচ্ছিস, আর এদিকে রোম পুড়ে যাচ্ছে—ব্যাটা গর্দ ভের দল সব ! আমার সাথে
আয়, আর যুদ্ধ কর ওই অন্ধকারের শক্তির সাথে, যে কিনা তোদের আত্মা গুলো স্রেফ ভেজে খেয়ে
নেবে !

কনস্টেনটিন মাথা নাড়লো আবার। এই কথাগুলো যদি ও শব্দ করে বলে তবে ? স্রেফ রাস্তার
কোণায় দাঁড়ানো সেসব পাগলের প্রলাপের মতোই শোনাবে, যাদের কথা শুনে সবাই দুঃখে মাথা
নাড়ে !

ওইসব পাগলেরা, আসলে কি সবসময় সত্যি কথাই বলে যায় ?

“এটা দেখতে সব সময়ই মজা লাগে ” কনস্টেনটিন চারপাশে তাকাতে তাকাতে বললো। একই
সাথে প্রশংসা আর দুঃখবোধে মাথা নাড়তে লাগলো সে।

চ্যাজ তাকালো ওর দিকে, মিড নাইট স্থির রইলো।

“সাধারণ জীবন” কনস্টেনটিন বলে চললো।

বিশেষ করে এখন , ভাবলো সে। যখন কিনা সবচেয়ে পাগলাটে পথটাই, সুস্থতম পথ হিসাবে বেছে
নিতে হচ্ছে !

মিডনাইট চ্যাজকে কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা ধরিয়ে দিলো , বললো “তু মি ফিরে এলে, আমার
সাথে দেখা কোরো, মেম্বারশিপ নিয়ে কথা বলা যাবে’খন ”
247

চ্যাজ নড করলো , ভেতরে ভেতরে খুশিতে ফেটে পড়ছে ! মিডনাইটের ক্লাবে মেম্বারশিপ !
ওয়াও!

পাপা মিডনাইট দূর থেকে হাত ঘোরাতে লাগলো চ্যাজের ওপর, বিড়বিড় করে কি জানি বলে
চলেছে। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে চ্যাজের দিকে।

“কি করছ তু মি ?” চ্যাজ জিজ্ঞেস করলো ।

“প্রার্থনা করছি ” গরগর করে উঠলো মিডনাইট। ওর নিজস্ব প্রার্থনার সংস্করণ এটা। ওইসব ভু ডু
আত্মাদের কাছে, যাদের সাথে খ্রিস্টানিটির কিছু সন্তদের মিল আছে !

মিড নাইট একইরকম প্রার্থনা শুরু করতে চাইলো কনস্টেনটিনের দিকে চেয়ে, কিন্তু ও হাত নেড়ে
উড়িয়ে দিলো ওসব।

“সময় নষ্ট করো না” বলে উঠলো সে। মনস্থির করে ফেলেছে, আজকের দিনটা, আসলেই, মারা
যাবার জন্য ভালো একটা দিন ! “বেশ ভালো একটা দিন” যত ভালোভাবে হাসা যায়, হেসে
বললো “নরকে যাওয়ার জন্য, সো ও জা নরকে ! তোমার ওই ‘নরক থেকে বেরিয়ে যাওয়া’ কার্ড
খেলে বসো না আবার ! ” ওপরের দিকে তাকিয়ে বললো কথাটা। ওর চারপাশে, নিয়তির কঠিন
নাগপাশ অনুভব করতে পারছে সে। ‘কার্মা’র বিশাল অস্তিত্তের সামনে , সবাই অসহায়। ওর
নিজেকে স্যামসনের মতো মনে হলো, ও যদি ওটাকে নামাতে যায়, ওটা ওর মাথার ওপর ভেঙ্গে
পড়বে। মিড নাইট ইতিমধ্যে যতটু কু সাহায্য করা যায়, করে ফেলেছে।

নীরবে মিডনাইটকে বিদায় জানালো নড করে, তারপর চ্যাজের ট্যাক্সিতে উঠে পড়লো দুজনেই।

মিডনাইট ওদেরকে ধোঁয়াটে লস এঞ্জেলসের রাতে গাড়ি নিয়ে মিলিয়ে যেতে দেখলো।

আর নিজে নিজে ভাবলো , আমার পক্ষ নেয়া উচিত নয়। কে জিতল, সেটা নিয়েও মাথা ঘামানো
উচিত নয়। এটা আমার জন্য কিইবা পার্থক্য এনে দেবে ? এমনকি পিশাচদেরও পার্টি করার জন্য
একটা জায়গার দরকার হয়। কিন্তু...... তবুও......কিভাবে যেন.........
248

......... নিজেকে সে আবিষ্কার করলো , প্রার্থনা করছে ! প্রার্থনা করছে কনস্টেনটিন যেন নরকের
দরজায় লাগাবার জন্য একটা নতু ন তালা খুঁজে পায় !

সময় এসে গেছে, এঞ্জেলা ডডসন......

কণ্ঠটা ভেসে এলো অন্ধকার থেকে। ঘাড়ের কাছে কোন মাকড়শার পায়ের সুড়সুড়ির মতো।

আমরা সবচেয়ে ভালো মুহূর্তে র অপেক্ষায় ছিলাম। নাক্ষত্রিক অবস্থান এখন সবচেয়ে কম ক্ষতিকর
অবস্থানে আছে। তারা জগত আছে নিরপেক্ষ অবস্থানে। দরজা, অরক্ষিত। বোকারা ওটাকে
সহস্রাব্দ যাবত ওভাবেই রেখে দিয়েছে, নাকি এটা দুই হবে ? ......

এসো এখন, তোমার পৃথিবীতে ফেরত যাও, ওটাকে আমার করে দাও, এঞ্জেলা ডডসন। এসো,
আর যীশুর লোহার বল্লমকে বিয়ে করো !

এঞ্জেলা টের পেলো, ও নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে......

একটা গর্তে র ভেতর দিয়ে, রেভন্সকারের দিকে পড়তে লাগলো সে। ছাদ ফুঁ ড়ে নিচের দিকে নামতে
লাগলো, যেন কু য়াশার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তারপর ‘ঝপাস’ করে পড়লো হসপিটালের চার ফু ট
গভীর ক্লোরিন সমৃদ্ধ পুলে। সেখানে খানিক হাবুডু বু খেলো , মাধ্যাকর্ষণের শক্তি যেন ওকে টেনে
আরও গভীরে নিয়ে যেতে চাইছে। আতংক সরিয়ে রেখে, নিজের পায়ের ওপর দাঁড়ালো সে। জল
ঝরছে শরীর বেয়ে, সেই অবস্থায় ও টের পেলো ওর সাথে তখনও ওর বন্দুক রয়েছে ।

বন্দুক বের করে, চারপাশে তাকালো সে। এটা হলো সেই বিশাল হাইড্রোথেরাপি ট্যাঙ্ক , ঠিক যেখানে
ইসাবেল মারা গিয়েছিল।

পুলের অন্য পাশে, পুরোদস্তুর পোশাক পরা এক লোক বসেছিল কুঁ জো হয়ে। কালো চেহারার,
কৃ শকায়, মুখে বসন্তের দাগ অলা , কালো চু লের এক লোক। উঠে দাঁড়িয়ে, মুখে বিশ্রী একটা হাসি
ঝু লিয়ে ওর দিকে সাঁতরে আসতে লাগলো লোকটা।
249

এই বন্দুকটা থেকে কি ফায়ার করা যাবে এখন ? আর এঞ্জেলা জানে এই লোকটা , ম্যামনের
প্রতিনিধি, ওঁর কাজ নিয়েই এসেছে এখানে। ম্যামনের হাত হিসাবেই কাজ করবে লোকটা, যতক্ষণ
না সেই দরজা না খোলে। সে এগুলো মুহূর্তে র মধ্যে টের পেলো, একইসাথে বন্দুক তু লে ফায়ার
করলো ......

আবার ফায়ার করলো, আবার.........

লোকটা এবার হেঁটে এগিয়ে আসছে ওর দিকে, ডান হাতে ধরা একটা লোহার স্পাইক। প্রতিবার
গান ফায়ারের সাথে সাথে , ওর হাসিটা যেন আরও বিস্তৃ ত হয়ে পড়ছে। এঞ্জেলা বন্দুকটা দুই হাতে
চেপে ধরে আরও দুইবার ফায়ার করলো।

প্রায় পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে করা ফায়ারেও, ভ্রুক্ষেপ নেই ওই লোকটার !

ও আসতেই লাগলো এঞ্জেলার দিকে...... আর ওর হাত থেকে থাবা দিয়ে বন্দুকটা ফেলে দিলো।
তারপর এঞ্জেলার গলা টিপে ধরলো।

ও স্প্যানিশে কি জানি বলে উঠলো। তারপর লোহার স্পাইকটা এঞ্জেলার মাথার ওপর ধরে
থাকলো। এঞ্জেলা , ওই স্পাইকটার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলো।

এটা কি সেই বর্শার ফলা , যেটা কিনা নাজারেথের যীশু খ্রিস্টের এক পাশ চিরে দিয়েছিল ? সেই
গলগোথা, খুলির পাহাড়ে ? এটা কি দুই হাজার বছর ভ্রমণ করে এখানে এসেছে , সব ভালোর
পরিসমাপ্তি ঘটাতে ? এটাই কি সেই ‘নিয়তির বল্লম ’ এর ফলা ?

তারপর, সে ওটার মধ্যেকার শক্তি টের পেলো। তখনই বুঝে গেলো, এই কালোকু লো দেখতে
লোকটার হাতেই ধরা আছে সেই চাবি, যেটা খুলে দেবে নরকের দরজা ......

হসপিটাল থেকে ভেসে আসা শব্দটা যেন চ্যাজের হাড় হিম করে দিচ্ছিল। ঠিক যেন
একপাল সী গালের গায়ে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ! কিন্তু আসলে , ওগুলো ছিল মানুষের
250

আওয়াজ। চিৎকারের শব্দ। শব্দটা একবার থেমে যাচ্ছে। আবার একটু পর শুরু হচ্ছে ! চিৎকারের
শব্দ, আবার থেমে যাচ্ছে, শুরু হচ্ছে আবার...... আবার......

“ওই বালের জিনিসটা কি, জন ?”

কনস্টেনটিন , ট্যাক্সি থেকে বেরোতে বেরোতে , মাথা নেড়ে বললো “আমি জানি না। তু মি কি
নিশ্চিত যে তু মি খুঁজে বের করতে চাও ?”

চ্যাজ একটু ভাবলো। কিন্তু এরপরে, খুব বেশী জায়গা বাকি থাকবে না পালিয়ে যাবার জন্য। “হুম,
ধীরে ধীরে দেখা যাবে। ”

“আমার কাছে তোমাকে কিছুই প্রমাণ করতে হবে না” কনস্টেনটিন বললো, হাসছে চ্যাজের দিকে
তাকিয়ে।

“হ্যাঁ, আছে প্রমাণ করার জন্য, অবশ্যই আছে ” হাতে ধরা শটগানটা ঝাঁকি দিয়ে বললো সে । ওটা
কনস্টেনটিনেরটার মতো ‘হোলি শটগান’ নয়, কিন্তু ‘ঐশ্বরিক আশীর্বাদ’ পুষ্ট বুলেট লোড করা
আছে সেটাতে।

কনস্টেনটিন কাঁধ ঝাকালো “তু মি কেবল নিজের কাছেই নিজেকে প্রমাণ করছো, চ্যাজ। আমি
ইতিমধ্যেই জানি তু মি একজন ভালো মানুষ। ” ফিরে হসপিটালের দিকে তাকালো সে। ওই
চিৎকারের নির্দি ষ্ট একটা প্যাটার্ন আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা ঠিক ধরা যাচ্ছে না। “চলো, এগোই ”

ওরা ভাঙ্গা স্টিলের গেটটা দিয়ে ভেতরে ঢু কতে লাগলো। ওটা বারবার বাড়ি খাচ্ছে পেছনের
দেয়ালের সাথে। ওদের চারপাশের বাতাস যেন অন্ধকার হয়ে এলো। ঠিক মনে হচ্ছিলো , ওরা
একটা কু য়াশাচ্ছন্ন নদীর পাড়ে এসে পড়েছে। কিন্তু সেই কু য়াশা যেন , দানাদার অন্ধকারের তৈরি,
পানির কণার বদলে। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন কু য়াশা, রেভেন্সকারের চারপাশে যেন পাক খাচ্ছে। এমন
না যে বিল্ডিঙের কোথাও কোন আলো নেই, আছে। কিন্তু সেই আলো যেন খুব ক্ষীণভাবে দেখা
যাচ্ছে। যেন কয়লার মেঘের ভেতর কোন লাইট জ্বালিয়েছে কেউ।
251

“কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না ” চ্যাজ বললো এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে।

“সবসময়ই, একটি নির্দি ষ্ট ধরণ ছাড়াও, কয়েক রকমের অন্ধকারের অস্তিত্ব ছিল ” কনস্টেনটিন
বললো, হাতের হোলি শটগানটা নিয়ে এগিয়ে গেলো পেছনের দরজা দিয়ে। লোহার ডাবল দরজাটা
ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকা হয়েছে। যেন ‘ব্যাটারিং র‍্যাম’ দিয়ে সাত আটজনের একটা দল ঢু কেছে
অখান দিয়ে। কিন্তু আসলে, কেবল একজন মানুষ আর একটা লোহার স্পাইকের কাজ ওটা !

অন্ধকার তার চরমতম মাত্রায় পৌছালো। একই রকম লাইট জ্বলছে আশেপাশে, একইরকম
জিনিসপত্র আশেপাশে, কিন্তু খুব বেশী কছু দেখা বা অনুভব করা যাচ্ছে না।

ওরা দরজা দিয়ে ঢোকার পর, অন্ধকারটা আরও বাড়ল। যেন রেভেন্সকারকে কেউ সতর্ক তামূলক
বেষ্টনীতে আটকে ফেলেছে। ম্যামনের কাজের জায়গা থেকে মরণশীলদের’কে দূরে সরিয়ে রাখার
একটা পন্থা হয়তো সেটা।

কিন্তু, চ্যাজের ভয় বাড়েনি একটু ও। মুখে একটা ধাতব স্বাদ পাচ্ছিলো সে, ওর মনের ভেতর যেন
কেউ চেপে বসেছে। ঠিক যেন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে , কয়েক ফু ট দূর থেকে একটা পাঁচটনি
ট্রাককে ধাক্কা মারতে দেখছে সে ! সামনে থেকে সরে যাওয়ার জন্য অনেক বেশী দেরী হয়ে গেছে।
চ্যাজ জানতো, কোনভাবে, যে এই জন্মে ওর নিয়তি একটা পথ ধরেই আসবে।

কনস্টেনটিন একটু বিরতি নিলো। লবি থেকে ভেসে আসা কাটা কাটা চিৎকারের শব্দ শুনছে মন
দিয়ে। একবার তাকালো চ্যাজের দিকে। ওর চেহারায় একটা নরম ভাব, একটা বাৎসল্য ফু টে
উঠতে দেখলো চ্যাজ – যেটা এর আগে কখনোই চোখে পড়েনি ওর। আর, এটাতে ভয়ই পেলো
সে, ঠিক যেন কেউ মৃত্যুশয্যায় শুয়ে নিজের উইল লিখতে বলছে !

“শোন, ছেলে --” শুরু করলো কনস্টেনটিন।


252

“কোরোনা, ঠিক আছে ?” চ্যাজ বাঁধা দিলো । সে বুঝতে পেরেছে, কনস্টেনটিন বেশ আবেগী কোন
কথা বলে উঠবে এখনি। “আমার মনে হয় না , আমি নরম-শরম কনস্টেনটিনকে সহ্য করতে
পারবো !”

কনস্টেনটিন হাসলো বাঁকাভাবে। শটগানের চেম্বারে একটা বুলেট পাঠালো বেশ কায়দা করে।

“এটা ভালো ?”

চ্যাজ নড করলো , নিজের শটগান আঁকড়ে ধরে জবাব দিলো “অনেক ভালো ”

ওরা এন্টি চেম্বার হয়ে, ভেতরকার সুইং ডোর ঠেলে, লবিতে এসে পৌছালো।

ঘষা কাঁচের মতো, ধ্বসে যাওয়া টিউব লাইটের আলো জ্বলছে সেখানে। আলোকিত করছে যেন
এক দুঃস্বপ্নের জগতকে। ডেস্কে বসে থাকা মহিলা, হেঁটে যাওয়া নার্স, একজোড়া দম্পতি, তাদের
উন্মাদ দেখতে সন্তানসহ – স্রেফ স্থির দাঁড়িয়ে আছে জমে যাওয়া বরফের মতো।

না, পুরোপুরি জমে যায়নি। কিছু সময় পর পর , ওরা নড়ে উঠছে। মনে হচ্ছে, সময় যেন থেমে
গেছে ওদের জন্য। এক সেকেন্ড বা আরেকটু বেশী সময় , চালু হয় সবকিছু, তারপর আবার
সবকিছু থেমে যায়। ওরা নড়ে ওঠে, বুঝতে পারে যে, আটকা পড়েছে কিছু একটাতে। চিৎকার
করে ওঠে সমস্বরে...... তারপর চিৎকার থেমে যায়, আবার ওরা জমে যায় ! একটু পর পর, একই
ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে।

“হোল্ডিং স্পেল” কনস্টেনটিন বিড়বিড় করে উঠলো।

“ওরা চিৎকার করছে কেন ?” চ্যাজ জিজ্ঞেস করলো।

“ছোট্ট নোংরা জাদু” কনস্টেনটিন বললো “ভয়ের ওপর চলে ”

চ্যাজ, সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে। ডেস্কের কাছে একটা জোড়ার দিকে
তাকিয়ে আছে সে। ওরা একটা ভয়ের গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছে , যেটা কিনা কেবল
253

চিৎকারের মাধ্যমেই প্রকাশ করা যাচ্ছে। ধাপ – এক-দুই, চিৎকার আর জমে যাও, ধাপ – এক-দুই
, চিৎকার করে হাত নাড়ো। ধাপ এক দুই চিৎকার আর জমে যাও, ধাপ এক দুই – চিৎকার করে
হাত নাড়ো।

চ্যাজ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো একটা। কারণ কনস্টেনটিন আর সে যখন ওইসব ফিটে আক্রান্ত
লোকগুলোর মাঝ দিয়ে চলে যাচ্ছিল, ওদের ওপর কোন রকম প্রভাব পড়ছিল না। কারণ জাদুটা
যখন করা হয়েছিলো, ওরা সেখানে ছিলো না। ওরা আরেক দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো।

এখন কোথায় , কনস্টেনটিন ভাবলো – আছে এঞ্জেলা আর সেই নিয়তির বর্শার টু করো ?

সতেরো

এঞ্জেলার কোন ধারণাই নেই, ওই লোকটা কিভাবে ওকে একদম শক্তিহীন করে ফেললো। এটা
কিছুতেই সম্ভব না। ও দুই ধরণের মার্শাল আর্ট স জানে, ও একজন ট্রেইন্ড পুলিশ ডিটেকটিভ।
ওই লোকটা তো দেখতেও তেমন শক্তিশালী নয় !

কিন্তু ওর গলায় চেপে ধরা হাতটা যেন এঞ্জেলার শরীর থেকে সমস্ত শক্তি শুষে নিচ্ছে।

ওই ‘নিয়তির বর্শা’ থেকেই হয়তো লোকটা শক্তি পাচ্ছে, ওর কাছ থেকে যদি কোনভাবে সরে
যাওয়া যায়......

কিন্তু কিভাবে ? ওর নিজেকে এখন একদম শক্তিহীন লাগছে , ঠিক যেন একটা দুই বছরের বাচ্চা
কোন কমান্ডোর কাছ থেকে বন্দুক কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ! পানিতে লাথি মারতে মারতে ,
লোকটার কুঁ চকিতে একটা লাথি ঝেড়ে দিলো সে, কিন্তু কোন ফল হলোনা।
254

একটা ভয়ংকর মুহূর্তে র জন্য , এঞ্জেলার ‘ওরাকল স্বত্বা’ ঢু কে পড়লো লোকটার মনের জানালা
দিয়ে। আর , এঞ্জেলা লোকটার স্মৃতি নিজের চোখের সামনে দেখতে পেলো। লোকটার নাম
ফ্রান্সিস্কো। একইসাথে করুণা আর ঘৃণার মিশ্রণ খেলা করে গেলো ওর মনে। যখন দেখলো
লোকটার ছেলেবেলা , রাস্তায় ভবঘুরে জীবন, চু রি করা খাবার খেয়ে জীবনযাপন। তারপর , ওর
শরীর বিক্রি করে দেয়া একটা স্নান ঘরে, বিকৃ ত কাম লোকেদের ভিড়ে।

সেখান থেকে পালানো, একটা গ্যাং এ যোগ দেয়া। নিজের একমাত্র বন্ধু কে কিছু ভীষণ মোটা
পুলিশের লোকের মেরে ফেলা স্রেফ খেলাচ্ছলে ! পুলিশের কাছ থেকে পালানো। আরেকটা শহরে
ট্যাক্সি ড্রাইভার হিসাবে জীবন শুরু করা, সেখান থেকেও পুলিশ দ্বারা বিতারিত হওয়া। শেষমেশ
ধাঙ্গড়ের দলে যোগ দেয়া।

আর নিজেকে ও দেখতে পেলো নোংরা লোকটার কল্পনায়। কিভাবে মনের চোখে এঞ্জেলার কাপড়
চোপড় ছিঁ ড়ে , ওকে বারবার রেপ করতে চাওয়া। আর এঞ্জেলার চাকরানীর মতো ক্রমাগত সাড়া
দিয়ে যাওয়া। ডলারের স্তুপের ওপর লাল বিকিনি পরা এঞ্জেলা......

এঞ্জেলা কান্না করতে করতে , ছাড়িয়ে নিতে চাইলো নিজেকে এই অসুস্থ মানসিক যোগাযোগ
থেকে। আর ফ্রান্সিস্কো , ঠিক এই সময়ই, পকেটে বল্লমের ফলাটা রেখে – সপাটে এক চড় কষালো
এঞ্জেলাকে। সেই চড় খেয়ে, ঘুরে গেলো এঞ্জেলা। আর পেছন থেকে, ওকে ছেঁ ড়া ইলেকট্রিক তার
দিয়ে শক্ত করে বেধে ফেললো ফ্রান্সিস্কো।

ঈশর , এঞ্জেলা প্রার্থনা করলো। তু মি কি এটা আসলেই ঘটতে দেবে ? এটা তো কেবল আমি নই,
এটা তো পুরো পৃথিবীর প্রশ্ন ......

সাইনটাতে লেখাঃ সংস্কার কাজের জন্য বন্ধ আছে।


255

ওরা দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলে, সাইনটা লাথি মেরে একদিকে সরিয়ে দিলো। আর রেভেন্সকারের
একটা আধা-পরিত্যাক্ত অংশে চলে এলো। কনস্টেনটিন চ্যাজের দিকে তাকালো। ছেলেটা এইসব
সময়ে সত্যিই বেশ সাহসেরই পরিচয় দিচ্ছে বটে।

যেন চ্যাজের স্নায়ু পরিক্ষা করার জন্যই, একপাশ দিয়ে একটা ইঁদুর দৌড়ে গেলো। ওটাকে প্রায় গুলি
করে দিচ্ছিল সে।

“ধীরে, ধীরে” কনস্টেনটিন বললো।

কিন্তু তার তখন মনে পড়ে গেলো, পোকায় তৈরি সেই পিশাচটা কিভাবে ওকে রাস্তার ওপরেই মেরে
ফেলছিল । ওই ধরণের কিছু কি লুকিয়ে আছে , আশেপাশে ? ওই ইদুরের পেছন পেছন কি,
কাঁকড়া বিছে বা পাখি খেয়ে ফেলার মতো মাকড়শার আবির্ভাব হবে ?

কিন্তু করিডোর দিয়ে , আরও ঘন অন্ধকারের দিকে এগোতে এগোতে – আর কিছুই নড়তে চরতে
দেখলো না ওরা।

চ্যাজ ওর ঠোঁট কামড়াচ্ছিল। ওর নাক বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছিল “কথা বলবো, নাকি বলবো না ?”

কনস্টেনটিন ওর দিকে এমনভাবে তাকালো, তাতেই উত্তর পেয়ে গেলো সে।

একটা বিরক্তিকর শব্দ ভেসে আসছিলো ওদের দিকে বিজবিজ করে। প্রথমে মনে হচ্ছিলো কোন
একটা শূয়রের ঘোঁত ঘোঁত শব্দ। তারপর মনে হচ্ছিলো কোন একটা সিরিয়াল কিলারের ঘুমের
মধ্যেকার বিড়বিড়ানির মতো। এমন কারো কথা বলছে যার সাথে ওর এখনও দেখা হয়নি –
নিশ্চয়ই তোমার কথা ! ও তোমাকে ধুলো ভরা কোন বেসমেন্টে একলা পেলে কি কি করবে। চেইন
দিয়ে বেঁধে, মুক্তির কোন আশা না রেখে। তারপর, মনে হলো , ওটা একটা গুরুগম্ভীর ভাষা। কিন্তু ,
ওগুলো আসলে সবই একই আওয়াজ।

“ওটা কি ?” চ্যাজ জিজ্ঞেস করলো।


256

“নরক – কথন !” কনস্টেনটিন বললো।

ওরা দুজনেই কেঁ পে উঠলো – শুনছে – নরকের ভাষা। ঠিক যেন কোন পাগলের বাজে
বকবকানির মতো। কিন্তু একই সাথে, যে কোন অন্য ভাষার মতোই অর্থবহ।

কনস্টেনটিন হসপিটালের এই অংশে কখনো আসেনি, কিন্তু সে জানে , ঠিক পথেই এগোচ্ছে। ও
নিজের আধ্যাত্মিক স্বত্বা দিয়ে, আশেপাশে ঠিক নরকের মতোই প্রচণ্ড রাগের আবহাওয়া টের
পাচ্ছে। এই দিকেই আসছে সেগুলি। ঠিক যেমন একজন দমকল কর্মী দেয়ালের অন্যপাশে
জ্বলতে থাকা আগুনের তাপ টের পায়। ওই যে, ওই দিকে – ওপরে লেখা – মেইনটেনান্স।

কনস্টেনটিন বুঝতে পারলো – ওরা সেই অন্ধকার শক্তির প্রান্তে চলে এসেছে । যেটা কিনা এই
হাসপাতালের সমগ্র আত্মা শুষে যাচ্ছে। আর একটু এগোলেই, ওরাও সেটার ভেতর ঢু কে যাবে।
ও চ্যাজের দিকে তাকালো – ভাবলো , ছেলেটা কিভাবে সামাল দেবে এই অবস্থা। কনস্টেনটিন
নিজেও জানে না যে, ও নিজে ওটা সহ্য করতে পারবে কিনা। যদিও সে একাধিকবার নরক থেকেই
ঘুরে এসেছে – কিন্তু তবুও, শটগানটা , ওর নিজের ঘামেই পিচ্ছিল মনে হচ্ছে নিজের হাতেই।

“আমি ঠিক আছি ” কনস্টেনটিন ওর দিকে তাকাতে, চ্যাজ বলে উঠলো।

“আমি তো জিজ্ঞেস করিনি ” কনস্টেনটিন বললো।

তারপর, সেই দরজাটার দিকে ইঙ্গিত করলো , তাকালো চ্যাজের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।

চ্যাজ বুঝতে পারলো , ও কি বলতে চাচ্ছে। ওরা এর মধ্যেই এই বিষয়ে সহমত হয়েছে – এটা
একইসাথে চ্যাজেরও মিশন। এখান থেকে , ওরা দুজনকে আলাদা পথে এগোতে হবে, নয়তো
কনস্টেনটিনকে এগিয়ে যেতে হবে -- একা।

ওদেরকে আলাদা হয়ে যেতে হবে , কারণ শত্রুকে অতর্কি ত ভাবে দুইদিক থেকে আক্রমণ করার
সুবিধাটা নিতে হবে। একজন ওদেরকে অপ্রস্তুত অবস্থায় পেয়ে যাবে, অন্যজন নিজের দিকে টেনে
নেবে সব আগুন ......
257

সেই একজন, কাজ করবে টোপে বাঁধা ছাগলের মতো। নেকড়েদেরকে লোভ দেখিয়ে এক দিকে
নিয়ে যাওয়ার জন্য।

তোমার যা করার, করো। নিজেকে বললো কনস্টেনটিন । একটা ‘ছাগল’ বা একটা মানুষের
চাইতেও অনেক বড় কিছু বিপদের মুখে আছে এখন। হয়তো তু মি সেখানে সময়মত পৌঁছেও
যেতে পারো, নেকড়েরা ভোজ শুরু করার আগে।

কিন্তু কনস্টেনটিন অপেক্ষা করতে লাগলো। অপেক্ষা করতে লাগলো , চ্যাজের সিদ্ধান্তের জন্য।
এটা ও চ্যাজের হয়ে নিতে পারে না, ওকে সে অর্ডার করতে পারে না।

একটা দীর্ঘ, নিঃসঙ্গ, অসহ্য মুহূর্ত পেরিয়ে গেলো।

কনস্টেনটিন আশা করলো, চ্যাজ ‘না’ বলে দেবে।

একটা বড় ঢোঁক গিলে, ‘ মেইনটেনান্স’ লেখা দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢু কে গেলো চ্যাজ।

কনস্টেনটিন প্রায় পিছে পিছে চলে গেছিলো। কিন্তু চ্যাজ নিজেই আসতে চেয়েছে। ওর নিজের
ভার নিজেই বহন করতে চেয়েছে। ‘শিক্ষানবিশ’ থেকে ‘ম্যাজিশিয়ান’ এ পরিণত হবার জন্য যে
যে ঝুঁকি নিতে হয়, নিতে হবে ওকে।

এখানে আলো খুবই ক্ষীণ। চ্যাজ প্রায় এটাকে গোঙাতে শুনতে পেলো বলা চলে।

একটা নিচু সিলিঙের করিডোর ধরে এগেচ্ছে সে। ওর মাথার ওপরে, পানির ফোঁটা অলা
অনেকগুলি পাইপ চলে গেছে সামনের দিকে। কিছু সুয়ারেজ পাইপের লিক দিয়ে নাড়ি উল্টে
আসার মতো গন্ধ আসছে। চারপাশের পাইপগুলো যেন ওর গলা টিপে ধরতে চাইছে, বাতাসটাও
যেন ওর শ্বাস বন্ধ করে দিতে চাইছে। সে ভাবলো , বাতাসটা.........

ও নিজেকে ঘন ঘন শ্বাস নেয়া অবস্থায় আবিষ্কার করলো, আর ভাবলোঃ


258

তো নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনো, ব্যাটা গর্দ ভ কোথাকার। নিজেকে নিজেই ভয় লাগাচ্ছ তু মি !

নিজের ওপর দখল নাও নয়তো ভয়ে পিশাচদের থুতু তেই ডু বে মরবে !

সে জানতো , পিশাচেরা ওকে শারীরিকভাবে নয়, বরং আক্রমণ করবে মানসিকভাবে। ওটাই
ওদের প্রধান অস্ত্র। ওরা মানুষদেরকে প্ররোচিত করে, আত্মধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়াতেই বেশী গর্ব
বোধ করে। একটু ফিস ফিস, একটু বাজে চিন্তা – ওরা চায়, মানুষ যেন ওদের জীবন আধা ঘুমন্ত
অবস্থায় কাটিয়ে দেয়, আর জীবন চলার পথে ক্রমাগত হোঁচট খায়।

কিন্তু পৈশাচিক আক্রমণই হোক বা নিজের ভয় – এগুলোকে আজ ওকে জয় করতেই হবে । ওর


পড়াশোনা আর কনস্টেনটিন যা যা শিখিয়েছে এতোদিন , সেগুলোর মাধ্যমে।

চ্যাজ একটা গভীর শ্বাস নিলো, আর একটা ‘মান্ত্রা’ আউরে চললো নিজের মনকে ‘আলফা’
পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওর হার্ট বিট কমে এলো, শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলো। বন্দুকটা
আঁকড়ে ধরে, আরও কিছুদুর এগোলো ও......

ওই যে, এই করিডোরটার শেষ মাথা দেখা যাচ্ছে – একটা ইউটিলিটি রুমে বেরিয়ে গেছে ওটা।
একটা বিশাল ট্যাঙ্ক আছে ওখানে, একটা স্টিকারে দেখা যাচ্ছে আগুনের ছবি। সেখানে ঢু কে
পড়লো সে।

ওর কোটের পকেট হাতড়ে, মিড নাইট যে জিনিসটা কাপড়ে মুড়ে ওকে দিয়েছিলো, সেটা বের
করে আনলো সে। উজ্জ্বল একটা রুপার খ্রিস্টান ক্রশ। সে ট্যাঙ্কের ক্যাপ খুললো – তারপর
ক্রশটা সেটার খোলা মুখের ওপরে ধরলো সে।

আর প্রার্থনা করতে শুরু করলো, সেই প্রাচীন শব্দগুলো, যেগুলো সে অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করে।
ট্যাঙ্কের ভেতরকার তরলকে আশীর্বাদ পুষ্ট করছে সে। সে নিজের আত্মিক সীমা ছড়িয়ে দিলো ,
ডাকছে শুভ শক্তিকে, যোগাযোগ করছে, পথ দেখাচ্ছে ......
259

কনস্টেনটিন টের পেলো, চারপাশের বাতাস হঠাৎ-ই যেন বিষাক্ত হয়ে উঠলো। করিডোরের
ওপাশে যেন , ওর জন্য ওর কিছু একটা অপেক্ষা করে আছে। ওর নিয়তিই হয়তো বা।

ও জানে, ও অনুভব করতে পারছে – ওর পুরো জীবন এই মুহূর্তে র জন্য অপেক্ষা করে আছে। ও
ভাবলো চ্যাজের কথা, এঞ্জেলার কথা – ওরাও একই পথে চলে যাবে, কনস্টেনটিনের কাছাকাছি
হওয়া লোকেরা যে পথে গেছে।

ওর মনে পড়লো গ্যারি লেসটারের কথা। গ্যারির সাথে একটা ব্যান্ডে গান গাইতো কনস্টেনটিন।
ব্যান্ডটার নাম ছিলো ‘মিউকাস মেমব্রেন’ । বেশ আবেগময় একটা সময় ছিলো সেটা , ছিলো
জেরি কর্নেলিয়াস, বাউহাউস। গ্যারি কেবল বেজ বাজাতে চাইত। কিন্তু কনস্টেনটিনের সাথে যুক্ত
হওয়াই কাল হলো ওর জন্য। ওকে পিশাচ ‘নেমথ’ এর কাছে বলি দিতে হলো কনস্টেনটিনকে।
যাতে সে আর পাপা মিডনাইট ‘নেমথ’ কে থামাতে পারে- নিউইয়র্ক শহরটাকে কাঁচা গিলে খাওয়া
থেকে ! অবশ্যই, ‘নেমথ’ এর সাথে জড়িয়ে পড়ার দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে গ্যারির অপরেই বর্তায়।
কিন্তু ওকে অতিপ্রাকৃ তের ওপর আগ্রহী করে তু লেছিল তো কনস্টেনটিনই ! মাদকাসক্ত গ্যারি
লেসটারকে বিশ্বাস করাটাই বোকামি হয়েছিলো। পুওর সান অব আ বিচ ! কনস্টেনটিন এখনও
ওর ভূ তটাকে দেখতে পায়, ওর আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে.........

আস্ত্রা লোগ’কেও ভোলার উপায় নেই, বেচারি অল্পবয়সী মেয়েটা নেহাতই একজন নির্দোষ দর্শক
ছিল। বেচারি ক্রস ফায়ারে পড়ে গেছিলো, যখন কিনা কনস্টেনটিন একটা অন্ধকার আত্মাকে
ডাকার প্রক্রিয়াটা লেজে গোবরে করে ফেলেছিল। বেচারি আস্ত্রা , সেই পিশাচের টানে নরকের
অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছিলো।

কনস্টেনটিন নিজে , এই রেভেন্সকারেরই আরেকটা উইং এ দুই বছর কাটিয়ে গিয়েছিলো ওই


ঘটনার পর। এরপর, ও দায়িত্ব এড়াতে শুরু করে। চেষ্টা করে চিরতরে ম্যাজিক ছেড়ে দেয়ার। কিন্তু ,
ম্যাজিক এতো সহজে ওকে ছেড়ে দেয়না। ও ইতিমধ্যে এস্ত্রাল ওয়ার্ল্ড (মৃত্যুর পরের জগত) এর
একজন চিন্হিত ব্যাক্তিতে পরিণত হয়েছে, সম্ভবত একজন অভিশপ্ত ব্যাক্তি হিসাবেও।
260

আর, নিজের যমজ ভাইকে সে মায়ের গর্ভে থাকতেই হত্যা করেছিলো, ওর বাবার তাই অভিমত
ছিল। ওর নাভিতে পেঁচিয়ে গিয়েই নাকি ওই বেচারা মারা গিয়েছিলো। ওর নিজের মৃত যমজ
ভাইয়ের কারণেই, এঞ্জেলা আর ইসাবেলের সাথে ওর যোগাযোগটা ওকে এতোটা নাড়া দিয়ে
গিয়েছিলো।

ও অত্যন্ত ভাগ্যবান যে ওর জীবনের প্রথম প্রেম – আইরিশ সুন্দরী কিট রায়ান, এখনও কোন
চরম ডানপন্থী লোকেদের দ্বারা খুন হয়ে যায়নি। ওরা কাছে এসে পড়েছিল। মেয়েটা খুবই আহত
হয়েছিলো এটা দেখে , যে কনস্টেনটিন আবারও ম্যাজিকের কাছে ফিরে গেছে। ও ম্যাজিকের ধারে
কাছে যাবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলো। আর এর পরে সে কনস্টেনটিনকে চিরতরে ছেড়ে চলে
যায়। ওর জন্য ভালোই হয়েছে। ভাবলো, মেয়েটা কি এখনও বেঁচে আছে ?

সম্ভবত পতিতদের মধ্যে প্রথমজন – লুসিফার , যাকে অনেকবার কনস্টেনটিন হতাশার স্বাদ
দিয়েছে, কিটের পেছনে লেগে ওর ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। মেয়েটা হয়তো হেরোইন আসক্ত হয়ে
পড়েছে, অথবা কোন অন্ধকার গলিপথে খুন হয়ে পড়ে আছে, এই মুহূর্তে .........

না , নিজেকেই বললো সে। ওভাবে চিন্তা করোনা, তু মি শয়তানেরই খেলা খেলছ, যখন কিনা তু মি
সবচেয়ে খারাপটা চিন্তা করছ। ও তোমাকে সেরকমই ভাবাতে চায়। ওর মানসিক পিশাচদের
আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে সম্ভবত। কিট ভালোই আছে, যেখানেই থাকু ক, ভালো আছে সে।

তবুও, স্মৃতিগুলো হানা দেয় মনে। ইতিমধ্যে ভর্তি হয়ে যাওয়া লিফটে উঠতে চাওয়া , দুর্গন্ধযুক্ত
মাতাল লোকেদের মতো। একজন রিক দ্যা ভিক ছিল – একজন ব্রিটিশ পল্লী পুরোহিত । যে কিনা
ব্রিটেন থেকে আমেরিকাতে এসে , বন্ধু ত্ব পাতায় কনস্টেনটিনের সাথে। ওর নিজের ধর্মতত্ত্ব নিয়ে
তেমন পরিষ্কার ধারণা ছিলো না। কনস্টেনটিনের সাথে জড়িয়ে পড়ার পর, লুসিফারের হাত থেকে
বাঁচার জন্য আত্মহত্যা করে। আর শেষমেশ নিজেকে নরকে লুসিফারের সামনেই আবিষ্কার করে !

তারপর আছে নাইজেল আর্চার – খানিক আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পন্ন এক আদর্শবাদী। কনস্টেনটিন
ওকে ব্যবহার করেছিলো ব্লেড-ডেমন ক্যালিব্রেক্সিস’কে ডাকার জন্য। আর তারপর ওকে জড়িয়ে
261

ফেলে শয়তানকে ধ্বংস করার একটা মরিয়া প্রচেষ্টায়। কনস্টেনটিন নিজে সেই ভয়াবহ আচার
অনুষ্ঠান থেকে বেঁচে ফিরেছিল ঠিকই, কিন্তু শয়তান স্বয়ং আর্চারের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একটা একটা করে
ছিঁ ড়ে নিয়েছিল।

‘কি গ্রিমোয়ার’ নামে একটা প্রাচীন জাদুবিদ্যার বই চু রি করার সময় গুলি খায় ওর স্কটিশ বন্ধু
হেডার। বেচারার অনেক সময় লেগেছিল মারা যেতে।

এরপর, ফাদার হেনেসি, বী ম্যান। কনস্টেনটিনের সাথে না জড়ালে, ওরা হয়তো এখনও বেঁচে
থাকতো।

ওর সমস্ত বন্ধু মহল, ওর প্রথম প্রেম, নিজের যমজ ভাই – সবাই-ই ওর নিজের রহস্যময় অশুভ
প্রভাবের কারণে অভিশপ্ত হয়েছে। সামনের ওই করিডোরের কোণায়, ওর নিজের কর্মফলই হয়তো
অপেক্ষা করে আছে।

আর এখন, সে চ্যাজ আর এঞ্জেলাকে বলি চড়াতে চলেছে।

হুম, ও ওর শাস্তি ঠিকই পেয়ে যাবে। পৃথিবীর জন্য আজকের ঘটনা যাই বয়ে আনুক না কেন,
আজকেই পৃথিবীতে কনস্টেনটিনের শেষ দিন।

আশেপাশের আবহাওয়াতে প্রচণ্ড রাগের আভাস পেলো সে, দেয়ালগুলো যেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ছে।
নরকের ভাষার অর্থহীন বকবকানি শুনতে পাচ্ছে সে পরিষ্কার।

সে করিডোরের কোণা ধরে এগিয়ে গেলো, শেষ প্রান্তের অদ্ভু ত জোড়া-দরজা ঠেলে ঢু কতে ঢু কতে
বললো “একটা শেষ প্রদর্শনী ”
262

আঠারো

ওটা ছিলো একটা ওয়েটিং রুম, দোআঁশলাদের দিয়ে ভর্তি । এটা ঠিকই আছে, সে ভাবলো । ওর
তো একটা ওয়েটিং রুমেই আসার কথা , যখন কিনা সব ধরণের কাজের প্রতিফলের জন্য
অপেক্ষা শেষের পথে। কারণ, এই পৃথিবীটাই তো একটা ওয়েটিং রুম। তু মি অপেক্ষা করো বেড়ে
ওঠার জন্য, বুড়ো হবার জন্য , তারপর ক্ষয়ে ক্ষয়ে , এক সময় মৃত্যুবরণ করার জন্য। এই
মরণশীল জগতে, সব কিছুই ক্ষণস্থায়ী। শুধু পরজগতটাই – সে যে ধরণের পরজগতেই তু মি যাও
না কেন, সেটাই হলো সত্যিকারের অনন্ত স্থায়ী জগত। তখন, হ্যাঁ, কেবলমাত্র তখনই সব অপেক্ষার
অবসান হবে।

এই পার্থিব ওয়েটিং রুমটা ভর্তি অপার্থিব স্বত্বাদের দ্বারা। প্রথমে, ওদেরকে দেখতে সাধারণ
লোকেদের মতোই লাগছিলো, যে ধরণের লোকেদের আপনি প্রতিদিন আপনার আশে পাশে
দেখেন। এরপর, নিজের সাইকিক লেন্সটা একটু ঘোরাতেই, ওদের সত্যিকারের চেহারা বেরিয়ে
এলো। কনস্টেনটিন দেখতে পেলো ওদের শিং, লেজ, শ্বদন্ত, কাঁটাঅলা হাত পা, আর বিভিন্ন রঙের
চোখের মণি।

আর সেই অসুস্থ নরকের ভাষার আওয়াজ থেমে গেলো হঠাৎ করে। ও ভেতরে যাওয়ামাত্র সবাই
একদম চু প মেরে গেলো। সবাই একসাথে ওর দিকে তাকালো , সবার মনে একইসাথে , একই চিন্তা
অনুরণন তু লে গেলঃ

কনস্টেনটিন !

“হাই” কনস্টেনটিন বললো। ওর কণ্ঠ ঠিক ততটাই ঠাণ্ডা আর আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ , যতটা কোন
সেমিনারে , কোন প্রধান বক্তার থাকে “আমার নাম জন”

ওরা সবাই ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কেবল। ওরা এখনও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে
না—একটা লোক ঘর ভর্তি ভয়ঙ্কর সব শত্রুর মাঝখানে এতো নির্ভ য় কিভাবে থাকতে পারে ?
263

“কাম অন” কনস্টেনটিন বলে চললো , হাত তু ললো অর্কে স্ট্রা পরিচালনাকারীর ভঙ্গিতে “সবাই
একসাথে – ‘হাই জন !’ ”

কোন জবাব এলো না। ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো সবাই। কোন ধরণের সংকেতের
অপেক্ষা করছে, ওকে ছিঁ ড়ে ফেলার জন্য। সবাইই আশা করছে সেই প্রথম হবে যে কিনা ওর পেট
ফেড়ে নাড়িভুঁ ড়ি বের করে আনবে। ভাবছে, হয়তো ‘বস’ – দ্যা লুসিফার হয়তো সেই আনন্দ
নিজেই পেতে চান।

“এটা একটা মিটিং নয় ?” কনস্টেনটিন বললো “ড্যাম ! ঠিক আছে, কেমন হয় আমরা সবাই যদি
বাড়ি ফিরে যাই ?”

ওদের নিজেদের মধ্যেকার সাইকিক আদানপ্রদান শুনতে লাগলো , ওরা যখন একে অন্যের দিকে
তাকাচ্ছে......

কে মারবে ওকে ? কে বসাবে প্রথম কামড় ?

আমরা কোন আদেশ পাইনি , গাধা ! আমাদেরকে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে !

কিন্তু ‘বস’ রেগে যাবেন যদি জানতে পারেন , আমরা এই নেড়ি কু ত্তাটাকে ওনার কাছে পাঠাই নি
সুযোগ পাওয়া স্বত্বেও............ আমি নিজেই.........

কিন্তু ভিড়ের পেছন থেকে একজন সামনে চলে এলো। কনস্টেনটিন নিজের ভেতর তিক্ত একটা
বিশ্বাসঘাতকতার খোঁচা টের পেলো ওকে দেখতে পেয়ে। ওরা তেমন ঘনিষ্ঠ ছিলো না, কিন্তু
তবুও...... এলি’কে এদের সাথে দেখে বেশ আহতই হলো সে।

“আমার জানা উচিত ছিলো, তু মিও এই খেলায় থাকবে , ক্যান্সার । ” নিজের গম্ভীরতাকে কাঁধ
ঝাঁকিয়ে তাড়িয়ে দিলো কনস্টেনটিন “তোমাকে নোংরা করে দিচ্ছে এটা”
264

“ওহ, জন ” এলি বললো, খুবই মিষ্টিভাবে। ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাসলো একটু । লেজ নড়ছে
একটু একটু “তু মি জানো আমি এখানের পরিবেশ কতোটা পছন্দ করি । মানুষের পৃথিবী । তো,
এখানের বাস চিরকালীন করার জন্য করার জন্য , এটা একটা ভালো সুযোগ । ”

ও ভেবে দেখলো , ও হয়তো প্রথম থেকেই ওদের সাথে কাজ করছিলো না । তাহলে সেই মোটেল
রুমেই ওকে মেরে ফেলত। ও সম্প্রতি ঢু কেছে দলে, হয়তো ‘বস’ এর গুড বুকে সম্প্রতি ঢু কেছে।

সে বুঝতে পারলো , ওদের মধ্যে যে কেউ, যে কোন মুহূর্তে লিড নিয়ে নেবে – আর চিৎকার করে
অন্যদের বলবে, যে আর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। জন কনস্টেনটিনকে খুন করার সময় ......
এখনই !

এঞ্জেলা আর ফ্রান্সিস্কো পুলে অপেক্ষা করছে। এঞ্জেলা আর ছটফট করছে না। ওরা বসে
আছে একটা ধাপে। এঞ্জেলার গলা এখনও বাঁ হাতে ধরে আছে ফ্রান্সিস্কো, শ্বাস রোধ করে নয়,
আবার হাল্কাভাবেও নয়। ডান হাতে ধরে আছে সেই লোহার স্পাইকটা। ভেজা শরীরে দুজনেই
কাঁপছে মৃদু মৃদু।

এঞ্জেলার কোন ধারণা নেই, ব্যাটা এখানে কিসের জন্য অপেক্ষা করছে। ওর ধারণা, ব্যাটার
নিজেরও ধারণা নেই।

ও তাকিয়ে আছে ওপরের দিকে, মনে হচ্ছে কিছু একটা শুনছে। গড়গড়া করার মতো একটা
চিৎকারের শব্দ, সেইসাথে গুরুগম্ভীর অনেকগুলো কণ্ঠের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে দরজার ওপাশ
থেকে। এখন, একটা ভয় ধরানো নীরবতা নেমে এসেছে চারিদিকে। এঞ্জেলার মনে হলো ফ্রান্সিস্কো
এমন একটা কিছু শুনতে পাচ্ছে, যেটা ও নিজে শুনছে না। গলা খাড়া করে রেখেছে সে, যেন কিছু
একটা শুনছে। জবাবে এমনকি নডও করছে মাঝে মাঝে !
265

মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে , যেন পাগলের প্রলাপের মতো করেই জবাব দিয়ে যাচ্ছে লোকটা।
পাগলামি বলে মনে হলেও, এই পাগলামিই বাস্তবতাকে ভেঙ্গে গুঁড়ো করে দিয়েছে সম্প্রতি। একটা
অদৃশ্য সত্ত্বাই তো ওকে এখানে নিয়ে এসেছে , তাই না ? ওইসব স্বত্বাদের অস্তিত্বে সন্দেহ করার
আর কোন অবকাশ নেই এখন। নিজের আধ্যাত্মিক ক্ষমতাকে একটু ব্যবহার করলেই হয়তো
ওটাকে দেখতে পাবে সে, কিন্তু ওর আসলে ইচ্ছে করছে না। কি লাভ ? ওর প্রথম যেটা করা
দরকার সেটা হলো , এই লোকটা থেকে ছুটে পালিয়ে যাওয়া।

ওর সুযোগ এলো তখনই। লোকটা এতক্ষণ লোহার স্পাইকটা ধরে ছিলো, স্পাইক ধরা হাতটা
কাঁপছিল ওর। হঠাৎ, সে ওটা কোটের পকেটে রেখে দিলো, মনে হলো ওটাকে যথেষ্ট ভয় পায় সে।

এঞ্জেলা লোকটার শক্তিতে অনেকখানি পরিবর্ত ন টের পেলো এবার। স্পাইকটা খালি হাতে ধরে
যেহেতু নেই, ওর ভেতরে এখন স্রেফ সাধারণ মানুষের শক্তি।

ও অবাক হয়ে গেছিলো , ওকে যখন সেই অদৃশ্য জিনিসটা দেয়ালগুলির মাঝ দিয়ে এখানে নিয়ে
এসেছিল। ফ্রান্সিস্কোর সাথে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। এখন...... শক্তি সঞ্চয়
করছে সে, ওই স্পাইকটা যদি একবার...... একবার হাত দিয়ে ধরতে পারে সে......

কনস্টেনটিন, এলির সাথে কথা বলে চলেছে এখনও। টের পেলো, ওর বামে একটা
দোআঁশলা ওর পেছনে চলে যাচ্ছে, ওকে ঘিরে ফেলার মতলব। ব্যাটা টের পেয়েছে, হোলি শটগান
কোন সাধারণ অস্ত্র নয়। এলির দিকে একটা চোখ রেখে, চোখের কোণা দিয়ে অন্য দোআঁশলাটাকে
দেখতে দেখতে সে বলে চললো “তু মি কি মনে করো, শয়তানের ছেলে ওর থেকে ভিন্ন কিছু হবে?
” মাথা নেড়ে যোগ করলো “ও স্রেফ এই জায়গাটাকে আরেকটা নিজস্ব নরকে পরিণত করবে –
তখন তোমরা পার্টি করতে কোথায় যাবে ? ” ক্ষীণ হাসলো সে “স্বর্গে ?”

এলি ভ্রু কুঁ চকালো। কনস্টেনটিন জোর দিয়ে বলেছে যে, সে অন্তত জানে না যে, স্বর্গ কি জিনিস !
266

“রাফ হবার দরকার নেই” সে বললো।

নাক দিয়ে শব্দ করলো কনস্টেনটিন “এর আগে তো কই বিরক্ত হও নি”

খেয়াল রেখেছে সে বরাবর, সেই দোআঁশলাটার দিকে, আস্তে আস্তে বৃত্ত ছোট করে আনছে।

এলি ওর এই ছোট্ট কৌতু কে হেসে উঠলো “আমাদের মিলনস্থান গুলো খুবই মিস করবো আমি,
নরকের চেয়েও গরম !”

“আমিও , বাছা !”

ওর বাম পাশের পিশাচটা হাঁটু বাঁকা করছে আস্তে আস্তে , ঝাঁপ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে.......

কনস্টেনটিন টের পেলো , ওটা নিজের চিন্তাগুলো আড়াল করার চেষ্টা করছে । কিন্তু কিছু টু করো
চিন্তা ঠিকই ধরতে পারলো সে......

একটা ঝাঁপ দেবো, গলা ছিঁ ড়ে দেবো ওর...... কিন্তু ওকে এতো তাড়াতাড়ি মারা যাবে না ... দ্যা বস
ওকে দ্রুতই হাতে পেয়ে যাবে। ওর দুর্দ শাগুলো খেয়ে নেবো আমি, রক্ত ফু রিয়ে মরে যাওয়ার আগে।
যদি ঠিকঠাক করতে পারি। আমি এর মধ্যেই রক্তের স্বাদ পাচ্ছি......আরেক ধাপ সামনে, তারপর......

কনস্টেনটিন ওর সিগারেট লাইটারটা বের করলো বাম হাতে “তোমরা এখানকার ভারসাম্য নষ্ট
করছো । ” রুমে উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো সে , বিরক্তিকর শান্তভাবে “এখনই চলে
যাও, নয়তো সব কটাকে নরকে পাঠাবো এক সাথে।”

“ওহ, জন” এলি বলে উঠলো “এটা খুবই বিব্রতকর। তোমার গর্ব কোথায় গেলো ?”
কনস্টেনটিনের দিকে একটা দুঃখ ভরা করুণার দৃষ্টি ছুঁ ড়ে দিলো সে।

সে জানে এটা একদম বোগাস শোনাচ্ছে। রুম ভর্তি পিশাচকে সে একটা সিগারেট লাইটার
দেখিয়ে বলছে, সে কিনা ওদের সবাইকে নরকে পাঠাবে ! কিন্তু ওর সর্বনেশে জীবনে, তখনও কিছু
আনন্দ বাকী রয়ে গেছিলো – আর ও সেই মুহূর্ত পুরোপুরি উপভোগ করছে। কনস্টেনটিনের সব
267

সময়ই মনে হয়েছে, এই পুরো বিশ্ব সৃষ্টির পেছনে আসলে কোন যুক্তিই নেই। একটা অন্ধকার ধরণের
আনন্দ পায় সে, এই অযৌক্তিকতাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে। একটা ব্যাক্তিগত প্রতিশোধ মনে
করে সে, এই মহাজগতের স্রষ্টাদেরকে ক্রমাগত বিদ্রুপ করে।

“সবাই , একসাথে বেরোও ! বেরিয়ে নিচের দিকে যাবার প্রথম লিফট টা ধরো। ” হাতের সিগারেট
লাইটারটা নাড়তে নাড়তে বললো কনস্টেনটিন।

সেই দোআঁশলাটা, যেটা ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলো, সেটা থমকে গেলো এটা শুনে।
ভাবছে, কনস্টেনটিন কি করতে যাচ্ছে আসলে। সেই সুযোগটা নিয়ে , কাছের একটা চেয়ারের
ওপর উঠে গেলো কনস্টেনটিন। হাতের লাইটারটা তু লে ধরলো , ওটাকে সিলিঙের দিকে উঁচিয়ে
ধরলো।

এলি ওর দিকে চেয়ে দুঃখ ভরে মাথা নাড়লো ।

“বেবি ডল” কনস্টেনটিন বললো এলির দিকে তাকিয়ে “জাহান্নামে যাও !”

এলি সিলিঙের দিকে তাকালো , কিছু একটা সন্দেহ করছে। তখনই, লাইটারের আগুনের শিখাটা ,
স্বয়ংক্রিয় ফায়ার এক্সটিংগুইশিং স্প্রিঙ্কলার (ছোট্ট ঝর্নার মতো কল) চালু করে দিলো।

পানি স্প্রে’র মতো নেমে এলো, ভিজিয়ে দিলো রুমের মধ্যে থাকা সমস্ত পিশাচদের। ভিজে
যাওয়ার পর, ওদেরকে বেশ নিষ্ঠু রভাবে আনন্দিত দেখালো।

ওই পানি ওদের ওপর কোন ক্রিয়াই করতে পারেনি ! কেবল সেগুলোর ভাঁজ গুলো নষ্ট করে
দিয়েছে। ওদের মধ্যে একজনকে বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা গেলো, আজকেই কেবল পোশাক
ইস্ত্রি করিয়েছে বলে !

“এটাই তোমার প্ল্যান ছিল ?” এলি একটা শ্বাস ফেলে বললো।


268

পানির স্প্রে কমতে কমতে , এক সময় প্রায় থেমে গেলো। তারপর হঠাৎ, লাইনে নতু ন পানির
জোয়ার এলো। তারপর, একটা অসঙ্গতিপূর্ণ কোলাহলে ভরে গেলো পুরো ঘর, পিশাচেরা হঠাৎ
শুরু করে দিলো যেন উন্মাদ নৃত্য। ওরা লাফাতে লাগলো, মোচড়াতে লাগলো , চেহারা বিকৃ ত
করে চিৎকার করতে লাগলো – কারণ ওদের চামড়া বগবগ করে সেদ্ধ হতে লেগেছে !

“হোলি ওয়াটার !” এলি চিৎকার করে উঠলো।

কনস্টেনটিনের শরীর জুড়ে স্বস্তির পরশ বয়ে গেলো। চ্যাজ ওর কাজ করতে পেরেছে। কনস্টেনটিন
অনেকটাই অনিশ্চিত ছিল চ্যাজ কাজটা করতে পারবে কি না। চ্যাজ, মিডনাইটের দেয়া ক্রশ দিয়ে
, ফায়ার স্প্রিঙ্কলারের ট্যাঙ্কের ভেতরের সব পানিকে হোলি ওয়াটারে পরিণত করে দিয়েছে !

পিশাচেরা যন্ত্রণায় উদ্বাহু নৃত্য জুড়ে দিয়েছে। এটা একই সাথে আধিভৌতিক আর শারীরিক একটা
যন্ত্রণা, যেটা কিনা ওদের অন্তরাত্মাকে ছুঁ য়ে দিচ্ছে ঐশ্বরিক শক্তিসমৃদ্ধ হোলি ওয়াটারে ভেজানোর
মাধ্যমে। ওদের মানুষের চামড়াটা গলে গলে যাচ্ছিলো, আর কনস্টেনটিন দেখতে পাচ্ছিলো ওদের
ভেতরকার পৈশাচিক চেহারাটা। ওদের বিকট দাঁত খিচানো চেহারা দেখে ওর ‘মোরে ঈল’ নামের
এক রকম রাক্ষু সে মাছের চেহারা মনে পড়ে গেলো। খানিকক্ষণের মধ্যে, সেই চেহারাগুলোও সুগার
ক্যান্ডির মতো গলে গলে যেতে লাগলো।

কিন্তু ওরা তখনও মারা যায়নি। তখনও সচল ছিল ওরা, আর কারো কারো মনের সক্রিয়তা
তখনও বজায় ছিলো। ওরা কনস্টেনটিনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। পুড়ে ছাই হয়ে নরকে
যাওয়ার আগে, ওকে খুন করে ফেলার মতো শক্তি ওদের মাঝে তখনও ছিল। ওরা ওদের সাথে,
ওকে নিয়েও যেতে পারে চাইলে।

যে দোআঁশলাটা ওকে ঘিরে ফেলতে চেয়েছিল, সেটা অ্যাকশনে গেলো এখন। অর্ধেক চামড়া নেই
হয়ে যাওয়ার পরও, লাফ দিলো ওটা। আর কনস্টেনটিনের হোলি শটগানের গুলি খেলো একদম
মুখের ওপর। সেই বুলেট , যেগুলি মিডনাইটের রান্নাঘরে ‘রান্না’ করেছে সে। পিশাচটার মাথা
বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো শরীর থেকে। কনস্টেনটিন একটু সরে গেলো ওর লাফের গতিপথ থেকে, কিন্তু
269

তারপরও পতনোন্মুখ শরীরটার ধাক্কা খেলো। পিশাচটার নরকের দিকে রওনা হওয়া আত্মার
আওয়াজও শুনতে পেয়েছে একই সাথে।

এই পুরো সময় ধরে স্প্রিঙ্কলারটা থেকে পানি বের হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে কনস্টেনটিন আর ওই
পিশাচদের। পানি বেয়ে পড়ে ওর দৃষ্টি অনেকটাই ঝাপসা হয়ে এসেছে। লবিতে একটা লকার
রুমের শাওরারের মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। পায়ের নিচে চেয়ারটা পিচ্ছিল মনে হওয়াতে, লাফ
দিয়ে মেঝেতে নামলো কনস্টেনটিন। শটগানটা রেডি করে নিলো সেই ফাকে।

সে ঘুরলো, আরেকটা পিশাচ ধেয়ে আসছে ওর দিকে। ধন্যবাদ হোলি ওয়াটারকে, ওটার চেহারা
নেই বললেই চলে। একটা চোখ পুরো গলে গেছে, আরেকটা কোনমতে ঝু লে আছে সকেটে।
কনস্টেনটিন ওটার বাকি চোখ, মাথাসহ উড়িয়ে দিলো। চিৎকার করতে করতে ওটার ঠাই হলো
নরক গহ্বরে।

সে এবার দেখতে পেলো এলি’কে, মোচড়াচ্ছে মেঝেতে শুয়ে। ওর কাপড় দেখে ওকে চিনতে
পেরেছে সে। বাকিটা , কেবল ওর ধ্বংসাবশেষ – মুখ ফিরিয়ে নিলো কনস্টেনটিন।

অন্য একটা পিশাচ, গলা পেঁচিয়ে ধরলো কনস্টেনটিনের। যে হাতটা ওকে ধরেছে, সেটার
বেশীরভাগই হাড়। তারপর, ওটা ওর শ্বদন্ত বসিয়ে দিতে চাইলো ওর গলায়। শটগানটা পাম্প
করে, ট্রিগার টেনে দিলো। পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জের গুলি, পিশাচটাকে স্রেফ দুই ভাগ করে ফেললো।
নিচের অংশটা সামনে হেঁটে গেলো কয়েক কদম, ওপরের অংশ খানিক ঝু লে রইলো ওর সাথে,
তারপর ঝপাৎ করে পড়ে গেলো নিচের পানির মধ্যে।

অন্যগুলোও এগিয়ে আসছে ওর দিকে। কিন্তু ওগুলো হামাগুড়ি দিচ্ছে চার হাত পায়ে। কিছু কিছুর
পা নেই হয়ে গেছে, কনুই এর ওপর ভর করে এগিয়ে আসছে ওরা......

লড়তে লড়তে অন্য মনস্ক হয়ে পড়ায়, ওর কাঁধে উঠে এলো ওদের একজন। ঘাড়ে নখ বিঁধিয়ে
দিয়ে , ওর কানের কাছে চিৎকার করে উঠলো “আমি ফেরত যাবো না !”
270

কনস্টেনটিন চেনে ওই গলা, যতই কর্ক শ হোক না কেন। ওটা এলি !

কনস্টেনটিন ওর মাথা ধরে, চেয়ারের ওপর উঠে স্প্রিঙ্কলারের আরও কাছে ধরলো সেটা। এলি
ঝাড়া মারল একটা, তারপর নড়াচড়া থামিয়ে দিলো। পরিণত হলো ছাইয়ে। ওর কাপড়গুলো পড়ে
গেলো নিচে, খালি.........

“দেখা হবে ওখানে, বাছা” কনস্টেনটিন বিষণ্ণ ভাবে বললো।

তখনই, পানি স্প্রে করা থেমে গেলো। ট্যাঙ্কের পানি পড়া থেমে গেলো......... কিন্তু পিশাচেরা
তখনও আসছেই। ওদের মধ্যে বেশ কিছু মারা গেছে, কিন্তু ভালোভাবে কাপড়ে মোড়ানো
থাকাতে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেঁচেও গেছে। নিচে ঝরে পরে যাওয়ায়, পানিও আর পবিত্র নেই।
সেগুলোও কোন সাহায্যে আসছে না আর।

আর পিশাচেরা এগিয়েই আসছে খালি।

কনস্টেনটিন ওদের দিকে পেছন ফিরে, দূরের একটা দরজার দিকে এগোতে লাগলো। দরজার ওপর
লেখাঃ হাইড্রোথেরাপি। এখানেই তো সেই স্প্যানিশ লোকটা নিয়তির বল্লম হাতে ঢু কে বসে আছে,
তাই না ?

কনস্টেনটিন দৌড়ে সেই দরজাটা খুলে ভেতরে ঢু কে গেলো। একটা হলওয়ে ধরে এগোতে
লাগলো। পেছনে শুনতে পেলো শ্লেষ্মা জড়ানো , দম আটকানোর শব্দ, হাড়ের সাথে হাড়ের
ঠোকাঠু কির শব্দ। সে ফিরে তাকিয়ে দেখলো, বেঁচে যাওয়া পিশাচেরা এগিয়ে আসছে ওর দিকে।
বিড়বিড় করে কি জানি বলছিলো ওদের মধ্যে কেউ কেউ, ফলে মেঝে থেকে একটু ওপরে উঠে,
ভেসে ভেসে আসতে লাগলো ওরা। এই এগিয়ে আসার সময়ও, ওদের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ,
এমনকি চোয়াল, চোখ , চামড়া খসে খসে পড়ছিলো ! হাড় বেরিয়ে পড়ছিলো জায়গায় জায়গায়।

কনস্টেনটিন যেখানে ছিলো, সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো। ওদেরকে পথ দেখিয়ে এঞ্জেলার কাছে
নিজে যেতে চায়না। কাঁধের ওপর শটগান তু লে, কাছে পিশাচটার দিকে লক্ষ্য স্থির করলো। ওটাকে
271

উড়িয়ে দিলো সে, কিন্তু অন্যগুলি এখনও এগিয়ে আসছে। পিশাচের পর পিশাচ, পচে যাচ্ছে, কিন্তু
এখনও ভয়ানক। ভেসে ভেসে, ছেঁ চড়ে ছেঁ চড়ে , ওর নাম উচ্চারণ করতে করতে এগিয়ে আসছে
ওরা অমোঘ নিয়তির মতঃ

“কনস্টেনটিন............ জন কনস্টেনটিন.........”

কনস্টেনটিন শটগান ফায়ার করলো , একবার, বার বার । ওদের মধ্যে একটা ছাদ থেকে উল্টো হয়ে
ঝু লে ঝু লে এগিয়ে আসছিলো। ওর ওপর ওখান থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলো , ঠিক ওটার
মুখের কাছে শটগান ব্লাস্ট করলো কনস্টেনটিন । চিৎকার করতে করতে ছাইয়ে পরিণত হলো
ওটা। আরেকটা মেঝে থেকে ঝাঁপ দিলো মাকড়শার মতো। শটগান পাম্প করার সময় না পাওয়ায়
ওটাকে বাঁট দিয়ে বাড়ি দিয়ে আরেকপাশে পাঠিয়ে দিলো সে। তারপর ওটার ঘাড়ে পাঠিয়ে দিলো
আরেকটা বুলেট, কাঁপতে কাঁপতে নরকের পথে রওনা হলো ওটা......... এরপরও পিশাচেরা
আসতেই থাকলো .........

এঞ্জেলা একটা নিচু ‘ধুপ’ করে শব্দ পেলো। বুঝতে পারলো , ওটা একটা গুলির
আওয়াজ, শটগান হতে পারে। বিল্ডিঙের আরেকটা অংশ থেকে – খুব বেশী দূরে নয়।

ফ্রান্সিস্কোও শুনতে পেয়েছে শব্দটা। এঞ্জেলার গলায় রাখা হাতটা একটু শিথিল করে শব্দটার
উৎসের দিকে তাকালো। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছে।

এটাই সুযোগ। এঞ্জেলা তায়-কোয়ান-দো তে শেখা একটা মার মারলো, ওর পা দিয়ে ফ্রান্সিস্কোর
হাতে, গলা থেকে ছাড়িয়ে নিলো হাতটা। একইসাথে বাম হাতে একটা ঘুষি ঝেড়ে দিলো, কাঁধ থেকে
যোগাড় করা সমস্ত শক্তি দিয়ে।

কিন্তু চতু র ধাঙ্গড় আঘাতটা প্রায় এড়িয়ে গেলো, খানিক ভারসাম্য হারালেও খাড়া রইলো দুই
পায়ে। পকেটে হাত চালিয়ে দিলো লোহার স্পাইকটার জন্য।
272

এঞ্জেলা পুল থেকে ওপরে উঠে আসতে চাইলো, ওর বন্দুকটার কাছে যাবার ইচ্ছা। ধাঙ্গড়টা ওটা
এক কোণায় ছুঁ ড়ে মেরেছে। কিন্তু ফ্রান্সিস্কো খেঁকিয়ে উঠে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। এবার
ভারসাম্য হারিয়ে, দুজনেই পিঠ দিয়ে পড়লো পুলের পানিতে, ঝপাস করে।

এঞ্জেলা টের পেলো, ক্লোরিন মেশানো পানি ওর ফু সফু সে ঢু কে পড়ছে। ফ্রান্সিস্কো উল্টে উঠে
পড়লো ওর ওপর, চেপে ধরলো পানির ভেতর ! কিছু একটা বলে উঠলো, কিন্তু এঞ্জেলার সাথে
কথা বলছে না লোকটা। এঞ্জেলা বুঝতে পারলো, ওকে খুন করার নির্দে শ পেয়ে গেছে লোকটা। দুই
হাতে ওকে প্রায় পুলের মেঝেতে নামিয়ে দিলো সে, এরপর এক হাত মুক্ত করে সেই লোহার
স্পাইক ছুঁ ল সে। ওর ভেতরে অমানুষিক শক্তি সঞ্চার হচ্ছে, টের পেলো এঞ্জেলা। সে বুঝতে
পারলো, সময় ফু রিয়ে এসেছে ওর। ওর ফু সফু সটা মনে হচ্ছে ফেটে যাবে। ও হাত পা ছুঁ ড়তে
লাগলো, চেষ্টা করলো কোনভাবে মুক্ত হওয়া যায় কিনা। কিন্তু , জগতের সকল অশুভ শক্তি যেন
ফ্রান্সিস্কোর হাতে ভর করেছে, ওকে পানির ভেতর দাবিয়ে রাখার জন্য। পানির ভেতর দিয়ে
ফ্রান্সিস্কোর চেহারা দেখতে পেলো সে, ক্ষণিকের জন্য সেখানে এক রাগী বালকের ছায়া দেখা
গেলো যেন। ওকে ছোটবেলায় পরিত্যাগ করার প্রতিশোধ নিচ্ছে।

এরপর, এঞ্জেলার চারপাশে যেন অন্ধকার নেমে আসতে লাগলো। সে আর কাউকে দেখতে
পাচ্ছিলো না। আলো ছায়ার খেলা দেখতে পেলো চারপাশে, পানির নীল রঙ পাল্টে যাচ্ছে গাঢ়
বেগুনিতে।

ঈশ্বর , সাহায্য করো আমাকে। আমি পৃথিবীতে তোমারই কাজ করতে চেয়েছিলাম। তু মি কি
কাউকে পাঠাবে না , আমাকে সাহায্য করার জন্য ?

এটা একটা হৃদয় নিংড়ানো প্রার্থনা ছিলো। কিন্তু জবাবে, কেবল আরও আরও অন্ধকার,
অন্ধকারের জগত জেঁ কে বসলো আশেপাশে।

এরপর, এলো আলো – প্রচণ্ড আলো। এটা মুক্তির আলো নয়, এটা হলো স্থানান্তরের আলো, সাদা
আগুনের মতো , এগিয়ে এসে ওকে গ্রাস করলো।
273

ও চিৎকার করে উঠলো, ঘুরতে ঘুরতে , পড়ে যেতে লাগলো নিচের দিকে। কিছু একটা শুষে
নিচ্ছে, আর ও সেখানে পড়ে যাচ্ছে , পড়ে যাচ্ছে, অনন্তকাল ধরে যেন.........

এরপর, ও নিজকে আবিষ্কার করলো , বসে আছে হাড়ের মতো খটখটে সাদা সুইমিং পুলে, একা।
কেবল , ওটা সেই একই পুল, একই হাইড্রোথেরাপি সেন্টার ছিলো না। ওটা ছিলো সেই রুমের
নারকীয় সংস্করণ। আশেপাশে তাকিয়ে, সে বুঝতে পারলো সেটা। চারপাশে ছেয়ে আছে নরকের
এক সর্বব্যাপী শব্দের মেলা, এমনকি চিৎকারের কোরাসও শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। যেন ভেজা
ভেজা একটা শব্দ, লক্ষ লক্ষ চোয়ালের , মানুষের মাংসে কামড় বসানোর গা গুলানো শব্দ আসছে
ভেসে। উঠে দাঁড়ালো সে, দেখতে পেলো রুমে থাকা সবগুলি বাথটাব ভর্তি , রক্ত দিয়ে !
দেয়ালগুলো ফাটা, সেই ফাটা অংশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে আগুনের ছায়া। বাতাস ভারী হয়ে আছে ছাই
আর হতাশার বিষ বাষ্পে।

এঞ্জেলা জানে, ও এখানে এসেছে অভিশপ্ত হিসাবে নয়, বরং একজন ভ্রমণকারী হিসাবে। পৃথিবীর
সাথে একটা যোগাযোগ রেয়ে গেছে ওর, যেটা অভিশপ্তদের থাকেনা। ও যেহেতু এখানে আগেও
একবার এসেছে, ও কিছুটা হলেও জানে এখানকার সম্পর্কে । কিন্তু এবার, ওকে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই
নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। কিন্তু কে আনলো ওকে এখানে ?

ফ্রান্সিস্কো কোথাও নেই। কিন্তু কেউ একজন কাছাকাছিই আছে, কেউ একজন , যে কিনা ওর দিকে
তাকিয়ে আছে। সে এগিয়ে আসছে ওর দিকে , পেছন থেকে। ওর ভয়াবহ মনোযোগ নিবদ্ধ
এঞ্জেলার প্রতি।

“এঞ্জেলা ......” খরখরে একটা গলা ভেসে এলো পেছন থেকে। সে এঞ্জেলার নাম উচ্চারণ করতে
লাগলো , আঠালো আর বিষাক্ত স্বরে , ভেঙ্গে ভেঙ্গে “এন......জে.........লা আআআ” ।
উচ্চারণটা , অদ্ভু তভাবেই , অশ্লীলতায় পাল্টে গেলো । আসলে, যে কোন শব্দই ম্যামন বলুক না
কেন, সেটা অশ্লীলই শোনাবে !

জোর করে নিজেকে সেদিকে ঘোরালো এঞ্জেলা।


274

ও একজন বেশ মানসিকভাবে শক্তিশালী মহিলা। আর, নিজের ছোট পুলিশি জীবনে, অনেক
ভয়ংকর জিনিসও দেখেছে সে, আর কোন জিনিস দেখেই চিৎকার করে ওঠেনি। আরেকবার
চিৎকার করেছিলো এর আগে, নরকের চেহারা দেখে। সহজে চিৎকার করে না সে।

কিন্তু এখন, ম্যামনকে সামনে দেখে, এঞ্জেলা ডডসন একটা লম্বা , ভয়ার্ত , আকাশ চিরে ফেলা
চিৎকার দিলো।

তিনটে পিশাচ, তখনও এগিয়ে আসছিলো কনস্টেনটিনের দিকে। রক্ত, মাংস আর আত্মার
আশায়, আর ওর শটগানটা জ্যাম হয়ে গেছে।

ওদের মধ্যে একজন , গলায় যাজকের সাদা কলার। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এসে , ঝাঁপ দেয়ার
জন্য রেডি হচ্ছিলো । ঠিক যেভাবে একটা বেড়াল, ইঁদুরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য রেডি হয়।

“এখন তু মি আমার, ছেলে ......” ওটা বললো, গলার বারোটা বেজে গেছে পচে যাওয়া জিহ্বার
কারণে।

কনস্টেনটিন গলাটা চিনতে পারলো। এটা হলো সেই পাদ্রী, যে ওর কিশোর বেলায় যখন
আরেকজন পাদ্রী ওকে ‘এক্সরসাইজ’ করছিলো – সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো। সেই পিশাচ, যে কিনা
‘ঈশ্বরের লোক’ হিসাবে ছদ্মবেশ ধরেছিল।

কনস্টেনটিন বিকট একটা চিৎকার দিয়ে ওর শটগানের জ্যাম ছুটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলো ।
সর্বান্তকরণে সে চেষ্টা করছিলো , এই পিশাচ পাদ্রীকে নরকে পাঠাতে।

কিন্তু ওটা ওর গলা লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিলো। অন্য দুই পাশ থেকে দুইজন পিশাচ গর্জ ন করে
উঠলো খুনে আনন্দে – ওরা ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর ওপর।
275

কনস্টেনটিন ওর শটগানের জ্যাম ছোটাতে পারলো না কিছুতেই, ও শেষ !

কিন্তু কেউ একজন , পিশাচগুলোর পেছন থেকে একটা শটগান ফায়ার করলো। সামনের
পিশাচটা, স্রেফ বাতাসে মিলিয়ে গেলো মাঝপথ থেকে। একটু পিছিয়ে এসে, একপাশের পিশাচকে
শটগানের বাঁট দিয়ে আঘাত করলো কনস্টেনটিন। অন্যটা উড়ে গেলো শটগানের ব্লাস্টে। তারপর,
অন্যটারও, যেটাকে কনস্টেনটিন আঘাত করেছে, সেটাও একই পরিণতি বরণ করলো।

বাতাসের জন্য খাবি খেতে খেতে, কনস্টেনটিন ফিরে তাকালো দরজার দিকে। চ্যাজ দাঁড়িয়ে আছে
ওখানে, নিজের শটগান হাতে, হাসছে দাঁত বের করে।

একটা অস্বস্তিকর দীর্ঘ মুহূর্ত ওরা তাকিয়ে রইলো পরস্পরের দিকে—বাতাসে কোন শব্দ নেই
কেবল ছায়ার ভেতরকার গা শিউরানো ফিসফিস ছাড়া...

তারপর কনস্টেনটিন ওর ধন্যবাদ জানালো নড করে। এরপর, বাঁকা হয়ে যাওয়া শেল’টা বের করে
নিলো শটগান থেকে। আশা করলো, এবার ওটা ফায়ার করা যাবে।

“জন......” চ্যাজ জিজ্ঞেস করলো “তু মি ঠিক আছো ?”

কনস্টেনটিন ওর দিকে ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো “কেন জিজ্ঞেস করছ ?”

উনিশ

কনস্টেনটিন আর চ্যাজ হাইড্রোথেরাপি রুমে প্রবেশ করলো হুড়মুড় করে। সেই ধাঙ্গড়টা দাঁড়িয়ে
আছে পুলের ভেতর, হাতড়াচ্ছে পানির ভেতর উদ্দেশ্যহীনভাবে।
276

আর এঞ্জেলা , ভাসছে, স্থির হয়ে পানির ওপর......... উপুড় হয়ে। ওর চু লগুলো ছড়িয়ে আছে
পানির ওপর, সাগরের আগাছার মতো। ডু বে গেছিলো মেয়েটা, কনস্টেনটিন টের পেলো, ওকে
ডু বিয়ে মারা হয়েছে।

কনস্টেনটিন ধাঙ্গড়টার দিকে শটগান তাক করলো, মরিয়া হয়ে গুলি করার অজুহাত খুঁজছে।
“সরো এখান থেকে, সরে যাও ওর কাছ থেকে, এক্ষু নি ! ”

ধাঙ্গড়টা কনস্টেনটিনের দিকে তাকালো – স্রেফ একটা বিভ্রান্ত , ভীত লোক , ওই বল্লমের টু করোটা
ছাড়া। কনস্টেনটিন টের পেলো, ওর ভেতরে আর আগের সেই ক্ষমতা নেই, যেহেতু ওর কাছে
বল্লমের মাথাটা আর নেই।

তাহলে ওটা কার কাছে এখন ?

ধাঙ্গড়টা এঞ্জেলার শরীরের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, পুল থেকে উঠে পেছনের দিকে
চলে যাচ্ছে সে।

কনস্টেনটিনের মনে হলো , এই ব্যাটাকে শটগানের এক বাড়ি মেরে, এঞ্জেলাকে সাহায্য করার চেষ্টা
করবে। সিপিআর দেয়ার জন্য অনেক দেরী হয়ে গেছে এতক্ষণে , কাছাকাছি কোন সত্যিকারের
ডাক্তার পাওয়া যায় যদি !

তখনই, জলের ছলছল আওয়াজ শুনল সে। দেখতে পেলো, এঞ্জেলা উঠে দাড়িয়েছে পুলের
ভেতর। সোজা তাকিয়ে আছে কনস্টেনটিনের চোখের দিকে।

কিন্তু ওর চোখে, সাদা কোন অংশ নেই, পুরো চোখ, কু চকু চে কালো !

“শিট !” কনস্টেনটিন বলে উঠলো। ওর দিকে তাকিয়ে, খেঁকিয়ে উঠলো এঞ্জেলা।

ও ‘পজেসড’ হয়েছে। একটা অত্যন্ত শক্তিশালী কিছু দ্বারা......... আর কনস্টেনটিন সন্দেহ


করলো, ওটা কে, সে জানে সেটা।
277

ম্যামন নিজেই।

কনস্টেনটিন ওর শটগান ফেলে, পা নিচে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো পুলের ভেতর। দৌড়ে গেলো
এঞ্জেলার দিকে, ওর বাহু আড়াআড়ি তু লে ধরে ধাক্কা মারার জন্য । ওর ব্যাল্যান্স নষ্ট করে দেয়ার
ইচ্ছা। ওকে যদি অর্ধেক সুযোগও দেয়া হয়, তবে খাবলে ওর চোখ তু লে নেবে । অথবা জুগুলার
ভেইনে একটা জুতসই কামড়, ব্যাস সব শেষ !

‘হিস’ শব্দ করে পিছিয়ে গেলো মেয়েটা। কনস্টেনটিন ওকে পুলের ভেতরের দেয়ালের সাথে ঠেসে
ধরলো, অন্য হাতে ওর চাবির রিঙের চেইনটা বের করতে লাগলো। সেইন্ট এন্থনির একটা
‘এক্সরসিজম চার্ম’ প্রয়োগ করলো ও মেয়েটার মাথার একপাশে। মনে ভাবতে লাগলো , এরকম
প্রায় উড়ন্ত অবস্থায় , ওটা কাজ করবে কিনা। এঞ্জেলার চামড়া হিসসস শব্দ করে পুড়তে শুরু
করায়, ভীষণ একটা ঝাড়া দিয়ে উঠলো সে, গর্জ ন করে উঠলো ব্যাথায়।

“ইন নমিনে পাত্রিস এত ফিলি এত স্পিরিতাস সানকটি এক্সতিঙ্গুয়াতু র ইন তে অমিনাস ভারতু স


ডায়াবোলি ” কনস্টেনটিন চিৎকার করে বলতে লাগলো , ওর নিজের সমস্ত শক্তি এই শব্দগুলোর
পেছনে ঢেলে দিচ্ছে সে “ইন নমিনে পাত্রিস এত ফিলি এত স্পিরিতাস সানকটি এক্সতিঙ্গুয়াতু র
ইন তে অমিনাস............”

ম্যামন প্রতিক্রিয়া দেখাতে লাগলো, মানুষের পৃথিবীতে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে লাগলো। ওকে
আবার নরকে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা ও একদমই পছন্দ করছে না। এই পুরোটা
সময় জুড়ে সে কল্পনা করে এসেছে , এঞ্জেলা নামের দরজার মাধ্যমে সে মানুষের পৃথিবীতে পদার্পণ
করবে। আর বল্লমটাকে সেই দরজার চাবি হিসাবে ব্যবহার করছে সে।

এখন, এঞ্জেলার শরীরে একটু পরপর ঢেউ খেলে যাচ্ছে, কারণ ম্যামন বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছে
চামড়া ফুঁ ড়ে। কিম্ভূ তকিমাকার, খেঁক খেঁক করতে থাকা , মাছির মতো দেখতে একটা অবয়ব,
বীভৎস মানব শিশুর মতো একটা আকৃ তি ভেসে উঠছে বারবার। এঞ্জেলার বুকে, হাতে, চেহারায়
সেই চেহারা বারবার স্পন্দিত হতে লাগলো।
278

সে যে মেয়েটার প্রেমে পড়েছে, সেই মেয়েটার চেহারায় ম্যামন বারবার দেখা দেওয়াতে, কনস্টেনটিন
অসুস্থ বোধ করতে লাগলো।

“ইন নমিনে পাত্রিস এত ফিলি---” কনস্টেনটিন চিৎকার করে, মরিয়া হয়ে জোর দিয়ে বলতে
লাগলো। কিন্তু এঞ্জেলাকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে ওর জন্য – আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে
ফেলছে সে ---

হঠাৎই উদয় হলো চ্যাজ , ঝাঁপ দিয়ে পড়লো পুলে। কনস্টেনটিনকে সাহায্য করলো এঞ্জেলাকে
টেনে পুলের পাড়ে তু লে নিতে। এঞ্জেলার কাঁপতে থাকা দেহটা চেপে ধরে রাখলো মেঝের সাথে
দুইজনে মিলে। ওর কপালে নিজের হাত চেপে ধরলো চ্যাজ , বলতে শুরু করলো “পার
ইম্পসিতিওনেম মানুম নস্ত্রারেরাম এত পার ইনভক্সানেম......”

জন এঞ্জেলাকে চেপে ধরে রাখলো । তারপর ওর সাথে গলা মিলিয়ে বলতে শুরু করলো
“গ্লরিওসে এত সাঙ্কতাএ দেই জেনেত্রিচিস ভারজিনিস মারিয়ায়। ইন নমিনে পাত্রিস এত ফিলি
এত স্পিরিতাস সাঞ্চতি ......”

চ্যাজের সাথে একটা অদ্ভু ত সংস্রব অনুভব করলো নিজের ভেতরে। একটা অনেক প্রাচীন
যোগাযোগ, এমনকি ল্যাটিন ভাষা উদ্ভাবন হবারও আগের সময়কার। সেই আদিম সময়ে, মানুষ
যখন , একত্রিত হয়ে মহান কোন সত্ত্বার কাছে প্রার্থনা করতো।

এঞ্জেলা – বা ম্যামন – নিশ্চয়ই নরকের দিক থেকে টান অনুভব করে থাকবে। মরিয়া হয়ে , মাথা
ঘুরিয়ে এক কামড় বসালো কনস্টেনটিনের হাতে। হাত ছুটে গেলো ওর, ব্যাথায় ঝাঁকি দিয়ে উঠলো
সে। ওকে হিংস্রভাবে এক ধাক্কা মারলো এঞ্জেলা, কনস্টেনটিন উল্টে পড়ে গেলো পুলের টাইলসের
ওপর। টের পেলো , মাথা ফেটে গেছে ওর।

চোখে ঝাপসা দেখছে, শুনতে পেলো চ্যাজ ফ্রান্সিস্কোর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠেছে। তারপর
ওর শটগান গর্জে উঠলো। ফ্রান্সিস্কো ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছিল।
279

এঞ্জেলা লাফ দিয়ে উঠলো । কনস্টেনটিন শুনতে পেলো চ্যাজ দুর্বোধ্য চিৎকার করে উঠলো
একটা......

মাথা পরিষ্কার হয়ে আসছে আস্তে আস্তে, ঝাড়া দিয়ে সামনে তাকালো কনস্টেনটিন। দেখলো ,
এঞ্জেলাকে পেছন থেকে ধরে রেখেছে চ্যাজ। ফ্রান্সিস্কোর শরীর পড়ে আছে একপাশে নিথর হয়ে,
বুকে শটগানের ফু টো নিয়ে।

“শেষ করো ওটা !” চ্যাজ চিৎকার করে উঠলো, ছটফট করতে থাকা এঞ্জেলাকে ধরে রাখতে
রাখতে।

টলতে টলতে এঞ্জেলার দিকে এগোল কনস্টেনটিন, আঘাতের ফলে মাথা ঘোরাচ্ছে এখনও।
নিজের আত্মিক শক্তির ওপর জোর করে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলো সে , কপালে হাত রেখে
উচ্চারণ শুরু করলো সেঃ

“এল সেপারেতু র আ প্লাজমাতে টু ও” – কাশির দমক সামলাতে সংগ্রাম করছে সে “আত নুম
কু য়াম লেদাতু র আমরসু এন্তিকি , ইন নমিনে পাত্রিস এত ফিলি স্পিরিতাস সানকটি ......”

ওর সাথে চ্যাজও গলা মেলালো আবার “এক্সতিঙ্গুইসার ইন তে অমিনাস ভিরতাস ডায়াবোলি


পার...... ”

তখনই এঞ্জেলা বিরাট এক ঝাঁকু নি দিলো , খাবি খেলো একবার – তারপর একদম নিস্তেজ হয়ে
গেলো। চোখের অন্ধকার অংশ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকলো। কিন্তু কনস্টেনটিন বুঝতে
পারলো, ম্যামন এখনও আছে এখানে। চলে যায়নি, পরবর্তী আক্রমণের জন্য শক্তি সঞ্চয় করছে
কেবল।

এঞ্জেলা চোখের পাতা ফেলে কনস্টেনটিনের দিকে তাকালো , কর্ক শভাবে বলে উঠলো “ওহ না !
ওটাকে আমার ভেতর থেকে বের করো , জন – বের করো। ” এরপর ওর চোখগুলো আবার
কু চকু চে কালো হয়ে গেলো – শরীর ঝাঁকি দিতে শুরু করলো ওর।
280

কনস্টেনটিন চ্যাজের দিকে ফিরে নড করলো , তারপর দুইজনেই একসাথে বলতে শুরু করলো।
কণ্ঠ স্তিমিত , কিন্তু ওদের অন্তরাত্মার সমস্ত শক্তি আছে সেগুলোর পেছনেঃ

“ইন নমিনে পাত্রিস এত ফিলি এত স্পিরিতাস সানকটি এক্সতিঙ্গুয়াতু র ইন তে অমিনাস ভিরতু স


ডায়াবোলি পার......” (পবিত্র পিতা, তাঁর সন্তান আর পবিত্র আত্মাদের নামে, আদেশ করছি ও
অশুভ আত্মা, নরকে ফিরে যা তু ই , যা .........)

এঞ্জেলা ঠকঠক করে কাঁপছে , দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। যে বীভৎস মুখাবয়বটা ভেসে উঠছিল ওর
চামড়ার ওপর দিয়ে, ওটা চলে গেছে।

কনস্টেনটিন বুঝতে পারলো , ম্যামন এখনও এঞ্জেলার সাথে সংযুক্ত আছে। ও আর নরকের
মাঝখানে ঝু লে আছে কোনভাবে। কিন্তু বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু ওকে পুরোপুরি তাড়াতে
গেলে ......আরও বেশী কিছু দরকার হবে। ওই বল্লমটা দরকার হবে। তবে ওরা বেশ খানিকটা
মূল্যবান সময় কেড়ে এনেছে।

চ্যাজের দিকে তাকিয়ে নড করলো কনস্টেনটিন “খারাপ না, বাছা !”

চ্যাজ হাসলো বাঁকা ভাবে। কনস্টেনটিনকে নকল করে বলে উঠলো “আমি ক্র্যামার, চ্যাজ
ক্র্যামার, ব্যাটা শয়তান ! ”

কিন্তু এরপর ওর চেহারা হঠাৎ শক্ত হয়ে গেলো, আর ও শূন্যে উঠে পড়লো ! অদৃশ্য কিছু একটা
ওকে ধরে আছে বলে মনে হলো ।

চ্যাজ এরপর চিৎকার করে উঠলো, ওর ঘাড় ধরে কিছু একটা ওকে টানছে, সেই অদৃশ্য শক্তিটাই।

এঞ্জেলা ছুটে গেলো ওর হাত থেকে, মেঝেতে পড়ে গেলো, অজ্ঞান।

কনস্টেনটিন অসহায়ভাবে দেখলো , চ্যাজ ওপরের দিকে উঠতে উঠতে , বাড়ি খেলো সিলিঙের
সাথে।
281

সেই অদৃশ্য শক্তি, বাতাসের মাঝখানেই চ্যাজকে , স্রেফ একটা কাপড়ের মতো করে মুচড়ে
ফেললো ! ঠিক যেভাবে কৃ ষকের বউ কোন মুরগীর ঘাড় মটকে দেয় ! ...... এটা একটু থামল ।

তারপর হাড়গোড় ভেঙ্গে যাওয়ার মতো প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে ছুঁ ড়ে মারলো মেঝের দিকে ।

কনস্টেনটিন আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো সেদিকে। চ্যাজের চোখ থেকে আস্তে আস্তে জীবনের
আলো নিভে যাচ্ছে। ও কথা বলতে চাইছে, কিন্তু মুখেই আটকে যাচ্ছে সেগুলি।

কি ইচ্ছা করছ সে ব্যাপারে সতর্ক থেকো, বাছা – কনস্টেনটিন ভাবলো । তু মি অতিপ্রাকৃ ত


জগত সম্মন্ধে জানতে চেয়েছিলে – সত্যিকারভাবে। এখন, তু মি এমনভাবে এটাকে জানবে,
যেভাবে এমনকি আমি কখনো জানতে পারিনি ............

কনস্টেনটিন ওর ভেতরে ফেনিয়ে ওঠা একটা প্রচণ্ড রাগ টের পেলো । একটা প্রচণ্ড দুঃখবোধ আর
হারানোর ব্যাথা, যেটা ওকে চমৎকৃ ত করে দিলো। সেই মুহূর্তে র আগে, ও বুঝতেই পারেনি, চ্যাজ
ওর কতোটা কাছের মানুষ ছিলো। ওর শেষ প্রকৃ ত বন্ধু ।

তীব্র শোক আর রাগ ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা প্রলম্বিত চিৎকার হয়ে – সেটা পরিণত
হলো তীব্রতম এক গর্জ নে ! ঘুরে তাকালো সে, খুঁজছে সম্ভাব্য শত্রুকে, কিন্তু কাউকে দেখতে
পেলো না। খুনি তখনও অদৃশ্য। কেবল একটা সূত্র দেখতে পেলো সে, দেয়ালে একটা ছায়া।
সেটার শরীরের কোন মালিক নেই। মানুষের আকৃ তির একটা ছায়া, সাথে ডানার ছায়াও দেখা
যাচ্ছে একটু খানি।

কনস্টেনটিন ওর হাতা গুটিয়ে নিলো, জাদুকরী ট্যাটু গুলো বেরিয়ে এলো। ওগুলি পরস্পরের সাথে
যুক্ত করে, গর্জে উঠলো সেঃ

“ ইন টু দ্যা লাইট আই কম্যান্ড দিই ” (আলোর দোহাই, তোমাকে সামনে আসতে আদেশ করছি)
ওর সমস্ত ইচ্ছাশক্তি ঢেলে দিলো এই মন্ত্রের পেছনে। আবারও বললো “ইনটু দ্যা লাইট আই
কম্যান্ড দিই ”
282

ও টের পেলো, কিছু একটা ওর মন্ত্রকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে............

নিজের সমগ্র সত্ত্বার, সমস্ত ইচ্ছাশক্তিকে কেন্দ্রীভু ত করে, আবারও চিৎকার করে উঠলো, প্রতিটা
শব্দে জোর দিয়ে বলে উঠলোঃ

“ইন টু দ্যা লাইট আই কম্যান্ড দিই !”

বাতাস ভারী হয়ে উঠলো, একটা মনুষ্যাকৃ তি ধীরে ধীরে আকার নিতে লাগলো ওর সামনে , শূন্যে
ভেসে আছে......

“তোমার অহংবোধ বেশ চমকপ্রদ ” একটা স্বর ভেসে এলো। একটা গমগমে, উভলিঙ্গ ধরণের
কণ্ঠস্বর।

কনস্টেনটিন মাথা তু লে তাকালো ওটার দিকে। একজোড়া পাখা, দুটো ইস্পাতকঠিন, বরফ ঠাণ্ডা
চোখ।

“গ্যাব্রিয়েল ?” কনস্টেনটিন বললো। চিন্তাটাই নাড়া দিয়ে গেলো ওকে, আর এটার সাথে জড়িত
সম্ভাবনাগুলোও। তারপর সামলে নিয়ে বললো “তাই তো বলি ......”

আর চিন্তা করলো, ম্যামন কোন একটা ‘কিছু ’ কে যে পাঠিয়েছিলো এঞ্জেলাকে বি জি আর বিল্ডিং


থেকে এখানে নিয়ে আসার জন্য। সেটা কিছু ছিল না , ছিল গ্যাব্রিয়েল।

গ্যাব্রিয়েল নেমে এলো মাটিতে, ঠিক একটা প্রজাপতির মতো আলতো ভাবে। হাতে, নিয়তির বল্লম
ধরা আছে।

“আর পৃথিবী চলে যাবে পাপিষ্ঠদের দখলে ” কনস্টেনটিন বলে উঠলো।

“তু মি কি আমার বিচার করতে চাও, কনস্টেনটিন ?”

কনস্টেনটিন নাক দিয়ে একটা শব্দ করে উঠলো “বিশ্বাসঘাতকতা......... খুন......... গণহত্যা ?
আমাকে অমার্জি ত বলতেই পারো ।” রাগে থরথর করে কাঁপছিলো সে, নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে
283

নিজেকে। কিছু একটা পায় কিনা চিন্তা করে দেখছে, যেটা ওকে জেতাতে পারে। কিন্তু গ্যাব্রিয়েলের
সাথে লড়াই করে জেতা ? একজন ফেরেশতাকে পরাজিত করা ?

বিশেষ করে সেই ফেরেশতা যখন শয়তানের একমাত্র পুত্রের সাথে হাত মিলিয়েছে ?

“আমি মানব সমাজকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করছি, যেরকম কথা ছিল ” গম্ভীরভাবে বলে
উঠলো গ্যাব্রিয়েল।

“শয়তানের পুত্রের হাতে পৃথিবী তু লে দিয়ে ?” কনস্টেনটিন বললো “আমাকে সাহায্য করো বরং”

গ্যাব্রিয়েলের ডানাগুলো গুটিয়ে গেলো , কনস্টেনটিনকে ঘিরে পাক খেতে শুরু করলো। ডিঙিয়ে
গেলো এই মাত্র খুন করা চ্যাজকে।

“কেন ?” গ্যাব্রিয়েল বললো , প্রশ্নটার অলঙ্কারকে যেন উপভোগ করছে, এমনভাবে বললো আবার
“কেন তোমাদেরকে এই অমূল্য উপহার দেয়া হয়, প্রত্যেককে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা মুক্তির পথে আহ্বান
করেন ? ” ওই যে – ওর স্বরে আশ্চর্যভাবে মনুষ্যসুলভ বিরক্তি আর ঈর্ষার খোঁচা টের পাওয়া
গেলো। “খুনি, রেপিস্ট , মলেস্টার – সবাই একই। কেবল বিশ্বাস করলেই হলো, ঈশ্বর তোমাদেরকে
বুকে টেনে নেন। সব বিশ্বে, বলতে কি এই বিশ্বসংসারে এমন আর কোনও প্রাণী নেই , যারা এই
ব্যাপারে অহঙ্কার করতে পারে। আর কাউকে ঈশ্বর এতোটা ক্ষমা, এতোটা ভালোবাসা দেন না।
আর তোমরা সেই উপহার নিয়ে কি করো ? ” ক্ষীণ হাসলো গ্যাব্রিয়েল, কনস্টেনটিনের চাইতে বেশী
লম্বা নয়, কিন্তু যেন অনেক ওপর থেকে সে বলে চললো “তোমরা পঙ্কিলতার সাগরে গা ভাসিয়ে
দাও। ঈশ্বরের অনুগ্রহ নাও তোমরা, ওনার অনন্ত ধৈর্যের সুযোগ নাও – আর সেটাকে অপবিত্র
করো। তোমরা একে অন্যের শরীর আর মনের ওপর শুধু নৃশংসতার পর নৃশংসতা করে যাও।
মনে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস, শেষ জীবনে আকাশবাণীর মতো ‘আমাকে ক্ষমা করে দাও প্রভু ’ বললেই,
ঈশ্বর তাঁর রাজধানীতে সাদরে বরণ করে নেবেন... ”
284

“ওনার পাশে একটা বসার জায়গা, আর কিছুই না। যদি মিষ্টি, অনেক মিষ্টি ঈশ্বর তোমাকে
এতোটাই পছন্দ করেন , তবে আমি তোমাকে সেই ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য করে তু লতে
পারি।” বললো কনস্টেনটিন।

মিষ্টি করে হাসলো গ্যাব্রিয়েল , বলে চললো “দ্যাখো, তোমরা ঠিক পশুর মতোই ! আনন্দ আর
পুরষ্কারের কোন দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নেই। কিন্তু ব্যাথা......... তোমরা ভালো বুঝতে পারো একমাত্র
ব্যাথার ভাষা। ব্যাথাই তোমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। আমি তোমাদেরকে অনেক বছর ধরে লক্ষ্য
করে যাচ্ছি। তোমরা কেবল তখনই একজন আরেকজনকে বাঁচাতে ছোটো, যখন কিনা তোমাদের
শহরগুলো পুড়তে থাকে। যখন তোমাদের রাস্তায় রক্তগঙ্গা বয়ে যায়, তোমাদের পরিবারের নিরাপত্তা
হুমকিতে পড়ে – কেবল তখনই তোমরা তোমাদের মুখ ঈশ্বরের দিকে ফেরাও। কেবল প্রচণ্ড
ভয়াবহ সময়েই, তোমাদের মহৎ সত্ত্বা প্রকাশ পায়। তো, আমি তোমাদেরকে ব্যাথা দেবো,
ভয়াবহতা নিয়ে আসবো তোমাদের ওপর। যাতে তোমরা পৃথিবীর এই নরকের রাজত্বে টিকে
থাকবে, তারা ঈশ্বরের ভালোবাসার উপযুক্ত হয়ে উঠবে। ”

“গ্যাব্রিয়েল” কনস্টেনটিন বললো আশ্চর্য হয়ে “তু মি একটা উন্মাদ” সে বললো, প্রভাবিত করার
কোন রকম আশা না রেখেই। কেবল স্তম্ভিত হয়ে গেছে, তাই বলা। একজন অমর সত্ত্বা , কিভাবে
ঈর্ষা আর বিদ্বেষের কারণে পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে যেতে পারে, তাই ভেবে।

আরও একটা আশা নিয়ে এটা বলা, যাতে গ্যাব্রিয়েল একটু অন্য মনস্ক হয়ে পড়ে। আর সেই
সুযোগে সে ওই বল্লমের টু করোটা হাতিয়ে নিতে পারে।

কিন্তু ও কোন সুযোগই পেলো না “পরিত্রাণের পথে যাত্রা” গ্যাব্রিয়েল বলে চললো “শুরু হবে
আজকে রাত থেকে, এখন থেকেই ”

নিজের ডানা দুটো ঝাড়া দিলো সে, আর সেই অতিপ্রাকৃ ত বাতাসের ঝটকা খেয়ে শূন্যে উঠে
গেলো কনস্টেনটিন। পুলের ওপর দিয়ে , ডবল দরজা খুলে, পেছনের হলের ভেতর গিয়ে পড়লো।
যেন একটা হাল্কা কাঁটাগাছের বীজ ভেসে গেলো বাতাসে।
285

বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে , লবির ওয়েটিং রুমে, হাল্কা কাঁটাগাছ না, বেশ ভারী হয়েই পড়লো
কনস্টেনটিন। ওরই মেরে রেখে যাওয়া পিশাচদের নোংরা দেহাবশেষের স্তুপের পাশে।

হাইড্রোথেরাপি রুমে, গ্যাব্রিয়েল এগিয়ে গিয়ে বসলো এঞ্জেলার পাশে, ওকে নিজের কোলে
তু লে নিলো, ঢেকে নিলো পাখনা দিয়ে।

আর ম্যামনের আগমনের রাস্তা তৈরি করতে শুরু করলো।

কনস্টেনটিন পড়ে রয়েছে, শরীর থেকে মনের দিক দিয়ে ভেঙ্গে পড়েছে অনেকটা। আয়নার
ভাঙ্গা টু করো পড়ে আছে পাশে অনেকগুলো। নিজেকে জোর করে হামাগুড়ি দেয়ার মতো
পজিশনে নিয়ে আসলো , নিজের পায়ের ওপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, ভাবছে , কত খারাপভাবে
আহত হয়েছে সে...... মুখে রক্তের স্বাদ পাচ্ছে.........

ওর স্রেফ উঠে দাঁড়াতেই ইচ্ছে করছে না। ক্যান্সার, ক্লান্তি, গ্যাব্রিয়েলের মার, চ্যাজের মৃত্যু, আর
নিজের হতাশা – ওর সমস্ত ইচ্ছাশক্তি কেড়ে নিয়েছে।

এমন একটা কাজ সে করতে যাচ্ছে, যেটা অনেক অনেক দিন ধরে সে করেনি।

সে প্রার্থনা করতে লাগলো।

“আমি জানি আমি তোমার পছন্দের কেউ ছিলাম না কখনও – এমনকি তোমার বাড়িতেও আমি
অবাঞ্ছিত, কিন্তু একটু মনোযোগ তো আমি আশা করতেই পারি.........”

অপেক্ষা করতে লাগলো সে, ভারী শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে, নিজেকেই যেন শুনতে লাগলো।

কিস্যু হলো না। কি আশা করেছিলো সে ? ভারী ড্রাম বেজে উঠবে, পরীরা গেয়ে উঠবে , অনেক
অনেক ওপর থেকে জলদগম্ভীর স্বরে কেউ কথা বলে উঠবে ?
286

নিজেকে মেঝের ওপর পড়ে যেতে দিলো সে, চিবুক লেপটে গেলো টাইলসের ওপর। ঠাণ্ডাটা
উপভোগ করছে। পাশের ভেঙ্গে পড়ে থাকা আয়নার টু করোগুলোর দিকে চোখ গেলো ওর।
নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো সে, তখনই মাথায় এলো আইডিয়াটা .........

হাইড্রোথেরাপি রুমে, গ্যাব্রিয়েলের কোলের ভেতর , এঞ্জেলা নড়াচড়া করা শুরু করলো।
সে বেঁচেই আছে। ডু বে যাওয়ার পর, ও আসলে মারা যায়নি, আর এখন গ্যাব্রিয়েল কেবল কাজ
সারার জন্য ওকে যতটু কু শক্তি দেয়া দরকার, ততটু কু ই দিয়েছেন। ওর পা ঝু লে আছে পানির
ভেতর।

ও চোখ খুললো , কোন কিছু পরিষ্কার দেখতে পেলো না ......

কেবল একটা সুন্দর, সদাশয় চেহারা বাদে, যেটা কিনা ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ও কিভাবে
ওটাকে প্রত্যাখ্যান করবে ? ওটা... স্বর্গীয় একটা চেহারা.........

ও অপেক্ষা করতে লাগলো .........

আর নিজের ভেতর টের পেলো এক অনির্বচনীয় শক্তি প্রবাহ। গ্যাব্রিয়েল ওর চোখের দিকে
তাকালো, দেখতে পেলো, অন্ধকার জমা হচ্ছে সেখানে।

একটা সন্দেহ উঁকি দিয়ে গেলো ওর ভেতরে, যেটার সাথে ও একদমই পরিচিত নয়। অনেকদিন
ধরেই, ঈশ্বরের ‘সরাসরি ইচ্ছা’ থেকে দূরে আছে সে। নিজের অতিপ্রাকৃ ত ক্ষমতা ধরে রেখেছে
ঠিকই, কিন্তু ফেরেশতার আসন দিয়েছে ছেড়ে। নিজের ওপর বিশ্বাস আছে তার, ঈশ্বরের সংসারের
জন্য যা কিছু করছে, সেগুলো তাঁর জন্যই কল্যাণকর। ও ভাবে, মানুষদেরকে ও ঈশ্বরের চাইতেও
ভালো চেনে। ঈশ্বর তাঁর এই সৃষ্টির প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছেন। ওনার দুরত্বে নিমগ্ন হয়ে
পরেছেন তিনি। সে যা করছে, ঈশ্বরও তাই করতে চাইতেন। উনি নিশ্চয়ই দেখবেন, যখন সবকিছু
করা হয়ে যাবে।
287

গ্যাব্রিয়েল আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগলো, এটাই কি ঈশ্বর চাইতেন ? উনি কি চাইতেন যে , গ্যাব্রিয়েল
পৃথিবীর আবেগ, বিরক্তি আর রাগের বশবর্তী হোক ?

অথচ ওর তো এসবের উর্দ্ধে থাকার কথা ছিলো। সে পৃথিবীতে আছে, কত বছর হবে ,
হাজারখানেক বছর ? অনেকগুলি সভ্যতার উত্থান আর পতন দেখেছে। চমৎকৃ ত হয়েছে সোডম,
রোমান সার্কাস , দাস প্রথা দেখে। শিউড়ে উঠেছে ইন্ডিয়া, চায়না আর আমেরিকার গণহত্যা দেখে।
হলোকাস্ট দেখে, এমনকি এই বিংশ শতাব্দীতেও পৃথিবীর কিছু কিছু অংশে এখনও দাস প্রথা
ভিন্নভাবে চালু আছে দেখে। এমন কি একজন ফেরেশতাও নিষ্ঠু র হয়ে উঠতে পারে, মনুষ্যত্বের
নামে অমানুষতা দেখে। তাঁর মতো ফেরেশতাও বিগড়ে যেতে পারে, এই ক্ষণস্থায়ী মানুষ জাতিকে
ঈশ্বর এতোটা গুরুত্ব দিচ্ছেন দেখে......

হুম, সে হয়তো শেষমেশ এই উন্মাদ মানবজাতির সাথে থাকতে থাকতে সংক্রমিত হয়ে পড়েছেন
এদের দ্বারা ! ম্যামনের সাথে চু ক্তি করাই হয়তো ভু ল হয়েছে, সম্ভবত সে ভু ল কাজ করছে ,
সম্ভবত......

কিন্তু এখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। সে ম্যামনের জন্য এই মেয়েটার মধ্যে দিয়ে রাস্তা খুলে দিয়েছেন
– এর মাধ্যমেই ম্যামন পৃথিবীতে পা রাখবে।

অন্ধকার ছেয়ে যাচ্ছে এঞ্জেলার চোখে, এক ক্রিস্টালের গামলা ভর্তি বিশুদ্ধ পানিতে ঢালতে থাকা
কালির মতোই, কালো থেকে আরও কালো হচ্ছে চোখ জোড়া......

করিডোরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে কনস্টেনটিন। একটা খুরের মতো ধারালো
কাঁচের টু করো যোগাড় করেছে সে।

একটা শেষ, তড়িৎ টান দিলো সে হাতের কব্জিতে, ঝর্ণার মতো বেরিয়ে এলো রক্ত, তড়িঘড়ি করে।
যেন ওর কাছ থেকে পালাতে পারলে বাঁচে.........
288

অন্য কব্জিতেও টান দিলো সে । রক্ত বেরিয়ে যেতে লাগলো কু লকু ল করে। কিছুক্ষণের মাঝেই ,
কনস্টেনটিন টের পেলো ওর রক্তচাপ কমে আসছে, পেটের কাছটা খালি খালি লাগতে লাগলো,
বাহু অবশ হয়ে এলো। ঘুম ঘুম ভাব আচ্ছন্ন করে ফেললো ওকে ক্রমশ......

মৃত্যু – এতোটাও খারাপ নয় ! এমন একটা বিস্মরণ , যেটা নিয়ে আপনি আর কারো কাছে
অভিযোগ করতে যাবেন না । এটা এমন একটা জিনিস, আপনি ভু গলেন কিছুটা, তারপর হয়তো
মারা গেলেন। আর আপনি ইহজগতে কি করেছেন, সেটার ওপরেও অনেক কিছুই নির্ভ র করে।
হয়তো, অনেক ভালো মদের ভেতর, আপনি খারাপটাই বেছে নিলেন......

যেমন এই আত্মহত্যা। আর , সে আবারও ওর কব্জি কেটে নিয়েছে......

পেছনের দেয়ালে হেলান দিলো কনস্টেনটিন। অবধারিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে, আশা করছে
ওটা তাড়াতাড়িই আসবে......

“তাড়াতাড়ি !” সে বিড়বিড় করে বলে উঠলো।

গ্যাব্রিয়েল বল্লমের টু করোটা এঞ্জেলার বুকের ওপর ধরলো।

ম্যামন প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে এঞ্জেলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। ওর চামড়ার ওপর
ভেসে উঠছে ম্যামনের ক্ষু ধার্ত , বিকৃ ত বাচ্চার মতো, অমানুষিক চেহারা। রাবারের একটা সিটের
ভেতর থেকে যেন ভেসে উঠছে সেটা – ভেঙ্গে, ছিঁ ড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে মানুষের পৃথিবীতে।
ও নরক থেকে মানুষের ভেতরে প্রবেশ করেছে, এবার সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে মানুষের
পৃথিবীতে। পিশাচেরা তাই করে থাকে সব সময় – কিন্তু আজকের মতো এতো পরিপূর্ণ, এতো
বিশাল পরিসরে এটা আগে কখনও হয় নি।

বল্লমের গায়ে লেগে থাকা রক্ত – যীশুর রক্ত – ছিলো সেই অসম্পূর্ণ দ্রব্য। এটাই শেষ সংযোগটা
পাকাপোক্ত করে দেবে। গ্যাব্রিয়েল বল্লমটা গেঁথে দেবে এঞ্জেলার শরীরে, কেটে দেবে সিজার
289

অপেরেশনের মতো করে। আর সেখান থেকেই উত্থান ঘটবে ম্যামনের , পুরোপুরিভাবে আত্মপ্রকাশ
করবে সে মানুষের পৃথিবীতে।

বল্লমের মাথাটা ধরে অপেক্ষা করতে লাগলো গ্যাব্রিয়েল, ম্যামনের আত্মিক শক্তি এই বিশাল
স্থানান্তরের জন্য যাতে তৈরি হতে পারে।

আশেপাশে থাকা লাইট বাল্বগুলো দপদপ করে উঠলো, সময় এসে গেলো ঠিক যেভাবে টার্গেটে
বিঁধে যায় অব্যর্থ তীর।

কনস্টেনটিন অনেক দূর থেকে ভেসে আসা একটা ধাতব গুন গুন ধ্বনি শুনতে পেলো।
যেন হাজার বছর আগেকার কোন ঘণ্টাধ্বনির প্রতিদ্ধনি সে শুনতে পেলো এই মাত্র ।

সে দেখতে পেলো, দুটো পা এগিয়ে আসছে ওর দিকে। ঠিক যেন ক্রু শে বিদ্ধ যীশুর পায়ের মতো।
“এতো দেরী হলো কেন ?” কনস্টেনটিন জিজ্ঞেস করলো।

“হ্যালো, জন” একটা পরিচিত কণ্ঠ ভেসে এলো।

ওটা ছিলো লুসিফারের গলা, দ্যা লাইট। একইসাথে অনেক নাম তাঁর , ইবলিশ, পুরানো আঁচর,
শয়তান, শায়তান, স্যাটান।

“তোমার মৃত্যু ” স্যাটান বলে চললো , ওর গলা গভীর আর প্রতিদ্ধনিপূর্ণ “এই একটা শো আমি
মিস করতে চাই না ।”

“সেরকমই শুনেছি...... অসুবিধা নেই তো ?” জিজ্ঞেস করলো কনস্টেনটিন। শেষবারের মতো


একটা ধূমপান ? কেন নয় ?

“বি মাই গেস্ট !”


290

স্যাটান এমন কি একটু হাসলো ! সে তার চামড়ার পাখাগুলো একটু ঝাড়া দিলো। একটা সুন্দর
পোজ নিলো। দ্যা ক্লাসিক স্যাটান। সে, আসলে, এখানে আসতেই পারে। ওর ছেলে পারে না।
পিশাচেরা পারে না, দোআঁশলা না হলে। কিন্তু মানুষের পৃথিবী যেহেতু শয়তানের মালিকানাভু ক্ত
নয়, এটাকে সে ঘোড়দৌড়ের মাঠ হিসাবেই ধরে নেয় !

কনস্টেনটিন ওর জ্যাকেট থেকে বের করে , একটা সিগারেট ধরালো। সে জানতো , সময় খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। সাথে এটাও জানতো , সময় লুসিফারের জন্য অনেকটাই নমনীয়। ওরা দুজনেই জানে,
কনস্টেনটিন স্রেফ একটা সিগারেট খাবার সময় চেয়েছে। তাই লুসিফার কনস্টেনটিনের মৃত্যুর
সময়টাকে থামিয়ে দিয়েছে , যাতে সে একটা শেষ সিগারেট খেতে পারে। যাতে, এই সময়টার স্বাদ
লুসিফার নিজেও নিতে পারে তাড়িয়ে তাড়িয়ে। এমন একজনের মৃত্যু দৃশ্য , যে কিনা একটা
প্রজন্ম ধরে ওর পথের কাঁটা হয়ে ছিলো ! হসপিটালের বাকি অংশের জন্যও সময় থেমে গেছে –
যেটা কনস্টেনটিন আগেই চিন্তা করে রেখেছে।

“কফিনের পেরেক” কনস্টেনটিন বললো , ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট ধরে রেখে। ওগুলো এতো অবশ
হয়ে আছে যে, জোর করে চেপে না ধরলে অস্তিত্বই বোঝা যাচ্ছে না।

“জায়গামত আছে” বললো স্যাটান, ওর হাসি পুরো রুমে গ্লেসিয়ারের ঠাণ্ডা বাতাস বইয়ে দিলো
যেন। “তোমার জন্য লাল গালিচা সংবর্ধনার ব্যবস্থা করা হয়েছে, বাছা ”

কনস্টেনটিন ধোঁয়া ছাড়লো স্যাটানের দিকে “ওহ, তু মি খুব মিষ্টি !”

স্যাটান কনস্টেনটিনের কাটা কব্জি দুটোর দিকে তাকালো । আত্মহত্যার চেষ্টা দেখে, বেশ অবাকই
হলো। “আমি ভাবিনি তু মি একই ভু ল দুইবার করবে ”

কনস্টেনটিন হাসলো ওর দিকে চেয়ে। একটা টান দিলো সিগারেটে । একটা উপোষী মুরগী ছানার
মতোই দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। সোজা ভাবে সিগারেট ধরে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে ওর জন্য।
291

“তু মি করোনি এটা, তাই না ? ” স্যাটান বললো। একই ভু ল দুইবার করা, সে বলতে চাইলো।
বুঝতে পেরেছে, কনস্টেনটিনের কিছু একটা উদ্দেশ্য আছে............

“তো ” কনস্টেনটিন জিজ্ঞেস করলো “পরিবারের সবাই কেমন আছে ?”

“তা দিয়ে তোমার কি দরকার ?” সন্দিহান সুরে প্রশ্ন করলো স্যাটান।

“শোনা যাচ্ছে তোমার ছেলে পুরানো পথ ধরেই চলতে চাইছে ”

“কেউ যা পারে, তাই তো করবে ”

“...... ও অন্য একটা রুমে আছে ” বললো কনস্টেনটিন।

“হুম, ছেলেরা তো ছেলেদের মতোই থাকবে” গরগর করে বললো স্যাটান।

“গ্যাব্রিয়েলের সাথে ” বললো কনস্টেনটিন।

“স্বাদের কোন ব্যাপার নয় , আসলেই” স্যাটান অধৈর্য হয়ে উঠেছে। ওর চোখগুলো লাল আর
সবুজের মাঝামাঝি রঙে জ্বলে উঠলো “তোমার পয়েন্টটা কি ?”

“ওর কাছে ‘নিয়তির বল্লম’ টা আছে ” বলার সময় মনে মনে প্রার্থনা করলো কনস্টেনটিন যে ,
স্যাটান যেন এটা না জানে। ম্যামনের আসল প্ল্যানটা কি, সেটা স্যাটান জানে না, এই ধারণার ওপর
ভিত্তি করেই জুয়াটা খেলছে সে।

স্যাটান ত্রিকালজ্ঞ নয়। যদি স্যাটান জানে , যে বিদ্রোহী ফেরেশতা আর ম্যামনের কাছে বল্লমের
টু করোটা আছে, তবে কনস্টেনটিনের এই শেষ চেষ্টা পুরোপুরি বিফলে যাবে। কারণ ও যদি আগে
থেকেই জেনে থাকে – সেটার অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে সে এর মধ্যেই। নরকে কোন কিছুই
স্যাটানের অনুমতি ছাড়া হয় না, যদি না কেউ ওকে না জানিয়ে কাজটা করে।

“পুরানো দিনগুলির মতো , জন ?” গর্জ ন করে উঠলো স্যাটান “তোমার আরেকটা ধোঁকাবাজি ?”
292

ইউরেকা ! বুড়ো খোকা এই ব্যাপারটা জানে না !

“নিজেই দেখে নাও গে ” কনস্টেনটিন বললো।

স্যাটান সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন হাজারটা বাল্বের তাপ নিয়ে এসে
পড়লো কনস্টেনটিনের মুখের ওপর।

“তু মি আমার জন্য বিশ বছর অপেক্ষা করেছ ” কনস্টেনটিন দেখিয়ে দিলো “আর বিশ সেকেন্ডে
কি আসবে যাবে ?”

স্যাটান ভাবছে বিষয়টা নিয়ে .........

বিশ

ডিটেকটিভ জেভিয়ার ওর চোখ বন্ধ করে, নিজের নাকের ব্রিজে টোকা দিলো একটা। তারপর
হসপিটালের পেছনের দরজার দিকে তাকালো । কন্ট্রোল কারগুলোর ফ্ল্যাশিং লাইটের ওপর দিয়ে
দেখা যাচ্ছে সেটা।

অবস্থাটা আগের মতোই আছে। ও কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। দুইজন পেট্রোলম্যান, আধভাঙ্গা
দরজা দিয়ে ঢু কে, স্রেফ ফ্রিজ হয়ে গেছে ! অস্পষ্ট বাতাসে কিছু ঠাহর করা যাচ্ছে না , কিন্তু ওই
দুজনকে মনে হচ্ছে কোন কার্টু ন ছবিতে অভিনয় করছে । ওদের হাতগুলো অসম্ভব ভঙ্গিতে
ওঠানামা করছে, কিন্তু কোন নির্দি ষ্ট দিকে তাক হচ্ছে না। অর্থহীন, কিন্তু ওটাই করে যাচ্ছে ওরা
ক্রমাগত !

রাতের আকাশের দিকে তাকালো জেভিয়ার, মেঘে ছেয়ে আছে পুরো আকাশ।
293

এটার সাথে ওই কনস্টেনটিন লোকটার সম্পর্ক না থেকেই যায় না। বিশেষ করে যখন থেকে
লোকটা ডিটেকটিভ ডডসনের আশেপাশে ঘুরঘুর করা শুরু করেছে। একটা অনুমান – কিন্তু সে
কনস্টেনটিনের ব্যাপারে কিছু খোঁজখবর নিয়েছে সম্প্রতি......

একজন তরুণ , এশিয়ান-আমেরিকান পেট্রোলম্যান ইই , হাতে একটা ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে এগিয়ে


এলো জেভিয়ারের দিকে। বললো “আমি একজন নার্সকে খুঁজে পেয়েছি, একজন ফিলিপিনো
মহিলা , উনি ......” ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো সে, বুঝতে পারছে না পরের কথাগুলো কিভাবে বলবে
“উনি বলেছেন যে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেয়েছেন, কিন্তু ওই অংশটা সংস্কারের জন্য বন্ধ করে
রাখা আছে বেশ কিছুদিন। ওখানে কারো থাকার কথা নয়। তো উনি ভাবলেন , কোন পাগল
পেশেন্ট হয়তো ওখানে গিয়ে গোলমাল করছে । উনি গেলেন আসলে কি ঘটছে সেটা দেখার
জন্য”

“সাহস আছে মহিলার” জেভিয়ার মন্তব্য করলো।

“হ্যাঁ। আর সেখানে গিয়ে উনি একটা অদ্ভু ত জিনিস দেখতে পেয়েছেন বলে রিপোর্ট করেছেন।
ওখানে ... ওখানে বেশ কিছু লোকজন, ঠিক যেন একটা টাইম লুপে বাঁ ওই ধরণের কিছু একটাতে
আটকা পড়েছে বলে মনে হয়েছে উনার ! ”

বছরখানেক আগে হলেও, জেভিয়ার বলে দিতো যে মহিলা হয়তো ওনার ব্রেকের সময় গাঁজা
টানতে টানতে স্টার ট্র্যাক ধরণের কোন মুভি দেখে থাকবে। কিন্তু শহরে সাপ্প্রতিক কালে যেসব
ঘটনা ঘটে চলেছে – উপরন্তু ওই দুজন জমে যাওয়া পুলিশ অফিসার , সে ব্যাপারটা আমলে না
নিয়ে পারলো না।

“তো – টাইম লুপ । হুম , আর কিছু ?”


294

“আর...... উনি কিছু ...... মৃত জীব-জন্তু’র দেহাবশেষ দেখতে পেয়েছেন—অর্ধ গলিত, পোড়া ।
‘শয়তানের মতো’ দেখতে । আর সেখানেই , মহিলার সাহস শেষ হয়ে গেছিলো, উনি দৌড়ে
পালিয়ে এসেছেন। ”

“আর দরজার কাছের ওই পুলিশ দুজন ?”

“হ্যাঁ, ওনারা হলেন অফিসার মরিসি আর গারসিয়া , ওনারা সেই মহিলার কল রিসিভ
করেছিলেন। আমি কাছে গিয়ে চিৎকার করেছি, কিন্তু ওনারা কোন সাড়া দেন নি। আমি কাছে
যেতে নিলে, আমার একটা অদ্ভু ত অনুভু তি হয় । যেন...... সবকিছু কেমন ধীর হয়ে যাচ্ছে। আমি
পেছনে এক পা সরে আসার পর অনুভূ তিটা মিলিয়ে যায়। তাই। উম্মম...... ”

“তাই তু মি আর সামনে না এগোনোর সিদ্ধান্ত নাও। খুব ভালো। অফিসার ইই, তু মি সার্জে ন্ট পর্যন্ত
যেতে পারবে ” জেভিয়ার জানতো না এখন সে কি করবে। তবে , আসলে এখানে কি চলছে না
জেনে , আর কোন পদক্ষেপ নেয়া ঠিক হবে না বলেই মনে হলো ওর কাছে।

“ডিটেকটিভ ” ইই পেছনে জমে যাওয়া দুই অফিসারের দিকে তাকালো নার্ভাসভাবে। “মনে হচ্ছে
‘কিছু একটা’ ওখানে একটা দেয়াল তৈরি করে দিয়েছে, সময়কে থামিয়ে দিয়ে কোন এক ধরণের
‘সতর্ক বার্তা’ দিতে চাচ্ছে আমাদেরকে। আমরা যেমন ক্রাইম সিনে হলুদ টেপ ব্যবহার করি,
অনেকটা সেরকম আর কি ...... ওটা ......”

“ওটা আমাদেরকে বলছে ‘এখানে এসো না ’ , তাই তো ?” জেভিয়ার সম্পূর্ণ করে দিলো বাক্যটা।

“হ্যাঁ, কিন্তু ওখানে কেউ একজন তো অবশ্যই আছে। আমি ...... শব্দ শুনেছি। আমি জানি না
ওটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবো। কিন্তু ...উম্মম...... আরেকদিন ওই যে ছোট্ট মেয়েটা ......”

“আমার মনে হয় আমি বুঝতে পেরেছি। এই সব কিছুর পেছনে কনস্টেনটিনের হাত আছে ”

ব্যাপারটা হলো, এই কনস্টেনটিন লোকটা এলএপিডি’র চাইতে এসব ব্যাপার সামলানোর ব্যাপারে
অনেক বেশী দক্ষ। কিন্তু এটা, সকল ব্যাতিক্রমের মধ্যেও , অনেক ব্যাতিক্রম। “ইই – আমি সিদ্ধান্ত
295

নিয়েছি, এখানে চু পচাপ খানিক অপেক্ষা করবো। এখনই এ ব্যাপারে কোথাও রিপোর্ট করার
দরকার নেই, ঠিক আছে ? একটু অপেক্ষা করা যাক ”

কিন্তু নিজের ভেতরে, সে ভাবছে অন্য কিছু । কোন একদিন, ঈশ্বরের দোহাই, আমি ওই
কনস্টেনটিন লোকটাকে একা পাবো কোথাও না কোথাও। কোন বারে বা কোন পেছনের গলিতে।
তখন আমি ওকে চেপে ধরে সত্যিটা আদায় করে ছাড়বো। জিম বিমের কোন বোতল বা নাইটস্তিক
টাইপের কিছু দিয়ে, আমি ব্যাটাকে গান গাওয়াবোই !

গ্যাব্রিয়েল আর এঞ্জেলার জন্য , সময় থেমে গেছে ! স্যাটান থামিয়ে দিয়েছে সেটা।
‘নিয়তির বল্লম’ এঞ্জেলার বুকের দিকে তাক করা – ওকে ফেড়ে ফেলার ঠিক আগের মুহূর্ত ।
একটা জমে যাওয়া স্থির চিত্র যেন।

রুমের একপাশের কাঁচের ডবল ডোর বিস্ফারিত হলো, কাঁচের টু করোগুলো বাতাসেই ভেসে
থাকলো স্থির হয়ে।

স্যাটান ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো রুমে। কাঁচের টু করোগুলো সরে সরে যাচ্ছে ওর গায়ে ধাক্কা
লেগে।

সে হেঁটে হেঁটে স্থির হয়ে থাকা গ্যাব্রিয়েলের দিকে এগোল, এঞ্জেলার মাথার নিচে ওর কাঁটাঅলা
হাতটা নিলো। আরেক হাতের আঙ্গুল আলতো করে বোলাল ওর মুখের ওপর.........

সুন্দর ......

তারপর , ওকে টেনে নিয়ে এলো নিজের বাহুডোরে, গ্যাব্রিয়েলের কাছ থেকে দূরে। নড করলো
সময়ের উদ্দেশ্যে .........

...... যে এখন আবার শুরু হবার সময় এসেছে।


296

শব্দ আর গতি ফিরে এলো রুমটাতে, যেহেতু আবার সময় প্রবাহিত হতে শুরু করেছে ।
গ্যাব্রিয়েলের বল্লম নিচের টাইলসে আঘাত করলো, যেখানে একটু আগেও এঞ্জেলা ছিলো। ঝনঝন
করে ভাসতে থাকা কাঁচের টু করোগুলো পড়লো মেঝেতে।

গ্যাব্রিয়েল স্যাটানের দিকে তাকালো অবাক হয়ে, স্তম্ভিত হয়ে গেছে।

“লুসিফার !”

স্যাটান কঠোর ভঙ্গিতে হাসলো। এঞ্জেলাকে ধরে রেখেছে শক্ত হাতে।

গ্যাব্রিয়েল এঞ্জেলার নিচের পানির দিকে তাকালো। সেখানে এঞ্জেলার বদলে, ম্যামনের ছবি দেখা
যাচ্ছে।

“এই বিশ্ব” স্যাটান বললো “আমার। সময় হলেই । অন্য কারো চাইতে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্মন্ধে
তোমার তো ভালো জানার কথা.........”

“ সর্বনাশের বর পুত্র ” গ্যাব্রিয়েল বলে উঠলো “ছোট শিং...... খুবই অপরিষ্কার ”

স্যাটান খলখল করে হেসে উঠলো “পুরানো নামগুলি ভালোই মিস করি আমি ”

গ্যাব্রিয়েল এক পা এগোল স্যাটানের দিকে “আমি তোমাকে আঘাত করতে যাচ্ছি তাঁর নামে !”

বলেই একটা ঘুষি হাকালো , আর স্যাটান খুব স্বাভাবিকভাবে হাতটা ধরে ফেললো। ঠিক যেভাবে
জিম টিচার কোন পাঁচ বছরের বাচ্চার হাত ধরে ফেলে।

গ্যাব্রিয়েল বিভ্রান্ত হয়ে গেলো , ওপরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো “.........পিতা ?”

নেকড়ের মতো হাসলো স্যাটান “মনে হচ্ছে, কেউ একজন আর তোমার পেছনে নেই !”

ফেরেশতাটির চেহারায় এক নতু ন ভাব খেলা করে গেলো । ওর জন্য একদম নতু ন সেটাঃ ভয় ।

পুলের পানিগুলি লাফিয়ে উঠে এলো ওপরে। ওদেরকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিলো। গ্যাব্রিয়েলের
ডানা দুটো পুড়ে ছাই হয়ে গেলো সেই সংস্পর্শে । ম্যামন চিৎকার করে উঠলো এঞ্জেলার ভেতর
থেকে।
297

“নাআআআ !” গ্যাব্রিয়েল চিৎকার করে উঠলো।

স্যাটান অদৃশ্য হয়ে গেলো। সাথে করে নিয়ে গেলো একটা অন্ধকার আর মোচড়াতে থাকা
সত্ত্বাকে। ম্যামনকে সাথে করে নিয়ে গেলো সে। যেখানে স্যাটান দাড়িয়ে ছিলো , সেখানে এঞ্জেলা
পড়ে থেকে গোঙাতে লাগলো।

স্যাটান নরকে ফেরত গেছে। অত্যন্ত ছোট্ট একটা ভ্রমণ। স্রেফ একটা জিনিস রেখে আসার জন্য।
পুরো বিল্ডিং কেঁ পে উঠলো ওর প্রস্থান আর আগমনে।

কনস্টেনটিন টের পেলো, বিল্ডিঙটা , ভিত্তিমূল থেকে কেঁ পে উঠলো। আর যেহেতু


সময় আবার বইতে শুরু করেছে, ওর কব্জি থেকে রক্ত গড়ানোও শুরু হয়ে গেছে। সে হাসলো
একটু । এই ঝাকু নির মানে হলো, স্যাটান কিছু শক্ত পাছায় লাথি ঝেড়েছে ঠিকঠাক !

ও মুখ তু লে দেখতে পেলো, স্যাটান ফিরে এসেছে আবার। একটা অধীর আশার ছায়া দেখতে
পেলো সে প্রথম পতিত এঞ্জেলের চোখে।

কনস্টেনটিন ওর দিকে নীরবে তাকালো, চোখের ভাষায় লেখাঃ তু মি আমার কাছে ঋণী ।

স্যাটান জানতো এটা সত্যি। সে এক ধরণের আধিভৌতিক অসুবিধায় পড়ে যাবে, যদি সে
কনস্টেনটিনকে ওর হয়ে, ওর নিজেরই রাজ্যের স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনতে দেয়। সেই ঋণ শোধ
করে, ওকে চালকের আসনে বসতেই হবে। আধ্যাত্মিক জগতের এটাও একটা পদার্থবিজ্ঞানের
নিয়ম !

“তো...... তু মি কি চাও ?” স্যাটান বলে উঠলো , ওর কণ্ঠস্বর টান টান হয়ে আছে উত্তেজনায়
“আরও কিছুদিন সময় ?”

রক্ত হারিয়ে ফেলায়, নিজের মুখটাকে সীসার তৈরি বলে মনে হচ্ছে। সেই অবস্থায় অনেক কষ্ট করে
বলতে পারলো “ইসাবেল......”

এমনকি নরকেও, সবকিছুই প্রাসঙ্গিক। স্যাটান জানতো কনস্টেনটিন কার কথা বলছে।

“ওর ব্যাপারে কি ?”
298

“ওকে...... বাড়ি যেতে দাও ......”

স্যাটান এতো সহজে অবাক হয় না । কিন্তু এখন কনস্টেনটিন ওকে আসলেই অবাক করে দিলো
“তু মি তোমার জীবন ত্যাগ করছো , যাতে মেয়েটা স্বর্গে যেতে পারে ?”

কনস্টেনটিন অনেক কষ্টে নড করলো।

আর স্যাটান বেশ খুশিই হলো। কনস্টেনটিন ওর নিজের জীবন চাইছে না। এর মানে হলো স্যাটান
ওকে নিয়ে খেলার সুযোগ পেয়ে যাবে, আর সেটা এখনই। সে তু ষ্টিকে দেরী করাতে চায় না। আর
কনস্টেনটিনকে নির্যাতন করে অনেক বেশী মানসিক শান্তি পাবে সে, ইসাবেলের বদলে। ইসাবেলকে
সে থোড়াই চেনে।

“ঠিক আছে ” স্যাটান বলে উঠলো।

একটু বিরতি নেয়া হলো । আর সেই বিরতির মাঝখানে , অনেকগুলি কাজ হয়ে গেলো।

হাইড্রোথেরাপি রুমে, এঞ্জেলা জেগে উঠেছে, মেঝেতে শুয়ে আছে সে। দুর্বল, কিন্তু শ্বাস
নিচ্ছে। একইসাথে সে অনেকখানি স্বপ্নালু অবস্থাওতেও আছে। এ ধরণের অবস্থাতে, সে বেশ কিছু
দৃশ্যকল্প দেখতে পেলো। সত্যিকারের দৃশ্যকল্প।

তো, সেখানে সে নিজেকে ওর বোনের সাথে আবিষ্কার করলো নিজেকে আবার। সেই সি – স
খেলনার সামনে ওরা, ছোট বেলাকার সেই পার্কে । খিলখিল করে হাসছে, দৌড়াদৌরি করছে, ধুলায়
গড়াগড়ি খাচ্ছে।

এখন ! সি-স মেশিনটা থেকে ভেসে শূন্যে উঠে গেলো দুই বোন। হাত ধরাধরি করে রেখেছে
এখনও।

এঞ্জেলা নেমে আসছে মাটিতে, কিন্তু ইসাবেল ওপরের দিকে চলে যাচ্ছে। উড়ে উড়ে , হিলিয়াম
বেলুনের মতো আকাশের দিকে চলে যাচ্ছে ! শেষবারের মতো আঁকড়ে ধরেছে এঞ্জেলার হাত,
তাকিয়ে আছে ওর দিকে.........
299

আর তখন এঞ্জেলা যেতে দিলো ওকে – বুঝতে পেরেছে , বোনকে ছেড়ে দেয়ার সময় এসেছে।
আর ইসাবেল উঠে গেলো আস্তে আস্তে ঘুরতে ঘুরতে , একটা অসম্ভব রকমের সুন্দর, অনবদ্য নীল
আকাশে......

এই সমস্ত কাজগুলো হলো, স্যাটান ‘ঠিক আছে’ বলার পরপরই।

নরক থেকে একটা আত্মাকে ছেড়ে দেয়া হলো, সে নিজেকে আবিষ্কার করলো স্বর্গে। ওখানে, ওর
আগমণ উপলক্ষে ছোটখাটো উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। আর অনেক কিছু ধীরে ধীরে ওর
কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে......

“স্বাগতম, ইসাবেল” বললো ওর দিদিমা “স্বাগতম, আমার সোনা। আমার কিছু বন্ধু র সাথে পরিচয়
করিয়ে দেই তোমায়। তোমার দাদুর সাথে তো তোমার আগে দেখা হয়নি , তাই না ? ওহ – আর
এখানে একজন বন্ধু র বন্ধু আছে – ওর নাম হলো চ্যাজ......”

“...... কাজ শেষ। ” স্যাটান বললো । কনস্টেনটিনের দিকে তাকালো সে – সেই


দৃষ্টিতে অনন্ত যন্ত্রণা মিশে আছে যেন “যাবার সময় হয়েছে ”

কনস্টেনটিন নড করলো, অনেক কষ্টে একটা হাত তু ললো। জানাতে চাইলো, সে তৈরি।

স্যাটান নিচু হয়ে , কনস্টেনটিনের হাত ধরলো। ওকে নিজের দিকে টানলো , তারপর রওয়ানা হলো
দরজার দিকে। সেই দরজা, যেটা এখন আর হসপিটালের দরজা নেই, পরিণত হয়েছে হেইডেস ,
মানে পরজগতের, মৃতদের জগতের দরজায়।

স্যাটান কনস্টেনটিনকে ওর পেছন পেছন টেনে নিয়ে যাচ্ছে......

......... কিন্তু করিডোরটা মনে হচ্ছে অনন্ত যোজন দূরে। ওরা যতই এগোচ্ছে, সেটা ততই লম্বা হচ্ছে
! ওরা এগোচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দরজাটা সেই একই দূরত্বেই রয়ে যাচ্ছে...... ওরা আসলে কোথাও
যাচ্ছে না।
300

কনস্টেনটিনের আরেকটা হাত শূন্যে উঠে গেলো এরপর, কিছু একটা ওকে অন্যদিকে টানছে।
নরকের উল্টোদিকে । সেই হাতটা , অন্য কেউ ধরে রেখেছে।

সেই হাত ধরে আছেন স্বয়ং ঈশ্বর !

স্যাটান কনস্টেনটিনের হাত ফেলে দিলো। এক অবর্ণনীয়, অনন্তব্যাপী, অসহ্য রাগে থরথর করে
কাঁপছে সে।

“দ্যা সেক্রিফাইস – আত্মত্যাগ ” স্যাটান গর্জ ন করে উঠলো। বুঝতে পেরেছে, কনস্টেনটিনের
ইসাবেলের জন্য আত্মত্যাগ , ঈশ্বরের নজর কেড়েছে। সেটাই ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কনস্টেনটিন
মারা যাচ্ছিলো, মরেই গেছে বলতে গেলে – কিন্তু সে কখনোই নরকে যাচ্ছিলো না ! সে যাচ্ছিলো
স্বর্গে। স্যাটানকে রাম ঠকান ঠকানো হয়েছে !

স্যাটান ওপরের ঐশ্বরিক আলোর দিকে মুঠি পাকিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠলো “নাআআ !
এটা আমার জিনিস ! কেবল আমার ! ”

কনস্টেনটিনের হাত , যেটা স্বর্গের দিকে বাড়ানো ছিল, সেটা খানিক নেমে এলো। সেটার ঠিক
মাঝখানের আঙ্গুলটা উঁচিয়ে আছে – যেটার মানে এমনকি স্যাটান’ও জানে।

কিন্তু এটা কনস্টেনটিন নয় – ঈশরই স্যাটান’কে আঙ্গুল দেখাচ্ছেন !

স্যাটান রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো। ওর শরীর আক্ষরিক অর্থেই আগুনে পরিণত হলো। আগুনে
আঙ্গুল তু লে কনস্টেনটিনের দিকে তাক করে বললো “তু মি বাঁচবে, জন কনস্টেনটিন ! তু মি বাঁচবে
এটা প্রমাণ করার জন্য যে, তোমার আত্মা আসলে নরকে যাবারই উপযুক্ত ! ড্যাম ইউ – তু মি
বাঁচবে !”

স্যাটান ওর আগুনে দুটো হাত কনস্টেনটিনের শরীরে ঢু কিয়ে দিলো , ওর বুকের গভীরে চলে গেলো
সেগুলো। ওকে মেঝে থেকে ওপরে তু লে ফেললো সেগুলো।

কনস্টেনটিন যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলো যখন স্যাটান ওর ফু সফু স থেকে ক্যান্সার খুঁড়ে বের করে
আনলো। একদলা রোগাক্রান্ত টিস্যু , সাথে কালো কালো আরও কিছু পোড়া অংশ এক হ্যাঁচকা
301

টানে বের করে আনলো। চেষ্টা করলো যত বেশী সম্ভব ব্যাথা দেয়া যায়। এরপর ছেড়ে ছিল
কনস্টেনটিনকে............

......... আর কনস্টেনটিন মেঝের ওপর পড়লো নিতম্ব দিয়ে।

ওর হাত আর পায়ে, সারা শরীরে , বল ফিরে আসছে টের পেলো সে। একটা গভীর শ্বাস নিলো
সে, অনেকদিন পর সুস্থ ফু সফু সে বাতাস ঢু কছে টের পেলো সে – অনেক বছর পর আসলে।

নিজের কব্জির দিকে তাকালো সে। ওগুলি ভালো হয়ে গেছে – ও একদম আপাদমস্তক সুস্থ হয়ে
গেছে ! স্যাটান ওকে সম্পূর্ণ নতু ন একটা জীবন দিয়েছে । সে এটা করেছে কারণ , পরে যে
কোনদিন যাতে ওকে উৎখাত করতে পারে এই পৃথিবী থেকে ।

কনস্টেনটিন ওর মনের ভেতর স্যাটানের কণ্ঠ শুনতে পেলো। সেই অন্ধকারের রাজা দরজা দিয়ে
বেরোচ্ছে নরকে ফিরে যাবে বলে, আর নিজের ছেলেকে শাস্তি দেবে বলে। বেরোতে বেরোতে সে
বলছে –

একদিন না একদিন আমি তোমাকে ঠিকই নাগাল পেয়ে যাবো, কনস্টেনটিন। আর কিছু বেশী বছর
আমার কাছে এমন কি ? তু মি একটা নষ্ট মানুষ, আর তু মি আমারই হবে একদিন !

আর , স্যাটান চলে গেলো – ঠিক যেভাবে এসেছিলো।

কনস্টেনটিন আশেপাশে তাকালো। কোন স্বর্গীয় আভা-টাভা দেখতে পেলো না। সেই ঐশ্বরিক
হাতের কোন স্পর্শও পেলো না, একটু আগেও যেটা খুবই তীব্র ছিলো। ঈশ্বরও চলে গেছেন।

আর, সে নিজে কিন্তু কোথাও যায়নি !

কনস্টেনটিন হাঁটতে হাঁটতে হাইড্রোথেরাপি রুমে ঢু কলো, এঞ্জেলাকে খুঁজছে। ওই


যে, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে সে, হাঁটু জড়িয়ে আছে, হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। জীবিত
আছে মেয়েটা ।

কনস্টেনটিন হাঁটু গেড়ে বসলো ওর পাশে। ওর পাশে রাখা আছে সেই বল্লমের টু করো। ‘নিয়তির
বল্লম’ ।
302

“ধন্যবাদ” এঞ্জেলা বলে উঠলো।

“কোন সমস্যা নেই” কনস্টেনটিন বললো , যত স্বাভাবিকভাবে বলা যায়।

না হেসে পারলো না এঞ্জেলা। কনস্টেনটিনও হাসি ফিরিয়ে না দিয়ে পারলো না।

একটা গোঙানি শুনলো সে, মুখ ফিরিয়ে দেখলো , অন্য দেয়ালের পাশে বসে আছে গ্যাব্রিয়েল।
কাঁপছে সে । পিঠের ওপর উঁচিয়ে আছে দুটো পোড়া তরুণাস্থি। ওর ডানার ধ্বংসাবশেষ ওগুলো।

সেই তরুণাস্থি থেকে, মানুষের মতোই রক্ত গড়াচ্ছে। কনস্টেনটিন আত্মতু ষ্টির সাথে হাসল , মেঝে
থেকে তু লে নিলো নিজের হোলি শটগান।

“মানুষ ...... ! ” কনস্টেনটিন হাসলো ।

গ্যাব্রিয়েল বাঁকা ভাবে হাসলো এই রায় শুনে। কিন্তু অস্বীকার করলো না। ওকে মরণশীল করার
মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়েছে। ঈশ্বরের রক্ষাকবচ ছাড়া, ম্যামনের সাথে চু ক্তি করার জন্য – স্যাটানের
ভয়ংকর জাদুর শিকার হয়েছে সে। ওকে স্যাটান এমন একজনে পরিণত করেছে, যাদেরকে সে
ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখত । একজন মানুষ ।

“তু মি মানুষ হওয়ার যোগ্য নও ” কনস্টেনটিন বললো, হাতের শটগানটা চিন্তিতভাবে তু লে নিয়ে
প্রাক্তন ফেরেশতার দিকে এগোতে এগোতে।

গ্যাব্রিয়েল গলা পরিষ্কার করলো “তাহলে......এখনই বিচার করো আমার”

কনস্টেনটিন শটগানের মাজল গ্যাব্রিয়েলের কপালে ঠেকাল, ও এটা উপভোগই করবে।

“করো এটা” গ্যাব্রিয়েল বলে উঠলো “প্রতিশোধ নাও , শেষ করে দাও আমাকে !”

ট্রিগারে চেপে বসছে কনস্টেনটিনের আঙ্গুল। আরেকটু দাবাতে হবে কেবল, আরেকটু ............

“টেনে দাও ট্রিগার” গ্যাব্রিয়েল ভিক্ষা চাইলো “ঈশ্বরের হাতে পরিণত হও !”

কনস্টেনটিনের আঙ্গুল স্বাভাবিক হয়ে এলো । ও যদি ট্রিগার চাপে, তাহলে ও আবার অভিশপ্ত
হয়ে পড়বে। বুঝতে পারলো, এটা ই ওকে দিয়ে করাতে চাইছে গ্যাব্রিয়েল।
303

কিন্তু তবুও, ট্রিগারটা টেনে দেয়ার এক অদম্য ইচ্ছা পাকিয়ে উঠলো ওর ভেতর। এটা ও সেভাবেই
চায়, যেভাবে চায় ও নতু নভাবে বাঁচতে.........

কিন্তু বন্দুক নামিয়ে নিলো সে। জানে, স্যাটান আছে এটার পেছনেও – গ্যাব্রিয়েলের কানে কানে
ওই বলে দিচ্ছে সব ! স্যাটান এর মধ্যেই ওকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করা শুরু করে দিয়েছে। ওকে
আবার অভিশপ্ত বানিয়ে, আবারও নরকে নেয়ার ইচ্ছা।

কনস্টেনটিন গ্যাব্রিয়েলের দিকে তাকালো এক মুহূর্ত ...... বন্দুকটা হাত বদল করে নিলো আরেক
হাতে......

তারপর প্রাক্তন ফেরেশতার মুখে কষে এক ঘুষি হাকালো। পেছনের দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে,
নিচের কংক্রিটের ওপর পড়ে গেলো গ্যাব্রিয়েল। স্তম্ভিত হয়ে গেছে, চেহারা দেখে বোঝা গেলো।

“এটাকে ব্যাথা বলে” কনস্টেনটিন বললো “অভ্যস্ত হয়ে যাও এটার সাথে !”

গ্যাব্রিয়েল কনস্টেনটিনকে অবাক করে দিয়ে হেসে উঠলো “তু মি আমাকে গুলি করতে পারতে,
জন। বদলে, তু মি আরও উচ্চতর পথ বেছে নিলে ”

কনস্টেনটিন ঘুরে, এঞ্জেলার কাছে চলে এলো।

“আমার প্ল্যান ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে ” গ্যাব্রিয়েল বলে উঠলো “দ্যাখো তু মি কত ভালো
করছ ”

এঞ্জেলা তাকিয়ে রয়েছে কনস্টেনটিনের দিকে, ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে আছে......

কনস্টেনটিন ওর ওপর ঝুঁকে, তু লে নিলো বল্লমের টু করোটা। সোজা হয়ে, এঞ্জেলার দিকে তাকিয়ে
হাসলো সে। ও অনুভব করতে পারছে, এঞ্জেলা জানে ইসাবেল নরক থেকে মুক্তি পেয়েছে।

গ্যাব্রিয়েল ওপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যেন সিলিঙ ভেদ করে, ঈশ্বরের সাথে কথা বলছে
“এতো ভালোবাসার কোন প্রতিদান পেলাম না। আর তোমার আধিপত্য কে বজায় রাখবে
এখন?”
304

কিন্তু ওর একটা উপস্থিত সমস্যা আছে – এমন কিছু না যে সে সামাল দিতে পারবে না। বিল্ডিঙের
আশেপাশের টাইম ব্যারিয়ার সরে গেছে। জেভিয়ার, অফিসার ইই এর সাথে আরও বেশ
কয়েকজন পুলিশ নিয়ে এদিকেই আসছে।

ওরা একটা ব্যাখ্যা চাইবে। আর , ওদেরকে সে সত্যি কথাটাই বলবে।

ওদের রিপোর্টে এটা থাকতেই হবে ।

কনস্টেনটিন এঞ্জেলাকে জড়িয়ে ধরে, ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

ওদের পেছনে, গ্যাব্রিয়েল কেঁ পে উঠলো, টের পাচ্ছে, ধীরে ধীরে একটা দরজা খুলে যাচ্ছে
যেন.........

আর রুমটা ভরে গেলো একটা অপার্থিব আলোতে। একটা ঝলমলে দরজা দিয়ে, এক ছায়াময়
অবয়ব প্রবেশ করলো। স্বর্গ গ্যাব্রিয়েলের কাছ থেকে উচ্চতর ফেরেশতার পদটি কেড়ে নিয়েছে।
স্বর্গের আনকোরা নতু ন অর্ধ-ফেরেশতাঃ চ্যাজ । নিজের ক্যাপটা ঠিকঠাক ভাবে মাথায় বসিয়ে
নিচ্ছে সে। গ্যাব্রিয়েলের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপভরে হাসলো সে “খবর কি , গ্যাবি ? ”

নিজের দুই হাত ঘষলো সে, এই নতু ন এসাইনমেন্টে ওর অনেক অনেক কাজ করতে হবে। আর
এটার জন্য অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে সে। “বিশেষ দ্রষ্টব্য , গ্যাবি ” গ্যাব্রিয়েলের পাশ দিয়ে হেঁটে
যেতে যেতে বললো “তোমাকে অনেক অনেক জবাবদিহি করতে হবে এখন ”

লস এঞ্জেলসের আরেকটা রাত, আরেকটা বিল্ডিঙের ছাদ। কনস্টেনটিনের বিল্ডিঙের ছাদ।


ছাদের কিনারায় দাড়িয়ে, শহরের ওপর বিছিয়ে থাকা আলোর চাদরের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
ওর পাশেই, হেলান দিয়ে রাখা আছে, হোলি শটগান।

ও অবাক হলো না যখন দেখলো এঞ্জেলা ফায়ার এস্কেপ দিয়ে উঠে এলো। ওকে এখানে দেখা
করতে বলেছে কনস্টেনটিন।

এঞ্জেলা একবার আলকাতরা লেপা, রঙের কৌটা ভর্তি ছাদের দিকে তাকালো।

“সুন্দর জায়গা !” মন্তব্য করলো সে।


305

কনস্টেনটিন ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো “তোমার জন্য একটা জিনিস আছে আমার কাছে ”

কাছে এগিয়ে এলো এঞ্জেলা, ভ্রু কপালে তু লে বললো “তোমাকে দেখে তো ফু ল দেয়ার মতো
মানুষ মনে হয় না !”

কনস্টেনটিন ওর পকেট থেকে একটা কাপড়ে মোড়ানো জিনিস বের করে , এঞ্জেলার হাতে তু লে
দিলো। এঞ্জেলা ওটা খুললো, যদিও না খুলেই বুঝতে পেরেছিলো জিনিসটা কি। ওটার ওজন,
অনুভু তি সাথে অজানা এক শিহরণ । সেটার সাথে সম্পৃক্ত সকল ধরণের কষ্ট, আর সেটা
অতিক্রম করার ভালোলাগাঃ দ্যা স্পিয়ার অব ডেস্টিনি – নিয়তির বল্লম।

“ঈশ্বরের দোহাই, এটা আমাকে দিচ্ছ কেন ?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো এঞ্জেলা।

কনস্টেনটিনের হাসিটা বিষণ্ণ দেখালো “নিয়ম ”

সে ওটা রাখতে পারবে না। এটাকে নিয়ে কোনরকম জাদুবিদ্যা চর্চা করতে পারবে না সে। আর সে
জানতো , এ ধরণের পবিত্র পুরাতাত্ত্বিক জিনিস সবসময় লোকচক্ষু র আড়ালে রাখতে হয়, সেটাই
প্রথা। এটা হলো , যে ধরণের প্রথা থেকে এটার উৎপত্তি হয়েছে, সেটার গোড়ার দিকের কথা। আর
এঞ্জেলা সেসব প্রথার অনেক কাছাকাছি বাস করে কনস্টেনটিনের চাইতে।

“এটাকে লুকিয়ে ফেলো” কনস্টেনটিন বললো বেশ হৃদয়গ্রাহী গাম্ভীর্যের সাথে “এমন কোন
জায়গায়, যেখানে এটাকে কেউ কোনদিন খুঁজে পাবে না ”

“আর আমি জানি সেটা ঠিক কোথায় --- কিভাবে ?”

“হেই। শয়তানের পুত্র তো আর আধ্যাত্মিক শক্তির জন্য আমাকে খুঁজছিল না। ” কনস্টেনটিনের
লীগ এঞ্জেলার চাইতে নিচে, এর মাধ্যমে স্বীকার করে নিলো সে।

“সব সময় আমাকে আটকে ফেলো তু মি !” হাসলো এঞ্জেলা।

কনস্টেনটিন তাকালো ওর দিকে। ভাবছে, ওর সাথে সম্পর্কে র ব্যাপারে আরও সামনে আগানো
যায় কি না। কিন্তু তার আগে , ওর নিজের কিছু কাজ সারতে হবে। আর সেসব ব্যাপারে মেয়েটা
আগ্রহী না-ও হতে পারে। কনস্টেনটিনের সাথে সম্পর্কে জড়ালে, এমন অনেক মুহূর্ত আসবে, যখন
মেয়েটা ওকে পেছনে ফেলে যেতে চাইতে পারে। আক্ষরিক অর্থেই, নরকে কাটানো মুহূর্ত গুলোর
306

কথাও যদি ভাবে মেয়েটা...... তবুও, এখন মেয়েটা ওর দিকে সেভাবে তাকাচ্ছে না, যাতে কিনা
মনে হতে পারে, কনস্টেনটিনকে পেছনে রেখে যেতে চায় সে।

“তো ?” এঞ্জেলা বলে উঠলো।

“আমাকে কিছু জিনিস পরিষ্কার করতে হবে ” বললো কনস্টেনটিন।

হোলি শটগানের দিকে তাকালো মেয়েটা , হেসে ফেলে বললো “তোমাকে আশেপাশে দেখা যাবে
তো ?”

কনস্টেনটিন হাসলো । সত্যিকারের ভারমুক্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। ওর কাছে এটা একটা আমন্ত্রণ
বলেই মনে হচ্ছে। “হ্যাঁ, ভালোই লাগবে আমার ”

এঞ্জেলা বল্লমটাকে আবার মুড়িয়ে নিলো কাপড়ে। পার্সে রেখে হেঁটে গেলো ছাদের দরজার দিকে।
নেইমান মারকাসের একটা পার্সের ভেতরে, এক মহিলা সেই বল্লমের টু করো নিয়ে যাচ্ছে, যেটা কিনা
যীশু খ্রিস্টকে বিদীর্ণ করেছিলো তাঁর মৃত্যুর সময় !

কনস্টেনটিন ফিরে তাকালো নিচের শহরের দিকে। আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগলো, যদি শহরবাসী ওর
কথা শুনতে পেত, তাহলে সে এই মুহূর্তে ওদেরকে কি বলতো। হয়তো বলতোঃ

আমি সেই লোক, যে হয়তো তোমাদের চোখে কখনও পড়িইনি। আমি দেখেছি অল্প বয়সী
ছেলেপেলে, যারা কিনা এক হাতেই তোমাদের ঘাড় মটকে দিতে পারে। আর মহিলারা তাদের
বাচ্চাদের বিক্রি করে দেয়, কেবল আগুনের সিংহাসন পাবে বলে । আমি দেখেছি, এই শহরের
রাস্তায় নরক নেমে আসতে। আমার মাথায় লস এঞ্জেলস শহরের ম্যাপ নেই, অন্তত অন্যদের কাছে
যেরকম আছে, সেরকম নয়। লস এঞ্জেলস আমার কাছে ভিন্ন এক রুপ নিয়ে ধরা দেয়। অন্ধকার
সীমান্তে, এটার শান্তি রক্ষার জন্য দেহের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে যাবো আমি। কিন্তু দুঃখের বিষয়,
তোমরা কেউ এটা নিয়ে বিন্দুমাত্রও মাথা ঘামাও না, বিন্দুমাত্রও না .........

কনস্টেনটিন ওর পকেট থেকে এক প্যাকেট সিগারেট বের করলো। সেগুলোর দিকে এক মুহূর্ত
তাকালো সে, তারপর দুমড়ে মুচড়ে ছাদ থেকে ফেলে দিলো নিচে। তারপর কোটের পকেট থেকে
বের করে আনলো, দুটো স্পেশাল শটগানের শেল। ওদের কেসিং-এ খোদাই করা আছে রহস্যময়
কিছু চিন্হ ।
307

আমাদের সবাইকে নিয়ে ঈশ্বরের আলাদা পরিকল্পনা আছে। আমাকে দুই দুইবার মারা যেতে হয়েছে,
স্রেফ সেটা বোঝার জন্য !

শটগানে শেল দুটো ভরে, পাম্প করে রেডি রাখলো সে।

ওই বইতে যেমন লেখা আছে, উনি কাজ করেন অনেক রহস্যময় পদ্ধতিতে।

সে ছাদের কিনারা দিয়ে নিচে তাকালো। যে ফাঁদ সে পেতেছে, সেটা কাজ করছে – ওটা আসছে
এদিকেই......

দাঁড়াও – সে ক্ষণিকের জন্য মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছিলো !

“জন ---”

সে এঞ্জেলার দিকে তাকালো, ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সে। ও পয়েন্ট করে দিলো “তোমার
বামে !”

একটু পেছনে এসে দাঁড়ালো কনস্টেনটিন। শটগানটা তাক করলো , এঞ্জেলাকে দরজা দিয়ে বেরিয়ে
যেতে দেখলো চোখের কোণা দিয়ে।

কিছু মানুষ এটা পছন্দ করে.........

ডানাঅলা পিশাচটা ওর দিকে ছোঁ মেরে নেমে এলো – সেই প্রথমবার ও আর এঞ্জেলাকে
আক্রমণকারী দলের মধ্যে যেটা পালিয়ে গিয়েছিলো।

ওর মাথার ওপর ঘুরছে ওটা, ঠিক ওর দিকেই নেমে আসছে ...... ওটার ঝকঝকে ধারালো দাঁত
দেখতে পেলো সে, ভয়াবহ দেখতে চোয়ালটা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে ওর ওপর কামড় বসানোর
জন্য ......

...... কিছু মানুষ পছন্দ করে না।

পিশাচটা নেমে এলো ওর দিকে, শটগানটা কেবল তাক করতে পারলো কনস্টেনটিন......

আর ও পিশাচটাকে চামড়ার ছিন্ন ভিন্ন টু করায় পরিণত করলো নিমিষে...... দুই রাউন্ড ফায়ার
করলো, নিশ্চিত হবার জন্য । তারপর ধোঁয়াগুলো উড়িয়ে দিয়ে , ফায়ার এঙ্কেপের কাছে চলে
308

এলো। ওর আরও অনেক কাজ পড়ে আছে, আজ রাতের ভেতরেই সারতে হবে সেগুলো। কিন্তু
ও ওর মন থেকে এঞ্জেলাকে সরাতে পারছে না কিছুতেই।

ও যেভাবে বললো ...... তোমাকে আশেপাশে দেখা যাবে তো ?

স্রেফ একটা কথার কথা, কিন্তু অবশ্যই – একটা আমন্ত্রণের ভঙ্গি ছিলো সেটায়।

আর, ফায়ার এস্কেপ দিয়ে নামতে নামতে , সে ভাবতে লাগলো – এঞ্জেলা, ঈশ্বর আর স্বর্গ নিয়ে।
জন কনস্টেনটিনের একটা অদ্ভু ত অনুভু তি হচ্ছিলো, একটা অপরিচিত অনুভু তি , অনেকখানি
ভেতর থেকে আসছে সেটা । কি সেটা ? এটা এমন একটা অনুভব, যেটা অনেক , অনেকদিন ধরে
সে টের পায়নি। সেটাকে চিনতে, ওর বেশ খানিকক্ষণ সময় লেগে গেলো।

অনুভূ তিটার নাম হলো – আশা ।

সমাপ্ত

You might also like